০৫.
কথায় আছে, দুঃসংবাদ হাওয়ার উড়ে আসে। ঠিক তেমনি গোপন কথাটি বোধহয় সবচাইতে বেশি প্রচারিত হয়। দত্তবড়ির বড়বাবু থেকে ছোটবাবু পর্যন্ত পিতৃদেবের রক্ষিতাদের খবর কাউকে না বললেও কী করে যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল,তা ভগবানই জানেন।
শুধু তাই না। এইসব খবর যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন অনেক সময়ই আসল গল্পটি চাপা পড়ে যায়, হারিয়ে যায়। যাঁরা এসব খবর জেনে ও শুনে রসবোধ করেন, তারা কী একটু রং না চড়িয়ে থাকতে পারেন?
সেদিন মেজবাবু ঘরে ঢুকেই অবাক। স্ত্রীকে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, কি গো,তুমি যে আগেই শুয়ে পড়েছে?
মেজবউ কোনো জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকেন।
কিগো, জবাব দিচ্ছ না যে! শরীর-টরীর খারাপ হয়নি তো?
না, তবুও মেজবউ কোনো জবাব দেন না।
হাত জোড় করে ঠাকুর-দেবতার ছবিতে প্রণাম করতে করতেই মেজবাবুর কানে আসে–রক্ষিতার ছেলের আবার ভক্তি! ঢং দেখে আর বাঁচি না।
কোনো মতে ঠাকুর-দেবতার ছবিতে প্রণাম করেই মেজবাবু স্ত্রীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী বললে?
কী বললাম, শুনতে পাওনি?
আবার একটু শুনি।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েই মেজবউ জবাব দেন, বলছিলাম, রক্ষিতার ছেলের আবার ভক্তি!
মেজবাবু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কে আবার রক্ষিতার ছেলে?
ন্যাকামি করো না। সব জেনে গেছি। এখন আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। মেজবউ এক নিঃশ্বাসে বলে যায়।
মেজবাবু তখনো ঠিক বুঝতে পারেন না। বলেন, তোমার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
এবার মেজবউ উঠে বসে স্বামীর মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলেন, কেন আমার এই সর্বনাশ করলে সেই কথার জবাব দাও। কী ভেবেছ তোমরা? আমিও কি তোমাদের মতো রক্ষিতার পেটে জন্মেছি?
কথাটা শুনেই মেজবাবুর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। উনি ঠাস করে স্ত্রীর গালে একটা চড় মেরে বলেন, হারামজাদী, আমি রক্ষিতার ছেলে! দূর হয়ে যাও এ বাড়ি থেকে।
.
ব্যস! দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। চিৎকার-চেঁচামেচি-কান্নাকাটি শুনে প্রথমে বাড়ির বউরা, পরে সেজবাবু থেকে শুরু করে ছোটবাবু পর্যন্ত ছুটে আসেন। কে কার কথা শোনে? মেজবউ তারস্বরে চিৎকার করে শ্বশুর-শাশুড়ির নামে যা তা বলে যান। বাড়ির বউরা অবাক হয়ে এক-ওর মুখের দিকে তাকায়। বড়বউ তো হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মেজ, তুই একি দুঃসংবাদ শোনালি রে?
ঠিক এমন সময় বড়বাবু হাজির হতেই সবাই চুপ। বনবিহারী দত্ত জীবিত থাকার সময়ও এ বাড়িতে বড়বাবুর মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। বনবিহারী দত্তকে সবাই সমীহ করতেন, ভয় করতেন, কিন্তু বড়বাবুকে সবাই ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। শুধু এ বাড়ির ছেলেমেয়েবউ-ঝিরাই না, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীরাও জানেন, বড়বাবু। মিথ্যা কথা বলেন না, আজেবাজে কথাও বলেন না। তাছাড়া ওঁর মতো ব্যক্তিত্ব কজনের হয়? কোনো আলতু-ফালতু আজেবাজে ব্যপারেও উনি কখনই নাক গলান না। তাইতো ওঁকে দেখেই একমুহূর্তে সব চিৎকার-চেঁচামিচি-কান্নাকাটি থেমে গেল। বড়বাবু কোন ভূমিকা না করেই বলেন, মেজবৌমা, আমাদের মা, বাবার রক্ষিতা ছিলেন না, তিনি তাঁর বিবাহিত স্ত্রীই ছিলেন। বাবার রক্ষিতা ছিল ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে এ সংসারের কোনো সম্পর্ক কোনো কালেই ছিল না, এখনও নেই।
উনি না থেমেই বলে যান, যদি বাবার ঐ রক্ষিতা সম্পর্কে কিছু জানতে চাও, তাহলে কাল সকালে তোমরা সবাই আমার ঘরে এসো।
এবার উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, আমি জীবিত থাকতে তোমাদের কারুর কোনো অমর্যাদা হতে আমি দেব না। এখন শুতে যাও। অনেক রাত হয়েছে।
হ্যাঁ, পরের দিন সকালেই বড়বাবু বাড়ির সব বউ আর ভাইদের নিয়ে বসেছিলেন। বলেছিলেন, এ সংসারে অনেক কিছু জেনেও জানতে নেই; বিশেষ করে যাঁরা গুরুজন আর স্নেহভাজন। তাই মানিকতলার জগত্তারিণী দাসী বাবার রক্ষিতা ছিলেন জেনেও আমি ঐ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাইনি।
বড়বাবু একটু থেমে বলেন, তাছাড়া আমার কোনো প্রয়োজনও হয়নি। প্রয়োজন হতো, যদি বাবা আমার মা ও আমাদের প্রতি কর্তব্য পালন না করে শুধু তাঁর রক্ষিতার জন্যই সবকিছু..
সেজবাবু হঠাৎ বললেন, বাবা কর্তব্যপালন করেননি, এ অপবাদ কেউ দিতে পারবে না।
বড়বউ বললেন, সে কথা একশবার সত্যি।
বড় বাবু এবার বললেন, বাবা আমাদের জন্য যে বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য, বিষয় সম্পত্তি ও নগদ টাকা রেখে গেছেন, তার খবর তোমরা সবাই জানো। তবে হ্যাঁ, বাবা ঐ জগত্তারিণী দাসীর জন্যও বেশ কিছু টাকা রেখে গেছেন এবং সে টাকাও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি করে দেননি।
বড়বাবু এবার মেজবউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, যে মানুষটা লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করেছেন, দিবারাত্র ব্যবসা বাণিজ্য আর নিজের পরিবারের কথা ভেবেছে, তিনি কি নিজের ইচ্ছা মতন কিছুই করতে পারেন না?
না, বড়বাবু এইটুকু বলেন থামলেন না। বললেন, বাবা যদি আমাদের পথে বসিয়ে তাঁর সর্বস্ব ঐ জগত্তারিণী দাসীকে দিয়ে যেতেন, তাহলে আমরা তাকে দোষারোপ করতে পারতাম, আমরা চোখের জল ফেলতে পারতাম কিন্তু তার বেশি কিছু করতে পারতাম না।
বড়বাবু রুচিবান মানুষ। তাই প্রত্যক্ষভাবে বললেন না, মেজবৌমার আপন বড় জ্যেঠাঁই তার সমস্ত টাকাকড়ি রক্ষিতাকে দিয়ে নিজের স্ত্রী-পুত্রকন্যাকে নিঃস্ব করে রেখে যান এবং ঐ ভদ্রমহিলাকে আর পাঁচজনের দয়ায় জীবন কাটাতে হচ্ছে। তবে বড়বাবুর কথার যুক্তি ও মর্ম সবাই বুঝলেন।
সব শেষ বড়বাবু বললেন, সব সংসারেই কিছু ভাল-মন্দ থাকে। আমাদের সংসারেও আছে। সেই ভাল-মন্দকৈ মেনে নিয়ে সংসারকে ভাল না বাসলে সংসার করাই নিরর্থক হয়ে যায়।…
মেজবাবু বললেন, ঠিক বলেছেন।
…আমি আগেই ভাইদের বলেছি, এখন সব বৌমাদেরও আমি খোলাখুলি বলছি, সংসারে সবাই ক্ষমতা চায়; মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্বও থাকতে পারে কিন্তু যৌথ
পরিবার, যৌথ ব্যবসা চালাতে হলে সবাইকেই কিছু না কিছু ত্যাগ করতে হয়।
সবাই এক দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
উনি বলে যান, আমি তোমাদের কোনো কিছু ত্যাগ করতেও বলতে পারি না, দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে সংসারে থাকতেও বলি না। তাই বলছিলাম, আমাদের যৌথ ব্যবসা বা যৌথ পরিবারের বদলে ভাগ-যোগ করে নেওয়াই বোধহয় সবার পক্ষে মঙ্গল হবে…অন্তত তাতে অশান্তি এড়ানো যাবে।
একমুহূর্তে সবার মুখের চেহারা বদলে গেল কিন্তু অন্য কেউ কিছু বলার আগেই মেজবউ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আপনি আর বড়দিই তো আমাকে এ বাড়িতে এনেছিলেন। আজ আপনিই বলছেন চলে যেতে?
না, না, বৌমা, আমি…।
বড়ভাসুরের কথা যেন মেজবউয়ের কানেই যায় না। উনি কাঁদতে কাঁদতেই বলে যান, আমি অন্যায় করেছি বলে আমাকে শাসন করুন কিন্তু তাই বলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন? ছোট ভাইবোন-ছেলেমেয়েরা অন্যায় করলে কি…
ওঁর কান্নাকাটি দেখে প্রায় সবার চোখেই জল এসে যায়। বড়বউ তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে ওঁর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলেন, নারে মেজ, তোরা কেউ কোথাও যাবি না। আমি কাউকে কোথাও যেতে দেব না। আমি না মরলে তোরা কেউ কোথাও যেতে পারবি না।
ছোটবাবু একটু হেসে বলেন, বাঁচালে বড়বৌদি, বাঁচালে। দাদাদের রোজগারে না খেতে পারলে গানবাজনার চর্চা করব কী করে?
সেজবাবুও হাসতে হাসতে বললেন, তুইও তো আমাদেরই মতো একজন পার্টনার।
আমি পার্টনার? ছোটবাবু হো হো করে হেসে উঠেই বলেন, আমাকে গদিতে বসিয়ে দেখুন না কী কেলেঙ্কারী করি! উনি এবার হাসি থামিয়ে বলেন, বড়বৌদির হোটেলে বেশ আছি। আর আপনারা আমাকে গানবাজনার জন্য টাকাকড়ি দিচ্ছেন। আমার তো আর কিছুর দরকার নেই।
এইসব টুকটাক কথাবার্তার পর বড়বাবু একটু হেসে বললেন, মেজবৌমা, তুমি যে এই সংসারের কী উপকার করলে, তা আর কী বলব! যে সামান্য পাপটুকু আমাদের মনের মধ্যে জমেছিল, তা তোমার চোখের জলে সব ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হলো।
মেজবৌমা মুখ নিচু করে বলেন, একি কথা বলছেন আপনি? আমি তো বরং এই সংসারটা ভাঙতেই গিয়েছিলাম।
বড়বাবু পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, মেজবৌমা, এ দুনিয়ায় কেউ রাগে বা হিংসায় চোখের জল ফেলে না। শোকে-দুঃখে, আনন্দে-অভিমানেই মানুষ চোখের জল ফেলে। চোখের জলের চাইতে পবিত্র কিছু হতে পারে না।
বড়বাবু একটু থেমে ওর দিকে তাকিয়ে আবার একটু হেসে বলেন, হোটেল বা ধর্মশালা ছাড়তে কি কেউ চোখের জল ফেলে? নিজের ঘরবাড়ি-সংসার ছেড়ে যাবার সময়ই মানুষ চোখের জল ফেলে। তুমি এই সংসারটাকে নিজের না ভাবলেই কি…
ওঁর কথাটা শেষ হবার আগেই বড়বউ বলেন, ঠিক বলেছ।
সেই রাত্রে মেজবউ তার স্বামীকে বললেন, তোমরা জন্ম জন্ম তপস্যা করে এমন বড়দা আর বড়বৌদি পেয়েছ। সত্যি, ওঁদের মতো মানুষ আমি এ জীবনে দেখিনি, দেখবও না।
মেজবাবু মুখ টিপে হেসে বললেন, এ বাড়ির মেজবাবুও সাক্ষাৎ দেবতা।
চুপ করো! তোমার মতো পেটুক আর কামুক এ বিশ্ব-সংসারে দ্বিতীয় নেই।
পেটুক হয়েছি বড়বৌদির জন্য আর কামুক হয়েছি তোমার জন্য।
তা তো বটেই!
.
যাই হোক নিজেদের বিষয়-সম্পত্তি ব্যবসা-বাণিজ্য একটু সামলে নেবার পর বড়বাবু একদিন ভাইদের ডেকে বললেন, আমার মনে হয় এবার একদিন জগত্তারিণী দাসী আর মিসেস উইলিয়ামসকে গিয়ে ওঁদের প্রাপ্য টাকাকড়ি বুঝিয়ে দেওয়াই ভাল। কারণ টাকাকড়ি বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে কবে কোথায় কি গণ্ডগোল দেখা দেবে, তা কিছু বলা যায় না।
ওঁর কথা সবাই সমর্থন করলেন এবং তখনই ঠিক হলো আগামী রবিবার সকালে বড় তিন ভাই গিয়ে ওঁদের সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন।
রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্তর ছেলেরা এসেছে শুনেই মিসেস উইলিয়ামস প্রায় ছুটে এসে ওদের অভ্যর্থনা করলেন, প্লিজ কাম ইন, মাই সনস্।
তারপর ড্রইংমে ওদের বসিয়েই বললেন, ইওর ফাদার ওয়াজ এ গ্রেট ম্যান! এ গুড ফ্রেন্ড অ্যান্ড এ ভেরি অনেস্ট ম্যান!
ওঁরা চুপ করে মেমসাহেবের কথা শোনেন।
মেমসাহেব বলেন, আমার উচিত ছিল তোমাদের সঙ্গে দেখা করা বাট মাই ডটার ওয়াজ হিয়ার উইথ হার কিডস্। সেজন্য আমি এত ব্যস্ত ছিলাম যে……
বড়বাবু বললেন, না, না, এর জন্য এত বলার দরকার নেই।
কিন্তু কর্তব্যচ্যুতি তত অন্যায়। এবং সে অন্যায় করেছি।
মেমসাহেবের কথা শুনে ওঁরা যেন একটু অবাক হন কিন্তু কেউই কোনা কথা বলেন।
মিসেস উইলিয়ামস একটু হেসে বলেন, তোমাদের বাবা আমার স্বামী ও আমার দুজনেরই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং উনিই আমাদের স্বামী-স্ত্রী ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে দিতেন।
মেমসাহেবের কথা শুনে ওঁরা তিনজনেই একটু হাসেন এবং বড়বাবু বলেন, তাই নাকি?
তবে আর বলছি কী? মেমসাহেব একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, রায়বাহাদুর বহুভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন এবং ওঁর সাহায্যের কথা আমি জীবনেও ভুলতে পারব না। বিশেষ করে আমার স্বামী মারা যাবার পর উনি যে আমার জন্য কী করেছেন, তা মুখে বলে শেষ করা যাবে না।
মিসেস উইলিয়ামস এবার বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, বন্ধু হিসেবে আমরাও তোমার বাবাকে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করছি।
এবার উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন স্বগতোক্তি করেন, আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে কত লোকে কত ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে, কেউ কেউ অত্যন্ত নোংরা কথাও বলেছে, কিন্তু আমি জানি, রায়বাহাদুর কত ভাল মানুষ ছিলেন।
রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্ত আর মিসেস উইলিয়ামসকে নিয়ে যে নানা মহলে সরস আলোচনা হতো, তা বড়বাবু খুব ভাল করেই জানেন, কিন্তু আজ মেমসাহেবের কথাবার্তা শুনে কেমন যেন একটু খটকা লাগে। যাই হোক, উনি মনের ভাব মনে রেখেই বলেন, আমরা একটু এসেছিলাম আপনার কাছে।
হা, হ্যাঁ, বলো কী কাজ।
বড়বাবু কোনো কথা না বলে ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কের একটা চিঠি ওঁর হাতে দেন। মিসেস উইলিয়ামস চিঠিটা পড়েই প্রায় চিৎকার করে ওঠেন, নো, নো, আই কান্ট টেক দিস মানি।
বড়বাবু হেসে বলেন, আপনি এ টাকা না নিলে কে নেবে? বাবা তো এখন বেঁচে নেই যে….
লুক হিয়ার মাই বয়, মেমসাহেব ওঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমরা বন্ধু ছিলাম। আমরা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছি কিন্তু তার সঙ্গে টাকাকড়ির কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু…
না, না, কোনো কিন্তু না। মিসেস উলিয়ামস একটু হেসে বলেন, রায়বাহাদুর বহুবার আমাকে টাকাকড়ি দিতে চেয়েছেন কিন্তু আমি নিইনি। বন্ধুর ব্যবসায় সাহায্য করে কি কমিশন নেওয়া যায়?
এবার মেজবাবুই প্রথম কথা বলেন, বান্ধবী হিসেবে আপনি আমার বাবাকে সাহায্য করেছেন ঠিকই কিন্তু বিজনেসম্যান হিসেবে তাঁরও তো কিছু কর্তব্য আছে।
মেমসাহেব মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, তোমরা যতই আমাকে বোঝাও, আমি একটি পয়সাও নিতে পারব না। উনি একটু গলা চড়িয়েই বলেন, তাছাড়া টাকা নিয়ে আমি কী করব? আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। পাঁচ বছর-সাত বছর পর একবার এখানে আসবে। আর আমার নিজের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আমার আছে।
ওঁরা তিন ভাই মিলে অনেক অনুরোধ-উপরোধ করার পর মেমসাহেব বললেন, ঠিক আছে, আমি এই টাকা নিয়ে তোমাদের স্ত্রীদের দিয়ে দিচ্ছি।
মেমসাহেব একটু থেমে একটু হেসে বলেন, এই টাকা থেকে তোমরা কেউ একটি পয়সা নিলে আমার কাছে বকুনি খাবে।
মেমসাহেবের কথা শুনে ওঁরা তিন ভাই হেসে ওঠেন।
হাসছ কী? আমি ঠিকই বলেছি। এই টাকা নিয়ে ওরা যা ইচ্ছে করুক কিন্তু তোমরা ওদের কিছু বলতেও পারবে না, একটি পয়সাও নিতে পারবে না।
মেমসাহেবের কাণ্ড-কারখানা দেখে ওঁরা অবাক হয়ে যান। তিনজনের মনেই সন্দেহ হয়, এই মহিলা কি পিতৃদেবের…
না, না, তা সম্ভব নয়। যার মধ্যে এই মনুষ্যত্ব, এই উদারতা আছে, তার কি চরিত্রে কোনো কলঙ্ক থাকতে পারে?
.
ও বাড়ি থেকে বেরুবার পরই সেজবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বড়দা, মেমসাহেবকে আপনার কেমন লাগল?
বড়বাবু একটু হেসে বললেন, শুধু ভাল লাগেনি, মেমসাহেবকে আমার মায়ের মতোই…।
ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মেজবাবু বললেন, ঠিক বলেছে! সত্যি শ্রদ্ধা করার মতো মহিলা।
সেজবাবু বললেন, আমার তো মনে হয়, এই মহিলার সঙ্গে বাবার কোনো অন্যায় সম্পর্ক কখনই ছিল না।
বড়বাবু বললেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
.
এরপর মাসখানেক ওঁরা সবাই নানা কাজে এমনই ব্যস্ত রইলেন যে জগত্তারিণী দাসীর কাছে যাওয়া সম্ভব হলো না। বিশেষ করে রাজশাহী, রংপুর আর সিলেটের তিনটে বড় বড় ব্রিজ তৈরির ব্যাপারে কিছু ঝামেলা সামলাতে দুভাইকে বেশ কিছুদিন কলকাতার বাইরে থাকতে হলো। যাই হোক মাস দেড়েক পর বড়বাবু আর মেজবাবু একদিন জগত্তারিণী দাসীর ওখানে গিয়ে হাজির।
. জগত্তারিণী দাসী মহাসমাদরে ওঁদের অভ্যর্থনা করে বললেন, এসো, বাবা, এসো। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বলেন, এমন কপাল করেই জন্মেছি যে এতকালপর তোমরা ছেলে হয়েও মাকে দেখছ এই প্রথম।
ওর কথা শুনেই দুভাই একবার পরস্পর পরস্পরের দিকে না তাকিয়ে পারেন না।
জগত্তারিণী ওদের দিকে না তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে চড়া গলায় ডাকেন, ওরে দুর্গা, ওরে শিবানী, কোথায় গেলি তোরা? এদিকে আয়। তোদের দাদারা এসেছে।
মহিলার কথা শুনে দুভাই একটু অবাক না হয়ে পারেন না।
পনের-ষোল বছরের একটি মেয়ে কোথা থেকে ছুটে আসতেই জগত্তারিণী বললেন, ওরে পেন্নাম কর। এরা তোর দাদা!
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে ওঁদের দিকে তাকাতেই জগত্তারিণী আবার বলেন, হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কিরে? ওরে, তোদের তিনজনের শরীরেই একই রক্ত আছে রে! উনি প্রায় নিঃশ্বাস না ফেলেই বলেন, দুর্গা হতচ্ছাড়ি আবার কোথায় গেল?
শিবানী কোনোমতে একজনকে প্রণাম করতে যেতেই ওঁরা দুভাই এক সঙ্গে বলে ওঠেন, থাক, থাক, প্রণাম করতে হবে না।
কেন বাধা দিচ্ছ বাবা? সৎ ভাইবোন আর সহোদর ভাইবোনদের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? জগত্তারিণী একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, সবই তো এক গাছের ফল।
ওর কথাবার্তা শুনে দুভায়ের গা জ্বলে যায় কিন্তু মুখে কিছু বলে না। শিবানীও একমুহর্ত না দাঁড়িয়ে প্রায় দৌড়ে ভিতরে চলে যায়।
ওরে হারামজাদী, চলে গেলি কোথায়? বিষ্ণুর মাকে বল, একটু চায়ের জল চাপাতে আর…
ওর কথাটা শেষ হবার আগেই বড়বাবু বলেন, আমরা সকালে চা খেয়েছি। এখন আর চা-টা খাব না।
তাই কি হয় বাবা? জগত্তারিণী ওদের দিকে তাকিয়ে একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, তোমরা কি আমার পর বাবা? নিজে পেটে ধরিনি বলে কি আমি তোমাদের মা না?
জগত্তারিণী দাসী শুধু বড়বাবু-মেজবাবু না, প্রায় ছোটবাবুর বয়সী। বড় জোর তার চাইতে সমান্য বড়। কামনার জ্বালা মেটাবার জন্যই যে মানুষ রক্ষিতা রাখে, তা ওঁরা খুব ভালভাবেই জানেন। শুধু তাই না, কোনো বুদ্ধিমান মানুষই বয়স্কা রক্ষিতা রাখে না, তাও ওঁরা জানেন। তাই পিতৃদেবের এই রক্ষিতার মুখে মাতৃস্নেহের বুলি শুনে ওঁরা দুজনেই মনে মনে বিরক্ত বোধ করে।
.
শুধু বিরক্ত কেন, ঘৃণাও যোধ হয়। কলকাতা শহরটা এখন আর অন্ধকার যুগে পড়ে নেই। সেই কোম্পানির যুগে সাহেবসুবোরা যেমন নিছক ফুর্তির জন্য একাধিক হিন্দুস্থানী রক্ষিতা পুষতেন, তেমনি তাদের স্নেহধন্য কিছু মানুষও রক্ষিতা রাখা মর্যাদার লক্ষণ বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সেই কলকাতা তো কোথায় হারিয়ে গেছে। কলকাতার রাস্তায় পালকি তো দূরের কথা, ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়িও এখন আর দেখা যায় না। আরো কত কি বদলে গেছে! বাঙালিরা যে সাহেবসুবোদের জুজুর মতো ভয় করতো, সেই বাঙালিরাই কবছর আগে স্বয়ং লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে লড়াই করল। এককালে সাহেবদের কিছু মুষ্টিমেয় প্রিয়পাত্র ও মোসাহেবরাই কলকাতার বাঙালি সমাজে গণ্যমান্য বিবেচিত হতেন কিন্তু এখন তাঁরা ঘৃণার পাত্র না হলেও নিশ্চয়ই সম্মানিত বা শ্রদ্ধেয় না। শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা এখন উমেশ বাঁড়ুজ্যে-সুরেন বাঁড়ুজ্যে রবিবাবুর মতো মানুষের মুখ চেয়ে থাকে। তাছাড়া সিমলে পাড়ার নরেন দত্ত দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণের পাল্লায় পড়ে কী কাণ্ডটাই করল! আরো, আরো, কত কি ঘটে গেল এই কলকাতার বুকে। আগে নাটক দেখা মানেই গোল্লায় যাওয়া মনে করতেন সবাই। আর এখন? গিরিশ ঘোষের নাটকে দানীবাবুর অভিনয় না দেখা মানেই জীবন ব্যর্থ!
বনবিহারী দত্তর ছেলেরা হিন্দু কলেজে লেখাপড়া করেনি, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনেও যোগ দেয়নি। তা হোক। তারা তো কলকাতাতেই জন্মেছে, বড় হয়েছে। এখানেই তাদের কাজ-কারবার। তাই আর কিছু না হোক, তারা কোনো মানুষেরই রক্ষিতাকে শ্রদ্ধা করতে পারে না–এমনকি এই জগত্তারিণী দাসীকেও তারা মনে মনে ঘৃণাই করে, কিন্তু সেই ঘৃণার ভাব প্রকাশ না করেই বড়বাবু বলেন, আজ আমরা একটা জরুরি কাজে এসেছি। তাছাড়া আমাদের এখুনি দোকানে যেতে হবে।
কাজ তো সবারই আছে। তাই বলে কি…..।
বড়বাবু ওঁর কথার জবাব না দিয়ে জমি আর ব্যাঙ্কের কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলেন, বাবা আপনাকে কিছু সম্পত্তি আর কয়েক লাখ টাকা দিয়ে গেছেন। কোন টাকা দিয়ে কি কাজ করতে পারবেন, তা বাবা ব্যাঙ্ককে জানিয়ে গেছেন।
জগত্তারিণী কাগজগুলো হাতে নিয়েই বলেন, মোটে চার লাখ রেখে গেছে?
মেজবাবুর ইচ্ছা করে মহিলার গালে একটা চড় মেরে বলতে, তোমার চোদ্দ পুরুষ কোনোদিন চার লাখ টাকা চোখে দেখেছে? কিন্তু জিভের গোড়ায় এসেও কথাটা বলতে পারলেন না। তবে বললেন, বাবা যা রেখে গেছেন, তাই আপনি পেলেন। আপনার ভাগ, থেকে আমরা একটা পয়সাও নিইনি।
কর্তা যে আমায় কথা দিয়েছিল, আমার জামাইরা ব্যবসার শেয়ার পাবে।
তেমন কোনো কথা তাঁর উইলে নেই।
উইলে নেই বললেই তো হবে না বাবা! তোমাদের ভাইবোনের মতো এই মেয়ে দুটোও তো তারই সন্তান। জগত্তারিণী একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, সব ব্যবসা-বাণিজ্যই তোমরা ভোগ করবে, তাই কি হয়?
এবার বড়বাবু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, বাবার উইলের কপি আপনাকে পাঠিয়ে দেব। তাছাড়া ব্যাঙ্কের কাগজপত্র তো দিয়েই গেলাম। একজন ভাল উকিলকে দেখিয়ে নিলেই…..
শুনেছি, উইল তো জালও হয়।
সন্দেহ হলে মামলা করবেন।
ব্যস! আর একটি শব্দ উচ্চারণ না করে ওঁরা দুভাই সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসেন।
.
সেইদিন রাত্রেই বড়বাবু সব ভাইদের কাছে সকালের ঘটনা জানাবার পর বললেন, ঐ কথাবার্তা শুনেই মনে হলো উনি কিছু গণ্ডগোল করবেনই।
মেজবাবু বললেন, ওর ন্যাকামি দেখে য়ে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল।
বড়বাবু অত্যন্ত চিন্তিত ও গম্ভীর হয়ে বললেন, মনে আমাদের যত রাগ-দুঃখই থাক, এখন আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
প্রায় সবাই এক সঙ্গে বললেন, সে তো একশবার।
আমরা যদি সবাই এক থাকি, তাহলে কেউই আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। বড়বাবু মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলেন, একদিকে আমাদের যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ষোল আনা নজর দিতে হবে, সেই সঙ্গে সঙ্গে বিপদ আসার আগেই আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।
ন’বাবু বললেন, বড়দা, আপনি যা বলবেন, আমরা সবাই তাই করব–এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
সেজবাবু বললেন, তবে বড়দা, আমি বলে দিচ্ছি, আমরা পথের ভিখারি হতে রাজি কিন্তু ঐ বদমাইশ মহিলার কাছে হেরে যেতে রাজী নই।
ছোটবাবু বললেন, ঠিক বলেছেন সেজদা। ঐ অতখানি জমি আর চার লাখ টাকা পেয়েও যে জাল দলিলের কথা বলে, তার কাছে দত্তবাড়ির ছেলেরা কিছুতেই হেরে যায় না।
বড়বাবু একটু হেসে বললেন, তোমাদের মনের কথা আমি বেশ বুঝতে পারছি, কিন্তু আমরা সবাই যদি একটু বেশি পরিশ্রম করি, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যও ঠিক চলবে আবার দরকার হলে কোর্ট-কাছারিও করা যাবে।
উনি একটু থেমে বলেন, যাই হোক, আমি কালই হেমেনকাকার কাছে যাব। যদি দরকার হয়, তাহলে হেমেনকাকাকে নিয়ে সোজা সি. আর. দাশকে গিয়ে ধরব আমাদের এই মামলার জন্য।
মেঝবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ঠিক বলেছেন।
হাজার হোক উনিও তো আমাদের এই ভবানীপুরেরই লোক। হেমেনকাকা আর আমি গিয়ে বললে উনি নিশ্চয়ই না বলতে পারবেন না।
.
বড়বাবুর কাছে সব শোনার পর ও সব কাগজপত্র দেখে হেমেনকাকা দুচারটে লাল মলাটের আইনের বই ঘাঁটাঘাঁটি করে বললেন, শোন দুর্গাপদ, আমার মনে হয় না জগত্তারিণী দাসী মামলা করে কিছু করতে পারবেন। তাছাড়া ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্ক তো উইল ও চিঠিপত্র দেখেশুনেই এই টাকার কথা তোমাদের বলেছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তাছাড়া কালীপদ, শ্যামাপদ, শিবপদ বা গুরুপদও তো উইল মেনে নিয়েছে।
তারা তো মেনে নিয়েছেই।
বৃদ্ধ উকিল হেমেন সেন এবার ওঁর দিকে তাকিয়ে কললেন, তবে কিছু চিন্তা নেই। ভাল করে ব্যবসা-বাণিজ্য করো। জগত্তারিণী যদি কিছু করে, তখন এসো। যা করার তা আমিই করব।
.
সংসারে অক্ষম, ছোট, দরিদ্র হবার সমস্যা অনেক। বিপদ অনেক। কিন্তু দশজনের একজন হলে, ধনী হলে বা কোনোকিছু বড় করলেও কম সমস্যা ও ঝামেলা সহ্য করতে হয় না। অতি সাধারণ মানুষের কজন শত্রু থাকে? বড় জোর দুচারজন, কিন্তু ধনী, রাষ্ট্রনায়ক বা রাজা-উজিরের অসংখ্য সমালোচক ও শত্রু থাকবেই। শত্রুর সংখ্যা থেকেই জানা যায়, বোঝা যায় মানুষটি সাধারণ না অসাধারণ।
যে যাই বলুক, রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্ত নিশ্চয়ই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। ধন-মান-ঐশ্বর্যের অধিকারী হবার সঙ্গে সঙ্গে তার শত্রুও নেহাত কম ছিল না। স্বয়ং লেফটেন্যান্ট গভর্নর রায়বাহাদুরকে বাংলাদেশের নানা জেলায় ব্রিজ তৈরির ভার দিতেই কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী আর সহ্য করতে পারলেন না।
আচ্ছা জগত্তারিণী, তুই আমাকে সত্যি ভালবাসিস?
কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরীর কথা শুনে জগত্তারিণী না হেসে পারে না। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলে, সেই সোল বছর বয়সে যে তুমি আমার প্রথম সব্বনাশ করলে, তারপর কি আমি আর কোনো পুরুষের দিকে ফিরে তাকিয়েছি?
চৌধুরীমশাই ওর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলেন, তুই না তাকালে কী হয়, তোর দিকে তো অনেকেরই নজর।
জগত্তারিণী ঠোঁট উল্টে বলে, আমি কি সেই কচি মেয়েটা আছি? তারপর একটু তির্যক দৃষ্টিতে চৌধুরীমশায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, এখন এই বয়সেও যদি পুরুষরা আমার দিকে নজর না দেয়, তাহলে আর কবে দেবে?
চৌধুরীমশাই একটু চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করেন, হারে জগত্তারিণী, বনবিহারী দত্তকে তোর কেমন লেগেছে রে?
কোন দত্ত?
বনবিহারী দত্ত।
সে আবার কে?
ঐ যে গতবার পুজোর পর আমি যখন তোকে নিয়ে ঘোষালদের বাগানবাড়ি গিয়েছিলাম, সেখানে যে লোকটা তোকে আর ঘোষালবাবুর মাগীকে একশ টাকা করে…
জগত্তারিণী এবার মানুষটাকে চিনতে পেরেই বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
লোকটাকে তোর কেমন লেগেছিল?
তোমার আর ঘোষাল মশাইয়ের মতো বদমাইশ না, বেশ ভদ্দর…
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই চৌধুরীমশাই এক গাল হাসি হেসে বলেন, তুই আমাদের বদমাইশ বললি?
জগত্তারিণী মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলে, ভুলে গেলে সে রাত্তিরের কথা? দুজনে কি নষ্টামি-দুষ্টুমিই করেছিলে!
যাই হোক, এই কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী পাকে-চক্রে জগত্তারিণীকে বনবিহারী দত্তর ঘাড়ে চাপিয়ে দেন কিন্তু নেপথ্যে ওদের দুজনের সম্পর্ক ঠিকই থাকল। একটু বেশি বয়সে বনবিহারী দত্তর নারীপ্রীতি বেড়েছিল ঠিকই কিন্তু তার জন্য তিনি কোনোদিনই নিজের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার বা ব্যবসা-বাণিজ্য উপেক্ষা করেননি। কাঁচা বয়সের জগত্তারিণীর কাছে নিয়মিতই যাতায়াত করতেন কিন্তু কোনদিনই দুএক ঘণ্টার বেশি থাকতেন না। সব কাজই উনি ঘড়ি ধরে হিসেব-নিকেশ করে করতেন।
মাঝে মাঝে জগত্তারিণী কত ন্যাকামিই করতো! বনবিহারী দত্ত মাসোহারার টাকা দিলেই বলতো, থাক, থাক, আমাকে টাকা দিতে হবে না। মথুরাপুরের ঘোষবাড়ির মেয়ে আমি। আমাকে নিজের সংসারে নিয়ে শাঁখা-সিঁদুর দিলেই…
বনবিহারী দত্ত একটু চাপা হাসি হেসে বললেন, এটা কি তোমার সংসার না? তুমি যেখানে থাকবে, সেখানেই তোমার সংসার।
না, না, এটা আমার সংসার হবে কেন? তুমি যেখানে থাকো, সেখানেই আমার সংসার। জগত্তারিণী একটু থেমে বলেছিল, তোমার টাকাকড়ি বিষয়-সম্পত্তি ব্যবসা বাণিজ্য থেকে ঘর-সংসার স্বামী-ছেলেমেয়ের সব রসই বড়বউ ভোগ করবে? এইসব কিছুর উপরই কি আমার কোনো দাবি নেই?
বনবিহারী দত্ত সাফ দবাব দিয়েছিলেন, দেখো জগত্তারিণী, তোমাকে সবকিছু দেবার দায়িত্ব আমার না, এ কথা কেন ভুলে যাও?
.
হ্যাঁ, জগত্তারিণী দাসী শেষ পর্যন্ত রায়বাহাদু বনবিহারী দত্তের পাঁচ ছেলের নামে মামলা করে বিষয়-সম্পত্তি ব্যবসা বাণিজ্যের আট আনা অংশ গবি করেছিল। ডগগরিণীর উকিল বিচারককে বলেন, ইওর অনার, আমার মক্কেল শ্ৰীমতী জগত্তারিণী দাসী রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্তর বৈধ এবং বিবাহিতা স্ত্রী।
আপনি ঠিক জানেন মিঃ রায়?
ইয়েস ইওর অনার।
আপনি কি এই বিয়ের আসরে উপস্থিত ছিলেন?
বিচারকের প্রশ্ন শুনেই কোর্টরুমের অনেকেই হাসি চাপতে পারেন না।
মিঃ রায় জবাব দেন, না ইওর অনার, আমি নিজে বিয়ের সময় উপস্থিত না থাকলেও অন্যেরা তো ছিলেন।
তাদের আপনি সাক্ষী হিসাবে হাজির করবেন তো?
নিশ্চয়ই।
ভেরি গুড মিঃ রায়।
.
জগত্তারিণীর উকিল প্রথম যে সাক্ষী উপস্থিত করেন তিনি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ জ্ঞান ভটচাজ। পৌরোহিত্য করাই তার পেশা হলেও দুচারজন ছাত্রকে স্মৃতিশাস্ত্র পড়ান। ঈশ্বরের নামে শপথ করে ভটচাজমশাই হাকিমকে বলেন, হ্যাঁ, বনবিহারী দত্তের সঙ্গে জগত্তারিণীর বিবাহে উনিই পৌরহিত্য করেন এবং সবিস্তারে সেই বিবাহ উৎসবের বর্ণনা দেন।
জ্ঞান ভট্টাচার্জের সাক্ষ্য শুনে কোর্টরুমের কতজনের কত হাসাহাসি! চাপা গলায় কতজনের কত কটু মন্তব্য। কোর্টরুম থেকে বেরুতে না বেরুতেই কৃবিনের চৌধুরী বড়বাবুকে ইশারায় কাছে ডেকে বললেন, দুর্গাপদ, তুমি জানো আমি তোমার পিতৃবন্ধু। ভাল-মন্দ অনেক কিছুই দুজনে মিলে করেছি। সত্যি কথা বলতে কি এই বিয়ের আসরে আমিও উপস্থিত ছিলাম।
বড়বাবু কোনো ভাবাবেগ প্রকাশ না করে ওঁর কথা শোনেন।
…তাই বলছিলাম, তোমাদের যখন কম নেই, তখন ভাগ-যোগ করে নিলেই তো সব মিটে যায়। শুধু তোমার বাবা কেন, লক্ষ লক্ষ লোকের দুটো-তিনটে বিয়ে থাকে। সেটা তো দোষের কিছু নয় বাবা!
না, বড়বাবু এবারও কোনো কথা বলেন না।
চৌধুরীমশাই বলে যান, কোর্ট-কাছারি মামলা-মোকদ্দমা মানেই কেলেঙ্কারি আর টাকার ছাদ্য! হেমেন সেনের খাই তো আমি জানি। কোথায় কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে, তার তো ঠিক নেই!
উনি একবার মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তোমাদের ভাইদের কথা আমি বাদই দিলাম কিন্তু বৌমাদের কথা একবার ভেবে দেখেছ কি? এইসব মামলা-মোকদ্দমা চললে ওরা সমাজে মুখ দেখাবে কী করে?
বড়বাবু একটি কথারও জবাব দিলেন না। সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরেই উনি বাড়ির বউদের ডেকে বললেন, বড়বউ, এবার থেকে তোমরা বউরাও আমাদের সঙ্গে কোর্টে যাবে।
বড়বাবুর কথা শুনে বউরা অবাক হন। এ-ওর মুখের দিকে তাকান। ভাইরাও চুপ।
একটু থেমে বড়বাবু বললেন, সবাইকে দেখিয়ে দেবার দরকার আমরা সবাই এক।
কেউ কোনো প্রশ্ন না করলেও সবাই বুঝলেন, কোনো বিশেষ কারণেই বড়বাবু বাড়ির বউদের কোর্টে যেতে বলছেন।
.
পরের দিন হাকিম এজলাসে এসে বসেই বললেন, ইয়েস মিঃ রায়, আপনি জগত্তারিণী দেবীর পক্ষে সাক্ষীদের হাজির করতে পারেন।
হাকিমকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মিঃ রায় সবার আগে একজন বৃদ্ধকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করলেন। প্রায় নব্বই বছরের বৃদ্ধ শুধু সত্য কথা বলার শপথ নেবার পরই মিঃ রায় তাকে প্রশ্ন করেন, আপনার নাম?
অভিলাষচন্দ্র ঘোষ।
আপনি জগত্তারিণী দাসীকে চেনেন?
চিনব না? ও আমার একমাত্র সন্তান।
মেয়ের বিয়ের কথা মনে আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ; তবে বয়স হয়েছে বলে সব কথা মনে নেই।
জামাই-এর নাম মনে আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্ত।
এবার মিঃ রায় হাকিমকে বললেন, ইওর অনার, আমার এই সাক্ষীর অনেক বয়স হয়েছে। তাই আমি ওঁকে আর প্রশ্ন করতে চাই না। বিরোধী পক্ষের উকিল ইচ্ছা করলে জেরা করতে পারেন কিন্তু আমি সবিনয়ে নিবেদন করব, বৃদ্ধকে বেশি প্রশ্ন না করাই বোধহয় সমীচীন হবে।
এবার প্রবীণ আইনজ্ঞ হেমেনবাবু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বৃদ্ধকে প্রশ্ন করলেন, আপনার নাম কী অবিনাশচন্দ্র ঘোষ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কোর্টসুদ্ধ সবাই সজোরে হেসে উঠতেন মিঃ রায় উঠে দাঁড়িয়ে কী যেন বলতেই হেমেনবাবু হাকিমকে বললেন, ইওর অনার, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি ডিসটার্বড বাই এনি ওয়ান।
হাকিম সঙ্গে সঙ্গে বলেন, মিঃ রায়, আপনি বসুন।
মিঃ রায় তবু কী যেন বলতে চেষ্টা করতেই হাকিম একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, মিঃ রায়, আদালতের কাজে বাধা দেবেন না। বসে পড়ুন।
মিঃ রায় বসতেই হেমেনবাবু সাক্ষীকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা অবিনাশবাবু, আপনার বাড়ি কোথায়?
আজ্ঞে মথুরাপুর।
সেখানেই থাকেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি আর আপনার স্ত্রী ছাড়া সেখানে আর কে থাকে?
আজ্ঞে আমার স্ত্রী বহুদিন হলো গত হয়েছেন।
মেয়ের বিয়ের আগেই আপনার স্ত্রী মারা যান?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আচ্ছা অবিনাশবাবু, মথুরাপুরে হাই স্কুলে-পোস্ট অফিস তো আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আচ্ছা অবিনাশবাবু, মথুরাপুর কোন জেলায়?
কী বললেন উকিলবাবু?
অবিনাশবাবু, আমি জিজ্ঞেস করেছি, আপনাদের মথুরাপুর কোন জেলায়?
আজ্ঞে হুগলি জেলায়।
অবিনাশবাবু, এবার বলুন, মথুরাপুর থেকে কোর্টে এলেন কীভাবে?
আজ্ঞে রেলগাড়িতে।
এবার হেমেনবাবু হাকিমকে বললেন, ইওর অনার, সাক্ষী অবিনাশচন্দ্র ঘোষকে আমি আর কোনো প্রশ্ন করতে চাই না।
মিঃ রায় উঠে দাঁড়াতেই হাকিম বললেন, আপনার পরবর্তী সাক্ষীকে হাজির করুন।
ইওর অনার, আমার প্রথম সাক্ষীর ব্যাপারে কিছু নিবেদন ছিল।
সাক্ষীদের সাক্ষ্যদান শেষ হবার পর আপনার সব নিবেদন শুনব। এখন পরবর্তী সাক্ষীকে হাজির করুন।
হাকিমের মনোভাব আন্দাজ করে মিঃ রায় কোনো তর্ক-বিতর্ক না করে দ্বিতীয় সাক্ষী হাজির করলেন।
আপনার নাম?
শ্রীকৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী।
আপনি জগত্তারণী দাসীকে চেনেন?
খুব ভাল করে চিনি।
আপনার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কী?
উনি আমার বন্ধু রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্তর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী এবং এই বিয়ের অনেক দায়িত্বই আমাকে পালন করতে হয়।
তাহলে বন্ধুপত্নী হিসাবেই জগত্তারিণী দাসীকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
বিয়ের দিনের ঘটনা মনে আছে? দি
নের আলোর মতো সবকিছু মনে আছে।
কী মনে আছে বলুন তো!
কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী গড় গড় করে বিবাহ উৎসবের বিশদ বর্ণনা শোনাবার পরই মিঃ রায় হাকিমকে বললেন, ইওর অনার, এবার বিরোধী পক্ষের উকিল জেরা করতে পারেন।
হেমেনবাবু প্রথমেই ওঁকে প্রশ্ন করেন, মিঃ চৌধুরী, আপনি কি রায়বাহাদুরের সহপাঠী ছিলেন?
না, আমার সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব…
মিঃ চৌধুরী, এটা কোর্ট। বাচালতা করার জায়গা না যে প্রশ্নের যেটুকু জবাব, শুধু সেইটুকুই বলবেন। তার বেশি বকবক করবেন না। আপনি সহপাঠী ছিলেন না, সেইটুকু যথেষ্ট।
কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী মনে মনে অত্যন্ত অপমানিতবোধ করলেও নীরবে তা হজম করেন।
এবার হেমেনবাবু প্রশ্ন করেন, আপনিই কি এই বিয়ের ঘটকালি করেন?
হ্যাঁ।
অর্থাৎ জগত্তারিণী দাসী পরবর্তীকালে বন্ধুপত্নী হলেও তার সঙ্গে আগে থেকেই আপনার সবিশেষ পরিচয় ছিল।
কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, হ্যাঁ ছিল।
আপনার দেশ কোথায়?
মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে।
সেখানেই লেখাপড়া করেছেন?
হ্যাঁ।
ম্যাট্রিক পাশ করেছেন?
না।
আপনি বিবাহিত?
আপনার কটি ছেলেমেয়ে?
চার মেয়ে।
বড় মেয়ের বয়স কত?
তা তিরিশ-বত্রিশ হবে।
বিয়ে হয়েছে?
হ্যাঁ।
বড় জামাইকে কত নগদ দিতে হয়েছিল?
পাঁচ হাজার।
সব মেয়ের বিয়ে হয়েছে?
তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
আপনি স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে কোথায় বেশি সময় থেকেছেন?
ওরা সবাই বহরমপুরে থেকেছে। আমি কলকাতা থেকে নিয়মিত যাতায়াত করেছি এবং এখনও করি।
বহরমপুরে কে ওদের দেখাশুনা করেন?
কাকারা আছেন, তিন ভাই আছে।
আপনি কলকাতায় থাকেন কেন?
ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য এখানে থাকি।
আপনার দোকান বা অফিস আছে?
না।
তাহলে কীসের ব্যবসা করেন?
সাপ্লাইয়ের।
কী সাপ্লাই করেন? ঘটকালি করে জগত্তারিণী দাসীর মতো দ্বিতীয় পক্ষের বউ সাপ্লাই করেন?
হেমেনবাবুর প্রশ্ন শুনে কোর্টঘরে উপস্থিত সবাই হেসে ওঠেন। এমনকি হাকিম পর্যন্ত একটু চাপা হাসি না হেসে পারেন না। হাসতে পারেন না জগত্তারিণী দাসীর উকিল আর সাক্ষী স্বয়ং।
কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলেন, হ্যাঁ, ঘটকালি করেও রোজগার করি। তাছাড়া নানা অফিসে মালপত্র সাপ্লাই দিই।
রায়বাহাদুরের সঙ্গে জগত্তারিণী দাসীর বিয়েতে কে আপনাকে টাকা দেন?
রায়বাহাদুর।
কত টাকা দিয়েছিলেন?
আড়াই হাজার।
কোন ব্যাঙ্কের চেক দিয়েছিলেন?
নগদ দিয়েছিলেন।
রায়বাহাদুর আপনার বন্ধু ছিলেন এবং আপনিই তার বিয়ে দেন। আপনার স্ত্রী কন্যারা সে বিয়েতে নিশ্চয়ই উপস্থিত ছিলেন?
না।
এবার হেমেনবাবু কোটের পকেট থেকে একটা ছবি বের করে সাক্ষীর সামনে এগিয়ে ধরে প্রশ্ন করেন, ঘোষালবাবুদের বাগানবাড়িতে ভোলা এই ছবিতে আপনি যে মেয়েটিকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে অর্ধশায়িত আছেন, তিনিই কী জগত্তারিণী দাসী?
প্রশ্ন শুনে সবাই চমকে উঠলেন। কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী স্তম্ভিত। জগত্তারিণীর উকিলবাবুর মুখের রক্ত কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে।
হঠাৎ হেমেনবাবু সিংহের মতো গর্জন করে উঠলেন, জবাব দিন মিঃ চৌধুরী।
হ্যাঁ, উনিই জগত্তারিণী দাসী।
এবার হেমেনবাবু বলেন, মিঃ চৌধুরী, আপনার লেখা একটা চিঠি আপনাকে দিচ্ছি। অনুগ্রহ করে এই চিঠিটা মহামান্য হাকিমকে পড়ে শোনান।
চিঠিখানা হাতে নিয়ে কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরীর চক্ষুস্থির। মুখ দিয়ে একটি শব্দ বেরোয় না। দুচার মিনিট কেটে যাবার পর হেমেনবাবু ওঁর হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে পড়তে শুরু করেন–
মাই ডিয়ার ঘোষালমশাই, দোলযাত্রা তো আসিয়া গেল। জগত্তারিণী এখন হইতেই নাচিতে শুরু করিয়াছে। না করিবার কোনো হেতু নাই। গত দুই বৎসর দোলযাত্রার সময় আমি আর জগত্তারিণী আপনার বাগানবাড়িতে যে অফুরন্ত আনন্দ ও স্ফুর্তি করিবার সুযোগ পাইয়াছি, তাহা কি ইহজীবনে ভুলিয়া যাওয়া সম্ভব? আশা করি শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় এইবারও দোলযাত্রা উপলক্ষে জগত্তারিণী আকণ্ঠ সুরাপান করিয়া আমাকে ও আপনাকে সমান আনন্দদান করিবে।
হেমেনবাবু একটু থেমে বলেন, ইতি–কলির কৃষ্ণ কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরী।
চিঠিখানা শুনে সবার মুখেই চাপা হাসি। হেমেনবাবু চিঠিখানা হাকিমের হাতে পেশ করে বললেন, ইওর অনার, সাক্ষীকে আমার আর কিছু প্রশ্ন করার নেই।
জগত্তারিণীর পক্ষে আরও কয়েকজন সাক্ষী হাজির করা হয় কিন্তু হেমেনবাবু তাদের কাউকেই কোনো প্রশ্ন করেন না। তবে মাননীয় হাকিমের কাছে নিবেদন করেন, ইওর অনার, আমি মাত্র দুজন সাক্ষী হাজির করব। আমার প্রথম সাক্ষী একজন বৃদ্ধা।
একজন বৃদ্ধা বিধবা সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবার পরই হেমেনবাবু প্রশ্ন করেন, আপনার নাম?
বাবা, আমার নাম মোক্ষদা দাসী।
আপনি কবে বিধবা হয়েছে?
তখন বোধহয় আমার বয়স সতেরো-আঠারো হবে।
আপনার স্বামীর নাম মনে আছে?
তা থাকবে না?
কী নাম ছিল তাঁর?
অ ভ-ইকার, র-আকার আর ম।
অভিরাম?
ঠিক বলেছ বাবা।
আপনার কোনো ছেলেমেয়ে হয়েছিল?
দুঃখের কথা কী বলব বাবা, একটা মেয়ে হয়েছিল কিন্তু একটা বদমাইশের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
আপনার মেয়ের নাম কী?
জগত্তারিণী।
হেমেনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধা মোক্ষদা দাসী হাকিমকে বলেন, বিধবা হবার পর ভাইদের কাছেই আশ্রয় পাই। স্বামী হারাবার দুঃখের কথা বাদ দিলে ভাইদের কাছে ভালই ছিলাম। মেয়েটাও লেখাপড়া শিখছিল। আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠল। বয়সের তুলনায় জগত্তারিণীকে একটু বেশি ডাগর-ডোগর দেখাতো।
তারপর?
আমার মেজ ভাইয়ের এক মেয়ের বিয়ের সময় বরযাত্রীদের সঙ্গে একটা ছোকরা এসে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এমন মেতে উঠল যে সে আর বরযাত্রীদের সঙ্গে ফিরে গেল না। দিন দশেক পর ঐ হতচ্ছাড়া আমার মেয়েটাকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল।
ঐ হতচ্ছাড়ার নাম কী?
কেষ্ট! কেষ্ট চৌধুরী।
আচ্ছা এটা কত বছর আগেকার কথা?
তখন ওর বয়স ঠিক ষোল।
আপনার মেয়ে খারাপ হয়ে গেছে, এ ধারণা হলো কী করে?
বাবা, মা হয়ে মেয়ের বিষয়ে সব কথা কি বলা যায়? তবে এইটুকু শুনে রাখো, কেষ্ট আমার মেয়েকে বিয়ে করে কিন্তু তা সত্ত্বেও ও নিজের বউকে বড়লোকদের বাগানবাড়িতে পাঠিয়ে বেশ মোটা টাকা রোজগার করেছে।
আপনি প্রমাণ দিতে পারেন?
একবার তো মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছিল। তাছাড়া কেষ্টর দাদা বিনোদকে জিজ্ঞেস করলেই সব জানতে পারবে।
জগত্তারিণীর উকিল একে জেরা না করেই ছেড়ে দিলেন।
এবার হেমেনবাবুর দ্বিতীয় সাক্ষী রায়বাহাদুর অনাদি ঘোষাল হাজির হয়ে বললেন, জমিদারির কাজকর্ম দেখাশুনা করার পর আমি যেটুকু সময় পাই, তা আমি সঙ্গীতচর্চায় ব্যয় করি। গানবাজনা শোনার জন্যই মাঝে মাঝে বড় বড় ওস্তাদ আর বাঈজীদের নিয়ে বাগানবাড়িতে আসর বসাই। কলকাতার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিই সেসব আসরে হাজির থেকেছেন।
কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?
ও আমার মোসাহেবী করে কিছু টাকাকড়ি পায়।
জগত্তারিণীকে চেনেন?
হ্যাঁ, ও কেষ্টর রক্ষিতা কিন্তু…
কিন্তু কী?
রোজগার করার মতো কোনো মুরোদ কেষ্টর নেই। তাই ও মাঝে মাঝেই এক একজন বড়লোককে ধরে এনে জগত্তারিণীকে ভিড়িয়ে দিয়ে কিছু টাকা আয় করতে।
এ ধরনের দুচারজন বড়লোকের নাম বলতে পারেন?
তার মধ্যে একজন তো আমি নিজে!
রায়বাহাদুরের উত্তর শুনে সবাই হেসে ওঠেন।
বৃদ্ধ হেমেনবাবু একটু চাপা হাসি হেসে প্রশ্ন করেন আপনি, ছাড়া আর কারুর নাম বলতে পারেন?
রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্ত।
মিঃ রায় এই সাক্ষীকে জেরা করেছিলেন অনেকক্ষণ ধরে কিন্তু যেসব উত্তর আদায় করেছিলেন, তার দ্বারা ওঁর মক্কেলের কেচ্ছা-কাহিনী আরো নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ল।
জগত্তারিণী দাসী মামলা করেছিলেন দুটি কারণে। প্রথমত, রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্তর যে উইলটি তার ছেলেরা ওকে দেখিয়েছেন, তা জাল এবং ওকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যই এই জাল উইলটি তৈরি করা হয়েছে। উনি এই উইলটি মানতে রাজি নন। দ্বিতীয়ত, উনি রায়বাহাদুরের বিবাহিতা স্ত্রী এবং সেজন্য রায়বাহাদুরের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অর্ধেক তাঁর প্রাপ্য।
মাননীয় হাকিম যে এই দুটি বিষয়েই মামলা বাতিল করেছিলেন, তা নয়। উপরন্তু তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ইহা দিনের আলোর মতো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে জগত্তারিণী দাসী একজন বারবণিতা ছাড়া আর কিছুই নহে এবং কৃষ্ণবিনোদ চৌধুরীর মন্ত্রণাতেই তিনি কলিকাতা মহানগরীর একটি বিশিষ্ট পরিবারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জঘন্য। ষড়যন্ত্র করিয়া এই মামলা দায়ের করেন। রায়বাহাদুরের পুত্ররা এই দুইজনের বিরুদ্ধে অবশ্যই মানহানির মামলা দায়ের করিতে পারেন।
.
দুর্গাপদ অত্যন্ত গুরুগম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। দেখে মনে হয়, সব সময় চিন্তিত। একমাত্র ছোট ভাইদের কটি ছেলেমেয়ে ছাড়া কেউ ওঁকে হাসতে দেখেন না। তবে সেদিন কোর্ট থেকে বেরুবার সময় ভাই আর বউদের বলেছিলেন, আজ আমাদের সত্যি আনন্দের দিন। তোমরা আজ যে যা চাইবে, আমি তাই দেব।
বড়বাবুর কথা শুনে সবার মুখেই হাসি।
দুর্গাপদ এবার বললেন, হেমেনকাকা কোর্টরুমের বাইরে বেরুলেই আমরা সবাই ওঁকে প্রণাম করব।
দুতিন ভাই প্রায় এক সঙ্গেই বলেন, হ্যাঁ, সে তো একশ বার! বড়বউ বললেন, সবার আগে আমরা চারজনে প্রণাম করব। তারপর তোমরা পাঁচ ভাই ওঁকে প্রণাম করবে।
একে একে ওঁরা সবাই প্রণাম করতেই হেমেনবাবু খুশির হাসি হেসে বলেন, আরে, আরে, তোমরা কী করছো?
দুর্গাপদ একটু হেসে বললেন,কাকাবাবু, শুধু আপনার দয়াতেই তো আমরা বেঁচে গেলাম।
হেমেনবাবু একটু হেসে বলেন, না, না, আমি কোনো দয়া করিনি। তোমার বাবাকে আমি দাদা বলে ডাকতাম; তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। তোমার বাবার মোটরগাড়ি চড়েই আমি প্রথম দিন কোর্টে এসেছি। তোমাদের প্রতি এটুকু কর্তব্য না করে কি থাকতে পারি?
মেজবাবু কালীপদ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা কাকাবাবু, ওরা যদি হাইকোর্টে যায়?
তাতে কোন লাভ হবে না। উনি একটু থেমে বললেন, আমার মনে হয় না ওরা হাইকোর্টে যাবে।
.
মামলা জেতার আনন্দে সন্ধেবেলায় কাঁসারীপাড়ার শিবমন্দিরে আর কালীঘাটের মায়ের মন্দিরে পুজো দেওয়া হলো। পাড়ার প্রত্যেকটি বাড়িতে বড়বউ হাঁড়িভর্তি রসগোল্লা পাঠালেন। বড় দুভাই পুজোর প্রসাদ আর দুহাঁড়ি মিষ্টি দিয়ে এলেন হেমেনকাকার বাড়িতে। বাড়ির ছেলেমেয়েরা মোটরগাড়ি চড়ে ইডেন গার্ডেন বেড়িয়ে এলো। একটু বেশি রাত্তিরে ভাই আর বউদের আসর বসল।
কিগো, যা চাইব, তাই দেবে তো? বড়বউ মিটমিট করে হাসতে হাসতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন।
দুর্গাপদ একটু হেসে বললেন, সবার আগে নবৌমাকে বলতে দাও। সব শেষে তোমার চান্স আসবে।
ঠিক আছে।
দুর্গাপদ বলেন, ন’বৌমা, বল তোমার কী চাই?
বড়বাবুকে এ বাড়ির সবাই ভয়ও করে, ভক্তিও করে। ওঁর কথা শুনে নবৌমা একটু হেসে লজ্জায় মুখ নিচু করেন।
কী হলো ন’বৌমা? বলল, তোমার কী চাই? দুর্গাপদ মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলেন, বড় দাদার কাছে কিছু চাইতে ছোট বোনেরা কী লজ্জা করে?
বড়বউ হাসতে হাসতে বলেন, ওরে বোকা মেয়ে, এমন সুযোগ আর পাবি না। বল কী চাই।
দুর্গাপদ আবার বলেন, তাছাড়া আজ আমাদের এত আনন্দের দিন। তোমাদের কিছু দিতে পারলে আমিই সব চাইতে বেশি আনন্দ পাবো।
ন’বৌমা মুখ নিচু করেই বলেন, পুরী যাবো।
নিশ্চয়ই যাবে। দুর্গাপদ সঙ্গে সঙ্গে নভাইকে বললেন, শিবু, কাল সকালেই আমি তোকে টাকা দেব। কাল-পরশুর মধ্যেই তোদের টিকিট কাটবি। টিকিট কাটা হলেই ওখানকার খরচপত্তরের টাকাও পেয়ে যাবি।
এবার উনি শিবপদর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, শোনো বৌমা, তোমার হাতখরচের জন্য যে টাকা দেব, তার একটি পয়সাও শিবুকে দেবে না।
বড়ভাসুরের কথা শুনে নবৌমা না হেসে পারেন না।
বড়বউ বললেন, ওকে কত টাকা দেবে, তা বলে দাও।
আমি ওকে পাঁচশও দিতে পারি, পাঁচ হাজারও দিতে পারি। তোমাদের সামনে বাব কেন? বড়বাবু হাসতে হাসতে বলেন, নবৌমা, তোমাকে আমি কত দেব, তা কাউকে বলবে না।
ওঁর কথায় সবাই হাসেন।
দুর্গাপদ একে একে সবাইকে প্রশ্ন করেন। যে যা চায় তাকে, তাই দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। সব শেষে বড়বউকে জিজ্ঞেস করেন, এবার বল তোমার কী চাই?
বড়বউ চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলেন, আমার চার বউ মিলে ঝগড়া করে ঠিক আনন্দ পাচ্ছি না। দুএক মাসের মধ্যেই এই বাড়িতে একটা টুকটুকে সুন্দরী ছোট্ট বউ আনতে হবে।
ওঁর কথা শুনে সবাই হেসে ওঠেন।
গুরুপদ লজ্জায় দ্বিধায় কোনমতে বলে, আমি ওসবের মধ্যে নেই।
তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না ছোট ঠাকুরপো। বড়বউ হাসতে হাসতে বলেন, তুমি শুধু মালাবদল করবে। ফুলশয্যা হবে তো আমার সঙ্গে।
বড়দার সামনে গুরুপদ আর একমুহূর্ত থাকতে পারে না। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
দুর্গাপদ বললেন, তোমাদের সবার যদি মত থাকে, তাহলে আমি আপত্তি করব কেন?
অন্য তিন বউ প্রায় একসঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বড়দা, এবার ছোট ঠাকুরপোর বিয়ে দিন।
ঠিক আছে, তোমরা মেয়ে দেখতে শুরু করো। দুর্গাপদ একটু থেমে বললেন, শুধু মনে রেখো, মেয়েটি যেন তোমাদের মতোই ভাল হয়।
নবৌমা হাসতে হাসতে বলেন, যে মেয়েকে আমরা পছন্দ করেছি তাকে আপনাদের সবারই..
মেজবাবু কালীপদ বললেন, মেয়ে পছন্দ করা হয়ে গেছে?
বড়বউ বললেন, তোমাদের ভরসায় থাকলে তো ছোট ঠাকুরপোকে আইবুড়োই থাকতে হবে।
সেজবাবু শ্যামাপদ বললেন, ঠিকই বলেছ বড়বৌদি।
আনন্দের বন্যায় ভেসে যায় দত্ত পরিবার। পাড়ার সবার মুখেই এক কথা, দুর্গাপদর মতো মানুষ হয় না। যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের বুদ্ধি, সেইরকম কর্তব্যপরায়ণ ও স্নেহশীল। পাড়ার বুড়িরা বলেন, সাক্ষাৎ যুধিষ্ঠির। এর মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রঘাত!
.
কোর্টের সমন পেয়েই দুর্গাপদ চমকে উঠলেন। জগত্তারিণী টাকা পাননি?
মেজভাই কালীপদ একটু বেশি রাত্রে বাড়ি ফিরলেও দুর্গাপদ তাকে ডেকে পাঠালেন।
বড়, আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ, বসো। দুর্গাপদ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ব্যাঙ্কের কাগজপত্রগুলো জগত্তারিণীকে পৌঁছে দিয়েছিলে?
প্রশ্ন শুনে কালীপদ একটু যেন চমকে ওঠেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেন, উনি পাননি?
তুমি পৌঁছে দিয়েছিলে কি?
কালীপদ মুখ নিচু করে বলেন, সেদিন আমি একটু ব্যক্তও ছিলাম, তাছাড়া ওখানে যেতে ইচ্ছা করছিল না বলে সরকার বাড়ির ছোটকর্তার মারফত..
দুর্গাপদ খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বুঝেছি। তারপর একটু থেমে বললেন, জগত্তারিণী মামলা করেছে।
মামলা করেছে?
করবে না কেন? উনি এক নিঃশ্বাসে বলে যান, আমরা যদি তার প্রাপ্য চার লাখ টাকা না দিই, তাহলে তিনি মামলা করবেন না?
কালীপদ মুখ নিচু করেই থাকেন। কোনো কথা বলেন না।
পরের দিন সকালে দুর্গাপদ সব ভাইদের সামনে মামলার সমনটা রেখে বললেন, আমি খোলাখুলিভাবেই তোমাদের জানাতে চাই, একজন বেশ্যা মামলা করে বলছে যে, আমরা তার প্রাপ্য চার লাখ টাকা মেরে দিয়েছি, এটা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মামলা লড়তে চাই না এবং জোর করে লড়লেও হেরে যেতে বাধ্য।
ন’ভাই শিবপদ বললেন, ব্যাঙ্ক বলছে, টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে অথচ জগত্তারিণী বলছে, সে টাকা পায়নি, এ তো ভারি মজার ব্যাপার।
দুর্গাপদ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার স্থির বিশ্বাস সরকার বাড়ির ছোটকর্তা কাউকে জাল জগত্তারিণী সাজিয়ে টাকাটা তুলে নিয়েছেন। ভুলেও যেও না, সরকার বাড়ির ছোটকর্তাই সাক্ষী হিসেবে ব্যাঙ্কের কাগজপত্রে সই করেছেন।
সব দেখে শুনে তাই তো মনে হচ্ছে। সেজভাই শ্যামাপদ বললেন।
এবার দুর্গাপদ মেজভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, কালী, ছোটকর্তা তোমাকে কত দিয়েছেন?
মেজবাবু মুখ নিচু করে বললেন, আমার শেয়ার থেকে চার লাখ জগত্তারিণীকে দিয়ে দেবেন।
এটা যৌথ পরিবার। লাভ-ক্ষতি যাই হোক, আমরা সবাই তা ভাগ করে নেব কিন্তু আমি সঙ্গে সঙ্গে এ কথা বলতে বাধ্য, তোমার জন্যই এই সংসারটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
মেজবাবু আর বসতে পারলেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে বললেন, কালই হেমেনকাকাকে খবর দেবেন। তিনি আমাদের বিষয়-সম্পত্তি ভাগ করে দিলেই আমি চলে যাবে। আর ঐ চার লাখ টাকার জন্য আপনাদের ভাবতে হবে না। আমি জগত্তারিণীর কাছে গিয়ে মিটমাট করে নেব।
মিটমাট মানে?
উনি যাতে মামলা তুলে নেন, তার ব্যবস্থা করবো।
মামলা তুলে নিলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। দুর্গাপদ সোজাসুজি বলেন, দুজন বিশিষ্ট সাক্ষীর সামনে ওকে লিখে দিতে হবে, উনি টাকাটা ও জমির দলিলপত্র ঠিক মতো পেয়েছেন।
ঠিক আছে; তাই হবে। কালীপদ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
দুর্গাপদ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, গিরীশবাবুর মতো আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।
.
০৬.
খবরের কাগজ হাতে নিয়ে অঘোরনাথকে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই কণিকা জিজ্ঞেস করেন, কী হলো ছোট কাকা, জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন?
বৃদ্ধ ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, দুঃখের কথা কি জানো ছোট মা, মিষ্টি আমেই বেশি পোকা লাগে; টক আমে কখনই পোকা পাবে না।
কণিকা চুপ করে এর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
অঘোরনাথ একটু চুপ করে থাকার পর বলেন, সত্যি বলছি ছোট মা, দত্তবাড়ি ভাঙছে। দেখে আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে।
এ পাড়ার প্রত্যেকটা পুরনো বাড়ি আর বাসিন্দাদের প্রতি আপনার খুব দুর্বলতা, তাই ছোটকাকা?
উনি একটু এগিয়ে ইজিচেয়ারে বসতে বসতে বলেন, হ্যাঁ, ছোট মা, তুমি ঠিকই ধরেছ।
অঘোরনাথ একটু থামেন। আপন মনে কী যেন ভাবেন। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, হাজার হোক বিরাশি বছর আগে এই পাড়াতেই জন্মেছি, এখানেই বড় হয়েছি। এ পাড়ার প্রত্যেকটা পরিবার তো দূরের কথা, প্রত্যেকটা বাড়ির ইট-কাঠের সঙ্গেও আমার একটা সম্পর্ক আছে।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে কণিকার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, আমার জীবনের সব চাইতে আনন্দের স্মৃতিগুলো তো এখানেই ছড়িয়ে আছে।
একটা মোড়া টেনে নিয়ে ওঁর সামনে বসে কণিকাও একটু হাসেন। তারপর বলেন, সারাজীবন বাইরে বাইরে চাকরি করলেন কিন্তু সব আনন্দের স্মৃতিগুলো শুধু এখানেই ছড়িয়ে আছে?
হ্যাঁ, ছোট মা, সত্যিকার আনন্দের স্মৃতিগুলো শুধু এখানেই ছড়িয়ে আছে।
অঘোরনাথ একবার নিঃশ্বাস নিয়েই আবার বলেন, চাকরির জন্য পেশোয়ার আম্বালা-দিল্লি-মীরাট বা এলাহাবোদে থাকলেও ছুটিতে সব সময় ছুটে এসেছি এই ভবানীপুরে। ছুটিতে অন্য কোথাও যাবার কথা ভাবতেই পারতাম না।
কণিকা বলেন, কিন্তু ছোট কাকা, অপনি এখন ভবানীপুরে থেকেও তো সব সময় মনমরা হয়ে তাকে।
না, ছোট মা, সব সময় আমার মন খারাপ হয় না।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলে, তুমি আর নীতু আমাকে যে আদর-যত্ন-সম্মানের সঙ্গে রেখেছ, তার জন্য আমি যে কী আনন্দে থাকি, তা আমি মুখে বলে বোঝাতে পারব না।
এটা তো আমাদের কর্তব্য ছোটকাকা।
না, ছোট মা, তোমরা শুধু কর্তব্য পালন করো না।
উনি একটু থেমে বলেন, একটু আশ্রয় আর দুবেলা দুমুঠো খেতে দিয়েই তোমরা কর্তব্য শেষ করতে পারতে কিন্তু তাহলে আমি আনন্দে খুশিতে থাকতাম না।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন,আদর-যত্ন-সম্মান অনেক মিষ্টি, অনেক লোভনীয়।
মুহূর্তের মধ্যে ওঁর মুখ থেকে হাসি উবে যায়। বেদনার্ত হয়ে ওঠে চোখ-মুখের চেহারা। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আশেপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যায়।
ছোটকাকা, একটা কথা বলব?
হ্যাঁ, ছোট মা, বলো।
আমাদের পাড়ার কিছু কিছু লোকের প্রতি আপনার অহেতুক দুর্বলতা আছে।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, আমি জানি, মিত্তিরবাড়ির রামপ্রসন্নকে টাকাকড়ি দিয়ে সাহায্য করলে তুমি রাগ করো কিন্তু…
ওঁর কথার মাঝখানেই কণিকা বলেন, উনি যে টাকাকড়ি পেলেই রেসের মাঠে চলে যান। তাই..
আমি জানি ছোট মা, তোমার রাগের কারণ আছে কিন্তু তবু পুরনো দিনের কথা মনে করে আমি কিছুতেই ওকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারি না। রামপ্রসন্নর ঠাকুমাই যে আমার নাড়ি কেটেছিলেন, সে কথা ভুলি কী করে?
মুহূর্তের জন্য একটু থেমে একবার নিঃশ্বাস নিয়েই উনি বলেন, সত্যি বলছি ছোট মা, এই পাড়াটাকেই মনে হতো নিজের সংসার, নিজের পরিবার।
কণিকা চুপ করে শুনে যান।
অঘোরনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এই যে চোখের সামনে দত্তবাড়ি ভেঙে ফেলছে, তা আমি সহ্য করতে পারছি না।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর কণিকা বলেন, কিন্তু ছোট কাকা, শুনেছি, দত্তবাড়ির কোনো এক মেজবাবুর জন্যই এই পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেল।
দত্তবাড়ির এই মেজবাবু একটি কুলাঙ্গার ছিলেন।..
কণিকা ওঁর মুখে ঐটুকু শুনেই একটু হেসে বলেন, সরকারবাড়ির বুড়ির কাছে সেইরকমই শুনেছি।
তুমি সরকারবাড়ির ছোটগিন্নীর কাছে যাও?
যাই মানে, শিবরাত্তির, অম্বুবাচী বা নববর্ষ-বিজয়ার সময় গিয়ে ফলমূল-মিষ্টি দিয়ে একটা প্রণাম করে আসি।
ভালই করো। ও বুড়ি সত্যি খুব ভাল মানুষ।
হ্যাঁ, কথাবার্তা শুনে তাই মনে হয়।
কণিকা একটু থেমে বলেন, উনি আমাকে খুবই স্নেহ করেন।
অঘোরনাথ একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, এই বুড়ি যেমন ভাল মানুষ, ওর স্বামী ছিল ঠিক ততটাই বদমাইশ। অমন চরিত্রহীন লোক বোধহয় ভূ-ভারতে জন্মায়নি।
উনি একটু থেমে বলেন, আর এই মহাপুরুষটির প্রাণের বন্ধু ছিলেন দত্তবাড়ির মেজবাবু।
হ্যাঁ, ঐ বুড়ির কাছেই শুনেছি, দত্তবাড়ির মেজবাবু ওঁর স্বামীর বন্ধু ছিলেন।
ওদের দুজনের কতা ভাবতে গেলেই রাগে, দুঃখে, ঘেন্নায় মাথা ঘুরে যায়।
.
দত্ত পরিবারের পরম সুহূদ ও পরম নির্ভরযোগ্য উকিল হেমেনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, আমাকে এই কাজ করতে হবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলবো, মামলা-মোকদ্দমা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি হবার আগেই যে তোমরা সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছ, ঠিকই করেছ।
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই মেজবাবু বললেন, কাকা, আমি কোনো ব্যবসা চাই না। আমি শুধু ভবানীপুরের বাড়ি আর নগদ টাকা চাই।
হেমেনবাবু বললেন, কালীপদর এই প্রস্তাবে কারুর কোনো আপত্তি আছে?
একে একে চার ভাই বললেন, না কোনো আপত্তি নেই।
আর কারুর কিছু বিশেষ দাবি আছে?
ছোটবাবু বললেন, কাকা, আমাকে আলাদা করে কিছু দেবেন না। আমি তো বড় দাদা বড় বৌদির সঙ্গেই থাকবো।
ওর কথা শুনেই বড়বাবু বললেন, না, না কাকা, বিষয়-সম্পত্তি যাকে যা দেবার, তা আপনি ঠিক করে দিন। তারপর যার যেখানে খুশি, সেখানে থাকুক।
হেমেনবাবু বললেন, দুর্গাপদ, তুমি ঠিকই বলেছ।
উনি একটু থেমে বললেন, বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারটা এখনই পাকাঁপাকিভাবে ঠিক হয়ে যাক।
যাই হোক, সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির কাগজপত্র আর হিসেব-নিকেশ ও তৎকালীন বাজার-দর বিচার-বিবেচনা করে হেমেনবাবু একমাস পর পাঁচ ভাইকে ভাগাভাগি করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে চাও?
উনি একটু থেমে বলেন, তোমাদের কারুর কোনো আপত্তি থাকলে আমি আবার সবকিছু ভেবে দেখব।
না, কেউই কোনো আপত্তি করলেন না। সবাই ওঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন।
এই ভাগবাটোয়ারায় মেজবাবু ভবানীপুরের বাড়ি ছাড়াও নগদ সাড়ে ছলাখ টাকা পেলেন। তবে হাতে পেলেন ছলাখ। সরকারবাড়ির ছোট কর্তার পরামর্শে জগত্তারিণীর টাকা থেকে যে পঞ্চাশ হাজার দিয়ে বরানগরে গঙ্গার ধারে এক পাটকলের সাহেবের বাগানবাড়ি কিনেছিলেন, তা ওঁকে দিতে হয় বলেই হাতে পেলেন ছলাখ।
মেজবাবু মহাখুশি। এতদিনের সংসারটা ভেঙে যাচ্ছে বলে মেজগিন্নি আগে দুঃখ করলেও শেষ পর্যন্ত ভবানীপুরের এই বিশাল বাড়ি আর নগদ ছলাখ টাকা স্বামীর হাতে আসায় খুসি না হয়ে পারলেন না। ওঁরা দুজনেই কত কি স্বপ্ন দেখেন!
বুঝলে মেজবউ, ঠিক করেছি, সবার আগে মেয়ের বিয়ের জন্য পুরো এক লাখ আলাদা করে রেখে দেব।
হ্যাঁ, তা তো রাখতেই হবে।
মেজগিন্নি একটু থেমে বলেন, রাধার বিয়ের সময় তো বড়বাবু বা বড়গিন্নি নিশ্চয়ই কিছু করবেন না; আর আমরাও কখনই ওঁদের কাছে হাত পাতবো না।
সে তো একশবার।
মেজবাবু একটু থেমে একগাল হাসি হেসে বলেন, আমি আর সরকারবাড়ির ছোটকর্তা এমন ব্যবসা করবো যে সবাই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
মেজগিন্নি একটু হেসে বলেন, ও বাড়ির ছোটর্কতা তো আমোদ-আহ্লাদ করেই দিন কাটান। ওর দ্বারা কি ব্যবসা হবে?
ওরে বাপু, আমি তো আছি।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। ওকে দিয়ে কী করে কাজ করিয়ে নিতে হয়, তা কি আমি জানি না?
সবই ঠিক কিন্তু তুমিও তো এতকাল বড়বাবুর কথায় উঠেছ-বসেছ। নিজের বুদ্ধিতে তো কিছু করোনি।
স্ত্রীর কথা শুনে মেজবাবু একটু রেগে যান।
তোমার কি ধারণা, এত বছর আমরা তিন ভাই ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকতাম আর বড়বাবু একাই এতগুলো ব্যবসা সামলাতেন?
এত কাল যা শুনে এসেছি, তাই বললাম।
ভুল শুনেছ।
মেজবাবু একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা আয় করে বড়বাবুর মাথা ঘুরিয়ে দেব। জগত্তারিণীও বলেছে, কালীপদ, আমি তোমার পিছনে আছি। কোনো চিন্তা কোরো না।
মেজগিন্নি অবাক হয়ে বলেন, তুমি ঐ নোংরা চরিত্রহীন মেয়েলোকটার সঙ্গে হাত মেলাবে?
কে কী খায় বা কে কার সঙ্গে রাত কাটায়, সেসব চিন্তাভাবনা করলে কি ব্যবসা বাণিজ্য করা যায়?
সবই বুঝলাম কিন্তু ঐ মহিলা যে অত্যন্ত অসৎ আর বদমাইশ, সে বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই। উনি যদি শেষ পর্যন্ত তোমাকে কোনো বিপদে ফেলেন?
আমি কি এতই কাঁচা ছেলে যে ঐ মাগী যেভাবে নাচাবে, আমি সেইভাবে নাচব?
ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে মেজবাবু বলেন, মেজবউ, ভুলে যেও না, আমি রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্তর ছেলে। তুমি দেখে নিও, ঐ মাগী আমার কথায় উঠবে আর বসবে।
মেজবউ আর তর্ক না করলেও স্বামীর কথায় বিশেষ আশ্বস্ত হতে পারেন না।
দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পর মেজবউ বললেন, এদিকে তোমার মেয়েকে নিয়ে তো আমি মহা সমস্যায় পড়েছি।
মেজবাবু অবাক হয়ে বলেন, কেন? রাধা আবার কী করল? বড়মা আর ভাইবোনের জন্য দিনরাত কান্নাকাটি করছে।
না, না, তুমি ওর এইসব ন্যাকামি একদম সহ্য করবে না।
সহ্য করবো না বললেই তো হলো না।
মেজবউ একটু থেমে বলেন, আমি পেটে ধরলেও বড়দিই তো ওর সবকিছু করেছেন। পাশে বড়মাকে পাচ্ছে না বলে মেয়েটা রাত্তিরে ঘুমুতে পর্যন্ত পারছে না। বিষয়-সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে বলেই তো মেয়েটা বড়মাকে শত্রুর ভাবতে পারে না।
শত্তুর না ভাবলেও মেয়েটাকে তো ওদের কাছে ফেলে রাখতে পারি না।
তুমি না পারলেও আমি পারি।
মেজবউ, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এত কাণ্ডের পর মেয়েকে ওদের কাছে। রাখবো?
উনি একটু থেমে বলেন, অসম্ভব। তা কখনই হতে পারে না।
কেন অসম্ভব?
মেয়েকে ওদের কাছে রাখলে আমার সম্মান থাকবে?
দুএক মিনিট পর মেজবাবু বললেন, যদি ইচ্ছা করো, তাহলে রাধাকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য আমার নতুন বাগানবাড়িতে গিয়ে থাকতে পারো।
আমি কি তোমার বাঈজী যে বাগানবাড়িতে গিয়ে থাকব? মেজবউ আর একমুহূর্ত দেরি না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। একটু পরেই বুড়ি সারদা মেজবাবুকে বলে, মেজমা বললেন, এখন তো মেয়ের ইস্কুল বন্ধ, তাই উনি আজ বিকেলে বাপের বাড়ি যাবেন। আপনি কি পৌঁছে দিতে পারবেন?
মেজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, বিকেলে আমার জরুরি কাজ আছে। তুমি আর মহাদেব মেজমাকে পৌঁছে দিও।
যে আজ্ঞে।
বুড়ি সারদা দুহাত জোড় করে ওঁকে নমস্কার করে চলে যায়।
.
সব শোনার পর সরকারবাড়ির ছোট ছোটকর্তা মুচকি হেসে বললেন, কালী, তুই সত্যি ভাগ্যবান।
ভাগ্যবান বলছিস কেন?
শালা বউগুলোর জন্যই তো আমরা প্রাণ খুলে কাজকর্মও করতে পারি না, আনন্দও করতে পারি না।
দুমাস ধরে টাকাগুলো নিয়ে বসে আছি কিন্তু এখনও পর্যন্ত কিছুই তো শুরু করতে পারলাম না।
ছোটকর্তা গম্ভীর হয়ে বলেন, দ্যাখ কালী, ভাল করে ভেবেচিন্তেই আমরা ব্যবসায় নামব। হঠাৎ দুম দাম করে কিছু করলে গণেশ ওল্টাতে বাধ্য।
তা ঠিক।
তাই বলছি, চল, আমরা বরানগরের বাগানবাড়িতে চলে যাই।…
ওখানে গিয়ে কী করব?
ওখানে গিয়ে আমরা দুএক হপ্তা আলাপ-আলোচনা করে একটা প্ল্যান ঠিক করব।
ওখানে তো এক বুড়ো দারোয়ান ছাড়া কোনো ঝি-চাকর নেই। আমাদের দেখাশুনো…
ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ছোটকর্তা একটু হেসে বলেন, বন্ধুবর, সেসব দায়িত্ব আমার উপরই ছেড়ে দাও। আমাকে শুধু দুটো দিন সময় দাও।
দুদিনের মধ্যেই সব লোকজনের ব্যবস্থা করতে পারবি?
আলবাত পারব।
ছোটকর্তা মুহূর্তের জন্য থেমে একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, পরশু দিন সন্ধেবেলায় তুই আমার সঙ্গে বাগানবাড়ি যাবি! দুরাত্তির থাকার পর যদি তোর মনে হয়, তেমন সেবা-যত্ন হচ্ছে না, তাহলে চলে আসিস।
ঠিক তো?
ওরে শালা, আমার নাম জয়নারায়ণ সরকার। আমি শুধু জয় করবার জন্যই জন্মেছি। আমি যা চাই, তাই পাই।
উনি একটু থেমে বলেন, তোকে একটু সেবা-যত্ন করার ব্যবস্থা করতে যদি না পারি, তাহলে এতকাল করলাম কী?
.
দুদিন পর বাগানবাড়িতে পা দিয়েই মেজবাবু সত্যি অবাক হয়ে গেলেন। দূর থেকে গাড়ি দেখেই নতুন উর্দি-পরা দারোয়ান গেট খুলে দেয়। তারপর গেট দিয়ে গাড়ি থামতেই দুটি দাসী ছুটে এসে ওঁদের দুজনের হাত ধরে নামিয়ে সামনের ড্রইংরুম আর নাচঘর পার করে ভেতরের ড্রংরুমে নিয়ে গিয়ে দুটো সোফায় বসিয়ে দেয়। দুজনের পা থেকে নিউকাট পাম্পশু খুলে দিয়ে জরি-দেওয়া দুটো চটি পরিয়ে দিতে না দিতেই অন্য দুটি দাসী এসে দুগেলাস চন্দনের শরবত দুজনের হাতে তুলে দেয়।
তারপর?
গঙ্গার পাড়ে সন্ধের অন্ধকার নেমে আসতে না আসতেই এই দাসীরাই ওদের মুখে তুলে দেয় হুইস্কির গেলাস। এক গেলাস শেষ হতে না হতেই আবার গেলাস ভরে দেয়। মাঝ-মধ্যে দুএকটা কাজু আর আখরোটের টুকরোও দাসীদের অনুরোধে ওদের খেতে
তিন-চার গেলাস পেটে যাবার পর ছোটকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, হারে কালী, কোনো অসুবিধে হচ্ছে নাকি?
কী যে বলিস শালা! মাইরি বলছি, দারুণ ভাল লাগছে।
রাত একটু গম্ভীর হতেই মেজবাবু এক দাসীর গলা জড়িয়ে গালচের উপর শুয়ে পড়েন।
এখনই শুচ্ছেন কেন? নুচি-মাংস রাবড়ি না খেয়ে শুতে পারবেন না।
শালা নুচি-মাংসের নিকুচি করেছে।
ছোটকর্তা ইশারা করতেই দুটি দাসী ওকে ধরাধরি করে শোবার ঘরে নিয়ে যায়।
পরের দিন অনেক বেলায় চোখ খুলতেই মেজবাবু দেখলেন, শুধু উনি না, দুটি দাসীও ওরই পাশে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে।
সন্ধেবেলার আসর জমে ওঠার পর ছোটকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে কালী, এই ছুঁড়িরা ঠিকমতো সেবা-যত্ন করছে তো?
মাইরি বলছি, জয়নারায়ণ, আমি এই দুটো মাগীকে ছেড়ে কিছুতেই ভবানীপুর ফিরে যাব না।
ওরে শালা, শরীর আর মন চাঙ্গা করে নিয়েই তো আমাদের ব্যবসা শুরু করতে হবে।
সেসব পরে ভেবে দেখব। তবে যাই করি না কেন, আমি এই গঙ্গাতীর ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।
.
যাব না, যাব না করেও মেজবাবু একদিন ভবানীপুর ফিরে আসেন। এ-ঘর ও-ঘর উপর-নিচ ঘুরেও মেজবউ আর মেয়েকে না দেখে চিৎকার করে ওঠেন, সারদা।
বুড়ি সারদা দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির হয়।
মেজবউ কোথায়?
তা তো জানি না।
বাপের বাড়ি থেকে এখনও ফেরেননি?
হ্যাঁ, ফিরেছিলেন কিন্তু দুচার দিন পরই আবার চলে গেলেন।
ও!
মেজবাবু দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পর বললেন, মহাদেব কোথায়?
নিচে আছে। পাঠিয়ে দেব?
হ্যাঁ, ওকে পাঠিয়ে দাও।
মহাদেব আসতেই মেজবাবু বললেন, ছোটকর্তাকে খবর দে, আমি এখনই ফিরে যাবো।
মহাদেব ওর হুকুম শুনেই সরকারবাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
আধঘণ্টার মধ্যেই দুই বন্ধু জুড়িগাড়ি চড়ে আবার বাগানবাড়ির দিকে রওনা হন।
.
এ সংসারের সব মানুষই ন্যায়-অন্যায় ভাল-মন্দ বিচার করতে পারে। চুরি করা অন্যায়, খুন করা জঘন্য অপরাধ, শুধু টাকা-পয়সার জোরে যৌনব্যভিচারে মত্ত থাকা আদৌ সম্মানীয় কাজ না–এইসব কথা গরিব বড়লোক শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই জানে।
তাই তো জুড়িগাড়ি চলে যেতে না যেতেই দত্তবাড়ির আদ্যিকালের ঝি সারদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ বিকৃতি করে আপনমনেই বলে, ছি! ছি! বাপের টাকা হাতে পেয়েছিস বলে কি দিনরাত্তির কুকুর-বেড়ালের মতো ফুত্তি করতে হয়!
মহাদেব পিছনে দাঁড়িয়ে বলে, মাসি, কুকুর-বেড়ালও হিসেব-নিকেশ করে ফুত্তি করে কিন্তু বাগানবাড়িতে যে বাঁদরামি আর অসভ্যতা হচ্ছে, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
ও মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, বাগানবাড়ির বুড়ো দারোয়ান কী বলছিল জানো?
সারদা মুখে কিছু না বলে শুধু ওর দিকে তাকায়।
মহাদেব একটু চাপা হাসি হেসে বলে, বুড়ো বলছিল, ঐ চারটে ছুঁড়ি যত বেশি অসভ্যতা করে, তত বেশি বখশিস পায়।
বৃদ্ধা সারদা একবার বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, ওরে বাপু, বাপের পুকুর বলে কি তাতে ঝাঁপ দিয়ে মরবি।
ঠিক বলেছ মাসি।
সারদা একটু হেসে বলে, যে মরবে আপন দোষে, কী করবে তার নরহরি দাসে!
হাজার হোক বহুদিনের ঝি-চাকর। সারদা তো সেই আদ্যিকাল থেকে এই বাড়িতে কাজ করছে। ও এই বাড়িতে আসার পরের বছরই তো নবাবুর জন্ম হলো। আঁতুড় ঘর থেকে বেরিয়েই গিন্নিমা ছেলেকে ওর কোলে দিয়ে বলেছিলেন, নে সারদা, তোকে এই ছেলেটা দিলাম। এর সব দায়িত্ব তোর।
গিন্নিমা যে ছেলেটা ওর কোলে দিয়েছিলেন, তার কারণ ছিল।
মাত্র ষোল বছর বয়সে শাঁখা ভেঙে, সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলে সাদা থান পরেও সারদা শুধু ছোট্ট দুবছরের ছেলেটাকে নিয়েই কোনোমতে দিন কাটাচ্ছিল, কিন্তু পোড়া কপালে ঐ সুখটুকুও সইলো না। ছেলেটাকে হারাবার পর সারদা প্রায় পাগল হয়ে গেল।
গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মোক্ষদা দিদির মেয়ে সারদার এই দুঃখের কাহিনী শুনেই গিন্নিমা ওকে নিয়ে কলকাতা চলে এলেন।
তার ঠিক তিন মাস পরেই শিবপদর জন্ম।
বাড়ির সবাই ওকে সারদা বলে ডাকলেও শিবপদ আর গুরুপদ ওকে মাসি বলেই ডাকে।
সেজন্য সারদার গর্বের শেষ নেই।
বাড়ির অন্য ঝি-চাকররা কোনো কারণে ওকে আলতু-ফালতু কিছু বললেই ও গর্জে ওঠে–দ্যাখ, তোরা মুখ সামলে কথা বলবি। আমি তোদের মতো মাইনে করা ঝি চাকর না। আমি নবাবু-ছোটবাবুর মাসি, সে কথা ভুলে যাস না।
দূরসম্পর্কের ভাইপো ছেলেমেয়েদের বিয়ে-থা উপলক্ষে পিসিকে নিতে এলেই সারদা বলতে, ইচ্ছে তো করে নাতি-নাতনীর বিয়েতে যাই, একটু আনন্দ করি কিন্তু এই পঞ্চু পাণ্ডবের সংসার ফেলে কী করে যাই বল।
মাখন বলে, পিসি, এ বাড়িতে অনেক কাজের লোক। তুমি দু-চারদিনের জন্য গেলে ওঁরা ঠিকই সামলে নিতে পারবেন।
সারদা আত্মপ্রসাদের একটু চাপা হাসি হেসে বলে, ওরে, তুই ঠিক বুঝবি না, আমি না থাকলে বড়মা আর নবাবু-ছোটবাবুর কী অবস্থা হয়।
একটু থেমে ও বলে, বিয়ে-থা মিটে যাক। তারপর একবার ফুরসত হলেই দুএকদিনের জন্য ঘুরে আসব।
আসল কথা হচ্ছে, সারদা এই সংসারটাকেই নিজের সংসার ভাবে, এই সংসারের মানুষ-জনই ওর আপনজন, প্রিয়জন।
তার কারণও আছে।
নিঃসঙ্গ নিঃসম্বল অবস্থায় মাত্র যোল-সতের বছর বয়সে যে সংসারে এসে চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর কাটিয়ে দিল, সেই সংসার ছেড়ে সারদা স্বর্গে যাবার কথাও ভাবতে পারে না।
শুধু এই সংসার কেন, এই বাড়িটা ছেড়ে যাবার কথাও ও ভাবতে পারে না।
বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা।
সেবার পাঁচ ভাই মিলে ঠিক করলেন, প্রত্যেকবারের মতো পুজোর সময় মধুপুর না গিয়ে পুরী যাওয়া হবে।
মধুপুর-গিরিডির বাড়িতে কয়েকজন কাজের লোক আছে বলে ভবানীপুরের বাড়ি থেকে দুতিনজন ঝি-চাকর নিয়ে গেলেই আর কোনো অসুবিধে হয় না কিন্তু পুরীতে। নিজেদের বাড়ি নেই বলে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে। তাই ঠিক হলো, স্ট্রান্ড রোডের গুদামের দুজন দারোয়ানকে ভবনীপুরের বাড়িতে রেখে সব কাজের লোকজনদেরও পুরী নিয়ে যাওয়া হবে।
সারদার একদম ইচ্ছে ছিল না কিন্তু শেষ পর্যন্ত না গিয়ে পারেনি। কিন্তু হা ভগবান! দুচারদিন পরই সারদা হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বড়গিন্নিকে বলল, বড়মা, এখানে। আমার কিছুতেই ঘুম আসে না। ঘুমুতে ভীষণ ভয় হয়। সত্যি বলছি বড়মা, আমি সারা রাত জেগে থাকি। তুমি বড়বাবুকে বলে আমাকে ভবানীপুর পাঠিয়ে দাও। এখানে থাকলে আমি ঠিক পাগল হয়ে যাব।
বড়গিন্নী বললেন, আমরা সবাই এখানে থাকব আর তুই একলা একলা ভবানীপুরের বাড়িতে থাকবি, তাই কখনো হয়?
তাতে কী হয়েছে?
অত বড় বাড়িতে তোর একলা একলা থাকতে ভয় করবে না?
ওখানে ভয় করবে কেন? ওটা তো আমাদেরই বাড়ি।
এই তো বিষয়-সম্পত্তি ভাগাভাগির সময়ও সারদা বড়গিন্নিকে বলেছিল, বডমা, তুমি আমাকে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে বলল না।
ও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, আমার কাছে এই বাড়িই কাশী-বিন্দাবন। আমি এই বাড়িতেই মরতে চাই।
.
কিন্তু মেজবাবুর কীর্তিকলাপের জন্য এই কাশী-বৃন্দাবনও সারদার কাছে নরক হয়ে উঠল।
এই মহাদেব, আমার একটা কথা রাখবি?
কী কথা, মাসি?
আগে বল, রাখবি কি না।
মহাদেব একটু হেসে বলে, তোমার কোন কথা শুনি না বলতে পারো?
আমাকে একটু মেজ মার কাছে নিয়ে যাবি? খুব জরুরি দরকার। মেজবাবু জানলে তো আমাকে খুন করে ফেলবে।
মহাদেব একটু থেমে বলে, মেজবাবুকে বলেছি, মেজ মার সঙ্গে দেখাশুনাই হয় না আর তোমাকে যদি সেখানে নিয়ে যাই, তাহলে…
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সারদা বলে, মেজবাবু জানবে কী করে? তিনি কী আজকাল এখানে থাকেন?
কিন্তু যখন-তখন তো এসে হাজির হতে পারেন।
সারদা সঙ্গে সঙ্গে বলে, তুই আমাকে সন্ধের পর নিয়ে যাবি। তখন তো মেজবাবু কখনই ঐ দুটো রাক্ষসীকে ছেড়ে আসবে না।
মহাদেব একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তা তুমি ঠিকই বলেছ।
পরের দিন সন্ধের পর মহাদেব সারদাকে নিয়ে মেজবাবুর শ্বশুরবাড়ি হাজির হয়।
সারদাকে দেখে মেজবউ একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন কী গো মাসি, হঠাৎ তুমি এখানে এলে?
সারদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কী করব বল মেজ মা, না এসে পারলাম না।
ও একটু থেমে বলে, ভগবান তো নিজের সংসার করার সুযোগ দিলেন না বলে তোমাদের সংসারটাকেই চিরকাল নিজের সংসার ভেবে এসেছি।
মেজবউ চুপ করে ওর কথা শোনেন।
দেখো মেজ মা, আমি মুখে কিছু না বললেও সবই জানি, সবই বুঝি। কর্তাবাবুও শখ-আহ্লাদ যথেষ্ট করেছেন কিন্তু তাই বলে তিনি সংসার-ধর্ম নষ্ট করেননি বা ছেলেমেয়ে বউকে ভাসিয়ে দেননি।
সারদা একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, পুরুষমানুষ একটু এদিক-ওদিক গিয়ে শখ-আহ্লাদ করবে, তাতে আর বলার কী আছে কিন্তু মেজবাবু যা শুরু করেছেন, তা তো আর সহ্য হচ্ছে না।
মেজবাবু আবার নতুন কী করলেন?
পরশু দিন কী হয়েছে জানো?
কী হয়েছে?
হঠাৎ মাঝরাত্তিরে জুড়িগাড়ি এসে থামতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় বেরুতেই দেখি, মহাদেব আর রাখাল লাফাতে লাফাতে নিচে নামছে।
সারদা দুহাত ঘুরিয়ে বলে, ব্যস! এরই মধ্যে মেজবাবু গাড়িতে বসে বসেই ওদের চোদ্দপুরুষ তুলে গালাগাল দিতে শুরু করেছেন।
মেজবউ গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মেজবাবু নিশ্চয়ই খুব নেশা করে এসেছিলেন?
সারদা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, শুধু কি মেজবাবু? সঙ্গে একটা রাক্ষসীকেও এনেছিলেন।
তারপর?
মেজবাবু গাড়ির মধ্যেই প্রায় শুয়ে রইলেন আর ঐ হতচ্ছাড়ি মাগী তোমাদের ঘরে এসে মেজবাবুর আলমারি খুলে জামা-কাপড় ও আরো কত কী নিয়ে চলে গেল।
বলিস কী রে?
তবে আর বলছি কী মেজ মা! সাধে কি আর তোমার কাছে ছুটে এলাম?
সারদা মুখ বিকৃত করে বলে, ঐ মাগীর কাণ্ডকারখানা আর কথাবার্তা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেছি। ঐ মাগী সেদিন আমাকে যা অপমান করেছে, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
কেন? তুমি কী করেছিলে?
আলনা থেকে তোমার কয়েকটা ভাল ভাল শাড়ি নিচ্ছিল বলে আমি বলেছিলাম, ও গুলোয় হাত দিও না। ওসব মেজ মা’র।
আমার শাড়ি নিয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
সারদা মেজবউয়ের দুটো হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, জানো মেজ মা, আমি আপত্তি করেছিলাম বলে রাক্ষসী ঠাস করে আমার গালে একটা চড় মেরে বলল, তোর চৌদ্দপুরুষের মেজমাকে বলিস, এ বাড়ির সবকিছু আমার।
কী বলছো মাসি?
মেজবউ প্রায় চিৎকার করেই বলেন।
কেউই বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলে না।
আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সারদা বলে, দেখো মেজ মা, আমি তোমাদের বাড়ির ঝি হলেও তো নবাবু-ছোটবাবুকে মানুষ করেছি। শুধু ওরা না, তোমরাও তো আমাকে মাসি বলেই ডাকো। তাই তো হতচ্ছাড়ির কথায় বড় খারাপ লেগেছে।
খারাপ লাগারই তো কথা।
যা হোক মেজ মা, তুমি একটা কিছু বিহিত করো। তা না হলে বোধহয় মেজবাবুকে। আর পাবে না।
মেজবউ উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, মাসি, তোমার মেজবাবু যেখানে নেমেছে সেখান থেকে আর কোনদিন ফিরতে পারবে না। আর ফিরে এলেও তাকে নিয়ে ঘর করে কী শান্তি পাব?
উনি একটু থেমে বলেন, তবে মাসি, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, এর একটা বিহিত আমি করবই। এইরকম চরিত্রহীন বদমাইশ স্বামীকে নিয়ে ঘর করার মতো মেয়ে আমি না।
.
অঘোরনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনেই একটু হেসে বললেন, ছোট মা, এই মেজবউ কী করে মেজবাবুকে জব্দ করেছিলেন তা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
কণিকা অপলক দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
নিজের মেয়েকে বড়বাবু বড়বউ-এর কাছে রেখে দেবার দুচারদিন পর মেজ বউ নিজেই একদিন একটু রাত্তিরে বরানগরের ঐ বাড়িতে হাজির হয়ে সবার সঙ্গে হাসি ঠাট্টা তামাশা করতে করতে মেজবাবুর মদে বিষ মিশিয়ে দেন।…
বলেন কী?
কণিকা একটু জোরেই বলে ওঠেন।
অঘোরনাথ মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, ছোট মা, সত্যি উনি স্বামীর মদে বিষ মিশিয়ে ছিলেন।
তারপর?
যে দুটো খারাপ মেয়েকে নিয়ে মেজবাবু ফুর্তি করতেন, তাদের একজন আবার ঐ গেলাসের অনেকটা মদ খেয়েছিল…
ওরা দুজনেই মারা গেল?
হ্যাঁ, ওরা দুজনেই মারা যায়।
মেজবউ-এর কী হলো?
উনি নিজেও সেই রাত্রে মারা যান।
ইস! কী কেলেঙ্কারি!
অঘোরনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এই ঘটনার ঠিক দুদিন পর বড়বাবুর কাছে মেজবউ-এর একটা চিঠি এসে হাজির।…
শ্রীচরণকমলেষু,
বড়দা, সম্পত্তি ভাগাভাগির পর আমার স্বামী নগদ ছয় লক্ষ টাকা পাওয়ায় আমি নিজেকে মহারানী ভাবিতে শুরু করিয়াছিলাম কিন্তু কয়েক দিন যাইতে না যাইতেই বুঝিতে পারিলাম, এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জন্যই আমার স্বামী চরম ব্যভিচারী হইয়া উঠিতেছেন। কখনও কখনও ভাবিতাম, উহার মোহ শীঘ্রই কাটিয়া যাইবে এবং উনি আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করিবেন কিন্তু যত দিন গিয়াছে, উনি তত বেশি ব্যভিচারী হইয়া উঠিতেছেন। এইরূপ চরিত্রহীন, ব্যভিচারী, বিকৃত রুচিসম্পন্ন মানুষকে লইয়া আমি কখনই জীবন কাটাইতে পারিব না। তাই ঠিক করিয়াছি, আমি এই জগত হইতে বিদায় লইবো। তবে এই পৃথিবী হইতে চিরবিদায় লইবার পূর্বে আমার চরিত্রহীন স্বামীকেও অবশ্যই শেষ করিব।
আমার কন্যা রাধা রহিল কিন্তু উহার জন্য আমার বিন্দুমাত্র চিন্তা নাই। আমি উহাকে গর্ভে ধারণ করিলেও বড়দিই উহাকে মানুষ করিয়াছেন এবং রাধাও তাহার বড়মাকে সব চাইতে আপনার মনে করে। সুতরাং ও আপনাদের নিকট সর্বতোভাবে ভাল থাকিবে, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।
আপনি ও বড়দি আমার সভক্তি প্ৰণাম গ্রহণ করিবেন এবং যদি কোনো অন্যায় করিয়া থাকি, তাহা হইলে দয়া করিয়া ক্ষমা করিবেন।
ইতি–আপনার মেহধন্যা মেজবৌমা
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অঘোরনাথ একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, মজার কথা কি জানো ছোট মা, ঘটনাটা এখানেই শেষ হলো না। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়েছিল।
কণিকা অবাক হয়ে বৃদ্ধ শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, মেজবাবু আর মেজবউ দুজনেই তো চলে গেলেন। এর পর আবার কী ঝমেলা বাধলো?
অঘোরনাথ এবার একটু জোরেই হেসে বলেন, ছোট মা, টাকাকড়ি আর সম্পত্তির লোভে মানুষ যে কত কী করতে পারে, তা তুমি-আমি ভাবতেও পারবো না।
উনি একটু থেমে বলেন, বরানগরের এক বাগানবাড়িতে তিন তিনটে মানুষের মারা যাবার খবর পেয়েই ইংরেজ এস পি একদল পুলিশ নিয়ে হাজির হয়ে সরকারবাড়ির ছোটকর্তা থেকে শুরু করে দারোয়ানকে পর্যন্ত লাঠিপেটা করতে করতে থানায় পাঠিয়ে দেবার পর খাবার-দাবার, মদের বোতল, মদের গেলাস থেকে শুরু করে সমস্ত বাক্স পেটরা পোঁটলা-পুটলি পর্যন্ত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করলেন।
কী কাণ্ড!
এখনই যদি অবাক হয়ে যাও, তাহলে সব কথা শুনলে তো তুমি মূৰ্ছা যাবে।
অঘোরনাথ একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলে যান, ওদিকে ময়না তদন্তের পর মেজভাই। আর মেজ বৌমার দেহ পেয়ে সকার পর্ব শেষ করে বাড়ি ফিরেই বড়বাবু মেজ বৌমার চিঠি পেয়ে অবাক।
সত্যি অবাক হবার মতো ব্যাপার।
যাই হোক, বাড়ির কাউকে ও চিঠির কথা না জানিয়েই উনি ছুটে চলে গেলেন হেমেন সেন-এর কাছে।
.
একবার না, দুবার চিঠিটা পড়ে হেমেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, দুর্গাপদ, এই চিঠি কি তোমাদের বাড়ির সবাই দেখেছে?
না, কাকাবাবু, এই চিঠি কাউকেই দেখাইনি।
বড়বাবু মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, মেজবৌমার চিঠিটা পেয়েই আমি আপনার কাছে এসেছি।
ভালই করেছ।
প্রবীণ উকিল হেমেনবাবু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এই চিঠির কথা তুমি আর কাউকে বলো না। আগে দেখা যাক পুলিশ কী করে।
কাকাবাব, পুলিশের আর কী করার আছে?
উনি একটু থেমে বলেন, এটা যদি খুন-টুনের ব্যাপার হতো, তাহলে না হয়…।
ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই হেমেনবাবু একটু হেসে বলেন, দুর্গাপদ, পুলিশি তদন্তে কোথা থেকে কী বেরিয়ে পড়বে, তা কিচ্ছু বলা যায় না।
কিন্তু কাকাবাবু, মেজবৌমা তো নিজেই জানিয়েছে…
আবার ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই উকিলবাবু বলেন, মেজবৌমা তো স্বামীকে বিষ দিয়ে মারার পর তোমাকে চিঠি লেখেননি?
না, তা লেখেননি কিন্তু…।
মেজবৌমা তার সিদ্ধান্তের কথা তোমাকে জানিয়েছেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার মাঝখানেও তো কিছু ঘটতে পারে?
হ্যাঁ, তা পারে কিন্তু…
হেমেন সেন একটু হেসে বলেন, তোমার এই কিন্তুর জবাব পুলিশি তদন্তে ঠিকই বেরিয়ে পড়বে।
উনি একটু থেমে বলেন, দেখো দুর্গাপদ, এ সংসারে টাকাকড়ি আর নারীঘটিত ব্যাপারে কোন মানুষ যে কী করবে, তা বলা যায় না। এমনও হতে পারে মেজবৌমা কিছু করার আগেই সরকারবাড়ির ছোটকর্তা বা ঐ দুটো মেয়েছেলের যে কোনো একজন হয়ত এই সর্বনাশ ঘটিয়েছে।
কী বলছেন কাকাবাবু?
প্রবীণ ও অভিজ্ঞ উকিল হেমেন সেন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দুর্গাপদ, বহুকাল ধরে ওকালতি করে এইটুকু জেনেছি, অনেক অভাবনীয় ঘটনা এ সংসারে ঘটে আর মানুষেই তা ঘটায়।
বড়বাবু সেদিনের মতো বিদায় নিলেও পরের দিন সকালেই আবার ছুটে যান হেমেন সেন-এর কাছে।
কী ব্যাপার দুর্গাপদ? আবার আজকে…
হেমেন সেন অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে না করতেই বড়বাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, কাকাবাবু, কালরাত্তিরে পুলিশ জগত্তারিণী আর কেষ্টবিনোদবাবুকে ধরে নিয়ে গেছে।
প্রবীণ হেমেন সেন একটু হেসে বলেন, দুর্গাপদ, যা সন্দেহ করেছিলাম, বোধহয় তাই হয়েছে। দেখো, হয়তো শেষ পর্যন্ত কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে।
হ্যাঁ, সত্যি সাপ বেরিয়ে পড়ল।
ভয়-ভীতি, একটু-আধটু চড়-থাপ্পড়-লাঠিপেটা আর সর্বোপরি ঝানু গোয়েন্দাদের জেরার মুখে সব ফাঁস হয়ে গেল।…
.
সত্যি কথা বলছি স্যার, বনবিহারী দত্তর ছেলেদের সঙ্গে মামলায় শুধু জগত্তারিণী হেরে গেল না, আমিও হেরে গেলাম। তারপর থেকেই সুযোগ খুঁজছিলাম, ওদের জব্দ করার।
কৃষ্ণবিনোদ মুহূর্তের জন্য থামতেই গোয়েন্দা দপ্তরের দারোগাবাবু হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, থামছিস কেন হারামজাদা? চটপট বলে যা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যার, বলছি।
কৃষ্ণবিনোদ একবার নিঃশ্বাস নিয়েই আবার শুরু বরেন, স্যার, আমি জানতাম সোজাসুজি এ কাজ করা যাবে না। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা হিসেবে-নিকেশ করে ঠিক করলাম, সরকারবাড়ির ছোটকর্তাকে হাত করতে পারলেই বনবিহারী দত্তর মেজ ছেলেটাকে হাতের মুঠোর মধ্যে আনা যাবে।
সরকারবাড়ির ছোটকর্তাকে হাতে আনলি কী করে?
বলছি স্যার, সব বলছি।
কৃষ্ণবিনোদ প্রায় না থেমেই বলেন, স্যার, নরোত্তম মল্লিক আমার দূরসম্পর্কের বন্ধু।…
দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়, দূরসম্পর্কের বন্ধু আবার হয় নাকি?
মানে স্যার, ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার বন্ধুত্ব হয়।
দারোগাবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, মাঝে মাঝে বন্ধুত্ব হয় মানে? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাচ্ছিস না?
না, স্যার, সত্যি মাঝে মাঝে বন্ধুত্ব হয়।
কৃষ্ণবিনোদ মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, স্যার, আমরা দুজনেই মাঝে মাঝে হরিদাসীর ওখানে যাই। মানে স্যার, ওর দুই মেয়ের সঙ্গে আমাদের একটু ভাব আছে। কখনও কখনও আমরা দুজনেই একসঙ্গে একটু আনন্দ-ফুর্তিও করি।
থামছিস কেন? বলে যা, বলে যা।
স্যার, ঐ নরোত্তম মল্লিকের জন্যই সরকারবাড়ির ছোটকর্তার সঙ্গে আমার ভাব হয়।
উনি একটু মুখ তুলে দারোগাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, স্যার, আমি কিছুদিন ওর সঙ্গে মেলামেশা করেই বুঝে গেলাম, মদ আর মেয়েছেলে সাপ্লাই করতে পারলে ওকে দিয়ে যা ইচ্ছে করিয়ে নেওয়া যাবে। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান করে ফেললাম।
কী প্ল্যান ঠিক করলি?
স্যার, সরকারবাড়ির ছোটকর্তার পাল্লায় পড়েই বনবিহারীর মেজব্যাটাকে দিয়ে জগত্তারিণীর টাকায় বরানগরের বাগানবাড়ি কেনাবার ব্যবস্থা করলাম।
কেন?
স্যার, মেজবাবু যদি ভবানীপুরের বাড়িতেই থাকে, তাহলে ওকে হাত করব কী করে?
ওকে হাত করবার কী দরকার ছিল?
স্যার, সম্পত্তি ভাগাভাগি হবার সঙ্গে সঙ্গেই ওর হাতে হলাখ-সাড়ে ছলাখ টাকা এসে গেল। তাই ঠিক করলাম, ওকেও মদ-মেয়েছেলের নেশায় জমিয়ে দিতে পারলে অন্তত ওর অর্ধেক টাকা তো আমাদের হাতে আসবেই।
ঐ মাগী দুটোকে কে যোগাড় করেছিল? তুই?
স্যার, আমি আর জগত্তারিণী দুজনে মিলে।
কী করে যোগাড় করলি?
স্যার, যে ঘোষালমশাইয়ের বাগানবাড়িতে আমি আর জগত্তারিণী ফুর্তি করতে যেতাম, সেখানে সুধা বলে একটা মাগী ছিল।…
তুই কি সুধাকে নিয়েও ফুর্তি করতিস?
না, স্যার, সুধাকে নিয়েই ঘোষালমশাই বাগানবাড়িতে থাকতেন।
তাতে কী হলো?
স্যার, ঐ সুধাই ওদের দেশ থেকে দুটো ছুঁড়িকে এনে ঘোষালমশাইয়ের এক ছেলে আর এক জামাইয়ের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেয়।
কৃষ্ণবিনোদ একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, তাই স্যার, জগত্তারিণীর সঙ্গেও ঐ ছুঁড়ি দুটোর বেশ ভাব ছিল। তবে মাঝখানে বহুদিন ওদের দেখাশুনা না হবার পর হঠাৎ বছর দুই আগে চড়কের মেলায় ওদের দেখা হয়।…
.
কী গো, তুমি জগত্তারিণী মাসি না?
ডাগর-ডোগর মেয়েটা পান-জর্দা চিবুতে চিবুতে মুখ টিপে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে।
জগত্তারিণী অবাক হয়ে ওকে দেখে কিন্তু ঠিক চিনতে পারে না।
হা ভগবান! আমাকে ভুলে গেলে? আমি লতা গো লতা! সেই ঘোষালের বাগানবাড়িতে…
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে জগত্তারিণীর সব কথা মনে পড়ে যায়। ও সঙ্গে সঙ্গে একগাল হাসি হেসে লতাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, সব্বোনাশী, তুই কি সুন্দর হয়েছিস রে! ঘোষালমশাইয়ের জামাই তাহলে তোকে বেশ যতেই রেখেছে।
লতা একটু জোরে হেসে ওঠে। তারপর বলে, ও মিনসেকে কবে দূর করে দিয়েছি।
ও একটু থেমে বলে, দেখো মাসি, একবার যখন খাতায় নাম লিখিয়েছি, তখন একজনের দাসীবাদী হয়ে চিরকাল থাকবো কেন?
ঠিক বলেছিস।
এখন আমি দুচার মাস অন্তরই বাবু পাল্টাই।
এখন তোর বাবু কে?
এই তো কদিন আগে নগেন দা-কে ছাড়লাম।
লতা একটু মুখ টিপে হেসে বলে, দু-তিনটে রুই কাতলা পিছনে লেগেছে। দেখি, কে বেশি দেয়।
সরস্বতীর কী খবর?
ওর খবরও খুব ভাল।
ভাল মানে?
এক জমিদারের ম্যানেজারবাবু ওকে নিয়ে মধুপুর গিয়েছেন। সামনের বুধবারই ওর ফেরার কথা।
ওর সঙ্গে তোর দেখা হয়?
দেখা হবে না কেন? আমরা দুজনে মিলেই তো দর্জিপাড়ায় ঘর ভাড়া নিয়েছি।
আরো টুকটাক কথাবার্তার পর জগত্তারিণী বলে, তোরা দুজনে একদিন আমার ওখানে আয়। খুব জরুরি কথা আছে।
ভাল মালদার পার্টি হাতে আছে নাকি?
তবে কি শুধু শুধু আসতে বলেছি?…
.
কৃষ্ণবিনোদ একটু চাপা হাসি হেসে দারোগাবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার, লতা আর সরস্বতীকে পেয়ে সরকারবাড়ির ছোটকর্তা আনন্দে প্রায় জগাই-মাধাই-এর মতো দুহাত তুলে নাচতে শুরু করলেন।
তারপর?
তারপর স্যার, ছোটকর্তার মাধ্যমেই মেজবাবুকে বরানগরের বাগানবাড়িতে নিয়ে ঐ দুই মাগীর খপ্পরে ফেলে দিলাম।
মেজবাবুকে খুন করার বুদ্ধিটা কি তোরই মাথায় আসে? নাকি জগত্তারিণীর?
স্যার, একদিন তার কাছে শুনলাম,মেজবাবুর ভবানীপুরের বাড়ির চাকর মহাদেব এসে এক বাক্সভর্তি টাকা দিয়ে গেছে।
কৃষ্ণবিনোদ একটু থেমে বলেন, এই খবরটা শুনেই মনে হলো, মেজবাবু ওর ভাগের সব টাকাই নিজের কাছে রেখেছেন। তাই স্যার, ঠিক করলাম, চটপট কিছু না করতে পারলে ঐ টাকাটা আর আমাদের ভাগ্যে জুটবে না।
তারপরই বুঝি বিষ কিনে মদের বোতলে মিশিয়ে দিলি?
হ্যাঁ, স্যার।
তুই আর জগত্তারিণী দুজনে মিলেই কি বিষ মিশিয়েছিলি?
হ্যাঁ স্যার।
তারপর লতা না সরস্বতীকে দিয়ে মেজবাবুকে ঐ মদ খাওয়াবার ব্যবস্থা করলি?
কোন বোতলের মদ কাকে খাওয়াতে হবে, তা জগত্তারিণী ওদের দুজনকেই ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিল।
মেজবাবুর বউ সেদিন যাবেন, সে খবর পেলি কী করে?
কৃষ্ণবিনোদ হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, স্যার, মা কালীর নামে দিব্যি করে বলছি, মেজবৌ যে ঠিক ঐদিনই ওখানে হাজির হবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি।
সরস্বতী ঐ বোতলের মদ খেলে কেন?
তা বলতে পারবো না স্যার।
উনি একটু থেমে বলেন, বোধহয় নেশার ঘোরে ভুল করে খেয়েছিল।
নাকি লতা ইচ্ছে করেই…
না, স্যার, লতা তা করতে পারে না।
মেজবাবুর মদে বিষ মেশাবার পর আবার ওর পানে বিষ মিশিয়েছিলি কেন?
স্যার, সত্যি বলছি, পানে আমরা বিষ দিইনি।
তাহলে কে দিয়েছিল? ছোটকর্তা?
স্যার, ছোটকর্তার মদ-মেয়েছেলের রোগ থাকলেও এ ধরনের কাজ উনি কখনই করবেন না।
তবে কি লতা বা সরস্বতী?
স্যার, ওরা বেশ্যা হতে পারে কিন্তু খুনী না।
.
অঘোরনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, জানো ছোট মা, ষড়যন্ত্র করে মেজবাবুকে খুন করার জন্য কৃষ্ণবিনোদ আর জগত্তারিণী দুদনেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। অন্যান্য সবাইকে জজসাহেব ছেড়ে দিলেন।
কণিকা অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, তার মানে মেজবউ বিষ দিয়ে স্বামীকে মারে নি?
না।
উনি একটু থেমে বললেন, মামলায় প্রমাণ হয়েছিল, মেজবউও একই বিষে মারা যান।
মেজবউও কি ঐ বিষ-মোশানো মদ খেয়েছিলেন?
ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, নিশ্চয়ই ঐ মদ খেয়েছিলেন বা ওঁর স্বামী খাইয়েছিলেন।
ইস! কী ট্র্যাজেডি।
হ্যাঁ, ছোট মা, সত্যিই খুব দুঃখের ব্যাপার।
অঘোরনাথ আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এই সমস্ত ব্যাপারে বড়বাবু এত দুঃখ, এত আঘাত পেয়েছিলেন যে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী তো ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তি ছেড়েছুড়ে কাশী চলে গেলেন।
মেজবাবুর মেয়ে রাধার কী হলো?
হ্যাঁ, রাধাকেও ওঁরা সঙ্গে নিয়ে গেলেন।