পাঁচ তারিখের মধ্যেই আমার কাজকর্ম শেষ হলেও মহিলা সমিতির মঞ্চে নতুন এক নাট্যগোষ্ঠীর নাটক দেখার জন্য ছ তারিখ ঢাকায় রইলাম। সাত তারিখের সেকেণ্ড ফ্লাইটে যশোর হয়ে যখন বেনাপোল সীমান্তে পৌঁছলাম, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে।
হাতের সুটকেসটা নিয়ে চেকপোস্টের ওসি মহীউদ্দীন সাহেবের ঘরে ঢুকে দেখি, উনি নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পা দিতেই একজন কনস্টেবল আমাকে সেলাম দিয়ে বললেন, ঘোষ সাহেব এসেছেন বলে ওসি সাহেব কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের ওখানে গিয়েছেন।
মনে হলো, কনস্টেবলটি যাবার দিন নিশ্চয়ই আমাকে দেখেছিলেন। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কে ঘোষ সাহেব?
আমার প্রশ্ন শুনে উনি যেন অবাকই হলেন। বললেন, আপনি ঘোষ সাহেবকে চেনেন না? ওকে তো কলকাতার সবাই চেনেন।…
-আমি তো কলকাতায় থাকি না।
–ও! আমার অজ্ঞানতার কারণে উনি বোধহয় সন্তুষ্ট হলেন। বললেন, ঘোষ সাহেব কোটি কোটি টাকার মালিক। আমাদের দেশেরই মানুষ। প্রায়ই যাতায়াত করেন।
ও!
মহীউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য কাস্টমস বিল্ডি-এর দিকে যেতে যেতে ভাবি, পয়সা থাকলেই কী সর্বত্র খাতির পাওয়া যায়? নাকি অর্থ দেখলেই মানুষ গোলাম হতে চায়?
মনে মনে একটু বিরক্ত হয়েই কাস্টমস বিল্ডিং-এ ঢুকি। বারান্দা পার হয়ে মালপত্র তল্লাসীর হলঘরে পা দিয়েই দেখি, কাউন্টারের একদিকে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে ঘিরে এপার-ওপার দুদিকের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের অনেকেই হাসি-ঠাট্টায় মত্ত। আমি বুঝলাম, ঐ মধ্যবয়সী ভদ্রলোকই কোটিপতি মিঃ ঘোষ।
আমি আর এগুলাম না। বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম। ঘোষ সাহেবকে নিয়ে কখন আড্ডা শুরু হয়েছে আর কখন শেষ হবে, তা ভেবে না পেয়ে সিগারেট শেষ হবার পর নীচে নেমে এসে একটা ডাব খেলাম। তারপর একটু পায়চারি করতে করতেই দেখি, ঘোষ সাহেব সদলবলে বেরিয়ে এলেন। আমি তাড়াতাড়ি একটু দূরে সরে গেলাম।
দূর থেকে দেখলাম, পুলিস কাস্টমস-এর লোকজন ঘোষ সাহেবের মালপত্র গাড়িতে তুলল। তারপর উনি কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট রহমান সাহেব ও মহীউদ্দীন সাহেব থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি কনস্টেবলকে পর্যন্ত বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলেন। মনে মনে ভাবি, লোকটি নিশ্চয়ই স্মাগলার! তা নয়ত এদের সবার সঙ্গে এত খাতির ভালবাসা কেন?
মিঃ ঘোষের গাড়ি ছাড়ার পর আমি কয়েক পা এগুতেই মহীউদ্দীন সাহেব আমাকে দেখে প্রায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলেন, আপনি কখন এলেন?
-এখনও আধঘণ্টা হয় নি।
-সে কী? উনি অবাক হয়ে বললেন, আমাকে ডাকেন নি কেন? ছি, ছি, এতক্ষণ আপনি..
না, না, আমার কিছু কষ্ট হয় নি। দেখলাম, আপনারা গল্প করছেন, তাই আর বিরক্ত করলাম না।
উনি মাথা নেড়ে বললেন, আপনি ডাকলে বিরক্ত হতাম, কী যে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে উনি আক্ষেপ করে বললেন, তাছাড়া অমলের সঙ্গে আলাপ হলে আপনিও খুশি হতেন।
–কে অমল।
–অমল ঘোষ। এই তো যার সঙ্গে আমরা সবাই গান করছিলাম।
মনে মনে বলি, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ অমল ঘোষ আছে কিন্তু তাদের সঙ্গে পরিচিত হতে আমি একটুও আগ্রহী নই। তাছাড়া কোটিপতিকে আমার কী প্রয়োজন? আমি তো তাদের খাতির বা গোলামি করতে পারব না। যাই হোক, আমি শুধু বললাম, ব্যস্ত কী? হয়ত ভবিষ্যতে কোনদিন আলাপ হবে।
মহীউদ্দীন সাহেব আমাকে নিয়ে ওর অফিস ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, তা হয়ত হবে কিন্তু অমলের মত হীরের টুকরো ছেলের সঙ্গে যত আলাপ হয়, ততই ভাল।
আমি ওর কথা শুনে একটু অবাক হলেও কোন কথা বলি না।
মহীউদ্দীন সাহেব আমাকে সাদরে নিজের ঘরে বসিয়েই একজন কনস্টেবলকে দৌড়ে ডাব আনতে হুকুম দিয়েই আমাকে বললেন, আপনার বন্ধু আসার আগেই বলে রাখি আজ রাত্তিরে আপনি আমার ওখানেই দুটো মাছের ঝোল ভাত খাবেন।
আমি হেসে বলি, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আমি তো দু একদিন আছি। পরে…
-না, না, পরে-টরে না। আজ রাত্তিরে আমার সঙ্গে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে তবে ইণ্ডিয়ায় ঢুকবেন।
আমি ডাব খেয়ে সিগারেট ধরাতে না ধরাতেই নিত্য ও আরো কয়েকজন হাজির হলো। মহীউদ্দীন সাহেব হাসতে হাসতে নিত্যকে বললেন, বাচ্চুবাবু আজ ইণ্ডিয়ায় যাবেন কিনা সন্দেহ।
বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব হাসাহাসির পর আমি নিত্যর সঙ্গে এবারে কাস্টমস কলোনীর গেস্ট হাউসে গেলাম। নিত্য ও কাস্টমস এর কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আমি আবার সীমান্ত অতিক্রম করে ওপারে যাই।
শুধু খেয়ে না, মহীউদ্দীন সাহেবের কাছে সেদিন রাত্রে অমল ঘোষের কাহিনী শুনে মুগ্ধ হয়ে যাই।
প্রায় বিশ বছর আগেকার কথা। তখন পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের তিনি প্রায় ক্রীতদাসই মনে করেন। মাঝে মাঝে কিছু মানুষ গর্জে উঠলেও কোটি কোটি বাঙালী ভয়ে, আতঙ্কে দিন কাটান। অন্যদিকে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার চলছে পুরোদমে। সীমান্তে কড়া নজর। বেনাপোল সীমান্তের ওপর আবার বিশেষ কড়া নজর। হাজার হোক কলকাতার খুব কাছে তো! চেকপোস্টের ও-সি বাঙালী হলেও কাস্টমস-এর সুপারিনটেনডেন্ট ছাড়াও পাঁচ-ছজন ইন্সপেক্টর পাঞ্জাব বা ফ্রন্টিয়ারের লোক। তাছাড়া যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দীন খান কখন যে নেকড়ে বাঘের মত সীমান্তের বাঙালী অফিসার ও সাধারণ কর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা কেউ জানে না। মানুষ যে এত হিংস্র ও অসভ্য হয়, তা ঐ ছোকরা ক্যাপ্টেনকে দেখার আগে বেনাপোল সীমান্তের বাঙালী অফিসার ও কর্মীরা জানতেন না।
সন্ধ্যে ঘুরে গেলেও চেকপোস্টের ওসি ইসলাম সাহেব নিজের ঘরে বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ একটি কনস্টেবল সেলাম করে ওর সামনে দাঁড়াতেই উনি মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কী, কিছু বলবে?
–স্যার, একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে একটা গাছতলায় বসে সারাদিন কাঁদছে।
একটু বিরক্ত হয়েই ইসলাম বললেন, কাঁদছে তা আমি কি করব?
কনস্টেবলটি অপরাধীর মত গলার স্বর বেশ নীচু করেই বলল, ছেলেটা বোধহয় খুব দুঃখী স্যার!
ইসলাম সাহেব হাতের কলমটা নামিয়ে রেখে কী যেন ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ওর সঙ্গে আর কে আছে?
–আর কেউ নেই স্যার।
–বাড়ি কোথায়?
–স্যার, ছেলেটা শুধু কাঁদছে। কোন কথা বলছে না। তবে চেহারা দেখে মনে হয়, অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছে।
ইসলাম সাহেব আবার কি যেন ভাবেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, ছেলেটি হিন্দু না মুসলমান?
–তাও বুঝতে পারছি না স্যার।
ওসি সাহেব একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন, যাও, ছেলেটাকে নিয়ে এসো।
কনস্টেবল ছেলেটিকে নিয়ে ওসি সাহেবের ঘরে ঢুকতেই উনি একবার ওর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। তারপর ওকে একটু কাছে ডেকে বললেন, কী নাম তোমার?
শ্ৰীঅমল ঘোষ।
–বাড়ি কোথায়?
-ফরিদপুর।
-ফরিদপুরে কোথায়?
মাদারিপুর।
-মাদারিপুর শহরেই?
-হ্যাঁ।
-তা তুমি সারাদিন ধরে কাঁদছ কেন?
অমল বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না। চাপা কান্নায় গলা দিয়ে স্বর বেরুতে পারে না।
ওসি সাহেব আদর করে ওর পিঠে হাত দিতেই অমল উঃ, বলে প্রায় ছিটকে সরে দাঁড়ায়। ইসলাম সাহেব অভিজ্ঞ পুলিস অফিসার। উনি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, তোমার পিঠে কী ব্যথা?
অমল কাঁদতে কাঁদতেই মুখ নীচু করে শুধু মাথা নেড়ে জানায়, হ্যাঁ।
এতক্ষণ পর ওসি সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে যান। কোন কথা না বলে অমলের গায়ের জামা তুলে দেখেই চমকে ওঠেন। জিজ্ঞেস করেন, কে তোমাকে এভাবে মেরেছেন?
অমল আগের মতই মুখ নীচু করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার বাবা আর তার বউ।
ওর কথা শুনে ওসি সাহেব না হেসে পারেন না। বলেন, তোমায় বাবার বউ তোমার কে হন?
আমার কেউ না।
ওসি সাহেব হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করেন, উনি তোমার মা না?
-না, আমার মা অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছেন।
ইসলাম সাহেবের কাছে অমলের দুঃখের দিনের ছবিটা আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায়। উনি ওকে আর কোন প্রশ্ন না করে কনস্টেবলকে বলেন, তুমি একে আমার কোয়ার্টারে দিয়ে বলে দিও, ও থাকবে।
.
বিমাতা ও স্ত্রৈণ পিতার অকথ্য অত্যাচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য অমল একদিন গভীর রাত্তিরে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ও সীমাহীন অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আমাকে বাঁচতে হবে, মানুষের মত বাঁচতে হবে।
কত নদী-নালা অরণ্য-জনপদ পার হয়ে চলতে চলতে অমল স্বপ্ন দেখে, সে কলকাতায় যাবে, লেখাপড়া শিখবে, মানুষ হবে। আর? আর হাজার-হাজার লাখ-লাখ টাকা আয় করে সব গরীব ছেলে মেয়েদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করবে।
ঐ স্বপ্নের ঘোরেই অমল অনাহার, অনিদ্রা ও শরীরের সমস্ত ব্যথা বেদনা ভুলে এগিয়ে চলেছিল। যশোর শহর পার হবার পর একটা চাপা আনন্দে খুশিতে ওর মন ভরে গেল। ভাবল, কলকাতা তো আর বেশী দূর নয়, বড়জোর দুআড়াই দিনের পথ। কিন্তু ঝিকড়গাছা পার হয়ে গদখালি-নাভারণ আসতেই রাস্তার ধারে ই. পি, আরদের দেখে একটু ভয় পায়। ঘাবড়ে যায়। মনে মনে ভয় হয়, ওরা ধরবে না তো? তবু দুটো পা থেমে থাকে না, এগিয়ে চলে।
ওসি সাহেবের কোয়ার্টারে বেশ কয়েক দিন কাটাবার পর অমল একদিন অতি কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে ইসলাম সাহেবকে বলে, স্যার, আপনার দয়ায় আমি বেঁচে গেলাম কিন্তু আমাকে একটা ভিক্ষা দিতে হবে।
-কী চাই তোমার?
–স্যার, আমাকে সীমান্ত পার করে দিতে হবে।
–তোমার পাসপোর্ট-ভিসা আছে?
-না স্যার।
-তবে? তবে কী করে তোমাকে পার করে দেব?
অমল কোন জবাব দেয় না; মুখ নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কয়েক মিনিট নীরব থাকার পর ইসলাম সাহেব বলেন, আমি কী ইচ্ছে করলেই তোমাকে পার করে দিতে পারি? কোন পাঞ্জাবী অফিসার জানতে পারলে হয়ত আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গুলি করেই মারবে।
অমল তবুও কিছু বলে না।
আবার একটু পরে ইসলাম সাহেব বলেন, অনেকে তো রাতের অন্ধকারে এদিক-ওদিক দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে যায়। তুমি গেলে না কেন?
অমল এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, না স্যার, ওভাবে আমি যাব না।
–কেন?
-আপনার নুন খেয়ে ও কাজ করলে বেইমানী করা হবে।
অত অভিজ্ঞ পুলিস অফিসারও ঐ কিশোরের কথা শুনে চমকে ওঠেন।
এতক্ষণ নিঃশব্দে সব কিছু শোনার পর আমি প্রশ্ন করলাম, তারপর?
মহীউদ্দীন সাহেব মুখ গম্ভীর করে বললেন, ঠিক সেদিন প্রায় মাঝ রাত্তিরে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল পাঞ্জাবী অফিসার হঠাৎ এখানে হাজির হয়ে সবাইকে জানালেন, কাশ্মীর বর্ডারে বেশ গণ্ডগোল হচ্ছে। সুতরাং বেনাপোল বর্ডার দিয়ে যেন বেআইনীভাবে একটা মশা-মাছিও পারাপার না করতে পারে।
আমি চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
মহীউদ্দীন সাহেব বলেন, ভোরের দিকে আরো বেশ কিছু ই-পি আর এসে হাজির হলো এবং এই পরিস্থিতিতে কাজকর্মের জন্যও ইসলাম সাহেবের পক্ষে ওদিকের ও-সির সঙ্গে দেখাশুনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল।
ওর কথা শুনে সে সময়কার পরিস্থিতি বেশ অনুভব করতে পারি। দিন সাতেক এইভাবেই কেটে গেল।
একে শীতকাল। তারপর তখন প্রায় মাঝ রাত্তির। হঠাৎ একদল নাক সীমান্ত পার হবার জন্য ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে হাজির হতেই ডিউটি অফিসার ভয়ে ওসিকে খবর দিলেন। খবর পেয়েই উনি কোয়ার্টার থেকে ছুটে এলেন।
ওদের সবাইকে একবার ভাল করে দেখে নিয়েই ইসলাম সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনারা এত রাত্তিরে এলেন কেন?
একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বললেন, স্যার, আমাদের দেশের বাড়িতে একটা বিয়ে ছিল। বিয়ের সাত দিনের দিন হঠাৎ আমাদের পরিবারের সব চাইতে বড় ভাই মারা গেলেন। ভেবেছিলাম, তার শ্রাদ্ধ সেরে আমরা ফিরব কিন্তু ঢাকায় গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ভিসার মেয়াদ বাড়াতে পারলাম না বলে আজই ফিরে যাচ্ছি।
ইসলাম সাহেব পাশ ফিরে এ-এস-আইকে জিজ্ঞেস করলেন, এদের ভিসা কবে শেষ হচ্ছে?
–আজ রাত্তিরেই স্যার!
মুহূর্তের জন্য ইসলাম সাহেব কি যেন একটু ভেবে এ-এস-আইকে, বললেন, আমি একটু পরে এসে নিজেই এদের নিয়ে কাস্টমস চেক করাতে যাব।
–জী!
ইসলাম সাহেব এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে প্রথমে কাস্টমস তারপর ওপারের কাস্টমস ও চেকপোস্টে গিয়ে কথাবার্তা বলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে এলেন।
সেদিন সেই মাঝ রাত্তিরের অন্ধকারে ঐ দলকে সীমান্ত পার করে দেবার সময় অমলকেও ওপারে দিয়ে এলেন।
মহীউদ্দীন সাহেব খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন সেদিন যদি কোনক্রমে জানাজানি হয়ে যেত তাহলে ইসলাম সাহেবের ভাগ্যে যে কি পুরস্কার জুটত, তা আল্লাই জানেন। একটু থেমে বললেন, যদি কোনক্রমে জানে বেঁচে যেতেন, তাহলে চাকরি নিশ্চয়ই যেত।
-তা তো বটেই।
মহীউদ্দীন সাহেব আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, ইসলাম সাহেব তাড়াহুড়োয় যাবার সময় অমলকে বিশেষ কিছুই দিতে পারেন নি। শুধু মেয়ের গলা থেকে পাঁচ-ছআনা ওজনের একটা সরু হার খুলে ওর গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ওপারের ওসি সাহেবকে দিলেই উনি এটা বিক্রির ব্যবস্থা করে দেবেন। ঐ টাকায় তোর বেশ কিছুদিন চলে যাবে।
আমি মনে মনে ইসলাম সাহেবকে প্রণাম জানিয়ে মহীউদ্দীন সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু চুপ করে থাকার পর উনি বললেন, নিত্যবাবুকে জিজ্ঞেস করলেও অমলের কথা জানতে পারবেন।
-তাই নাকি?
–হ্যাঁ। ও দুদিকের বর্ডারেই খুব পপুলার। সবাই ওকে ভালবাসেন। মহীউদ্দীন সাহেব একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, ভালবাসার মতই তো ছেলে ও!
আমি কয়েক মিনিট না ভেবে পারি না। তারপর জিজ্ঞেস করি, আজ অমলবাবু কোথায় গেলেন? মাদারিপুর?
না, না, ও ইসলাম সাহেবের বাড়ি গেল। দুতিন মাস অন্তরই ও ইসলাম সাহেবকে দেখতে যায়
–আচ্ছা!
-হ্যাঁ বাচ্চুবাবু, এখন ইসলাম সাহেবই ওর আব্বা!
সে তো একশ বার!
মহীউদ্দীন সাহেব একটু হেসে বললেন, বোম্বেতে অমলের যে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ফার্ম আছে, তার নাম হচ্ছে ইসলাম ইন্টারন্যাশনাল!
-তাই নাকি?
-হ্যা বাচ্চুবাবু, বলেছি না, অমলের মত ছেলে হয় না!
আমাদের এ দিকের কাস্টমস-এর সুপারিটেনডেন্ট মিঃ ঘোষ ও নিত্যর কাছেও অমলের কথা শুনি। ঐ হার বিক্রির টাকা দিয়েই অমল এই বর্ডার চেকপোস্টের পাশে একটা চায়ের দোকান করে। সারাদিন দোকানদারী করে সন্ধ্যের পর পড়াশুনা করে অমল হায়ার সেকেণ্ডারী পাস করার পর একদিন হরিদাসপুর ছেড়ে কলকাতা চলে যায়। তারপর ধাপে ধাপে সে এগিয়েছে।
মিঃ ঘোষ বললেন, তখন আমি এই এখানেই সাব-ইন্সপেক্টর ছিলাম। তাই সবকিছু জানি। অমলের উন্নতির কথা শুনলে অনেকে বিশ্বাস করতেই চান না। কিন্তু আমরা তো অবিশ্বাস করতে পারি না।
–তা তো বটেই!
–এমন ভদ্র বিনয়ী ছেলে অন্তত আমি তো জীবনে দেখি নি।
–ভাল না হলে কী কেউ এত উন্নতি করতে পারে?
–শুধু ভাল হলেই কী জীবনে উন্নতি করা যায় বাচ্চুবাবু? মিঃ ঘোষ একটু থেমে বললেন, ও যে কি পরিশ্রমী আর কি সৎ, তা চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা যায় না। উনি একটু হেসে বললেন, ওর অনেক, অনেক গুণ আছে বাচ্চুবাবু!
নিত্য বলল, তা ছাড়া ভাই ও দুদিকের বর্ডারের সবাইকে যে কি শ্রদ্ধা করে আর ভালবাসে, তা তুমি ভাবতে পারবে না। ওকে এখানকার সবাই নিজের সন্তানের মতই ভালবাসেন।
শুয়ে শুয়েও অমল আর ইসলাম সাহেবের কথাই ভাবছিলাম। ওদের দুজনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, তা নিজেই জানতে পারিনি।
.
০৬.
নিছক আয়তনে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ হচ্ছে আমাদের এই ভারতবর্ষ এবং স্থলে জলে আমাদের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় তেরো হাজার মাইল। পৃথিবীর ঠিক মাঝখান দিয়ে যে বিষুবরেখা চলে গেছে তার দৈর্ঘ্য পঁচিশ হাজার মাইলও নয়। আমাদের সীমান্তের দৈর্ঘ্য এর অর্ধেকেরও বেশী। ভাবতে গেলে মাথা ঘুরে যায়।
এই সীমান্তের ওপারে আছে নেপাল, ভুটান, চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ব্ৰহ্মদেশ। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াতের জন্য সীমান্তে বেশ কয়েকটি স্থান নির্দিষ্ট আছে। তারই একটি হলো হরিদাসপুর। চলতি কথায় লোকে বলে বনগাঁ বর্ডার। ওপারে যশোর জেলার বেনাপোল।
দেশ দুটুকরো হবার আগে বনগাঁ যশোর জেলারই অন্যতম মহকুমা ছিল। এখন সেই বনগাঁ চব্বিশ পরগনায় ঢুকেছে।
পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশের মধ্যে যারা যাতায়াত করেন, তারা অধিকাংশই এই হরিদাসপুর-বেনাপোল দিয়ে যাওয়া পছন্দ করেন। এর সব চাইতে বড় কারণ কলকাতার অবস্থিতি। তাছাড়া এই পথ দিয়ে যাতায়াত করা কম খরচের।
বনগাঁ স্টেশন থেকে তিন-চার টাকায় সাইকেল রিকশা হরিদাসপুর পৌঁছে দেবে। পথে বি-এস-এফএর ক্যাম্প ও কাস্টমস কলোনী পড়বে। তবে তার অনেক আগেই বনগাঁ শহর পিছনে পড়ে রইবে। রিকশা থেকে নামতে না নামতেই কিছু দালাল যাত্রীদের ঘিরে ধরেন, স্যার, টাকা চেঞ্জ করবেন? একটি লম্বা বংশদণ্ড দিয়ে সীমান্ত চেকপোস্টের সীমানা শুরু। এই বংশদণ্ডর পাশেই একজন তালপাতার সেপাই সব সময় মজুত থাকেন। মামুলী চেহারা ও পোশাকের যাত্রী দেখলেই উনি বলেন, পাসপোর্ট দেখি। বাঁ দিকেই ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। ডানদিকে কাঠের খাঁচার মধ্যে সরকার অনুমোদিত মানি চেঞ্জার।
গ্রামের পাঠশালার মত আধপাকা আধকাঁচা ঘরে এই চেকপোস্ট। এক পাশে ওসি সাহেবের টেবিল। তার একটু দূরেই জানলার সামনে একজন এ-এস আই বাংলাদেশগামী যাত্রীদের নাম-ধাম পাসপোর্ট নম্বর ইত্যাদি খাতায় লিখে নিয়ে পাসপোর্টে মোহরের ছাপ দেন–একজিট,হরিদাসপুর ইমিগ্রেশন চবিবশ-পরগনা। ও দেশের মানুষ এ দেশে ঢোকার সময় একটা অতিরিক্ত তথ্য নথিভুক্ত করা হয় এবং তা হচ্ছে ভারতস্থ ঠিকানা। তবে কে যে সঠিক ঠিকানা জানান তা ঈশ্বরই জানেন।
চেকপোস্টের গণ্ডী পার হবার পর কাস্টমস কাউন্টারে সতোর পরীক্ষা দেবার আগে হেলথ সার্টিফিকেট দেখবার ও দেখার নিয়ম থাকলেও ও ঝামেলা কেউই ভোগ করেন না। যাত্রীদের মত হেলথ অফিসারও সমান নির্বিকার।
ওদিকেও একই ব্যাপার, একই নিয়ম।
আপাতদৃষ্টিতে নেহাতই সাদামাটা ব্যাপার কিন্তু আসলে তা নয়। আমেরিকা-কানাডা বা নরওয়ে-সুইডেনের মত সম্পর্ক কটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে হয় বা হতে পারে? দুটি প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক কত মধুর ও দুটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান এই সীমান্ত চেকপোস্ট। সে যাইহোক সীমান্ত চেকপোস্ট দিয়ে শুধু যাত্রীদের আসা যাওয়া ও দুটি দেশের মালপত্রের আমদানি রপ্তানি হওয়াই নিয়ম ও বিধিসম্মত কিন্তু এই সুযোগের অপব্যবহার রোধ করার জন্যই সীমান্তের দুদিকেই দুটি দেশ সতর্ক দৃষ্টি রাখে।
এই তো চেকপোস্টের কেদারবাবুই একটা ঘটনা বললেন।
বছর তিনেক আগেকার কথা। সেদিন মহাষ্টমী পূজা। কাস্টমস ও চেকপোস্টের অনেকেই ছুটি নিয়েছেন। চেকপোস্টে কেদারবাবু আর কাস্টমস কাউন্টারে মিঃ শ্রীবাস্তব দুচারজন সহকর্মী নিয়ে কাজ চালাচ্ছেন। তাছাড়া সেদিন যাত্রীর আসা-যাওয়াও বিশেষ নেই।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে কোন যাত্রীর আসা-যাওয়া নেই দেখে কাস্টমস কাউন্টারে মিঃ শ্রীবাস্তবের সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন কেদারবাবু। হঠাৎ এক ভদ্রলোকের একটু চেঁচামেচি শুনেই ওরা দুজনে বাইরে এসে দেখেন, একজন সুপুরুষ ভদ্রলোক চেকপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে কনস্টেবলকে ইংরেজীতে বলেছেন, এটা চেকপোস্ট নাকি মগের মুলুক? চেকপোস্ট ফেলে তোমার দারোগাবাবু কোথায় স্ফুর্তি করতে গেছেন?
ভদ্রলোকের কথা শুনেই ওরা দুজনে একটু ঘাবড়ে যান। ভাবেন বোধহয় কোন কূটনীতিবিদ বা উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসার। কেদারবাবু অর্ধেক কাপ চা ফেলে রেখেই ছুটে আসেন।
–স্যার, ইওর পাসপোর্ট প্লীজ!
ভদ্রলোক অত্যন্ত বিরক্তভাবে পাসপোর্টখানা এগিয়ে দিয়েই বললেন, চটপট ছাপ দিয়ে দিন। আমার ভীষণ দেরি হয়ে গেছে।
পাসপোর্টের রং দেখেই কেদারবাবু আশ্বস্ত হলেন। না, ডিপ্লোম্যাট বা হাই অফিসিয়াল না, নিছক একজন সাধারণ ভারতীয়। ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে কেদারবাবুর মেজাজ আগেই বিগড়ে গিয়েছিল কিন্তু ভয়ে কিছু বলেন নি। এবার পাসপোর্টখানা হাতে নিয়েই কেদারবাবু নির্বিকারভাবে বললেন, অত তাড়াহুড়ো করার জায়গা এটা নয়।
–পাসপোর্টে একটা ছাপ মারতে কতক্ষণ লাগে?
-চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন। কখন ছাপ মারব, তা নিজেই দেখতে পাবেন।
বাট আই অ্যাম ইন এ হারি। আমার অত্যন্ত জরুরী
–আপনি ব্যস্ত বলে কী আমার কাজ করব না?
কথাবার্তা বলতে বলতেই কেদারবাবু পাসপোর্টের পাতা উল্টে যান। একটু আড়াল করে পাসপোর্ট দেখতে দেখতে ভদ্রলোকের মুখের দিকে কয়েকবার তাকিয়ে দেখেন।
ভদ্রলোক বোধহয় ঈশান কোণে মেঘের ইঙ্গিত দেখতে পান।
একটু নরম সুরে বলেন, কাইন্ডলি একটু তাড়াতাড়ি করবেন। আমার খুব জরুরী কাজ আছে।
কেদারবাবু সে কথার কোন জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম?
পাসপোর্টে তো সবই লেখা আছে।
–আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
–আমার নাম ইন্দুশেখর গোরে।
বাবার নাম?
আন্নাসাহেব গোরে।
-কোথায় জন্মেছেন?
নাগপুর।
কবে জন্মেছেন?
–সাতই নভেম্বর।
কোন্ সালে?
মুহূর্তের জন্য উনি একটু ঘাবড়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে বললেন, পঁয়ত্রিশ সালে।
–ঠিক তো?
মিঃ গোরে তাড়াতাড়ি একটু হেসে বললেন, বাবার ডায়রী দেখে তো ফর্ম ভর্তি করেছিলাম।
–আপনার মুখের আঁচিলটা কোথায় গেল?
–ও! একটু ঢোক গিলে বললেন, ওটা পড়ে গেছে।
–পড়ে গেছে?
হ্যাঁ। মিঃ গোরে যেন কষ্ট করেই হেসে কথাটা বললেন।
–হঠাৎ পড়ে গেল? কেদারবাবু শ্যেন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেয়ে পড়ে গেছে।
এবার কেদারবাবু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি ভিতরে আসুন।
-কেন বলুন তো?
–দরকার আছে।
কেদারবাবুর কথাবার্তা শুনে দুজন কনস্টেবল সতর্ক হয়ে গেছে। ওদেরই একজন ইশারায় ঘরের বাইরের দুচারজনকে সতর্ক করে দিয়েছে।
মিঃ গোরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই হাতের রোলেক্স ক্রনোমিটারটি খুলে হঠাৎ কেদারবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, প্লীজ হেলপ মী!
কেদারবাবু গর্জে উঠলেন, সতীশ, দরজা বন্ধ করো। চোখের নিমেষে দরজা বন্ধ হতেই কেদারবাবু, একটু হেসে বললেন, একশ তিরিশ টাকার এইচ-এম-টি এত ভাল সময় দেয় যে দশ বিশ হাজার টাকা দামের রোলেক্স ক্রনোমিটারের কোন দরকার নেই।
এক নিঃশ্বাসে এই পর্যন্ত বলার পর কেদারবাবু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ঐ লোকটা কি করেছিল জানেন?
-কী?
–সপ্তমীর দিন রাত্রে বোম্বের এক ফাঁইভ স্টার হোটেলে এক বিদেশী কাপলকে মার্ডার করে সর্বস্ব লুঠ করে।
–তারপর?
–ওর যমজ ভাই এক ট্রাভেল এজেন্সীতে কাজ করে। ঐ ভাইয়ের পাসপোর্ট নিয়ে ও ভোরের প্লেনেই কলকাতা রওনা হয়। কলকাতায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের একটা জাল ভিসা যোগাড় করে পালাবার জন্য. ..
–বলেন কী?
কনস্টেবল সতীশ পাশেই ছিলেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানেন স্যার, ও যদি মেজাজ না দেখাত তাহলে বোধ হয় পার হয়ে যেতো।
কেদারবাবু ওকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, তা ঠিক। হাজার হোক যমজ ভাইয়ের পাসপোর্ট নিয়ে যাচ্ছিল। মুখের পাশের ছোট একটা আঁচিল নিয়ে কি সব সময় আমরা মাথা ঘামাই?
আমি মাথা নেড়ে বলি, তা তো বটেই।
সতীশ আবার বলেন, ওর সুটকেসের মধ্যে কী না ছিল! ঢাকা থেকে বিলেত-আমেরিকা যাবার টিকিট থেকে শুধু লাখখানেক টাকার ডলার ও কয়েক লাখ টাকার গহনা ছিল।
কেদারবাবু বললেন, গহনা মানে ডায়মণ্ডের কয়েকটা নেকলেস। আসলে ঐ বিদেশী ভদ্রলোক ডায়মণ্ডের বিজনেস করতেন। উনি ডায়মণ্ড-কাটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যই বোম্বে এসেছিলেন।
আমি বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের ডায়মণ্ড-কাটাররা তো পৃথিবী বিখ্যাত।
এতক্ষণ নিত্য কোন কথা বলেনি। কেদারবাবুর কথা শেষ হবার পর ও একটু মুচকি হাসি হেসে বলল, আরে ভাই, শুধু চোর-ডাকাত না, কত রথী-মহারথী ফলস পাসপোর্ট নিয়ে যাতায়াত করেন।
আমি প্রায় আঁতকে উঠি। বলি, সে কী? আমাদের দেশের বিখ্যাত লোকেরা কী করে…।
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ও বলল, না, না, আমাদের দেশের বিখ্যাত লোকদের কথা বলছি না। দিল্লীর কিছু কিছু এম্বাসীতে এমন কিছু মহাপুরুষ আছেন যাদের ব্রীফকেসে সব সময় ডজনখানেক পাসপোর্ট মজুত থাকে।
আমি একটু হেসে বললাম, এ কারবার তো তাদেরই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়।
–তা তো বটেই।
–কিন্তু ওদের তো ধরার উপায় নেই নিত্য ছত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, আমরা একজনকে ধরেছিলাম।
-কী করে?
–ভদ্রলোক ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট নিয়ে ওদিকে গিয়েছিলেন। মাস খানেক পরে ফিরেও এলেন ঐ পাসপোর্ট নিয়ে কিন্তু ওর অনেক মালপত্তর ছিল। ভুল করে উনি একটা দড়ির ব্যাগ ফেলে বাকি সব মালপত্তর গাড়িতে তুলে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কোল্ড ড্রিঙ্ক খাচ্ছিলেন।
-তারপর?
–দশ পনের মিনিটের মধ্যে আরো অনেকে এসেছেন–গিয়েছেন। ভাবলাম, কেউ বোধ হয় ভুলে ফেলে গিয়েছেন। টেবিলের উপর ব্যাগটা পড়ে থাকতে দেখে হাতে তুলে নিতেই অবাক।
–কেন?
–দেখি, ভিতরে একটা পিস্তল আর দুটো পাসপোর্ট।
–সে কী? -আর সে কী? ভদ্রলোক ক্যাচ-কট-কট!