৬০. ভূমি পূজা
ভূমি পূজা দেখলাম, যেমন কাবা পরিক্রমণ দেখি, মিনা শহরের দেওয়ালে শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোড়া দেখি, সেন্ট প্যাট্রিক ডে’র প্যারেড দেখি, গির্জার সারমন দেখি, পুরোনো জেরুজালেম শহরের ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইহুদিদের মাথা ঠোকা দেখি। ওইসবে অংশগ্রহণ আমার কাজ নয়, অবলোকন আমার কাজ। রাম মন্দির তৈরি হচ্ছে বলে আমি শোক করছি না, সুখও করছি না। ভারতের হিন্দুদের অধিকাংশই চাইছে রাম মন্দির তৈরি হোক, সুতরাং তৈরি হোক। দুনিয়াতে একেশ্বরবাদের ভিড়ে এবং আধিপত্যে এখনও একটি প্রাচীন বহুঈশ্বরবাদ নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে টিকে আছে। টিকে থাকা একটা চ্যালেঞ্জ বটে। টিকে থাকুক।
ইতিহাস জুড়ে কত যে গির্জাকে মসজিদ করা হয়েছে, ফের মসজিদকে গির্জা করা হয়েছে, কত যে সিনেগগকে মসজিদ করা হয়েছে, আবার মসজিদকে সিনেগগ। কত যে হিন্দুর, আর জোরোস্ত্রিয়ানদের মন্দিরকে ভেঙে মসজিদ করা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কাবাই তো ছিল মক্কার বহুঈশ্বরবাদীদের মন্দির। শেষ নবী মুহম্মদ সেই মন্দিরের ৩৬০টি দেব দেবীর মূর্তি ভেঙ্গে কাবা দখল করে নেন। যে-ই ক্ষমতা দখল করেছে কোনও অঞ্চলের, সে-ই সেই অঞ্চলে তার বিশ্বাসের ইমারত নির্মাণ করেছে। কোথায় এখন অলিম্পিয়া পর্বতের সেই দেবতারা, কোথায় শক্তিশালী রোমান ঈশ্বরেরা! কোথায় মিশরের দেবদেবী? সবই বিলুপ্ত। এক ধর্ম সরিয়ে আরেক ধর্ম এসেছে, এক ধর্মের উপাসনালয় আরেক ধর্মের উপাসনালয়ে পরিণত হয়েছে। স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চল দখল করার পর গির্জাগুলোকে মসজিদ বানিয়েছিল মুসলমান শাসকেরা। কয়েক শতক পর মুসলমানরা যুদ্ধে পরাজিত হলে মসজিদগুলোকে ফের গির্জা বানিয়েছে স্পেনের খ্রিস্টান শাসক। এভাবেই চলছে জগৎ। কোনও একদিন রোবটেরা যদি দখল করে নেয় পৃথিবী, বা কোনও এলিয়েন, তাহলে আমাদের মন্দির মসজিদ, গির্জা প্যাগোডা, সিনেগগ গুরুদুয়ারাকে কী বানাবে ওরা কে জানে, হয়তো নাটবল্টুর ওয়্যারহাউজ।
ভারতের হিন্দুরা এখন যদি মুসলমানরা যেমন পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ গড়ে তোলে, তেমন মন্দির গড়ে তোলে পাড়ায় পাড়ায়, তাহলে আপত্তি করার তো কিছু নেই! মুসলমানদের মতো আপাদমস্তক ধার্মিক এমনকি ধর্মান্ধ হওয়ার অধিকার তাদেরও আছে। হিন্দু হলে সেক্যুলার হতে হবে, কে দিব্যি দিয়েছে! আসলে সেক্যুলার নামধারী যারা আছে ভারতবর্ষে, তারা হিন্দু মুসলমান যে-ধর্মেরই হোক না কেন, ধর্মে তাদের গভীর বিশ্বাস। এদেশে নাস্তিক খুব চোখে পড়ে না।
ইসলাম ধর্ম যেমন শেখায় বিধর্মীদের কাছ থেকে দূরে থাকতে, অবিশ্বাসী আর অমুসলিমদের পেছন থেকে হাত পা কেটে ফেলতে, তেমন শিক্ষা হিন্দু ধর্মের লোকেরা তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে পায় না। তেমন শিক্ষা বাইবেল থেকেও ইহুদি আর খ্রিস্টানরা পায় না। তেমন শিক্ষা বৌদ্ধরাও তাদের ত্রিপিটক থেকে পায় না। এখন যদি হিন্দুরা বিধর্মীদের বা অহিন্দুদের ধরে ধরে হত্যা করে, তাহলে বুঝতে হবে তারা তাদের ধর্মের শিক্ষার বাইরে গিয়ে হত্যা করছে। তারা মুসলমানের ধর্মগ্রন্থকে নিজের ধর্মগ্রন্থ ভাবছে, তারা ইসলাম থেকে প্রেরণা পাচ্ছে, বা মুসলিম সন্ত্রাসীদের তারা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করছে।
হিন্দুরা নিজ ধর্মে ডুবে থাকতে চাইলে ডুবে থাক। এভাবেই বিরুদ্ধ স্রোতে ধর্মকে তারা বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সাচ্চা হিন্দু হওয়া জরুরি, সাচ্চা মুসলমান নয়। এই উপমহাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া সহজ নয়। এখানে বিজ্ঞানীরাও বিজ্ঞানমনস্ক নয়। এখানে সাচ্চা কমিউনিস্টরাই সাচ্চা ধার্মিক। আপাতত ভায়োলেন্স আর ঘৃণাকে সমস্ত মনোবল দিয়ে দূরে রাখুক। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খিস্টান সকলে। যদি ভারতবর্ষ একদিন হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে ওঠে, তাহলেও যেন মুসলমানদের রাষ্ট্রের মতো সেই রাষ্ট্র না হয়, যেন নানা গোষ্ঠীর নানা বর্ণের নানা জাতের নানা মতের নানা বিশ্বাসের নানা ধর্মের নানা সংস্কৃতির সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থানে সমৃদ্ধ হয় সেই রাষ্ট্র।
৬ ১. ফ্যাক ফ্যাক
আমি লক্ষ করেছি আমি যখন করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাই, তখন কিছু ধার্মিক লোক ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে আর বলে, নাস্তিক হয়েও মৃত্যুকে ভয় পায়। যেন তরবারির সামনে গিয়ে বুক পেতে দেওয়াই নাস্তিকদের জন্য সঠিক কাজ। আরে বাবা, নাস্তিক বলেই তো জীবন বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করি, কারণ নাস্তিক বলেই জানি পরকাল আর পুনর্জন্ম বলে কিছু নেই, জীবন একটাই, জীবন যেহেতু একটাই জীবন খুব মূল্যবান, মৃত্যুকে যত বাধা দেওয়া যায় তত ভালো কারণ মৃত্যুতেই ঘটে মূল্যবান জীবনটির সমাপ্তি।
যারা পরকালে আর পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে, মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই তাদের, কারণ তারা বিশ্বাস করে মরে গেলেও আবার তারা একদিন ঠিকই বেঁচে উঠবে। ধার্মিকদের কাছে ইহকালের চেয়ে পরকালের মূল্য বেশি, তাই তারা ইহকালে হেন মন্দ কাজ নেই যে করে না। ইহকালের পাপের শাস্তি পরকালে পেতে হবে বলে তাদের খুব একটা ভয় থাকার কারণও নেই। কারণ ইহকালে যত রকম অন্যায় আছে ক’রে একসময় আকাশে বসে থাকা ওপরওয়ালার গুণগান গেয়ে তার কাছে ক্ষমা টমা চেয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পারার সুযোগ তাদের আছে।
নাস্তিকদের মধ্যে বদ লোক যে একেবারে নেই তা নয়। তারাও বদ কর্ম করে আস্তিকদের মতো। তবে নাস্তিকদের মধ্যে যারা ভালো কাজ করে, তারা পরকালে পুরস্কার পাওয়ার জন্য ভালো কাজ করে না। তবে আস্তিকরা যারা ভালো কাজ করে সবই কিন্তু পুণ্যের লোভে, পরজন্মে বা পরকালে রিওয়ার্ড পাওয়ার আশায়। এই পার্থক্যটা বোঝা কিন্তু জরুরি। একজন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালো কাজ করছে, আরেকজন স্বার্থের জন্য করছে।
৬২. বিশ্বাস
অনেকে বিশ্বাস করে হনুমান কাঁধে করে গোটা গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে এসেছিল, মুসার আদেশে সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল, যীশু সমুদ্রের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, মুহম্মদ ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে আকাশে উড়ে গিয়ে বেহেস্ত আর দোযখ দেখে এসেছিলেন, আল্লাহর সঙ্গেও বাৎচিত হয়েছিল তাঁর।
বিশ্বাস একটা অদ্ভুত জিনিস। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জজ ব্যারিস্টার হলেই যে অলৌকিকতা থেকে বিশ্বাস চলে যাবে, তা কিন্তু নয়।
ছোটরা রূপকথা পড়ে ভালোবেসে, বড়রা রূপকথা পড়ে ভয়ে। আমি ছোটদের রূপকথায় বিশ্বাসী, কারণ ওই রূপকথা হার্মলেস।
৬৩. কাঁদা
আমি কাঁদলে লোকে বলে, কাঁদা নাকি আমাকে মানায় না। কেন মানায় না? আমি স্ট্রং, তাই। স্ট্রং হলে দুঃখে কষ্টে কাঁদতে নেই, এই ধারণা থেকেই মানুষ পুরুষলোক কাঁদছে এই দৃশ্য দেখতে চায় না। ছিঃ ছিঃ, পুরুষ হয়ে মেয়েদের মতো কাঁদছে কেন! স্ট্রং মেয়েরা, জীবনে যা কিছুই ঘটুক, কাঁদবে না। কাঁদলে তাকে আর স্ট্রং মনে হয় না। আর পুরুষ মাত্রই, যেহেতু বিশ্বাস করা হয়, সবাই স্ট্রং। তাই কোনও পুরুষ কাঁদলে তাকে আর ‘পুরুষ’ বলে মনে হয় না। কাঁদাটা কাদের জন্য? নরম কোমল সেন্সিটিভ মেয়েদের জন্য।
দুঃখে কষ্টে যন্ত্রণায় বেদনায় কোমল এবং কঠিন মানুষ কাঁদে, লিঙ্গ নির্বিশেষে কাঁদে, কাঁদাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই ছেলেরা না কাঁদতে শেখে। বাবা মারা শেখায়। ছেলে হয়ে জন্ম নিলে নাকি কাঁদতে হয় না।
যারা কাঁদে না, তাদের আমার খুব ভয়ংকর মানুষ বলে মনে হয়। আবেগ কি পুরুষের নেই? নিশ্চয়ই আছে। যে আবেগ থেকে রাগ ঘৃণা প্রতিশোধস্পৃহা, হাসি খুশি আনন্দ ইত্যাদি উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়, সে আবেগ থেকেই তো মানবিক ক্রন্দন উঠে আসার কথা।
অন্যের জন্য কাঁদার মতো সুন্দর কী আছে জগতে! মুসলমানেরা দেখলাম কাঁদার বিরুদ্ধে। আমার মা যখন মারা গেল, লক্ষ্য করলাম, যারা মা’কে হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল, তাদের থামিয়ে দিল কিছু সাচ্চা মুসলমান। তাদের ভাষ্য, ‘আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন, আল্লাহ এখন নিয়ে যাচ্ছেন। শব্দ করে কাঁদলে আল্লাহ নারাজ হবেন, যদি নিতান্তই কাঁদতে হয়, নীরবে কিছুটা চোখের জল ফেলো, ব্যস’।
ধর্মের নামে, পুরুষতন্ত্রের নামে, মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের মতো গুণগুলোকে বিদেয় করার চেষ্টা চলছে, মানুষকে পাথর বানাবার চেষ্টা চলছে। যে যত পাথর সে তত পুরুষ সে তত স্ট্রং! যুক্তিবাদীদের কাঁদতে নেই কে বললো! আবেগে কাঁদার পর মানুষের ব্যাথা বেদনা কম হয়, টেনশান কমে, মন ভালো হয়, চোখের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। যুক্তিবাদীরা এই বেনেফিটটা বোকার মতো হারাবে কেন?
আমি যখন মা’কে নিয়ে আমার ‘নেই কিছু নেই’ বইটি লিখছিলাম, লেখার সময় আমি প্রতিদিন মা’র জন্য কাঁদতাম, মা’র না থাকার কষ্টে কাঁদতাম। বইটি লেখার পর আমার কী যে ভালো লেগেছে তা বোঝাতে পারবো না। কান্না আমাকে সেই ভালো লাগা, সেই প্রশান্তি দিয়েছে।
৬৪. মনুষ্যত্ব
খুব খুব খুবই ভালো ফিল্ম না হলে আমি দেড় দু’ঘণ্টা সময় নষ্ট করি না। বাংলা আর হিন্দি ফিল্ম দেখতাম কিশোর বয়সে, পৃথিবীর ভালো ফিল্মের স্বাদ পেয়ে যাওয়ার পর খুব বেছে ছবি দেখি। বাংলা হিন্দি একেবারেই দেখা হয় না এখন তা নয়, দেখা হয়, যদি খুব খুব ভালো হয় সেসব। ‘দিল বেচারা’ আমার দেখার কথা নয়। সাধারণ মানের ছবি এটি। কিন্তু দেখলাম সুশান্ত সিং রাজপুতের জন্য। প্রচণ্ড প্রতিভাধর একজন শিল্পীর চলে যাওয়া, তাও আবার আত্মহত্যা করে, খুব স্বাভাবিক, কষ্ট দেয়। দিল বেচারাতেও সুশান্ত প্রমাণ করেছেন স্ক্রিপ্ট যেমনই হোক, ছবি যে মানেরই হোক, উনি খুব বলিষ্ঠ অভিনেতা। ইমানুয়েল রাজকুমার জুনিওরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুশান্ত। যখন ইমানুয়েল মারা যায়, চোখে আমার জল জমে একাকার। আমি বুঝিনি এই জল কি ছবির ইমানুয়েল চরিত্রটির মরে যাওয়ার কারণে, নাকি ওই চরিত্রে অভিনয় করা বাস্তবের সুশান্ত সিং রাজপুতের মরে যাওয়ার কারণে!
ক্যান্সার রোগটি আমার ফ্যামিলিতে। আমার মা, দাদা, মামা, কাকা সব ক্যান্সারে গেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কোনও ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের কথা শুনলে বা পড়লে সে ফিকশান হলেও, এমনকি পর্দায় তাদের দেখলেও, সে ফিচার ফিল্ম হলেও, অভিনয় হলেও, চোখ আমার ভিজে ওঠে। জানি সবাই আমরা মরে যাবো, তারপরও প্রিয়জনদের তো বটেও অন্য কারোর অকাল মৃত্যুই, এমন কী অচেনা কারোর, মেনে নিতে কষ্ট হয়। আমরা তো এখন মৃত্যুপুরীতে বাস করছি। প্রতিদিন খবর আসছে মৃত্যুর। মৃত্যু দেখতে দেখতে আমাদের তো অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। আমি কেন এখনও অভ্যস্ত হচ্ছি না বুঝি না! এখনও আমার দিল বেচারা বেদনার দৃশ্য দেখলে ককিয়ে ওঠে। মানুষের জন্য মানুষের এই অনুভূতি, এর নামই হয়তো মনুষ্যত্ব। এই মনুষ্যত্ব বাদ দিলে মানুষ নামক প্রাণীর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
৬৫. আত্মা
কোনও এক স্টিভ হাফ দাবি করছেন তিনি নাকি সুশান্ত সিং রাজপুতের ‘আত্মা’র সঙ্গে কথা বলেছেন। ভিডিওও পোস্ট করেছেন দুখানা। মানুষ তো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, বিশ্বাসও করছে আজগুবি কথোপকথন। কবে যে বিজ্ঞানমনস্ক হবে মানুষ, কবে যে ভূত প্রেত, আত্মা ফাত্মা ইত্যাদির যে অস্তিত্ব নেই বুঝবে। হয়তো এমনই হওয়ার। কিছু লোক বুঝবে, কিছু লোক বুঝবে না, হয়তো কেউ পরে বুঝবে, কেউ আবার কোনওদিনই বুঝবে না। মানুষ সব এক নয়। কমিউনিজম সব মানুষকে এক করতে চেয়েছিল, যাদের আছে তারা দেবে, যাদের নেই, তারা খাবে। এতে কিছু লোক রাজি হলেও সব লোক রাজি হয়নি। সব লোক সব কিছুতে এক মত হয় না। এই ভয়ংকর করোনার দুর্দিনে যখন প্রাণে বাঁচার জন্য মাস্ক পরা সবার জন্য অত্যন্ত জরুরি, তখন কিছু লোক রাস্তায় নেমেছে মাস্ক পরবে না ঘোষণা দিয়ে। মানুষ চাঁদে গেলেও কিছু মানুষ থাকে বিশ্বাস না করার যে মানুষ চাঁদে গিয়েছে। আকাশে কোনও ঈশ্বর বসে আছে, এর প্রমাণ আজও মেলেনি। তারপরও ঈশ্বরে বিশ্বাসী মানুষের অভাব নেই। কোনও পুনর্জন্ম নেই, কোনও পরকাল নেই। মানুষকে কেউ সৃষ্টি করেনি—বহু আগেই বিবর্তন তত্ত্ব তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তারপরও কিছু মানুষ বিশ্বাস করবেই এসব। ভূত পেতনি, আত্মা—এসব মানুষের কল্পনা থেকে রচিত। আর এগুলোকে সত্যি বলে মেনে এই বিজ্ঞানের যুগেও মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে ‘আত্মা’র কথা শুনতে। এরা আছে বলেই স্টিভ হাফের মতো লোক-ঠকানোর ব্যবসায়ীরা করে খাচ্ছে। পৃথিবী এমনই, বিজ্ঞান আর অবিজ্ঞানের, সংস্কার আর কুসংস্কারের, বুদ্ধিমান আর মূর্খের, সত্য আর মিথ্যের, যুক্তি আর বিশ্বাসের মিশেল।
৬৬. প্লাজমা
প্লাজমা বিক্রি হচ্ছে লাখ টাকায়। চার লাখ, পাঁচ লাখ। হাসপাতালের আইসিইউতে কোনও রোগীকে বাঁচানোর জন্য প্লাজমা দরকার। কোথায় করোনা থেকে সুস্থ হওয়া লোকেরা নিজের প্লাজমা দান করতে হাজির হবে, না, তারা প্লাজমার বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা হাঁকছে। টাকাটা না দিতে পারলে রোগী মারা যাবে। এতে এন্টিবডিতে ভরপুর এমন প্লাজমা নিয়ে যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার কিছু যায় আসে না। মানুষ মরে গেলে মরে যাক। তার টাকা চাই। টাকা টাকা টাকা। পৃথিবীতে মানুষের ভবিষ্যৎ যত অন্ধকার হচ্ছে, যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, তত সেই ভবিষ্যতে সুখভোগের জন্য ধন দৌলত জড়ো করছে মানুষ। যে গরিব লোকটি প্লাজমা দান করবে, তাকে বিত্তবানদের সাহায্য করা দরকার। কিন্তু জীবন নিয়ে বেচাকেনা বন্ধ হোক। আমার ভয় হয় করোনার ভ্যাক্সিন এলেও কেউ কেউ গুদামজাত করবে ভ্যাক্সিন, তারপর আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি করবে। ৭.৮ বিলিয়ন লোক এই পৃথিবীতে। সবার জন্য ভ্যাক্সিন তৈরি করতে কমপক্ষে তিন বছর লাগবে। এই তিন বছরে কি নকল ভ্যাক্সিন বের হবে না? মানুষের চরিত্র সম্পর্কে যতটা ধারণা পেয়েছি, তাতে মনে হয় বের হবে। একেবারে দেখতে আসল টিকার মতো। মানুষ ভুল করে কিনবে, টিকা নেবে, বিশ্বাস করবে সে এখন নিরাপদ, আসলে নয়, যে কোনও সময় করোনায় আক্রান্ত হবে।
দুর্যোগের সময়, আকালের সময়, মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়, এ কথা আমি আগে বিশ্বাস করতাম, এখন আর করি না। মানুষের চরিত্রের যে মন্দ দিক, তা যেন তখন আরও উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসে।
পৃথিবীর সব দেশেই ইউনিভার্সাল ভ্যাক্সিনেশান প্রোগ্রাম আছে। প্রতিটি দেশের সরকারই বিনামূল্যে জনগণকে ভ্যাক্সিন দেয়। রোগশোক দূর করার জন্য, মানুষকে বাঁচাবার জন্য। সরকারের হাতের বাইরে যেন করোনার ভ্যাক্সিন চলে না যায়। তাহলে মহা বিপদ।
৬৭. সেনা
বাংলাদেশে চৌধুরি হাসান সারোয়ার্দি নামে এক লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে সেনানিবাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ, বলা হয়েছে, ১। একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, ২। স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছে। ৩। ডিভোর্সের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। তবে বিয়ের আগে সেই নারীর সঙ্গে মেলামেশা করেছে, এমনকি তাকে নিয়ে বিদেশে বেড়াতে গিয়েছে। ৪। যাকে বিয়ে করেছে, সে এক বিতর্কিত নারী।
সেনাবাহিনী জিনিসটা আমি পছন্দ করি না। অস্ত্রটস্ত্র আমার একেবারেই ভালো লাগে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর লোকদের তো করার কিছু নেই, ক্যু করা ছাড়া আর বসে বসে সস্তায় খাওয়া ছাড়া আর বোকা-সুন্দরীদের বিয়ে করা ছাড়া। এই লেঃ জেনারেলকে কোনও কারণে অন্য সেনাদের পছন্দ নয়, তাঁকে তাই লাথি মেরে তাড়িয়েছে। কিন্তু যে কারণগুলো বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, তা যদি সত্যি হয় তবে সত্যিই চিন্তার বিষয়। চিন্তার বিষয় এই জন্য যে, এগুলো অতি স্বাভাবিক ঘটনা, এগুলো কোনও অন্যায় নয়, কোনও অপরাধও নয়। সবারই অধিকার আছে ডিভোর্স করার, প্রেম করার, প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর, পুনরায় বিয়ে করার, যাকে খুশি তাকে বিয়ে করার। লক্ষ্য করেছি বিবৃতিতে যত না ঘৃণা প্রকাশ হয়েছে লেঃ জেনারলের প্রতি, তার চেয়ে বেশি উনি যে নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন, তাদের প্রতি।
দেশটা মানুষ হল না।
৬৮. মাস্ক
যারা মাস্ক পরছে, তারা অনেকে মনে করে তারা বোধহয় নিজেকে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা করার জন্য মাস্ক পরছে। আসলে মাস্ক কিন্তু অন্যকে রক্ষা করার জন্য, নিজেকে নয়। যারা করোনায় আক্রান্ত, উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, তারাই যেহেতু ভাইরাস ছড়ায়, তারা ঠিকঠাক অর্থাৎ কোনও ফাঁক টাক না রেখে মাস্ক পরলে তাদের হাঁচি কাশি কথা আর নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে বড় এবং ছোট ড্রপলেট বেরোবে, তা ছুটে বেরোতে পারবে না, মাস্কে অনেকটাই আটকা পড়বে। ড্রপলেটগুলোই যেহেতু ভাইরাস বহন করে, ড্রপলেট না বেরোলে অন্যরা ভাইরাস থেকে বাঁচবে।
কেন মাস্ক অন্যকে রক্ষা করার জন্য, নিজেকে রক্ষা করার জন্য নয়? কারণ বাতাসে ভাসা ছোট ড্রপলেটগুলো নিজের সার্জিক্যাল মাস্ক বা কাপড়ের মাস্ক দিয়ে ঠেকানো যায় না। নিজেকে অন্যের মুখ থেকে বেরোনো ছোট ড্রপলেটে চড়ে যে ভাইরাস আসে, তা থেকে রক্ষা করতে গেলে এন৯৫ রেস্পিরেটর পরতে হয়। এই রেস্পিরেটর ল্যাবে যে বিজ্ঞানীরা ভাইরাস নিয়ে কাজ করছেন, যে ডাক্তাররা সারাক্ষণ হাসপাতালে করোনা রোগীদের মধ্যে কাটাচ্ছেন তাঁদের জন্য দরকার। তাঁরা এন৯৫ ব্যবহারের নিয়ম কানুন জানেন। এই রেস্পিরেটর কখন পরতে হয়, কীভাবে পরতে হয়, রেস্পিরেটরের কোথায় স্পর্শ করা যায়, কোথায় যায় না, কীভাবে একে ফেলতে হয় তাঁরা জানেন। সাধারণ মানুষ এন৯৫ রেস্পিরেটর ব্যবহার করলে বিপদে পড়তে পারেন। কারণ অনেক সময় এই রেস্পিরেটরই শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রেস্পিরেটর, সার্জিক্যাল মাস্ক এগুলো কিন্তু একবার ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয়। প্রশ্ন হল, কেন মাত্র একবার ব্যবহার, কেন বারবার নয়। একবার ব্যবহার করার পর মুখের ব্যাক্টেরিয়াগুলো বের হয় মাস্কে জমা হয়, নিজের ঘামের সঙ্গে মিশে, ব্যাক্টেরিয়াগুলো সংখ্যায় বাড়তে থাকে। আবার সেটি পরলে ব্যাক্টেরিয়ার স্তূপ মুখে ঢুকে শ্বাসনালীতে চলে গিয়ে ইনফেকশান ঘটায়। সার্জিক্যাল মাস্ক ধোয়ার জন্য নয়। কিন্তু কাপড়ের মাস্ক ধুয়ে পরিষ্কার করে বারবার পরা যায়। যারা কাপড়ের মাস্ক পরেন, তাদের প্রতিদিন সাবান দিয়ে সেটি ধুয়ে শুকিয়ে তারপর কিন্তু পরতে হবে, এতে মুখের ব্যাক্টেরিয়াগুলো কাপড় থেকে দূর হবে।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয় কেন? বলা হয় কারণ করোনা আক্রান্ত কারও মুখের মাস্কে যে ছোট ড্রপলেটগুলো আটকা পড়ে না, তারা অনেকটা দূর পর্যন্ত ভেসে যেতে পারে। আগে বলা হত ৬ ফুট, দেখা গেছে তার চেয়েও বেশি দূর ভাইরাস যায়। কতক্ষণ বাতাসে থাকে ভাইরাস? ১৬ ঘণ্টা। এইজন্যই এই করোনা ভাইরাসকে বায়ু বাহিত বলা হচ্ছে। বায়ু বাহিত বলেই এই ভাইরাস এমন ভয়ানক সংক্রামক।
আমরা কেন বাইরে থাকা আসা সবকিছু ধুয়ে নিই? ধুয়ে নিই, কারণ জিনিসপত্রের গায়ে মানুষের মুখ থেকে বড় ড্রপলেট ছিটকে পড়তে পারে। যাদের শরীরে করোনা আছে, তাদের ড্রপলেটে থাকবে ভাইরাস। বড় ড্রপলেটে ২০,০০০ পর্যন্ত ভাইরাস থাকতে পারে। ছোট ড্রপলেট যেগুলো বাতাসে ভাসে, সেগুলোয় কম থাকে ভাইরাসের সংখ্যা। বড় ড্রপলেটগুলো বাতাসে ওড়ে না, তারা শুধু কোনও কিছুর গায়ে সেঁটে থাকে। সেইজন্যই সাবান দিয়ে সবকিছু ধুয়ে নিই। হাতও সে কারণে ধুই।
সবাই যদি হাত ধুয়ে বড় ড্রপলেটের ভাইরাসগুলো হাত থেকে দূর করতো, সবাই যদি ঠিকঠাক মাস্ক পরে বাইরে বেরোতো, একে অপরের কাছ থেকে অন্তত ১২ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলতো, তাহলেই কারও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকতো না। কেউ আক্রান্ত না হলে ভাইরাসকে একদিন বিদেয় নিতে হত। ভ্যাক্সিনেরও হয়তো দরকার পড়তো না।
৬৯. বন্দিত্ব
চার মাস বাড়ির বাইরে পা ফেলিনি। মানুষের মুখোমুখি হইনি চার মাস। কাটাচ্ছি কিডনি নষ্ট হতে থাকা ১৬ বছর বয়সী একটি বেড়ালের সঙ্গে। অনলাইন শপ থেকে চাল ডাল আনাজপাতি আসে, পাড়ার মাছের বাজার থেকে মাছ আসে। যারা দিতে আসে, তারা ওসব সদর দরজার বাইরে রেখে চলে যায়। আমি একসময় ভেতরে ঢুকিয়ে নিই। ভাইরাস কতই হয়তো ঢুকেছে বাড়িতে। এখনও কণ্ঠদেশের নাগাল পায়নি। যদি দেখতে পেতাম বাড়ির কোথায় কোথায় এরা কিলবিল করছে! মুশকিল এটাই, এদের খালি চোখে দেখা যায় না। এদের সামনে কী ভীষণ অসহায় আমরা। অদৃশ্য শত্রু আমাদের।
কেউ কেউ বলে করোনার দুর্যোগ জুড়ে অঢেল সময় পেয়েছো, একটা উপন্যাস লিখে ফেলো। আমাদের বাঙালি লেখকদের তো কেউ কেউ ২০০/৩০০ উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। এত উপন্যাস অন্য কোনও ভাষার লেখকরা লেখেন বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, লিও টলস্টয় তো মাত্র ৩টে উপন্যাস লিখেছেন, তাঁকে কি লোকেরা বলতো, লিও আরও কিছু উপন্যাস লিখুন? আলবেয়ার কাম্যুকে কি বলতো, শুধু ৫টা উপন্যাস লিখলে চলবে, আরও কিছু লেখো। ছোট লেখকদের হয়তো প্রচুর লিখতে হয়, বড় লেখকদের কম লিখলেও চলে। অবশ্য শেক্সপিয়ার প্রচুর লিখেছিলেন। তাঁর মতো বড় কবি আর কে আছেন!
আমি বরাবরই ফিকশানের চেয়ে নন-ফিকশান লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। পৃথিবীতে সত্যিকার যেসব ঘটনা ঘটছে সেসব তো ফিকশানের চেয়ে রোমহর্ষক, এবং অবিশ্বাস্য।