টাঙ্গাইল শহর এখন সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত, সার্কিট হাউসের দখল নিয়েছেন মেজর জেনারেল নাগরা। আদালত ভবনের ঘরগুলোয় রাখা হয়েছে বন্দীদের, প্রতি ঘণ্টায় আরও বন্দীদের নিয়ে আসা হচ্ছে এখানে। পলাতক পাকিস্তানী বাহিনীর একটা দল লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তুরাগ নদীর পাড়ে। সেখানে তাদের মোকাবিলা করছে যৌথ মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ক্লের। জামালপুর ও মৈমনসিং-এ পাকিস্তানী দুর্গের পতন হয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে পাক সৈন্যরা যাতে পিছু হটে ঢাকায় গিয়ে রাজধানী রক্ষায় অংশ নিতে না পারে সেই দায়িত্ব নিয়েছেন মেজর জেনারেল। নাগরা। টাঙ্গাইল না পেরিয়ে ওদের ঢাকা যাবার কোনো উপায় নেই।
নাগরা শুধু একটা ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করছেন, তাঁকে এখানে একটা সভায় বক্তৃতা করতে হবে। তিনি একজন পেশাদার সৈনিক, বক্তৃতা করার অভ্যেস নেই তাঁর। তা ছাড়া, তিনি একটা ব্যাপারে চিন্তিত। ঢাকা অবরোধ প্রথম মুক্ত করবে কে? তাঁর ডিভিশন ১০১ কমুনিকেশান জোন-এর ওপর দায়িত্ব দেওয়া ছিল, ঢাকার উত্তরে টঙ্গী পর্যন্ত পৌঁছে অবস্থান নেওয়া। সেইজন্যই ট্যাঙ্ক ও ভারী ধরনের অস্ত্রশস্ত্র তাঁর বাহিনীতে বেশি নেই। মূল পরিকল্পনায় ছিল যে আখাউড়ার দিক থেকে এগিয়ে আসা মিত্রবাহিনীই ঢাকার ওপর আঘাত হানবে। যশোর, খুলনা, বগুড়া, রংপুরের দিক থেকেও ভারতীয় পদাতিক বাহিনী গোলন্দাজ ও ট্যাঙ্ক স্কোয়াড নিয়ে এগিয়ে আসছে। কিন্তু মেজর জেনারেল নাগরাই সবচেয়ে আগে এসে পৌচেছেন ঢাকার খুব কাছে। ছত্রীবাহিনী নামিয়ে টাঙ্গাইল যে এত দ্রুত দখল করা যাবে, আগে কেউ ভাবেনি। কাঁদেরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এখানকার অনেকগুলি ব্রীজ ভেঙে অনেকখানি পাকা সড়ক আগেই মুক্ত করে সুবিধে করে রেখেছিল। এখন মুক্তিবাহিনীর ছেলেরাও ঢাকা আক্রমণ করার জন্য ছটফট করছে।
এদিককার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকীর পেড়াপীড়িতে নাগরাকে সংবর্ধনা সভায় যেতেই হলো। বিন্দুবাসিনী স্কুলের মাঠে কয়েক লক্ষ মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। উল্লাসের চিৎকার আর জয়ধ্বনিতে কান পাতা দায়। বহু নারী-পুরুষ ছুটে এসে নাগরাকে মালা পরাতে লাগলো, মালার বোঝায় তাঁর নুয়ে পড়ার উপক্রম। শেষপর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা অন্যদের আটকে কোনোক্রমে মঞ্চে তুললো ভারতীয় সেনাপতিকে।
সেই বিশাল জনসমুদ্রের দিকে বেশ কয়েক মিনিট নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন নাগরা। যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, একটু কান পাতলে দুরে কামান গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়, মাঝে মাঝেই ভারতীয় বোমারু বিমান উড়ে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার দিকে। এরপর ঢাকার রক্তক্ষয়ী শেষ সংগ্রাম কতদিন চলবে, কত মানুষ মরবে তার ঠিক নেই, কিন্তু টাঙ্গাইলের মানুষ এরই মধ্যে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে গেছে।
প্রথমে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় সেনাপতিকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা জানানো হলো। কয়েক ডজন মুক্তিযোদ্ধা আকাশের দিকে বন্দুকের নল উচিয়ে ট্রিগার টিপে ‘গান স্যালিউট’ দিল তাঁকে। তারপর নাগরা যাতে সবাই বুঝতে পারে এমন সহজ হিন্দীতে ধীরে ধীরে বললেন, আমরা যে এতদূর পর্যন্ত বিজয়ী হয়ে এসেছি, তার জন্য মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের কৃতিত্ব অনেকখানি। মুক্তিবাহিনীর এই বীরত্বের ইতিহাস আগামী দিনের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আপনাদের টাঙ্গাইলের এই ছেলেটি, এই কাদের সিদ্দিকী, এর মতন সাহসী সংগঠক আমি খুব কমই দেখেছি। এ সত্যিই টাইগার। একে আমার সালাম জানাচ্ছি! আপনারা অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন, ধৈর্য ধরে আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন, বাংলাদেশের আশীভাগ এখন আমাদের দখলে, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকায় চরম আঘাত হানবো। আপনারা শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখুন, আমাদের সাহায্য করুন! জয় বাংলা! জয় হিন। জয় যৌথবাহিনী। ইন্দিরা-মুজিব জিন্দাবাদ!
সভা অনেকক্ষণ চলবে, কিন্তু মেজর জেনারেল নাগরা বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। তাঁকে হেড কোয়াটারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মঞ্চ বাঁধা হয়েছে বিন্দুবাসিনী স্কুলের ছাদে, সেখান থেকে মই বেয়ে তিনি নেমে এলেন। আবার একদল লোক ছুটে এলো তাঁকে মালা দেবার জন্য, তিনি গাড়িতে উঠে পড়লেন ভিড় ঠেলে। সভায় গোলমাল থামাবার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা আবার আকাশে গুলি ছুঁড়লো।
টাঙ্গাইল শহর এবং কাছাকাছি গ্রামগুলি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানী সৈন্যদের তারা বন্দী করে আনছে, সেই সঙ্গে খুঁজে খুঁজে ধরছে কুখ্যাত দালাল ও শান্তি কমিটির নেতাদের। মুছা তালুকদারের ছেলে খোকা পালাতে গিয়ে জোগনীচরে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। এই খোকার আর একটি ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল জল্লাদ, তার নির্দেশে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে মারা হয়েছে, সে রাজাকারদের সংগঠক। আর একজন নৃশংস রক্তলোলুপ অধ্যাপক খালেককে ধরা যায়নি, কিন্তু খোকাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে মঞ্চের নীচে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে খোকার বিচার সাঙ্গ হলো, তারপর মঞ্চে তুলে সর্বসমক্ষে তিন মুক্তিযোদ্ধা তার পেটে ঢুকিয়ে দিল বেয়নেট। যাদের মা-বোন-ভাই এই খোকার নির্দেশে আদেশে নিহত হয়েছে, তারা এমনভাবে চিৎকার করতে লাগলো যেন ওই শাস্তিতেও তারা সন্তুষ্ট নয়, তারা খোকার শরীরটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে চায়।
সার্কিট হাউসে এসে মেজর জেনারেল নাগরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাই কমান্ডের কাছ থেকে নতুন নির্দেশ পেয়ে গেলেন। ১০১ কমুনিকেশান জোন ঢাকা নগরীর পনেরো মাইলের মধ্যে পৌঁছে ঘাঁটি গেড়ে বসলেই তাদের দায়িত্ব সফলভাবে পূর্ণ হয়েছে ধরা হবে। তবে অবস্থা বুঝে এই বাহিনী যদি আরও এগিয়ে যেতে চায় তাতে আপত্তি নেই। সেক্ষেত্রে যুদ্ধে উপস্থিত সেনাপতিই সিদ্ধান্ত নেবেন।
মেজর জেনারেল নাগরার বুকটা একবার কেঁপে উঠলো। তিনি পুরো জেনারেল নন, মেজর জেনারেল, তিনি ছিলেন ফ্রন্ট লাইনের অনেক পেছনে। তা হলে কি ঢাকা দখলের মতন একটা ঐতিহাসিক কৃতিত্ব তাঁর ভাগ্যেই ঝুলছে?
তিনি তার বাহিনীর সবকটি পজিশানে নির্দেশ পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
এদিকে ভারতীয় সবাধিনায়ক মানেকশ’র গম্ভীর গলা ভারতীয় বেতারে কয়েকদিন ধরেই বারবার শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তানী সিপাহী, হাতিয়ার ডাল দো! যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছেই। ঢাকা শহর এখন আমার কামানের এলাকার মধ্যে। এরপর লড়াই চালাতে গেলে তোমাদের শুধু শুধু রক্তক্ষয় হবে। তোমরা হাতিয়ার নামিয়ে আত্মসমর্পণ করো, তোমাদের জীবন ও সম্মানরক্ষার দায়িত্ব আমরা নেবো!
ভারতীয় বিমান ঢাকার আকাশে এসে একবার ছড়িয়ে যাচ্ছে এই মর্মে লক্ষ লক্ষ লিফলেট, আবার এসে বোমা ফলছে। বোমার আঘাতে গভর্নর হাউসের একদিক গুঁড়িয়ে গেছে। প্রাণ বাঁচাবার জন্য গভর্নর মালেক দ্রুত পদত্যাগপত্র লিখে দলবল নিয়ে পালিয়ে এসেছেন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে। ওখানে ভারতীয় বোমার ভয় নেই।
ভূগর্ভ বাঙ্কারে দু’হাতে মাথা চেপে বসে আছেন জেনারেল নিয়াজী। রাওয়ালপিন্ডির হেড কোয়াটার তাঁকে বারবার মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছে। কোথায় চীনে সৈন্য? বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরী বাহিনী ঢুকে পড়েছে বলে জোর গুজব উঠেছিল, কোথায় সেই সেভেন্থ ফ্লিট? তিনি শুধু দেখতে পাচ্ছেন একটা দড়ির ফাঁস এগিয়ে আসছে তাঁর গলার দিকে। আকাশে শত্রুপক্ষের বিমান গর্জন। অন্যদের ওপর ভরসা করে তাঁকে চালাতে বলা হয়েছিল এত বড় একটা যুদ্ধ?
ভারতীয় সর্বাধিনায়ক মানেকশ তাঁর শেষ হুমকি দিলেন। তিনি ভারত বাংলা যৌথ কমান্ডকে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দিচ্ছেন এক রাত্রির জন্য। আগামীকাল সকাল নটার মধ্যে যদি পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ না করে, তা হলে চরম আঘাত হানা হবে ঢাকা শহরে, একজন সৈন্যকেও পালাতে দেওয়া হবে না!
শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ঢাকা রক্ষা করার সাধ জেনারেল নিয়াজীর মিটে গেছে এর মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তান গোল্লায় যাক। এখন তাঁর একমাত্র চিন্তা পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও নাগরিকদের জীবন রক্ষা করা যাবে কী করে! আরও যুদ্ধ চালিয়ে গেলে পশ্চিমে আরও নব্বই হাজার বিধবা ও প্রায় পাঁচ লাখ অনাথ ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়বে! এখন আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো গতি নেই। সেই মর্মে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পাঠালেন, কিন্তু তার কোনো উত্তর নেই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হতাশায় ডুবে আছেন, কারুর সঙ্গে দেখা করতে চান না।
গলার ফাঁসটা ক্রমশ কঠিন হয়ে আসছে দেখে জেনারেল নিয়াজী মরীয়া হয়ে পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ হামিদকে টেলিফোন করে অনুরোধ জানালেন, স্যার, আমি প্রেসিডেন্টের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আপনি অনুগ্রহ করে একটু ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে দেখবেন, তাড়াতাড়ি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না!
শেষপর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটা লম্বা উত্তর এলো। তাতে যুদ্ধ বন্ধ এবং পাকিস্তানী নাগরিকদের জীবনরক্ষার সমস্ত রকম ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আত্মসমর্পণের কোনো কথা নেই। সে নির্দেশ পেয়ে নিয়াজী আবার ধাঁধায় পড়ে গেলেন। এর মানে কী? এমনি এমনি যুদ্ধ বন্ধ করা যায় নাকি? ভারতীয় পক্ষ তা গ্রাহ্য করবে কেন? তারা মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় দিয়েছে।
নিয়াজী তখন রাও ফরমান আলীকে ডাকলেন যুদ্ধ বন্ধ চুক্তির শর্তগুলো ঠিক করার জন্য। লম্বা ছিপছিপে চেহারার জেনারেল ফরমান আলী ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, নিয়াজীর মতন বাগাড়ম্বরপ্রিয় কিংবা আবেগপ্রবণ নন। তিনি দ্রুত রচনা করলেন একটি সন্ধিপত্র, সেটি নিয়ে তারা দু’জনে গেলেন আমেরিকান কনসাল জেনারেল মিঃ স্পীভাকের কাছে। এই দুই সৈন্যাধ্যক্ষকে তেমন কিছু খাতির দেখালেন না এই মার্কিন কূটনীতিবিদটি। নিয়াজী তাঁকে অনুরোধ করলেন ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে তাঁদের হয়ে আলোচনা করতে, এর উত্তরে মিঃ স্পীভাক নীরস গলায় জানালেন যে আপনাদের হয়ে কথাবার্তা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি শুধু আপনাদের বাতাটা পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারি।
তাও মিঃ স্পীভাক অতি সাবধানী হয়ে নিজের দায়িত্বে নিয়াজীর বাতা সরাসরি জেনারেল মানেকশকে না পাঠিয়ে সেটা পাঠালেন ওয়াশিংটনে তাঁর কর্তাদের কাছে। নিয়াজী ও ফরমান আলী নিজেদের কমান্ডে ফিরে এসে অধীর প্রতীক্ষায় বসে রইলেন উত্তরের জন্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতে লাগলো, উত্তর আর আসে না!
রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি যুক্তির খসড়া ছাড়া আরও একটি পরিকল্পনার খসড়াও রচনা করে রেখেছিলেন। পরাজিত সেনানায়কেরা চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের আগে গোপন দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলে, নিজেদের পাপের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে হয়, সে দায়িত্বও নিয়েছেন ফরমান আলী, তা ছাড়াও তিনি বিশ্বাসঘাতক বাঙালীদের শেষ শিক্ষা দিয়ে যাবেন। বাঙালীরা স্বাধীন হয়ে নিজেরা রাজত্ব চালাবে? এই গোরস্তানে হাজার হাজার করোটি আর শুকনো হাড় দিয়ে তারা কি ভেল্কি দেখাবে সারা পৃথিবীকে?
বাঙালীদের মধ্যে জ্ঞানে-গুণে যারা কিছুটা উন্নত, সেই সমস্ত মানুষদের একটা তালিকা প্রণয়ন করে রেখেছিলেন ফরমান আলী। এদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক-অধ্যাপক, উকিলব্যারিস্টার, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি সব ধরনের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী। এদের সকলকে হত্যা করতে পারলে স্বাধীন বাংলাদেশ চলবে কাদের নিয়ে? ভারতীয় সৈন্যরা যখন ঢাকার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছোলো, তখন ফরমান আলী আল বদর ও আল শামস বাহিনীকে
লেলিয়ে দিলেন সেই তালিকা ধরে ধরে সকলকে বিনাশ করবার জন্য। আল বদর, আল শামসের লোকেরাও তো বাঙালী, তারা কি যুদ্ধের গতি বুঝতে পারেনি, যুদ্ধের শেষ মুহূর্তেও তারা স্বজাতির শ্রেষ্ঠ মানুষদের বিনা দোষে মেরে ফেলতে রাজি হলো কেন? কোনো যুক্তি নেই, বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করাও যাবে না, যুদ্ধের উন্মাদনা সব শ্রেণীর মানুষকে সব যুক্তি ভুলিয়ে দেয়। হিটলারের এস এস বাহিনীও তো শেষদিন পর্যন্ত তাদের নৃশংসতা বন্ধ করেনি।
প্রখ্যাত অধ্যাপক এবং নাট্যকার মুনীর চৌধুরী ঢাকায় তার সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে সকাল এগারোটায় স্নান সেরে মায়ের কাছে খাবার চেয়েছেন। মা খাবার সাজিয়ে দিচ্ছেন, এমন সময় সাত-আটটি যুবক এসে তাকে ডাকলো। তাদের কমান্ডার একবার অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে চান। মুনীর চৌধুরী বললেন, খাবার দেওয়া হয়ে গেছে, একটু দাঁড়াও খেয়ে নিই। ছেলেরা বললো, স্যার, আমাদের কমান্ডার ওই মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করছেন, আপনি যাবেন আর দুটো কথা বলে চলে আসবেন। বড়জোর পাঁচ মিনিট সময় লাগবে, এসে খাবেন।
ছেলেগুলির মুখের ভাষা বিনীত কিন্তু হাতে বন্দুক, তাই তাদের ধমক দিয়ে তাড়ানো যায় না। লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি পরা, মাথার চুল আঁচড়ানো হয়নি, সেই অবস্থায় বেরিয়ে পড়লেন মুনীর চৌধুরী, মোড়ের কাছে আসতেই আল বদর বাহিনী তাঁর চোখ মুখ বেঁধে ফেললো!
ঠিক একই ভাবে ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়াটার থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো। আনোয়ার পাশাকে, চণ্ডীচরণ বোস স্ট্রিটের বাড়ি থেকে আইনজীবী এ কে এম সিদ্দিককে, ডাক্তার আবদুল আলীম চৌধুরীকে, বিজ্ঞানী আবুল কালাম আজাদকে এবং আরো অনেককে। মীরপুরের গোরস্তানে এদের হত্যা করে গোর দেবারও কোনো ব্যবস্থা হলো না, লাশের ওপর জমতে লাগলো লাশ।
টাঙ্গাইল শহরে মুক্তিবাহিনীর কারুর চোখে সারা রাত ঘুম নেই। মেজর জেনারেল নাগরার অধীনে দু’জন ব্রিগেডিয়ার, সান সিং আর ক্লের দুটি বাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেছে ঢাকার পথে, তাদের সঙ্গে আছে মুক্তিবাহিনীর অত্যুৎসাহী যোদ্ধারা। মুক্তিবাহিনীর বাকি ছেলেরা রাত জেগে যুদ্ধরত বারো হাজার ভারতীয় সৈন্যদের জন্য নাস্তা তৈরি করছে, হেলিকপটারে সেই খাবার পৌঁছে দেওয়া হবে বিভিন্ন সমর প্রাঙ্গণে।
ব্রিগেডিয়ার ক্লের কড়া নামের একটা জায়গায় একটা পাক বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে শেষপর্যন্ত তাদের পর্যদস্ত করে নদীর ধারে আস্তানা গেড়েছেন। ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী নবীনগর-সাভারের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে ঢাকার দিকে। সাভারের জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে হঠাৎ খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। রাত তখন তিনটে, আকাশ খান খান হয়ে গেল কামান আর মেশিনগানের গর্জনে।
ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর অধীনে তিন হাজার রেগুলার আর্মি এবং বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানী ক্যাম্পটিতে সৈন্যসংখ্যা কিছুতেই সাত আট শোর বেশি না। তবু তারা অসম সাহসীর মতন আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলো। কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবে না। সান সিং-এর অনেক সৈন্য পাকা সড়কের পশ্চিম পাশের কাঁচা রাস্তা দিয়ে সাভার বাজার পর্যন্ত পেরিয়ে গেল, এই ভাবেও ঢাকার দিকে এগুনো যায়, কিন্তু পেছনে একটা শত্রু ঘাঁটি রেখে যাওয়াটা সান সিং-এর পছন্দ হলো না। এই গোঁয়ার পাকিস্তানীরা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবে না, সবাই মরতে চায়?
সান সিং বারবার তাদের অস্ত্রসংবরণ করতে বললেন, উত্তরে ছুটে এলো ঝাঁক ঝাঁক গুলি। শেষপর্যন্ত সান সিং নিজে একটি গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেলেন এই ঘাঁটিটি উৎখাত করতে। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আরও এগিয়ে যেতে চায়। সান সিং সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের অধিনায়ক ছিলেন, এই সমস্ত দুরন্ত, দুঃসাহসী ছেলেদের সম্পর্কে তাঁর মনে একটা স্নেহের ভাব আছে। তিনি বুঝলেন, এই মরীয়া পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করতে গেলে সুবিধে হবে না, পটাপট করে মরবে, এখানে পেশাদার সৈন্যদের সঙ্গে টক্কর দিতে হবে পেশাদার সৈন্যদের। একটা উঁচু দেওয়ালের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে তিনি চেঁচিয়ে মুক্তিবাহিনীকে বলতে লাগলেন, আপনারা এগোবেন না, আপনারা পেছন দিকে থেকে আমাদের সাহায্য করুন, পিছিয়ে যান। কিন্তু কে কার কথা শোনে! এবার সান সিং কঠোরভাবে আদেশ দিলেন, আমার নির্দেশ ছাড়া কেউ একটিও গুলি ছুঁড়বে না।
পাকিস্তানী বাহিনীর সাঙ্ঘাতিক গোলাবর্ষণের মুখে ভারতীয় সৈন্যরা খানিকটা এগিয়েও পিছিয়ে আসছে বারবার। পাক বাহিনী একটা বাড়ির দোতলায় উঠে সুবিধেজনক অবস্থান পেয়েছে। বিশেষত একটা জলের ট্যাঙ্কের পাশ দিয়ে অনবরত মটারের গর্জন হচ্ছে, কিছুতেই ঘায়েল করা যাচ্ছে না সেটাকে।
হঠাৎ সান সিং দেখলেন আগুনের ঝলক ও ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেড়জন। মানুষ। একজন দীর্ঘকায় পুরুষ, আর একটি কিশোর। এরা কি পাগল নাকি! তিনি নিজে ছুটে গিয়ে লম্বা লোকটির কাঁধের জামা চেপে ধরে কর্কশভাবে বললেন, তোমরা আদেশ অমান্য করছো যে! ফেরো!
মুখ ফিরিয়ে বাবুল চৌধুরী শান্ত গলায় বললো, ওই মটরটাকে থামানো দরকার। আমি জলের ট্যাঙ্কের পেছন দিকে যাচ্ছি!
সান সিং বললেন, সে কাজ আমাদের জওয়ানরাই পারবে। একটু সময় লাগবে বড় জোর। ওরা কতক্ষণ যুঝবে! তোমাদের বলেছি না পেছনে থাকতে!
বাবুল চৌধুরী বললো, শুধু আপনারাই যুদ্ধ করবেন কেন? এটা আমাদেরও লড়াই, ব্রিগেডিয়ার!
সান সিং ধমক দিয়ে বললেন, শুধু শুধু বোকার মতন প্রাণ দেওয়ার কোনো মানে হয় না। লড়াই করার পরে আরও অনেক সুযোগ পাবে। গেরিলা যোদ্ধারা এরকম মুখোমুখি যুদ্ধ করে না। আমার অর্ডার বড় রাস্তার দিকে যাও!
বাবুল বললো, আমি এগিয়ে যাবোই, ব্রিগেডিয়ার! আমাকে বাধা দিয়ে লাভ নেই। এদের শেষ করে দিতে পারলেই ঢাকার রাস্তা একেবারে খোলা। মীরপুরের ব্রীজে ওরা কোনো কামান বসায়নি, আমি দেখে এসেছি!
ওদিক থেকে আবার একটা মটারের গোলা ছুটে আসতেই স্নান সিং কিশোরটির কাঁধ ধরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মাটিতে। বাবুল চৌধুরী ছুটে গেল সামনের দিকে।
সান সিং শফিকে নিয়ে চলে এলেন একটা দেওয়ালের আড়ালে। শফি ছটফট করে বলতে লাগলো, আমিও যাবো, আমারে ছাইড়্যা দ্যান, আমিও যাবো!
সান সিং সাত আট মাস মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে কিছুটা বাংলা শিখেছেন। তিনি শফিকে শক্ত করে ধরে রেখে বললেন, আরে বাচ্চা, এটা মরণবাঁচন লড়াই, ফুটবল খেলা আছে না! চুপ। মেরে থাক!
বাবুল চৌধুরী মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে। কিন্তু পাক সৈন্যরা নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পেয়েছে। একটা সার্চলাইট পড়লো সেখানে, কয়েক ঝাঁক মেশিনগানের গুলি সেই আলো-অন্ধকার কুঁড়ে দিতে লাগলো। সান সিং-ও যেন দেখতে পেলেন লম্বা লোকটিকে মাটিতে পড়ে যেতে। গুলি খেয়ে সে কয়েক পাক গড়িয়ে গেল, তার হাতের এল এম জি-টাও থামেনি, একটু পরেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো জলের ট্যাঙ্কটি।
দেওয়ালটার ওপর লাফিয়ে উঠে সান সিং হাত দুড়ে বললেন, চার্জ! ডান পাশের বাঙ্কারটা। দখল করো! বাঁয়ে একদল ভাগছে, ধরো!
দেড় ঘণ্টা তুমুল লড়াইয়ের পর সাভারের পাক ঘাঁটির পতন হলো। ওদের দেড়শো মতন। সৈন্য এর মধ্যেই মারা গেছে, বাকিরা অস্ত্রত্যাগ করলো, কিছু পালালো। বন্দীদের আটকে রাখার ব্যবস্থা করে সান সিং নিজের সৈন্যবাহিনীর একটি অংশকে নির্দেশ দিলেন মীরপুরের দিকে এগিয়ে যেতে। তারপর তিনি টর্চ হাতে এগিয়ে গেলেন ভাঙা জলের ট্যাঙ্কটির দিকে।
ট্যাঙ্কটির পিলারগুলো পার হয়ে একটা নালার ধারে উপুড় হয়ে পড়ে আছে বাবুল চৌধুরী। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার গায়ের জামা
যারা মটর চালাচ্ছিল, তাদের কয়েকজনও ওপর থেকে খসে পড়েছে এখানে। বাবুল বুকে হেঁটে এই পর্যন্ত এসে অতর্কিতে ওদের পেছন থেকে গুলি করেছে, এল এম জি র গুলির ঝাঁপটাতেই ট্যাঙ্কটি ঝাঁঝরা হয়ে খসে পড়েছে।
বাবুলের শরীরে এখনো প্রাণ আছে। সান সিং তাকে চিৎ করতেই সে প্রথমে এল এম জি-টা। তুলতে গেল, তারপর সান সিং-এর পাশে শফিকে দেখে চিনতে পেরে সে ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞেস করলো, ব্রিগেডিয়ার, ওরা খতম হয়েছে?
সান সিং বললেন, যথেষ্ট সাহস দেখানো হয়েছে! এবার আমার হাত ধরে ওঠো তো, কোথায় কোথায় গুলি লেগেছে! টাঙ্গাইল হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছোতে পারবে তো?
বাবুল উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হাসপাতালে যেতে হবে কেন? আমার তো বেশি লাগেনি! এই দ্যাখো, আমি দু হাত তুলতে পারছি। দু পায়ে দাঁড়াতে পারছি। আমার মাথায় কোনো চোট নেই!
একটা গুলি লেগেছে বাবুলের ঘাড়ে, একটা বাম বাহুতে। খুব গুরুতর আঘাত নয় ঠিকই। তবে বাম বাহুতে বুলেট ঢুকে আছে ভেতরে, সে-যন্ত্রণা সে এখনো টের পাচ্ছে না। সে শফির পিঠ চাপড়ে বললো, চল, এবার সোজা ঢাকায় যাবো!
মীরপুর ব্রীজ অরক্ষিত, মুক্তিবাহিনীর সূত্রে এ খবর শেষরাতের মধ্যেই পেয়ে গেলেন মেজর জেনারেল নাগরা। ব্রিগেডিয়ার ক্লের-কে সেদিকে এগোবার নির্দেশ দিয়ে ভোরবেলা তিনি উঠলেন একটি হেলিকপটারে, সঙ্গে নিলেন টাঙ্গাইলের হীরো কাদের সিদ্দিকীকে। আকাশপথ সম্পূর্ণ নিরাপদ। শীতকালের সূর্য গড়িমসি করে উঁকি মারছে পূর্ব দিগন্তে। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে লাল আলো।
সাভার ও মীরপুরের রাস্তার মাঝামাঝি একটা বাঁকে যখন হেলিকপটারটি নামলো, তখনও সেখানকার বাতাসে বারুদের গন্ধ। ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর কাছ থেকে মেজর জেনারেল নাগরা শুনলেন জাহাঙ্গীর নগরের লড়াইয়ের বিবরণ। সামনে আর বড় রকমের কোনো বাধার সম্ভাবনা নেই। মীরপুর পেরুনো মানেই তো ঢাকার দরজায় পৌঁছে যাওয়া। মুক্তিবাহিনীর প্রায় এক হাজার যোদ্ধা এরই মধ্যে গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে মীরপুর ব্রীজের পাশে পৌঁছে গেছে। ভারতীয় বাহিনীও সেই ব্রীজের দিকে মার্চ করছে।
মেজর জেনারেল নাগরা কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন। একটা ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি দুরবীন চোখে লাগিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন ঢাকা নগরী। বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু বাড়িঘর। কাঁদেরের হাতে দূরবীনটা দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, দ্যাখো তো, ওই বাড়িটা কোন্ বাড়ি?
কাদের বললো, ওইটা তো শেরে বাংলা নগরের নতুন সংসদ ভবন! বিল্ডিংটাই বানানো হয়েছে, কোনোদিন কাজে লাগেনি!
আবার দূরবীন চোখে এটে দেখতে দেখতে নাগরা জিজ্ঞেস করলেন, রাস্তার ওপর কারা যেন দৌড়োদৌড়ি করছে মনে হচ্ছে? ওরা কারা?
কাদের বললো, ওরা আমাদের ছেলে! ছুটকো ছাটকা কিছু হানাদার সেনা এখনো আছে। বোধ হয়, তাদের দেখলেই তেড়ে যায়।
নাগরা বললেন, মীরপুর ব্রীজের প্রায় কাছেই আমি দেড়জনকে দেখতে পাচ্ছি। একজন ঢ্যাঙা, একজন বেঁটে, ওদের কি ভয়ডর নেই? হাতে অস্ত্রও আছে।
সান সিং বললেন, ওরা এক অদ্ভুত জুটি, জেনারেল। পরে ওদের কথা আপনাকে শোনাবো!
চোখ থেকে দূরবীন নামিয়ে নাগরা একজন কমুনিকেশান অফিসারকে ডেকে খবরাখবর নিলেন। অন্যদিক থেকে যৌথবাহিনী নারায়ণগঞ্জ, দাউদকান্দি, নরসিংদি এসে গেছে। ঢাকা শহর এখন সত্যিই চতুর্দিক থেকে ভারতীয় কামানের আওতায়, ওপরে বিমান বাহিনী তো আছেই। ইচ্ছে করলে নাগরার বাহিনীই এখন ঢাকায় আগে পৌঁছোতে পারে।
নাগরাকে দেখলে নিয়াজীর মুখের অবস্থা কী হবে সেটা ভেবে নাগরা মুচকি হাসলেন। নিয়াজী নাগরাকে ভালোই চেনেন। দু’জনে একসঙ্গে কমিশনড় অফিসার হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছেন ব্রিটিশ আমলে। পাকিস্তানী আর্মিতে তাড়াতাড়ি পদোন্নতি হয়, তাই নিয়াজী জেনারেল হয়েছেন, আর নাগরা এখনো মেজর জেনারেল।
হেমায়েতপুর সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে একটা জিপের বনেটে এক টুকরো কাগজ রেখে নাগরা খসখস করে লিখলেন একটা ব্যক্তিগত চিঠি;
প্রিয় আবদুল্লাহ
আমরা এসে পড়েছি। তোমার সব বাহাদুরি আর খেলা শেষ। আমরা তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মতন আত্মসমর্পণ করো। না হলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনিভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। তোমাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানাচ্ছি, তোমার জীবনের নিরাপত্তা অবশ্যই দেওয়া হবে।
তোমার
মেজর জেনারেল নাগরা
সকাল ৮-৩০ মিনিট, ১৬-১২-৭১
কাছে সাদা পতাকা নেই, তাই একজনের একটা সাদা জামা খুলে নিয়ে পতাকার মতন করে বাঁধা হলো একটা জিপ গাড়িতে। তারপর নাগরার সেই চিঠিটা নিয়ে কয়েকজন সেই জিপ ছুটিয়ে গেল ঢাকার দিকে।
আধঘণ্টার মধ্যে বিনা বাধায় বাতটি এসে পৌঁছে গেল নিয়াজীর কাছে। তখন তাঁর পাশে বসে আছেন মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল ফরমান আলী ও রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ। এর মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ স্পীভাক মারফত প্রেরিত যুদ্ধ বন্ধের আবেদন বাটি পৌঁছে গেছে ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ মানেকশ’র কাছে। তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। যুদ্ধবিরতি আবার কী? বিজয়ী পক্ষ চূড়ান্ত জয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে নিছক যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে কেন? মানেকশ চান আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্র সমর্পণ। শুধু তারপরেই নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে।
নিয়াজীর কাছ থেকে অন্য সেনাপতিরা চিরকুটটা নিয়ে দেখলেন। ফরমান আলী উদ্ধতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, এই নাগরা নামের লোকটিই কি তবে ভারতীয় পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধের শর্ত আলোচনা করতে আসছে।
অন্যরা নীরবে তাকিয়ে রইলেন। চিরকুটটির অর্থ অতি স্পষ্ট। আলোচনা-টালোচনা কিছু নয়। হয় আত্মসমর্পণ, অথবা যুদ্ধ! আর যুদ্ধ মানেই প্রতি ইঞ্চি ভূমি দখলের লড়াই।
ফরমান আলী আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোনো রিজার্ভ বাহিনী আছে কি? নিয়াজী সেই উর্দু শুনেও হতভম্বের মতন তাকিয়ে আছেন দেখে রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ পাঞ্জাবীতে অনুবাদ করে বললেন, কুজ পাল্লে হ্যায়? অর্থাৎ থলেতে কিছু আছে কি?
নিয়াজী এবার তাকালেন জামশেদের দিকে। বিষণ্ণ মুখে জামশেদ দুদিকে মাথা নাড়লেন।
ফরমান আলী ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, তবে তো আর লড়াইয়ের প্রশ্নই ওঠে না। যাও, ওই লোকটাকে খাতির করে নিয়ে এসো!
বিকেলবেলা পূবাঞ্চলের ভারতীয় সেনাপতি জগজিৎ সিং অরোরা সস্ত্রীক একটি বিশেষ বিমানে এসে পৌঁছোলেন ঢাকায়। এর আগে কলকাতা থেকে মেজর জেনারেল জেকব দুপুরে এসে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা পাকা করে ফেলেছেন। আত্মসমর্পণ দলিলে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড কথাটিতে আপত্তি তুলেছিলেন ফরমান আলী। এখনও তাঁরা বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিতে চান না, তারা আত্মসমর্পণ করবেন শুধু ভারতীয় পক্ষের কাছে। সে আপত্তি অগ্রাহ্য হলো। এই রকমই দিল্লির নির্দেশ। অনুষ্ঠানটি হবে রমনা রেস কোর্সে। অত বড় প্রকাশ্য জায়গায় অপমানের দৃশ্যটি অনুষ্ঠিত হোক, তা নিয়াজী চান না। তার সে আপত্তিও উড়িয়ে দেওয়া হলো। ওই ময়দানে ৭ মার্চ শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, ওই জায়গা থেকেই পাকিস্তানী বাহিনী চিরবিদায় নেবে! বিজয়ী পক্ষের শর্তই পরাজিতরা মেনে নিতে বাধ্য।
ঢাকা শহরে যে এখনো এত মানুষ আছে তা আজ সকালেও বিশ্বাস করা যায়নি। লক্ষ লক্ষ লোকে রাস্তায় নেমে পড়ে পাগলের মতন চিৎকার করছে। ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাক দেখলেই লোকে ছুঁড়ে দিচ্ছে ফুলের মালা, আর পাকিস্তানী বাহিনীর দিকে থুতু। বয়স্ক ব্যক্তিরা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছে এই দৃশ্য। কেউ কেউ ভাবছে, পয়ষট্টি আর একাত্তর সাল, এই ছ বছরের মধ্যে কত তফাত! এর পরের ভবিষ্যৎ পাঁচ-ছ’ বছরের মধ্যে আবার কী হবে কে জানে!
বিকেলবেলা আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি হলো সংক্ষিপ্ত। মুক্তিযোদ্ধারা শহরের রাজপথে ঘুরে ঘুরে প্রচণ্ড উল্লাসে আকাশের দিকে গোলাগুলি বর্ষণ করছে। রাজধানী ঢাকায় কোনো সরকারের অস্তিত্ব নেই। আইনশৃঙ্খলা যে কোনো মুহূর্তে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে, ভারতীয় সৈন্যরা শান্তিরক্ষায় পুরোপুরি দায়িত্ব নিতে পারে না, উজ্জ্বল সাধারণ নাগরিকদের ওপর ভারতীয় সেনারা গুলি চালালে সে হবে আর এক কেলেঙ্কারি। এমনিতেই একদল লোক সর্বক্ষণ চিৎকার করছে, নিয়াজী, ফরমান আলীদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, তারা ওই নরঘাতকদের দেহ ছিঁড়ে কুটিকুটি করবে!
ভোরবেলাতেই কয়েকটি হেলিকপটারে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানের ধনী ব্যক্তি ও কয়েকজন আহত সেনাপতি পলায়ন করেছেন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী নার্সদের তাড়াহুড়োতে তাঁরা নিতে ভুলে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে প্রতিশোধ নিতে শুরু করে না দেয় তাই বিভিন্ন জায়গায় নিযুক্ত করা হয়েছে ভারতীয় সেনাদের। বিজয়ের গর্বে তারাও বাড়াবাড়ি করে ফেলছে অনেক জায়গায়। আইন শৃঙ্খলার কোনো রক্ষক নেই বলেই গুন্ডা বদমাসশ্রেণী শুরু করে দিয়েছে। লুটপাট, অবাঙালীদের বাড়িঘর লুণ্ঠনের তো একটা নৈতিক সমর্থন আছেই। ভারতীয় সেনারা অবাঙালী হলেও তারাও অনেক জায়গায় হাত মেলাচ্ছে সেইসব লুণ্ঠন যজ্ঞে। ঢাকায় এসব বিদেশী জিনিস পাওয়া যায়, এসব তো আগে দেখেনি ভারতীয়রা। রেফ্রিজারেটার, টি ভি, টু-ইন-ওয়ান, কার্পেট, টিনের খাবার, এই সব ভর্তি হতে লাগলো ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে। শুধু সেই বিজয় উন্মত্ত সৈনিকেরা বাংলাদেশের সুন্দরী মেয়েদের দিকে হাত বাড়াতে সাহস করলো। না, সে ব্যাপারে তাদের ওপর গোড়া থেকেই কঠোর নির্দেশ ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী!
রেসকোর্স ময়দানে টেবিল পেতে জেনারেল অরোরা ও জেনারেল নিয়াজী বসলেন পাশাপাশি। বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রায় কেউই আসেননি। সকলেই আশা করেছিল, বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানি অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু তিনি অভিমান করে আসতে রাজি হননি। তিনি আশা করেছিলেন যে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে শুধু বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে। কিন্তু এই অবাস্তব প্রস্তাবে পাকিস্তানীরা রাজি হবে কেন, তারা তো বাংলাদেশ বাহিনীর অস্তিত্বই স্বীকার করে না, তারা পরাজয় মেনেছে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত হয়েছেন শুধু এয়ার কমান্ডার এ কে কুশু, মেজর হায়দার, ফ্লাইট লেফটেনান্ট ইউসুফ। আর নিজের গড়া মুক্তিবাহিনীর অবিসংবাদী নেতা কাদের সিদ্দিকী।
নিয়াজী তার কোমরের বেল্ট খুলে রিভলভারটা দিলেন অরোরাকে। তারপর আত্মসমর্পণের দলিলে সই করতে গিয়েও তাঁর হাত এমনই কাঁপতে লাগলো যে কলমে লেখাই পড়লো না। আর একটি কলম এগিয়ে দেওয়া হলো তাঁর দিকে। অস্ত্রসমর্পণের প্রতীক হিসেবে একশো জন পাকিস্তানী অফিসার এবং একশো জন জওয়ান তাদের হাতিয়ার মাটিতে নামিয়ে রাখলো।
ভারত-পাকিস্তানের পশ্চিম রণাঙ্গনেও যুদ্ধ থেমে গেল স্বাভাবিক কারণেই। সন্ধের সময়। দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধজয়ের ঘোষণায় আশ্চর্য সংযমের পরিচয় দিলেন। তিনি বললেন, এই জয় নিয়ে আমাদের গর্ব করার এমন কিছুই নেই। দু’পক্ষেরই বহু সৈন্য হতাহত হয়েছে। আমাদের আসল যুদ্ধ তো দারিদ্র্যের সঙ্গে। দারিদ্র্যই আমাদের প্রধান শত্রু!
রেসকোর্স ময়দানের শেষ প্রান্তে শফিকে সঙ্গে নিয়ে বসেছিল বাবুল চৌধুরী। এখনো সে তার ক্ষতস্থানের কোনো চিকিৎসা করায়নি, নিজেরই জামা ছিঁড়ে কোনোরকমে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিয়েছে। তার মুখখানা রক্তশূন্য, অসম্ভব যন্ত্রণা ও ক্লান্তিতে সে প্রায় ধুকছে। কিন্তু আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান না দেখা পর্যন্ত সে নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। তা হলে সত্যিই লড়াই শেষ। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় আর সম্মুখযুদ্ধ করতে হলো না। হাতের এল এম জি-টাতে লাঠির মতন ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললো, চল শফি, এবার আমাদের ছুটি!
একটুখানি এগিয়েই সে সামনে দেখতে পেল কাদের সিদ্দিকীকে। কাদের তার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট, প্রায় তার ছাত্রের পর্যায়ে পড়ে; তবু বাবুল একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা, কাদের নিজস্ব দলটির অধিনায়ক, তাই বাবুল তাকে একটি স্যালিউট দিয়ে বললো, আমার আর অস্ত্রের দরকার নেই। এটা আপনি রাখুন!
কাদের বললো, এখনই অস্ত্র ছাড়বেন না। আমাদের এখনও অনেক কাজ বাকি। শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ওরা যদি শেখ সাহেবকে না ছাড়ে তা হলে আলটিমেটাম দিয়ে আমরা পাকিস্তান আক্রমণ করবো!
বাবুল বললো, সেসব আপনারা করবেন। আমার কাজ শেষ। এটা আপনারা রাখুন!
এল এম জি-টা সে ফেলে দিল কাঁদেরের পায়ের কাছে। কাঁদেরের মন তখন বঙ্গবন্ধুর জন্য উতলা হয়ে আছে। সে বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চায়, ব্যস্ততার মধ্যে সে আর কথা বাড়ালো না, একজন সঙ্গীকে অস্ত্রটা তুলে নিতে বলে সে একটা জিপে উঠে পড়লো।
শফির কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে লাগলো বাবুল। তার পায়েও কখন একটা চোট লেগেছে সে। খেয়াল করেনি, তাকে কিছুটা খোঁড়াতে হচ্ছে। রাস্তায় মানুষের ভিড়ে গায়ে গা ঠেকে যায়। অচেনা লোকজনও এসে হঠাৎ হঠাৎ আলিঙ্গন করছে। চতুর্দিকে উদ্দাম কোলাহল। এ যেন এক অচেনা নগরী। গোলাগুলির শব্দের সঙ্গে একটা ভয়ের অনুষঙ্গ থাকে, আজ চতুর্দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে, তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের উল্লাসধ্বনি। আর শোনা যাচ্ছে সম্মিলিত গর্জন, জয় বাংলা!
নিজের পাড়ায় এসে এগোতে এগোতে বাবুল থমকে দাঁড়ালো। জাহানারা আপার বাড়িটা এত নিস্তব্ধ কেন? এ বাড়িতে এখনো বাংলাদেশের পতাকা ওড়েনি। এটা যেন অবিশ্বাস্য!
সদর দরজাটা খোলা। বাবুল শফিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে এলো। বসবার ঘরটা খালি, কেমন যেন শোকের গন্ধ! ভেতরের দিকে এক জায়গায় আট-দশজন নারী-পুরুষ বসে নীচু গলায় দোয়া-দুরুদ-তুল পড়ছেন। বাবুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রুমী তা হলে নেই!
একজন বাবুলকে বসে পড়ার ইঙ্গিত করলো। তারপর ফিসফিস করে জানালো সংক্ষিপ্ত সংবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কিংবা রুমীর প্রসঙ্গ কিছুই নেই। মাত্র তিনদিন আগে জাহানারার স্বামী শরীফ মারা গেছেন। হার্ট অ্যাটাকের পর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ব্ল্যাক আউটের জন্য হাসপাতালের মেইন সুইচ অফ করে দেওয়া হয়েছিল। লাইফ সেভিং মেশিন চালু করা যায়নি, প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই প্রাণটা গেছে শরীফের।
একটু পরে একটা কাঠের মূর্তির মতন জাহানারা এসে দাঁড়ালেন সেখানে। তাঁর মুখে শোক-দুঃখ-খেদের লেশমাত্র নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি যে চাল-চিনি ইত্যাদি জমিয়ে রেখেছিলেন, এখন সে ঘরের দরজার তালা খুলে দিয়ে ঐসব দিয়ে কুলখানির জর্দা রাঁধবার নির্দেশ দিতে লাগলেন। বাবুলকে তিনি একবার দেখলেন। কিন্তু একটা প্রশ্নও করলেন না!
অন্য একজন হঠাৎ চিৎকার করে বললো, ও বাবুল, তুমি ফিরে এলে, যুদ্ধও শেষ হলো, তা হলে রুমী কোথায়?
বাবুল মুখ নীচু করলেন। ধারালো বাণের মতন আরও অনেক প্রশ্ন ছুটে এলো। রুমী কোথায়? বসির কোথায়? সিরাজুল, জুয়েল, মন্টু, আশরাফ, দেবনাথ, মজিদ, নাঈম, শওকত, বেলু, নাজমা, জ্বলেখা, কাইয়ুম, নুরুজ্জামান, এরা কোথায়?
কেউ জানে না ওরা কোথায়। স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু ওরা আর ফিরে আসবে না! স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হবে না!
খানিক পরে জাহানারা ইমামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে এগোতে গিয়ে বাবুল আবার আঁতকে উঠলো। সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে তার বাড়ির সিঁড়িতে কে বসে আছে, এক প্রেতিনী?
ছেঁড়া ঝুলঝুলে শাড়ি, চুলগুলো শনের দড়ির মতন, মুখের চামড়ায় কয়েক পরত ময়লা। তবু শুধু চোখের দৃষ্টিতেই চেনা গেল মনিরাকে। কোথা থেকে একটা আখের টুকরো যোগাড় করে সে চিবোচ্ছে।
বাবুলকে দেখে সে মুখ তুলে খুব বেশিরকমের স্বাভাবিক গলায় বললো, এই যে, দুলাভাই, আসছেন? হেই মানুষ কোথায়?
এই মনিরার খোঁজেই বাবুল একদিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল। মনিরা নিজেই এতদিন বাদে ফিরে এসে অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিন্তু মনিরাকে এখন কার হাতে তুলে দেবে বাবুল! তার চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে, সে এবার অজ্ঞান হয়ে যাবে। ঝাঁপসা চোখে বাবুলের একবার মনে হলো, এই মনিরাই যেন আজকের সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতীক।
সে শফিকে বললো, ওরে, আমাকে ধর! আমি আর পারছি না। মরে যাচ্ছি বোধ হয়, আমাকে ধর!
বাবুলের শরীরটা দুলছে, প্রতিরোধ শক্তি শেষ হয়ে আসছে। সিরাজুলের আত্মদানের খবর সে শুনেছে কয়েকদিন আগে। সিরাজুল আর ফিরবে না, আরও হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে কোনোদিন ফিরে আসবে না এই স্বাধীন বাংলাদেশে। আর্মি ব্যারাক থেকে শুধু ফিরে এসেছে মনিরা। সে কতবার ধর্ষিতা হয়েছে তার ঠিক নেই, কতভাবে অত্যাচারিত হয়েছে তা কে জানে, তবু তার প্রাণ যায়নি, এই দেশটারই মতন। সে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে।
পাগলাটে গলায় মনিরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ও দুলাভাই, হেই মানুষ কোথায়? সে আপনের সাথে ফেরে নাই? সে এখনো যুদ্ধ করে নাকি? বাবুল কোনো উত্তর দিতে পারছে না। সে এখন অন্ধকার দেখছে।