2 of 3

৬১. পড়াতে পড়াতে সব মনে পড়ে যাচ্ছে

৬১

তোকে পড়াতে পড়াতে সব মনে পড়ে যাচ্ছে। কত কী ভুলে গিয়েছিলাম।

বিষ্ণুপদ খুব আহ্লাদের সঙ্গে হাসল। সামনে মাদুরে বসা পটল, তার পাশে শান্ত বোবা গোপাল।

পটল খাতা খুলে দেখছিল। গাঁয়ের স্কুলে পরীক্ষা মোটে দুটো। হাফ ইয়ার্লি আর অ্যানুয়াল। কলকাতার ভাল ভাল ইংরিজি স্কুলে নাকি সপ্তাহে সপ্তাহে নানারকম পরীক্ষা হয়। পটলের এখন পরীক্ষার একটা ঝোঁক এসেছে। আজকাল দাদুই তার পরীক্ষা নিচ্ছে, নম্বরও দিচ্ছে। একখানা প্রশ্নের উত্তরে দাদু দিয়েছে দশে ছয়। উরিব্বাস! ইংরিজিতে শতকরা ষাট নম্বর তো সে ভাবতেই পারে না।

ও দাদু, তুমি আমাকে বেশি বেশি নম্বর দাওনি তো!

বিষ্ণুপদ হাসল, প্রথম প্রথম তাই দিতুম। যাতে তোর নিজের ওপর ভরসা আসে। এখন বুঝেসুঝেই দিচ্ছি।

কিন্তু এ তো অনেক নম্বর।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, যখন ইস্কুলে পড়াতাম তখনও অবশ্য আমার নম্বর দেওয়ার হাতটা দরাজই ছিল। হেডমাস্টারমশাই ডেকে বলতেন, বিষ্টুবাবু, নম্বরটা বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের দিচ্ছেন। আমি ভাবতাম কি জানিস! নম্বর তো আর ঘরের গোলার ধান নয়, ক্যাশবাক্সের টাকাও নয়, তা হলে কেপ্পনের মতো দেবো কেন?

ও দাদু, তুমি কি আমাকে ওরকমভাবেই নম্বর দিয়েছে নাকি? আমার সে নম্বর চাই না। জ্যাঠার মতো লেখাপড়ায় ভাল হতে হবে যে।

ওরে না, তোকে ওরকমভাবে নম্বর দিইনি। তোর আজকাল দিব্যি ভাল হচ্ছে। মাথা খুলছে। বিশ্বাস না হয় ইস্কুলের মাস্টারমশাইকে দেখাস।

বিষ্ণুপদ খুব হাসতে লাগল। দাদুর ওপর পটলের খুব একটা নির্ভরতা নেই। তবে দাদুকে তার বড় ভাল লাগে। সবসময়ে ঠাণ্ডা, সুস্থির। রাগারাগি, চেঁচামেচি নেই। এ বাড়িতে দাদু আর ঠাকুমা ছাড়া বাকি সকলেরই মাথা গরম। ঠাকুমার চেয়েও দাদু ঠাণ্ডা। আর দাদু যে ভালই পড়ায় এটা আজকাল পটল বুঝতে পারছে খুব। দাদু পড়ালে মাথায় খুব বসে যায় পড়া।

বিষ্ণুপদ গলাটা নামিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, তুই জ্যাঠার মতো হতে চাস?

খুব চাই দাদু। অনেক লেখাপড়া শিখব, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াব।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, খুব ভাল। রোখ থাকা চাই। খুব গোঁ ধরে যদি থাকিস তবে পারবি।

পারব দাদু?

মানুষ তো সবই পারে। কত কী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছে। মানুষের বুদ্ধির বহর দেখে তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি।

আমাকে জ্যাঠার কথা বলবে দাদু? জ্যাঠার গল্প শুনতে খুব ভাল লাগে।

বিষ্ণুপদ কৌতুকের দৃষ্টিতে নাতির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সে তো অনেক বলেছি তোকে।

আবার শুনতে ইচ্ছে করে।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, শোনা অবশ্য ভাল। শুনলে ভিতরটা চাঙ্গা হয়। কৃষ্ণর কষ্টের জীবন ছিল, আমাদের সকলেরই ছিল। কষ্টের ভিতর দিয়েই যা হওয়ার হয়েছে। আমিও তার কথা খুব ভাবি। যত ভাবি তত অবাক হই। কেন জানিস?

কেন দাদু?

তার ধারাটা এ বাড়িতে নেই।

তার মানে কী দাদু?

কৃষ্ণ যেমনটা হল ঠিক তেমনটা আর কেউ তো হল না। বংশের একটা ধারা তো থাকবে। তাই অবাক হই। তুই যদি কৃষ্ণর মতো হয়ে উঠিস, তা হলে একখানা কাণ্ডই হয়।

পারব না দাদু?

বললাম যে, মানুষের পারার যেন শেষ নেই। মানুষই তো পারে।

মাঝে মাঝে মনে হয় কি জাননা? উরিব্বাস, কত বই পড়তে হবে, কত কি শিখতে হবে, কত বুদ্ধি লাগবে, স্মৃতিশক্তি লাগবে, তবে না জ্যাঠার মতো হওয়া যাবে।

খুব গোঁ ধরে থাক। কচ্ছপের কামড়ের মতো ধরে থাক।

আমি আজকাল কত মন দিয়ে পড়ছি না দাদু?

হ্যাঁ। তোর খুব মন হয়েছে পড়ায়।

শুধু বাবা মাঝে মাঝে সব ভণ্ডুল করে দেয় যে! এমন চেঁচামেচি ঝগড়া করে যে মাথাটা তখন গুলিয়ে যায়।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, তারও রোখ ছিল। দাদাকে খুব ভক্তি করত। সেই ভক্তি থেকেই আবার ফ্যাকড়া বেরোলো যে। তোর বাবা যা করে তাও একটা রাগ থেকে করে। দাদার সঙ্গে পাল্লা টানতে গেল যে! এ তো আর পাঞ্জার লড়াই নয়। তোকেও বলি, রোখ রাখিস, কিন্তু রাগ নয়, পাল্লা টানতে যাস না।

না, রাগ পটলের নেই, সে কারও সঙ্গে পাল্লাও টানতে চায় না। সে কিছু একটা হতে চায়। জ্যাঠা বড় ওপরে উঠে গেছে। অত ওপরে কি উঠতে পারবে সে? নাও যদি পারে, কাছাকাছিও যদি ওঠা যায় তবে তাই ঢের। আজ কোন বেহানবেলা থেকে পড়তে লেগে গেছে সে। ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। নিবু নিবু হ্যারিকেন উস্কে বইপত্র নিয়ে বসেছে। একটু একটু আলো ফুটতেই বারান্দায় দাদুর কাছে এসে মাদুর পেতে সেই থেকে পড়া করছে, টাস্ক করছে। গোপাল ঘুম থেকে উঠে গুটিগুটি এসে কোন ফাঁকে বসেছে তার পাশটিতে। গোপাল দাদা ছাড়া থাকতেই পারে না।

ও দাদু, গোপালের কি পড়া হবে?

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কে জানে দাদা। বোবার মুখেও একদিন হয়তো মানুষ কথা ফোটাবে। কানে শুনতে পায় না তো, তাই বোল ফোটে না। কানের ব্যবস্থা হলে কথা ফুটতে কতক্ষণ?

বোবাদের ইস্কুলে যদি দেওয়া যায়?

সেখানে কী শেখায়?

আমি জানি না।

খোঁজ নিস।

গোপাল যদি কথা কইতে পারত তা হলে একটা কাণ্ডই হত, না দাদু?

বিষ্ণুপদ একটু হাসল।

পটল বলল, আমি প্রায় রাতেই স্বপ্ন দেখি, গোপাল হঠাৎ আমাকে দাদা বলে ডেকে উঠল। আচ্ছা স্বপ্ন কি সত্য হয় দাদু?

বিষ্ণুপদ হাসল, সত্য হওয়াই কি ভাল? সব স্বপ্ন সত্য হলে ভারী বিপদ হত। ওই যে কালঘড়ি দেখেছিলাম দু’ রাত্তির, তখন থেকে কথাটা মনে হয়।

হয় না, না দাদু?

কে জানে ভাই। তবে সব স্বপ্ন যে হয় না তা জানি।

আমি লেখাপড়া করে যখন অনেক টাকা রোজগার করব তখন গোপালকে বিলেতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব।

কিসের চিকিৎসা?

বিলেতে তো ভাল ডাক্তার আছে, তারা হয়তো অপারেশন করে গোপালের মুখে কথা ফুটিয়ে দিতে পারবে।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, পারলে তো খুব ভাল হবে।

গোপাল কিন্তু বোকা নয় দাদু, সব বুঝতে পারে। বুদ্ধিও খুব। শুধু কানে শুনতে পায় না আর কথা কইতে পারে না।

বিষ্ণুপদ মাথা নাড়ল, জানি।

বইখাতা গুছিয়ে মাদুর গুটিয়ে পটল ভাইকে নিয়ে চলে গেল।

বিষ্ণুপদ বারান্দায় বসে রইল। আজ হঠাৎ ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ছে তার। খুব মনে পড়ছে। কী ছিল ছেলেবেলায়? এই এমনিই ভাঙা ঘরদোর, অনেকটা এরকমই দারিদ্র্য ছিল। ময়মনসিংহ জেলার এক অখ্যাত পাড়াগাঁয়ে বাস ছিল। গাছে গাছে প্রকৃতিদত্ত ফল ছিল বলে রক্ষে। নইলে উপোসে উপোসে প্রাণ বেরিয়ে যেত। সে-সব জাতের ফল নয়। কামরাঙা, করমচা, ডেউয়া, বেল কিংবা কাঁচা আম বা বরই। আর ছিল লটকা, পানিয়ল, খেতের আখ। কিন্তু দারিদ্র্য ছিল গায়ের ধুলো, ভিতরে ঢুকত না। না, ভিতরে কোনও দারিদ্র ছিল না তখন। বড় আনন্দ ছিল। গায়ের জামা খুলে ফেলে পুকুর বা নদীতে অনায়াসে ঝাঁপিয়ে পড়া যেত। গাছ বাইতে, ফুটবল খেলতে তখন কী ভালই লাগত। বাবা ছিল, মা ছিল, দাদু-ঠাকুমা ছিল, পিসি-কাকা-জ্যাঠা ছিল, ভাইবোন ছিল মেলা। কোথায় যে কালের বাতাসে সব উড়ে গেল! চিহ্নও নেই। এখানে সেখানে আছে কেউ কেউ, এখন আর খোঁজও রাখে না। যে যার নিজেরটা নিয়ে আছে। সকলে হয়তো নেইও। কে জানে বাবা!

ও বাবা, কী করছেন?

বামাচরণ নাকি? কিছু বলবি?

বামাচরণ বেরোবে বোধহয়। গায়ে হাওয়াই শার্টের ওপর সোয়েটার চাপাননা, পরনে পাতলুন। গালে কয়েকদিনের দাড়ি। বিষ্ণুপদ লক্ষ করল।

বামাচরণ কিন্তু-কিন্তু করে বলে ফেলল, ভাগজোখের কিছু হল?

কিসের ভাগজোখ?

জমিজমার একটা বিলিব্যবস্থার কথা হয়েছিল, আপনার মনে নেই?

বিষ্ণুপদ ঝম করে অতীত থেকে বর্তমানের কঠিন মাটিতে এসে পড়ল। বলল, তোরা যা করিস, আমার তো আপত্তি নেই।

কিন্তু হচ্ছে কোথায়? আপনি তো হাত গুটিয়ে রইলেন। গাঁয়ের মাতব্বরদের ডেকে সালিশি বসিয়ে সব বাঁটোয়ারা করে দেওয়ার কথা হয়েছিল যে!

বিষ্ণুপদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, তা হয়েছিল বটে। তা হলে সেরকম কিছু করলেই তো হয়।

করবেন তো আপনি। জমিজমা তো আপনার। আপনি করছেন না, এদিকে রামজীবন তো গাপ করতে লেগে গেছে। আমার ঘরের পিছনের জমিটায় তো দেখছি রামজীবন সর্ষে বুনেছে। এরকম অরাজকতা তো চলতে পারে না। জমির কতটা কার, কোনটায় কে চাষ করবে তার একটা বন্দোবস্ত না হলে তো বড়ই কঠিন হচ্ছে।

বিষ্ণুপদ প্রবল অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে বলে, সবাইকে ডেকে একদিন বসে তোরাই ঠিক করে নে না। আমার মতামত দিয়ে কী হবে? আমার একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই হয়।

আপনি তো বলেই খালাস। কিন্তু মধ্যস্থ কে হবে? মধ্যস্থ একজন না থাকলে তো ফের লাঠালাঠি লেগে যাবে।

কৃষ্ণজীবনকে একটা খবর পাঠা না হয়। সরস্বতী আসুক, বীণাপাণি আসুক।

আপনি কি জমির ভাগ মেয়েদেরও দেবেন নাকি?

বিষ্ণুপদ আতান্তরে পড়ে বলে, আজকাল নাকি কি সব আইন-টাইন হয়েছে। মেয়েদেরও পাওনা হয়।

বামাচরণ রূঢ় গলায় বলে, মোট তত দেড় দুই বিঘের ওপর আমাদের বসত। তা এতগুলো ভাগ হলে আর থাকবে কী?

তা হলে কী করতে চাস?

মেয়েদের বাদ দিন। বিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন তারা নিজেদের আখের বুঝুক। জমি তিন ভাগ হবে। চাষের জমি রামজীবন নিতে পারে, কিন্তু আমাদের ন্যায্য দাম দিয়ে নিতে হবে। যা হয় দু’-চার দিনের মধ্যেই ঠিক করে ফেলুন।

গলা খাঁকারি দিয়ে বিষ্ণুপদ বলল, সবাই মানলে আমার আর আপত্তি কিসের?

আপনার জন্যই ব্যাপারটা ঝুলে আছে। সরকারী দলিল তো আপনার হাতে। উদ্যোগ তো আপনাকেই নিতে হবে। চুপ করে বসে থাকলে তো হবে না। আমি দাদাকে চিঠি দিয়েছি। জবাবও এসে গেছে।

বিষ্ণুপদ ফের গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, কী লিখেছে সে?

আসছে। আজই আসার কথা।

আজই! বলে চোখ কপালে তোলে বিষ্ণুপদ।

নিজের ভাগ নিয়ে কি করবে, তা আপনাকে জানিয়ে দিয়ে যাবে। যদি ছেড়ে দেয় তো ভালই। জমি বাড়ি দু’ ভাগ হবে। রামজীবন পাকা যে ঘরখানা তুলেছে সেটাও বে-আইনি। পঞ্চায়েতের একটা পারমিশন নেওয়া উচিত ছিল। তবে আমি গোলমাল করব না ও নিয়ে। আপনি আর মা ও-ঘরে উঠে যান, আমরা আপনার ঘরের দখল নেবো।

এ ঘরের?

তা ছাড়া আর ঘর কোথায়? আমি যে ঘরে আছি সেটার অবস্থা দেখেছেন? টিন ঝুরঝুর করছে, বেড়া ভাঙা। মেঝেটাও সারানো দরকার। আমি সারাচ্ছি না, তার কারণ ঘর কার দখলে পড়ে তার তো ঠিক নেই।

বিষ্ণুপদ কুণ্ঠিত গলায় বলে, কৃষ্ণ যদি তার ভাগ ছেড়ে দেয় আর মেয়েরা যদি ভাগ না বসায় তা হলে তো আর ঝামেলাই নেই।

হ্যাঁ। সেক্ষেত্রে বাড়ি দু’ ভাগ হবে। ভাগ-বাঁটোয়ারা না হলে এ বাড়িতে থাকা কঠিন হচ্ছে। আমার বউকে তো শোওয়ার ঘরেই রান্না করতে হচ্ছে। দেখছেন তো!

তা অবিশ্যি ঠিক।

ঠিক তো বলছেন, কিন্তু আমার কথা ভেবেছেন কখনও? আপনার হাবভাব দেখে তো মনে হয় আমি বানের জলে ভেসে এসেছি। ভাগ করে দিলে আমি আর কথা কইতে আসব না। ও ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলুন।

কৃষ্ণজীবন তা হলে আসুক।

আমি অফিসে বেরোচ্ছি। আজ তাড়াতাড়িই ফিরব। ফেরার সময় পঞ্চায়েতের বাঞ্ছারামকেও নিয়ে আসব। তার সঙ্গে কথা হয়েছে। দাদার সঙ্গে যা কথা হবে তার একজন সাক্ষী থাকা ভাল। রামজীবনকেও থাকতে বলবেন।

কৃষ্ণজীবন তার ভাগ নেবে না? তোকে তাই লিখেছে?

নিয়ে করবেটা কি? এ বাড়িতে তো সে থাকতে আসবে না!

বিষ্ণুপদ একটু অসহায়ভাবে চারদিকে চাইল। তারপর খুব মিয়োনো গলায় বলল, সে কিন্তু অন্যরকম বলেছিল।

কিরকম?

কৃষ্ণজীবন বলেছিল, সে ফিরে আসবে। চাষবাস করবে। গাছপালা করবে।

তার চিঠি আমার কাছে আছে। সে লিখেছে বাড়ির ভাগ তার চাই না।

দুই হাত উল্টে বিষ্ণুপদ বলল, কি জানি কেন লিখল!

শহরের লোকেরা ওরকম বলে। গাঁয়ে এসে থাকবেই বা কেন? কোন মধু আছে এখানে?

তা তো জানি না। তবে বলেছিল কিন্তু।

সে তো আসছে। কথা কয়ে পরিষ্কার করে নেবেন সব।

তাই হবে বাবা। তুই গিয়ে তাড়াতাড়ি আয়।

ভাগজোখ মিটিয়ে ফেললে আমিও পাকা বাড়ি তুলব। অফিস থেকে লোন দেবে। কিন্তু জমির দলিল জমা না দিলে হবে না। কত অসুবিধে করে আছি দেখছেন তো!

বামাচরণ নতুন সাইকেল কিনেছে। বেশ বাহারী জিনিস। সেইটে চালিয়ে চলে গেল। তার বউ দরজার আড়াল থেকে সব শুনছিল বোধ হয়। এইবার বেরোলো। হাতে হাঁড়িকুড়ি। পুকুরে যাবে।

উনুন ধরানোর কাঠকুটো কুড়িয়ে আনতে বাগানে গিয়েছিল নয়নতারা। এক বোঝা ডালপালা নিয়ে এসে বারান্দার কোণে ফেলে বলল, ওগো, করছোটা কী?

বিষ্ণুপদ একবার নয়নতারার দিকে চেয়ে দেখল। বলল, কিছু করছি না।

আমার শরীরগতিক ভাল বুঝছি না। বড্ড হাঁফ ধরে যাচ্ছে আজকাল।

হাঁফ ধরছে!

একটুতেই আজকাল হাঁফিয়ে যাচ্ছি। ঘাম হচ্ছে এই শীতেও।

ডাক্তারকে একটা খবর দেবো নাকি?

দুটো দিন দেখি। বয়সের দোষই হবে। বামা কী বলছিল তোমাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে?

বাড়ির ভাগ চাইছে। পাকা বাড়ি তুলবে।

তা তুলুক না। কে ঠেকাচ্ছে?

জমির দলিল না হলে নাকি টাকা ধার পাবে না।

ওসব কথায় কান দিও না।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, কান না দিয়েও উপায় নেই। বামা কৃষ্ণজীবনকে চিঠি দিয়েছিল। কৃষ্ণ নাকি আজই আসছে।

আসছে! বলে নয়নতারা ঝটিতি খাড়া হল, কখন আসবে? খাবে তো এসে! জোগাড়যন্তর করতে হবে যে!

ব্যস্ত হয়ো না। আগে আসুক। সে কাজের মানুষ। কখন ফুরসত পাবে তার ঠিক নেই। তুমি জিরোও। বরং একটা পান খাও বসে।

পান খাচ্ছি, কিন্তু জিরোনোর উপায় নেই। রাঙার মাজায় ব্যথা। সে আজ আর রান্নাঘরে যেতে পারবে না। আমাকেই করতে হবে সব।

বিষ্ণুপদ একটু হাসল। তারপর বলল, একটা কথা কইব?

কি কথা?

আজ আমাকে তোমার যোগালি করে নাও।

সে আবার কি?

যোগালি বোঝে না? জল তোলে, মশলা করে, এটা-ওটা এগিয়ে দেয়।

যোগালি বুঝি। তা তোমার আবার এ ভীমরতি কেন হল?

তোমার শরীরটা যখন যুতের নেই, করলামই না হয় একটু কাজ।

সে কাজের দরকার নেই। আরও ভণ্ডুল লাগাবে। তার চেয়ে বাজারে যাও বরং কিছু নিয়ে-টিয়ে এসো। রেমো তো কাল রাত থেকে নেই। কেষ্টনগর না কোথায় যেন গেছে।

যাচ্ছি।

একটু মাছ-টাছ এনো। শীতের সবজি। একটু তেলও লাগবে।

বিষ্ণুপদ উঠল।

একসময় বাজার করতে বড় ভালবাসত বিষ্ণুপদ। যথেষ্ট পয়সা ছিল না বটে, কিন্তু বাজারে ঘুরে বেড়ানোরও একটা আনন্দ আছে। ঘুরে ঘুরে দেখত। কিনতে পারত সামান্যই। দরাদরি করা, জিনিস পরখ করা এসবই করত বেশি। দোকানীদের সঙ্গে আলাপ-সালাপও হত। আজকাল বাজারের নামে গায়ে জ্বর আসে যেন।

বটতলায় আগে বাজার বসত সপ্তাহে দু’ দিন। আজকাল নিত্যি রমরমে বাজার। কিন্তু জায়গাটা আর ভাল নেই। গায়ে একখানা জামা চাপিয়ে থলি আর তেলের শিশি নিয়ে বেরিয়ে পড়ার পর বিষ্ণুপদ টের পেল, বাইরের দুনিয়াটা এখন অনেক অচেনা হয়ে গেছে। সরু একটা রাস্তার শেষে একটু মাঠ, তারপর আবার মেটে রাস্তা। বরাবর গেলে পাকা রাস্তায় উঠেই বাজার। এটুকু পথ তার তো মুখস্থ। কিন্তু না-বেরোনোর অভ্যাস এমন হয়েছে যে, এটুকু পথকেই মনে হয় যেন তেপান্তর পেরোতে হচ্ছে।

কী নিতে হবে বলে দেয়নি নয়নতারা। বিষ্ণুপদ একটু পালং কিনতে গেল। দর শুনে ভিরমি খেতে হয়। ফুলকপি বাঁধাকপির দরও অবিশ্বাস্য। আজকাল এত দাম দিয়ে নাকি এসব কেনে লোকে? এ তো পয়সা চিবিয়ে খাওয়া।

মাছ কিনতে গিয়ে বিষ্ণুপদ বড্ড বেচাল হয়ে পড়ল। কী দাম বলছে! সর্বনেশে ব্যাপার।

আনমনা ছিল বড়। একখানা বিশাল বাস এসে বটতলায় দাঁড়ানোর পর বেশ কিছু লোক নামল। আজকাল শীতলাতলা-বিষ্টুপুরে লোকের আনাগোনা বেড়েছে। অতি সুলক্ষণ। আনাগোনা মানেই জায়গাটা বর্ধিষ্ণু হচ্ছে। আগে লোকজন এদিকে মাড়াতই না।

সাহেবী পোশাক পরা একটা লোক হঠাৎ বিষ্ণুপদর সামনে দাঁড়াল এসে। বিষ্ণুপদ তটস্থ হয়ে পড়তেই লোকটা বলল, বাবা! আপনি কী করছেন এখানে?

বিষ্ণুপদ একগাল হাসল, কৃষ্ণজীবন! এই এলি?

হ্যাঁ। কী করছেন? বাজার নাকি?

তোর মা পাঠাল।

কৃষ্ণজীবন একটু হাসল। বলল, বাজার করতে হবে না। কলকাতা থেকে আমি এক ঝুড়ি সবজি এনেছি। ওই নামাচ্ছে বাসের মাথা থেকে।

বিষ্ণুপদ ফের হাসল। বলল, ভাল। তা হ্যাঁ রে, তোর যে গাঁয়ে ফিরে আসার কথা ছিল, তুই নাকি আসবি না?

কে বলল বাবা?

বামাচরণকে নাকি চিঠিতে লিখেছিস!

আসব না লিখিনি। বামাচরণ চায় আমি আমার ভাগটা ছেড়ে দিই। আমি রাজি হয়েছি। তা বলে গাঁয়ে ফিরে আসব না কেন? নতুন করে জমি-জায়গা কিনব, চাষবাস করব।

বিষ্ণুপদ সামান্য লজ্জাতুর গলায় বলে, বাপেরটা নিবি না তো!

তা নয় বাবা। ওরা আমাকে চায় না।

তা বটে। কে যে কাকে চায় আর কে যে কাকে চায় না, আজকাল আর বুঝতে পারি না।

বাড়ি চলুন বাবা।

চল। বলে বিষ্ণুপদ হাঁটতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *