এমনি সময় সুট করে সে আমগাছের ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল আর ভোরবেলাকার প্রথম সূর্যের আলো এসে বাগান ভরে দিল। ফিরে দেখি আমার পাশে লাল নীল ছককাটা লুঙি আর সবুজ কম্বলের ড্রেসিংগাউন পরে আম-কাঠির দাঁতন চেবাতে-চেবাতে সেজ-দাদামশাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সেজ-দাদামশাই বললেন, “জানিস, এই বারান্দাটাতে আমার ছোটকাকা কত কি করিয়েছিলেন। বিলেত থেকে ছোটকাকা ভীষণ সাহেব হয়ে ফিরলেন ঘাড়-ছাঁট চুল, কোটপ্যান্ট পরা, হাতে ছড়ি, মুখে চুরুট, কথায়-কথায় খারাপ কথা। ক্রমেই বললেন, “আমি মেম আনিব, বিলেতে সব ঠিক করে রেখে এসেছি। এই দোতলার উপর শোবার ঘরের সঙ্গে লাগা এক বাথরুম বানাব, লম্বা বারান্দাটা তো আছেই, তার এক কোণ দিয়ে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বানাব। সাদা পাগড়ি মাথায় দিয়ে ঐ সিঁড়ি বেয়ে জমাদার ওঠানামা করবে। নইলে মেম আসবে না বলেছে। তাই-না শুনে আমার ঠাকুমা-পিসিমা আর জেঠিমারা হাত-পা ছুঁড়ে বললেন, “অমা! সে কি কথা গো! মেমদের যে লাল চুল, কটা চোখ, ফ্যাকশা রঙ আর মড়াখেকো ফিগার হয়। কি যে বলিস তার ঠিক নাই, মেমরা যে ইয়েটিয়ে পর্যন্ত খায় শুনেছি। ছোটকাকা বিরক্তমুখ করে বললেন, “অবিশ্যি তোমরা যদি চাও যে আমি সন্নিসী হই, তা হলে আমার আর কিছুই বলবার নেই। বল তো নাগা সন্নিসীই হই, মেমেও দরকার নেই, নতুন সুটগুলোতেও দরকার নেই।” তাই শুনে ঠাকুমারা সবাই আরো চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কিন্তু ভয়ে ঠাকুরদার কানে কেউই কথাটা তুললে না। ছোটকাকাও সেই সুযোগে মিস্ত্রি লাগিয়ে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি তৈরি করিয়ে ফেললেন। ঐখানে রেলিং কেটে সিঁড়ি বসানো হয়েছিল। দোতলা থেকে ছাদে ওঠবার কাঠের সিঁড়ি একটা ছিলই, বাদর তাড়াবার জন্যে, তারই ঠিক নীচে দিয়ে নতুন সিঁড়ি হল। এখন খালি বাথরুম বানানো আর জমাদারের পাগড়ি কেনা বাকি রইল। ঠাকুরদার কাছে কী ধরনের মিথ্যে কথা বলে টাকা বাগানো যায় দিনরাত ছোটকাকা সেই চিন্তাই করতে লাগলেন। এদিকে পাড়ার চোররাও সুবিধে পেয়ে রোজ রাত্রে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে শুরু করে দিল। তাদের জ্বালায় ঘুমোয় কার সাধ্যি! শেষটা একদিন ঠাকুরদার ঘুম ভেঙে গেল, গদা হাতে করে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, চোররাও সিঁড়ি দিয়ে ধপধপ নেমে বাগানের মধ্যে দিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। চাঁদের আলোয় ঠাকুরদা অবাক হয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর আস্তে-আস্তে আবার শুতে গেলেন। পরদিন সকালে উঠেই মিস্ত্রি ডাকিয়ে ঐ সিঁড়ি খুলিয়ে ফেললেন। রাগের চোটে ছাদে ওঠবার কাঠের সিঁড়িটা অবধি খুলিয়ে দিলেন। কাটা রেলিং ফের জোড়া দেওয়ালেন। আর ছোটকাকাকে ডেকে বললেন, “পানুর ছোটমেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। টোপর পরে প্রস্তুত হও। শেষটা ঐ পানুর ফর্সা মোটা গোলচোখো বারো বছরের মেয়ের সঙ্গে ছোটকাকার বিয়ে হয়ে গেল। এবং বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তারা সারাজীবন পরম সুখে কাটাল। পাঁচুটা তো ওরই নাতি। এই রে, ঘনশ্যাম আবার আমার ঈশপগুল নিয়ে আসছে। বলিস যে আমি বেরিয়ে গেছি।” বলেই সেজ-দাদামশাই হাওয়া!
আমি তাকিয়ে দেখলাম ছাদ পর্যন্ত বাঁদর তাড়াবার সিঁড়ির খাজগুলো দেওয়ালের গায়ে কাটা-কাটা তখনো রয়েছে।
সব পুরনো বাড়ির মতন মামাবাড়ির ঘরগুলো বিশাল-বিশাল, সিঁড়িগুলো মস্ত-মস্ত, বারান্দাগুলোর এ মাথা থেকে ডাকলে ও মাথা থেকে শোনা যায় না। আর দুপুরে সমস্ত বাড়িখানা অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে গেল! পাঁচুমামার টিকিটি সকাল থেকে দেখা যায় নি। নেহাত আমার সঙ্গে এক ট্রেনে এসেছিল, নইলে ও যে জন্মেছে তারই কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। বাড়িসুদ্ধ কেউ ওর নাম করল না। দুপুরে পদিপিসীর বর্মিবাক্সর সন্ধান নিচ্ছি এমন সময় কানে এল খুব একটা হাসি-গল্পের আওয়াজ।
রান্নাঘরে আনন্দ কোলাহল এমন কথা তো জন্মে শুনি নি। অবাক হয়ে এগিয়ে-বাগিয়ে চলোম। বারান্দার বাঁকে ঘুরেই দেখি চাকর-বাকররা বিষম ঘটা করে অতিথি-সৎকার করছে। কে একটা রোগা লোক ঠ্যাং ছড়িয়ে বামুনঠাকুরের উঁচু জলচৌকিতে বসে রয়েছে। চার দিকে পানবিড়ি আর কাচি সিগারেটের ছড়াছড়ি। বামুনদিদি পর্যন্ত ঘোমটার মধ্যে বিড়ি টানছে। ঘনশ্যামট্যাম সবাই উপস্থিত আছে, পান খেয়ে-খেয়ে সব চেহারা বদলে ফেলেছে।
আমার পায়ের শব্দ পেয়েই নিমেষের মধ্যে রান্নাঘর ভোঁভাঁ, কে যে কোথায় চম্পট দিল ঠাওরই করতে পারলাম না। চোখের পাতা না ফেলতেই দেখি কেউ কোথাও নেই, খালি বামুনদিদি ঘোমটার ভিতরে হাই তুলছে এবং বিড়িটার শেষ চিহ্ন পর্যন্ত গোপন করে ফেলেছে! কিন্তু একটা জিনিস আমার চোখ এড়াতে পারে নি। ঠাং ছড়ানো রোগা লোকটা হচ্ছে আমাদের পরিচিত সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক। ভাবতে ভাবতে গা শিউরে উঠল। এতদূর সাহস যে ভোরবেলা দুরবীন দিয়ে পরখ করে নিয়ে দুপুর না গড়াতে একেবারে ভেতরে এসে সেঁদিয়েছে। চুলগুলো আমার সজারুর কাটার মতন উঠে দাঁড়াল। বামুনদিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, “কে লোকটা?” বামুনদিদি যেন আকাশ থেকে পড়ল।
“কোন লোকটা খোকাবাবু? তুমি-আমি ছাড়া আর তো লোক দেখছি না কোথাও!” বলেই সে সরে বসল, অমনি তার কোলের মধ্যে কতকগুলো রুপোর টাকা ঝনঝন করে বেজে উঠল। বুঝলাম ঘুষ দিয়ে চাকর সম্প্রদায়কে হাত করেছে! কি ভীষণ।
এদিকে পাঁচুমামার সঙ্গে পরামর্শ করব কি! সে যে সকাল থেকে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে তার আর কোনো পাত্তাই নেই! একবার কি একটা গুজব শুনেছিলাম নাকি ভুলে বেশি জোলাপ খেয়ে ফেলেছে। তবুও তখুনি তার খোঁজে বেরুলাম। চার-পাঁচটা ভুল দরজা খুলে চার-পাঁচবার তাড়া খাবার পর দেখি পূর্বদিকের ছোট ঘরে তক্তপোশের ওপর শুয়ে-শুয়ে পাংশুপানা মুখ করে পাঁচুমামা পেটে হাত বুলচ্ছে। আমাকে দেখেই বিষম বিরক্ত হয়ে নাকিসুরে বলল, “কেন আবার বিরক্ত করতে এসেছ। যাও না এখান থেকে।” আমি বললাম, “চার দিকে যেরকম ষড়যন্ত্র চলেছে এখন আর তোমার আরাম করে শুয়ে-শুয়ে পেটে হাত বুলনো শোভা পায় না! এদিকে শক্র এসে ঢুকেছে সে খবর রাখ কি?” পাঁচুমামা কোথায় আমাকে হেল্প করবে, না তাই-না, শুনে এমনি ক্যাও-ম্যাও শুরু করে দিল যে আমি সেখান থেকে যেতে বাধ্য হলাম!
সারাদিন ভেবে-ভেবেও একটা কুলকিনারা করতে পারলাম না। রাত্রে দিদিমা পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলতে-বুলতে বললেন, “বলেছিলাম তোকে পদিপিসীর বর্মিবাক্সের গল্প বলব, তবে শোন।”
দিদিমা সবুজ বালাপোশ ভালো করে জড়িয়ে গালের পান দাঁতের পেছনে তুসে গল্প বলবার জন্যে রেডি হলেন। আর আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। দিদিমা বলতে লাগলেন, “পদিপিসীর ইয়া ছাতি ছিল, ইয়া পাঞ্জা ছিল। রোজ সকালে উঠে আধ সের দুধের সঙ্গে এক পোয়া ছোলা ভিজে খেতেন। কি তেজ ছিল তারা সত্যি মিথ্যে জানি না, শুনেছি একবার একটা শামলা গোরু হাম্বা-হাম্বা ডেকে ওর দুপুরের ঘুমের ব্যাঘাত করেছিল বলে উনি একবার তার দিকে এমনি করে তাকালেন যে সে তিনদিন ধরে দুধের বদলে দই দিতে লাগল। পদিপিসী একবার শীতকালে গোরুর গাড়ি চেপে কাউকে কিছু না-বলে রমাকান্ত নামে একটিমাত্র সঙ্গী নিয়ে কোথায় জানি চলে গেলেন ফিরে এলেন দুপুর-রাত্রে। এসেই মহা হৈ-চৈ লাগালেন কি একটা নাকি বর্মিবাক্স হারিয়েছে। সবাই মিলে নাকি দেড়বছর ধরে ঐ বাক্স খুঁজেছিল। কোথায় পাওয়া যাবে! কেউ চোখে দেখেনি সে বাক্স। শেষপর্যন্ত সে পাওয়াই গেল না!” আমি নিশ্বেস বন্ধ করে বললাম, “তাতে কী ছিল?”
দিদিমা বললেন, “কে জানে! মসলা-টসলা হবে। ঐ পদিপিসীর একটিমাত্র ছেলে ছিল, তার নাম ছিল গজা। কালো রোগা ডিগডিগে, এক মাথা কোঁকড়া-কোঁকড়াতেল-চুকচুকে চুলে টেরি বাগানো। দিনরাত কেবল পান খাচ্ছে আর তামাক টানছ। পড়াশুনো কি কোনোরকম কাজকর্মের নামটি নেই। সারাদিন গোলাপি গেঞ্জি আর আদির ঝুলো পাঞ্জাবি পরে পাড়াময় টোটো কোম্পানি। সখের থিয়েটার, এখানে-ওখানে আড্ডা। অথচ কারু কিছু বলবার জো নেই, পদিপিসী তা হলে আর কাউকে আস্ত রাখবেন না।
“জনিস তো ভালো লোকের কখনো ভালো হয় না। যত সব জগতের বদমায়েস আছে সবাই সুখে জীবন কাটিয়ে যায়। গজারও তাই হল। যখন আরো বড় হল, গাঁজা গুলি খেতে শিখল, জুয়োর আড্ডায় গিয়ে জুটল। মাঝে-মাঝে একমাস-দুমাস দেখা নেই। আবার একগাল পান নিয়ে হাসতে-হাসতে ফিরে আসে। পদিপিসী যেখান থেকে যেমন করে পারেন টাকা জোগান। পাজি ছেলেকে পায় কে!
“হঠাৎ দেখা গেল গজার অবস্থা ফিরেছে। কথায়-কথায় বাড়িসুদ্ধ সবাইকে পাঁঠার মাংস খাওয়ায়, ঝুড়ি ঝুড়ি সন্দেশ আনে। একবার সমস্ত চাকরদের গরম বেনিয়ান কিনে দিল। ঘোড়ার গাড়ি কিনল, হীরের আংটি কিনল। বাড়িসুদ্ধ সবাই থরহরি কম্পমান! কে জানে কোথা থেকে এত টাকা পায়! পদিপিসী অবধি চিন্তিত হলেন। অথচ চুরি-ডাকাতি করলে তো এতদিনে পেয়াদা এসে হানা দিত। টাকা ভালো, কিন্তু পায় কোথা?”
গজার উপাখ্যান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাই নি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। রাতের অদ্ভুত চুপচাপের মধ্যে শুনতে পেলাম পাহাড়ে-পাশবালিশটার আড়ালে দিদিমা আস্তেআস্তে নাক ডাকাচ্ছেন। আর কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। তার পর শুনলাম দূরে হুতুমপ্যাঁচা ডাকছে, আর মাথার উপর পুরনো কাঠের কড়িগুলো মটমই করে মোড়ামুড়ি দিচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম এ-সবের জন্যে ঘুম ভেঙে যায় নি। যার জন্যে ঘুম ভেঙেছে সে নিশ্চয় আরো লোমহর্ষক। শুয়ে-শুয়ে যখন শুয়ে থাকা অসহ্য হল, পা সিরসির করতে লাগল, আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, জল না খেয়ে আর এক মিনিটও থাকা অসম্ভব হল, আস্তে-আস্তে খাট থেকে নামলাম। আস্তে-আস্তে দরজা খুলে বাইরে প্যাসেজে দাঁড়ালাম। ঐ একটু দূরে সারি সারি তিনটে কলসিভরা জল রয়েছে, কিন্তু মাঝখানের ঘুরঘুঁটে অন্ধকারটুকু পেরোতে ইচ্ছা করছে না। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁ পায়ের গুলিটা চুলকোচ্ছি আর মন ঠিক করছি এমন সময় কার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
কি আর বলব! হাত-পা পেটের মধ্যে সেদিয়ে গেল। যেদিকে শব্দ সেদিকে সেজ-দাদামশাইয়ের ঘর। কল্পনা করতে লাগলাম দাঁত দিয়ে ছোরা কামড়ে ধরে হাত দিয়ে সিঁদ কাটতে-কাটতে, কানে মাকড়িপরা, লাল নেংটি, গায়ে তেল-চুকচুকে সব চোর-ডাকাতেরা সেজ-দাদামশাইয়ের ঘরে ঢুকে ওর হাতবাক্স সরাচ্ছে, রুপোর গড়গড়া নিচ্ছে, মখমলের চটি পায়ে দিচ্ছে!
এমন সময় ঠুস করে সেজ-দাদামশাইয়ের দরজা খুলে গেল আর বিড়ি ধরাতে-ধরাতে যে বেরিয়ে এল বিড়ির আগুনে স্পষ্ট তাকে দেখে চিনলাম সেই চিম্ড়ে ভদ্রলোক-বগলে জুতো নিয়ে পা টিপেটিপে এগুচ্ছে।
আমার তো আর তখন নড়বার-চড়বার ক্ষমতা ছিল না তাই চুপ করে ভীষণ মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলাম। লোকটা কিন্তু কি-একটা পেরেকে না কিসে হোঁচট খেয়ে ”দুর শালা!” বলে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। একটু বাদেই নীচের তলায় একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেলাম।
এতক্ষণে আমার চলবার শক্তি ফিরে এল, ভাবলাম জল খেয়ে কাজ নেই। ঘরেই ফিরে যাওয়া যাক। একবার বেরুল চিম্ড়ে ভদ্রলোক, এর পরে হয়তো বেরুবে দামড়া ডাকাত। ফিরতে যাব এমন সময় একটা সাদা কাগজ উড়ে এসে আমার পায়ে জড়িয়ে গেল। নিমেষের মধ্যে সেটা তুলে নিয়ে সবেমাত্র পকেটে পুরেছি এমন সময় আবার সেজদাদামশাইয়ের দরজা খুলে গেল এবং এবার স্বয়ং সেজ-দাদামশাই বেরিয়ে এসে টর্চ হাতে নিয়ে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজতে লাগলেন। আমি তো এদিকে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। ধরে ফেললে কী যে হবে ভাবা যায় না। এমন সময় সেই একই পেরেকে না কিসে হোঁচট খেয়ে সেজ-দাদামশাইও হাত-পা ছুঁড়ে কত কি যে বললেন তার ঠিক নেই। ভালোই হল, আমাকে দেখবার আগেই খোঁড়াতে-খোঁড়াতে ঘরে ফিরে গিয়ে বোধ হয় কিছু লাগালেন টাগালেন।
আমি যে কি ভাবব ঠাওর করতে না-পেরে খানিকটা জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। পকেটে কাগজটা করকর, করতে লাগল, কিন্তু দিদিমা আলো নিভিয়ে দিয়েছেন, পড়বার উপায় নেই। রঙ-চঙে চৌকির উপর রোজকার মতন আজও দেশলাই মোমবাতি রাখা ছিল, কিন্তু সব জানাজানি হয়ে যাবার ভয়ে আর জ্বালোম না। সকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অপেক্ষা করতে-করতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখলাম পদিপিসী এসে পেছনের বারান্দার দরজা থেকে আমাকে ডাকছেন। ইয়া ষণ্ডা চেহারা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, থান পরা, ছোট করে চুল ছাঁটা, কপালে চন্দন লাগানো-অবিকল পাঁচুমামা যেমন বলেছিল। এক হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে ডাকছেন, আর অন্য হাতটা পেছনে রেখেছেন। আমি কাছে যেতেই বললেন, “বাক্স পেয়েছিস?” আমি বললাম, “কই না তো! নিমেষের মধ্যে বাক্স কোথায় ফেলেছিলে যে কবছর ধরে খুঁজে-খুঁজেও পাওয়া যায় নি, আমার আশা আছে যে আমি দুদিনেই খুঁজে দেব? কোথায় রেখেছিলে?”
পদিপিসী বললেন, “ভালো করে খুঁজে দেখা পেলে তুইই নিস। পাঁচুটা একটা ইডিয়ট, জোলাপের পর্যন্ত ডোজ ঠিক করতে পারে না, তুইই নিস। বাক্সের মধ্যে লাল চুনীর কানের দুল আছে, তোর মাকে দিস। আর দেখ, ঐ ব্যাটা চিড়েটাকে আর ঐ বুড়োটাকে একেবারে কাইণ্ড অফ বোকা বানিয়ে দিস। বিশ্বনাথের কৃপায় গজার আমার কোনো অভাব নেই, জুড়িগাড়ি কিনেছে, বাড়ি কিনেছে, গাঁজার ব্যবসা করেছে। আহা বাবা বিশ্বনাথ না দেখলে পাপিষ্ঠদের কী গতি হবে?” বলে আমাকে চুমু খেয়ে পদিপিসী ছোটকাকার তৈরি সেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বাগানের দিকে চললেন, এবং পেছন ফিরতেই দেখলাম যে হাতটা পেছনে। রেখেছিলেন তাতে ইয়া মস্ত এক গদা!
গদা দেখে এমন চমকে গেলাম যে ঘুমই ভেঙে গেল। দেখলাম সকালবেলার রোদ পেছন দিকের বারান্দা দিয়ে ঘরে এসে বিছানা ভরে দিয়েছে। কাটা সিঁড়ির দাগটা চকচক করছে। হঠাৎ কেন জানি মনে হল সিঁড়িটা একটা ভারি ইমপরট্যান্ট জিনিস।
এই তো সুবর্ণ সুযোগ সেই গোপন চিঠি পড়বার। পকেট থেকে বের করে দেখলাম লাল কালিতে লেখা–শ্ৰীযুতবাবু বিপিন বিহারী চৌধুরীর কাছ হইতে ২০০ পাইলাম। স্বাঃ নিধিরাম শর্মা।
পুঃ সব অনুসন্ধানাদি গোপন থাকিবেক।
অবাক হয়ে ভাবছি সেজ-দাদামশাই কী উদ্দেশ্যে চিমড়েকে টাকা দিলেন, কী অনুসন্ধান? এ বিষম সন্দেহজনক! এমন সময় দরজা খুলে পাঁচুমামা ঝড়ের মতন ঘরে ঢুকেই দুম করে দরজা বন্ধ করে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বোয়ালমাছের মতন হাঁপাতে লাগল। মুখটা দেখলাম আগের চাইতেও সাদা, কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে, চুল উস্কোখুস্কো।
চিঠিটা পকেটে গুঁজে লাফিয়ে খাট থেকে নেমে বললাম, “কী হয়েছে পাঁচুমামা? আবার জোলাপ খেয়েছ?”
পাঁচুমামা শুকনো ঠোঁট আরো শুকনো জিভ দিয়ে চাটতে চেষ্টা করে বলল, “খেন্তিপিসী এসেছে।”
আমি বললাম, “খেস্তিপিসীটা আবার কে?” পাঁচুমামা আমসি হেন মুখটি করে বলল, “পদিপিসী দি সেকেণ্ড!”
.
০৬.
চিঠিটা পাঁচুমামার নাকের সামনে নেড়ে বললাম, “ও-সব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বৃথা সময় নষ্ট কোরো না মামা! স্বয়ং সেজ-দাদামশাই এতে ভীষণভাবে জড়িত আছেন, এই দেখ তার প্রমাণ!” পাঁচুমামা চোখ গোল গোল করে চিঠিটা সবে পড়তে যাবে এমন সময় প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে দরজা গেল খুলে, আর সত্যি বলছি, অবিকল আমার সেই স্বপ্নে দেখা পদিপিসীর মতন কে একজন তোলোহাড়ির মতন মুখ করে ভিতরে এলেন। বুঝলাম, ঐ খেন্তিপিসী। পাঁচুমামা দরজার ঠেলা খেয়ে ছিটকে আমার খাটের উপর পড়েছিল, সেখান থেকে সরু গলায় চেঁচিয়ে বলল, “কী করতে পার আমার তুমি? এমন কোনো স্ত্রীলোক জন্মায় নি যাকে আমি ভয় পাই! জানো আমার বুকের মধ্যে সিংহ–” এইটুকু বলতেই খেন্তিপিসী কোমরে কাপড় জড়িয়ে খাটের দিকে। একপা এগুলেন আর পাঁচুমামাও অন্যদিক দিয়ে টুপ করে নেমে খাটের তলায় অগুনতি হাড়ি-কলসির মধ্যে সেঁদিয়ে গেল।
খেন্তিপিসী তখন আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আপাদমস্তক আমাকে কাঠফাটা দৃষ্টিট দিয়ে দেখতে লাগলেন, আমার হাত এমনি কাঁপতে লাগল যে চিঠিটা খড়মড়, খড়মড় করে উঠল। তাই শুনে খেন্তিপিসী এমনি চমকালেন যেন বন্দুকের গুলি শুনেছেন। কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সে কথা বলবার আগেই সেজ-দাদামশাই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। খেন্তিপিসীকে দেখে একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আ খেন্তি, তুই আবার এখানে কেন?”
খেন্তিপিসী চায়না ক্যাণ্ডেল পাওয়ারের চোখ দুটো আমার ওপর থেকে সরিয়ে বরফের মতন ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কেন, তোমার কি তাতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে? পুজোর সময় একটা কাঁচকলাও দিলে না, আমার ভজাকে যে কাপড় দিলে সেও অতি খেলো সস্তা রাবিশ। বাপের বাড়ি থেকে কলাটা-মুলোটা দূরে থাকুক কচুটারও মুখ দেখি না। তাই বলে বৌদির ঘরের কোনায়ও একটু জায়গা হবে না?”
পাঁচুমামা এখানে দুটো হাড়ির মাঝখান দিয়ে মুণ্ড বের করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “জায়গা হবে কি না হবু তাতে তো তোমার ভারি বয়ে গেল! এই ভরসকালে আমার ঘরেই-বা তোমার কত জায়গা–” বলেই কচ্ছপের মুণ্ডুর মতন সুই করে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল!
সেজ-দাদামশাই এবার গলা পরিষ্কার করে পাঁচুমামাকে তাড়া দিয়ে বললেন, “এই পাঁচু হতভাগা, বেরিয়ে আয় বলছি। আমার একটা ইমপরট্যান্ট কাগজ হারিয়েছে, খুঁজে দে বলছি, নইলে ভালো হবে না।” সঙ্গে সঙ্গে থেন্তিপিসীও বললেন, “বেরো একখুনি। তুইই নিশ্চয় আমার সুটকেশ থেকে বাড়ির নকশাটা সরিয়েছিস। বেরো বলছি। তোকে আমি সার্চ করবই করবা না বেরোলে ঐ খাটের তলায় সেদিয়েই সার্চ করব। আমি জানি না তোদের সব চালাকি! পদিপিসীর বাক্সর জন্যে তোরাও ছোঁক-ছোঁক করে বেড়াচ্ছিস। অথচ বাক্সতে আর কারো অধিকার নেই। ওটা স্ত্রীধন, ওটা আমি পাব।” সেজ-দাদামশাই রেগে বললেন, “তুই পাবি মানে? তোর ভজার পেটে যাবে বল। আমি আইন পাস করেছি, তা জানিস? কেউ যদি পায় তো আমি পাব। জানিস আমি দুশো টাকা খরচ করে ডিটেকটিভ লাগিয়েছি। ও বাক্স আমি বের করবই!”
এইবার দরজার কাছ থেকে একটা নরম কাশির শব্দ শোনা গেল। দেখলাম চিমড়ে ভদ্রলোক সেখানে কালো আলস্টার পরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছেন। বিড়িটা এবার বের করে বললেন, “মনে থাকে যেন তিনভাগের একভাগ আমার। যদি বাক্স পান আমার অদ্ভুত বুদ্ধির সাহায্যেই পাবেন।”
খেন্তিপিসী হঠাৎ আবিষ্কার করলেন খাটের তলা থেকে পাঁচু-মামার ঠ্যাং দুটো অসাবধানতাবশত একটুখানি বেরিয়ে রয়েছে। আর যায় কোথা, নিমেষের মধ্যে হিড় হিড় করে টেনে পাঁচুমামাকে বের করে এনে
দুই থাপড় লাগালেন, তার পর বুকপকেট থেকে একটা মোটামতন কাগজ টেনে বের করে বললেন, “তবে না নকশা নিস নি।”
তার পর কাগজটা খুলে বললেন, “ইস, দেখেছ সেজদা, ব্যাটাছেলে সংস্কৃতে উনিশ পেয়েছে।”
সেজ-দাদামশাইও অমনি বললেন, “কই দেখি-দেখি!”
চিম্ড়ে ভদ্রলোকও এগিয়ে বললেন, “মানুষ হওয়াই একরকম অসম্ভব।”
পাঁচুমামা তখন একদৌড়ে আবার ধাটের তলায় ঢুকল এবং এবার পা গুটিয়ে সাবধানে বসে বলল, “আমার কলেজের পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়ে তোমাদের কী দরকার শুনি? বিশেষত খেন্তিপিসীর মতন একজন। আকাট মুখ্য স্ত্রীলোকেরা নকশা হারিয়েছে। দরকারি কাগজ হারিয়েছে। তাই আমার ওপর হামলা। আর ঐ ইজের-পরা ছোকরার হাতে যে কাগজটা আছে সেটা কী?”
পাঁচুমামার কাছে আমি এমন বিশ্বাসঘাতকতা আশা করি নি। কিন্তু তখন দেখলাম আপত্তি-টাপত্তি করবার সময় নেই। দেখলাম খেন্তিপিসী, সেজ-দাদামশাই আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক নিজেদের ঝগড়া ভুলে, পাঁচুমামার সংস্কৃতের নম্বর ভুলে, গোল হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। শুনতে পেলাম ফোঁস্-ফোঁস্ করে ওদের ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। বুঝলাম বিপদ সন্নিকট!
হঠাৎ ‘ও দিদিমা’ বলে চেঁচিয়ে ধা করে আমার পেছনের দরজা দিয়ে বারান্দায় উপস্থিত হলাম। বুঝলাম দেয়ালে সিঁড়ির খাঁজকাটার কাজ শেষ হয় নি। নিমেষের মধ্যে খাঁজের মধ্যে মধ্যে পায়ের বুড়ো আঙুল গ জে গুঁজে একেবারে ছাদে উপস্থিত হলাম। এবার আমি নিরাপদ, যদিও আমি এখন অবধি চা পাই নি তবু নিরাপদ। আমি ছাদে শুয়ে খুব খানিকটা হাপরের মতন হাঁপিয়ে নিলাম। আমি জানি ওদের কারু সাধ্য নেই ওপরে ওঠে।
আস্তে–আস্তে রোদ এসে ছাদটাকে ভরে দিল। আমার পায়ের আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে। হাওয়া বইতে লাগল। দেখলাম ছাদে রাশি-রাশি শুকনো পাতা জমেছে কত বছর ধরে কে বা জানে। শুনলাম কত-কত পায়রা বুক ফুলিয়ে বকবকম করছে। দেখলাম বাড়ির সামনের দিকে গম্বুজের মতন করা, তাতে খোপ খোপ আছে, পায়রারা তার মধ্যে থেকে যাওয়া-আসা করছে। চারদিক একটা পায়রা-পায়রা গন্ধ! খিদে যে পায় নি তা নয়। তবু যেই মনে হল নীচে সব ওৎ পেতে বসে আছে, নেমেছি কি কপাং করে ধরবে, আমনি আর আমার নামবার ইচ্ছে রইল না। দরকার হলে ছাদে শুধু দিনটা কেন, রাতটাও কাটাব স্থির করলাম।
কিছু করবার নেই, কিছু দেখবার নেই। চার দিকে পাঁচিল, ওপরে আকাশ আর ক’শো পায়রা কে জানে! শুনতে পাচ্ছিলাম ওরা নানান সুরে কখনো রেগে চেঁচিয়ে, কখনো নরম সুরে ফুসলিয়ে আমাকে ডাকছে। আমি সে ডাকের কাছ থেকে যতদূরে পারি সরে গিয়ে একেবারে খোপওয়ালা গম্বুজের পাশে এসে দাঁড়ালাম। যেন পায়রাদের রাজ্যে এসেছি। খোপের ভেতর থেকে দেখলাম কচিকচি লালমুখোরা আমাকে অবাক হয়ে
দেখছে, আর তাদের মায়েরা চ্যাঁ-চ্যাঁ লাগিয়ে দিয়েছে। সারি সারি খোপে শত-শত পায়রার বাসা। চার দিকে। পায়রার পালক, পায়ের নীচে পায়রার পালকের নরম গালচে তৈরি হয়েছে।।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সব খোপে পায়রার বাসা, কেবল এক কোণে দুটো খোপ ছাড়া!
তখন আমার গায়ের লোমগুলি খড় খড় করে একটার পর একটা উঠে দাঁড়াল আর পা দুটো তুলতুলে মাখনের মতন হয়ে গেল, কানের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলাম শোঁ-শাঁ করে সমুদ্রের শব্দা যে আমি কোনোদিনও অঙ্কে চল্লিশের বেশি পেলাম না, সেই আমি কি তবে আজকে একশো বছর ধরে কেউ যা পায় নি সেই খুঁজে পাব?
খট্ করে হাঁটু দুটো ফের শক্ত হয়ে গেল আর আমি তরতর করে গম্বুজের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। উপরে গিয়ে দেখি গম্বুজের চার দিকটা গোলপানা বটে কিন্তু মাঝখানটা ফোপরা, কেমন। একটু ভিজে ভিজে গন্ধ, আর ভিতরের দেয়াল কেটে লেখা খোঁচাখোঁচা হরফে–
“ইতি শ্রীগজার একমাত্র আশ্রয়।”
ধপাস করে লাফিয়ে পড়লাম ওর ভেতরে। দেখলাম গম্বুজের গায়ে কুলুঙ্গির মতন ছোট তাক করা আছে, বোধ হয় তারই বাইরের দিকটাতে যে খোপ আছে তাতেই জায়গার অভাবে পায়রা বাসা করে নি। তাই দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল।
মাটিতে বসে দুহাত দিয়ে কুলুঙ্গির মধ্যে থেকে মাঝারি সাইজের একটা বাক্স নামালাম। কি আর বলব! তার রঙ একটুও চটে নি, একেবারে চকচক করছে, আর ঢাকনার উপর আঁকা ড্রাগনের সবুজ চোখ জ্বলজ্বল করছে।