ত্রিপুরার বাংলাদেশ হাসপাতালের ডাক্তার ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, বীর প্রতীকএর নিজের কথা।
১৯৬১ সালের কথা। তখন আমি হলিক্রস কলেজের ছাত্রী। প্রচুর খেলাধুলা করতাম। ডাক্তার হওয়ার পর ৬ মাস ইন্টার্নিশিপ করে আর্মিতে ১৯৬১ সালের জুন-জুলাই মাসে যোগদান করি। কারণ, আমার বড় ভাইও ছিলেন। আমিতে। ১৯৬১ সালে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত একজন লেফটেনেন্ট-এর পদে ছিলাম। ১৯৬১-এ শেষের দিকে জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে আমার পদোন্নতি ঘটে— আমি ক্যাপ্টেন হই। বড় ভাই হায়দার সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন। ছোট ভাই এ টি এম সাফদার (জিতু) মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিভিন্ন খবর এবং গোপনবার্তা পৌঁছে দেবার কাজে নিয়োজিত ছিল।
১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে আমি ছিলাম কুমিল্লায়। বড় ভাই মেজর হায়দার পিণ্ডির চেরাট থেকে এই সময় বদলি হয়ে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে চলে আসেন। যদ্দুর মনে পড়ে তারিখটা ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি, রোজার দিন। দুভাইবোন কিশোরগঞ্জে বেড়াতে এসেছি। আমার ছুটি ছিল ১ মাস আর বড় ভাই হায়দারের ছুটি ছিল ২ সপ্তাহের। তিনি কুমিল্লায় ফিরে গেলেন একমাস পর ছুটি শেষ হবার আগেই। আর তখুনি শুরু হয়ে গেল দেশে রাজনৈতিক সজঘাতজনিত আলোড়ন।
মার্চের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি ঢাকায় ফিরে আসি। বড় ভাই তখন ক্যান্টনমেন্টে। আমার এক ফুপার বাসায় এসে তিনি লুকিয়ে-ছুপিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁর কথা মতো, ছুটির পর সেনাবাহিনীতে আবার যোগ দিয়ে কিশোরগঞ্জে বাসায় ফিরে আসি। কিন্তু যেদিন কিশোরগঞ্জ ক্টেশনে air-raid হলো, সেদিনই আমরা পালালাম। মামার শ্বশুরবাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে ৩ মাইল দূরে ছিল। চলে গেলাম। সেখানেই। এক সপ্তাহ থাকার পর আবার কিশোরগঞ্জে ফিরে এলাম। ক্যাপ্টেন নাসের এবং বড় ভাই হায়দার ময়মনসিংহের দুটো ব্রিজ উড়িয়ে দিতে এখানে এলেন। এই সময় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হেড কোয়ার্টার্স থেকে ২/৩টা টেলিগ্রাম এলো জয়েন করার জন্য চাপ দিয়ে। আকাবাই এগুলোর উত্তর দিতেন এই লিখে–she is sick, অর্থাৎ আমি অসুস্থ।
এক সপ্তাহ কিশোরগঞ্জে থাকার পর মিলিটারি আসার মাত্র দুদিন আগে দশ-বারো মাইল উত্তরে হোসেনপুরে আম্মার নানার বাড়ি পালিয়ে গেলাম। ওখানে থাকার সময় বড় ভাইয়ের খবর পেতাম। লোক মুখে শুনতাম, তিনি আগরতলায় আছেন, ট্রেনিং দিচ্ছেন। বিশ্বাস করতাম না। কিশোরগঞ্জে সেই তখন আমার বড় ভাই ও আকবার নামে কাগজে বেরুত যে, তাদেরকে ধরে দিলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। জুলাইয়ের শেষের দিকে বড় ভাই একজন মুক্তিবাহিনীর সদস্যকে আমাদের কাছে পাঠালেন বাবা-মাকে পাকবাহিনী মেরে ফেলেছে–এই খবর পেয়ে। তিনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন খবরটার সঠিকতা সম্পর্কে।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে একটানা আট-দশদিন নৌকায় চেপে কিশোরগঞ্জের গোজদিয়া ঘাটি হয়ে মেঘালয় পৌঁছলাম। তারপর সিলেটের টেকেরহাটে ছিলাম এক সপ্তাহ। এরই মধ্যে বড় ভাই কী করে যেন আমার খবর পেলেন, জানি না। সেখান থেকে ট্রারেন্স করে পৌঁছলাম শিলং-এ। পথে আকবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় শিলং-এ থাকলাম। ৪/৫ দিন। পরে গৌহাটি হয়ে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পৌঁছলাম মেলাঘরে। দুতিন সপ্তাহ পরে যোগ দিলাম। বাংলাদেশ হাসপাতালে।
আমি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিলাম। মেলাঘরের বাংলাদেশ হাসপাতালটি বাশের তৈরি ছিল এবং তাতে বেড ছিল চারশোর মতো। মেডিকেল কলেজের তিন-চারজন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সেখানে নিয়োজিত ছিলেন। লন্ডন থেকে মবিন এসেছিলেন, এসেছিলেন ডা. জাফরউল্লাহ, ডা. কিরণ সরকার দেবনাথ, ডা. ফারুক মাহমুদ, ডা. নাজিমুদ্দিন এবং ডা. মোর্শেদ। এদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দশ-বারো জন ভলান্টিয়ারও আমি থেকে এসেছিলেন। তবে সুবেদারের ওপরে কেউ ছিলেন না। কোনো ভারতীয় ডাক্তার আমাদের সাথে নিয়মিতভাবে থাকতেন না। তবে ওষুধের জন্য আগরতলা ও উদয়পুরে যেতে হতো। উদয়পুরের ডিসি মি. ব্যানার্জি, আগরতলা এড়ুকেশন বোর্ডের পরিচালক ডা. চ্যাটার্জি, ডা. মজুমদার এবং ডা. চক্রবর্তী ঐরা আমাদের প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।
আমাদের OT অর্থাৎ Operation Theatre ছিল প্লাস্টিক ক্লথ দিয়ে চারদিকে ঘের দেয়া একটা ঘর। এর মেঝেও আবৃত ছিল প্লাস্টিক ক্লথে। আমি ওখানে থাকার সময় কেবল দুজন রোগী ডায়রিয়া-ডিসেন্ট্রিতে মারা গিয়েছিল।
ভারতীয় আর্মিরও অনেক সৈন্য আসতো এখানে চিকিৎসার জন্য। আমি আগরতলা IA HOSPITAL-এ মাঝে-মধ্যে যেতাম। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকেও আমরা প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। আমাদের রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই থাকত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত।
একবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা ট্রাক রাস্তার খাদে উল্টে পড়ে গিয়েছিল। ট্রাকটি সেনা সদস্যে ছিল। ঠাসা। আহতদেরকে আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে এনে এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জেনারেল রবি-এর হেলিকপ্টারে গুলি লেগেছিল। তিনিও এখানে চিকিৎসা গ্ৰহণ করেছিলেন।
যখন হাসপাতালে ছিলাম, তখনো বড় ভাই হায়দারের সঙ্গে দেখা করতে পারতাম না। অধিকাংশ সময় অসম্ভব ব্যস্ত থাকতেন তিনি। মাঝে সাঝে দেখা হতো। আকবা-আৰ্ম্মা মেলাঘর ক্যাম্পের কাছেই একটা মাটির ঘর ভাড়া নিয়ে মেঝেতে প্লাস্টিক ব্যাগ বিছিয়ে দিনরাত যাপন করতেন। তাদের সাথেও ভাইয়া দেখা করার সময় পেতেন না।