দরজা খুলেই ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী আনন্দিত গলায় বললেন, আরো তুমি! কেমন আছ শাহেদ?
নাইমুল স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করতে করতে বলল, স্যার, আমি শাহেদ না, আমি নাইমুল।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, নাইমুল নামটাই মাথায় এসেছে। বলার সময় শাহেদ বলে ফেলেছি। তোমার ঐ বন্ধুটা কোথায়?
সে ইন্ডিয়ার দিকে রওনা হয়েছে। তার স্ত্রী-কন্যার অনুসন্ধানে। আজ সকালেই রওনা দিয়েছে।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিস্ময়ে অভিভূত হবার মতো ভঙ্গি করলেন। মুখে বললেন, বিলো কী! আশ্চর্য তো! নাইমুল মনে মনে হাসল। কী অদ্ভুত মানুষ। জগতের কোনো কিছুর সঙ্গে মানুষটার যোগাযোগ নেই, অথচ তা তিনি প্ৰকাশ করতেও অনিচ্ছুক।
স্যার, দুপুরে আপনার সঙ্গে খাব।
অবশ্যই খাবে। স্পেশাল ডিশ হবে। তুমি বাজার করে নিয়ে আসো। ঘরে চাল-ডাল ছাড়া কিছুই নেই। ইলিশ মাছ খাওয়া যাক, কী বলো? মাছ কাটিয়ে নিয়ে আসবে। তেলে ভেজে গরম গরম খাব।
নাইমুল বলল, মাছ খাওয়া যাবে না স্যার। বাংলাদেশের মানুষ এখন মাছ খায় না।
কেন? মাছ খায় না কেন? মিলিটারিরা মানুষ মেরে মেরে নদীতে ফেলে। নদীর মাছ মরা-গলা ডেড বডির মাংস খায়। এই জন্যেই মাছ খাওয়া নিষেধ।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বললেন, ইলিশ মাছ তো নদীর মাছ না। সাগরের মাছ।
সাগরের মাছ হলেও এরা ধরা পড়ে নদীতে।
সেটাও কথা। তবে মাছ ডেডবডি খাবে কেন? মাছ কি আমিষাশী? লাইব্রেরি ঘরে যাও তো। মাছের উপর কিছু বইপত্র থাকার কথা। পড়ে দেখি মাছ আমিষাশী কি-না। দেখা যাবে মাছ আমিষই খায় না। মাটি শৈবাল এইসব খায়। মাঝখান থেকে আমরা মাছ খাওয়া বন্ধ করে বসে আছি।
নাইমুল লাইব্রেরি ঘরে গেল না। সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকে গেল। তার চায়ের পিপাসা হয়েছে। নাইমুল রান্নাঘর থেকে বলল, স্যার, আপনি চা খাবেন?
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি রান্নাঘরে কী করছ? তোমাকে বললাম না, মাছের উপর বই খুঁজে বের করতে?
নাইমুল চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে মাছের উপর বই খুঁজতে গেল। স্যারের উপর তার সামান্য রাগ হচ্ছে। ডেডবডি পানিতে ফেলছে বলে মাছ খাওয়া বন্ধ, এই বিষয়টি তার কাছে গুরুত্বহীন। গুরুত্ব পেয়ে গেছে মাছের খাদ্য কী!
নাইমুল!
জি স্যার।
বই পাওয়া গেছে?
খুঁজছি স্যার। সব বই এলোমেলো করে রাখা।
বই তো এলোমেলোই থাকবে। গোছানো থাকবে শাড়ি, জামা-কাপড়। ভালো কথা, তুমি কি বিয়ে করেছ?
জি স্যার।
ঐ রাতে তো আমি ভালো বিপদে পড়েছিলাম। তুমি ভুল ঠিকানা দিয়ে চলে গেলে। আমি রাত দশটা পর্যন্ত বাড়ি খুঁজলাম। তোমার স্ত্রীর নাম কী?
মরিয়ম।
সুন্দর নাম। যিশুর মাতা মরিয়ম। তুমি বৌমাকে নিয়ে অবশ্যই একদিন আসবে। আগে থেকে খবর দিয়ে আসবে যেন সার্ট-পাঞ্জাবি কিছু একটা গায়ে থাকে। খালি গায়ে থাকা হয়েছে। অভ্যাস। মেয়েদের সামনে খালি গায়ে থাকা বিরাট অসভ্যতা।
আমি খবর দিয়েই তাকে আনিব। বই পাওয়া গেছে স্যার।
ভেরি গুড। আমার কাছে বই দাও, আর একটা কাগজ-কলম দাও।
কাগজ-কলম কী জন্যে?
নোট করি। ছাপার অক্ষরের উপর দিয়ে শুধু চোখ বুলিয়ে গেলে তো হবে না। নোট নিতে হবে। কী পড়েছ সেটা ভাবতে হবে।
স্যার, আমি কয়েকদিন আপনার সঙ্গে থাকব।
থাক।
আপনার অসুবিধা হবে না তো?
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী জবাব দিলেন না। তিনি খাতায় নোট নেয়া শুরু করেছেন।
নাইমুল বলল, গতকাল আপনার বাড়ির কথা একেবারেই মনে আসে নি। গতকাল রাতে থাকার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী এই কথার উত্তরেও কিছু বললেন না।
চায়ের পানি ফুটছে। নাইমুল চা বানাতে গেল। মৎস্য বিষয়ক জটিলতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঋষিতুল্য এই মানুষটি কোনো কথা বলবেন না–এটা বোঝা যাচ্ছে।
পুণ্যবান মানুষের আশেপাশে থাকলেই পুণ্য হয়। আলাদা করে পুণ্য করতে হয় না। নাইমুল ঠিক করল, কয়েকদিন এই মানুষটার আশেপাশে থেকে সে পুণ্য সঞ্চয় করে নেবে। এই আলাভোলা মানুষ তাঁর জীবনের সমস্ত সঞ্চয়, পৈতৃক বাড়িঘর–সবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন। তিনি এখন চলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া পেনসনের টাকায়। মাঝে-মাঝে তার মেয়ে কানাডা থেকে ডলার পাঠায়।
স্যার!
বলো।
একটা প্রশ্ন ছিল, আপনি কি এই বাড়িটাও ইউনিৰ্ভাসিটিকে দিয়ে দিয়েছেন?
হুঁ। তবে আমার মৃত্যুর পর।
ইউনিৰ্ভাসিটি যদি এখনই বাড়ি চায়, আপনি কী করবেন?
ধীরেন্দ্ৰনাথ রায় চৌধুরী রেগে গেলেন। ধমকের স্বরে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এটা তো খুবই অন্যায় সিদ্ধান্ত। আমি তো বলে দিয়েছি, মৃত্যু পর্যন্ত আমাকে এই বাড়িতে থাকতে দিতে হবে। লিখিত কোনো ডিড অবশ্যি হয় নাই, মৌখিক কথা। দেখি টেলিফোনটা দাও তো। ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের সঙ্গে কথা বলি। হুট করে আমাকে এত বড় ঝামেলায় ফেলা তো ঠিক না।
নাইমুল বলল, স্যার, আপনি আপনার কাজ করুন। ইউনিৰ্ভাসিটি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় নি। চা খান স্যার। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী চায়ে চুমুক দিয়ে খাতায় নোট নিতে লাগলেন
রুই মাছ
বৈজ্ঞানিক নাম : Labeo rohita
খাদ্য : উদ্ভিদ ভুক। মাটিও খায়।
কাতল
বৈজ্ঞানিক নাম : Catila catla
খাদ্য : ফ্লাইটো প্লাঙ্কটন, জুপ্রাঙ্কটন। শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদ, ছোট চিংড়ি ও পোকামাকড়।
মৃগেল মাছ
বৈজ্ঞানিক নাম : Cirrhinus mrigala
খাদ্য : পচা জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড়, মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ, মাটি।
চিতল
বৈজ্ঞানিক নাম : Notopterus chitala
খাদ্য : আমিষাশী
এপর্যন্ত লিখে ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ঘোষণা দিলেন–মাছ খাওয়া যাবে না; মাছের ডেডবডি খাবার সম্ভাবনা আছে। দুপুরে হবে ডিমের ঝোল।