৫-৬. ধুবড়ি শহরের সার্কিট-হাউস

০৫.

ধুবড়ি শহরের সার্কিট-হাউসটি ভারি সুন্দর। একেবারে ব্রহ্মপুত্রর ওপরেই। নদীর পাশে বসে নদীর দৃশ্য দেখার একটি জায়গা আছে। মনোরম।

সার্কিট-হাউস অবশ্য গুয়াহাটি শহরেরও খুব ভালো। সেটিও ব্রহ্মপুত্রর একেবারে ওপরে। চখা, নামেরই কারণে জলের পাখি বলেই কি না বলতে পারে না, তবে নদীমাত্ররই বড়ো ভক্ত সে।

এখন কাকভোর। চখা একা বসেছিল নদীর দিকে চেয়ে। এখন দেখলে ব্রহ্মপুত্রর ভয়াবহতা কিছুই বোঝা যায় না। তার ভয়াল রূপ দেখতে হয় ভাদ্র-আশ্বিনে। ভরা শ্রাবণেও।

 রবীন্দ্রনাথ চমৎকার করে বলেছিলেন, নদীর সাগরে গিয়ে থামার প্রকৃত মানে। বলেছিলেন যে, থামা মানেই ফুরিয়ে যাওয়া নয়। সেই থামা মানে নিজেকে নবীকৃত করা বা ওইরকমই কিছু।

তিব্বতের চেমায়ুং-জং হিমবাহ থেকে ব্রহ্মপুত্রর জন্ম। তারপর তিব্বতের ভেতর দিয়ে সতেরো-শোকিমি প্রবাহিত হয়ে এসেছে সে। তখন অবশ্য তার নাম, ব্রহ্মপুত্র নয়, সাংপো। ভারতে এসে ঢুকেছে সাংপো প্রথমে অরুণাচল প্রদেশে। সেখানে তার নাম হয়েছে ডিহাং। সদিয়ার কাছে সে হঠাৎ নেমে এসেছে হিমগিরিছেড়ে সমুদ্রতল থেকে মাত্র দেড়-শো ফিট মতন উচ্চতাতে। সেখানেই ডিবাং আর লুহিত এই দুটি নদীও এসে সাংপোর সঙ্গে মিলিত হয়েছে আর তখনই তার নতুন নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র।

গঙ্গা যেমন গিরিরাজের কন্যা, ব্রহ্মপুত্রও কি ব্রহ্মার পুত্র? জানে না চখা। কলকাতায় ফিরে, দিলীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করবে।

যে দেশে পাখিরা শুধুই পাখি, গাছেরা শুধুই গাছ সেখানে নদীরাও শুধুই নদী। তাই জানার ইচ্ছা যাঁদের আছে তাঁরাই জানেন যে, এই পৃথিবীতে কোনো বিষয়েই জানার কোনো শেষ নেই। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে পৃথকীকরণের উপায় তাঁদের দেরাজের মধ্যে গোল করে পাকিয়ে-রাখা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নয়, তাঁদের জিগীষারই তারতম্য।

অসমের পূর্ব ভাগ দিয়ে বিষধর সাপের চাল-এর মতন এঁকেবেঁকে একের পর এক দ্বীপের সৃষ্টি করে একদিকে পাড় ভাঙতে ভাঙতে, অন্যদিকে চর ফেলতে ফেলতে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র শত শত মাইল। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো নদী-দ্বীপ গজিয়ে উঠেছে ব্রহ্মপুত্রেরই বুকে। ডিব্রুগড়ের কাছে। যেখানে ব্রহ্মপুত্র প্রায় সাড়ে ষোলো কিমি চওড়া। সেই দ্বীপের নাম মাজুলি তার আয়তনও প্রায় সাড়ে ন-শো বর্গ কিমি। তারও পর গুয়াহাটির কাছে এসে আর এক নতুন দ্বীপ গড়েছে সে। তার নাম ময়ূর দ্বীপ বা Peacock Island।

উত্তর-দক্ষিণ দু-দিক থেকেই অনেকগুলি উপনদী এসে মিশেছে এই ব্রহ্মপুত্রে। উত্তর থেকে এসেছে যারা তাদের মধ্যে সুবনসিরি, কামেং বা জিয়াভরলি (সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ এর একটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম এই নদীরই নামে), মানাস এবং সংকোশ।

মানাস ও সংকোশ হিমালয়ের বরফাবৃত অঞ্চল থেকে নেমে আসার কারণে সারা বছরই তাদের জল হিমশীতল। যমদুয়ার-এ শিকারে গিয়ে ভুটানের মহারাজ এবং চখার সঙ্গী-সাথি সাহেব-সুবোরা নদীর বালির নীচে বিয়ারের বোতল পুঁতে রেখে দিতেন রেফ্রিজারেটরের বদলে। এই মানাসের অববাহিকাতেই মানাস টাইগার প্রোজেক্ট। আর সংকোশের পারে চখা চক্রবর্তীর প্রিয় যমদুয়ারের বন।

দক্ষিণ থেকে ব্রহ্মপুত্রে এসে মিশেছে বুড়িডিহিং, ধানসিঁড়ি, কোপিলি আর কালাং। আরও কিছু উপনদী আছে যাদের প্রত্যেকেরই উৎস ভুটান ও সিকিমের বরফাচ্ছাদিত নানা পর্বতে। এই সব কটি উপনদীই পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে বাংলাদেশে সেঁধিয়েছে। তারা হল তিস্তা, জলঢাকা, তোর্সা, কালজিনি এবং রায়ডাক।

এতসব কথা মনে এল এলমেলো। একা থাকলেই ওর ভাবনাগুলো কিলবিল করে। আসলে একা থাকলেও ও কখনোই একা থাকে না তো। কত পুরুষ ও নারী, কত গাছগাছালি পাখপাখালি তাকে সর্বক্ষণই ঘিরে থাকে যে, তা বলার নয়। তাদের চোখে দেখা যায় না কিন্তু চখা অনুক্ষণ তাদের অস্তিত্ব অনুভব করে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সেইজন্যেই যে, তার ব্যক্তিত্বটা কোনো একক ব্যক্তির নয়, সে সর্বজনীন। সর্বজনীন বললেও হয়তো সব বলা হয় না, বিশ্বজনীন বলাই হয়তো ভালো। সারাপৃথিবীর সঙ্গে তার মনে মনে ঘর করা। এই ঘর করার রকম অন্য কারওকে বলাও যায় না, বোঝানোও যায় না।

আজ কাকভোরে উঠে যে নদীপারের এই বসবার জায়গাতে এসে বসেছে তার কারণ আছে।

ঝন্টু চখারই ঘরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। এখনও ঠাণ্ডার আমেজ আছে বেশ এখানে। সকাল সন্ধেও ভারি মনোরম। শেষরাতে নিজের পাশে কোনো উষ্ণ শরীরের তরুণী আছে ভেবে সুখস্বপ্ন দেখতে না দেখতেই ঝন্টুর সরব উপস্থিতি সেই সুগন্ধি স্বপ্নে গোবরছড়া দিয়ে দেয়। অসহ্য ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দে নাক ডাকে।

ঝন্টু বলে, চখা নিজেও নাকি নাক ডাকে।

হবে। কে আর কবে নিজের নাক ডাকা শুনেছে আধ-ঘুমন্ত অবস্থার ফুরুৎ-ফুরুৎ শব্দ ছাড়া?

তার পাশের ঘরে আছেন নিমাইদা। প্রাক্তন সাংবাদিক ও বর্তমানে শুধুই সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য এবং তাঁর স্ত্রী দীপ্তি বউদি। নিমাইদা-বউদির এখনও বহুত প্রেম আছে। আশ্লেষে শুয়ে আছেন তাঁরা।

নিমাইদার সুন্দর চেহারাটি, চখার ধারণা, মিস্টার ব্রহ্মা নিজে হাতে এবং অনেক সময় নিয়েই গড়েছিলেন, নইলে কোনো মানুষের চেহারা নিখুঁতি মিষ্টিরই মতন এমন মিষ্টি হওয়া সম্ভব ছিল না। ধবধবে ফর্সা রং, উজ্জ্বল ত্বক, পঁয়ষট্টি বছর বয়েসেও পনেরো বছরের তরুণের মতন ছটফটে সহাস্য স্বভাব। এমনটি বড়ো দেখেনি চখা।

কলকাতাতে ওঁর সঙ্গে অতিসামান্যই দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, পয়লা বৈশাখে বইপাড়াতে, কলকাতা বইমেলাতেও, কিন্তু সে পরিচয় এক, আর কলকাতার বাইরে এসে দিনরাতের আঠেরো ঘণ্টা একসঙ্গে থাকা আর এক।

মিস্টার ব্রহ্মা ছোট্টখাট্ট নিমাইদাকে শুধু যত্ন করে যে গড়েছেন তাই নয়, এই ধরাধামে পাঠাবার সময়ে নিজে হাতে তাঁর চুলটি পর্যন্ত আঁচড়ে পাঠিয়েছিলেন। একমাথা, ব্রুনেট মেমেদের মতন ঘন চুল পরিপাটি করে আঁচড়ে দিয়েছেন এমনই করে যে, জীবনে কোনোদিনও চিরুনির প্রয়োজন পড়েনি নিমাইদার। ঝড়ে অথবা বসন্তের হাওয়াতে অথবা রণে অথবা রমণেও নিমাইদার মাথার একটি চুলও এদিক-ওদিক হয় বলে চখার মনে হয় না। অমন একখানা Custom-Built চেহারা যদি ঈশ্বর চখাকে দিতেন তবে চখা চক্রবর্তী একটি শতরঞ্জি বিছিয়ে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে ভিক্ষে চাইলেও তার দিন চমৎকার গুজরান হয়ে যেত। ঈশ্বর বড়োই একচোখো। যাকে দেন, তাকে ছপ্পর কুঁড়েই দেন, আর যাঁকে দেন না, চখা চক্রবর্তীর মতন কানা ছেলে পদ্মলোচন নাম নিয়েই তাকে খুশি থাকতে হয় সারাজীবন।

পরিকল্পনামতো সবুজের আসর আয়োজিত গোয়ালপাড়ার এই ধুবড়ি শহরের প্রথম বইমেলার উদবোধন হয়ে গেছে। নিমাইদাই করেছেন। সঙ্গে পোঁ ধরেছিল চখাও। আজ অসমিয়া সাহিত্যর ওপরে সেমিনার আছে বিকেলে। আগামীকাল ইংরেজি সাহিত্যর ওপরে। আর তার পরদিন বাংলা সাহিত্যের ওপরে। যে কারণে, নিমাইদা এবং চখাকে ওই সংস্থার কর্মীরা এবং স্থানীয় বাঙালিরা কলকাতা থেকে অনেক খরচ করে আনিয়েছেন।

 নিমাইদা আগে এদিকে আসেননি কিন্তু চখা এসেছে। তামাহাটের, গৌরীপুরের, ধুবড়ির আত্মীয়রাই তাকে বারে বারে এই অঞ্চলে নিয়ে এসেছেন। এবারে সবুজের আসর বইমেলার উদ্যেক্তারা আবার ফিরিয়ে আনলেন তাকে। ওঁরা আবারও না আনলে হয়তো চখার আসাই হত না আর। তাই এই প্রত্যানয়ন তার কাছে এক গভীর অর্থবাহী। বড়োই সুখের।

খরচটা বড়ো কথা নয়। তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসা খরচ করেছেন ওঁরা ওঁদের দু-জনেরই ওপরে। আন্তরিকতা শব্দটির তাৎপর্যই কলকাতায় মানুষেরা ভুলে গেছেন হয়তো। সেখানে পরিবেশ দূষণের জন্যে নিশ্বাস নিতেও যেমন কষ্ট, নানারকম অপ্রয়োজনীয় গগননিনাদী আওয়াজে (যেমন লাল বাতি জ্বালনো ভিআইপিদের গাড়ির সাইরেন।) যেমন কথা বলা বা শোনাও কষ্ট, কারওকে একটু ভালোবাসাও যেমন কষ্ট, মন এবং শরীর দুইয়ের ভালোবাসাই, তেমনই আন্তরিক হওয়াটাও বোধ হয় অসাধ্য। অন্তরই যেখানে নিরন্তর চৈত্রর হাওয়ার নদীচরের ঝুরো বালিরই মতন ঝুরঝুর করে ঝরে উড়ে যাচ্ছে, সেখানে আন্তরিক হয়ই বা মানুষ কেমন করে!

ধুবড়ি-গৌরীপুর-তামাহাটের সবচেয়ে বড়ো আনন্দ এখানে ভি আই পি বা লাল আলো জ্বালানো বেশি গাড়ির ভিড় নেই। পি-পি-পাঁ-পাঁ আওয়াজ করে শূন্য-কুম্ভের মতন, শয়ে শয়ে নিরীহ শান্তিকামী খেটে-খাওয়া মানুষের পিলে চমকে দিয়ে নিরন্তর অকাম কইরবার লাইগ্যা তাঁদের যাওয়া-আসা নাই। মানুষের দাম দিনে দিনে যতই কমছে, ভেরি ইম্পর্ট্যান্স পার্সনস এর সংখ্যা ততই বাড়ছে। বাঁশবন যত বড়ো, শেয়ালরাজাদের সংখ্যাও তত বেশি। আগে পুলিশের গাড়ি, পেছনে পুলিশের গাড়ি, তারও আগে ভটভটিয়া ভটভট-করা সাইরেন বাজানো সার্জেন্ট। মধ্যেখানে লাল-আলো জ্বালানো গাড়ি।

 চখা মনে মনে ঘেন্নাতে বলে, আরে খোকা! তোদের মারছেটা কে? নিজের জীবিকার্জনের ক্লান্তিতে সবাই এতই ক্লান্ত যে, সময় থাকলে কিছু ছারপোকা, তেলাপোকা, বা মশা-মাছি মারারই চেষ্টা করত তারা। কিন্তু তোরা কে র‍্যা? তোদের নিয়ে মাথাটাই বা ঘামায় কে? আর তোরা তো ভোটাদাতাদের চাকর, তাদের সেবাদাস। ভাব দেখলে মনে হয় তোরাই বুঝি রাজা-রানি। হাসি পায়। তোরা কি জানিস সাধারণে কোন চোখে দেখে তোদের মতো ভি আই পিদের? ভি আই পি হলেও হতে পারতেন গুণীরা। তোদের কোন গুণটা আছে যে, সদাই সাধারণ মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখিস? তোদের সব দলের রংই তো সাধারণের জানা হয়ে গেছে। তবুও কোন লজ্জায়, নির্লজ্জ অকারণ উচ্চম্মন্যতার দুর্মর কর্বর রোগে ভুগে তোরা দিনে-রাতে শ্যামের বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাস অপদার্থ, আত্মসম্মানজ্ঞানহীনেরা?

চখার ইচ্ছে করে ওইসব ভি আই পি দের (কোন শালা ভি আই পি নয় আজকাল? হাঃ) গাড়ির লাল বাতিগুলো খুলে নিয়ে সেই ভি আই পি দের প্রত্যেকের পেছনে লাগিয়ে দেয়। জোনাকি করে দেয় সব শালা ঘুসখোরদের। রক্তচোষাদের। তারপর দেখুক নিজের নিজের পশ্চাৎদেশের আলোতে নিজেরা নিজেদের!

লজ্জা শব্দটা কি দেশ থেকে উধাওই হয়ে গেল?

হঠাৎ চটকা ভাঙল চখার, কারও গলার আওয়াজে।

কতক্ষণ?

ফিঙে বলল।

 চখা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ফিঙের দিকে। বলল তুমি!

অভাবনীয় মিথ্যে বলবে না, বাগডোগরাতে প্লেন থেকে নামার পর থেকেই ফিঙের কথা যে তার মনে আসেনি তা নয়! কিন্তু হৃদয় খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে চায়? শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতারই মতন তার মন বলতে চেয়েছিল, তোমায় আমি ভোগ করেছি তোমায় বিনাই।

গৌরীপুরে সামান্য সময় কলেজে পড়ার স্মৃতি তাকে বড়ো মেদুর করে তুলেছিল। বড়ো বড়ো গাছের সারির মধ্যে দিয়ে সোজা চলে যাওয়া পথ, নদীর গন্ধ, ফিঙের সঙ্গ। যা হারিয়ে গেছে তা গেছেই। হারানো জিনিসের প্রতি ওর কোনো মোহ নেই। হারানো জিনিস মূর্খরাই ফিরে চায়। তা সে জাগতিক কোনো বস্তুই হোক কি স্মৃতি, অথবা ভালোবাসাও। তবে এটা স্থিরই করেছিল যে ও এসে ফিঙের খোঁজ করবে না নিজে। গৌরীপুর থেকে গুয়াহাটি, তারপর গুয়াহাটি থেকে ধুবড়িতে যে এসে থিতু হয়েছে ফিঙে, সে খবর কলকাতাতে বসেই পেয়েছিল এক পরিচিতর চিঠিতে। গৌরীপুরের বিল্টু। তার এক সময়ের জিগরি দোস্ত।

ফিঙের স্বামী এখনও থাকেন গুয়াহাটিতেই কিন্তু ফিঙে ধুবড়িতেই থাকে। সুন্দর বাড়ি করেছে নাকি অনেকখানি জমি কিনে। ফুলের বাগান। ওর স্বামীও যে এই সময়ে ধুবড়িতেই আছেন ছুটিতে তাও লিখেছিল বিল্টু। ফিঙের খবর জানত সবই কিন্তু গা করেনি চখা। ওই একই কারণে। সেলাই-করা ক্ষত পুরোনো হলেও সেই ক্ষতস্থানে আঘাত লাগলে ব্যথা লাগেই। এমনিতেই বেঁচে থাকতে অনেকই কষ্ট। কষ্ট আর বাড়িয়ে কী হবে?

ভালো করে তাকাল চখা ফিঙের দিকে। বিশ্বাস হচ্ছিল না ওর।

 সবে সূর্য উঠছে। ফিঙের ছায়া পড়েছে মাটিতে লুটিয়ে। সাদা, নরম, প্রভাতী আলো যেন ফিঙের কালো রূপের কাছে হার মেনে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে লজ্জাতে।

চখা দেখছিল যে, ফিঙে দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই আছে। অথচ কত দূরে। কতগুলো বছর কেটে গেছে মাঝে। কত্বগুলো। অথচ ফিঙে ঠিক তেমনই আছে। গৌরীপুরের প্রমথেশ বড়ুয়া কলেজ থেকে বই-খাতা দু-হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে, ভীতা হরিণীর মতন দু-দিকে দু-বিনুনি ঝুলিয়ে যেমন করে বাড়ি ফিরত, ঠিক তেমনই। আশ্চর্য! ঠিক তেমনই। বছরগুলো নিজেরাই বুড়ি হয়ে গেছে যেন, ফিঙেকে ছুঁতে না পেরে।

চখা অস্ফুটে বলল, বোসো। পাশে বোসো।

পাশে থাকলে দেখা যায় না একে অন্যকে। এখানেই ঠিক আছে। তোমাকে দেখি।

আমাকে?

 লজ্জিত অপদস্থ, চখা বলল।

তারপর বলল, আমাকে কী দেখবে? আমি কি আর দেখার মতন আছি? দেখে তো, যে দেখে, তার চোখই। যাকে দেখে, সে দ্রষ্টব্য কি না, তা সে নিজে কতটুকু জানে! নোড়ো না চখাদা। তুমি তেমনই ছটফটে আছ। তোমাকে দেখতে দাও ভালো করে!

চখার সেই আবেশের মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল ফিঙের কথা শুনে।

 হাসছ যে? আমাকে দেখে কি তোমার হাসি পাচ্ছে?

ফিঙে আহত গলাতে বলল।

না। তোমাকে দেখে নয়। একটা গল্প মনে পড়ে গেল আমাকে ছটফটে বলাতে।

কী গল্প?

বলেই, সেই ছেলেবেলায়, জলপাই গাছটার তলাতে মুনিষদের কেটে ফেলে রেখে যাওয়া বুনো তেঁতুলের কাটা গুঁড়ির ওপরে যেমন করে ওরা বসত পাশাপাশি, তেমন করেই বসল ফিঙে।

আবার ফিঙে বলল, বল।

একজন পেটুক ছিল। সে এক বিয়েবাড়িতে গিয়ে এমন খাওয়াই খেয়েছে যে, আর হেঁটে ফিরতে পারে না বাড়িতে। দুই বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে কোনোক্রমে সে ফিরছিল বাড়ির দিকে, এমন সময়ে পাড়ার মোড়ের পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা ছোঁড়ারা বলল, আরে এ ভগলু, বেগাড় পইসা খনা মিলা ত ইতনাহি খালি, যো চলনে ভি নেহি শকতা?

কোথাকার গল্প?

ফিঙে বলল।

গিরিডির। আমার মামাবাড়ির। ছোটোমামার মুখে শোনা।

তারপর?

তারপর ভগলু দু-বন্ধুর কাঁধে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আরে ম্যায় ক্যা খায়া, খায়া তো জুগনু। উ দেখো! উ চৌপাইমে সওয়ার হো কর আ রহা রহা হ্যায়।

এ গল্পর মানে?

ফিঙে বলল।

মানে, আমার পাশের ঘরে নিমাইদা আছেন। তাঁকে দেখলে ছটফটে কাকে বলে, তা তুমি বুঝবে। প্রতিমুহূর্ত শরীরের প্রতিটি মাংসপেশি ছটফট করছে। সত্যি! নিমাইদার সঙ্গে দুটি দিন না কাটালে প্রাণশক্তি ব্যাপারটা যে কী, সম্বন্ধে কোনো ধারণাই হত না।

সত্যি?

সত্যি!

সুন্দর চেহারা।

কার?

নিমাইবাবুর।

তুমি দেখলে কখন? তুমি কি বইমেলা উদবোধনের সময়ে এসেছিলে? কই? দেখিনি তো!

না। আসিনি। আমার বাড়ির বারান্দা থেকে শোভাযাত্রাতে দেখেছিলাম ওঁকে। উনিই যে নিমাই ভট্টাচার্য তা জানতাম না। তোমার বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বলে এখন জানলাম।

ও।

ছটফটানি অনেকরকম হয়। আমিও ছটফটে। কিন্তু সেই ছটফটানি বাইরে থেকে দেখা যায় না।

সেটা কীরকম?

সেটা ভেতরের ছটফটানি। গভীর নদী যখন তার তলের পাহাড় ও ধারালো পাথরে নিয়ত রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হতে হতে বয়ে যায়, তখনও বাইরে থেকে দেখে মনে হয় তার কোনো কষ্ট নেই। ব্যথা নেই। শান্ত, প্রায় স্থির দেখায় তাকে। অথচ যার চোখ আছে, সে তার ভেতরের কষ্টটা দেখতে পায়।

বাবা। তুমি দেখি দার্শনিকের মতন কথা বলছ। দার্শনিকের সঙ্গে বিয়ে হলেও যে দার্শনিক হয়ে ওঠে মানুষে তা তো জানা ছিল না! শুনেছিলাম, তোমার স্বামী দার্শনিক।

হাসল, ফিঙে।

বলল, সব মেয়ের স্বামীই দার্শনিক। কিন্তু তাঁরা জানেনও না যে, তাঁদেরই নিজস্বার্থময় দর্শনে প্রভাবিত হয়ে প্রত্যেক স্ত্রীও একদিন দার্শনিক হয়ে যান। তবে তুমি অবশ্য নির্বোধই। চিরদিনের। তোমার চোখ নেই। মন নেই। তাই আমাকে দেখেও দেখোনি, জেনেও জানোনি। অবশ্য এখন মনে হয় যে, বুদ্ধিমান পুরুষকে ভালোবাসার চেয়ে মেয়েদের পক্ষে নির্বোধ পুরুষকে ভালোবাসা অনেকই নিরাপদ। যদি তোমার চোখই থাকত তবে তোমার ওই দুটি ড্যাবা-ড্যাবা চোখের দূরদৃষ্টির সামনে দিয়ে সেই দার্শনিক আমাকে ড্যাং ড্যাং করে বিয়ে করে নিয়ে যেতে পারত না।

 চখা বলল, আমাদের সময়ে ওইরকম ড্যাং ড্যাং করেই অন্যমানুষের সঙ্গে প্রেমিকাদের বিয়ে হত। সকলেরই। যাদের ভালোবেসেছি আমরা, তাদের সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের কম মানুষেরই বিয়ে হয়েছে। আজকাল যেমন উলটোটাই নিয়ম। সে কারণেই হয়তো ভালোবাসা সম্বন্ধে আমাদের এখনও এত রোম্যান্টিসিজম বেঁচে আছে।

ফিঙে চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।

তারপরে বলল, তাই?

তাই তো! কিন্তু এখন ভাবি, ভাগ্যিস তেমন হত তখন। ভালোবাসাটা আলাদা ব্যাপার। চিরদিনই। ভালোবাসাটা যে বিয়েতে পৌঁছে ফুল-ফলন্ত হয়ে উঠবেই, এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম তো নেই। বরং আমি বলব, তোমাকে একটু দেখতে পেয়েই যেরকম খুশিতে আমার মন ভরে উঠত, তেমন খুশি, তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী হয়ে এসে ঘর করলে হয়তো কখনোই হতে পারতাম না। এটা কোনো দোষ বা গুণের ব্যাপার নয় ফিঙে। এটাই ঘটনা। এটাই সত্যি। আমরা স্বীকার করি আর নাই করি। বিবাহিত জীবন মানেই টাকা-পয়সা ছেলে মেয়ে-সংসার, অভ্যেস, পরশ্রীকাতরতা, নিজেদের এবং অন্যের। সেই আবর্তে পড়ে ভালোবাসার লাশকাটা ঘরের লাশ-এরই মতন অবস্থা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।

ওসব কথা থাক।

তুমি তো জানতে যে, আমার গুয়াহাটিতেই বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরে গৌরীপুর থেকে তো সেখানেই গেছিলাম। আমি যে ধুবড়িতে থাকি এখন, তা তুমি জানলে কী করে?

ফিঙে শুধোল।

জেনেছিলাম বলেই তো গণেশ সেনের সই-করা সবুজের আসর-এর নেমন্তন্ন পেয়েই একবাক্যে আসব বলে রাজি হয়ে গেলাম। নইলে সচরাচর আমি কোথাও-ই যাই না।

কেন? যাও না কেন?

 প্রথমত, আমি এখনও সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারিনি, সেইজন্যে। দ্বিতীয়ত আমার মনে হয়, সাহিত্যিকের যথার্থ স্থান তাঁর লেখার টেবল-এ। তিনি নিজে অন্য জীবন যাপন করতে অবশ্যই পারেন ব্যক্তি হিসেবে। কিন্তু সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে সবসময়ে লুকিয়ে রাখাই বোধ হয় ভালো।

কেন?

 বিমল মামা, মানে বিমল মিত্র এই কথাই বলতেন। একজন সাহিত্যিক নায়কও নন, খেলোয়াড়ও নন। তাঁর স্থান আলোজ্বলা মঞ্চে নয়। দূরদর্শনের পর্দাতেও নয়। তাঁর সঙ্গে পাঠক-পাঠিকার যোগসূত্র থাকা উচিত শুধুমাত্র তাঁর লেখারই মাধ্যমে। পাঠক-পাঠিকারও সাহিত্যিককে চোখে না দেখাই ভালো, সাহিত্যিকেরও উচিত পাঠক-পাঠিকার কাছে না যাওয়া।

তাই? বিমল মিত্র তাই বলতেন বুঝি?

হ্যাঁ।

 তুমি যদি জানতেই আমি এখানে আছি তাহলে আসামাত্রই যোগাযোগ করলে না কেন?

বা:! ভালোই বলছ তো! তুমি যদি আমাকে না চিনতে চাইতে! তোমার বর, তোমার ঘর, তোমার ছেলে মেয়ে সম্বন্ধে তো কিছুই জানতাম না আমি। এখনও জানি না। তামাহাট, গৌরীপুর, ধুবড়ির পাট কি আমার আজকে চুকেছে! সেসব কতদিনের কথা। আমি জানতাম যে, আমি যে আসছি, সে খবরটা তোমার কানে ঠিকই পৌঁছোবে।

 কী করে সেকথা জানতে?

আমি তো আর সেইসব দিনের পরিচয়হীন চখা চক্রবর্তী আজ নেই। আমার আসা যাওয়ার আগে আগেই ফুলগন্ধর মতন খবর ওড়ে। জানতাম, আমি এলে তুমি খবর পাবেই। শুধু ধুবড়িতে আসার খবরই নয়, আমার মৃত্যু-সংবাদও পাবে কাগজে, রেডিয়োতে, টিভিতে। যে দুঃখে তুমি দিয়েছিলে একদিন, তার শোধ আমি এমনি করেই তুলব।

তুমি যেমন নির্বোধ ছিলে তখন, এখনও ঠিক তেমন নির্বোধই আছ। তোমার লেখা বই কোন নির্বোধেরা পড়ে যে তোমাকে বিখ্যাত করল, তা ঈশ্বরই জানেন!

হাসল চখা। কিন্তু শব্দ হল না কোনোও।

বলল, তুমি হয়তো জানো না যে, বোধের নানারকম স্তর থাকে। বুদ্ধিমান এবং নির্বোধদেরও। আমার স্তরের নির্বোধেরাই হয়তো আমার লেখা পড়েন।

তারপরে বলল, আজ ঝগড়া করবে বলেই কি কাল সার্কিট-হাউসে ফোন করেছিলে? তুমি কি জানো যে, তোমার সঙ্গে এখন এখানে আমার দেখা হওয়ার কত বাধা? সেদিনের কনসার্ভেটিভ গৌরীপুরে সেই কলেজছাত্রীর সঙ্গে দেখা করাও হয়তো আজকে তোমার সঙ্গে দেখা করার চেয়ে অনেকই সহজ ছিল।

কেন?

এই জন্যে যে এখন আমার পায়ে বেড়ি। বড়ো ভারী সেই বেড়ি।

কীসের বেড়ি?

খ্যাতির।

খ্যাতির বেড়ি এতই ভারী?

বড়ো ভীষণই ভারী, ফিঙে।

 তারপরই বলল, বেলা বাড়ছে। এক্ষুনি বডিগার্ডই এল আর নিতবরই এল, আমার কাজিন ঝন্টুবাবু আমার খোঁজে আসবে।

তামাহাটের?

 হ্যাঁ। তা ছাড়া, নিমাইদা আর দীপ্তি বউদিও আসতে পারেন। তাঁরা সকালের চা খাওয়ার পরই এদিকে আসেন রোজই বেড়াতে।

হাসল ফিঙে।

বলল, এলে হবেটা কী? আমাদের দেখলেই বা কী হবে?

হয়তো হবে না কিছুই। তুমি আমার এক সময়ের প্রেমিকা না হলে হয়তো এই ভয়টাই জাগত না মনে। তা ছাড়া আমার আর কী হবে! তার চেয়ে তোমার স্বামীকে বিকেলে বইমেলাতে আসতে এল না। তাঁর সঙ্গে তোমাদের বাড়িতেই না হয় যাব ছাতিয়ানতলাতে। যে ঘর আমার হতে পারত সেই ঘরেই দেখব তোমাকে। তোমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ হবে, ছেলে-মেয়ের সঙ্গেও।

তারপরে বলল, তোমার ছেলে-মেয়ে কী? ফিঙে?

আমার স্বামী বা ছেলে-মেয়ের খোঁজে তোমার দরকার কী? আমি কি কেউই নই?

 আশ্চর্য তো! তুমি ঠিক সেইরকমই আছ।

 কীরকম?

অবুঝ।

তুমিও হুবহু সেরকমই আছ।

 সেটা কীরকম?

বুঝদার, হুশিয়ার।

চখা হেসে বলল, তোমার সঙ্গে কথায় পারব না। পারিনি কোনোদিনও।

 লেখাতেও পারবে না। আমি যদি কলম ধরতাম তবে তোমার মতন অলকা-পলকা লেখকেরা হাওয়ার মুখে কুটোর মতন ভেসে যেতে।

তারপর বলল, শোনো, আমি এখন যাচ্ছি। আমি আবারও আসব পরশু এখানেই। রাত আটটার সময়ে। নৌকো ঠিক করে রাখব। চাঁদের রাতে আমরা যেমন গঙ্গাধর নদীর বুকে ভেসে বেড়াতাম নৌকোতে নৌকোতে, বালুচরে চখাচখি হতাম, মনে আছে? তেমনই আজ রাতেও ভাসব ব্রহ্মপুত্রে, খেলব। আঃ!

আরে! আজ কী করে হবে! আজ যে আমার নেমন্তন্ন রাতে। শুধু আজই কেন? যে ক-দিন আছি রোজই নেমন্তন্ন। নিমাইদা-বউদিকেই আসলে করেছেন নেমন্তন্ন ওঁরা। সঙ্গে আমাকেও হয়তো চক্ষুলজ্জাতেই।

যেয়ো নেমন্তন্নে, তবে কটা চুমু খেয়ে ও খাইয়ে একটু দেরি করেই যেয়ো না হয়।

 তারপরই বলল, আচ্ছা! এবারে যেতে হবে। আমি সন্ধের পরে পরেই আসব কিন্তু।

পাগলামি কোরো না। হবে না আমার আসা ফিঙে। তখন তো বইমেলাতেই থাকব। আজকে অসমিয়া সাহিত্যর ওপরে আলোচনা হবে। কনক শর্মা সাহেব, জেলার ডি সি ছিলেন সাত দিন আগেও, গৌরীপুরের অসমিয়া সাহিত্যিক শীলভদ্র সাহেব, এঁরা সবাই বক্তৃতা দেবেন। প্রদীপ আচার্য, যদিও ইংরেজির অধ্যাপক গুয়াহাটির কটন কলেজের, তবু তিনিও আজ মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন। যাব বলে তাঁদের কথাও দিয়েছি। না গেলে, অসভ্যতা হবে।

 সেখানে কিছুক্ষণ থেকে চলে আসতে পারবে না? আমার ডাকে সাড়া না-দেওয়াটাই কি তোমার সভ্যতার একমাত্র নিদর্শন?

জানি না। যদি না পারি?

না পারলে, পেরো না। তবু আমি এখানে আসবই সাতটার সময়ে। ঠিক সাতটা। আটটা অবধি দেখব। রিকশা দাঁড় করিয়ে রাখব। নৌকোও। যদি না আসতে পারো তো কী আর হবে? ফিরে যাব।

 চখা আন্তরিক গলাতে বলল, বলল যে, সত্যিই চেষ্টা করব আমি। সত্যি! তুমি এত বছরেও একটুও বদলাওনি। তেমনই দুর্বোধ্যই আছ।

 বদলেছি। অবশ্যই বদলেছি। সেই বদলটা তোমার চোখ দেখতে পায়নি। আমরা মেয়েরা, নদীরই মতন। কত যে চর ফেলেছি, পাড় ভেঙেছি, দ্বীপ গড়েছি এই ক-বছরে, তার খোঁজ তুমি পাবে কী করে! তোমার যা নেবার তা তো তুমি স্বার্থপর নির্বোধ পুরুষ, নিয়ে খুশি থেকেছ। তুমি ভেবেছিলে, আমার সর্বস্ব পেয়েছ। অথচ যে প্রাপ্তিকে তুমি সবচেয়ে দামি বলে ভেবেছিলে তার দাম আমার কাছে কানাকড়িও ছিল না। আমার সর্বস্ব যদি কেউ কোনোদিন পায়ও তবে তার সর্বনাশ হবে।

চখা বলল, বলছ, তোমার সর্বস্ব পাওয়া আর নিজেকে সর্বস্বান্ত করাতে তফাত বিশেষ নেই!

সাধে কি আর তোমাকে নির্বোধ বলতাম, না আজকেও বলছি?

বলেই ফিঙে বলল, যাই হোক, আশা করছি, যত অসুবিধেই থাক, ঘণ্টাখানেকের জন্যে অন্তত আসতে পারবে।

তোমার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবে না? আজ দুপুরেও যেতে পারি, যদি এল।

না।

তবে তো সার্কিট-হাউসেই তুমি আমার ঘরে আসতে পারো। ঝন্টুকে কোনো বাহানা করে কোথাও না হয় পাঠিয়ে দেব। মানে, ঘরে একাই থাকব আমি।

না। নদীতেও তো আমি একাই থাকব। দুজন একা যোগ করলেই যে দোকা হয় তাও কি জানো না? অত কথার দরকার নেই। নদীতেই যাব। আসতে পারলে এসো, না আসতে পারলেও কিছু বলার নেই। আমার ঘর…

এই অবধি বলেই, ফিঙে চুপ করে গেল।

 তারপরে চলে যাবার আগে বলল, আমার ঘর যে নেই এমন নয়। ঘর বলতে সাধারণে যা বোঝায়, আমার ঘরে তার সবই আছে। স্বামী আছেন, পুত্র আছে, ফ্রিজ, টিভি, সোফা সেট, সমস্যা, দৈনন্দিনতা, অভ্যেসের নিগড়, সবই। সেই থোড়-বড়ি-খাড়া খাড়া-বড়ি-থোড়। আছে সবই কিন্তু আমি একাই।

 চখা চুপ করে ফিঙের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আশ্চর্য! মুখের চামড়া আজও তেমনই টানটান আছে, সজীব, মসৃণ। একটি স্লিভলেস ব্লাউজ পরেছে। হালকা খয়েরি। আর খয়েরি কালো ডুরে শাড়ি। চুল উড়ছে ফুলের মতন, ভুলের মতন ফিঙের, ব্রহ্মপুত্রর ওপর দিয়ে বয়ে-আসা প্রভাতি হাওয়াতে। ওর বোধ হয় গরম বেশি। চখা তসরের একটি চাদর গায়ে দিয়ে বেরিয়েছিল অথচ ফিঙে স্লিভলেস-ব্লাউজ পরে রয়েছে। বগলের কাছে ছায়ার মতন একটু কালোর আভাস। সেই ছায়া তার শরীরের রহস্য যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মনের রহস্য তো আছেই।

ফিঙে বলল, আমরা সকলেই একা। আমার স্বামীও একা। তুমিও একা। আমার ঘর থাকলেও সেই ঘরে তোমাকে আদৌ মানাবে না চখাদা। তোমার মধ্যে আমি আমার আকাশকে দেখেছিলাম একদিন। আকাশ কি কখনো ঘরে আসে? চখাচখিরা থাকে নদীতেই। চিরদিন। অথবা হ্রদে। অথবা নদীচরে। উদাত্ত আদিগন্ত আকাশের নীচে। তুমি কি ভুলে গেছ যে তুমি আমাকে চখি বলে ডাকতে?

তারপর শেষ কথা বলল, এসো। এসো। নদীটাই, নদীর চরটাই আমার বারান্দা। তোমাকে ঘরে না নিয়ে গিয়ে বারান্দাতেই খেলব তোমার সঙ্গে।

যাবার সময়ে, এমনই এক চাউনিতে চাইল ফিঙে চখার দিকে যে, ওর মনে হল ও যেন ফিঙের গভীর ভালোবাসাতে চান করে উঠল।

সত্যি! এই মেয়েরা বিধাতার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। ভাবল চখা। সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়েরা জানলই না তাদের কী ছিল? তারা মস্ত বোকা বলেই পুরুষের মতন নিগুন, ঈশ্বরের আশীর্বাদ-অধন্য ইতর জানোয়ারদের সমান হবার জন্যে প্রাণপণ লড়াইতে শামিল হল।

এ ভারি লজ্জার কথা।

তারপর পিছু ডাকল ফিঙেকে ও।

ফিঙে তার মরালীর মতন গ্রীবা বেঁকিয়ে, ভুরু তুলে নীচু গলাতে বলল, কী?

বলতে ভুলে গেছিলাম। ঠিক তোমারই মতন একজনের সঙ্গে আলাপ হল গত সন্ধেতে বইমেলাতে।

ফিঙের মুখে ঈর্ষা এবং বিদ্রূপ ফুটে উঠল।

বলল, আমারই মতন? হাঃ। আমার মতন এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউই নেই। তোমার ছোটোখাটো ফর্সা নিমাইদারই মতন ব্রহ্মাও একটিই মাত্র চিকন-কালো ফিঙেকে তৈরি করেছিলেন তাঁর ভাঁড়ারে যতকিছু ভালো উপাদান ছিল তার সবটুকু দিয়ে।

 তারপরই বলল, উপাদান না বলে, উপচার বলাই ভালো। স্বয়ং ব্রহ্মারও পুজো-পাঠ করতে হয়েছিল আমাকে বানাতে। আমার মতন দ্বিতীয় কেউ থাকতেই পারে না।

সেকথার জবাব না দিয়ে চখা বলল, সত্যি বলছি। হুবহু তুমি। তুমি ঠিক যেমনটি ছিলে কলেজে পড়ার সময়ে। মেয়েটির নাম জবা। কী ভাবল সে, কে জানে! অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। কী সুন্দর যে তার চোখ দুটি! কী সুন্দর ভুরু। আর কালো তো নয়, যেন জগতের আলো। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত বহু জন্ম আগে ওকে দেখেই লিখেছিলেন :

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
 কালো তারে বলে অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে,
কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ।

থমকে দাঁড়াল ফিঙে।

বলল, সে মেয়ে থাকে কোথায়?

এখন কলকাতাতে। বিয়ে হয়ে গেছে যে। ধুবড়িরই মেয়ে।

কোন বাড়ির মেয়ে?

গণেশ সেনের দাদার মেয়ে।

কোন গণেশ সেন?

আরে সবুজের আসর-এর গনেশ সেন, যাঁরা বইমেলার উদ্যোক্তা।

 আমি চিনি না।

চখা বলল, বিশ্বাস করবে না, অবিকল সেই গৌরীপুরি তোমারই মতন। হুবহু তুমি! সে যেন Incarnated তুমি!

হতে পারে সে জবা। তবে বাবোমেসে জবা নয় সে। কখনোই নয়। আমার নাম ফিঙে। আমি চিরকালীন। এবং আমি একমাত্র। আমার কোনো Double নেই।

তারপর বলল, রাতে এখানেই এসো চখাদা, প্লিজ। এবারে কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই চললাম।

শোনো ফিঙে।

 তোমার স্বামীর নাম কী? নামটি বলে যাও।

চখা বলল।

একমুহূর্ত চুপ করে রইল ফিঙে।

 তারপরে বলল, রাতে স্বামীর নাম? আমার স্বামীর নাম, স্বামী।

বলেই, চলে গেল এবারে সত্যিই দূরে দাঁড় করিয়ে-রাখা রিকশার দিকে।

চখা ভাবছিল, এ এক আশ্চর্য দেশ। এখানে নদীর নাম নদী।

গাছের নাম গাছ।

পাখির নাম পাখি।

আর স্বামীর নামও স্বামী।

শুধুই স্বামী।

ফিঙে চলে গেলে চখার ঘরে বসেই চখা ও ঝন্টু নিমাইদা ও দীপ্তি বউদির সঙ্গে প্রাতরাশ সারল।

নিমাইদাকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে চখা। সত্যিই জীবনীশক্তির সংজ্ঞা যেন মানুষটি। অনুক্ষণ চৈত্র-দুপুরের চড়াই পাখিটির মতনই ছটফট করছেন। পরিবেশে, প্রতিবেশে অনবরত আনন্দর ধুলো ওড়াচ্ছেন। এমন জীবন্ত মানুষের সঙ্গ পাওয়াও ভাগ্যের। খুবই ভাগ্যবতী দীপ্তি বউদি।

ব্রেকফাস্ট সবে শেষ হয়েছে, এমন সময়ে বন্ধ দরজার বাইরে কাদের যেন পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। সবসময়েই কেউ না কেউ আসছেনই। ঝন্টু, চখার পাহারাদারিতে আছে অবশ্য। গম্ভীর গলাতে, ভারিক্কি চেহারাতে আগন্তুকদের ভালোমতন ভয় পাইয়ে দিয়ে বলছে, অটোগ্রাফ এখান উনি দেবেন না, বিকেলে বইমেলাতে আসবেন।

গতকাল এই যান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই অধ্যাপক প্রদীপ আচার্যকেও স্বাক্ষর-শিকারি ভেবে ও হাঁকিয়ে দিচ্ছিল। ভেতর থেকে নাম শুনতে পেয়ে চখা নিজেই দৌড়ে এসেছিল তাঁকে ভেতরে ডেকে নিতে। তারপর অনেক গল্প করেছিল। শুধু ইংরেজি সাহিত্যে অসাধারণ দখল আছে বলেই নয়, প্রদীপ যে চখা চক্রবর্তীর মতন অপাঙক্তেয়, অ-আঁতেল লেখকের বাংলাতে-লেখা প্রত্যেকটি প্রণিধানযোগ্য বইও পড়ে ফেলেছেন, একথা জেনে অত্যন্তই অভিভূত হয়েছিল ও।

 আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে যেমন ওড়িশা ও অসম, বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে যতখানি উৎসাহ ও আগ্রহ, তার সিকি ভাগও বাঙালিদের মধ্যে দেখতে পায় না, তাঁদের সাহিত্য অথবা সংগীত সম্বন্ধেও। এই কূপমন্ডুকতা এবং অকারণ উচ্চমন্যতা চখাকে আন্তরিকভাবে লজ্জিত করে। সম্মান বা শ্রদ্ধা দিলে তবেই তো তা ফেরত পাওয়া যায়।

 ঝন্টু দরজা খুলতেই সমীর দাশগুপ্ত এবং মিসেস নিয়োগী ঢুকে এলেন।

বললেন, দেখুন, কাকে এনেছি।

কাকে?

বলেই, উল্লাসে লাফিয়ে উঠল চখা, সোফা থেকে। উত্তেজিত হয়ে বলল, বিল্টু! তুই!

গৌরীপুরের বিল্টু হাসতে হাসতে বলল, তুই ত এলায় ডাঙ্গর হইছ। চখা চক্কোত্তি যার নাম। চিনবার পারস কি আমারে?

বাজে কথা বলিস না। এখন বল, তুই আছিস কেমন? করিস কী? তোকে চিনব না? কারও পক্ষেই কি বিল্টু কলিতাকে ভোলা সম্ভব, একবার আলাপ হবার পরে?

তারপর সমীরবাবুদের দিকে চেয়ে বলল, আপনারা কী বলেন?

ঠিক, ঠিক।

সকলেই একবাক্যে বললেন।

করুম আর কী? যা কাম আমার আছিল তাই করি।

বিল্টু বলল।

 কী কাজ?

 নাই-কাম।

 হাসল চখা। মনে পড়ে গেল তিস্তার চ্যাংমারীর চরে যখন রিক্ল্যামেশনের কাজ চলছিল তখন দুর্গাকাকুর সঙ্গে হাতির পিঠে চড়ে বনশুয়োরের তালাশে যেতে যেতে শোনা কথোপকথন। একজন চাষি, নতুন উদ্ধার-করা নতুন জমিতে কী যেন বুনছিল। দুর্গাকাকু তাকে বললেন, কী করেন হে বাহে?

সেই চাষি একবার নিস্পৃহভাবে মুখ ঘুরিয়ে দেখল।

রাজা-রাজড়ার বাহন হাতির মতন জানোয়ারের পিঠে সওয়ার-হওয়া, রাইফেল বন্দুক হাতে গণ্যমান্য তাদের প্রতিও তার বিল্টুমাত্র মনোযোগ ছিল না। সে আরও বেশি নিস্পৃহভাবে বলল, না-করি-কোনো। অর্থাৎ কিছুই করছি না এবং করবার ইচ্ছেও নেই, এমনই এক ভাব আর কী!

নাই-কাম করি বলে, বিল্টুও আসলে বলতে চাইছে, না-করি-কোনো।

গান-টান গাইছিস না আজকাল?

চখা শুধোল বিল্টুকে।

কামের মধ্যে হেইটাই করি একমাত্র।

 তারপরই বলল, হ। ভালো কথা মনে পড়াইছস।

কী?

তরে প্রতিমাদি দেখা করনের লইগ্যা ডাকছেন। আমারে কয়্যা দিছেন।

এখন প্রতিমাদি কি গৌরীপুরেই আছেন?

 হ। বয়স ত হইতাছে আস্তে আস্তে।

বিয়ে করেননি?

করছেন। প্রমথেশ বড়ুয়া কলেজের প্রফেসর পান্ডে সাহেবরে। এহনে তাঁর নাম হয়্যা গিছে। প্রতিমা বড়ুয়া পান্ডে।

নিমাইদা জিজ্ঞেস করলেন, এই প্রতিমাদি কে?

প্রতিমা বড়ুয়া। লালজি, মানে, প্রকৃতীশ বড়য়ার মেয়ে আর প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাইঝি। নাম শোনেননি ওঁর? গোয়ালপাড়িয়া গানে উনি ভারত-বিখ্যাত। পদ্মশ্রী, সংগীত-নাটক অ্যাকাডেমির অ্যাওয়ার্ড সবই পেয়েছেন। মাহুতের গান, হাতির গান, আরও কতরকমের গান গেয়ে নিম্ন আসামের এই গোয়ালপাড়া জেলাকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন। পার্বতী বড়য়ার নামও নিশ্চয়ই পড়েছেন কাগজে। লালজির মৃত্যুর পরে উনিই তো এখন ডুয়ার্সের জঙ্গলের মধ্যের নানা জনপদে অত্যাচার-করা জংলি হাতির দলকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধে। আগে যে দায়িত্ব, তাঁর বাবা লালজির ওপরেই অনেকদিন ন্যস্ত ছিল।

বাবা:! তুমি এত জানলে কী করে?

নিমাইদা অবাক হয়ে বললেন চখাকে।

জানব না? গৌরীপুর ধুবড়ি তামাহাটে যে একসময়ে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি নিমাইদা। তা ছাড়া, পরবর্তী জীবনেও গৌরীপুরের রাজন্য এই বড়য়া পরিবারের অনেকের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল।

তারপর বিল্টুর দিকে ফিরে বলল, প্রতিমাদি কি প্যালেসেই আছেন?

 মাটিয়াবাগেই আছেন এহনে।

মাটিয়াবাগটা কী ব্যাপার হে চখা? কোনো জায়গার নাম যে তা তো বুঝছি। কিন্তু হাজারিবাগের ভায়রাভাই নাকি?

হাওড়া জেলার মানুষ নিমাইদা চখা অ্যাণ্ড কোম্পানির আক্রমণে উদ্ৰান্ত দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ে শুধোলেন।

মাটিয়াবাগ হচ্ছে গৌরীপুরের বড়ুয়া রাজাদের সামার প্যালেস। ওই প্যালেসেরই সামনে, ডান পাশে, প্রতাপ সিং-এর কবর আছে।

কে প্রতাপ সিং? ওদের পূর্বপুরুষ কেউ?

হেসে ফেললেন সকলেই নিমাইদার কথা শুনে।

চখা বলল, প্রতাপ সিং লালজির বড়ো প্রিয় হাতি ছিল। অত বড়ো হাতি বড়ো একটা দেখা যেত না তখনকার দিনেও ভারতে।

অ্যানথ্রাক্স রোগে পরে মারা যায় প্রতাপ সিং। প্রমথেশ এবং প্রকৃতীশ দুজনেরই অত্যন্ত প্রিয় ছিল সেই হাতি।

সমীরবাবু বললেন, শোনা না একখান গান চখাদারে।

বিল্টু কলিতা বলল, শুনাইলে শুধু একখান ক্যান শুনাম? অনেক গানই শুনাম। তবে ঘরে বইস্যা কি আমাগো গোয়ালপাড়িয়া গান গাইতে বা শুনাইতে ভালো পাওন পাওয়া যায়? চখা, তুই-ই ক?

চখা বলল, গা না। খারাপ পাওনের কী আছে?

তারপরই চখার দিকে ফিরে গলা নামিয়ে বলল, তর গৌরীপুরি চখি ত এহনে ধুবড়িতেই আছে। জানস কি তা?

অন্যরা একুট উৎসুক হয়ে চাইলেন কিন্তু অত্যুৎসাহী হওয়ার অসৌজন্য এড়ানোর জন্যে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।

চখা চোখ দিয়ে বিল্টুকে প্রসঙ্গান্তরে যেতে বলল, মুখে কিছু না বলে।

মুখে বলল, এখন একটি গান তো শোনা। তারপরে সমীরবাবু এবং মিসেস নিয়োগীও শোনাবেন। যে রাতে ধুবড়িতে এসে পৌঁছোলাম সার্কিট হাউসে, তামাহাট থেকে, সেই রাতেও ওঁরা এসেছিলেন। গানও গেয়েছিলেন।

নিমাইদা বললেন, আমি কিন্তু আজ গাইতে পারব না।

 বিল্টু রসিকতা না বুঝেই বলল, কেন?

কারণ, আমার গলা আজ ভালো নেই।

ও।

সকলেই মেনে নিলেন।

সমীর দাশগুপ্ত আর মিসেস নিয়োগীই একমাত্র বুঝলেন রসিকতাটা, নিমাইদা নিজে, আর চখা ছাড়া।

বিল্টু কোনো ভণিতা না করেই ধরে দিল :

দেহের কপাট খুলে দেখিলে হয়
দেহের আয়না খুলে দেখিলে হয়
মনের মানুষ কোথায় পাওয়া যায়।
যেমন আন্ধার ঘরে
 সাপ সোন্দাইলে
সারা রাইতে মন সাপের ভয়
মনের মানুষ কোথায় পাওয়া যায়।
যেন শিঙি মাছে
কাঁটা দিলে মন।
সর্ব অঙ্গ জ্বইলে যায়
 মনের মানুষ কোথায় পাওয়া যায়।

বাঃ বাঃ করে তারিফ করে উঠলেন নিমাইদা।

সাধুবাদ দিলেন সকলেই।

কিন্তু চখা ভাবছিল যে, বিল্টু ঠিকই বলেছিল। এইসব গোয়ালপাড়িয়া গান ঘরে বসে গাইবারও নয়, শোনবারও নয়।

এমন সময় হীরেন পাল আর গণেশ সেনও হাতে মিষ্টি পান আর একশো বিশ বাবা জর্দার কৌটো নিয়ে ঢুকলেন। নিমাইদা মিষ্টি পান খান। চখা আর ঝন্টুও জর্দা পান খেল।

বিল্টু বলল, গুয়া পান আনেন নাই আমার লইগ্যা বুঝি?

 আরে। আইন্যা দিতাছি। যামু আর আমু।

বলেই, হীরেনবাবু নদীপারে রাস্তার মোড়ের পানের দোকানে ছুটলেন।

 গুয়াটা কী জিনিস?

 দীপ্তি বউদি বললেন।

ঝন্টু বলল, আরে গুয়াহাটি শুনেছেন আর গুয়া শোনেননি? গুয়া, মানে সুপুরি। আগে যখন প্লেন নামত গৌহাটির বড়ঝর এয়ারপোর্টে তখন দীর্ঘপথ আসতে হত গৌহাটি পৌঁছাতে। সেই পথের দু-পাশেই সুপুরির সারি ছিল ঘন পথ বেয়ে। ইংরেজরা গুয়াহাটিকে বলত গহাটি। ব্যাটাদের জিভ ভারী তো! তার থেকেই বাংলাতে গৌহাটি। আসলে সুপুরির হাট ছিল ওখানে মস্ত বড়ো, তা থেকেই নাম গুয়াহাটি।

চখা বলল, সেই গানটা গা তো রে বিল্টু। সেই, ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…

আরে ও সমীরদা, এট্টু চা-ও ত খাওয়াইবেন নাকি? আমি না হয় চখা চক্কোত্তির মতন ফ্যামাস নাই হইলাম! গান কি শুকনা গলায় হয় নাহি?

সঙ্গে সঙ্গে গণেশবাবুও বাইরে গিয়ে বাবুর্চিখানাতে চায়ের কথা বলতে গেলেন। এক-দু পটের কম্ম তো নয়!

এমন সময়ে রাজা, রুবি আর ইতু এসে ঢুকল ঘরে।

চখা বলল, এসো এসো। ঠিক সময়েই এসেছ।

তারপর সকলের সঙ্গে ওদের আলাপ করাতে যেতেই সমীরবাবু বললেন, আরে মায়ের সঙ্গে মাসির আলাপ করিয়ে আর কী হবে? ধুবড়ি গৌরীপুর তো আর আপনাদের কলকাতা নয় স্যার? ছোটো জায়গা। দিল-এ নয়, আয়তনে। আমরা সকলেই সকলকে চিনি।

মিসেস নিয়োগী বললেন, ইতু তো নাটকও করে নিয়মিত।

সবুজের আসরে?

তাও করে। আর আমাদের অন্য ক্লাবও আছে।

 চখা বলল, বিয়ে-থা করেনি ইতু, কিছু তো নিয়ে থাকবে একটা!

নিমাইদা বললেন, নাটক জীবনে না করে মঞ্চে করছে–ভালো। কী বল ইতু?

ইতু হাসল।

 এবারে ধর তুই বিল্টু। শোনেনা তোমরা বিল্টুর গান।

 চখা বলল।

 সমীরবাবু বললেন রুবি কিন্ত আলিপুরদুয়ারের মেয়ে।

তাই? কালকে আলিপুরদুয়ার থেকে একজন আসবেন আমার কাছে। অ্যাডভোকেট এবং জুনিয়র পাবলিক প্রসিক্টর তপন সেন। চেনো নাকি?

চখা বলল।

তপন সেন? আমাদের তপনদা নয় তো? বলেই তার স্বামী রাজার দিকে তাকাল।

রাজা বলল, বিয়ের আগে তোমার তো কত দাদাই ছিল। তপনদাটি কে, তা আমি কী করে জানব?

রুবি লজ্জিত হয়ে বলল, এত অসভ্য না!

সকলেই হেসে উঠলেন রাজার কথাতে।

 রুবি বলল, তপনদা আমার দিদির ক্লাসফ্রেণ্ড।

 নিমাইদা বললেন, যাকগে আনসিন কোশ্চেন তপন সেনকে তাহলে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো। এক্সপ্ল্যানেশন দিলে, তোমার দিদিই দেবেন।

এবার শুরু কর বিল্টু।

 চখা বলল।

হ্যাঁ।

বিল্টু দুবার গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করল। তার আগে বলল, বগার গান শোননের আউগ্যা অন্য একটা শোন। রসের গান।

তারপরেই মিসেস নিয়োগীর দিকে ফিরে বলল, নন্দাদি, খারাপ পাইয়েন না য্যান আবার।

 মিসেস নিয়োগী লজ্জিত হয়ে হেসে বললেন, আপনারে ত চিনিই আমরা হক্কলেই। খারাপ পাওনের আছেটা কী? গান তো আর আপনে বান্ধেন নাই। খারাপ পাওনের কিছুই নাই। গায়েন আপনি।

 না, তা না হয়। এ গুলান আবার ফ্যামাস মানষি ত! তাই আগেভাগে কয়্যা গুলাম আর কী?

বিল্টু গান শুরু না করে চখাকে বলল, নন্দাদি কিন্তু খুব ভালো শুঁটকি মাছ রান্ধন তা কি জানস? লইট্যা, চিংড়ি, শীতল শুঁটকি। খাওয়ান নাই তরে?

পরক্ষণেই মিসেস নিয়োগীর দিকে ফিরে বলল, ছিঃ ছিঃ নন্দাদি।

উনি বললেন, এঁদের সময় কোথায়? প্রতিরাতেই তো হাউস-ফুল। অ্যাডভান্স-বুকিং হইয়া গ্যাছে গিয়া। একপ্রহরও খালি নাই। উনাগো খাওয়াইতে পারন ত ভাগ্যের কথা।

আমি কিন্তু ওইসব বিজাতীয় শুঁটকি-মুটকি খাই না। চখাও যে খায়, তা তো জানা ছিল না।

নিমাইদা বললেন।

তাই?

বিল্টু কলিতা বলল।

তারপরেই ধরে দিল গান। একেবারে তারাতে। বিল্টু যখনই গায়, তখনই তারাতে।

ভাগিনারে, তোর স্বভাব ভালো নয়
ভাগিনা গেইল মাছ মারিতে
মামি গেইল তার খলাই ধরিতে
কাদো জলে মাছ না পায়্যা ভাগিনা,
কাদো ছিটায় মামির গায়।
হায়! হায়! ভাগিনারে!
 তোর স্বভাব ভালো নয়।

সমীরবাবু বললেন, এবার থামো বিল্টু মহারাজ। অন্তরাটা আর নাই গাইলে। যে গানটি চখাদা রিকোয়েস্ট করলেন, সেইটাই বরং গাও।

 ক্যান? খারাপ পাইলেন কি আপনেরা? না খারাপ গাইলাম মুই?

হে কথা কেউই কয় নাই। ভ্যারাইটির কথা হইতাছে। নানারকম গান ত আছে আমাগো, নাকি?

হীরেনবাবু বললেন।

হীরেনবাবু কবিও। তাঁর একটি কবিতা সংকলন উত্তরণ চখা এবং নিমাইদাকে দিয়েছেনও উনি।

আজি ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে
 ফান্দ বসাইছে ফান্দি ভাইয়া রে
পুঁটি মাছ দিয়া
পুঁটি মাছের লোভে বগা
পরে উধাও দিয়া রে।
ফান্দেতে পড়িয়া বগা করে টানাটুনা
আহা রে কুমকুরা সুতা
হইল লোহার গুণারে…

গাইল বিল্টু।

তারপর?

নিমাইদা শুধোলেন।

তারপর আর গামু না। অগো ভ্যারাইটি দেখাইতেছি।

 সকলেই বিল্টুর ওই কথাতে হেসে উঠলেন।

 সমীরদা, তুমি এবার একখান গান শুনাও দেহি চখাদারে।

বিল্টু বলল।

সমীরবাবু বললেন, আমার গলাটা আজ ভালো নেই।

 নিমাইদা বললেন, আজ অবধি কোনো গায়ক-গায়িকার গলা যে ভালো আছে এমন কথা তো শুনিনি।

সকলেই সেকথাতেও হেসে উঠলেন।

সমীরবাবু দুবার গলা খাঁকরেই ধরে দিলেন :

হুটুককারা আসিলেন বাড়ি সুট করিয়া কং।
দাদা আসছে নিয়া যাবার নাইয়োর যাবার চাং।
মাদাদিনে আসছে দাদা যদি বা না যাং।
গোসা হয়্যা যাবেন দাদা (কথাটা) কেমন কইরা কং।
 মনটা মোর একবার আগায়, পাঁচবারে ভাটায়।
হোলোক-পোলক মন মোর যাবার না চায়।

চখা বলল, এই গানটা নিখিলেশ পুরকাইত মশায়ের লেখা গোয়ালপাড়িয়া ভাষা ও লোকসাহিত্য শীর্ষক একটি প্রবন্ধে দেখেছিলাম। তাই না?

 তা ত দ্যাখবাই। আমাগো গৌরমোহন রায়ও একখান গ্রন্থ লিখছেন কাষ্ঠের দোতারা করে রাও। তাতেও মেলাই গোয়ালপাড়িয়া গান পাবাঅনে।

নিমাইদা বললেন, ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে এই গানটি, শুনেছি, লিখেছিলেন জিতেন মৈত্র নামক কুচবিহারের এক ভদ্রলোক আর সুর দিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন সাহেব।

তারপর বললেন, উত্তরবঙ্গীয় ভাষা আর গোয়ালপাড়িয়া ভাষা কি এক?

না, এক নয়। কিন্তু খুবই কাছাকাছি বলা যায়। গোয়ালপাড়িয়া ভাষার সঙ্গে অধুনা বাংলাদেশের রংপুর জেলার ভাষারও খুবই মিল আছে।

সমীরবাবু বললেন।

তারপর বললেন, আব্বাসউদ্দিন সাহেবের গলাতে এই গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু প্রকৃত সত্য কী, তা যোগ্য জনেদের কাছ থেকে জেনে আপনাকে জানাতে পারি। কলকাতাতে লিখব নিমাইদা আপনাকে।

হ্যাঁ। একটু জানাবেন তো স্যার।

অতি-বিনয়ী নিমাই ভট্টাচার্য বললেন।

এমন সময়ে চা এসে গেল।

চখা বলল, আগে পান খেয়ে ফেলেছি। এখন আমি আর চা খাব না। তুই আর একটা গান শোনা বিল্টু। কবে আবার দেখা হবে কে বলতে পারে!

হইলেই হয়। তুই-ই ত দেখি ডুমুরের ফুল হইছস।

গা, গা। বড়ো কথা বলিস তুই।

চখা ওকে দাবিয়ে দিয়ে বলল।

 বিল্টু চা-টা খেয়েই গান ধরল :

অ মোর নদী রে অ মোর গঙ্গাধর নদী।
কোন বা দোষে বৈরী রে আমি
আজি ভাঙিয়া নিলু তুই সুখের বাড়ি
এলা বেয়াই পরার বাড়িত থাকিবে।
এহেনো মোর সোনার মাটি
ভাঙিয়া নিলু নদী কূলকিনারী
করিলু নদী পথের ভিখারি রে।
তোর গঙ্গাধরের পাগলারে মতি
ভাঙিয়া নিলু খেতের মাটি
আরও ভাঙিলু তুই নয়া পিরিতেরে।
 ও মোর নদী রে….।

ঝন্টু বলল, এগুলো কী গান? আমি নিজে গোয়ালপাড়িয়া হয়েও তো এসব গান শুনিনি কখনো।

চখা বলল, তুই তো ওই গৌরবেই গোয়ালপাড়িয়া। ছেলেবেলাতে পড়লি কুচবিহারে, তারপরে গেলি কলকাতায়। আর তার ওপর গত তিরিশ বছর তো বিহারিই হয়ে গেছিস। লালুপ্রসাদ যাদবের চেলা।

তা যা বলেছ।

কবুল করল ঝন্টু।

চখা বলল, বিল্টু, সমীরবাবু এবং অন্য সকলকেই, খুব ইচ্ছা করে যে, এখানে এসে বেশ কিছুদিন থাকি। গোয়ালপাড়ার মানুষ, নদী, চর, পাহাড়, জঙ্গল, গান এইসব নিয়ে বড়ো এবং সিরিয়াস কিছু লিখি। কিন্তু সময় কি আর হবে?

 বিল্টু বলল, ছিরিয়াছ লিখতে চাইলে কুনো আপত্তি নাই কিন্তু ফেরোছাস লিখিস না য্যান ভাইডি।

সকলেই হেসে উঠল ওর কথায়।

ঝন্টু বলল, বেশি সিরিয়াস হলে তো আবার আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাবে। দেখো, যেন তা না হয়।

অত বিদ্যাবুদ্ধিই আমার নেই। আমি লিখলে সকলে যাতে বুঝতে পারে তেমন করেই লিখব। পন্ডিত পাঠকদের জন্যে পন্ডিত লেখকেরা তো আছেনই! আমি সাধারণের লেখক। যাদের হাতে-পায়ে ধুলো, গায়ে ঘামের গন্ধ, আমার স্বদেশের মাটিতে যাদের শিকড় ছড়ানো।

তারপর বলল, সকলকেই উদ্দেশ করে, আপনারা তো এই গোয়ালপাড়িয়া গান সম্বন্ধে অনেকই জানেন। আমাদের কিছু বলুন না, শুনি!

বিল্টু বলল, গানের কি শ্যাষ আছে নাহি? ভাওয়াইয়ারই মইধ্যে পড়ে ওই গানখান।

ওই ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে অথবা ধর,

গৌরীপুরের শহরে হাউয়াই ছাড়িছে
 মোর কামবকতির দুখের কথা নাই কং বাপ মাওকে।
কী আবাগীর মনে কয় দেখি আইসং যায়্যারে।

ঝন্টু বলল, কামবকতি শব্দটা উর্দু কামবক্ত থেকে এসেছে কি?

অবশ্যই। ভাষা এক দারুণ মজার জিনিস। ভাষাবিদ হতে পারার মতন আনন্দ আর নেই। দুস। জীবনটা এতই ছোটো যে, কিছুই হওয়া হল না জীবনে। অন্নচিন্তা চমৎকারা। তাই করেই জীবন গেল।

 সমীরবাবু বললেন।

নিমাইদা বললেন, কথাটা ঠিকই বলেছেন সমীরবাবু। প্রাণীমাত্রকেই বেঁচে থাকতে হলে খাওয়ার চিন্তা করতেই হয়। বাঘ হরিণ ধরে, সাপে ব্যাং, আমরা রোজগার করি জীবনধারণের জন্যে। করতে হয়। কিন্তু এইসবই জীবিকা। জীবন নয়। জীবনকে যদি জীবিকার নখ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারেন তাহলে সবই বৃথা। জীবিকা আর জীবনের তফাত বোঝে শুধুমাত্র মানুষেই। আমরা যে বিধাতার সৃষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। জানোয়ারদের সঙ্গে আমাদের তফাত তো থাকবেই। মানে, থাকা উচিত অন্তত।

বলেই বলল, আরও কী কী গান আছে? বলুন না একটু আমাদের।

এবারে সমীরবাবু বললেন, চটকার কথা তো বিল্টু বললই।

একটা নমুনা দেখা না বিল্টু চটকার?

চখা বলল বিকে।

 বিল্টু সঙ্গে সঙ্গে ধরে দিল :

ও বন্ধু রে তোমার আশায় বসিয়া আছং বটবৃক্ষের
তলে মন মোর উরাং পারাং করে–

মনে পড়ে গেল চখার যে, তামাহাটের গঙ্গাধরের আর তামা নদীর সংগমে সেদিন সূর্যাস্তবেলাতে ভগুয়া আকাশের পটভূমিতে গাছতলাতে বসে ছেলেটি এই গানটিই গাইছিল। নাকি অন্য গান?

 এ ছাড়াও নানা গান আছে। যেমন চাঁচর, ভাসান, দেহতত্ত্বের গান, খেদা করে বা ফাঁদে বুনোহাতি ধরার পরে সেই হাতিদের শিক্ষার গান, কুশান গান।

কুশান গানের আবার চারটি ভাগ আছে। বন্দনা, সরস্বতীর আরাধনা, মূলের আরাধনা ও মূল পালা। কুশান গান আসলে রামায়ণ গান।

মিসেস নিয়োগী বললেন, কৃত্তিবাস, এ-অঞ্চলে অত্যন্ত পূজ্য কবি। কারণ অসমিয়া কবি মাধব কন্দলীর রামায়ণ প্রথমে ছাপা হয় ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। ততদিনে কৃত্তিবাসী রামায়ণ শিকড় পেয়ে গেছিল এখানে।

আর কী কী গান আছে?

ধুবড়ি জেলাতে সর্পদেবী মনসার গানও জনপ্রিয়। এদিকে নারায়ণদেব ও উত্তরবঙ্গে জগজ্জীবন ঘোষালের পুথি অনুসরণে মনসার গান গাওয়া হয়ে থাকে।

হীরেনবাবু বললেন।

সমীরবাবু বললেন, আরও আছে। গোরুদের দেবতা গোন্নাথের কাহিনি নিয়ে গোন্নাথের পাঁচালি। বাঁশের দেবতা মদনকামকে নিয়েও, মানে তাঁর পুজোর জন্যেও অনেক গান আছে। তাকে বলে মদনকামের গান। বাঘেদের দেবতা সোনা রায়ের গানও আছে। বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্যে এই গানের উদ্ভব। পৌষ মাসের প্রথম দিন থেকে ফুলের সাজি হাতে নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে এই গান গাওয়া হয়।

ঝন্টু বলল, এখনও?

হায়! হায়! এখন কোথায় বাঘ?

আমার বাবা একটা চিতাবাঘ মেরেছিলেন আমাদের গদিঘরের পাশের মুরগির খাঁচারই মধ্যে। মুরগি ধরতে ঢুকেছিল রাতে। ছোটো চিতা। আর এখন তপস্যা করতে হয় বাঘ দেখতে।

মিসেস নিয়োগী বললেন, ধুবড়ি অঞ্চলে একটিমাত্র লোকগীতি নমলকাতির কথা জানি। কার্তিক দেবতার পুজো করা হয় এই গানে।

কার্তিক পুজো তো কলকাতায় সব খারাপ পাড়াতেই হয় বলে জানি। মানে, সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি।

নিমাইদা বললেন।

 বিল্টু বলল, আইপনাগো কইলকাতার কথা ছাড়ান দ্যান দেহি। জায়গাই খারাপ। তাই তার নজরডাই খারাপ।

সমীরবাবু বললেন, নমলকাতি অবশ্য মেয়েদেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। দেবতা হিসেবে কার্তিক তো সর্বত্রই মেয়েদেরই উপাস্য। কথাই তো আছে কার্তিকের মতন বর। তবে একজন মাত্র পুরুষ এই গানে অংশগ্রহণ করে। সে হল ঢাকি। কিন্তু সেও বাড়ির বাইরে থেকেই বাজায়। এই নমলকাতি পুজো শুরু হয় কার্তিক সংক্রান্তিতে। আর চলে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি পর্যন্ত। তাই এই পুজোকে অকালের কার্তিক পুজো বলা হয়ে থাকে। এই নাটকের পাঁচটি ভাগ। মানে, নাটকের পাঁচটি দৃশ্য।

কী কী? চখা জিজ্ঞেস করল।

কাতিসজ্জন, কাতিকামান, কাতিঘামান, নাচপর্ব এবং সবশেষে আগনেওয়া। আগনেওয়াতে আবার চাষবাসের পুরো প্রক্রিয়াটাই অভিনয় করে দেখানো হয়। তবে এই নাটকে গীদালি মহিলাদের ভূমিকাই সবচেয়ে বড়ো। নাচনি মহিলারাও থাকেন যদিও।

গীদালি মানে?

নিমাইদা জিজ্ঞেস করলেন।

গীদালি মানে, গায়িকা।

তাই? বাঃ। গীতালি মানেও কি গায়িকা? কী ঝন্টু?

ভালো লোককেই জিজ্ঞেস করেছেন।

 ঝন্টু বলল, লজ্জিত হয়ে।

তারপর ওঁদের জিজ্ঞেস করল যে, গোয়ালপাড়িয়া গান সম্বন্ধে বিশদভাবে কে বলতে পারেন?

অনেকেই পারেন। গৌরীপুরের প্রতিমা বড়য়া পান্ডে তো পারেনই। তা ছাড়া আরও অনেকেই আছেন। ভূপেন হাজারিকার সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন কলকাতায়। উনি না থাকলে প্রতিমা বড়ুয়া আজ এত পরিচিতি পেতেন না। গ্রেট মানুষ আমাদের ভূপেনদা।

সমীরবাবু বললেন, ধুবড়ি বা গৌরীপুর মিউজিক কলেজ অথবা সবুজের আসর-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন। তাঁরাও হদিশ দিতে পারেন গুণীজনদের।

ঝন্টু বলল, ধুবড়ি বইমেলার উদ্যোক্তা তো তাঁরাই?

হ্যাঁ।

 ঠিকানা তো জানি না।

আমরাই তো ঠিকানা। তবু লিখে নিন।

বললেন, সমীরবাবু।

বলুন।

সবুজের আসর, নেতাজি সুভাষ রোড, ধুবড়ি, আসাম। পিনকোড ৭৮৩৩০১।

থ্যাঙ্ক উ।

বলল, ঝন্টু।

বিল্টু বলল, মুই এখনই চইল্যা যা গৌরীপুরে। তুই আইবি ত? কবে আইবি তাই ক? প্রতিমাদি কিন্তু বারংবার কয়্যা দিছে।

যাব।

কবে?

পড়শু যামু কয়্যা দিস। সকালে যামু।

আমার বাড়িত খাইতে অইব কিন্তু। মহামায়ার মন্দিরে যাবি না? আর আশারিকান্দি?

আশারিকান্দিটা কী জিনিস?

 দীপ্তি বউদি এতক্ষণ পরে কথা বললেন।

 জিনিস নয় বউদি। একটি গ্রাম। গৌরীপুরের কাছেই। দেশভাগের সময়ে পাবনা জেলা থেকে এসেছিলেন পাল পরিবার। পোড়ামাটির নানা জিনিস বানান তাঁরা। দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে পৌঁছোয়।

মিসেস নিয়োগী বললেন চখাকে, বা: আপনি তো আমাদের ভাষা বেশ ভালোই বলেন।

আমি তো গড়িয়াহাটের মোড়ে হেলিকপ্টার থেকে পড়ে সাহিত্যিক হইনি মেমসাহেব। আমি বাঙাল। আমি উদবাস্তু। অতিসাধারণ আমি। এই মিষ্টি গন্ধ মাটি, এই একূল-ওকূল দেখা-না-যাওয়া নদী, ঘুঘু, কবুতর এবং চখা-চখির ডাক, হাঁসেদের প্যাঁকপ্যাঁকানি, নদীর বিস্তীর্ণ উদাসী চর, দগদগে ঘা-এর মতন ভাঙা পাড়, পাট-পচানোর আর গুয়ার গন্ধ, পাটকাঁচার শব্দ, মাদারের আর ভেরেন্ডার ফুলের ভাগুয়া রং, গোরুর গাড়ির ক্যাঁচোর কোঁচোরের রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ, শব্দেরই মধ্যেই আমি বড়ো হয়ে উঠেছি। ঈশ্বর করুন যেন, যে বাংলাদেশে বড়ো হয়েছি, রংপুর, বরিশাল, ধুবড়ি গৌরীপুর, তামাহাট, যেখানে আমার ছেলেবেলার অনেকখানি কেটেছে, আমি যেন চিরদিন এদেরই থাকি।

নিমাইদা বললেন, ব্রাভো!

বক্তৃতার মতন শোনল কি?

চখা বলল, লজ্জিত গলায়।

 তা একটু শোনাল বই কী। কিন্তু খারাপ লাগল না।

স্বদেশ, স্বভূমি, স্বদেশের মানুষের প্রসঙ্গ উঠলেই আমার গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে ওঠে নিমাইদা। গলার স্বর বুজে আসে। এ এক দুরারোগ্য রোগ।

চখা বলল।

 নিমাইদা বললেন, এই রোগ, তোমার যেন কোনোদিনও নিরাময় না হয় চখা। এই প্রার্থনা করি।

আজ বইমেলাতে বাংলা সাহিত্যের অধিবেশন ছিল।

 ধুবড়ির মতন ছোটো শহরে, যেখানে কলকাতা বা গুয়াহাটি থেকে যেতে হলে বাস বা জলপথ ছাড়া সরাসরি পৌঁছোনোর উপায় নেই, সেখানে এত মানুষে যে বাংলা এবং অসমিয়া সাহিত্য ও গ্রন্থ সম্বন্ধে উৎসাহী আছেন, এই কথা ভাবলেও অবাক হতে হয়। ট্রেনে গিয়ে পৌঁছোনো যে যায় না তা নয়। তবে, অনেকই ঘুরে। সরাসরি পৌঁছোনো যায় না মানে প্রধান রেলপথে হয় নিউ কুচবিহার হয়ে আসতে হয়, নয় মটরঝার অথবা গোসাইগাঁও বঙ্গাইগাও বা গোলকগঞ্জ হয়ে। নিউ কুচবিহার থেকে দ্রুতগামী ট্রেন পাওয়া যায় কলকাতা বা গুয়াহাটির। দ্রুতগামী হলে কী হয়, দিনে গড়ে ছ থেকে আট ঘণ্টা লেট থাকে সেইসব গাড়ি। যাঁরা উড়োজাহাজে আসতে চান তাঁরা বাগডোগরা বা গুয়াহাটিতে পৌঁছে সেখান থেকে আসতে পারেন। চখার তো গাড়িতেই আট ঘণ্টা লেগেছিল তামাহাটে পৌঁছোতে। শুনেছে, চালক ভুল পথে আসাতেই অত সময় লেগেছিল। ঘণ্টা পাঁচেক নাকি লাগে।

আগে ধুবড়ির কাছে রূপসিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অ্যামেরিকানদের তৈরি করা এয়ারস্ট্রিপ ছিল। তা এখন জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে. ল্যানটানার জঙ্গল আগেও ছিল। চিতাবাঘের আস্তানা ছিল। সুখের কথা এই যে, এখন সেখানে একটি অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। কুচবিহারে আগে বায়ুদূতের ছোটো প্লেন যেত। বহুদিন হল তাও বন্ধ আছে।

সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য আজকের অধিবেশনে চমৎকার বক্তৃতা দিলেন। তিনি আগে সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিক ও রাজনীতিক এবং অবশ্যই অধ্যাপকেরাও স্বভাবতই খুবই ভালো বক্তা হন। আর চখা চক্রবর্তী মোটে কথাই বলতে পারে না। সে যদি কথাই বলতে পারত ভালো, তবে লেখক না হয়ে হয়তো সুবক্তা হবার সাধনাই করত।

সবুজের আসর পরিচালিত ধুবড়ি ও গৌরীপুর মিউজিক কলেজের ছেলেমেয়েরাও অত্যন্ত ভালো অনুষ্ঠান করেছিলেন।

বইমেলাতে গান-বাজনার অনুষ্ঠান থাকা আদৌ বাঞ্ছনীয় কি নয় সেই তর্কে না গিয়েও, ও বলবে যে, ওর মনে হয়েছি যে তাতে কোনো দোষ আদৌ ঘটেনি। যে জায়গাতে কখনোই বইমেলা হয়নি আগে সেখানে বইমেলা সম্বন্ধে আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার জন্যে এমন অনুষ্ঠানের অবশ্যই প্রয়োজন আছে বই কী। এই বইমেলা বাঙালি ও অহমিয়াদের মধ্যে গান গাওয়ার, গান শোনার, বই পড়ার, বই ভালোবাসার ও বই নিজেরা কিনে উপহার দেওয়ার অভ্যেসকে দৃঢ়মূল যখন করবে, একদিন তা করবেই, সেদিন আর অন্য অনুষ্ঠানের প্রয়োজন নাও হতে পারে। তখন শুধুমাত্র সাহিত্য, ভাষা এবং সেইসব সম্পর্কিত বিষয়ের ওপরেই তর্ক, সেমিনার, একক বক্তৃতা ইত্যাদির আয়োজন তাঁরা করতে পারেন।

অধিবেশনের পরে মেলাপ্রাঙ্গণেই ছিল ও। নিমাইঁদারাও ছিলেন। ছিলেন উদ্যোক্তারাও।

 চখা যা বলেছিল ফিঙেকে, তাই সত্যি হল। মেলাতে নিজের বক্তব্য শেষ করে, উদ্যোক্তাদের বিশেষ অনুরোধে দু-খানি গানও গাইতে হয়েছিল ওকে।

অগণ্য পাঠক-পাঠিকাদের স্বাক্ষর দেওয়া এবং বহুদিন আগে শেষ দেখা-হওয়া অসংখ্য পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে যখন ঘড়ির দিকে তাকাবার সময় হল তার, তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা বেজে গেছিল। সার্কিট-হাউসের সামনের নদীপারে আর যাওয়া হল না। তা ছাড়া, সে এখন এমনই পরিবেষ্টিত যে, এই পরিবেশে এবং প্রতিবেশে এখন ফিঙের কথা ভাবার সময়ও নেই।

বেচারি ফিঙে!

 সে নিশ্চয়ই একঘণ্টা বসে থেকে চলে গেছে। কিন্তু চখা নিরুপায়। সে যে যেতে নাও পারতে পারে সেকথা তো আগেই জানিয়ে দিয়েছিল।

.

০৬.

আজ রাঙাপিসির বড়ো মেয়ে বুড় তাকে রাতে খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিল। নিমাইদা বউদিকেও করেছিল। বলেছিল, ছ্যাপ ছ্যাপ খাওয়াবে।

সেটা কী বস্তু? জানতে চাওয়াতে চখাকে বলেছিল নেপালি বিরিয়ানি। দই দিয়ে রাঁধতে হয়। দাতু নাকি ওকে শিখিয়েছে। ওর বড়ো জা নাকি খুব ভালো শীতল শুঁটকিও রাঁধেন। তিনিও চখার জন্যে শুঁটকি মাছ রান্না করবেন। বুড় এও বলেছিল, দাদা, শুনছি, তুমি কলম খুব ভালোবাসো। তোমার জন্যে একখান কলম কিইন্যা থুইছি। নিমাইবাবুর জন্যেও।

শুনে অভিভূত হয়েছিল চখা।

মানুষের অর্থের সঙ্গে মনের প্রসারতার কোনো সাযুজ্যই ছিল না কোনোদিনই। অল্পবয়সে স্বামীহারা বুড় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। কতই বা মাইনে পায় সে! একই মেয়ে ওর। এবারে নাকি হায়ার-সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দেবে। যৌথ-পরিবারে থাকে বলে, শ্বশুরের ভিটে ছিল বলে, দিন চলে যায় সাধারণভাবে। অথচ সেই মেয়েরই মন কত বড়ো! যে-দাদা, তাকে দেওয়ার মতন কিছুই দেয়নি কোনোদিনও, যার সঙ্গে জীবনে দেখাই হয়েছে কয়েকবার মাত্র সেই দাদারই জন্যে কত খরচ করছে। কত যত্নে সব ভালোবাসার পদ বেঁধে খাওয়াচ্ছে।

টাকার পরিমাপ তাও করা যায়, মানে, উপহারের অর্থমূল্য, কিন্তু ভালোবাসার পরিমাপ তো করা যায় না। কোনোদিনও নয়। ভালোবাসা, সে প্রেমিকের প্রতিই হোক, কি দাদার প্রতিই, যে ভালোবাসে আর যে সেই ভালবাসা পায়, তাদের দুজনের অন্তরে যে এক গভীর সুখানুভূতির সৃষ্টি করে, তার গভীরতা মাপার মতো যন্ত্র এই রাক্ষুসে বিজ্ঞানের অত্যাচারের দিনেও আবিষ্কৃত যে হয়নি,এইটাই সান্ত্বনার কথা। ঈশ্বর করুন, সেই যন্ত্র যেন কোনোদিনও আবিষ্কৃত না হয়।

গতকাল রাতে নেমন্তন্ন ছিল শিবাজিদের বাড়িতে। ধুবড়ির টাউন স্টোর্স-এর শিবাজি রায়। তার স্ত্রী গৌরী এবং খুড়তুতো ভাইদের স্ত্রীরা সকলে মিলে অনেক যত্ন করে খাইয়েছিল।

 তাদের লোন অফিস লেনের বাড়িতে শিবাজির মায়ের আদেশ ফেলতে পারেনি চখা। তারও আগের দিন নেমন্তন্ন ছিল ইতু-মানা-রাজা-রুবিদের বাড়ি। ছাতিনায়নতলাতে। দারুণ খিচুড়ি বেঁধেছিল মানা, চখারই অনুরোধে। রাজা-রুবি অন্য অনেক কিছু খাইয়েছিল। ইতু সান্নিধ্য দিয়েছিল। চশমা-পরা স্টেট-ট্রান্সপোর্টে কাজ করা, ইতুর দিকে চেয়ে চখার ফ্ৰকপরা যে কিশোরীটি কিশোর চখাকে নদীপারের পথ দিয়ে হাত ধরে হাঁটতে নিয়ে যেত, তার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

বইমেলার উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান রামপ্রসন্ন ভট্টাচার্যি মশায় সংস্কৃত অধ্যাপক ছিলেন। অত্যন্তই পন্ডিত ব্যক্তি। চখা, বইমেলা উদবোধনের দিন সকালে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়া মাত্রই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল। তবে তাঁর পান্ডিত্যের গভীরতা বুঝতে পারল শুধু তখনই যখন চখা সভাতে নিমাইচরণ মিত্রর লেখা একটি ব্রহ্মসংগীত গাইবার সময়ে উল্লেখ করেছিল যে, ওই গানটি উপনিষদের একটি শ্লোক-নির্ভর। গান গাওয়ার পরেই যখন সে রামপ্রসন্নবাবুর পাশে গিয়ে বসল মঞ্চের ওপরে তখন উনি ফিসফিস করে বললেন, শ্লোকটি কি অপানিপাদো জবনো গ্রহীতা…?

চখা অবাক হয়ে গেল তাঁর পান্ডিত্যে। শ্বেতাশ্বেতরোপনিষৎ-এ আছে ওই সংস্কৃত শ্লোকটি। কলকাতাতে অসংখ্যবার এই গানটা গেয়েছে ও বিভিন্ন জায়গাতে কিন্তু আজ পর্যন্ত উপনিষদের এই শ্লোকটির কথা সেখানে কেউই উল্লেখ করেননি।

কলকাতার অনেক কূপমন্ডুকই মনে করে থাকেন, যে যত বিদ্বান, বুদ্ধিমান পন্ডিত, সকলেই বুঝি একমাত্র কলকাতাতেই বাস করেন। পশ্চিমবঙ্গের, বিহারের, ওড়িশার এবং অসমের রাজধানীর কথা তো ছেড়েই দিলাম, ছোটো ছোটো মফসসল শহরেও এমন এমন পন্ডিতেরা বাস করেন, সব বিষয়েরই পন্ডিত, যাঁরা কলকাতার উচ্চমন্য এবং পন্ডিতমন্যদের কানে ধরে শেখাতে পারেন। শিক্ষার প্রধান দান যে বিনয়, সেই বিনয়ই কলকাতা-ভিত্তিক সাহিত্যিক-কবি-সাংবাদিক-অধ্যাপক-গবেষকদের অধিকাংশেরই নেই।

অগ্রজ রামপ্রসন্নবাবুর মতন মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাও পরমসৌভাগ্যের কথা।

আরও একজন অধ্যাপকের সঙ্গে এখানে এসে পরিচিত হল ও, তাঁর নাম দেবাশিস ভট্টাচার্য। বয়েসে অবশ্য তাঁকে তরুণই বলা চলে। তিনি গৌরীপুরের প্রমথেশ লাহিড়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের পল-সায়ান্স বিভাগের মুখ্য। তাঁর পান্ডিত্যের গভীরতা বোঝার সুযোগ হয়নি চখার বটে কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব, চেহারা ও কথাবার্তাতে মুগ্ধ হয়েছে ও।

নিমাইদা ও দীপ্তি বউদি এখন ফিরবেন না। অসমের গভর্নর নাকি নিমাইদার বন্ধু। গুয়াহাটি যাবেন নিমাইদা। বউদি নাকি কামাক্ষ্যা দেখেননি। তাই তাঁকে কামাক্ষ্যা দেখাবেন।

কাল সকালে চলে যেতে হবে ধুবড়ি থেকে। আবার এ জীবনে কখনো আসা হবে কি না জানা নেই। ছ-ছটি দিন, যেন স্বপ্নের মতনই কেটে গেল। কত অসমবয়েসি নারীপুরুষের ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, প্রশংসা পেল। সেসব পাবার যোগ্যতা চখার থাক আর নাই থাক।

বড়োই আবিষ্ট হয়ে আছে।

বুড়ুদের বাড়িতে সরষে দেওয়া প্রকান্ড বড়ো বড়ো টুকরোর আড় মাছের ঝাল, প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা কাজরি মাছের চচ্চড়ি, মুরগির মাংস, গরম ভাত দিয়ে শীতল শুঁটকি এবং ছ্যাপ ছ্যাপ খেয়ে যখন চখা, ঝন্টু, নিমাইদা এবং বউদি বেরোল তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা এগারোটা হবে। ছোটো শহরের পক্ষে, গভীর রাত। ক-দিন আগেই ইদ গেছে। শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলো কিছুটা আছে।

 বুড়ুর ভাসুর চখাদের অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেলেন, যদিও সার্কিট হাউস থেকে ওঁদের বাড়ি অত্যন্তই কাছে।

অন্ধকারে, নদী থেকে আসা হু হু হাওয়ার মধ্যে বড়ো বড়ো কিন্তু ছাড়া-ছাড়া গাছে ছাওয়া পথ বেয়ে সার্কিট-হাউসের দিকে হেঁটে আসতে আসতে ভাবছিল ও যে, এখানেই বাকি জীবনটুকু থেকে গেলেই বেশ হত। হাজার হাজার গাড়ি, বাস, ট্রাকের কর্ণবিদারী শব্দ, ডিজেল ও পেট্রোলের ধোঁয়াতে অন্ধকার, লোভে আর ঈর্ষাতে আর পরশ্রীকাতরতাতে জরজর নতুন রঙের পোঁচ লাগানো বহুতল বাড়ির অসুস্থ কলকাতাতে থাকতে আর ভালো লাগে না। এখানে বাহন বলতে রাখবে সাইকেল রিকশা। তাই বা কেন? সাইকেলই তো চমৎকার। ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজিয়ে চড়িতেছি সাইকেল দেখিতে কি পাও না? বলতে বলতে সারাপাড়া বেপাড়াতে চক্কর মেরে বেড়ানো যেত। একটি ছোট্ট ভাড়া বাড়ি, শহরের কিনারে, অথবা অনেক জমি নিয়ে নিজের বাড়ি, যেখানে এখনও বাঁশঝাড় আছে, রঙ্গনের ডালে মৌটুসি পাখি কিসকিস করে, হাঁস পোষা যায়, গ্রীষ্মের দুপুরে পেঁয়াজখসি রঙা শাড়ির উড়ন্ত আঁচলের মতন শব্দ করে যেখানে বাঁশবনের গা থেকে ফিকে হলুদরঙা খোলস বাতাসে খসে খসে উড়ে পড়ে, ঝোড়ো-হাওয়াতে কটকটি ব্যাঙের মতন বাঁশবনের বুকের কষ্ট ফুটে বেরোয়, যেখানে এখনও মাদার আর ভেরেন্ডার ফুল ফোটে, বসন্তে ও শীতে বেতবন দেখা যায়, বর্ষাতে মাকাল ফল তার মাতাল করা লালে জগৎ আলো করে ফুটে থাকে আজও এই কলুষিত পৃথিবীতে, তেমনই কোনো কোণে যদি কাটিয়ে দিতে পারত অনামা, অচেনা, খ্যাতিহীন একজন সাধরাণ অতিসাধারণ, মানুষের অসামান্য, অকৃত্রিম, আসাধারণ দুর্মূল্য মুর্শিদাবাদি বালাপোশেরই মতন সর্বাঙ্গে মুড়ে, তাহলে কী ভালোই না হত! কী ভালো!

কিন্তু তা হবার নয়।

কবি শ্যামল ঘোষ এবং তাঁর এক বন্ধু চখাকে নিউ কুচবিহার অবধি নিয়ে গিয়ে ট্রেনে তুলে দেবেন–কামরূপ এক্সপ্রেসে। আগের স্টপেজ নিউ-আলিপুরদুয়ার। যেখান থেকে চখার অন্ধ ভক্ত তপন সেন, অ্যাডভোকেট, এসেছিলেন ধুবড়ির বইমেলাতে শুধুমাত্র চখার সঙ্গেই দেখা করতে। একদিন থেকইে তিনি ফিরে গেছিলেন। উঠেছিলেন, ধুবড়ির মহামায়া হোটেলে।

কতরকম মনোমুগ্ধকর পাগলই থাকেন এই বিচিত্র পৃথিবীতে!

আর কালকে যে স্টেশন থেকে সে ট্রেনে উঠবে, সেই নিউ কুচবিহারের কাছেই কুচবিহার শহর। শেলি যেখানে থাকে। চখা সেই শহরে ঢুকবে না ইচ্ছে করেই।

 কৈশোরের স্বপ্ন প্রজাপতিরই মতন সুন্দর। সত্যিই তো শেলি এক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়! কোনো স্বপ্নের গায়েই আঙুল ছোঁয়াতে নেই। কাঁচপোকার গায়ের রঙেরই মতন সেইসব স্বপ্ন মসৃণ, উজ্জ্বল। সেইসব স্বপ্নকে তার স্মৃতিতে ঠিক তেমন করেই বাঁচিয়ে রাখতে চায় চখা। যেদিন তার চোখ চিতার আগুনে গলে যাবে সেদিন সেই সুন্দর স্বপ্নও গলে যাবে, নিঃশেষে। বাকি থাকবে না কিছুমাত্রই।

ঝন্টু শুয়ে পড়েছে।

নিমাইদা ও বউদিও ঘরে গেলেন।

 চখা দরজা ভেজিয়ে রেখে বাইরে এল। নদীপারে।

আজ শুক্লাষষ্ঠী। চাঁদ এখন সবে উঠছে। ফালি চাঁদ। আদিগন্ত সেই আশ্চর্য অস্পষ্ট চন্দ্রালোকে কারও আদরের অস্ফুট আলতো চুমুর ছোঁয়াতে জেগে ওঠারই মতন নদীচর যেন জেগে উঠছে। খুবই আস্তে আস্তে। জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকারে অস্পষ্ট বাঘকে যেমন ঘোলাটে সাদাটে দেখায়, ব্রহ্মপুত্রের জল ও বিস্তীর্ণ চরকেও তেমনই দেখাচ্ছিল। তার রূপ আস্তে আস্তে আরও ধবল কোমল হচ্ছে। ক্রমশ।

 হাওয়া বইছে জোরে। চুল উড়ছে চখার। পায়জামা-পাঞ্জাবি উড়ছে পতপত শব্দ করে। ধুবড়ি শহর এখন ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে গঙ্গাধর আর গঙ্গাধরের কোলে গৌরীপুর, কুমারগঞ্জ আর তামাহাট।

নদীর দিকে চেয়ে কেমন গা-ছমছম করে উঠল চখার।

এই আবছা, মোহময় এবং রহস্যময় রাতে কতদূর থেকে বয়ে-আসা এবং কতদূরে বয়ে যাওয়া ব্ৰহ্মপুত্র নদী, নদীর বিস্তীর্ণ দুধলি চর, যেন কত কী বলছিল চখাকে, ফিসফিস করে।

কে? ফিঙে?

কী বললে?

তুমি এসেছিলে?

মিথ্যে কথা।

সত্যি!

সত্যি?

তুমি খুব খারাপ।

কে যেন ফিসফিস করে বলল।

ফিঙেই কি?

হয়তো ফিঙেই।

হয়তো।

কী?

 আমি খারাপ। মার্জনা করে দিয়ে। একটা সময়ে আমার চেখে তুমিও খুব খারাপ ছিলে। আজ, তোমার চোখে আমি।

আবার অপার নিস্তব্ধতা।

এই রাতে, কারওকেই, কিছুকেই দেখা যায় না। নড়ে-চড়েও না কিছু। সব নদীই সব নারীরই মতন রহস্যময়। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চখার দু-চোখ ঝাপসা হয়ে এল।

 বেচারি ফিঙে। বেচারি চখা!

আকাশে অগণ্য তারারা মিটমিট করছে। কারা যেন তার অলক্ষ্যে চেয়ে আছেন নদীর দিক থেকে তার দিকে। নাকি নক্ষত্রলোক থেকে? পিসেমশাই, পূর্ণজেঠু, কড়িদা, বাপ্প, বড়দাদা, বৈদ্যকাকু, মানিকদা, ভানুদা-বউদি, ভারতীদি।

শচীন জামাইবাবু যেন বলছেন, তুমি এসেছিলে! এঁরা তোমাকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন বলে বড়োই খুশি হয়েছি আমরা। ভালো থেকো। ভালো থেকো।

চেক-চেক লুঙ্গি পরা আবু ছাত্তার আর কাসেম মিয়া আর তামাহাটের কাছের বাগডোরা গ্রামের টাট্টু ঘোড়াতে চেপে তামাহাটে হাটবারে হাট করতে আসা মুনসের সর্দারও যেন একইসঙ্গে বলে উঠলেন, আইছেন এদ্দিন পরে তা হইলে। আমাগো তো ভুইল্যাই গেছিলেন গিয়া। সালাম! সালাম!

কথা না বলে চখা বলল, আইলেকুম আসোলাম।

 কাসেম মিয়ার গলাতে একটি কালো আর হলুদ চেক-চেক মাফলার নদীর হাওয়াতে উড়ছে। শীত-গ্রীষ্ম সর্ব ঋতুতে যে মাফলার ছিল তার সঙ্গী, সেই মাফলার। মুনসের সর্দারের মাথায় সেই খয়েরি রঙা ফেজ টুপি। হাওয়াতে সেই টুপির ল্যাজ নড়ছে।

একটু পরেই পেছন থেকে কে যেন ডাকল, কী করছ এখানে?

 মুখ ফিরিয়ে চখা দেখল ঝন্টু। চখার বডিগার্ড। এবং নিতবর।

বলল, অনেক রাত হল। চলো শোবে। কাল সকালে তো বহুমানুষে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এবং বিদায় দিতে আসবেন।

চখা অস্ফুটে বলল হু।

তারপর বলল, চলো যাই।

সার্কিট-হাউসের দিকে ফিরে আসতে আসতে চখা ভাবছিল, যেন দ্বিরাগমনে আসারই মতন সে এঁদের নিমন্ত্রণে, এত মানুষের চাহিদাতে তার প্রিয় এবং পুরোনো ধুবড়ি গৌরীপুর তামাহাটে ফিরে এসেছিল বহুদিন পরে।

 ফিরে আসাটা বড়োই আনন্দের। এত মানুষের হৃদয়ের উত্তাপের কাছে থাকা বড়োই সুখের। কিন্তু সেই উষ্ণতা থেকে শীতার্ত পৃথিবীতে একা একা ফিরে-যাওয়াটা সুখের নয়। আদৌ নয়।

চখা জানে যে, কাল সকালে অনেকে মিলে তাকে ধুবড়ি সার্কিট-হাউসের হাতা থেকে যখন নিউ-কুচবিহার স্টেশনের দিকে রওয়ানা করিয়ে দেবেন গাড়িতে, তখন ওর গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠবে একটা। অনামা সেই বোধ।

তার নিতবরও এবারে তার সঙ্গে যাবে না ফেরার সময়ে।

ঝন্টু বলবে, আচ্ছা চখাদা! ভালোমতো যেয়ো তাহলে।

বিচ্ছিরি কলকাতার দিকে রওয়ানা দেবে প্রত্যানীত, নদীপারের এই শান্তির রাজ্য ছেড়ে।

একা একা।

ফিঙে তার ঘর এবং স্বামী-পুত্রকে ছেড়ে কাল সকালে যদি আসতে পারত, ভাবে চখা, তবে লোকভয় ত্যাগ করে ওকে সঙ্গে যেতে বলত নিউ-কুচবিহার স্টেশন অবধি। সঙ্গে অবশ্য শ্যামলেরাও থাকত। থাকলে থাকত।

মুখে মেয়েরা অনেক কিছুই বলে। ওসব কথারই কথা। ফিঙে সেই রাতেও আদৌ আসেনি। জানে চখা। যে বোধ ফিঙের মনে একটুও বেঁচে নেই, সেই বোধ আছে যে, এমনই ভাব সেদিন সকালে দেখিয়ে গেল।

মেয়েরা যখনই নোঙর ফেলে, তখনই টেনে-টুনে খুব ভালো করে দেখে নেয়, হঠাৎ ঝড়ে বা জোয়ারে সে নোঙর যেন হটে না যায়। বুঝদার হুঁশিয়ার তারাই। মূর্খ পুরুষেরা কোনোদিনও নয়।

আজ চখা বিখ্যাত হয়েছে বলে কি আপশোস হচ্ছে ফিঙের?

কে জানে!

নদীদের বোঝে, এমন ক্ষমতা কি চখার মতন সামান্য পাখির আছে?

একদিন যাকে পাগলের মতন ভালোবেসেছিল এবং মিথ্যে বলবে না, সেই ভালোবাসা হয়তো ফেরতও পেয়েছিল, তার পাশে, বহুবছর পরে দু-ঘণ্টার পথ ঘন হয়ে গাড়িতে বসে যাওয়াও তো কম সুখের নয়!

কিন্তু আসবে না ফিঙে। ও জানে যে আসবে না। একা চখার দোকা হওয়া হবে না, স্বল্পক্ষণের জন্যেও।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথা আবারও মনে পড়বে চখার পথে যেতে যেতে।

তোমাকে আমি ভোগ করেছি তোমায় বিনাই।

দ্রুত ছুটে যাবে গাড়ি। হু হু করে হাওয়া আছড়ে পড়বে ওর গায়ে মাথায়। নির্মল হাওয়া। দূর থেকে দূরতর হতে থাকবে সেই দেশ,

যেখানে পাখির নাম পাখি,
নদীর নাম নদী
গাছের নাম গাছ
এবং স্বামীর নাম স্বামী।

[‘ফিঙে’ চরিত্রটি সম্পূর্ণই কাল্পনিক।
যদি এই নামে ধুবড়ি বা গৌরীপুর শহরে কোনো মহিলা থেকে থাকেন তবে তিনি নিজগুণে লেখককে মার্জনা করবেন। সেই অঘটনের মিল, নিতান্তই দুর্ঘটনা-প্রসূত বলেই জানতে হবে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *