সাতসকালে কে যেন ‘শ্রীনাথবাবু! শ্রীনাথবাবু!’ বলে ডাকাডাকি লাগিয়েছে। এ সময়টায় শ্রীনাথের ভারী একটা আমেজের ঘুম হয়। আবোঘুম আর আধো-জাগরণের মধ্যে সে ভারী একটা আয়েসি ব্যাপার। বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুলে দেখে, প্রেসের আর এক প্রুফরিডার মানিক গুপ্ত। বহুকাল দেখা নেই।
কীরে? কী ব্যাপার? আয় ভিতরে এসে বোস।
জিভ কেটে মানিক বলে, বসব কী? স্বয়ং বদুবাবু বাইরে গাড়িতে বসে আছেন। ঘরদোর একটু সামলে নিন। আপনার খবর করতে এসেছেন।
বলিস কী? বদুবাবু!—বলে শ্রীনাথ ভারী ব্যস্ত হয়ে লোকজন ডাকাডাকি করতে লাগল।
হাঁকডাকে বৃন্দা আর নতুন একটা কাজের লোক দৌড়ে এসে ঘরদোর সারতে লাগে। শ্রীনাথ কোনওক্রমে মুখ ধুয়ে কাপড় পালটে নেয়। তারপর ফটকের বাইরে দাঁড় করানো পুরনো প্রকাণ্ড হাডসন গাড়িটার কাছে এগিয়ে যায়।
আজ্ঞে, আপনি আসবেন ভাবতেই পারিনি।
বদুবাবুর বয়স শ্রীনাথের মতোই হবে। ফর্সা, গোলগাল বনেদি চেহারা। বাবা কষ্ট করে কারবার তৈরি করেছিল। এরাও ব্যাবসা জানে। প্রেস ছাড়াও অন্যান্য কারবার আছে। প্রচুর পয়সা।
বদুবাবুর পরনে পাঞ্জাবি আর ধুতি। কাঁধে শাল। মুখটা ব্যক্তিত্বময়, গম্ভীর। একটু হেসে বলে, আপনি সেই যে অসুখের খবর দিলেন, তারপর আর দেখা নেই। বাবার আমলের লোক, কী হল কী হল ভাবতে ভাবতে চলে এলাম।
আসুন, আসুন, বড় ভাগ্য।
বদুবাবুর সঙ্গে মানিক আর ড্রাইভার ছাড়াও বাড়ির চাকর এসেছে। সে একটা মাঝারি ঝুড়ি নামাল সামনের সিট থেকে। ফল-টল আছে, অনুমান করে শ্রীনাথ।
ভাবন-ঘর অল্প সময়ের মধ্যে ফিটফাট হয়ে গেছে। এমনকী টেবিলে ফ্লাওয়ার-ভাস-এ টাটকা ফুলও হাজির।
বদুবাবু চেয়ারে বসে বললেন, কী হয়েছিল বলুন তো!
স্ট্রোক মতো।
এখন কেমন আছেন?
এখন ভালই।
চেহারা কিছু খারাপ দেখাচ্ছে না।
শ্রীনাথ একটু হেঁ হেঁ করল।
বদুবাবুর হাতে হীরের আংটি, মুক্তোর আংটি, পান্নার আংটি। গলায় সোনার চেনে গৃহবিগ্রহের লকেট। মৃদু একটু সুবাস ছড়াচ্ছে গা থেকে। শ্রীনাথ বিগলিত হৃদয়ে অবাক চোখে কেবল দেখল আর দেখল। স্বয়ং বদুবাবু তার বাড়িতে! বিশ্বাস হওয়ার কথা?
বদুবাবু বলে, শরীর যখন তেমন কিছু খারাপ নয় তখন কাল থেকে প্রেসে আসতে থাকুন না কেন! কাজটাজ তেমন কিছু করতে হবে না। সুপারভাইজ করবেন একটু।
ঘাড় চুলকে শ্রীনাথ বলে, শরীরের জন্য নয়। মনটাই কেমন হয়ে গেছে। দূরে যেতে ভয় ভয় করে।
বদুবাবু উদাস মুখে বলে, ভয় তো আমারও। বাবা মরে যাওয়ার পর থেকেই কেমন একটা মরণের ভয় এসে ধরেছে। কেবল ভয় পাই, এই বুঝি কে কোথায় মরে গেল, আর বুঝি তার সঙ্গে ইহজন্মে পরজন্মে আর দেখা হল না। মনটা খুব দুর্বল হয়ে আছে সেই থেকে। গত দু’দিন কেবল আপনার কথাই মনে হচ্ছে। শ্রীনাথবাবু বেঁচে আছেন তো! তাই আজ ছুটে এসেছি।
দেখি একটু ভেবে।
ভাববার কিছু নেই। আপনার এখনও পঞ্চাশ পেরোয়নি, বুড়োও হননি। এই বয়সে অত ঘাবড়াবার কী আছে? চলে আসুন, বাদবাকি যে কদিন বাঁচি সবাই মিলেমিশে থাকি।
শ্রীনাথ এ কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তৃষা খবর পেয়ে ভিতরবাড়ি থেকে প্রচুর খাবার চা পাঠিয়েছে। বদুবাবু বসে বসে অনেকটা খেল। চায়ে চুমুক দিতে বলল, এ জায়গাটা বেশ ভাল।
বদুবাবু উঠল। শ্রীনাথ গাড়িতে তুলে দিয়ে এল তাকে। তারপর ঘরে এসে ভাবতে বসল। এখান থেকে কলকাতা আগে হাতের নাগালে মনে হত। আজকাল মনে হয়, কলকাতা বুঝি সাত সমুদুরের পার। কী করে অতদূরে রোজ যাবে শ্রীনাথ?
বউদিমণি নোটিশ দিয়েছে, এ বাড়িতে আর থাকা চলবে না। নিতাই বাজারের দিকে বস্তিতে সস্তায় একখানা ঘর পেয়ে গেছে। তার নিজের এলেমে নয়। বউ পাঁচ বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ করবে। তার রোজগারেই এই ঘর নেওয়া।
আজ নিতাই সকালে উঠেই ঝোপড়াটা ভাঙছিল। একটু আগে তার তল্পিতল্পা মাথায় করে বউ বস্তিতে রওনা হয়ে গেছে। ফাঁকা নড়বড়ে ঘরখানা ভাঙতে তেমন কষ্ট নেই। তবে চালের ওপর একটা সতেজ লাউডগা। সেটার জন্যই যা কষ্ট। কুশি কুশি লাউ ফলেছে মেলা।
বাঁশের খুঁটিগুলোর গোড়া নড়বড়ে, বেড়ার বাঁধন পচে গেছে কবে। চালে খড় পচে গোবর। পোকামাকড় বিস্তর বাসা করেছিল। নিতাইয়ের সঙ্গে সেগুলোরও আশ্রয় গেল।
লাউডগা সমেত চালের খড়গুলো নামিয়ে নিতাই ঘাম মোছে। গাছটা যদি বাঁচে এই আশায় বাঁশ-বাখারি দিয়ে চটপট একটা মাচান খাড়া করতে লেগে যায় সে। মংলু এসে তাড়া দেয়, হল তো? একটু বাদেই ছুঁইমালি এসে এ জায়গা চৌরস করবে। হাত চালা।
দাঁড়া তো। মাচানটা বেঁধে দিই আগে।
তোর ওই লাউগাছ থাকবে ভেবেছিস? মালি এসে একটানে উপড়ে ফেলে দেবে। খামোখা খাটছিস।
কথাটা সত্যিই। নিতাই দম ধরতে একটু জিরোয়। বলে, বিড়ি-টিড়ি কিছু আছে? দে না।
তা দেয় মংলু। লোকটা চলে যাচ্ছে। বিড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলে, বিয়ে করলি বলে জায়গাটা গেল তোর। দিব্যি ছিলি।
ভৈরবী ছাড়া সাধনভজন হয় শুনেছিস?
মংলু সঠিক বিশ্বাস করে না নিতাইকে। আবার পুরোপুরি অবিশ্বাস করতেও ভয় পায়। ব্যাটার বাণে কাজ হয় না ঠিকই। আবার যদি এক-আধটা লেগে যায়। তাই সে নিতাইয়ের মুখের ওপর তেমন ঠাট্টা-ইয়ারকি করে না। তারও বালবাচ্চা আছে। মংলু বলে, সামন্তর বেটি আবার ভৈরবী হল কবে থেকে?
ভৈরবী কি পেট থেকে পড়ে রে ব্যাটা? বানিয়ে নিতে হয়।
কবে আর বানাবি বাপ? নিজেই জটা কেটে দাড়ি কামিয়ে ভদ্রলোক বনে গেলি!
নিতাই বিড়িতে লম্বা টান মারে। নিমীলিত চোখে লাউগাছটার দিকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। বলে, পটাশপুরে এক মহান্ত এসেছে। কপাল থেকে জ্যোতি বেরোয়। সেই জ্যোতিতে হোমের আগুন জ্বালে। বিদ্যেটা শিখে আসতে হবে।
তোরও তো অনেক বিদ্যে শুনি।
দুর! এখনও কত শেখার আছে।—বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, বউদিমণি তা হলে এখানে ক্ষেত করবে!
তাই তো বলল ভূঁইমালিকে।
ক্ষেত জ্বলে যাবে। মংলু অবাক হয়ে বলে, কী করে জানলি?
এখানে পঞ্চমুন্ডির আসন ছিল রে ব্যাটা! বহুত ইলেকট্রিসিটি জমে আছে এখানে। গাছ কি বাঁচে?
তবে লাউগাছটা বাঁচল কী করে?
সে আমি ছিলাম বলে। আমি না থাকলে ভূতেরা তিনধা নাচন নাচতে লাগবে। দেখিস, বলে দিলাম।
মংলু একটু হাসে। অনিশ্চয়তার হাসি।
নিতাই বিড়িটা শেষ করে অন্যদিকে চেয়ে বলে, বাবু জানে?
তা কে বলবে?
বাবু জানতে পারলে রাগ করবে। আমাকে বাবু বড় ভাল চোখে দেখে।
মংলু উদাস মুখে বলে, বাবু রাগ করলেই বা কী? মা যখন বলেছে তখন সেইটেই হাকিমের আইন।
বড়দিদির বিয়েটা পর্যন্ত থাকতে পারলে বেশ হত। বউদিমণি বলেছিল আমাকে ফাইফরমাশ খাটতে এলাহাবাদ নিয়ে যাবে। ভেবেছিলাম, এলাহাবাদ থেকে হিমালয়টা কাছে হয়, একবার ঘুরে আসব। অঘোরীবাবার চরণ দুখানাও দর্শন হয়ে যাবে।
অঘোরীবাবা কে রে?
নাম শুনিসনি? তিন হাজার বছর এক ঠাই বসে সাধনা করে যাচ্ছে। গায়ে পটপট করছে পোকা। জটা মাইলখানেক লম্বা।
বলিস কী?
শুধু কি তাই! সাপের মতো খোলস ছাড়েন একশো বছর পরপর। হিমালয়ে অঘোরীবাবার ঠিকানাটা আমাকে এক সাধু লিখে দিয়ে গিয়েছিল।
মংলু সান্ত্বনা দিয়ে বলে, তা যাবে এলাহাবাদ, তাতে কী?
মুখখানা বেজার করে নিতাই বলে, আর তো যেতে বলছে না।
বলবে, বিয়ের দেরি আছে। সেই ফাল্গুনে।
ফাল্গুনের আর দেরি কী?
এলাহাবাদটা কোনদিকে বল তো!
হিমালয়ের গোড়ায়। সেখানকার জলহাওয়া খুব ভাল শুনেছি। মেলা সাধু আসে।
মংলু ওঠে। বলে, ঘর ভাঙা হয়ে গেলে ডাকিস। বাঁশবাখারিগুলো বাগানের উত্তরদিকে চালার নীচে জমা করে যাস।
তোকে ভাবতে হবে না। যা।
লাউডগাটা ভূঁইমালি এসে উপড়ে ফেলবে। তবু নিতাই সেটাকে ফেলে যেতে পারছে না। আবার উঠে মাচানটা বাঁধতে লেগে যায়। মালিটা মহা খোঁচড় লোক। কিছু বলতে গেলেই খেকিয়ে ওঠে। লাউডগাটার কথা তাকে সাহস করে বলবে কি না ভেবে পায় না নিতাই। বিড়ির একটু তামাক জিভ দিয়ে থুঃ করে ফেলে নিতাই আপনমনে বলে, দূর খ্যাপা! দুনিয়াটাই তো তোর নিজের। এ জায়গা ও জায়গা বাছিস কেন? সব সমান। বাজারের বস্তিও যা, চাটুজ্জেবাড়ির বাগানও তা।
ঝোপড়া ভেঙে জিনিসপত্র চালার নীচে সরিয়ে রেখে নিতাই মস্ত বকুল গাছটার তলায় বসে জিবরাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হল, যাওয়ার কথাটা বাবুকে জানানো দরকার।
যেই ভাবা সেই গিয়ে ভাবন-ঘরে উঁকি মারে নিতাই।
ইজিচেয়ারে বসে ইংরিজি একটা খবরের কাগজ কোলে নিয়ে পেনসিল দিয়ে কী যেন কাটাকুটি করছে বাবু। খবরের কাগজের পিছনে একটা সুন্দরমতো মেয়েছেলের ছবি।
বাবু!
উঁ!–শ্রীনাথ কাগজ নামিয়ে বলে, নিতাই নাকি?
আজ্ঞে। একটা কথা বলতে এলাম।
আমিও তোর কথাই ভাবছি। ভিতরে আয়।
নিতাই ভিতরে ঢুকে মেঝের ওপর বসে।
আমার তো ঝাটিপাটি ওঠাতে হল এখান থেকে।
কথাটা না বুঝে শ্রীনাথ বলে, কী বলছিস?
আজ্ঞে চলে যেতে হচ্ছে।
কোথায়?
বস্তিতে ঘর নিয়েছি।
সে কী! আমার যে তোকে ভীষণ দরকার। কাল থেকে প্রেসের চাকরিতে যাব। তুই রোজ আমার সঙ্গে গিয়ে সারাদিন থাকবি, আবার আমার সঙ্গেই ফিরে আসবি।
ঠিক এই সময়ে লাউগাছটার কথা মনে পড়ায় বড় হু-হু করে উঠল বুক। নিতাই ভ্যাক করে কেঁদে ফেলে।
কাঁদছিস কেন?
বউদিমণি তাড়িয়ে দিলেন যে!
তাড়ায় কেন?
বিয়ে করেছি বলে।
বিয়ে করেছিস? কই, বলিসনি তো!
আজ্ঞে লুকিয়ে-চুরিয়ে করেছি। বউদিমণির ভয়ে।
শ্রীনাথ বহুকাল বাদে একটু সত্যিকারের হাসি হাসল, বিয়ে করে বেশ করেছিস। আর একবারও তো করেছিলি। এবারকার বউটা কেমন?
খুব ভাল। অমন মেয়ে হয় না।
ভাল হলেই ভাল। কিন্তু বিয়ে করলি বলেই বউদি তাড়িয়ে দিচ্ছে, এ কেমন কথা?
আজ্ঞে সবাই বলছে বুড়ো বয়সে কচি মেয়ের সর্বনাশ করেছি।
বউটা খুব বাচ্চা নাকি?
বাচ্চা নয়, আঁটো মেয়ে।
তোর বয়স কত?
কত আর হবে! ঠিক বুঝতে পারছি না।
সে যা-ই হোক, কাল থেকে আমার সঙ্গে রোজ কলকাতায় টানা মারতে হবে, কথাটা মনে রাখিস। বরং আজই গিয়ে স্টেশন থেকে একটা মান্থলি করে আয়। টাকা দিচ্ছি।
সে যাব। কিন্তু বউদিকে কথাটা একটু বলে রাখবেন বাবু। নইলে যা চটে আছে আমার ওপর!
তোকে বস্তিতে যেতে হবে না। ঝোপড়াতেই থাক। আমি তোর বউদিকে বলে দিচ্ছি।
ঝোপড়া ভাঙা হয়ে গেছে। মালি সেখানে চাষ দেবে।
শ্রীনাথ অবাক হল। বলল, তুই না দাদার আমলের লোক!
আজ্ঞে। এই বাড়ি ঘর সব আমার চোখের ওপর হয়েছে।
শ্রীনাথ একটু চিন্তিত হয়। একটু ভেবে বলে, ঝোপড়া ভেঙেছিস তো কী আছে! ভাবন-ঘরের পিছনদিকে ছাড়া জমি আছে। চালাঘরে বিস্তর টিন আর খুঁটি আছে। একটা ঘর বেঁধে নিগে যা।
কিন্তু বউদি?
বউদিকে আমি বলছি।
তৃষার কথা কোনওদিন ওলটায় না। যা বলে তাই হয়। কিন্তু আজ যখন গিয়ে শ্রীনাথ তাকে বলল, খ্যাপা নিতাইটাকে আমার বড় দরকার। কাল থেকে রোজ আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবে। তখন তৃষা না করল না।
রঘু স্যাকরা বসে ছিল তৃষার ঘরে। তাকে বিয়ের গয়নার বরাত দিচ্ছিল তৃষা। শ্রীনাথের কথা মন দিয়ে শুনে বলল, ঠিক আছে, ওকে নতুন করে ঘর তুলে নিতে বলো গে।