৫.৫ রামধনু
অনন্ত বিছানার একপাশে বসিয়া এতক্ষণ নীরবে তাহীদের কথাবার্তা শুনিতেছিল। এইবার বড় বোন নয়নতারার দৃষ্টি তাহার দিকে পড়িল। প্রত্যেকটি কথা যেন ছেলেটা গিলিয়া খাইতেছে, প্রত্যেকটা লোককে যেন নাড়ীর ভিতর পর্যন্ত দেখিয়া লইতেছে, এমনি কৌতূহল।
‘এরে তুই কই পাইলি?’
‘এ আমার পথের পাওয়া! মা বাপ নাই। সুবলার বউ রাঁড়ি মানুষ করত। পরে নি গে। বুঝে পরের মর্ম, একদিন খদাইয়া দিল। বড় মায়া লাগল আমার। লইয়া আইলাম, যদি কোনদিন কামে লাগে।’
বলে কি, পরের একটা ছেলে—মাটির পুতুল নয়, কাঠের পুতুল নয়, একটা ছেলে এমনি করিয়া পাইয়া গেল! একি দশে মানে, না তুনিয়া মানে। পেটে ধরিল না, মানুষ করিল না, পথের পাওয়া—তাই কি তার আপন হইয়া গেল? এমন করিয়া পরের ছেলে যদি আপন হইয়া যাইত তবে আর ভাবনা ছিল কি? কিন্তু হয় না। পরের ছেলে বড় বেইমান।
বনমালী ও পুরুষ দুইজন একটু আগেই অন্য ঘরে চলিয়। গিয়াছিল – কোন খালে কোন বিলে কোন সালে কত মাছ পড়িয়াছিল, তার সম্পর্কে তর্কাতর্কি তখন উচ্চগ্রামে উঠিয়াছে আর এঘর হইতে শোনা যাইতেছে। আসমানতারার বরের গল৷ সকলের উপরে। সরেস জেলে বলিয়া প্রতিবেশী দশ বারো গায়ের মালোদের মধ্যে তার নামডাক আছে। সেই গর্বে আসমানতারা বলিল, ‘আমারে দিয়া দে দিদি, আমি খাওয়াইয়া ধোঁয়াইয়া মানুষ করি; পরে একদিন বেইমান পক্ষীর মত উইড্রা যাউক, আমার কোন দুঃখ নাই।’
‘তোর ত দিন আছে ভইন। ঈশ্বর তোরে দিব—কিন্তু মামারে কোনকালে দিব না—এরে দিলে আমি নাচতে নাচতে লষ্টয়া যাই? নিঃসন্তান বুকের বেদন নয়নতার হাসিয়া হাস্ক করিল।
কেন আমি কি দোকানের গামছা না সাবান! কোন সাহসে আমাকে কিনিয়া নিতে চায় —অনন্ত এই কথা কয়টি মনে মনেই ভাবিল। প্রকাশ করিয়া বলিল না।
অনন্ত ও অন্যান্য পুরুষ মানুষদের খাওয়া হইয়া গেলে তিন বোনে এক পাতে বসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া খাইল। তারপর পাশের ঘরে তিন পুরুষের বিছানা করিয়া দিয়া, অনন্তকে এ ঘরে শোয়াইয়া, তিন বোনে পিঠা বানাইতে বসিল।
রাত অনেক হইয়াছে। প্রদীপের শিখা তিন বোনের মুখে হাতে কাপড়ে আলো দিয়াছে। পিছনের বড় বড় ছায় দেওয়ালে গিয়া পড়িয়াছে। ভাবে বোঝা গেল, তারা আজ সারারাত না ঘুমাইয়া কাটাইবে।
‘ঘুম আইলে কি করুম? ছোট বোন জিজ্ঞাসা করিল।
‘উদয়তারা শিলোকের রাজা। শিলোক দেউক, তার আমরা মানতি করি—ঘুম তা হইলে পলাইব। বলিল বড় বোন।
উদয়তারা একদল কাই হাতের তালুতে দলিতে দলিতে বলিল, ‘হিজল গাছে বিজল ধরে, সন্ধ্যা হইলে ভাইঙ্গা পড়ে —কও, এই কথার মান্তি কি?’
‘এই কথার মাস্তি হাট।‘ বলিল আসমানতারা।
‘আচ্ছা,—পানির তলে বিন্দাজী গাছ ঝিকিমিকি করে, ইলস মাছে ঠোকর দিলে ঝরঝরাইয়া পড়ে?’
বড় বোন মানে বলিয়া দিল—‘কুয়াসা।‘
এইভাবে অনেকক্ষণ চলিল। অনন্তর খুব আমোদ লাগিতেছিল, কিন্তু ঘুমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়া পারিল না। শুনিতে শুনিতে সে এক সময় ঘুমাইয়া পড়িল।
নিশুতি রাতে আপনা-থেকে ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তিন বোন তখনও অক্লাস্ত ভাবে হেঁয়ালী বলিতেছে আর হাত চালাইতেছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ মুদিয়া অনন্ত তখনও কানে শুনিতেছে —‘আদা চাক্চাক দুধের বর্ণ, এ শিলোক না ভাঙ্গাইলে বৃথা জন্ম।’
এর মাস্তি—টাকা, বলিয়া এক বোন পাল্টা তীর ছাড়ে—
ভোরের আঁধার ফিক হইবার সঙ্গে সঙ্গে অনন্তর ঘুম পাতলা হইয়া আসিল। উঠান দিয়া কে মন্দিরা বাজাইয়া গাহিয়া চলিয়াছে,—
রাই জাগো গো, আমার ধনী জাগো গো,
বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই জাগো গো।
অনন্ত উঠিয়া পড়িল। পিঠা বানাইতে বানাইতে তিন বান কখন এক সময় শুইয়া পড়িয়াছিল। অর্ধসমাপ্ত পিঠাগুলি অগোছালো পড়িয়া আছে, আর তিন বোনে জড়াজড়ি করিয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। প্রদীপটা এখনও জ্বলিতেছে, তবে উস্কাইয়া দেওয়ার লোকের অভাবে আর জ্বলিতে পারিবে না, এ স্বাক্ষর তার শিখায় স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে।
অনন্ত বাহিরে আসিল। ও-ঘরে তিনজন ঘুমাইয়াছিল, তারা নাই। শেষরাতে বনমালী জালে গিয়াছে, অতিথি &জনও সঙ্গে গিয়াছে, এখানকার মাছধরা সম্বন্ধে জানিবার বুঝিবার।
পূবের আকাশ ধীরে ধীরে খুলিতেছে। স্নিগ্ধ নীলাভ মৃদু আলো ফুটিতেছে। চারিদিকে একটানা ঝিঁঝির ডাক। গাছে গাছে পাখির কলরব। মন্দিরা বাজাইয়া লোকটা এ-পাড় হইতে ও-পাড়ায় চলিয়া গিয়াছে! তার গানের শেষ কলি মন্দিরার টুনটুনটুন আওয়াজের সঙ্গে অনন্তর কানে আসি৷ বাজে,—
শুক বলে ওগো সারী কত নিদ্রা যাও,
আপনে জাগিয়া আগে বন্ধুরে জাগাও;
আমার রাই জাগো গো, আমার ধনী জাগো গো,
বৃন্দাবন বিলাসিনী, রাই জাগো গো।
অনন্ত উঠানের পর উঠান পার হইয়া চলিল। যুবকরা সব নদীতে গিয়াছে। বাড়িতে আছে বুড়ার আর বৌ ঝি মায়ের। বুড়ার সকালে উঠিয়া তুলসীতলায় প্রণাম করিতেছে। প্রত্যেক বাড়িতে তুলসী গাছ, উঁচু একটা ছোট বেদীর উপর। দুই পাশে দুই চারিট ফুলের গাছ। মিষ্টি গন্ধ। বৌর উঠানগুলি ঝাড় দিয়াছে, এখন গোবরছড়া দিতেছে। হাঁটিতে হাঁটিতে এক উঠানে গিয়া দেখে, আর পথ নাই, মালোপাড় এখানে শেষ হইয়া গিয়াছে। এরপর গভীর খাদ, তারপর থেকে কেবল পাটের জমি। পুরুষপ্রমাণ পাটগাছ কোমবজলে দাঁড়াইয়া বাতাসে মাথা তুলাইতেছে। ক্ষেতের পর ক্ষেত, তারপর ক্ষেত, শেষে আকাশের নীলিমার সঙ্গে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে। সীমার মাঝে অসীমের এই ভোরের আলোতে ধরা দেওয়ার দৃশ্য দেখিতে দেখিতে বিস্ময়ে তাহার চক্ষু দুইটি আপনি আনত হইয়া আসিল। প্রকৃতির সঙ্গে তাহার এত নিবিড় অন্তরঙ্গতার মাধুর্য কিন্তু একজনের দৃষ্টি এড়াইল না। তুলসীতলায় প্রণাম সারিয়া সে গুনগুন করিয়া নরোত্তম দাসের প্রার্থনা গাহিতেছিল, কাছে আসিয়া তাহার মনে হইল, অসীম অনন্ত সংসার পারাবারের ও-পারে আপনা থেকে জন্মিয়াছে যে বৃন্দাজী গাছ, প্রকৃতির একটি ছোট্ট সন্তান তাহার দিকে চোখ মেলিয়া নিজের প্রণতি পাঠাইয়া দিতেছে। কাঁধে হাত দিয়া আবেগের সহিত বলিল, ‘নিতাই, ওরে আমার নিতাই, কঙালেরে ফাকি দিয়া এতদিন লুকাইয়া কোথায় ছিলি বাপ। আয় আমার কোলে আয়।‘
তার বাহুর বাঁধন দুই হাতে ঠেলিতে ঠেলিতে অনন্ত বলিল, ‘আমি অনন্ত!’
‘জানি বাবা জানি, তুই আমার অনন্ত! অনন্ত রাখিল নাম অস্ত না পাইয়া; আমি দান জানি না, ধ্যান জানি না, সাধন জানি না, ভজন জানি না;—কেবল তোমারেই জানি। ধরা যখন দিছ, আর ছাড়মু না তোমায়।’
অনন্ত বিস্ময়ে অবাক। লোকটা সহসা সম্বিং পাইয়া বলিল, ‘হরি হে, একি তোমার খেলা। বারবার মায়াজাল ছিড়িতে চাই, তুমি কেন ছি ভূতে দাও না? যশোদা তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাদছিল, শচীরাণী তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাদছিল, রাজা দশরথ তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাদতে কঁদিতে প্রাণ দিল। তবু তোমারে পুত্ররূপে পাওয়ার মধ্যে কত তৃপ্তি, কত আনন্দ। পুত্ররূপে একবার আইছিল, চইলা গেল। ধইরা রাখতে স্ত পারলাম না। আইজ আবার কেনে সেই স্মৃতি মনে জাগাইয়া তুললা। ভুলতে দাও হরি, ভুলতে দাও! যা বাবা, কার ছেলে তুই জানি না, মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরা যা। আমার অখন অনেক কাজ। গোষ্ঠের সময় হইয়া অইল, যাই বাছারে তামার গোষ্ঠে পাঠাই গিয়া।’
খেলাঘরের মত ছোট একটা মন্দির। সে ঘরে একখানা রাধাকৃষ্ণ ঠাকুর, আর সালুকাপড়ে মোড়া খানদুই পুঁথি। সেখানে গিয়া সে গান ধরিল, ‘মরি হয়েরে কিবা শোভা। রাখালগণ ডাকতে আছে ঘনঘন বৃন্দাবনে।‘
একটু পরে প্রশস্ত সূর্যালোকে পাড়াটা ঝলকিত হইয়া উঠিল। ঘরে ঘরে জাগিয়া উঠিল কর্মচাঞ্চল্য। এখানে হাটবাজার নাই। এ গাঁয়ের মালোর দূরের হাটবাজারে মাছ বেচিয়া আসে। সূতাকাটা, বাঁশের জাল বোন, ছোড়া জাল গড়া, জালে গাব দেওয়া,— কারো বাড়িতে অবসর নাই। অন্তঃপুরের মেয়েদেরও অবসর নাই। নানারকম মাছের নানারকম ভাজাভুজি ঝোলঝাল রণধিতে রাধিতে তারা গলদঘর্ম হয়। দুপুর গড়াইয়া যায়। পুরুষের সকালে পাস্তা খাইয়া কাজে মাতিয়াছিল, মায়েদের আদেশে ছেলেরা গিয়া জানায়, ভাত হইয়াছে, স্নান কর গিয়া। জলে ডুব দিয়া আসিয়া তারা খাইতে বসে। তারপর শুইয়া কতক্ষণ ঘুমায়, সন্ধ্যায় আবার জাল দড়ি কাঁধে করিয়া নৌকায় গিয়া ওঠে। বিরাম নাই।
অতিথিবৃন্দ যেমন একদিন আসিয়াছিল, তেমনি একদিন বিদায় হইয়া গেল। বনমালীর ঘর হাসি গান আমোদ আহ্লাদে থই থই করিতেছিল, নীরব হইয়া গেল।
শ্রাবণ মাস, রোজই রাতে পদ্মাপুরাণ গান হয়। বনমালী রাতের জালে আর যায় না। দিনের জালে যায়। আর রাত হইলে বাড়ি বাড়ি পদ্মাপুরাণ গান গায়। এক এক রাতে এক এক বাড়িতে আসর হয়। সুর করিয়া পড়ে সেই সাধুবাবাজী —যে-জন রোজ ভোরে মন্দিরা বাজাইয়া পাড়ায় নাম বিতরণ করে, যে জন অনন্তকে সেদিন ভোরে নিতাক্টর অবতার বলিয়া ভুল করিয়াছিল। প্রধান গায়ক বনমালী। তার গলা খুব দরাজ। হাতে থাকে করতাল। আর দুইটা লোক বাজায় খোল। গায়ক আছে অনেকে। কিন্তু বনমালীর গলা সকলের উপরে। সেজন্য সাধু সকলের আগে তাকেই বলে ‘তোল।‘
‘কি? লাচারী না দিশা?’
একখানা ছোট চৌকিতে সালু কাপড়ে বাঁধা পদ্মাপুরাণ পুঁথি। কলমী। সাধু ছাড়া এযুগের কোনো মানুষের পড়ার সাধ্য নাই। সামনে সরিষা-তেলের বাতি। সলতে উস্কাইয়া চাহিয়া দেখেন যেখান থেকে শুরু করিতে হইবে তাহা ত্রিপদী। বলিলেন, ‘লাচারী তোল।’
বনমালী ডানহাতে ডানগাল চাপিয়া, বাহাত সামনে উঁচু করিয়া মেলিয়া কাক-স্বরে ‘চিতান ধরিল,—
‘মা যে-মতি চায় সে-মতি কর, কে তোমায় দোষে,
বল মা কোথায় যাই দাঁড়াইবার স্থান নাই,
আমারে দেখিয়া সাগর শোষে মা,
আমারে দেখিয়া সাগর শোষে!’
দুই একজনে দোহার ধরিয়াছিল, যুৎসই করিতে না পারিয়া ছাড়িয়া দিল। ছাড়িল না শুধু অনন্ত। মুরট। অনুকরণ করিয়া বেশ কয়েদা করিয়াই তান ধরিয়াছিল সে। মোটা মোটা সব গলা মাঝপথে অবশ হইয়া যাওয়াতে তার সরু শিশুগল পায়ের তলায় মাটি-ছাড়া হইয়া বায়ুর সমুদ্রে কাঁপিতে কাঁপিতে ডুরিয়া গেল। তার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে চাহিয়া বাবাজী বনমালীকে বলিলেন, ‘পুরান মুর। কিন্তু বড় জমাটি। আইজকালের মানুষ শ্বাসই রাখতে পারে না, এসব সুর তাবা গাইব কি। যারা গাইত তারা দরাজ গলায় টান দিলে তিতাসের ঐ-পারের লোকের ঘুম ভাঙ্গত। কর্ণে করত মধু বরিষণ। তখন সব হালকা স্বর। হরিবংশ গান, ভাইটাল সুরের গান তখন নয়া বংশের লোকে গাইতে পারে না, গাওয়ে গাওয়ে যে দুইচার জন পুরান গাতক আখনো আছে, তারা গায়, আর গলার জোর দেইখ্যা জোয়ান মানুষ চমকায়! সোজা একটা লাচারী তোল বনমালী।’
বনমালী সহজভাবেই তুলিল—
‘সোণার বরণ দুইটি শিশু ঝলমল ঝলমল করে গো,
আমি দেইখে এলাম ভরতের বাজারে।’
বাবাজী বলিলেন, ‘না এইখানে এই লাচারী খাটে না। কাইল প্ৰহলাদের বাড়িতে লখিন্দররে সৰ্পে দংশন করছিল; অখন তারে কলার ভেলাতে তোলা হইছে, ভেলা ভাসব, যাত্রা করব উজানীনগর, আর গাঙ্গের পারে পারে ধেনুক হাতে যাত্রা করব বেহুলা। দিশা কইরা তোল।’
‘অ, ঠিক, সুমন্ত্র চইলে যায়রে, যাত্রা কালে রাম নাম।‘
‘রামায়ণের ঘুষ। তরণীসেন যুদ্ধে যাইতাছে। আচ্ছা, চলতে পারে।‘
ভেলা চলিয়াছে নদীর স্রোত ঠেলিয়া উজানের দিকে; তীরে বেহুলা, হাতে তীর ধনুক। কাক শুকুন বসিতে যায় ভেলাতে, পার হইতে বেহুলা তীর নিক্ষেপের ভঙ্গি করিলে উড়িয়া যায়। কত গ্রাম, কত নগর, কত হাওর, কত প্রান্তর, কত বন, কত জঙ্গল পার হইয়া চলিয়াছে বেহুলা, আর নদীতে চলিয়াছে লখিন্দরের ভেলা। এইখানে ত্রিপদী শেষ হইয়া দিশা শুরু।
‘এইবার চান্দসদাগরের বাড়িতে কান্নাকাটি। খেদের দিশা তোল।’
বনমালী একটু ভাবিয়া তুলিল—
‘সাত পাঁচ পুত্র যার ভাগ্যবতী মা;
আমি অতি অভাগিনী একা মাত্র নীলমণি,
মথুরার মোকামে গেলা, আর ত আইলা না।’
এই গানে অনন্তর বুক বেদনায় টন টন করিয়া উঠিল।
গানের শেষে পুঁথি বাধিতে বাধিতে বাবাজী বলিলেন : অমূল্য রতনের মত ছেলে এই অনন্ত। কৃষ্ণ তাকে বিবেক দিয়াছে, বুদ্ধি দিয়াছে, তবে ভবাণবে পাঠাইয়াছে। ইস্কুলে দিলে ভাল বিদ্যা পাইত। তোমরা যদি বাধা না দাও, চারদিকে এখন বর্ষা, জল শুখাইয়া মাঠে পথ পড়িলে তাকে আমি গোপালখালি মাইনর ইস্কুলে ভরতি করিয়া দেই। বেতন মাপ, আর আমি যখন দশকুয়ারে ভিক্ষা করি—কৃষ্ণের জীব, তাকেও কৃষ্ণে উপবাসী রাখিবে না।
কথাটি উপস্থিত মালোদের সকলেরই মনঃপুত হইল : মালোগুষ্টির মধ্যে বিদ্যামান লোক নাই, চিঠি লেখাইতে, তমলুকের খত লেখাইতে, মাছ বেপারের হিসাব লেখাষ্টতে গোপালনগরের হরিদাস সা’র পাও ধরাধরি করি, ভাল ভাল মাছ খাওয়াই। এ যদি বিদ্যামান হইতে পারে মালোগুষ্টির গৈরব।
তবে আর তাকে উদয়তারার সাথে গোকনগণ ওয়ে দিয়া কাজ নাই, এখানেই রাখ। সামনে তিন মাস পরেই মুদিন। বনমালী স্বীকৃত হইয়া বাড়ি আসিল। কিন্তু ব্যবস্থাটা উদয়তারার মনঃপূত হইল না।
কয়েক দিন আগে পাড়াতে একটা বিবাহ গিয়াছে। এখন জামাই আসিয়াছে দ্বিৰাগমনে। যুবতীরা এবং অনুকূল সম্পর্কযুক্ত বর্ষীয়সীরা মিলিয়া ঠিক করিল জামাইকে আচ্ছ। ঠকান ঠকাইতে হইবে। জামাই অনেকগুলি খারাপ কাজ করিয়াছে। প্রথমতঃ সে তাদের জন্য পান-বাতাসা, পানের মসলা এ-সব আনে নাই; দুপুরে তার স্নানের আগে মেয়েরা গাহিতে লাগিল; জামাই খাইতে জানে, নিতে জানে, দিতে জানে না, তারে তোমরা ভদ্র বইলো না। জামাই যদি ভদ্র হইত, বাতাসার হাঁড়ি আগে দিত, জামাই খাইতে জানে, নিতে জানে ইত্যাদি। কিন্তু, উহু, তাতেও কুলাইবে না। খুব করিয়া ঠকাইতে হইবে। কিন্তু কি ভাবে জব্দ করা যায় তাকে। একজন সমাধান করিল, ভয় কি জামাই-ঠকানী আছে, বনমালীর বোন জামাই-ঠকানী। সকলেষ্ট যেন সাতারে অবলম্বন পাইল, বলিল, লইয়া আয় জামাইঠকানীরে? সমাগত নারীদের অবাক করিয়া দিয়া উদয়তারা জানাইল যাইতে পারিবে না।
শ্রাবণ মাস শেষ হইয়াছে, পদ্মাপুরাণও পড়া শেষ হইল। ঘরে ঘরে মনসা পূজার আয়োজন করিয়াছে। আর করিয়াছে জালা বিয়া’র আয়োজন। বেহুলাসতী মরা লখিন্দরকে লইয়া পুরীর বাহির হইবার সময় শাশুড়ী ও জা’দিগকে কতকগুলি সিদ্ধ ধান দিয়া বলিয়াছিল, আমার স্বামী যেদিন বাঁচিয়া উঠিবে, এই ধানগুলিতে সেদিন চারা বাহির হইবে। চারা তাতে যথাকলেই বাহির হইয়াছিল। এই ইতিহাস পুরাণরচয়িতার অজানা হইলেও মালোপাড়ার মেয়েদের অজানা নাই। তারা বেহুলার এয়োস্তালির স্মারকচিহ্নরূপে মনসা পূজার দিন এক অভিনব বিবাহের আয়োজন করে। ধানের চারা বা জালা এর প্রধান উপকরণ। তাই এর নাম জালাবিয়া। এক মেয়ে বরের মত সোজা হইয়া চেকিতে দাঁড়ায়, আরেক মেয়ে কনের মত সাতবার তাকে প্রদক্ষিণ করে, দীপদানির মত একখানি পাত্রে ধানের চারাগুলি রাখিয়া বরের মুখের কাছে নিয়া প্রতিবার নিছিয়া-পুছিয়া লয়। এইভাবে জোড়ায় জোড়ায় নারীদের মধ্যে বিবাহ হইতে থাকে আর একদল নারী গীত গাহিয়া চলে।
পূজার দিন এক সমবয়সিনী ধরিল, ‘দুই বছর আগে তুই আমারে বিয়া কইরা রাখছিলি, মনে আছে? এইবছর তোরে আমি বিয়া করি কেমুন লা উদি।‘
‘ন ভইন।‘
‘তবে তুই কর আমারে।‘
‘না ভইন। আমার ভাল লাগে না।’
বিয়ের কথায় অনন্তর আমোদ জাগিল, ‘কর না বিয়া, অত যখন কয়?
‘তুই কস্? আচ্ছা তা হইলে করতে পারি।’
কি মজা। উদয়তারা নিজে মেয়ে হইয়া আরেকজন মেয়েকে বিবাহ করিতেছে! দুইজনেরই মাথায় ঘোমটা, কি মজা। কিন্তু অনন্তর কাছে তার চাইতে ও মজার জিনিস মেয়েদের গান গাওয়াটা। তারা গাহিতেছে এই মর্মের এক গান : অবিবাহিতা বালিকার মাথায় লখাই ছাতা ধরিয়াছে; কিন্তু বালিকা লখাইকে একটাও পয়স। কড়ি দিতেছে না; ওরে লখাই, তুই বালিকার মাথায় ছাত। ধরা ছাড়িয়া দে, কড়ি আমি দিব। তারপরের গান : ‘সেই দোকানে যায় গো বালা ঘট কিনিবারে।‘ সেই ঘটে মনসা পূজা হইল, কিন্তু মনসা নদী পার হইবে কেমন করিয়া। এক জেলে, নৌকা নিয়া জাল পাতিয়াছিল। মনসা তাকে ডাকিয়া বলিল, তোর না খান দে আমি পার হই, তোকে ধনে পুত্রে বড় করিয়া দিব। উদয়তারার এক ননাসের নাম ছিল মনসা। তাই মনসাপূজা বলিতে পারে না। স্বামী যেমন মান্ত, স্বামীর বড় বোনও তেমনি মান্য। সে কনে-বোটিকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘শাওনাই পূজা ত হইয়া গেল ভইন, সামনে আছে আর নাও-দোঁড়ানি। বড় ভাল লাগে এইসব পূজা-পালি হুড় ম-হড়ম নিয়া থাকতে।’
কনে-বৌ মাথার ঘোমটা ফেলিয়া দিয়া কাসেব থালায় ধানদূর্ব পঞ্চপ্রদীপ ইত্যাদি তুলিতে তুলিতে বলিল, তারপর কত পূজাই ত আছে—দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, কার্তিকপূজা, ভাইফোঁটা’—
‘কিন্তু তা ত কত পরের কথা। শাওন মাস, ভাদর মাস, তারপরে ত আইব বড় ঠাকরাইন পূজা।‘
কিন্তু দুই মাস ত মোটে—তেমন কি বেশি। ক্ষেতপাথারের জল কমিতে লাগিবে পনর দিন। তিতাসের জল কমিয়া তার পাড়ে পাড়ে পথ পড়িতে লাগিবে আরও পনর দিন। তখন বর্ষা শেষ হইয়া যাইবে। গাঙ-বিলের দিকে চাও, দেখিবে পরিষ্কার—দিনের দিকে চাও, পরিষ্কার। কিন্তু ঘর বাড়ির দিকে চাও– পরিষ্কার দেখ কি! দেখ না। পরিস্কার না করিলে পরিষ্কার দেখিবে কি করিয়া! চারিদিকে পুজা-পূজা ভাব। লাগিয়া যাও ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার কাজে! কিন্তু কি ঘরবাড়ি পরিষ্কার করিবে তুমি? ভাঙ্গা ঘরবাড়ি? না, পুরুষ আছে কোন দিনের তরে? বর্ষাকালে একটানা বৃষ্টির জলে ধা’র ভাঙ্গিয়াছে, পিড়া ভাঙ্গিয়াছে, কি খুব সুন্দর দেখাইয়াছিল না সেদিন। তিন চারি জনে ধরিয়া তাহাকে চুল আঁচড়ানো, তেল-সিন্দুর পরানো, চন্দনতিলক লাগানো প্রভৃতি প্রসাধন কর্ম করিয়াছিল। একটা কলার ডিগা সে মানুষটার গালে বুলাইয়াছিল—সে তখন ছোট বালিকা মাত্র, বুকটা তার ভয়ে তুরু হুরু করিতেছিল। চাহিতে পারিতেছিল না লোকটার চোখের দিকে, অথচ চারি দিক হইতে লোকজনে চীৎকার করিয়া কহিতেছিল, চাও, চাও, চাও, দেখ, এই সময়ে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখ—চারিজনে পি’ড়ির চারিটা কোণা ধরিয়া তাহাকে উঁচু করিয়া তুলিয়াছিল –এই সময়ে সে একটুখানি চাহিয়া দেখিয়াছিল—মাত্র একটুখানি, আর চাহিতে পারে নাই, অমনি চোখ নত করিয়াছিল। সেদিন মোটে চাওয়া যায় নাই, তার দিকে। কিন্তু আজ! কতবার চাওয়া যায়, কোন কষ্ট হয় না, কিন্তু সেইদিনের একটুখানি চাওয়ার মত তেমন আর লাগে কি; সে চাওয়ার মধ্যে যে স্বাদ ছিল, সে-স্বাদ কোথায় গেল!
ভাবিতে ভাবিতে উদয়তারা একসময় ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।
কনেবে চুল বাঁধিতে বাঁধিতে বলিল, ‘কি লা উদি, হাসলি যে?’
‘হাসি পাইল, হাসলাম। আচ্ছা, আমি ত তোর বর হইলাম, আমার মুখের দিকে চাইতে তোর লাজ লাগে নাই?’
‘শুন কথা। সত্যের বিয়ার বরেরেই লাজ করলাম না, তুই ত আমার জালা বিয়ার বর।‘
‘সত্যের বিয়ার বরেরে তোর লাজ করে নাই? ওম কেনে, লাজ করল না কেনে?’
‘সেই-কথা এক পরস্তাবের মত! বর আমার বাপের কাছে মুনী খাট্ত। মা বাপ কেউ আছিল না তার। সুতা পাকাইত আর জাল বুনত। আমার বয়স আট বছর, আর তার বার বছর। সেইন সময়ে বাপে দিল বিয়া। এক সঙ্গে খেলাইছি বেড়াইছি, মাছ ধরছি মাছ কাট্ছি, আমি নি ডরামু তারে!’
‘ও মা! সেই কথা ক।‘
‘একটা মজার কথা কই, শুন। বিয়ার কালে আমি ত ফুল ছিট্লাম তার মাথায়, সে যত ছিট্তে লাগল, কোন ফুলই আমার মাথায় পড়ল না। ডাইনে-বায়ে কাঁধে-পিঠে পড়তে লাগল, কিন্তুক মাথায় পড়ল না। কারোরে আমি ছাইড়া কথা কই না, আর সে ত আমরার বাড়িরই মানুষ —খুব রাগ হইল আমার। তেজ কইরা কইলাম, ভাল কইরা ছিট্তে পার না? মাথায় পড়ে না কেনে ফুল? ডাইনে-বায়ে পড়ে কেনে? কাজের ভাস্সি নাই, খাওনের গোঁসাই!’
‘বরেরে তুই এমুন গালি পাড়লি? তোর মুখ ত কম খরোধরো আছিল না? বর কি করল তখন?’
‘এক মুঠ ফুল রাগ কইরা আমার চোখেমুখে ছুঁইড়া মারল’—
‘খুব আস্পর্দা ত! তুই সইয়া গেলি?’
‘না।’
‘কি করলি তুই?’
‘এক ভেংচি দিলাম।’
‘তুই আমারে তেমুন কইরা একটা ভেংচি দে না!’
‘ধেৎ। তুই কি আমার সত্যের বর? তুই ত মাইয়া মানুষ!’
‘তবে আমি তোরে দেই।’
‘ধেৎ, আমরা কি আর অখন ছোট রইছি?’
কি এমুন বড় হইয়া গেছি। বারোবছর বয়সে বিয়া হইছিল, তারপর ন’বছর –মোটে ত একুশ বছর। এর মধ্যেই বড় হইয়া গেলাম?’
বড় হইয়া গেলি কি গেলি না, বুঝতি যদি কোলে দুই একটা ছাও-বাচ্ছা থাক্ত। জীবনে একটারও গু-মুত কাচাইলি না, তোর মন কাঁচা শরীল কাঁচা, তাই মনে হয় বড় হইলি না; যদি পুলাপান হইত, বয়সও মালুম হইত।
‘সেই কথা ক।’
তারপর চারিদিক আঁধার হইয়া আসিল। শাদা শাদা অজস্র সাপলা ফুলে শোভিত, সর্পাসনা মনসা মূর্তিটি অনন্তর চোখের সামনে ঝাপসা হইয়া আসিল, অন্যান্য পূজাবাড়িগুলিরও গান ধুমধাম ক্রমে অস্পষ্ট হইয়া একসময় থামিয়া গেল।
শ্রাবণ মাসের শেষ তারিখটিতে মালোদের ঘরে ঘরে এই মনসা পূজা হয়। অন্যান্য পুজার চাইতে এই পূজার খরচ কম, আনন্দ বেশি। মালোর ছেলেরা ডিঙ্গি নৌকায় চড়িয়া জলভরা বিলে লগি ঠেলিয়া আলোড়ন তোলে। সেখানে পাতাল ফুঁড়িয়া ভাসিয়া উঠে সাপের মতো লিক্লিকে সাপলা। শাদ শাদা ফুল ফুটিয়া বিল জুড়িয়া ছত্রাইয়া থাকে। যতদূর চোখ যায় কেবল ফুল আর ফুল—শাদা মাণিকের মেলা যেন। ঘাড়ে ধরিয়া টান দিলে কোন এক জায়গায় সাপলাটা ছিঁড়িয়া যায়, তারপর টানিয়া তোল—খালি টানো আর টানো, শেষ হইবে না শীঘ্র। এইভাবে তারা এক বোঝাই সাপলা তুলিয়া আনে। মাছের ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখে —মালোর ছেলের কেমন সাপলা তুলিতেছে। সাপলা তোলার ফাঁকে ফাঁকে মালোর ছেলেরাও চাহিয়া দেখে। জল শুকাইবে, বিলে বাধ পড়িবে, তখন বেঘোরে প্রাণ হারাইতে হইবে—এসব জানিয়া শুনিয়াও বোকা মাছেরা, কিসের মায়ায় যেন বিলের নিষ্কম্প জলে তিষ্ঠাইয়া আছে। তিতাসের স্রোতাল জলে নামিয়। পড়িলে, অত শীঘ্র ধরা পড়িবার ভয় থাকিবে না, ধরা যদি পড়েও, পড়িবে মালোদের জালে; সেখান থেকে লাফাইয়াও পালানো যায়। কিন্তু নমশূদ্রের বাঁধে পড়িলে হাজারবার লাফাইলেও নিস্তার নাই।
মনসার পুষ্পসজ্জা শেষ হইলে পুরোহিত আসে! মালোদের পুরোহিত ডুমুরের ফুলের মত দুর্লভ। একজন পুরোহিতকে দশবারো গাঁয়ে এক একদিনে মনসা পূজা করিয়া বেড়াইতে হয়। গলায় একখানা চাঁদর ঝুলাইয়া ও হাতে একখানা পুরোহিত দর্পণ লইয়া আসিয়া অমনি তাড়া দেয়—শীঘ্গির। তারপর বারকয়েক নম নম করিয়া এক এক বাড়ির পূজা শেষ করে, দক্ষিণা আদায় করে। এবং আধঘণ্টার মধ্যে সারা গায়ের পূজা শেষ করিয়া তেমনি ব্যস্ততার সহিত কোনো মালোকে ডাকিয়া বলে, ‘অ বিন্দাবন, তোর নাওখান্ দিয়া আমারে ভাটি-সাদকপুরে লইয়া যা।‘