অষ্টম পরিচ্ছেদ
১.
সুখী হওয়াটা অনেকের কাছে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাদের কাছে সুখী হওয়ার মানেই এক মিথ্যা আত্মপ্রসাদে মগ্ন হয়ে পড়া। সুখ অনেক সময় জীবনের এমন একটা ভ্রান্ত দিক হয়ে দাঁড়ায়, যে দিকে গেলে মানুষ জীবনের আসল দিকটার কথা ভুলে যায়, জীবনের অন্য সব কর্তব্যের কথা ভুলে যায়।
তবু এজন্য দোষ দেওয়া যায় না মেরিয়াসকে। বিয়ের আগে সে মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত সম্বন্ধে কিছু জানতে চায়নি। বিয়ের পরেও সে জাঁ ভলজাঁ’র কতকগুলি জ্ঞাতব্য বিষয় সম্পর্কে ভয়ে কোনও প্রশ্ন করেনি। তাই ভলজাঁ’র কাছ থেকে তার স্বীকারোক্তি শোনার পর তার মনে হল সে ভলজাঁকে নিয়মিত তাদের বাড়িতে কসেত্তের সঙ্গে দেখা করতে আসার অনুমতি দিয়ে ভুল করেছে। সে তার কোনও কথা কসেত্তেকে বা অন্য কাউকে বলবে না প্রতিশ্রুতি দিয়েও ভুল করেছে বলে মনে হল তার।
সে তাই ধীরে ধীরে কৌশলে ভলজাঁকে তাদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করল। তার আসা বন্ধ করে দিল। ভলজাঁ আর কসেত্তে’র মাঝখানে ক্রমশ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে কসেত্তে’র মন থেকে ভলজাঁকে একেবারে অপসারিত করার চেষ্টা করতে লাগল।
এ ব্যাপারে যা কিছু প্রয়োজনীয়, যা কিছু ন্যায়সঙ্গত বলে ভাবতে লাগল তা-ই করে যেতে লাগল সে। একটা মামলার ব্যাপারে সে একসময় লাফায়েত্তে ব্যাঙ্কের এক কর্মচারীর সংস্পর্শে আসে। তার কাছে সে কিছু দরকারি তথ্য পায়। কিন্তু তার ওপর ভিত্তি করে সে কোনও খোঁজখবর নিতে পারেনি বা বেশি দূরে সে ব্যাপারে এগোতে পারেনি। কারণ সে ভলজাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এ বিষয়ে আর সে ঘাটাঘাটি করবে না। তাছাড়া ভলজাঁ’র বিপজ্জনক অবস্থা দেখেও সে সাহস পায়নি। এই সময়ে সে ভলজাঁর দেওয়া ছয় লক্ষ ফ্রাঁ অন্য একজনের নামে রাখার ব্যবস্থা করছিল। কিন্তু তার নাম-ধাম ভালো করে জানার জন্য অপেক্ষা করছিল। ইতোমধ্যে সে টাকায় সে হাত দেয়নি।
এ বিষয়ে কসেত্তেকে দোষ দেওয়া যায় না। সে এই সব গোপন কথার কিছু জানত না। তার ওপর মেরিয়াসের প্রভাব এমনই বেশি ছিল যে মেরিয়াসের ইচ্ছা ও চিন্তাভাবনার বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে কিছু ভাবতে পারত না। ভলজাঁর ব্যাপারে মেরিয়াস যা বলত, যা ঠিক করত, সে অন্ধভাবে তাই সমর্থন করতে। কোনও কারণ জানতে চাইত না। মেরিয়াসের সত্তার মধ্যে তার সত্তা এমনভাবে মিশে যায় যে মেরিয়াসের মন থেকে যা মুছে যেত, তা তার মন থেকেও আপনা থেকে অবলুপ্ত হয়ে যেত। তার জন্য কোনও চেষ্টা করতে হত না তাকে।
তবে ভলজাঁ’র কথাটা কসেত্তে ভুলে গেলেও সে বিস্মৃতি তার মনের উপরিপৃষ্ঠের মধ্যেই ছিল সীমায়িত। সে বিস্মৃতি তার মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি। অন্তরে সে ভলজাঁকে ভালোবাসত তখনও। তার কথা ভাবত। যাকে সে এতদিন বাবা বলে এসেছে এবং যার কাছ থেকে পিতামাতার স্নেহ, আদর নয় বছর ধরে লাভ করে এসেছে, তার স্মৃতিটা সে একেবারে মুছে ফেলতে পারেনি তার অন্তর থেকে।
মেরিয়াসের কাছে ভলজাঁ’র কথা প্রায়ই তুলঁত কসেত্তে। তার দীর্ঘ অনুপস্থিতির জন্য বিস্ময় প্রকাশ করত। কিন্তু মেরিয়াস তাকে বলত, ভলজাঁ এখন এখানে নেই। বাইরে গেছে বলেই সে আসতে পারেনি। কসেত্তে জানত, মাঝে মাঝে বাইরে যেত ভলজাঁ। কিন্তু এতদিন সে তার আগে কখনও থাকেনি বাইরে।
এর মধ্যে কসেত্তেকে নিয়ে একবার ভার্নলে যায় মেরিয়াস। সেখানে তার বাবা কর্নেল পঁতমার্সির কবরটা দেখিয়ে আনে তাকে। এইভাবে ভলজাঁ’র কথাটা ভুলিয়ে দেয় কসেত্তেকে।
বৃদ্ধদের প্রতি যুবক-যুবতীদের এই অকৃতজ্ঞতার প্রতিরূপ প্রকৃতিজগতেও দেখতে পাই আমরা। আমরা দেখতে পাই পত্ৰসবুজ সজীব শাখাপ্রশাখাগুলো বৃক্ষকাকে ছেড়ে আলো আর হাওয়ার বাইরের দিকে এগিয়ে চলে। যুবক-যুবতীরাও তেমনি বৃদ্ধদের ছেড়ে আনন্দ, উৎসব, আলো আর প্রেমের সন্ধানে বাইরের দিকে ছুটে চলে। বৃদ্ধরা তাদের। জীবনটাকে ক্রমশই গুটিয়ে এনে শুধু মৃত্যুচিন্তা আর অবক্ষয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে সে জীবনকে। ফলে বৃদ্ধ আর যুবক, প্রাচীন আর নবীনদের মধ্যে ব্যবধানটা কমার পরিবর্তে বেড়ে যায় দিনে দিনে।
.
২.
একদিন সন্ধ্যার দিকে ভলজাঁ তার বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে সামনের রাস্তাটা ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল তার। সে বাড়ির কাছে একটা পাথরের উপর বসে পড়ল। গত ৫ জুন রাত্রিতে এই পাথরটায় বসে থাকাকালেই গাভ্রোশের সঙ্গে দেখা হয় তার। সেখানে মিনিটকতক বসে থাকার পর আবার সে বাড়ির ভেতর ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে তার ঘরে ফিরে গেল।
পরদিন সে আর তার ঘর থেকে বার হল না। তার পরদিন বিছানা ছেড়েই উঠল না। বাসা থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়ির দারোয়ান ভলজাঁ’র খাবার রান্না করে দিয়ে যেত। তার খাবার বলতে ছিল কিছু শুয়োরের মাংস, বাঁধাকপি অথবা কিছু আলু। সেদিন দুপুরে দারোয়ান ভলজাঁ’র খাবার দিতে এসে আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল, আপনি তো কালকের খাবার কিছুই খাননি। দেখল, তার খাবারের প্লেটটা যেমন ছিল তেমনিই রয়েছে।
দারোয়ান বলল, এ কী, গতকাল যে খাবার দিয়েছিলাম তা খাননি?
ভলজাঁ বলল, হ্যাঁ খেয়েছি।
প্লেটটা যেমন ছিল তেমনিই রয়ে গেছে।
কিন্তু জলের মগটা দেখ, সেটা খালি।
তার মানে আপনি শুধু জল খেয়েছেন, আর কিছু খাননি।
তার মানে আমার শুধু জলেরই দরকার ছিল। কিছু খাবার ইচ্ছা ছিল না।
কিছু যদি খাবার ইচ্ছা না থাকে তা হলে আপনার নিশ্চয় জ্বর হয়েছে।
আমি আগামীকাল কিছু খাব।
আজ না খেয়ে কাল খাবেন কেন? নতুন আলুগুলো কত ভালো ছিল।
আমি কথা দিচ্ছি ওগুলো খাব।
আমার কিন্তু মোটেই ভালো লাগছে না।
ভলজাঁ যে বাসায় থাকে সে বাসায় কেউ আসে না। ঘরে কোনও লোক নেই। কিছুদিন আগে সে বাইরে বেরিয়ে দোকান থেকে একটা তামার ক্রস কিনে এনে দেয়ালে এঁটে রাখে। সেইটার দিকে প্রায়ই তাকাত।
সে সপ্তায় ভলজাঁ একদিনও ঘর ছেড়ে বাইরে বার হল না।
দারোয়ান তার স্ত্রীকে বলল, ভদ্রলোক ওঠে না, কিছু খায় না। এমন ভাবে ও ক’দিন বাঁচবে! আমার মনে হয় খুব একটা দুঃখ পেয়েছে। আমার মনে হয় মেয়ের বিয়েটা ভালো হয়নি।
তার স্ত্রী বলল, ভদ্রলোকের যদি পয়সা থাকে, ডাক্তার ডাকবে আর যদি পয়সা না থাকে তা হলে মারা যাবে।
দারোয়ান একদিন রাস্তা দিয়ে এক স্থানীয় ডাক্তারকে যেতে দেখে ডেকে এনে ভলজাঁ’র ঘরে পাঠিয়ে দিল। ডাক্তার ভলজাঁকে দেখে ফিরে এলে দারোয়ান জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?
উনি তো বললেন ভালো আছেন। তবে দেখে মনে হল, উনি ওঁর জীবনের কোনও একান্ত প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। এই ধরনের আঘাতে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আপনি আবার একবার আসবেন?
আসব। তবে ডাক্তারদের থেকে ওঁর এখন আপনার মতো লোকের দরকার।
.
৩.
একদিন সন্ধ্যাবেলায় ভলজাঁ বিছানার উপর অতিকষ্টে উঠে বসল। তার নাড়ির স্পন্দন এত কমে গেছে যে সে তা অনুভব করতে পারছিল না। সে বুঝল, আগের থেকে সে অনেক বেশি দুর্বল হয়ে গেছে। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সে হাঁপাচ্ছিল। সে উঠে কোনওরকমে শ্রমিকের পোশাকটা পরল। আজকাল সে রাত্রিতে ঘুরতে বার হয় না বলে এ পোশাক আর পরে না। পোশাকটা পরতে গিয়ে তার ঘাম বেরিয়ে গেল।
কাঠের টুলের উপর রাখা বাক্স থেকে কসেত্তে’র পোশাকগুলো বার করে বিছানার উপর ছড়িয়ে রাখল। বাতি রাখার জায়গায় বিশপের যে বাতিদান দুটো ছিল রাতে ড্রয়ার থেকে দুটো মোমবাতি বার করে জ্বেলে দিল। ঘরের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে যেতে হলেও তাকে মাঝে মাঝে বসে বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল। সে বুঝল এটা সাধারণ ক্লান্তি নয়, সে ক্লান্তি তাড়াতাড়ি কেটে যায়। এ হচ্ছে তার ক্ষয়িষ্ণু প্রাণশক্তির এমনই অভাব, যা আর কোনওদিন পূরণ হবে না।
বড় আয়নাটার উল্টো দিকে একটা চেয়ারে বসল সে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখে সে যেন চিনতেই পারছিল না। তাকে দেখে এখন আশির উপর বয়স বলে মনে হচ্ছিল। অথচ কসেত্তে’র বিয়ের আগে তাকে দেখে পঞ্চাশের বেশি বয়স বলে মনে হত না। তার কপালে যে কুঞ্চনের রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তাতে মৃত্যুর ছায়া ফুটে উঠেছিল। এক-একটা রেখা যেন মৃত্যুর এক-একটা নিষ্ঠুর আঙুল। তার গাল দুটো ঝুলে গেছে। গায়ের চামড়ার রংটা কবরের মাটির মতো দেখাচ্ছিল।
এই অবস্থায় একটি চিঠি লেখার জন্য সে কাগজ-কলম বার করল। তার পিপাসা পেয়েছিল। কিন্তু জলের জগটা ধরে জল খেতে গেলে জগটা পড়ে গেল। হাতটা কাঁপছিল। লিখতে গিয়ে দেখল দোয়াতে কালি শুকিয়ে গেছে। কয়েক ফোঁটা জল দিয়ে। কালিটা ভিজিয়ে সে কলমটা তুলে নিয়ে অতিকষ্টে লিখতে লাগল। লিখতে লিখতে কপালের ঘাম মুছতে লাগল সে। হাতটা কাঁপছিল। সে লিখল,
কসেত্তে, আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি। একটা কথা তোমাকে বলা দরকার। আমাকে দূরে চলে যেতে হবে একথাটা আমায় বুঝিয়ে দিয়ে তোমার স্বামী ঠিকই করেছে। সে যা ভেবেছিল তা ঠিক না হলেও সে ঠিকই করেছে। সে ভালো লোক। আমার মৃত্যুর পরেও তাকে ভালোবেসে যাবে।
মঁসিয়ে পঁতমার্সি, তুমিও আমার প্রিয় সন্তান কসেত্তেকে ভালোবেসে যাবে। আমি টাকাটা কোথা থেকে পেয়েছি, কিভাবে রোজগার করেছি, সেই কথা বলার জন্যই এই। চিঠি লিখছি। ও টাকা তোমার নিজস্ব। মন্ত্রিউলে আমার যে কাঁচের কারখানা ছিল তাতে স্বচ্ছ পাথরের মতো এক ধরনের কাঁচ তৈরি হত, যা ধাতুর তৈরি জিনিসপত্রে ও সোনার গয়নায় লাগে। এ কাঁচ স্পেনে খুব বিক্রি হত। এই কাঁচ তৈরির জন্য তার উপাদান আগে নরওয়ে, ইংল্যান্ড ও জার্মানি থেকে আমদানি করতে অনেক খরচ হত। কিন্তু আমি সে উপাদান নকল করে ফ্রান্সেই তৈরি করি এবং তাতে অনেক খরচ বেঁচে যায়।….
আর লিখতে পারল না ভলজাঁ। সে বিছানায় উপর ঢলে পড়ল। হাতে মাথাটা রেখে কাঁদতে লাগল সে। একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া সে মর্মভেদী সকরুণ কান্না শোনার আর কেউ ছিল না সেখানে। কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে সে বলে যেতে লাগল, হায়, আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল। এক উজ্জ্বল হাসির আলো হয়ে সে আমার জীবনে এসেছিল এবং সে আমার জীবন থেকে চিরদিনের মতো চলে গেল। মৃত্যুর সময় শেষবারের মতো দেখা হল না তার সঙ্গে। মৃত্যুটা কিছুই নয় আমার কাছে। কিন্তু মৃত্যুকালে তার সঙ্গে দেখা না হওয়াটা কী ভয়ঙ্কর! সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসত, দুটো কথা বলত, তাতে কার কী ক্ষতি হত? কিন্তু এখন সবকিছু শেষ হয়ে গেল। আর তাকে আমি দেখতে পাব না।
ঠিক এই সময় তার ঘরের দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনতে পেল সে।
.
৪.
সেইদিনই রাতে খাওয়ার পর মেরিয়াস যখন তার পড়ার ঘরে মামলার কাগজপত্র দেখছিল তখন বাস্ক একটা চিঠি এনে তার হাতে দিল। বলল, এ চিঠির লেখক হলঘরে অপেক্ষা করছে। এক একটা চিঠিও এক একজন মানুষের মতো দেখতে কুৎসিত হয়। সে চিঠি দেখলেই বিরক্তি আসে।
মেরিয়াস তার হাতে যে চিঠিটা পেল সেটাও ছিল এমনি এক ধরনের চিঠি। চিঠিটা থেকে তামাকের গন্ধ আসছিল। চিঠিটার উপর লেখা আছে, লে ব্যারন পঁতমার্সিকে।
চিঠিটা থেকে তামাকের গন্ধ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা কথা মনে পড়ে তার। চিঠিতে তামাকের গন্ধ, বাজে কাগজ, ভাঁজ করার পদ্ধতি, জলো কালি, সব মিলিয়ে জনদ্ৰেত্তে’র সেই ঘরটার কথা মনে পড়ছিল তার।
মেরিয়াস ভাবল, সে দু জন লোককে খুঁজছিল। ঘটনাক্রমে তাদের দু জনের একজন স্বেচ্ছায় এসে গেছে তার কাছে। তার মানে পত্ৰলেখক থেনার্দিয়ের ছাড়া আর কেউ নয়।
চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল মেরিয়াস।
মঁসিয়ে লে ব্যারন,
ঈশ্বর যদি আমাকে উপযুক্ত প্রতিভা দান করতেন তা হলে আমি আকাঁদেমি দে সায়েন্সের সদস্য ব্যারন থেনার্দ হতে পারতাম। আমি তার নাম বহন করছি। এই কথা বিবেচনা করে যদি আপনি আমাকে কিঞ্চিৎ অনুগ্রহ করেন তা হলে বিশেষ সুখী ও বাধিত হব। আপনি আমার প্রতি যে দয়া প্রদর্শন করবেন আমি তার অবশ্যই প্রতিদান দেব। আপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি সম্বন্ধে এক গোপনীয় তথ্য আমি জানি এবং সে তথ্য আপনার কাজে লাগতে পারে। সে বাড়িতে মাদাম লা ব্যারনীর মতো উচ্চ অভিজাতবংশীয়া মহিলা থাকেন সে বাড়িতে ওই ধরনের লোক থাকা কোনও মতেই উচিত নয় এবং এ লোককে কিভাবে তাড়াতে হবে বাড়ি থেকে সে উপায় আমি বলে দেব। পাপ এবং পুণ্য কখনও এক বাড়িতে থাকতে পারে না। আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম। ইতি–
সশ্রদ্ধ নমস্কারান্তে থেনার্দ।
থেনার্দিয়ের নামটা কিছু সংক্ষিপ্ত করে থেনার্দ করা হয়েছে। কিন্তু তা করা হলেও চিঠির ভাষা আর লেখার ভঙ্গিমা দেখে এ চিঠি কার লেখা, তা বুঝতে বাকি রইল না মেরিয়াসের।
মেরিয়াস ভাবল একজনকে পেয়ে গেল। একটা দিকে নিশ্চিন্ত হল সে। তার বাবার উদ্ধারকর্তাকে পেয়ে গেল। এবার যদি সে তার উদ্ধারকর্তাকে পেয়ে যায় তা হলে তার জীবন একেবারে মুক্ত হবে সব চিন্তা থেকে। সে ড্রয়ার থেকে ব্যাংকনোট বার করে তার পকেটে ভরে রাখল। তার পর ঘণ্টা বাজিয়ে বাস্ককে ডাকল।
বাস্ক এলে তাকে বলল, ভদ্রলোককে এখানে নিয়ে এস।
বাস্ক ঘোষণা করল, মঁসিয়ে থেনার্দ এসে গেছেন।
তাকে দেখে চিনতেই পারছিল না মেরিয়াস। মাথায় পাকা চুল, বড় নাক, চোখে চশমা, থুতনিটা সরু হয়ে বেঁকে গেছে। পরনে কালো ছেঁড়া পোশাক। কোমরে ঝোলানো একটা ঘড়ির কার ছিল। তার একটা পুরনো টুপি ছিল। তার পেটটা বাঁকা থাকায় সে কুঁজো হয়ে হাঁটছিল।
থেনার্দিয়ের যে পোশাকটা পরেছিল সে পোশাকটার দিকে প্রথম দৃষ্টি আকৃষ্ট হল মেরিয়াসের। পোশাকটা তার গায়ে বড় হচ্ছিল এবং বেশ বোঝা যাচ্ছিল সেটা তার নয়। তার চেহারাটা আগের তুলঁনায় পাল্টে যাওয়ায় তাকে ঠিক চিনতে না পারলেও তার নামসইটা দেখে এবং চিঠিটা পরীক্ষা করে সে যে থেনার্দিয়ের এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না তার।
সেকালে আর্শেনালের কাছে একজন ইহুদি পুরনো পোশাকের এক ব্যবসা খুলেছিল। সেখানে প্রতিদিন তিরিশ স্যু’র বিনিময়ে পোশক ভাড়া পাওয়া যেত। সে পোশাক পরে অনেক দুবৃত্ত প্রকৃতির লোকও দু-একদিনের জন্য সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক সাজতে পারত। অনেক চোর সেই দোকানটায় গিয়ে তিরিশ স্যু জমা দিয়ে তার পছন্দমতো এক সাজ-পোশাক বেছে নিয়ে পরে চলে যেত। পরের দিন সে পোশাকটা ফেরত দিয়ে যেত। কিন্তু মুশকিল হত এই যে পোশাকটা প্রায় লোকেরই গায়ের সঙ্গে খাপ খেত না।
মেরিয়াস এই পোশাক ভাড়ার ব্যাপারটা জানত না বলে এ লোক থেনার্দিয়ের নয় বলে সন্দেহ জাগল তার মনে। সে হতাশ হল।
লোকটা তার সামনে এসে খুব নত হল।
মেরিয়াস কড়াভাবে জিজ্ঞাসা করল, কী চাও তুমি?
আগন্তুক কুমিরের হাসির মতো মুখটা অদ্ভুতভাবে বিকৃত করল। তার পর বলল, আমি মঁসিয়ে লে ব্যারনকে এর আগে প্রিন্সেস বাগ্রেশন, ভিক্টোতে সাষ্ট্রে প্রভৃতি অভিজাত সমাজের ব্যক্তিদের বাড়িতে দেখিনি একথা বিশ্বাস করতেই পারছি না।
অভিজাত সমাজের যে সব লোকদের সঙ্গে কোনও পরিচয় নেই তাদের সঙ্গে পরিচয়ের ভান করা ভণ্ড প্রতারকদের এক ছলনাময় কৌশল।
মেরিয়াস মন দিয়ে তার কণ্ঠস্বরটা শুনতে লাগল। কিন্তু তার নাকি সুরের কথাগুলো থেনার্দিয়েরের শুষ্ক নীরস কণ্ঠস্বর থেকে একেবারে আলাদা। মেরিয়াস বলল, আমি ওদের কাউকেই চিনি না।
মেরিয়াসের চোখমুখের কড়াভাব দেখেও কিছুমাত্র দমে না গিয়ে আগন্তুক বলতে লাগল, হা, হ্যাঁ, হয়তো শ্যাতোব্রিয়াৰ্দের বাড়িতে দেখেছি আপনাকে। তিনি আমাকে মদপানের জন্য তার বাড়িতে যেতে বলেন।
মেরিয়াস এবার ভ্রুকুটি করে বলল, আমি শ্যাতোব্রিয়াকেও চিনি না। তুমি কি আসল কথাটা বলবে? আমি কী করতে পারি তোমার জন্য?
আগের মতোই মাথাটা নত করে আগন্তুক বলতে লাগল, আপনি অন্তত দয়া করে আমার কথাটা মন দিয়ে শুনতে পারেন। আমেরিকার পানামা অঞ্চলে লা বোয়া নামে একটা গাঁ আছে। সে গাঁয়ে একটা মাত্র বাড়ি আছে। রোদে পোড়ানো ইট দিয়ে তৈরি তিনতলা সেই বাড়িটা বেশ বড় এবং বর্গক্ষেত্রাকার। বাড়িটার এক-একদিকের দেয়ালগুলো পাঁচশো ফুট করে লম্বা। ভেতরের উঠোনটায় অনেক মালপত্র জমা করা আছে। বাড়িটাতে কোনও ঘরে কোনও জানালা নেই। শুধু বাতাস চলাচলের জন্য কিছু ফুটো আছে। কোনও দরজাও নেই; দরজার পরিবর্তে মই আছে। একতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত মই আছে এবং দোতলা থেকে তিনতলা পর্যন্তও মই আছে। ভেতরের দিকে উঠোন থেকে দোতলা-তিনতলায় যাবার জন্যও মই আছে। রাত্রিতে মইগুলো তুলে নেওয়া হয়। তাই বাড়িটা দিনে বাড়ি এবং রাত্রিতে দুর্গের মতো হয়ে ওঠে এবং তার মধ্যে আটশো লোক বাস করে। সেই বাড়িটাই একটা গোটা গা। তবে আপনি বলতে পারেন বাড়িটাতে এত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রয়োজন কী? তার কারণ হল এই যে, ওই অঞ্চলটায় বহু নরখাদকের বাস। আপনি বলতে পারেন কেন তা হলে ওখানে সভ্য জগতের লোকেরা যায়? যায় এইজন্য যে ওখানে অনেক সোনা পাওয়া যায়।
ক্রমেই অধৈর্য হয়ে পড়ছিল মেরিয়াস। সে বলল, এসব কথা আমাকে বলছ কেন?
বলছি এই জন্য যে আমি একজন ক্লান্ত ও অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ। রাষ্ট্রদূতের কাজ করেছি বহু জায়গায়। আধুনিক সভ্যতা পীড়াদায়ক আমার পক্ষে। আমি তাই ওই সব বন্য বর্বর আদিবাসীদের সঙ্গে বাস করতে চাই।
কিন্তু তাতে কী হয়েছে?
অহঙ্কারই জীবনের ধর্ম মঁসিয়ে লে ব্যারন। সব আপন আপন স্বার্থপূরণ আর অহঙ্কার নিয়ে যখন শহরের ধনী ব্যক্তিরা ঘোড়ার গাড়িতে করে মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া পথের উপর দিয়ে যায় তখন চাষিরা সেদিকে তাকায় না। সকলেই আপন স্বার্থ আর সম্পদে মত্ত হয়ে আছে।
এই স্বার্থপূরণ ও সম্পদের জন্য চাই টাকা।
কিন্তু তুমি আসল কথাটা বলনি এখনও।
আমি লা বোয়াতে বসবাস করতে চাই। আমরা মানে তিনজন–আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার অতি সুন্দরী এক কন্যা।
তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?
বহু দূর দেশ। সেখানে যেতে অনেক খরচ। আমার কিছু টাকার দরকার।
আমি তার কী করতে পারি?
শকুনির মতো ঘাড়টা বাড়িয়ে লোকটা হাসিমুখে বলল, মঁসিয়ে আমার চিঠিটা পড়েছেন?
আসলে হাতের লেখাটার দিকে নজর দিতে গিয়ে চিঠিটা ভালো করে পড়া হয়নি মেরিয়াসের। তাছাড়া লোকটা যখন বলল, তার স্ত্রী আর মেয়ে আছে তখন তার আশা হল। ভাবল, লোকটা হয়তো থেনার্দিয়েরই হবে।
তাই তার কথাটার জবাব না দিয়ে মেরিয়াস বলল, আর কিছু তোমার বলা আছে? ঠিক আছে মঁসিয়ে লে ব্যারন। আমার কাছে একটা গোপন তথ্য আছে। সেটা আমি বিক্রি করতে পারি।
সে তথ্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি আছে?
হ্যাঁ, কিছুটা আছে।
ঠিক আছে, কী সে তথ্য তা বল।
আমার মনে হয় এ বিষয়ে আপনি অবশ্যই আগ্রহান্বিত হবেন।
ঠিক আছে।
মঁসিয়ে, আপনি একজন চোর আর নরঘাতকের সঙ্গে বাস করছেন।
আমার কাছে এমন কেউ থাকে না।
এতে কিছুটা বিচলিত হয়ে আগন্তুক লোকটা বলতে লাগল, একটা চোর এবং নরঘাতক। আমি তার অতীতের অপরাধ ও পাপকর্মের কথা বলছি না। সেটা আইনের ব্যাপার। সেসব হয় আইনের দিক থেকে বাতিল বা খারিজ হয়ে গেছে এবং তা হয়তো অনুশোচনার দ্বারা স্খলন হয়ে গেছে। কিন্তু সম্প্রতি সে যা করেছে তা এখনও আইনের চোখে ধরা পড়েনি। এই লোকটা কৌশলে আপনার বিশ্বাস অর্জন করে এক অন্য নাম ধারণ করে আপনার পরিবারের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমি তার আসল নামটা বলব আপনাকে।
ঠিক আছে, আমি শুনছি।
তার নাম জাঁ ভলজাঁ।
আমি তা জানি।
আমি বলব সে কী প্রকৃতির লোক।
বল।
সে এক জেলপলাতক কয়েদি।
আমি তা-ও জানি।
আমি বললাম বলেই তা জানলেন।
না, আমি আগেই তা জেনেছি।
মেরিয়াসের কণ্ঠস্বরের নীরস ভাষা এবং তার ঔদাসীন্য দেখে দমে গেল আগন্তুক। এক প্রবল রাগে জ্বলে উঠল তার চোখ দুটো। সে একবার মেরিয়াসের দিকে কটাক্ষপাত করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। তার চোখের মাঝে একরাশ নারকীয় আগুন জ্বলে উঠেই আবার নিবে গেল মুহূর্তে।
আগন্তুক মৃদু হেসে বলতে লাগল, আমি আপনার কথা অস্বীকার বা খণ্ডন করতে চাইছি না মঁসিয়ে লে ব্যারন। তবে যাই হোক, আপনি দেখেছেন আমি অনেক তথ্য জানি। আমি যে কথা বলতে এসেছি সেকথা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। সেটা হচ্ছে মাদাম লা ব্যারনীর সম্পত্তি সম্পর্কিত। এটা কিন্তু মূল্যবান এক গোপন তথ্য এবং এটা আমি কুড়ি হাজার ফ্রাঁ নিয়ে বিক্রি করব।
আগের তথ্যগুলো যেমন আমার সব জানা তেমনি তোমার এ তথ্যও আমি জানি।
আগন্তুক তার দামটা কমানো যুক্তিসঙ্গত মনে করে বলল, তা হলে দশ হাজার দেবেন।
আমি বলছি, নতুন কিছু বলার তোমার নেই। আমি আগেই সব জেনে ফেলেছি।
কিন্তু আমাকে যেতে হবে মঁসিয়ে লে ব্যারন। দয়া করে আমার এই গোপন তথ্যটি অন্তত দশ ফ্রাঁ দিয়ে কিনে নিন।
তার মুখের ভাবটা একেবারে পাল্টে গিয়েছিল।
মেরিয়াস বলল, আমি যেমন জাঁ ভলজাঁ’র নাম জানি তেমনি তোমার নামও জানি।
সেটা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়, আমার চিঠিতে আমার নাম লেখা ছিল। থেনার্দ নামটা স্বাক্ষরে ছিল।
কিন্তু তোমার নামের সবটা লেখনি।
তা হলে সেটা কী?
থেনার্দিয়ের।
সে আবার কে?
বিপদে পড়ে শজারুরা যে এমন গায়ের কাঁটাগুলোকে খাড়া করে তোলে, থেনার্দিয়ের তেমনি বিপদে পড়ে ভয় না পেয়ে হাসতে লাগল।
মেরিয়াস বলল, তুমি শুধু থেনার্দিয়ের নও, তুমি শ্রমিক জনদ্ৰেত্তে, অভিনেতা ফাবান্ত, কবি জেনফ্লট, স্পেনদেশীয় ভন আলজারেজ এবং বিধবা বলিৰ্জাদ। এক সময় মঁতফারমেলে একটা হোটেল ছিল তোমার।
হোটেল? কখনও না।
তোমার আসল নাম হল থেনার্দিয়ের।
আমি তা অস্বীকার করছি।
তুমি একটা পাকা জুয়োচোর এবং দুবৃত্ত। তবু এই নাও। এই নিয়ে চলে যাও।
এই বলে সে পকেট থেকে একটা নোট বার করে দিল।
থেনার্দিয়ের তা নিয়ে দেখল, পাঁচশো ফ্রাঁ। সে বলল, ধনবাদ, ধন্যবাদ মঁসিয়ে। কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেল।
এবার সে তার সব ছদ্মবেশ খুলে ফেলল। তার ঢোলমতো কোট, নকল বড় নাক, সবুজ চশমা সব খুলে ফেলতে তার কপালে কতকগুলি কুঞ্চিত রেখা দেখা গেল।
এবার নাকি সুরের কথা ছেড়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, সত্যিই আপনি সম্ভ্রান্ত মঁসিয়ে লে ব্যারন। আমিই থেনার্দিয়ের।
এবার সে কুঁজো ভাবটা কাটিয়ে সোজা হয়ে বসল।
এটা সত্যিই আশা করতে পারেনি থেনার্দিয়ের। গোপন তথ্য জানিয়ে দিয়ে মেরিয়াসকে বিস্ময়ে তাক লাগিয়ে দিতে এসে নিজেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। যেসব কথা বলতে এসেছিল সেসব কথা মেরিয়াস আগে হতে জেনে ফেলায় সে অপমানিত বোধ করে। তবে সে অপমানের পুরস্কারস্বরূপ পাঁচ শো ফ্রা’র নোট পেয়ে যাওয়ায় তার বিস্ময় আরও বেড়ে যায়।
ব্যারন মার্সিকে জীবনে সে প্রথম দেখছে। সে যে মেরিয়াস এটা সে বুঝতে পারেনি। তাকে চিনতে পারেনি। তবু ব্যারন পঁতমার্সি তার ছদ্মবেশ সত্ত্বেও তাকে চিনতে পেরেছে। সে ভলজাঁ সম্বন্ধেও সবকিছু জানে। দাড়িহীন এই যুবক একই সঙ্গে একাধারে এক হিমশীতল কঠোরতায় প্রস্তরীভূত এবং উদারতায় বিগলিত। যে লোকচরিত্র বোঝে এবং সবার সব কথা বোঝে এবং অভিজ্ঞ বিচারকের মতো দুষ্ট প্রকৃতির বিচার করে, যে মেরিয়াস একদিন তার পাশের ঘরে বাস করত, তার ছিল নিকটতম প্রতিবেশী, যার কথা তার মেয়েদের মুখে শুনেছে এবং এই ব্যারন পতমার্সি–এই দু জনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক সে ধরতে পারেনি। ওয়াটারলু যুদ্ধে পঁতমার্সি নামটা সে শুনলেও সে নাম নিয়ে সে মাথা ঘামায়নি, কারণ তাতে কোনও টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
তার মেয়ে আজেলমাকে ধন্যবাদ। সেই ১৬ ফেব্রুয়ারি মেরিয়াসের বিয়ের দিন রাস্তা থেকে বিয়ের শোভাযাত্রায় একটি গাড়িতে ভলজাঁকে দেখে তার বাবাকে বলে। সেই সূত্রেই থেনার্দিয়ের জানতে পারে জাঁ ভলজাঁ মেরিয়াসদের বাড়ির সঙ্গে এক বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে। এর আগে সে একদিন সন্ধ্যার সময় সেন নদীর ধারে সেই ঢাকা নর্দমার মুখে এক মৃতবৎ আহত লোকের সঙ্গে ভলজাঁকে দেখে এবং গেটের চাবি খুলে দেয়। সে এ-ও বুঝতে পারে যে ব্যারনের স্ত্রী ব্যারনেস পর্তমার্সিই হল কসেত্তে। এই কসেত্তে এক অবৈধ সন্তান এবং তার অতীতের কথা সে জানে। কিন্তু এ কথা সে ব্যারন পঁতমার্সির মুখের ওপর বললে সে রেগে যাবে এবং তাতে তার ক্ষতি হবে বলে সে-কথা বলতে সাহস পায়নি।
থেনার্দিয়েরের আসল কথাটা কিন্তু বলা হয়নি, শুধু তার ভিত্তিভূমিটা রচিত হয়েছে মাত্র। এরই মধ্যে সে পাঁচ শো ফ্রাঁ পেয়ে গেছে। সে এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। এবার সে ভাবছিল, যে কথা সে বলতে এসেছে এবং যে কথার তথ্যপ্রমাণাদি সে সংগ্রহ করে এনেছে–সেকথাটা কিভাবে তুলঁবে। সে তাই সুযোগের অপেক্ষা করছিল।
মেরিয়াস ভাবছিল, যে লোকটাকে খুঁজে বার করার জন্য সে কত চেষ্টা করে সে। লোক এখন তার সামনে হাজির। এবার সে তার পিতার প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারে। তার দায় থেকে মুক্ত হতে পারে। এই ধরনের এক দুষ্ট প্রকৃতির লোক তার পিতাকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে উদ্ধার করে–এ কথা মনে করে অপমান বোধ করে সে। যাই হোক, পিতার ঋণ থেকে মুক্ত হবার সুযোগ পেয়ে মনে মনে খুশি হল মেরিয়াস।
তার একটা কর্তব্য আছে। কসেত্তেকে দেওয়া টাকার রহস্যটার তাকে সমাধান করতে হবে এবং এ বিষয়ে থেনার্দিয়ের কাজে লাগতে পারে।
মেরিয়াস দেখল, থেনার্দিয়ের টাকাটা পকেটে ভরে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসছিল। মেরিয়াস এই সুযোগে বলল, ‘থেনার্দিয়ের, আমি তোমার আসল নাম বলেছি। এবার তুমি যে কথা বলবে বলছিলে সে কথাটা বলতে পার। তুমি জান, আমি অনেক কিছু জানি। তোমার থেকে হয়তো বেশি কিছু জানি। জাঁ ভলজাঁ চোর এবং খুনি। সে মঁসিয়ে ম্যাদলেন নামে এক ধনী ব্যবসায়ীর সব টাকা আত্মসাৎ করে এবং পুলিশ অফিসার জেভার্তকে খুন করে।
থেনার্দিয়ের বলল, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে লে ব্যারন।
মেরিয়াস বলল, আমি বুঝিয়ে দেব। ১৮২২ সালের কাছাকাছি পাস দ্য ক্যালেতে একটা লোক বাস করত। কোনও কারণে আইনের ভয়ে আত্মগোপন করে পরে মঁসিয়ে মাদলেন নামে নিজেকে নতুনরূপে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। সে মন্ত্রিউল-সুর-মেরে কালো কাঁচের এক কারখানা স্থাপন করে সমস্ত শহরটাকে সমৃদ্ধিশালী করে তোলে। এই কারবারে প্রচুর লাভ হয় তার। কিন্তু তার লাভের টাকা সে অকাতরে গরিব-দুঃখীদের দান করত। তাদের জন্য অনেক স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপন করে। বিধবা ও অনাথ শিশুদেরও দেখাশোনা করত। মোট কথা, ওই সমগ্র অঞ্চলের গরিব-দুঃখীদের অভিভাবক হয়ে ওঠে সে। সে শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়। একজন জেলফেরত কয়েদি তাকে চিনতে পেরে ধরিয়ে দেয় এবং তার গ্রেফতারের সুযোগ নিয়ে প্যারিসের লাফিত্তে ব্যাংকে মঁসিয়ে ম্যালেনের যে মোটা টাকা জমা ছিল সেই টাকা সে স্বাক্ষর জাল করে তুলে নেয়। প্রায় ছয় লক্ষ ফ্রাঁ। এই জেলফেরত কয়েদিই জাঁ ভলজাঁ। আর তার খুনের কথা যদি বল, তা হলে বলব সে পুলিশ অফিসার জেভার্তকে খুন করে, আমি নিজে ঘটনাস্থলে ছিলাম।
থেনার্দিয়ের এমনভাবে মেরিয়াসের মুখপানে তাকাল যাতে করে মনে হল সে দাঁড়াবার যে জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছিল সে জায়গাটা আবার পেয়ে গেছে এবং এবার তার জয় সুনিশ্চিত। পরাজয়ের সব অপমান ঝেড়ে ফেলে সে বলল, আমার মনে হয় আপনি ভুল করছেন মঁসিয়ে লে ব্যারন।
মেরিয়াস বলল, সে কী, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার? কিন্তু এ ঘটনা সত্য।
না, এ ঘটনা সম্পূর্ণ অসত্য। এর আগে মঁসিয়ে লে ব্যারন যে সব কথা বলেছেন তা আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু একথা মানতে পারব না। এবার এ ব্যাপারে আসল কথাটা বলা আমার কর্তব্য বলে মনে করি। সত্য এবং ন্যায় সব কিছুর ঊর্ধ্বে। কোনও লোক অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হোক–এটা আমি চাই না। জাঁ ভলজাঁ মঁসিয়ে ম্যালেনের টাকা আত্মসাৎ করেনি এবং জেতার্তকেও সে খুন করেনি।
কী করে তুমি তা বুঝলে?
দুটো কারণে। প্রথমত সে মঁসিয়ে ম্যালেনের টাকা অপহরণ করেনি–কারণ সে নিজেই মঁসিয়ে ম্যাদলেন।
সে কী করে হয়…?
এবং দ্বিতীয়ত সে জেতার্তকে খুন করেনি, কারণ জেতার্ত নিজেই নিজেকে খুন করে। এটা আত্মহত্যার ঘটনা।
মেরিয়াস আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, কিন্তু এ কথার সমর্থনে কোনও প্রমাণ আছে?
পুলিশ অফিসার জেভার্ত জলে ডুবে আত্মহত্যা করে এবং পঁত-অ-শেঞ্জের কাছে সেন নদীতে একটা নোঙর করা নৌকোর পাশে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।
তার প্রমাণ দাও।
থেনার্দিয়ের তার পকেটে ভাজকরা খবরের কাগজের একটা খাম বার করল। তার পর সে বলতে লাগল, মঁসিয়ে লে ব্যারন, আমি আপনার স্বার্থেই জাঁ ভলক্স সম্বন্ধে সব খবর সংগ্রহ করি। যখন আমি বলছি আপনাকে, ভলজাঁ এবং ম্যাদলেন একই লোক এবং সে জেভার্তকে খুন করেনি তখন আমি তার সমর্থনে প্রমাণ দেখাতে পারি। হাতের লেখা প্রমাণ নয়, মুদ্রিত তথ্যই আসল প্রমাণ।
কথা বলতে বলতে থেনার্দিয়ের ভাজকরা দুটো পৃথক খবরের কাগজ বার করল। কাগজগুলো থেকে কড়া তামাকের গন্ধ আসছিল। তার মধ্যে একটা কাগজ বেশি পুরনো। কাগজ দুটো জনসাধারণের কাছে পরিচিত। পুরনো কাগজটা হল দ্রেপো ব্লার ১৮২৪ সালের ২৫ জুলাই সংখ্যা–যাতে জাঁ ভলজাঁ আর মঁসিয়ে ম্যাদলেনকে একই লোক বলে দেখানো হয়েছে। আর একটি কাগজ হল ১৮৩২ সালের ১৫ জুন সংখ্যার মন্ত্রিউর’ যাতে জেভাৰ্ত-এর আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয় এবং তার সঙ্গে একথাও প্রকাশিত হয় যে জেভাৰ্ত পুলিশের বড়কর্তার কাছে স্বীকারোক্তি করে লা শাঁশ্রেরি’র ব্যারিকেডে বিপ্লবীদের হাতে বন্দি হওয়ার পর একজন বিপ্লবীর মহানুবতায় তার প্রাণরক্ষা হয়, যে বাতাসে ফাঁকা আওয়াজ করে তাকে ছেড়ে দেয়।
থেনার্দিয়ের আরও বলল, এই সব সাক্ষ্যপ্রমাণে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। খবরের কাগজে যে ঘটনা প্রকাশিত হয় তা নির্ভরযোগ্য, কারণ তার উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই ছাপা হয়, যেনার্দিয়েরের কথায় তা ছাপা হয়নি।
এতক্ষণে মেরিয়াস বুঝতে পারল ভলজাঁ সম্বন্ধে তার ধারণা কত ভুল। সে সব কিছু বুঝতে পেরে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, তা হলে তো ভলজাঁ এক চমৎকার লোক। টাকাটা তা হলে তারই–কারণ সেই ম্যাদলেন। সে আবার জের্তের রক্ষাকর্তা, উদ্ধারকর্তা। সে সত্যিকারের একজন বীর এবং সাধু পুরুষ।
থেনার্দিয়ের বলল, সে এর কোনওটাই নয়। সে চোর এবং খুনি।
সে এমনভাবে কথাগুলো বলল যাতে মনে হবে তার কথা স্বতঃসিদ্ধ সত্য।
মেরিয়াস আশ্চর্য হয়ে বলল, সে কী! আবার কী অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে?
থেনার্দিয়ের বলল, হ্যাঁ আছে। ভলজাঁ ম্যাদলেনের টাকা নেয়নি, তবু সে চোর। সে জেতার্তকে হত্যা করেনি ঠিক, তবু সে খুনি।
মেরিয়াস বলল, তবে কি তুমি তার চল্লিশ বছর আগেকার এক অপরাধের কথা বলছ? খবরের কাগজের বিবরণ অনুসারে সে তো স্থান হয়ে গেছে।
থেনার্দিয়ের বলল, আমি সত্য ঘটনার কথা বলছি মঁসিয়ে লে ব্যারন যে কথা আজও কোথাও প্রকাশিত হয়নি এবং সে কথা আজও কেউ জানতে পারেনি। এ টাকা তার নয়, পরের ধনসম্পদ নিয়েই সে আপনার পত্নীকে দান করেছে চাতুর্যের সঙ্গে। এইভাবে কৌশলে সে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে নেয়।
মেরিয়াস বলল, এখানে আমার একটা আপত্তি আছে। কিন্তু তুমি বলে যাও।
হ্যাঁ, আমি আপনাকে সব বলব। এর পুরস্কার সম্বন্ধে আপনার উদারতা ও বদান্যতার ওপর আমি নির্ভর করছি। এই গোপন তথ্যের দাম অনেক। আপনি হয়তো বলবেন, আমি ভলজাঁর কাছে কেন যাইনি। যাইনি, কারণ তার কাছে গেলে আমার কোনও লাভ হবে না। তার কাছে আর টাকা নেই, সে সব টাকা আপনাদের দিয়েছে। লা বোয়ার যাবার জন্য আমার এখন টাকা চাই এবং আপনিই এ বিষয়ে যোগ্য ব্যক্তি বলে আপনার কাছে আমি আবেদন করেছি। আমি কি বসতে পারি?
মেরিয়াস তাকে বসতে বলে নিজেও বসল।
থেনার্দিয়ের খবরের কাগজগুলো ভাঁজ করে খামের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে পায়ের উপর পা দিয়ে বসে তার গোপন তথ্য বিবৃত করে যেতে লাগল। সে বলল, গত বছর ৬ জুন তারিখে যেদিন শহরে নানা জায়গায় বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে সেদিন সন্ধ্যার সময় প্যারিসের সবচেয়ে বড় যে ঢাকা নর্দমাটা ইনভ্যালিদে আর দ্য লেনার মাঝখানে সেন নদীতে পড়েছে সেইখানে মাটির তলায় নর্দমার সুড়ঙ্গপথে একটা লোক লুকিয়ে ছিল।
মেরিয়াস তার চেয়ারটা থেনার্দিয়েরের আরও কাছে টেনে আনল। আগ্রহান্বিত শ্রোতার সামনে সফলকাম বক্তার মতো আশ্বস্ত হল থেনার্দিয়ের। সে আবার বলতে লাগল, আমার কাছে সেই নর্দমার গেটের চাবি ছিল। আমি সেখানে এমন এক কারণে যাই যার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। তখন সন্ধ্যা আটটা হবে। আমার পদশব্দ শুনে লোকটা লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু গেট দিয়ে আসা আলোয় আমি দেখতে পাই লোকটার কাঁধে একটা মৃতদেহ ছিল। নরহত্যা এবং চুরির স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কারণ কেউ কখনও বিনা কারণে কাউকে খুন করে না। খুনি লোকটা মৃতদেহটা নর্দমার জলা জায়গায় না রেখে সেটা নদীতে ফেলে দেবার জন্য অনেক কষ্ট করে সুড়ঙ্গপথের জলকাদা ভেঙে কাঁধে করে সেটা বয়ে নিয়ে আসছিল। কারণ সে হয়তো ভেবেছিল, নর্দৰ্মার মধ্যে মৃতদেহ দেখে পরদিন সকালে মেথররা কাজ করতে এসে হৈচৈ করবে। এটা সে চায়নি বলেই সে নদীতে মৃতদেহটা ফেলতে যাচ্ছিল। আমি আশ্চর্য হয়ে শুধু ভাবছিলাম, লোকটা ওই মৃতদেহ বহন করে এতটা দুর্গন্ধময় নর্দমার সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে জীবন্ত অবস্থায় এল কী করে
মেরিয়াস তার চেয়ারটা আরও কাছে সরিয়ে নিয়ে এল। থেনার্দিয়ের একবার হাঁফ ছেড়ে আবার বলতে লাগল, আমি খুনি লোকটার মুখোমুখি হতেই সে আমাকে গেটের চাবি খুলে দিতে বলল। আমার কাছে গেটের চাবি ছিল সে তা জানতে পারে। আমার থেকে সে অনেক বেশি বলবান। আমি তাই রাজি না হয়ে পারিনি। কিন্তু সে যখন মৃতদেহটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখন আমি তার অলক্ষে অগোচরে মৃত ব্যক্তির জামা থেকে একটা অংশ ছিঁড়ে নিই যাতে আমি পরে খুনের প্রমাণ হিসেবে তা উপস্থাপিত করতে পারি। আমি তাকে গেটটা খুলে দিতে সে মৃতদেহ নিয়ে বাইরে চলে গিয়ে নদীর ধারে সেটা নামিয়ে রাখে। এবার আপনি নিশ্চয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। সেই খুনি লোকটা হল জাঁ ভলজাঁ এবং আমারই সঙ্গে তার সেখানে দেখা হয়।
থেনার্দিয়ের এবার তার কোটের পকেট থেকে মৃতদেহের জামা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া অংশটা মেরিয়াসের চোখের সামনে তুলে ধরল।
সেটা দেখেই চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল মেরিয়াস। ক্ষিপ্রগতিতে চাবি নিয়ে তার পোশাকের আলমারিটা খুলে ব্যারিকেড থেকে অচেতন অবস্থায় আসার সময় যে রক্তমাখা জামাটা তার গায়ে ছিল সে জামাটা বার করল। তার পর থেনার্দিয়েরের হাত থেকে সেই ছেঁড়া অংশ নিয়ে দেখল সেটা তারই, সেই জামার অংশ দুটোকে জোড়া লাগালে ঠিক খাপ খেয়ে যাচ্ছে।
থেনার্দিয়ের বলল, আমার বিশ্বাস মঁসিয়ে লে ব্যারন, মৃত ব্যক্তি ছিল কোনও ধনী বিদেশি–যার কাছে প্রচুর টাকা ছিল বলে ভলজাঁ তাকে খুন করে ফেলে কৌশলে। মৃতদেহটি ছিল বয়সে যুবক।
মেরিয়াস বলল, আমিই সেই ব্যক্তি। আর এটা আমার জামার অংশ।
সে সেটা ভালো করে দেখিয়ে দিল থেনার্দিয়েরকে।
থেনার্দিয়ের স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভাবল, আমি গেলাম এবার।
মেরিয়াস বসার পর আবার উঠে দাঁড়াল। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। কিন্তু তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ছিল। উঠে গিয়ে থেনার্দিয়েরের মুখে একটা ঘুষি মেরে তার পকেট থেকে আরও দেড় হাজার ফ্র’র নোট নিয়ে থেনার্দিয়েরের হাতে গুঁজে দিল।
মেরিয়াস বলল, তুমি একটা মিথ্যাবাদী ঘৃণ্য লোক। তুমি তাকে দোষী সাজাতে এসে তাকে দোষমুক্ত করে দিলে। তুমি তাকে ধ্বংস করতে এসে নিজে ধ্বংস হয়ে গেলে। শোন থেনার্দিয়ের জনদ্ৰেত্তে, আমি নিজে সেই ব্যারাকবাড়িতে দেখেছি তুমি চোর এবং খুনি। তোমার সব কীর্তি আমি দেখেছি। আমি তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারতাম। তার যথেষ্ট প্রমাণ আমার কাছে আছে। তোমাকে জেলে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু ওয়াটারলুর ঘটনাই তোমাকে বাঁচিয়ে দিল। তুমি সেখানে এক কর্নেলের জীবন রক্ষা করেছিলে।
থেনার্দিয়ের বলল, কর্নেল নয়, জেনারেল।
জেনারেলের জীবনের জন্য আমি একটা পয়সাও তোমায় দিতাম না। এখন আরও তিন হাজার ফ্রাঁ নিয়ে বিদায় হও। আর তোমার মুখদর্শন করতে চাই না আমি শয়তান কোথাকার! তোমার স্ত্রী তো মারা গেছে। তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবে বলছিলে, যাও এই টাকা নিয়ে। তুমি সেখানে গেছ জানতে পারলে সেখানকার ব্যাঙ্ক থেকে কুড়ি হাজার ফ্ৰাঁ টাকা যাতে তুলঁতে পার তার ব্যবস্থা করে দেব। সেখানে গিয়ে গলায় ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলবে তুমি।
থেনার্দিয়ের নত হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে বলল, আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।
এই ঘটনার দু দিন পরে আমেরিকায় চলে যায় থেনার্দিয়ের। সঙ্গে ছিল তার ছোট মেয়ে আজেলমা। ব্যাংকের চিঠি নিয়ে গিয়ে নিউইয়র্ক থেকে সে কুড়ি হাজার ফ্ৰ তোলে। কিন্তু তার স্বভাবের কোনও পরিবর্তন হয়নি। সে দাসব্যবসা শুরু করে সেই টাকা দিয়ে।
থেনার্দিয়ের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাগানে ছুটে গেল মেরিয়াস। সেখানে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের সঙ্গে বেড়াচ্ছিল কসেত্তে।
মেরিয়াস চিৎকার করে ব্যস্ত হয়ে বলল, কসেত্তে, তাড়াতাড়ি করো, আমাদের এখনি বেরোতে হবে। বাস্ক, একটা গাড়ি ডাক। হা ভগবান, তিনিই সেই লোক যিনি আমায় উদ্ধার করেন। এক মিনিট সময়ও নষ্ট করা চলবে না। তুমি তোমার শালটা নিয়ে নাও।
কসেত্তে ভাবল, মেরিয়াস হয়তো পাগল হয়ে গেছে। তবু ওর কথামতো কাজ করল।
মেরিয়াসের হৃদস্পন্দন প্রবল হয়ে উঠল। সে নিশ্বাস নিতে পারছিল না। সে তার বুকের উপর হাত রাখল। সে কসেত্তেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি কত বোকা!
তার মনে হল, ভলজাঁ যেন সহসা কয়েদি থেকে খ্রিস্টে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ভলজাঁ অবর্ণনীয়ভাবে মহান শান্ত এবং বিনয়ী। এত অভিভূত হয়ে পড়েছিল সে যে তার অনুভবের কথাগুলো বুঝিয়ে বলতে পারছিল না।
কসেত্তে বলল, কী সুখের কথা! আমি তোমাকে র্যু হোমির কথা ভয়ে বলতে পারিনি। আমরা তাহলে মঁসিয়ে জাকে দেখতে চলেছি।
তোমার বাবা কসেত্তে। তার থেকেও বড়। আমি এইরকমই একটা ভেবেছিলাম। কসেত্তে, আমি গাভোশেকে দিয়ে তোমাকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তা তুমি পাওনি বলেছিলে। আমি জানি কী হয়েছিল। সে চিঠি তোমার বাবার হাতে পড়ে এবং তিনি আমাকে উদ্ধার করার জন্য, আমার জীবন রক্ষা করার জন্য বারিকেডে গিয়েছিলেন। মানুষকে বাঁচানোই তাঁর কাজ। তিনি জেভার্তের প্রাণরক্ষা করেন এবং আমাকে সেই নরককুণ্ড থেকে মাটির তলায় নর্দমার মধ্যে গিয়ে বয়ে এনে তোমার হাতে তুলে দেন। ওহ্, আমি কত অকৃতজ্ঞ! তিনি নর্দমার জলকাদা ভেঙে কত কষ্ট করে নিরাপদে বাইরে নিয়ে আসেন আমায়। সেখানে দু জনেই আমরা মরে যেতে পরতাম। আমি অচেতন অবস্থায় ছিলাম বলে কী হচ্ছে কিছুই জানতে পারিনি। আমরা তাঁকে জোর করে এখানে নিয়ে আসব। কোনও কথা শুনব না। তার যদি একবার দেখা পাই তো এখানে নিয়ে আসবই। সারাজীবন তাঁকে শ্রদ্ধা করে যাব। গাভ্রোশে তা হলে চিঠিটা তার হাতে দিয়েছিল! এইবার সব পরিষ্কার হয়ে গেল, বুঝলে?
কসেত্তে কিছুই বুঝতে পারল না।
গাড়িটা র্যু হোমির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
.
৫.
জাঁ ভলক্স দরজায় করাঘাত শুনে মুখ ঘুরিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ভেতরে এস।
দরজা খুলে কসেত্তে আর মেরিয়াস ঘরে ঢুকল।
ভলজাঁ বিছানার পাশে চেয়ারটায় খাড়া হয়ে বসে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, কসেত্তে!
তার সাদা ফ্যাকাশে মুখখানা সহসা অপরিসীম খুশির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে দু হাত বাড়িয়ে দিল। কসেত্তে তার দু হাতের বন্ধনে ধরা দিল। বলল, বাবা!
মেরিয়াস তখন দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল।
ভলজাঁ ভাঙা ভাঙা কথায় তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, তা হলে তুমি আমায় ক্ষমা করেছ?
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেরিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও আমায় ক্ষমা করেছ?
মেরিয়াস কথা বলতে পারল না। ভলজাঁ বলল, ধন্যবাদ।
কসেত্তে তার টুপি আর শালটা খুলে বিছানার উপর রেখে ভলজাঁ’র মাথার চুলগুলো সরিয়ে তার কপালে চুম্বন করল। ভলজাঁ হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। কসেত্তে তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল।
ভলজাঁ আমতা আমতা করে বলতে লাগল, আমি কত বোকা! আমি ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না। জান মঁসিয়ে পঁতমার্সি, তোমরা যখন ঘরে ঢুকলে তখন আমার মনে হল, সব শেষ হয়ে গেল। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কসেত্তে’র ছেলেবেলাকার পোশাকগুলো বিছানায় রেখে দেখছিলাম, কারণ ভেবেছিলাম আর তার দেখা পাব না এ জীবনে। আমার মনের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে আমি ঈশ্বরে সব বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম।
কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল ভলজাঁ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। তার পর সে আবার বলতে লাগল, কসেত্তেকে দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। ভালোবাসার বস্তুকে দেখতে না পেয়ে অন্তত বাঁচতে পারে না। কিন্তু আমি যেতে পারিনি, কারণ আমি ভেবেছিলাম আমি সেখানে অবাঞ্ছিত। আমি নিজেকে এই বলে বুঝিয়েছিলাম যে, তোমাকে তাদের প্রয়োজন নেই, জোর করে কখনও কারও ওপর নিজেকে চাপিয়ে দিতে নেই। আজ আমি আবার কসেত্তেকে দেখছি। কিন্তু তোর পোশাকটা তো তেমন ভালো নয়। তোর স্বামী কি এটা পছন্দ করে কিনেছে? মঁসিয়ে পঁতমার্সি, আমি যদি তুই বলে ডাকি কিছু মনে করো না। বেশিক্ষণ আর এভাবে ডাকতে পারব না।
কসেত্তে বলল, তুমি কী নিষ্ঠুর বাবা! কোথায় ছিলে এতদিন? এতদিন তো কোথাও থাক না। আগে তিন-চারদিনের বেশি বাইরে কোথাও থাকতে না। আমি নিকোলেত্তেকে প্রায়ই তোমার খোঁজে পাঠাতাম। সে বলত, তুমি বাইরে কোথাও গেছ, বাসায় নেই। তুমি ফিরে এসে আমাদের জানাওনি কেন? তোমার চেহারার কত পরিবর্তন হয়েছে। তুমি অসুস্থ, সেকথাও আমাদের জানাওনি। মেরিয়াস, হাতটা দেখ, কত ঠাণ্ডা।
জাঁ ভলজাঁ বলল, মঁসিয়ে পঁতমার্সি, তুমি কি সত্যি সত্যিই আমায় ক্ষমা করেছ?
এ কথার পুনরাবৃত্তিতে মেরিয়াস একেবারে ভেঙে পড়ল। সে বলল, কসেত্তে, শুনছ উনি কী বলছেন? উনি আমাকে ওঁকে ক্ষমা করতে বললেন। তিনি আমার জীবন বাঁচান, তার থেকেও বড় কথা, তিনি তোমাকে আমার হাতে তুলে দেন এবং আমাদের জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে আত্মনিগ্রহ ও আত্মত্যাগের দিকে নিজেকে ঠেলে দেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাকে বাঁচিয়ে উনি আমাকে ক্ষমা করতে বলছেন। কী নির্দয়, নিষ্ঠুর এবং অকৃতজ্ঞ আমি! তাঁর সাহস, সাধুতা, নিঃস্বার্থপরতার সীমা-পরিসীমা নেই। তার কোনও দাম দেওয়া যায় না।
ভলজাঁ মৃদু অনুযোগের সুরে বলল, ওসব কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই।
কণ্ঠে কপট তিরস্কারের সঙ্গে শ্রদ্ধা মিশিয়ে মেরিয়াস বলল, কেন আপনি নিজে একথা বলেননি? এটা আপনার কিছুটা দোষ। আপনি একজনের জীবন বাঁচিয়ে তাকে সে কথা বলবেন না? উল্টো আপনি যে স্বীকারোক্তি করলেন তাতে নিজের গুণের কথা না বলে শুধু দোষের কথাটা বললেন।
ভলজাঁ বলল, সত্য কথাই আমি বলেছি।
না সত্য মানে সমগ্র, কোনও অংশ নয়। আপনি বলেননি, মঁসিয়ে ম্যাদলেন এবং জাঁ ভলজাঁ একই ব্যক্তি এবং জেতার্তকে ছেড়ে দিয়েছেন সেকথাও বলেননি। আপনি বলেননি, আমার জীবনের জন্য আপনার কাছে আমি ঋণী।
আমি ভেবেছিলাম তুমি এটা জানতে। ভেবেছিলাম তুমি যা করছ ঠিকই করছ। তাই নিজেকে দূরে সরিয়ে আনি আমি। তোমার প্রাণ বাঁচাবার কথাটা বললে তুমি আমাকে তোমাদের বাড়িতে রেখে দিতে। তা হলে হয়তো সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেত।
মেরিয়াস বলল, কিসের ওলটপালট হয়ে যাবে? আপনি কি ভাবছেন আমরা কি আপনাকে এখানে রেখে যাব? আমরা আপনাকে সঙ্গে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। একবার যখন ঘটনাক্রমে সবকিছু জানতে পেরেছি তখন আর আপনাকে ফেলে রেখে যাব? আপনি আমাদেরই একজন। আপনি কসেত্তে’র এবং আমার দু জনের পিতা। এই ভয়ঙ্কর নির্জন ঘরে আর একটা দিনও থাকতে দেব না।
জাঁ ভলজাঁ বলল, কাল অবশ্য আমি থাকছিই না।
মেরিয়াস বলল, তার মানে? আমরা আর আপনাকে বাইরে যেতে দিচ্ছি না। আমাদের ছেড়ে আর কোথাও যেতে দিচ্ছি না।
কসেত্তে বলল, নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দরকার হলে জোর করে তোমাকে তুলে নিয়ে যাব।
এই বলে হাসতে হাসতে ভলজাঁ’র হাত দুটো ধরল কসেত্তে, তোমার ঘরটা এখনও আমরা খালি রেখে দিয়েছি। বাগানটা এখন কত সুন্দর হয়েছে। বাগানের ভেতরের পথগুলো সমুদ্রের বালি দিয়ে ভরে দেওয়া হয়েছে। সে বালির মধ্যে ছোট ছোট কত নীল ঝিনুক আছে। আমি জামগাছে নিজে জল দিই। তুমি আমার জামগুলো খেতে পার। আর মাদাম’, ‘আপনি এসব চলবে না। আমরা এদিক দিয়ে প্রজাতন্ত্রী। মেরিয়াস আর আমি দু জনে দু জনকে তুই বলে ডাকি। কিন্তু বাবা, একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে। একটা বুলবুল আমার ঘরের বাইরের দিকের দেয়ালে বাসা বেঁধেছিল। সে প্রায়ই আমার জানালা দিয়ে উঁকি মারত। একদিন একটা বিড়াল তার বাসায় গিয়ে খেয়ে ফেলে তাকে। আমি বিড়ালটাকে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু এখন আমরা সবাই সুখী, এখন আর মারব না। দাদু তোমাকে নিয়ে গেলে খুব খুশি হবেন। বাগানের একটা দিক ছেড়ে দেওয়া হবে তোমাকে। তুমি তোমার খুশিমতো গাছ বসাতে পার সেখানে। তুমি যা বলবে আমি তাই করব। তবে তোমাকেও অনেক সময় আমার কথা শুনতে হবে।
ভলজাঁ কসেত্তে’র কথাগুলো সব মন দিয়ে শুনে গেল। তার কণ্ঠস্বর মধুর গানের মতো শোনাচ্ছিল তার কানে। আত্মার মুক্তো হয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু তার চোখে। এসে টলমল করতে লাগল। সে শান্ত মৃদু কণ্ঠে বলল, এর থেকে বোঝা যায় ঈশ্বর কত দয়ালু।
কসেত্তে বলল, লক্ষ্মী বাবা আমার!
জাঁ ভলজাঁ বলল, সত্যি। একসঙ্গে এক বাড়িতে থাকাটা সত্যিই কত সুখের। বাগানের গাছগুলো ফুল আর পাখিতে ভরে আছে। সে বাগানে আমি কসেত্তে’র সঙ্গে বেড়াব। আমরা বাগানের মধ্যে আপন আপন জায়গায় চাষ করব, গাছ লাগাব। কসেত্তে’র গাছ থেকে আমি জাম খাব আর কসেত্তে আমার গাছ থেকে গোলাপ তুলে নেবে। সত্যিই কত আনন্দের কথা। শুধু–
তার চোখ দুটো জলে কানায় কানায় ভরে উঠলেও সে জল গড়িয়ে পড়ল না। তার ওপর সকরুণ এক হাসি ফুটিয়ে তুলঁল সে। কসেত্তে তার হাত দুটো টেনে নিল তার হাতের মধ্যে।
কসেত্তে বলল, তোমার হাত দুটো কি ঠাণ্ডা! তুমি অসুস্থ? এখনও কি যন্ত্রণা হচ্ছে?
ভলজাঁ বলল, না, আমার আর কোনও যন্ত্রণা নেই। শুধু—
বলতে বলতে থেমে গেল।
শুধু কী?
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি মারা যাব।
কসেত্তে ও মেরিয়াস দু জনেই চমকে উঠল। ভয়ে অন্তর দুটো কেঁপে উঠল।
মেরিয়াস বলল, মারা যাবেন?
জাঁ ভলজাঁ বলল, হ্যাঁ, সেটা এমন কিছু না। কসেত্তে, তুমি কথা বলে যাও। তোমার কণ্ঠস্বর আমি প্রাণভরে শুনে যাই।
মেরিয়াস স্তম্ভিতের মতো ভলজাঁ’র পানে তাকিয়ে রইল আর কসেত্তে এক মর্মভেদী কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাতর কণ্ঠে বারবার বলতে লাগল, না বাবা, তোমাকে মরতে দেব না। তোমাকে বাঁচতে হবে। আমি চাই তুমি বাঁচবে। বুঝলে?
ভলজাঁ কসেত্তে’র মুখপানে তাকিয়ে বলল, আমি তো মরেই যাচ্ছিলাম। মৃত্যু এসে গিয়েছিল। তোমরা হঠাৎ এসে পড়ায় মৃত্যু বাধা পেল কিছুটা। কিছুক্ষণের জন্য আমি যেন নবজন্ম লাভ করেছিলাম।
মেরিয়াস বলল, এখনও আপনার দেহে শক্তি আছে, প্রাণশক্তি আছে। আপনি এতদিন অনেক দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন। আজ আপনার সব দুঃখকষ্টের অবসান হয়েছে। এখন আমি নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইছি। আপনাকে বাঁচতে হবে এবং আমাদের কাছেই থাকতে হবে। অনেক অনেকদিন ধরে বাঁচতে হবে। আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। এবার থেকে আপনার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে লক্ষ রাখাই হবে আমাদের একমাত্র কাজ এবং চিন্তা।
কসেন্তে চোখে জল নিয়ে বলল, দেখছ বাবা, মেরিয়াস বলছে তোমায় মরতে দেবে না।
ভলজাঁ হাসিমুখে বলতে লাগল, আমাকে যদি তোমরা নিয়ে যাও পঁতমার্সি তা হলে আমি কি সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ হয়ে উঠব? না, ঈশ্বর কিন্তু তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন করেননি। আমার চলে যাওয়াই ভালো। মৃত্যুই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। ঈশ্বর জানেন আমাদের কাকে কিসে মরতে হবে। তিনি ঠিকই ব্যবস্থা করেছেন। তোমরা সুখী হও। রৌদ্রস্নাত প্রভাতী প্রান্তরের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠুক তোমাদের জীবন। তোমাদের চারদিকে ফুল আর পাখিরা তোমাদের ঘিরে থাক। এক অনাবিল অফুরন্ত আনন্দের স্রোত বয়ে যাক তোমাদের জীবনে। আমার জীবন ফুরিয়ে এসেছে। আমি আর কোনও কাজে লাগব না। আমার পক্ষে মৃত্যুই ভালো। আমাদের সব কিছু বোঝা উচিত। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার মৃত্যুকাল এসে গেছে। কিছুক্ষণ আগে একবার মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলাম। গতরাতে জগের সব জলটা খেয়ে ফেলেছি। তোমার স্বামী কত ভালো কসেত্তে। এখন তার কাছেই সুখে-শান্তিতে থাকবে।
দরজায় আবার করাঘাত হল। ডাক্তার ঘরে ঢুকল।
ভলজাঁ বলল, একই সঙ্গে অভ্যর্থনা এবং শেষ বিদায় জানাচ্ছি ডাক্তার। এরা আমার দুটি সন্তান।
মেরিয়াস ডাক্তারের কাছে গিয়ে প্রশ্নের সুরে বলল, মঁসিয়ে—
ডাক্তার তার উত্তরে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মেরিয়াসের দিকে।
ভলজাঁ বলল, সব সময় সব ঘটনা আমাদের মনঃপূত হয় না। তার জন্য ঈশ্বরকে দোষ দেওয়া উচিত নয়।
কিছুক্ষণ এক অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করতে লাগল ঘরে। ভলজাঁ কসেত্তে’র পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগল। যেন তার ছবিটা অনন্তের পথে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। আসন্ন মৃত্যুর যে ঘনায়মান ছায়ার মধ্যে সে ডুবে যেতে বসেছে সেই ছায়ার মধ্যেও কসেত্তেকে দেখতে পেয়ে আনন্দের এক উজ্জ্বল আবেগের ঢেউ খেলে যেতে লাগল। কসেত্তে’র সুন্দর মুখের জ্যোতিটা তার ছায়াচ্ছন্ন মুখের ওপর ফুটে উঠল। মৃত্যুর মধ্যেও আনন্দ পেতে লাগল সে।
ডাক্তার ভলজাঁ’র নাড়ি দেখতে লাগল। সে মেরিয়াসকে বলল, আপনাদের দেখতে চাইছিলেন উনি। আপনাদের অভাবটাই খুব বেশি করে বোধ করছিলেন উনি। আপনারা এলেন, কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে বড় দেরি হয়ে গেল।
কসেত্তে’র ওপর থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই ভলজাঁ বলতে লাগল, মরাটা এমন কিছু কষ্টের নয়, কিন্তু জীবন ছেড়ে চলে যাওয়া সত্যিই বড় কষ্টের।
হঠাৎ জোর করে উঠে দাঁড়াল ভলজাঁ। মৃত্যুর সময় এমনি করে হঠাৎ এক শক্তির উচ্ছ্বাস দেখা যায়। ডাক্তার ও মেরিয়াসের বাধা ঠেলে সে দেয়ালের কাছে গিয়ে দেয়াল থেকে তামার সেই ক্রসটা এনে তার চেয়ারের সামনে টেবিলটার উপর রাখল। রেখে বলল, যিশু হচ্ছেন সবচেয়ে বড় শহীদ।
তার মাথাটা ক্রসের উপর ঢলে পড়ল। হাতের আঙুলগুলো তার পায়জামার উপর আঁচড় কাটতে লাগল।
কসেত্তে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভলজাঁ’র কাছে ছুটে গিয়ে বলল, বাবা, তোমাকে কি হারাবার জন্য খুঁজে পেলাম?
মড়ার মতো হয়ে গিয়েও কিছুক্ষণ পরে আবার উঠে বসল ভলজাঁ। মরতে মরতে মানুষ এমনি করে জীবনের দিকে যেন পেছনে ফিরে চায়। জীবনমৃত্যুর খেলা চলে। কসেত্তে’র জামার আস্তিনটা চুম্বন করল ভলজাঁ।
মেরিয়াস বলল, ডাক্তারবাবু, ওঁর জ্ঞান ফিরে এসেছে।
ভলজাঁ আবার বলতে লাগল, আমার দুঃখের কথাটা এবার বলব তোমাদের। সবচেয়ে আমার দুঃখ লেগেছে কখন জান? যখন তোমরা আমার দেওয়া টাকাটা ব্যবহার করনি। এটা সত্যিই তোমার স্ত্রীর টাকা মেরিয়াস। তোমরা এসেছ ভালোই হয়েছে। আমি এবার সব বুঝিয়ে বলতে পারব তোমাদের। ব্রেসলেটে বসাবার জন্য আমি এক ধরনের কাঁচ আবিষ্কার করি। কাঁচটা যেমন সুন্দর তেমনি সস্তা। এই কাঁচের কারখানা এবং কারবার করে প্রচুর টাকা লাভ করি আমি। সুতরাং কসেত্তেকে যা দিয়েছি তা তার নিজস্ব সম্পদ। তার মধ্যে কোনও জাল-জুয়োচরি নেই। তোমাদের মনে যাতে সংশয় না থাকে তার জন্যই একথা বললাম।
বাড়ির দারোয়ানের স্ত্রী এসে মুমূর্ষ ভলজাঁকে বলল, কোনও যাজক দরকার আপনার?
জাঁ ভলজাঁ বলল, আমার যাজক আছে।
এই বলে সে উপর দিকে তাকাল। মনে হল ঘরের মধ্যে এমন একজন আছে যার অদৃশ্য উপস্থিতি কারও চোখে না পড়লেও সে তাকে দেখতে পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল বিশপ মিরিয়েল তার মৃত্যুর সময় তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভলজাঁর পিঠের নিচে একটা বালিশ এনে দিল কসেত্তে।
ভলজাঁ বলতে লাগল, আমার টাকাটা তোমরা ব্যবহার না করলে আমার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যেত মেরিয়াস। আমি মরেও সুখী হতাম না।
কসেত্তে ও মেরিয়াস কোনও কথা না বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুমূর্ষ ভলজাঁ’র মুখপানে।
ভলজাঁ যেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এক অন্ধকার দিগন্তের পানে এগিয়ে চলেছে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মাঝে মাঝে একটা কাতর শব্দ বেরিয়ে আসছিল মুখ থেকে। তার হাত-পাগুলো শক্ত হয়ে উঠছিল। কিন্তু তার দেহের শক্তিটা স্তিমিত হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে যতই সে দুর্বল হয়ে পড়ছিল ততই তার আত্মার মধ্যে একটা শক্তি খুঁজে পাচ্ছিল সে। জীবনাতীত এক রাজ্যের স্বর্গীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল তার মুখখানা।
তার চোখ দুটো ম্লান হয়ে গেলেও তার দৃষ্টিশক্তি যেন গম্ভীর হয়ে উঠছিল আরও। মনে হচ্ছিল ভলজাঁ যেন মরছে না, দেবদূতের মতো পাখা মেলে কোথায় উড়ে চলেছে।
কসেত্তে এবং মেরিয়াস দু জনকেই ইশারায় কাছে ডাকল ভলজাঁ। বলল, তোমরা দু জনেই আমার খুব কাছে এস। আমি তোমাদের দু জনকেই গভীরভাবে ভালোবাসি। এভাবে মরতে পারাটা কত সুখের। কসেত্তে, তুই আমার জন্য অল্প একটু কাঁদবি, বেশি কাঁদবি না। আনন্দ করবি, জীবনকে উপভোগ করবি। পঁতমার্সি, তুমি কোনও কুণ্ঠা করবে না। এটা আমার সত্তাবে উপার্জিত টাকা। সরল মনে ওটা ভোগ করতে পার। তোমরা এতে ধনী হয়ে উঠবে। একটা গাড়ি কিনবে। কসেত্তেকে ভালো পোশাক-আশাক কিনে দেবে। থিয়েটারে একটা বক্স রেখে দেবে। মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে খাওয়াবে। তোমরা সব দিক দিয়ে সুখী হও। ওই দুটো রুপোর বাতিদান আমি কসেত্তেকে দিয়ে গেলাম। ও দুটো যিনি আমাকে দিয়ে গেছেন, জানি না আজ তিনি স্বর্গ থেকে আমাকে দেখে খুশি হচ্ছেন কি না। আমার ড্রয়ারে পাঁচশো ফ্রা’র নোট আছে। আমি তার থেকে খরচ করিনি কিছুই। ওটা গরিবদুঃখীদের দিয়ে দেবে। মনে রাখবে আমি গরিব। আমাকে একটা খালি জায়গা দেখে কবর দেবে। কবরের উপর শুধু একটা পাথর থাকবে। কিছু লিখতে হবে না। কসেত্তে ও তুমি যদি মাঝে মাঝে আমার সে কবরে যাও তো আমি খুশি হব। মেরিয়াস, আমি সব সময় তোমার ওপর খুশি হতে পারিনি। তুমি তার জন্য ক্ষমা কর আমায়। এখন আর সে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ এখন তুমি আর কসেত্তে এক। এখন তোমাদের একজনকে ভালোবাসা মানেই দু জনকে ভালোবাসা! মনে আছে কসেত্তে, দশ বছর আগে কত সুখে ছিলাম আমরা! কেঁদো না কসেত্তে। মরে গেলেও দূরে থাকব না। আমি সব কিছু লক্ষ করব তোমাদের। অন্ধকার রাত্রিতে তাকালেই আমার হাসিমুখ দেখতে পাবে। মঁতফারমেলের কথা মনে আছে কসেত্তে? তুমি সে রাত্রিতে একা চলতে কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলে। সেদিন প্রথম আমি তোমার হাত ধরি। সেদিন তোমার হাত দুটো লাল ছিল, আজ তা সাদা হয়েছে। তোমার সেই পুতুলটার কথা মনে আছে, পুতুলটার নাম দিয়েছিলে ক্যাথারিন। কনভেন্টে থাকার সময় সেটা নিয়ে যেতে চাইলে আমি হেসেছিলাম। তোমার চোখের আলো, মুখের হাসি এখন সব মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম তুমি চিরদিন আমারই থাকবে, এইখানেই ভুল করেছিলাম আমি। থেনার্দিয়েররা খুব দুষ্ট প্রকৃতির লোক ছিল। কিন্তু তাদের ক্ষমা করা উচিত। কসেত্তে, এখন তোমার মা’র নামটা বলা উচিত। তার নাম হল ফাঁতিনে। এ নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করবে। সে জীবনে অনেক কষ্ট পায়। সে তোমাকে খুব ভালোবাসত। তুমি যে পরিমাণে সুখী হয়েছ সে ছিল সেই পরিমাণে দুঃখী। ঈশ্বর এইভাবে সব কিছুর বিধান করে থাকেন। তিনি সব সময় স্বর্গ থেকে আমাদের ওপর লক্ষ রাখেন। সব কিছু দেখেন। আমি এখন তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। পরস্পরকে ভালোবাসবে তোমরা। ভালোবাসার মতো মূল্যবান বস্তু জগতে আর কিছু নেই। কসেত্তে মা আমার, আমি তোকে শেষ ক’দিন দেখতে যেতে পারিনি। সেটা আমার দোষ নয় কিন্তু। আমি তোদের বাড়ির কাছে গিয়ে ফিরে এসেছি।
আমি প্রায় দিনই যেতাম সেখানে। একদিন টুপি না পরেই গিয়েছিলাম। একদিন বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় দিইনি। লোকে আমায় পাগল বলত। আমি মরে গেলে মাঝে মাঝে আমার কথা শুধু ভাববি।
এখন আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না। আমি একটা আলো দেখতে পাচ্ছি। আমি এবার পরম সুখে মরতে পারব। তোমাদের মাথা দুটো একটু নত কর যাতে আমি হাত রাখতে পারি তার উপর।
তাদের চোখের জল মুছে ভলজাঁ’র দু পাশে নতজানু হয়ে বসল কসেত্তে ও মেরিয়াস। ভলজাঁ তার হাত দুটো তাদের মাথার উপর রাখল। কিন্তু হাত দুটো আর নড়ল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে। রুপোর বাতিদানে জ্বলতে থাকা দুটো মোমবাতির আলো ছড়িয়ে পড়ল তার মুখের উপর।
.
৬.
পিয়ের ল্যাসের প্রশস্ত সমাধিভূমিতে সাধারণত গরিব-দুঃখীদের এবং অভিজাত ধনীদের। কবরখানার মাঝখানে একটু খালি জায়গা আছে। জায়গাটা কবরখানার পাঁচিলের কাছাকাছি। সে জায়গায় একটা ইউগাছের তলায় চারদিকে ফুল দিয়ে ঘেরা একটা পাথর আছে। পাথরটা কালো এবং সবুজ। সেই পাথরটার কাছে কেউ যেতে চায় না, কারণ সেখানে যাবার পথটা লম্বা লম্বা ঘাসে ভরে গেছে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সেই লম্বা লম্বা ঘাসগুলোর কাছে টিকটিকি-গিরগিটিরা এসে খেলা করে। ঘাসগুলো সজীব হয়ে নড়তে থাকে এবং গাছে গাছে পাখিরা গান করে।
কোনও সাজসজ্জা বা কারুকার্য নেই পাথরটাতে। এ পাথর যে মৃতের সমাধিস্তম্ভ তারই ইচ্ছামতো নির্মিত হয়েছে এভাবে। লম্বায় ও চওড়ায় একটা শায়িত মানুষের আচ্ছাদনের পক্ষে যথেষ্ট।
এ পাথরের উপর কোনও নাম নেই।
কিন্তু কয়েক বছর আগে কে একজন এই পাথরের উপর চারটে লাইন খড়ি দিয়ে লিখে দিয়ে যায়। বাতাস ও জলের ঝাঁপটায় ক্রমে তা মুছে যায়। লাইন চারটে হল :
সে এখন ঘুমিয়ে আছে, জীবনে কিছুই পায়নি সে; শুধু একজনকে ভালোবেসে জীবনকে আঁকড়ে ধরেছিল সে; সেই ভালোবাসার জন তার কাছ থেকে চলে যেতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। কিন্তু সে মৃত্যুর রূপ ছিল বড় মনোরম। রাত্রির পর যেমন দিন আসে তেমনি প্রশান্ত এবং নিঃশব্দ ছিল সে মৃত্যুর গতি।
সমাপ্ত