সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ওরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গাইছে, সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি, লোকে যত বলে তারো চেয়ে খুঁটি, আমার বাংলাদেশের মাটি…। পাঁচ-সাতটি তরুণ কণ্ঠ। ধুপ ধাপ পায়ের আওয়াজ করে তাল দিচ্ছে তারা। কেউ কেউ নাচছেও বোধ হয়। কে কী ভাববে, তা নিয়ে ওদের বিন্দুমাত্র ক্রুক্ষেপ নেই। এ বাড়ির অন্য ভাড়াটেরা এর মধ্যে অনেকেই শুয়ে পড়েছে বাতি নিবিয়ে, তারা এই গানের হুল্লোড় শুনে চমকে উঠবে, বিরক্ত হবে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ প্রতিবাদ করবে না অবশ্য।
দোতলায় এসে ওদের গান থামলো। তারপর বন্ধ দরজার গায়ে চাপড় পড়লো। প্রথমে একটি নরম হাতে, একটু পরেই একসঙ্গে কয়েকজন দরজা ঠেলতে ঠেলতে স্লোগান দিল, জেলের তালা ভাঙবো! শেখ মুজিবকে আনবো! জেলের তালা ভাঙবো!
মামুন আলো জ্বেলে রেখেই শুয়ে পড়েছিলেন। উঠে এসে ছিটকিনি খুলে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললেন, কী রে, এই ঘরটাকেও তোরা জেলখানা মনে করেছিস নাকি?
মামুনের কথা কেউ শুনলো না। মঞ্জু একটা মস্ত বড়ো রাজভোগ জোর করে তার মুখে ঠেসে দিয়ে হাসতে হাসতে বললো, এই তোমার দ্বারিক ঘোষের মিষ্টি!
হঠাৎ যেন ঘরখানা ভরে গেল প্রাণচাঞ্চল্যে। তিনটি তরুণী আর পঁচজন যুবক, তারা যে-যেখানে পারলো বসে পড়লো, কথা বলতে লাগলো দুতিনজন একসঙ্গে। সাদা দেওয়ালগুলোতে কোনো ছবি নেই, কিন্তু ওদের পোশাকের রঙে ঝলমল করে উঠলো পরিবেশ।
গত চার-পাঁচদিন ধরে এরকমই চলছে। যখন তখন এসে পড়ছে এক একটি দল, শুরু হচ্ছে আচ্ছা। সেইসঙ্গে হাসি, অকারণ উচ্ছ্বসিত হাসি, যেন কথার চেয়ে হাসিটাই আসল। রাত দেড়টা-দুটোর আগে আড্ডা ভাঙে না, এরপর অনেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে, কলকাতার রাত থেকে হঠাৎ যেন সব আতঙ্ক মুছে গেছে, নকশালদের খুনোখুনিও বন্ধ।
হলুদ সিল্কের শাড়ির ওপর একটা কমলা রঙের সোয়েটার পরেছে মঞ্জু, এই দুটি রঙেই যেন তার রূপ সবচেয়ে ভালো খোলে। মঞ্জুর সঙ্গে অন্য দুটি মেয়ের মধ্যে একজন তাহমিনা, ব্যারিস্টার মতিউর রহমানের কন্যা, তার সাজ বেশ উগ্র, ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক, অতি সূক্ষ্ম ভুরু, এই শীতেও তার গায়ে সোয়েটার বা আলোয়ান নেই, অবশ্য সে হল্যান্ড থেকে সদ্য এসেছে। অন্য মেয়েটিকে মামুন ঠিক চিনতে পারছেন না। ছেলেদের মধ্যে রয়েছে মাহবুব, আপেল, পলাশ, সাত্তার, শওকতরা।
খাটের তলা থেকে হারমোনিয়ামটা টেনে পলাশ বাজাতে শুরু করে দিল, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী…’। মামুন গান ভালোবাসেন। কিন্তু এক একসময় গানটাও তার কাছে অত্যাচার বলে মনে হয়, তিনি বিরক্তভাবে ভাবলেন, আবার এত রাত্রে গান!
মঞ্জু বললো, আরও অনেক মিষ্টি রয়ে গেছে, কে কে খাবে? মামুনমামা, তুমি আর একটা খাও! তুমি এত দ্বারিক ঘোষের মিষ্টির গল্প বলতে, অনেক খুঁজে আনা হয়েছে!
মামুন মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে না না বলতে লাগলেন, মঞ্জু তার হাতের রস গড়ানো রাজভোগটা খুঁজে দিল পলাশের মুখে, পলাশের দু’ হাত হারমোনিয়ামে, সে বাধা দিতে পারলো না, অন্যরা একটা উদ্দাম হাসির ঝড় তুললো।
এই আড্ডায়, হাসিতে, গানে সুর মেলাতে পারছেন না মামুন। এদের সঙ্গে তার বয়েসের অনেক তফাত তো বটেই, তা ছাড়াও আজ সারাদিন ধরেই তার বুকটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এইরকমই হয়, কোনো কিছুর জন্য যদি তীব্র প্রতীক্ষা থাকে, দিনের পর দিন যার জন্য প্রবল অনিশ্চয়তা কুরে কুরে খায়, তারপর সেটা পাওয়া হয়ে গেলেও যেন ঠিক সেরকম আনন্দ হয় না। এত ভয়, উৎকণ্ঠা ও বিপদের বিষাদের পর স্বাধীনতা এলো, মামুন খুশি হয়েছেন ঠিকই। তবু মাঝে মাঝে মন খারাপও লাগছে কেন? জয়ের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছেদের বিষণ্ণতা তো লেগে থাকবেই। এই যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে, যারা চিরকালের মতন হারিয়ে গেছে, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করেছেন মামুন অনেকবার। কিন্তু সেইজন্যই কি তার বুকে পাষাণভার চেপে আছে?
শওকত জিজ্ঞেস করলো, কবে ঢাকায় ফিরবেন, মামুনভাই?
উত্তর দেবার আগে মামুন তীব্র চোখে একবার মঞ্জুর দিকে তাকালেন। এই প্রশ্নটা সবচেয়ে প্রথমে মনে আসা উচিত ছিল মঞ্জুর। কিন্তু সে ঢাকা ফেরার ব্যাপারে একবারও উচ্চবাচ্য করেনি! এজন্য মঞ্জুর ওপর বেশ বিরক্ত হয়েছেন মামুন। মঞ্জুর স্বামী বাবুল চৌধুরীর সঠিক কোনো খবর আজও পাওয়া যায়নি। হারিয়ে যাওয়া তিরিশ লক্ষ বাঙালীর মধ্যে সেও আছে কি না তাও কেউ জানে না, তবু সে সম্পর্কে মঞ্জুর কোনো উদ্বেগ নেই? দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে কি মেয়েরাও সব স্বাধীন হয়ে যা ইচ্ছে করবে, ধেই ধেই করে এখানে সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াবে!
মামুন উত্তর দেবার আগেই আর একজন বললো, দাঁড়াও, আর কয়েকটা দিন যাক। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারই তো এখনো ঢাকায় যায়নি। কুত্তার বাচ্চা রাজাকাররা এখনো নাকি এদিক সেদিকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
শওকত বললো, না, গেছে, বাংলাদেশ সরকার আজ বিকাল থেকে ঢাকায় ফাংশান করছে। আজ দুপুরেই আমি এয়ারপোর্টে তাজউদ্দিন সাহেবদের সী-অফ করে এসেছি!
মাহবুব বললো, ঢাকার আশেপাশে এখনো গোলমাল চলছে ঠিকই। মুক্তিযুদ্ধের পোলাপানদের হাতে এল এম জি, স্টেনগান… আজ এখানকার দু-একটা পেপারে কাদের সিদ্দিকীর গ্রেফতারের খবর পড়েছো?
মামুন শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, আঁ? টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী গ্রেফতার হয়েছে নাকি? কেন?
মাহবুব বললো, গ্রেফতার হয়নি এখনো, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছে ইন্ডিয়ান আর্মিকে। ঢাকার পল্টন ময়দানে কাদের সিদ্দিকী হাজার হাজার লোকের সামনে চারজন লোককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে শাস্তি দিয়েছে, সে কথা শোনেননি? ল অ্যান্ড অর্ডার যদি সে নিজের হাতে নিতে চায়…
মামুন বললেন, মুক্তিযুদ্ধের অতবড় একজন বীর কাদের সিদ্দিকীকে যদি ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যারেস্ট করে, তাহলে সাধারণ মানুষ আবার ক্ষেপে যাবে না? ইন্ডিয়ান আর্মির ওপরেই ক্ষেপে যাবে।
মাহবুব বললো, সারা দেশে এখন অরাজকতা, শেখ সাহেব যদি না আসেন, তাহলে আর একটা গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। গেরিলারা যদি বিনাবিচারে যাকে তাকে ধরে মারতে শুরু
মঞ্জু বললো, তোমরা আবার ঐ সব কথা শুরু করলে! এখন থামো তো!
তাহমিনা বললো, গান হোক, গান হোক! এত কষ্টে স্বাধীনতা পাওয়া গেল, তা নিয়ে আনন্দও করতে জানো না? এর মধ্যেই উল্টো সুর গাইতে শুরু করলে!
মঞ্জু বললো, কে কে চা খাবে? আমি চায়ের পানি বসাবো!
হার্টের অসুখের পর মামুন চা-পান কমিয়ে দিয়েছেন, তবু তিনি এখন বললেন, আমারে এক কাপ দিস, মঞ্জু!
মঞ্জুর ছেলে সুখ এখন জাস্টিস মাসুদ সাহেবদের বাড়িতেই থাকে। হেনা কৃষ্ণনগরের এক ক্যাম্পে নার্সের কাজ শুরু করেছিল, আগামীকাল তার ফেরার কথা। মঞ্জু প্রত্যেক সন্ধেবেলা। কোনো না কোনো বিজয় উৎসবে গান গেয়ে আসছে। মঞ্চে বসে হাজার মানুষের হাততালি শোনার নেশা পেয়ে বসেছে তাকে। কয়েকদিন আগে তার গানের একটা রেকর্ডও বেরিয়েছে এইচ এম ভি থেকে, কলকাতার বড় বড় কাগজে ছাপা হয়েছে তার ছবি।
পলাশ আবার হারমোনিয়ামে সুর ধরলো।
যাঃ, সত্যিই পাকিস্তান ভেঙে গেল? এই চিন্তাটা কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছেন না। মামুন। তিনি তো এই ন’ মাস মনেপ্রাণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাইছিলেনই, তবু কেন এই নৈরাশ্য? পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায় শোষণ, সামরিক বাহিনীর বীভৎস অত্যাচার, বাঙালী মুসলমানদের একেবারে পঙ্গু করে দেবার চেষ্টা, এসব তো মামুন নিজের চোখেই দেখেছেন। মরিয়া হয়েই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিশেষ প্রস্তুতি না নিয়েই মুক্তি সংগ্রামে নেমে পড়েছিল। তবু তার ধারণা ছিল, পাকিস্তানী শাসকরা একসময় ভুল বুঝতে পারবে, ভুট্টোর পরামর্শে কর্ণপাত না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব দেবেন। পাকিস্তান বাচবে। শেষ মুহূর্তেও ওরা সেই ভুল স্বীকার না করে পাকিস্তান ভাঙতেও রাজি হয়ে গেল! এখনকার ছেলে ছোকরারা বুঝবে না, একসময় কত স্বপ্ন, কত সাধ নিয়ে গড়া হয়েছিল এই পাকিস্তান, এর জন্য কত অশ্র, কত রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে।
সিঁড়িতে ধুপ ধাপ শব্দ করতে করতে আবার উঠে এলো একটি দল। তাদের মধ্যে শাখওয়াত হোসেনকে দেখে মামুন বেশ চমকে উঠলেন। হোটেল টাইকুন ও দিন-কাল পত্রিকার মালিক এই হোসেন সাহেবের সঙ্গে মামুনের কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়েছে কয়েকবার, মামুন শুকনো ভদ্রতা রক্ষা করেছেন মাত্র, এর সঙ্গে আর পুরোনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। হোসেন সাহেবকে তিনি কোনোদিন তার বাসায় আসতে বলেননি, তবু তিনি এখানে চলে এলেন কী করে?
তাহমিনা হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, ঠিক টানে টানে চলে এসেছে! ওরে নাসিম, বলেছিলাম না, ডোন্ট গেট নারভাস, তুই হারাবি না!
দু’দিকে কান পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে হোসেন সাহেব বললেন, হারাবে কেন? তোমাদের সাথে আছে… এই নাও, তোমাদের সকলের জন্য বিরিয়ানি এনেছি, সিরাজ থেকে, আর কিছু কাবাব, মুর্গ মশল্লম শেষ হয়ে গেছে, ওরা ভালো বানায়।
হোসেন সাহেবের এক সঙ্গীর হাতে তিন-চারখানা বিরাট খাবারের প্যাকেট। ঘি ও মাংসের গন্ধে ঘরের বাতাস থেকে গান মুছে গেল।
এমন দিনে সকলকেই খাতির করতে হয়, মামুন নিজের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসামু আলাইকুম, বসেন বসেন!
হোসেন সাহেব মামুনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আলাইকুম আসোলাম, হক সাহেব, স্বাধীন, স্বাধীন! আমরা একটা স্বাধীন নেশান! আপনের কথাই সত্যি হইলো, ইন্ডিয়াই আমাগো প্রকৃত বন্ধু! হারামজাদা পাকিস্তানীরা এমন শিক্ষা পাইছে যে এখন ঘা শুকাইতে এক জেনারেশান লাগবে।
চেয়ারটাতে গ্যাট হয়ে বসে তিনি সোনার সিগারেট কেস খুলে প্রথমে নিজে একটি তুললেন, তারপর সেটা বন্ধ করে পকেটে ভরতে গিয়েও কী মনে করে আবার এগিয়ে দিলেন মামুনের দিকে।
মঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, না, মামুনমামাকে দেবেন না। ওঁর সিগারেট বন্ধ।
হোসেন সাহেব বললেন, আরে, আইজ একটা খাইলে কোনো ক্ষতি নাই!
গত কয়েকদিন ধরে মামুন মঞ্জুকে লুকিয়ে আবার সিগারেট টানতে শুরু করেছেন। এখনও সংযম রাখতে পারলেন না, তুলে নিলেন একটা।
হোসেন সাহেব যেখানে উপস্থিত থাকেন সেখানে তিনিই প্রধান বক্তা। সিগারেটে বড় টান। দিয়ে তিনি বললেন, আমি সারেণ্ডারের খবরটা কোথায় পেলাম জানেন? দিল্লিতে? আজমীড় শরীফ হয়ে আমি আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, দিল্লি ঘুরে আসলাম। ওঃ, ইন্ডিয়া কি বিরাট কান্ট্রি, কত ভ্যারাইটি, এখানে মোছলমান, শিখ, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, হিন্দু,কতরকম মানুষ, সবাই মিলামিশা আছে। আর ম্যাডাম ইন্দিরা গান্ধী, গ্রেট লেড়ি, সারা দুনিয়ায় এমন মহান লেডি আর নাই, বোঝলেন। সিক্টটিথ বিকালে আমি দিল্লিতে, সারেণ্ডারের খবর শোনার পর বুকখান দশহাত হইয়া গেল, আর পাকিস্তানের সেকেণ্ড ক্লাস সিটিজেন না, স্বাধীন বাংলার ফাস্ট ক্লাস সিটিজেন, ম্যাডাম ইন্দিরা গান্ধীরে স্বচক্ষে দ্যাখলাম, বোঝলেন, দিল্লির পার্লামেন্টের সামনে, বড় ঘরের মেয়ে তা দ্যাখলেই বোঝা যায়, কই, তোমরা বিরিয়ানি খাও, এখনও গরম আছে।
শওকত একসময় হোসেন সাহেবের পত্রিকা অফিসে চাকরি করতো, কোনোদিন ওর সামনে চোখ তুলে কথা বলেনি, কিন্তু এই ক’মাসেই সে যেন অনেক বদলে গেছে। সে রীতিমতন। ইয়ার্কির সুরে বললো, হোসেন সাহেব, আপনি বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক বললেন কেন? স্বাধীন বাংলাতেও কি প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক থাকবে নাকি?
হোসেন সাহেব বললেন, ওটা কথার কথা! বাংলাদেশে আমরা সবাই ফাস্ট ক্লাস, কী কও? আচ্ছা, ইচ্ছা করলে আমরা এখন ইন্ডিয়ারও সিটিজেনশিপ নিতে পারি না? ইন্দিরা গান্ধীরে ঠিকমতন বুঝাইলে উনি রাজি হবেন মনে হয়। ইন্ডিয়ায় একসময় আমার অনেক প্রপাটি ছিল। জানো, পার্ক সার্কাসে আমি একটা বাড়ি এক্সচেঞ্জ করছিলাম, সেই বাড়িটা আজ সকালে এককবার দ্যাখতে গেলাম, কী সুন্দর চকমিলানো বাড়ি, আম গাছ দুইটা এখনো আছে, এক হিন্দু উকিল সেই বাড়ি নিয়েছে, ঢাকায় পুরানা পল্টনে আমার একখান বাড়ির বিনিময়ে, কিন্তু কলকাতায় সেই বাড়ির দাম এখন ভারতীয় টাকায় নয় লাখ! ক্যান ইউ ইমাঝিন! সেই বাড়িখান যদি ফিরৎ পাইতাম এখন।
শওকত একই রকম লঘ সুরে জিজ্ঞেস করলো, আপনি ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ চান? বাংলাদেশ ছেড়ে দেবেন? আপনি চলে গেলে আমাদের কী করে চলবে!
হোসেন সাহেব বললেন, না, না। বাংলাদেশ ছাড়বো কেন? সে কোয়েশ্চেনই ওঠে না। আমি কইতেছি ডুয়াল সিটিজেনশিপের কথা। যেমন ধরো আমেরিকা আর ক্যানেডা, ইচ্ছামতন। যখন যে দেশে থাকতে চাই থাকলাম। একমাস আগে আমি আমেরিকা ট্যামেরিকা ঘুইরা আসলাম তো!
মামুন চুপ করে আছেন। তিনি অনুভব করলেন, এই ক’মাসে আর যাই-ই হোক, হোসেন। সাহেবের ইংরিজি জ্ঞানের বেশ উন্নতি হয়েছে।
বিরিয়ানি খেয়ে একদল বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাত এখন সাড়ে বারোটা। কয়েকজন এখনো রয়ে গেছে। হোসেন সাহেব কথায় মশগুল হয়ে আছেন। মামুনের ঘুম পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি মুখ ফুটে অন্যদের চলে যেতে বলবেন কী করে? হোসেন সাহেবরা তার ঘরে মেহমান, ভদ্রতা রক্ষা করতে হবে। মামুন হাই চাপছেন। হেনা থাকে না বলে মঞ্জু এখন জাস্টিস মাসুদের বাড়িতে শুতে যায়, সে বাড়ি বেশি দূর নয়, কিন্তু এর পরে আর সেখানে মঞ্জু যাবে কী করে? রাত দুপুর পার করে সে বাড়ির লোকদের ডেকে তুলবে? মঞ্জুর চোখে চোখ ফেলার চেষ্টা করছেন তিনি, কিন্তু মঞ্জু মুগ্ধভাবে চেয়ে হোসেন সাহেবের বাগাড়ম্বর শুনছে অন্যদিকে চেয়ে।
মাঝখানে দুটি গান হলো বটে, কিন্তু পলাশ একটু গান থামাতেই হোসেন সাহেব আবার কথা শুরু করলেন। শুধু ইন্দিরা গান্ধীর গুণপনার বিবরণ। আর ভারতের মহান জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতার উচ্ছ্বাস।
আরও দু’জন বিদায় নিল দশ নিট পরে।
শওকত জিজ্ঞেস করলো, হোসেন সাহেব, আলতাফের খবর কী? সে আপনার সাথে ইন্ডিয়ায় আসে নাই?
হোসেন সাহেব বললেন, না হে! সে তো ওয়েস্ট জামানি চলে গিয়েছিল। চিকিৎসার জন্য। যুদ্ধ করতে গিয়ে সে তো উল্ডেড হয়েছিল কিনা। অতি সামান্য অবশ্য। বাম পায়ের বুড়া আঙ্গুলে একটা চোকলা ওঠছে। কিছুদিন আগে তাকে দিল্লিতে দ্যাখলাম। এখন ভালোই আছে। তাকে দিল্লিতেই থাকতে বলেছি, সে আমার বিজনেস ইন্টারেস্ট দেখবে এখানে।
এতক্ষণ বাদে মামুন জিজ্ঞেস করলেন, আলতাফের ছোট ভাই বাবুল চৌধুরীর কোনো সন্ধান রাখেন?
হোসেন সাহেব একবার মঞ্জুর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, সে তো একজন কোলাবোরেটার, তাই না? কমুনিস্ট!
যেন এর বেশি কিছু আর বলার প্রয়োজন নেই। তিনি আবার সিগারেট ধরাতে মন দিলেন, তারপর মুখ তুলে বললেন, চলো নাসিম! শওকত যাবে কোথায়? আমার গাড়ির ড্রাইভার আবার ঘুমায়ে পড়লো নাকি!
শওকত জিজ্ঞেস করলো, কবে ঢাকায় ফিরবেন আপনি?
হোসেন সাহেব হেসে বললেন, দেরি আছে। কতকগুলা বিজনেস ডিল করে যাবো। ইন্ডিয়ার সাথে এবার ভালোমতন বিজনেস শুরু হবে। তা তো বুঝতেই পারো। এরা কি আর শুধা ধা যুদ্ধ করলো। আমি অলরেডি বারো কোটি টাকার টোব্যাকো, মানে সিগারেট, তামাক, পানের ইমপোর্ট অর্ডার পেয়েছি। তার বদলে আমি মাছ পাঠাবো। কলকাতার মানুষ আমাগো মাছের জন্য জেহা বার করে আছে।
শওকত হাসতে হাসতে বললেন, তামাকের বদলে মাছ! এ যে নিকোটিনের বদলে প্রোটিন! এ তো আমাদের ঠকা!
হোসেন সাহেবের মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে। তিনি বললেন, ঠকতে তো হবেই! এখন কত বছর ঠকতে হয় তাই দ্যাখো! এই হিন্দু ইন্ডিয়া মাগনা যুদ্ধ করে নাই। সব সুদে-আসলে তুলে নেবে! মুসলমানের হোমল্যান্ড ছিল পাকিস্তান, সেটা ভেঙে দিয়ে দিল্লিতে সবাই নাচানাচি করতাছে, বোঝলা? নিজে দেখে আসছি! আই হ্যাভ সিন ইন মাই ওউন আইজ! বাংলাদেশ-টাংলাদেশ ওরা কিছু বোঝে না। মুসলমানদের ডাউন দিয়াই অগো আনন্দ। হেঃ, সেকুলার না হাতি! ইন্ডিয়া মানেই হিন্দু! আর ঐ যে ইন্দিরা গান্ধী, মুখেই শুধু মিঠা মিঠা বুলি, আসলে ইয়াহিয়া খানের বদলে ঐ ইন্দিরা গান্ধীই এখন ইস্ট পাকিস্তানরে এক্সপ্লয়েট করবে। আগে ছিল পাকিস্তানী আর্মি, এখন রইলো ইন্ডিয়ান আর্মি। এই আমি কইয়া দিলাম। লিখ্যা রাখো, একবার যে ইন্ডিয়ান আর্মি ঢাকায় গিয়া গাইড়া বসছে, আর সহজে আসবে না!
মঞ্জু আর তাহমিনার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে, শওকত কয়েকবার উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাসি দিয়ে হোসেন সাহেবকে বোঝাতে চেয়েছে, মামুন দুতিনবার বাধা দেবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু হোসেন সাহেব সেসব কিছুই লক্ষ না করে ছুটিয়ে দিয়েছেন কথার রেলগাড়ি। ঘরের মধ্যে লোকজন কমে গেছে বলে হোসেন সাহেব প্রাণ খুলে কথা বলতে শুরু করেছেন, পলাশের মুখে সরু দাড়ি দেখে তিনি তাকেও ধরে নিয়েছেন নিজেদের একজন হিসেবে।
পলাশ গায়ক মানুষ, সে রাজনৈতিক আলোচনায় বিশেষ অংশ নেয় না। সে লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি এবার চলি?
শওকত তার হাত ধরে টেনে বললো, আর একটু বসো। একসঙ্গে যাবো।
তারপর সে গলা চড়িয়ে বললো, ইন্ডিয়ান আর্মি আর ফিরে আসবে না, তাই না? আপনি এই গুজবটাও শোনেননি যে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অফিসাররা বাংলাদেশের সব জেলায় গিয়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হবে! তারাই দেশটা চালাবে!
হোসেন সাহেব বললেন, এটা গুজব কে কইলো তোমায়? এইটাই ফ্যাকট!
শওকত মামুনের দিকে ফিরে বললেন, আপনিও তাই মনে করেন, মামুনভাই? ইন্ডিয়ান আর্মি আর ফিরে আসবে না? ওরা বাংলাদেশকে একটা কলোনি করে রাখবে?
মামুন মৃদু হেসে বললেন, সব ইন্ডিয়ান আর্মি নিশ্চয়ই ফিরবে না। কিছু থেকে যাবে। যে বারো-চোদ্দ হাজার ইন্ডিয়ান আর্মি এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, বাংলাদেশের মাটিতে যাদের গোর হয়েছে, তারা আর ফিরবে কী করে বলো!
হোসেন সাহেব সদর্পে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা যতই ইন্ডিয়ার তোষামোদ করো, আমি তবু সাচাই কথা বলবো! এখন থেকে আমাদের হিন্দ ইন্ডিয়ার আণ্ডারেই থাকতে হবে। এত ছোট বাংলাদেশ স্বাধীন থাকতে পারে না!
শওকত বললো, কেন, নেপাল নেই? বার্মা নেই? হোসেন সাহেব বললেন, নেপাল হিন্দু রাজ্য আর বার্মিজরা বৌদ্ধ। তোমরা তো সব কিছু তলিয়ে দেখো না! ঐ ইন্দিরা গান্ধীর চোখ দ্যাখলেই বোঝা যায়, প্যাটে প্যাটে শয়তানী বুদ্ধি। যুদ্ধ মানেও ব্যবসা! সে এমনি এমনি যুদ্ধ করে নাই। যা খরচ হয়েছে, এখন সুদে-আসলে। উঠাইয়া নেবে।
মঞ্জু কাঁদো কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, ভালো লাগছে না! আমার এসব কথা একেবারে ভালো লাগছে না! আপনারা চুপ করবেন?
তাহমিনা বললো, প্লিজ স্টপ ইট! ইন্ডিয়ার সঙ্গে হয়তো পরে আমাদের সম্পর্ক অন্যরকম হতে পারে, কিন্তু এখনই আপনারা কু গাইছেন কেন? হোয়াই সো সুন? বিগ ব্রাদারকে কেউ বেশিদিন সহ্য করে না! আমেরিকানরা যখন ফ্রান্সকে লিবারেট করলো, তার কিছুদিন পরেই ফ্রান্স অ্যান্টি-আমেরিকান হয়ে গেল! সোভিয়েত ইউনিয়ন ইস্টার্ন ইউরোপের দেশগুলো লিবারেট করে সেখানে বড় বড় শহরে নিজেদের সোলজারদের একটা করে মূর্তি বসিয়ে গেছে, তাই নিয়ে এখন হাসি-ঠাট্টা হয়। তবু অ্যাটলিস্ট প্রথম দিকে সেসব দেশে অনেক ইউফোরিয়া ছিল। আমাদের মাত্র চারদিন হয়েছে! এর মধ্যেই এইসব শুরু করলেন আপনারা? ইন্ডিয়া আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে, তা কি অস্বীকার করতে পারবেন? তার বিনিময়ে আমাদের কি কিছুই দেবার নেই?
শওকত বক্র হেসে বললো, কিছু কেন, বেশ কিছুই আমরা অলরেডি দিয়েছি। এই যে নব্বই-পঁচানব্বই লাখ শরণার্থী এতদিন রয়ে গেল ইন্ডিয়ার মাটিতে, তাদের পেচ্ছাপ-পায়খানাও রয়ে গেল এখানে। তাতে এখানকার জমি উর্বর হবে। সেটাই বা কম কী? বলো, পলাশ?
এবার পলাশ হেসে উঠলো হা হা শব্দে।
এরপর বিদায় নেবার পালা। রাত দেড়টা বাজে, মঞ্জু আর জাস্টিস মাসুদের বাড়িতে যেতে চাইলো না। তাহমিনাও মঞ্জুর সঙ্গে থেকে যেতে চায়। হোসেন সাহেব তার গাড়িতে শওকত, পলাশ, নাসিমকে নিয়ে চলে গেলেন।
পাশাপাশি দুটি খাট, একটিতে মঞ্জু আর তহমিনা শোবে। একসময় মামুনের ঘুম এসে গিয়েছিল, এখন তার চোখ খরখরে। আজ আর সারা রাতে তার ঘুম আসবে কি না সন্দেহ। ঘুম চটে গেছে। মনের মধ্যে একটা উথাল-পাথাল চলছে, এক জীবনে দেশের দু’বার স্বাধীনতা দেখলেন মামুন, প্রথমবারের তীব্র আনন্দের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের যে অনেক তফাত তা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারছেন না। হোসেন সাহেবের কথাগুলির তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেননি, তবু একটা বিষণ্ণতা যাচ্ছে না কিছুতেই।
রাত্রির প্রসাধন সারতে মঞ্জু গেছে বাথরুমে, তাহমিনা লজ্জা লজ্জা মুখ করে জিজ্ঞেস করলো, মামুনমামা, আপনার সামনে স্মোক করতে পারি? একটা সিগারেট!
এ মেয়ে ইওরোপে থাকে, ধূমপানের নেশা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। অন্যদের সামনে সে একথা প্রকাশ করেনি। মামুন ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে চোখ ঘুরিয়ে বললেন, আমাকেও একটা দাও, মঞ্জু এসে পড়ার আগে।
তাহমিনা শুধু মামুনকে সিগারেট দিল না, মেম সাহেবদের ভঙ্গিতে তার গণ্ডদেশে একটা চুম্বন করে বললো, ইউ আর আ ডিয়ার!
তারপর সিগারেট ধরিয়ে সে বললো, মামুনমামা, ঐ হোসেন সাহেব একজন ফিলদি রিচ পার্সন, তাই না? এইসব লোকের পাকিস্তানী আমলেও যত সুযোগ সুবিধা ছিল, পরের জমানাতেও সেই একইরকম থাকবে, দেখবেন! ওনার কথা শুনে আমার একটা পিকিউলিয়ার ফিলিং হচ্ছিল, জানেন! একঘণ্টা আগে ইন্দিরা গান্ধীর খুব প্রশংসা করছিলেন, যেই ঘরের অন্যলোক চলে গেল অমনি ইন্দিরা গান্ধীর নিন্দা শুরু করলেন। আমার মনে হলো, এইরকম লোক আমি আগে অনেক দেখেছি। পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি তো, সব দেশেই এই রকম হোসেনসাহেবরা থাকে। আমার আরও মজা লাগছিল এই জন্য যে, আমি ইন্ডিয়ান।
মামুন একটু চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাই নাকি? তবে যে শোনলাম, তুমি—
তাহমিনা হাসলো। মজার ব্যাপার। আমার বাবা ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে গিয়ে পাকিস্তানের সিটিজেনশীপ নিয়েছিল। কিন্তু আমি আবার ফিরে এসেছি।
মামুন আরও কিছু শোনার জন্য উৎসুকভাবে তাকিয়ে রইলেন।
তাহমিনা বললো, আমার জন্ম বরিশালে। আমার আম্মা-আব্বু কলেজ লাইফেই আমাকে ইওরোপে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আই অ্যাম ম্যারেড় টু অ্যান ইন্ডিয়ান ডক্টর, ইউসুফ আলী, আমার হাজব্যান্ডের সাথে আমি আমস্টারডামে থাকি। মনে-প্রাণে আমি বাংলাদেশের সাপোর্টার। কিন্তু আই হোল্ড অ্যান ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট।
মামুন বললেন, এই জেনারেশানটা আমি বুঝি না। সত্যিই বুঝি না!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে মঞ্জু বললো, এইবার তুমি যাও, আপা!
এত রাতে ঠাণ্ডার মধ্যে মঞ্জু চুল ভিজিয়েছে? একটা তোয়ালে দিয়ে সে চুল মুছছে, তার পরনে এখন একটা সাধারণ ডুরে শাড়ি, সে গুনগুন করে গান গাইছে। মামুন মঞ্জুর সঙ্গে একটাও কথা বললেন না, নিজের খাটে শুয়ে কম্বল দিয়ে মুখ ঢাকা দিলেন।
তার ঘুম আসছে না। একটু পরেই তিনি অনুভব করলেন, তার খাটের পাশে কেউ এসে বসেছে। নারীর যৌবনের সুগন্ধ এসে লাগছে তার নাকে। মামুন নিশ্বাস বন্ধ করতে চাইছেন।
মঞ্জু বললো, মামুনমামা, আমরা ঢাকা ফেরার আগে একবার আজমীড় শরীফ যাবো না?
মামুন শরীরটাকে নিস্পন্দ করে রাখলেন, কোনো সাড়া দিলেন না।
মঞ্জু আবার জিজ্ঞেস করলো, আমরা তাজমহল দেখবো না? ও মামুনমামা, বলো না।
এবারও উত্তর না পেয়ে মঞ্জু জোর করে মামুনের মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দিয়ে অভিমানের সুরে বললো, তুমি আমার ওপর রাগ করেছো? আমি কী দোষ করেছি? তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না?
হঠাৎই যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন মামুন। ভালোবাসা শব্দটি বহুদিন হারিয়ে গিয়েছিল। দেশকে ভালবাসা মানুষকে ভালোবাসা, এইসব কথা যখন-তখন মুখে এসে যায়, খুব বেশি বিশ্বাসের জোর না থাকলেও চলে! কিন্তু একজন নারীর মুখ থেকে ভালোবাসা শব্দটির উচ্চারণের শিহরনই অন্যরকম।
মামুন উঠে বসে অভিভূতের মতন তাকিয়ে রইলেন মঞ্জুর দিকে। কোনো কথাই বলতে পারলেন না।
মামুনের বাহু ছুঁয়ে মঞ্জু বললো, তোমার শরীর খারাপ করছে না তো?
মামুন এবার দুদিকে মাথা নাড়লেন।
মঞ্জু মামুনের কাছে ঝুঁকে এসে বললো, আমরা কলকাতা ছেড়ে বেশি দূরে যাইনি কখনো। আমরা ইন্ডিয়ার আর কিছু দেখবো না? দার্জিলিং? মামুনমামা, হেনার খুব ইচ্ছা শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করার।
খুট করে বাথরুমের দরজার শব্দ হতেই মঞ্জু সরে গেল। সেকি বেশি তাড়াতাড়ি সরে গেল? তাহমিনার কাছে তার কিসের লজ্জা?
তাহমিনা বললো, হায় আল্লা, ইট ইজ টু এ এম! আর কোনো কথা না, এবার ঘুম। কিন্তু আই অ্যাম নট শ্লিপি অ্যাট অল! সারা রাত গল্প করলে কেমন হয়? আর তিন চার ঘণ্টা পরেই তো ভোর হয়ে যাবে।
মামুন দুর্বল গলায় বললেন, তোমরা চাও তো গল্প করা, আমি ঘুমবো।
তাহমিনা খিলখিল করে হেসে বললো, আমরা দু’জন গল্প করলে আপনি ঘুমাতে পারবেন? মামুনমামা, আমি জানি, ইউ আর আ পোয়েট। আপনার দুই একটা কবিতা শোনান না আমাদের? কী বলল, মঞ্জু?
মঞ্জু উত্তর দিল না। মামুন শুকনো গলায় বললেন, দা মিউজ হ্যাঁজ লেট মী! এখন শুয়ে পড়াই ভালো। ঠিক সাড়ে ছটায় ঝি এসে দরজা খটাখট করবে।
ওদের মতামতের অপেক্ষা না করে মামুন নিজেই আবার শুয়ে পড়লেন মুখে কম্বল চাপা দিয়ে। মঞ্জু আর তাহমিনা আরও কিছুক্ষণ গল্প করলো ফিসফিস করে। মামুন ওদের কথা ঠিক শুনতে পাচ্ছেন না, কিন্তু তার মাথার মধ্যে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটাই বাক্য, মামুনমামা, তুমি আমায় আর ভালোবাসো না? তুমি আমায় আর ভালোবাসো না? তুমি আমায় আর ভালোবাসো না?
কেন মঞ্জু বললো এ কথা? মামুন তো কোনোদিন মঞ্জুর সামনে ভালোবাসা শব্দটি ঠিক স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেননি! অবশ্য ভালোবাসা শব্দটি অনেকেই হাল্কাভাবে ব্যবহার করে। বাংলাভাষায় ভালোবাসা যে কতরকম! মাকে ভালোবাসা, পোষা কুকুরকে ভালোবাসা, সন্দেশ রসগোল্লা ভালোবাসা, সবই তো ভালোবাসা! স্নেহের নামও তো ভালোবাসা!
পঁচিশে মার্চের পর থেকে মামুন মঞ্জু সম্পর্কে স্নেহ বা ভালোবাসা, কোনোটাই বোধ করেননি। এই ন’মাসের দুশ্চিন্তায়, দুঃস্বপ্নে সেসব কোমল অনুভূতির কোনো স্থানই ছিল না। বরং এর মধ্যে বেশি খরচ-টরচ হয়ে গেলে তিনি মঞ্জুকে বকুনিও দিয়েছেন কয়েকবার। কোনোরকমে বেঁচে থাকাটাই যেখানে সমস্যা, সেখানে অন্য কোনো কথাই মনে আসে না। মঞ্জু তো এই কয়েকমাসে একবারও মামুনের বাহু ছুঁয়ে এমন অন্তরঙ্গ সুরে কিছু বলেনি। স্বাধীনতা এসেছে বলেই কি স্বাভাবিক চিত্তবৃত্তিগুলি ফিরে এসেছে?
তাহমিনা আর মঞ্জুর কথাবার্তা থেমে গেল এক সময়, মামুনের তবু ঘুম আসছে না। এখন কত রাত তা কে জানে! মামুন ছটফট করতে লাগলেন। গত মাস দেড়েক এই ঘরে তার একা থাকা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। এখন পাশের খাটে শুয়ে আছে দুই যুবতী! শরীর ভেঙে গেছে, মামুন এখন প্রৌঢ়ত্বের এলাকা পার হয়ে বার্ধক্যের দিকে ঝুঁকেছেন, বাইরে থেকে দেখে সবাই তাই বুঝবে। কিন্তু মনটা যে এখনো তাজা রয়ে গেছে, তা তো কেউ দেখে না। মন এখনও চঞ্চল হয়, ভালোবাসার জন্য একটা কাঙালপনা আজও রয়ে গেছে। মজ সম্পর্কে একটা সুপ্ত টান তিনি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারেন না। অন্য যুবকেরা মঞ্জুর সঙ্গে বেশি অন্তরঙ্গতা করলে তার বুক ঈর্ষায় জ্বলে যায়। মকে বাবুল চৌধুরীর হাতে পুনরায় সঁপে দেওয়া তার এক পবিত্র দায়িত্ব, সেই জন্যই মঞ্জুকে তিনি আগলে আগলে রাখেন। শুধু কি সেইজন্য? বাবুল যদি আর বেঁচে না থাকে? এত সব স্বাস্থ্যবান সুবেশ যুবকের সঙ্গে মঞ্জুর এখন মেলামেশা, ঐ পলাশ ছেলেটা তো মঞ্জুর পাশ থেকে নড়তেই চায় না, তবু মঞ্জু আজ হঠাৎ কী ব্যাকুল গলায় তাকে বললো, মামুনমামা, তুমি আমায় আর ভালোবাসো না? মঞ্জু কি তাহলে শুধু মামুনের ভালোবাসারই প্রত্যাশী? নাকি, এটা নিছক কথার কথা!
খুট করে বেড় সুইচ টিপে আলো জ্বেলে মামুন খাট থেকে নামলেন। দুই নারীই এখন ঘুমন্ত। মঞ্জু চিত হয়ে আছে, তাহমিনা দেওয়ালের দিকে পাশ ফেরা। দিন দিন আরও যেন সুন্দর হচ্ছে মঞ্জু। কলকাতায় এত নারী দেখলেন মামুন, কিন্তু মঞ্জুর চেয়ে সুন্দর যেন একজনও না। মঞ্জু যেন মামুনের প্রথম যৌবনের মানসী সেই বুলা অর্থাৎ গায়ত্রীরই প্রতিমূর্তি। কী আশ্চর্য মিল!
এই যে মামুন এখন মঞ্জুর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন, এখন তিনি আর মঞ্জুর মামুনমামা নন। তিনি কবি মোজাম্মেল হক। অনেকদিন কবিতা লেখেননি, তাতে কী হয়েছে, কবির কখনো মৃত্যু হয় না।
মৃদু নিঃশ্বাসে মঞ্জুর বুক উঠছে নামছে। কপালে এসে পড়েছে কুঞ্চিত চুল। মঞ্জুর ঠোঁটে একটু একটু হাসি লেগে আছে। চোখ দুটি যেন ঘুমন্ত দুটি পাখি।
মামুন আরও এগিয়ে এসে মঞ্জুকে স্পর্শ করতে গেলেন। বুকের মধ্যে অসম্ভব তোলপাড় হচ্ছে। যেন এক্ষুনি জাগিয়ে তুলে জানানো দরকার, ওরে, আমি তোকেই শুধু ভালোবাসি। তোকে ছেড়ে আমি একদণ্ড থাকতে পারি না।
হাতখানা তুলেও মামুন থেমে রইলেন। যেন একটা পাথরের মূর্তি। তাহমিনা পাশে শুয়ে আছে, এসময় মঞ্জুকে ছুঁয়ে জাগানো যায় না।
বুকের মধ্যে শুধু তোলপাড় নয়, একটা সূচবেঁধার মতন ব্যথাও হচ্ছে, আবার কি হৃদযন্ত্রণা শুরু হলো? সেকেন্ড অ্যাটাক! ডাক্তার সিগারেট খেতে প্রবলভাবে নিষেধ করেছিলেন, এবার অ্যাটাক হলে আর বাচার আশা নেই। ঢাকায় আর পোঁছোনো হবে না? যদি আজ রাতেই মৃত্যু আসে, তার আগে একবার মঞ্জুকে বুকে নেবেন না?
টলতে টলতে সরে এসে মামুন একটা সরবিট্রেট মুখে দিলেন, তারপর জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বুকটা ডলতে লাগলেন জোরে জোরে। তার চোখ জলে ভিজে আসছে। না, না, তিনি এখন মরতে চান না কিছুতেই।
জানলার বাইরে দেখা যাচ্ছে আবছা অন্ধকারে শীতকালের ঠাণ্ডা আকাশ। ভোরের আর কত দেরি? কাছেই একটা মশজিদ আছে, সেখান থেকে মাইকে প্রত্যেকদিন ফজরের আজানের সুর ভেসে আসে। সেই শব্দে এক একদিন অতি ভোরে ঘুম ভেঙে যায় বলে মামুন বিরক্তই হন। আজ তিনি ব্যাকুলভাবে সেই আজানের মধুর সুরের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।
আশ্চর্য ব্যাপার, বুকে এইরকম ব্যথা, তবু মামুনের দুটি ইচ্ছে ক্রমশ তীব্র হতে লাগলো। আর একটা সিগারেট খাওয়া আর মঞ্জুকে একবার গাঢ় আলিঙ্গনে বুকের মধ্যে পাওয়া। এ কী অদ্ভুত পাগলামি, মামুন নিজেই বুঝতে পারছেন এরকম করা যায় না। তবু কেন ইচ্ছে হয়! না, না, বাচতে হবে, ঢাকায় ফিরে যেতে হবে, বাবুল চৌধুরীর হাতে তুলে দিতে হবে মঞ্জুকে, ফিরোজার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে হেনাকে। মামুনের এখনও কত দায়িত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপটি তিনি দেখে যাবেন না?
দু’চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু নেমে আসছে, মামুন হাত জোড় করে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, হে আল্লা, হে মহান পিতা, আমাকে শক্তি দাও! ভোগবাসনা ভুলিয়ে আমাকে শান্তি দাও! সদ্যোজাত বাংলাদেশকে তুমি রক্ষা করো। দীন দুঃখী, নিপীড়িত মানুষগুলিকে তুমি নতুনভাবে জীবন গড়ার ভরসা দাও! হে করুণাময়, আমার চিত্তের অস্থিরতা ঘুচিয়ে দাও! অনুচিত বাসনা থেকে, লোভ থেকে আমায় মুক্তি দাও! “আলহামদুলিল্লাহে নাহমাদুহু অ নাস্তাঈনূহু…” আমাকে আবার কবিত্বশক্তি ফিরিয়ে দাও!