৬২. ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার জানেন

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার জানেন যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যরা তার ওষুধের ওপরে পুরোপুরি ভরসা রাখতে না পেরে অ্যালোপ্যাথিক, বায়োকেমিক, কবিরাজি, হেকিমি, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি কোনও কিছুই বাকি রাখেনি। পরমহংসের স্ত্রী সারদামণি তারকেশ্বর হত্যে দিয়েও এসেছেন। মহেন্দ্রলাল আপত্তি করেননি। তার মতন বড় ডাক্তাররা সাধারণত এরকম হলে আর কোনও দায়িত্ব নিতে চান না, কিন্তু মহেন্দ্রলালের অহংবোধ এক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেনি। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, দেখুন না চেষ্টা করে, যদি কিছু ফল হয় তা ভালো কথা!

না ডাকলেও তিনি নিজে থেকেই মাঝে মাঝে চলে আসেন কাশীপুরে। অন্যের ওষুধ চলতে থাকলে তিনি আর কোনও ওষুধ দেন না, পরমহংসের রোগের অবস্থাটা দেখে নেন, গল্প করেন তাঁর সঙ্গে, তরুণ শিষ্যদের সঙ্গে তর্ক মেতে ওঠেন। নরেন, রাখাল, শশী, কালীর মতন কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর বেশ ভাব হয়ে গেছে, এদের পড়াশুনো ও বুদ্ধির প্রাখর্যে তিনি মুগ্ধ। গিরিশকে তিনি আগে থেকেই চেনেন।

বউবাজারে এক মস্ত ধনীর বাড়িতে রুগী দেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন মহেন্দ্রলাল। সে বাড়ির লোকদের ব্যবহারে তিনি এতই বিরক্ত যে কর্তার ছেলে তাঁকে ফি দিতে এলে সে টাকা তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মাটিতে।

মহেন্দ্রলালের নিজস্ব জুড়িগাড়িতে অপেক্ষা করছিল তার সহকারী জয়কৃষ্ণ। সে এই দৃশ্য দেখে সচকিত হয়ে বলল, কী হল, স্যার, পেশেন্ট এক্সপায়ার্ড?

গাড়িতে উঠে মহেন্দ্রলাল মুখ ভেরকুট্টি করে বললেন, না, মাগী সহজে মরবে না, বাড়ির লোকদের আরও কিছুদিন দগ্ধে দগ্ধে!

— তা হলে স্যার আপনি ফি নিলেন না কেন?

— চিকিৎসা কি করেছি যে ফি নেব! জমিদার গিন্নির বুকে ব্যথা। তা কেমনতরো ব্যথা, কোথায় ব্যথা, তা বুঝতে হবে না? আমাকে সে বুক দেখাবে না, মুখ দেখাবে না। স্টেথোস্কোপও বসাতে দেবে না। ষাটের ওপর বয়েস, ইয়া থলথলে মোটা চেহারা, ওর বুক তো এখন কাশীর বেগুন, মরে যাই মরে যাই, তাও কী লজ্জা! পর্দার আড়ালে শুয়ে রইল, এক ঝি বেটী আমার স্টেথোস্কোপ নিয়ে বুকে লাগাচ্ছে না পোদে লাগাচ্ছে বোঝার উপায় নেই! কায়স্থ বাড়ির বুড়ি মাগী, আমিও তো কায়স্থ, আমার কাছে অত লজ্জা কিসের? বাড়ির কত্তাটিও তেমনি!

জয়কৃষ্ণ ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগল। মহেন্দ্রলাল ধমক দিয়ে বললেন, হাসছিস কেন রে হারামজাদা? এই তো দেশের অবস্থা। সাধে কি আনি বলি, মেয়েরা ডাক্তারি না শিখলে এ দেশের মা জননীরাই চিরকাল কষ্ট পাবে।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। জয়কৃষ্ণ একটা নোট-বুক দেখে বলল, এর পর মেডিক্যাল কলেজে আপনার একটা মিটিং আছে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, নাঃ, আজ আর মিটিঙে যাব না। কাশীপুরের বুড়োটাকে অনেকদিন দেখতে যাইনি। মন টানছে, এখন একবার দেখে আসি।

জয়কৃষ্ণ বলল, সেই পরমহংস? শুনেছি মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ডক্তর জে এম কোটসকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। বত্ৰিশ টাকা ভিজিট। তিনি দেখেটেখে জবাব দিয়ে দিয়েছেন। আর কিছু করার নেই।

মহেন্দ্রলাল অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, হুঁ।

— গিরিশবাবু কী বলেছেন, জানেন স্যার? এই পরমহংস নাকি সাক্ষাৎ ভগবান, এখন কেউ চিনতে পারছে না। একদিন উনি নাকি তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হেঁটে বেড়াবেন। হো-হো-হে! গিরিশবাবুরও মাথাটা উনি চিবিয়ে খেলেন কী করে? দেশটা যত রাজ্যের ভাণ্ড-বুজরুগ সাধু-সন্ন্যাসীতে ছেয়ে গেছে!

— চোপ! যা বুঝিস না তা নিয়ে কথা বলতে যাস কেন? অনেক বুজরুগ সাধু আছে বলে কি ভালো মানুষ কেউ নেই? এ মানুষটা খাটি!

– স্যার, আপনিও কি মনে করেন, মানুষ কখনও ভগবান হতে পারে?

– ভগবান টগবান বুঝি না। মানুষ তো খাঁটি হতে পারে, কেউ যদি তার সরল বিশ্বাস নিয়ে থাকে…

জয়কৃষ্ণকে শ্যামবাজারে নামিয়ে দিয়ে মহেন্দ্রলাল চলে এলেন কাশীপুরের বাগানবাড়িতে।

বিস্ময়ের ব্যাপার এই, আজ রামকৃষ্ণ পরমহংস যেন সম্পূর্ণ সুস্থ। শিষ্যদের নিয়ে মজলিশে বসেছেন, হাস্যময় মুখখানিতে রোগভোগের কোনও চিহ্নই নেই। তিনি মাস্টারকে বলছেন, এখানকার ছেলেরা রোজ খিচুড়ি-মিচুড়ি খেয়ে থাকে, বল নষ্ট হয়ে যাবে যে, আজ একটু মাংস খাওয়া, পাচ আনা না ছ’আনা লাগবে, তুমি দিবে? দেখ যদি সরকারি মাংস পাও-

ডাক্তারকে দেশে সবাই সচকিত হল, রামকৃষ্ণ বললেন, বসো—।

দক্ষিণের জানলা থেকে তিন চার হাত দূরে খাটটা সরানো হয়েছে। সতরঞ্চির ওপর মাদুর, তার ওপর তোশক পাতা। রামকৃষ্ণের কোমরে ধুতির কষি আলগা করে জড়ানো, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা চাদর, গলায় কি সব যেন ঘাসপাতার পট্টি লাগানো আছে। চোখ দুটি আবেশ মাখা।

মহেন্দ্রলাল জিজ্ঞেস করলেন, ডক্তর কোটস তোমাকে দেখতে এসেছিলেন নাকি? জবরদস্ত সাহেব, খুব রাগী।

সবাই শশীর দিকে তাকাল। সে সাহেব শশীকে বিশ্ৰী গালাগাল দিয়েছিল। সে এসে হাতের ডাক্তারি ব্যাগটা শশীর দিকে এগিয়ে দিলেও শশী ধরেনি। সে নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণ, খ্রিস্টানদের ব্যাগ ছুঁতে চায়নি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্রুদ্ধ সাহেব শশীর দিকে চেঁচিয়ে ওঠেন, ইউ গো ফ্রম হিয়ার, ইউ উল্লু!

মহেন্দ্রলাল হাসতে হাসতে রামকৃষ্ণকে বললেন, সে স্লেচ্ছ ডাক্তার তোমাকে ছুঁয়ে দিল? তোমার বিছানায় বসেছিল?

রামকৃষ্ণ বলেন, কী জানি, আমার তো এখন ওই হয়ে গেল। সব দেখিনি। তবে সে চলে যাবার পর বিছানায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে, ওঁ তৎ সৎ জপ করে শুদ্ধ করে নিয়েছি!

মহেন্দ্রলাল দু দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, মশাই, এটা তো ঠিক মিলল না। কিছুদিন আগে তুমিই একটা গল্প বলেছিলে। বায়ুতে সুগন্ধ দুৰ্গন্ধ দুইই পাওয়া যায়, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত। আত্মাও সে রকম। কাশীতে শঙ্করাচার্য একদিন পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এক চণ্ডালও পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। মাংসের ভার নিয়ে, হঠাৎ ছোঁয়া লেগে গেল। শঙ্করাচার্য বললেন, তুই ছুঁয়ে ফেললি? তখন চণ্ডাল বলল, ঠাকুর, তুমিও আমায় ছোঁও নাই, আমিও তোমায় ছুঁই নাই! আত্মা নির্লিপ্ত, তুমি আমি দুজনেই সেই শুদ্ধ আত্মা! কি, বলনি এই গল্প? শুদ্ধ আত্মা যদি মানো, তবে আবার ছোঁয়াছানির বিচার কেন?

রামকৃষ্ণ চোখ মুখে একটা কৌতুকের ভঙ্গি করলেন। যেন বোঝাতে চান, ডাক্তার খুব প্যাঁচে ফেলেছে। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, সংস্কার আর লোকাচার। একদিন আমায় পথ্যি খাওয়াবার সময় লাটু আর কে যেন খাট ধরে দাঁড়িয়েছিল। ওদের ছোঁওয়া থাকলে তো খেতে পারি না। যেই ওদের সরে যেতে বলেছি, অমনি নরেন আমায় ধমকাল। বলল, আপনি তো এসব মানেন না! আমি মানি না ও বটে, মানিও বটে। এই ব্ৰাহ্মণ শরীর, সংস্কার সহজে যায় না।

প্যান্ট-কোট পরা মহেন্দ্রলাল মেঝেতে বসতে পারেন না, তার জন্য একটা চেয়ার এনে দেওয়া হল।

মহেন্দ্রলালকে দেখলে এখানে অনেকেই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। এই হামবড়া, দুমুর্খ ডাক্তারটি কখন কী যে বলবেন তার ঠিক নেই। এক একটা কথা শুনলে পিলে চমকে যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে যখন মুখে মুখে তর্ক করেন, কথার পিঠে কথার খোঁচ মারেন, তখন ভক্তদের বড় প্রাণে লাগে। গভীর তত্ত্বের কথা এমন সরল, সুন্দর করে বলেন রামকৃষ্ণ, তার ওপরে কোনও কথা চলে? ডাক্তার কিছুতেই ভক্তির ব্যাপারটা বুঝবেন না, তিনি জ্ঞান ও যুক্তি আঁকড়ে ধরে বসে আছেন।

ডাক্তারের প্রতি রামকৃষ্ণের নিশ্চয়ই প্রশ্রয় আছে, তা না হলে উনি অমন সব কঠিন কঠিন কথা সহ্য করেন কী করে? ভক্তরা দেখেছে, এর আগে কেউ কেউ এসে কুযুক্তির কথা শুরু করলে রামকৃষ্ণ হয় রসিকতায় তাদের নাস্তানাবুদ করেছেন, অথবা তাদের অগ্রাহ্য করে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছেন। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে রামকৃষ্ণ হাসেন।

এই ডাক্তার বাইরে ঠাকুর-দেবতা কিংবা বিভিন্ন ধর্মের মহাপুরুষদের সম্পর্কে। করেন তা অনেকেই জানে। কিন্তু রামকৃষ্ণ পরমহংসের সামনেও মা কালী সম্পর্কে ওই সব বলতে সাহস করেন। একদিন তিনি বিজ্ঞান আর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে করতে বলে ফেলেছিলেন, কমপারেটিভ হিস্ট্রি সব জানা ভালো। সাঁওতালদের হিস্ট্রি পড়ে জানা গেছে যে, কালী একজন সাঁওতাল মাগী ছিল—খুব লড়াই করেছিল।

এমন হাত-পা নেড়ে তিনি লড়াইয়ের ভঙ্গি দেখেছিলেন যে অন্যদের সঙ্গে হেসে ফেলেছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণও। ডাক্তার তখন ধমক দিয়ে বলেছিলেন, হাসছ কেন? তোমরা হেসো না। সব কিছু জানতে হয়।

আর একদিন রামকৃষ্ণ জ্ঞান ও ভক্তির তফাত কী চমৎকার করে বোঝাচ্ছিলেন। তিনি। বলেছিলেন, ভক্তি হচ্ছে মেয়েমানুষ, তাই অন্তঃপুর পর্যন্ত যেতে পারে। জ্ঞান বারবাড়ি পর্যন্ত যায়।

ডাক্তার অমনি টপ করে বললেন, কিন্তু অন্তঃপুরে যাকে-তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বেশ্যারা ঢুকতে পারে না। জ্ঞান অবশ্যই চাই।

রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, খই কেমনভাবে ভাজা হয় জান? খোলায় যখন চাপানো হয়, ভাজার সময় দু’চারটে খই খোলা থেকে টপ টপ করে লাফিয়ে বাইরে পড়ে। সেগুলি যেন মল্লিকা ফুলের মতন, গায়ে একটুও দাগ থাকে না। খোলার ওপর যে-সব খই থাকে, সেও বেশ খই, তবে অত ফুলের মতন হয় না, একটু গায়ে দাগ থাকে। সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী যদি জ্ঞান লাভ করে, তবে ঠিক ওই মল্লিকা ফুলের মতন দাগশূন্য হয়। আর জ্ঞানের পর সংসার-খোলায় থাকলে একটু গায়ে লালচে দাগ হতে পারে।

অন্য সকলে হেসে উঠলেও ডাক্তার বলেছিলেন, উপমা দিয়ে কি সব যুক্তি খণ্ডন করা যায়? উপমা শুনতে বেশ লাগে, কিন্তু সেগুলি যুক্তি নয়। তা হলে আমিও একটা উপমা দিই শোনো আমার বাড়ির বারান্দায় কিছু চড়ুই পাখি বসে থাকে, আমি তাদের দিকে ময়দার গুলি চূড়ে খুঁড়ে দিই, তারা ভয়ে পালায়। জ্ঞানের অভাব। জ্ঞান থাকলে বুঝত, ওগুলো তাদের খাবার জিনিস, ভয় পাবার কিছু নয়। যেদিন সেই জ্ঞানোদয় হবে, সেদিন আর পালাবে না, খুঁটে খুঁটে খাবে।

রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, এ অতি তুচ্ছ সাংসারিক ছেঁদো জ্ঞান।

ডাক্তার বলেছিলেন, বেঁচে থাকার জন্যই এই জ্ঞানের দরকার। মানুষ তো বাঁচার জন্যই জন্মায় না কি? ভক্তি দিয়ে বাঁচা যায় না। জন্মাবার পর এই পৃথিবীটাকে ভালো করে চেনা জানার জন্যও যুক্তি আর জ্ঞানের দরকার। আর তোমরা কেবল ভক্তি নিয়ে চোখ বুজে বসে থাকতে বল!

রামকৃষ্ণ তখন তাঁকে সচ্চিদানন্দ সমুদ্রের কথা বোঝালেন। ভক্তি হিমে সমুদ্রের স্থানে স্থানে জল বরফ হয়ে যায়, আবার জ্ঞান সূর্যে সেই বরফ গলে। তবু সেই সাগর সাগরই রইল।

সবাই যে রামকৃষ্ণকে প্রণাম করে তাতেও ডাক্তারের ঘোর আপত্তি। সব মানুষের মধ্যেই যদি নারায়ণ থাকে, তা হলে বিশেষ একজনকে অত টিপ টিপ করে প্রণামের কী দরকার? যদি প্রণাম করতে হয়, সবাইকে করো। গিরিশকে তিনি অনেকবার ধমক দিয়ে বলেছেন, এমন ভালো লোকটার মাথা খাচ্চ কেন? আর সব করো, কিন্তু ডু নট ওয়ারশিপ হিম অ্যাজ আ গড! কেশব সেনের চ্যালারা এইভাবে তাকে নষ্ট করেছে।

রামকৃষ্ণকে তিনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ভাব হলে তুমি লোকের গায়ের ওপর পা তুলে দাও কেন? সেটা মোটেই ভালো নয়। মানুষ না-নারায়ণ?

রামকৃষ্ণ কিন্তু কিন্তু করে বলেছিলেন, আমি কি জানতে পারি গা, কারুর গায়ে পা দিচ্ছি কি না?

ডাক্তার বলেছিলেন, ওটা যে ভালো নয়, এটুকু তো অন্তত বোধহয়?

রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, আমার ভাবাবস্থায় আমার কী হয় তা তোমায় কী বলব? সে অবস্থার পর এমন ভাবি, বুঝি রোগ হচ্ছে ওই জন্য। ঈশ্বরের ভাবে আমার উন্মাদ দশা হয়। উন্মাদে এরূপ হয়, কী করব?

নরেন বলেছিল, সায়েন্টিফিক ডিসকভারি করবার জন্য আপনি লাইফ ডিভোট করতে পারেন, শরীর অসুখ ইত্যাদি কিছুই মানেন না। আর ঈশ্বরকে জানা, গ্র্যান্ডেস্ট অফ অল সান্সেরস-এর জন্য ইনি হেলথ রিস্ক করবেন না?

ডাক্তার গজ গজ করতে করতে বলেন, ঈশ্বরকে জানা এমন কি জরুরি দরকার? যার যার কর্তব্য কর্ম করে যাওয়াই কি উচিত না? যত রিলিজিয়াস রিফর্মার হয়েছেন, যিশু, চৈতন্য, বুদ্ধ, মহম্মদ শেষে সব অহঙ্কারে পরিপূর্ণ—বলে, ‘আমি যা বললুম, তাই ঠিক! এ কী কথা?

আজ আবার মহেন্দ্রলাল এরকম কী প্রসঙ্গ শুরু করেন, তার জন্য সবাই উদ্বেগের সঙ্গে তাকিয়ে রইল।

কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে মহেন্দ্রলাল নরম গলায় বললেন, কাল শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। তোমার কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলুম, জানলা-টানলাগুলো ঠিক মতন বন্ধ করেছে কি না, তোমার যদি ঠাণ্ডা লেগে যায়— তাই একবার দেখতে এলুম।

রামকৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, ওমা, এ যে ভালোবাসার কথা গো! তোমার মনে রং লেগেছে। তবে কি মেনেছ?

ডাক্তার বললেন, না, সব মানিনি। তবে ভালোবাসা সব যুক্তিতর্কের বাইরে। তোমার টানে বারবার ছুটে আসি তারপর ভক্তদের দিকে চক্ষু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, এরা অনেকেই আমাকে পছন্দ করে না, বুঝি। এক একদিন মনে হয়েছে, আমার কথা শুনে এরা আমায় জুতো মেরে তাড়াবে।

রামকৃষ্ণ বললেন, সে কি! এরা তোমায় কত ভালোবাসে। তুমি আসবে বলে বাসক-সজ্জা করে জেগে থাকে।

ডাক্তার বললেন, আমার ছেলে—আমার স্ত্রী পর্যন্ত—আমায় মনে করে হার্ড হার্টেড। স্নেহ-মমতা শূন্য, কেন না আমার দোষ এই যে আমি ভাব কারুর কাছে প্রকাশ করি না।

গিরিশ বলল, মাঝে মাঝে মানের কপাট খোলা তো ভালো।

ডাক্তার বললেন, ওসব কথা থাক। একটু গান শুনি। নরেন গাইবে নাকি?

রামকৃষ্ণও নরেনকে গান গাইবার জন্য ইঙ্গিত করলেন। আজ গুরু বেশ সুস্থ আছেন, তাই শিষ্যরা সকলেই উৎফুল্ল।নরেন গান ধরল :

প্ৰভু ম্যয় গোলাম, মায় গোলাম, ম্যয় গোলাম তেরা

তু দেওয়ান, তু দেওয়ান, তু দেওয়ান মেরা।

দো রোটি এক লেঙ্গোটি, তেরে পাস ম্যয় পায়া

ভগতি ভাব আউর দে নাম তেরা গাঁবা…

এর পর সে গাইল :

নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি

তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরিগুহাবাসী…

গান শুনতে শুনতে মহেন্দ্রলাল এক দৃষ্টিতে রামকৃষ্ণের দিকে চেয়ে রইলেন। এক সময় রামকৃষ্ণ বিছানা ছেড়ে নামলেন মেঝেতে। হাত তুললেন নাচের ভঙ্গিতে। অন্য দিন হলে মহেন্দ্রলাল প্রবল আপত্তি জানাতেন, সামান্য পরিশ্রমেই রোগ বেড়ে যাবার সম্ভাবনা। আজ কিন্তু কিছুই বললেন না। একটু নাচতে গিয়েই রামকৃষ্ণের ভাব সমাধি হল সামান্য সময়ের জন্য।

ডাক্তারের চক্ষু দিয়ে জল গড়াচ্ছে। গলার কাছে যেন আটকে রয়েছে কিছু। তিনি রুমাল বার করে মুখ মুছলেন।

স্বাভাবিক হয়ে রামকৃষ্ণ বললেন, ও কি গো, তুমি কাঁদছ নাকি?

মহেন্দ্রলাল বললেন, ভালো গান শুনলে আমার বুকের ভেতরটা মোচড়ায়।

রামকৃষ্ণ কাছে এসে বললেন, তবে তো তোমার হয়ে এসেছে গো, তুমি মজেছ! আমায় থ্যাঙ্ক ইউ দাও!

মহেন্দ্রলাল ধরা গলায় বললেন, সে কথা কি তোমাকে মুখে বলতে হবে? আমি সামান্য ডাক্তার, তোমার কাছে এসে কত কী শিখলাম!

সকলের কাছে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন মহেন্দ্রলাল। গিরিশও এলেন সঙ্গে সঙ্গে। উৎফুল্ল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আজ পরমহংসদেবকে কেমন দেখলেন? সেভেন্টি ফাইভ পারসেন্ট বেটার, তাই না?

মহেন্দ্রলাল গিরিশের কাঁধে হাত দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন অপলক। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ভালো নয়, ভালো নয়, অবস্থা একেবারে ভালো নয়!

গিরিশ চমকে উঠে বললেন, সে কি! আপনার সব সময় উল্টো কথা। এখন তো অন্য সব ওষুধ বাদ দিয়ে আপনার ওষুধই খাচ্ছেন উনি। কত চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। দু’চার দিনের মধ্যে রাস্তায় বেরুতে পারবেন, এই আমি বলে দিচ্ছি।

মহেন্দ্রলাল বললেন, তা যদি হয়, আমিই সবচেয়ে খুশি হব। কোন টানে বারবার ছুটে আসি, তা বোঝো না? উইল পাওয়ার অ্যাপ্লাই করে দেখো, যদি পার-

অন্য দিন মহেন্দ্রলাল সিঁড়ি দিয়ে সদৰ্পে দুপদাপ করে নেমে যান, আজ এক পা এক পা করে নামলেন, চলে যেতে যেন পা সরছে না। একেবারে নীচে গিয়ে মুখ ফেরালেন। অদ্ভুত বিষাদ মাখা সেই মুখ!

দুদিন পরেই রামকৃষ্ণের মুখ দিয়ে আবার রক্ত উঠল, রোগ যন্ত্রণা অসম্ভব বেড়ে গেল। ছটফট করতে লাগলেন বিছানায়।

এ রকম শুরু হবার ঠিক আগে তিনি মাস্টারকে বলেছিলেন, এত অবতার অবতার করেই অসুখটা বাড়িয়ে দিল। এ যেন নতুন বউয়ের ঘোমটা খুলে দেখানো। মাঝে বেশ সেরে এসেছিল, আবার রোগটা বেড়ে গেল। এখন গিরিশ হুজুগি করে ভালো হবার জন্য। এত বাড়িয়ে এখন আর কী হয়?

একটু ভালো বোধ করলে তিনি শুধু নরেনকে ডেকে পাঠান। নরেনের সঙ্গে তাঁর গুহ্য কথা হয়। নরেনের হাত ছুঁয়ে তিনি একবার বললেন, আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে আমি ফকির হলুম। দেখ নরেন, তোর হাতে এদের সকলকে দিয়ে যাচ্ছি।

নরেন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তখনও ভাবছে, ইনি সত্যিকারের কে!

রামকৃষ্ণ বারবার নিজের অবতারত্ব অস্বীকার করলেও এই সময় বললেন, এখনও তোর জ্ঞান হল না! সত্যি সত্যি বলছি, যে রাম, সে কৃষ্ণ, সেই ইদানীং এই শরীরে রামকৃষ্ণ—তবে তোর বেদান্তের দিক দিয়ে নয়!

রবিবার সকালবেলা বাগবাজারের রাখাল মুখার্জি নামে একজন দেখা করতে এল। পাক্কা সাহেবি কেতার মানুষ, সে কার কাছ থেকে শুনে এসেছে যে, পাঠার মাংস বা গুগলির ঝোলটোলে কিছু হবে না, মুর্গির জুস খেলে শরীরে বল আসবে। সে বারবার পিড়াপিড়ি করার পর রামকৃষ্ণ বললেন, খেতে আপত্তি নেই, তবে লোকচার। আচ্ছা কাল দেখা যাবে।

দুপুরবেলা ঘর যখন ফাকা, তখন সারদামণি সে ঘরে এলেন লক্ষ্মীমণিকে সঙ্গে নিয়ে। ওদের দেখেও রামকৃষ্ণ অনেকক্ষণ কথা বললেন না, চোখ খোলা, তবু যেন ঘুমঘোরে রয়েছেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, এসেছ? দেখ, আমি যেন কোথায় যাচ্ছি। জলের ভেতর দিয়ে। অনেক দূর।

সারদামণি হঠাৎ কাঁদতে শুরু করতেই তিনি বললেন, তোমার ভাবনা কী? যেমন ছিলে, তেমনি থাকবে। আর এরা, নরেন, রাখালরা সব আমায় যেমন করেছে, তোমায়ও তেমন করবে।

আবার বললেন, জান তো, আমি গোমড়া মুখ সহ্য করতে পারি না!

বিকেলবেলা আবার প্রফুল্ল মুখে গল্প করতে লাগলেন কয়েকজনের সঙ্গে। দিব্যি হাসছেন, গল্প করছেন, তারই মধ্যে একবার আঁ আঁ শব্দ করে বলে উঠলেন, জ্বালা, জ্বালা, আমার দুটাে পাশ একেবারে জ্বলে যাচ্ছে গো! এই বুঝি শেষ?

শশী ছুটে গিয়ে একজন স্থানীয় ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এল। রামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করতে করতে ডাক্তার আর কোনও কথা বলে না।

রামকৃষ্ণের বেশ জ্ঞান আছে। তিনি বলছেন, তার প্রত্যেক শিরায় যেন গরম জলের পিচকিরি ছুটছে। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, সারবে?

ডাক্তার কোনও উত্তর দিতে পারে না। রামকৃষ্ণ পাশের এক ভক্তের দিকে তুড়ি দিয়ে বললেন, বলে কি গো? এরা এতদিন পরে বলে সারবে না? মারি তাতে ভয় নেই, কিসে প্রাণবায়ু যায় বলতে পার?

কেউ কিছুই বলতে পারে না। ডাক্তার চলে যাবার পর রামকৃষ্ণের ব্যথা যেন অনেক কমে গেল। তিনি বললেন, আমার খিদে পেয়েছে, খুব, পায়েস খাব!

দুধ তাঁর একেবারেই সহ্য হয় না, তাই ভাতের মণ্ড নিয়ে আসা হল তাঁর জন্য। খেতে পারলেন না, সব মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। অথচ উদরে খিদে রয়ে গেল। তিনি বললেন, দেখ, আমার হাঁড়ি হাঁড়ি ডাল-ভাত খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না।

দুজন ভক্ত বড় তালপাতার পাখা নিয়ে বাতাস করতে থাকে, এক সময় রামকৃষ্ণ অন্যদিনের মতনই হরি ওঁ তৎসৎ বলে ঘুমিয়ে পড়েন। অনেকে নিশ্চিন্ত হয়ে নীচে নেমে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ পড়ে লাটুর মনে হল, ঘুমের মধ্যেই গুরু কেমন যেন অস্বাভাবিক শব্দ করছেন। আবার সবাইকে ডাকা হল। রামকৃষ্ণ কিন্তু জেগে উঠলেন, ভক্তদের দেখে বললেন, খুব খিদে পেয়েছে যে! খাওয়াবি না?

তিনি জল পানও করতে পারছিলেন না, তুলো ভিজিয়ে তাঁর মুখে দেওয়া হচ্ছিল। এ অবস্থায় তিনি আর কী খাবেন? তবু আবার আনা হল ভাতের মণ্ড। এবারে কিন্তু তিনি দিব্যি খেতে লাগলেন, এক বাটি শেষ করে আর এক বাটি। যেন তাঁর কোনও দিন গলার ব্যাধি হয়নি। খাওয়া শেষ করে বেশ তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, আঃ শান্তি হল! এখন আর কোনও রোগ নাই!

আবার তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। লাটু আর শশী তাঁর বিছানার দু’পাশে বসে রইল অতন্দ্র প্রহরীর মতন। রাত বাড়ছে, চারিদিক নিঝুম। দু’একটা শেয়ালের ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যায় না। নীচতলার দানাদের ঘরেও আজ আর কোনও আওয়াজ নেই।

রাত একটা বাজার কয়েক মিনিট পরেই রামকৃষ্ণ বিছানার একদিকে ঢলে পড়লেন, গলা দিয়ে একটা সরু শব্দ বেরুল। সারা গায়ের রোম খাড়া। ভাবসমাধির সময় এরকম হয়। অথচ শরীর যেন বেশি আড়ষ্ট। ভক্তরা এসে কেউ তার নাড়ি দেখতে লাগল, কেউ তাঁর নাকের সামনে হাত পাতল। প্রায় সকলেরই ধারণা হল, ঘুমের মধ্যে তাঁর ভাবের ঘোর এসেছে, কিছুক্ষণ পরেই আবার জ্ঞান ফিরবে। শুধু নরেন কিছুক্ষণ তাঁর পা দুখানি বুকে জড়িয়ে বসে থাকে, এক সময় পা দুখানি আবার বিছানায় রাখল। তারপর দৌড়ে সে নীচে নেমে গেল। আর সে ওই ঘরে থাকতে চায় না।

রাত শেষ হয়ে সকাল হল, খবর গেল চতুর্দিকে। অনেকেরই এখনও ধারণা, রামকৃষ্ণ সমাধিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। তারা কীর্তন গান করতে লাগল তাঁর শরীর ঘিরে। গিরিশের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাঁর গুরু ঈশ্বরের পূর্ণ অবতার, তিনি আবার সুস্থ হয়ে উঠবেনই। ইদানীং রামকৃষ্ণের বেশি অসুস্থতা তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না, অতিরিক্ত মদ্যপান কর একেবারে মাতাল হয়ে থাকতেন। আজও গিরিশের সেই রকমই বেসামাল অবস্থা, সেই অবস্থায় ধরে ধরে আনা হল তাঁকে।

কেউ কেউ বলছে, মেরুদণ্ড এখনও উষ্ণ আছে, এখানে গাওয়া ঘি মালিশ করা দরকার। কেউ বলছে, চোখের পাতা একবার কাঁপল যেন। স্থানীয় চিকিৎসকরাও ঠিক কিছু বলতে পারে না।

মহেন্দ্রলাল সরকারের কাছে লোক গেছে সকালেই। সব বৃত্তান্ত শুনেও তাঁর মুখে কিছু ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি তখুনি ছুটে যেতে পারবেন না, ডাফ স্ট্রিটে অতি সঙ্কটাপন্ন এক রোগিণী রয়েছে, তাকে আগে দেখে যেতেই হবে।

তিনি কাশীপুরে পৌঁছলেন বেলা একটায়। হাত দিয়ে ছোবারও দরকার হল না, রামকৃষ্ণের শরীরের দিকে তিনি কয়েক পলক চেয়ে রইলেন মাত্র। যেন তিনি আগে থেকেই জানতেন। প্ৰদীপ নিবে যাবার আগে যে একবার দপ করে জ্বলে ওঠে, তা ওঁর শিষ্যরা সেদিন বোঝেনি। রামকৃষ্ণের শরীর বা পাশ ফেরা, পা দুটো গোটানো, চক্ষু খোলা, মুখটাও একটু খোলা। উনি বাঁচতে চেয়েছিলেন খুব, যেন এখনও সেই কথা বলতে চাইছেন।

অবতার হোন বা যাই-ই হোন, স্বর্গ কিংবা পরলোকের প্রতি ওঁর কোনও টান ছিল না, এই ধুলোমাখা পৃথিবীটাকেই উনি ভালোবাসতেন। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার জন্য বড় ব্যাকুলতা ছিল ওই বুকে।

মৃদু স্বরে মহেন্দ্রলাল বললেন, অন্তত বারো ঘণ্টা আগে মৃত্যু হয়েছে। ক্যানসার রোগ আমাদের চিকিৎসার অতীত। চেষ্টার কোনও ক্রটি হয়নি। তোমরা শবদাহের সব ব্যবস্থা করো।

পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে বললেন, তোমরা ওঁর শেষ যাত্রার একটা ছবি তুলে রেখো। এই নাও আমার পক্ষ থেকে কিছু।

বেলা পাঁচটার সময় দোতলা থেকে রামকৃষ্ণের দেহ নামিয়ে রাখা হল একটি পালঙ্কে। ধপধপে সাদা চাদর পাতা, অজস্র সাদা ফুলে সাজানো হল সেই পালঙ্ক, ভক্তরা গুরুর শরীরে মাখিয়ে দিল শ্বেত চন্দন। সারা দিন অসহ্য গুমোট গরম ছিল, এই সময় বৃষ্টি নামল বড় বড় ফোঁটায়। স্বস্তি বোধ হল তো বটেই, কেউ কেউ ভাবল, এক মহাপুরুষের তিরোধানে স্বর্গ থেকে দেবতারা পুষ্প বৃষ্টি করছে।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথা তো খুব বেশি লোক জানে না। সারা দিন ধরে খবর ছড়ালেও তাঁর শবানুগমনকারীর সংখ্যা বড় জোর দেড়শো, এঁদের মধ্যে কেশবচন্দ্রের ব্ৰাহ্ম দলের কয়েকজনও রয়েছেন। অন্য দুটি ব্ৰাহ্ম দল তাঁকে গুরুত্ব দেয়নি কখনও। অনেক হিন্দু সাধুর মৃত্যুতে এর চেয়ে অনেক বেশি সমারোহ হয়, হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়, সেই তুলনায় রামকৃষ্ণের শবযাত্রা অতি সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু এই শবযাত্রার দলে রয়েছে এগারোজন যুবা, তাদের মধ্যে থেকে অন্তত একজনকে পেলেও অন্য সাধুরা ধন্য হতো।

মিছিলের এক একজনের হাতে রয়েছে হিন্দু ধর্মের ত্রিশূল ও ওঁকার, বৌদ্ধধর্মের খুন্তি, মোহাম্মদীয় ধর্মের অর্ধচন্দ্র এবং খ্রিস্টধর্মের ক্রুশবাহিত পতাকা। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, যত মত তত পথ, এই শোকের সময়ও ভক্তরা তা ভোলেনি।

যারা সাক্ষাৎ শিষ্য নয়, এমনও এসেছিল কিছু মানুষ। স্টার থিয়েটারের সমস্ত নটী-নটী ও কলাকুশলী। বাংলা থিয়েটার রামকৃষনের আর্শীবাদধন্য হয়ে জাতে উঠেছিল। স্টার থিয়েটারের এই দলটির একেবারে পেছনে, কিছুটা দূরত্ব রেখে কেউ মুখে বসানে মোড়া এক নারী মূর্তি। তার দুই চক্ষু দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল অনবরত, তার কান্নার শব্দ শুনতে পায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *