৫.৬ রামধনু
শ্রাবণের শেষ দিন পর্যন্ত পদ্মাপুরাণ পড়া হয়, কিন্তু পুঁথি সমাপ্ত করা হয় না। লখিন্দরের পুনর্মিলন ও মনসা-বন্দনা বলিয়া শেষ দুইটি পরিচ্ছেদ রাখিয়া দেওয়া হয় এবং তাহা পড়া হয় মনসা পূজার পরের দিন সকালে, সেদিন মালোর জাল বাহিতে যায় না। খুব করিয়া পদ্মাপুরাণ গায় আর খোল করতাল বাজায়।
শেষ দিন বনমালীর গলাটা ভাঙ্গিয়া গেল। এক হাতে গলি চাপিয়া ধরিয়া, চোখ দুইটা বড় করিয়া, গলায় যথাসম্ভব জোর দিয়া শেষ দিশা তুলিল, ‘বিউনি হাতে লৈয়া বিপুলায়ে বলে, কে নিবি বিউনি লক্ষটেকার মূলে।‘ কিন্তু স্বরে আর জোর বাঁধিল না; ভাঙ্গা বাঁশের বাঁশীর মতো বেসুরে বাজিল। অন্যান্য যারা দোহার ধরিবে তাদের গলা অনেকের আগেই ভঙ্গিয়া গিয়াছে তারাও চেষ্টা করিয়া দেখিল স্বর বাহির হয় না। তারা পদ্মাপুরাণ পড়া শেষ করিল। বেহুলা বিজনী বেচিতে আসিয়াছে, জায়েদের নিকটে গোপনে ডোমনীর বেশ ধরিয়া। শেষে পরিচয় হইল এবং চাঁদসদাগরের পরাজয় হইল; সে মনসা পূজা করিয়া ঘরে ঘরে মনসার পূজা খাওয়ার পথ করিয়া দিল।
বন্দন শেষ করিয়া পুঁথিখানা বাঁধা হইতেছে। এক বৎসরের জন্য উহাকে রাখিয়া দেওয়া হইবে। আবার শ্রাবণ আসিলে খোলা হইবে। একটা লোক ঝড়ি হইতে বাতাস ও খই বিতরণ করিতেছে। লোকে এক একজন করিয়া খষ্ট বাতাসা লইয়া প্রস্থান করিতেছে। যাহাদের তামাকের পিপাসা আছে তাহারা দেরি করিতেছে। এদিকে পূজার ঘরের অবস্থা দেখিলে কান্না পায়। আগের দিন পূজা হইয়াছে। তখন দীপ জ্বলিয়াছিল, ধূপ জ্বলিয়াছিল; দশ বারোটি তেপায়ায় নৈবেদ্য সাজাইয়া রাখা হইয়াছিল। সদ্য রঙদেওয়া মনসামূর্তি যেন জীবন্ত হইয়া হাসিতেছিল; আর তার সাপ দুইটা বুঝিব। গলা বাড়াইয়া আসিয়া অনন্তকে ছোবলই দিয়া বসে—এমনি চকচকে ঝকঝকে ছিল। আজ তাদের রঙ অন্তরকম। অনিপুণ কারিগরের সস্তায় তৈয়ারী একদিনের জৌলুস, রঙচটা হইয় মান হইয়া গিয়াছে। কোন অসাবধান পূজার্থীর কাপড়ের খুটে লাগিয়া একটা সাপের জিব ও আরেকটা সাপের ল্যাজ ভাঙ্গিয়৷ গিয়াছে। এখন তাহাদের দিকে চাহিলে অনুকম্প জাগে। রাশি রাশি সাপলা ছিল মূর্তির দুই পাশে। ছেলেরা আনিয়া এখন খোসা ছাড়াইয়া খাইতেছে আর অটুট খোসাটার মধ্যে ফু দিয়া বোতল বানাইতেছে। কেউ কেউ সাপলা দিয়া মালা বানাইয়া গলায় পরিতেছে। অনন্ত এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল। একটি ছোট মেয়ে তেমনি কয়েক ছড়া মালা বানাইয়া কাহার গলায় পরাইবে ভাবিতেছিল। অনন্তর দিকে চোখ পড়াতে তাহারই গলায় পরাইয়া দিল। অনন্ত চট করিয়া খুলিয়া আবার মেয়েটির খোঁপায় জড়াইয়া থুইল। চক্ষুর নিমিষে এই কাণ্ডটি ঘটিয়া গেল। মেয়েটির দিকে চাহিলে প্রথমেই চোখ পড়িবে এই খোঁপার উপর। ছোট মেয়ের তুলনায় অনেক বড় সে-খোঁপা। সাত মাথার চুল এক মাথায় করিয়া যেন মা বাঁধিয়া দিয়াছে।
খুশি হইয়া মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোনোদিন ত দেখি নাই তোমারে; তোমার নাম কি?’
‘অনন্ত। আমার নাম অনন্ত।‘
‘দূর, তা কেমনে হয়! ঠিক কইরা কও, তোমার নাম কি?’
‘ঠিক কথাই কই। আমার নাম অনন্ত।‘
‘তবে আমার মত তোমার খোঁপা নাই কেনে; আমার মত তুমি এইরকম কইরা শাডি পর না কেনে? তোমার নাক বিন্ধা নাই কেনে, কান বিন্ধাইয়া কাঠি দেয় নাই কেনে; গোধানি কই, হাতের চুড়ি কই তোমার?’
‘আরে, আমি যে পুরুষ। তুমি ত মাইয়া।‘
‘তবে তোমার নাম অনন্ত না?’
‘না! কেনে?’
‘অনন্ত যে আমার নাম। তোমার এই নাম হইতে পারে না।‘
‘পারে না? ওমা, কেনে পারে না?’
‘তুমি পুরুষ। আমার নাম কি তোমার নাম হইতে পারে?’
‘হইতে পারে না যদি, তবে এই নাম আমার রাখল কেনে। আমার মা নিজে এই নাম রাখছে। মাসীও জানে।‘
‘কেবল মাসী জানে? আর কেউ না?’
‘যে-বাড়িতে আছি, তারা দুই ভাই-ভইনেও জানে।’
‘এই! আর কেউ না! ওমা, শুন’ তবে। আমার নাম রাখছে গণক ঠাকুরে। জানে আমার মায় বাবায়, সাত কাকায়, আর পাঁচ কাকীয়ে; আব ছয় দাদা আর তিন দিদিয়ে, চার মাসী দুই পিসিয়ে।‘
‘ও বাব্বা৷ ‘
‘আরো কত লোকে যে জানে। আর কত আদর যে করে। কেউ মারে না আমারে।‘
‘আমারেও কেউ মারে না। এক বুড়ি মারত, মাসী তারে আটকাইত।‘
‘মাসী আটকাইত, ত মা আটকাইত না?’
‘আমার মা নাই।‘
মেয়েটি এইবার বিগলিত হইয়া উঠিল, ‘নাই! হায়গো কপাল! মানুষে কয়, মা নাই যার ছাড় কপাল তার। ‘
অনন্তর নিজেকে বড় ছোট মনে হইল। চট করিয়া বলিল, ‘মাসী তাছে।’
মেয়েটি ভুরু বাকাইয়া একটা নিশ্বাস ছাড়িল, ‘মাসী আছে তোমার, তবু ভালা। মানুষে কয়, তীর্থের মধ্যে কাশী ইষ্টির মধ্যে মাসী, ধানের মধ্যে খামা কুটুমের মধ্যে মামা।‘—বলিয়া হঠাৎ মেয়েটি কোথায় চলিয়া গেল।
অনন্ত মনে মনে ভাবিল, বাব্বা, খুব যে শিলোক ছাড়ে। উদয়তারার কাছে একবার নিয়া গেলে মন্দ হয় না।
একটু পরেই পুজামণ্ডপের সামনে মেয়েটির সহিত আবার দেখা হইল।
‘আচ্ছা, আমারে তোমার মাসীর বাড়ি লইয়া যাইবা?’
‘কেমনে লইয়া যামু। অনেক দূর যে। নাওয়ে গেলে এক দুপুরের পথ।‘
‘মানুষে কি মানুষেরে দূরের দেশে লইয়া যায় না?’
‘যায়। কিন্তু অখন যায় না। বৈশাখ মাসে তিতাসের পারে মেলা হয়। তখন লইয়া যায়। অনেক দূর থাইক্যা অনেক মানুষ তখন অনেক মানুষেরে লইয়া যায়!’
‘তখন আমরেও লইয়া যাইও। কেমুন?’
‘আমারত নাও নাই। আচ্ছা বনমালীরে কইয়া রাখুম। তার নাওয়ে যাইতে পারবা।’
‘পরের নাওয়ে বাবা যাইতে দিলে ত?’
‘খালের টেকের ভাঙ্গা নাওয়ের খোড়ল থাইক্যা সাতদিনের উপাসী মানুষেরে যে-জন বাইর কইরা আনল, তারে কও তুমি পর। কি যে তুমি কও।‘
মেয়েটির চোখমুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, ‘খালের টেকে ভাঙ্গা নাওয়ের খোড়লে তুমি থাকতা, ডর করত না তোমার? রাইতে দেও-দৈত্য যদি দেখা দিত। কও না, কি কইরা তুমি থাক্তা এক্লা—‘
‘সে এক পরস্তাবের কথা। কইতে গেলে তিনদিন লাগব!’
‘তোমরার গাঁওয়ে আমারে লইয়া যাইবা? সেই নাওখান দেখাইবা?’
‘আচ্ছা নিয়া যামু।’
‘নিবা যে, তোমার মাসী আমারে আদর করব ত তোমার মত?’
‘হ, তোমারে করব আদর। আমারেই বইক্যা বাইর কইরা দিল।’
‘কও কি! বাইর কইরা দিল, আর ডাইক্য ঘরে নিল না?’
‘না।‘
‘তবে গিয়া কাম নাই। তুমি আম্রার বাড়িতেই চল। কেউ তোমারে বাইর কইরা দিব না। যদি দেয়ও, আমি তোমারে ডাইক্যা ঘরে নিমু।’
কথাগুলি অনন্তর খুব ভাল লাগিল। একঘর ভরতি লোকের মধ্যে থাকিতে খুব ভাল লাগিবে। সেখানে দশটি লোকে দশ রকমের কথা বলিবে, বিশ হাতে কাজ করিবে, দশমুখে গল্প করিবে—একটা কলরবে মুখরিত থাকিবে ঘরখানা। তার মধ্যে এই চঞ্চল মেয়েটি তার সঙ্গে খেলা করিবে, জালবোন মাছধরা খেলা। অনন্ত সত্যিকারের জেলে হইয়া নৌকাতে না উঠা পর্যন্ত তাকে এই খেলার মধ্য দিয়াই জাল ফেলা জাল তোলা আয়ত্ত করিতে হইবে।
একটা করুণ সুর তার মনে গুণ গুণ করিয়া উঠিল। তার জগৎ বেদনার জগৎ। এ জগতে হাসি নাই, আমোদ নাই। আপনজন না থাকার ব্যথায় তার জগৎ পরিম্লান। আকাশে তারা আছে, কাননে ফুল আছে, মেঘে রঙ আছে। তিতাসের ঢেউয়ে সে-রঙের খেলা আছে, সব কিছু নিয়াও এই রূপোন্মত্ত বহির্বিশ্ব তার মনের মানিমার সঙ্গে একাকার। একটার পর একটা সাগরের ঢেউয়ের মত কি যেন তার সারা মনট ডুবাইয়া চুবাইয়া দেয়। তখন সে চাহিয়া দেখে, কুল নাই, সীমা নাই, খালি জল আর জল। তুই তীরের বাঁধনে বাঁধা তিতাসের সাধ্য কি সে জল আগলায়। এ যেন বার-দরিয়ার নোন। জল—ছোট তটিনীর সকল নৃত্যবিলাসকে তলাইয়া দিয়া জাগিয়া থাকে শুধু একটানা হাহাকার।
অনন্ত ইহার কারণ বিশ্লেষণ করিতে চায় মনে মনে। দেখে এত বিশাল বিপুল সময়ের মহাম্রোতে সে বুঝি বা একখণ্ড দুর্বল কুটার মতই ভাসিয়া চলিয়াছে। কিছুদিন আগে একমাত্র মাকে আপন বলিয়া জানিত। তারপর মাসী। কিন্তু সে যে আসলে তার কেউ না, অনন্তর এ বোধ আছে। বনমালী উদয়তারা এরাও দুইদিনের পথের সাথী। এরা যেদিন মাসীর মতই তাকে পর করিয়া দিবে সেদিন সে কোথায় যাইবে।
কোথায় আর যাইবে। একটা পান্থশালা জুটিয়া যাইবেই। যে ছাড়িতে পারে তার জুটিতেও বিলম্ব হয় না। পান্থশালারই মত এই মেয়েটির সংসারে ঢুকিয়া পড়িলে ক্ষতি কি?
তিনটি নারী একযোগে অনন্তর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। মাসী তার একান্তই অসহায়। তিক্তবিরক্ত বাপ মার অনাত্মীয় পরিবেশে সে নিতান্তই অসহায়। অতীতের সঙ্গে তার বর্তমানের যে যোগ-সূত্র আছে, ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াইয়া সে-সূত্র ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। একটা নগণ্য খড়কুটার মতই সে সময়ের মহাম্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে। তিতাসের জলে হাজারো খড়কুটা ভাসিয়া যায়; কিন্তু কোন না কোন মালোর জালে তারা আটকা পড়িবেই পড়িবে। কিন্তু মাসীর ভবিষ্যৎ, কোন অবলম্বনের গায়েই আটকা পড়িবে না। আর উদয়তারা? অনেক বেদনা তার মনে জমা হইয়া আছে, কিন্তু বড় কঠিন এ নারী। হাস্য পরিহাসে, প্রবাদে শ্লোকে সব বেদন ঢাকিয়া সে নারী সব সময়ে মুখের হাসি নিয়া চলে। তাহাকে জদ করিবে এমন দুঃখ বুঝি বিধতাও সৃষ্টি করিতে পারে নাই। মাসী তার মত সকল দুঃখকে অগ্রাহ করিয়া চলিবার ক্ষমতা পাইল না কেন? হায়, তাহা যদি সে পাইত, অনন্তর মন অনেক ভাবনা হইতে নিস্কৃতি পাইত। আর এই হাস্যচঞ্চল মেয়েটি। এর জীবন সবে শুরু হইয়াছে। সে নিজে যেমন চাঁদের রোশনি, তেমনি অনেক থমথমে আকাশের তারাকে সে কাননের ফুলের মত বোটায় আঘাত করিয়া ফুটাইয়া ছিটাইয়া হাসাইতে মাতাইতে সক্ষম। সে যদি সব সময় তার সঙ্গে সঙ্গে থাকিতে পারিত। তবে তার মনের মানিমাটুকু একটু একটু করিয়া ক্ষয় হইয়া যাইত।
মেয়েটি হঠাৎ হাসিতে ফাটিয়া পড়িল। অনন্ত চম্কাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘হাস কেনে?’
মেয়েটির চোখ দুটি নাচিয়া উঠিল, ‘তোমার গলায় যে মালা দিলাম; কারো কাছে কইও না কইলাম।‘
‘কইলে কি হইব?’
‘তোমারে বর বইল্য মানুষে ঠাট্টা করব।‘
‘দূর। আমি কি শামসুন্দর বেপারী, আমার কি ঐ লকম বড় বড় দাড়ি আছে যে আমারে বর কইব!’
‘বরের বুঝি লম্বা দাড়ি থাকে? মিথ্যুক।‘
‘আমি নিজের চোখে দেখলাম। মা আমারে সাথে কইরা নিয়া দেখাইছিল। আরো কত লোকে দেখতে গেছিল। তারা কইল, এতদিন পরে বরের মত বর দেইখ্যা নয়ন সার্থক করলাম।‘
‘ও, বুঝ্ঝি। বুড়া, বুড়া বর। সে ত বুড়া কিন্তু তুমি ত বুড়া না।’
অনন্ত বুড়া কিনা ভাবিয়া দেখিতে গিয়া সব গোলমাল করিয়া ফেলিল। এমন সময় ডাক আসিল, ‘কইলো অনন্তবালা, ও সোণার-মা!’
মায়ের আহ্বান। আদুরে মেয়ে। মা তাকে ডাকিতে তুইটি নামই ব্যবহার করেন। খাওয়ার সময় হইয়াছে। তার আগে নাইবার জন্য এই আহ্বান।
অন্য একটি মেয়ে সাপলা চিরিয়া বোতল বানাইয়াছে, তাতে গ্রন্থি পরাইতেছিল। সে মাথা না তুলিয়াই ছড়া কাটিল ‘অনন্ত বালা, সোণার মালা, যখনি পরি তখনি ভালা।‘
‘দেখল। ত, আমার নাম কতজনে জানে। আমার নাম দিয়া শিলোক বানাইছে। মা ডাক্তাছে। আমি যাই। যে-কথা কইলাম—কারো কাছে কইও না, কেমুন?’
‘না।‘
‘আমি কিন্তু কইয়া দিমু।’
‘কি?’
‘তুমি আমার খোঁপায় মালা দিছ—এই কথা।’
‘কার কাছে?’
‘মার কাছে।‘
অনন্ত বিচলিত হইয়া উঠিল।
‘আরে না না। মা তোমারে বকব না। আদর করব। তুমিও চল না আম্রার বাড়িত!‘
অনন্ত বলিল ‘না।’
মাসীর জন্য তার মনটা এই সময় বেদনায় টন্ টন্ করিয়া উঠিয়াছিল!
এই সময় তিতাসের বুকে কিসের বাজনা বাজিয়া উঠিল। ছেলের দল পূজার বাড়ি ফেলিয়া দৌড়াইয়া চলিল নদীর দিকে। সকলেরই মুখে এক কথা—দৌড়ের নাও, দৌড়ের নাও।
নামটা অনন্তর মনে কৌতুহল জাগাইল। অনেক নাও সে দেখিয়াছে, এ নাও ত কই দেখে নাই। ঘাটে গিয়া দেখে সত্যি এ দেখিবার জিনিসই বটে। অপূর্ব, অপূর্ব।
রাঙা নাও। বর্ষার জলে চারিদিক একাকার। এদিকে ওদিকে কয়েকটি পল্লী যেন বিলের পানিতে সিনান করিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তিতাসের বুক শাদা, তার পারের সীমার বাহিরে সাপলাসালুকের দেশ, অনেক দূরে ধানক্ষেত পাটক্ষেত, তাহাও জলে ভাসিতেছে। নৌকাটি তিতাস পার হইয়া দূরের একখানা পল্লীর দিকে রোখ করিয়াছে। গলুইটা জলের সমান নিচু। সরু ও লম্বা পাছাটা পেটের পর হইতে উঁচু হইয়া গিয়া আকাশে ঠেকিয়াছে; হালের কাঠিটা তির্যকভাবে আকাশ ফুড়িবার মতলবে যেন উচাইয়া উঠিয়াছে। তাহাতে ধরিয়া একটা লোক নাচিতেছে আর পাটাতনে পদাঘাত করিতেছে। লোকটাকে একটা পাখির মত ছোট দেখাইতেছে। ডরার উপর দাঁড়াইয়া একদল লোক খোল করতাল বাজাইয়া সারি গাহিতেছে। আর তাহারই তালে তালে দুই পাশে শত শত বৈঠা উঠিতেছে নামিতেছে, জল ছিটাইয়া কুয়াসা স্থষ্টি করিতেছে।
কিন্তু অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতে পাওয়া গেল না। পল্লীর গাছপালা ঘরবাড়ির আড়ালে ঢাকা পড়িয়া গেল। ছেলেরা অনন্তকে সান্ত্বনা দিল, গাঁয়ের এই পাশ দিয়া আড়ালে পড়িয়াছে, ঐ-পাশ দিয়া নিশ্চয়ই বাহির হইবে।
কিন্তু আর বাহির হইল না।
কেন বাহির হইল না জিজ্ঞাসা করিতে ছেলেরা জানাইল, হয়ত ঐ-গাঁয়ের ঐ-পাশটিতে ওদের ঘরবাড়ি। নৌকা সাজাইয়া রঙ করাইয়া লোকজন লইয়া তালিম দিতে গিয়াছিল। পাঁচদিন পরেই বড় নৌকা-দৌড় কিনা। নাও কেমন চলে দেখিবার জন্য একপাক ঘুরিয়া আসিয়াছে। এখন ওদের ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া যে-যার বাড়ি খাইতে চলিয়া গিয়াছে।
আর নয় তো ঐ-গায়ের আড়াল দিয়া সোজা চলিয়া গিয়াছে দূরের কোন খলায় দৌড়াইবার জন্য।
শেষের কথাটাই অনন্তর নিকট অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে হইল। যেরকম সাপের মত হিস্ হিস্ করিয়া চলিয়াছিল, ঐ-গাঁয়ে উহা থামিতেই পারে না। সারাগায়ে লতাপাতা সাপ ময়ূরের ছবি লইয়া রঙিন দেহ তার একের পর এক পল্লীর পাশ কাটাইয়া আর হাজার হাজার ছেলেমেয়ের মন পাগল করিয়া ছুটিয়াই চলিয়াছে। সারাদিন চলিবার পর কোথায় রাত্রি হইবে কে জানে।