2 of 2

৬৩. এই মানুষে সেই মানুষ আছে

এই মানুষে সেই মানুষ আছে
কত মুনি ঋষি চার যুগ ধরে
তারে বেড়াচ্ছে খুঁজে
জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়
ধরতে গেলে কে হাতে পায়…

হঠাৎ থেমে গেলেন স্বামীজি। একটু গলা তুললেই হাঁপানির টান আসে। মঠবাড়ির দোতলায় গঙ্গার ধারের দক্ষিণ পূর্ব কোণে স্বামীজির নিজস্ব প্রশস্ত কক্ষ। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে চেয়ে স্বামীজি আপন মনে গান গাইছিলেন। আগে কতবার হয়েছে, কয়েকখানি গান গাইলেই মনের প্রফুল্লভাব ফিরে আসে। কিন্তু গান যেন তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছে। ঠিক মতন সুর না লাগলে তিনি নিজের ওপরেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।

বিকেলের আকাশে ঘনিয়ে আসছে বজ্রগর্ভ মেঘ। গঙ্গার ওপর এখন অনেক নৌযান। এদিককার লোকজনেরা কলকাতায় বিষয়কর্ম সেরে ঘরে ফিরছে। ঝড় ওঠার আগে সবাই পৌঁছে গেলে হয়। একখানি খেয়ার নৌকো আসছে মঠের ঘাটের দিকে। স্বামীজি উদগ্রীব হয়ে তাকালেন। নৌকোয় অন্য কয়জন যাত্রীর মাঝখানে নিবেদিতা বসে আছে না?

নিবেদিতা অনেকদিন আসেনি। আজ সে এই অবেলায় আসছে কেন? ঝড়-বাদল শুরু হয়ে গেলে সে ফিরবে কী করে, এই মঠে তো তার থাকার ব্যবস্থা নেই। নিজের ভুল বুঝতে পেরে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে আসছে?

নৌকোটি এসে পাড়ে ভিড়ল। জোর বাতাসে উত্তাল হয়ে উঠেছে নদী, যাত্রীরা নামছে একে একে, স্বামীজির আশঙ্কা হল, নৌকোটা উল্টে না যায়। সকলের তাড়াহুড়োয় তীরে এসে তরী ডোবার ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে।

না, যাত্রীদের মধ্যে নিবেদিতা নেই, স্বামীজির দৃষ্টি বিভ্রম হয়েছিল। একটা চোখ তো প্রায় গেছে, দূরের সব কিছুই এখন খানিকটা ঝাঁপসা। নিবেদিতা তবে আজও এল না। সে নতুন হুও মুগ নিয়ে মত্ত হয়ে আছে। ধুলোর ঝড় আটকাবার জন্য স্বামীজি জানলা বন্ধ করে দিলেন।

একদিকে একটা খাওয়ার টেবিল। স্বামীজির খাওয়া-দাওয়া এখন খুবই নিয়ন্ত্রিত, তাই অন্য সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সাধারণ ভোজনাগারে আর প্রায়ই খেতে বসেন না, ওখানে ওরা মশলা দেওয়া তরকারি ও মাছ খায়, তিনি নিজের ঘরেই যৎসামান্য আহার সেরে নেন। আর একদিকে তাঁর লেখার টেবিল, কয়েকটি চেয়ার, আলমারি, বিছানা, জপের আসন, একটি তানপুরা ও মৃদঙ্গ সারা ঘরে চক্ষু বুলিয়ে এই সবই তাঁর হঠাৎ যেন অলীক মনে হল। যে কোনও নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। চক্ষু বুজলে আর কিছুই থাকে না।

নিবেদিতা কী নিয়ে মেতে আছেন, তা তিনি প্রথম প্রথম জানাতে না চাইলেও স্বামীজি ঠিকই জেনে গেছেন। তাঁর কাছেও কিছু কিছু যুবক আসে, যারা ঠিক আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। হঠাৎ সম্প্রতি বেশ কিছু যুবকের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনার ভাব দেখা যাচ্ছে। বুয়র যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের প্রাথমিক ধাক্কা খাওয়ার পরেই যেন এটা ঘটছে। এই সব যুবকেরা নিবেদিতার কাছেও যাতায়াত করে। নিবেদিতা আর জাপানি পণ্ডিত ওকাকুরা মিলে এদের কানে স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য উস্কানি দিচ্ছে। ওদের ধারণা, এক বছরের মধ্যে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি সম্ভব! ওরা দুজনে জো ম্যাকলাউডকে দলে টেনেছে, টাকা সাহায্য নিচ্ছে তার কাছ থেকে। ওলি বুলের কাছেও অর্থ সাহায্যের আবেদন করেছে কিনা কে জানে! ওঁরা দুজনেই ছিলেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সবচেয়ে বড় শুভার্থী!

স্বাধীনতা যেন ছেলের হাতের মোয়া! স্বামীজি নিজে পরাধীনতার অপমানের কথা অনেকবার বলেননি? এমনকী তিনি বোমা বানাবার কথাও বলেছেন। আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত, দেশের জন্য ত্যাগ, এমনকী প্রাণদানের মতন সর্বোচ্চ ত্যাগের কথা তাঁর আগে কে বলেছে? হা, স্বাধীনতার জন্য দেশকে অবশ্যই প্রস্তুত হতে হবে, কিন্তু সেই প্রস্তুতির জন্য নেতৃত্ব দেবে এক জাপানি আর এক আইরিশ রমণী, সাহায্য করবে দুই আমেরিকান? এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে! এ দেশে আর মানুষ নেই?

নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর এই নিয়ে মন কষাকষি, এমনকী বিবাদ পর্যন্ত হয়ে গেছে।

ওকাকুরাকে স্বামীজি বেশ পছন্দই করেছিলেন প্রথম দিকে। না হলে কি আর তাঁর সঙ্গে এই অসুস্থ শরীর নিয়েও বোধগয়া যেতেন? লোকটি যথার্থ পণ্ডিত ও অনেক বিষয়ে গুণী, শিল্প সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান আছে। এশিয়ার মানুষদের একাত্মতা এবং মর্যাদাবোধ–এই বিষয়ে এই মানুষটির মতন আগে কেউ বলেননি। বাংলার এক কবি হেম বাঁড়জ্যে জাপান সম্পর্কে কী খারাপ কথাই লিখেছেন, তা জানতে পারলে ওকাকুরা নিশ্চিত দুঃখ ও আঘাত পাবেন। স্বাধীন ও উন্নত দেশ জাপান, সেখানকার মানুষ একই সঙ্গে দুঃসাহসী ও শিল্পপ্রিয়, হেমচন্দ্র জাপান সম্পর্কে কিছু না জেনেই অমন কথা লিখেছেন। এমন অজ্ঞতা কবিদের সাজে না।

কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই ওকাকুরা সম্পর্কে মনোভাব বদলে যাচ্ছে স্বামীজির। লোকটির যতই গুণ থাক, ওঁর মধ্যে ত্যাগের লেশমাত্র নেই। বরং অধিকমাত্রায় ভোগবাদী। ত্যাগ ছাড়া কি কোনও মহৎ কাজ সম্ভব হতে পারে? ত্যাগ ত্যাগ, এখন শুধু সর্বস্ব ত্যাগ চাই। কংগ্রেসের এক সর্বভারতীয় নেতা কিছুদিন আগে স্বামীজির প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত করে একটা খোঁচা মেরে বলেছিলেন, বিবাহ না করে সন্ন্যাসীর জীবন বরণ করাটাকেই কেউ কেউ আদর্শ পথ বলেন কেন? প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিরা তো সকলেই বিবাহ করতেন। নারীদের তাঁরা জীবন থেকে বাদ দেননি, সাধনপথের অন্তরায়ও মনে করেননি। কথাটা শুনে স্বামীজির হাড়-পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল। প্রাচীন ভারতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা হয়? তোরা বিয়ে করে এক গুষ্ঠি কাচ্চাবাচ্চার জন্ম দিবি, সংসার চিন্তা অর্থ চিন্তা, তারপর দেশ সেবা? যত্ত সব অপেগণ্ডের দল!

ওকাকুরা এমনিতে স্বল্পভাষী, কিন্তু স্ত্রীলোকদের কাছে বেশ বাপটু। নিবেদিতার ওপর যেন কুহক বিস্তার করেছেন। নিবেদিতা এখন আর অন্য কোনও কথাই শুনতে বা বুঝতে চায় না।

মাস দেড়েক আগে নিবেদিতা দেখা করতে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মায়াবতী যাওয়ার জন্য স্বামীজির কাছে অনুমতি চাওয়া। হঠাৎ মায়াবতী আশ্রম পরিদর্শন করার জন্য নিবেদিতার মন উথলে উঠল কেন? সঙ্গে আর কে কে যাচ্ছে? হ্যাঁ ঠিক, ওকাকুরা অন্যতম সঙ্গী। স্বামীজি প্রশ্ন করেছিলেন, তোমার স্কুলের কাজ ভাল করে শুরু হল না, এখনই তোমাকে অতদূরে যেতে হবে। কেন? ওকাকুরাও কিছুদিন আগে উত্তর ভারত ভ্রমণ করে এলেন।

নিবেদিতা স্কুলের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, আমরা যে কাজ শুরু করেছি, তার কিছু গোপন শলাপরামর্শের জন্য একটা কোনও নিভৃত স্থানে যাওয়া দরকার।

স্বামীজি বলেছিলেন, তুমি কী কাজ শুরু করেছ, তা আমি জানি। ও রকম মরীচিকার পেছনে ছোটার চেষ্টা ছাড়ো, মার্গট। নারীদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারই তোমার আসল কাজ।

কথাটা মনঃপূত হয়নি নিবেদিতার। গুরুর কথায় তিনি প্রতিবাদ করেন না, মুখে মুখে তর্কও করেন না, তবু চক্ষু নত করে বলেছিলেন, আমার কাছে এখন স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করাই আরও বড় কাজ। প্রধান কাজ। স্বাধীন না-হলে এ দেশের মানুষের পক্ষে কোনও উন্নতিই সম্ভব নয়।

স্বামীজি বলেছিলেন, স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু তার জন্য দেশকে আগে তৈরি হতে হবে। এই জাত-পাত, ঘূত্মার্গ, কুসংস্কার আর অশিক্ষায় ভরা দেশ, এখানে এমনি এমনি স্বাধীনতা আসতে পারে?

নিবেদিতা মৃদু স্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, এই সব ভেবে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে তো কোনওদিনই স্বাধীনতা আসবে না। এখনই প্রকৃষ্ট সময়। ইংরেজকে আচমকা আঘাত দিয়ে অল্পদিনের মধ্যে ধরাশায়ী করা যেতে পারে।

স্বামীজি বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলেছিলেন, বাতুলতা! ও সব উদ্ভট চিন্তা ছাড়ো তো! ওকাকুরার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করো। ও লোকটার দ্বারা কিছু হবে না।

নিবেদিতা যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। স্বামীজি ওকাকুরার মতন মানুষের সম্পর্কে এইভাবে কথা বলছেন? এই ওকাকুরাকেই স্বামীজি একদিন নিজের ভাই বলে আলিঙ্গন করেছিলেন না? অন্যদের কাছে এঁর কত গুণপনার উল্লেখ করেছেন। আর আজ এই কথা বললেন! তবে কি স্বামীজির মনে ঈর্ষা জন্মেছে? না না, তা কেমন করে হবে, তাঁর গুরুর মতন মহাপুরুষ নিশ্চয়ই ঈর্ষা-বিদ্বেষের মতন সাধারণ মানসিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে।

তবু, শারীরিক দুর্বলতার কারণেই হয়তো, সম্প্রতি স্বামীজি মাঝে মাঝে এমন কথা বলেন, যার মধ্যে ঠিক সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না। কখনও কখনও মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। তাঁর মেজাজের ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মতামতের পরিবর্তন ঘটে। জগদীশ বোস সম্পর্কেও হঠাৎ একদিন এ রকম কথা বলে তিনি নিবেদিতাকে হতবাক করেছিলেন। যে-জগদীশচন্দ্রের প্যারিসে বিজ্ঞান কংগ্রেসে সাফল্য দেখে স্বামীজি প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, যাঁকে ভারতের সুসন্তান বলে তিনি গর্ব বোধ করেছিলেন, সেই জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে তিনি এমন কথা বলেছিলেন, যা মনে হতে পারে ঈষা-সঞ্জাত। সেদিন নিবেদিতা অবশ্য জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে একটু বেশি কথাই বলছিলেন। রামায়ণে আছে, ঋদ্ধিমান পুরুষ কোনও নারীর মুখে অপর পুরুষের বেশি প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। এমনকী স্বয়ং রাম তাঁর নিষ্কলঙ্ক ভ্রাতা ভরতের প্রশংসাও বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেননি সীতার মুখে। স্বামীজিও নিবেদিতার ওপর হঠাৎ ফেটে পড়ে বলেছিলেন, ও লোকটা তত গৃহী। গৃহীর মুক্তি নেই। যদি তোমার সঙ্গে থাকে, এ কথা ওকে জানিয়ে দিয়ো। তাকে বোলো, ত্যাগ চাই, ত্যাগ। যদি বিরাট কোনও ত্যাগ না করতে পারে, তা হলে কখনও বড় ধরনের শক্তি আয়ত্ত করতে পারবে না। বিয়ে জিনিসটা জঘন্য। যারা বিয়ে করে ফেলে, তাদের দ্বারা আর কী হবে? তুমি জগদীশকে নিয়ে অত আদিখ্যেতা করো কেন?

ফ্রান্সে সেই দিনটিতে নিবেদিতা স্বামীজির এত রাগের কারণ বুঝতে পারেননি। বিবাহিত ব্যক্তি মাত্রেরই ওপর তাঁর রাগ। তাহলে কি জগতে আর কেউ বিয়ে করবে না? জগদীশচন্দ্রের শিক্ষিতা স্ত্রী তো স্বামীকে সব কাজে অনেক সাহায্য করেন। স্বামীজি বড়ই উগ্র ও অযৌক্তিক হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। জগদীশচন্দ্র যদিও স্বামীজি সম্পর্কে খুবই শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু তিনি ব্রাহ্ম, তিনি কালীপূজা এবং গুরুবাদের বিরোধী, সেটাই কি রাগের কারণ? কিংবা বিবাহিত মানুষদের সম্পর্কে স্বামীজির এত উগ্র ক্রোধের কারণ কি তাঁর নিজেরই অবচেতনের কোনও অপরাধবোধ?

নিবেদিতাকে নিঃশব্দ দেখে স্বামীজি আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি যে স্বাধীনতার লড়াই শুরু করতে চাও, ইংরেজরা কি কচি খোকা? পৃথিবীতে তারা সবচেয়ে শক্তিশালী জাত। শুধু বক্তিমে দিয়ে তাদের ঘায়েল করা যাবে না। বোমা চাই, কামানবন্দুক, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, প্রচুর টাকাকড়ি, এ সব কোথায় পাবে, কে দেবে?

নিবেদিতা বলেছিলেন, সে সবের তো ব্যবস্থা হয়ে গেছে। জাপান সাহায্য করবে। কোরিয়াও প্রস্তুত আছে। এশিয়ার অন্য সব দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, এ দেশের যুব সমাজকে এখন সঙ্ঘবদ্ধ করতে পারলেই হয়।

স্বামীজি অট্টহাস্য করে বললেন, এশিয়ার সব দেশ সাহায্যের জন্য তৈরি? এটা কি স্বপ্ন, না উত্ত কল্পনা, না কি গাঁজাখুরি গপ্পি? অ্যাঁ?

নিবেদিতা ব্যথা পেলেন। ওকাকুরা সম্পর্কে এ রকম অশ্রদ্ধেয় উক্তি তিনি মেনে নিতে পারেন না। তিনি কি মিথ্যে কথা বলবেন!

নিবেদিতা বললেন, নোগু নিজে আমাকে এ সব কথা বলেছে।

স্বামীজি ভ্রূ কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন, নোগু? নোগুটা আবার কে?

কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নিবেদিতা বললেন, নোগু ওকাকুরার ডাকনাম। আমি অনেক সময় ওকে এই নামে ডাকি।

এবার ক্রোধে স্বামীজির চক্ষু বিস্ফারিত হল। তিনি বললেন, ও, এতদূর? তুমি জগদীশ বোসকেও মাঝে মাঝে খোকা, খোকা বলল। অথচ সে তোমার চেয়ে বয়েসে বড়! তুমি ব্রিটিশ, তুমি শ্বেতাঙ্গিনী, এই পরিচয় কিছুতে ভুলতে পারো না, না?তোমরা নিজেদের সব সময় বড় ভাবো। প্রাচ্য দেশের দু-একটা উঠতি গুণীদের তোমরা খানিকটা প্রশ্রয় দিয়ে বাচ্চাদের মতন পিঠ চাপড়াও, তাই না? নইলে ওকাকুরার মতন একজন বিশিষ্ট মানুষকে তুমি ডাকনাম ধরে ডাকো কোন সাহসে? কদিন মাত্র তোমাদের পরিচয়! কোনও ইংরেজকে এ দেশের কেউ হ্যারি-ল্যারি-গ্যারি বলে ডাকতে পারে?

নিবেদিতার বুকে যেন শেল বিদ্ধ হল। যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেল মুখমণ্ডল। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, এ আপনি কী বলছেন? আমি শ্বেতাঙ্গিনী, বিদেশিনী? আমি তো ভারতেরই কন্যা, আমার আর সব পরিচয় মুছে গেছে। আপনিই তো আমাকে এ দেশের কাজের জন্য নিবেদন করেছেন, তাই আমি নিবেদিতা। [ স্বামীজি বললেন, না। তোমাকে আমি দেশ নামে কোনও ভাবমূর্তির কাছে নিবেদন করিনি। তোমাকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা দিয়ে নিবেদন করেছি ভগবানের চরণে, আমার গুরুর কাজে। তোমাকে মানবসেবায় বুদ্ধের পথ অনুসরণ করতে বলেছিলাম। তুমি শ্রীশ্রী মায়ের কন্যা!

নিবেদিতা বললেন, সে পথ থেকে তো আমি এক মুহূর্তের জন্যও সরে যাইনি। দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করা কি মানবসেবা নয়?

স্বামীজি বললেন, শোনো মার্গট, এ বার তোমাকে স্পষ্ট কথা জানাবার সময় এসেছে। আমরা সন্ন্যাসী, রাজনীতি আমাদের পথ নয়। তোমাকে আমি এ দেশে এনেছি, সকলেই জানে তুমি শ্রী রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত। তুমি এখন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে সে দায় আমাদের ওপরও অশাবে। তোমাকে এ বার তোমার পথ বেছে নিতে হবে। তুমি মাঝে মাঝে এক একটা হুজুগ নিয়ে মেতে ওঠো। প্রথমে তোমার ছিল ব্রাহ্ম-ঝোঁক, ওদের সঙ্গে খুব মেশামেশি করতে। তারপর হল ঠাকুরবাড়ির ঝোঁক। ওখানে নিয়মিত যাতায়াত, ওদের সঙ্গে গলাগলি। এখন হয়েছে এই ওকাকুরা-ঝোঁক। আশা করি এটাও তোমার কেটে যাবে, তুমি স্থিত হবে।

নিবেদিতা নীরব রইলেন। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কি নিছক হুজুগ বা ঝোঁক? শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অনুগামী হলে কি অন্যদের সঙ্গে মেশা যাবে না? ব্রাহ্মদের মতবাদ জানা দোষের কেন হবে? ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতিবান পুরুষ-নারীরা কেউ শিল্পী, কেউ কবি, কেউ দার্শনিক। আর কোন পরিবারের মহিলারা নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে পারেন? সরলা ঘোষালের মতন যুবতী সমগ্র বাংলায় আর একটিও আছে কি? এঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করা কি অপরাধ? নিবেদিতার উদারনৈতিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় এটা ঠিক মেলাতে পারেন না। যদিও গুরুর প্রতি অচলা ভক্তি ও ভালবাসা তাঁর এক চুলও টলেনি। গুরুর কোনও নির্দেশ লঙঘন করার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন না। কিন্তু আইরিশ রক্ত রয়েছে তাঁর শরীরে, স্বাধীনতার স্পৃহা তাঁর জন্মগত, বিপ্লবী ক্রোপটকিনের চিন্তাধারায় তিনি উদ্বদ্ধ, ওকাকুরা বিপ্লবের প্রস্তুতির কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংগ্রাম শুরু করার এখনই তো সুবর্ণ সুযোগ। এখন তিনি এ পথ থেকে সরে যাবেন কী করে? ইস, এ সময় যদি স্বামীজি দেশের বাইরে থাকতেন, তা হলে কী ভালই হত, নিবেদিতাকে এই সঙ্কটে পড়তে হত না। স্বামীজি সংগ্রামে অংশ নেবেন না, এখন ভারতে তাঁর উপস্থিতিই দেশসেবার পরিপন্থী।

নিবেদিতার কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে স্বামীজি আবার গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি তোমার পথ বেছে নাও, আজই মনস্থির করো।

স্বামীজি নির্দেশ দেননি, পথ বেছে নেবার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তা হলে তো নিবেদিতার আর কোনও দ্বিধা রইল না।

নীরবতাই উত্তর ধরে নিয়ে স্বামীজি বললেন, যদি রাজনীতির হুজুগ নিয়েই মেতে থাকতে চাও, তা হলে মঠের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে। এখানে তোমার যাওয়া-আসা আর ঠিক হবে না। মঠের ওপর পুলিশের নজর পড়ক এটা আমরা কেউ চাই না!

নিবেদিতা গুরুকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন। তারপর সত্যি সত্যি ওকাকুরার সঙ্গে চলে গেলেন হিমালয়ে।

স্বামীজি পরে অনুভব করেছিলেন, তিনি প্রিয় শিষ্যার ওপর বেশি কঠোর হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। নিবেদিতার স্বাধীনতার লড়াই এখনও পর্যন্ত শুধু আলোচনা পর্বেই রয়েছে, ওকাকুরা আর নিবোদতা মিলে কিছু লোকজনের সঙ্গে মাঝে মাঝে মিটিং করে, সরলার দল ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বোধহয়, এখনও এমন কিছু ঘটেনি, যাতে নিবেদিতার এই মঠে আসা-যাওয়া বন্ধ করতে হবে। মঠের সন্ন্যাসীদের মধ্যে নিবেদিতাকে নিয়ে যে একটা চাপা গুঞ্জন চলছে, তা স্বামীজি টের পান। নিবেদিতা যে এখন ধর্মচর্চার বদলে রাজনীতিচচইি বেশি করছেন, তা এখানকার অনেকেই জেনে গেছে। স্বামী ব্রহ্মানন্দও একদিন অনুযোগ করছিলেন এ বিষয়ে। তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বামীজি।

নিবেদিতা আর এখানে আসবে না? মায়াবতী থেকে ফিরে এসেছেন নিবেদিতা, স্বামীজি সে খবর পেয়েছেন। ফেরার পর একবার দেখা করতেও এল না? স্বামীজির মেজাজ মাঝে মাঝে খুব গরম হয়ে যায় সবাই জানে, আগেও তো কয়েকবার নিবেদিতাকে বকাবকি করেছেন। এবার তার অভিমান এত তীব্র? নিবেদিতা বাগবাজারের বাড়িতেই রয়েছেন, স্বামীজি হঠাৎ একদিন সেখানে উপস্থিত হলে তাঁর মুখের অবস্থা কী রকম হবে? কিংবা বলরাম বসুর বাড়িতে গিয়ে স্বামীজি ওঁকে ডেকে পাঠাতে পারেন। কিন্তু শরীর যে আর বয় না, গঙ্গা পার হতে আর ইচ্ছে করে না। এক-একদিন দোতলা থেকে আর নীচেই নামেন না সারাদিন। না ডাকলে নিজে থেকে আর আসবে না নিবেদিতা!

শরৎ নামে সেই গৃহ শিষ্যটি প্রতিদিনই দেখা করতে আসে কলকাতা থেকে। সঙ্গে কিছু না কিছু আনে। আগে কলকাতার বিখ্যাত দোকানগুলির মিষ্টি নিয়ে আসত। এখন স্বামীজির একদানা চিনি খাওয়াও সম্পূর্ণ বারণ। মিষ্টি খেতে তিনি কী ভালই বাসতেন। কতদিন আইসক্রিম খাওয়া হয়নি। আর কি খাওয়া হবে এ জীবনে? শরৎ এখন নানারকম ফলমূল আনে। র শরৎ দ্বারের কাছে এসে দেখল, সন্ধে হয়ে এলেও ঘরে বাতি জ্বালা হয়নি, প্রায়ান্ধকারে স্বামীজি খাটের ওপর চুপ করে বসে আছেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। শরৎ নিঃশব্দে ভেতরে এসে বসে রইল।

একটু পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বামীজি বললেন, এসেছিস! আজ শরীরটা বড় বেজুত হয়েছে। রে! পা ফুলে গেছে, হাঁটতে পারছি না ভাল করে, ঘরের বাইরে যাইনি।

শরৎ জিজ্ঞেস করল, একটু পা টিপে দেব?

স্বামীজি বললেন, দে। একটু তামাক সেজে দে, অনেকক্ষণ খাইনি।

স্বামাজি বিছানায় বসলেন, শিষ্য তাঁর পদসেবা করতে লাগল। স্বামীজি তাঁর নানান প্রশ্ন ও কৌতূহলের উত্তর দেন, আবার তাঁর কাছ থেকে কলকাতার অনেক খবরও শোনেন।

একটু পরে স্বামীজি মেঝেতে নেমে আসতেই শরৎ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। স্বামীজি বললেন, দ্যাখ, সারাজীবন কত কষ্ট করেছি, গাছ তলায় শুয়ে রাত কাটিয়েছি। এখন আমেরিকানরা আমার আরামের জন্য খাট-বিছানা-গদি করে দিয়েছে। এ রকম বিছানায় শুলে এক একসময় আমার গায়ে ব্যথা হয়, শরীর তো জলে ভরে গেছে। কিছুক্ষণ মেঝেতে শুলেই বরং আরাম হয়। মাঝে মাঝে ভাবি কী জানিস, এ সব মঠ ফঠ করার বদলে বোধহয় আমাদের গাছতলায় ফিরে যাওয়াই উচিত ছিল।

মেঝেতে শুয়ে চক্ষু বুজে বললেন, লোকের গুলতোন দেখে আর কী হবে? আজ তুই আমার কাছে থাক।

শরৎ ধন্য হয়ে বলল, আপনার সঙ্গে থাকলে ব্রহ্মজ্ঞান লাভেও আমার ইচ্ছে হয় না।

স্বামীজি আস্তে আস্তে বললেন, সর্বদা মনে রাখিস, ত্যাগই হচ্ছে মূলমন্ত্র। এ মন্ত্রে দীক্ষিত না। হলে ব্ৰহ্মাদিরও মুক্তির উপায় নেই।

একটু পরে স্বামীজি ঘুমিয়ে পড়লেন।

জেগে উঠলেন রাত চারটের সময়। ব্যস্ত হয়ে শরৎকে ঠেলে তুলে বললেন, ওঠ, ওঠ, জপে বসতে হবে না? সবাইকে গিয়ে জাগা। দেরি হয়ে গেছে। একটা ঘণ্টা নিয়ে যা, ওটা বাজিয়ে সবাইকে ডাকবি। ব্রহ্মানন্দটা বেশি ঘুমকাতুরে, ওর কানের কাছে জোরে জোরে ঘণ্টা বাজাবি।

তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, পাখি ডাকেনি। গ্রীষ্মকালে শেষ রাত্তিরেই ভাল ঘুম হয়, হঠাৎ ঘণ্টাধ্বনি শুনে অনেকে কাঁচা ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠল। ব্রহ্মানন্দ কোনও বিপদের আশঙ্কায় ত্রস্তে উঠে বসলেন, তারপর শরৎকে দেখে বললেন, আ মোলো যা, এ বাঙালের জ্বালায় যে মঠে থাকাই দায় হল! তোরা কি রাত পোহাতেও দিবি না!

প্রতিদিন প্রত্যুষে ঠাকুর ঘরে রামকৃষ্ণের ছবির সামনে জপ-ধ্যান করা সমস্ত মঠবাসীর জন্য বাধ্যতামূলক। স্বামীজি এক একদিন সকলের সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেন। কোনওদিন নীচে নামতে না পারলে তিনি নিজের ঘরেই একাকী ধ্যানে বসেন।

আজ কিছুক্ষণ ধ্যান করার পর স্বামীজি আস্তে আস্তে ঠাকুর ঘরে নেমে এলেন। ঘর প্রায় খালি। অনেকেই আবার বিছানায় ফিরে গেছে, ধ্যান করছে মাত্র দুজন। সে দৃশ্য দেখা মাত্র স্বামীজির মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। তিনি চিৎকার করে বললেন, শরৎ, বাকিরা কোথায় গেল? ডাক, সবাইকে এক্ষুনি আমার সামনে আসতে বল।

সেখানে একটা বিচার সভা বসিয়ে দিলেন স্বামীজি। সন্ন্যাসীরা একে একে চোখ মুছতে মুছতে আসছে, স্বামীজি তাদের কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করছেন। কেউ কেউ অপরাধীর মতন চুপ করে রইল, কেউ কেউ অজুহাত খোঁজার জন্য বলল, পেট ব্যথা করছিল, কাল একটু জ্বর জ্বর হয়েছিল। স্বামীজি প্রচণ্ড বকাবকি করতে লাগলেন সবাইকে। তারপর বিচারের রায় দিলেন, যা, আজ তোরা কেউ মঠে খেতে পাবি না। ভিক্ষে করতে বেরো। ভিক্ষে করে যা পাবি, তাই খেয়ে থাকবি।

ব্রহ্মানন্দ দেখলেন, অসুস্থ শরীরে এ রকম রাগারাগি করা স্বামীজির পক্ষে ভাল নয়। তিনি কাছে এসে মৃদু কণ্ঠে বললেন, ভাই নরেন, তুই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন, শান্ত হ। বাইরে এখনও ঘুটঘুটি অন্ধকার, এর মধ্যে বেচারারা উঠবে কী করে? সবার ভো আর তোর মতন স্বল্প ঘুম নয়!– স্বামীজির মেজাজ এমনই তিরিক্ষি হয়ে আছে যে বাল্যবন্ধুকেও রেয়াত করলেন না। চোখ গরম করে বললেন, তুই খুব সদার হয়েছিস, তাই না? যা, আজ তোরও মঠে খাওয়া বন্ধ। তোকেও মাধুকরী করে খেতে হবে।

স্বামীজির হুকুম কে অগ্রাহ্য করবে? এ মঠের পরিচালনা ভার তিনি নিজেই ছেড়ে দিয়েছেন, তবু তিনিই সর্বেসর্বা। সবাই আড়ষ্ট মুখে বেরিয়ে যেতে লাগল। স্বামীজি আবার হেঁকে বললেন, তা বলে কোনও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যাওয়া চলবে না! অচেনা মানুষের কাছে ভিখ মাঙবি, মনে থাকে যেন!

তারপর স্বামীজি সারাদিন গ্রন্থ পাঠে ডুবে রইলেন। বিকেলের দিকে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হল। জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ খেয়া নৌকোগুলি দেখলেন! নিবেদিতা আজও এলেন না।

আজ মঠের সন্ন্যাসীদের তিনি কঠিন শাস্তি দিয়েছেন। যদিও সন্ন্যাসীদের পক্ষে মাধুকরী নতুন কিছু নয়। বরানগরে থাকার সময় তাঁদের অনেকদিনই ভিক্ষান্ন খেতে হয়েছে। কিন্তু এখন তো সেই ছেঁড়া কাঁথায় পাঁচজন শুয়ে থাকার দিন আর নেই। নতুন নতুন সন্ন্যাসীরা কি আর লোকের কাছে মুখ ফুটে ভিক্ষে চাইতে পারবে? আহা, ছেলেগুলিন যদি আজ না খেয়ে থাকে—

স্বামীজি নীচে নেমে এলেন। একটা ঘরে প্রচুর হাসাহাসি হচ্ছে, স্বামীজি সেখানে উপস্থিত হতেই ব্রহ্মানন্দ বললেন, আজ বিবেকানন্দ স্বামী আমাদের কী উপকারটাই না করলেন সবাই বল! ভাই নরেন, তোর দয়ায় আজ মঠের রাঁধুনির একঘেয়ে রান্না খেতে হল না, চমৎকার স্বাদ বদল হল!

স্বামীজি কৌতূহলী হয়ে বললেন, কী পেলি রে, কী পেলি?

ব্ৰহ্মানন্দ বললেন, আমাদের রাঁধতেও হয়নি। এই তো মাইল তিনেক দুরে সালকের মোড়ের কাছে এক মাড়োয়ারির বাড়ি। তারা ডেকে যত্ন করে কত কী ভাল ভাল জিনিস খাওয়াল।

স্বামীজি সহাস্যে বললেন, তাই নাকি? তা হলে তো আমারও যাওয়া উচিত ছিল, কী কী ছিল

ব্ৰহ্মানন্দের সঙ্গে যে দলটি গিয়েছিল, তারা সবাই উত্তম সুখাদ্য পেয়েছে। বাকি সকলের এমন সৌভাগ্য হয়নি। কেউ কেউ চাল ডাল পেয়ে ফুটিয়ে খিচুড়ি বানিয়েছে, কেউ কেউ গৃহস্থদের কাছ থেকে পেয়েছে মুখঝামটা। যারা কিছু পায়নি, তাদের সঙ্গেও হাসাহাসি করতে লাগলেন স্বামীজি। তারপর বললেন, যা দ্যাখ ভাঁড়ারে চিড়ে-মুড়ি কী আছে, তাই-ই এখন খেয়ে আয়!

তাঁর শেষ রাত্রের উগ্র মূর্তির সঙ্গে এখনকার প্রসন্নতার কত তফাত।

গল্প করতে করতে স্বামীজি এক সময় ব্রহ্মানন্দকে বললেন, হ্যাঁ রে রাখাল, এই অমাবস্যায় মঠে কালীপুজো করলে হয় না?

ব্রহ্মানন্দ বললেন, তা কী করে হবে, আগে বলিসনি। অমাবস্যা তো এসে গেল।

স্বামীজি তবু উৎসাহের সঙ্গে বললেন, তাতে কী! এই ক দিনেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে! লাগিয়ে দে। খুব গান হবে সে দিন।

অন্য সকলেই রাজি। এরপর কদিন কালীপুজোর প্রস্তুতি চলতে লাগল।

মঠে কালীপূজা হবে, আর নিবেদিতা আসবেন না? তাঁকে খবরও দেওয়া হবে না? দুগা পুজোর সময় তিনি এ-দেশে ছিলেন না। নাঃ, মেয়েটার এবার মান ভাঙাতেই হবে। শরৎকে স্বামীজি বললেন, আজ ফেরার পথে নিবেদিতাকে একবার খবর দিয়ে যাস তো যে আমি তাকে মঠে ডেকেছি।

একটু পরেই তার মনে হল, শুধু মুখে খবর পাঠাবার বদলে চিঠি লিখে দিলে ভাল হত না? জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলেন, শরৎ নৌকোয় উঠতে যাচ্ছে। তিনি হাঁক দিলেন, শরৎ, শরৎ, একটু দাঁড়া, উঠিসনি–

খালি গায়ে ছিলেন, শুধু একটা চাদর জড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে এলেন স্বামীজি। বাইরে এসে বললেন, চল, আমিও তোর সঙ্গে ওপারে যাব।

শরৎ বিস্মিত হয়ে বলল, সে কী! আপনার শরীর ভাল নেই, সন্ধে হয়ে এসেছে, এখন কেন যাবেন? ফিরবেন কখন?

স্বামীজি হাত তুলে বললেন, ওসব তোকে চিন্তা করতে হবে না!

বাগবাজারের ঘাটে নেমে বললেন, তোকে আর আসতে হবে না। তুই বাড়ি যা।

ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া না করে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন স্বামীজি। বোসপাড়া লেন বেশি দূর নয়।

সবে মাত্র দিনের তৃতীয়বার স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেশবিন্যাস করছেন নিবেদিতা, দরজায় একটা শব্দ শুনে চমকে তাকালেন। পরিচারিকাটি অসুস্থ, নীচে কারুর সাড়া না পেয়ে স্বামীজি একেবারে ওপরে উঠে এসেছেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারলেন না নিবেদিতা, হাতে যেভাবে চিরুনিটা ধরা ছিল, সেইভাবেই হাত থেমে গেল, তিনি যেন চিত্রার্পিত হয়ে রইলেন। তারপর ঘোর ভেঙে অস্ফুট স্বরে বললেন, আমার প্রভু!

স্বামীজি সহাস্যে বললেন, কেমন আছ, মার্গট?

যেন ঠিক আগের মতন, মাঝখানে কিছই ঘটেনি।

নিবেদিতা একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, বসুন।

স্বামীজি বললেন, না, বেশিক্ষণ থাকব না। মঠে ফিরতে হবে। তুমি কেমন আছ, দেখতে এলাম।

নিবেদিতা বললেন, আপনি আমাকে বিশুদ্ধ আনন্দের সন্ধান দিয়েছেন। আমি আর কখনও খারাপ থাকি না।

সত্যিই আর বেশিক্ষণ রইলেন না স্বামীজি। হঠাৎ হাঁপানির টান এসেছে, সেটা তিনি নিবেদিতাকে জানাতে চান না। নিবেদিতা বিশেষ কথা বলতে পারলেন না, শুধু স্থির দৃষ্টিতে স্বামীজিকে দেখছেন।

যাবার আগে স্বামীজি বললেন, শিগগির একদিন মঠে এসো।

কয়েকদিন পরই ভোরবেলা নিবেদিতা এসে উপস্থিত। গুরুর পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। নিবেদিতা পরেছেন কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত লুটোনো সাদা রঙের গাউন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।

স্বামীজি সকৌতুকে বললেন, না ডাকলে বুঝি তুমি আর আসতে না?

নিবেদিতা বললেন, মায়াবতী থেকে ফিরেই আমি এখানে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তখন জানতে পারলাম আপনি নদিয়ার কোন গ্রামে গেছেন, কবে ফিরবেন ঠিক নেই।

স্বামীজি বললেন, হ্যাঁ গিয়েছিলাম বটে বড় জাগুলিয়ায়, আমার এক শিষ্যা মৃণালিনী বসু খুব করে ডেকেছিল। ভেবেছিলাম, গ্রামে গিয়ে থাকলে শরীর সারবে, এক সপ্তাহ রইলাম, বিশেষ কিছু সুবিধে হল না।

নিবেদিতা বললেন, আপনি সর্বক্ষণ আমার হৃদয়ে রয়েছেন। অনেক দূরে থাকলেও আপনাকে খুব কাছে অনুভব করি।

স্বামীজি বললেন, তুমি তো প্রাতরাশ খেয়ে আসোনি, দাঁড়াও, তোমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি।

নিবেদিতা উঠে গিয়ে সাহায্য করতে গেলে স্বামীজি আবার তাঁকে বললেন, তুমি চুপটি করে বসো, আমি নিজের হাতে তোয়ের করব।

স্বামীজি তাঁদের মতভেদ, ওকাকুরা প্রসঙ্গ একেবারেই উত্থাপন করলেন না। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে খাদ্য প্রস্তুত করতে লাগলেন। কাঁঠালের বিচি সেদ্ধ, আলুসেদ্ধ। দু চামচ সাদা ভাত আর পাথরের গেলাসে বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা করা দুধ।

টেবিলের ওপর একটি পিরিচে সে সব সাজিয়ে দিলেন। নিবেদিতা জিজ্ঞেস করলেন, এ কী, আপনি আমার সঙ্গে খেতে বসবেন না?

স্বামীজি বললেন, আজ যে একাদশী, আমার উপোস। আজ মঠে নিরামিষ, তাই তোমাকে আর কিছু দিতে পারলাম না।

নিবেদিতা বললেন, আপনি নিজের হাতে যা দেবেন, তা-ই অমৃত। নিরামিষ সাত্ত্বিক আহার আমার খুব পছন্দ।

যেন মাঝখানে কিছুই হয়নি, আগেরই মতন সব কিছু স্বামীজি রঙ্গ রসিকতা করতে লাগলেন নিবেদিতার সঙ্গে। আহার শেষ হবার পর নিবেদিতা হাত ধোবার জন্য একটি জলের জগ তুলে নিতেই স্বামীজি হা-হা করে উঠে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি তোমার হাত ধুইয়ে দেব।

নিবেদিতার উচ্ছিষ্ট মাখা হাতে জল ঢেলে দিতে লাগলেন স্বামীজি। তারপর একটি পরিষ্কার সাদা তোয়ালে দিয়ে মুছতে শুরু করলেন সেই নরম, চম্পকবর্ণ আঙুলগুলি। নিবেদিতা বিস্ময়ে বিমূঢ় ভাবে তাকিয়ে রইলেন স্বামীজির মুখের দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, এ কী করছেন? এর তো আপনার জন্য আমারই করার কথা!

স্বামীজি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, যিশু তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন মনে নেই?

নিবেদিতার চক্ষে জল এসে গেল। যিশু তো ওই কাজ করেছিলেন তাঁর জীবনের শেষ দিনে। এ কী অলক্ষুণে কথা বলছেন স্বামীজি?

উদগত অশ্রু কোনওক্রমে চেপে নিবেদিতা বললেন, আপনি কয়েক মাস আগে জো ম্যাকলাউডকে বলেছিলেন, আপনি চল্লিশ বছরের বেশি বাঁচবেন না। তা শুনে জো কী বলেছিল, আপনার মনে আছে? আপনি গৌতম বুদ্ধের ভক্ত, বুদ্ধের জীবনের বড় কাজ তো তাঁর চল্লিশ বছর বয়েস থেকে আশি বছর বয়েসের মধ্যেই হয়েছিল। আপনি এর মধ্যে এ সব কথা ভাবছেন কেন? আপনার জীবনের অনেক কাজ বাকি!

স্বামীজি ধীর স্বরে বললেন, আমার যা দেবার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি, এখন আমাকে যেতেই হবে।

নিবেদিতা ব্যাকুল ভাবে বললেন, আপনি আরও অনেক কিছু দিতে পারেন। আপনার মতন আর কে পারবে?

দূরের দিকে তাকিয়ে স্বামীজি অনেকটা আপন মনে বললেন, বড় গাছের ছায়া ছোট গাছগুলোকে বাড়তে দেয় না। তাদের জায়গা করে দেবার জন্যই আমাকে যেতে হবে। আমি চলে গেলেও কাজ থেমে থাকবে না। এই বেলুড়ে যে আধ্যাত্মিক শক্তির ক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা দেড় হাজার বছর ধরে চলবে। তা একটা বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেবে। মনে কোরো না, এটা আমার নিছক স্বপ্ন বা কল্পনা, এ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

এরপর নিবেদিতার সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটালেন, শরীরে কোনও অসুস্থতা বোধ করলেন না। কিন্তু পরদিনই শরীর আবার বেশ দুর্বল হয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না। তবু জোর করে উঠলেন। কালীপূজার অনেক ব্যবস্থা বাকি আছে। ব্রহ্মানন্দকে আবার দু দিনের জন্য কলকাতা যেতে হবে।

নীচে এসে বসলেন সকলের সঙ্গে। গতকাল সারাদিন উপবাস ছিল, তবু আজ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। শুধু এক গেলাস ঠাণ্ডা দুধ চেয়ে নিলেন। অন্য দিন তিনিই মধ্যমণি, অন্যরা তাঁর কথা শোনে। আজ তিনি চুপ, বাকি সবাই কথা বলে যাচ্ছে। দুধ পান শেষ হয়ে গেছে, এই সময় একটু তামাক খেতে ইচ্ছে করে, সে জন্যও কারুকে অনুরোধ করলেন না, শূন্য কাঁচের গেলাসটা হাতে ধরে তিনি বসে রইলেন উদাসীন মুখে।

এক সময় তাঁর মনে হল, সকলে যেন বড় বেশি কথা বলছে। এত কথা কেন? তাঁর কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। বাইরে পাখি ডাকছে, পোষা হাঁসগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাঘা নামের কুকুরটা একবার উঁকি দিয়ে গেল, আকাশে কালো মেঘের পাশে পাশে রুপোলি রেখা, সে সব দিকে কারুর মন নেই, শুধু কথা আর কথা!

স্বামীজির হাত থেকে কাঁচের গেলাসটা খসে পড়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল।

সেই সঙ্গে সবাই চকিত হয়ে তাঁর দিকে তাকাল। ব্রহ্মানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে নরেন, শরীর খারাপ লাগছে?

স্বামীজি কোনও উত্তর দিলেন না। ব্রহ্মানন্দ প্রায় জোর করে স্বামীজিকে ওপরে পাঠিয়ে দিলেন, ব্ৰজেন নামে একটি তরুণ শিষ্য সঙ্গে গেল তাঁর সেবার জন্য। নিজের ঘরে গিয়ে স্বামজি জোর করে গ্রন্থপাঠে মন বসাবার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু ঘুমিয়ে পড়তে লাগলেন বার বার। চ আশ্চর্য মানুষের শরীর। পরদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তেরও আগে স্বামীজির ঘুম ভাঙা মাত্র নিজেকে খুব টাটকা মনে হল, শিরা-উপশিরা সব চাঙ্গা, ব্যাধি বালাইয়ের চিহ্নমাত্র নেই। হাঁটতে গিয়ে দেখলেন, পায়ে ব্যথা করছে না। চোখের দৃষ্টিও যেন আবার উজ্জ্বল।

ধ্যান-জপ করলে মন একাগ্র হয়, তাতে শরীর আরও ভাল থাকে। আজ তিনি ঠাকুরের ঘরে বসে তন্ময় হয়ে চক্ষু বুজে রইলেন প্রায় তিন ঘণ্টা। তারপর চোখ মেলতেই তাঁর খুব ক্ষুধা বোধ হল। না খেয়ে খেয়ে শরীরটা আরও জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। স্বামীজি ঠিক করলেন, আজ কোনও নিয়ম মানবেন না, আজ নুন, তেল, মশলা দিয়ে রান্না ব্যঞ্জন খাবেন ভাতের সঙ্গে। অম্বল খাবেন।

সোনায় সোহাগার মতন আজই জুটে গেল ইলিশ। গঙ্গার ইলিশ মাছ ধরা হচ্ছে, স্বামী প্রেমানন্দ মঠের জন্য ইলিশ কিনছেন, স্বামীজি খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইলিশ দেখে মন উচাটন হয় না, এমন বাঙালি কজন আছে? স্বামীজি নিজে মাছ পছন্দ করতে লাগলেন। পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছ ধরা দেখেছিলেন, সেই তুলনায় গঙ্গার ইলিশ যেন আকারে আরও বড়, আর অপ্সরাদের মতন আকৃতি।

ব্ৰজেন নামে শিষ্যটি পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছে, তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে বাঙাল, তোদের দেশে এত ভাল ইলিশ পাওয়া যায়!

ব্ৰজেন জাঁক করে বলল, আমাদের পদ্মার ইলিশ আরও বড় হয়!

স্বামীজি বললেন, ইস, আমি দেখিনি বুঝি! গঙ্গার ইলিশের মতন স্বাদ ওই ইলিশের হয় না। হারে, তোদের বাঙাল দেশে নাকি ইলিশ মাছের পুজো হয়?

ব্ৰজেন বলল, সে তত সরস্বতী পুজোর পর। দুগা পুজোর বিজয়া দশমীর পর ইলিশ মাছ খাওয়া নিষেধ, আবার সরস্বতী পুজোর পর জোড় ইলিশ ঘরে আনতে হয়।

স্বামীজি বললেন, মঠের জন্য এ বছর তো এই প্রথম ইলিশ কেনা হল, কী দিয়ে তোরা পুজো করিস কর না!

তারপর প্রেমানন্দকে বললেন, আজ মঠে লোক কম, শুধু ঝোল করতে বলিস না, গোটা কতক ইলিশ ভাজাও খাব। ভাজার মাছ আর ঝোলের মাছের স্বাদই সম্পূর্ণ আলাদা। আর একটু মাছের অম্বল করতেও বলে দিস।

তারপর স্বামীজি আবার ঠাকুরের ঘরে গিয়ে পূজায় বসলেন। এবার একা, দরজা-জানলা পর্যন্ত বন্ধ।

নয় বেলা সাড়ে এগারোটায় বেরিয়ে এলেন সে ঘর থেকে। বেশ জোরে জোরে একটা গান ধরলেন, ‘মা কি আমার কালো রে, কালরূপা এলোকেশী হৃদিপদ্ম করে আলো রে…’। আজ আর কণ্ঠের জড়তা নেই, হাঁপানি নেই। গান থামিয়ে প্রেমানন্দকে বললেন, হারে বাবুরাম, কালীপুজোয় কি পাঁঠা বলি হবে? বলি না হলে কি মায়ের পুজো পূর্ণাঙ্গ হয়?

প্রেমানন্দ বললেন, মাতা ঠাকুরানী কি মত দেবেন? সেবারে আপত্তি করেছিলেন।

স্বামীজি বললেন, সে তো দুর্গাপুজোয়। কালীপুজোয় রাজি হন কি না ওঁর কাছে একবার জেনে আসলে হয়। এবার অনেক লোককে ডাকতে হবে। আমার বাড়ির লোকদের আনার ব্যবস্থা করা দরকার। ৫ এর মধ্যে খাবার ঘণ্টা বেজে উঠল। স্বামীজি ব্যস্ত হয়ে বললেন, চল, চল, ইলিশ মাছের ঝোল ঠাণ্ডা করা মহাপাপ। দ্বিতীয়বার গরম করলেও সেই স্বাদ থাকে না।

অনেকদিন বাদে বেশ তৃপ্তি করে খেলেন স্বামীজি। ইলিশ মাছ ভাজার তেল দিয়ে মেখে ভাত খেলেন, তারপর ডালের সঙ্গে মাছভাজা। ঝোল তেমন ঝাল হয়নি বলে নিজেরটায় আরও কাঁচা লঙ্কা ডলে নিলেন, আঙুলে অম্বল চাটতে চাটতে প্রেমানন্দকে বললেন, একাদশী করতে করতে কী রকম খিদে হয়েছে দেখছিস! থালাবাটি-গেলাসও যে খেয়ে ফেলিনি, এই রক্ষে।

খাওয়ার পর বিশ্রাম করতে গিয়েও ফিরে এলেন এক ঘণ্টার মধ্যে। প্রেমানন্দকে ডেকে তুলে বললেন, ওঠ, ওঠ, সন্ন্যাসীর পক্ষে দিবানিদ্রা খারাপ। আমার আজ ঘুমই এল না। মাথাটা একটু ব্যথা ব্যথা করছে কেন বল তো? খুব বেশিক্ষণ ধ্যান করা হয়েছে, তাই ব্রেন উইক লাগছে। চল পড়াশুনো করি, তাতে মাথা ঠিক হয়ে যাবে।

দুজনে এলেন লাইব্রেরি ঘরে। সেখানে কয়েকজন তরুণ সন্ন্যাসী পাঠে নিমগ্ন। স্বামীজি বললেন, কী করছিস তোরা সব? ভাল করে বেদ পড়বি। গীতার নিজস্ব ভাষ্য তৈরি করে নিতে হবে। তার জন্য সংস্কৃত ব্যাকরণটা আগে ভাল করে শেখা দরকার। পাণিনি ছাড়া গতি নেই। আয় সকলে মিলে আজ পাণিনি পড়ি।

তাদের পাণিনির ব্যাকরণ পড়াতে লাগলেন স্বামীজি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। অত কঠিন বিষয়, যাতে সহজে দন্তস্ফুট করা যায় না, তা নিয়েও সরস আলোচনা করতে লাগলেন। এক সময় প্রেমানন্দ এসে বললেন, আর কত পড়ানো হবে? তিন ঘণ্টা হয়ে গেল, তোমার না মাথা ব্যথা। করছিল?

স্বামীজি বই নামিয়ে রেখে দু হাত ছড়িয়ে বললেন, তাই নাকি, এতক্ষণ? তা হলে এখন একটু মুক্ত বায়ু সেবন করা দরকার।

বাইরে এসে প্রেমানন্দের সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন স্বামীজি। মঠের চত্বর পেরিয়ে রাস্তায়। খানিকটা যাবার পর প্রেমানন্দ বললেন, এবার ফেরা যাক। অনেকদিন তো এতটা হাঁটোনি।

স্বামীজি হেসে বললেন, ইলিশ মাছ খেয়ে আজ যেন নবযুবকের মতন শক্তি এসেছে। একটুও কষ্ট হচ্ছে না। চল, আরও যাই।

চলে এলেন বেলুড় বাজার পর্যন্ত। প্রেমানন্দ এবার ফেরার জন্য জোর করতে লাগলেন। স্বামীজি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, দ্যাখ বাবুরাম, কদিন ধরে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। আমাদের এখানে একটা বেদ বিদ্যালয় স্থাপন করা দরকার। যেখানে শুধু বেদ পড়ানো হবে।

প্রেমানন্দ বললেন, এখন এই যুগে এত বেদ পড়ে কী হবে?

স্বামীজি বললেন, আর কিছু না হোক, কুসংস্কারগুলো দূর হবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই তো বেদ গ্রন্থখানি চক্ষেও দেখেনি। মুসলমান বাড়িতে কোরান থাকে, খ্রিস্টানবাড়িতে বাইবেল থাকে, কটা হিন্দুর বাড়িতে বেদ থাকে বলতে পারিস? অশিক্ষিত পুরুতগুলো কথায় কথায় বলে, বেদে অমুক আছে তমুক আছে, নিজেরা বেদ কখনও পড়েও দেখেনি। আমাদের দেশে এই যে স্ত্রী-পুরুষের ভেদ করে, মেয়েদের শিক্ষা দেয় না, এ তো বেদ-বিরুদ্ধ। এ সব পরবর্তী স্মৃতির অনুশাসনের ব্যাপার। যে-দেশে, যে-জাতে মেয়েদের পুজা নেই, সে দেশ কোনও কালে বড় হতে পারে না। পুণা থেকে বেদের মূল সংস্করণ আনাতে হবে। চল, আজই গিয়ে চিঠি লিখে ফেলি।

এবারে দ্রুত পদে ফিরতে লাগলেন। এক ধনী-পরিবারের বাড়ি-সংলগ্ন বাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, হায় রে, বাগানের কী ছিরি! আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ বাগানের মর্ম বোঝে না। বাড়ি করার সময় ক’জন বাগান রাখার কথা ভাবে? বাগান থাকলেও যত্ন নেয় না। ইওরোপ-আমেরিকায় ছোট ছোট বাড়ির সঙ্গেও এক চিলতে বাগান অন্তত থাকবেই। বাড়ির মালিক নিজের হাতে আগাছা ছাঁটে। আমেরিকায় লেগেট সাহেবের বাড়িতে আমি অতিথি ছিলাম, আহা কী বাগান, যেন স্বগোদ্যান, শুধু পারিজাত বৃক্ষটি নেই। ওদের দেশের বড় বড় বাগানের যত্ন করার জন্য গুচ্ছের মালি রাখতে হয় না, মেশিন দিয়ে ঘাস কাটা যায়, পাইপে জল দেয়। আমি সেই বাগানে যখন ঘুরে বেড়াতাম…

একটু আগে বেদ পাঠ সম্পর্কে নানা কথা বলছিলেন, এখন বাগানের আলোচনায় মেতে উঠলেন। আজ যেন তাঁকে কথায় পেয়ে বসেছে। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তর।

ফিরে এসে দু একজন অভ্যাগতর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালালেন কিছুক্ষণ। সন্ধ্যার উপাসনার সময় এসে গেলে তিনি গাত্রোখান করলেন, ব্রজেনকে ডেকে নিয়ে উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। ব্ৰজেনের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, শরীরটা বড় হালকা লাগছে, আজ বেশ আছি। তুই আমার জপের মালাদুটো দিয়ে বাইরে বসে থাক। দরকার হলে তোকে ডাকব।

খানিকবাদেই হাঁক পাড়লেন, ব্যাজা, এই ব্যাজা!

ব্ৰজেন এসে তাঁর ঘরের দরজার কাছে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, এত গরম লাগছে কেন রে, আকাশে মেঘ জমেছে বুঝি? এত গুমোট।

ব্ৰজেন বলল, না, আজ তো মেঘ নেই। আকাশ একেবারে পরিষ্কার।

স্বামীজির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত। তিনি বললেন, জানলাগুলো সব খুলে দে। আমাকে একটু বাতাস কর।

ব্ৰজেন দৌড়ে একটা হাতপাখা নিয়ে এল। স্বামীজি বিছানায় শুয়ে পড়ে বললেন, পা দুটো আবার ভার ভার লাগছে। অনেক হেঁটেছি তো। বেশ করে টিপে দে তো।

ব্ৰজেন এক হাতে পা টিপে দিতে দিতে অন্য হাতে বাতাস করতে লাগল। একটু পরেই শান্ত হলেন স্বামীজি। স্নেহের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁরে ব্যাজা, তুই যে বাড়িঘর ছেড়ে এত দূরে এসে এই মঠে পড়ে আছিস, তোর কোনও কষ্ট হচ্ছে না তো?

ব্ৰজেন বলল, মোটেও না। এত আনন্দ, সব সময় মনে হয় নিজেদের লোকেদের সঙ্গেই আছি। তবে দুএকটা কথা মনে হয় বটে। কখনও কারুকে বলিনি, এখন বলব?

স্বামীজি বললেন বল।

ব্ৰজেন বলল, সেই যে একবার এক পণ্ডিত এসেছিল উত্তর ভারত থেকে, আপনার সঙ্গে বেদান্ত বিচার করতে। আপনি তাকে বলেছিলেন, পণ্ডিতজি, সর্বত্র যে ভয়ংকর হাহাকার উঠছে। প্রথমে তার নিরসনের জন্য–এক মুষ্টি অন্নের জন্য স্বদেশবাসীর আর্তনাদ বন্ধ করার জন্য কিছু করুন, তারপর আমার সঙ্গে বেদান্ত বিচার করতে আসবেন। বেদান্তধর্মের সারমর্ম হচ্ছে এই যে, অন্নের অভাবে মুমূর্ষ জনগণের প্রাণরক্ষার জন্য নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করতে হবে। … আমরা কি তা পেরেছি?

স্বামীজি অন্যমনস্কভাবে বললেন, যা, ত্যাগ আর সেবা, ত্যাগ আর সেবা!

শিষ্য আবার বলল, আর একবার সখারাম গণেশ দেউস্করের সঙ্গে দুজন পঞ্জাবি ভদ্রলোক এসেছিলেন। পঞ্জাবে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল, তবু তাঁরা সে কথা না তুলে শাস্ত্র আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন। আপনার সঙ্গে তর্ক বেঁধে গেল। সেদিনে আপনার একটি কথা আমার মনে গেঁথে আছে। আপনি বলেছিলেন, মশাই, যে পর্যন্ত আমার দেশের একটা কুকুরও অভুক্ত থাকবে, সে পর্যন্ত আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ানো ও তার যত্ন নেওয়া– আর যা কিছু তা হয় ধর্মধ্বজিতা, নয় অধর্ম! স্বামীজি, তাই-ই যদি হয়, তা হলে আমরা মঠে সারাদিন ধরে জপ-তপ আর শাস্ত্র পাঠ করছি কেন? এখনও তো দিকে দিকে ক্ষুধার্তের হাহাকার। দেশটা আরও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে।

স্বামীজি বললেন, আরও জোরে বাতাস কর। গরমে ঝাঁ ঝাঁ করছে শরীর। ওরে, আমরা সন্ন্যাসী, সারা দেশের অবস্থা বদলাবার ভার কি আমরা নিতে পারি?

ব্ৰজেন বললেন, আপনি এত বড় মানুষ, আপনি ডাক দিলে সারা দেশের মানুষ সে কথা শুনবে। বিভিন্ন জায়গায় সভা করে যদি আপনি বলেন…

স্বামীজি বললেন, এসব কথা এখন থাক। আমি বড় ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত। মুখের রক্ত তুলে তুলে অনেক বক্তৃতা দিয়েছি।

ব্ৰজেন বলল, স্বামীজি, আপনি যে দেশ-বিদেশে এত পরিশ্রম করে গেলেন, তার ফল কী হল?

স্বামীজি মৃদু স্বরে, টেনে টেনে বললেন, শরৎও একদিন ওকথা জিজ্ঞেস করেছিল। ফল কী হয়েছে তার কিছুটা অন্তত তোরা দেখে যাবি। কালে এই পৃথিবীকে ঠাকুরের উদার ভাব নিতেই হবে, তার সূচনা হয়ে গেছে। এই প্রবল বন্যার মুখে সকলকে ভেসে যেতে হবে।

ব্ৰজেন বলল, মঠ প্রতিষ্ঠার সময় আপনি বলেছিলেন, সর্বমতের, সর্বপথের আচণ্ডালব্রাহ্মণ–সকলে যাতে এখানে এসে আপন আপন আদর্শ দেখতে পায় তা করতে হবে। সাহেবরা বেদ পড়ে, কিন্তু এ দেশের কোনও চণ্ডাল কি আজও বেদ পাঠের অধিকার পেয়েছে?

স্বামীজি যেন আর সেসব শুনতে পেলেন না, তাঁর দুই চক্ষু বুজে এসেছে, নিশ্বাসে ঘুমের শব্দ।

শিষ্য নিষ্ঠার সঙ্গে গুরুর সেবা করে যেতে লাগল। জানলার বাইরে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট রাত্রির আকাশ। বাতাস বইছে উথাল-পাথাল। এ সময় মঠ একেবারে শান্ত। গঙ্গাবক্ষে কোনও নৌকোয় কে যেন ভাটিয়ালি গান ধরেছে। দূরদেশি কোনও নাবিকের জন্য তার প্রেমিকার বিচ্ছেদ-বেদনার গান। কাছাকাছি এক মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে। একটু বাদে ভোঁ দিতে দিতে চলে গেল এক যাত্রীবাহী স্টিমার। ঢেউগুলি ছলাৎ ছলাৎ করে এসে লাগছে তীরে, সেই শব্দ এখান থেকেও শোনা যায়।

জীবন বয়ে চলেছে প্রতিদিনের নিয়মে। রাত প্রায় ন’টা, বিশ্বের এই ভূখণ্ডে আজকের জীবনযাত্রা প্রায় শেষ হতে চলল। আবার রাত্রি প্রভাত হবে, আবার শুরু হবে সংসারের কলরোল। সারাদিন ঠা। ঠা পোড়া রোদ গেছে, রাত্রির বাতাস শান্তি এনে দিয়েছে, আজ সকলের ভাল ঘুম হবে।

ব্ৰজেন ঠায় বসে আছে, পা টেপা বন্ধ করে পাখা নেড়ে যাচ্ছে একমনে। স্বামীজি খানিকবাদে ডান দিকে পাশ ফিরলেন, তারপর শিশুরা যেমন ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে, সে রকম একটা শব্দ বেরুল তাঁর মুখ থেকে, ডান হাতখানা একবার কেঁপে উঠল। একটা গভীর নিশ্বাস পড়ার পর মাথাটি গড়িয়ে গেল বালিশ থেকে।

ব্ৰজেন সঙ্গে সঙ্গে মাথাটি তুলে দিয়ে নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে আনল কাছে। স্বামীজি কি কিছু বলতে চাইছেন? তিনি রাত্রে কিছু খেলেন না, খিদে পায়নি? ঘরেই দুধ এনে রাখা আছে, মাঝে মাঝে রাত্রে শুধু এক গেলাস দুধ খান। আজ দিনের বেলা পেট ভরে খেয়েছেন অবশ্য। তাঁর ইলিশ মাছের প্রীতি বাঙালদেরও হার মানায়।

দু মিনিট বাদে স্বামীজি আবার পাশ ফিরে চিত হলেন। এবারেও খুব গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তারপর আর কোনও শব্দ নেই।

মানুষের প্রতিদিনের ঘুম আর শেষ ঘুম কি এক হতে পারে? দৃশ্যত একই রকম হলেও কিছু তফাত থাকে নিশ্চয়ই। নইলে ব্ৰজেন তৎক্ষণাৎ আর্তনাদ করে উঠবে কেন? স্বামীজি, গুরুদেব বলে সে কয়েকবার ব্যাকুলভাবে ডাকল। লণ্ঠনটি খুব কাছে নিয়ে এসে দেখল। স্বামীজির চোখের মণি দই ভুরুর মাঝখানে স্থির, বুকে নিশ্বাসের ওঠা-পড়া নেই।

ব্ৰজেন কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল নীচে। ঠিক তখনই খাবার ঘণ্টা পড়েছে, সন্ন্যাসীরা খেতে বসার উদযোগ করছিলেন, দৌড়ে ওপরে এলেন প্রেমানন্দ ও আরও কয়েকজন। কেউ নাড়ি। দেখতে লাগলেন, কেউ আগে থেকেই কান্না শুরু করে দিলেন। এ কী ভাবসমাধি, না মহাসমাধি? দু’ একজন নিঃস্পন্দ বিবেকানন্দর কানের কাছে বারবার শোনাতে লাগলেন শ্রীরামকৃষ্ণের নাম।

বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, তবু বিশ্বাস না করে উপায় নেই। মঠাধ্যক্ষ ব্রহ্মানন্দ আজ রাতে কলকাতায় থাকবেন। তখুনি লোক ছুটল বরানগর থেকে ডাক্তারকে ধরে আনার জন্য, কানাই গেল বলরাম বসুর বাড়িতে ব্রহ্মানন্দকে খবর দিতে। কাছেই নিবেদিতার বাসস্থান, কিন্তু তাঁকে সংবাদ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল না কেউ।

পরদিন সকালে এল সেই ভগ্নদৃত। তার হাতে সারদানন্দের চিঠি। সেই চিঠি পাঠ করা মাত্র নিবেদিতার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, যেন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। সব শেষ? এ যে অসম্ভব। তাঁর গুরু মাঝে মাঝেই মৃত্যুর কথা বলতেন বটে, কিন্তু নিবেদিতার মনে মনে দৃঢ় ধারণা ছিল, আরও অন্তত তিন-চার বছর স্বামীজি নিশ্চয়ই বাঁচবেন। দুদিন আগেও তিনি তাঁকে হাসি-ঠাট্টা করতে দেখে এসেছেন।

পরনে যা পোশাক ছিল তার ওপর একটা চাদর জড়িয়ে নিয়ে তক্ষুনি বেলুড় রওনা হলেন নিবেদিতা। দোতলায় স্বামীজির ঘরে তখন কয়েকজন চিকিৎসক ও সন্ন্যাসী-ভক্তদের বেশ ভিড়। কেউ কেউ পাগলের মতন হাত-পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি করছে। শিয়রের কাছে এসে বসলেন নিবেদিতা, তাঁর গুরুর মুখ একটুও বিকৃত হয়নি, কিন্তু চক্ষুদুটি জবা ফুলের মতন টকটকে লাল, নাক ও মুখের দু’পাশে রক্তের রেখা। একজনের কাছ থেকে তুলো চেয়ে নিয়ে নিবেদিতা সেই রক্ত মুছে দিলেন। তারপর পাখার বাতাস করতে লাগলেন আস্তে আস্তে।

ঘরের মধ্যে অন্যরা কে কী করছে, তা লক্ষই করলেন না নিবেদিতা। তিনি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন গুরুর মুখের দিকে। তাঁর চোখে অশ্রু নেই। তাঁর কান্না কেউ বুঝবে না। স্বামীজির সঙ্গে কত কথা বাকি রয়ে গেল। ঘরের মধ্যে যদিও অসহ্য গরম, তবু নিবেদিতা বোধ করতে লাগলেন নিদারুণ নিঃসঙ্গতার শৈত্য। যদি এ সময় জো ম্যাকলাউডও পাশে থাকত! জো কী ভালই না বাসে স্বামীজিকে। জো দীক্ষা নিয়ে স্বামীজির শিষ্যা হতে চায়নি, সে সবসময় বলত, আমি স্বামীজির বন্ধু। এ রকম বন্ধু ক’জন পায়? নিবেদিতার সঙ্গে শেষ দেখার দিনেও জোর প্রসঙ্গ একবার উঠতে স্বামীজি বলেছিলেন, ও পবিত্রতার মতন পবিত্র, প্রেমের মতন প্রেমময়ী। সেই জো কিছুই জানল না। ইংলন্ডে সপ্তম এডোয়ার্ডের রাজ্যাভিষেক দেখার জন্য গত মাসে ইওরোপ চলে গেছে। ৪ঠা জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে স্বামীজি চলে গেলেন, তাঁর কত আমেরিকান বন্ধু ও ভক্ত আছে, তারা এখন স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে মেতে আছে।

বেলা দুটোর সময় একজন নিবেদিতাকে বলল, এবার উঠতে হবে।

নিবেদিতা সরে গেলেন। স্বামী বিবেকানন্দর দেহকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে, নতুন গৈরিক বস্ত্র পরিয়ে, রাশি রাশি পুষ্পমালা দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হল নীচে। সামনের চত্বরে বেলগাছটির চে প্রস্তুত হয়েছে চিতা। যখন মন্ত্র পাঠ হচ্ছে, তখন নিবেদিতা লক্ষ করলেন, স্বামীজির ব্যবহৃত নসপত্রও শবদেহর ওপরে দেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে একটা চাদর, সেটা এই পরশুদিনও নিবেদিতা দেখেছিলেন তাঁর গুরুর গায়ে। তিনি সারদানন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই চাদরটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিলে হয় না?

সারদানন্দ বললেন, পরিধেয় সব বস্ত্র পুড়িয়ে ফেলাই নিয়ম। তবে তুমি যদি রাখতে চাও, তা হলে ওটা তোমাকে দিয়ে দিতে পারি।

নিবেদিতা কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। অন্য কেউ কিছু নিচ্ছে না, তাঁর পক্ষে চাদরটা নিয়ে নেওয়া আদিখ্যেতা হয়ে যাবে না তো? কে আবার কী মনে করবে, বরং থাক। অন্তত একটা টুকরোও যদি জো ম্যাকলাউডের জন্য কেটে নেওয়া যেত। সঙ্গে কোনও কাঁচি বা ছুরিও নেই। কারুর কাছে চাইতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।

চন্দনকাঠের চিতায় ঢালা হল প্রচুর ঘি। জ্বলে উঠল আগুন। কাল এই সময় যে মানুষটি মহা উৎসাহে শিষ্যদের পাণিনির ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন, আজ তিনি নেই। আজকের সংবাদপত্রে তাঁর তিরোধান সংবাদ ছাপা হয়নি বলে বেশি লোক জানতে পারেনি, তবু মুখে মুখে খবর ছড়াচ্ছে, এখনও নৌকোয় করে দলে দলে লোক আসছে।

মনুষ্য শরীর দাহ করার দৃশ্য আগে দেখেননি নিবেদিতা। আজ প্রথম দেখছেন, এবং দেখছেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির নশ্বর শরীর শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিবেদিতার বুক এমনই শুন্য, যে অশ্রুও নেই। তিনি বসে রইলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ বিশেষ কথা বলছে না তাঁর সঙ্গে। একটা সান্ত্বনা বাক্যও কেউ বলেনি, যেন তিনি এখানকার কেউ না। নিবেদিতা অবশ্য এসব ভ্রুক্ষেপও করছেন না। শুধু দেখছেন আগুন।

ক্রমে বেলা পড়ে এল, সূর্যাস্তে বণাঢ্য হল আকাশ। তখনও চিতার আগুন লকলক করছে। হঠাৎ এক সময় নিবেদিতার এক হাতে কী যেন লাগল। তিনি চমকে পাশে তাকালেন। স্বামীজির সেই চাদরখানির একটা টুকরো চিতা থেকে উড়ে এসে পড়েছে তাঁর কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *