৫-৬. গণদেবতা এক্সপ্রেস

‘গণদেবতা’ এক্সপ্রেস নতুন গাড়ি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বীরভূম-এর ওপরে এক বিশেষ দুর্বলতা ছিল। তাঁর প্রজন্মের অনেক দুষ্টলোক তারাশঙ্করের এই বীরভূমপ্রীতির জন্যে তাঁকে আড়ালে ডাকতেন ‘ট্যারাশংকর’ বলে। শুনেছিল নীলকমল তার জ্যাঠামশায়ের লাভপুরের জমিদার এক মক্কেলের কাছ থেকে। ভদ্রলোক নিজে জমিদার হয়েও ভিখিরিরও অধম ছিলেন আর মিথ্যাচারী। গরিব মানুষদের মামলায় মামলায় উত্যক্ত করাই ছিল তাঁর কাজ। অধিকাংশ উকিলদের কাজ-ই ভালো নয়। তার জ্যাঠামশাইকে দেখেই নীলকমল উকিল হয়নি। হলে নিঃসন্তান জ্যাঠামশায়ের সেরেস্তা ও মক্কেলও পেয়ে যেত। অনেকই আয় করতে পারত।

ভাবছিল, নীলকমল।

রাঢ় বাংলার মানুষদের নিয়েই বেশি লিখেছেন। বলল নীলকমল। ‘গণদেবতা’, ধাত্রীদেবতা’, কালিন্দী’, আরও কত বই।

জানি। ‘গণদেবতা’, ধাত্রীদেবতা’, কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’ আরও কত বই! আমার তো ওঁর লেখা খুব-ই ভালো লাগে। সল্লি বলল।

এই ট্রেনের নামকরণটি ভালো হয়নি?

হুঁ। দেশে কিছু কিছু ভালো কাজ তো নিশ্চয়ই হয়। শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস-এর নাম করে দেওয়া উচিত কোয়েলের কাছে বা কোয়েল এক্সপ্রেস অথবা একটু উষ্ণতার জন্যে এক্সপ্রেস।

হ্যাঁ। বলে, হাসল নীলকমল। বলল, বুদ্ধদেব গুহর কু-প্রভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারলে না।

না। পারলাম আর কই? সত্যি! কু-প্রভাবই বটে!

শান্তিনিকেতনে কখন পৌঁছোব আমরা? শান্তিনিকেতন হয়েই যেতে বললেন কেন ধরসাহেব?

কথা ঘুরিয়ে বলল, সল্লি।

এয়ার-কণ্ডিশানড কোচ আছে বলে। চেয়ার কার। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস-এও যেতে পারতাম, সে গাড়িতেও তো এসি কোচ আছে। কিন্তু সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছে এ.সি. কোচ থেকে নামলেই গায়ে ফোঁসকা পড়বে। গতসপ্তাহে বেয়াল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। এখন হয়তো আরও বেড়েছে। শ্রীনিকেতনের হিসেব। দুবরাজপুরে আরও কয়েক ডিগ্রি বেশিই হবে। তার ওপর লোডশেডিং হলে তো কথাই নেই।

কতক্ষণ লাগবে শান্তিনিকেতন থেকে দুবরাজপুর যেতে? আমি তো যাইনি কখনো।

শান্তিনিকেতন থেকে দুবরাজপুর পঁয়তাল্লিশ কিমি মত। গাড়িতে যেতে ঘণ্টা দেড়েক মতো লাগবে। পথে চা-টা খেয়ে।

আমরা তো পানাগড় বা দুর্গাপুর হয়েও যেতে পারতাম।

তা পারতাম। তবে গ্র্যাণ্ড-ট্রাঙ্ক রোডের যা-অবস্থা তা দেখে শেরশাহ বেঁচে থাকলে আত্মহত্যাকরতেন। ও-পথ দিয়ে গেলে অনেক বেশি সময় লাগত। ধরসাহেব জানেন বলেই হয়তো…

শান্তিনিকেতনে পৌঁছোবে কখন ‘গণদেবতা’?

সাড়ে নটাতে বোধ হয়। এই গাড়িতে আমি কখনো যাইনি। তবে ঠিক সময়ে পৌঁছেলে রোদ চড়া হওয়ার আগেই দুবরাজপুরে পৌঁছে যাব।

ভেস্টিবিউল গাড়ি। কিছুক্ষণ পরেই একটি ছেলে ‘লেবু চা’ ‘লেবু চা’ করতে করতে ওদের কামরাতে এল অন্য কামরা থেকে।

খাবে?

নীলকমল জিজ্ঞেস করল সল্লিকে।

ট্রেনের লেবু চা কি ভালো হবে?

লেবু চা, তারমধ্যে গোলমরিচের গুঁড়ো। চিনি-দুধ-এর চা-এর চেয়ে ভালো। খেয়ে দেখতে পারো।

আপনিই খাওয়াবেন?

এর চেয়ে, বেশিকিছু করি এমন সাধ্য কী আমার আছে?

সল্লির চোখে চোখ পড়লেই নীলকমলের সব গোলমাল হয়ে যায়। হাত-পা অবশ হয়ে আসে। অবশ্য সেই ভাব গোপন করার চেষ্টা করে খুব-ই।

সল্লি মুখে কথা না বলে, দু-টি গাঢ় গভীর কালো চোখ তুলে তাকাল নীলকমলের দিকে।

নীলকমল লক্ষ করেছিল, বড়োঘড়ির নীচেই, যে, সল্লি একটা সাদা জমি আর সবুজ পাড়ের শাড়ি পরেছে। সবুজ ব্লাউজ। হালকা কোনো পারফিউম মেখেছে। সাদা আর সবুজ চৌখুপি চামড়ার চৌখুপি ব্যাগ একটা। স্নান করে উঠে চুলটা পনিটেইল করে বেঁধেছে। মাথার তেলের সুগন্ধ উড়ছে বাতানুকূল কামরাতে ওপরের পাখার হাওয়ায়। তখনও ভিজে আছে চুল। সল্লির ডান হাতের কনুই নীলকমলের বাঁ-হাতের কনুই-এর সঙ্গে লেগে রয়েছে। প্রথমবার ইলেকট্রিক শক লাগার মতন মনে হয়েছিল নীলকমলের। লাগতেই, হাত তুলে নিয়েছিল। তারপরে আবার সাহস করে আস্তে আস্তে সইয়ে সইয়ে চুঁইয়েছে। যেন অনবধানেই ঠেকে গেল, এমন করে! খুব ভালো লাগছে নীলকমলের সল্লির এতকাছে, গা ঘেসে বসে। এইরকম বুদ্ধিমতী, ছিপছিপে, সুন্দরী, সুগায়িকা একজন স্ত্রী যদি তারও থাকত, বেশ হত। সল্লিকে প্রথমবার দেখেছিল নীলকমল দূরদর্শনের একটি প্রভাতি অনুষ্ঠানে। সাদা খোলের ওপর হলুদ ফুল ভোলা এবং হলুদ পাড়ের একটি ঢাকাই শাড়ি পরে সে তাদের গানের স্কুলের একটি ব্লক-প্রোগ্রামে গান গাইছিল গানের স্কুলের হয়ে। রবীন্দ্র জন্মোৎসবে। গান-ই শুনবে, না ঢাকাই শাড়িই দেখবে, না দেখবে গায়িকাকে, তা বুঝতেই পারছিল না নীলকমল। বসন্তের বিকেলের মতন, বৈশাখের ভোরের মতন, শ্রাবণের দুপুরের মতন এমন সৌন্দর্য কোনো নারীর মধ্যে আগে দেখেনি নীলকমল। তার সর্বনাশ হয়েছিল সেই নাম-না জানা মেয়েটিকে দেখামাত্র। টিভির সামনে-বসা, ওর গাইয়ে সহোদরা রুমা বলেছিল, দাদা কী চমৎকার গায় রে মেয়েটি আর তেমন-ই ব্যক্তিত্ব! সুন্দরী তো অবশ্যই। তোর জন্যে বউ আনলে এইরকম বউদিই আনব।’

নীলকমল করুণ হাসি হেসে বলেছিল শাড়িটা দেখেছিস? আমাকে বিক্রি করলেও কী অমন একটা শাড়ি হবে? কত দাম হবে রে?

তা ঠিক জানি না। আমিও তো রোজ রোজ এমন শাড়িই পরি কিনা! তবে মনে হয় হাজার দু-তিন তো হবেই।

হাজার দু-তিন! বলিস কী রে! এই কন্যার জন্যে কত রাজপুত্র অপেক্ষা করে আছে অর্ধেক রাজত্ব নিয়ে। অমন ফুলকে তুলে এনে ঘর সাজাই এমন ফুলদানি কী আমার আছে? না কোনোদিন হবে! তা ছাড়া, আমার বিদ্যা-বুদ্ধি এবং যোগ্যতাই বা কতটুকু যে, এমন মেয়ে আমাকে মানুষ বলে গণ্য করবে! আমি একটা যা-তা। দূরদর্শনে সেই প্রভাতি অনুষ্ঠান দেখার বছর দুয়েক পরে সেই মেয়েটিকেই যখন নববধূর বেশে বাজ-এর বিয়ের রাতে সুবেশা, সালংকারা দেখল বাজ-এর সঙ্গে মালাবদল করতে তখন বরযাত্রী নীলকমলের বুকের মধ্যে কে যেন, ছুরি আমূল বিদ্ধ করে দিয়েছিল।

বিয়ের পর পর যখন, বরযাত্রীদের মধ্যে ফিরে এল বর তখন, বাজ তার কলেজের সতীর্থ এবং সহকর্মী নীলকমলকে বলেছিল, কিরে নীল, আমার বউকে পছন্দ হয়নি তোর? মুখটা অমন ব্যাজার করে আছিস কেন?

নীলকমল মাথা নীচু করে বলেছিল, খুউব, খুউব।

মুখে বলেছিল বটে সে-কথা, কিন্তু এক অদ্ভুত অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়েছিল ও। বাজ-এর মুখে তাকাতে পর্যন্ত পারেনি।

সপ্রতিভ বাজ বলেছিল, আরে আমার বউ তো পালাচ্ছে না। আর তুইও তো আমার কলিগ-ই। পরে তোর সঙ্গে ভালো করে আলাপ করিয়ে দেব। রুমার সঙ্গেও। তোরাই তো রবীন্দ্রসংগীত-টংগীত করিস। ওকে অ্যাপ্রিশিয়েট করবি তোরা। আমার তো ওসব একেবারেই আসে না। গান-ফান ওসব মেয়েলি ব্যাপার! আমার কোনোই ইন্টারেস্ট নেই।

তারপর দেখতে দেখতে ছ-বছর কেটে গেল। জলপিপি জন্মাল। তারও বয়স হল চার বছর। ওদের দুজনেরই চাকরিতে অনেক উন্নতি হল।

সল্লির সঙ্গে বাজ যেদিন আলাদা করে নীলকমল-এর আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সেদিন সল্লিরও মনে হয়েছিল যে বলে, এতদিন কোথায় ছিলেন? ভেবেছিল, এতবড়ো পৃথিবীতে, কে আর কাকে চেনে? একজনকে পছন্দ করে জীবনসাথি করার পর কতজনের সঙ্গে চেনাজানা হয় আর তখন মনে হয়, ইশ এর সঙ্গে আগে যদি দেখা হত! এই তো আমার স্বপ্নের মানুষ! অথবা মানুষী।

বিয়ের পরে, মা হওয়ার পরে, সল্লি যেন, আরও সুন্দরী হয়ে উঠল। আরও ব্যক্তিত্বময়ী। নীলকমলের কষ্ট আরও বাড়ল। সে কষ্টের কথা মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারেনি। বললেও সল্লি কি বুঝতে পারত? কে জানে! Love at firstsight বলে একটা কথা শোনা ছিল ওর। কিন্তু তা যে, এমন সত্যি হবে ওর নিজের জীবনে আর এমন কষ্টেরও, তা ও দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। বাজ-এর বিয়ের রাতের দিন থেকেই শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ও শুধু, সল্লিকেই দেখেছে। সল্লির কথাই ভেবেছে। কত নিদ্রাহীন বাসন্তী ও, বর্ষার রাতে তাকে কল্পনাতে কতরকম করে আদর করেছে। কোনো রাতে কল্পনাতে আদর করার পরেই যেদিন প্রথম দেখা হয়েছে সল্লির সঙ্গে, ভারি লজ্জিত হয়েছে ও। সল্লির চোখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারেনি।

সপ্রতিভ, রসিকা সল্লি হেসে বলেছে, কী হলটা আপনার নীলকমলবাবু? আমার প্রেমে পড়লেন নাকি?

সল্লির এই নিষ্ঠুরতাতে মরমে মরে গিয়ে, নীলকমল বোকা-বোকা মুখ করে বলেছে, কী যে বলো।

কেন? আমাকে ভালো লাগে না আপনার? আমি কি প্রেমের অযোগ্যা?

লাগে, লাগে, খুব-ই লাগে।

মুখ নীচু করে বলত নীলকমল।

তারপরে বলত, কিন্তু তুমি তো বাজ-এর স্ত্রী। আমার বন্ধুপত্নী। তা ছাড়া…

তা ছাড়া কী?

প্রেমের কতরকম হয় সল্লি!

সল্লি হেসে বলেছে, কী জানি বাবা। আমি তো একরকম-ই জানি। একরকমেই অস্থির। আবার কতরকম! তারপর কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে…কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!

নীলকমলের চোখ সল্লির পোশাকের ওপরে পড়ল। হঠাৎ-ই। সল্লি তা লক্ষ করে স্বগতোক্তির মতন বলল, আমাদের গানের স্কুলের এই পোশাক। সবুজ পাড় সাদা শাড়ি। সঙ্গে সবুজ ব্লাউজ। অনেকদিন পরে পরলাম। স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক তো চুকে গেছে কবেই। তা ছাড়া আগের মতন আর নেইও স্কুল। হয়তো আমিও বদলে গেছি।

আর হলুদ টিপটা?

সেটা ইচ্ছে হয়েছে বলে পরেছি।

তারপর বলল, জানেন, ভাবছি গান আবার শুরু করব নতুন করে। বাড়িতেও শেখাব। সপ্তাহে দু-দিন মেয়েদের।

নীলকমল হেসে বলল, এমন করছ তুমি যেন, বাজ-এর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক সব চুকেবুকেই গেছে। বাতিল করার আগে বিচার তো করতে হবে। বেচারি আদৌ অপরাধী কি না তা না জেনেই দন্ড ধার্য করছ? Ex-parte order! এটা ঠিক নয়। ধৈর্য ধরো। ধৈর্যর মতন। বড়োগুণ আর নেই।

হঠাৎ-ই সল্লি বলল, আমার সঙ্গে বাজ-এর যদি সব, চুকেবুকেই যায়, আপনি আমার জন্যে, মানে, সসম্মানে আমাকে বেঁচে থাকতে দেওয়ার জন্যে কিছু কি সাহায্য করতে পারবেন?

সাহায্য? হাসালে তুমি? আগে থাকতেই আজেবাজে ভাবছ যে, কেন তা আমি বুঝতে পারছি না।

বুঝেছি। আপনি প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চান।

নীলকমল সল্লির দু-চোখে নিজের দু-চোখকে কানায় কানায় ভরিয়ে বলল, কী চাও তুমি বলো? কোন সাহায্য…কতখানি সাহায্য?

আপনি কী দিতে পারেন, কতটুকু পারেন, তা না-জেনে বলি কী করে?

সল্লি একনিশ্বাসে কথাটা বলে তাকিয়ে রইল নীলকমলের চোখে।

নীলকমল বলল, সব, সব দিতে পারি, আমার সর্বস্ব। তোমাকে অদেয় আমার কিছুমাত্রই নেই।

বাক্য দু-টি বাক্যবাগীশের মতন বলে ফেলেই নীলকমল ভাবল, বানিয়ে বলল না তো! ও কি নিজেই বলল কথাগুলো?

সল্লি নীরবে হাসছিল। শুধু ঠোঁট নয়। ওর দুটি চোখ, ওর চিবুক, ওর মুখের শান্তশ্রী সব ই যেন ধীরে ধীরে হেসে উঠল, শুক্লপক্ষের রাতে চাঁদের আলো যেমন, ধীরে ধীরে ফোটে। চাঁদের আলোয় যেমন, ধীরে ধীরে ফোটে কুমুদিনী।

নীলকমল-এর মনে হল ও ভালো লাগাতে অজ্ঞান হয়ে যাবে।

সল্লি অস্ফুটে বলল, আমি জানতাম। আপনি মানুষটা খুব ভালো। খাঁটি মানুষ। এই যুগে, এই সময়ে আপনার মতন মানুষ বেশি দেখা যায় না।

ভালো নই, ভালো নই, খাঁটিও নই…

বলতে গিয়ে, নীলকমলের কথাগুলি মুখের মধ্যেই ভিজে গিয়ে নেতিয়ে গেল। সম্পূর্ণ করতে পারল না বাক্যটা।

.

০৬.

শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার ‘গণদেবতা’ ছটা-কুড়ি নাগাদ বোলপুর স্টেশনে আসে এবং মিনিট দু-তিন দাঁড়িয়েই ছেড়ে যায়। ওরা যখন দুবরাজপুর থেকে ফেরার সময়ে বোলপুরে ঢুকেছে বোলপুর স্টেশনে পৌঁছোবে বলে, বোলপুর কোর্টের সামনে এসেছে, ঠিক তখন-ই ট্রেন-এর সময় হয়ে গেল।

ধরসাহেবের ড্রাইভার বদরুদ্দিন-এর হাত খুব-ই ভালো। শেষ পনেরো মিনিট গাড়ি চালাল না হেলিকপ্টার-ই চালাল তা বোঝা যাচ্ছিল না। তবে ভয়ও করছিল। রুদ্ধশ্বাসে বসেছিল ওরা দু-জনে। এই ট্রেনটা ফেল করলে ওদের হয় সিউড়ি বা দুবরাজপুর ফিরে যেতে হবে নয়তো শান্তিনিকেতনের কোনো, হোটেলে বা টুরিস্ট লজ-এ রাত কাটাতে হবে। পরস্ত্রীর সঙ্গে রাত কাটালেই, আলাদা ঘরেই যদিও, যুধিষ্ঠিরেরও চরিত্রদোষ খুঁজে বের করবেন আত্মীয় পরিচিতরা, বিশেষ করে সল্লির বিয়েটাই যখন নড়বড়ে হয়ে গেছে।

একথা ভেবেই টেনশান হচ্ছিল নীলকমলের।

সল্লির তো হচ্ছিলই!

ফ্যাকাশে মুখে সল্লি একবার বলল, পাব তো ট্রেন নীলকমল?

দেখি।

নীলকমল বলল।

বদরুদ্দিন বলল, এগারো বছর গাড়ি চালাচ্ছি স্যার, আজপর্যন্ত আমার একজন প্যাসেঞ্জারও কখনো কোনো গাড়ি ফেল করেননি। নিশ্চিন্তে থাকুন স্যার। আমি নিজে আপনাদের ট্রেনে তুলে দেব। এ.সি. চেয়ারকার প্ল্যাটফর্মের কোথায় দাঁড়ায় তা আমি জানি। একটাই অসুবিধা এই যে, ওদিকের প্ল্যাটফর্মে আসবে ট্রেনটা। ওভারব্রিজ পেরুতে হবে।

ওভারব্রিজ পেরুতে হবে? সেকী! তবে আর পেয়েছি ট্রেন!

এবারে একেবারে হতাশ গলাতে বলল, নীলকমল।

তাতে কী? মাল তো আপনাদের কিছুই নেই। ওই দুটো হালকা স্যুটকেস আমিই নিয়ে নেব। দৌড়োতে হবে কিন্তু।

ওরা জবাব দিল না। উদবেগে ওদের দুজনেরই গলা শুকিয়ে গেছিল। তেষ্টাও পাচ্ছিল ভীষণ। মিনারেল ওয়াটারের বোতল দুটোও শেষ হয়ে গেছে। গরমও পড়েছে কিছু। সমস্ত শরীর জ্বলছে। যেন লঙ্কাবাটা লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।

গাড়িটা স্টেশনের কার পার্কে রেখেই অন্য একটি পার্ক করা গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, বদরু, এই যতীন, গাড়ি দেখিস, গাড়ি খোলা রইল–আসছি এখুনি।

বলেই, সামনের সিট থেকে ওদের স্যুটকেস দুটো তুলে নিয়েই বলল, আসুন স্যার।

তারপর দৌড় লাগাল।

সল্লি স্কুল-কলেজের স্পোর্টস-এর অনেক ইভেন্টে ফাস্ট হত। তারপরে নাচতও। শ্যামা হয়েছিল একবার। কিন্তু দৌড়োনোর অভ্যেস বহুদিন চলে গেছে। তবুও দৌড়োল। রাত নেমে আসছে। রাত নেমে আসার ভয়টা এক এক জন নারীর বুকে, এক এক সময়ে এক একরকম হয়ে জাগে। এ-কথার সত্যতা শুধু নারীরাই জানে।

হাঁফাতে হাঁফাতে ওরা যখন, সামনের যে-দরজা পেল, তা দিয়েই উঠে পড়ল কম্পার্টমেন্টে, বদরু বলল, কনডাক্টর গার্ড ওই দিকে আছেন। কোনো চিন্তা নেই মেমসাহেব, গাড়ি উইকডেইজ-এ ফাঁকাই থাকে।

ভুলেই গিয়েছিল সল্লি। কম্পার্টমেন্টে উঠেই দাঁড়িয়ে পড়ে ওর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটি খুলে একটি পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বদরুর হাতে দিতে গেল। সকাল আটটা থেকে, যে-মুহূর্তে ওরা ‘গণদেবতা এক্সপ্রেস থেকে নেমেছিল শান্তিনিকেতনে, বদরু ওদের খিদমগারি করছে এই অসহ্য গরমে।

সল্লি হাত বাড়িয়ে বলল, এই যে, এইটে রাখো।

বদরু বলল, না মেমসাহেব।

কেন?

অপ্রতিভ হয়ে বলল সল্লি।

এরপরের বারেই নেব। তখন বড়োপাত্তি দেবেন মেমসাহেব। এবারে থাক।

সল্লির মুখটা কালো হয়ে গেল।

বদরুদ্দিন জানে না যে, সল্লির দুবরাজপুরে এই শেষবার আসা।

ও বলল, পরেরবার আবারও দেব। এখন এটা রাখো।

বদরু এবারে নিল, হাসিমুখেই। তারপর হাত তুলে সেলাম করল।

পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এখনও সহবত, ভদ্রতা ইত্যাদি বেঁচে আছে। সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের ড্রাইভারদের অনেকেই যেমন অসভ্য-অভব্য হয়, বদরু তেমন নয়। তেলও চুরি করবে, ওভারটাইমও নেবে, আবার অসভ্য ব্যবহারও করবে তারা।

ট্রেনটা নিঃশব্দে ছেড়ে দিল। কখন যে, ছাড়ল বোঝা পর্যন্ত গেল না।

নীলকমল হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, একেবারে অন ডট। হল কী আমাদের দেশের? এ-যে, জাপান হয়ে গেল দেখছি।

অফিস থেকে ওকে মাস ছয়েক আগে জাপানে পাঠিয়েছিল পনেরো দিনের জন্যে। এখন কিছুদিন কথায় কথায় জাপানের প্রসঙ্গ এসেই যায় অসাবধানে।

তারপর ওরা ভেতরে ঢুকল সুইং-ডোর খুলে। নীলকমল বলল, তুমি এখানে বোসো একসেকেণ্ড আমি কনডাক্টর গার্ডকে বলে আসি।

কোথায় বসব?

যেখানে খুশি, সব-ই তো ফাঁকা। তবুও আমি জিজ্ঞেস করে আসছি।

কনডাক্টর গার্ডও এসে পড়লেন। বললেন, সব-ই তো ফাঁকা। যেখানে খুশি বসুন।

দু-চারজন প্যাসেঞ্জার ছিলেন মাত্র পুরো কম্পার্টমেন্টে তবে বগির সামনের কম্পার্টমেন্টটাতে কিছু বেশি যাত্রী।

ফাঁকাই ভালো। সল্লি ভাবছিল। এখন অনেক-ই জায়গা দরকার সল্লির। Space-এর দরকার ট্রেনে তো বটেই, জীবনেও। নীলকমলও যেন, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল কম্পার্টমেন্টটা ফাঁকা পেয়ে। সল্লির মনের অবস্থাও ও বুঝতে পারছিল।

বদরুকে দেখা গেল, এরইমধ্যে একদৌড়ে ওভারব্রিজ পার হয়ে উলটোদিকের প্ল্যাটফর্মে নেমে পার্কিং লট-এর দিকে যাচ্ছে। ওকে দেখে সল্লির মনটাও খারাপ হয়ে গেল। সল্লি জানে, আর এখানে আসা হবে না। ওকে এক-শো টাকার একটা নোট দিলেই হত। পরক্ষণেই ভাবল, টাকা তো ওর নয়, বাজ-এর। ওই টাকা ছুঁতে ঘেন্না হবে এবার থেকে। ছুঁতে যাতে না-হয়, তার একটা বন্দোবস্তও করতে হবে যত, তাড়াতাড়ি সম্ভব। এ-কথা ভাবতে ভাবতে সল্লির চোয়াল শক্ত হয়ে এল।

দুবরাজপুরে ও আর আসবে না কখনো না কখনোই নয়। শান্তিনিকেতনে আসতে পারে। বসন্তোৎসবে, পৌষমেলাতে, বৃক্ষরোপণ উৎসবে, বা হলকর্ষণ উৎসবে।

নীলকমল-এর এক উদবেগ গেল তো অন্য উদবেগ জাগল।

ধরসাহেব নিজে সল্লিকে নিয়ে গিয়েছিলেন মেঝেন-এর বাড়িতে। এখন যার সঙ্গে থাকে বাজ। ওই গ্রামে আগে বাজ-এর সঙ্গে নীলকমলও গেছে। একাধিকবার গেছে। মেয়েটিকে দেখেওছে। সুন্দর ঝকঝকে তকতকে গ্রাম। গোবর নিকোনো। ঘুঘু ডাকছে পেয়ারা গাছে। মোরগ ডাকছে। ধান ভাঙছে কেউ কেঁকিতে। সুন্দর চিত্র-বিচিত্র করা। পোড়া-মাটির রঙা বা কালো-রঙা দেওয়ালে। সাঁওতালেরা ভারি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুরুচিসম্পন্ন। বাজ নাকি তিনদিনের ছুটিতে আছে এখন। বিয়ে করবে কয়নাকে। দেনা-পাওনার কথাও হয়ে গেছে। আগামীকাল পূর্ণিমা। নাচ-গান হবে। শুয়োরের মাংস আর ভাত রান্না হবে। হাঁড়িয়া খাবে সকলে। তারপর সারারাত মাদল আর ধামসার সঙ্গে কাঁচভাঙা কণ্ঠস্বরের গান শোনা যাবে।

কয়না মেয়েটি খুবই প্রাণোচ্ছল। অত্যন্তই সুন্দরী। যেমন মুখ-চোখ, তেমন-ই ফিগার। সিনেমাতে নামলে মুম্বইতে হিরোইন হতে পারত। তা ছাড়া খুব ভদ্রসভ্যও। লেখাপড়া জানে। সম্ভবত ক্লাস ফাইভ-সিক্স অবধি পড়েছিল মিশনারি স্কুলে। বাংলা তো পড়তে পারেই, ইংরেজিও পড়তে পারে। বলতেও পারে একটু-আধটু।

নীলকমলের সহপাঠী বিবাহিত বাজ প্রথম যেদিন, এখানে আসে সেদিন নীলকমলকেও নিয়ে এসেছিল। এক পূর্ণিমার রাতে। ওই মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিল, এই কয়না শোন, আমার তো বিয়ে হয়েই গেছে, তুই বিয়ে কর নীলকমলকে। তাহলে মাঝেমধ্যে তোকে দেখতে পাব।

নীলকমল মুখে কিছু বলেনি। মনে মনে বলেছিল, তোর জন্যে আমি যেমন, মাঝে মাঝে সল্লিকে দেখতে পাই।

কয়না দারুণ শরীরিণী। কিন্তু মেয়েদের শরীর-ই কি সব? সল্লির শরীরও তো কিছু খারাপ নয়। শুধু শরীরের প্রতিযোগিতা হলেও দু-জনে সমান নম্বর-ই পাবে। সল্লির পারিবারিক পটভূমি, অধ্যাপক বাবা, স্কুল-শিক্ষিকা মা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, সাহিত্য-মনস্কতা, অমন সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত সব-ই কি শুধু, ওই কৃষ্ণাঙ্গীর শরীরের কাছে তুচ্ছ হয়ে যাবে? কে জানে! বাজ চিরদিন-ই দুর্বোধ্য ছিল নীলকমলের কাছে, সেই কলেজের দিন থেকেই। আজ বাজ আরও বেশি দুর্বোধ্য হয়েছে।

সল্লি যতবার-ই বাজ-এর লেখা চিঠিটির কথা মনে করছিল ততবার-ই হতবাক হয়ে যাচ্ছিল। যে, মানুষটা তার স্ত্রী আর শিশুকন্যা সম্বন্ধে এমন সংবেদনশীল, সেই কী করে এমন হয়? তবে কী সল্লি ওকে বুঝতে পারেনি? বাজ কী একজন তঞ্চক? এতবড়ো মারাত্মক ভুল যে, কী করে করল সল্লি, যে-ভুলের মাশুল দিতে হবে সমস্ত জীবন দিয়ে, তা ভেবে পর্যন্ত পাচ্ছিল না ও। বড়ো অসহায় লাগছিল সল্লির। আজকালকার ছেলেরা সকলেই কী এমন-ই তঞ্চক, ভন্ড, মিথ্যাচারী? লেখাপড়া শেখা উচ্চশিক্ষিত পুরুষমানুষদের চরিত্রও যদি এমন-ই হয় তবে আর কী বলার থাকতে পারে? কিন্তু নীলকমল-এর মতো পুরুষেরাও তো পুরুষ! আশ্চর্য! পুরুষের কত্তরকম হয়। কে জানে! হয়তো নারীরও হয়। ও একরকম, কয়না একরকম। তুলনা করতেও ঘেন্না হচ্ছিল ওর। শরীর! শরীর কী এতই বড়ো? নীলকমল পাশে থাকাতে মনে হচ্ছিল, সল্লির তার শেষ অবলম্বন হয়তো সেই হবে, কিন্তু তাকেই বা বিশ্বাস কী? সেও তো আর একজন পুরুষ-ই!

এই মুহূর্তে সল্লির মনের মধ্যে কী হচ্ছে তা নীলকমল বুঝতে পারছে। কতখানি অপমানিত হয়েছে সল্লি, যে-অপমান, এই শরীরে জ্বালা-ধরানো গরমের চেয়েও অসহ্য, তা নীলকমল বুঝতে পারছে। কিন্তু, করার তো কিছুই নেই।

বদরু যখন ট্রেন থেকে নেমে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ পকেট থেকে বের করে নীলকমলকে একটা মুখবন্ধ লেফাফা দিয়েছিল। বলেছিল, সাহেব দিয়েছেন।

কোন সাহেব? ধরসাহেব?

না না।

তবে। বাজ?

হ্যাঁ।

কাকে?

আপনাকে।

নীলকমল অবিশ্বাসী গলাতে বলল, ঠিক জানো, আমাকেই?

হ্যাঁ স্যার। আপনার নাম-ই তো লেখা।

ঠিক আছে।

বলেছিল, নীলকমল।

সল্লি তাকাল একবার চিঠিটার দিকে কিন্তু কোনো ঔৎসুক্য ফুটল না তার চোখে-মুখে। সব ঔৎসুক্যই যেন মরে গেছে ওর।

ও চিঠি এখন পড়তে পারবে না। নীলকমল ওর মুখের ভাব গোপন করতে পারে না। কী লিখেছে? কে জানে বাজ। জলপিপির কথাও কী মনে পড়ল না! চার বছরের অমন সুন্দরী বুদ্ধিমতী একমাত্র মেয়েকেও অন্য নারীর শরীরের জন্য ত্যাগ করতে পারে এমন নিষ্ঠুর মানুষ যে, সংসারে থাকতে পারে এবং সে-মানুষ যে, তার সহপাঠী ছিল, তার ‘বন্ধু’ বলে পরিচিত ছিল এত দীর্ঘদিন, এ-কথা বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারছিল না নীলকমল। ভালোবেসে, বাড়ির এবং শ্বশুরবাড়িরও অমতে বিয়ে করেছিল যে-স্ত্রীকে, নিজেদের পরিবারের সব নিরাপত্তার দেওয়ালকে অগ্রাহ্য করে নিজস্ব নীড় করে তুলেছিল বাসা-বাড়িকে, অমন সুন্দর আধো আধো কথা বলা মেয়ে জলপিপিকে যে, এত ভালোবাসত, সে কী-এমন দেখল, এই নিকষ কালো সাঁওতাল মেয়ে কয়নার মধ্যে, কে জানে!

এই ভাবনাটাই বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে নীলকমলকে। আর সল্লির বুকের মধ্যে যে, কী হচ্ছে তা কে জানে! কোন মুখে সে, কলকাতা পৌঁছে তার মা-বাবাকে বলবে যে, বাজ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, এমনকী জলপিপিকেও সে ত্যাগ করেছে। কী করে বলবে সে-কথা?

শিরীষবাবু হয়তো বলবেন, কেস করব। ডিভোের্স চাইব, খোরপোশ চাইব। টাইট করে ছেড়ে দেব ছোকরাকে। শিক্ষিত, সংযত, অধ্যাপক শিরীষবাবু হয়তো মুখ খারাপও করবেন। কখন যে, কোন আঘাতে, কোন নির্মোক ছিঁড়ে যায়, তা আগের মুহূর্তেও জানা যায় না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, আভিজাত্য–এইসব মোড়কের কোনোটাই যথেষ্ট মজবুত নয়। মুহূর্তের মধ্যে ঝড়ে উড়ে যেতে পারে এইসব রঙিন র‍্যাপিং-পেপার।

সল্লির মুখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছে না নীলকমল। চুপ করে বসেছিল ও। বাতানুকূল কামরা থেকে রাতের বেলাতে বাইরে ছাই কিছু দেখাও যায় না। দৃষ্টি যখন অস্বচ্ছতাতে বাধা পেয়ে প্রতিহত হয় তখন, মস্তিষ্কে তা বোবা ধাক্কা মারে। কোথায় যেন, পড়েছিল অনেকদিন আগে, “When there is nothing to be done, there is no point in trying to do something.”

ঠিক এমন সময়ে প্রায় নিস্তব্ধ কামরার মধ্যে মা-আ-আ-আ করে জোরে চিৎকার করে উঠল একটি শিশুকন্যা। একেবারে জলপিপির-ই বয়সি। তবে চিৎকার করল দুঃখে নয়, আনন্দে। আনন্দের আতিশয্যে তার মা সম্ভবত পাশের কম্পার্টমেন্টে কারো সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বাচ্চাটি যে, উঁচু পিঠ-অলা সিটের মধ্যে কোথায় ডুবে বসেছিল, তা পেছন থেকে বোঝা পর্যন্ত যায়নি আগে। পাশ থেকে তার ছোট্টখাট্ট বাবা রাশভারী গলাতে শিশুটিকে শাসন করে বললেন, শ-শ-শ। এটা কি আমাদের বসবার ঘর? ছিঃ। আস্তে মৌ।

পাশের কামরা থেকে হেঁটে আসা মহিলার মুখে কিন্তু এক আশ্চর্য উজ্জ্বল হাসি জ্বলজ্বল করছিল, যেমন হাসি শুধুমাত্র সন্তান-গর্বে গর্বিতা অল্পবয়েসি মায়েদের মুখেই দেখা যায়। মায়ের বয়েসও সল্লির-ই মতো। মৌ-এর মা কিন্তু মৌকে বকলেন না বরং তাকে তার সিট থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে কোলে টেনে নিয়ে নিজের সিটে বসালেন।

একপাশে বাবা অন্যপাশে মা আর মায়ের কোলে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সুন্দরী শিশুকন্যা। কী সুন্দর নিটোল একটি ছবি। এইরকম সব টুকরো-টাকরা ছবিই বোধ হয় নীলকমলের-ই মতন অগণ্য অবিবাহিত পুরুষ ও নারীকেও নীড়-এর স্বপ্ন দেখায়। আবার যেমন, সেই স্বপ্ন ভাঙায় আজকের রাতের সল্লির ছবির মতো ছবিও।

সল্লির জন্যে নীলকমলের বুকটা নতুন করে হু হু করে উঠল। ওর কপালটাই এমন। পৃথিবীর যত দুঃখ সব-ই যেন, নীলকমল চুম্বকের মতন আকর্ষণ করে নিয়ে আসে তার নিজের বুকে অথচ সেইসব দুঃখের অধিকাংশই প্রতিকার করে এমন সাধ্য তার নেই। একেবারেই নেই।

নীলকমল পকেট থেকে চিঠিটা বের করে সল্লিকে দেখিয়ে বলল, চিঠিটা কি তুমি পড়তে চাও?

না। আপনাকে লেখা চিঠি আমি পড়ব কেন?

আমি পড়েই বা কী করব?

সে আপনি জানেন। না পড়বেন তো ছিঁড়ে ফেলুন।

ফেলব?

ফেলুন। নীলকমল বাজ-এর চিঠিটাকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে সামনের সিট-এর পেছনে যে-পকেট ছিল, তাতে ফেলে দিল। চিঠিটা তাকে বড়োঔৎসুক্য ও অস্বস্তিতে ফেলেছিল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল নীলকমল। সেই পকেটের দিকে একবার চেয়ে মুখটা জানলার দিকে ফেরাল সল্লি। কিন্তু রঙিন কাঁচের মধ্যে দিয়ে কিছু দেখা গেল না। সল্লি জানত যে, দেখা যাবে না। অথচ আশ্চর্য! তবু চেয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *