৬০. কলতলায় মানুষের ভিড়

 ষাট

সকাল থেকেই তিন নম্বরের কলতলায় মানুষের ভিড়, যেন বিয়ে বাড়ির আবহাওয়া। বড়রা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, বাচ্চারা নড়ছে না। বিলু মাটি আর ইট সাজিয়ে উনুন করেছে। বেশ মজবুত। তাতে আগুন দিয়ে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। তরিতরকারি কাটা হচ্ছে অর্কদের ঘরের সামনে। রান্নার নেতৃত্ব ঝুমকির। সকাল থেকে সে কোমরে আঁচল জড়িয়ে লেগে গেছে কাজে। চারধারে এখন হইচই। অর্ক খানিক আগে অনিমেষের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে।

একটা ছোট খাতায় হিসেব লিখছিল বিলু। রোজ যা যা কেনা হচ্ছে তা লিখে রাখতে হবে যাতে কেউ অপবাদ না দিতে পারে। ব্যাপারটার অভিনবত্ব তাকে উত্তেজিত করছে। দিনের হিসেব যোগ করার পর সে ঠোঁট কামড়ালো। যদিও আজ বেশ কিছু জিনিস বেশী আনা হয়েছে কিন্তু একে তিরিশ দিয়ে গুণ করলে যা হয় তা থেকে জমা টাকার পরিমাণ অনেক কম। বিলুর মাথায় ঢুকছিল না কিভাবে তিরিশ দিন চালানো যাবে। সে তাকিয়ে দেখল চারপাশে পিকনিকের আবহাওয়া। সে ন্যাড়াকে ডাকল, ‘ন্যাড়া, এখান থেকে ভিড় হঠা।’

‘হঠালেই শালারা হঠবে? অক্কদা বলেছে খিস্তি না করতে।’

‘খিস্তি করতে তোকে বলেছি আমি?’

‘খিস্তি না করলে এরা শুনবে না।’

‘ঠিক আছে। কিন্তু খাওয়ার সময় যেন বাইরের লোক না বসে যায়। যারা যারা মেম্বার শুধু তারাই বসবে খেতে। নাহলে আমরা ফতুর হয়ে যাব।’

ন্যাড়া কি একটা ভাবল। তারপর হন হন করে চলে গেল বড় রাস্তার দিকে। বিলু লক্ষ্য করল ছোকরার হাবভাবে বেশ হিম্মত-হিম্মত ভাব এসে গেছে। শরীরে বড় না হয়েও বড়দের যথার্থ অনুকরণ করে ফেলেছে ও। কিন্তু শান্তি কমিটির কাজের জন্যে এখন একটু চাপা। শুধু ও নয়, এই এলাকায় যত উঠতি মাস্তান সবাই এখন সমঝে চলছে। বিলু এসে এর মধ্যেই খবর পেয়েছে দিশী মালের চেনা ঠেকগুলো এখন বন্ধ। কিন্তু গোপনে যে বিক্রি হচ্ছে না তা নয়। তবে রাস্তায় কেউ মাতলামি করতে সাহস পাচ্ছে না। এইটে কতদিন চলবে কে জানে।

বিলু একটা সিগারেট ধরালো। আজকাল সে বয়স্কদের দেখলে সিগারেট লুকোয় না। তার ধারণা, সিগারেট খেলে কোন অন্যায় হয় না। তিন নম্বরের ছেলেরা মাল খেয়ে খিস্তি করলে বড়রা আদর করে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায় যখন তখন সিগারেটে কোন দোষ হতে পারে না। ধোঁওয়া ছাড়তে ছাড়তে বিলু কলতলায় এসে দাঁড়াল। দুটো ইটের ওপর দাঁড়িয়ে ঝুমকি খুন্তি নাড়ছে। এই ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও মেয়েটার কপালে ঘাম জমেছে, মুখ চকচক করছে। এখন ওর শরীরে একফোঁটা রঙ নেই। বিলু চোখ ছোট করল। অর্কটার এলেম আছে। ঝুমকি যে লাইনের মেয়ে তা জানতে বাকি নেই। ক্যাবারে ড্যান্স শেখে, আয়ার কাজ করে, এসব বাজে কথা। মেয়েরা পয়সা নিয়ে শুয়ে পড়ে। খুরকির সঙ্গে এককালে খুব মহব্বত ছিল। তারপরে কি কারণে সেটা ফুটে গেল তা জানা নেই। কিন্তু এই মেয়েকে দেখে কেউ ভাবতে পারবে না লে লে বাবু পঞ্চাশ টাকা। মাস্তান হঠাও, মালের ঠেক হঠাও কিন্তু রাণ্ডী হঠাও বলে কেউ চেঁচাল না।

কিন্তু এই মেয়েকে দেখলে কোন শালা রাণ্ডী বলবে? এই সময় ঝুমকি মুখ তুলে তাকাতেই বিলু হাসল। ঝুমকি খুন্তি নাড়তে নাড়তে মুখ নামিয়ে আবার ফিরে তাকাল। সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুছে গেল বিলুর। বেশ অপরাধী ভাব ফুটে উঠল মুখে। সেইসঙ্গে ভয়। ওর মনে হল ঝুমকি যেন একটু আগে ভাবা কথাগুলো বুঝে ফেলেছে।

বিলু নিজেকে গালাগালি দিন। শালা, এই সব ভাবতে যাওয়ার কি দরকার ছিল। পুরোনো অভ্যেস। আঠার মত লেগে থাকে। ঝুমকি যদি অর্ককে বলে দেয়—! সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে গালাগাল দিল সে। মেয়েটাকে কিছুই বলেনি, অতএব তার বিরুদ্ধে বলবার কিছুই নেই। স্রেফ কল্পনা করে সে ব্যাপারটা তৈরি করে নিচ্ছে। বিলু এগিয়ে গেল কয়েক পা, ‘এই ঝুমকি, কিছু দরকার আছে?’ গলা তুলে প্রশ্ন করল সে।

ঝুমকি মাথা নেড়ে না বলল। তারপর সেখান থেকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই আমায় দেখে হাসছিলি কেন রে? খুব বিচ্ছিরি হাসি।’

বিলু থিতিয়ে গেল, ‘হাসছিলাম কোথায়। অবশ্য তোকে দেখতে যেরকম অদ্ভুত লাগছে তাতে না হেসে পারাও যায় না।’

ঝুমকি বলল, ‘কাজ নেই কোন? নিজের কাজে যা না।’

এতগুলো লোকের সামনে ঝুমকির এভাবে কথা বলা মোটেই ভাল লাগল না বিলুর। কিন্তু সে চুপচাপ সরে এল সামনে থেকে। তারপর আবার হিসেবে চোখ রাখল। তার মনে হল অর্ক ঝুমকিকে বেশী খাতির করছে। ওদের তিনজনকে বিনি পয়সায় খাওয়ানোর কি দরকার ছিল। তার বদলে ঝুমকি দুবেলা রান্না করে দেবে, এটা সমান হল? একটা ঠাকুর রাখলে অনেক কম খরচ হতো।

অন্যমনস্ক হয়ে বিলু গলির মুখে চলে এসেছিল। সেখানে নির্মল ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। বিলুকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোদের চাঁদা কত রে?’

‘কিসের চাঁদা?’

‘বারোয়ারি খাওয়ার!’

‘মাথা পিছু পঞ্চাশ টাকা।’

‘কি কি খাওয়াবি?’

‘মাছ মাংস পোলাও কালিয়া।’

‘ভ্যাট! সত্যি কথা বল না।’

‘পঞ্চাশ টাকায় কি খাওয়া যায় জানো না?’

নির্মল মাথা নাড়ল। তারপর নিচু গলায় শুধালো, ‘এটা কি শান্তি কমিটির পয়সায়?’

‘না।’

‘মাইরি কেমন যেন গোলমাল মনে হচ্ছে। ডালমে শালা কালা হ্যায়।’

এই সময় একটা ট্যাক্সিকে ঈশ্বরপুকুর দিয়ে আসতে দেখা গেল। বিলুর নজরে এল অর্ক জানলা দিয়ে হাত নাড়ছে। ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াতেই অর্ক দরজা খুলে নামল, ‘এই বিলু, একটা চেয়ার আনতে পারবি?’

‘চেয়ার কি হবে?’

‘মাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাব।’

বিলু উঁকি মেরে দেখল ট্যাক্সির পেছনে মাধবীলতা হেলান দিয়ে বসেছিল, কথাটা শোনামাত্র সোজা হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘এই না, আমি হেঁটে যাব। চেয়ার আমার দরকার নেই।’ ট্যাক্সির পেছন থেকে পরমহংস আর অনিমেষ নামছিল। বিলু সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিল। অর্কদের ঘরের চাবি যাওয়ার সময় তাকে দিয়ে গিয়েছিল। চটপট তালা খুলে সে চেয়ারটাকে মাথার ওপর তুলে দৌড়ে চলে এল গলির মুখে।

মাধবীলতা তখন নামতে চাইছে কিন্তু অর্ক কিছুতেই নামতে দেবে না। ট্যাক্সিটাকে ঘিরে বেশ ভিড় জমে গেছে। মাস্টারনির চেহারার অবস্থা দেখে সবাই খুব অবাক। বিলু চেয়ারটা দরজার সামনে রেখে বলল, ‘মাসীমা এখন আপনাকে মাটিতে পা দিতে দেব না। নইলে যে রক্ত দিয়েছিলাম সেটা জল হয়ে যাবে।’

মাধবীলতা অবাক হয়ে বিলুর দিকে তাকাতে অর্ক বলল, ‘ও তোমার অপারেশনের সময় রক্ত দিয়েছিল। ও আর কোয়া।’

‘কোয়া? সে কোথায়?’

‘থানায়।’

মুহূর্তেই মাধবীলতার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। অর্ক সেটা লক্ষ্য করে বলল, ‘সে অনেক ব্যাপার, তোমাকে পরে বলব। এসো, আমাকে ধরে নামো।’

খুব সাবধানে মাধবীলতাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চেয়ারে বসানো হল। তারপর অর্ক আর বিলু দুপাশ থেকে তাকে তুলে নিল ওপরে। পেছনে পিল পিল করে বাচ্চারা আসছে। মাধবীলতা লজ্জায় যেন মরে যাচ্ছিল।

একেবারে বিছানা পেতে মাকে শুইয়ে দিয়ে অর্ক বলল, ‘এবার আমি যাচ্ছি, ওদিকে অনেক কাজ পড়ে আছে।’

মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল। এটুকু আসতেই সে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল। পরমহংস অর্ককে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই যে দেখলাম রান্না হচ্ছে, ওটা কি তোমার ব্যবস্থায়?’

‘আমরা সকলে মিলে করছি।’

‘দারুণ ব্যাপার তো। প্রত্যেকে কো-অপারেট করছে?’

‘নিশ্চয়ই। প্রত্যেকের প্রয়োজন মিটবে যেখানে সেখানে তো করবেই।’

বিলুকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘সব ঠিক আছে?’

‘বিলকুল। কিন্তু গুরু, আমার জান তো খতম হয়ে যাচ্ছে।’

‘কেন? খুব খাটতে হয়েছে?’

‘দূর? খাটনিতে আমি ভয় পাই নাকি?’ বিলু পকেট থেকে হিসেবের কাগজটা বের করে দেখাল, ‘কুড়ি থেকে বাইশ দিন চলবে। ম্যাক্সিমাম পঁচিশ দিন। তারপর? এই পাবলিক তো ছিঁড়ে খাবে আমাদের।’

অর্ক হিসেবটা দেখল। সে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না। কিন্তু এখন এই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বসে পড়লে আর কাজ হবে না। সে বলল, ‘ঠিক আছে। এখনও তো পঁচিশ দিন বাকি, এর মধ্যে ভেবে ঠিক করব।’

বিলু বলল, ‘তুমি মাইরি ঝুমকিদের যদি ফোকটে না খেতে দিতে তাহলে হয়তো এটা ম্যানেজ করা যেত। একজন খাটছে তিনজন খাচ্ছে।’

অর্ক বিলুর দিকে তাকাল। কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। কিন্তু সে যখন একবার ঝুমকিকে কথা দিয়ে ফেলেছে তখন আর না বলা যায় না। সে বলল, ‘রান্না করার তো লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। এ মাসটা যাক, সামনের মাস থেকে দেখা যাবে।’

এই সময় ন্যাড়াকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল, ‘বিলুদা। মিল গিয়া!’

বিলু অবাক হয়ে তাকাল, ‘কি?’

পকেট থেকে গোটা পঞ্চাশেক চাকতি বের করল ন্যাড়া। চাকতির গায়ে নম্বর দেওয়া। সেগুলো বিলুর হাতে দিয়ে সে বলল, ‘যারা খাবে তাদের এগুলো দিয়ে দাও। যখন খেতে আসবে এগুলো আমাদের দিলে তবেই খাবার পাবে। আবার খাওয়ার পর ফেরত দিয়ে যাবে। তাহলে আর ফালতু লোক ঢুকতে পারবে না।’

অর্ক অবাক হয়ে বিলুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার?’

বিলু হাসল, ‘একেই ফাণ্ড কম তারপর যদি ফালতু লোক খেতে আসে তাই ন্যাড়া এই মতলব বের করেছে। খারাপ না, কি বল?’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘দূর। তিন নম্বরের সবাইকে আমরা চিনি। তাছাড়া টাকা দিয়ে সবাই যেখানে খাচ্ছে তখন বিনি পয়সায় কেউ খেতে আসবে কেন? এখানকার মানুষ এত ছোট হবে না।’

ন্যাড়া বলল, ‘না না। এখানে সব হতে পারে, বিশ্বাস নেই।’

অর্ক বলল, ‘হলে দেখা যাবে।’

কিন্তু গোলমাল হল না। দশটা থেকে খাওয়া শুরু হল। বারোজন পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। আর সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে তিন নম্বরের লোক তাদের খাওয়া দেখছে। এ নিয়ে হাসাহাসি করছিল কেউ কেউ। কিন্তু বাচ্চাগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে অর্কর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। একটা লোভী ক্ষুধার্ত ছাপ ফুটে উঠেছে ওদের দৃষ্টিতে। তৃপ্তি করে খেল মানুষগুলো। রান্না নাকি চমৎকার হয়েছে। ঝুমকি নিজে পরিবেশন করছিল। প্রথম ব্যাচ হয়ে যাওয়ার পর সে এগিয়ে এল অর্কর কাছে,

‘তুমি খুশি?’

অর্ক চমকে উঠল। তারপর নীরবে মাথা নাড়ল, ‘খুব পরিশ্রম হয়েছে?’

‘এ কিছু না। কাজ করতে গিয়ে কিন্তু আমার খুব ভাল লেগেছে। এতগুলো মানুষকে রান্না করে খাওয়ানোর মধ্যে বেশ তৃপ্তি আছে।’ ঘাম-ঘাম মুখে ঝুমকি হাসল।

অর্কর খেয়াল হল। সে ঝুমকিকে বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে।’

ঝুমকি বলল, ‘কোথায়?’

‘আমি যেখানে বলব সেখানে যেতে আপত্তি আছে?’

‘নিশ্চয়ই। আমি কি ফ্যালনা?’

‘না। খুব দামী।’

কথাটা শোনামাত্র ঝুমকি মুখ নামাল। অর্ক বুঝল, কথাটা বলা খুব অন্যায় হয়ে গেছে। সে পরিবেশটাকে সহজ করার জন্যে বলল, ‘আরে আমি তোমাকে আমার মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছিলাম।’

ঝুমকি অবাক হল। তারপর বলল, ‘পরিচয় তো আছেই।’

‘সেটা মায়ের নিশ্চয়ই মনে নেই। এসো এসো।’

‘কেন?’ ঝুমকি যেন দ্বিধায় পড়েছে।

কেন মানে? আমার মা কি খুব খারাপ?’

ঝুমকি এবার হেসে ফেলল। তারপর আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে অর্কর পেছনে হাঁটতে লাগল। যাওয়ার আগে অর্ক ন্যাড়াকে চেঁচিয়ে বলল, ‘পরের ব্যাচ রেডি কর।’

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অর্ক বলল, ‘মা, এর নাম ঝুমকি। এর ওপর রান্নার ভার।’ মাধবীলতা উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু পরমহংস বাধা দিল, ‘আরে, তুমি উঠছ কেন?’

‘কিছু হবে না।’

‘হলে কিছু করার থাকবে না। আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে। শুয়ে থাকো।’

অনিমেষ মেয়েটিকে দেখছিল। এই মেয়েই সেদিন তাদের রান্না করে দিতে চেয়েছিল। অর্ক বলেছিল এ নাকি ক্যাবারে নাচিয়ে হতে চায়। শরীরের গড়ন ভাল কিন্তু ওই রঙ আর মুখ নিয়ে কি করে ওরকম শখ হয় ভাবা যায় না। অর্ক যখন তাকে বলেছিল ও-ই বারোয়ারি রান্না রাঁধবে তখন অবাক হয়েছিল অনিমেষ। যেন তার হিসেবে কিছুতেই মিলছিল না। পরে ভেবেছে, কি অবস্থায় পড়লে একটা নিম্ন আয়ের বাঙালি মেয়ে ক্যাবারে নাচতে চায়, অর্থ উপার্জন করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। এর জন্যে ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সামাজিক অবস্থাই ওকে এরকম ভাবতে বাধ্য করেছিল। আবার ওই মেয়ে অর্কর কথায় একটি পরিশ্রমসাধ্য কাজে রাজি হল যা থেকে কোন বাড়তি আর্থিক সাহায্য পাবে না। সবটাই রহস্যময়। এমনও হতে পারে মেয়েটা অর্কর প্রেমে পড়েছে। এখন যেটা করছে সেটা ওই মানসিকতা থেকেই। কথাটা মনে হতে সে হেসে ফেলেছিল। ছেলেকে সে যতটা জানে তাতে এসব ব্যাপার গোপনে রাখার ধাত ওর নেই।

অনিমেষ ঝুমকিকে বলল, ‘এসো, ঘরে এসো।’

ঝুমকি ইতস্তত করছিল। ঘরের ভেতর তিনজন মানুষ। এক বস্তীতে থেকেও সে কোনদিন এইভাবে আসেনি। মুখ না তুলে ঝুমকি বলল, ‘থাক, আমি পরে আসব।’

মাধবীলতা বলল, ‘এসো না।’

এবার ঝুমকি এড়াতে পারল না। পায়ে পায়ে খাটের পাশে এসে দাঁড়াতেই পরমহংস উঠে পড়ল, ‘আমি আজ চলি। পরে দেখা হবে।’

‘এখনই চলে যাবে?’ মাধবীলতা তাকাল।

‘এখনই কি? সকাল থেকে তো আছি। আর হ্যাঁ, তোমাদের জন্যে তাহলে আবার ফ্ল্যাট দেখতে বের হই নতুন করে, কি বল?’

এবার অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘দ্যাখো পাও কিনা।’

পরমহংস বলল, ‘এই সব ঝামেলা থেকে একটা লাভ হল কিন্তু।’

‘কি?’ অনিমেষ উঠে দাঁড়াল ক্রাচ টেনে।

‘তুমি এখন সচল হয়েছ। যেভাবে জলপাইগুড়ি থেকে একা চলে এলে, দুবেলা হাসপাতাল করছ তা তো আগে কল্পনা করা যেত না। এখনও মাঝে মাঝে আমার ওখানে আসতে পারো, আড্ডা দেওয়া যাবে। চলি।’

পরমহংসকে এগিয়ে দিতে গেল অনিমেষ। মাধবীলতা ঝুমকিকে এবার বলল, ‘বসো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ওই চেয়ারটায় বসো। ঘরদোর যা করে রেখেছে এরা—।’

‘না না, ঠিক আছে।’

‘তোমার নাম ঝুমকি?’

‘হুঁ।’

‘কোনদিকে থাকো?’

‘ভেতরের দিকে?’

‘আজ কি রেঁধেছ?’

‘খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর তরকারি।’

‘বাঃ। কিন্তু একা দুবেলা রাঁধতে হলে তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে না?’

‘না, এ তো কিছু না।’

‘তবু প্রয়োজন হলে আমাকে বলো। আমি তরকারি কেটে দিতে পারি।’

‘আপনার শরীর তো খুব খারাপ।’

‘এখন আমি ভাল হয়ে গেছি।’

ঝুমকি অর্কর দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি কি খাবেন?’

মাধবীলতা হাসল, ‘কেন, তোমার রান্না খাবো।’

অর্ক বলল, ‘ওটা বাবার ওপর ছেড়ে দাও। বাবা তো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। জানো মা, ঝুমকি কাজ খুঁজে না পেয়ে ক্যাবারে ড্যান্সার হতে চেয়েছিল।’

‘সে কি?’ মাধবীলতা অবাক হয়ে গেল।

আর তখনই দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল ঝুমকি। তার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছিল। শব্দটাকে সে প্রাণপণে চাপতে চাইলেও পারছিল না। মাধবীলতা কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকে দেখে আস্তে আস্তে উঠে বসল। তারপর হাত বাড়িয়ে ঝুমকির বাহু ধরল, ‘এদিকে এস।’ ঝুমকি পাথরের মত তখনও দাঁড়িয়ে, শুধু শরীর কাঁপছে।

মাধবীলতা বলল, ‘তুই এখান থেকে যা, এর সঙ্গে আমার কথা আছে।’

অর্ক হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। ঝুমকি যে কেঁদে উঠবে তা সে কল্পনা করতে পারেনি। এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হবে কে জানতো। মায়ের কথা শোনামাত্র সে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এইভাবে কথাটা না বললেই হতো। সে ঝুমকিকে আঘাত দিতে চায়নি। সরলভাবে মাকে কথাটা জানিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল ঝুমকি এক সময় ভুল করেছিল এখন সামলে নিয়েছে।

তিন নম্বরে বারোয়ারি খাওয়া হচ্ছে। এর ফলে স্বল্প আয়ের মানুষদের খুব উপকার হচ্ছে। এই খবরটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। দুপুরবেলায় সতীশদা এল খোঁজ নিতে।

‘তুমি তাহলে আরম্ভ করলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘পারবে শেষ পর্যন্ত।’

‘দেখি।’

‘বেশ। যদি আমার কোন সাহায্য দরকার থাকে বলো।’

‘আচ্ছা।’

‘তুমি কি শান্তি কমিটিতে যাবে না?’

‘কে বলল যাবো না? আসলে এই ব্যাপারটা সামলে আর সময় পাচ্ছি না। তবে কোন জরুরী দরকার থাকলে, আপনি বলবেন নিশ্চয়ই যাবো।’

‘তুমি আমাদের পার্টি অফিসে আসবে না?’

‘পার্টি অফিস?’

‘তোমার সঙ্গে আমার সেই রকম কথা হয়েছিল।’

‘আমি এখনও ভাবিনি।’

‘ভাবো।’

‘এখন শান্তি কমিটি কাজ করছে। এই সময়ে পৃথক করে আপনারা পার্টির কাজ করবেন?’

‘শান্তি কমিটি একটা সাময়িক ব্যাপার। শান্তি কমিটি কাজ করছে। রাজনৈতিক ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। পার্টি এবং শান্তি কমিটির তাছাড়া পাড়ার সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজের ক্ষেত্র তাই সম্পূর্ণ পৃথক। তাই না?’

সতীশদার কথা মাথায় ঢুকছিল না অর্কর। কংগ্রেস এবং সি পি এম যদি এখন সক্রিয় হয়ে কাজ শুরু করে তাহলে শান্তি কমিটি ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। সেক্ষেত্রে আবার সমাজবিরোধীরা প্রশ্রয় পাবে। তারা এসে পার্টির ছায়ায় আশ্রয় নেবে। অর্কর মনে হচ্ছিল সতীশদারা পার্টির কথা যতটা চিন্তা করেন সমাজের কথা ততটা না। সতীশদারা হয়তো সেই অর্থে সমাজবিরোধী নন কিন্তু সমাজ-এর বন্ধু বলেও মনে হয় না।

কিন্তু এইসব চিন্তা নিয়ে মগ্ন থাকার সময় ছিল না অর্কর। তিন নম্বরের অনেক পরিবার থেকে ক্রমাগত চাপ আসছিল। মোটামুটি দুবেলা যাদের খাবার জোটে তারাও এই বারোয়ারি ব্যবস্থায় যোগ দিতে চাইছিল। এর ফলে এখনই কিছু অর্থ যদিও পাওয়া যাবে কিন্তু ঝুঁকিটা বেড়ে যাবে অনেক। অথচ কাউকে না বলতে অনেক অসুবিধে আছে।

অনিমেষের সঙ্গে কথা বলে অর্ক একটা সিদ্ধান্তে এল। তিন নম্বরের যেসব পরিবার এই ব্যবস্থায় যোগ দিতে চায় তাদের সক্রিয় অংশ নিতে হবে। অন্তত প্রত্যেক পরিবার থেকে একজনকে এগিয়ে আসতে হবে কাজে।

খুব দ্রুত যে কয়টি পরিবর্তন দেখা দিল তা হল, বস্তির পরিবেশ অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। এখন আর দিনরাত সেই খিস্তি খেউড় শোনা যায় না। মাতলামিটা সম্পূর্ণ বন্ধ। তাছাড়া প্রত্যেকের পরিবারের সঙ্গে বেশ ভাই ভাই এবং বন্ধুর সম্পর্ক তৈরি হতে চলেছে।

অর্ক বুঝতে পারছিল তিন নম্বরের এই সব পরিবার তার ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। এই ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। যে করেই হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *