অধ্যায় ৬০
শেষ রাতের দিকে ঘুম এলেও ছফা উঠে পড়লো সকাল আটটার পরই। এর কারণ হয়তো দমিয়ে রাখা উত্তেজনা।
ওদিকে সুশোভন যতো ড্রিঙ্কই করুক না কেন, তার আগেই উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। এখন ড্রইংরুমে বসে পত্রিকায় নজর বুলাচ্ছে।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে জামা পাল্টে ফেললো সে। মোবাইলফোনটা বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো। কয়েকবার রিং হবার পর কলটা ধরা হলো ওপাশ থেকে।
“আসলাম…ঘুমাচ্ছো নাকি?”
“না,” ওপাশ থেকে বললো পিএসের গানম্যান।
“ডাক্তারের কী খবর?”
“আইসিসিইউ’র এক স্পেশাল কেবিনে আছে এখন।”
“তার শরীর কি বেশি খারাপ?” ছফার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা।
“আরে নাহ!” তিক্ততার সাথে বললো কথাটা। “বুড়ো অ্যাক্টিং করেছে…আগেই বলেছিলাম আপনাকে।”
নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো ছফা। ডাক্তার তাকে ধোঁকা দিয়েছে। ভাবতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো।
“তবে চিন্তার কিছু নেই,” ছফা চুপ মেরে আছে বলে আসলাম বললো। “বুড়ো কয়েকটা দিন ওখানেই থাকবে, বের হবে না। আমার নজরদারিতে আছে…চাইলেও বিদেশে যেতে পারবে না, স্যার সেই ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন।”
“হুম,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে। “আমি এখানকার কাজ শেষ করে। যতো দ্রুত সম্ভব চলে আসতে পারবো বলে মনে হচ্ছে। এখানকার কাজে বেশ কিছুটা ডেভেলপমেন্ট হয়েছে, স্যারকে ফোন দিয়ে জানাবো।”
আসলাম কিছু জানতে চাইলো না আর।
“ঠিক আছে। পরে কথা হবে। তুমি ডাক্তারের দিকে নজর রেখো।” কলটা কেটে দিয়ে উদাস হয়ে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। এর পর ডাক্তারকে যখন ইন্টেরোগেট করবে তখন বিন্দুমাত্রও অনুকম্পা দেখাবে না।
“ব্রেকফাস্ট করতে আসো।”
চমকে তাকালো কণ্ঠটা শুনে। পত্রিকা হাতে সুশোভন দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরের দরজার সামনে।
“বসে বসে কী ভাবছো?”
“দ্বিতীয়জনের ব্যাপারে আমার কিছু ইনফর্মেশন লাগবে।”
কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝতে পারলো না সুশোভন মিত্র। দ্বিতীয়জন?”
“মুশকান জুবেরির সম্ভাব্য দ্বিতীয় শিকারের কথা বলছি।”
“ও…সমস্যা নেই। ব্রেকফাস্টের পর তদন্তকারী অফিসারকে ফোন দিয়ে জেনে নেবো। এখন চলল, ব্রেকফাস্ট করে নেই। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে।”
ডাইনিং টেবিলে বসেই তাদের মধ্যে কথা হলো।
“দ্বিতীয়জন যে নিখোঁজ হয়েছে তার নাম সুকুমার রঞ্জন, পরোটা, সজি, টোস্ট আর হরেক রকম ফল সাজানো আছে টেবিলে। “এক ডেটা অ্যানালিসিস ফার্মে চাকরি করতো, নিখোঁজ হয়েছে ডিপি মল্লিকের প্রায় এক বছর পর।”
“আচ্ছা,” মুখে খাবার নিয়ে বললো নগরপাল।
“তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করা তো প্রায় অসম্ভব, তাই আমি তোমার কথামতো, ও যেখানে কাজ করতো সেই ফার্মের পেইজে টু মেরেছিলাম, কিন্তু ওখানে সুকুমার রঞ্জন নামে কোনো এয়ির খোঁজ পাইনি।”
“না পাওয়ারই কথা, বছরখানেক আগে নিখোঁজ হয়েছে…পেইজটা যেহেতু নিয়মিত আপগ্রেড করা হয় তাই ওর নাম নেই।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। সে-ও খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো।
“সুকুমার রঞ্জনের কেসটা যে থানা তদন্ত করছে সেখানে ফোন করে জেনে নেবো একটু পর, ঠিকাছে?”
“ওকে,” ছোট্ট করে বললো ছফা। “আজকে তো তুমি ফ্রি আছো, নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“শ্বশুড়বাড়ি যাবে না?”
“কাল তো গেছিলাম।”
এ সময় সুশোভনের গৃহকর্মী ছেলেটা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলো। ডাইনিং টেবিলে চা-কফি রেখে চুপচাপ চলে গেলো সে।
“অবাঙালি নাকি?” ছেলেটাকে ইঙ্গিত করে বললো ছফা।
“দার্জিলিংয়ের।”
নাস্তা পর্ব দ্রুত শেষ করে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিলো ছফা। “আমি যে সূত্র ধরে কলকাতায় এসেছি ঐ মহিলাকে খুঁজতে, সেই ডাক্তার আসকারের সাথে ডিপি মল্লিকের ঘনিষ্ঠতার খোঁজ পেয়েছি ফেসবুক থেকে। ভদ্রলোক সুন্দরপুর গেছিলো…ঐ মহিলার রেস্টুরেন্টে।”
“বলো কি!” যারপরনাই অবাক হলো সুশোভন মিত্র।
“তোমাকে তো আগেই বলেছি, মহিলা ওখানে একটা রেস্টুরেন্ট চালাতো।”
“হ্যাঁ-হ্যা…রবীন্দ্রনাথ খেতে যাননি নাকি কী যেনো বলেছিলে?”
“রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি।”
“মাইরি, নামও দিয়েছে…দুর্দান্ত!” প্রশংসার সুরে বললো সহকারী নগরপাল।
“ডিপি মল্লিক ঐ রেস্টুরেন্টের সামনে একটা সেল্ফি তুলে পোস্ট দিয়েছিলো।” নাস্তা পর্ব শেষ করে ফেললো ছফা।
“তাহলে তো ফেসবুক তোমার বেশ কাজে দিচ্ছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হলো নুরে ছফা, যদিও এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কের উপরে ভীষণ খাপ্পা সে। দিন দিন এটা যে আসক্তি তৈরি করছে সেটা আশঙ্কার বিষয়। ডিবি অফিসাররাও আজকাল অফিসে ফোন নিয়ে বসে থাকে চোখের সামনে। এমনকি তদন্তনাধীন মামলা নিয়ে ফেসবুকের বন্ধুদের সাথে কথাবার্তাও বলে! কেউ কেউ এক কাঠি উপরে-তারা নিজেকে জাহির করার জন্য ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানায়, আজকে কী করলো, কাকে ধরলো, কিভাবে ধরলো!
“আমি যে তালিকাটি তোমাকে দিয়েছি সেটা নিয়ে আসো। ঐ কেসটা কোন থানা দেখছে দেখি।” ন্যাপকিন দিয়ে ঠোঁট মুছে নিলো সুশোভন। তারও নাস্তা পর্ব শেষ।
ছফা উঠে বেডরুমে চলে গেলো, ফিরে এলো একটু পরই। তালিকাটা নগরপালের হাতে তুলে দিয়ে দেখিয়ে দিলো নামটা।
কেস নাম্বারটা দেখে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো সুশভোন। কল রিসিভ হতেই নিজের পরিচয় দিলো সে। সুকুমার রঞ্জনের নাম আর কেস নাম্বারটা বলে বিস্তারিত জানতে চাইলো।
ছফা তার দিকে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে। ফোনের ওপাশে যে আছে সে নিশ্চয় কম্পিউটার দেখে তথ্যটা জেনে নিচ্ছে বলে একটু সময় লাগছে।
“ওয়াটগঞ্জ থানা? আচ্ছা…থ্যাঙ্ক ইউ,” ফোনটা রেখে দিলো সুশোভন। “ওয়াটগঞ্জ থানা এই কেস তদন্ত করছে।” ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে আরেকটা নাম্বার ডায়াল করলো নগরপাল।
সুশোভন নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে শুরু করলো ওয়াটগঞ্জ থানার কোনো অফিসারের সাথে। “আমার একটা ইনকোয়ারি ছিলো…” তালিকাটা দেখে নিখোঁজের নাম আর কেস নাম্বারটা বললো সে। “এই কেসটা যে দেখছে সে কি এখন ডিউটিতে আছে?…আচ্ছা, তার নাম্বারটা দিন…” একটু থেমে ছফার দিকে তাকালো, তার হাতে থাকা নোট প্যাড আর কলমটা ইশারায় চেয়ে নিলো সুশোভন। দ্রুত ফোন নাম্বারটা টুকে নিলো। “থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।” নোটপ্যাড থেকে নাম্বারটা ডায়াল করলো এবার। একটু অপেক্ষা করার পর কলটা সিরিভ করা হলো।
ফোনের ওপাশে তদন্তকারী অফিসারের কাছে সুশোভন আবারও নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলো, সুকুমার রঞ্জনের নিখোঁজ হবার কেসটা কী অবস্থায় আছে, সে ব্যাপারে একটু কথা বলতে চায়। ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ শুনে গেলো সে। “হুম…কোনো সাসপেক্ট?…” ছফার দিকে চকিতে তাকালো, “ওহ্, পালিয়েছে?…তারপর?”
উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলো নুরে ছফা।
“সাসপেক্ট ওই ছেলেটার ফ্রেন্ড সার্কেলেরই একজন?”
পরিচিত! মনে মনে বলে উঠলো ছফা। মুশকান জুবেরি পরিচিত সার্কেলে কখনও শিকার করবে না বলেই তার ধারণা। তারপরও, কলকাতায় এসে ডিপি মল্লিককে শিকার বানিয়েছে। সুতরাং আবারো পরিচিত মহল থেকে শিকার করার সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
“নাম কি?…আচ্ছা…হুম,” ছফার দিকে তাকালো নগরপাল। “নো প্রবলেম…আমি একটু পর কল দিচ্ছি,” বলেই কলটা কেটে দিলো।
“কি বললো?”
“ও অফিসের পথে আছে…হেভি নয়েজ। একটু পর কল দিতে বললো।”
“সাসপেক্ট পালিয়ে গেছে বললো না?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো ছফা।
“হুম,” সহকারী নগরপাল বললো।
“নাম কি?”
“বললো তো ওর ফ্রেন্ডসার্কেলেরই এক মেয়ে…সুস্মিতা সমাদ্দার।”
.
অধ্যায় ৬১
সাসপেক্ট একজন মেয়ে!
সুকুমার রঞ্জনের নিখোঁজ ঘটনায় পুলিশ প্রাথমিকভাবে সুস্মিতা সমাদ্দার নামের একজনকে সন্দেহ করেছিলো, কিন্তু তন্ত এগোতেই মেয়েটা পালিয়ে যায়। ছফার কাছে এর অর্থ একদম পরিস্কার-সুস্মিতাই সত্যিকারের খুনি! আর মহিলা খুনির কথা জানতে পেরে সে আরো বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে।
“কিছু বুঝতে পেরেছে, দাদা?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সুশোভন। “সাসপেক্ট একজন মেয়ে…তোমার ঐ ডেঞ্জারাস লেডিই হবে মনে হচ্ছে।”
“আমি নিশ্চিত, জোর দিয়ে বললো নুরে ছফা। “এটা মুশকান।”
“তদন্তকারী অফিসারের সাথে আরেকটু কথা বললেই অনেকটা পরিস্কার হয়ে যাবে।”
“হুম,” বললো ছফা।
এমন সময় সুশোভন মিত্রের ফোনে ইনকামিং কল এলো।
“অতনু মজুমদার…ঐ ইন্সপেক্টর,” বললো নগরপাল। তারপরই কলটা রিসিভ করলো। “হ্যাঁ, বলুন।” কথাটা বলেই ফোনের স্পিকার অন করে দিলো যাতে ছফা শুনতে পায়। কানে চেপে না রেখে হাতে নিয়ে মুখের সামনে ধরে রাখলো সেটটা।
“কেসটার এখন কী অবস্থা? আর কোনো ডেভেলপমেন্ট?”
“খুব বেশি ডেভেলপমেন্ট হয়নি, স্যার, ওপাশ থেকে অতনু মজুমদারের কণ্ঠটা শুনতে পেলো ছফা। “মরেটরে গেলে তো একটা ডেডবডি পাই, ওটার সূত্র ধরে এগোতে পারি, কিন্তু নিখোঁজ কেসগুলো বড্ড টাফ হয়…বুঝতেই পারছেন।”
“হুম, তা ঠিক।” সায় দিলো সুশোভন মিত্র। পুলিশ হিসেবে সে-ও জানে, অনেক বিচিত্র কারণে মানুষ নিখোঁজ হয়-প্রেমের বিরহে বিবাগী হয় অনেকে; নায়িকা হবার বাসনায় বাড়ির কাউকে না জানিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরে চলে আসে কেউ কেউ; টাকা ধার নিয়ে উধাও হয়ে যায় মানুষজন; এমনকি, হুট করে ইসকনে যোগ দেবার ঘটনার কথাও তার জানা আছে। বলা নেই কওয়া নেই একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না-অনেক পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো, ইসকনের কোনো আশ্রমে পড়ে আছে।
“ফাইল দেখে ডিটেইল বলা যেতো…এখন যতোটুকু মনে আছে। ততোটুকুই বলতে পারবো।”
“সমস্যা নেই, বলুন।”
একটু থেমে ফোনের ওপাশ থেকে বলতে শুরু করলো অতনু মজুমদার, “তদন্তের শুরুর দিকে সুকুমারের পরিচিত অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি, ও প্রায়ই সল্টলেকে যেতো সাসপেক্টের বাড়িতে, বন্ধুবান্ধব মিলে গান-বাজনা করতো, মাস্তি করতো,” একটু থেমে আবার বললো, “তো, ওর এক বন্ধু আমাকে জানালো, ঘটনার দিন সুকুমার ওর কাছ থেকে বেশ ভালো ব্র্যান্ডের একটি হুইস্কির বোতল নিয়েছিলো সুস্মিতাকে গিফট দেবে বলে। আমি সেই সূত্র ধরেই মেয়েটার বাড়িতে গেছিলাম।”
“তারপর?”
“মেয়েটা যেহেতু অস্বীকার করেছিলো সুকুমার ঐদিন ওর ওখানে যায়নি, তাই আমি এটা ডাবল চেক করে দেখলাম। মেয়েটার বাসায় যে দারোয়ান ছিলো তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম, সে কদিন আগে জয়েন করেছে…মানে, ঐ ঘটনার পরে। আমার তখন সন্দেহ হলো। আশেপাশের বাড়ির দারোয়ানদের সাথে কথা বলে আগের দারোয়ানকে খুঁজে বের করলাম, স্যার।”
“দ্যাটস গ্রেট,” অতনুর এই বুদ্ধিটার প্রশংসা না করে পারলো না। প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো কমিউনিটিতে বিলং করে। দারোয়ানদেরও নিজস্ব একটি কমিউনিটি আছে। আশেপাশের অন্য দারোয়ানদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলাটাই স্বাভাবিক। সারা দিন বাড়ি পাহারা দেবার মতো বিরক্তিকর কাজ করতে যেয়ে আশেপাশের বাড়ির দারোয়ানদের সাথে খোশগল্প করে তারা। ওইসব দারোয়ানদের অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যায়। সুতরাং ওদের মধ্যে কেউ না কেউ তার খোঁজ দিতে পারবেই।
“ঐ দারোয়ানকে আমি সুকুমারের ছবি দেখালে সে চিনতে পারে। ও আমার কাছে স্বীকার করে, ঐ দিন সুকুমার সল্টলেকের সমাদ্দার ভিলায় গেছিলো। দারোয়ানের কাছ থেকে আরো কিছু কথা জানার পর বুঝতে পারি, মেয়েটা…মানে, সাসপেক্ট আমাকে অনেক মিথ্যে বলেছে।”
ছফা এবং সুশোভন উন্মুখ হয়ে রইলো পরবর্তী কথাগুলো শোনার জন্য।
“ঐ দারোয়ানের সাথে কথা বলার পরই আমি মেয়েটার বাড়িতে আবার যাই, কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি বাড়িতে তালা ঝুলছে। মেয়েটাকে আর পাইনি, স্যার।” হতাশ কণ্ঠে জানালো অতনু। “আগের দারোয়ান আমাকে বলেছিলো, ওই বাসার তিন তলায় মেয়েটার এক কাজিন থাকতো, সেই মেয়েটাও উধাও। এমনকি দারোয়ানও নেই। প্রথমবার জিজ্ঞাসাবাদের সময় মেয়েটার ফোন নাম্বার নিয়ে নিয়েছিলাম, ওই নাম্বারে কল করে দেখি ফোনটা বন্ধ। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না…সাসপেক্ট পালিয়েছে।” একটু থেমে আবার বললো ইন্সপেক্টর, “আমি তখন মেয়েটার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে তালা ভেঙে বাড়িটা তল্লাশি করি।”
“ওখান থেকে কিছু পেয়েছিলেন?”
“দেখে মনে হয়েছে, খুব তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ছেড়েছে সাসপেক্ট, কোনো আসবাবপত্রই নিতে পারেনি। দোতলায় মেয়েটা যে ঘরে থাকতো সেখানে তল্লাশী চালিয়েও কিছু পাইনি। তবে নীচতলার এক ঘরে মেয়েটার একটি ছবি পেয়েছিলাম। সম্ভবত এটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছিলো।”
“তার মানে সাসপেক্টের ছবি আছে আপনার কাছে?”
“হ্যাঁ, স্যার। ঐ ছবিটাই আমি কপি করে সবখানে সাকুলেট করে দেই তখন।”
“হুম,” গম্ভীর হয়ে বললো সুশোভন।
“এরপর পুরো বাড়িটা সিলগালা করে দেই। এখনও বাড়িটা অমনি আছে।”
“স্ট্রেঞ্জ,” অস্কুটকণ্ঠে বলে উঠলো সহকারী নগরপাল। “এরকম জায়গায় একটা বাড়ি ফেলে চলে গেলো, আর এতোদিনেও কেউ এসে দাবি করলো না?”
“সেটাই, স্যার। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, বাড়ির মালিকানা সাসপেক্টের মা শুভমিতা সমাদ্দারের নামে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, মেয়েটার মা মারা গেছে ক-বছর আগে…লন্ডনে। তার কোনো আত্মীয়স্বজনের টিকিটাও খুঁজে পাইনি। আশপাশের বাড়ির লোকজনও আমাকে কিছু বলতে পারেনি, স্যার। ওরা সুস্মিতাকে ঠিকমতো চেনেও না। মেয়েটা বেশির ভাগ সময় লন্ডনেই ছিলো, কিছুদিন ছিলো শান্তিনিকেতনে।”
“আচ্ছা, মেয়েটার ছবি কি দেয়া যাবে?”
“যাবে, স্যার। আমি স্টেশনে গিয়ে ফাইল থেকে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিতে পারবো।”
“গুড। আপনি আমার হোয়াটসআপে দিয়ে দেবেন, ঠিকাছে?”
“ওকে, স্যার,” অতনু মজুমদার বললো। “মেয়েটা আমায় বলেছিলো, ওর বাবা বিদেশে থাকে, ওর সাথে তেমন একটা যোগাযোগ নেই। ওর বাবা-মার ইন্টার-রিলিজিওন ম্যারেজ…বাবা মুসলিম, মা ব্রাহ্ম। সল্টলেকের বাড়িটা ওর মা পেয়েছিলো বড়বোনের কাছ থেকে…দ্রমহিলা বিয়েটিয়ে করেননি। মারা যাবার আগে ওই বাড়িতেই ছিলেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সুশোভন মিত্র।
“আমি আরেকটু খোঁজবর নিয়ে জানতে পারলাম, সাসপেক্ট মেয়েটা শান্তিনিকেতনে ভর্তি হলেও পড়াশোনার পাট সম্ভবত চুকোতে পারেনি, একটু থামলো পুলিশ অফিসার। “মায়ের মৃত্যুর পরও ওখানেই ছিলো কিছু দিন তারপর হুট করেই আবার চলে আসে কলকাতায়।”
ছফা আস্তে করে সুশোভনের কনুইতে হাত রাখলো। ইশারা করলো-ঘটনাটা কবেকার।
“এটা কবেকার ঘটনা…মানে, মেয়েটা কলকাতায় এসেছিলো কবে?”
“সম্ভবত সুকুমার নিখোঁজের কয়েক মাস আগে।”
ছফার দিকে তাকালো সুশোভন। সে এরইমধ্যে নোটপ্যাডে টুকে রাখতে শুরু করে দিয়েছে তথ্যটা।
“মেয়েটাকে যখন প্রথম বার জিজ্ঞেস করি তখন সে আমায় বলেছিলো, ওর সাথে সুকুমারের পরিচয় শান্তিনিকেতনের এক বন্ধুর মাধ্যমে।”
“হুম,” আস্তে করে বললো সুশোভন।
“মেয়েটা বৃটিশ সিটিজেন,” একটু থেমে আবার বললো ইন্সপেক্টর, “ও আমাকে বলেছে, বাবার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। ওর মা কখনও বাবার নামও বলেনি। আমার কাছে এটা ক্রেডিবল মনে হয়নি, স্যার।”
ছফা আর সুশোভনের মধ্যে চোখাচোখি হলো। তাদের কাছেও এটা অবিশ্বাস্য লাগছে।
“এ কারণে আমি মেয়েটাকে তখনই বলে দিয়েছিলাম, লোকাল থানায় ইনফর্ম না করে যেনো কলকাতার বাইরে না যায়।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নগরপাল। “ও কোথায় গেছে বলে আপনি মনে করছেন?”
“নিশ্চিত করে তো বলতে পারবো না, স্যার। তবে ভারতবর্ষ অনেক বড়…সম্ভবত অন্য কোনো রাজ্যে চলে গেছে।” একটু থেমে আবার বললো, “আমার ধারণা ওকে পালাতে সাহায্য করেছে ওর বাবা।”
অবাক হলো সুশোভন। “ওর বাবা!”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“আপনি না বললেন, ওর বাবার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই…এমন কি নামটাও জানে না?”
“মেয়েটা আমাকে সেরকমই বলেছিলো কিন্তু আগের দারোয়ান আমাকে বলেছে, মেয়েটার বাবা সল্টলেকের বাসায় মাঝেমধ্যেই আসতো।”
ভুরু কপালে তুলে পাশ ফিরে তাকালো সুশোভন। ছফারও একই অবস্থা। উদগ্রীব হয়ে বাকিটা শুনতে চাইছে সে।
“ও কেন ওর বাবার পরিচয় লুকোলো সেটা আমার কাছে খুবই রহস্যময় লেগেছে।”
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো সহকারী নগরপাল।
“বাবার নামটা কি বের করতে পেরেছিলো, অফিসার?” সুশোভনের কানে ফিসফিসিয়ে বললো ছফা।
“ওর বাবার নামটা কি আপনি বের করতে পেরেছিলেন?”
“হ্যাঁ, স্যার। ঐ দারোয়ানই আমায় বলেছিলো, ভদ্রলোক নামকরা ডক্টর…লন্ডনে থাকেন। আসকার না কী যেনো নাম বলেছিলো আমায়। ফাইল দেখে নিশ্চিত করে বলতে পারবো।”
কথাটা শুনে সোজা হয়ে বসলো ছফা। সে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত-এই সুস্মিতা আসলে কে! এ নিয়ে তার মধ্যে আর কোনো সংশয় নেই!
.
অধ্যায় ৬২
দৃশ্যপটে ডাক্তার আসকারের আবির্ভাব নুরে ছফাকে খুব একটা বিস্মিত করেনি। সে ঢাকায় থাকতেই বুঝে গেছিলো, এই ভদ্রবেশি ডাক্তার মুশকানের একমাত্র সহযোগী।
এখন ছফার কাছে সবটাই পরিস্কার। মুশকানকে মেয়ের পরিচয় দিয়ে কলকাতায় নিজের শ্বশুড়ালয়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ডাক্তার। তারপর পূর্ব-পরিচিত এক প্লাস্টিক সার্জনকে দিয়ে মুশকানের চেহারাটাও পাল্টে ফেলার আয়োজন করেন। কাজশেষে, চেহারা পাল্টানোর কথাটা চিরতরে গোপন রাখার জন্য ঐ সার্জনকে হত্যা করে মহিলা।
সুশোভন এখনও ফোনে কথা বলে যাচ্ছে অতনু মজুমদার নামের পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। ছফা আবারো তাদের ফোনালাপে মনোযোগ দিলো।
“ওকে,” বললো সুশোভন মিত্র। “থ্যাঙ্ক ইউ, ফর ইওর কোঅপারেশন।” কলটা কেটে দিয়ে ছফার দিকে তাকালো সে। “কী বুঝলে?”
“আমি জানতাম মুশকান জুবেরি আমেরিকান সিটিজেন, এখন দেখছি তার বৃটিশ পাসপোর্ট আছে।”
“আমেরিকান পাসপোর্ট হোল্ডারদের পক্ষে বৃটিশ সিটিজেনশিপ বাগানোটা কী আর এমন কঠিন কাজ।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। অন্য একটা কথা মনে পড়ে গেছে তার। ডাক্তার আসকারও তাকে বলেছিলেন, আন্দিজের কথা জানাজানি হয়ে গেলে মুশকান আমেরিকা ছেড়ে বৃটেনে চলে যায়। তবে ডাক্তারের নতুন এই গল্পে ঐ মুশকান হলো মুশকান জুবেরির মা! ভদ্রলোকের নতুন গল্পটি জটিল আর দুর্বোধ্য গোলকধাঁধা তৈরি করেছে। মুশকান যদি রুখসান হয়ে থাকে, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভক্ষণ করে চিরযৌবন লাভের কথাটা যদি সত্যি না হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতায় এসে মুশকান কেন পুরুষ শিকার করলো? চেহারাই বা পাল্টানোর চেষ্টা করবে কেন? চেহারা পাল্টানোর ব্যাপারটা গোপন রাখার জন্য যদি ডিপি মল্লিককে হত্যা করে থাকে, তাহলে সুকুমার রঞ্জনকে কেন শিকার বানাতে গেলো?
তার মানে, ডাক্তার আসকার সুকৌশলে সত্য-মিথ্যার মিশেলে এমন এক গল্পের অবতারনা করেছেন, ছফা যাতে বিভ্রান্ত হয়। ডাক্তারের কোন কথাটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে তা জানতে হলে, মুশকান জুবেরির রহস্যের সবগুলো পাজলের টুকরো মেলাতে চাইলে ঐ মহিলাকে হাতের মুঠোয় নিতে হবে সবার আগে।
“এখন কী করবে তাহলে?”
সম্বিত ফিরে পেয়ে সুশোভনের দিকে তাকালো ছফা।
“অতনু সল্টলেকের বাড়ির ঠিকানাটা টেক্সট করে দিয়েছে, নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো সহকারী নগরপাল। “যদিও সরেজমিনে গিয়ে একবার দেখা উচিত কিন্তু ওখানে গিয়ে তো কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “আমিও সেটাই ভাবছি।” “টেনশনে আছে মনে হচ্ছে… সিগারেট খাবে?”
“হুম,” সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলো ছফা।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা বাড়িয়ে দিলো ছফার দিকে। দু-জনেই সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ বসে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
“তুমি যে এতো তাড়াতাড়ি সাসপেক্টকে ট্রেস করতে পারবে আমি কিন্তু আশা করিনি,” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সহকারী নগরপাল বললো।
“এজন্যে তোমার কাছে আমি ঋণী। তুমি অনেক হেল্প করেছে, দাদা। তুমি না থাকলে এটা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।”
প্রসন্ন হাসি দিলো সুশোভন, কিছু বলতে যাবে অমনি তার ফোনটা বিপ করে উঠলো। “অতনু মনে হয় সাসপেক্টের ছবি পাঠিয়েছে।”
কথাটা শোনামাত্রই উন্মুখ হয়ে উঠলো ছফা। মুশকান জুবেরি তার চেহারা পাল্টে কি অবস্থায় আছে সেটা দেখার তর সইছে না তার।
“এই যে, দেখো,” ফোনটা ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো সুশোভন।
ফোনের ডিসপ্লেতে যে ছবিটা দেখতে পাচ্ছে সেটা নুরে ছফাকে রীতিমতো ঝাঁকুনি দিলো যেনো। বিস্ময়ে চোখ দুটো বিস্ফারিত হবার উপক্রম হলো তার।
“মাই গড!” তার মুখ দিয়ে অস্ফুট ধ্বণি বের হয়ে গেলো।
.
অধ্যায় ৬৩
ঢাকায় ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বনানীর বাড়ি থেকে একটু দূরে কালো রঙের একটি প্রাইভেট কারে বসে আছে আসলাম। সকাল এগারোটা থেকে ধৈর্য নিয়ে ডুপ্লেক্স বাড়িটার দিকে নজর রাখছে সে। বাড়িতে যে ঐ মেয়েটা আছে সেটা জানে। সঙ্গে আছে আরেকটা ছেলে। এখন পর্যন্ত দারোয়ান একবারের জন্যেও গেটের কাছে আসেনি। মেইনগেটের নীচে, মেঝে থেকে যেটুকু ফাঁক আছে সেখানে কড়া নজর রেখেছে সে, কোনো মানুষজনের পা দেখতে পায়নি।
এই বিশাল বাড়িতে মাত্র তিনজন মানুষ আছে এখন-দু-জন পুরুষ আর এক তরুণী। আসলাম মেয়েটার সাহসের প্রশংসা করলো মনে মনে। দু দুটো সিংহের সাথে একই খাঁচায় একটা হরিণ কিভাবে অক্ষত থাকে! সে নিজেও একজন পুরুষ মানুষ, ভালো করেই জানে, এরকম অবস্থায় বেড়ালও সিংহ হয়ে যেতে পারে। আর সেই সিংহ প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়বে হরিণের উপরে। ছিঁড়ে খুবলে খাবে তাকে।
তার বস পিএস আশেক মাহমুদ গোপন এক সূত্র থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, ঐ তরুণী ডাক্তারের খুবই ঘনিষ্ঠ কেউ হয়। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এই বিশাল বাড়িতে মেয়েটার কোনো ক্ষতি করার সাহস হয়তো করবে না কেউ। তারপরও কথা থাকে, পুরুষগুলোর যদি মতলব খারাপ হয়, তাহলে যেকোনো কিছুই ঘটে যেতে পারে। বহু বছর আগে এক শিল্পপতির মেয়ের ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের কথাটা মনে পড়ে গেলো তার। বাড়ির কাজের লোকেরাই করেছিলো জঘন্য কাজটা। শিল্পপতি ভেবেছিলেন, এতোগুলো কাজের লোক-যাদের মধ্যে মেয়েছেলেও আছে-তার মেয়েটা নিরাপদেই থাকবে। কিন্তু সেটা হয়নি। কিশোরী মেয়েটাকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে ধর্ষকের দল।
ঐ মেয়েটাকে দেখে তার অন্য একজনের কথা মনে পড়ে গেছিলো, যার সাথে তার এখন কোনো সম্পর্কই নেই।
মনীষা দেওয়ান!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আসলামের ভেতর থেকে। পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দেবার আগে রাঙামাটি থানাই ছিলো তার শেষ পোস্টিং। সন্তানের স্কুল বদলাতে হবে বলে তার স্ত্রী আর রাঙামাটিতে আসেনি, ঢাকাতেই নিজের বাপ-মায়ের কাছে থেকে গেছিলো। আসলামও এ নিয়ে জোর করেনি। বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই স্ত্রীর সাথে তার শীতল সম্পর্ক। তাদের বিয়েটা হয়েছিলো পারিবারিকভাবে, বাবা-মায়ের পছন্দে। কিন্তু বিয়ের দু-বছরের মাথায় এসে আসলাম যখন জানতে পারে তার স্ত্রী সোমার সাথে এক ছেলের সম্পর্ক আছে, ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের প্রথম এবং একমাত্র সন্তান আরাফ তখন মায়ের পেটে বেড়ে উঠছে। তার স্ত্রী স্বীকার করে বলেছিলো, কলেজ জীবনের বন্ধু, এর বেশি কিছু না। নিছক খোঁজখবর নেবার জন্য ফোন দেয় ছেলেটা। আসলাম বিশ্বাস করেছিলো তার স্ত্রীকে কিন্তু সন্তান জন্মাবার পরও সোমা তার সেই কথিত বন্ধুর সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখতো। আসলামের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলে সে ইনফর্মার লাগিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলে স্ত্রীকে। এর পর তাদের সন্তানের মাথা ছুঁয়ে কসম খেয়ে সোমা বলেছিলো, ঐ ছেলের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সে আর যোগাযোগও রাখবে না ওর সাথে। আসলাম আবারো বিশ্বাস করেছিলো স্ত্রীর কথা, ক্ষমাও করে দিয়েছিলো। কিন্তু বছর গড়াতেই টের পায়, ভেতরে ভেতরে স্ত্রীর এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি সে। তার ভেতরে ছাইচাপা আগুন ঠিকই জ্বলছিলো।
পুলিশের জীবনে অনেক লাশ দেখেছে আসলাম। সব লাশই বরফের মতো হিম শীতল হয়ে থাকে। ঠিক সেভাবে, সম্পর্কের মৃত্যু ঘটলেও সেটা ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। এক সময় বরফ-শীতল হয়ে ওঠে। ধৈর্য কিংবা অভিনয় দিয়ে সেই শীতলতা বেশি দিন সহ্য করা যায় না।
তো, এমন সময় রাঙামাটিতে পোস্টিং হলে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছিলো সে। স্ত্রীর অভাব বোধ করতো না, তবে তার সন্তান আরাফের জন্য খুব খারাপ লাগতো। রাঙামাটি থানা থেকে নিজের বিশাল কোয়ার্টারে ফিরে এসে নিঃসঙ্গ সময় কাটাতো আসলাম। কালেভদ্রে তার স্ত্রী খোঁজ নিতো। আর যখন নিতো, তখন সেটার মধ্যে কোনো আন্তরিকতা খুঁজে পেতো না। তার কাছে মনে হতো পুরোপুরি আন্তরিকতাবিবর্জিত একটি ফোনকল-দায় সেরে নেবার জন্যই করা।
এরকম নিঃসঙ্গ আর একাকী সময়েই তার সাথে পরিচয় হয় কলেজ পড়ুয়া মনীষা দেওয়ানের সঙ্গে। মিষ্টি চেহারার হালকা-পাতলা গড়নের এই চাকমা মেয়েটি তার হৃদয় হরণ করে ফেলে খুব দ্রুত। চমৎকার বাংলা বলতো মনীষা। এই মেয়ে তাকে যে ভালোবাসা দিয়েছিলো সেটার কোনো তুলনাই হয় না। আসলাম সেই প্রথম সত্যিকারের ভালোবাসার দেখা পেয়েছিলো। তার এমন আহামরি সম্পদ ছিলো না যে, নিজের চেয়ে বয়সে অনেক বড় কারোর সাথে প্রেম করতে যাবে মনীষা। বয়স-জাতি-ধর্ম সব পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছিলো মনীষার সেই অপ্রতিরোধ্য নিখাদ ভালোবাসা। এমন ভালোবাসা পেয়ে তার উচিত ছিলো সব কিছু ভুলে যেয়ে স্ত্রীকে ক্ষমা করে দেয়া, কিন্তু আসলাম সেটা করেনি। মাথা গরম করে হুট করেই একদিন এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যেটা তার জীবনটাই পাল্টে দেয়।
সেলফোনের রিংয়ের শব্দ আসলামের অতীত চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালো। পকেট থেকে ফোনটা বের করেই দেখতে পেলো পিএস কল করেছে।
“জি, স্যার?”
“কি অবস্থা?”
“বাড়ির বাইরে আছি…ওরা কেউ বের হয়নি।”
“শোনো, আমাদের প্ল্যানে একটু পরিবর্তন করতে হচ্ছে। তোমাকে এখন একটা কাজ করতে হবে খুবই সাবধানে।
“বলুন, স্যার,” উদগ্রীব হয়ে বললো আসলাম। তারপর ওপাশ থেকে শুনে গেলো পিএসের নতুন প্ল্যানের কথা। তবে খুব একটা অবাক হলো না সে। আগেই জানতো, এরকম কিছু করার দরকার হতে পারে। পিএসের কথা শোনার পর সে বললো, “কোনো সমস্যা নেই।”
“গুড। লোকেশন আগেরটাই, ওকে। তাহলে সেলিম আর বদরুলকে পাঠিয়ে দেই?”
“না, স্যার…দরকার নেই। আমি একাই পারবো।”
“একাই পারবে?!” অবাক হলো পিএস।
“জি, স্যার।” আশ্বস্ত করে বললো সে। “আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”
কয়েক মুহূর্তের জন্য ফোনের ওপাশে নীরবতা নেমে এলো। “ওকে…সাবধানে কাজটা কোরো।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
ফোনটা কেটে গেলে আসলাম তার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করলো বাড়িটার দিকে। তার বসের কোনো ধারণাই নেই কতো সহজে আর নিখুঁতভাবে কাজটা করবে সে। এই জীবনে একটা কাজেই ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছিলো, আর সেটাই তাকে বিরাট রকমের শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে। বার বার ভুল করার মতো লোক সে নয়।
বাড়িতে ঢুকে একটা হট্টগোল সৃষ্টি করার চেয়ে আসলাম যেটা করবে সেটা অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত আর শৈল্পিক হবে।
এখন শুধু ঠাণ্ডা মাথায় অপেক্ষা করার পালা।
.
অধ্যায় ৬৪
রাতে ভালো ঘুম হয়নি সুস্মিতার। ওষুধ ছিলো না বলে সরাটা রাত জেগে জেগে কাটাতে হয়েছে। তবে ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে মশগুল না থাকলে ঘুমটা ঠিকই আসতো।
সত্যি বলতে, আগে তার এই বদঅভ্যেস ছিলো না। কিন্তু এই নিঃসঙ্গ জীবনে ভার্চুয়াল দুনিয়াই হয়ে উঠেছে তার একমাত্র সঙ্গি। রীতিমতো আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে এটা। একটু পর পর ফেসবুকে আর মেসেঞ্জারে ঢু মারাটা তার বাতিক হয়ে গেছে। ক-দিন আগে নেটে একটা আর্টিকেল পড়েছিলো, হারভার্ডের এক দল গবেষক নাকি দীর্ঘদিন রিসার্চ করে দেখেছে, ১৬ থেকে ৩০ বছরের ছেলেমেয়েদের ৪৫% প্রায় সারাক্ষণই কোনো না কোনো অনলাইন সাইটে ঢু মারে। গড়ে ৯ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে এসবের পেছনে। প্রতিদিন এরা গড়ে ৯৬ বার ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম আর মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সাইটে ঢু মারে। ত্রিশের উপরে যারা আছে, তাদের আসক্তির হারও অবিশ্বাস্য রকমের বেশি দিনে ৩৫ বার। স্বাভাবিক মানসিক সুস্থতার জন্য টু মারার এই হারটা নাকি ১০-এর নীচে থাকা বাঞ্ছনীয়।
প্রথমে তার বিশ্বাসই হয়নি। ৩৫ থেকে ৯৬ বার! এতো! নিজেকে প্রশ্ন করেছিলো সে : কী করে সম্ভব! এটা হতেই পারে না। সে বড়জোর ৭/৮ বার ঢু মারে, এর বেশি না। কিন্তু হারভার্ডের মতো প্রতিষ্ঠানের উপর তার অগাধ আস্থা রয়েছে, তাই নিজের আসক্তিটা কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটা যাচাই করে দেখেছিলো খুবই নিরপেক্ষ আর নির্মোহ উপায়ে। অ্যাডডিটেক্ট” নামের ছোট্ট একটি অ্যাপস নামিয়ে ইন্সটল করে নিয়েছিলো-ঐ আর্টিকেলেই দেয়া ছিলো অ্যাপসটার লিঙ্ক-ওটার কাজই হলো, ইউজার কতো বার কোন্ সাইটে কখন টু মারলো সে হিসেব রাখা। ইন্সটল করার পর দিন সকালে খুব অবাক হয়ে দেখে, আগের দিন ৮৮ বার ঢু মেরেছে! সে কোনো টিনএজার নয়, তার জন্য সংখ্যাটা অনেক অনেক বেশি!
যাই হোক, রাতে ঘুমোতে যাবার আগেও এই স্মার্টফোনটা থাকে তার হাতে। আর নিদ্রাহীনতার কারণও এটাই! তবে গতকাল সে পণ করেছিলো ঘুমোতে যাবার আগে ফেসবুক-মেসেঞ্জারে ঢু মারবে না। কারণ পরদিন এয়ারপোর্টে যেতে হবে তাকে। ঢাকা টু যশোর, তারপর ওখান থেকে সোজা চলে যাবে সুন্দরপুরে। তার ছোটো ছোটো ছাত্রছাত্রিদের খুবই মিস্ করছে। তাছাড়া ঢাকা শহর তার একটুও ভালো লাগে না। শহরটার শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য-কোনোটাই সহ্য হয় না তার। সুন্দরপুরের মনোরম পরিবেশ আর প্রকৃতির মধ্যেই আপাতত থিতু হয়েছে সে।
কিন্তু যে পণ করেছিলো সেটা আর রাখতে পারেনি-রাত দুটো পর্যন্ত ফেসবুক-মেসেঞ্জারে ঢু মেরেছে। কেন করেছে সে নিজেও জানে না। যেমন জানে না এ গ্রহের শত-কোটি মানব সন্তান।
এখন ঢুলু ঢুলু চোখে বিছানায় শুয়ে আড়মোড়া ভেঙে দেয়াল ঘড়িতে তাকালো। প্রায় বারোটা। এখনও আলসেমি ছাড়েনি তাকে। বিছানায় একটু গড়াগড়ি দিলো। উঠতে চাইছে না। তার হাতে এখনও দু-ঘণ্টার মতো সময় আছে। তারপর ঢাকা শহর বলে কথা। অনেক জ্যাম হয় এয়ারপোর্ট রোডে, হাতে তাই সময় নিয়ে বেরোতে হবে। অগত্যা জোর করেই বিছানা থেকে শরীরটা তুলে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো।
আধঘণ্টা পর পুরোপুরি ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এলো সে। সকালে শাওয়ার না নিলে তার ভালো লাগে না। এটা দীর্ঘদিনের অভ্যেস। গায়ে একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে ড্রইংরুমে এসে দেখলো শ্যামল টিভি দেখছে চুপচাপ।
“ব্রেকফাস্ট করেছো, শ্যামল?”
“হ্যাঁ, দিদি।” হাসি দিয়ে বললো ছেলেটা। “আপনিও করে নেন। টেবিলে নাস্তা রেডি…এতোক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে মনে হয়।”
প্রসন্নভাবে হেসে ডাইনিং টেবিলে চলে গেলো সে। নাস্তা শেষ করে আরো পনেরো মিনিট সময় নিলো জামা-কাপড় পাল্টাতে। ড্রইংরুমে এসে বললো, “আমরা এক্ষুনি বের হচ্ছি।”
“আচ্ছা, দিদি,” কথাটা বলেই পাশের ঘরে চলে গেলো ছেলেটা।
ফোনটা হাতে নিয়ে উবার ডাকলো সে। মিনিটখানেক পরই ড্রাইভার কল দিলে তাকে এই বাড়ির লোকেশন জানিয়ে দিলো।
ফোনের ডিসপ্লেতে নেভিগেশন বলে দিচ্ছে, উবারের ড্রাইভার ঠিক মতোই এগোচ্ছে। অ্যারাইভাল টাইম পাঁচ মিনিট।
কিছুক্ষণ পরই শ্যামলকে সঙ্গে নিয়ে নীচে চলে গেলো সে। ছেলেটার হাতে ছোট্ট একটা লাগেজ।
বাড়ির কেয়ারটেকার ওয়াহাব তাদেরকে দেখেই মেইনগেটটা খুলে দিলো। গেটের বাইরে কালো রঙের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াহাবকে দুশো টাকা বখশিস দিয়ে বের হয়ে গেলো সে।
পেছনের সিটে শ্যামলকে নিয়ে বসতেই সানক্যাপ পরা উবারের ড্রাইভার গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে দিলো।
গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে আশেপাশে তাকালো। ঢাকা শহরের অন্য। অংশের তুলনায় বনানী বেশ ছিমছাম। তারপরও এখানে থাকতে পারেনি বেশিদিন।
এবার ফোনের দিকে নজর দিলো, যথারীতি ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফেসবুক নিয়ে। তার পাশে চুপচাপ বসে ঢাকা শহর দেখে যাচ্ছে শ্যামল। এর আগে ছেলেটা কখনও ঢাকায় আসেনি, তার কাছে নিশ্চয় শহরটা ভালোই লাগছে।
খুব দ্রুতই ফেসবুকের বিচিত্র সব মানুষজনের বিচিত্র সব পোস্ট আর কমেন্টে হারিয়ে গেলো সে। তার কাছে মনে হয়, এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষই নানান রকম মানসিক রোগে আক্রান্ত। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের এই আসক্তি তাকেও রেহাই দেয়নি। সেই আর্টিকেলের কথাটা আবারো মনে পড়ে গেলো। ওটাতে গবেষকেরা জানিয়েছে, মদ্যপান আর জুয়াখেলায় আসক্ত হলে মানুষের মস্তিষ্কে নাকি এক ধরণের পদার্থ নির্গত হয়-নামটা এ মুহূর্তে মনে করতে পারছে না সে-ঐ একই পদার্থ ফেসবুক আসক্তির বেলায় প্রায় তিনগুণ বেশি নির্গত হয়!
পরিহাসের হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান! মাথার ভেতরে গুনগুনিয়ে উঠলো গানটা।
হঠাৎ করে তার মাথায় আরেকটি চিন্তার উদ্রেক হলো। বিষে বিষ ক্ষয়! পুরনো বাংলা প্রবাদ এটি, খনার বচন কিনা সে জানে না-যাই হোক, সেটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে অতিরিক্ত ফেসবুক আসক্তি দূর করতে হলে আরো বেশি করে আসক্ত হবার দরকার আছে, নাকি? বেশি আসক্তির ফলে একঘেয়েমী চলে আসতে পারে। এভাবে কেটে যেতে পারে আসক্তিটা!
মনে মনে হেসে ফেললো সুস্মিতা। এটা হলো মানুষের মস্তিষ্কের সেই অংশের কারসাজি, যেটা সব রকম অনিয়ম আর অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গায়, যুক্তি খুঁজে বেড়ায়। তার মধ্যে এই যে চিন্তার উদ্রেক হয়েছে, সেটাও মস্তিষ্কের সেই অংশের কাণ্ড!
মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেটিয়ে বিদায় করার আগেই প্রবলভাবে ঝাঁকি খেলো সে। সামনের দিকে হুরমুর করে ছিটকে গেলো, হাত থেকে পড়ে গেলো তার স্মার্টফোনটা। অবিশ্বাসে চেয়ে দেখলো, একটা বাড়ির ড্রাইভওয়েতে হার্ড ব্রেক করে থেমে পড়েছে উবারের গাড়িটা!
ড্রাইভারকে যেই না বলতে যাবে, কী হয়েছে-তার আগেই দেখতে পেলো অবিশ্বাস্য একটি দৃশ্য! উবারের ড্রাইভারের হাতে পিস্তল! আর সেটা তা করে রেখেছে ঠিক তার দিকেই!
চিৎকারটা না দিয়ে পারলো না সে।
“একদম চুপ!” উবারের ড্রাইভার পিস্তলটা নেড়ে ধমকের সুরে বললো। “আওয়াজ করলেই গুলি করে দেবো!”
মুখে হাতচাপা দিলো সে। এদিকে মূর্ছা যাবার উপক্রম হলো শ্যামলের। জীবনে কখনও এরকম পরিস্থিতিতে পড়েনি সে।
.
অধ্যায় ৬৫
লাঞ্চের পর আয়েশ করে এক চা কাপ খাওয়া খোদাদাদ শাহবাজ খানের বহু পুরনো অভ্যাস। শরীর ভালো থাকুক আর খারাপ, চা কখনও বাদ যায় না। আজ ঘুম থেকে তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে ওঠার পরই বুঝতে পেরেছিলো, সারাটা দিন মাথার উপর দিয়েই যাবে! গতকাল এটা গিয়েছিলো ঘাড়ের উপর দিয়ে!
আইনস্টাইনকে চা আনতে পাঠাবে কিনা বুঝতে পারছে না। একটু আগেই দুপুরের খাবার খেয়েছে, এখন যদি চায়ের কথা বলে পিচ্চি আইনস্টাইন বয়োজ্যেষ্ঠদের মতো শাসন করে বলবে, এই অবেলায় চা খাওয়া ঠিক না।
মুচকি হাসি ফুটে উঠলো কেএস খানের ঠোঁটে। দিন দিন ছেলেটার খবরদারি বাড়ছে-আর সে-ও এটা উপভোগ করে। সবাই কমবেশি শাসিত হয় কিন্তু কয়জনের ভাগ্যে ভালোবাসার শাসন জোটে?
নিজের সিঙ্গেল বিছানাটায় বসে আছে সে। এই অখণ্ড অবসর বই পড়ে কাটিয়ে দেয়া যায় খুব সহজে, কিন্তু মাথাব্যথা সেটা থেকে বিরত রাখছে তাকে। তার শরীর যতো খারাপই হোক, বই পড়ায় বিরতি দেয় না কখনও, কিন্তু মাথাব্যথা হলেই ছেদ পড়ে তাতে।
বিছনায় বসে উসখুস করতে লাগলো কেএস খান। ঘুমিয়ে যে সময় পার করবে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। অবেলায় তার ঘুম আসে না কখনও। কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু কী করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। নতুন একটা মোবাইলফোন কিনেছে গতকাল, সেই সাথে সিমও। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ তার এই নতুন নাম্বারের কথা জানে না। ডাক্তার লুবনাকে ফোন করবে কিনা বুঝতে পারলো না। তার খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটার সাথে কথা বলতে। কিন্তু এ সময় হাসপাতালের ডিউটিতে ব্যস্ত আছে সে।
এমন সময় তার ল্যান্ডফোনটার রিং বেজে উঠলে খুশি হলো কেএস খান। রিসিভারটা ক্রাডল থেকে তুলে নিলো সঙ্গে সঙ্গে।
“হ্যালো?”
“স্লামালেকুম, স্যার,” ফোনের ওপাশ থেকে বললো নুরে ছফা।
“ওয়ালাইকুম সালাম,” ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিলো সে।
“কেমন আছেন, স্যার?…শরীর ভালো?”
“আর শরীর! একদম কি সুস্থ থাকি,” কথাটা হাসিমুখেই বললো সাবেক ডিবি অফিসার। “কলকাতার খবর কি? ওইখান থেইকা আইসা পড়ছেন যে এতো তাড়াতাড়ি! কিছু পান নাই?”
“স্যার, আমি এখন বেনাপোল বর্ডার পার হয়ে সুন্দরপুরে যাচ্ছি।”
কথাটা শুনে অবাক হলো খোদাদাদ শাহবাজ খান। “আবার সুন্দরপুর যাইতাছেন ক্যান? আপনে তারে কলকাতায় ট্রেস করবার পারেন নাই?”
“ওখান থেকেই তার হদিস পেয়েছি, স্যার।”
“বলেন কি!”
“মুশকান জুবেরি এখন সুন্দরপুরেই আছে!”
“সুন্দরপুরে আছে!?” কেএস খান যেনো সাসপেন্স নভেল পড়ার উত্তেজনায় পড়ে গেলো। “এইটা কেমনে সম্ভব! আপনে না ওইখানে গেছিলেন কয়দিন আগে…তখন তো তারে পান নাই!”
“স্যার, লম্বা গল্প…দেখা হলে সবটাই বলবো, এখন সংক্ষেপে বলছি।”
“বলেন বলেন, তাড়া দিলো সে। “আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবার পারতাছি না।”
এরপর ফোনে যতোটুকু সম্ভব কলকাতা থেকে কিভাবে নিখোঁজদের তালিকা অনুসন্ধান করে প্লাস্টিক সার্জনের খোঁজ পেয়েছিলো, আর সেখান থেকে মুশকান জুবেরির নতুন পরিচয় সুস্মিতা সমাদ্দারের হদিস পেয়েছে, সবটাই বললো। এ-ও জানালো, ওখান থেকে নিশ্চিত হবার পর আর দেরি করেনি; সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা থেকে রওনা দেয় যশোরের উদ্দেশে, সেখান থেকে সুন্দরপুরে।
“পুরাই তো দেখি রিটার্ন টু ইডেনের কাহিনী!” ছফার কথা শেষ হলে বললো কেএস খান।
“কীসের কাহিনী?!” ছফা বুঝতে পারলো না তার সিনিয়রের কথা।
“একটা সিনেমার কাহিনী! অনেক আগে টিভিতে দেখাইতো…রিটার্ন টু ইডেন…ওইটাতে এক মহিলা তার হাজব্যান্ডের উপর রিভেঞ্জ নেওনের লাইগা প্লাস্টিক সার্জারি কইরা নিজের চেহারা পাল্টায়া ফালায়…নতুন একটা আইডেন্টি নিয়া ফিরা আসে আবার,” দ্রুত বলে গেলো। একই রকম ঘটনা মুশকান জুবেরিও ঘটাইছে! আনবিলেভেল!” একটু থেমে আবার বললো, “মহিলার সাহসের তারিফ না কইরা পারতাছি না।”
“জি, স্যার।” ফোনের ওপাশ থেকে সায় দিলো ছফা। বেনাপোল দিয়ে দেশে ঢুকতেই মনে হলো, মুশকানকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে আপনার কাছে আমি ঋণী। আপনিই বলেছিলেন, সুন্দরপুর থেকে তদন্তটা আবার নতুন করে শুরু করতে, মহিলার বদঅভ্যেসটা ফলো করতে, আর। সে কারণেই আমি মুশকানের হদিস বের করতে পেরেছি।”
“কী যে বলেন না, বিনয়ের সাথেই বললো মি. খান। “আমি আবার কী হেল্প করলাম! সব তো করলেন আপনে। আমার দেখা সবচায়া কঠিন একটা কেস ছিলো এইটা…শেষ পর্যন্ত আপনে সলভ করবার পারলেন। কংগ্রাচুলেশন্স, ছফা। ইউ ডিড অ্যা গুড জব…অ্যাবসলিউটলি ব্রিলিয়ান্ট।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”
“এখন যতো তাড়াতাড়ি পারেন, ঐ মহিলারে অ্যারেস্ট কইরা ঢাকায় নিয়া আসেন। আর একটু সতর্ক থাকবেন, আগেরবারের মতো যে না হয়।”
“জি, স্যার।”
“আর আমার ঐ কথাটা ভুইলা যায়েন না কিন্তু,” মনে করিয়ে দিয়ে বললেন খোদাদাদ শাহবাজ খান।
“কোন কথাটা, স্যার?” বুঝতে না পেরে বললো ছফা।
“ঐ যে…মুশকারে অ্যারেস্ট করার পর তারে ভুলেও জিগায়েন না, কোন অর্গানটা খাইলে…বুঝবারই তো পারছেন।”
“বুঝতে পেরেছি। আমি সেটা করবো না, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
“ঢাকায় আসেন…আপনের মুখ থেইকা ডিটেইল শুনতে হইবো সবটা।”
“জি, স্যার।”
ফোনের রিসিভারটা বুকের কাছে রেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য উদাস হয়ে রইলো কেএস খান। মুশকান জুবেরির এমন নাটকীয় আচরণ তাকে বিস্মিত করেছে। মহিলা সম্পর্কে যতোটুকু জেনেছে, তাতে করে এমন কাজ করার কথা নয়। কিন্তু তারপরও কথা থাকে-মানুষ সব সময় নিজের সর্বোচ্চ বুদ্ধি আর কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে কাজ করে না-বেশির ভাগ সময়ই তাকে পরিচালিত করে আবেগ, রাগ-ক্ষোভ, হতাশা, উচ্চাভিলাষীতা, প্রতিশোধপরায়ণতা আর প্রেম-বিরহ। না জানি আরো কতো কী! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে।
সম্বিত ফিরে পেয়ে আইনস্টাইনের ঘরের দিকে তাকালো। “ফ্লাস্কটা লইয়া চা নিয়া আয় তো…মাথাব্যথায় মইরা যাইতাছি।” বেশ জোরে বললো কথাটা, যাতে করে মটু পাতলু কার্টুনের শব্দ ছাপিয়ে ছেলেটার কানে সেটা পৌঁছায়।
“আইচ্ছা।” ঘরের ভেতর থেকে আইনস্টাইনের কণ্ঠটা ভেসে এলো।
মাথাব্যথার মতো বিচ্ছিরি যন্ত্রণার মধ্যেও কেএস খানের মুখে ফুটে উঠলো প্রসন্ন হাসি। অবশেষে মুশকান জুবেরির রহস্য অবসান হতে চলেছে। মহিলা নতুন পরিচয়ে, নতুন একটা মুখ নিয়ে আবারো ফিরে গেছে সুন্দরপুরে-আর ছফা সেটা উদঘাটনও করে ফেলেছে।
অবিশ্বাস্য!
.
অধ্যায় ৬৬
রমাকান্তকামার এ জীবনে কখনও সন্দেহগ্রস্ত হননি তা নয়, তবে এর আগে আর কখনও এই বাতিক তাকে এতোটা গ্রাস করেনি। সন্দেহগ্রস্ততা সব সময়ই সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন তিনি।
লাইব্রেরির ছোট্ট অফিস ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। এখনও চার-পাঁচজন পাঠক বইয়ে নিমগ্ন। এরকম দৃশ্য দেখতে তার বেশ ভালো লাগে, তবে অন্যদিনের মতো আজকে সেটা হলো না। সন্দেহগ্রস্ততার পাশাপাশি দুশ্চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। না চাইলেও, কখনও কখনও সন্দেহ জোর করে অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে, এর থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে।
সুস্মিতার সাথে ডাক্তার আসকারের সম্পর্কটা নিয়ে মাস্টারের মনে এক ধরণের সন্দেহ তৈরি হয়েছিলো গতকালই। ডাক্তার ভদ্রলোক তাকে বলেছিলেন, সুস্মিতা তার এক প্রয়াত বন্ধুর মেয়ে হয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আদতে তাদের সম্পর্কটা অনেক বেশি গভীর।
বেশ কয়েক মাস আগে সুস্মিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডের সম্মানিত সদস্য ডাক্তার আসকার, আর ঐ সময়েই স্কুলের জন্য গানের শিক্ষক খুঁজছিলেন মাস্টার। কথাটা তিনি জানিয়েছিলেন ভদ্রলোককে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, সুস্মিতার মতো শান্তিনিকেতন থেকে আসা কেউ সুন্দরপুর স্কুলে বাচ্চাদের গান শেখাতে আগ্রহী হবে। ডাক্তার তার বন্ধুর মেয়েকে প্রস্তাবটা দিতেই সানন্দে রাজি হয়ে যায় সে! মাস্টার অবাক হলেও, ভালো একজন শিক্ষক পেয়ে এতোটাই খুশি হয়েছিলেন যে, খুব একটা মাথা ঘামাননি এ নিয়ে।
গতকাল বিকেলের দিকে তিনি যখন স্কুলের অফিস থেকে রবীন্দ্রনাথে যাবার জন্য বের হবেন, তখন উদ্বিগ্ন হয়ে সুস্মিতা এসেছিলো তার কাছে। মেয়েটা সব সময় যেভাবে পরিপাটি থাকে সেটা দেখতে ভালো লাগে তার-যেনো রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে উঠে আসা কোনো নায়িকা। কিন্তু গতকাল সেই পরিপাটি সুস্মিতার দেখা পাননি রমাকান্তকামার। সচরাচর বাঙালি মেয়েরা যেরকম সালোয়ার-কামিজ পরে থাকে সেরকমই কিছু পরেছিলো, আর তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছিলো সে ভীষণ বিচলিত।
“মাস্টারমশাই,” ঘরে ঢুকেই মলিন কণ্ঠে বলেছিলো সে। “ডক্টর আসকার হসপিটালে অ্যাডমিট। ওর কন্ডিশান নাকি খুবই ক্রিটিক্যাল!”
রমাকান্ত নড়েচড়ে বসেছিলেন কথাটা শুনে। “বলেন কি?”
“এখন আইসিসিসিইউতে আছে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেছিলো কথাগুলো।
মেয়েটার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন মাস্টার। তখনই প্রথম বারের মতো এই সন্দেহগ্রস্ততার শিকার হোন তিনি-এই মেয়ের সাথে ডাক্তারের সম্পর্ক কী? ভদ্রলোকের অসুস্থতার খবর পেয়ে তার চোখ এভাবে ছল ছল করে উঠবে কেন?
“ওর বাসায় পুলিশের দু-জন লোক গেছিলো ওকে ইন্টেরোগেট করার জন্য…তখনই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়ে।”
মাস্টারের ভুরু কুঁচকে গেছিলো কথাটা শুনে। কারা গেছিলো-প্রশ্নটা করতে গিয়েও করেননি, ভালো করেই জানতেন, এটা ঐ নুরে ছফার কাজ। উকিল ভদ্রলোক তাকে ফোন করে সবই জানিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্যে নিজেকে কিছুটা দায়ীও মনে করেন মাস্টার। তার বলা উচিত হয়নি চিরকুটটা তাকে কে দিয়েছিলো। এই চিরকুটের সূত্র ধরেই উকিলকে হেনস্তা করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে ডাক্তারের নাগাল পেয়ে গেছে ডিবি অফিসার।
“এখন ডাক্তারসাহেবের কী অবস্থা?” আস্তে করে জানতে চেয়েছিলেন রমাকান্তকামার। একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এসেছিলো ভেতর থেকে।
ঠোঁট ওল্টায় সুস্মিতা। “কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ওর ফোন বন্ধ, তাই বাসার দারোয়ানকে ফোন দিয়েছিলাম…সে-ই আমায় বললো। এরপর হসপিটালে যোগাযোগ করেছিলাম, কিন্তু ওরা কিছুই জানে না! খুবই অদ্ভুত ঠেকছে ব্যাপারটা। ভীষণ চিন্তাও হচ্ছে।”
মাস্টারের ভুরু কুঁচকে গেছিলো। “হাসপাতালও কিছু জানে না? ওটা উনার নিজেরই…?”
“হুম, সেজন্যেই আমার খুব টেনশন হচ্ছে।”
সুস্মিতার দিকে ভালো করে তাকিয়ে মাস্টার দেখতে পেয়েছিলেন, মেয়েটা আসলেই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।
“আমাদের কি ঢাকায় গিয়ে উনাকে দেখে আসা দরকার?” ট্রাস্টের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে এটা করা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বলে মনে করেছিলেন রমাকান্তকামার। যদিও জানতেন, তিনি গেলে ঐ নুরে ছফার সন্দেহের দৃষ্টিতে পড়বেন আবার, সে নিশ্চয় নজরদারিতে রেখেছে ডাক্তারকে, তার লোকজন থাকতে পারে হাসপাতালের আশেপাশে। তার চেয়েও বড় কথা, স্কুলের গুরুদায়িত্ব ফেলে তার পক্ষে দু-দিনের জন্যে ঢাকায় যাওয়াটাও খুব কঠিন। অন্যদিকে, ট্রাস্টের একজন সদস্য ছাড়া ডাজার আসকার ইবনে সায়িদের সাথে তার তেমন সখ্যতাও নেই। তার চেয়ে বরং সুস্মিতা গেলেই ভালো হয়। তবে মেয়েটাকে একা ছাড়েননি তিনি। সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন শ্যামলকে। শত হলেও ঢাকা শহর, তিনি নিজেই ওখানে গিয়ে…
এমন সময় লাইব্রেরির ছোট্ট অফিস ঘরের দরজায় টোকা দিলে মাস্টারের চিন্তাভাবনায় ছেদ পড়লো। তিনি কিছু বলার আগেই দরজাটা খুলে গেলো, দেখতে পেলেন নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে।
যারপরনাই বিস্মিত হলেন রমাকান্তকামার। অনেক অনেক বছর পর, তার সমস্ত শরীর রাগে কেঁপে উঠলো।
ছফার ঠোঁটে লেগে আছে বাঁকাহাসি, যেনো বিশাল একটি বিজয় অর্জন করে এসেছে সে।
“মাস্টারসাহেব, আপনার সাথে আমার জরুরী কথা আছে,” ঘরের ভেতরে ঢুকে বললো ছফা।
“আমার সাথে! কী কথা?” মাস্টার খুবই অবাক হলেন। বেশ বেগ পেতে হলো নিজের ভেতরে ফুঁসে উঠতে থাকা এই ক্রোধকে দমন করতে গিয়ে।
“আপনার স্কুলে যাচ্ছি, আপনাদের গানের শিক্ষিকা সুস্মিতাকে গ্রেপ্তার করতে।”
“কি!” মাস্টার যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। “সুস্মিতাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছেন!” এই লোক কি তার সঙ্গে তামাশা করতে এসেছে-রমাকান্তকামার ভেবে পেলেন না। “ও কী করেছে? ওকে কেন গ্রেপ্তার করতে চাইছেন আপনি?”
বাঁকাহাসি দিলো ছফা। “আসলে আমার বলা উচিত ছিলো মুশকান জুবেরিকে গ্রেপ্তার করতে এসেছি, তাহলে আপনার জন্য বুঝতে সুবিধা হতো।”
মাস্টার বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। কথাটা হজম করে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। “আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?!”
বাঁকা হাসি দিলো ছফা। “রমাকান্তবাবু, আজকেই কলকাতা থেকে ফিরেছি আমি, সেখান থেকেই জেনে এসেছি, মুশকান জুবেরি সুস্মিতা সমাদ্দার সেজে আপনার স্কুলে চাকরি নিয়েছে। সম্ভবত আপনিও সেটা জানতেন।”
মাস্টার যেনো বজ্রাহত হলেন। “কী যা-তা বলছেন! সুস্মিতাকে আপনি দেখেছেন না? ও কিভাবে মুশকান জুবেরি হতে যাবে? আমার সাথে এসব তামাশা করার মানে কী!”
“লম্বা গল্প…আমার হাতে এখন অতো সময় নেই। পরে যখন। আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো তখন সবটাই বলবো।”
মাস্টারের ভুরু কুঁচকে গেলো।
“বাইরে পুলিশের ভ্যান অপেক্ষা করছে, আমি আপনার স্কুলে যাচ্ছি ওদের নিয়ে,” বললো ছফা। আশা করি, এখানকার এমপিকে আর জড়াবেন না। জড়ালেও কোনো ফায়দা হবে না,” কথাটা বলে যেই না ঘর থেকে বের হতে যাবে অমনি মাস্টারের কথায় থমকে দাঁড়ালো সে।
“কিন্তু সুস্মিতা তো স্কুলে নেই।”
মাস্টারের দিকে ফিরে তাকালো ছফা। তার চোখেমুখে অবিশ্বাস। “নেই মানে??”
ও ঢাকায় চলে গেছে…গতকাল।”
“ঢাকায় গেছে??” বিস্ময় আর হতাশায় বলে উঠলো ছফা। “ঢাকার কোথায়? কেন গেছে?!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো সে।
“জানি না।” মিথ্যেটা অনেক কষ্টে বললেন রমাকান্তকামার। তার কাছে মনে হচ্ছে, এই লোকের কাছে সত্যি বলা মানে কাউকে বিপদে ফেলা।
ছফার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। রাগেক্ষোভে ফুঁসে উঠলো সে। একহাত দিয়ে অন্যহাতের তালুতে আঘাত করলো জোরে। দাঁতে দাঁত পিষে অনেকটা আর্তনাদের মতো করে বললো, “পালিয়েছে! ঐ ডাইনিটা আবারো পালিয়ে গেছে!”
.
অধ্যায় ৬৭
ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ এবার সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দুশ্চিন্তায় তার প্রেসার বেড়ে গেছে। ডুয়েল সিটিজেন তিনি, বৃটিশ পাসপোর্ট আছে তার, চাইলে যেকোনো সময় ভিসা ছাড়াই সেকেন্ডহোমে যেতে পারেন। তারপরও বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন তাকে লন্ডনের ফ্লাইটে উঠতে দেয়নি। এরজন্যে কোনো কারণও দেখায়নি তারা, শুধু বলেছে, উপর মহল থেকে নির্দেশ আছে, ডাক্তার আসকার যেনো দেশ ত্যাগ করতে না পারেন। তার সঙ্গে আসা হাসপাতালের কর্মচারীরা অনেক অনুরোধ করেও তাদেরকে বোঝাতে পারেনি। তবে ডাক্তার জানতেন, ইমিগ্রেশনে যারা আছে তাদেরকে অনুরোধ করে কোনো ফায়দা হবে না, সেজন্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলেন তিনি, যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়। তার নামে কোনো মামলা নেই, কোনো কেসে তিনি সন্দেহভাজন আসামিও নন, এমনকি বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন-তাহলে কীসের ভিত্তিতে তাকে ইমিগ্রেশন আটকে দিলো?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে দারুণ অবাক হয়েছিলেন, কেননা এ কাজ তার মন্ত্রণালয়ই করে থাকে সব সময়। জানামতে, ডাক্তারের ব্যাপারে এরকম নিষেধাজ্ঞা দেয়নি তার মন্ত্রণালয়। কিন্তু ইমিগ্রেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তিনি জানতে পারেন, সত্যি সত্যি সরকারের উপরমহল থেকে বিশেষ একজন ব্যক্তির নির্দেশে ডাক্তারকে বিদেশে যেতে বাধা দেয়া হচ্ছে। সেই বিশেষ ব্যক্তিটি কে, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানাতে অপারগ হলেও ডাক্তার আসকার বুঝে গেছেন-এটা প্রধানমন্ত্রীর পিএসের কাজ। ক্ষমতাধর ব্যক্তি তিনি, ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। আর এর পেছনে যে নুরে ছফার হাত আছে সেটাও বুঝতে পেরেছেন।
ইমিগ্রেশন থেকে বিমুখ হয়ে নিজের হাসপাতালের অফিসে ফিরে এসেছেন অনেকক্ষণ হলো কিন্তু অন্য একটি দুশ্চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সুস্মিতার ফোন বন্ধ। তিনি ঢাকা ছাড়ার পর মেয়েটা ঢাকা টু যশোর ফ্লাইটে সুন্দরপুরে চলে যাওয়ার কথা। ঘণ্টখানেক আগে সে ফোন দিয়ে বলেছেও, একটু পরই রওনা দেবে। রওনা দেবার পর এসএমএসও পাঠিয়েছিলো। এরপর থেকে আর কোনো খবর নেই।
প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো সুস্মিতার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, যে ফ্লাইটে সুস্মিতার যশোর যাবার কথা, সেটা সে মিস্ করছে! গতকালই হাসপাতালের অ্যাডমিনের একজনকে দিয়ে মেয়েটার জন্য দুটো টিকেটের ব্যবস্থা করেছিলেন।
এখন তার মনে খারাপ কিছুর আশঙ্কা দানা বাঁধছে।
ওর কিছু হলো না তো?! আসকার ইবনে সায়িদ নিজের মাথা থেকে এই দুশ্চিন্তাটা কোনোভাবেই দূর করতে পারছেন না। পথে কোনো দুর্ঘটনা? এরকম আশঙ্কাও হচ্ছে তার। তবে মন বলছে, যে লোক তাকে দেশের বাইরে যেতে না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে, সেই একই লোক সুস্মিতাকেও কিছু করেছে।
কিন্তু কী করেছে?! কেন করবে?
ডাক্তার টের পাচ্ছেন, তার নাজুক হৃদপিণ্ডটা এবার সত্যি সত্যি বিপাকে পড়ে গেছে। বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যথাটা বাড়ছে ক্রমশ। তার হার্টে তিনটা রিং লাগানো হয়েছিলো কয়েক বছর আগে। তারপর বেশ সুস্থই ছিলেন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা দিনকে দিন নাজুক হয়ে উঠছে আবার।
পকেট থেকে সদ্য কেনা সেলফোনটা হাতে নিলেন ডাক্তার। নুরে ছফা আর গুণ্ডা প্রকৃতির ঐ লোক যখন তার বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়েছিলো তখন তিনি দ্রুত নিজের মোবাইলফোন থেকে সিমটা খুলে ফোনটা কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিয়েছিলেন, সিমটা লুকিয়ে রেখেছিলেন মেঝের কার্পেটের নীচে। তবে পাসপোর্টটার কথা মাথায়ই আসেনি। এলেও ওটা তিনি নষ্ট করার বিলাসিতা দেখাতে পারতেন না।
স্মৃতি থেকে একটা নাম্বার প্রেস করলেন। এই নাম্বারটা তার স্মৃতি ছাড়া আর কোথাও সংরক্ষণ করেননি নিরাপত্তার কারণে। এখন এই সঙ্কটময় মুহূর্তে এসে শেষ দুটো ডিজিট তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।
৪৮ নাকি ৮৪? মনে মনে আওড়ালেন ডাক্তার।
অবশেষে প্রথমটাই বেছে নিলেন। রিং হতেই কর্কশ কণ্ঠের এক লোকের কণ্ঠ শুনেই কলটা কেটে দিলেন। এবার শেষ দুটো ডিজিটে ৮৪ যোগ করে কল করলেন। কিন্তু রিং হতে থাকলেও কেউ ধরলো না কলটা। আবারো ডায়াল করলেন তিনি।
ফোনটা ধরো…প্লিজ!
.
অধ্যায় ৬৮
তার কোনো ধারনাই নেই কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, কে বা কারা তাকে এভাবে অপহরণ করেছে সে সম্পর্কেও বিন্দুমাত্র ধারনা করতে পারছে না। তার নার্ভ বেশ শক্ত, সহজে ভেঙে পড়ার মতো নয়। কিন্তু আকস্মিক এই ঘটনায় সাময়িক নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হয়েছিলো।
একটা ঘরে হাত-পা-মুখ আর চোখ বেঁধে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কোনো রকম নড়াচড়া করলে তার ভালো হবে না বলেও শাসিয়ে দেয়া হয়েছে।
নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার জন্য কিছুটা সময় পেতেই প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিতে পেরেছে সে কিন্তু তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে শ্যামলকে নিয়ে। ছেলেটাকে কোথায় রেখেছে সে জানে না। এই বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে উবার ড্রাইভার ছাড়াও আরো দু-জনকে দেখেছে। তারপরই পিস্তলের মুখে তার হাত-মুখ আর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। সে বার বার জানতে চেয়েছে, তারা কারা, কেন তাদের সাথে এরকম করা হচ্ছে-কিন্তু উবারের ড্রাইভার আর বাকি লোকগুলো কিছুই বলেনি। তবে এটা বুঝতে পারছে, ঐ। ড্রাইভারই এই অপহরণ দলের নেতা।
শ্যামলের হাত-মুখ-চোখ বাধার সময় বেশ কান্নাকাটি করেছিলো ভয় পেয়ে। তাকে সজোরে এক থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দেয় এক ষণ্ডা।
আমি সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছি! মনে মনে বললো সে। নাকি এরা অন্য কেউ? কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারলো না। সবটাই তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে।
এরা পুলিশ নয়। ভালো করেই বুঝতে পারছে। পুলিশ হলে তাকে থানায় নিয়ে যেতো। কিংবা ওরকম কোথাও। কিন্তু এ জায়গাটা একেবারেই বিরাণ। চোখ বাধার আগে যতোটুকু দেখেছে, একটা পরিত্যক্ত বাড়ি বলেই মনে হয়েছে তার কাছে।
তহলে এরা কারা?!
এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই, তাই এসব চিন্তা বাদ দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। গভীর করে নিশ্বাস নিলো বার কয়েক। নিজেকে আরেকটু ধাতস্থ করা দরকার।
সে আছে এই বাড়ির দোতলায়। শ্যামলকে কোথায় নিয়ে গেছে জানে না। সিঁড়ি দিয়ে প্রায় টেনে নিয়ে এসেছে তাকে। বার কয়েক সে জোরাজুরি করেছিলো, কিন্তু ঐ ড্রাইভার পেছন থেকে তার চুলের মুঠি ধরে কানের কাছে মুখ এনে বলেছে, তার কথা না শুনলে, বাড়াবাড়ি করলে অকল্পনীয় শাস্তি দেয়া হবে।
এরপর আর কিছু করেনি সে। লোকটার হুমকি তার কাছে নিছক কথার কথা বলে মনে হয়নি। যে লোক উবারের ড্রাইভার সেজে, পিস্তলের মুখে দু দু-জন মানুষকে দিনে-দুপুরে অপহরণ করতে পারে, তার কোনো হুমকিকে হালকাভাবে দেখার উপায় নেই।
চোখ বাঁধার আগে সে আরো অবাক হয়েছে, ড্রাইভারের চেহারা দেখে। তার যতোটুকু মনে পড়ে, উবারে রিকোয়েস্ট দেবার পর উবার অ্যাপসে ড্রাইভারের যে ছবি দেখেছিলো, এই লোক সেই লোক নয়-এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। ছবির ড্রাইভার ছিলো হ্যাংলা পাতলা এক তরুণ। পুরু গোঁফ, মাথার চুল কোকড়ানো, চোখদুটো সামান্য ট্যারা। এ কারণে অ্যাপসে লোকটার ছবি অল্প কিছুক্ষণ দেখলেও তার মনে আছে। কিন্তু যে ড্রাইভার তাকে অপহরণ করেছে, সে বেশ পেটানো শরীরের, ক্লিনশেভড, ছোটোছোটো করে ছাটা চুল। লোকটার চোখমুখ দেখলেই মনে হয় ষণ্ডা প্রকৃতির।
কি কারণে আমাকে অপহরণ করেছে এরা? মনে মনে আবারো প্রশ্নটা আওড়ালো। টাকা? তার কাছে অবশ্য মনে হচ্ছে না। এরা তাকে টার্গেটই বা করলো কিভাবে? জানলোই বা কিভাবে সে ঢাকায় আছে? আর সে যে উবারে কল দিয়েছিলো সেই খবরই বা পেলো কোত্থেকে?–এসবের কোনো উত্তরই পেলো না।
হঠাৎ টের পেলো ঘরে কেউ ঢুকেছে। গভীর করে নিশ্বাস নিলো সে। ঘরে যে উবারের ড্রাইভার ঢুকেছে সেটা বুঝতে পারলো। লোকটার শরীরের গন্ধ তার মুখস্ত হয়ে গেছে এরইমধ্যে!
একটুও চমকালো না। নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। যা কিছু মোকাবেলা করতে হবে, শক্ত থেকেই করবে।
.
অধ্যায় ৬৯
আসলাম ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে বন্দী মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার, মেয়েটা স্থির হয়ে বসে আছে, একটুও চমকায়নি। খুবই স্বাভাবিক হতো, যদি চমকে উঠতো। বোঝাই যাচ্ছে এই মেয়ের নার্ভ বেশ শক্ত। আসলাম এরইমধ্যে সেটা টেরও পেয়েছে।
একটা পুরনো ডাবল সোফা আর কাঠের চেয়ার ছাড়া ঘরটা প্রায় খালি। এই বাড়িটা ক-দিন পরই ভেঙে ফেলা হবে, এখানে গড়ে উঠবে দশ তলার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। যে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এটা ডেভেলপ করবে সেটা পিএস আশেক মাহমুদের নিজেরই। যদিও কাগজে-কলমে চারজন পার্টনার আছে কিন্তু আসল পুঁজি আসে আসলামের বসের কাছ থেকে। এরকম আরো অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই পিএসের বিনিয়োগ রয়েছে।
ঘরের এককোণে থাকা সোফাতে গিয়ে বসলো আসলাম। টর্চার করার কিছু সাধারণ ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে এসেছে সে-একটা কাটার প্লাঞ্জার, পলিথিনের কিছু ব্যাগ আর স্কচ টেপ-এসবই যথেষ্ট। যদি টর্চার করার আদৌ কোনো দরকার পড়ে তো! আসলামের অবশ্য ইচ্ছে নেই, এই মেয়েকে এসব জিনিস দিয়ে টর্চার করার। তার চেয়ে বরং মেয়েদের কাছে যেটা সবচে বিভীষিকাময়, সেই ‘অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে পারলেই সে বেশি খুশি হবে। আর বলাই বাহুল্য, সেটা কাজেও দেবে বেশ!
মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না সে। তার দেহসৌষ্ঠব যেকোনো পুরুষের কাছেই লোভনীয়। আর সেটা তাদেরকে পতঙ্গ বানিয়ে কাছে টেনে পুড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। একেবারে হালকা-পাতলা গড়ন-গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের মতো যা-পাও-তাই-খাও’টাইপের নয়, বেশ সচেতন। কথাবার্তাও বেশ মার্জিত, অন্তত যতোটুকু আসলাম শুনেছে। প্রবল একটা ব্যক্তিত্ব আছে। দেখে মনে হচ্ছে, বয়স ত্রিশের নীচেই হবে। মেয়েটার মসৃণ গ্রীবা থেকে সুডৌল বুকের দিকে তার চোখ আটকে আছে। পরনে ঘিয়েরঙা ফতুয়া আর কালো জিন্স প্যান্ট। চুলগুলো সামনে থেকে টেনে ঝুটি করে বাধা। ঘরে ফ্যান নেই বলে শরীরটা ঘেমে আছে, গায়ের সাথে লেপ্টে আছে ফতুয়াটি।
মনীষা দেওয়ানের কথা মনে পড়ে গেলো। ওর-ও এমন মসৃণ গ্রীবা আর সুডৌল বুক ছিলো। আরো ছিলো…।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। মেয়েটাকে হারানোর পর সারা দিনে কতো বার যে ওর কথা মনে পড়ে ইয়ত্তা নেই।
মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে বন্দীর দিকে তাকালো। তার ইচ্ছে করছে একটা তোয়ালে দিয়ে মেয়েটার মুখ থেকে শুরু করে সারা শরীর মুছে দিতে।
নিজের ভেতরে জান্তব পশুটা জেগে ওঠা টের পেতেই ওটাকে দমন করার জন্য পকেট থেকে ফোন বের করে পুরনো মেসেজগুলো পড়তে লাগলো। পিএস এসে পড়বে আরেকটু পরই। তার বস্ কল্পনাও করতে পারেনি এতো সহজে মেয়েটাকে তুলে আনতে পারবে সে।
ডাক্তার আসকারের বাড়ির মেইন গেট থেকে একটু দূরে কালো রঙের গাড়িটা নিয়ে নজর রাখছিলো সে। এমন সময় তার বস্ ফোন করে বলে, তাদের প্ল্যানে একটু পরিবর্তন করা হয়েছে। আগের প্ল্যানটা ছিলো অনেকটা এরকম-নুরে ছফা যদি কলকাতা থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে তাহলে ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ এই তরুণীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, ভদ্রলোককে বাধ্য করা হবে মুশকান জুবেরির খোঁজ দিতে। কিন্তু একটু আগে তার বস্ তাকে বলে, আসলাম যেনো সময় নষ্ট না করে দ্রুত এই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে আসে এখানে।
কথাটা শুনে একটু অবাকই হয়েছিলো সে। ছফা কি তাহলে মুশকানের হদিস বের করতে পারেনি? কিন্তু গতকাল তার সাথে যখন কথা হলো, তখন তো ডিবি অফিসার বলেছিলো তার কাজ বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছে। অবশ্য পিএসকে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি আসলাম।
যাই হোক, পিএস আশেক মাহমুদই তাকে জানিয়েছিলো মেয়েটা কখন বাড়ি থেকে বের হতে পারে। বসের ক্ষমতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ তার নেই, তারপরও কোত্থেকে কিভাবে এরকম মূল্যবান খবর জোগাড় করেছে সেটা ভেবে একটু অবাকই হয়েছিলো। যাই হোক, মেয়েটার গন্তব্য যেহেতু এয়ারপোর্ট, সে নিশ্চয় উবারই ব্যবহার করবে। হাসপাতাল থেকেও উবারে করেই এসেছে এখোন।
উবার ব্যবহার করবে!
পিএস তাকে পর্যাপ্ত লোকবলও দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার মাথায় চট করেই একটা বুদ্ধি চলে আসে।
বাড়িতে ঢুকে হৈহল্লা করার কোনো দরকার নেই। অনেক সহজেই কাজটা করা যেতে পারে। আর সেটা করার জন্য সে একাই যথেষ্ট।
ডাক্তারের বাড়ির সামনে একটা প্রাইভেট কার থামতেই নড়েচড়ে ওঠে আসলাম। দূর থেকেই দেখে ড্রাইভার ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে কী যেনো দেখছে। উবার! বুঝে যায় সে। সঙ্গে সঙ্গে ড্যাশবোর্ড থেকে সানক্যাপটা নিয়ে মাথায় চাপিয়ে নেয়। নজরদারি করার সুবিধার্থে গাড়িতে রেখেছিলো ওটা। এরপর নিজের গাড়িটা নিয়ে দ্রুত চলে আসে উবারের ঠিক সামনে, একেবারে পথরোধ করে। ড্রাইভার হতবাক হয়ে জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করে কিছু বললেও আসলাম সেটা আমলে নেয়নি। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ না করেই হ্যান্ড ব্রেকটা টেনে দরজা খুলে বের হয়ে আসে। সে। বিস্মিত ড্রাইভার কিছু বলার আগেই একহাতে পকেট থেকে তার পুরনো আইডি কার্ডটা বের করে দেখায়, অন্য হাতে কোমর থেকে বের করে আনে পিস্তলটা, নিজেকে পুলিশের অ্যান্টি টেরররিস্ট স্কোয়াডের সদস্য পরিচয় দিয়ে ড্রাইভারের কাছ থেকে জেনে নেয়, গাড়িটা উবারের কিনা। নিশ্চিত হবার পর, ড্রাইভারকে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, এই বাড়িটা তার স্কোয়াড কর্ডন করে রেখেছে সকাল থেকে। এখানে এক মহিলা জঙ্গি আছে, সে যেনো এক্ষুণি তার গাড়িটা নিয়ে চলে যায়। ঐ মহিলা কাস্টমার তাকে ফোন দিলে সে যেনো বলে, বাড়ির সামনে চলে এসেছে। ঠিক আছে? মাথা নেড়ে সায় দেয় বেচারা ড্রাইভার, তারপর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করেনি, গাড়িটা ব্যাক গিয়ারে নিয়েই সোজা বাম দিকে টার্ন নিয়ে চলে যায়।
এরপর আসলাম তার গাড়িতে উঠে ঝটপট একটু পিছিয়ে নিয়ে মেইনগেটের সামনে এনে রাখে। মাথার ক্যাপটা আরো নীচু করে দেয় দারোয়ান যাতে তাকে দেখলেও চিনতে না পারে। কয়েক মিনিট পরই বাড়ির গেটটা খুলে যায়, সেখান থেকে বের হয়ে আসে ঐ তরুণী, তার সঙ্গে সেদিনের ছেলেটাও।
বনানীর অভিজাত অ্যাভিনু থেকে বের হবার সময় রিয়ার মিরর দিয়ে দেখে, পেছন সিটে বসে থাকা মেয়েটি কোনো কথাই বলছে না, মোবাইলফোন নিয়ে ব্যস্ত সে। তার সঙ্গি ছেলেটা গোবেচারার মতো বসে আছে। গাড়িটা কোন্ দিকে যাচ্ছে সে খেয়াল ছিলো না তাদের কারোরই। এরপর আস্তে করে বামহাতে ফোনটা নিয়ে এই বাড়িতে থাকা বদরুলের নাম্বারে মিস কল দেয় গেটটা খুলে রাখার সংকেত হিসেবে।
গুলশান ২ নাম্বারের নির্জন এক রোডে গাড়িটা ঢুকে পড়লেও পেছনের সিটের যাত্রিদের কারো চোখে সেটা ধরা পড়েনি। মেয়েটা তখনও ফোন নিয়ে ব্যস্ত, আর ছেলেটা সম্ভবত এই এলাকাটা চেনে না। তার হাবভাব দেখে তা-ই মনে হয়েছে।
দূর থেকেই আসলাম দেখতে পায় এই বাড়ির খোলা মেইনগেটটা। গাড়ি নিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তেই ব্রেক কষে সে। মেয়েটা বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে থাকলেও যেই না মুখ খুলতে যাবে অমনি আসলাম পেছন ফিরে তার পিস্তলটা তা করে। কিন্তু তাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে কানফাঁটা চিৎকার দেয় মেয়েটি, অবশ্য তার সেই চিত্তার ঢাকা পড়ে যায় মেইনগেটটা টেনে বন্ধ করার ঘরঘর শব্দে আর আসলামের হুমকির কারণে।
এমন সময় ফোনের রিংয়ের শব্দ হতেই তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো পিএস কল দিয়েছে।
“স্লামালেকুম, স্যার।”
“কি অবস্থা?”
“কাজ হয়ে গেছে, স্যার।”
“দ্যাটস গ্রেট।” প্রশংসার সুরে বললো আশেক মাহমুদ। “তোমার জন্য বড়সর পুরস্কার অপেক্ষা করছে।”
গানম্যান কিছুই বললো না। পুরস্কার বলতে টাকা-পয়সা বোঝাচ্ছে নিশ্চয়। কিন্তু কাজ শেষে যদি এই মেয়েটাকেই দিয়ে দেয় তার বস্, তাহলে বরং সে বেশি খুশি হবে! ইদানিং তার আবার খুব ধর্ষণ করতে ইচ্ছে করে-সহজলভ্য মেয়েগুলো আর তাকে আকর্ষণ করে না!
“শোনো,” পিএস বললো। “শেষ মুহূর্তে পিএম একটা কাজ দিয়েছেন,..আটকে গেছি। আমার একটু দেরি হবে আসতে।”
“সমস্যা নেই, স্যার। আপনি কাজ সেরে আসুন।” মুচকি হাসি তার ঠোঁটে। বাড়তি কিছুটা সময় হাতে পেয়ে খুশি। তার বস্ এমনিতেও সন্ধ্যার পর আসতো, এখন মনে হচ্ছে আরো ঘণ্টাখানেক দেরি হবে।
পিএস কলটা কেটে না দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো। “এই মেয়েটা খুবই ডেঞ্জারাস, বুঝতে পেরেছো?”
“জি, স্যার।” কিন্তু আসলাম আসলে বুঝতে পারছে না। মেয়েটাকে দেখে মোটেও সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না তার।
“অনেকগুলো মানুষ খুন করেছে ও। একটু সাবধানে থাকবে।” কথাটা শুনে খুবই অবাক হলো গানম্যান, কিন্তু নিজে থেকে প্রশ্ন করলো। “ঠিক আছে স্যার।”
ফোনের ওপাশে পিএস যে দ্বিধার মধ্যে আছে সেটা বুঝতে পেলো।
“একেই আমরা খুঁজছিলাম!” আস্তে করে বললো আশেক মাহমুদ।
আসলাম যারপরনাই অবাক হলো। এই মেয়েটাই মুশকান জুবেরি? কিন্তু ঐ ডাইনির ছবি সে দেখেছে, সেই ছবির সাথে কোনোভাবেই এই মেয়ের চেহারার মিল নেই!
“প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা পাল্টে ফেলেছে। দেখা হলে সব বলবো…লম্বা ঘটনা।” পিএস আর কিছু না বলে কলটা কেটে দিলো।
পকেটে ফোন রেখে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো আসলাম। ভুরু কুঁচকে তাকালো বন্দীর দিকে। দেখে মনেই হচ্ছে না, এই হালকা-পলকা মেয়েটি খুনখারাবি করতে পারে, তা-ও আবার অনেকগুলো! তার বস্ হন্যে হয়ে যাকে খুঁজছে, এই হালকাপলকা মেয়েটাই মুশকান জুবেরি!
যতোটুকু তার কানে গেছে, তাতে করে ভিরমি খেয়েছে সে-মহিলা নাকি মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অঙ্গ খেয়ে নিজেকে চিরযৌবনা করে রেখেছে।
মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বন্দীর দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলে আসলাম। মেয়েটার ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ফতুয়ার প্রশ্বস্ত গলা দিয়ে মসৃণ পিঠের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। হালকা ঘামে ভিজে আছে ফর্সা ত্বক। ঝুটি করে বাধা চুলের কারণে পিঠটা উন্মুক্ত। আসলাম আস্তে করে তার মুখটা নামিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিলো।
মেয়েটা চমকে উঠলো একটু। সে বুঝতে পারছে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে, কিন্তু মুখ বেঁধে রাখার কারণে কিছুই বলতে পারছে না। আবারো ঘ্রাণটা নিলো স্ত্রীহত্যার দায়ে চাকরিচ্যুত সাবেক এসআই মাহবুব আসলাম। বন্দীর ঝুটি করা চুলের কাছে নাক নিলো সে। মেয়েটা বুঝতে পেরে মাথা সামান্য সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতেই বামহাত দিয়ে তার থুতনীটা ধরে নিজের নাকের খুব কাছে নিয়ে এলো। বেয়াড়া মেয়েমানুষ তাকে অন্যরকম আনন্দ দেয়! আর এই মেয়েটা মুশকান জুবেরি জানার পর তার মধ্যে অন্য রকম উত্তেজনা তৈরি হয়েছে!
চাপা গোঙানি দিলো মেয়েটি। সম্ভবত গালাগালি করছে। মাথাটা সরানোর অনেক চেষ্টা করলেও আসলামের শক্ত হাতের সাথে পেরে উঠছে না। বুকভরে চুলের গন্ধটা নিলো সে। সুগন্ধীটা বেশ ভালো কিন্তু মনীষার মতো নয়। ঐ মেয়ে কী সব ভেষজ সুগন্ধী মাখতো চুলে, মুখে, শরীরে। পাহাড়ে ওসব জিনিস পাওয়া যায়।
বন্দীকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আস্তে করে মেয়েটার চোখ আর মুখের বাধন খুলে দিলো সে।
“ইউ পারভার্ট!” রেগেমেগে বললো সুস্মিতা। দম ফুরিয়ে হাপাচ্ছে। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে আসলামের দিকে। “আমার ধারেকাছেও আসবি না! আই উইল কিল ইউ!” চিৎকার করেই বললো কথাটা।
কিন্তু আসলাম তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্বিকার চেয়ে রইলো। পারভার্ট সে ছিলো না কখনও, যদি না সোমাকে হত্যা করার মতো ভুল সিদ্ধান্তটা নিতো। যদি না, এসব ঘটনা জানাজানি হতো। যদি না, সব জানাজানি হবার পর মনীষা তাকে ছেড়ে চলে যেতো!
মুচকি হাসলো গানম্যান। “তোর আর আমার মধ্যে একটা মিল আছে। কিন্তু!”
কথাটা শুনে বন্দীর কপালে ভাঁজ পড়লো।
“আমরা দুজনেই মানুষ খুন করেছি!”
বিস্ময়ে চেয়ে রইলো সুস্মিতা। এ কথা এই স্কাউন্ট্রেলটা জানলে কী করে! মনে মনে বলে উঠলো সে।