প্রৌঢ়ত্ব থেকে বার্ধক্য
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৫ –পরিস্থিতি। পরিচ্ছেদ ৫
নারীর ব্যক্তিগত জীবন-ইতিহাস–কেননা সে আজো বদ্ধ তার নারীধর্মী ভূমিকায় পুরুষের থেকে অনেক বেশি মাত্রায় নির্ভর করে তার শারীরবৃত্তিক নিয়তির ওপর; এবং এ-নিয়তির বক্ররেখা অনেক বেশি বিষম, অধিকতর অধারাবাহিক পুরুষের নিয়তির বক্ররেখার থেকে। নারীর জীবনের প্রতিটি পর্ব সমরূপ ও একঘেয়ে; তবে স্তর থেকে স্তরান্তরে যাওয়ার ক্রান্তিকালগুলো বিপজ্জনকভাবে আকস্মিক; এগুলো দেখা দেয় সংকটরূপে–বয়ঃসন্ধি, কামদীক্ষা, ঋতুবন্ধ–পুরুষের মধ্যে যা ঘটে, তার থেকে এগুলো অনেক বেশি চূড়ান্তধর্মী। পুরুষ যেখানে ধীরেধীরে বৃদ্ধ হয়, সেখানে নারী হঠাৎ বঞ্চিত হয় তার নারীত্ব থেকে; সমাজের ও তার নিজের দৃষ্টিতে যা প্রতিপন্ন করে তার অস্তিত্বের যাথার্থ ও তার সুখলাভের সুযোগ, সে-কামাবেদনশীলতা ও উর্বরতা সে হারায় আপেক্ষিকভাবে তরুণ বয়সেই। ভবিষ্যত্বীন, তখনো তার সামনে বেঁচে থাকার জন্যে পড়ে থাকে তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের প্রায় অর্ধেকটা।
‘বিপজ্জনক বয়স’টা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে কিছু জৈবিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে, তবে এগুলোকে যা গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে, তা হচ্ছে এগুলোর প্রতীকী তাৎপর্য। জীবন বদল-এর সংকট অনেক কম তীব্রভাবে অনুভব করে সে-সব নারী, যারা তাদের সব কিছু বাজি ধরে নি নারীত্বের ওপর; যারা গুরুভার কাজে নিয়োজিত–ঘরে বা বাইরে তারা এ-মাসিক ভার লোপ পাওয়াকে স্বস্তির সাথে স্বাগত জানায়; কৃষক নারী, শ্রমজীবীর স্ত্রী, যারা ধারাবাহিকভাবে থাকে নতুন গর্ভধারণের ভীতির নিচে, তারা সুখবোধ করে, যখন অবশেষে তাদের আর বিপদের ঝুঁকি থাকে না।
পরিণামের অঙ্গচ্ছেদের অনেক আগে থেকেই নারীর ভেতরে হানা দিতে থাকে বুড়ো হওয়ার ভয়। প্রৌঢ় পুরুষ ব্যস্ত থাকে প্রেমের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কর্মোদ্যোগে; এ-সময়ে তার কামের ব্যগ্রতা অনেক কম থাকে যৌবনের থেকে; এবং যেহেতু তার মধ্যে থাকে না বস্তুর অক্রিয় বৈশিষ্ট্যগুলো, তাই তার মুখমণ্ডল ও শরীরের বদলে তার আকর্ষণীয়তা নষ্ট হয় না। এর বিপরীতে, সাধারণত পঁয়ত্রিশ বছরের। দিকে, অবশেষে যখন জয়করা হয়েছে সব সঙ্কোচ, তখন নারীর মধ্যে অর্জিত হয় কামের পূর্ণবিকাশ। তখনই তার কামাবেগগুলো হয় তীব্রতম এবং সে প্রবলতমভাবে কামনা করে সেগুলোর পরিতৃপ্তি। কী হবে তার, যদি তার পুরুষটির ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকে? সে উদ্বেগের সাথে নিজেকে জিজ্ঞেস করে এ-প্রশ্নটিই, যখন অসহায়ভাবে সে দেখতে থাকে অবক্ষয়গ্রস্ত হচ্ছে সে-মাংসল বস্তুটি, যার সাথে সে অভিন্ন করে তুলেছে নিজেকে। সে শুরু করে একটা যুদ্ধ। তবে কখনোই চুলের কলপ, ত্বকচর্চা, রূপাস্ত্রোপচার কিছুতেই তার মুমূর্ষ যৌবনকে প্রলম্বিত করার বেশি কিছু করতে পারে না। তবে সে অন্তত তার আয়নাটিকে ফাঁকি দিতে পারে। কিন্তু যখন প্রথম আভাস দেখা দেয়নিয়তিনির্ধারিত ও অনিবর্তনীয় সে-প্রক্রিয়ার, যা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেবে বয়ঃসন্ধির কালে নির্মিত সৌধটি, সে বোধ করে মৃত্যুর আপন করাল স্পর্শ।
কারো কারো মনে হতে পারে যে-নারী তার যৌবন ও রূপে বোধ করে অতিআকুল পরমানন্দ, সে-ই হবে সবচেয়ে বিপর্যস্ত; তবে আদৌ তা নয় : আত্মরতিবতী তার দেহ সম্পর্কে এতো ভাবিত থাকে যে তার পক্ষে তার দেহের অবধারিত অবক্ষয়ের ব্যাপারটি আগেই না-জানার এবং পিছু হটার জন্যে প্রস্তুতি না-নেয়ার কথা নয়। এটা সত্য তার অঙ্গহানিতে সে কষ্ট পাবে, তবে অন্তত সে অতর্কিতে ধরা পড়বে, এবং সে অবিলম্বেই নিজেকে মানিয়ে নেবে। যে-নারী ছিলো আত্মবিস্মৃত, একান্তভাবে নিয়োজিত, আত্মোৎসর্গকারী, সে বরং অনেক বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে এ-আকস্মিক গুপ্তকথা প্রকাশ পাওয়ায় : ‘যাপনের জন্যে আমার ছিল মাত্র একটি জীবন; ভেবো দ্যাখো কী ছিলো আমার ভাগ্য, আর এখন তাকিয়ে দ্যাখো আমার দিকে!’ বিস্ময়ে সবাই দেখতে পায় তার মধ্যে ঘটছে এক আমূল পরিবর্তন : যা ঘটেছে তা হচ্ছে, যে-বৃত্তি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলে, সেটা থেকে উৎখাত হয়ে, তার পরিকল্পনাগুলো বিপর্যস্ত হয়ে, নিরুপায়ভাবে সে হঠাৎ নিজের মুখখামুখি দেখতে পায় নিজেকে। যে-মাইলফলকে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে সে পড়ে গেছে, তার মনে হয় সেটি পেরিয়ে তার সুদিনগুলোর পর বেঁচে থাকা ছাড়া তার জন্যে করার মতো আর কিছু রইলো না; তার দেহ কোনো প্রতিশ্রুতি দেবে না; যে-সব স্বপ্ন, যে-সব আকুল আকাঙ্খ অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেগুলো চিরকাল অপূর্ণ রয়ে যাবে। এ-পরিপ্রেক্ষিতে সে বিচার করে অতীতকে; পাতার এক দিক থেকে অন্য দিকে টানতে হবে একটি রেখা, তার হিশেব মেলাতে হবে; সে মেলায় তার বইগুলো। এবং জীবন তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে যে-সংকীর্ণ সীমাবদ্ধতা, তাতে সে মর্মহত হয়।
শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পুনর্জীবিত হয়ে ওঠে, নারী ফিরে ফিরে স্মরণ করে তার যৌবনের গল্পগুলো, এবং মা-বাবা, তার ভাইবোনের জন্যে যে ভাবাবেগগুলো ঘুমিয়ে ছিলো দীর্ঘকাল ধরে, সেগুলো এখন আবার জেগে ওঠে। অনেক সময় সে নিজেকে সমর্পণ করে স্বপ্নাতুর ও অক্রিয় বিষন্নতার কাছে। তবে প্রায়ই সে হঠাৎ ব্যগ্র হয়ে ওঠে তার হারানো অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে। সে বেশ ঘটা করে প্রদর্শন করতে থাকে তার এ-ব্যক্তিত্ব, যা সে তার ভাগ্যের হীনতার সঙ্গে তুলনা করে এইমাত্র আবিষ্কার করেছে; সে ঘোষণা করে এর গুণাবলি, সে উদ্ধতভাবে সুবিচার দাবি করে। অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক হয়ে, সে বোধ করে যে অবশেষে সে যোগ্য হয়ে উঠেছে বিখ্যাত হওয়ার; সে আবার কাজে নামবে। এবং সর্বপ্রথম, সকরুণ ব্যগ্রতায় সে ফেরাতে চায় সময়ের প্রবাহ। মাতৃধর্মী নারী দাবি করবে সে এখনো সন্তানধারণে সক্ষম : সে সংরক্তভাবে চেষ্টা করে আবার জীবন সৃষ্টির। ইন্দ্রিয়াতুর নারী প্রয়াস। চালাবে আরেকটি প্রেমিককে ফাঁদে ফেলতে। ছেনাল এ-সময় আগের থেকে অনেক বেশি চেষ্টা করবে অন্যদের খুশি করার। তারা ঘোষণা করে যে এতো তারুণ্য তারা আগে আর কখনো বোধ করে নি। তারা অন্যদের বোঝাতে চেষ্টা করে যে সময়ের প্রবাহ আসলেই তাদের স্পর্শ করতে পারে নি; তারা ‘তরুণী সাজতে’ শুরু করে, তারা শিশুসুলভ হাবভাব ধরে। বার্ধক্যের দিকে অগ্রসরমাণ নারী বেশ জানে যদি সে আর কামসামগ্রি না থাকে, তা শুধু এজন্যে নয় যে পুরুষদের দেয়ার মতো তার মাংসের আর টাটকা অপরিমেয় সম্পদ নেই; বরং এজন্যেও যে তার অতীত, তার অভিজ্ঞতা তাকে, ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয়, পরিণত করেছে একটি ব্যক্তিতে; সে নিজের জন্যে সংগ্রাম করেছে, ভালোবেসেছে, ইচ্ছে পোষণ করেছে, উপভোগ করেছে। এ-স্বাধীনতা ভীতিপ্রদ; সে এটা অস্বীকার করতে চায়; সে তার নারীত্বকে অতিরঞ্জিত করে তোলে, সে নিজেকে সাজায়, সে সুগন্ধি ব্যবহার করে, সে নিজেকে করে তুলতে চায় মনোমমাহিনী, রূপসী, বিশুদ্ধ সীমাবদ্ধতা। সে পুরুষদের সাথে শিশুসুলভ আধােআধােভাবে কথা বলে এবং তাকায় সরল অনুরাগের দৃষ্টিতে, এবং সে ছোটো মেয়েটির মতো অনর্থক বকবক করতে থাকে; কথা বলার বদলে সে কিচিরমিচির করে, সে করতালি দেয়, সে হাসিতে ফেটে পড়ে। এক ধরনের আন্তরিকতার সাথেই সে অভিনয় করে এ-কমেডির। তার নতুন আগ্রহগুলো, পুরানো নিত্যনৈমিত্তকতা থেকে তার মুক্তি পাওয়ার ও নতুনভাবে শুরু করার বাসনা তাকে এমন অনুভূতি দেয় যেনো সে আবার শুরু করছে জীবন।
কিন্তু আসলে প্রকৃত শুরুর প্রশ্নই ওঠে না; বিশ্বে সে এমন কোনো লক্ষ্য দেখতে পায় না মুক্ত ও কার্যকর রীতিতে যে-দিকে সে এগোতে পারে। তার কার্যকলাপ ধারণ করে বাতিকগ্রস্ত, অসমঞ্জস, ও নিষ্ফল রূপ, কেননা সে অতীতের ভুল ও ব্যর্থতাগুলোর ক্ষতিপূরণ করতে পারে শুধু প্রতীকী উপায়ে। একদিকে, যে-বয়সের নারীর কথা আমরা বিবেচনা করছি, খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে সে পূরণ করার চেষ্টা করবে তার শৈশব ও কৈশোরের সাধগুলো : সে ফিরে যেতে পারে তার পিয়ানোর কাছে, শুরু করতে পারে ভাস্কর্য, লেখা, ভ্রমণ, সে স্কি-করা শিখতে শুরু করতে পারে বা শিখতে পারে বিদেশি ভাষা। সে এখন দু-বাহু মেলে স্বাগত জানায়–আবারও খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে–সে-সব কিছুকে, যা থেকে আগে সে বঞ্চিত করেছে নিজেকে। যে-পতিকে সে আগে সহ্য করতে পারতো, তার প্রতি এখন সে বিরক্ত এবং কামশীতল হয়ে ওঠে তার সঙ্গে; বা, এর বিপরীতে, সে প্রকাশ করতে থাকে প্রবল আবেগ, যা সে আগে বশে রাখতে এবং তার দাবিদাওয়ায় বিহ্বল করে তোলে স্বামীকে; সে শুরু করে হস্তমৈথুন, শৈশব থেকে যার চর্চা সে ছেড়ে দিয়েছে। সমকামী প্রবণতা–ছদ্মবেশী রূপে যা বিরাজ করে সব নারীর মধ্যে এখন দেখা দেয়। সে প্রায়ই এটা নিয়োগ করে তার কন্যার প্রতি; তবে অনেক সময় এ-অনভ্যস্ত আবেগ চালিত হয় কোনো বান্ধবীর প্রতি। কাম, জীবন, ও ধর্মবিশ্বাস-এ রোঁ লাদো বলেছেন। নিচের গল্পটি, যা তাকে বিশ্বাস করে বলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি :
মিসেস ক… এগোচ্ছিলেন পঞ্চাশের দিকে; পঁচিশ বছর ধরে তিনি বিবাহিত, তিনটি বড়ো সন্তান ছিলো, এবং তিনি বিশিষ্ট ছিলেন সামাজিক ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে। লন্ডনে তার দেখা হয় তার থেকে দশ বছরের ছোটো এক মহিলার সাথে, যার ছিলো একই ধরনের আগ্রহ, মিসেস খ, যিনি তাকে নিমন্ত্রণ করেন তাঁর বাড়িতে। নিমন্ত্রণের দ্বিতীয় সন্ধ্যায় মিসেস ক হঠাৎ দেখেন তিনি সংরক্তভাবে আলিঙ্গন করে আছেন তার নিমন্ত্রণকর্মীকে; তিনি তার বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং রাতটি তার সাথে যাপন করেন, তারপর আতঙ্কিত হয়ে গৃহে ফেরেন। এ-পর্যন্ত তিনি সমকাম সম্পর্কে অজ্ঞই ছিলেন, জানতেন যে এমন জিনিশ আছে। তিনি সংরক্তভাবে ভাবতে থাকেন মিসেস খ-র কথা এবং জীবনে এই প্রথম তার স্বামীর অভ্যস্ত চুম্বন ও স্পর্শাদর তার কাছে অপ্রীতিকর লাগে। ‘সব কিছু সমাধান করার জন্যে’ তিনি আবার বান্ধবীর সাথে দেখা করতে মনস্থ করেন, এবং এতে শুধু তাঁর সংরাগ বাড়তেই থাকে; এ-পর্যন্ত যা কিছু তিনি উপভোগ করেছেন তার থেকে অনেক বেশি সুখকর ছিলো তাঁদের সম্পর্ক। তিনি পাপ করেছেন, এ-ভাবনায় পীড়া বোধ করতে থাকেন এবং তার অবস্থার ‘কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’ আছে কি-না এবং নৈতিকভাবে তার যাথার্থ্য প্রতিপাদন করা যায় কি-না এটা জানার জন্যে তিনি দেখা করেন একজন চিকিৎসকের সাথে।
এ-ক্ষেত্রে বিষয়ী সাড়া দিয়েছে এক স্বতস্ফূর্ত প্রবর্তনার প্রতি এবং নিজে এতে বিপর্যস্ত হয়েছে গভীরভাবে। তবে প্রায়ই নারী স্বেচ্ছায় লাভ করতে চায় তার অজ্ঞাত সে-রোমাঞ্চকর ঘটনার বাস্তবিক অভিজ্ঞতা, শিগগিরই যা লাভের সামর্থ তার থাকবে না। সে কখনো কখনো অনুপস্থিত থাকে তার বাড়ি থেকে, কেননা তার মনে হয় বাড়িটা তার অযোগ্য এবং যেহেতু সে একলা থাকতে চায়, এবং কখনো কখনো অনুপস্থিত থাকেরোমাঞ্চকর ঘটনার খোঁজে। সে যদি তা পায়, তাহলে তাতে নিজেকে ছুঁড়ে দেয় উন্মুখতার সঙ্গে। এমন ঘটে স্টেকেলের এক রোগীর ক্ষেত্রে :
চল্লিশ বছরের এক নারী, বিশ বছর ধরে বিবাহিত ও যার আছে বড়ো সন্তান, সে বোধ করতে শুরু করে যে সে মূল্য পায় নি এবং সে তার জীবন অপচয় করেছে। সে নতুন কর্মকাণ্ড শুরু করে এবং, একদিকে, স্কি করার জন্য যায় পর্বতে। সেখানে তার পরিচয় হয় তিরিশ বছরের একটি পুরুষের সাথে এবং সে হয়ে ওঠে তার রক্ষিতা।
যে-নারী থাকে সুরুচি ও মানমর্যাদার কঠোর প্রথার প্রভাবের ভেতরে, সে সব সময় বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটানোর মতো চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় না। তবে তার স্বপ্নগুলো ভরা থাকে কামাতুর ছায়ামূর্তিতে, যেগুলোকে সে জাগ্রত অবস্থায়ও মনে মনে ভাবে; সে তার সন্তানদের প্রতি দেখায় অতি ব্যাকুল ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ স্নেহ; সে। নিজের পুত্রের প্রতি লালন করে অজাচারী আবিষ্টতা; সে গোপনে একের পর এক যুবকের প্রেমে পড়তে থাকে; কিশোরীর মতো তার মনে হানা দিতে থাকে ধর্ষিত হওয়ার ভাবনা; বেশ্যাবৃত্তি করার উন্মত্ত বাসনাও তাকে পেয়ে বসে। তার বাসনা ও ভীতির পরস্পর বিপরীত মূল্য সৃষ্টি করে এমন উদ্বেগ, যার ফলে ঘটতে পারে মনোবিকলন : তখন সে তার অদ্ভুত আচরণ দিয়ে মর্মাহত করে আত্মীয়স্বজনদের, যা আসলে তার কাল্পনিক জীবনের প্রকাশ মাত্র।
এ-বিঘ্নিত সময়ে কাল্পনিক ও বাস্তবিকের মধ্যবর্তী সীমানা অনেক বেশি অস্পষ্ট হয়ে ওঠে বয়ঃসন্ধির কালের থেকেও। বার্ধক্যের দিকে অগ্রসরমাণ নারীর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিব্যক্তিকীকরণবোধ, যা নষ্ট করে দেয় তার সমস্ত বস্তুনিষ্ঠতা। যে-সব স্বাস্থ্যবান মানুষও মৃত্যুর কাছাকাছি উপনীত হয়েছে, তারাও বলে যে তারা বোধ করেছে এক ধরনের উদ্ভট দ্বৈতানুভূতি; যখন কেউ নিজেকে বোধ করে একটি সচেতন, সক্রিয়, স্বাধীন সত্তা, তখন যে-অক্রিয় বস্তুর ওপর ক্রিয়া করতে থাকে চরম বিপর্যয়, সেটিকে মনে হয় যেনো আরেকজন; একটা গাড়ি যাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, সে আমি নই; আয়নায় দেখা যাচ্ছে যে-বুড়ীকে, সে আমি হতে পারি না! যে-নারী ‘তার জীবনে কখনো এতো তারুণ্য অনুভব করে নি’ এবং যে নিজেকে কখনো এতো বুড়ো দেখে নি, সে তার এ-দুটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে সফল হয় না; যেনো একটা স্বপ্নের মধ্যে সময়উড়ে চলে যায় এবং সময়কালটা অতর্কিতে হামলা চালায় তার ওপর। তাই বাস্তবতা পিছু হটে ও ক্ষীণ হয়ে ওঠে, এবং একই সময়ে একে আর প্রতিভাস থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করা যায়। এ-অদ্ভুত বিশ্বে যেখানে সময় বয়েচলে পেছনের দিকে, যেখানে তার ডবলকে আর তার মতো দেখায় না, যেখানে পরিণতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার সাথে, তাতে আস্থা পোষণ না করে বরং সে আস্থা পোষণ করে তাতে, যা স্পষ্ট তার আন্তর দৃষ্টির কাছে। তাই তার ঘটতে থাকে তুরীয়ানন্দবোধ, সে হতে থাকে অনুপ্রাণিত, বোধ করতে থাকে ক্ষিপ্ত উন্মত্ততা। এবং যেহেতু আগের যে-কোনো সময়ের থেকে এসময়ে তার প্রধান বিষয় হচ্ছে প্রেম, তাই তার পক্ষে স্বাভাবিক এ-প্রতিভাসকে আলিঙ্গন করা যে কেউ তাকে ভালোবাসে। দশজনের মধ্যে ন-জন কামোন্মাদই নারী, এবং এদের অধিকাংশই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স্ক।
তবে এতোটা সাহসে বাস্তবতার দেয়াল ডিঙ্গোনোর সামর্থ্য সকলের থাকে না। এমনকি স্বপ্নেও সমস্ত মানবিক প্রেমবঞ্চিত হয়ে বহু নারী সাহায্যের জন্যে নির্ভর করে বিধাতার ওপর; ঠিক ঋতুস্রাবনিবৃত্তির সময়টিতেই ছেনাল, নাগরালির নারী, চরিত্রভ্রষ্টা হয়ে ওঠে ধর্মপরায়ণ; নিয়তি সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা, রহস্য, এবং স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে যখন শুরু হয় নারীর হেমন্তকাল, তখন সে ধর্মের মধ্যে লাভ করে একটা মননগত একীভবন। ধর্মভক্ত মনে করে যে তার নষ্ট জীবনটা ছিলো তাকে নিয়ে বিধাতার এক পরীক্ষা; দুর্দশা থেকে তার আত্মা লাভ করেছে সে-সব অসাধারণ গুণ, যার ফলে সে যোগ্য হয়ে উঠেছে করুণাময় বিধাতার বিশেষ পরিদর্শন লাভের; সে অবলীলায় বিশ্বাস করে যে সে পায় স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা, বা এমনকি বিধাতা তার ওপর অর্পণ করেছে এক জরুরী দায়িত্বভার।
কম-বেশি পুরোপুরিভাবে বাস্তববোধ হারিয়ে ফেলার ফলে এ-সংকটের সময় নারী গ্রহণ করে সব ধরনের পরামর্শ, তাই কোনো স্বীকারোক্তিগ্রহণকারী এমন অবস্থানে থাকে যে সে নারীটির আত্মার ওপর ফেলতে পারে শক্তিশালী প্রভাব। উপরন্তু, প্রবল উৎসাহে সে মেনে নেবে অতিশয় প্রশ্নসাপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের; সে একটি পূর্বনির্ধারিত শিকার হয়ে ওঠে ধর্মগোত্রগুলোর, মৃত-আত্মার-বাণীপ্রাপকদের, দৈবজ্ঞদের, বিশ্বাসে ব্যাধিনিরাময়কারীদের, যে-কোনো ও প্রতিটি শার্লাটানের। এর কারণ হচ্ছে বাস্তব বিশ্বের সাথে সংস্পর্শ হারিয়ে সে শুধু বিচারবিবেচনার সব শক্তিই হারিয়ে ফেলে নি, বরং ব্যগ্র হয়ে উঠেছে একটা চূড়ান্ত সত্যের জন্য : তাকে অবশ্যই পেতে হবে একটা প্রতিষেধক, একটা সূত্র, একটা চাবি, যা হঠাৎ রক্ষা করবে তাকে যেমন রক্ষা করবে মহাবিশ্বকে। যে-যুক্তি তার বিশেষ ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে অপ্রযোজ্য, সেটিকে সে আগের থেকে অনেক বেশি ঘৃণাভরে অবজ্ঞা করে; শুধু যে-সব প্রমাণ বিশেষভাবে তারই জন্যে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো তার কাছে মনে হয় বিশ্বাসযোগ্য : তাকে ঘিরে পুষ্পিত হতে থাকে গুপ্তবাণীলাভ, অনুপ্রেরণা, বার্তা, এমনকি অলৌকিক ঘটনা। তার। আবিষ্কারগুলো অনেক সময় তাকে কর্মে প্রণোদিত করে : সে ঝাপিয়ে পড়ে ব্যবসায়, কর্মোদ্যোগ, দুঃসাহসিক কর্মে, তাকে যা করার পরামর্শ দিয়েছে কোনো উপদেশক বা তার আন্তর কণ্ঠস্বর। নিজেকে সমস্ত ধ্রুব সত্য ও প্রজ্ঞার আধার বলে গণ্য করে সে সন্তোষ বোধ করে অন্যান্য সব ব্যাপারে।
সক্রিয়ই হোক বা হোক ধ্যানমগ্ন, তার মনোভাবের মধ্যে জড়িত থাকে অতিশয় ব্যাকুল পরমানন্দ। ঋতুস্রাবনিবৃত্তির সংকট নারীর জীবনকে নিষ্ঠুরভাবে দু-টুকরো করে ফেলে; এর ফলে ঘটে যে অবসান, তাই নারীকে দেয় একটা ‘নতুন জীবন’-এর প্রতিভাস; তার সামনে উন্মুক্ত হয় আরেকটি কাল, তাই সে এর ভেতরে ঢোকে এক ধর্মান্তরিতের উদ্দীপনা নিয়ে; সে বিশ্বাস স্থাপন করে প্রেমে, পুণ্যজীবনে, শিল্পকলায়, মানবতায়; এসব জিনিশের মধ্যে সে নিজেকে লুপ্ত করে ও অতিশায়িত করে। নিজেকে। সে মরে গিয়েছিলো এবং সেখান থেকে ফিরে এসেছে, সে বিশ্বকে দেখে এমন এক দৃষ্টিতে, যা ভেদ করেছে অতিসুদূরের গুপ্তসত্য, এবং সে মনে করে যে সে স্বপ্নাতীত শীর্ষলোকে আরোহণ করতে যাচ্ছে।
কিন্তু বিশ্ব বদলায় নি; চুড়োগুলো রয়ে গেছে অগম্য; যে সব বার্তা পাওয়া গেছে। সেগুলোকে যতোই উজ্জ্বল মনে হোক–সেগুলোর পাঠোদ্ধার দুরূহ; অন্তর্গত উদ্ভাসনগুলো নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে; আয়নার সামনে দাঁরায় এমন এক নারী, সব কিছু সত্ত্বেও গতকালের থেকে যার একদিন বয়স বেড়েছে। পরমানন্দের মুহূর্তগুলোর পর দেখা দেয় বিষাদগ্রস্ততার বেদনাদায়ক প্রহরগুলো। এ-প্রাণীসত্তাটি প্রকাশ করে এতাললয়, কেননা নারী-হরমোন হ্রাসের ক্ষতিপূরণের জন্যে অতিশয় সক্রিয় হয়ে ওঠে হরমোনক্ষরক গ্রন্থিটি; তবে সর্বোপরি মনস্থাত্ত্বিক অবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করে মেজাজের এপর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন। কেননা নারীর অস্থিরতা, তার প্রতিভাসগুলো, তার উদ্দীপনা, এসব হচ্ছে যা ঘটেছে সে কর্তৃত্বশীল চরম সর্বনাশের বিরুদ্ধে নিতান্তই আত্মরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া। আবার তীব্র মনোকষ্ট জমা হয় নারীর কণ্ঠনালিতে, মৃত্যু যাকে নেয়ার আগেই যার জীবন শেষ হয়ে গেছে। হতাশা জয়ের চেষ্টার বদলে, প্রায়ই সে ধরা দেয় এর মাদকতার কাছে সে নিরন্তর প্যানর প্যানর করতে থাকে তার ভুলগুলো, খেদগুলো, কটুবাক্যগুলো; সে কল্পনা করে তার আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা তার। বিরুদ্ধে করে চলছে কুটিল ষড়যন্ত্র; যদি তার জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকে সমবয়সী কোনো বোন বা বান্ধবী, তাহলে তারা দুজনে মিলে পুঞ্জীভূত করে তোেল যন্ত্রণাভোগের ব্যানোহ। তবে বিশেষ করে সে রুগ্নভাবে তার স্বামীকে ঈর্ষা করতে শুরু করে, এবং এ-ঈর্ষা সে চালিত করে তার বন্ধুদের প্রতি, তার বোনদের প্রতি, তার ব্যবসার প্রতি; সঠিক বা ভুলভাবে সে তার দুঃখকষ্টের জন্যে দায়ী করতে থাকে কোনো একটি প্রতিদ্বন্দ্বীকে। পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্না বছর বয়সের মধ্যে অজস্র ঘটে বিকারগ্রস্ত ঈর্ষাকাতরতার ঘটনা।
যে-নারী বুড়ো হওয়া সম্পর্কে মনস্থির করে উঠতে পারে না, তার রজোনিবৃত্তির বিপদগুলো চলতে থাকে। অনেক সময় আমৃত্যু; যদি তার শারীরিক সৌন্দর্য খাটানো ছাড়া আর কোনো সম্পদ না থাকে, তাহলে সে পদে পদে লড়াই করতে থাকবে। ওগুলো বজায় রাখার জন্যে; যদি তার যৌন কামনাগুলো প্রাণবন্ত থাকে, যা আদৌ বিরল নয়, তাহলে সে যুদ্ধ করবে পাগলের মতো। কোন বয়সে নারী আর তার মাংসের জ্বালা বোধ করে না, জিজ্ঞেস করা হলে রাজকুমারী মেটারনিক উত্তর দিয়েছিলেন : ‘আমি জানি না, আমার বয়স মাত্র পঁয়ষট্টি’। বিয়ে, তেইনের মতে যা ‘টুকিটাকি জিনিশের’ বেশি কিছু নারীকে দিতে পারে না, সেটা ক্রমাগত হয়ে উঠতে থাকে এক অকার্যকর প্রতিষেধক, নারী যতোই বুড়ো হতে থাকে; তার যৌবনের সংবাধের, শীতলতার ক্ষতি তাকে প্রায়ই পূরণ করতে হয় পরিণত অবস্থায়; পরিশেষে সে যখন কামনার জ্বর বোধ করতে শুরু করে, তার অনেক আগে থেকেই তার স্বামী বিনা প্রতিবাদে সয়ে যেতে শুরু করেছে তার উদাসীনতা এবং মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। ঘনিষ্ঠতা ও কালপ্রবাহের ফলে যৌনাবেদন হারিয়ে ফেলে স্ত্রীর পক্ষে দাম্পত্য শিখা আবার জ্বালানোর আর কোনো সুযোগই থাকে না। ক্লিষ্ট, তার ‘জীবনযাপনে’ বদ্ধপরিকর, প্রেমিক ধরার ব্যাপারে–যদি একটা সুযোগ পাওয়া যায়হাস পায় তার বিবেকের অস্বস্তি; তাদের ধরতেই হবে : এটা এক পুরুষ-মৃগয়া। সে প্রয়োগ করে হাজারো ছলাকলা : নিজেকে দান করার ভান করে সে চাপিয়ে দেয় নিজেকে; বিনয়, বন্ধুত্ব, কৃতজ্ঞতাবোধকে সে পরিণত করে ফাঁদে। তারুণ্যদীপ্ত মাংসের সজীবতা ভালো লাগে বলেই শুধু সে যুবকদের আক্রমণ করে না : তাদের থেকে সে প্রত্যাশা করতে পারে শুধু সে-নিরাসক্ত প্রীতি, যা অনেক সময় কিশোর বোধ করে মাতৃতুল্য রক্ষিতার প্রতি। সে নিজে হয়ে উঠেছে আক্রমণাত্মক; এবং যুবকের সুদর্শন রূপ যতোটা সুখী করে বৃদ্ধাদের, তেমনি তাদের বশ্যতাও অনেক সময় তাদের ততোটাই সুখী করে; মাদাম দ্য স্তেল যখন ছিলেন চল্লিশোত্তর, তিনি পছন্দ করতেন অর্বাচীন যুবকদের,যারা বিহ্বল বোধ করতো তার মর্যাদায়। এবং যাই ঘটুক না কেননা, একটি ভীরু নবিশ ধরা অনেক সহজ।
প্রলোভন ও মন্ত্রণা বেশ নিষ্ফল বলে প্রমাণিত হয়, তখন একয়ে অধ্যবসায়ী নারীর বাকি থাকে একটি সম্পদ : অর্থাৎ, সেবার জন্যে টাকা দেয়া। মধ্যযুগে জনপ্রিয় কানিভেত নামের ছোটো ছুরিকার গল্পে চিত্রিত হয়েআছে এসব চির-অতৃপ্ত রাক্ষসিনীদের ভাগ্য : এক যুবতী নারী তার অনুগ্রহ বিতরণের বিনিময়ে তার প্রত্যেক প্রেমিকের কাছে থেকে নিতো একটি করে ছোটো কানিভেত, এবং ওগুলো জমাতো তার হাড়িপাতিল রাখার আলমারিতে। এমন একদিন আসে যখন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তার আলমারি; তবে তখন থেকে প্রত্যেক রাতের প্রেমের শেষে তার প্রেমিকেরা সগর্বে উপহাররূপে নিতে থাকে একটি করে ছুরিকা। শিগগিরই আলমারি খালি হয়েযায়; সব কানিভেত হস্তান্তরিত হয়ে গেছে, এবং তাই তাকে কিনতে হয় নতুন কানিভেত। কিছু নারী এ-পরিস্থিতিকে দেখে সিনিকীয় দৃষ্টিতে : একদা তাদের দিন ছিলো, এখন তাদের সময় এসেছে ‘কানিভেত দেয়ার’। বারবনিতার কাছে টাকা যেভূমিকা পালন করে, এ-নারীদের চোখে টাকা পালন করে তার বিপরীত ভূমিকা, তবে এ-ভূমিকাও সমান পবিত্রকর : এটা পুরুষটিকে রূপান্তরিত করে হাতিয়ারে এবং নারীটিকে দেয় সে-কামস্বাধীনতা, যা সে যৌবনের গরিমায় একদা প্রত্যাখ্যান করেছে।
যেদিন থেকে নারী বৃদ্ধ হতে সম্মত হয়, তখন বদলে যায় তার পরিস্থিতি। এসময় পর্যন্তও সে ছিলো এক তরুণী, যে সংগ্রামে একাগ্র ছিলো সে-দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে, যা তাকে বিকৃত ও কদাকার করে তুলছিলোবিস্ময়করভাবে; এখন সে হয়ে উঠেছে এক ভিন্ন সত্তা, অলৈঙ্গিক তবে সম্পূর্ণ : বৃদ্ধ নারী। মনে করা যেতে পারে তার ‘বিপজ্জনক বয়স’-এর সংকট কেটে গেছে। তবে এটা মনে করা ঠিক হবে না যে এর পর থেকে তার জীবন হবে সহজ। যখন সে সময়ের বিপর্যয়কতার বিরুদ্ধে সগ্রাম ত্যাগ করে, তখন শুরু হয় আরেক লড়াই : তাকে একটি জায়গা রাখতে হবে পৃথিবীতে।
জীবনের হেমন্ত ও শীতকালে নারী মুক্তি পায় তার শৃঙ্খল থেকে; তার ওপর চেপে থাকা বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে সে সুযোগ নেয় তার বয়সের; তার স্বামীকে সে এখন জানে ভালোভাবেই, তার থেকে আর ভয় নেই, সে এড়িয়ে যায় স্বামীর আলিঙ্গন, স্বামীর পাশে সে গুছিয়ে তোলে তার নিজের জীবন–বন্ধুত্ব, ঔদাসীন্য, বা বৈরিতার মধ্যে। যদি তার থেকে তার স্বামীর শরীরক্ষয় দ্রুত হতে থাকে, তাহলে সে নেয় তাদের যৌথ কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব। সে ফ্যাশন করা এবং ‘লোকে কী বলবে’টাকেও অস্বীকার করতে পারে; সে মুক্ত সামাজিক দায়ভার, স্বল্পাহার ও রূপচর্চা থেকে। তার সন্তানদের কথা বলতে গেলে, তারা এতোটা বড়ো হয়েছে যে তাকে ছাড়াই চলতে পারে, তারা বিয়ে করছে, বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সে অবশেষে মুক্তি পায়। দুর্ভাগ্যবশত, প্রতিটি নারীর গল্পে ফিরে আসে সে-ঘটনা, যার সত্যতা আমরা দেখতে পেয়েছি নারীর ইতিহাসব্যাপী। সে তখনই পায় এ-স্বাধীনতা যখন এটা তার কোনো কাজে লাগে না। এ পৌনপুনিকতা কোনোমতেই আকস্মিকতাবশত নয় : পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর সমস্ত কাজকে দিয়েছে সেবামূলক কাজের বৈশিষ্ট্য, এবং নারী তখনই মুক্ত হয় ক্রীতদাসত্ব থেকে, যখন সে হারিয়ে ফেলে সমস্ত কার্যকারিতা। পঞ্চাশের কাছাকাছি সে থাকে তার সমস্ত শক্তিসম্পন্ন; সে বোধ করে যে সে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ; অর্থাৎ যে-বয়সে পুরুষ অর্জন করে উচ্চতম অবস্থান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ; নারীর কথা বলতে গেলে, তখন তাকে দেয়া হয় অবসর। তাকে শেখানো হয়েছে শুধু নিজেকে কারো প্রতি নিয়োজিত রাখতে, এবং এখন আর কেউ তার আত্মনিয়োজন চায় না। অপ্রয়োজনীয়, অযথার্থ, সে তাকিয়ে থাকে সে-দীর্ঘ, সম্ভাবনাহীন বছরগুলোর দিকে, যে-সময়টা তাকে বেঁচে থাকতে হবে, এবং সে বিড়বিড় করতে থাকে : ‘আমাকে কারো দরকার নেই!’
সে সঙ্গে সঙ্গে বিনা প্রতিবাদে এসব ব্যাপার মেনে নেয় না। অনেক সময় নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে সে আঁকড়ে ধরে স্বামীকে; আগের থেকে অনেক বেশি কর্তৃত্বের সাথে সেবাযত্নে স্বামীর শ্বাসরোধ করে তোলে; তবে বিবাহিত জীবনের নিত্যনৈমিত্তিকতা সুপ্রতিষ্ঠিত; হয়তো সে জানে যে অনেক আগেই সে স্বামীর কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে, বা স্বামীকে তার উদ্যোগগুলোর যোগ্য মনে হয় না। তাদের একত্রজীবন রক্ষা করে চলা একলা বুড়ো হওয়ার মতোই এক নৈমিত্তিক কঠিন কাজ। আশাপ্রদভাবে সে যা করতে পারে, তা হচ্ছে সে মনোযোগ দিতে পারে সন্তানদের প্রতি; তাদের ছাঁচ এখনো ঢালাই হয় নি; এখনো তাদের সামনে খোলা আছে বিশ্ব, ভবিষ্যৎ; সে সানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের পেছনে। যে-নারী আকস্মিকভাবে বেশ দেরিতে সন্তান প্রসব করেছে, তার আছে একটি বিশেষ সুবিধা : সে তখনো এক তরুণী মা যখন অন্য নারীরা দাদী-নানী। নারী তার জীবনের চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে সাধারণত দেখতে পায় যে তার সন্তানেরা হয়ে উঠছে প্রাপ্তবয়স্ক। ঠিক যখন সন্তানেরা মুক্ত হয়ে যেতে থাকে তার থেকে, তখন সে সংরক্তভাবে উদ্যোগ নেয় সন্তানদের মধ্যে বেঁচে থাকার।
তার পরিত্রাণের জন্যে সে নির্ভর করতে চায় পুত্র না কন্যার ওপর, সে-অনুসারে তার মনোভাব হয়ে থাকে বিভিন্ন; সাধারণত সে তার সবচেয়ে সযত্নলালিত আশাগুলো স্থাপন করে আগেরটির ওপর। তার অতীতের অতলতা থেকে অবশেষে পুত্রের মধ্যে দেখা সে-পুরুষটি, যার মহিমান্বিত আবির্ভাব দেখার জন্যে সে একদা তাকিয়ে। থেকেছে দূরদিগন্তের দিকে; নবজাত পুত্রের প্রথম কান্না থেকেই সে অপেক্ষা করে আছে সে-দিনের জন্যে, যে-দিন পুত্র তার ওপর বর্ষণ করবে সমস্ত ধনরত্ন, যা পুত্রটির পিতা তার ওপর বর্ষণ করতে পারে নি। এর মাঝে সে পুত্রকে চড়থাপ্পড় মেরেছে ও শোধন করেছে, তবে এসব ভুলে গেছে; এই যে পুরুষটি, যাকে সে বহন করেছে তার হৃদয়তলে, সে এরই মাঝে হয়ে উঠেছে সেই নরদেবতাদের একজন, যারা শাসন করে বিশ্ব এবং নিয়ন্ত্রণ করে নারীর নিয়তি; এখন সে তাকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে মাতৃত্বের পরিপূর্ণ মহিমায়। পুত্রটি তাকে রক্ষা করবে তার স্বামীর আধিপত্য থেকে, তার যে-সব প্রেমিক ছিলো ও ছিলো না, তাদের ওপর চরিতার্থ করবে প্রতিশোধ; সে হবে তার। মুক্তিদাতা, তার ত্রাতা। পুত্রের সঙ্গে সে পুনঃরায় শুরু করে সেই তরুণীর প্রলুব্ধকর ও আঁকালো আচরণ, যে তার চোখ মেলে রেখেছিলো মনোহর রাজকুমারের জন্যে; যখন সে হাঁটে পুত্রের পাশে, মার্জিত, এখনো আকর্ষণীয়, তার মনে হয় তাকে দেখাচ্ছে। পুত্রের বড়ো বোনের মতো; সে পুলক বোধ করে, যদি তার পুত্র–নিজেকে মার্কিন ছায়াছবির নায়কদের আদলে গড়ে তুলে- তার সাথে ঠাট্টামশকরা করে ও রসিকতা করে তাকে জ্বালায়, সহাস্যে ও সম্মানের সাথে। সগর্ব বিনম্রতায় সে মেনে নেয় এপুরুষটির, যে একদা ছিল তার শিশু, তার পৌরুষের শ্রেষ্ঠত্ব।
এ-হৃদয়ানুভূতিগুলোকে কতোটা অজাচারী বলে গণ্য করা যায়? সন্দেহ নেই যখন সে আত্মতৃপ্তির সাথে নিজেকে কল্পনা করে পুত্রের বাহুবন্ধনে, তখন বড়ো বোন নামটি হয়ে ওঠে দ্ব্যর্থবোধক কল্পনার একটা সংযত বর্ম; সে যখন নিদ্রিত, সে যখন অসতর্ক, সে যখন স্বপ্নপ্রয়াণে, অনেক সময় সে অত্যাধিক্যই করে; তবে আমি ইতিমধ্যেই। বলেছি যে স্বপ্ন ও উদ্ভট কল্পনাগুলো কোনোক্রমেই কোনো বাস্তবিক কর্মের সংগোপন বাসনার অবিকার্য প্রকাশ নয়। অনেক সময় ওগুলো নিজে নিজেই সম্পূর্ণ, ওগুলো এমন বাসনার পরিতৃপ্তি, যা কাল্পনিক তৃপ্তির বেশি কিছু দাবি করে না। যখন কোনো মা কম-বেশি ছদ্মবেশি রীতিতে পুত্রের মধ্যে প্রেমিককে দেখতে পাওয়ার খেলা খেলে, তখন তা নিতান্তই খেলা। কাম শব্দটি সত্যিকার অর্থে যা বোঝায়, এ-সম্পর্কের মধ্যে তার বিশেষ কোনো স্থান নেই।
তবে এ-দুজন গঠন করে একটি যুগল; মা তার নারীত্বের গভীরতা থেকে সম্ভাষণ জানায় তার পুত্রের মধ্যে নিহিত সার্বভৌম পুরুষকে; প্রণয়িনী নারীর সমস্ত ঐকান্তিকতা নিয়ে সে নিজেকে তুলে দেয় পুত্রের হাতে, এবং, এ-উপহারের বিনিময়ে, সে প্রত্যাশা করে সে একটি আসন পাবে বিধাতার ডান পাশে। এই সশরীরে স্বর্গে প্রবেশের জন্যে প্রণয়িনী নারী আবেদন জানায় তার প্রেমিকের স্বাধীন ক্রিয়ার কাছে; সে অকুতোভয়ে একটি ঝুঁকি নেয়, এবং তার পুরস্কার নিহিত থাকে প্রেমিকের ব্যগ্র দাবিদাওয়ার মধ্যে। অন্য দিকে, মা বোধ করে যে শুধু জন্মদানের মাধ্যমেই সে অর্জন করেছে অলঙ্ঘ্য অধিকার; পুত্রকে তার জীব হিশেবে, তার সম্পত্তি হিশেবে গণ্য করার জন্যে তার প্রতি পুত্রের ঋণ স্বীকারের জন্যে সে অপেক্ষা করে না। প্রণয়িনী নারীর থেকে তার দাবিদাওয়া কম, কেননা তার মধ্যে প্রশান্ত আন্তরিকতাহীনতা বেশি; অর্থাৎ, তার আত্ম-অধিকারত্যাগ অনেক কম উদ্বেগগ্রস্ত; একটি রক্তমাংসের সত্তা তৈরি করে সে নিজের বলে দখল করে একটি অস্তিত্বের মালিকানা : সে আত্মসাৎ করে এর কাজ, এর কর্ম, এর উত্তৰ্ষ। তার পেটের ফলটিকে উন্নীত করে সে নিজেকে উন্নীত করে আকাশমণ্ডলে।
প্রতিনিধিত্ব করে জীবনধারণ সব সময়ই একটা আশঙ্কাজনক কৌশল। যেমন আশা করা হয়েছিলো, সব কিছু তেমন নাও ঘটতে পারে। অধিকাংশ সময়ই পুত্রটি হয় অপদার্থ, একটা গুণ্ডা, একটা ব্যর্থ মানুষ, একটা গবা, একটা অকৃতজ্ঞ। পুত্রটি হবে কোন বীরের প্রতিমূর্তি, সে-সম্পর্কে মায়ের নিজস্ব ধারণা আছে। যে-মা তার শিশুর মধ্যে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা পোষণ করে মানুষের প্রতি, যে এমনকি পুত্রের ব্যর্থতার মধ্যেও মেনে নেয় তার স্বাধীনতা, যে পুত্রের সঙ্গে মেনে নেয় সাফল্য অর্জনের সমস্ত বাধাবিপত্তিও, তার থেকে আর কিছুই বেশি দুর্লভ নয়। আমরা খুবই মুখখামুখি হই সে-সব মায়ের, যারা সমকক্ষ হতে বা এমনকি ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে সেই অতিপ্রশংসিত স্পাটানকে যে সানন্দে নিজের পুত্রকে সমর্পণ করতো জয় অথবা মৃত্যুর কাছে; মনে হতো যেনো পৃথিবীতে পুত্রের কাজ হচ্ছে এসব অর্জন করে তার মার অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রতিপাদন করা, তাদের উভয়ের লাভের জন্যে, মার কাছে যা মূল্যবান বলে মনে হয়। মা চায় শিশু-দেবতাটির কর্মোদ্যোগগুলো হবে তার নিজের ভাবাদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এতে তার সাফল্য হবে সুনিশ্চিত। প্রতিটি নারীই জন্ম দিতে চায় একটি বীর, একটি প্রতিভা; তবে সব প্রকৃত বীর ও প্রতিভাদের মারাই প্রথমে অভিযোগ করেছে যে তাদের পুত্ররা তাদের মনে খুবই কষ্ট দিয়েছে। সতা হচ্ছে যে পুরুষ অধিকাংশ সময় তার মার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই জয় করে সে-সব ট্রোফি, তার মা যা পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে ব্যক্তিগত আভরণরূপে এবং যখন তার পুত্র সেগুলো রাখে তার পদতলে সেগুলোকে সে চিনতেও পারে না। নীতিগতভাবে যদিও সে তার পুত্রের উদ্যোগগুলো অনুমোদন করে, তবুও সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এমন এক বিরোধিতায়, যা প্রণয়িনী নারীর বিরোধিতার প্রতিসম, যা পীড়ন করে প্রণয়িনী নারীকে। নিজের এবং তার মায়ের জীবনের যাথার্থ্য প্রতিপাদনের জন্যে তাকে এগোতে হয় সামনের দিকে, তার জীবনের সীমাতিক্রমণ করতে হয় কোনো উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিকে; এবং সেটা অর্জনের জন্যে বিপদের মুখোমুখি তাকে ঝুঁকি নিয়ে হয় তার স্বাস্থ্যের। কিন্তু যখন সে নিতান্ত জীবনধারণ করা থেকে গুরুত্ব দেয় কিছু লক্ষ্যের ওপর, তখন সে তার মার উপহারের মূল্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে ধরে। মা এতে আহত হয়; পুরুষের ওপর শুধু তখনই সে সার্বভৌম, যখন তার জন্ম দেয়া এ-মাংস পুত্রের জন্যে হয় পরম শুভ। তা ধ্বংস করার কোনোঅধিকার নেই পুত্রের, যা সে উৎপাদন করেছে প্রসববেদনার মধ্য দিয়ে। ‘তুমি নিজেকে ক্ষয় করে ফেলছো, তুমি অসুখে পড়বে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে,’ সে ক্রমাগত পুত্রের কানে ঢোকাতে চেষ্টা করে।
অবশ্য সে ভালোভাবেই জানে যে শুধু বেঁচে থাকাই যথেষ্ট নয়, তাহলে প্রজনন ব্যাপারটিই হতো অনর্থক। তার সন্তান নিষ্কর্মা, ক্লীব, হলে সে-ই প্রথম আপত্তি জানায়। তার মন স্থির থাকে না। যখন পুত্র যুদ্ধে যায়, সে চায় যে তার ছেলে জীবিত ফিরে আসবে। তবে পদকপচিত হয়ে। সে চায় পুত্র সফল হবে কর্মজীবনে, তবে ভয় পায় যদি ছেলে বেশি কাজ করে। ছেলে যা-ই করে, মা সব সময়ই উদ্বিগ্ন থাকে, সে অসহায়ভাবে তাকিয়েথাকে একটি কর্মজীবনের দিকে, যা তার পুত্রের, যে-কাজের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে ভয় পায় পুত্র হয়তো পথভ্রষ্ট হবে, হয়তো বিফল হবে, হয়তো সফল হওয়ার চেষ্টায় তার দেহ ক্ষয় করে ফেলবে। যদি পুত্রের ওপর তার আস্থাও থাকে, তাহলেও বয়স ও লিঙ্গের ভিন্নতা বাধা দেয় মা ও ছেলের মধ্যে কোনো প্রকৃত সহযোগিতা সৃষ্টিতে; পুত্রের কাজের বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই; তার কাছে কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয় না।
এটাই ব্যাখ্যা করে কেননা মা থাকে অসন্তুষ্ট, এমনকি পুত্রকে নিয়ে সে অপরিমিত গর্ব বোধ করলেও। সে শুধু একটি জীবন্ত দেহই জন্ম দেয়নি, সে একটি অতিশয় জরুরি অস্তিত্বকেও প্রতিষ্ঠিত করেছে, একথা বিশ্বাস করে সে যখন অতীত ঘটনাবলির প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তখন সে নিজেকে ন্যায্য বলে মনে করে; তবে তার ন্যায্যতা। প্রতিপাদন কোনো বৃত্তি নয় : তার দিনগুলোকে কাজে ভরে রাখার জন্যে সে দরকার বোধ করে তার বদান্যতাপূর্ণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার; সে বোধ করতে চায় যে তার দেবতার জন্যে সে অপরিহার্য; ভক্তকে যে-ধোঁকা দেয়া হয় এ-ক্ষেত্রে তা উন্মােচিত হয় নিষ্ঠুরতম রীতিতে : পুত্রের স্ত্রী তাকে বঞ্চিত করতে যাচ্ছে তার কাজগুলো থেকে। যে-অপরিচিত নারী তার শিশুকে ‘কেড়ে নিচ্ছে’ তার থেকে, তার প্রতি সে যে-শত্রুতা বোধ করে, তা প্রায়ই বর্ণিত হয়েছে। মা গুণ্ডাটিকে উন্নীত করেছে এক স্বর্গীয় রহস্যের উচ্চতায়, এবং সে এটা মেনে নিতে রাজি নয় যে একটা মানবিক সিদ্ধান্তের থাকতে পারে বেশি গুরুত্ব। তার চোখে মূল্যবোধগুলো ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেগুলো উদ্ভূত হয় প্রকৃতিতে, অতীতকালে : সে ভুল বোঝে স্বাধীনভাবে গৃহীত একটি বাধ্যবাধকতার বিশেষ মূল্যকে। তার পুত্র জীবনের জন্যে তার কাছে ঋণী; গতকালও যে-নারী পুত্রের কাছে ছিলো অচেনা, পুত্র কী ধার ধারে তার কাছে?
প্রাপ্তবয়স্ক কন্যার প্রতি মায়ের মনোভাব অতিশয় পরস্পরবিপরীত মূল্যসম্পন্ন : পুত্রের মধ্যে সে দেখতে চায় একটি দেবতা; তার কন্যার মধ্যে সে পায় একটি ডবল। ডবল একটি সন্দেহজনক সম্রান্ত ব্যক্তি, যে হত্যা করে তার আসলটিকে, যেমন আমরা দেখতে পাই, উদাহরণস্বরূপ, পোর কাহিনীগুলোতে এবং ওয়াইল্ডের দি পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রেতে। তাই নারী হতে গিয়ে কন্যা মৃত্যুদণ্ডিত করে তার মাকে; এবং তবুও সে তাকে বেঁচে থাকতে দেয়। সে ধ্বংসের আভাস দেখতে পায়, না-কি কন্যার বিকাশের মধ্যে দেখে পুনরুজ্জীবন, সে-অনুসারে মায়ের আচরণ হয় বহুবিচিত্র।
বহু মা কঠোর হয় শত্রুতায়; সে মেনে নেয় না সে-অকৃতজ্ঞের দ্বারা অপসারিত হওয়া, যে তার জীবনের জন্যে ঋণী তার কাছে। সজীব কিশোরী মেয়ে, যে উদঘাটিত করে দেয় ছেনালের ছলচাতুরি, তার প্রতি ছেনালের ঈর্ষার ব্যাপারটি প্রায়ই পরিলক্ষ করা হয়েছে : প্রত্যেক নারীর মধ্যেই যে দেখতে পেয়েছে একটি করে ঘৃণ্য প্রতিদ্বন্দ্বী, সে তা-ই আবার দেখতে পাবে এমনকি নিজের কন্যার মধ্যে; সে মেয়েকে দূরে। পাঠিয়ে দেয় বা চোখের আড়ালে রাখে, বা সে তাকে সামাজিক সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত করার ফন্দি খোঁজে। সে নিজে দৃষ্টান্তমূলক ও অনন্য ধরনে স্ত্রী হয়ে, মা হয়ে বোধ করেছে গর্ব, তবু সে নিজের সিংহাসনচ্যুতির বিরুদ্ধে চালায় প্রচণ্ড যুদ্ধ। সে বলতে থাকে যে তার মেয়ে নিতান্তই শিশু, তার উদ্যোগগুলোকে সে মনে করে বাল্যকালের খেলা; বিয়ের জন্যে সে খুবই ছোটো, প্রজননের জন্যে অতিশয় সুকুমার। যদি মেয়ে স্বামী, গৃহ, সন্তান লাভের জন্যে চাপ দিতে থাকে, এগুলোকে মায়ের কাছে। ভানের থেকে বেশি কিছু বলে মনে হয় না। মা কখনোই মেয়েকে সমালোচনা করতে, অবজ্ঞা করতে, তার বিপদ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে ক্লান্ত হয় না। যদি এটা করতে তাকে অনুমতিও দেয়া হয়, তবুও সে তার মেয়েকে দণ্ডিত করে শাশ্বত শৈশবে : যদি তা না পারে, তাহলে অন্যজন যে-প্রাপ্তবয়স্ক জীবন সাহসের সঙ্গে দাবি করছে, সে চেষ্টা করে তা ধ্বংস করে দিতে। আমরা দেখেছি যে এ-কাজে সে প্রায়ই সফল হয় : এ-অশুভ প্রভাবের ফলে বহু তরুণী নারী থাকে বন্ধ্যা, তাদের ঘটে গর্ভপাত, সন্তান লালনপালনে বা নিজেদের সংসারের দায়িত্ব নিতে তারা ব্যর্থ হয়। দাম্পত্য জীবনকে করে তোলা হয় অসম্ভব। অসুখী, একলা, সে আশ্রয় খোঁজে তার মার সার্বভৌম বাহুতে। যদি সে প্রতিরোধ করে, তাহলে তারা মুখোমুখি হয় নিরন্তর বৈরিতায়; তার কন্যার ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বাধীনতা হতাশাগ্রস্ত মার মনে জাগিয়ে তোলে যে-ক্ষোভ, তার অধিকাংশ সে স্থানান্তরিত করে পুত্রবধুর ওপর।
যে-মা নিজেকে সংরক্তভাবে অভিন্ন করে তোলে নিজের কন্যার সাথে, সেও কম স্বৈরাচারী নয়; সে যা চায় তা হচ্ছে তার পরিপক্ক অভিজ্ঞতার সুবিধা নিয়ে তার। যৌবনকে আবার যাপন করতে, এভাবে নিজেকে এর থেকে বাঁচিয়ে তার অতীতকে উদ্ধার করতে। সে যে-ধরনের স্বামীর স্বপ্ন দেখেছিলো, কিন্তু কখনো পায় নি, তার সাথে খাপ খাইয়ে সে নিজে পছন্দ করবে একটি জামাতা; ছেনালিপূর্ণ, স্নেহপরায়ণ, সে সহজেই কল্পনা করবে যে জামাতা তার নিজের অন্তরের গোপন কোণে বিয়ে করছে তাকেই; কন্যার মাধ্যমে সে পূরণ করবে ধন, সাফল্য, ও খ্যাতির জন্যে তার পুরোনো কামনাগুলো। প্রায়ই চিত্রিত হয়েছে এসব নারী, যারা ব্যাকুলভাবে তাদের কন্যাদের ঠেলে দেয় নাগরালির পথে, চলচ্চিত্রে, বা নাট্যমঞ্চে; কন্যাদের পাহারা দেয়ার অজুহাতে তারা অধিকার করে নেয় কন্যাদের জীবন। আমাকে এমন। কয়েকজনের কথা বলা হয়েছে, যারা এতো দূর পর্যন্ত যায় যে তারা তাদের তরুণী কন্যাদের পাণিপ্রার্থীদের নেয় নিজেদের বিছানায়। কিন্তু কন্যার পক্ষে এ-অভিভাবকত্ব দীর্ঘকাল সহ্য করা সম্ভব হয় না; যখন সে একটি স্বামী বা একটি দায়িত্বশীল রক্ষক পেয়ে যায়, তখন সে বিদ্রোহ করে। যে-শাশুড়ি শুরু করেছিলো জামাতাকে হৃদয়ে ধারণ করে সে তখন হয়ে ওঠে বৈরী; সে মানুষের অকৃতজ্ঞতায় গোঙাতে থাকে, নিজেকে দাবি করতে থাকে শহিদ বলে; সে হয়ে ওঠে একটি বৈরী মা।
এসব আশাভঙ্গের কথা আগেই বুঝতে পেরে অনেক নারী যখন দেখে যে তাদের কন্যারা বড়ো হচ্ছে, তখন তারা গ্রহণ করে উদাসীন মনোভাব; তবে এমন করলেও এতে তারা বিশেষ সুখ পায় না। সন্তানদের জীবনের মানোন্নয়নের জন্যে মার জন্যে দরকার পড়ে বদান্যতা ও নিরাসক্তির এক দুর্লভ সমন্বয়, যাতে সে সন্তানদের কাছে স্বৈরাচারী না হয়ে ওঠে বা সন্তানদের না করে তোলে তার যন্ত্রণাদানকারী।
এমন ঘটতে পারে যে নারীটির কোনো উত্তরাধিকারী নেই বা বংশধর লাভের জন্যে তার আগ্রহ নেই; সন্তান ও সন্ততির সাথে স্বাভাবিক বন্ধনের অভাবে সে কখনো কখনো চেষ্টা করে এর সমতুল্য কৃত্রিম সম্পর্ক সৃষ্টির। সে অল্পবয়স্কদের প্রতি দেখাতে থাকে মাতৃস্নেহ; তার প্রেম প্লাতোয়ী হোক বা না হোক, যখন সে বলে যে সে কোনো একটি অনুগ্রহভাজনকে ‘পুত্রের মতো ভালোবাসে’, তখন সে পুরোপুরি কপটতাপূর্ণ নয় : মায়ের আবেগ, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে, কম বা বেশি কামনাতুর। এবং প্রায়ই মাতুধর্মী নারীরা মেয়ে দত্তক নেয়। এখানে আবার সম্পর্কগুলো মে-রূপ ধারণ করে, তা কম-বেশি স্পষ্টভাবে যৌন; প্লাতোয়ীভাবেই হোক আর শাঁরীরিকভাবেই হোক, অনুগ্রহভাজনের মধ্যে চাওয়া হয় একটি ডবল, অলৌকিকভাবে নবযৌবনপ্রাপ্ত।
অভিনেত্রী, নর্তকী, গায়িকা হয়ে ওঠে শিক্ষক : তারা ঢালাই করে শিক্ষার্থীদের; বুদ্ধিজীবী–তাঁর কলোম্বীয় নির্জনাবাসে মাদাম দ্য শাবিয়েরের মতো–ভাবাদর্শে। দীক্ষিত করেন তাঁর শিষ্যদের; ধর্মভক্ত চারদিকে জড়োকরে আধ্যাত্মিক কন্যাদের; নাগরালির নারী হয়ে ওঠে মাসি। তাদের ধর্মান্তরিতকরণের প্রতি তারা ব্যাকুল আগ্রহ সৃষ্টি করলেও তা কখনোই উদ্যোগগ্রহণের প্রতি আকর্ষণবশত ঘটে না; সংরক্তভাবে তারা যা চায়, তা হচ্ছে তাদের আশ্রিতাদের পুনর্জন্ম। তাদের স্বৈরাচারী বদান্যতা সৃষ্টি করে প্রায় একই বিরোধ, যা দেখা দেয় রক্তের বন্ধনে জড়িত মা ও মেয়েদের মধ্যে পৌত্রপৌত্রী দত্তক নেয়াও সম্ভব; এবং চাচাতো দাদীরাও নির্দ্বিধায় পালন করে পিতামহীর মতো ভূমিকা। তা যা-ই হোক, নারীর পক্ষে তার স্বাভাবিক ও দত্তক উত্তরাধিকারীর মধ্যে তার ক্ষীয়মান বছরগুলোর যাথার্থপ্রতিপাদন লাভ দুর্লভ : সে এই তরুণ অস্তিত্বদের সত্যিকারভাবে নিজের জীবনে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়।
এখানে আমরা মুখোমুখি হই বৃদ্ধ নারীর করুণ ট্র্যাজেডির : সে বুঝতে পারে যে সে অপ্রয়োজনীয়; সারাজীবন ভরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীকে প্রায়ই সমাধান করতে হয়েছে সে কীভাবে সময় কাটাবে এ-হাস্যকর সমস্যাটি। তবে যখন সন্তানেরা বড়ো হয়ে গেছে, স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ বা অন্তত স্থির হয়ে বসেছে, তখনো তাকে কোনো উপায়ে সময় কাটাতে হবে। সূচের কারুকর্ম উদ্ভাবিত হয়েছিলো তাদের ভয়ঙ্কর আলস্যকে ঢাকা দেয়ার জন্যেই; হাত নকশি করে, হাত বোনে; হাত সচল। এটা কোনো প্রকৃত কাজ নয়, কেননা উৎপাদিত পণ্যটি লক্ষ্যবস্তু নয়; এর গুরুত্ব তুচ্ছ, এবং এটা দিয়ে কী করা হবে, সেটাই অনেক সময় সমস্যা–এটা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে, হয়তো, কোনো বন্ধুকে বা কোনো দাতব্য সংস্থায় দান করে, বা ম্যান্টলপিস বা মধ্যবর্তী টেবিলের ওপর গাদাগাদি করে রেখে। এটা আর খেলা নয় যে এর অপ্রয়োজনীয়তাই প্রকাশ করবে জীবনধারণের বিশুদ্ধ আনন্দ; এটা আদৌ পলায়নও নয়, কেননা মনটা থাকে শূন্য। এটা পাস্কালের বর্ণিত ‘উদ্ভট কৌতুক’; সূচ বা কুশিকাঁটা দিয়ে নারী বিষন্নভাবে বোনে তার দিনগুলোর শূন্যতা। জলরঙ, সঙ্গীত, বইপড়াকাজ করে একইভাবে; কর্মহীন নারী নিজেকে এসব ব্যাপারে নিয়োগ করে পৃথিবীর ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে না, শুধু দূর করতে চায় তার অবসাদগ্রস্ততা। কোনো কর্ম যদি ভবিষ্যৎকে উন্মুক্ত না করে, তাহলে সেটা ভেঙে পড়ে নিরর্থ সীমাবদ্ধতায়; কর্মহীন নারী বই খোলে এবং একপাশে ফেলে রাখে, পিয়াননা খোলে শুধু বন্ধ করার জন্যে, আবার শুরু করে তার নকশি তোলার কাজ, হাই তোলে এবং শেষে তুলে ধরে টেলিফোন।
বৃদ্ধ নারী সাধারণত প্রশান্ত হয় জীবনের একেবারে শেষ দিকে, যখন সে ত্যাগ করেছে লড়াই, যখন মৃত্যু ঘনিয়ে আসতে আসতে তাকে মুক্তি দেয় ভবিষ্যতের সব ভাবনা থেকে। তার স্বামী সাধারণত তার থেকে বুড়ো, এবং সে নিঃশব্দে আশ মিটিয়ে দেখে তার স্বামীর ক্রমবিনাশ–এটা তার প্রতিশোধগ্রহণ। স্বামী আগে মারা গেলে সে প্রফুল্লভাবে স্বীকার করে নেয় এ-ক্ষতি; প্রায়ই দেখা গেছে যে বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীর মৃত্যুতে পুরুষেরা বেশি কষ্ট পায় স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীদের কষ্টের থেকে; স্বামীরা বিয়েতে বেশি লাভবান হয় স্ত্রীদের থেকে, বিশেষ করে বুড়ো বয়সে। কেননা তখন বিশ্ব কেন্দ্রীভূত হয় গৃহের সীমানার মধ্যে; বর্তমান তখন আর ভবিষ্যতের সীমান্তবর্তী নয়। এ-সময়ে স্ত্রী আধিপত্য করে দিনগুলোর ওপর এবং রক্ষা করে তাদের সহজ ছন্দোস্পন্দ। পুরুষটি যখন তার চাকুরিবাকুরি ছেড়ে দেয়, তখন সে হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়; তার স্ত্রী অন্তত তখন ঘরসংসার দেখাশোনা করে; স্ত্রীটিকে তার স্বামীর দরকার, আর সেখানে স্বামীটি নিতান্তই একটা উৎপাত।
বৃদ্ধ নারীরা তাদের স্বাধীনতায় গর্ববোধ করে; অবশেষে তারা বিশ্বটিকে তাদের নিজেদের চোখে দেখতে শুরু করে; তারা লক্ষ্য করে যে সারাজীবন ভরে তাদের বোকা বানানো হয়েছে ও প্রবঞ্চনা করা হয়েছে; প্রকৃতিস্থ ও সন্দিগ্ধ, প্রায়ই তাদের মধ্যে দেখা দেয় একটা তিক্ত সিনিসিজম। বিশেষ করে, যে-নারী ‘জীবন যাপন করেছে’, সে পুরুষদের এমনভাবে জানে, যা কোনো পুরুষ জানে না, কেননা সে পুরুষের মধ্যে জনগণের কাছে তার যে-ভাবমূর্তি, তা দেখতে পায় নি, বরং দেখেছে ঘটনাচক্ৰজাত একটি ব্যক্তিকে, পরিস্থিতির প্রাণীটিকে। সে নারীদেরও জানে, কেননা তারা অসংযমের সাথে নিজেদের প্রকাশ করে শুধু অন্য নারীদের কাছে : সে দৃশ্যের আড়ালে থেকেছে। তবে তার অভিজ্ঞতা তাকে প্রতারণা ও মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে ফেলতে সমর্থ করলেও ওই অভিজ্ঞতা সত্য প্রদর্শন করার মতো যথোপযুক্ত নয়। সে হাসিখুশি থাক বা থাক তিক্ত, বৃদ্ধ নারীর প্রজ্ঞা তখনোথাকে পুরোপুরি নেতিবাচক : এর স্বভাব বিরোধিতাকরণ, অভিযুক্তকরণ, অস্বীকারকরণ; এটা বন্ধ্যা। যেমন তার কাজে তেমনি তার ভাবনাচিন্তায় নারী-পরগাছার পক্ষে লভ্য মুক্তির শ্রেষ্ঠতম রূপ হচ্ছে স্টোয়িকধর্মী বিরুদ্ধাচরণ বা সংশয়বাদী বক্রোক্তি। জীবনের কোনো সময়েই সে একই সঙ্গে কার্যকর ও স্বাধীন থাকতে সমর্থ হয় না।