বিমলবাবুদের আদি নিবাস জলপাইগুড়ি। ওর ঠাকুর্দা অভয়চরণ অর্থাভাবে স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতেই পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হন ও তরাই অঞ্চলে বাবার সামান্য চা-বিস্কুটের দোকানে কাজ করতে শুরু করেন। অভয়চরণ যখন মাত্র ষোল বছরের তখন ওর পিতৃবিয়োগ হয় ও বিধবা মা আর দুটি ছোট বোনের দায়িত্ব তাকে নিতে হয়। উনি পরিশ্রম করতে কখনই কুণ্ঠাবোধ করতেন না; তাইতো উনি ঠিক করলেন, ভোর থেকে একটু রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখবেন।
ওদের বাড়ি থেকে বড় রাস্তার ধারের ওই দোকান ছিল প্রায় বারো মাইল দূরে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করলে কোনমতেই সাড়ে ন’টা-দশটার আগে দোকান খোলা সম্ভব হত না; দোকান বন্ধ করতে হত সন্ধে হতে না হতেই। অভয়চরণ জানতেন, ওদের চায়ের দোকানের সামনের রাস্তা দিয়েই শুধু কোচবিহার বা তরাইয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে না, ভূটানেও যাতায়াত করতে হয় লোকজন ও গাড়িকে। ওই অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানে যারা কাজকর্ম বা ব্যবসা করেন, তারাও ভোরবেলায় ওই রাস্তা দিয়ে যান ও বিকেল-সন্ধের দিকে ফেরেন। অভয়চরণ ঠিক করলেন ভোর হতে না হতেই ওকে দোকান খুলতে হবে ও খোলা রাখতে হবে সন্ধে ঘুরে যাবার পরও দু’তিন ঘণ্টা।
মা, কাল থেকে আমি দোকানেই থাকব।
দোকানে থাকবি কেন?
ভোরে দোকান খুললে অনেক খদ্দের পাব; দোকান বন্ধও করব একটু রাত করে।
ঘুমুবি কোথায়?
দোকানেই ঘুমোব।
খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?
দোকানের কাছেই একটা বাড়ি আছে, ওই বাড়ির ছেলের সঙ্গে আমার খুব ভাব। ওর মা-ও আমাকে খুব ভালবাসেন। ওরাই আমাকে খেতে দেবেন।
কিন্তু…
অভয়চরণ ওর মা-র দুটি হাত ধরে বলে, তুমি কিছু চিন্তা করো না, সত্যি আমি ভাল থাকব।
অভয়চরণের মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কী আর বলব! আমাদের পেট চালাবার জন্য তোকে কি কষ্টই করতে হবে।
মা, তুমি বিশ্বাস করো আমার কোন কষ্ট হবে না।
.
অভয়চরণ নিরুপায়। তাইতো ওকে মিথ্যে কথা বলেই দোকানে থাকার অনুমতি নিতে হয়।
অভয়চরণ শুরু করে নতুন সংগ্রাম।
সূর্য ওঠার অনেক আগেই অভয়চরণ ঘুম থেকে উঠেই আবছা অন্ধকারে গাছপালার আড়ালে যায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। তারপর মুখ ধুয়েই উনুন ধরিয়ে চায়ের জল বসিয়ে দুধের পাত্র উনুনের পাশে রাখে।
কী আশ্চর্য! জল ফুটতে না ফুটতেই তিনজন খদ্দের এসে হাজির।
চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
আমাদের তিনটে স্পেশাল চা দাও।
হ্যাঁ, বাবু, দিচ্ছি।
অভয়চরণ ওদের হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিতেই একজন বলেন বিস্কুট দাও।
বাবু, তিনজনকেই দেব?
হ্যাঁ, তিনজনকেই দেবে।
বাঁশ দিয়ে তৈরি বেঞ্চিতে বসে বাবুরা চা-বিস্কুট খায়।
বাঃ! বেশ চা বানাতে পারিস তো তুই।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলেন, আপনাদের ভাল লেগেছে?
হ্যাঁ, সত্যি ভাল লেগেছে। আমাদের আরো তিনটে চা দাও।
হ্যাঁ, বাবু, দিচ্ছি।
দ্বিতীয়বার ওদের চা খাওয়া শেষ হতেই একজন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করেই বলেন, তোর কত হয়েছে?
বাবু, ছ’টা চা বারো আনা আর তিনটে বিস্কুট তিন আনা মোট পনের আনা।
ভদ্রলোক এক টাকার একটা নোট অভয়চরণকে দিয়ে বলেন, তোকে আর এক আনা ফেরত দিতে হবে না।
অভয়চরণ ডান হাত কপালে ছোঁয়ায়।
খুশিতে ভরে যায় ওর মন।
দু’এক মিনিট পরই একটা মোটর সাইকেল এসে থামে ওর দোকানের সামনে। মোটর সাইকেলে বসে বসেই একজন বলেন, চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
চা কত করে?
এক আনা করে।
না, না, এক আনা না, দু’আনা করে চা দে আমাদের দু’জনকে।
এখনই দিচ্ছি।
অভয়চরণ ওদের হাতে বড় গেলাসের চা দিতেই একজন বাবু বলেন, দুটো করে বিস্কুট দে।
চা বিস্কুট খাওয়া শেষ হতেই এক বাবু অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই তো বেড়ে চা করিস।
অভয়চরণ কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে।
হ্যাঁরে, সিগ্রেট আছে?
হ্যাঁ, আছে।
কী সিগ্রেট আছে?
বাবু, পাশিংশো আর সিজার।
এক প্যাকেট সিজার দে।
অভয়চরণ বেশ লজ্জিত হয়ে বলে, বাবু পুরো প্যাকেট তো হবে না।
যা আছে তাই দে।
ভদ্রলোক পাশ ফিরে ওর সহযাত্রী বন্ধুকে বলেন, শালা গোবিন্দবাবুকে সিগ্রেট না খাওয়ালে তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখবে।
ও শালা, মহা খচ্চর আছে। বিল থেকে তো বিশ-পঁচিশ টাকা কেটে রাখার পরও ছোটলোকটাকে সিগ্রেট খাওয়াতে হবে।
অন্য বাবু বলেন, তোর কত হয়েছে?
চার আনার চা, চার আনার বিস্কুট আর তিন আনার…
এক টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরে উনি বলেন, এই নে ধর।
অভয়চরণ পাঁচ আনা ফেরত দেবার জন্য এগিয়ে ধরতেই বাবু বলেন, একটা ম্যাচ বক্স দে।
হ্যাঁ, অভয়চরণ দেশলাই আর বাকি পয়সা ভদ্রলোকের সামনে ধরতেই উনি দেশলাইটা তুলে নিয়ে বলেন, ওটা রেখে দে।
ওরা তখনও মোটর সাইকেলে স্টার্ট দেন নি, হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়িতে বসে বসেই এক ভদ্রলোক অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
কেক আছে?
আজ্ঞে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেকারীর কেক আছে।
চারটে চা–চারটে কেক দাও।
বাবু, এক আনার চা দেব নাকি দু’আনার–
না, না, এক আনার চা দিও না।
অভয়চরণ চা বানাতে বানাতেই দেখে, বাবুরা গাড়িতে বসে বসেই খুব গম্ভীর হয়ে কথা বলছেন; ওদের চোখ মুখ দেখে ওর মনে হয়, বাবুরা খুব জরুরী কাজে যাচ্ছেন।
অভয়চরণ ওদের চা আর কেক দিয়ে একটু দূরে দাঁড়ায় গেলাসগুলো ফেরত নেবে বলে।
একটু পরেই আগের বাবুই গাড়ির ভিতর থেকে একটু মুখ বের করে বাঁ হাতে তুড়ি মেরে অভয়চরণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আরো চারটে কেক দাও।
এক মিনিটের মধ্যেই অভয়চরণ ওদের কেক দেয়।
ওদের চা খাওয়া শেষ হতেই ওরা গেলাস ফেরত দেন।
কত হয়েছে?
বাবু, আটটা কেক একটাকা আর চারটে চা আট আনা।
ভদ্রলোক দু’টাকার একটা নোট ওর হাতে দিতেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করে; অভয়চরণ গলা চড়িয়ে বলেন, বাবু, পয়সা…
গাড়ি ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক এইভাবে খদ্দেরের পর খদ্দের আসায় অভয়চরণ নিজে একটু চা আর বিস্কুট খাবার ফুরসত পায়নি। এতক্ষণ খালি পেটে থাকায় পেটের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করে। না, আর দেরি না করে এক গেলাস চা তৈরি করার পর একটা বিস্কুট নিতে গিয়েও নেয় না, ও আপনমনেই একটু হেসে একটা কেক তুলে নেয়।
খুব খুশি মনেই অভয়চরণ চা-কেক খেতে শুরু করে আর মনে মনে চিন্তা করে এইভাবে যদি খদ্দের আসে তাহলে তো দোকানের স্টক বাড়াতে হবে কিন্তু স্টক বাড়িয়ে রাখবে কোথায়? দোকান বড় করতে হলে তো অনেক টাকা চাই কিন্তু ও কোথায় টাকা পাবে? এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতেই অভয়চরণ ঠিক করে, দোকান ঘর বড় করতে না পারলেও কিছু স্টক বাড়াতেই হবে।
পাঁচ-সাত মিনিট পরই হরেন সাপ্লায়ারের মোপেড এসে থামে। মোপেডের ইঞ্জিন বন্ধ করেই উনি অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই এরই মধ্যে দোকান খুলেছিস?
অভয়চরণ এক গাল হেসে বলে, কাকা, আজ ছ’টার আগেই দোকান খুলেছি।
কী বলছিস তুই?
কাল রাত্রে আমি দোকানেই ঘুমিয়েছি।
এইটুকু দোকানের মধ্যে ঘুমোলি কী করে?
গুটিসুটি মেরে শুয়েছিলাম।
অভয়চরণ গম্ভীর হয়ে বলে, কাকা দশটা-এগারোটায় দোকান খুলে আর সন্ধে লাগতে না লাগতেই দোকান বন্ধ করে বিশেষ কিছুই হচ্ছিল না। তাইতো ঠিক করেছি, এই দোকানেই থাকব আর সপ্তাহে একদিন দুপুরের দিকে বাড়ি গিয়ে মাকে সংসার খরচের টাকা পৌঁছে দেব।
তুই ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। তুই যদি ভোর থেকে রাত আটটা ন’টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে পারিস, তাহলে তোর আয় প্রচুর বেড়ে যাবে কিন্তু তোর খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?
কাল তো মুড়ি আর বাতাসা খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। তবে ঠিক করেছি মা-র কাছ থেকে দু’একটা বাসন এনে রোজ একটু সিদ্ধ ভাত খাবো।
যেভাবেই হোক ভাত খাবি, তা না হলে শরীর ভেঙে যাবে।
অভয়চরণ ওর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দেয়।
হরেন এক চুমুক চা খেয়েই বলেন, আজ সকালে কেমন খদ্দের হল?
অভয়চরণ এক গাল হেসে বলে, খুব ভাল, প্রায় সব স্টকই শেষ।
তাহলে তো ভালই বলতে হবে।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, বল কী কী দেব।
কাকা, সবই বেশি বেশি করে চাই। তাছাড়া দু’এক রকম একটু ভাল বিস্কুটও রাখব।
যত বেশি রকমের জিনিষ রাখবি তত বেশি বিক্রি হবে। আমি থাকতে তোকে মালপত্তরের চিন্তা করতে হবে না।
কিন্তু কাকা, ইচ্ছা থাকলেও তো বেশি জিনিষ এইটুকু দোকানে রাখতে পারব না।
যদি ভাল বিক্রি হয়, তাহলে দোকানটা বড় করতে হবে।
সে তো অনেক টাকার ব্যাপার।
হরেন একটু হেসে বলেন, ব্যবসা বাড়াবার জন্য টাকার অভাব হয় না।
হরেন সাপ্লায়ার আর কথা না বাড়িয়ে ওকে সবরকমের মালপত্র অনেক বেশি দিয়ে মোপেডে স্টার্ট দেন।
যাইহোক অভয়চরণ স্বপ্নেও ভাবেনি, সারাদিন দোকান খোলা রাখলে এত বিক্রি হতে পারে। পরের দিন ও হরেন সাপ্লায়ারকে বলে, জানেন কাকা, কাল ভোর ছ’টা থেকে রাত নটা পর্যন্ত দোকান খোলা রেখে যা বিক্রি হয়েছে, তা আগে এক সপ্তাহেও হত না।
হরেন সাপ্লায়ার একটু হেসে বলেন, ওরে অভয়, ভুলে যাস না এইটাই ভূটান আর আসাম ছাড়া ওই দিকের সর্বত্র যাবার মেন রাস্তা। তাছাড়া এই রাস্তা দিয়েই চা বাগানগুলোয় যেতে হয়। এই রাস্তার উপর যাদেরই দোকানে ভাল স্টক থাকবে তাদেরই বিক্রি ভাল হতে বাধ্য।
উনি মালপত্র দিয়ে চলে যাবার আগে বলেন, আমি এক সপ্তাহের মধ্যে তোর দোকান বড় করে দিচ্ছি।
.
সত্যি জগদীশ মিস্ত্রি যে এক সপ্তাহের মধ্যে দোকানটাকে এত সুন্দর আর বড় করে দেবে, তা অভয়চরণ ভাবতে পারেনি।
তারপর হরেন সাপ্লায়ার ওকে বলেন, কীরে অভয়, দোকানঘর তোর পছন্দ হয়েছে?
কাকা, সত্যি বলছি এত ভাল হবে তা ভাবিনি।
অভয়চরণ না থেমেই বলে, উপরের খোপে আমি আমার বিছানাপত্র রাখব। দোকানের তাকগুলোতে সব জিনিষ সাজিয়ে রাখক আর নীচে রাখব এক্সট্রা স্টক আর এক পাশে রাখব রান্না-খাওয়ার বাসনপত্র।
এবার তো ভাল করে শুতে পারবি?
হ্যাঁ, কাকা, খুব ভালভাবে শুতে পারব।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে বলে, কাকা কত খরচ হল?
জগদীশ পুরো হিসেব দেয়নি। তবে বোধহয় সাড়ে তিন-চারের বেশি হবে না।
কাকা, আমাকে কীভাবে শোধ করতে হবে?
তুই প্রত্যেক সপ্তাহে আমাকে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা দিতে পারবি না?
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, হ্যাঁ কাকা, তা পারব।
হরেন সাপ্লায়ার মালপত্র দিয়ে চলে যাবার আগে বলেন, আমি জগদীশকে বলেছি চারজন করে বসতে পারে এমন দুটো বেঞ্চি তোকে দিয়ে যেতে।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলে, তাহলে তো খুব ভাল হয়।
.
তারপর?
তারপর আর কি? অভয়চরণের অদৃষ্টের চাকা বন বন করে ঘুরতে শুরু করল। কোনদিনই তিনশ সাড়ে তিনশ’র কম বিক্রি হয় না। সপ্তাহে দু’একদিন সাড়ে চারশ-পাঁচশ টাকার বিক্রি হয়।
দোকানে খদ্দের না থাকলেই অভয়চরণ কোন না কোন বই পড়ে। ও যখনই বাড়ি যায়, তখনই বাল্যবন্ধু শশাঙ্কর কাছ থেকে দু’একটা বই নিয়ে আসে। খদ্দের এলেই অভয়চরণ হাতের বই রেখে ওদের হুকুম মতো কাজ করে। কদাচিৎ কখনও কোন কোন খদ্দের ওকে জিজ্ঞেস করেন, দেখি কী পড়ছ।
অভয়চরণ তাকে হাতের বই তুলে দিতেই ভদ্রলোক একবার বইয়ের পাতা উল্টেই বলেন, তুমি ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদারের লেখা ‘ভারতের ইতিহাস’ পড়ছ?
হ্যাঁ।
বইটা পড়তে ভাল লাগছে?
হ্যাঁ, খুব ভাল লাগছে।
ভাল।
এইভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস, ঘুরে যায় বছর। এই এক বছরের মধ্যেই অভয়চরণ সংসারের চেহারা বদলে দেয়। দু’বোনকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেয়। মা-বোনেদের মুখে হাসি দেখে অভয়চরণ মনে মনে বড় শান্তি পায়।
ওদিকে কিছু কিছু খদ্দেরের সঙ্গেও অভয়চরণের বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ছাতি বন্ধ করে দিনহাটা স্কুলের মাস্টারমশাই শশধরবাবুকে বেঞ্চিতে বসতে দেখেই অভয়চরণ ওকে প্রণাম করে বলে, স্যার, ভাল আছেন?
হ্যাঁ, ভাল আছি। তুমি ভাল আছ?
আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ভালই আছি।
তোমার মা-বোনেরা ভাল…
হ্যাঁ, স্যার, ওরাও ভাল আছে।
বেশ।
স্যার, চা খাবেন তো?
হ্যাঁ, দাও। যতক্ষণ বাস না আসে। ততক্ষণ তো বসতেই হবে।
অভয়চরণ ওর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিয়েই বলে, স্যার আপনার মেয়ে-জামাই ভাল আছেন?
হ্যাঁ, ওরা ভালই আছে।
শশধরবাবু চায়ের গেলাসে এক চুমুক দিয়েই একটু হেসে বলেন, তবে আমার তিন বছরের নাতি কি ওস্তাদ হয়েছে, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
দাদুকে কাছে পেলে ও তো একটু বাঁদরামী করবেই।
কাল ওই বাঁদরটা বলছে, দাদু, তুমি বাবার মতো মোটর সাইকেল চালাতে পারো?
আপনি কী বললেন?
আমি বললাম, না। আমার খুব ভয় করে।
শশধরবাবু সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে বলেন, ওই বাদরটা আমাকে বলে, তুমি এক নম্বরের ভীতু।
অভয়চরণ একটু জোরেই হেসে ওঠে।
.
তিস্তা তোর্ষার জল আরো গড়িয়ে যায়।
গাড়িটা দোকানের সামনে থামতেই অভয়চরণ দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। মিঃ সেনগুপ্ত গাড়ি থেকে নামতেই অভয়চরণ ওকে প্রণাম করে।
মিঃ সেনগুপ্ত হাসতে হাসতে বলেন, দেখা হলেই কী প্রণাম করতে হবে?
আপনি গুরুজন। আবার আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। তাছাড়া আপনি আমাকে স্নেহ করেন। আপনাকে প্রণাম করলে আমারই ভাল হবে।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে বলে, স্যার নতুন মা ভাল আছেন?
হ্যাঁ, নন্দিতা ভাল আছে?
স্যার, দিদির কী খবর?
তুমি তো জানো, ওকে আমি হস্টেলে রেখেছি। আমাদের চা বাগান থেকে শিলিগুড়িতে যাতায়াত করলে তো ও পড়াশুনারই সময় পাবে না।
তা ঠিক।
তবে পাপড়ি তো প্রত্যেক মাসেই দু’একদিনের জন্য আসে।
দিদি যখনই যাতায়াত করে তখনই আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব না করে যায় না।
হ্যাঁ, ও তোমাকে খুবই পছন্দ করে।
অভয়চরণ মিঃ সেনগুপ্তর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিয়েই একটু হেসে বলে, স্যার, দিদির নাম পাপড়ি দিয়ে খুব ভাল করেছেন, দিদি সত্যি ফুলের মতো পবিত্র।
ওর কথা শুনে মিঃ সেনগুপ্ত না হেসে পারেন না।
অভয়চরণ ড্রাইভার হৃদয়কে চা দিয়ে বলে, দাদা, চা খাও।
তোমার এখানে চা না খেয়ে স্যারও যেতে পারেন না, আমিও যেতে পারি না।
সে তো আমার সৌভাগ্য।
চা খাওয়া শেষ করেই মিঃ সেনগুপ্ত ড্রাইভারকে বলেন, হৃদয় বইয়ের প্যাকেটটা অভয়কে দিয়েছ?
স্যার, চা খেয়ে দিচ্ছি।
চা খেয়ে হৃদয় বইয়ের প্যাকেটটা অভয়চরণের হাতে দিতেই মিঃ সেনগুপ্ত বলেন, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ আছে, তোমার নিশ্চয়ই ভাল লাগবে।
উনি না থেমেই বলেন, অভয় মনে রেখো রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প লেখক।
অভয়চরণ ওকে প্রণাম করতেই মিঃ সেনগুপ্ত গাড়িতে উঠতে উঠতে বলেন, আজ আসি।
অভয়চরণ শুধু মাথা নাড়ে আর অবাক হয়ে ভাবে ওর কথা।
.
এই অঞ্চলের সমস্ত চা বাগানের মধ্যে সব চাইতে বড় ও বিখ্যাত হচ্ছে মডার্ন টি এস্টেট। অভয়চরণ আগে এর নামও শোনে নি; হরেন কাকার কাছে শুধু শুনেছিল, এই রাস্তা দিয়েই যারা মোপেড, স্কুটার, মোটর সাইকেলে যাতায়াত করে তারা প্রায় সবাই হয় কোন না কোন চা বাগানে কাজ করে অথবা ব্যবসা করে।
হরেন কাকা একটু হেসে বলেন, এদের সবার পকেটেই টু-পাইস থাকে। এদের একটু খাতির করলে আখেরে তোরই ভাল হবে।
কাকা, আমি তো সব খদ্দেরকেই যথেষ্ট সম্মান করি।
ভালই করিস।
.
তারপর আস্তে আস্তে অভয়চরণের সঙ্গে খদ্দেরদের আলাপ পরিচয় হতে শুরু হয়।
বাবু, আপনি কী এই দিকের কোন চা বাগানে কাজ করেন?
কেন বল তো?
আপনি তো সপ্তাহের ছ’দিনই আমার এখানে চা খেয়ে ওই দিকে যান তাই…
বীরেনবাবু একটু হেসে বলেন, থার্ড ক্লাস মাড়োয়ারির ফোর্থ ক্লাস বাগানে গোলামী করি। হালারা আমাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে।
সব বাগানের মালিকরাই কী ওইরকম?
না, না।
বীরেনবাবু না থেমেই বলেন, সব দিক দিয়েই এই অঞ্চলের বেস্ট বাগান হচ্ছে মডার্ন।
সব দিক দিয়েই বেস্ট মানে?
এই অঞ্চলের সব বাগানের চাইতে ওদের চা সব চাইতে ভাল। ওখানকার প্রত্যেক কর্মচারী ন্যায্য মাইনে পায়, বোনাস পায়। তাছাড়া ওই বাগানের ম্যানেজার সাহেবকে তো সব কর্মচারীরা দেবতার মতো ভক্তি করে।
আচ্ছা!
হ্যাঁ, অভয়, উনি অসম্ভব ভাল মানুষ। উনি প্রতিদিন লেবার কোয়ার্টার্স থেকে শুরু করে হাসপাতালেও আসেন স্টাফ বা লেবারদের সুবিধে-অসুবিধের খোঁজখবর নিতে।
অন্য বাগানের ম্যানেজাররা তা করেন না?
ঘোড়ার ডিম করেন।
বীরেনবাবু একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, অন্য বাগানের ম্যানেজারদের প্রধান কাজ হচ্ছে ঘুষ খাওয়া, চুরি করা আর ফুর্তি করা।
.
অভয়চরণের কাছে চা খাবার জন্য অন্যান্য খদ্দেরদের মধ্যে ছ’জন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আসেন তিনটে মোটর সাইকেল চড়ে। ওদের দেখে মনে হয় ওরা ভাল চাকরি করেন। আস্তে আস্তে ওদের সঙ্গেও বেশ ভালই আলাপ-পরিচয় হয় অভয়চরণের; তাইতো জানতে পারে, ওরা ছ’জনই মডার্ন টি এস্টেটে কাজ করেন।
শুনছিলাম, এই অঞ্চলের মধ্যে আপনাদের বাগানের চা সব চাইতে ভাল। কথাটা কি ঠিক?
ছ’জনের মধ্যে যিনি বয়সে বড় তিনি বেশ জোর করে বলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
উনি না থেমেই বলেন, অন্য বাগানে একই গাছ থেকে পনের বিশ বছর পাতা নেওয়া হয় কিন্তু আমাদের বাগানে ক’বছর অন্তরই পুরনো গাছের জায়গায় নতুন গাছ লাগানো হয়। তাইতো আমাদের বাগানের চা এত ভাল।
ওদের যিনি বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘মডার্ন’ হচ্ছে আমাদের যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী।
অন্যরা প্রায় একসঙ্গে বলেন, ঠিক বলেছিস।
.
ছ’-আট মাস পরের কথা।
অভয়চরণের দোকানে হঠাৎ একটা বড় মোটর গাড়ি এসে থামতেই ড্রাইভার তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এসে বলে, তোমার নাম কী অভয়চরণ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গিয়ে পিছনে বসা সাহেবকে কি যেন বলে। তারপরই একজন অত্যন্ত সুদর্শন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এসে একটু হেসে বলেন, আমি মডার্ন টি এস্টেটের ম্যানেজার অপূর্ব সেনগুপ্ত।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে ওকে প্রণাম করেই বলে, স্যার আমার কি সৌভাগ্য।
আমাদের বাগানের অনেকেই তো তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের কাছেই শুনলাম, তুমি নিয়মিত ভাল ভাল বই পড়ো।
স্যার, ভাল ভাল বই পড়তে আমার খুব ভাল লাগে; তাই যখন খদ্দের থাকে না, তখন বই পড়ি।
এখন কোন বই পড়ছ?
স্যার, শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী পড়ছি।
খুব ভাল।
স্যার, দয়া করে একটু চা খাবেন?
দয়া করে বলছ কেন? এবার থেকে যাতায়াতের পথে সবসময় তোমার এখানে চা খাব।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলে, স্যার, গাড়িতে বসুন আমি এখুনি চা দিচ্ছি।
গাড়িতে বসব কেন? তোমার বেঞ্চিতেই বসছি।
মিঃ সেনগুপ্ত বেঞ্চিতে বসেই বলেন, আমার ড্রাইভার মাখনকে চা দিও।
হ্যাঁ, স্যার দেব।
চা খাওয়া শেষ হতেই মিঃ সেনগুপ্ত পার্স বের করে বলেন কত হয়েছে? স্যার, আট আনা।
উনি একটা পাঁচ টাকার নোট এগিয়ে ধরে বলেন, এটা নাও এরপর কয়েকবার চা খেয়ে আর দাম দেব না।
অভয়চরণ হাসে।
আবার সন্ধের পর মিঃ সেনগুপ্তর গাড়ি এসে থামে ওই দোকানের সামনে।
মিঃ সেনগুপ্ত একটা মোটা বই এগিয়ে ধরে বলেন, এটা হচ্ছে চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বিদ্যাসাগরের জীবনী।
অভয়চরণ বই হাতে নিয়ে বলে, স্যার, কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছি না।
ধন্যবাদ দিতে হবে না; বইটা পড়ো।
নিশ্চয়ই পড়ব।
এবার আমাদের চা খাওয়াও তো।
হ্যাঁ, স্যার, দিচ্ছি।
এইভাবেই শুরু হল ওদের সম্পর্ক।
কয়েক মাস পরের কথা।
.
সেদিন রবিবার। হঠাৎ একটা জিপ এসে থামল অভয়চরণের দোকানের সামনে। ও ভেবেছিল, বোধহয় কোন কন্ট্রাক্টারের জিপ। তারপর সেনগুপ্ত সাহেবকে জিপ থেকে নামতে দেখেই ও অবাক। সঙ্গে সঙ্গে জিপ থেকে নামেন মিসেস সেনগুপ্ত।
মিঃ সেনগুপ্ত একটু হেসে বলেন, নন্দিতা এই হচ্ছে অভয়।
অভয়চরণ প্রথমে ওকে, তারপর সেনগুপ্ত সাহেবকে প্রণাম করে।
নন্দিতা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেন, ভাল থাকো বাবা।
উনি সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, তোমার এত প্রশংসা শুনতে হয় যে তোমাকে না দেখে থাকতে পারছিলাম না।
স্যার আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন।
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
আগে বল, আমাদের ওখানে কবে আসবে?
আপনি আমার নতুন মা। আপনাদের কাছে যেতে খুব ইচ্ছা করে কিন্তু যেতে হলে তো দোকান বন্ধ রাখতে হবে।
মিঃ সেনগুপ্ত বলেন, অভয়, তোমার দোকানে কী রোজই সমান খদ্দের আসে? একই টাকার বিক্রি হয়?
না, স্যার, রবিবার খুব সকালে আর সন্ধের পর কিছু খদ্দের আসে। দিনে খুব কম খদ্দের আসে।
নন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তাহলে চল আমাদের সঙ্গে, সন্ধের আগেই ফিরে আসবে।
গেটের বাইরে জিপ থামে। সেনগুপ্ত দম্পতির পর অভয়চরণ জিপ থেকে নেমে দেখে বিরাট বাংলোর সামনে সবুজ কার্পেটের মতো লন আর তার পাশে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। দূর থেকে বাংলো দেখেই ও অবাক হয়।
একটু পিছন ফিরে নন্দিতা বলে, এস অভয়।
সেনগুপ্ত সাহেব আগেই প্রায় লাফাতে লাফাতে বাংলোয় ঢুকেই গলা চড়িয়ে বলে, মাদার দেখো কে এসেছে।
দ্বিধা সংকোচে অভয়চরণ ধীর পদক্ষেপে বাংলোর বারান্দায় পা দিতেই পরমা সুন্দরী অষ্টাদশীকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, নতুন মাকে দেখতে কি ভাল; দেখে মনে হয়, সব সময় হাসছেন কিন্তু তুমি তো অসাধারণ সুন্দরী।
পাঁপড়ি হাসতে হাসতে বলে, কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? এস ভিতরে এস।
হ্যাঁ, চল।
অভয়চরণ এগিয়ে আসতেই নন্দিতা বলেন, মুন্নী, তুই অভয়কে তোর ঘরে নিয়ে যা। তোরা গল্প কর। আমি একটু পরে আসছি।
পাঁপড়ি অভয়চরণকে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকেই বলে, যেখানে খুশি বসতে পারো।
অভয়চরণ একবার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে সামনের একটা চেয়ারে বসে।
পাঁপড়ি একটা মোড়া নিয়ে ওর সামনে বসেই বলে, তুমি কী জানো, বাবা তোমাকে খুব ভালবাসেন?
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, স্যার সত্যিই আমাকে খুব স্নেহ করেন।
ভাল ভাল বই পড়তে তোমার খুব ভাল লাগে, তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি বাংলা-ইংরাজি দু’রকম বই-ই পড়ো?
আমি শুধু বাংলা বই পড়ি। আট বছর আগে স্কুল ছাড়ার পর তো আর ইংরেজি পড়া হয়নি।
তাতে কী হয়েছে? একটু কষ্ট করে পড়লেই বুঝতে পারবে।
আমি আগে একটা ইংলিশ-বেঙ্গলী ডিক্সনারী কিনব। তারপরই ইংরেজি বই পড়া শুরু করব।
পাপড়ি সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে একটা মোটা বই এনে ওর হাতে দিয়ে বলে, এই নাও ডিক্সনারী। এবার তো ইংরেজি বই পড়বে?
তুমি ডিক্সনারী আমাকে দিলে কিন্তু তোমার তো অসুবিধে হবে
না, না আমার অসুবিধে হবে না। আমার আরো একটা ডিক্সনারী আছে।
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, দিদি, তুমি আমার দারুন উপকার করলে। তোমাকে কি বলে কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছি না।
পাঁপড়ি হাসতে হাসতে বলে তুমি একটা গাগল! আমাকে মোটেও কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাতে হবে না
দিদি, তুমি দেখতে যেমন অসম্ভব সুন্দর, তোমার মনও ঠিক সেইরকম সুন্দর। ভগবান নিশ্চয়ই তোমার ভাল করবেন।
পাঁপড়ি জোরেই হেসে ওঠে।
ঠিক সেই সময় মিঃ সেনগুপ্ত ওই ঘরে ঢুকেই বলেন, মাদার হাসছ কেন?
ইওর অভয় ইজ টু গুড এ বয়।
নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট।
.
‘পরশপাথর’-এর গল্প পড়েছে অভয়চরণ। এই পরশপাথরের ছোঁয়ায় সবকিছু সোনা হয়ে যায়। অভয়চরণের বাস্তব জীবনে এই কি অপূর্ব সেনগুপ্তই ওর পরশপাথর।
সেনগুপ্ত সাহেবের কৃপাতেই ওদের অফিসার্স ক্লাবে মদ ছাড়া অন্যান্য জিনিষ সাপ্লায়ের ঠিকা পায়। শুরু হল চা-কফি-চিনি-গুঁড়ো দুধ, সাত-আট রকমের বিস্কুট, ক’রকমের দামী সিগারেট-দেশলাই ছাড়া পাঁচ রকমের কোল্ড ড্রিঙ্ক।
তারপর?
বছর পাঁচেক পরই শুরু হল চা বাগানের সাপ্লাই।
তারপর?
চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই শুরু হল একটার পর একটা চা বাগানের সাপ্লাই।
.
অভয়চরণ অকৃতজ্ঞ না। তাই তো মিঃ সেনগুপ্ত রিটায়ার করার পর কল্যাণীর বাড়িতে চলে গেলেও নববর্ষ আর বিজয়ার পরদিনই অভয়চরণ তার ‘স্যার’ আর নতুন মাকে প্রণাম করতে কোনদিন ভোলে নি। না, কোনদিন ভোলেনি ওদের দু’জন আর পাঁপড়ি দিদির জন্মদিনে প্রণাম আর শুভেচ্ছা জানানো ছাড়াও নানা উপহার পাঠাতে।
.
ছোট দু’বোন বি.এ পাস করার পরই অভয়চরণ ওদের বিয়ে দিয়েছেন দুটি সুপাত্রের সঙ্গে। মায়ের পছন্দমতো মেয়েকে নিজেও বিয়ে করেছেন।
তারপর?
অভয়চরণ অর্থাভাবে লেখাপড়া করতে পারেন নি বলেই উনি পাঁচ ছেলেকেই উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেন কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন কী সার্থক হয় নাকি সার্থক হতে পারে?
সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করায় বাহান্ন বছরেই অভয়চরণ হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন; মাস তিনেক পর সুস্থ হলেও অনেকটাই কর্মশক্তি হারালেন। বড় ছেলে অমল বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র থাকায় সে তখন কলকাতায় হস্টেলে থেকে এম. এ পড়ছে কিন্তু পরের তিন ছেলে দু’তিন বারের চেষ্টায় মাধ্যমিকের গণ্ডী পার হলেও ওরা কেউই উচ্চমাধ্যমিক পাস করতে পারল না।
প্রথমে অজয় আর অমিত বাবার ব্যবসা দেখতে শুরু করল।
ব্যস, ওদের আর কে দেখে? শুরু হল দু’ভাইয়ের মদ্যপান; প্রথমে লুকিয়ে চুরিয়ে। তারপর অনেকটাই খোলাখুলি।
অভয়চরণের শরীর দিন দিনই ভেঙে পড়ছে। তাইতো তিনি পাঁচ ছেলেকে ব্যবসার অংশীদার করতে চাইলেন কিন্তু বড় ছেলে অমল স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, সে ব্যবসা বাণিজ্য বোঝে না। তাইতো অংশীদারও হতে চায় না। শেষ পর্যন্ত অন্য চার ছেলেকেই অভয়চরণ ব্যবসার সমান অংশীদার করে দিলেন।
অমল এম. এ. বি. টি পাস করে কাটোয়ার স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করার পর পরই অভয়চরণের মৃত্যু হয়। শ্রাদ্ধাদি শেষ হবার পর অমল তার মাকে কাটোয়ায় নিজের কাছে নিয়ে আসে।
ওদিকে অমলের সবচেয়ে ছোট ভাই অমিত ছাড়া অন্য তিন ভাই আগেই নিজেদের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেছে আর সারা জলপাইগুড়ি শহরে ছড়িয়ে গেছে ওদের বেলেল্লাপনার খবর।
শুধু কী তাই?
দিন দিন একদিকে হারাতে শুরু হল সাপ্লায়ের ব্যবসা, অন্যদিকে শুরু হল ব্যাঙ্কের টাকা মারা ও লুকিয়ে-চুরিয়ে সম্পত্তি বিক্রি আর দীর্ঘ মেয়াদী লিজ নেওয়া।
তারপর ছোট ভাই অমিত অন্য তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে শুরু করল মামলা।
.
বিমলবাবু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, বুঝলি শান্ত, আঠারো বছর ধরে মামলা চলার পর শেষ হল হাইকোর্টের রায়-এ। এই রায়-এর ফলে তিন ভাই ভিখিরি হয়ে গেল। আমার আর ছোট ভাই অমিতের জুটলো আঠারো লাখ করে। আমি আমার ভাগের টাকা দিয়ে দিলাম জলপাইগুড়ির এক অখ্যাত গ্রামের স্কুলে যেখানে আমার ঠাকুর্দা অভয়চরণ ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে সেভেনেই পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হন।
খুব ভাল করেছেন।
শান্ত উঠে দাঁড়াতেই বিমলবাবু বলেন, তোকে আর একটু বসতে হবে।
শান্ত বসতেই উনি একটু হেসে বলেন, আমার আদি বাড়ি জলপাইগুড়ি শুনেই তোর মা একদিন বললেন, দিদিমার কাছে শুনেছি উনি অনেক বছর জলপাইগুড়ির একটা চা বাগানে ছিলেন।
দিদিমা ছিলেন মানে? ওর স্বামী কী চা বাগানে চাকরি করতেন?
না, না; দিদিমার স্বামী না, দিদিমার বাবা একটা নামকরা চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন।
উনি কোন বাগানের ম্যানেজার ছিলেন?
যতদূর মনে পড়ছে বোধহয় মডার্ন।
আপনার দিদিমার নাম কী?
পাঁপড়ি।
বিমলবাবু একগাল হেসে বলেন, এবার আমি বলি, আপনার দিদিমার বাবার নাম অপূর্ব আর মা-র নাম নন্দিতা।
মনিকা দেবী চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, আপনি তাদের নাম জানলেন কী করে?
বিমলবাবু আবার হাসতে হাসতে বলেন, আপনার দিদিমার বাবা রিটায়ার করার পর তো কল্যাণীর বাড়িতে থাকতেন।
কী আশ্চর্য! আপনি তো আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন।
উনি না থেমেই বলেন, সত্যি করে বলুন তো কী করে আপনি এসব জানলেন।
আমার ঠাকুর্দার ডায়েরী থেকে। অপূর্ব সেনগুপ্ত ছিলেন আমার ঠাকুর্দার জীবন দেবতা; ওরই কৃপায় ঠাকুর্দা চা বাগানের বিখ্যাত সাপ্লায়ার হয়ে প্রায় রাস্তার ভিখারী থেকে রাজা হয়েছিলেন। আপনার দিদিমাকে আমার ঠাকুর্দা বলতেন ‘দিদি আর ওকে ‘দাদা’ বললেন অভাবনীয় সুন্দরী পাঁপড়ি।
এই কথা বলেই বিমলবাবু হো হো করে হেসে ওঠেন।
মনিকা দেবী বলেন, কেন জানি না দিদিমা বিয়ে করেন বোধহয় চল্লিশ বছর বয়সে আর তার সাত-আট বছর পর আমার মায়ের জন্ম।
এসব আমি জানি না।
বিমলবাবু সঙ্গে সঙ্গেই একটু হেসে বলেন, মোটকথা অভয়চরণ পাঁপড়ির মধুর সম্পর্কের বৃত্ত বোধহয় সম্পূর্ণ করবে শান্ত আর মৌ।
.
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, ভাল কাকা, এ তো ড্রিম কাম ট্রু।
ওরে ট্রুথ ইজ স্ট্রেনজার দ্যান ফিকসন।
ঠিক বলেছেন।
.
০৬.
এম. এ পরীক্ষা শেষ হবার পর মৌ-এর মনে হল যেন মহাযুদ্ধের শেষ হল। কবে শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ, তা আজ আর ওর ঠিক মনে পড়ে না। তবে স্পষ্ট মনে পড়ছে, তারপরের আট দশ-বছরের যুদ্ধের কথা। বছরে দুতিনটে পরীক্ষা দিতে দিতে প্রায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলার পর মাধ্যমিক।
দু’বছর পর আবার পরীক্ষা। সব গুরুজনেরাই বলেন, ভবিষ্যত জীবনের রাজপথে হাঁটার আসল পাসপোর্ট এই পরীক্ষা।
অর্থাৎ?
এক মিনিট সময় নষ্ট করবে না; দিন-রাত শুধু পড়তে হবে।
দু-তিন মাস পরও বন্ধুদের সঙ্গে একটা সিনেমা দেখব না?
নৈব নৈব চ।
এই দু’বছর সব ভুলে যাও; এখন তোমার ধ্যান-জ্ঞান শুধু…
বুঝেছি, আর বলতে হবে না। তোমরা কেউ বুঝতে চাও না, সতের-আঠারো বছরের মেয়ের মন। তোমরা জানো না, আমাদের মনেপ্রাণে এখন রামধনু রঙের খেলা। ক’বছর আগে থেকেই শরীরে জোয়ার আসতে শুরু করেছে কিন্তু এখন যে জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর। বাথরুমে চান করার সময় নিজেই নিজেকে দেখে অবাক হই, মুগ্ধও হই; বাপরে বাপ, কত ঢেউ খেলছে এই শরীরে।
হঠাৎ যেন নিজেই নিজেকে ভালবাসতে শুরু করি।
কে আমাদের মনের খবর রাখে?
তোমরা কী জানো, আমি আর শ্রীতমা যখন স্কুলে যাই ঠিক সেই সময় তখন পার্কের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে দেবুদা আর ওর দু’তিনজন বন্ধু। ওরা শুধু হাঁ করে আমাদের দুজনকে দেখে না, ওরা দু’চোখ দিয়ে যেন আমাদের গিলে খেতে চায়। শুধু কী চাই? ওদের মধ্যে কে একজন দু’এক কলি প্রেমের গানও গেয়ে ওঠে।
আমি আর শ্রীতমা কনুই দিয়ে একটু খোঁচা মেরে মুখ টিপে হাসি।
শুধু ওদেরই বা দোষ দিই কী করে? পথেঘাটে কত বয়স্ক লোকও বিশ্রী হ্যাংলার মতো আমাদের দেখে। সত্যি বলছি, এই লোকগুলোকে দেখলেই আমাদের ঘেন্না করে।
যাকগে ওইসব। ওইসব নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তা করি না। আপাতত আমাদের চিন্তা জীবনের রাজপথে পৌঁছবার পাসপোর্ট জোগাড় করার। তাছাড়া অবসর পেলেই আমরা আমাদের নিয়েই চিন্তা করি, চিন্তা করি মনের মানুষের। সত্যি শান্তদাকে কাছে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠি।
তারপর?
তারপর কলেজে ঢুকেই হঠাৎ বসন্তের বাতাস আমাদের যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল। স্কুলের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে হঠাৎ একটু স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে মনে নতুন আনন্দের জোয়ার। ক্লাসের অন্য মেয়েরা অচেনা হলেও চেনা হল কয়েকদিনের মধ্যেই। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতেও দেরি হল না।
বিলিভ মী, তোকে দেখেই আমার ভাল লেগেছিল।
রিয়েলী?
আমি এক গাল হেসে বলি, ইয়েস রুচিরা, ইয়েস।
আমি না থেমেই বলি, আমাকে দেখে তোর কী মনে হয়েছিল?
সত্যি কথা বলব?
তবে কী মিথ্যে কথা বলবি?
তুই দারুণ সুন্দরী; তাইতো ভেবেছিলাম খুবই,অহঙ্কারী হবি।
আচ্ছা?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
রুচিরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে, কলেজে আসার দু’তিন দিন পর ক্যান্টিনে তোর সঙ্গে আলাপ হতেই বুঝলাম আমার ধারণা ভুল। সেদিন তোর সঙ্গে কথা বলে এত ভাল লেগেছিল যে রাত্রে টেলিফোন করে তোর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারিনি।
সেদিন রাত্রে তোর টেলিফোন পেয়ে আমারও খুব ভাল লেগেছিল।
গঙ্গা দিয়ে আরো জল গড়িয়েছি।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছে আরো কয়েকজনের সঙ্গে।…
.
জানো শান্তদা, দেখলাম সবাই কোন না কোন ছেলের প্রেমে পড়েছে।
তাই নাকি?
দু’তিনজন তো স্বীকার করেছে তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
অনেক দুর মানে?
মানে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে।
ভেরি গুড।
এই কথা বলেই শান্ত হাসতে হাসতে বলে, আমি তখন কলকাতায় থাকলে তুমিও সেই অমৃতের স্বাদ পেতে।
অসভ্য কোথাকার।
ওহে সুন্দরী, যতক্ষণ মনের মানুষের কাছে সেই আনন্দ না পাওয়া যায়, ততক্ষণ বলা যায় আঙুর ফল টক কিন্তু সেদিন যখন আমাকে ভাসিয়ে দিলে, তখন তো মনে হয়নি।…
আঃ! শান্তদা।
আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে রাখলে কী চরম সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে?
আমি জানি না, প্লীজ চুপ করো।
শান্ত আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, মৌ, একটা চরম সত্যি কথা জেনে রাখো; আমরা যতক্ষণ বিশেষ কিছু না পাই ততক্ষণই সৎ। যাকে কেউ ঘুষ দেয় না বা যার ঘুষ খাবার সুযোগ নেই তিনি সৎ থাকতে বাধ্য হন কিন্তু ঘটনাচক্রে ওই মানুষই যদি ঘুষ খাবার সুযোগ পায় তখন আর তিনি ঘুষ নিতে দ্বিধা করেন না।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
সেইরকম যে ছেলে-মেয়ে মিলেমিশে আনন্দ করার সুযোগ না পায় ততক্ষণ তারা ভাল কিন্তু সুযোগ পেলে কোন ছেলেমেয়েই নিষিদ্ধ ফল খেতে দ্বিধা করে না।
হ্যাঁ, শান্তদা ঠিক বলেছ।
.
জানো শান্তদা, আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে একটা ব্যাপার জেনে আমি অবাক হয়েছি।
কী খবর জেনে অবাক হয়েছিস?
সায়নী আমার খুবই প্রিয় বন্ধু। ক্লাস ইলেভেন থেকে এম. এ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি। ওর থেকে মাত্র ছ’বছরের বড় ওর ছোট মামা। ছোটবেলা থেকেই দু’জনের মধ্যে খুব ভাব।’হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিয়ে মামাবাড়ি যাবার পর ছোট মামার সঙ্গে যে শারীরিক সম্পর্ক শুরু হয়েছে তা এখনও চলছে।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, আগেকার দিনে ঠাকুমা-পিসিমারা ঠিকই বলতেন।
ওরা কী বলতেন?
বলতেন, আগুন আর বারুদ কাছাকাছি এলে তো জ্বলে উঠবেই।
আচ্ছা!
তোর বন্ধুর সঙ্গে ছোট মামার সম্পর্ক আছে বলে অবাক হবার কারণ নেই; কারণ কারুর সঙ্গে ছোট মামা, কারুর সঙ্গে ছোট কুর্কি, বা পিসতুতো-মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়া যতটা সহজ বাইরের কোন ছেলের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা হওয়া অসম্ভব।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মৌ বলে, বড় হবার পর তোমাকে কাছে না পেয়ে আমি যে কি করে কটা বছর কাটিয়েছি তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না।
কী করব বল? নতুন চাকরি, অমানুষির্ক পরিশ্রম, বাবার অসুস্থতা, বাবার মৃত্যু, মা-র অসুস্থতা, তারপর তার মৃত্যু, আমি তখন কোনমতে কর্তব্য পালন করে চলেছি।
বুঝেছি।
মৌ, তুই ভাবতে পারবি না, নতুন চাকরি করতে করতে আমি কী করে ওদের বেস্ট ট্রিটমেন্ট দেবার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করেছি।
শান্ত না থেমেই বলে, যখন একটু সামলে নিয়েছি আবার নিজের দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পেয়েছি, তখনই আমি তোদের কাছে ছুটে এসেছি।
মৌ ওর গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলে, গুড বয়!
এখন গুড বয় মনে হচ্ছে কিন্তু এই ক’বছর ধরে তো ভেবেছিস শান্তদা তোদের ভুলে গেছে অথবা গোল্লায় গেছে বা হয়তো ভেবেছিস শান্তদা এক নম্বর বেইমান।
শান্ত না থেমেই বলে, আর তুই তো ভেবেছিস আমি তোকে ঠকিয়েছি, তোর সঙ্গে ভালবাসার অভিনয় করে নিশ্চয়ই এতদিনে বিয়ে করে মহা ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছি।
হয়েছে? নাকি আরো কিছু বলবে?
আর কী বলব?
শান্তদা, তোমার প্রতি মা-বাবার এত অন্ধ স্নেহ যে তুমি খুন করলেও ওরা তা কখনই বিশ্বাস করবেন না। তুমি আমার মায়ের পেটে না জন্মালেও ওরা তোমাকে প্রথম সন্তানই মনে করেন, তা জানো?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জানি ও বিশ্বাসও করি।
আমার কথা শুনবে?
হ্যাঁ, বল।
মৌ ওর গলা জড়িয়ে চোখের পর চোখ রেখে বলে, তুমি কী জানো প্রেম- ভালবাসার ব্যাপারে ছেলেদের চাইতে মেয়েরা অনেক বেশি সিরিয়াস। তারা একবার কাউকে মন দিলে আর তাকে সারাজীবনেও ভুলতে পারে না।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, আমি মাঝে মধ্যে এখানে এলে আর তোর এম. এ পর্যন্ত পড়া হতো না।
কেন?
এর মধ্যে তোকে অন্তত নিশ্চয়ই বার ছয়েক মেটারনিটি ওয়ার্ডে ভর্তি করতে হতো।
আঃ! শান্তদা!
শান্ত একটু চাপা হাসি হেসে বলে, একদিক দিয়ে এখন এসে ভালই করেছি।
শুনি, কোনদিক দিয়ে ভাল করেছ।
তুই তো এখন গাছপাকা আম, যেমন মিষ্টি তেমনি রসে ভরপুর। তোকে পেয়ে এখন কি ভালই লাগছে।
আমি গাছপাকা আম?
তুই তো এখন চব্বিশ বসন্তের পরিপূর্ণ ফোঁটা পদ্মের মতো…
আর কিছু না?
মৌ, সত্যি বলছি তুই যে আমাকে কি আনন্দে রেখেছিস তা জানিস না। তোর জন্য আমি জীবনে পরিপূর্ণতার স্বাদ পাচ্ছি।
সত্যি তাই?
হ্যাঁ মৌ, সত্যি তাই।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমাকে পরিপূর্ণভাবে পেয়ে তুই কোন পূর্ণতার স্বাদ পাচ্ছিস না?
বেশ কিছু বছর শূন্যতার জ্বালা সহ্য করার পর এখন তোমাকে পেয়ে নিশ্চয়ই ভাল লাগছে।
মৌ না থেমেই ওর মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, আবার সেই পুরনো শূন্যতার জ্বালা আমাকে সহ্য করতে হবে না তো?
কখনই না।
এই কথা বলেই শান্ত ওকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়।
মৌ-ও ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
দু’চার মিনিট নীরবতার পর মৌ বলে, শান্তদা একটা কথা বলব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল।
তুমি যখন আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নাও, তখন যে কি শান্তি পাই তা তুমি ভাবতে পারবে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ শান্তদা, এখন আমার কোন দুঃখ কষ্ট নেই, অভাব-অভিযোগ নেই, ভূত-ভবিষ্যত নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই; এখন আমার মন আনন্দে টইটুম্বর।
তুই আমাকে সত্যি খুব ভালবাসিস।
নিশ্চয়ই ভালবাসি; তা না হলে কেউ এভাবে নিজেকে উজাড় করে সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারে?
শান্ত আলতো ওকে একবার চুমু খায়।
মৌ আবার বলে, নিজেকে কখনই এভাবে বিলিয়ে দিতে পারতাম না যদি তুমি আমাকে না ভালবাসতে। তুমিও আমাকে পাগলের মতো ভালবাসো।
সত্যি তাই মনে করিস?
হ্যাঁ, সত্যিই তাই বলে তো তুমি আমাকে প্রাণভরে পাবার জন্য কি পাগলামীই করো!
তুই পাগলামী করিস না?
পাগলের পাল্লায় পড়ি বলেই তো পাগলামী করতে বাধ্য হই। যত দোষ নন্দ ঘোষ, তাই না?
কী করব? নন্দ ঘোষই যদি প্রথম আগুন জ্বালায়, তাহলে তো সে আগুন ছড়িয়ে পড়বেই।
শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।
.
ওরা দুজনে সারাদিন শুধু হোটেলের ঘরে বসে থাকে না। রোজই সকালের দিকে শান্ত এক একদিন এক এক এরিয়ার ডিস্ট্রিবিউটারের দীর্ঘ আলোচনা করে ড্রইং- ডাইনিং রুম-এ বসে। এইসব আলোচনার সময় মৌ-ও শান্তর পাশে থাকে।
মিঃ কেজরিওয়াল, দিস ইজ মহুয়া…
মিঃ কেজরিয়াল সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জোড় করে ওকে নমস্কার করে বলেন, নমস্তে মেম সাব!
মৌ-ও দু’হাত জোড় করে ওকে নমস্কার করে।
শান্ত ধীরে ধীরে বলে, মহুয়া খুবই উচ্চশিক্ষিতা ও অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে; ও আমাদের কোম্পানীতে শিগগিরিই জয়েন করবে।
স্যার, আপনাদের বহু প্রোডাক্টই তো মেয়েদের জন্য; সেইগুলোর ব্যাপারে ওর পরামর্শ আমাদের খুবই সাহায্য করবে।
হ্যাঁ, তা তো করবেই কিন্তু অন্যান্য প্রোডাক্টের ব্যাপারেও ওর মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে হয়।
স্যার, তা তো হবেই।
আপনাদের প্রত্যেককে উইকলি সেলস্ রিপোর্ট ওর কাছে পাঠাতে হবে প্রতি সোমবার।
হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই পাঠাব।
শান্ত একইভাবে নন্দলাল জালান, বিমলেন্দু পাইন, অশোক মেটা, জগদীশ্বর আগরওয়াল, গঙ্গাশরণ যাদব আর নরনারায়ণ বসাকের সঙ্গে মহুয়ার পরিচয় করিয়ে দেন।
.
এই পর্ব মিটতেই মৌ বলে, শান্তদা, আমি কী পারব এই কাজ করতে?
আসল কথা হচ্ছে, এদের সবাইকে প্রতিনিয়ত চাপে রাখতে হবে বিক্রি বাড়াবার জন্য।
কিন্তু কীভাবে চাপে রাখব?
এদের প্রত্যেককে বলবে, এই প্রোডাক্ট, ওই প্রোডাক্ট, সেই প্রোডাক্টের বিক্রি বাড়াও।
শান্ত একটু হেসে বলে, এরা প্রত্যেকেই জানে ওদের বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট হেড অফিসে গেলেই এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ চলে যেতে পারে; তাইতো ওরা যেভাবেই হোক বিক্রি বাড়াবেই।
আমার মতো মেয়ের কথাকেও ওরা সত্যি গুরুত্ব দেবে?
আলবাত দেবে।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, হাজার হোক তুমি ভারতের অন্যতম বিখ্যাত কোম্পানীর একজন অফিসার হিসেবে কথা বলবে। ওরা কোম্পানীর অফিসারদের যেমন ভয় করে, সেইরকমই ভক্তি করে।
ও একটু হেসে বলে, তোকে দু’একটা টেকনিক শিখিয়ে দেব, দেখবি তাতে কি দারুণ কাজ হবে।
মৌ একটু হেসে বলে, প্লীজ একটা উদাহরণ দাও।
তুই হাতের ফাইলের কাগজগুলো একটু উল্টেপাল্টে দেখে নিয়েই বলবি, মিঃ কেজরিওয়াল, লাস্ট ক’ উইকের রিপোর্টে দেখছি প্রত্যেক সপ্তাহে জগদীশ্বর আগরওয়াল, পাইন আর অশোক মেটার বিক্রি দশ কোটি থেকে বাইশ কোটি টাকার মাল বেশি বিক্রি করছেন কিন্তু আপনার বিক্রি বাড়ছে না কেন?
যাদের বিক্রি বাড়ছে বললাম, তাদের বিক্রি কী সত্যি বাড়ছে?
শান্ত গম্ভীর হয়ে বলে, না, কিন্তু তোর কথা শুনেই কেজরিওয়ালের মুখ শুকিয়ে যাবে।
তারপর?
তারপর তুই ওকে বলবি, আপনি আমাদের কোম্পানীর বহু পুরনো ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে যথেষ্ট সুনাম আছে; তবে আমার মনে হয়, আপনার সেলসম্যানরা বোধহয় ঠিক মতো কাজ করছে না।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, দেখবি তোর এই কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।
.
ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্টদের সঙ্গে কথাবার্তার পর্ব শেষ, এবার শান্তকে ফিরতে হবে মুম্বাই।
ভাল কাকা, এবার আমাকে ফিরতে হবে।
এরই মধ্যে?
ভেবেছিলাম তিন-চারদিনের বেশি থাকব না কিন্তু নানা কারণে ছ’দিন রইলাম। তাইতো ঠিক করেছি কালই ফিরে যাব।
আবার কবে আসবি?
এবার থেকে এক-দেড় মাস অন্তরই আমাকে আসতে হবে।
তাহলে তো ভালই।
আর একটা কথা।
হ্যাঁ, বল।
আমি ঠিক করেছি মৌ-কে কলকাতাতেই আমাদের কোম্পানীর কাজে লাগিয়ে দেব।
মৌ কী পারবে সে কাজ করতে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব পারবে।
বিমলবাবু একটু হেসে বলেন, ও যদি পারে সে কাজ করতে, তাহলে আমি আপত্তি করব কেন?
তবে ওকে একটা ফর্মাল ইন্টারভিউ তো দিতে হবে আমাদের মুম্বাই অফিসে; তারপর ওকে তিন-চার সপ্তাহ ধরে ট্রেনিং দেওয়া হবে।
মৌ-কে কবে যেতে হবে?
আমি ভাবছিলাম ওকে সঙ্গে নিয়েই যাব।
মৌ রাজি আছে?
ও তো এক পায়ে খাড়া।
ও রাজি থাকলে আমি আপত্তি করব কেন?
বিমলবাবু সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, তুই তোর ভাল মা-র সঙ্গেও এই ব্যাপারে কথা বলিস।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, ভাল মা-র সঙ্গে কথা বলেছি, তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।
তবে আবার কী? তবে দেখিস বোম্বের মত অচেনা শহরে ও যেন একা একা না ঘুরতে বেরোয়।
ওকে কখনই একলা ছাড়ব না; তেমন দরকার হলে আমাদের অফিসের কাউকে ওর সঙ্গে পাঠাব।
তাহলে তো ভালই হয়।
.
পরের দিন সকালে শান্ত হোটেল থেকে রওনা হয়ে এয়ারপোর্ট যাবার পথে মৌ-কে তুলে নিতে আসে। প্রণাম করে ভাল কাকাকে।
বিমলবাবু ওকে আশীর্বাদ করেই বলেন, তোকে কাছে পেয়ে ভরসা বেড়ে গেল; মাঝে মাঝেই একটু দেখে যাস।
হ্যাঁ, ভাল কাকা, নিশ্চয়ই আসব। এখন আপনারা দু’জন ছাড়া আমার আপনজন তো কেউ নেই।
শান্ত অনুপমা দেবীকে প্রণাম করেই ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, এখন তোমার চাইতে আপনজন আর কেউ নেই। তুমি যে কি ধাতুতে গড়া, তা ভগবানই জানেন। আমি তোমাকে যত বিরক্ত করি, তুমি তত আনন্দ পাও, তত খুশি হও।
শান্ত ওর হাতে একটা খাম দিয়েই গাড়িতে ওঠে।
.
মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে পৌঁছেই শান্ত টেলিফোন করে কলকাতায়।
ভাল কাকা, আমি শান্ত বলছি।
তোরা এর মধ্যেই পৌঁছে গেছিস?
হ্যাঁ, ভাল কাকা। মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে পৌঁছেই তো ফোন করছি। এবার মৌ-এর সঙ্গে কথা বলো।
হ্যাঁ, দে।
মৌ বলে, জানো বাবা, প্লেনে কি আনন্দেই এলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, বাবা।
প্লেনে কিছু খেয়েছিস?
দারুণ খেয়েছি।
শান্তর ফ্ল্যাটটা কেমন?
ওয়ান্ডারফুল! অনেক দিনের পুরনো বাড়ি; তাই প্রত্যেকটা ঘরই হলঘরের মতো। তাছাড়া সব চাইতে ভাল হচ্ছে নীচে রাস্তার ঠিক পাশেই আরব সাগর ভাবাই যায় না।
যাইহোক সাবধানে থাকিস আর মাঝে মাঝে টেলিফোন করতে ভুলিস না।
না, না, ভুলব না।
এবার মা-র সঙ্গে কথা বল।
হ্যাঁ, দাও।
অনুপমা দেবী রিসিভার ধরেই বলেন, ভালভাবে পৌঁছেছিস?
হ্যাঁ, মা, খুব ভালভাবে এসেছি।
বোম্বে বিরাট শহর। একলা একলা কোথাও বেরুবি না।
শহরটা তো চিনি না; একলা বেরুব কোথায়?
এবার শান্তকে দে তো।
এই নাও।
হ্যাঁ, ভাল মা, বলো।
তুই আমাকে অতগুলো টাকা দিয়ে গেলি কেন?
বেশ করেছি।
অনুপমা হাসতে হাসতে বলেন, ওরে হতভাগা অতগুলো টাকা দিয়ে আমি কী করব?
যা ইচ্ছে।
তোর উপর আমার সত্যি খুব রাগ হয়েছে।
সামনের বার কলকাতা গেলে তুমি আচ্ছাসে আমাকে পিটুনি দিও। তাহলে তো হবে?
তোকে নিয়ে আমি কী করি বলতো?
আমাকে শুধু আদর করবে।
অনুপমা হো হো করে হেসে ওঠেন।