ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১.
বিয়ের পরদিন সকালে সব বাড়িই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। নবদম্পতি দেরি করে ওঠে। বাড়িতে লোকজন দেরি করে আসে। বেলা বারোটার পর বাস্ক যখন ঘরের ভেতর কাজ করছিল হঠাৎ সে দরজায় মৃদু করাঘাত শুনতে পেল। দরজা খুলে দেখল, মঁসিয়ে ফশেলেভেস্ত দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।
বাস্ক ব্যস্ত হয়ে বলল, আজ আমাদের উঠতে দেরি হয়ে গেছে মঁসিয়ে।
তোমাদের মালিক উঠেছেন?
কোন মালিক–পুরনো না নতুন?
মঁসিয়ে পঁতমার্সি।
আপনার হাতটা কেমন আছে?
ভালো।
আপনি বসুন, আমি মঁসিয়ে লে ব্যারন পঁতমার্সিকে ডেকে দিচ্ছি।
সেকালের গৃহভৃত্যরা তাদের মালিকদের উপাধি ও সামাজিক মর্যাদা সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিল। কারণ ওই উপাধিতে তারাও গৌরবান্বিত বোধ করত নিজেদের। একদিন এই উপাধির জন্য মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ কত ঝগড়া করেন মেরিয়াসের সঙ্গে। অথচ মেরিয়াস যখন উপাধি সম্বন্ধে উদাসীন একেবারে, তখন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদই মেরিয়াসের এই উপাধির ব্যাপারে বেশি আগ্রহান্বিত।
বাস্ক ঘর থেকে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল মেরিয়াসকে ডাকার জন্য, জাঁ ভলজাঁ তখন তাকে। সাবধান করে দিল, আমার কথা বলবে না। বলবে কে একজন গোপনে দেখা করতে চায়।
বাস্ক চলে গেলে ভলজাঁ একা বসে রইল স্তব্ধ হয়ে। গতরাতে একেবারে ঘুম না হওয়ায় তার মুখ-চোখ ম্লান আর রোগা রোগা দেখাচ্ছিল। তার কালো কোটটাকেও পাটভাঙা আর ময়লা দেখাচ্ছিল। মেঝের উপর কাঁপতে থাকা একফালি সূর্যরশ্মির দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে ছিল ভলজাঁ।
এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল মেরিয়াস। গতরাতে তারও ঘুম হয়নি। ভলকে দেখেই সে আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল, বাবা আপনি! বাস্ক তো বলেনি। তবে আপনি হয়তো একটু আগে এসে পড়েছেন, এখন মাত্র সাড়ে বারোটা, কসেত্তে এখনও ওঠেনি।
বিয়ের আগে ভলজাঁ সম্বন্ধে একটা রহস্য বরাবর দানা বেঁধে ছিল মেরিয়াসের মনে। তাই সে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারত না তার সঙ্গে। কিন্তু এখন প্রেমের আবেগে আগেকার সেই ভাবটা দূর হয়ে যায়। মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত যখন কসেত্তে’র বাবা তখন। বিয়ের পর থেকে সে তারও বাবা। তাই ভলজাঁকে বাবা বলেই ডাকল সে।
মেরিয়াস আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, আপনাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি। কাল হঠাৎ আপনি চলে যাওয়ায় আমরা সকলেই আপনার কথা বলাবলি করছিলাম। আপনার হাতটা ভালো আছে তো? কসেত্তে আপনার কথা বলছিল। সে আপনাকে খুব ভালোবাসে। আপনার হয়তো মনে আছে এ বাড়িতে আপনার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘরটা আমাদের ঘরের পাশে এবং তার পাশেই বাগান। বসন্তকালের রাত্রিতে আপনি নাইটিঙ্গেল পাখির গান শুনতে পাবেন। দিনের বেলায় কসেত্তে কত কথা বলবে। সে আপনার বই ও জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখবে। র্যু হোমির বাড়িতে একা একা থাকার কোনও দরকার নেই। আপনি আজই চলে আসবেন। কসেতে চায়, আপনি এখানেই থাকুন আমাদের কাছে। বিকালে আপনি যেমন লুক্সেমবুর্গ বাগানে কসেত্তেকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন তেমনি এখানেও তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন। আমাদের সুখে আপনিও অংশগ্রহণ করবেন বাবা। হ্যাঁ, আর আপনি আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেয়ে যাবেন।
সব কিছু চুপ করে শুনে এতক্ষণে কথা বলল ভলজাঁ। সে বলল, আমার একটা কথা বলার আছে মঁসিয়ে। আমি একজন পলাতক কয়েদি।
কথাটা মেরিয়াসের কানে গেলেও সে তার মানে বুঝতে পারেনি। সে বিহ্বল হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভলজাঁ’র পানে তাকিয়ে দেখল, তার মুখখানা খুবই বিব্রত এবং ম্লান।
ভলজাঁ সহসা তার হাতের বাঁধনটা সরিয়ে হাতটা মেরিয়াসের দিকে বাড়িয়ে দেখিয়ে বলল, আমার হাতে কিছুই হয়নি। আমি তোমাদের বিয়ের ভোজসভা থেকে দূরে থাকার জন্যই হাতভাঙার কথা বলেছিলাম। তাছাড়া পরে যদি কোনও বিপত্তি দেখা দেয় এই ভয়ে আমি তোমাদের বিয়ের কাগজপত্রে সই করিনি।
মেরিয়াস বলল, কিন্তু এ সবের অর্থ কী?
ভলজাঁ বলল, অর্থ এই যে আমি সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলাম। আমার উনিশ বছরের কারাদণ্ড হয়। প্রথমে চৌর্যবৃত্তির অপরাধে, পরে জেল থেকে পালানোর জন্য। বর্তমানে আমি পলাতক কয়েদি।
মেরিয়াস ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে একথা অবিশ্বাস করতে পারল না। কিন্তু সে একথা মেনে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি সব কথা বলুন। আচ্ছা, আপনি কি সত্যিই কসেত্তে’র পিতা?
ভলজাঁ খাড়া হয়ে বসে যথেষ্ট আত্মমর্যাদাসূচক গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, আমার কোনও কথা আইন-আদালতে গ্রাহ্য না হলেও এ বিষয়ে আমার কথা বিশ্বাস করতে পার তুমি। আমি কসেত্তে’র পিতা নই এবং তার সঙ্গে আমার কোনও আত্মীয়তা নেই। আমার নাম ফশেলেভেন্ত নয়। আমার নাম জাঁ ভলজাঁ। আমি ফেবারোল গাঁয়ের এক চাষি পরিবারের। ছেলে। সেখানে আমি প্রথমজীবনে গাছকাটার কাজ করতাম।
মেরিয়াস বলল, এ কথার প্রমাণ?
আমার কথাই আমার প্রমাণ।
মেরিয়াস ভলজাঁ’র পানে তাকিয়ে দেখল তার চোখেমুখে হিমশীতল এক বিষাদঘন প্রশান্তি বিরাজ করছিল তার মাঝে এক প্রস্তরকঠিন নিষ্ঠা আর সততা স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। তার সে মুখ থেকে কোনও মিথ্যা বেরিয়ে আসতে পারে না।
ভলজাঁ বলল, যদি বল কসেত্তে’র সঙ্গে আমার তা হলে সম্পর্ক কী, তা হলে বলব, দশ বছর আগেও আমি তার অস্তিত্বের কথা জানতাম না। আজ থেকে নয় বছর আগে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। সে তখন খুবই ছোট। পিতৃমাতৃহীন অনাথ শিশুর প্রতি কোনও বয়স্ক লোকের পিতৃসুলভ স্নেহমমতা জাগা স্বাভাবিক। আমারও তাই হয়েছিল। আমার অন্তঃকরণ বলে একটা জিনিস ছিল এবং আমি আমার সেই অন্তরের সব স্নেহমমতা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলাম তাকে। তখন তার সে স্নেহমমতার দরকার ছিল। আমার এ কাজ ভালো বা তুচ্ছ যা-ই বল আমি তখন তা করেছিলাম। তাকে সব দিক দিয়ে রক্ষা করেছিলাম আমি। এখন সে বিবাহিত, এখন তার প্রতি আমার আর কোনও দায়দায়িত্ব নেই। এখন তার ও আমার পথ সম্পূর্ণ পৃথক। যে টাকা আমি তোমাদের দিয়েছি ওটা এক ট্রাস্টের সম্পত্তি ছিল তার নামে। কী করে সেটা আমার হাতে এল সেকথা এখন নিষ্প্রয়োজন। আমি তা এতদিন সযত্নে রক্ষা করে এসেছি। আমি আমার নিজের জন্য তোমাকে সব কথা বললাম, আমার আসল নাম বললাম।
মেরিয়াস তখন একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। মদের নেশায় যেন মাতাল হয়ে পড়েছিল সে। তার মনে হল ভলজাঁ যেন তাকে এক গুরুতর আঘাত দিয়েছে এইসব অবাঞ্ছিত কথা বলে।
সে বলল, এসব কথা আপনার মনের মধ্যে না রেখে আপনি আমাকে বলতে গেলেন। কেন? কে আপনাকে বাধ্য করেছে এ সব কথা বলতে? আপনাকে কেউ ধরতে আসেনি। আপনার নামে কোনও পরোয়ানা বার হয়নি। অবশ্য আপনার কোনও ব্যক্তিগত কারণ থাকতে পারে একথা বলার। কিন্তু কী সে কারণ? আমার মনে হয় আরও কিছু গোপনীয় কথা আছে। আপনি সে কথা খুলে বলুন।
ভলজাঁ বলল, তার শুধু একটা কারণ আছে এবং সেই অদ্ভুত কারণ হল আমার সততা। আমি আমার অন্তরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম এ বিষয়ে। আমি সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারতাম, আমি দূরে চলে যেতে পারতাম কোনও কথা না বলে। কিন্তু আমার অন্তরটা পড়ে থাকত এখানে। তাই যাবার আগে অন্তরটাকেও ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তোমরা হয়তো বলবে আমি কত বোকা! কেন, আমিও তো এখানেই থাকতে পারি। এখানে তোমরা ঘর দিয়েছ থাকতে, এখানে কসেত্তে’র ভালোবাসা আছে। তোমার দাদু আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এই সুখী পরিবারের একজন হয়ে আমি সুখে থাকতে পারতাম।
ভলজাঁ’র মুখের ভাবটা বদলে গেল হঠাৎ। সে তার কণ্ঠটাকে ঝাঁঝালো করে বলতে লাগল, আমার কোনও পরিবার নেই, আমি তোমাদের পরিবারের কেউ নই। আমি মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বহিষ্কৃত এক কয়েদিমাত্র। আমার আর কেউ কোথাও নেই, কখনও ছিল না। এক একসময় মনে হয় আমার মা-বাবাও হয়তো ছিল না। আমার শুধু জীবনে একজনই ছিল, সে এখন পর হয়ে গেছে, সে এখন বিবাহিত। আমি তার জন্যই। এতদিন আমার আসল নাম গোপন করে তোমাদের ঠকিয়ে এসেছি। এখন সে কাজ আমার হয়ে গেছে। তাই সারারাত আমি নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমাকে সব কথা খুলে বলতে এসেছি। একথা না বলে আমি হয়তো সুখ পেতাম, কিন্তু মনে শান্তি পেতাম না। সারাজীবন আমাকে তা হলে মিথ্যা আর প্রতারণার সঙ্গে বেঁচে থাকতে হত। আমার খাওয়া, শোয়া, বসা, আমার হাসি, কথাবার্তা–সব কিছুর মধ্যে থাকত মিথ্যা। আর প্রতারণা। তোমাদের মাঝখানে থেকে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার কেবলই মনে হত, আমার আসল পরিচয় জানলে তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দিতে। তোমাদের ঝি-চাকরেরা পর্যন্ত সে পরিচয় পেলে ভয়ে শিউরে উঠত। যে জন্ম থেকে সারাজীবন অবহেলিত, অবজ্ঞাত–তার আবার সুখ কিসের?
ভলকে কোনও বাধা দিল না মেরিয়াস। বাধা দেওয়া বৃথা, কারণ আবেগে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার অন্তর। সে আবার আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, তোমরা হয়তো বলতে পার, এখন আমাকে কেউ ধরেনি বা ধরা পড়ার বিপদও নেই। কিন্তু বাইরের কেউ না ধরলেও আমার বিবেক, আমার কর্তব্যবোধের হাতে আমি ধরা পড়ে গিয়েছি। আমার আত্মাই আমাকে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করছে পেছন থেকে। এই কর্তব্যবোধ, এই বিবেক বড় সাংঘাতিক জিনিস, তাদের বিধান অমোঘ নির্মম। তারা মানুষকে শাস্তি দেয়, আবার পুরস্কারও দেয়। তারা যদি আমাকে নরকে নিক্ষেপ করে তা হলে সেখানে গিয়েও আমি ঈশ্বরকে দেখতে পাব, স্বর্গসুখ অনুভব করব। আমার অন্তর ভেঙে গেলেও মনে শান্তি পাব।
ভলজাঁ’র কণ্ঠটা আবার বদলে গেল। মর্মস্পশী কণ্ঠে সে আবার বলতে লাগল, এ কথা সব বলার পর আজ নিজেকে সম্মানিত মনে হচ্ছে আমার। নিজেকে ছোট না করে অপরের কাছ থেকে শ্রদ্ধা বা সম্মান পেতে পারি না আমি। এক অপরাধী কয়েদির বিবেক এত তীক্ষ্ণ কেন হল–এটাকে অনেকের বৈপরীত্য বলে মনে হতে পারে।
একটু চুপ থেকে আবার বলতে লাগল ভলজাঁ। বলল, যদি কোনও মানুষের মাথায় এই ধরনের কলঙ্কের কালিমা নেমে আসে তা হলে অপর কারও মাথায় তাকে না জানিয়ে সে কালিমা সঞ্চারিত করে দেবার কোনও অধিকার নেই তার। যেমন প্লেগরোগগ্রস্ত কোনও রোগীর অপরের মধ্যে সে রোগ সংক্রমিত করে দেবার কোনও অধিকার নেই। আমি চাষি ঘরের ছেলে হলেও কিছুটা লেখাপড়া শিখেছি। আমার বিবেক আছে, বুদ্ধি আছে। দেখছ তো, আমি কথাবার্তাও ভালো বলতে পারি। আমি নিজে শত কষ্ট পাব সে ভালো, কিন্তু কোনও সৎ ও ভদ্র মানুষকে ঠকাতে পারব না। কখনই না। একদিন আমি বাঁচার জন্য একটা পাউরুটি চুরি করেছিলাম, কিন্তু আজ আমি বেঁচে থাকার জন্য একজনের নাম চুরি করতে পারি না। যদিও সে নামটা আমি তার একটা উপকার করার জন্য ফশেলেভেন্ত নামে একটা লোকই দিয়েছিল। কিন্তু সে নাম ব্যবহার করার কোনও অধিকার নেই আমার।
মেরিয়াস বলল, কিন্তু শুধু বেঁচে থাকার জন্য ও নাম ধার করার কোনও প্রয়োজন নেই আপনার।
ভলজাঁ বলল, কিন্তু এর মনে কী তা আমি জানি।
এরপর কিছুক্ষণ দু জনেই চুপচাপ রয়ে গেল। ভলজাঁ ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল আর মেরিয়াস টেবিলের উপর হাতে মাথা রেখে ভাবতে লাগল। দু জনে মগ্ন হয়ে রইল আপন আপন চিন্তায়।
পায়চারি করে বেড়াতে বেড়াতে এক সময় দেয়ালে টাঙানো আয়নার উপর নিজের প্রতিফলনটা একবার দেখে বলল, এখন আমি অনেকটা স্বস্তিবোধ করছি।
এই কথা বলে আবার পায়চারি করতে লাগল ভলজাঁ। সে যখন দেখল মেরিয়াস তারই পানে তাকিয়ে রয়েছে, তখন আবার বলতে লাগল, মনে কর, আমি তোমাদের কিছুই বলিনি, আমি তোমাদের সঙ্গেই এ বাড়িতে একসঙ্গে বাস করেছি, তোমাদেরই একজন হয়ে তোমাদের সুখে সুখী হয়ে মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তরূপে সম্মানিত জীবন যাপন করছি। মনে কর তোমাদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে বেরিয়েছি, হাসাহাসি ও গল্প করছি, এমন সময় কেউ আমাকে জাঁ ভলজাঁ নামে ডেকে ফেলল অথবা কোনও পুলিশ এসে আমার কাঁধের উপর হাত রাখল এবং আমাকে ধরে নিয়ে গেল। তখন তুমি কী করবে?
মেরিয়াস কিছুই বলতে পারল না। তার কিছুই বলার নেই এ বিষয়ে।
ভলজাঁ বলল, এবার তা হলে বুঝতে পারছ কেন আমি এসব কথা না বলে থাকতে পারলাম না। কিন্তু কিছু মনে কর না। তোমরা সুখী হও, সুখে থাক। আমার মতো একজন সমাজ-বহির্ভূত লোক কিভাবে তার কর্তব্য পালন করে, তা নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাবার কোনও প্রয়োজন নেই।
মেরিয়াস এগিয়ে গিয়ে ভলজাঁ’র একটা হাত ধরল। কিন্তু সে হাত মর্মরপ্রস্তরের মতো শক্ত আর হিমশীতল।
মেরিয়াস বলল, আমার দাদুর অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, আমি আপনাকে খালাস করে দেব।
ভলজাঁ তার হাতটা ছাড়িয়ে বলল, তার আর দরকার হবে না। আমি মরে গিয়েছি বলে সবাই জানে, এটাই যথেষ্ট। আমি আমার কর্তব্য করে যাব। আমার বিবেকই আমায় মুক্তি দিতে পারে।
এমন সময় ঘরের দরজাটা আধখানা খুলে গেল এবং কসেত্তে তার ভেতর মুখটা বাড়িয়ে দিল। তার সুন্দর চুলগুলো তখন আলুথালু অবস্থায় ছিল এবং তার চোখ দুটো ঘুমে ভারী হয়ে ছিল। পাখি যেমন তার বাসার ভেতর থেকে মুখ বার করে দেখে তেমনি কসেত্তে মুখটা বাড়িয়ে তার স্বামী ও ভলজাঁর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তোমরা হয়তো রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছ। কী অবান্তর ব্যাপার, তোমরা আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতে!
ভলজাঁ চমকে উঠল। মেরিয়াস বিব্রত হয়ে আমতা আমতা করে বলল, কসেত্তে–।
তারা দু জনেই নিজেদের অপরাধী ভাবল।
কসেত্তে তার উজ্জ্বল চোখ দুটো দিয়ে তখনও তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বলতে লাগল, আমি তোমাদের ধরে ফেলেছি। দরজা খুলেই আমি তোমাদের বিবেক এবং কর্তব্য সম্বন্ধে কিছু কিছু কথা শুনে ফেলেছি। ওসব রাজনীতির কথায় আমার কোনও দরকার নেই। বিয়ের পরদিন কেউ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে না।
মেরিয়াস বলল, তুমি ভুল করছ, আমার ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলছিলাম। কিভাবে টাকাটা খাটানো যায় আমরা বলছিলাম তারই কথা।
কসেত্তে ঘরের ভেতর ঢুকে বলল, এই কথা? আমি তা হলে তো তোমাদের সে কথায় যোগদান করতে পারি।
কসেত্তে এমন সাদা জমকালো গাউন পরেছিল যাতে তার ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা ছিল। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে বলল, আমি তোমাদের পাশে বসছি। খাবার প্রস্তুত হতে এখনও আধঘণ্টা দেরি আছে। তোমরা যা খুশি আলোচনা করতে পার। আমি তোমাদের বাধা দেব না। আমি খুব ভালো মেয়ে।
মেরিয়াস তাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, আমরা ব্যবসার ব্যাপারে কথা বলছিলাম। এ সব অঙ্কের ব্যাপার তোমার ভালো লাগবে না।
কসেত্তে বলল, না, ভালো লাগবে। তোমার নেকটাইটা কত সুন্দর মেরিয়াস! তোমাকে খুব চটপটে দেখাচ্ছে।
মেরিয়াস বলল, না, তোমার ভালো লাগবে না।
আমি তা বুঝতে না পারলেও শুনে যাব। তোমাদের দু জনের কাছে আমি থাকতে চাই। তোমাদের কণ্ঠস্বরটাই যথেষ্ট আমার কাছে।
প্রিয়তমা কসেত্তে, সেটা অসম্ভব।
অসম্ভব!
হ্যাঁ।
কসেত্তে বলল, ঠিক আছে, আমি তোমাদের কতকগুলি মজার খবর দিই। যেমন ধর, দাদু এখনও ঘুমোচ্ছেন, মাসিমা চার্চের প্রার্থনা সভায় গেছেন। নিকোলেত্তে ঝাড়দার ডাকতে গেছে। নিকোলেত্তে তুস’র তোতলামির জন্য তাকে ক্ষেপাচ্ছিল বলে তাদের দু জনের এরই মধ্যে ঝগড়া হয়ে গেছে। এসব কথা তোমরা জানতে না। প্রিয়তম মেরিয়াস, আমাকে এখানে থাকতে দাও।
প্রিয়তমা কসেত্তে, আমি শপথ করে বলছি, আমাদের দুজনকে এখন নির্জনে থাকতে হবে।
কিন্তু আমি নিশ্চয় বাইরের লোক নই।
ভলজাঁ এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। কসেত্তে এবার তার দিকে ঘুরে বলল, বাবা, তুমি আমাকে এসে চুম্বন কর। তুমি কী ধরনের বাবা? দেখছ না, আমার স্বামী আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভলজাঁ তার কাছে যেতেই কসেত্তে তার কপালটা বাড়িয়ে দিল এবং ভলজাঁ তার উপর চুম্বন করল। কসেত্তে বলল, তোমার মুখখানা এমন ম্লান দেখাচ্ছে কেন বাবা? তোমার হাতটায় কি এখনও ব্যথা করছে?
না।
তোমার মনে কি কোনও অশান্তি আছে?
না।
তা হলে আমার কপালটায় আবার চুম্বন করে হাস।
ভলজাঁ আবার তার কপালে চুম্বন করে এক ভুতুড়ে হাসি হাসল।
কসেত্তে বলল, এবার তা হলে তুমি আমার পক্ষ অবলম্বন করে ওকে বক। ওকে বল, আমি এখানে থাকতে পারি। তুমি ভাবছ আমি খুব দুষ্টু। কিন্তু ব্যবসা, টাকা লগ্নি–এসব ব্যাপার এমন কী কঠিন? পুরুষরা সব ব্যাপারকেই ঘোরালো ও জটিল করে তোলে অকারণে। আমি এখানে থাকব। আজ আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তাই না মেরিয়াস?
এই বলে সে মেরিয়াসের পানে মদির দৃষ্টিতে তাকাতে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খেলে গেল তার চোখে। মেরিয়াস উঠে দাঁড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করল। ভলজাঁ’র উপস্থিতির কথা যেন ভুলে গেল।
কসেত্তে এবার বিজয়িনীর হাসি হেসে বলল, তা হলে আমি থাকছি।
মেরিয়াস বলল, না প্রিয়তমা। একটা ব্যাপার আজ আমাদের ঠিক করতেই হবে।
তবু নয়?
আমি বলছি সেটা অসম্ভব।
ঠিক আছে, আমি যাই। বাবা, তুমি কিন্তু আমায় সমর্থন করলে না। তোমরা দু জনেই অত্যাচারী, নিষ্ঠুর। আমি দাদুর কাছে গিয়ে অভিযোগ করব। তোমরা যদি ভাব আবার আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসব তা হলে ভুল করবে। আমি আর আসব না তোমাদের কাছে, তোমাদেরই যেতে হবে আমার কাছে। আমি যাচ্ছি।
যেতে যেতে দরজাটা বন্ধ করার সময় উঁকি মেরে বলল, আমি কিন্তু তোমাদের দু জনের ওপরেই খুব রেগে গিয়েছি।
দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলে ঘরখানা আবার অন্ধকার হয়ে উঠল। মেরিয়াস হতাশ হয়ে বলল, হায়, বেচারা কসেত্তে! সে যখন শুনবে…।
সে কথা শুনে ভলজাঁ’র সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। সে পাগলের মতো মেরিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল, তা তো বটেই। সবার সব কথা সহ্য করার শক্তি থাকে না। আমার অনুরোধ, তুমি কথা দাও, ওকে একথা বলবে না। তুমি নিজে জানলেই হবে। কয়েদি, সশ্রম কারাদণ্ড–এসব কথা শুনলে সে ভয়ে অভিভূত হয়ে পড়বে।
ভলজাঁ একটা আর্মচেয়ারে বসে তার হাতে মুখ ঢাকল। সে কোনও কথা বলল না। কিন্তু তার কান্নার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ভলজাঁ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে মড়ার মতো শুয়ে পড়ল। চোখ দুটো বন্ধ করে বলে উঠল, এর থেকে মৃত্যু ভালো ছিল।
মেরিয়াস বলল, ভাববেন না। আমি আপনার কথা গোপন রেখে দেব। তার কণ্ঠ থেকে বোঝা গেল ভলজাঁ আর তার মধ্যে নতুন অবস্থার জটিল পরিপ্রেক্ষিতে যে ব্যবধান গড়ে উঠেছে সে বিষয়ে সে সচেতন পূর্ণমাত্রায়।
মেরিয়াস বলল, ট্রাস্টের টাকাটা আপনি যে বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তার জন্য আপনাকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। আপনি কোনও কুণ্ঠা বা দ্বিধা না করে সে পুরস্কারের টাকাটা কত হওয়া উচিত তা বলে ফেলুন।
ভলজাঁ শুধু শান্তকণ্ঠে বলল, ধন্যবাদ মঁসিয়ে। সব কিছু ঠিক হয়ে গেল, শুধু একটা জিনিস বাকি রয়ে গেল।
কী সে জিনিস?
তুমি হচ্ছ এখন মালিক। তুমি কি মনে কর কসেত্তের সঙ্গে আমার আর দেখা হওয়া উচিত নয়?
মেরিয়াস নীরসভাবে বলল, আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে।
ভলজাঁ বলল, তা হলে আমি আর দেখা করব না।
এই বলে সে উঠে দরজার দিকে চলে গেল।
কিন্তু যাবার জন্য দরজাটা একটু খুলেই আবার মেরিয়াসের কাছে ফিরে এল ভলজাঁ। তার মুখখানা শুধু ম্লান নয়, মৃতের মতো সাদা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। তার চোখে কোনও জল ছিল না। তার পরিবর্তে যেন আগুন ছিল সে চোখে। কিন্তু কণ্ঠটা আশ্চর্য রকমের শান্ত ছিল।
সে বলল, মঁসিয়ে, মাঝে মাঝে এসে কসেত্তেকে দেখে যাবার অনুমতি দাও আমাকে। মাঝে মাঝে দেখে যাবার অনুমতি পাব বলেই আমি এসব কথা বলেছি তোমাকে তোমার সম্মানের খাতিরে! তা না হলে কিছু না বলেই ঘরে চলে যেতাম। আজ নয় বছর ধরে সে আমার কাছে আছে। প্রথমে গর্বোর ব্যারাকবাড়িটাতে, তার পর কনভেন্টে, তার পর র্যু প্লমেতের বাড়িতে, অবশেষে লা হোমিতে। এই নয় বছরের মধ্যে বেশিদিনের জন্য আমরা কেউ কারও কাছছাড়া হইনি। এখন হঠাৎ দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে গেলে আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন হবে। তবে আমাকে অনুমতি দাও, আমি মাঝে মাঝে এসে নিচের ঘরে এসে তার সঙ্গে দেখা করে যাব। আমি খুব বেশি আসব না এবং বেশিক্ষণ থাকব না। তাছাড়া আমি একেবারে না এলে অনেকে কথা বলতে পারে। আমি বরং সন্ধ্যার দিকে অন্ধকার হয়ে উঠলে আসব।
মেরিয়াস বলল, আপনি রোজ সন্ধ্যায় আসবেন।
ভলজাঁ খুশি হয়ে বলল, মঁসিয়ে, সত্যিই তোমার অসীম দয়া।
তারা করমর্দন করল। ভলজাঁ বিদায় নিল। মেরিয়াস ভলকে দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
আপন মনে ভাবতে লাগল মেরিয়াস। কসেত্তে’র পিতা হিসেবে পরিচিত মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তু নামে যে লোকটিকে দেখে সব সময় তার মনে হত লোকটি যেন কী একটা গোপন রহস্য চেপে রেখে দিয়েছে তার অন্তরের মধ্যে, যার সঙ্গে প্রাণ খুলে মেশার কোনও উৎসাহ পেত না সে, আজ তার কারণটা নিশ্চিতরূপে জানতে পারল সে। কিন্তু আজ তার সুখের দিনে তার সেই গোপন রহস্যটা জানতে পারাটা সুখী কপোতের বাসায় একটা কাকড়াবিছে দেখতে পাওয়ার মতোই এক অবাঞ্ছিত ঘটনা বলে মনে হল। এখন থেকে তার ও কসেত্তে’র জীবনের সব সুখ কি ওই লোকটার ওপরে নির্ভর করবে এবং তাদের বৈবাহিক বন্ধনের একটা শর্ত হিসেবেই কি মেনে নিতে হবে তাকে? সত্যিই কি সে এক জেলপলাতক কয়েদি?
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে আবার একথাও ভাবতে লাগল যে এ বিষয়ে তারও একটা দোষ আছে। তার কি বাস্তব বুদ্ধি-বিবেচনা সব লোপ পেয়েছিল এবং সে কি ইচ্ছা করেই তার চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছিল? এটা সে অস্বীকার করতে পারে না যে তার প্রকৃতিটাই কল্পনাপ্রবণ এবং প্রেমাবেগের বশবর্তী হয়ে সে কসেত্তে’র প্রতি ভালোবাসার গভীরে ডুবে যাওয়ার আগে তার বাস্তব জীবন সম্বন্ধে কোনও খোঁজখবর নেয়নি। র্যু প্লামেতের বাগানে ছয়টি সপ্তাহ ধরে সে যখন কসেত্তে’র সঙ্গে নিবিড় প্রেমালাপে মত্ত হয়ে ছিল তখন সে একটি দিনের জন্য গর্বের বাড়িতে দেখা সেই নাটকীয় ঘটনার কথাটার একবারও উল্লেখ করেনি কসেত্তে’র কাছে। থোর্দিয়েরদের সম্বন্ধেও কোনও কথা বলেনি তাকে। ছয়টি সপ্তাহ একটা স্বপ্নের মতো কেটে যায়। তখন ভালোবাসার কথা ছাড়া আর কোনও কথাই মনে পড়েনি।
আবার ভাবল কসেত্তেকে সে সব কথা বললেই-বা কী হত? জাঁ ভলজাঁ সম্বন্ধে যে কথা সে জানতে পেরেছিল সে কথা কসেত্তেকে বললেই-বা কী হত? তাতে কসেত্তে’র প্রতি তার মনোভাবের কোনও পরিবর্তন হত? তার প্রতি দুর্বার প্রেমাবেগকে কি সে ঠেকিয়ে রাখতে পারত? মোটেই না। সুতরাং এ বিষয়ে অনুশোচনা বা দুঃখ করার কোনও কারণ নেই। অন্ধভাবে যে পথ সে অনুসরণ করেছিল, খোলা চোখে সে সেই একই পথ ধরে চলত। যে প্রেম তাকে অন্ধ করে দেয় সেই প্রেমই তাকে নিয়ে যায় স্বর্গসুখের এক ঐন্দ্রজালিক রাজ্যে।
জাঁ ভলজাঁ নামে ওই লোকটার প্রতি যে হিমশীতল ঔদাসীন্য তার কাছ থেকে তাকে দূরে ঠেলে রেখেছিল আজ সেই ঔদাসীন্যটা এক অব্যক্ত ভীতি, করুণা এবং বিস্ময়ের এক মিশ্র অনুভূতিতে পরিণত হল। যে লোক চোর, জেলপলাতক কয়েদি সেই লোকই ছয় লক্ষ ঐ তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। সে টাকার কথা কেউ জানত না। সে টাকাটা সে নিজের জন্য রেখে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে সে টাকা সব সে দিয়ে দিয়েছে। তাদেরই সুখের জন্য। সে তাদের পরিবারে নিরাপদে ও সুখে বাস করতে পারত কাউকে কোনও কথা না বলে, কিন্তু সে লোভ সংযত করে তার গোপন সব কথা বলে দিয়েছে। এটা তার নিশ্চয় নিষ্ঠা, সততা ও মহত্ত্বের পরিচায়ক। কোনও নীচাশয় হীন প্রকৃতির মানুষের মধ্যে এই ধরনের সততা দেখা যায় না। সে আর যা-ই হোক, তার বিবেক এবং নীতি আছে। একদিন সে যত খারাপই থাক, পরে নিশ্চয় তার জীবনের মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। আর এই পরিবর্তনই তার মধ্যে নিয়ে আসে নিষ্ঠা আর সততা। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তের মধ্যে তবু এক রহস্যময় অবিশ্বস্ত আর ঔদ্ধতের ভাব ছিল, কিন্তু জাঁ ভলক্স অন্য মানুষ; সে যেন সততা এবং বিশ্বস্ততার মূর্ত প্রতীক।
ভলজাঁর দোষগুলোকে চিরে চিরে নিক্তিতে চাপিয়ে ওজন করে দেখতে লাগল মেরিয়াস। জনদ্ৰেত্তের ঘরের জানালা দিয়ে পুলিশ দেখে পালায় সে। অবশ্য তার একটা কারণ ছিল, সে পলাতক কয়েদি। কিন্তু সে ব্যারিকেড়ে যায় কেন? সেখানে সে যুদ্ধে কোনও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি। তবে কি জেভার্তের ওপর তার প্রতিশোধ নেবার জন্যই সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করছিল সে? এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে সে জেতার্তকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করে।
তবে একটা প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেল মেরিয়াসের মনে। অনেক ভেবেও তার কোনও উত্তর খুঁজে পেল না। কসেত্তে’র মতো মেয়ে কিভাবে ভলজাঁ’র সংস্পর্শে এল এবং কী করেই-বা দীর্ঘ নয় বছর তারা রইল এক সঙ্গে নিয়তির কোন নিষ্ঠুর চক্রান্ত বা ঈশ্বরের কোন অদ্ভুত খেয়ালের ফলে এক দেবদূত এসে দানবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রইল এতদিন তা বুঝে উঠতে পারল না সে। এমন সাক্ষাৎ-অপরাধ আর সাক্ষাৎ-নির্দোষিতার সহাবস্থান বড় একটা দেখা যায় না। একটি মেষশাবক ঘটনাক্রমে এসে পড়ল এক নেকড়ের গুহায় আর নেকড়ে সেই মেষশাবকটিকে ভালোবেসে নয় বছর ধরে তার অস্তিত্ব রক্ষা করে এল এক অভূতপূর্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে। আর সেই অসম ভালোবাসার আশ্চর্য এক ছায়ায় কসেত্তে’র বাল্য, কৈশোর এবং প্রথমযৌবন লালিত হল। এ ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যময় বলে মনে হল মেরিয়াসের। তার মাথাটা ঘুরতে লাগল।
বাইবেলের জেনেসিসে আবেল আর কেন এই দুই ধরনের মানুষের কথা আছে। উচ্চ এবং নীচ প্রকৃতির দুটি মানুষ। কিন্তু ভলজাঁর মতো নীচ প্রকৃতির মানুষ কসেত্তে’র। মতো নিষ্পাপ সরল প্রকৃতির মেয়েকে মানুষ করল। এক অন্ধকারের জীব যেন একটি নক্ষত্রকে লালন করে আকাশে তার আবির্ভাবকে সম্ভূত করে তুলেছে। ঈশ্বর যেন কসেত্তেকে মানুষ করার জন্যই ভলজাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন। সেটা কি ভলজাঁ’র দোষ?
মেরিয়াস ভাবল, যাই হোক, কসেত্তে আজ তার। সে তাকে ভালোবাসে। ভলজাঁ’র ব্যক্তিগত ব্যাপারে তার কোনও প্রয়োজন নেই। ভলজাঁ নিজেই বলেছে কসেত্তে’র সঙ্গে কোনও আত্মীয়তা নেই। সে এতদিন কসেত্তেকে মানুষ করেছে ঠিক, কিন্তু কসেত্তের জীবনে তার আর কোনও ভূমিকা নেই, কোনও প্রয়োজন নেই তার। কসেত্তে আজ তার স্বামী আর প্রণয়ীকে পেয়ে ভলজাঁকে ফেলে রেখে পাখা মেলে যেন সুদূর স্বর্গরাজ্যে উড়ে চলে গেছে।
ভলজাঁকে নিয়ে মেরিয়াস যা-ই ভাবুক না কেন, যা-ই চিন্তা করুন না কেন, ঘুরে-ফিরে সে একটা অবাঞ্ছিত জায়গায় এসে পৌঁছচ্ছিল। তার কেবলি মনে হচ্ছিল যাই হোক ভলজাঁ সমাজপরিত্যক্ত এমনই এক ভয়ঙ্কর মানুষ যে মানবসমাজের সব স্তরগুলো একে একে অতিক্রম করে অধঃপতনের শেষ প্রান্তে নেমে গেছে। মেরিয়াস গণতন্ত্রবাদী হলেও সে আইন আর সমাজের পক্ষপাতী ছিল। তার মনে হল আইনের দিক থেকে সামাজিক কোনও অধিকার ভলজাঁ’র প্রাপ্য নয়। মেরিয়াস মুখে প্রগতির কথা বললেও তখনও পুরোপুরি প্রগতিবাদী হয়ে উঠতে পারেনি। ঈশ্বরের বিধান এবং মানুষের বিধান, আইন এবং ন্যায় ও নীতি–এই দুই-এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের কোনও ক্ষমতা ছিল না তার। তার মনে হল ভলজাঁর মতো লোকের পক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগের বিধানই উপযুক্ত শাস্তি। তাকে ঘৃণ্য জীব বলে মনে হচ্ছিল তার।
জনদ্ৰেত্তে, ব্যারিকেড, জেভার্ত প্রভৃতি বিষয়ে কোনও প্রশ্ন ভলজাঁকে করেনি মেরিয়াস। করলে কী উত্তর দিত তা বলা যায় না। আসল কথা প্রেমাবেগের আতিশয্যবশত কোনও বিষয়ের গভীরে দৃষ্টি দিয়ে সত্যাসত্য যাচাই করার মতো মনের অবস্থা তার তখন ছিল না। এই সব প্রশ্ন যদি সে করত তা হলে তার উত্তর কসেত্তের নিরীহ নির্দোষ জীবনের উপর কোনও অশুভ আলোকপাত করত কি না, তা কে জানে? মেরিয়াস তাই ভয় পেয়ে এ প্রশ্ন তুলঁতে সাহস পায়নি ভলজাঁর সামনে। অনেক সময় এসব ব্যাপারে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে অনেক পবিত্র ও শুচিশুভ্র জীবন কলঙ্কের কালিমায় লিপ্ত হয়ে উঠতে পারে। সে শুধু কসেত্তেকে চায়। তাকে আঁকড়ে ধরে ভলজাঁর দিকে চোখ বন্ধ করে থাকতে চায়।
কিন্তু সবশেষে একটা কথা ভাবতে গিয়ে অনুশোচনার বেদনায় মোহ্যমান হয়ে উঠল মেরিয়াস। সে নিজে ভলজাঁ’র সঙ্গে কোনও সম্বন্ধ না রাখলেও কসেত্তের সঙ্গে তার সম্পর্কটা ঠিকই থাকবে, কসেত্তে’র সঙ্গে রোজ তার দেখা হবে এবং সে নিজেই তার অনুমতি দান করেছে। সে এখন আক্ষেপ করতে লাগল, ভলজাঁর প্রতি আরও কঠোর হওয়ায় উচিত ছিল তার, তাকে বাড়ি থেকে চিরদিনের মতো তাড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল। আবেগের বশবর্তী হয়ে আবেগের স্রোতে ভাসতে ভাসতে ঠিকমতো বিচার সে করতে পারেনি। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হতে রাগল তার।
কিন্তু এখন সে কী করবে? সে যখন আসার ব্যাপারে ভলজাঁকে অনুমতি দিয়েছে তখন আর কোনও কথা নেই। সে যখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভলজাঁকে, সে যত খারাপ লোকই হোক, সে প্রতিশ্রুতি তার রক্ষা করে চলা উচিত। তাছাড়া কসেত্তে’র প্রতিও তো তার একটা কর্তব্য আছে।
এই চিন্তার একটা ছায়াম্নান প্রভাব মেরিয়াসের মুখচোখের ওপর ফুটে উঠলেও সে কৌশলে কসেত্তেকে অন্য কথা বলে এড়িয়ে গেল। সে কৌশলে কসেত্তেকে কয়েকটা প্রশ্ন করে জানল সুদূর শৈশবকাল থেকে আজ পর্যন্ত ভলজাঁ যতদিন তার সঙ্গে ছিল সে। তাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসত। তার ব্যবহার ছিল খুবই সম্মানজনক। তাদের সম্পর্ক ছিল খুবই পবিত্র।