৫-৬. বিকেলের রোদ

০৫.

তখনও বিকেলের রোদ ছিল। বেশ কড়া রোদ। ভজনদা সাহেবদের বলে রেখেছিলেন যে, তিতিরের জায়গায় পৌঁছোতে প্রায় কুড়ি মিনিট কী আধঘণ্টা লাগবে। অতএব বেলা থাকতে থাকতে না গেলে তিতির পাওয়া যাবে না।

আমি, ভজনদা, পান্ডে ড্রাইভার সব বাংলোর কাছে ঠা ঠা রোদে চারটের থেকে দাঁড়িয়ে আছি। সাহেবের অতিথিদের সাড়াশব্দ নেই। পান্ডে নিজে শিকারি না হলে কী হয় তার উৎসাহ দেখলাম শিকারিদের চেয়েও বেশি। সে কেবল-ই বলছে, বড়ি দের হো রহা হ্যায়। ইতনা দের করনেসে চিড়িয়া মিলেগা নেহি।

ভজনদা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, তা আমাকে বলছিস কেন? সাহেবের মেহমানদের ঘুম ভাঙিয়ে কি চাকরিটা খাব?

একটা ঘর থেকে ফোঁ-ফোঁ, ফোঁ-ফোঁৎ করে নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।

ভজনদা আঙুল দিয়ে ঘরটা দেখিয়ে আমার দিকে চেয়ে চোখের ভুরুতে নীরব প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকলেন।

বললেন, এ কোন জানোয়ার?

আমি বললাম, ওটা কাতলামাছের ঘর।

 কাতলামাছ?

ভজনদা অবাক হয়ে শুধোলেন।

আমি বললাম, হ্যাঁ। একজন কাতলামাছ, একজন ছাগলদাড়ি, একজন শেতলপাটি এবং একজন মাত্র ভদ্রলোক। তিনি ফোটোগ্রাফার।

ভজনদা বললেন, কম্বিনেশনটা দারুণ। তার সঙ্গে দাঁড়কাক পাতিকাক। আজকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলে হয়।

ঠায় আধঘণ্টা আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। চা পর্যন্ত খাইনি কেউ। কিন্তু বাড়ির মধ্যে যে, কেউ জেগেছেন এমন লক্ষণ দেখলাম না কোনো। ওপাশের ঘর দুটো থেকে এয়ার কণ্ডিশনারের মৃদু ঝিরঝির শব্দ ভেসে আসছে শুধু।

প্রায় পৌনে পাঁচটা নাগাদ কাতলামাছ হেঁড়েগলায় চিৎকার করলেন, মেহবুব, চায়ে….।

 ভজনদা বললেন, যাক তাও নড়াচড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

 সাহেবরা প্রায় সোয়া-পাঁচটা নাগাদ বেরোলেন। তাদের পোশাক-আশাক দেখে আমরা থ!

ছাগল-দাড়ি এসে অবধি একটা হাফ-প্যান্ট পরেছেন, যেটাকে হাফ-প্যান্ট না বলে সুইমিং ট্রাঙ্ক বলাই ভালো। কোনোক্রমে লজ্জা নিবারণ হয়। ওপরে নীলরঙা ব্যাংলনের গেঞ্জি। কাতলামাছও এসে অবধি একটা লাল জিনের ফ্লেয়ার গলিয়ে নিয়েছেন, ওপরে জিনের লাল শার্ট–দারুণ দেখাচ্ছে। শেতলপাটির পরনে খাকি প্যান্ট, সঙ্গে লাল মোজা, কালো জুতো, গায়ে খালিজ-ফেজেন্টের মতো ছিটছিট খয়েরি জামা। ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোকের গায়ে হলুদ ব্যাংলনের গেঞ্জি–টেরিকটের কালো প্যান্ট। সকলের হাতেই গুপী-যন্তর। শুধু কাতলামাছের হাত খালি। সকলের চোখ-মুখ-ই দুপুরে জাপানিজ টি-হাউসে বসে বিস্তর বিয়ার পানের পর চোব্য-চোষ্য খেয়ে ও ঘুমিয়ে, ফুলে উঠেছে।

সকলে একে একে গাড়িতে এসে উঠলেন। মেমসাহেবরা এসে তাঁদের আঙুল-নেড়ে সি অফ করে গেলেন। কাতলামাছের বউ নেই। থাকার কোনো সম্ভাবনাও নেই বলে মনে হল। এরকম লোককে বিয়ে করে কোন মহিলা জীবনের ওপর ট্রাক্টর চষবেন?

সামনের সিটে পান্ডে, আমি, ভজনদা ও কাতলা মাছ, পেছনে বাকি তিনজন, কাতলা মাছ একাই অর্ধেক সিট জুড়ে বসেছেন, আমি, ভজনদা ও পান্ডে শুঁটকি মাছের মতো গায়ে গায়ে সেঁটে বসে আছি। পান্ডের শরীরটা প্রায় সিটের বাইরে। পশ্চাৎদেশের পাঁচশো গ্রাম মাংস কোনোক্রমে সিটে ঠেকিয়ে সে যে, কী করে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে, গিয়ার চেঞ্জ করছে! সেই-ই জানে।

বাজারের কাছের ঘড়িঘরের পাশের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে আমরা দুমকা রোডে পোঁছালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম।

বেশ লাগছে- গরম হলেও হু-হু শুকনো হাওয়া। মনের মধ্যের সব আদ্রতা শুষে নেয়।

 যখন আমরা মেন লাইনের লেভেল-ক্রসিং পেরিয়ে টিগরিয়া পাহাড়ের কোলে এসে পোঁছোলাম তখন তিতিররা প্রত্যেকেই রাতের মতো শোয়ার বন্দোবস্ত করছে। আলো বিশেষ নেই-ই বলতে গেলে।

কিন্তু এখানের তিতিরদের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা যে, এমন বেশি আমার তা জানা ছিল না।

দু-পাশে ঝাঁটি-জঙ্গল-খোলা টাঁড়–লাল খোওয়াই।

কাতলামাছ স্বগতোক্তি করলেন, খরগোশ, তিতির ও ক্যাজুয়াল লেপার্ডের আইডিয়াল জায়গা।

এমন সময় পান্ডে জোরে ব্রেক কষল।

দেখলাম বাঁ-দিকে পথের পাশেই একটা বড়কা তিতির দাঁড়িয়ে পড়ে মুখ হাঁ-করে কাতলামাছকে দেখছে।

মুহূর্তের মধ্যে শেতলপাটি পেছন থেকে গাড়ির জানলা দিয়ে বন্দুকের নল বের করে দেগে দিলেন।

তিতিরটার চোখে কাতলামাছের ছবিটা ফিল্টারড হয়ে তার ব্রেনে পৌঁছোবার আগেই তিতিরটা দু-ঠ্যাং ওপরে তুলে উলটে গেল।

প্রায় নল ঠেকিয়েই মারা হয়েছিল। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়নি এই-ই যথেষ্ট।

পান্ডে মুহূর্তের মধ্যে নেমে দৌড়ে গিয়ে তিতিরটা তুলে এনে বুটে রাখল।

 গাড়ির মধ্যে কনগ্রাচুলেশানস, গুড শট ইত্যাদি শোনা গেল।

কাতলামাছ উত্তেজনায় ভুরুক-ভুরুক করে পাইপ খেতে লাগলেন।

পাইপের মধ্যে এত নিকোটিন আর থুতু জমেছে যে, থেলো-কোর মতো আওয়াজ করছে পাইপটা। লোকটা থ্রোট বা টাঙ ক্যান্সার হয়ে মরল বলে, মরার আর দেরি নেই; মনে হল আমার।

আর একটু এগিয়ে যেতেই পথের ডানদিকের টাঁড় থেকে দুটো বড়ো তিতির ভরররর আওয়াজ করে উঠল।

উড়তেই দেখি, অর্ধ-নগ্ন ছাগল-দাড়ি নেমে পড়ে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে একবার এদিকে আর একবার ওদিক করে দুটো গুলি করলেন।

 উড়োপাখি দুটোই ঝুপ ঝুপ করে পড়ে গেল।

এবার আমার-ই তারিফ করতে ইচ্ছে হল। শিকারি বটে। ইচ্ছে হল, ছাগল-দাড়ির দাড়িতে চুমু খেয়ে দিই।

পরক্ষণেই ভাবলাম, আমার কপালে চুমু খাওয়ার এ ছাড়া আর কোন জায়গা জুটবে? একটা হীনম্মন্যতা আমাকে ছেয়ে ফেলল। নিজের বাসানার সুতো মনের লাটাইয়ে গুটিয়ে নিলাম।

পান্ডে গিয়ে পাখি দুটোকে আবারও নিয়ে এল।

এখন পরিবেশটা বড়ো মনোরম হয়ে এল। কুয়াশার মতো সদ্যোজাত নরম অন্ধকার। প্রসন্ন চাঁদটা ইতিমধ্যেই পাহাড়ের গা বেয়ে উঠেছে। পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারাটা নীল স্নিগ্ধ শান্ত শরীরে ফুটে উঠেছে।

আমি বাঙালির ছেলে। সাঁওতাল পরগনায় এই-ই প্রথম। ভারি ভালো লাগছে। দুমকার পথটা নরম সবুজ ঝাঁটি-জঙ্গলের আর পাহাড়ের মাঝ দিয়ে গিয়ে সামনেই একটা হঠাৎ বাঁক নিয়েছে। মাঝে মাঝে লাল মাটির খোওয়াই। পূর্ণিমার চাঁদ, সন্ধ্যাতারা, বনের সবুজ আর লাল এবং পিচ-ঢালা পথের কালো মিলে-মিশে একটা দারুণ সুন্দর কম্পোজিশনের সৃষ্টি হয়েছে।

এমন সময় বাঁ-দিকে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ গজ দূরে একটা একলা দার্শনিক তিতিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। ভজনদার কাছে শুনেছিলাম যে, তিতির সাধারণত দলে থাকে অথবা জোড়ায় থাকে। মনে হল, এখানের তিতিরগুলোর দাম্পত্যজীবন বিশেষ সুখের নয়। নইলে এরা এমনভাবে এই আধো-অন্ধকারে গুলিভোর হওয়ার অভিপ্রায়ে আত্মহত্যা করার জন্যে একা একা দাঁড়িয়ে থাকবে কেন?

এবার ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক নামলেন। হাতে বন্দুক নিয়ে।

ভদ্রলোকের শিকারের প্রক্রিয়াটা অদ্ভুত লাগল। উনি গাড়ি থেকে বসেই গুলি করতে পারতেন, তিতিরটা কাছেই ছিল, কিন্তু তা না করে বন্দুকটা বাগিয়ে ধরেই তিনি তিতিরটার পেছনে দৌড় লাগালেন।

তিতিরটা প্রথমে এই চোর চোর খেলাটা খেলতে চায়নি। অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যখন শিকারি তার পাঁচ হাতের মধ্যে দৌড়ে গেলেন, তখন বোধ হয় ওর মনে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা হঠাৎ জাগরূক হয়ে উঠে থাকবে।

সেও এই অদ্ভুত শিকারির কারবার দেখে ঝেড়ে দৌড় লাগাল।

 তিতিরের দৌড় দেখতে ভারি মজার। ওয়াল্ট-ডিজনির ছবির হাঁসের মতো দৌড়োয় এরা।

তিতিরও দৌড়োচ্ছে, হলুদ গেঞ্জিও দৌড়াচ্ছেন। বন্দুকের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন শিকারি। তাঁর মনে বন্দুকটা হঠাৎ লাঠি হয়ে গেছে বোধ হয়।

দেখতে দেখতে দু-মিনিটের মধ্যে শিকারি ও শিকার আমাদের সকলের চোখের সামনে থেকে খোওয়াই-এর মধ্যে জঙ্গলের গভীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কাতলামাছ, শেতলপাটি এবং ছাগল-দাড়িকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। চিন্তায় দাঁড়কাকের অবস্থা ঝোড়োকাকের মতো হয়ে গেল।

.

ভজনদা একেবারে গরম দুধে মুড়ির মতো চুপসে গেলেন। যদি সাহেবের একজন অতিথিকেও এখানে রেখে যেতে হয়, তাহলে ভজনদাকেও চাকরি এখানে রেখে চিরদিনের মতো জয়নগর-মজিলপুরে গিয়ে মোয়া খেয়ে বাদবাকি জীবন কাটাতে হবে।

যখন দশ-পনেরো মিনিট হয়ে গেল তখন সাহেবরা সমস্বরে বামাপদ বামাপদ বলে চেঁচাতে লাগলেন। ওঁরা এমন সুরে ও পর্দায় বামাপদকে ডাকছিলেন যে, হঠাৎ আমার মনে হয় বাল্মীকি প্রতিভা-র বাল্মীকি-রাঙাপদ, পদযুগে প্রণমি হে ভবদারা গাইছেন। বামাপদ কথাটাকে হুবহু সেই গানের রাঙাপদ বলে মনে হচ্ছিল।

কিন্তু আসন্ন রাতের জঙ্গল থেকে, পাহাড় থেকে বামাপদর কোনো আওয়াজ শোনা গেল না।

সকলে চিন্তিত হয়ে উঠলেন। নীল ছাগল-দাড়ি ওইদিকে হলুদ বামাপদকে খুঁজতে গেলেন।

এমন সময় গাড়ির একেবারে গায়ের পাশ থেখে কুঁই কুঁই আওয়াজ শোনা গেল।

আমরা তাকিয়ে দেখি, চারটে তিতির আর তাদের সঙ্গে একপাল একশোগ্রাম ওজনের সুনটুনি-মুনটুনি বাচ্চা।

বিনা বাক্যব্যয়ে কাতলামাছ শেতলপাটির হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে গদাম করে মা-বাচ্চাদের ওপর কসাইয়ের মতো দেগে দিলেন। দুটো তিতির পড়ে গেল, দুটো উড়ে গেল; আর বাচ্চাগুলো মিনি লাটুর মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল।

শেতলপাটি বললেন, পাকড়ো, পাকড়ো।

আদেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি, ভজনদা আর পান্ডে বাচ্চাগুলোর পেছনে পেছনে দৌড়োতে লাগলাম। এবং বারংবার বডি-থ্রো করতে লাগলাম। সে-এক হাসির ব্যাপার। দৌড়োতে গিয়ে ভজনদা পাথরে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়লেন। কিন্তু পরক্ষণেই উঠে পড়ে আবার দৌড়োলেন।

চাকরি রাখতে যে, এমন সার্কাসও করতে হবে তা কোনোদিন ভাবিনি।

 যখন আমরা তিনজন ফিরলাম, তখন ভজনদা বুক-পকেটের ওপর থেকে দুটো বাচ্চা উঁকি মারছিল আর আমার আর পান্ডের দু-হাতের তেলের মধ্যে আরও চারটে করে বাচ্চা।

ভজনদা হুংকার ছাড়লেন। খবরদার। সাহেব যদি জানতে পারেন যে, একটা বাচ্চাও মরে গেছে তো সর্বনাশ হবে। এদের যত্ন করে গাড়ির বুটের মধ্যে রাখো।

শেতলপাটি মৃদু ভসনা করলেন। বললেন, বাচ্চাসুদু মারলে?

কাতলামাছ লাজুক মুখে বললেন, কী করব বলো? সংযম ব্যাপারটা যে, আয়ত্ত হল না জীবনের কোনোক্ষেত্রেই।

ইতিমধ্যেই হলুদ বামাপদ ও নীল ছাগল-দাড়ি এসে হাজির হলেন প্রায় অন্ধকার ফুঁড়ে।

 ছাগল-দাড়ি শুধোলেন ভজনবাবুকে, ভজনবাবু এতটুকু-টুকু বাচ্চাদের বাঁচাবেন কী করে?

ভজনদা গর্বিত গলায় বললেন, তাহলে আর এতদিন চিড়িয়াখানার ম্যানেজারি কী করলাম।

কী খাওয়াবেন ওদের? শেতলপাটি প্রশ্ন করলেন।

ভজনদা উত্তর দিলেন, উই পোকা, পোস্ত দানা আর জল। দেখবেন, সব কটাকে ঠিক বাঁচিয়ে তুলব।

রাতে তিতির শিকার করে ফিরে আসার পর ছাগল-দাড়ি, শেতলপাটি ও ভদ্রলোকের মেমসাহেবরা মিলে লনে বসে গান-বাজনা করবেন বলে ঠিক করলেন। বউরানিও ছিলেন। কাতলামাছ যেন কোর্ট জেস্টার। আগের দিনের রাজরাজড়ার বিদূষকের মতো। যাই-ই হোক, সবসময় হেঁড়েগলায় রসিকতা করে গান করে সকলকে আনন্দ দান করছেন তিনি। তিনি নিজে জানেন না যে, তাঁর চেহারাটাই এমন যে, তাঁকে দেখলে লোকের এমনিই হাসি আসে।

ভাগ্যিস জানেন না।

বউরানি বড়ো ভালো গান গাইলেন। ছেলেবেলায় উনি বেনারসে মানুষ হয়েছিলেন। গজল ও ঠুংরির গায়কি। ডান হাতের পাঁচখানা আঙুল নাড়িয়ে তিনি যখন গজল গান তখন না-দেখে গহরজান বা মালককা-জান বাইজিদের গায়কির কথা মনে পড়ে যায়। পড়েছিলাম যে, গহরজান যখন পান খেয়ে পানের পিক গিলতেন তখন নাকি তাঁর ধবধবে ফর্সা গলা দিয়ে পানের পিকের রক্তিমাভাকে নামতে দেখা যেত। মেমসাহেব পান খেয়ে পিক গিললেও বোধ হয় তেমন-ই দেখা যায়। চাঁদের আলোয় বোঝা যাচ্ছিল না। ভাবলাম, একদিন দিনের আলোয় ভালো করে লক্ষ করতে হবে।

শেতলপাটি মেমসাহেব বললেন, আমি তবলা ছাড়া গাইতে পারি না।

অমনি বউরানি বললেন, টিকলু, লেডকেনিকে ডাকো।

আমি না বুঝে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

বউরানি বুঝতে পেরে বললেন, সরি। লালমোহনকে।

আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, যিনি বাঁশের কাজ করেন?

-নীলমোহনবাবু?

–হ্যাঁ।

 আমি আর সময় নষ্ট না করে নীলমোহনবাবুকে ডাকতে চললাম।

দাঁড়িয়ে পড়ে যে, ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবব, তারও সময় নেই। চলতে চলতেই ভাবতে লাগলাম। কিন্তু ভেবেও বাঁশের মিস্ত্রির সঙ্গে তবলার কী সম্পর্ক বুঝতে পারলাম না।

নীলমোহনবাবু তাঁর কোয়ার্টার্সের সামনে একটা চৌপাইয়ের ওপর লুঙ্গি পরে আসন-পিঁড়ি হয়ে উত্তরমুখো বসে ঠাকুরের নাম করছিলেন।

ওঁকে বললাম, আপনাকে বউরানি ডাকছেন।

 উনি ঠাকুরের নাম থামিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থিরনেত্রে তাকিয়ে থাকলেন।

তারপর হঠাৎ বললেন, গান-বাজনার আসর বসেছে বুঝি?

আজ্ঞে। আমি বললাম।

নীলমোহনবাবু আমায় বললেন, একটু ভেতরে আসুন।

ওঁর কোয়ার্টার্সে ঢুকেই উনি একজোড়া পেতলের তবলা দেখিয়ে আমাকে বললেন, উঠিয়ে নিন।

আমি বাঁয়াটার কান ধরে তুললাম। উনি তবলাটার কান।

তারপর-ই পাশের ঘরের কাকে যেন ডাকলেন নীলমোহনবাবু, ছোটুয়া বলে।

ওঘরে গিয়ে দেখলাম, একটি বছর বারো-তেরোর ছেলে ভেক-কুম্ভস্য আসনে উবু হয়ে বসে দু-হাত দিয়ে কাঁসার থালাতে আটা মাখছে–রুটি বানাবে বলে।

সে চমকে উঠে বলল, ক্যা হুয়া?

নীলমোহনবাবু বললেন, কুচ্ছ হুয়া নেই; আভি হয়েগা।

তারপর-ই আমাকে হতবাক করে দিয়ে দারুণ হিন্দিতে বললেন, তুমহারা বাঁশিটা লেকে আভভি হামারা ল্যাজমে ল্যাজমে আও।

ছোটুয়া তার দু-হাতের আঙুলে লেগে থাকা ভিজে আটার দিকে তাকাল।

 নীলমোহনবাবু বললেন, সময় নেহি হ্যায়, যেইসা হ্যায়, অইসাই আও।‘

 তারপর আমরা শোভাযাত্রা করে লনের দিকে এগোতে লাগলাম।

নীলমোহনবাবু দৈর্ঘ্যে চার ফিট দশ ইঞ্চি, ব্যাসে তিন ফিট। গায়ের রং কুচকুচে কালো, তার ওপর একটা খয়েরি-রঙা লুঙ্গি ও হাতকাটা গেঞ্জি পরেছেন। তাও খয়েরি। উনি আমার সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

মনে হল, বউরানি লেডিকেনি নামকরণটা নেহাত খারাপ করেননি।

পরক্ষণেই মনে হল, আমার চেহারাটাও কি তাহলে হুবহু পাতিকাকের মতো? আজ-ই রাতে কোয়ার্টারে গিয়ে আয়নায় ভালো করে দেখতে হবে নিজেকে। আত্মদর্শন করতে হবে।

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছোলাম, তখন বউরানি বললেন, বাঃ, ছোটুয়াও এসেছ?

ছোটুয়ার হাতের ভিজেআটা তখন পুরো শুকিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে চষি বেরোচ্ছে। ইমিডিয়েটলি চষি-পিঠে করা যায়।

ছোটুয়া আড়ষ্ট হাত তুলে সেলাম ঠুকে বলল, জি হাঁ মেমসাব।

বউরানি শেতলপাটির মেমসাহেবের দিকে তাকালেন। তাঁর নাম ততক্ষণে জানা গেল, লিচি।

পরে ওভার-হিয়ার করে জেনেছিলাম যে, তাঁদের বাড়ি নাকি মুজফফরপুরে। তাই তাঁর দিদিমা মুজফফরপুরের বিখ্যাত লিচুর নামে নাম রাখেন তাঁর। চেহারাটাও লিচু-লিচু। ভালো মানিয়েছে।

মেমসাহেব বললেন, লিচি, সোলো গাইবে না কোরাস?

লিচি লজ্জা লজ্জা গলায় বললেন, না সঙ্গে ছুপকি ও নিনির গাইতে হবে।

কাতলামাছ বিনা রিকোয়েস্টেই বললেন, আমিও গাইব।

কোন গান গাওয়া হবে, তাই আলোচনা করে প্রথমে দশ মিনিট কেটে গেল। ততক্ষণে ছোটুয়ার হাতের ভিজে আটা স্টিকিং-প্লাস্টারের মতো তার দু-হাতে সেঁটে গেছে।

যখন গান ঠিক হল তখন দেখা গেল লিচি আর মিনি গানটা জানেন, কিন্তু ছুপকি ও কাতলামাছ জানেন না। তারপর অনেক ন্যাকামি, এমা :, তা হবে না, পারব না ওরে বাবা রে-র পরে ওঁরা ঠিক করলেন যে, রবীন্দ্রসংগীত-ই গাইবেন–পুরানো সেই দিনের কথা শুনবি যদি আয়।

কাতলামাছ বললেন, দেবব্রত বিশ্বাস বড়ো ভালো গান, এই গানটা।

তারপরে আরও পাঁচ মিনিট গেল রেডি গেট-সেট গো-তে।

হঠাৎ আমার বউরানি ফোর-ফরটি ইয়ার্ডস রেসের স্টার্টার-এর মতো পিস্তলের বিকল্পে পানের সেই রুপোর বটুয়া দিয়ে টেবিলে ফটাস করে আওয়াজ করে বললেন, স্টার্ট।

তারপর গান আরম্ভ হল।

লিচি ধরলেন বি-ফ্ল্যাটে, ছুপকি ও নিনি আরও খাদে আর কাতলামাছ বি-ফ্ল্যাটে শুরু করে মুহূর্তের মধ্যে ব্যালিস্টিক মিসিলের মতো চলে গেলেন হারমোনিয়ামের একেবারে শেষ দক্ষিণ প্রান্তে।

সে যে কী কোরাস কী বলব!

এদিকে লেডিকেনি লনের মধ্যে লুঙ্গি পরে হাঁটুগেড়ে বসে পেতলের তবলায় উড়ন-চাঁটি দিয়ে যেতে লাগলেন। এ তবলা-বাঁয়া বোধ হয় বাঁধতে-টাধতে হয় না, সেজন্যেই পেতল দিয়ে চামড়া চিরতরে সিল করা আছে।

তবলাটা থেকে অনেকদিনের পুরোনো ব্রংকাইটিসের রুগি যেমন করে কাশে, তেমন একটা ঠং-ঠং আওয়াজ বেরোতে লাগল, আর বাঁয়া থেকে চ্যবনপ্রাশ আর ছাগলাদ্য মিশিয়ে খল-নোড়ায় মকরধ্বজ দিয়ে মারলে যেরকম ঢ্যাবঢেবে আওয়াজ হয় তেমন আওয়াজ।

ছোটুয়া কেষ্ট ঠাকুরের মতো বাঁ-পায়ের মধ্যে ডান পাটা সড়াৎ করে ঢুকিয়ে দিয়ে এমন বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে বাঁশি তুলল ঠোঁটে যে, আমার মনে হল, এই ঝোড়ো-হাওয়ায় যেকোনো সময়ে ও ছাগল-দাড়ির ঘাড়ে পড়ে যেতে পারে।

ছোটুয়ার বাঁশিটা ও ওর দেশ হাজারিবাগ জেলা থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল চাকরিতে বহাল হওয়ার সময়। ওই বাঁশি ওর বাবা হাজারিবাগের জঙ্গলের মধ্যে বাজরার খেতে রাতে বুনো শুয়োর যাতে বাজরা না খায় সেজন্যে মাচার ওপরে বসে বসে বাজাত।

যে-বাঁশির সুর ও স্বরের উদ্ভব হয়েছিল, দাঁতাল বুনো শুয়োরদের ভিরমি লাগানোর জন্যে সেই বাঁশি পুরানো সেই দিনের কথার প্রতি কী করে জাস্টিস করবে?

এতক্ষণে গায়ক-গায়িকাদের মুড এসে গেছে। একেবারে হইহই ব্যাপার। উত্তেজনায় আমার পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি আর সহ্য করতে না পেরে লনের মধ্যে বসে পড়লাম।

গায়ক-গায়িকার গলা বিভিন্ন স্কেলে, বিভিন্ন দিকে চলেছে কলকাতার দিকে গ্যালোপিং, লোকাল, এক্সপ্রেস ট্রেন ও মালগাড়িতে। বাঁশি ছুটেছে টিগরিয়া পাহাড়ের দিকে। তবলা পরেশনাথ পাহাড়ে।

আমার যে, কখনো এমন সুপারসনিক বিটোফেনিক অর্কেস্ট্রা শোনার সৌভাগ্য হবে, একথা স্বপ্নেও ভাবিনি।

মনে মনে বললাম, পাগল ভালো করো মা।

.

০৬.

সাহেব আজ ভোরের ট্রেনে এলেন।

আমি আর পান্ডে ড্রাইভার, স্কুটার-টেম্পো সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম।

এবারও সাহেবের সঙ্গে গন্ধমাদন পর্বত। প্রতিবার-ই চ্যাপটা করে ভাঁজ করা পিচবোর্ডের বাক্স নিয়ে আসেন আর যাওয়ার সময় কূপে ভরতি করে ডিম নিয়ে যান কলকাতায়। কলকাতায় দাম ভালো পাওয়া যায়–তাই যতটুকু পারেন কলকাতাতেই বিক্রি করেন– বাদবাকি লোকালি।

শহরের প্যাঁড়াওয়ালারা দুধ কেনেন সাহেবের ডেয়ারি থেকে। বাজারের হোল-সেলাররা টেবল-বার্ডস ও ডিম কেনেন।

সাহেব নেমেই আমাকে বললেন, কেমন আছ গজেন?

আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।

তারপর বললাম, ভালো।

আমার গেস্টরা সব ভালো মুডে? যত্ন-আত্তি করছ তো?

হ্যাঁ স্যার। কাল বিকেলে তিতির মেরেছেন। রাতে লনে গান-বাজনা হয়েছে। তারপর লোডশেডিং হয়েছিল বলে, বাইরের চাঁদের আলোয় লনে বসে ডিনার খেয়েছিলেন!

মেহবুব হুইস্কি-টুইস্কি সব দিয়েছিল তো? কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

–না স্যার।

তারপর ওভারব্রিজ পেরোতে পেরোতে বললেন, তোমার স্টকে কী কী কমে গেছে একটা লিস্ট করে দিয়ো। বুঝলে গজেন।

বললাম, হ্যাঁ স্যার!

সাহেব একটু এগিয়ে যেতেই দেখি পান্ডে আমার পাশে এসে আমার মুখে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।

অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, কী ব্যাপার?

পান্ডে বলল, ব্যাপার কিছু না, সাহেব নাম ভুলে যান মাঝে মাঝে সকলের-ই। তাই আপনাকে গজেন বললেন। দেখবেন, পরে আবার মনে পড়ে যাবে। আমাকেও মাঝে মাঝে দুখিরাম, খান্ডেলওয়াল, যোধ সিং এরকম নানা উলটোপালটা নামে ডাকেন।

এ ক-দিনে চিড়িয়াখানার কান্ড-কারখানায় অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন আর কিছুতেই অবাক লাগে না।

সাহেব বাড়ি ফিরতেই বাড়ির চেহারা পালটে গেল। বোধ হয় সবসময়েই পালটে যায়।

সাহেব বললেন, ব্রেকফাস্টের পর তুমি আমার সঙ্গে হানিফ সাহেবের বাড়ি যাবে। আমার বন্ধুদের জন্যে একদিন বিরিয়ানি পোলাও আর গুলহার কাবাবের আয়োজন করতে হবে। বউরানি আবার লোকটাকে দেখতে পারেন না। কিন্তু ভদ্রলোক ভারি ভালো রান্না করেন, বড়ো শৌখিন লোক, বয়স হয়েছে বিস্তর, কিন্তু এভার ইয়াং।

বললাম, আচ্ছা স্যার।

গেস্টরা সবাই তখনও ঘুমোচ্ছিলেন। রাতে অবশ্য শুয়েছেন সকলে প্রায় দুটো নাগাদ। লনে সকলেই চাঁদের আলোয় ইজিচেয়ারে বসেছিলেন। লনের সামনের বড়ো চাঁপাগাছটা থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় চাঁপাফুল উড়ে উড়ে লনময় ছড়িয়ে পড়ছিল। চাঁপাফুলের গন্ধ, মেমসাহেবদের গায়ের বিভিন্ন পারফিউমের গন্ধে মিলে-মিশে কেমন নেশা-নেশা লাগছিল।

ভাবছিলাম চাকরিটা টিকে গেলে, বউদিকে একবার আমার কোয়ার্টার্সে এনে দিনকতক রাখব। বউদির শখ ও রুচি আছে। এমন জায়গা বউদি দারুণ অ্যাপ্রিসিয়েট করবে। চাঁপাফুল বউদির দারুণ প্রিয়। কলকাতার রাস্তায় চাঁপাফুলওয়ালার কাছ থেকে কাঠিতে গোঁজা একটা দুটো চাঁপাফুল কিনে দিয়েছি বউদিকে। বউদি চাঁপাফুল বালিশের নীচে নিয়ে ঘুমোতে ভালোবাসে। এত চাঁপাফুল, মানে চাঁপাফুলের গালচে-বিছানো আছে দেখলে কী যে, করবেন জানি না।

সাহেবের ঘুম বড়োকম। লোকটার এনার্জি দেখে অবাক হয়ে যাই। দিনে-রাতে বড়োজোর চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমোন।

সাহেব এসেই এককাপ চা খেয়ে যে, জামাকাপড় পরে ট্রেনে এসেছিলেন, সেই বাথরুম স্লিপার, মোটা কাপড়ের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে পড়লেন কাজকর্ম দেখাশোনা করতে। তা কম্পাউণ্ডের মধ্যের ডেয়ারি, পোলট্রি, সামান্য চাষবাস দেখাশোনা করলেই প্রায় মাইল খানেকের চক্কর। তারপর কম্পাউণ্ডের বাইরে কো-অপারেটিভ বেসিসে যেসব জায়গায় চাষবাস হবে, পুকুর কাটা হবে, কর্মচারীদের কোয়ার্টার হবে সেইসব দেখাশোনা করলে তো দু-মাইলের চক্কর।

চলে যাওয়ার আগে সাহেব শুধোলেন, সাঁওতাল নাচের সব বন্দোবস্ত পাকা আছে তো? ভজনকে জিজ্ঞেস করেছিলে?

হ্যাঁ সাহেব। কাল দুপুর থেকে তো ভজনদা ওই ব্যাপার নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।

 সাহেব বললেন, ভজনকে বলে দিয়ো যে, আমরা সাড়ে আটটা নাগাদ সুজানী গ্রামের অশ্বথ গাছতলায় গিয়ে পৌঁছোব। তার আগেই যেন সব বন্দোবস্ত পাকা করে রাখে।

আচ্ছা স্যার। বললাম আমি।

ভেতরে ভেতরে আমারও কম উত্তেজনা হচ্ছিল না। ছেলেবেলা থেকে সাঁওতালি নাচ সম্বন্ধে পড়েছি, শুনেছি। জীবনে এই প্রথম আমিও তা দেখব। তাই বন্দোবস্তে যেন ত্রুটি না হয়, সেজন্যে ভজনদার পেছনে আমিও ছিনে-জোঁকের মতো লেগেছিলাম।

সাহেব চলে যেতেই ভজনদা এলেন।

বললেন সাহেব কই?

 আমি বললাম, ডেয়ারির দিকে গেলেন।

বললেন, তুমি তো এসে অবধি ডেয়ারিতে একবারেও গেলে না। খুব চাকরি করছ বাছা! চলো আমার সঙ্গে। তোমাকে গোরু ও ষাঁড় চেনাই।

আমি বললাম, এক্ষুনি সাহেবের গেস্টরা উঠে পড়বেন। কার কী প্রয়োজন হয়। এখন আমি যেতে পারব না।

ভজনদা বললেন, তা অবশ্য ঠিক।

তারপর বললেন, সাহেবের যেন প্রত্যেক উইক-এণ্ডে গেস্ট না আসলে চলে না। এত বন্ধু যে, সাহেবের কবে হল, কী করে হল, তাই-ই ভাবি। আসলে বুঝেছ টিঙ্কু, বন্ধু-ফন্ধু কেউ নয়, সব স্যার এ এম-এর হোটেলে বডি-ফেলে দিব্যি খানা-পিনা করে চলে যায়। এমনিতেই গোদ নিয়ে বেঁচে আছি আমরা। তার ওপর প্রতি সপ্তাহে-সপ্তাহে বিষ-ফোঁড়া।

পরক্ষণেই বললেন, আচ্ছা। চললুম তাহলে।

বললাম, আচ্ছা।

ভজনদা চিড়িয়খানার দিকে চলে গেলেন।

দেখতে দেখতে সাহেবের গেস্টরা ঘুম ভেঙে উঠলেন। বারান্দায় চায়ের আসর বসল। বউরানি মুখ-টুখ ধুয়ে যখন বারান্দায় এলেন, তখন আমার সাময়িকভাবে ছুটি মিলল। আমিও বাবুর্চিখানায় গিয়ে আরও এককাপ চা খেয়ে নিয়ে স্কুটার-টেম্পো চড়ে বাজারে বেরোলাম।

বাজার থেকে ফিরে এলাম ন-টার মধ্যে। এসে দেখি সাহেবও বারান্দায় বসে আছেন। সাহেবের গেস্টদের সব চান-টান হয়ে গেছে। লিচু একটা হলুদ লুঙ্গি পরেছেন। খাসা দেখাচ্ছে। চলমান এককাঁদি হলুদ সবরিকার মতো।

ব্রেকফাস্ট হয়েছে টিঙ্কু? সাহেব শুধোলেন।

-না স্যার।

আমি বললাম।

–শিগগিরি খেয়ে নাও। চলো, হানিফ সাহেবের বাড়ি যাব।

মেমসাহেবরা সমস্বরে বলে উঠলেন, আমরাও যাব।

 চলো। সাহেব বললেন, প্রশ্রয়ের সুরে।

আমি তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। তারপর শেতলপাটির গাড়ি ও আমাদের গাড়ি নিয়ে আমরা হানিফ সাহেবের বাড়ি গেলাম।

বিরাট কম্পাউণ্ড। গোলাপের চাষ করেন ভদ্রলোক। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। কিন্তু খুব শক্ত-সমর্থ ডাঁশা পেয়ারার মতো চেহারা।

গোলাপের চাষ সাহেবেরও কিছু আছে। নবীন রায় বলছিলেন।

আমরা যেতেই সাহেব সকলের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিলেন হানিফ সাহেবের। বিরাট সিটিং রুমের একপাশে ফায়ার প্লেস, অন্যপাশে সেলার–আর একপাশে একটা দারুণ রাইটিং টেবিল। টেবিলটা দেখে বড়ো লোভ হল। আহা! আমার যদি এমন একটা টেবিল থাকত, তবে আমিও হয়তো লেখক হতে পারতাম একদিন ওই টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে কসরত করতে করতে।

হানিফ সাহেব মেয়েদের কোকাকোলা, ছেলেদের রাম অফার করলেন।

 শেতলপাটি ও আমি মেয়েদের মতো কোকাকোলা খেলাম।

সাহেবরা রাম।

হানিফ সাহেবের গোলাপ-বাগানে বাডিং করতে আসত একটি মেয়ে দূরের গ্রাম থেকে। হানিফ সাহেব তাকেই বাডিং করে দিলেন। শেষে বিয়ে করতে হল রীতিমতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠান করে–আমার সাহেবের মধ্যস্থতায়। চারশো টাকা খরচ করে, শ্বশুরকে গোরু-বলদ, ধুতি এবং গাঁয়ের লোককে প্রচুর মহুয়া খাইয়ে। হানিফ সাহেবের বউও ভজনদার স্ত্রীর মতোই ডি অ-স–ভার্সেটাইল বউ। সকালে বাগানে গোলাপের বাডিং করেন, দুপুরে রান্না-বান্না; বিকেলে বাগানে জল দেওয়া। রাতে তাঁকেই আবার হানিফ সাহেব বাডিং করেন। সিস্টেমটা সম্মানজনক, লিস্ট এক্সপেনসিভ ও অত্যন্ত কনভিনিয়েন্ট।

দেখেশুনে কাতলামাছ খেপে গেলেন যে, তিনিও এখানে একটা বাড়ি করে লাল গোলাপ ফুলের বাডিং ও অন্য ফুলের বাডিং একসঙ্গে চালু করে দেবেন।

কাতলামাছের মুখটার কোনো রাখ-ঢাক নেই।

সাহেব আনকম্ফর্টেবল ফিল করতে লাগলেন, যদিও কথাবার্তা সব ইংরিজিতেই হচ্ছিল কিন্তু পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস হানিফ কাতলামাছের চোখ-মুখের উত্তেজনা দেখে কিছুটা অনুমান করতে নিশ্চয়ই পারছিলেন।

বিরিয়ানি পোলাও রান্না হবে আগামীকাল রাতে–সঙ্গে গুলহার কাবাব। কতজনের মতে হবে, কখন হবে, সব জেনে নিয়ে সাহেবের নির্দেশানুসারে হানিফ সাহেব আমাকে বুঝিয়ে দিলেন প্রস্তুতি পর্বে কী কী লাগবে। নধর এবং মাঝবয়সি খাসির কোন কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে কতখানি করে মাংস কিনতে হবে কাটিয়ে নেয়ে, কতখানি জাফরান, গরম মশলা, বড়ো নৈনিতাল আলু ইত্যাদি ইত্যাদি। গুলহার কাবাবের মাংস সেদ্ধ করার জন্যে পেঁপে, ভাঙা কাপ-ডিশ (ভাঙা কাপ-ডিশে নাকি তাড়াতাড়ি মাংস-সেদ্ধ হয়) ইত্যাদিরও রিকুইজিশন দিলেন। লিস্টের শেষে লিখলেন–এক বোতল রাম।

এই ব্যাপারটা আমার জানা ছিল। মামাদের জমিদারিতে যখন যজ্ঞির ঠাকুর আসত হয়তো পাঁচ-শো লোকের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে কোনো পালা-পার্বণে–তখন বাজারের লিস্টের শেষ আইটেমে থাকত; শরীর মেরামতি খাতে–দুই টাকা। অর্থাৎ যজ্ঞির ঠাকুরদের আফিং-এর খরচা।

সেইরকম এই হানিফ সাহেবও বডি রিপেয়ারিং-এর জন্য ওষুধের বন্দোবস্ত করে রাখলেন। ভাবলাম, ষাট বছর বয়সেও এত বাডিং করলে শরীরের দোষ কী?

হানিফ সাহেবের কাছ থেকে আমরা যখন বাড়ি ফিরে এলাম, তখন বউরানিকে দেখা গেল না কোথাওই।

সাহেব শুধোতে, মেহবুব বলল, মেমসাহেব স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়েছেন আর আপনাকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছেন।

ছাগল-দাড়ি মুখ কালো করে দাড়ি চুলকে বললেন, বেলা এগারোটায় স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়ার মানে? কী গো অংশুমান? শেষে কি তোমার বউ আত্মহত্যা-টত্যা করে আমাদের খুনের মামলায় জড়াবে?

সাহেব বললেন, ও কিছু না, ভ্রমরের যে, রাগ হয়েছে এটা তার সিমটম। এ নিয়ে তোমরা মাথা ঘামিয়ো না।

সাহেব বাইরের বারান্দাতেই মেমসাহেবের চিঠিটা অ্যাশট্রে চাপা দিয়ে রেখে দিয়েছিলেন, এক নজর চোখ বুলিয়ে।

টি-হাউসে ওঁরা সকলে মিলে বসলেন গিয়ে।

সাহেব বন্ধুদের বললেন, তোমরা গল্প-সল্প করো, ততক্ষণে আমি একটু কাজ সেরে আসি। নিনি বললেন, আমি যাই ভ্রমর বউদিকে একটু দেখে আসি।

সাহেব বললেন, ওর দু-চারটে স্লিপিং পিলে আজকাল কিছু হয় না। ঠিক লাঞ্চ-টাইমে ঘুম ভেঙে যাবে। এখন ওকে বিরক্ত না করাই সেফ সকলের পক্ষে।

বলেই, সাহেব চলে গেলেন।

সাহেব চলে যেতেই ওই চিঠিতে মেমসাহেব কী এমন রাগের কথা লিখলেন জানতে বড়ো ইচ্ছে হল। সাহেব আমাকে সকালেই বলেছিলেন যে, বউরানি হানিফকে পছন্দ করেন না।

আমি মেহবুবকে টি-হাউসের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং ওঁদের খিদমদগারি করতে বলে বারান্দায় এসে চিঠিটা উঠিয়ে নিলাম।

চিঠিটা এত সংক্ষিপ্ত সাংকেতিক ভাষায় লেখা যে, তার মর্মোদ্ধার করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল।

চিঠিটায় কোনো সম্বোধন অথবা লেখিকার নাম ছিল না। ওপরে তারিখ ছিল শুধু, আর লেখা

মি. হানিফকে যখন ডেকেছে, তখন তুমিই সমস্ত রাত ধরে রান্না শিখবে। মির্জা গালিবের প্রেমপত্রর ব্যবস্থা করো। আমার শরীর তখন খারাপ হবে। একশোবার কথা দিয়ে কথা রাখো না।

ঝাঁকি দর্শনে কথা হল না বলে, এতখানি কালি খরচ হল।

কিছুই না-বুঝতে পেরে চিঠিটা যেমন অ্যাশট্রে চাপা দেওয়া ছিল তেমন-ই চাপা দিয়ে রেখে আমি কোয়ার্টারের দিকে এগোলাম।

আধাআধি গেছি, এমন সময় চিড়িয়াখানার দিক থেকে একটা প্রচন্ড ও উত্তেজিত চিৎকার ভেসে এল। হয়েছে; হয়েছে; হয়েছে রে, হয়েছে।

কী হয়েছে, বুঝলাম না, কিন্তু প্রচন্ড উত্তেজনাকর কিছু যে, একটা হয়েছে তা বুঝলাম।

 চিড়িয়াখানার দিকে দৌড়ে গেলাম।

প্রায় আমার পাশে পাশেই গ্রিনহাউসের দরজা খুলে হঠাৎ বেরিয়ে নবীন রায়ও দৌড়ে চললেন ওদিকে।

গিয়ে দেখি, মুখে হঠাৎ গরম আলু পড়লে লোকে যেমন এক ঠ্যাং-এ নাচে, তেমনি করে ভজনদা একঠ্যাং-এ লাফিয়ে নাচছেন আর চিৎকার করছেন, হয়েছে রে হয়েছে; অবশেষে হয়েছে।

নাচতে নাচতে হঠাৎ-ই নবীনকে দেখতে পেয়েই ভজনদা আরও চেঁচিয়ে উঠে বললেন, নবনে রে নবনে হয়েছে রে হয়েছে।

যাই হয়ে থাকুক, খারাপ কিছু যে, হয়নি তা বুঝলাম।

 কিন্তু কী হয়েছে সেটা এখন জানা দরকার।

হঠাৎ নবীনবাবু আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, টিকলুবাবু দৌড়ে যান অফিসঘরে, সাহেবকে গিয়ে খবর দিন যে, হয়েছে।

কী হয়েছে? আমি তাড়াতাড়ি শুধোলাম।

কিন্তু আমার কথার উত্তর কে দেবে?

দেখি, ভজনদা আর নবীন রায়ে জড়াজড়ি করে ঘুরে ঘুরে নাচছেন আরও জোরে চিৎকার করছেন, ওরে নবনে হয়েছে, এতদিনে হয়েছে। আর নবনেও সমান উল্লসিত হয়ে বলছেন, ধন্যি তুই ভজনদা, হয়েছে রে হয়েছে।

স্কুলের স্পোর্টস-এর পর এতজোরে আমি আর দৌড়োইনি।

দৌড়ে অফিসঘরের দিকে যেতে যেতে দেখি সাহেবের গেস্টরাও সকলে পড়ি-কী-মরি করে চিড়িয়াখানার দিকে সেই চিৎকার শুনে দৌড়ে আসছেন।

লিচুর লুঙ্গি খুলে যার আর কী।

এমন বিপজ্জনকভাবে তিনি দৌড়োচ্ছেন। ছুটন্ত আমি যখন বিপরীত দিকে ছুটন্ত গেস্টদের ডেলিগেশনকে মাঝপথে মিট করলাম, তখন কাতলামাছ হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়োতে দৌড়োতে শুধোলেন, কী হয়েছে?

আমি হাত তুলে বললাম, হয়েছে।

ওঁরা ঘাবড়ে গিয়ে জোরে দৌড়োলেন।

ওঁদের ঘাবড়ে যেতে দেখে আমিও ঘাবড়ে গিয়ে আরও জোরে দৌড়োলাম।

সাহেব টেবিলে বসে একটা ফাইলের কাগজ দেখছিলেন।

আমাকে ওইভাবে দৌড়ে ঘরে ঢুকতে দেখেই সাহেব উদবেগে ভুরু কুঁচকে বললেন, কী হল গজেন?

আমি বললাম, স্যার হয়েছে।

বলেই, চিড়িয়াখানার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালাম।

সাহেব একলাফে উঠে দাঁড়ালেন। সেই হঠাৎ উঠে দাঁড়ানোতে হালকা অ্যালুমিনিয়ামের চোয়ারটা ফটাস করে উলটে গেল।

সাহেব তক্ষুনি দু-হাত ওপরে তুলে তেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন অফিস থেকে দৌড়োতে দৌড়োতে চেঁচিয়ে বললেন, আসছি, ভজন আসছি।

মনে হল, কাউকে জলে ডুবে যেতে দেখলে বা কারও বাড়ি ডাকাত পড়লে বন্ধুরা যেমনভাবে দৌড়ে যান, তেমনভাবেই যেন উনি দৌড়ে গেলেন।

আমিও পেছন পেছন। ভাবনা বেড়ে গেল।

কিন্তু আমার সাধ্য কী, সাড়ে ছ-ফিট সাহেবের ক্যাঙারুর মতো পায়ের সঙ্গে পাল্লা দিই আমি?

আমি আধ-রাস্তা যেতে-না-যেতেই দেখলাম সাহেব পৌঁছে গেছেন ভজনদার কাছে।

আমি যখন পৌঁছোলাম, তখন দেখি সাহেব ভজনদার হাতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ভজনদার দু-চোখে জল।

সমবেত জনমন্ডলী নির্বাক, নিস্তব্ধ। ছাগল-দাড়ির দাড়ি উড়ছে না, কাতলামাছের মুখ আরও ফাঁক হয়েছে; শেতলপাটি স্ট্যাচু হয়ে গেছেন।

আমি ফিসফিস করে ওঁদের বললাম, কী হয়েছে স্যার?

তিনি আমাকে আরও ফিসফিস করে বললেন, ময়ূরীর ডিম হয়েছে। চুমকির।

এরপর আর এক নতুন বিপত্তি হল।

দেখি, খাঁচার দরজা খুলে সাহেব চুমকির ঘরে ঢুকে পড়লেন।

চুমকি তার সদ্যোজাত ঐতিহাসিক ডিম্ব প্রসব করতে যা-না উত্তেজনা বোধ করেছিল, প্রসবের পর প্রসবিনীর মতো ঘটনা-পরম্পরায় সে হতচকিত হয়ে খাঁচার এককোনায় গিয়ে চুপ করে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। যেন মহা অন্যায় কিছু করে ফেলেছে। তার সামনে আড়াইশো গ্রাম ওজনের ডিমটা খাঁচার মধ্যে খড়ের ওপর লজ্জায় নীল হয়ে নট নড়নচড়ন নট-কিচ্ছু হয়ে পড়েছিল।

খাঁচাটা উচ্চতায় বড়োজোর পাঁচ ফিট। সাড়ে ছ-ফিট সাহেব তারমধ্যে কুঁজো হয়ে ঢুকলেন। ঢুকেই বললেন, মা গো। বোস মা লক্ষ্মীটি।

শেতলপাটি হাতের সিগারেটটা উত্তেজনায় ছুঁড়ে ফেলে বললেন, ব্যাপারটা কী? এখন কী হবে?

ভজনদা এই অর্বাচীন প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনারা এবার যান স্যার–এখানে ভিড় করলে বোধ হয় চুমকি তা দিতে বসবে না।

তারপর একটু থেমে বললেন, আপনারা বোধ হয় জানেন না যে, ক্যাপ্টিভিটিতে ময়ূরের বাচ্চা করানো অত্যন্ত কঠিন। আমরা, আপনারা কো-অপারেট করলে, সেই অসাধ্যসাধন করতে পারি।

সাহেবও খাঁচায় মধ্যে থেকে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, যাও হে, তোমরা গিয়ে বিয়ার খেয়ে চুমকির ডিম-হওয়া সেলিব্রেট করো।

আমরা ওখান থেকে চলে আসার সময় দেখলাম, চুমকি সুন্দরী গর্বিতা মেয়ের মতো এক পা এক-পা করে খাঁচাটার চারপাশে ঘুরে ডিমটাকে প্রদক্ষিণ করছে আর সাহেব পেছনে পেছনে–অদ্ভুত ভঙ্গিমায় না দাঁড়িয়ে, বসে তার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে বলছেন, বোসো মা, মা আমার লক্ষ্মী সোনা তা-য়ে বোসো মা।

সাহেবের বন্ধুরা আগেই চলে এলেন।

 নবীনবাবুর সঙ্গে আমি ফিরছিলাম।

গ্রিনহাউসের পাশে আসতেই নবীনবাবু বললেন, চলুন, আমার গ্রিনহাউসটা আপনাকে দেখাই। এসে অবধি তো আপনার সময় হল না।

গ্রিনহাউসের ভেতর ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেল।

কতরকম যে, গাছ আর ফুল আর অর্কিড। মধ্যে একটা জাপানিজ কায়দায় খোঁড়া পুকুরের মতো ছোট্ট পাথর-খোঁড়া জল। তারমধ্যে ফোয়ারা। চারপাশে হেঁটে বেড়াবার জায়গা। আর পথের পাশে পাশে গ্যালারির ওপরে টবে সাজিয়ে রাখা পাতা, অর্কিড, ফুল। গ্রিনহাউসের ছাদ থেকেও অনেক অর্কিড ঝুলছে। সেই অর্কিডের মাটির টবগুলো সুন্দর রং-করা পাট দিয়ে তৈরি শিকে থেকে ঝুলছে। শিকেগুলোতে ফুল তোলা। ফুলগুলো আবার রং করা।

এমন একটিও তুচ্ছ জিনিস নেই, যাতে চিন্তা, কল্পনা ও সুরুচির ছাপ নেই। কত মাথা খাটিয়ে, কতদিনের পরিশ্রমে ও কত যত্নে যে, এই গ্রিনহাউসের প্রতিটি টুকরোকে গড়ে তোলা হয়েছে তা ভেবেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি।

আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে নবীনবাবুকে শুধোলাম, ওই যে নানারঙা সুন্দর লতাগুলো, ওগুলোরকী নাম?

–কোনগুলো?

–ওইগুলো।

বলে আঙুল দিয়ে দেখালাম আমি।

নবীনবাবু বললেন, ওগুলো ফিলোডেন-ড্রন। নানারকম হয় ওগুলো। বাই-কালার হয়, মনো-কালারও হয়। সবুজ। ডেকরেটিভ পাতাগুলো দেখছেন না লতার সঙ্গে। এইগুলোই বিশেষত্ব।

আমি শুধালাম, ওই যে পানপাতার মতো বড়ো বড়ো পাতাঅলা লতা, ওগুলো কী?

 নবীনবাবুর চোখে-মুখে গর্ব ঝরে পড়ছিল। এত কষ্ট করে, যত্ন করে এগুলো পরিচর‍্যা করেন, কেউ দেখে তারিফ করলে তবে না আনন্দ।

উনি বললেন, ওগুলোকে বলে অ্যান্থোরিয়াম। ওরোকুইনামও আছে। সাদা সাদা শিরা বের করা ডেকরেটিভ।

আমি অবাক গলায় বললাম, এত বিভিন্নরকম কচুগাছ রেখেছেন কেন?

 নবীনবাবু হাসলেন। বললেন, কচু তো মাটির তলায় হয়। কিন্তু তাদের পাতার বাহারের কি শেষ আছে? আমার এখানেই তো কতরকমের কচু আছে। যেমন দেখুন ওইটা।

আমি বললাম, কোনটা।

ওই যে ওইটা, বলে বাঁ-দিকের কোনায় দেখালেন।

বললেন, ওগুলোকে বলে এলোকেশিয়া।

বললাম, বাঃ বেশ বাংলা এলোকেশী-এলোকেশী গন্ধ আছে তো নামটাতে।

নবীনবাবু বললেন, এলোকেশিয়ার মধ্যে আবার নানারকম ভ্যারাইটি আছে। যেমন সানড্রিয়ানা-কালো, ওই দেখুন, তারপর মেটালিকা–একেবারে ব্রোঞ্জের রং। সানড্রিয়ানার কালোর মধ্যে সাদা শিরা আছে।

হঠাৎ চোখ পড়ল ডানদিকে–ছোটো ছোটো পানপাতার মতো লতা।

আমি শুধোলাম, ওগুলো কী? পানগাছ কি?

নবীনবাবু হেসে বললেন, না ওগুলো এগ্লোনিয়া–ডোয়ার্ফ–পানপাতার-ই মতো; কিন্তু ডেকরেটিভ।

সব দেখেশুনে রীতিমতো উত্তেজিত বোধ করছিলাম।

নবীনবাবু বললেন, ওই যে, ভেলভেটি বড়ো পাতাগুলোতে সাদা ফুল–নানারঙা পাতায় ছাওয়া–ওইগুলোর নাম বিগোনিয়া রেক্স।

আমি বললাম, কলাপাতার মতো পাতাগুলো কোন গাছের?

নবীনবাবু হাসলেন। বললেন ওগুলোকে বলে ডিফিয়োনবিচিয়া। কলাপাতার মতোই ছোটো ছোটো হয়–অনেকরকম পাতা হয় এদের। এদের মধ্যে একটা বিশেষ ভ্যারাইটির ডাঁটি হয়–তাদের রং সাদা। সাদা মানে, একেবারে মাৰ্বল হোয়াইট।

হঠাৎ জলের পাশে একটা এগ্লোনিমা প্ল্যান্টের গায়ে চোখ পড়ল। দেখি একটা ছোটো ব্যাং হাত-পা ছড়িয়ে তার ওপর বসে আছে। গ্রিনহাউসের ওপরের ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের আলো এসে জলে পড়েছে। পড়ে, সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে নানারঙা পাতা ও প্ল্যান্টের ওপর, অর্কিডের ওপর বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সেই আলোর প্রতিফলনে, বিভিন্ন রঙে, জলের ঝিকিমিকিতে পুরো জায়গাটাকে একটা স্বর্গরাজ্য বলে মনে হচ্ছে।

এমন সময়ে হঠাৎ পেছনে গ্রিনহাউসের দরজা খোলার আওয়াজ শোনা গেল। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে একসঙ্গে অনেক পুরুষ ও নারীকণ্ঠে হাউ লাভলি, হাউ সুইট ইত্যাদি আওয়াজ।

তাকিয়ে দেখলাম, সাহেবের অতিথিরা।

প্রত্যেকের হাতেই একাধিক ক্যামেরা। স্টিল ক্যামেরা। টেলিফোটো ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স লাগানো স্টিল ক্যামেরা; মুভি ক্যামেরা–এইট মিলিমিটারের।

হঠাৎ ফোটোগ্রাফার বামাপদ ব্যাংটাকে আবিষ্কার করল। তারপর বেচারা ব্যাংটার যে, কী হেনস্থা হল সে চোখে দেখা যায় না। কে যেন দৌড়ে গিয়ে চেয়ে-চিন্তে কোথা থেকে একটা আয়না জোগাড় করে আনল। রোদের যেটুকু ফালি গ্রিনহাউসের মধ্যে এসে পড়েছিল, সেই ফালিতে আয়না ধরে আলোর প্রতিফলন ফেলা হল ব্যাংটার গায়ে। তিনি মাটিতে থেবড়ে বসে সেই আয়নাটা ধরে ফোকাস করে থাকলেন। আর চতুর্দিকে ক্যামেরাম্যানরা কখনো শুয়ে, কখনো থেবড়ে বসে, কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো হাঁটু গেড়ে বসে কির-কির, খুট-খটাস, ক্লিক-ক্লিক করে ছবি তুলতে লাগলেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো কটকটি ব্যাং এতবড়ো ইম্পর্টেন্স পেয়েছে বলে মনে হল না আমার।

ভালো করে ফোটো তুলতে গিয়ে কাতলামাছ একটা ডিফিয়োন-বিচিয়ার ওপরে হেলান দিয়ে ফেলেছিলেন একটু হলে।

সঙ্গে সঙ্গে নবীনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, আমার গাছ; আমার গাছ।

ওঁর আর্তনাদ শুনে মনে হল কেউ জুতোসুষ্ঠু ওঁর নাক-ই মাড়িয়ে দিয়েছে বুঝি।

ভাবছিলাম, ভালোবাসা, ডেডিকেশন এসব-ই একটা অনুপ্রেরণার ব্যাপার। এই চিড়িয়াখানার প্রতিটি লোক সাহেবের সংস্পর্শে এসে এমন-ই অনুপ্রাণিত হয়েছেন যে, সে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। শুধু টাকার জন্যে কোনো কর্মচারী কখনো এমন করতে পারেন না। ময়ূরের বাচ্চা হলে পাথুরে ভজনদার চোখফেটে আনন্দাশ্রু গড়ায়, নবীনবাবু সাপ মেরে সে সাপ দু-মাইল বয়ে আনেন, চুমকি সাপ খেতে ভালোবাসে বলে, গ্রিনহাউসের গাছ-পাতায় কেউ হাত ছোঁয়ালে মনে হয় কেউ নবীনবাবুর বিষফোঁড়ায় হাত ছোঁওয়াল।

সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম যে, ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, সৎসঙ্গ, এই ব্যাপারগুলো নিশ্চয়ই খুব ছোঁয়াচে-নইলে সাহেবের কাছ থেকে একজন লোকের মধ্যে এ ব্যাপারগুলো এমনভাবে সংক্রমিত হত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *