অধ্যায় ৬০
দোতলা বাড়িটার সবগুলো রুমে তল্লাশি চালিয়েও কাউকে পেলো না জেফরি বেগ।
এ বাড়ির পেছনের বাগানে খোঁজ করেছে, কিন্তু অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটা। এমন কিছু চোখে পড়েনি যেখানে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। বিভিন্ন ধরণের ফুলের গাছে ভর্তি।
অমূল্যবাবু যখন হুট করেই তাকে তল্লাশী করার অনুমতি দিয়ে দিলো তখনই একটু সন্দেহ তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে। এখন বুঝতে পারছে, এই বাড়িতে রাহিদ হাসানের স্ত্রী আর সন্তান থাকলে বাবু তাকে তলাশী চালাতে দিতো না।
উত্তরা থানার এসআই আর জামানকে নিয়ে তল্লাশি শেষ করে হতাশ হয়ে বাড়ির ড্রইংরুমে চলে এলো সে। বাবু এখন নিজের ঘরে আছে, তাকে আর ডাকলো না।
“স্যার, জিপিএস তো ভুল হতে পারে না,” জামান বলল। “ওরা এখানেই ছিল।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “অবশ্যই এখানে ছিল কিন্তু আমার ধারনা, পুলিশ আসার আগেই সটকে পড়েছে।”
উত্তরা থানার এসআই’র দিকে তাকালো জামান। “আপনি এখানে ঠিক কখন এসেছেন, বলেন তো?”
“আপনারা আসার দশ-পনেরো মিনিট আগে।”
“স্যার, নওরিন খানের জিপিএসটা বন্ধ হয়েছে আমরা এখানে আসার মাত্র সাত-আট মিনিট আগে,” জামান বলল।
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো জেফরি বেগ। সময়ের এই হিসেবটা সে-ও মেলাতে পারছে না। যেন জাদুর মতোই এই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে ঐ মহিলা আর তার বাচ্চা ছেলেটি।
“ওরা কিভাবে জেনে গেল আমরা আসছি?” অবাক হলো জামান। “কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেফরি বেগ। “ঠিক ইমরুলের মতোই…আমরা আসার একটু আগে সটকে পড়েছে, ফোনটাও নষ্ট করে ফেলেছে।”
“এটা ঐ মহিলা কিভাবে জানবে? বাস্টার্ড তাকে জানিয়ে থাকলে, সে-ই বা কিভাবে জানতে পারলো?”
মাথা দোলালো জেফরি বেগ। সহকারির এ প্রশ্নের জবাব সে-ও খুঁজছে। রহস্যময় ঐ লোকটা যে বাস্টার্ড তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অমূল্যবাবুর বাড়িতে নওরিন খানকে সে-ই নিয়ে এসেছে। কিন্তু এরপরই সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। একটার সাথে আরেকটা মেলানো যাচ্ছে না। বাস্টার্ড যদি শেষ মুহূর্তে এখান থেকে ওদের নিয়ে সটকে পড়ে থাকে, তাহলে কে তাকে জানালো?
“স্যার, এখন কি করবো?”
একটু ভেবে নিলো জেফরি বেগ। “ঐ মহিলার ফোনটা বন্ধ হবার আগে কাকে কাকে কল করেছে, তাকে কারা কল করেছে, সব জানতে হবে। নাম্বারটার সিডিআর বের করতে বলো মনীষকে।”
“ওকে, স্যার,” জামান বলল, ফোনটা বের করে কল দিলো সে।
জেফরি বুঝতে পারছে, অমূল্যবাবু আবারো কোনো চালাকি করেছে। লোকটা ঠাণ্ডা মাথায় বিচ্ছিরি সব চালাকি করতে পারে।
“স্যার?” উত্তরা থানার এসআই’র ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো জেফরি বেগ। “আমি কি করবো এখন?”
“আপনি চলে যেতে পারেন। থ্যাঙ্কস ফর দি সার্ভিস, অফিসার।”
এসআই চলে যাবার পর নন্দকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো, সহকারিকে নিয়ে সে-ও বের হয়ে গেল অমূল্যবাবুর বাড়ি থেকে। ঠিক করলো, আশেপাশে কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নেবে দুজন।
অধ্যায় ৬১
নিজের ঘরে বসে আছে অমূল্যবাবু। অন্যদিন হলে এ সময়ে ঘুমিয়ে পড়তে কিন্তু আজকের দিনটা সে রকম নয়। অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। অনেক কিছুই ঘটতে পারতো। খারাপ কিছু।
একটু আগে ঐ জেফরি বেগ তল্লাশী শেষ করে হতাশ হয়ে চলে গেছে।
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে আবারো স্থিরতার মধ্যে নিয়ে এলো সে। এতো সাধনা, এতো অনুশীলনের পরও মাঝেমধ্যে উদ্বেগ পেয়ে বসে তাকে। যতই নিজেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত রাখতে চায় না কেন, সম্ভব হয় না। মানুষ বলে কথা!
বাবলুর ফোনটা পেয়েই বুঝে গেছিল, কী করতে হবে। এই বাড়ির সামনে পুলিশ, তারা সম্ভবত নজরদারী করার জন্য এসেছে, নইলে বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালাতো। তার ধারনা সত্যি প্রমানিত হয়, একটু পরই চলে
আসে জেফরি বেগ।
কিন্তু দশ মিনিট যথেষ্ট সময় তার জন্য। বিশেষ করে এখন যে বাড়িতে আছে সেখান থেকে সটকে পড়ার জন্য। আর এটাই তাকে বাড়তি একটি সুবিধা দিয়েছে। এই বাড়িসহ, এর পেছনে যে বাড়িটা আছে-দুটোকে একসঙ্গে মিলিয়ে বড় আকারে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে কয়েক মাসের মধ্যেই।
যে সব ব্যবসার সাথে সে জড়িত, তার মধ্যে রিয়েল এস্টেট অন্যতম। এই ব্যবসা করতে লাগে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষজনের আশীর্বাদ আর সহযোগিতা। তার সেটা আছে। এটাই তাকে বিভিন্ন প্রজেক্টে পার্টনারশিপ করার জন্য বড় ভূমিকা রাখে।
জমি-জমা মানেই কাগজপত্র থেকে শুরু করে ওয়ারিশান নিয়ে নানান ধরেণের সমস্যা, এসব সমস্যা আদালতের উপরে ছেড়ে দিলে যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হয়। অমূল্যবাবু এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে অন্য যে কারোর চেয়ে দ্রুত গতিতে। অবশ্যই নির্ঞ্ঝাটভাবে। তাই রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় তার কদর আছে। এই ব্যবসায় যারা ঝাণু, তারা তাকে সব মুশকিলের আসান হিসেবে বিবেচনা করে।
তার অনেক অ্যাসোসিয়েট আছে, তার মধ্যে লিগ্যাল অ্যাডভাইজার কামালুদ্দীন হলো সবচেয়ে করিকর্মা। লোকটা বিয়েথা করেনি, একাই থাকে। সত্যিটা অবশ্য বাবু ছাড়া কম মানুষই জানে-কামালুদ্দীন আসলে সমকামী। কিন্তু এ দেশের সামাজিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পুরো ব্যাপারটা গোপন রেখেছে সে। অনেক আগে, লোক দেখানো একটা বিয়েও করেছিল, বেশিদিন টেকেনি।
কামালুদ্দীন উত্তরায়-ই থাকে, তাকে ফোন করে বলে দিয়েছিল কী করতে হবে। তার পরই ঐ মা আর বাচ্চাটাকে বাড়ির পেছনে নিয়ে যায় নন্দ। দুটো বাড়ির মধ্যে ছোট্ট একটা গেট আছে। আপন দু ভাইয়ের বাড়ি এটা, বাপ মারা গেলে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল, তবে সম্পর্কের খাতিরে ছোট্ট একটা গেট রেখে দিয়েছিল দুই বাড়ির মধ্যে। তার ধারনা এক ভাই রাজনীতি করতো বলেই এমনটা করেছিল। বিরোধী দলে গেলে যে প্রায়শই পুলিশি ঝামেলা হয়, সেটা মাথায় ছিল হয়তো। এই চোরা গেটটা বার কয়েক তাকে সেই ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। আজকে রাতে ঐ ছোট্ট গেটটা আরেক বার কাজে লেগেছে। বাচ্চাটা আর তার মাকে পেছনের ফাঁকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যায় সে।
জেফরি বেগ এখানে আসার পর ইচ্ছে করেই কথা বলে কিছুক্ষণ অতিবাহিত করে, এই সময়ের মধ্যে কামালুদ্দীন গাড়ি নিয়ে পেছনের বাড়ি থেকে মহিলা আর তার বাচ্চাকে নিয়ে গেছে। কথা বলার এক পর্যায়ে বাড়ির ভেতর থেকে যখন নন্দকে আসতে দেখে, বুঝে যায়, সময় হয়েছে জেফরি বেগকে একটু ছাড় দেবার। বেচারা সারা বাড়ি তল্লাশি করলেও বাগানের দিকটা ভালোমতো খুঁজে দেখেনি। ওখানে কোনো লাইট নেই, ফুলের গাছগুলোর জন্য ছোট্ট গেটটা খালি চোখে দেখাও যায় না সহজে। আর যদি দেখতেও পেতো, ওদের নাগাল পেতো না। ততক্ষণে ওরা চলে গেছিল।
সে জানে, জফরি বেগ এখন রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছে। তাকে আর বাবলুকে জব্দ করার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। কিন্তু বাবলুর ফিঙ্গারপ্রিন্টটা তাকে খুব বেশি সাহায্য করবে না। ইনভেস্টিগেটর যখন এটা বুঝতে পারবে তখন অন্য একটি সত্যি আবিষ্কার করবে-প্রমানকে প্রমান দিতে হয়!
সত্যি বলতে, সে নিজেও এটা জেনেছে ক-দিন আগে, আর সেটা কামালুদ্দীনের কাছ থেকেই।
বাবলুর যে ফিঙ্গারপ্রিন্টটি হোমিসাইডে আছে সেটা সরানো নিয়ে বিরাট একটি পরিকল্পনা করেছিল সে : খোঁজ নিয়ে জেনেছে, হোমিসাইডের সমস্ত কম্পিউটার আর সেগুলোর নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যাঙ্কে অ্যাকসেস আছে, সেই প্রতিষ্ঠানের এমন একজনকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে প্রিন্টটা ডিলিট করে ফেলা যাবে।
ভাগ্য ভালো, পরিকল্পনাটা নিয়ে কামালুদ্দীনের সঙ্গে আলাপ করেছিল। সব শুনে তার আইনজীবি গাল চুলকে বলেছিল, “মাছ ধরতে পুকুর সেঁচার কী দরকার? জাল ফেললেই তো হয়।”
কথাটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত লেগেছিল তার। কামালুদ্দীন তখন খুলে বলেছিল, এ কাজের জন্য এতো বিরাট আয়োজনের কোনো দরকার নেই। মি. বেগ ঐ হাতের ছাপটা নিয়েছে বুলেটের খোসা থেকে-এই তো? হোমিসাইডের এমন ফিঙ্গারপ্রিন্টের কোনো অথেনটিকেশন নেই। একেবারেই নতুন মেথড এটা, পৃথিবীর খুব কম দেশেই ব্যবহৃত হয়। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের ফৌজদারী আইনে এভাবে আঙুলের ছাপ নেবার পদ্ধতিটি এখনও স্বীকৃতি পায়নি। এখনও ভিডিও ফুটেজকে এভিডেন্স হিসেবে যেখানে অকাট্য প্রমান মনে করা হয় না, সেখানে এমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ভাবার কিছু নেই। ওটা আদালতে টিকবেই না।
কামালুদ্দীনের এমন কথা শুনে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সে। তার আইনজীবি আরো বলেছিল, নতুন নাম আর পরিচয়ে এনআইডি কার্ড করে ফেললেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে। আর এটা করা এমন কোনো কঠিন কাজ না। লোকজন কেন টাকা খরচ করে আইনজীবির শরণাপন্ন হয়, বুঝতে পেরেছিল সে।
দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো, ঘুমিয়ে পড়ার সময় হয়ে গেছে। ছেলেটা নিশ্চয়ই জেগে আছে। “নন্দ?” ডাকলো তাকে। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। একটু অবাকই হলো। “নন্দ…ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
এই ছেলে কখনও তার আগে ঘুমিয়ে পড়ে না, আবার তাকে কখনও দু বার ডাকতে হয় না। অজানা আশঙ্কায় উঠে দাঁড়ালো সে। ড্রইংরুমে এসে দেখলো ঘরটা ফাঁকা।
“নন্দ?” আরেক বার ডেকেও ছেলেটার কোনো সাড়া পেলো না। দোতলায় যাবার জন্য যে-ই না পা বাড়াবে, অমনি সেখানে ঢুকে পড়লো তিনজন লোক।
কিন্তু তাদের কাউকেই অমূল্যবাবু চেনে না!
অধ্যায় ৬২
রাত ঘনিয়ে আসছে। ঢাকা শহর প্রায় ফাঁকা। পথেঘাটে যানবাহনের সংখ্যা হাতে গোণা যাবে।
কালো রঙের মাইক্রোবাসটা চলছে মাঝারি গতিতে, গন্তব্য অমূল্যবাবুর পরিচিত এক হোটেলে। ওখানে কয়েকটা দিন থাকতে হবে তাকে। ঠিক কতোদিন, বাবু সেটা বলেনি।
বহু পুরনো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। কোথাও সে স্থির থাকতে পারে না, এটাই যেন তার নিয়তি। অথচ তার ঠিক বিপরীত অবস্থা অমূল্যবাবুর-চাইলে যেকোনো জায়গায় থিতু হয়ে যেতে পারে, কিন্তু লোকটার আজব খেয়াল, কোথাও বেশিদিন থাকে না। আজ এখানে তো কাল ওখানে। ঢাকা শহরের সবখানেই চষে বেড়ায়।
একটা জিনিস খেয়াল করেছে সে, এই লোক এমন সব বাড়িতে ওঠে যেগুলো কিছুদিন পরই ভেঙে ফেলা হবে। এ রকম পাঁচ-ছয়টা বাড়ির কথা জানতে পেরেছে। এটা কাকতালীয় হতে পারে না। সংসারবিবাগী মানুষটা ঠিক কী কারণে এটা করে?
মায়ায় জড়ানোর ভয়ে?
নাকি অন্য কিছু?
বাড়ি মানে ঠিকানা-সংসার। আর সেটা তিল তিল করে গড়ে তোলে মানুষ, তারপর এক সময় সেই বাড়ি তো বাড়ি, দুনিয়া ছেড়েই চলে যেতে হয় তাকে। বাবু কি সেটাই নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে এমন কিছু করে? নাকি সংসারের প্রতি বৈরাগ্য আনতে করে? লোকটার অতীতও তেমন একটা জানে না। কারোর অতীত জানা না থাকলে তাকে চেনা কঠিন হয়ে পড়ে।
তার ভাবনায় ছেদ পড়লো পাশ দিয়ে বেশ দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া একটি গাড়ির কারণে। রাতের বেলায় অভিজাত এলাকা গুলশান তার আসল মালিকদের দখলে চলে যায়-ধণীর দুলালের দল! দামি গাড়ি নিয়ে এখানকার অ্যাভিনুগুলোতে দাপিয়ে বেড়ায় তারা, ফর্মুলা ওয়ানের সাধ মেটায়। বিয়ার মদ আর নেশা করার কারণে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে একেকজন।
ঠিক করলো, হোটেল থেকে বেশ খানিকটা দূরে, পথের পাশে গাড়িটা পরিত্যাগ করবে। লাইসেন্স প্লেটটা সম্ভবত নকল। পুলিশ নাম্বারটা টুকেও নিতে পারেনি, পারলে এতোক্ষণে তার পেছনে পুলিশ লেগে যেতো। তারপরও কোনো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।
এমন সময় আবারো ভাবনাটা তার মাথায় উঁকি দিলো : ব্ল্যাক রঞ্জু কী করে বেঁচে গেল? অসম্ভব মনে হলেও এটাই এখন অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। তার দলের অন্য কেউ তাকে তুলে নিয়ে যেতে চাইবে কেন?
কয়েক মাস আগে যখন পত্রপত্রিকাগুলোতে রঞ্জুর খবর আসতে শুরু করলো, তখন সে একটুও বিশ্বাস করেনি। ধরেই নিয়েছিল, রঞ্জুর নাম ভাঙিয়ে আবারো চাঁদাবাজি করছে তার দলের লোকজন। তার এই বিশ্বাস এখন টলে গেছে।
কলকাতায় গিয়ে রঞ্জুকে মেরে এসেছিল সে, পরে দেখা গেল, ওটা আসলে নকল একজন রঞ্জু বানিয়ে ধোঁকা দেয়া হতো সবাইকে। নকলটাকে মেরে ঢাকায় চলে আসার পর এক দিন আচমকাই দলবল নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হয় ব্ল্যাক রঞ্জু। তাদের এই সাক্ষাৎ দু-জনের জন্যই ছিল প্রাণঘাতী। এরপর দিল্লিতে…
এমন সময় তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে বের করে দেখতে পেলো একটা অপরিচিত নাম্বার। জেফরি বেগের কারণে সতর্ক হয়ে গেছে, সেজন্যে হয়তো অমূল্যবাবু অন্য কোনো নাম্বার থেকে কল করেছে তাকে, সে ঠিকমতো পৌঁছালো কি না সেটার খোঁজ নিতে। নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে মানুষটি। রাস্তার পাশে গাড়িটা থামিয়ে কলটা রিসিভ করলো।
“হ্যালো?”
কিন্তু কয়েক মুহূর্ত ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তার পরই একটা কণ্ঠ আমুদে ভঙ্গিতে বলে উঠল : “পার্থিব রায় চৌধুরী?!”
ভুরু কুঁচকে গেল তার।
“ওরফে বাস্টার্ড!”
অধ্যায় ৬৩
নন্দ বুঝতে পারছে না কী করবে!
তার কাকাকে ধরে নিয়ে গেছে কয়েকজন লোক। তারা দরজা ভাঙেনি, কলিং বেল বাজায়নি। সম্ভবত, দেয়াল টপকে একজন ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে খুলে দিয়েছিল।
একটু আগে পুলিশের লোকগুলো তল্লাশি করে কিছু না পেয়ে চলে গেলে অমূল্যকাকা তাকে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করে শুয়ে পড়তে বলেছিল। সামনে তার এসএসসি পরীক্ষা, ঘুমানোর আগে একটু পড়াশোনা করে এখন। দোতলার ঘরে বসে যখন পড়ছিল তখনই বাইরে একটা শব্দ শুনতে পেয়ে পেয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকায়, দেখতে পায় তিনজন লোক ঢুকে পড়ছে বাড়ির ভেতরে। তার ধারনা, আবারো পুলিশ এসেছে। তবে কলিংবেল কেন বাজালো না? চোরের মতো কেন বাড়িতে ঢুকে পড়লো? বুঝে উঠতে পারেনি। সতর্ক পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায় সে, অমূল্যকাকার ঘরের দিকে যাবার আগেই শুনতে পায়, লোকগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে, আড়াল থেকে দেখে, কাকাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা।
এক বার ভেবেছিল বেরিয়ে এসে বাঁধা দেবে লোকগুলোকে, জানতে চাইবে তার কাকাকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে পরক্ষণেই বুঝে যায়, এটা করলে কাকাকে ওরা ছেড়ে তো দেবেই না, বরং তাকেও ধরে নিয়ে যাবে। সেটা হলে কাউকে জানাতে পারবে না, কাকাকে ধরে নিয়ে গেছে। তাই অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছিল। সম্ভবত একটু আগে পুলিশের লোকগুলো সুবিধা করতে না পেরে বেআইনীভাবে তার কাকাকে ধরে নিয়ে গেছে।
অমূল্যকাকার জন্য কিছু একটা করতে হবে, কিন্তু কী করবে এতো রাতে? বাচ্চা একটা ছেলে, তার ক্ষমতাই বা কতোটুকু?
নিজেকে বড্ড অসহায় লাগলো তার। কিন্তু যে মানুষটা তার জন্য এতো কিছু করেছে, তার জন্য কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকে কী করে?
মানুষটা দেবতার মতো, তাকে সন্তানের চোখে দেখে, স্নেহ করে। বলতে গেলে, তার পুরো পরিবারের ভরণপোষণই করে।
নদীভাঙার কবলে পড়ে নন্দর পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। নমশূদ্র সম্প্রদায়ের তারা, গরীবেরও গরীব, তিনবেলা অন্ন সংস্থান করতে পারতো না তার জেলে বাপ। নদীর কবলে ভিটেটা চলে গেলে রাতারাতি ভিক্ষুকে পরিণত হয়ে যায়, বউ-বাচ্চা নিয়ে চলে আসে ঢাকায়, কিন্তু এখানকার বস্তিতে ঠাঁই পায়নি। ওখানে থাকতেও টাকা-পয়সা দিতে হয়, সেই টাকা তার হতদরিদ্র বাপের ছিল না। বাধ্য হয়ে তারা ফুটপাতে পলিথিন দিয়ে ঝুপড়িঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করে। তার জেলে বাপ রিক্সা চালিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারেনি, তাই তিনবেলা অন্ন জোটাতে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড় য়া নন্দকে নামতে হয়েছিল রাস্তায়। রাস্তা মানে রাস্তা-ই। প্রথম দিকে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করতো, অচিরেই বুঝতে পারে, বছরে হাতেগোণা কয়েকটা দিন ছাড়া মানুষজন ফুলটুল খুব একটা কেনে না। অন্য একজনকে দেখে নীলক্ষেত থেকে বাংলা-ইংরেজি বই কিনে এনে ট্রাফিক সিগন্যালে বেচা শুরু করেছিল। এ কাজ করতে গিয়েই একদিন দেখা হয়ে যায় অমূল্যকাকার সঙ্গে।
“স্যার, অনেক ভালো বই…নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার,” বলেছিল নন্দ। “আরো আছে মোটিভেশনাল বই…এই যে…” বলেই কিছু বই মেলে ধরেছিল বাবুর গাড়ির কাঁচ নামানো দরজার সামনে।
“কী নাম তোমার?” তার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে প্রসন্নভাবে জানতে চেয়েছিলেন বাবু।
“নন্দ, স্যার। নন্দ কুমার জলদাস।”
অন্য অনেক দিনের মতো ভীষণ জ্যাম ছিল সেদিনটায়ও, বাবুর গাড়ি এক সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল পনেরো-বিশ মিনিটের মতো। পড়াশোনা করেছো কতো দূর?”
“স্যার, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি।”
পকেট থেকে পাঁচশ টাকা বের করে অমূল্যবাবু তার দিকে বাড়িয়ে দেন। “এই টাকায় যতোগুলো বই কেনা যায়, দাও।”
নন্দ খুব অবাক হয়েছিল, হিসেব করতে গিয়ে একটু ঝামেলায় পড়ে গেছিল সে। বার বার হিসেব করেও মেলাতে পারছিল না।
“একেবারে কাটায় কাটায় মিলতে হবে না,” বলেছিলেন বাবু। “পাঁচশ টাকার একটু কম হলেও চলবে।”
নন্দ সেদিন চার শ আশিটাকার বই দিয়েছিল কিন্তু বাবু আর বিশ টাকা ফেরত নেননি। এরপর যখন বই নেবো তখন এই বিশ টাকা মিলিয়ে দিও।”
হা করে চেয়ে ছিল সে। “কবে আসবেন, স্যার?”
“কাল বিকেলে,” বইগুলো হাতে নিয়ে বলেছিলেন অমূল্যবাবু।
পর দিন বিকেলে ঠিকই বাবু এসেছিলেন তবে বই কিনতে নয়, তার সঙ্গে কথা বলতে। গাড়িটা রাস্তার এক পাশে থামিয়ে জানতে চান, তার কে আছে, কোথায় থাকে, কিভাবে গ্রামের বাড়িটা নদীতে বিলীন হলো, ঢাকায় চলে এলো।
“পড়াশোনা করতে চাও?”
বাবুর এ কথা শুনে কান্না পেয়েছিল নন্দর। চাইলেও এই ইচ্ছেটা পূরণ করা সম্ভব নয় তার বাপের পক্ষে। সে স্কুলে গেলে তার হাড্ডিসার বাপ, অসুখবিসুখে পর্যুদস্ত মা, পুষ্টিহীন ছোটোভাই-এদের অন্ন সংস্থান হবে কী করে? মাথা নিচু করে রেখেছিল সে। অনেক চেষ্টা করেও চোখের জল আটকাতে পারেনি। তার মাথায় স্নেহময় হাত রাখেন বাবু, গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যান ফুটপাতের সেই বস্তিতে, যেখানে তার পরিবার থাকতো।
কিন্তু ওখানে গিয়ে নন্দ দেখে ফুটপাতে কেউ নেই! আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, কয়েক ঘণ্টা আগে ফুটপাত থেকে বস্তিটা তুলে দেয়া হয়েছে। একটু দূরে নিজেদের সামান্য সাংসারিক সম্বল নিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল তার বাবা-মা আর ছোট ভাইটি। ঐদিন বাবু যেন তাদের জন্য দেবদূত হয়ে এসেছিলেন, রাস্তা থেকে তাদের সবাইকে তুলে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। কিছুদিন থাকার পর সাভারের দিকে এক টুকরো জমিতে ঘর তুলে দেন অমূল্যকাকা। তার মা-বাবা আর ছোটো ভাই ওখানেই থাকে এখন। তার বাপকে সাভারের দিকে এক কন্ট্রাকশন সাইটের দেখভালের কাজও দিয়েছেন।
এসএসসি পরীক্ষা দেবার জন্য কয়েক মাস ধরে বাবুর সঙ্গে উত্তরায় আছে নন্দ। প্রতি সপ্তাহে সাভারে গিয়ে মা-বাবা আর ছোটভাইয়ে সাথে দেখা করে আসে।
অমূল্যকাকার সঙ্গে থেকে কতো কিছুই না শিখেছে সে। আদব-কায়দা থেকে শুরু করে কিভাবে কী করতে হয়, সবই। নতুন কোনো জায়গায় গিয়ে বোকার মতো এদিক ওদিক না ঘুরে ট্রাফিক পুলিশ কিংবা লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কোথাও গিয়ে সবার আগে মন দিয়ে সব কিছু দেখতে হয়, মুখ খুলতে হয় সবচেয়ে কম। পরিমিত আহার, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, অবসরে বই পড়া, বাগান করা, গাছেদের যত্ন নেয়া-সবই কাকার কাছ থেকে শেখা। আজকে কি না সেই মানুষটাকে একদল মন্দ লোক তুলে নিয়ে গেছে! কাকাকে তারা কী করবে, এই চিন্তায় মুষড়ে পড়েছিল সে।
এখন বুঝতে পারছে, ঘরে বসে বসে হায় হুতাশ না করে কিছু একটা করতে হবে তাকে। মনে পড়ে গেল, ক-দিন আগে কাকা তাকে মোবাইলফোন কিনে দিয়েছিলেন, তাতে দরকারি কিছু নাম্বারও সেভ করে দিয়েছেন বৈদ্যুতিক সমস্যা হলে লোকাল ইলেক্ট্রিক অফিসে যেন ফোন করে; বিপদে পড়লে পুলিশে; হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে; অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, নেটপ্রোভাইডারের নাম্বার। দৌড়ে গিয়ে নন্দ তার ফোনটা নিয়ে এলো কিন্তু বুঝতে পারছে না কাকে ফোন দেবে। ছোট্ট মাথাটায় কিছুই ঢুকছে না। এতোদিন অমূল্যকাকার ছায়ায় ছিল, কোনো কিছু নিয়েই ভাবতে হতো না, এখন সেই মানুষটার অনুপস্থিতিতে হিমশিম খাচ্ছে।
গভীর করে শ্বাস নিয়ে ছাড়লো বার কয়েক-অমূল্যকাকা তাকে শিখিয়েছিলেন-এতে চিত্ত অচঞ্চল হয়, মাথা থাকে ঠাণ্ডা। বুদ্ধিও খুলে যায়।
তাই হলো!
কিছুক্ষণ আগে যে উকিলকে ডেকেছিলেন কাকা, অন্য অনেক জরুরি নাম্বারের মধ্যে সেই লোকের নাম্বারটাও আছে তার ফোনে! সঙ্গে সঙ্গে কামালুদ্দীনের নাম্বারে কল দিলো। পর পর তিন বার রিং হলেও কলটা ধরলো না ভদ্রলোক। এই নাম্বারটা সম্ভবত ঐ লোকের কাছে নেই, তাই এতো রাতে অপরিচিত নাম্বার বলে ধরেনি। কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। নিজেকে খুবই অসহায় লাগলো তার, খুব কান্না পেলো। আর এমন সময়েই বেজে উঠল তার ফোনটা!
অধ্যায় ৬৪
একটু আগে ব্যর্থ মনোরথে অমূল্যবাবুর বাড়ি থেকে বের হয়ে সে টের পায় প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। নিশ্চয় জামানেরও একই অবস্থা। আশেপাশে ভালো একটা রেস্টুরেন্ট দেখে খেয়ে নিলে কেমন হয়-এমন কথা শুনে সায় দিয়েছিল তার সহকারিও। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়েছিল তারা, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়েছে রাতের খাবার। শেষে দু-কাপ কফি নিলো।
“আজকের মতো কাজ শেষ,” বলল সে। “কাল থেকে পুরোদমে শুরু করবো।”
ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত জামান যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
সোয়ান লেক সিটির তিন তিনটি হত্যাকাণ্ড যে শেষ পর্যন্ত এতো দূর গড়াবে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। এই এক ঘটনায় তারা নিশ্চিত হয়ে গেছে, ব্ল্যাক রঞ্জু সম্ভবত জীবিত আছে। আরো বেশি নিশ্চিত হয়েছে, পেশাদার খুনি বাস্টার্ড বেঁচে আছে।
কফি শেষ করে বাইকে উঠে বসলো তারা। বড়জোর দুশো গজও এগোয়নি, জেফরি টের পেলো তার ফোনটা বাজছে। “থামো,” পেছন থেকে বলল সে।
জামান তার বাইকটা রাস্তার পাশে থামাতেই নেমে পড়লা হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কলার আইডি দেখে খুবই অবাক হলো। ফারুক স্যার! এতো রাতে?
“স্যার?” কলটা রিসিভ করে বলল।
“তুমি কোথায়?” জানতে চাইলো হোমিসাইডের ডিজি।
“উত্তরার দিকে।”
“ওখানে কি করো এতো রাতে?”
“একজনকে ট্রেস করতে করতে এখানকার এক বাড়িতে চলে এসেছিলাম।”
ফোনের ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারুক আহমেদ। “অমূল্যবাবুর বাড়িতে?”
অবাক হলো জেফরি বেগ। “আপনি কিভাবে জানলেন, স্যার?”
“বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল মহাপরিচালক। “হোমমিনিস্টার নিজে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন।”
ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। হোমমিনিস্টার!
“ঐ ভদ্রলোককে একটু আগে সাদা পোশাকের পুলিশ বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে।”
“পুলিশ?!” অবিশ্বাসে বলে উঠল জেফরি।
“হুম। তুলে নিয়ে যাবার আগে তুমি নাকি উনার বাসায় গিয়ে হুমকি ধামকি দিয়েছো?”
“আমি ওখানে গেছি, এটা হোমমিনিস্টার কিভাবে জানলেন, স্যার?”
জামান উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলো।
“সেটা তো আমি জিজ্ঞেস করিনি,” ওপাশ থেকে বলল ডিজি। “তবে উনাকে যারাই ইনফর্ম করেছে, তারা বলেছে এটা।” একটু থেমে আবার বলল ফারুক আহমেদ, “তুমি চলে আসার পরই ঘটনাটা ঘটেছে, তাই…”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল জেফরির। “স্যার, উনি আপনাকে ঠিক কী বলেছেন, বলবেন কি?”
“উনি জানতে চেয়েছেন, এই ঘটনার সাথে তোমার…মানে আমাদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না।”
বিশ্বাস করতেও কষ্ট হলো জেফরি বেগের। “উনাকে আপনার বলা উচিত ছিল, হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট কখনও কাউকে গুম করেনি।”
“রাগ কোরো না,” ডিজি বলল। “ঐ লোকটা মিনিস্টারসাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ কেউ, তাই উনি একটু ইয়ে হয়ে আছেন।”
“অবশ্যই উনার ঘনিষ্ঠ লোক!” জোরেই বলল জেফরি বেগ। “খুনখারাবি করা লোকজনই তো উনাদের ঘনিষ্ঠ মানুষ হবেন, এ আর নতুন কি!”
“কুল ডাউন, মাই বয়,” জেফরির রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করলো হোমিসাইডের মহাপরিচালক। “উনি ঠিক অভিযোগ করেননি, জানতে চেয়েছেন আর কি। আমি বলে দিয়েছি, এটা হতেই পারে না। উনাকে নিশ্চয়ই ভুল ইনফর্মেশন দেয়া হয়েছে।”
বহু কষ্টে রাগ দমন করলো জেফরি বেগ।
“তোমার কি ধারনা, উনাকে কারা তুলে নিয়ে যেতে পারে?”
জেফরি বেগ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না আসলে কী হয়েছে। “এক ফিউজিটিভকে লোকেট করেছিলাম উনার বাড়িতে, অল্পের জন্য ধরতে পারিনি। আমরা চলে আসার পর ওখানে কী হয়েছে, জানি না।”
মনে হলো ফারুক আহমেদ একটু কাচুমাচু খেলো। “উমম…ডু ইউ সাসপেক্ট এনিথিং?”
ডিজির স্যারের ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো জেফরি। হোমমিনিস্টারকে কিছু একটা বলতে হবে-সেটা অনুমাণ নির্ভর হলেও। আজকে রাতে বাস্টার্ডের উপর হামলা করেছিল রঞ্জুর দল। সুতরাং…
“সম্ভবত ব্ল্যাক রঞ্জুর লোকজন তুলে নিয়ে গেছে।”
“বলো কি!” অবাক হলো ফারুক আহমেদ। “এই ঘটনায় রঞ্জু এলো কিভাবে?”
“স্যার, ঐ অমূল্যবাবু বাস্টার্ডের মেন্টর আর বাস্টার্ডের সঙ্গে রঞ্জুর ঝামেলাটা বেশ পুরনো।”
“সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু ওরা ভদ্রলোককে খুঁজে পেলো কী করে?”
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জেফরি। চট করেই একটা ভাবনার উদয় হলো। “স্যার, আপনাকে একটু পর ফোন দিচ্ছি আমি।”
জামান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফোনালাপের সবটাই শুনেছে সে। “অমূল্যবাবুকে রঞ্জুর লোকজন কিডন্যাপ করেছে!” বিস্মিত তার সহকারিও। “এটা কী করে হলো?”
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো জেফরি। “কিভাবে হলো, একটু পরই জানা যাবে।”
হা করে চেয়ে রইলো জামান, কিছুই বুঝতে পারলো না সে।
অধ্যায় ৬৫
অমূল্যবাবু এখন রঞ্জু গ্রুপের হাতে বন্দি!
এ নিয়ে তার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। আর যে কণ্ঠটা ফোনের ওপাশ থেকে কথা বলছে, সে রঞ্জু?!
কণ্ঠটা বিকৃত। কেমন ফ্যাসফেসে। মনে হয় টেনে টেনে, ঠোঁটমুখ বেঁকিয়ে কথা বলছে।
আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে?
বদমাশটা প্রাণে বেঁচে গেলেও ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে যাবার কথা। এখন আরেক আগুনে পুড়ছে ওই সন্ত্রাসি-প্রতিশোধের আগুনে।
“আমি বেঁচে আছি…অবাক হচ্ছিস?”
সে কিছুই বলল না। রঞ্জুর কণ্ঠটা কেমন ছিল মনে করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতো দিন আগে শুনেছে, আর সেটাও এতো অল্প সময়ের জন্য যে মনে নেই। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত, রঞ্জু ঠিক এভাবেই কথা বলতো-প্রমিত বাংলায়। ওর মতো একজন সন্ত্রাসি প্রমিত বাংলায় কথা বলে, ব্যাপারটা অবাক করার মতোই সত্য।
“আগুনে পুড়িয়ে মারলি, তারপরও বেঁচে গেলাম! মাথায় কিছুই ঢুকছে?” আমোদিত হয়ে হাসলো ফোনের ওপাশ থেকে। “ঢুকবে না রে, বাস্টার্ড! ঢুকবে না! শুধু জেনে রাখ, রঞ্জু এতো সহজে মরবে না!”
গভীর করে শাস নিলো সে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, দিল্লিতে যাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, সে-ও আসল রঞ্জু ছিল না! কলকাতার ঐ নকল রঞ্জুর মতো আরো অনেক রঞ্জু আছে, তাদেরই একজনকে সে পুড়িয়ে মেরেছে।
“কী দিনকাল পড়লো, আজকাল বাস্টার্ডদেরও বাপ থাকে!” বিকৃত কণ্ঠটা বলল। “ঐ লোক তো হিন্দু, তুই-ও কি হিন্দু?” বলেই খ্যাক খ্যাক করে হাসলো। বিচ্ছিরি সেই হাসি।
বাস্টার্ডের মাথায় ঢুকছে না, বাবুর বাড়িতে পুলিশ গেছিল, কিন্তু রঞ্জুর লোকজন কিভাবে তাকে তুলে নিয়ে এলো?!
“আমি তো ভেবেছিলাম, আদারে পাদরে তোকে জন্ম দিয়ে চলে গেছে তোর বাপ।” কোনো সাড়া না পেয়ে আবার বলল কণ্ঠটা, “আছিস, বাস্টার্ড?”
“হুম,” আস্তে করে বলল সে।
“কথা বলছিস না কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না? তোর এই নাম্বারটা হোয়াটসঅ্যাপে আছে? থাকলে বল, তোর বাপের ছবি পাঠিয়ে দেই।”
“দরকার নেই,” একদম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো নিজের কণ্ঠ।
হাসির শব্দ শোনা গেল ফোনের ওপাশ থেকে। “তোর এই লোককে, মানে তোর বাপকে আমি আগুনে পুড়িয়ে মারবো। জিন্দা জ্বালিয়ে মারবো, ঠিক যেভাবে তুই আমাকে মারতে চেয়েছিলি!”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার।
“আগুনে পোড়া অনেক কষ্টের…অনেক! তুই-ও বুঝবি, যখন তোকেও আমি পোড়াবো, বাস্টার্ড!”
সত্যি বলতে, এ কথা শোনার পর ব্ল্যাক রঞ্জুর ব্যাপারে তার সন্দেহের দুর্বলতম ভিতটাও এক লহমায় ভেঙে পড়লো।
“আমার কাছে আকুতি মিনতি করবি না, তোর এই বাপকে আমি যেন মারি? বলবি না, তুই ধরা দিবি আমার কাছে, তবু যে তোর বাপকে না মারি?” তারপরই এমনভাবে হেসে ফেলল যেন খুব মজা পেয়েছে। “নাকি তুই ভাবছিস, আমি বলবো, তুই ধরা দে, নইলে তোর এই বাপকে জিন্দা পুড়িয়ে মারবো?”
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো সে, কিছুই বলল না।
“আমি অতোটা পাগল না, বাস্টার্ড। আমি জানি, তোর মতো বানচোত এটা করবে না। একটু থেমে আবার বলল, “তুই আমার অনেক ক্ষতি করেছিস, আমার অনেক কাছের মানুষকে খুন করেছিস, আমি এখন তোর এই বাপকে মেরে শুরু করবো আমার খেলা। মনে রাখিস, তোকেও আমি ধরবো, পুড়িয়ে মারবো…বাস্টার্ড!”
বুঝতে পারছে, তার উপরে যতো ক্ষোভ, সবটাই এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসি উগলে দেবে বাবুর উপরে। “ঐ লোক আমার বাবা না।”
“হা-হা-হা!” অট্টহাসি দিলো রঞ্জু। “ভেবেছিস আমি এটা জানি না? বাপ থাকলে কি তোকে সবাই বাস্টার্ড বলতো!” ভারি নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। দম ফুরিয়ে গেছে। “কিন্তু আমি জানি, এই লোক তোর বাপের চেয়েও বেশি! আমি তোর এই বাপকেই মারবো!”
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “তারপর?”
ফোনের ওপাশের জন বুঝতে পারলো না। তারপর কী?”
“তারপর কী করবি?” শীতল কণ্ঠে কথাটা বলতে পারলো সে।
“শুয়োরের বাচ্চা! আমি তোকেও মারবো!” প্রচণ্ড রেগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ফোনের ওপাশ থেকে।
“আজকে যেভাবে মারতে চেয়েছিলি, তিন-চারজনকে পাঠিয়ে?”
চুপ মেরে রইলো রঞ্জু।
“মনে রাখিস, আমি নিজে তোকে মারবো…অন্য কাউকে পাঠাবো না।”
“তুই আমার বাল ফেলবি!” রেগেমেগে বলল রঞ্জু।
আবারো হাসলো বাবলু। “সেটা করতে হলে তো তোর খুব কাছাকাছি আসত হবে।”
“খানকির পোলা!”
রঞ্জু যে মেজাজ হারিয়েছে, বুঝতে পারলো। এটাই চেয়েছিল সে। ওপাশ থেকে কণ্ঠটা চুপ মেরে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। “ভয় পেয়ে গেলি?”
“শুয়োরের বাচ্চা!” ব্ল্যাক রঞ্জু রেগেমেগে বলল। “আয় তুই…আয় আমার সামনে!”
“কোথায় আসবো, বল?” একদম শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো।
কী বলবে ভেবে পেলো না রঞ্জু।
“ভয় পাচ্ছিস?”
রেগেমেগে ফোনটা কেটে দিলো সন্ত্রাসি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। খুব হিসেব করে, সাবধানে কথা বলতে হয়েছে। তাকে। কিছুই করার নেই। বাবুর প্রতি সামান্য দুর্বলতা দেখালে ওই সন্ত্রাসি আরো বেশি পেয়ে বসততা। এমন মুহূর্তে এ কাজ না করে ঠিকই করেছে। তবে তার কেন জানি মনে মনে হচ্ছে, বাবুকে এক্ষুণি মারবে না-যা করার আগামি কাল করবে।
সঙ্কটের সময় কোনো না কোনো একটা পথ খুঁজে পায় সে। অন্যদের মতো চাপের মুহূর্তে তার মাথা আউলে যায় না, বরং অবিশ্বাস্যভাবেই সেটা কাজ করতে শুরু করে।
কোনো রকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আক্রান্ত না হয়ে ধীরস্থিরভাবে ভাবতে শুরু করলো। কিন্তু একা আ
ময়ের মধ্যে সে কী করতে পারবে।
অমূল্যবাবুর জন্য খুব খারাপ লাগলো তার। যদি তাকে বাঁচানোর সামান্যতমও সুযোগ থাকতো, আপ্রাণ চেষ্টা করতো।
পরক্ষণেই মনে হলো, এতা সহজে কখনও সে হাল ছেড়ে দেয় না। এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। যতো অসম্ভবই হোক, সে চেষ্টা করে দেখে।
তাই করলো। গভীর করে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো সে।
কিছুক্ষণ পরই একটা চিন্তা উঁকি দিলো তার মাথায় রঞ্জু যেভাবে তার খোঁজ পেয়েছে, সেভাবে ওর খোঁজও বের করা সম্ভব!
অধ্যায় ৬৬
যে লোকটা চাতুর্যের সঙ্গে বার বার পেশাদার খুনি বাস্টার্ডকে আইনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়, তার মেন্টর হয়ে রক্ষা করে, সে কি না হোমমিনিস্টারের ঘনিষ্ঠ লোক! আর তাকে নিয়ে মন্ত্রী রাত-বিরাতে উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। নিজের মানুষজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন।
রাগে জেফরির গা কাঁপছে।
ইন্টেরোগেশনের সময় কোনো অভিযুক্ত আসামিকে চড় মারতেও দশ বার চিন্তা করে সে, সচরাচর ধমক পর্যন্ত দেয় না, সে করবে অপহরণ? এমন আজগুবি অভিযোগ করার আগে মন্ত্রী একটুও ভাবলেন না? হয়তো অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনির অপকর্মের ফল ভোগ করছে তারা! ‘গুম’ করার মতো জঘন্য কাজ তো হচ্ছেই এ দেশে, কিন্তু ওসব কারা করে, হোমমিনিস্টার ভালো করেই জানে।
জেফরি অনেকটাই নিশ্চিত, অমূল্যবাবুকে রঞ্জু গ্রুপ তুলে নিয়ে গেছে। কিভাবে বাবুর বাড়ির খোঁজ পেলো রঞ্জু গ্রুপ, সেটাও আন্দাজ করতে পারছে। গত মাসে রাহিদ হাসান উজ্জ্বলকে হোমিসাইডে নিয়ে আসার পর একেবারে শেষ মুহূর্তে ইমরুল নামের রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোকটি টের পেয়ে ফোন নষ্ট করে সটকে পড়ে। তখন সে বুঝতে পারেনি, কিভাবে এটা হলো-তবে এখন পারছে। সে আত্মবিশ্বাসী, তার ধারনাই সত্যি। আর সেজন্যেই এখন ছুটে যাচ্ছে উত্তরার এগারো নাম্বার সেক্টরের পার্কের দিকে। একটু আগে উত্তরা থানায় ফোন করে এটা জেনে নিয়েছে।
আবাসিক এলাকাটি পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েছে। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাইরে ঝিমুতে থাকা দারোয়ানদের কেউ কেউ বাইকের শব্দে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো। পার্কের পশ্চিম দিকে চলে গেছে ১ নাম্বার রোডটি, সেখানে টহল পুলিশের একটি গাড়ি থেমে আছে। এই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় টহল দিয়ে এখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে তারা।
জামানের বাইক টহল দলের পিকআপ ভ্যানের পাশে থামতেই নড়েচড়ে উঠল পুলিশের দলটি। জেফরি বেগ তার হেলমেট খুলে বাইক থেকে নেমে পড়লো।
উত্তরা থানার এসআই আবুল কালাম সিগারেট খাচ্ছিল ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে, জেফরিকে চিনতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটটা জলাঞ্জলি দিলো। “স্যার, আপনি?” বেশ অবাক হলো সে।
“একটা দরকারে এসেছি,” বলল জেফরি বেগ। “আপনি একটু আমার সঙ্গে আসুন,” বলেই পার্কের মেইনগেটের দিকে ইশারা করলো।
এসআই আবুল কালাম চুপচাপ তার সঙ্গে চলে এলো পার্কের গেটের সামনে, পুলিশের ভ্যান থেকে একটু দূরে। “কী হয়েছে, স্যার?”
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো জেফরি। “একটু আগে এখানকার একটা বাড়িতে রেইড দিয়েছিলাম, মনে আছে?”
“জি, স্যার।”
“আমরা ঐ বাড়ি থেকে বের হবার পর, বাড়ির মালিককে একদল লোক তুলে নিয়ে গেছে।”
“বলেন কী!” বিস্মিত হলো এসআই।
“আমি জানি, কাজটা কারা করেছে,” শান্তকণ্ঠে বলল জেফরি বেগ। “কিন্তু ওদেরকে ধরতে হলে আপনার সাহায্য লাগবে।”
আরো বিস্মিত হলো এসআই। “বলুন, স্যার…কী করতে পারি আমি?”
এমন সময় বাইকটা রেখে তাদের কাছে চলে এলো জামান।
“আপনার ফোনটা দিন,” হাত বাড়িয়ে শীতল কণ্ঠে বলল হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
আবুল কালাম কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝতে পারলো না। “আ-আমার ফোন মানে!” তোতলালো সাব-ইন্সপেক্টর। চোখেমুখে তার অবিশ্বাস।
“যে ফোনটা দিয়ে ওদের কাছে খবর দিয়েছেন, সেটা!” দাঁতে দাঁত পিষে বলল জেফরি বেগ।
জামান অবশ্য বাক্য ব্যয় করলো না, লোকটার কাঁধে হাত রাখলো।
অধ্যায় ৬৭
শ্বাসপ্রশ্বাস আবারো স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে অমূল্যবাবু।
লম্বা একটা সময় নিশ্বাস নিতে বেগ পেয়েছে। তিনজন লোক তাকে অস্ত্রের মুখে একটা গাড়িতে তুলে নেবার পর থেকে হাত-পা-মুখ-চোখ বেঁধে একটা পাজেরো গাড়িতে তোলে। তারপর সিটের নিচে শুইয়ে দেয়া হয় তাকে, দু-জন অস্ত্রধারি সিটে বসে পা দিয়ে চেপে রাখে তাকে যেন নড়তে চড়তে না পারে।
কিন্তু এসবের কোনো দরকারই ছিল না। শান্তভাবেই সব মেনে নিতো।
গাড়িটা চলতে শুরু করলে গভীর ধ্যানে চলে যায় সে। শ্বাসপ্রশ্বাস একদম ধীরগতির করে ফেলে। গাড়িটা কতোক্ষণ পর, কতো দূর গিয়ে কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, সবই যেন দেখতে পাচ্ছিল মনের চোখ দিয়ে।
ঢাকা শহরটা তার মুখস্ত। সারা জীবন এখানেই কেটেছে। নতুন-পুরান সব অংশেই সমান বিচরণ। কতো জায়গায় থেকেছে, ইয়ত্তা নেই। দুই যুগেরও বেশি আগে থেকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জড়িত বলে শহরটা তার হাতের তালুর মতোই চেনা।
গাড়িটা যে গতিতে চলছিল সেটাও বুঝতে পারছিল সে, ডানে-বাঁয়ে মোড় নিয়ে শহরের কোন্ অংশে যাচ্ছে, ধারনা করে নিতে কষ্ট হয়নি। অবশেষে, প্রায় বিশ মিনিটের যাত্রাপথ শেষ হলে বুঝতে পারে, ঠিক কোথায় তাকে নিয়ে আসা হয়েছে!
একটা ভবনের সামনে কিছুক্ষণ থামে গাড়িটা, তারপর মেইনগেট খোলার শব্দ শুনতে পায়-ঢাকা শহরের আর সব অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের মতোই কোনো ভবন। গাড়িটা পার্কিং এরিয়ায় গিয়ে থামলে দু-জন লোক তাকে দু-দিক থেকে ধরে লিফটের কাছে নিয়ে যায়। লিফটটা যে সময় নিয়েছে, হিসেব করে বুঝতে পারে, তিন তলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে।
ফ্ল্যাটের মেইন দরজার পর একটি অংশ পেরিয়ে নিয়ে আসা হয় এক ঘরে, সেখানে একটা সোফায় বসিয়ে রাখা হয়। চোখ বাঁধা থাকলেও বুঝতে পারে ঘরে আলো জ্বলছে। তার থেকে একটু দূরে দু-জন লোক ফোনে কথা বলে, কাউকে জানায়, তাকে তুলে আনার কথাটা। কথা বলা শেষ করে তাদের একজন সম্ভবত মোবাইলফোনে ছবি তুলেছে তার।
এরপরই ঘরের বাতি নিভিয়ে তারা চলে যায়।
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থিরতার মধ্যে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে সে। যেকোনো সময় তাকে মেরে ফেলা হবে, হয়তো ভয়াবহভাবে, খুব বেশি বেশি নৃশংস উপায়ে। এই শেষ সময়টার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রাখা দরকার-জীবিত সকল প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়, এড়ানোর কোনো উপায় নেই। এ নিয়ে তার মধ্যে যে ভয়ডর, সেটা চলে গেছিল সেই একাত্তরেই। বার কয়েক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে, এমন কি যুদ্ধের পরও বেশ কয়েকবার মৃত্যু তার কাছ দিয়ে চলে গেছিল। সত্যি বলতে, নিজের জন্য সবচেয়ে খারাপ পরিণতিটা মেনে নেবার পর নির্ভারও লাগছিল তার!
এমন বন্দিদশায়ও নিজেকে নিয়ে নয়, বরং তার যতো ভয় হচ্ছিল বাবলুকে নিয়ে। তার উপরে পা দিয়ে সিটের উপরে বসা দু-জন লোকের কথাবার্তা থেকে সে বুঝে গেছে রঞ্জুর লোকজনই তাকে তুলে এনেছে। হয়তো এরইমধ্যে বাবলুকে জানিয়েও দিয়েছে সে কথা। তার মোবাইলফোনটা ওদের হাতে, কললিস্ট চেক করলেই ‘পার্থিব রায় চৌধুরী নামে একটা নাম পাবে। এই নামটা হোমিসাইডের ঐ ইনভেস্টিগেটরকে সে নিজেই বলেছিল। সমস্যা হলো, তার সঙ্গে থাকা উত্তরা থানার এক এসআই ও জেনে গেছিল সেটা। সে অনেকটাই নিশ্চিত, ঐ এসআই রঞ্জুর দলকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছে। ঢাকার প্রতিটি থানায় রঞ্জুর পে-রোলে থাকা পুলিশ আছে–এমন কথা কয়েক মাস ধরেই শুনে আসছিল।
রঞ্জুর হাতে সে বন্দি, এটা জানার পর বাবলু ওদের পিছু নেবে, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। সেটা করতে না পারলেও তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠবে। কিন্তু একা, এ রকম ভয়ঙ্কর একটি চক্রের সঙ্গে পেরে উঠবে না। ও যখনই ব্যক্তিগত আবেগের বশে কাজ করেছে, ওর জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়েছে সেটা। ভাবনাটা ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল তার ভেতর থেকে।
কিছুক্ষণ পর আবারও তাকে নিচে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তোলে দু-জন লোক। তিনজনের মধ্যে আগের একজন ছিল না তখন, বুঝতে পেরেছিল। তবে এবার তাকে পাদানিতে না, সিটে বসানো হয়। এরপর গাড়িটা বের হয়ে যায় সেই আবাসিক এলাকা থেকে। এবারও মনের চোখ দিয়ে দেখতে পায়-গাড়িটা উত্তর দিকে যাচ্ছে, তারপর সামান্য ডানদিকে, আবার উত্তর দিকে। অল্প সময় পরই আরেকটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে, লিফটের কাছে থামে সেটা।
এবারের ফ্ল্যাটটা অনেক বেশি বড়। এখানে এনে তার হাত-মুখ-চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। কিন্তু চশমা ছাড়া অন্ধকার ঘরে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না, তাই চোখ বন্ধ করে বসেছিল সে।
.
ঠিক কতোক্ষণ পর অমূল্যবাবু জানে না, দরজা খোলার শব্দ হলো, ঘরে প্রবেশ করলো আরেকজন মানুষ। কিন্তু চোখ খুলে দেখলো না সে। যে প্রবেশ করেছে তার পায়ে পাম সু আছে সম্ভবত, ফ্লোরের উপরে সেটা ঠক ঠক শব্দ তৈরি করছে। লোকটা ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালো। তার দিকে যে তাকিয়ে আছে, বুঝতে পারলো।
অপহরণকারি দলের নাটেরগুরু?
রুচিসম্মত পারফিউম ব্যবহার করেছে লোকটা। তবে সেটা নব্যধনীদের মতো উকট কিছু না। টের পাচ্ছে, এখনও তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে, যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখেছে।
কী দেখছে লোকটা? তাকে দেখে অবাক হবারই বা কী আছে?
গভীর করে শ্বাস নিলো বাবু, তবে সেটা বুঝতে দিলো না। খ্যাচ করে একটা মৃদু শব্দ হলো, সম্ভবত তার বিপরীত দিকের সোফায় বসে পড়েছে লোকটি।
অধ্যায় ৬৮
উত্তরা থানার এসআই আবুল কালাম সব কিছু অস্বীকার করলেও জেফরি বেগ তার কথা বিশ্বাস করেনি। তাকে পরিস্কার জানিয়ে দেয়, একটু আগে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টকে তার ফোনের সিডিআর বের করতে দিয়েছে, সে যদি তার ফোনের কললিস্ট থেকে নির্দিষ্ট কলটা ডিলিট করেও থাকে, কোনো লাভ হবে না, সিডিআর-এ সব পাওয়া যাবে। এসআই যদি সবচেয়ে কম খারাপ কিছু আশা করে, তাহলে পূর্ণ সহযোগিতা করবে। তাদের হাতে সময় কম। যে লোককে রঞ্জুর দল তুলে নিয়ে গেছে সে অনেক বড় হোমড়া চোমড়া, স্বয়ং হোমমিনিস্টার তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। এই লোকের কোনো ক্ষতি হবার আগেই তাকে উদ্ধার করতে হবে। নইলে তার চাকরি তো যাবেই, জেলের হাত থেকেও রেহাই পাবে না।
তারপরও এসআই আবুল কালাম ফোনটা এতো সহজে দেয়নি। হতবিহ্বল মুহূর্তটা কাটিয়ে ওঠে থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, জেফরি তখন ওসিকে ফোন দিয়ে জানায় ব্যাপারটা। ওসি যখন বলে, হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটরকে সব ধরণের সহযোগিতা করতে হবে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, তখন ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো অবস্থা হয় তার, বাধ্য হয়েই ফোনটা দিয়ে দেয় জেফরিকে। জামান দ্রুত কললিস্ট ঘেঁটে দেখে, বিগত এক ঘণ্টায় মাত্র দুটো আউটগোয়িং কল করেছে সে। তার ফোনে ইনকামিং কল এসেছে একটা।
“ঐ বাড়ি থেকে বের হবার পর কোথায় কোথায় কল করেছেন?” জেফরি বেগ জানতে চাইলো।
“আমার ওয়াইফকে, স্যার, এসআই আবুল কালাম বলল। “আর কোথাও না।”
“এটা কার নাম্বার?” আফিয়া নামে সেভ করা একটি নাম্বার দেখিয়ে জানতে চাইলো জামান।
“এটাই আমার ওয়াইফের।”
“মিথ্যে বলবেন না, আমরা কিন্তু চেক করে দেখবো,” সন্দেহের সুরে বলল জেফরি।
“জি, স্যার…চেক করে দেখেন,” বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল এসআই।
সময় দেখে মনে হচ্ছে, অমূল্যবাবুর বাড়ি থেকে বের হবার পরই এই নাম্বারটায় কল করেছে। জেফরি বেগের কাছে মনে হলো না, এই নাম্বারটা রঞ্জু গ্রুপের কারোর। যদি তাই হতো, এসআই এতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতো না। এবারকার রঞ্জু গ্রুপটা এতো বেশি সতর্ক যে তাদেরকে ট্রেস করাই যায় না। ওরা ইনসিকিউর্ড লাইনে যোগাযোগ করে বলেও মনে হয় না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো উপায়ে যোগাযোগ করে।
আর তখনই মনে পড়ে গেল একটা কথাটা : ভিডিও কলে কথা বলেছে ইকরাম হোসেন আর সঙ্গি! উজ্জ্বলও!
নিজের লোকজনের সঙ্গে কি তারা এভাবেই যোগাযোগ করে?
“হোয়াটসঅ্যাপ চেক করো,” জেফরি বেগ বলল। লক্ষ্য করলো এসআই একটুও ভড়কে গেল না।
জামান এবার ফোনটার হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাপ্লিকেশন ওপেন করলো। সেখান থেকে বিগত আঠারো ঘণ্টায় কাউকে কল বা মেসেজ করা হয়নি। জেফরির দিকে তাকিয়ে মাথা দোলালো সে।
“মেসেঞ্জোর, ইমো…সব চেক করো।”
জামান সেটাই করলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই মাথা দুলিয়ে মুখ তুলে তাকালো। কিছু নেই।
“সময় নষ্ট করছেন আপনি!” একটু চেঁচিয়েই বলল জেফরি বেগ। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালো সাব-ইন্সপেক্টর।
“কো-অপারেট করুন। নইলে আমি মিনিস্টারকে বলে দেবো, আপনিই রঞ্জু গ্রুপে খবরটা দিয়েছেন।” একটু থেমে আবার বলল, “আপনার এই ফোনটার ডিজিটাল ফরেনসিক টেস্ট করলে সব বেরিয়ে আসবে, আপনি পার পাবেন না। কো-অপারেট করলে আপনার কম ক্ষতি হবে।”
এ কথা শোনার পর এসআই কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আপনি আমাকে এতো বড় ব্লেইম দিতে পারেন না, স্যার! আমার চাকরি জীবনে এটা কতো বড় স্পট ফেলবে, জানেন?”
জেফরি বেগ লোকটার দিকে চেয়ে রইলো, কিছুই বলল না।
“খামোখাই আমাকে সন্দেহ করছেন,” বলেই চোখ মুছলো এসআই কালাম।
থুতনী চুলকালো জেফরি বেগ। লোকটার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই বলছে। কিন্তু এই লোক যদি না বলে থাকে, তাহলে রঞ্জুকে খবরটা দিলো কে? অমূল্যবাবুর বাড়িতে সে আর জামান ছাড়া এই লোকটাই গেছিল। তারা ওখান থেকে বের হবার পর খুব দ্রুত বাবুকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
“স্যার?”
জামানের দিকে ফিরে তাকালো। বুঝতে পারলো, তার সহকারি জানতে চাইছে, এখন কী করবে। “ঠিক আছে, আপনি…” জেফরি কিছু বলতে যাবে অমনি বিপ্ করে একটা শব্দ হলো।
জামান অবাক হয়ে তাকালো তার হাতে ধরা ফোনটার দিকে। একটা ইনকামিং মেসেজ এসেছে ওটাতে। স্ক্রিনে মেসেজের নোটিফিকেশনটা দেখে অবাক হয়ে গেল সে।
“কি হয়েছে?”
“স্যার,” মুখ তুলে তাকালো জামান। “এই মেসেজটা পাঠিয়েছে…দেখুন।” জেফরির দিকে বাড়িয়ে দিলো ডিসেপ্লেটা।
এসআই কালাম ঢোক গিলল। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মেসেজটা পড়লো জেফরি বেগ। ছোট্ট আর অর্থবহ :
১০০০০০ পাঠানো হয়েছে।
মেসেজটা পাঠানো হয়েছে ‘আপা নামের একটি আইডি থেকে।
এসআই’র দিকে তাকালো জেফরি বেগ। “এটার মানে কি? কে এই আপা?”
এবার সত্যি সত্যি কাঁদো কাঁদো অভিব্যক্তি ফুটে উঠল এসআই কালামের চেহারায়। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না।
“স্যার, সিগন্যাল নামের একটি অ্যাপসে মেসেজটা পাঠিয়েছে!” জামান বলল। “একটু আগে আপা’ নামের একজনকে কলও করেছিল…এই যে দেখুন।”
ডিসপ্লেটার দিকে এক পলক তাকিয়ে এসআই’র দিকে ফিরলো জেফরি। দুর্দান্ত অভিনয় করে তাকেও ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত করেছে। তার ইচ্ছে করছে এসআই’র গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে। “কথা বলছেন না কেন??”
“ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, স্যার!” ভেঙে পড়লো এসআই আবুল কালাম।
“ওরা আপনাকে কী করবে আমি জানি না,” বলল জেফরি বেগ। “তবে আমি আপনাকে কি করবো সেটা ভালো করেই জানি।”
জেফরির কথাটা বুঝতে না পেরে ঢোক গিলল সাব-ইন্সপেক্টর।
“আপনাকে অ্যারেস্ট করা হলো।”
অধ্যায় ৬৯
নওরিন খান!
উজ্জ্বলের সাবেক স্ত্রী!
একটু আগেও মাথাটা কাজ করছিল না, তারপরই সেটা আবার আগের মতো কাজ করতে শুরু করে।
কিন্তু তারা এখন কোথায়? অমূল্যবাবু তাদেরকে কোথায় পাঠিয়েছে, সে জানে না। ঐ মহিলার সঙ্গে এখনই যোগাযোগ করা দরকার কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো, মহিলার ফোনটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বাবুর বাড়ি থেকে বের হবার আগেই।
তাহলে কিভাবে যোগাযোগ করবে এখন?
অমূল্যবাবুর বাড়িতে নন্দ নামে যে ছেলেটা থাকে, সে কি জানে। জায়ানরা কোথায় আছে? আবার উত্তরায় ফিরে যাবে? ওখানে গেলে কি নন্দকে পাওয়া যাবে? নাকি রঞ্জুর সন্ত্রাসিরা বাবুকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবার পর ভয়ে পেয়ে ছেলেটা বাড়ি ছেড়েছে?
আবারো সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেল। তার পরই হুট করে মনে পড়ে গেল আরেকটা কথা।
জায়ান!
ছেলেটার সার্বক্ষণিক সঙ্গি ওর প্রিয় ট্যাবটা, তাতে একটি সিম আছে, ফোন হিসেবে ব্যবহার করে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। সেই নাম্বার থেকেই একটা এসএমএস করে আজকে তার জীবনটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
ফোনটা বের করে জায়ানের নাম্বারে কল দিলো সে, মনে মনে একটাই কামনা করলো, এতো রাতে যেন ট্যাবটা বন্ধ না থাকে।
রিং হবার শব্দ শুনে আশান্বিত হয়ে উঠল, কিন্তু পর পর পাঁচ-ছয়বার রিং বাজলেও যখন সাড়া পেলো না, বুঝতে পারলো, ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। রাতের এই সময়ে একটা বাচ্চাছেলের জেগে থাকার কথাও নয়। তারপরও আরো দু-বার কল দিয়ে চেষ্টা করলো।
হাল ছেড়ে দিলো যখন তখনই তার ফোনে কলব্যাক করা হলো। তবে সেটা জায়ান নয়, তার মা। মহিলার কণ্ঠে একই সাথে বিস্ময় আর ভীতি।
“আপনি? কী হয়েছে?!”
জায়ানের নাম্বার থেকে আজ তার মা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেসেজ দিয়েছিল। মহিলা জানে, এটা তার নাম্বার। “একটা দরকারে ফোন দিয়েছি। খুবই ইমার্জেন্সি।”
“বলুন?”
“আমার ঐ আঙ্কেলকে রঞ্জুর লোকজন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে।”
“হায় আল্লাহ!” চাপা আর্তনাদ করে উঠল নওরিন খান। “কী ভয়ঙ্কর। আমাদেরকে উপকার করতে গিয়ে আপনার কাকা কতো বড় বিপদেই না পড়ে গেলেন!”
“আপনার এক্স…ঐ লোকটা কোথায় থাকে, কোথায় পাবো তাকে?”
গভীর করে শ্বাস নিলো জায়ানের মা। “আমি এখন জানি না কোথায় থাকে।”
“আগে কোথায় থাকতো?”
“গেন্ডারিয়ায়, ওদের পৈতৃক বাড়িতে।” একটু চুপ থেকে আবার বলল, “কিন্তু যতোটুকু জানি, ওই বাড়িতে খুব একটা থাকে না।”
হতাশ হয়ে পড়লো বাবলু। “আর কোথায় থাকতে পারে, জানেন?”
“শুনেছি ইমরুল নামের ওর এক বন্ধু আছে, ওর সঙ্গেই বেশি থাকে।” ফোনের ওপাশ থেকে মহিলার দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। “পান্থপথে একটি ফ্ল্যাট আছে ইমরুলের, আমার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবি এক সময় অন্য একটি ফ্লোরে থাকতো…সে বলেছে, উজ্জ্বল প্রায়ই সেখানে থাকে।”
“ফ্ল্যাটটার ঠিকানা জানেন?”
“সেটা তো জানি না, তবে ওকে কল করে জেনে নিচ্ছি…একটু পরে ফোন দিচ্ছি আমি।”
প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পর নওরিন খান তাকে ফোন দিয়ে জানালো, বান্ধবিকে ফোন করেছিল বেশ কবার কিন্তু কল ধরছে না। তার সঙ্গে যোগাযোগ হলে জানাবে।
সামনের ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে থাকলেও পুরোপুরি আনমনা হয়ে পড়লো বাবলু। মাথার ভেতরে অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না। এই একটা সুযোগ ছিল-উজ্জ্বলকে ধরলে রঞ্জুর খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অস্ত্রের মুখে যে কোনো লোকের মুখ থেকে দরকারি তথ্য বের করতে পারে সে। তার ধারনা, উজ্জ্বলের সঙ্গে খুব বেশি কিছু করার দরকারও পড়তো না, লোকটার মাথায় পিস্তল তাক করলেই ভয়ে প্যান্ট নষ্ট করে ফেলতো। রঞ্জুকে সে-ই তার খোঁজ দিয়েছে, সুতরাং তাকে দেখলে মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত হতো, সব বলে দিতো।
সিদ্ধান্তহীনতায় মাইক্রোবাসটার ড্রাইভিং সিটে ঠিক কতোক্ষণ ধরে বসে আছে সে জানে না, টের পেলো পা দুটো আড়ষ্ট হয়ে গেছে। একটু নড়েচড়ে বসলো, আর তখনই বুঝতে পারলো সিটের পেছন দিকে কিছু একটা আছে। এতোক্ষণ টেরই পায়নি। হাতড়ে দেখলো একটা মানিব্যাগ পড়ে আছে।