৫-৬. কচুর শাক

সবুজ অফিসে চলে যাওয়ার পর, হাসি খোকাকে স্কুলে পাঠিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছিল। ভালো করে কচুর শাক রেঁধেছিল ইলিশমাছের মাথা দিয়ে। টক রেঁধেছিল। কালকের ঝোল ছিল। দু টুকরো গাদার মাছে নুন-হলুদ মাখিয়ে রেখেছিল, ফণী এলে গরম গরম ভেজে দেবে।

ফণীর সকালে আসার উপায় নেই। আসতে আসতে সেই একটা-দেড়টা। দোকানের পেছনের উঠোনে টিউবওয়েলে চান করে এতখানি পথ ভাদ্রমাসের রোদে হেঁটে আসবে ফণী। ফণী আসার আগেই চান করে নেবে হাসি। একটা বাড়িতে-কাঁচা পরিষ্কার শাড়ি পরবে। সাবান দিয়ে ধুয়ে হাতের হলদের ছোপ তুলবে। তারপর ফণী এলে, একটু লেবু টিপে চিনি দিয়ে ওকে এক গ্লাস শরবত করে দিয়ে দু-জনে বসে অনেক গল্প করবে। তারপর দু-জনে একসঙ্গে বসে খাবে।

কাল সন্ধেতেই খবরটা পাওয়ার পর মোড়ে ডাকাতে-কালীর ওখানে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছিল হাসি, ফণীর জন্যে। খুব-ই খুশি হয়েছে হাসি। এত খুশি ও বহুদিন হয়নি।

রান্নাঘরের টুলে বসে গরমে ঘামতে ঘামতে, হাসি ছোটোবেলার কথা ভাবছিল! ওদের বাড়িটা ছোট্ট একতলা ছিল। তার পাশেই প্রকান্ড লনঅলা ফুলবাগানের কেয়ারি-করা তিনতলা বাড়ি ফণীদের। ফণী স্কুলে যেত প্রকান্ড গাড়ি চেপে। সামনে দারোয়ান ও ড্রাইভার বসে থাকত। হাসিদের স্কুলের সময় আর ওদের স্কুলের সময় প্রায় কাছাকাছি ছিল। হাসি যখন বেণী দুলিয়ে, ফ্রক পরে, বইখাতা হাতে নিয়ে রাসবিহারী অ্যাভিন ধরে ওর স্কুলের দিকে যেত, তখন প্রায় রোজ-ই এক জায়গায় ওর পেছন থেকে গাড়িটা এসে দাঁড়াত। ফণী ওকে ডাকত হাতছানি দিয়ে–তারপর নিজে গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিত হাসির জন্যে। হাসিকে আদর করে বসাত-বসিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজের স্কুলে যেত। হাসির চেয়ে পাঁচ-ছ বছরের বড়ো ছিল ফণী।

তখন থেকেই এক আশ্চর্য চোখে ফণী চেয়ে থাকত হাসির দিকে। মেয়েরা বয়সে ছোটো হলেও, বুদ্ধি ছেলেদের চেয়ে বেশি রাখে। হাসি বুঝতে পারত, এই চাউনির মানে। বিকেলে যখন ফণীদের বাড়ি যেত হাসি, তখন নানারকম গল্প করত ওরা, খেলা খেলত, ফণীর পড়ার ঘরে ছুটির দিনে সারাদুপুর কাটাত–বই পড়ত।

সেসব দিনের কথা চিরদিন মনে থাকবে হাসির। ফণীর মায়ের আদর-যত্নের কথা। ভাবতে অবাক লাগে। কতদিন হয়ে গেল।

ফণীর সম্বন্ধে হাসিকে যা, চিরদিন চমৎকৃত করেছে, তা হচ্ছে ফণীর সুন্দর সভ্য ব্যবহার। এত ভদ্র মানুষ ও জীবনে দেখেনি। ফণীর চরিত্রে এমন কিছু একটা ছিল যে, কোনো কিছুই তাকে ময়লা করতে পারত না। অত বড়োলোকের একমাত্র ছেলে হয়েও টাকা-পয়সার মোহ, গর্ব, দোষ কখনো কোনোভাবে ওকে স্পর্শ করেনি। ওর ব্যবহার, ওকে ওদের বাড়ির সমবয়সি আর সকলের থেকে একেবারে আলাদা করে রেখেছিল। ফণীকে হাসি যত কাছ থেকে জেনেছিল, তেমন করে বেশি লোকে জানেনি।

হাসির ছেলেমানুষি-মনে অনেক রামধনু উঠত। ফণীকে ঘিরে, ওর কিশোরী-মনে অনেক কিছু কল্পনা করত। কিন্তু নিজের মনের ইচ্ছেগুলোকে গলা টিপে নিজের মধ্যেই বোতল-বন্ধ করে রেখে দিত। হাসি জানত, ফণী যখন বড়ো হবে, যুবক হবে, তখন কোনো বড়োলোকের কন্যাকে বিয়ে করবে, যাদের একমাত্র কাজ পিয়ানো-বাজানো, সাজগোজ করা আর মার্কেটিং করা। ও তখন জানত না যে, ফণীর এ অবস্থা হবে। জানলে, কখনো সবুজের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বিয়েতে রাজি হত না। বাড়ির সকলের সঙ্গে ঝগড়া করে ও ফণীকেই পেতে চাইত। ওর মতো কাজ করে আজ আর কেউই জানে না যে, ফণীর দুর্দিনে, ফণীর পাশে। পাশে ও থাকলে ফণীকে এতখানি কষ্ট পেতে হত না।

হাসি এতদিনে বুঝছে যে, জীবনের ওপর, জীবনের গন্তব্য, জীবনের গতির ওপর ওর মতো একজন সাধারণ মেয়ের কোনোই হাত নেই। আজকে ফণী শুধু, দু-মুঠো আদরের ভাত খাওয়ার জন্যে হাসির কাছে আসে। ফণীকে আদর করে কাছে বসিয়ে, একমুঠো ভাত খাওয়াবার মতো একজন লোকও আজ আর নেই। যখন টাকা ছিল, তাকে সকলে মাথায় করে রেখেছিল, যে-মুহূর্তে তা থেকে সে বঞ্চিত হল, তার আসন হল ধুলোয়। কিন্তু ধুলোয় থেকে, ধুলো খেয়ে ফণী একটুও ছোটো করেনি নিজেকে। তার চারপাশের মলিনতা, তার শুভ্রমনকে একেবারেই ছুঁতে পারেনি। এত দুঃখ-কষ্ট, অপমানে কিছুতেই মানুষটা নীচু হয়ে যায়নি, ইতর হয়ে যায়নি সবুজের মতো। আজকে হাসির জীবনে, মাঝে মাঝে ফণীদার মুখোমুখি বসে গল্প করা ছাড়া, সুখ’ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ফণীদাই তার জীবনের সব সুখ।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল।

হাসি গিয়ে দরজা খুলল।

ফণী রোদে একেবারে ঘেমে জবজব করছিল।

দরজা খুলেই হাসি বলল, এসো। ইস ঘেমে যে, একেবারে জল হয়ে গেছ।

ফণী বলল, আর তুমি?

হাসি অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকাল। ও দেখল, তাই-ই তো, রান্নাঘরে বসে ও-ও তো একেবারে ঘেমে গেছে।

হাসি হাসল। বলল, আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। আমার এসবে কষ্ট হয় না।

ফণী বলল, তুমি চান করোনি এখনও? শরীরের ওপর বড়ো অত্যাচার করো তুমি হাসি। যদি তুমি আমার আসা, আমার খাওয়া নিয়ে এত ব্যস্ত হও, এমন করো, তাহলে কিন্তু কখনো আসব না আমি।

হাসি চুপ করে রইল। জবাব দিল না।

তারপর ফণীকে পাখার নীচে বসিয়ে শরবত এনে দিয়ে বলল, তুমি একটু বোসো। আমি এই চান করে এলাম বলে।

চান করতে যেতে যেতে, হাসি মনে মনে বলল, আমি তো রোজ-ই এমন সময় চান করি, খাই–। কেই তো আজ অবধি, এ-নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তুমি কেন মাথা ঘামাও ফণীদা? তুমি তো আমার কেউ নও, কেউ হবে না এ-জন্মে। তবে কেন কষ্ট পাও, ভাবো, এই হাসির জন্যে?

চান-টান করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে এসে, হাসি দু-জনের জায়গা করল। যদুকে বলল একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে দিয়ে চান করে আসতে।

ফণীর পাতে দু-টুকরো ভাজা মাছ দিয়ে, গরম মাছ-ভাজার তেল দিল পাতে। যদু কাঁচা লঙ্কা দিয়েছিল, পেঁয়াজও।

ফণী হাসল। বলল, যদুকে তুমি বলে দিয়ো যে, আমি কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ খাই না। রোজ রোজ পাতে নষ্ট হয়। তোমাদের বাড়িতে তোমরা সকলে বুঝি, পেঁয়াজ-লঙ্কা খুব খাও?

হাসি হাসল। বলল, আমি খাই না। ও খায়। ওরা তো বাঙাল।

ফণী হাসল। বলল, এইজন্যে বাঙালরা খুব খাটতে পারে। কিন্তু বড়ো রাগি হয় বাঙালেরা।

–যা বলেছ। হাসি হেসে হেসে বলল।

হঠাৎ চোখ পড়ল ফণীর হাসির পাতে। তাড়াতাড়ি বলল এই! তোমার মাছভাজা কই? মাছের ঝোল কই?

হাসি বলল, ওমা! আমরা সকলে তো কাল সব পেট-পুরে খেয়েছি। শুধু তোমার জন্যেই তোলা ছিল।

ফণী কথা না শুনে, একটা ভাজা মাছ ও একটা ঝোলের মাছ তুলে দিল হাসির পাতে।

হাসি রেগে গেল। বলল, কী-যে করো না, ভালো লাগে না। এই-ই তো খাবার। তা ছাড়া আমরা তো সবাই-ই খেয়েছি। বিশ্বাস না হয়, যদুকে জিজ্ঞেস করো।

ফণী বলল, খেয়েছ তত ভালো। একা একা খাওয়া আর আমার সঙ্গে বসে খাওয়া কি এক হল?

হাসির ভালো লাগল। মুখে কিছু বলল না।

একটু পরে বিড় বিড় করে বলল, তোমার-ই আনা মাছ, তোমাকেই ঘটা করে খাওয়াচ্ছি–তার আবার! তোমাকে আদর-যত্ন করি, তোমার জন্যে কিছু করতে পারি, সে-সামর্থ্য তো ভগবান দেননি আমাকে।

ফণী খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে বলল তুমি বড়ো খারাপ। কী যে বলো না! কত কী খাওয়াও তুমি আমাকে–কত কত আদর করে খাওয়াও।

তারপর একটু চুপ করে থেকে, কী যেন ভেবে বলল, আদর যে কী জিনিস, তা তোমার কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকেই তো জানলাম। তা ছাড়া শুধু খাওয়ানোটাই কী করা? তার চেয়ে কত বড়ো কত কিছু করো তুমি। আমিই বরং তোমার জন্যে কিছুই করতে পারি না। মেয়েরা আবার ছেলেদের জন্যে এসব করে নাকি? এসব তো ছেলেদের-ই ব্যাপার; তাদের-ই একার।

একটু থেমে, খেতে খেতেই বলল ফণী, সত্যি! সেই ছোটোবেলা থেকে জানি-না কেন, তোমাকে এক বিশেষ চোখে দেখেছিলাম। তারপর সব গোলমাল হয়ে গেল। তাই না? তবে তোমার স্বামী সবুজবাবু কিন্তু খুব উদার। এত উদারতা আমি খুব কম লোকের মধ্যে দেখেছি। উনি যদি না চাইতেন, তবে তো মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতেই পেতাম না। যতটুকু কাছে পাই তোমাকে, তোমার কাছে থাকতে পাই, তাও পেতাম না। জানো, আমি-না ওঁর কাছে খুব কৃতজ্ঞ।

হাসি চুপ করে খাচ্ছিল। কথা বলছিল না। ভাবছিল, ফণীটা বড়োবেশি ভালোমানুষ। ও তো জানে না সবুজকে। কিছুই জানে না।

হাসি ভাবছিল, ফণীদা বড়োঅল্পে সন্তুষ্ট-কেন জোর করে না সে-জোর করে, তার যা কিছু আছে, কেন তা কেড়ে নেয় না তার কাছ থেকে সবুজ যেমন করে তাকে ঠকায়, ঠকিয়ে এসেছে বছরের পর বছর, তেমন করে কেন ফণীদা সবুজকেও ঠকায় না!

হাসি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে, ফণীদার রোজগার আর একটু বাড়লে, একটা ছোট্ট বাসার খরচ আর তাদের দুজনের খরচ জোগাবার মতো অবস্থা হলেই ফণীদার কাছে চলে যাবে ও। আর ভালো লাগে না এ-জীবন। এই ঘরের মধ্যে শুধু ঘৃণা, শুধু সন্দেহ। দমবন্ধ হয়ে যায় হাসির। জীবনটা বড়ো একঘেয়ে, বড়ো নিরানন্দ হয়ে গেল। খোকাও হয়তো সঙ্গে যাবে, ও যদি যায়। হয়তো কেন? নিশ্চয়ই যাবে। খোকা ফণীদাকে যতখানি ভালোবাসে, তার বাবাকে সে, তার সিকিভাগও বাসে না। সবুজ এত স্বার্থপর, এত নীচু ও এত বেশি ভালোবাসে নিজের সুখ, নিজের আরাম, নিজের সুবিধাকে যে, তার কাছে অন্য কারোর-ই সুখের কোনো দাম নেই।

তাই তো ফণীদার উন্নতিতে হাসি এত খুশি হয়েছে।

পরক্ষণেই নতুন করে ভাবল হাসি, ভাবল ফণীদাটা আবার বড়োবেশি নরম। এ-কথা তাকে বললে, সে বোধ হয় আঁতকেই উঠবে–সবুজের প্রতি কর্তব্যের কথার ফোয়ারা ফোঁটাবে। যে নিজের সুখ ছিনিয়ে না নেয়, ছোঁ মেরে না নেয় অন্যের কাছ থেকে, তার পক্ষে এ-জীবনে সুখী হওয়ার আশা নেই। ফণীদাটা বড়ো মিনমিনে। এত ভ্যাবাগঙ্গারাম লোককে ভালোবাসা যায়, কিন্তু এরকম লোকের ভরসায় বাড়ি ছেড়ে বেরোনো যায় না। একদিক দিয়ে বুঝি লঙ্কা-পেঁয়াজ খাওয়া জেদি লোকগুলো ভালো। লোকগুলো মারুক বা বকুক, যাই ই করুক, তাদের ওপর বোধ হয় পুরোপুরি নির্ভর করা যায়।

হাসিদের বাড়ির কাছেই একটা মালটি-স্টোরিড বাড়ি উঠছে। সারা দিন-রাত পাইলিং হচ্ছে –যার ‘পুপ-ধ্বপ পুপ-ধ্বপ’ আওয়াজ সারাদিন শোনা যায়। প্রতিবার-ই যখন বিরাট লোহার হাতুড়িটা লোহার পাইপের ওপরে পড়ে, তখন হাসিদের পুরোনো ভাড়াবাড়িটার অনেক দিনের ভিত কেঁপে ওঠে। হাসির বুকের মধেও কী-যেন কেঁপে ওঠে! ভয়-ভয় করে হাসির।

খাওয়া-দাওয়ার পর বাথরুমে আঁচাতে গেল ফণী। আঁচিয়ে বেরিয়ে আসার সময় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল–পশ্চিমদিকে চেয়ে বলল, আরে; কনকচাঁপার গাছ-না? এতদিন তোমাদের বাড়ি এসেছি কখনো তো চোখে পড়েনি?

হাসি মুখ তুলে চাইল। বলল, হ্যাঁ, জজসাহেবের বাড়ির কম্পাউণ্ডের গাছ–খুব সুন্দর-না গাছটা?

–খুব সুন্দর, ফণী বলল।

তারপর থেমে বলল, মনে আছে, তোমাকে কনকচাঁপার গাছ চিনিয়েছিলাম আমি!

হাসির চোখ-মুখ জ্বলে উঠেই নিভে গেল, বলল, কই? মনে করতে পারছি না তো আমি! একেবারেই পারছি না।

ফণী হাসল, বলল, তুমি বড়ো ভুলে যাও। তোমার কিছুই মনে থাকে না।

তারপর বলল, আঁচিয়ে এসো, বলছি।

হাসি আঁচিয়ে এসে ওকে একটু মৌরি দিল।

ওরা মৌরি খেতে খেতে শোয়ার ঘরে এল পাখার নীচে। হাসি খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে পা তুলে বুকের কাছে গুটিয়ে বসল। ফণী বসল ইজিচেয়ারে।

ফণী বলল, মনে আছে, তুমি আর আমি মা-বাবার সঙ্গে, আমাদের দত্তপুকুরের বাগানে গিয়েছিলাম পিকনিকে। আমার মনে আছে, তুমি সেদিন একটা নীলের মধ্যে সাদা পোলকা ডট-তোলা ফ্রক পরেছিলে, মাথায় নীল রিবন বেঁধেছিলে-কালো জুতো পরেছিলে একটা।

তারপর একটু থেমে ফণী হাসতে হাসতে হঠাৎ মনে পড়ে-যাওয়া কথাটা বলেছিল, তোমার বাঁ-হাঁটুর ঠিক ওপরে একটা লালরঙা তিল ছিল, আমাকে দেখিয়েছিলে–মনে আছে? এখনও আছে তিলটা?

হাসির মুখ আচমকা আরক্ত হয়ে গেল।

মুখ নামিয়ে নিল হাসি।

তারপর আস্তে মাথা নোওয়াল। কথা-বলল না।

হাসির সব মনে পড়ে গেল। সমস্ত টুকরো টুকরো কথা। আশ্চর্য, ফণীদা কী করে এত বছরের কথা সব মনে করে রেখেছে।

ফণী হাসির মুখে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর হেসে বলল, কী হাসি? নেই তিলটা?

এবার হেসে ফেলল হাসি।

হেসে বলল, আছে। বলেই চুপ করে গেল।

আজ থেকে কুড়ি বছর আগের, এমনি এক মেঘলা দুপুরে ফণীদের বাগানবাড়িতে কনকচাঁপা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে হাসিই নিজে হাতে তার ফ্রক তুলে ফণীকে তার কিশোরী ঊরুর তিলটা দেখিয়েছিল। চোখ বড়ো বড়ো করে, মুখ নাড়িয়ে বলেছিল, দেখেছ, আমি কেমন ফর্সা–আমার লাল তিল।

সেদিন দেখিয়েছিল। আজ আর দেখানো যায় না। সহজ হওয়ার দিন চলে গেছে। কুড়িটা বছর ঝরে গেছে মধ্যে। সেদিনের ফণীদা আর আজকের ফণীদার কত তফাত। হাসিও কত বদলে গেছে।

একটু চুপ করে থেকে হাসি বলল, আপনার এতদিনের কথা মনে থাকল কী করে? আপনার স্মৃতিশক্তি তো খুব ভালো।

ফণী হাসল। বলল, একেবারে উলটো। আমি কিছুই প্রায় মনে রাখতে পারি না। তবে কিছু-কিছু কথা আছে, কিছু-কিছু ঘটনা আছে মাথার মধ্যে, স্মৃতির মধ্যে জমা করা বয়সের কোনো রাবারেই তা মুছবে না।

তারপর গম্ভীর গলায় চোখ নামিয়ে বলল,জানি না, হয়তো যা ভীষণভাবে মনে রাখতে চেয়েছিলাম, যা-যা কিছুতেই ভুলতে চাইনি, শুধু সেগুলোই মনে আছে। অন্যসব কথা, সব মনে না-রাখার কথা ভুলে গেছি।

হাসি বলে উঠল, আপনার কাকাদের ব্যবহারের কথাও ভুলে গেছেন?

ফণী এক অদ্ভুত ক্ষমাময় হাসি হেসে বলল, গেছি; বিশ্বাস করো।

রাগে হাসির গা জ্বলে গেল। এমন যিশুখ্রিস্ট লোককে সহ্য করা যায় না। যারা মেরেকেটে, লুটেপুটে কিশোর ভাইপোকে বাড়ি থেকে একবস্ত্রে তাড়িয়ে দিল, পথের ভিখারি করে, তাদের ক্ষমা করে দেওয়াটা কাপুরুষতা’ ছাড়া কিছুই নয়।

হাসি বলল, এটা ঠিক নয়। এটা আপনার চরিত্রের দুর্বলতাই প্রকাশ করে।

ফণী আবার হাসল। বলল, জানি না, হয়তো তাই। কিন্তু বিশ্বাস করো, যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে। তবে তোমার বিয়ে হওয়া অবধি যদি কাকারা আমায় না তাড়াতেন, তবে কী করতাম বলা যায় না। তোমার জন্যে, তোমার মুখ চেয়ে হয়তো লাঠিসোঁটা ধরা যেত। শুধু নিজের জন্যেই অত ঝামেলা করার কোনো মানেই হত না। কিন্তু তোমার বিয়েতে তুমি আমাকে একটা খবর পর্যন্ত দিলে না। হয়তো ভালোই করেছ। অবশ্য তুমি বলতে পারো, আমি কেন এগিয়ে আসিনি? কিন্তু আমি কী করে আসতাম? তোমার সরকারি চাকুরে বরের কাছে সহায়-সম্বলহীন, পথে-পথে ঘুরে বেড়ানো, ফুটপাতে রাত কাটানো ভিখারির কী দাম ছিল? ভালোই করেছি না এসে। আমার সঙ্গে তোমার জীবন গেঁথে গেলে তোমার বড়ো কষ্ট

বলতে বলতে ফণীর স্বরটা কেমন রুক্ষ হয়ে এল।

হাসির মনে হল, এ রুক্ষতা হাসির প্রতি নয়, তার কাকাদের প্রতিও নয়; এ রুক্ষতা সাধারণভাবে জীবনের প্রতি–পৃথিবীর সমস্ত নীচতা, স্বার্থপরতার প্রতি।

অবাক চোখে হাসি ফণীর দিকে চেয়ে রইল।

ফণী আবার বলল, বড়ো কষ্ট হত হাসি, কষ্ট দিতাম তোমায়–সে-কষ্ট তুমি কি সইতে পারতে? বনেদি মিত্তিরের বংশধর এই ফণী মিত্তির। অনেক পুরুষ, অনেক ভালো-মন্দ খেয়ে মানুষ, পিতৃপুরুষের বাড়িভাড়ার টাকায় বসে খেয়ে, অনেক লোকের ওপর অনেক অত্যাচার করে, অনেক গলায়-গামছা দেওয়া সম্মান কুড়িয়ে মানুষ অনেক কিছু জমা ছিল সেসব, ভোগের ঘরে পাপের ঘরে-নইলে এত কষ্ট, এত অসম্মান অন্য কেউ হলে সহ্য করতে পারত না। ভেঙে পড়ে যেত ফুটপাতের ওপর কুঁকড়ে শুকিয়ে মরে থাকত।

বলেই, একটু থেমে ওর উপোসি, রোগা শিরা বের করা হাত দু-খানা হাসির সামনে ঘুরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু এই দ্যাখো না, আমি কেমন বেঁচে আছি! কী দারুণ বেঁচে আছি।

হাসি চুপ করে ফণীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। এক অসহায় হাহাকারে তার মন ভরে গেল এবং সেই ফণীদার প্রতি এক সুতীব্র সহানুভূতিতেও তার মন কানায় কানায় ভরে উঠল। সেই সহানুভূতি, যে-সহানুভূতি একমাত্র মেয়েদের কাছেই আশা করা যায়, শুধু তেমন মেয়েদের কাছ থেকে–যারা কাউকে সমস্ত হৃদয় দিয়ে কখনো ভালোবেসেছে।

ফণীও চুপ করেছিল। ফণী ভাবছিল, মেয়েদের মতো ভালোবাসতে, এমনকী ঘৃণা করতেও পুরুষরা কখনো পারবে না। হাসিকে ও জেনেছে–জেনেছে, মেয়েদের ভালোবাসার স্নিগ্ধ প্রশান্ত অনুপ্রেরণার রূপে–আর তার ছোটোকাকিমাকে দেখেছে তাকে ঘৃণা করতে। অথচ দু-জনেই মেয়ে। ছোটোকাকিমা প্রায় ফণীর সমবয়সি ছিল। এক অশিক্ষিত ব্যবসাদারের একমাত্র সুন্দরী মেয়ে-ফণীর কাছ থেকে সে, যা চেয়েছিল, তা পেলে ফণী আজকে ভিখারি হত না। মেয়েরা যা চায়, যেমন করে চায়, তা এবং তেমন করে না পেলে বাঘিনির মতোই হিংস্র হয়ে ওঠে। ছোটোকাকিমার পটভূমিতে, হাসির চরিত্র তাই বড়ো মুগ্ধ করে ফণীকে। এরা–এই দুই নারী–ফণী মিত্তিরের জীবনের দুই দিগন্ত। এক দিগন্ত পেছনে ফেলে এসেছে ফণীভুলে যেতে চেয়েছে–ভুলে গিয়ে সুখী হয়েছে। আর অন্য দিগন্ত সন্ধ্যাতারার দিগন্ত; সে দিগন্তে হাসি।

হাসি হঠাৎ আবদারের গলায় বলল ফণীদা, তুমি রোজ রোজ আসবে। দুপুরে খাবে আমার সঙ্গে। রোজ। বুঝেছ?

ফণী চমকে উঠল।

তারপর হাসল। বলল, তা হয় না। সেটা ঠিক না। আমার এই জীবনেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি হাসি। তোমার জীবন তোমার–। তোমার স্বামী আছে, ছেলে আছে, তোমার সুন্দর শান্তির ঘর আছে, এরমধ্যে আমাকে মানায় না। বেশি কাছে টেনে না আমাকে। তাহলে দুজনেরই দুঃখ বাড়বে। যা পাই যতটুকু পাই তোমার কাছ থেকে, তাতেই আমি বড়োখুশি আছি। বেশিলোভ নেই আমার। তা ছাড়া, সবুজবাবুর কথাটাও ভাবো। এতে তাঁর প্রতি অন্যায় করা হয়।

হাসির আবার রাগ ধরে যায় ফণীর কথা শুনে। যে-লোকটার ওপর পৃথিবীসুষ্ঠু লোক অন্যায় করল, করছে এখনও-প্রতিমুহূর্তেই করছে, এমনকী হাসিও কম অন্যায় করেনি যার ওপর–সে লোকটা, কার প্রতি কখন অন্যায় করে ফেলল, এই ভাবনাতেই মরে গেল। এটা বাড়াবাড়ি; এটা বোকামি। এর কোনো মানে নেই।

হাসি চুপ করেছিল অনেকক্ষণ। ফণীর রুক্ষ-করুণ পুরুষালি মুখের দিকে চেয়েছিল। বাইরে পেয়ারাওয়ালা পেয়ারা হেঁকে যাচ্ছিল, বাসনওয়ালি মেয়ে তীক্ষ্মগলায় চিৎকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, নারকেল গাছগুলোর মাথার উপরে চিল উড়ছিল ঘুরে ঘুরে। রান্নাঘরের উঠোনে বড়ো বড়ো মাছি ভন ভন করে উড়ছিল। ঘরে বসে শোনা যাচ্ছিল তাদের ডানার ভনভনানি। কলঘরের কলে জল আসবে বোধ হয় এক্ষুনি–চোঁ চোঁ করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করছে কলটা।

হাসি বলল, তুমি যে, একটু আগে বললে, নিজের জন্যে এত ঝামেলা করার মানে নেই কোনো’–এ কথাটা আমার বুদ্ধিতে ঠিক বুঝলাম না। যত ঝামেলা সব তো মানুষ নিজের জন্যেই করে। নিজের সুখের জন্যেই।

ফণী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। এবার ও উঠবে বোধ হয়। দোকান খোলার সময় হয়ে এল।

ফণী স্বপ্নোত্থিতের মতো বলল, তুমি ঠিকই বলেছ।

হাসি ওকে সহজে ছাড়ল না। বলল, কী ঠিক-ই বলেছি?

ফণী নিরুপায় হয়ে পড়ল যেন। বলল, তা করে। কিন্তু তেমন কিছু করতে পারে না, বড়োকিছু; সত্যিকারের কিছু। নিজের জন্যে করে নিজের ঘর-সংসার ছেলেমেয়ে, নিজের বাড়ি-গাড়ি অবধি পাওয়া যায়, তার বেশি নয়। এর চেয়ে বেশি যারা চায় জীবনে, বড়োকিছু করার মতো, তারা সকলেই অন্য কারও জন্যে করে। কোনো মতের জন্যে; কোনো বিশ্বাসের জন্যে।

তারপর-ই বলল, যাক, এসব কথা তুমি বুঝবে না।

হাসি বলল, বুঝব। বুঝব। বলো-না ফণীদা, শুনতে ভালো লাগছে।

ফণী হাসল। বলল, সবকথা না বুঝলেও চলবে। সবকথা বুঝলে মুশকিল। যত কম বোঝো ততই ভালো। যারা সুখী হয়, সুখী থাকতে চায়, তারা কম-ই বোঝে। বেশি বোঝার বড়ো বিপদ।

বলেই ফণী বলল, আজ উঠি, কেমন? অনেক খাওয়ালে তুমি। একেবারে আইঢাই করছে শরীর। ভালোই হল, রাতের খাওয়ার ঝামেলা করতে হবে না আর।

হাসি উদবিগ্ন গলায় বলল, ওরকম কোরো না ফণীদা-রাতে খেয়ো। না-খেয়ে থাকতে নেই, পিত্তি পড়বে।

ফণী হাসল। বলল, ওরে বাবা! কত জানেনা তুমি! পিত্তি পড়বে!

বলেই হাসতে হাসতে বাইরের ঘরে এল।

ফণী বলল, যখন-ই আসি, খোকাটার সঙ্গে দেখা হয় না। খোকা খুশি হয়েছে ফুটবল পেয়ে?

–খু-উ-ব। খুশি আবার হয়নি!

–ওকে মাঝে মাঝে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। ওকে না-দেখলে, মনটা ভালো লাগে না।

হাসি মুখ নীচু করে বলল, আচ্ছা! দেব পাঠিয়ে।

হাসি দরজাটা খুলল। ফণী ওর টায়ার-সোলের চটি ফটাস-ফটাস করতে করতে চলে গেল।

ফণী চলে যাওয়ার পর, হাসি এসে একটু শুয়েছে। একটু পরেই খোকা আসবে। খোকাকে যে, বিকেলে কী খাবার দেবে ভেবে পেল না হাসি। একমুঠো ভাত বেঁচেছে, ভাবল, তাই দেবে একটু গুড় দিয়ে। দিনকাল যা পড়েছে, তাতে বেঁচে থাকাই মুশকিল। সবুজ সব কেটেটেটেও নেহাত কম পায় না। এই মাইনের লোকের পক্ষে স্বামী-স্ত্রী, এক ছেলের সংসারে অনটন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু টাকার কী দাম আছে আর কোননা। কিছু একটা করা দরকার। কে করবে, কারা করবে, কেমন করে করবে, তাই ভেবে পায় না হাসি। নিজেদের জীবন, না হয় যা করে হোক কেটে যাবে, কিন্তু খোকার কী হবে? পরীক্ষা সময় মতো হয় না, হলেও টোকাটুকি, মারামারি। পরীক্ষা যদি হল, ফল আর বেরোয় না। পাশও যদি বা করল, তো চাকরি কোথায়?–কী করবে, কী খাবে ওরা বড়ো হলে! ওদের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার। ওদের কথা ভাবলে সত্যি বড়ো ভয় করে হাসির।

দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। এ সময় তো কেউ আসে না। খোকার আসারও সময় হয়নি। আকাশে তাকিয়ে বেলা দেখল হাসি। নাঃ, বেলা তো পড়েনি।

উঠে গিয়ে দরজা খুলেই হাসি একটু ভয় পেয়ে গেল।

গোটা পাঁচ-ছয় ছেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, তাদের চেহারা, মুখের ভাব কিছুই ভালো লাগল না হাসির। তাদের মধ্যে যে, সর্দার গোছের, সে অভদ্রর মতো শুধোল, এখানে। ফণীবাবু আছেন?

হাসি বিরক্ত হল। বলল, আপনারা কে?

ছেলেগুলোর মুখ পাথরের মতো।

সর্দার বলল, আমরা; আমরা।

তারপর-ই বলল, ফণীবাবু নেই?

হাসি বলল, এসেছিলেন। চলে গেছেন।

ছেলেটি বলল, দোকানে?

হাসির মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়েছিল, হ্যাঁ।

পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, তা ঠিক জানি না।

ছেলেটি আবার বলল, আপনার কাছে এসেছিলেন কেন? দুপুরে আসেন কেন?

হাসির চোখ দুটো জ্বলে উঠল।

বলল, সে কথা তাঁকেই জিজ্ঞেস করবেন।

ছেলেটি বলল, আপনি রাগ দেখাবেন না। আমরা রাগারাগি পছন্দ করি না।

হাসি বলল, খেতে এসেছিলেন।

–রোজ-ই আসেন?

–না। আজ নেমন্তন্ন ছিল।

–আপনার স্বামী বাড়ি নেই? আপনি নেমন্তন্ন করেছিলেন, না আপনার স্বামী করেছিলেন?

হাসি রেগে গেল। ওর নিজের সাহস দেখে ও নিজেই অবাক হয়ে গেল।

ও বলল, আপনারা বড়ো বাড়াবাড়ি করছেন। আপনাদের আর একটা কথারও জবাব দেব না আমি।

বলেই, দুম করে ওদের নাকের ওপরেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। দিয়েই দৌড়ে ওর শোয়ার ঘরে এল। এসেই খাটে শুয়ে পড়ল।

এতক্ষণ ভয়টা ওকে তেমন করে পেয়ে বসেনি। কিন্তু শোয়ার ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে আসার পর-ই ওর ভীষণ ভয় করতে লাগল। ওর দুর্বল-রোগা শরীরে বুকটা টিপটিপ করতে লাগল। বালিশে উপুড় হয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল হাসি। কাঁদতে কাঁদতে ওর বালিশ ভিজে গেল। এত কান্না যে, ওর বুকে জমে ছিল, ও যে, এত কাঁদতে পারে, ও নিজেও এর আগে কখনো জানেনি।

.

০৬.

হারাধন অনেকদিন থেকে ঘ্যানঘ্যান করছিল।

প্রথম প্রথম রীতিমতো বিরক্তি বোধ করেছে সবুজ। ওকে বলেছে, এমন কথা আর বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে।

কিন্তু হারাধন, একদিন ছেড়ে আর একদিন প্রায় বরাবরই বলে চলে। বলে, এ-কাজ দাদা আপনার করে দিতেই হবে। করে দিলে, কারওর কোনো ক্ষতি নেই; কিন্তু আপনার আমার বিস্তার লাভ।

হারাধন বয়সে সবুজের চেয়ে বছর দশেকের ছোটো হবে। বাড়ির অবস্থা মোটামুটি ভালো। কসবায় নিজেদের ছোটো একতলা বাড়ি আছে, দুই ভাই, এক বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা এখন পেনশন পান। ভাই যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ওর যে, এই বয়সেই এত টাকার কী দরকার হয়, সবুজ বোঝে না। একেবারে যে, বোঝে না তাও নয়। লোকমুখে শুনতে পায় যে, হারাধন প্রায় নিয়মিত রেসে যায়। মাঝে মাঝে শনিবার ছাড়া অন্যদিনও দুপুর বেলাতেই ‘আসছি’ বলে হাওয়া হয়ে যায়।

ওর শাগরেদরা হাসাহাসি করে। বলে, শালা গেরোবাজ পায়রা হচ্ছে। ওড়া আরম্ভ করেছে। কোথায় যায় জানেন সবুজদা? পাড়ায় যায়।

সবুজ বোকার মতো বলে ফেলেছিল, পাড়ায় মানে? ওদের পাড়া তো বহুদূর। সে তো কসবাতে।

ছেলেগুলো হাসে। বলে, আপনার কিসসু হবে না। এ পাড়া সে পাড়া নয়।

অন্যরা চোখ নামিয়ে বলে, এ পাড়া অন্য পাড়া।

সবুজের বিশ্বাস হয় না। ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের ছেলে, দায়-দায়িত্ব নেই ঘাড়ে–এখনও বিয়ে থা করেনি। কিন্তু কেন? কী জন্যে এত উপরি টাকার দরকার হয় ওর?

হারাধন আবার বললে, কী দাদা? পার্টিকে আসতে বলি?

সবুজ বলল, কেন আমাকে রোজ রোজ বিরক্ত করো? আমাকে ওসব বোলো না। আমার টাকার দরকার নেই কোনো।

হারাধন হাসে দাঁত বের করে, আঙুল দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে সুপুরির কুচি টেনে বের করে সটাসট করে চিরুনি দিয়ে চুল ঠিক করে নেয়, তারপর সবুজের টেবিলের ওপরে রাখা

হরজাই-রঙা কাঁচের গোলাকার পেপারওয়েটটা দু-আঙুলে টেবিলের ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, এ-বড়ো মূখের মতো কথা হল। টাকার দরকার কার নেই দাদা? যে লাখপতি তারও আছে, যে ভিখারি তারও। তা ছাড়া আপনাকে তো কিছু করতে হচ্ছে না। যা ঝামেলা-ঝক্কি সব তো আমারই। আপনি শুধু কাগজপত্র ঠিক করে নিয়ে গিয়ে সাহেবকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে আসবেন। ঝামেলা তারপরে যদি কিছু হয়, সে তো সাহেবের।

সবুজ বলল, সাহেব আমাকে বিশ্বাস করেন। অমন বিশ্বাসঘাতকতা আমি করতে পারব না। হারাধন রাগ দেখিয়ে বলে, কী অত সবসময়, সাহেব-সাহেব করেন–ব্যাটা তো আমার ই সমবয়সি। আর আপনার তাকে এত মান্যগণ্য করার কী? আপনি না, বি-এ-তে বাংলায় আর ইকনমিকসে লেটার পেয়েছিলেন? আপনার বাবা মোস্ট ইনকনসিডারেটের মতো বে টাইমে মরে না গেলে, আপনিও কি কমপিটিটিভ পরীক্ষায় বসতে পারতেন না? আর বসলে কি আপনার মতো ভালো ছেলে পাশও করতেন না? হু! কত গাধা-গোরুকে দেখি, কতশত ডিপার্টমেন্টের হাকিম হয়ে বসে আছে। এ কি আর সাহেবি যুগ যে, বাজিয়ে নেবে পাশ করাবার আগে। বাবাঃ, কিছু কিছু মাল যা-দেখি হরি হরি!

হারাধন একটু থেমে দম নিয়ে বলল, এইসব সাহেবদের প্রতি ভয়-ভক্তি সব বাজে। আপনি দাদা এখনও পৌত্তলিক আছেন। এত সাহেব-পুজো কীসের জন্যে? কামাবার মওকা এসেছে, কামিয়ে নিন। টাকা উড়ে যাচ্ছে চারপাশে, শুধু খপাখপ ধরে নিন।

সবুজ বলল, দ্যাখো হারাধন,কষ্ট করে বেঁচে থাকলেও, আজকেও দেশে অনেক লোক অনেস্ট আছে। না থাকলে-বলেই, কী বলবে ভেবে না পেয়ে সবুজ বলল, না থাকলে, দেশটা চলত না। থেমে যেত।

–ফুঃ-বলে হারাধন থুথু ফেলল খানিকটা।

বলল, অনেস্ট আছে নাকি কেউ? হ্যাঁ আপনাদের মতো দু-চারজন মুখ আছে–এবং যাদের ডিসঅনেস্ট হবার উপায় নেই, তারা। তাও বুঝতাম, তারা শেষ অবধি অনেস্ট থাকলে। এপর্যন্ত কত মক্কেল দেখলাম দাদা–হ্যাঁ, হ্যাঁ এই ডিপার্টমেন্টেই দেখলাম–বুড়ো বয়েসে –রিটায়ার করার আগে আগে ঠিক মুখ থুবড়ে পড়ল। আপনি কি মনে করেন বুড়ো বয়সে ডিসঅনেস্ট হওয়া, অল্প বয়সে ডিসঅনেস্ট হওয়ার চেয়ে কম অপরাধ? ভুল সবুজদা ভুল। দুই-ই এক। তা ছাড়া আপনার কি ধারণা দেশটা চলছে? একে কি চলা বলে দাদা? ঘুণ ধরে গেছে। আমরা সব ঘুণপোকা। যারা আমাদের কাটছে, আমরা যাদের কাটছি- সকলেই ঘুণপোকা।

তারপর হারাধন আবার বলল, ভালোকথা বলছি সবুজদা, হয় প্র্যাকটিকাল হোন, নয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। কোনো চয়েস নেই মাঝামাঝি। আমার কথা ভালো না-লাগে তো, শহিদ হয়ে যান। অনামা অজানা শহিদ পরিবার-সুদ্ধ শহিদ। তবে, আপনাদের কবরে কেউ ফুল দেবে না।

সবুজ তবুও মুখ গোঁজ করে বসে রইল।

হারাধন, বলল, আমি পার্টিকে খবর দিচ্ছি। সে আসার পরও, যদি আপনি মত না বদলান, তবে সে ফিরে যাবে–এই-ই তো। এর চেয়ে বেশি কিছু তো হবে না। অত ভাববার কী?

সবুজ বাধা দেওয়ার আগেই হারাধন ফোন তুলে অপারেটরের কাছে নম্বর চাইল। নম্বর যথারীতি পেল না–সরকারি অফিসের টেলিফোন অপারেটররা খুব দেরি করে লাইন দেয়, যাতে সবুজের মতো অনেস্ট লোকেরা হঠাৎ ডিসঅনেস্ট হয়ে যেতে না পারে।

কিন্তু হারাধন ছাড়বার পাত্র নয়। অনুনয় করে বলল, দিদি, কাইগুলি লাইনটা দিন না– পরক্ষণেই মাউথপিসের মুখটা হাত দিয়ে বন্ধ করে বলল, শালিরা কী যে, এত গল্প করে সারাদিন– শালিরাই জানে।

‘অধ্যবসায়’-এ সব-ই হয়। হারাধন অনেকক্ষণ পর লাইনটা পেল। সংক্ষেপে ও-প্রান্তকে বলল, “যাইয়ে! আপকো কাম বন গ্যয়া। জলদি মাল লেকে আ যাইয়ে”।

কথা শেষ করেই ঘটাং করে রিসিভার ছেড়ে দিল হারাধন।

তারপর শিস দিতে, দিতে আলমারি খুলে খুঁজে খুঁজে ফাইলটা বের করে সবুজের টেবিলে দিল। তারপর উলটোদিকের চেয়ারে বসে সবুজের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে গম্ভীর মুখে বলল, ‘হ্যাভ ফেইথ ইন মি’–আপনার ভালো হবে।

সিগারেটটা ধরিয়ে হারাধন কী-যেন একটু ভাবল, তারপর বলল, জানেন দাদা, কেউ কেউ আছে যে, নিজের ভেলোসিটিতেই বৈতরণী পার হয়। আবার কেউ কেউ আছে যে, তাদের কান্ডারির দরকার হয়। আপনি দ্বিতীয় দলের লোক। কুছ পরোয়া নেই। কান্ডারি আপনার ফার্স্টক্লাস। এই যে-হাতে হাত মেলান সবুজদা; আজ থেকে আপনার ফিনান্স ডিরেক্টর আমি হলাম। আপনি শুধু জানিয়ে দেবেন, কবে আপনার টাকা চাই–পেয়ে যাবেন। বদলে আপনাকে যা বলব, তাই-ই করতে হবে। এইটাই আমাদের ডিল।

তারপর মুখটা কানের কাছে নামিয়ে বলল, ভয় নেই–চাকরি যাবে না–আরে আমাদের তো কোনো স্ট্যাটাস নেই–আমাদের ধরে কোন শালা। চাকরি গেলে, অডিটে ধরলে, যাবে ওই সাহেবদের–তা ছাড়া–তা ছাড়া–চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, আমাদের ইউনিয়ন নেই?–চাকরি আমাদের খায় কে? ওদের চাকরি গেলেও যেতে পারে; আমাদের? আপনি পাগল?

অনেক অনেকক্ষণ সবুজ ফাইলটা সামনে করে বসেছিল।

ওর কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। পেটের কাছে ব্যথা-ব্যথা করছিল।

একবার বাথরুমে গিয়ে মুখে-চোখে জল দিয়ে এল। তবু গরম গেল না। সবুজের অনেক কথা মনে হল। বাবার কথা। বাবার জ্বর হলে, জ্বরের ঘোরে সবুজকে অনেক ভালো ভালো কথা বলতেন, নইলে বাবাকে কখনো জ্ঞান-দেওয়া বলতে যা বোঝায়, তা দিতে শোনেনি সবুজ।

বাবা বলতেন, সবুজ সবচেয়ে আগে চরিত্র, তারপর পড়াশুনা, তারপর খেলাধুলা।

সবুজ ভাবছিল, আজ তার চরিত্র নষ্ট হয়ে গেল। তারপর-ই ভাবল, কমলা? কমলার সঙ্গে তার সম্পর্কটা কি দুশ্চরিত্রতা?

না, না। নিজেই নিজেকে বলল, সেটা একটা পবিত্র ব্যাপার। বাবাদের আমলে এক্সট্রা-মারিটাল সম্পর্কর কথা ওঁরা ভাবতে পারতেন না–কিন্তু ঠাকুরদাদের আমলে অনেকের-ই অনেক রক্ষিতা ছিল, বাগানবাড়ি ছিল। তার চেয়ে আজকের এই সহজ, সরল, খোলাখুলি ভালোবাসা ঢের ভালো। অনেক অনেস্ট, সিনিয়র, অনেক সোজাসুজি। সবুজ তার মৃত বাবার সঙ্গে মনে মনে সওয়াল করল। বলল, বাবা, আগেকার জেনারেশনটাই ভন্ড ছিল–কিন্তু আমরা নই।

তার গত-হওয়া বাবার সঙ্গে সওয়ালে জিতে সবুজের ভালো লাগল। চা-ওয়ালাকে ডেকে এক কাপ চা খেল।

এমন সময় কমলা ফোন করল–বলল, এ্যাই। ছুটি পেয়েছ?

–এখনও জানি না।

কমলা খুব অনুযোগের সুরে বলল, কী করছ তুমি? ভালো লাগে না। আমি কিন্তু যাওয়া ক্যান্সেল করছি তাহলে।

–না, না। বলল সবুজ। খুব সম্ভব পেয়ে যাব।

–সম্ভব-উম্ভব নয়। পেতেই হবে।

–আচ্ছা।

–কী আচ্ছা?

–যাব। আচ্ছা।

–আজকে একবার এসো না! বাবাঃ কতদিন আসো না। তোমার ভীষণ পায়া ভারী। তারপরেই বলল, হাসি কেমন আছে? হাসি আর খোকা? সবুজ এড়িয়ে গিয়ে বলল, ভালো।

–ওদের অনেকদিন দেখি না। কমলা বলল।

–হুঁ। সবুজ বলল।

–ছাড়ছি এখন। কেমন?

–আচ্ছা। বলে সবুজ ফোন ছেড়ে দিল।

কমলা এক আশ্চর্য মেয়ে। ও একইসঙ্গে সবুজ ও হাসির খবর নেয়। একইস্বরে, একই আন্তরিকতায় ও খোকা এবং সবুজের কুশল শুধোয়। বোঝে না, সবুজ বোঝে না। কমলা হয়তো খুব বড়ো অভিনেত্রী, নয়তো কোনো দেবী-টেবী। মেয়েরা সত্যিই বড়ো গোলমেলে।

বসে বসে ফাইলের কাগজ-পত্র, কনস্ট্রাকশন রিপোর্ট, সাবমিটেড-বিলের হিসেবে, ওভারসিয়রের সার্টিফিকেট–সব দেখে টেখে নিয়ে পে-অর্ডারটা রেডি করে রাখল সবুজ। যা হবে, তা হবে।

সবুজ ভাবছিল, কত টাকা দেবে হারাধন ওকে! দুশো? পাঁচশো? না! না! এই কাজের জন্যে পাঁচশো দেবে কেন? সইটার-ই তো দাম। আর সই তো সাহেবের। মধ্যে ওরা তো নেপো। বেচারা সাহেব!

তারপর ভাবছিল, হারাধন যদি পাঁচশো টাকাই দেয়–তবে অতগুলো টাকা দিয়ে ও কী করবে?

সত্যি ভাবা যায় না–পাঁচশো টাকা–হঠাৎ–আকাশ থেকে ভাবা যায় না।

সবুজ ঠিক করল, কমলার জন্যে কিছু একটা কিনবে। একটা ভালো কিছু। ভালো প্রেজেন্টেশান। কিন্তু কী কেনা যায়? ভেবে পেল না সবুজ।

যে গতদশ বছর বিয়ে, কী পইতে, অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্নে, কমের মধ্যে বই, কী খেলনা, কী কলম, বা ওরকম কিছু ছাড়া আর কিছুই কেনেনি–তার পক্ষে হঠাৎ দামি উপহার নির্বাচন করাও বড়োকঠিন বলে মনে হল। দামি জিনিস কী হয়, কত দামের হয়, সব ভুলে গেছে সবুজ। তারপর খোকার জন্যও কিছু নিতে হবে। ছেলেটাকে ফণী সেদিন ফুটবল দেওয়াতে কত খুশি! নাঃ ওর জন্যে দামি কিছু কিনে নিয়ে যেতে হবে–খুব দামি, ফণীটাকে হারাতে হবে।

কিন্তু সবুজের ভালো লাগে না খোকাকে, খোকার চাউনি, খোকার কথাবার্তা। কেন যেন, সবুজের মনে হয়, খোকা যথেষ্ট বড়ো হয়ে উঠলেই ফুটবলে লাথি মারার মতো করে ওকে। লাথি মারবে। জানে না, হয়তো ভয়টা অমূলক। সম্পূর্ণই অমূলক। সে তো বাবা হিসেবে কর্তব্যই করেছে। টাকা রোজগার করেছে, খাইয়েছে-দাইয়েছেন-মাসে-ছ-মাসে ‘কিং কং’, টারজান’ ইত্যাদি ছবিতেও নিয়ে গেছে–এমনকী চিড়িয়াখানাতেও, শীতকালে; কখনো-সখনো। আর কী চাইতে পারে খোকা তার কাছ থেকে? কী সে দেয় না, দেয়নি খোকাকে? বাবার পক্ষে আর কী করণীয়? সবুজ বুঝতে পারে না।

যাক খোকার জন্যে রসগোল্লা কিনবে। তবে ভালো শিকারের গল্পের বই–জঙ্গলের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, খোকাটা অন্ধকার ঘরে গলির মধ্যের বদ্ধতায় থাকে বলেই বোধ হয়, ওর অ্যাডভেঞ্চারের গল্পের ওপর এত ঝোঁক। যতসব বানানো রাবিশের ওপর! বেশ তাই-ই হবে। তাই-ই কিনবে ও।

আর হাসি! হাসির জন্যে?

সবুজ নিজেই নিজেকে বলল, আর হাসিয়ো না, হাসি হাসি কোরো না আর। কেন জানে না সবুজ, হাসিকে ওর কীরকম মনুষ্যেতর বলে মনে হয়। এমন কোনো জীবের মতো, যে, অত্যাচারিত হতে ভালোবাসে এবং যার ওপর অত্যাচার করে আরাম পাওয়া যায়।

হাসির জন্যে একটা শাড়ি নিয়ে যাবে–খুব দামি। ফণীর দেওয়া শাড়ির চেয়ে অনেক, অনেক দামি। আর নিয়ে যাবে চাইনিজ খাবার। অফিসে একদিন এই সাহেবের আগের সাহেব ট্রান্সফার হয়ে চলে যাওয়ার আগে ওদের খাইয়েছিলেন। আঃ, মুখে লেগে আছে এখনও। চাও-মিয়েন না কী যেন বলে, আর চিলি-চিকেন পাকোড়া। একেবারে অবাক করে দেবে আজকে হাসিকে। মাসের সাতাশ তারিখেও অবাক করে দেবে। ডাকিয়ে পাঠাবে হাসির প্রেমিক ফণীকে। তারপর দু-জনকে সামনে বসিয়ে খাওয়াবে। হাঃ হাঃ। হাসির প্রেমিক!…

মি. সাহনি বিকেল তিনটে নাগাদ এলেন।

রুক্ষ, খুনি-খুনি চেহারা। টকটকে রং গায়েব। ফুল-ফুল একটা হাওয়াইন শার্ট ইমপোর্টেড কাপড়ের ট্রাউজার। হাতে ‘ডানহিল’ সিগারেটের প্যাকেট–পায়ে চটি।

বললেন, কেয়া সবুজবাবু, ইতনা রোজ বাদ দিমাগমে কুছ হোঁস আয়া?

সবুজ বোকার মতো ‘হ্যাঁ ও না, না’ ও হ্যাঁ একটা উত্তর দিল। মুখ নীচু করে রইল।

হারাধন তাড়াতাড়ি এসে পার্টিকে নিয়ে গিয়ে, কী-যেন সব বলল, ফিসফিস করে।

সবুজ একবার সাহেবের ঘরে গেল। ফাইলটা হাতে করে।

সাহেব ব্যস্ত ছিলেন।

ফিরে এসে বলল, বিজি হ্যায়!

মি. সাহনি দু-হাত নাড়িয়ে, মাথা দুলিয়ে বললেন, কোই গাল নেহি।

সবুজ বোকার মতো শুধোল, কী?

হারাধন ইনটারপ্রেটার হয়ে বলল, মানে ক্ষতি নেই।

হারাধন শুধু যে, মানুষের মন বোঝে তা নয়, পাঞ্জাবি ভাষাটাও বোঝে।

একটু পরে সবুজ আবার গেল।

সাহেব বললেন, কী ব্যাপার সবুজবাবু। সই করতে হবে?

সবুজের পা কাঁপছিল। ওর গলাও কেঁপে গেল। বলল হ্যাঁ।

–দিন, দিন-বলে সাহেব ফাইলটা টেনে নিলেন।

পরক্ষণেই বললেন, ওহো, একজন কনট্রাক্টার একটা বলপয়েন্ট পেন দিয়ে গেছেন। আপনার জন্যে রেখে দিয়েছি। নিন–বলেই, ড্রয়ার খুলে পেনটা দিলেন।

সবুজ মুখ তুলে সাহেবের মুখের দিকে চাইল–সরল, ছেলেমানুষ, অপাপবিদ্ধ, সদবংশজাত, সুন্দর একটি মুখ–যে-মুখে পৃথিবীর কালির ছাপ এখনও পড়েনি।

সাহেব তখনও সবুজের মুখের দিকে চেয়েছিলেন, বললেন, কী হল? পছন্দ হয়নি।

সবুজ বলল, হয়েছে–হয়েছে।

খসস-খসস, করে সই করতে করতে সাহেব বললেন, আপনার দেওয়া কোনোকিছুতে সই করতে আমার কোনো চিন্তাই হয় না। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। তারপর হেসে বললেন, আই নো দ্যাট ইউ ওন্ট লেট মি ডাউন।

সবুজের গলার কাছে কী-যেন, কী একটা দলা পাকিয়ে উঠল।

সবুজ মুখ নামিয়ে নিল। কথা বলল না।

সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে সবুজের মনে হল যে, যে-লোকটা ঘরে ঢুকেছিল, তারসঙ্গে, যে-লোকটা বেরোল তার কোনো মিল নেই। সাহেবদের মধ্যে অনেকেই, এই সাহেবের মতো নয়। এই ছেলেমানুষ লোকটি ভালো। অফিসার-লাইক অফিসার। ছেলেটাকে ডুবিয়ে দিল সবুজ। ভবিষ্যতে কিছু-না-দেখে সই করার মতো সুস্থ সাহস আর হয়তো ও দেখাতে পারবে না। এই সরকারি গোলমেলে ক্রিয়াকান্ডর মধ্যে, ও-ও আর একজন ভীতু, ঝামেলাবাজ, সমস্ত লোকের জীবন দুর্বিষহ করা চাকরি-বজায়-রাখা অফিসার হয়ে যাবে। কিছুই করার নেই। এখন আর কিছুই করার নেই।

অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিল সবুজ।

করিডোরের অন্ধকার কোনায় খামটা দিয়েছিল হারাধান সবুজের হাতে। বলেছিল, সবুজদা,এক আছে। আমারটা আমি নিয়ে নিয়েছি।

খামটা ভারী ঠেকেছিল। দশ টাকার কী পাঁচ টাকার নোট হবে হয়তো। সবুজ অফিসে দেখতে পারেনি। ডালহাউসির এপ্রান্ত অবধি হেঁটে এসে, পুরোনো রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল সবুজ। বেসিনে মুখটা আবার ধুল। মনটা বড়ো অশান্ত লাগছিল। সমস্ত শরীরে একটা চাপা উত্তেজনা। ওর কাছে আজ সকালে মাসের এই সাতাশ তারিখে পাঁচটা টাকারও ভীষণ দাম ছিল–কিন্তু যেহেতু মনে মনে পাঁচশো টাকার প্রত্যাশা করে ফেলেছিল, এখন এক-শো টাকায় মন আর ভরবে না।

সবুজ একটা ডাবল ওমলেট আর চা-এর অর্ডার দিয়ে একবার বাথরুমে গেল। খামটা খুলল। খুলতেই,ওর হৃৎপিন্ড যেন বন্ধ হয়ে গেল। সব এক-শো টাকার নোট। দশটা।

খামটা হিপ পকেটে রেখেছিল। এবার টাকাগুলোকে ভাগ ভাগ করে রাখল বিভিন্ন পকেটে। সবুজ ভাবল, আজ মিনিবাসও নয়, ট্যাক্সি নেবে। আজ বাড়ির সামনে বহুদিন পর ট্যাক্সি করে নামবে। ফণীর দোকানে গেলেও হয়।

সবুজ ঠিক করল, ফণীর দোকানের যত ধার-ফার আছে, সব শোধ করে দেবে আজ। যখন ওর কাছে টাকা ছিল না, তখন ফণীর টাকা মেরে আনন্দ পেয়েছে। আজ যখন উপরি টাকায় ওর পকেট ভরা, তখন সে-টাকা ফণীর মুখে ছুঁড়ে মেরে আনন্দ।

ওমলেট আর চা খেয়ে–ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করেও ট্যক্সি পেল না সবুজ। শুনল, ট্যাক্সি স্ট্রাইক হয়ে গেছে দুপুর থেকে। মাঝে মাঝেই এ পকেটে ও পকেটে হাত বোলাতে বোলাতে, হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলা অবধি এল। ফুটপাতে ইমপোর্টেড নানারকম জিনিস বিক্রি হচ্ছিল। একটা বিলিতি পারফুম কিনল সবুজ কমলার জন্যে। অন্যান্য সব জিনিস নিজেদের পাড়ায় পৌঁছেই কিনবে বলে ঠিক করল। লিণ্ডসে স্ট্রিটের কাছাকছি এসে, একটা মিনিবাসে উঠে পড়ে কমলাদের বাড়ির কাছে এসে নামল।

কমলা স্নান করতে যাচ্ছিল। বলল, বোসো, বোসো। কী খাবে বলো?

সবুজ বলল, তুমি বুঝি চান করতে যাচ্ছিলে?

ফালতু প্রশ্ন। কমলা হাসল। বলল, হ্যাঁ, কেন বলো তো?

কমলা ঘেমে গিয়েছিল।

বলল, সারাদুপুর লোডশেডিং ছিল। গরমে সেদ্ধ হয়ে গেছি।

সবুজ কমলার দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল। কপালের কাছে চুল লেপটে আছে ঘামে। বগলের কাছ দুটো ঘামে ভিজে গেছে। কেমন ক্লান্ত, রুক্ষ চেহারা কমলার। এই ঘর্মাক্ত ক্লান্ত কমলাকেও ভীষণ ভালো লাগল সবুজের; সুস্নাতা, সুগন্ধি কমলার মতোই।

হঠাৎ সবুজ বলল, আমি তোমাকে চান করাব।

কমলা হেসে উঠল। বলল, কত কী-ই না তুমি জান? আমি দু-বছরের খুকি? চান করাতে হবে না। এখন বোসো তো লক্ষ্মীছেলের মতো। আমি আসছি এক্ষুনি।

সবুজ বলল, না। আজ বসব না। তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি। কাছে এসো।

কমলা কাছে এল সরলভাবে।

সবুজ পাগলের মতো ওর বুকে চুমু খেল, বাহুমূলে চুমু খেল।

কমলা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। বলল, এ মাঃ, ঘাম ঘাম।

সবুজ ওর কোমর জড়িয়ে ধরল।

কমলা জোর করে হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, অমন কোরো না, আমি নোংরা। এখন নয়, এখন নয়। সব জিনিসের সময় আছে। এখন সময় নয়।

সবুজ ওর পকেট থেকে বের করে পারফিউমের শিশিটা কমলার হাতে দিল।

কমলা বলল, টোপাজ? বাবাঃ এর তো ভীষণ দাম। তুমি কেন এত খরচ করলে?

পরক্ষণেই বাক্স খুলে, ছিপি খুলে নাকে গন্ধ নিল।

নিয়েই বলল, এ তো জাল! কোথা থেকে নিয়েছ। তোমায় ঠকিয়ে দিয়েছে। আমায় বললে না কেন? নিউমার্কেটে আমার জানা দোকান আছে–যেখান থেকে আমি সাবান-টাবান কিনি। সব ইমপোর্টেড জিনিস রাখে ওরা।

সবুজের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

শুধোল, জাল? তোমাকে ভালোবেসে একটা জিনিস-ই এনে দিলাম, তাও জাল? দাও, আমাকে ফেরত দাও।

কমলা হাসল। বলল, না, ফেরত দেব না। আমি এটাই ব্যবহার করব। তা ছাড়া ফুটপাতের দোকান–ফেরত নেবে না। উলটে তোমাকে অপমান-ই করবে।

সবুজ বলল, ইস!

কমলা আবার হাসল।

তারপর বলল তাতে কী? জিনিসটাই না-হয় জাল? তোমার ভালোবাসাটা তো জাল নয়। নাকি তাও জাল?

সবুজ বলল, তুমি জান-না?

কমলা সবুজের কপালে হাত বুলিয়ে বলল, জানি, জানি যে-জাল নয়। আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনো আমাকে আর কিছু উপহার দিয়ো না।

সবুজ অবাক হয়ে শুধোল, কেন? কেন ও-কথা বলছ?

কমলা বলল, জানি না। আমার ভালো লাগে না। আমার মনে ভয় হয় যদি কখনো উপহারটার দাম তোমার ভালোবাসার দামের চেয়ে বেশি বলে মনে হয় আমার। তুমি যা দাও, যা দিয়েছ তাতেই আমি খুশি। আমার তো এসবের অভাব নেই। কুমুদ তো আমাকে সব-ই দেয়, এ-সবকিছু। কুমুদের কাছে যা পাইনি, পাব না কখনো, আমাকে শুধু তাই দিয়ো। অন্য কিছু না। কিছুই নয়। বুঝেছ সবুজ?

সবুজ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল।

তারপর-ই বলল, চলি, কেমন। আজ বড়োতাড়া আছে।

হাসির জন্যে কাঞ্জিপুরম শাড়ি, খোকার বই, ফাউন্টেন পেন, রসগোল্লার হাঁড়ি, এসব কিনে অনেক বোঝা হয়ে গেল সুবজের। এমন সময় দেখল সেই কাল্টু রিকশাওয়ালা ঠুংঠুং করে ওর দিকেই আসছে।

জিনিসগুলো রিকশায় সিটের একপাশে তুলে দিয়ে সবুজ বলল, কাঁসারিপাড়ায় চলো। তুমি যে-দোকানে সেদিন রুটি নিয়ে ঝগড়া করেছিলে, সেই, দোকানে। মনে আছে?

কাল্টু হাসল। বলল, আচ্ছা।

দোকানের ন্যাংটা আলোটা সেদিনও দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল। মাসের শেষ। দোকানে খরিদ্দার ছিল না। ফণী টুলে বসে কী একটা বই পড়ছিল। সবুজকে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়াল।

রিকশাটা ফণীর দোকানের কাছাকাছি এসে পড়তেই সবুজ মত বদলাল। ঠিক করল, ফণীকে চাইনিজ খাবার খাইয়ে লাভ কী? এসব জিনিসের কদর ও কী জানবে? তার চেয়ে কাল ছুটি আছে, ওকে ডেকে মাছ খাইয়ে দেবে।

চাইনিজ-খাবারের প্যাকেটটা রিকশাতে রেখে, রিকশাটা একটু দূরে দাঁড় করিয়ে, সবুজ ফণীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

সবুজের তুলনায় ফণী অনেক বেঁটে। সবদিক দিয়ে ফণীকে খাটো লাগল সেদিন সবুজের। ওর পকেটে অনেকগুলো একশো টাকার নোট ছিল তো।

ফণী বলল, কিছু দেব সবুজবাবু?

সবুজ হাসল, দাঁত চেপে, বিদ্রুপের হাসি।

বলল, না না। অনেক তো দিয়েছেন। আর কিছু চাই না।

তারপর একটু থেমে বলল, আপনার কাছে আমার ধার কত? আজ শোধ করে দেব বলে এসেছি। কারও কাছে ধার রাখা আমি পছন্দ করি না। সব শুধে দেব।

ফণী বিব্রত হল। বলল, কী বলছেন আপনি! আমার কাছে আপনার কীসের ধার?

সবুজ বলল, হিসেবটা বের করুন না।

ফণী বলল, হিসেব রাখিনি। বিশ্বাস করুন। তা ছাড়া, আমার কাছে আপনার কোনো ধার নেই। ধার যদি কিছু থাকে, তা আমার-ই আছে আপনার কাছে।

ফণীর রোগা হাড়-বের-করা মুখে উজ্জ্বল চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল।

ফণী মুখ নামিয়ে স্বগতোক্তির মতো বলল, আপনার কাছে বড়ো কৃতজ্ঞ আমি। কত-যে কৃতজ্ঞ, তা মুখে বলতে পারব না। তা ছাড়া, যা সামান্য জিনিস দিয়েছি, তা তো হাসির জন্যে, খোকার জন্যে, আপনার জন্যেই। আপনারা কি আমার পর?

সবুজ মনে মনে বলল, শালা থিয়েটার তো শিখেছ খুব!

মুখে বলল, তাহলে শোধ করতে দেবেন না? ঋণীই থাকতে হবে আমায়?

ফণী আবার নরম করে হাসল।

বলল, থাকলেন-ই বা ঋণী। আপনার কি ধারণা জীবনে ঋণ রাখা পাপ? এমন লোক কি কেউ আছে পৃথিবীতে, যার কোনো ঋণ নেই অন্যের কাছে? আমারও কি ঋণ নেই?

সবুজ বলল, না, না, মশাই, ওসব বুঝি না। আমার বিবেক দংশন করে। টাকাটা আমি দিতে চাই।

ফণী হাসল আবার। বলল, আপনার বিবেক যে, আছে এ-প্রমাণ অন্তত আপনি পেয়েছেন। এটাই বা কম কী? যদি নাই-ই শোনেন আমার কথা, তবে আজ অন্তত নাই-ই বা দিলেন। ধার শোধার সময় তো পড়ে আছে।

সবুজ আর কথা বাড়াল না।

মনে মনে বলল, আমার শুকনো-স্ত্রীর জীবনে তুমি ফগ্লধারা শালা, ধার শোধ করলে যদি তোমার যাওয়া-আসা বন্ধ করে দিই আমি! সেই-ই ভয়।

রিকশায় উঠে বসল সবুজ।

একটু এগিয়েই কাল্টু রিকশাওয়ালা বলল, ই বাবুকো আপ জানতে হেঁ!

সবুজ বলল, থোড়া, হোড়া। মানে, তানি তানি।

কাল্টু বলল, দিখাতা সিধি আদমি, মগর বহুত টেড়া হ্যায়। এক রোজ উসকো হাম জানসে মার দুংগা।

সবুজ উল্লসিত হল।

বলল, আরে এইসাহি হ্যায় উ আদমি। শিখলাও না এক রোজ ঠিকসে।

কাল্টু বলল, শিখলানা নেহি হোগা। হামকো কুছ করনা নেহি হোগা–যো লোক করেগা, উ লোগ উসকো পিছুমে লাগা হুয়া হ্যায়। ঠিকসে শিখলায়গা।

সবুজ বাড়িতে পৌঁছে একটা পাঁচ টাকার নোট দিল কাল্টুকে।

ভাড়া এক টাকা হয়। কাল্টু চার টাকা ফেরত দিতে গেল।

সবুজ বলল, কোই বাত নেই’-–। মিস্টার সাহনি যেমন করে অফিসে বলেছিলেন পাঞ্জাবিতে ‘কোই গাল নেহি’–তেমন করে।

কাল্টু অনেকক্ষণ সবুজের চোখের দিকে চেয়ে রইল।

তারপর সেলাম করে বলল, ‘আচ্ছা বাবু’!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *