প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৫.৪ রাস্তা মেরামতকারী বুলাত্রিউলের কথা

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১.

মঁতফারমেল গাঁয়ের রাস্তা মেরামতকারী বুলাত্রিউলের কথা আমরা প্রথমদিকে আগেই বলেছি। তার পর কয়েক বছর কেটে গেলেও তার তখনও বিশ্বাস ছিল মঁতফারমেলের প্রান্তবর্তী সেই বনটায় গুপ্তধন আছে। সেই গুপ্তধনের মায়া সে তখনও ত্যাগ করতে পারেনি। তার আশা সে একদিন সে গুপ্তধর খুঁজে পাবেই। ইতোমধ্যে সে পকেট মারার কাজে মন দেয়।

কিন্তু একদিন ধরা পড়ে যেতে যেতে কোনওরকমে বেঁচে গিয়ে সে তার জীবনের পথ পরিবর্তন করে সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়। একদিন জনদ্ৰেত্তে অঞ্চলে একটা বাড়ির ছাদে কয়েকজন চোর-ডাকাতের সঙ্গে সে পলিশের হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু সে তখন মাতাল অবস্থায় থাকার জন্য ছাড়া পায়, কারণ সে যে অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধের মনোভাব নিয়ে সেখানে ছিল, সে তখন মদের নেশার ঘোরে মাতাল অবস্থায় থাকার জন্য তা প্রমাণ হয়নি। এরপর থেকে সে গ্যাগনি থেকে ন্যাগনি পর্যন্ত যে রাস্তাটা চলে গেছে সেই রাস্তায় পাথর ভাঙার কাজে যোগদান করে। কারণ মদ খাওয়ার জন্য তার টাকার দরকার।

একদিন সকালবেলায় সে তার কাজে যোগদান করার আগে মঁতফারমেল গায়ের শেষে সেই বনটায় চলে যায়। বনের মধ্যে যেতেই সে একটি অচেনা লোকের পিঠটা দেখতে পায়। তার মনে হল বছরকতক আগে সে যেন এই লোকটাকে দেখেছে এই বনে। বুলাত্রিউলের স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর ছিল। তাই কথাটা মনে পড়ে গেল তার।

দেখতে দেখতে লোকটা বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়। বুলাত্রিউল তাই একটা গাছের উপর উঠে লক্ষ করতে লাগল লোকটা কোথায় যায়। লোকটা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেও তার মনে হল লোকটা এক জায়গায় বসে কী কাজ করছে। তার মনে সন্দেহ জাগল।

বুলাত্রিউল তখন ধৈর্য ধরতে না পেরে গাছ থেকে নেমে লোকটা যেদিকে চলে গেছে সেইদিকে ঝোঁপঝাড় ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু লোকটা যেখানে ছিল বলে মনে হচ্ছিল তার সেখানে কোনওরকমে গিয়ে দেখল লোকটা সেখানে নেই। কতকগুলি পাথর আর জিঙ্ক প্লেট পড়ে রয়েছে সেখানে। পাথরখণ্ডগুলোর মধ্যে একটা গর্ত রয়েছে দেখল। কিন্তু সেটা পরীক্ষা করে দেখল বুলাত্রিউল, গর্তটা খালি।

বুলাত্রিউল হতাশ হয়ে বলে উঠল, পাজি বদমাশ কোথাকার!

.

২.

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে আসার পর জ্বর হয় মেরিয়াসের। জ্বর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রলাপ বকতে থাকে সে। জ্বরের ঘোরে বারবার কসেত্তে’র নাম করতে থাকে। তার দেহের কতকগুলি ক্ষত ভয়ের কারণ হয়ে উঠল। কারণ ডাক্তার ভাবল সেগুলো থেকে গ্যাংগ্রিন হয়ে যেতে পারে। আবহাওয়া যেদিন খারাপ থাকত সেদিন ডাক্তারের ভয় হত বেশি।

ডাক্তার বলল, রোগী যেন কোনও অবস্থাতেই উত্তেজিত না হয়। তখনকার দিনে প্লাস্টারের ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষতস্থান পোয়া ও ব্যান্ডেজ করা বিশেষ কষ্টকর ছিল। এইভাবে দিনের পর দিন যেতে থাকে। মেরিয়াস যতদিন অসুখের ঘোরে থাকে এবং তার অবস্থা আশঙ্কাজনক থাকে ততদিন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ নিদারুণ উদ্বেগে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকেন। তাঁকে দেখে জীবিত না মৃত তা বোঝাই যায় না।

দারোয়ান বলল, রোজ ভালো পোশাকপরা মাথায় সাদা চুলওয়ালা এক ভদ্রলোক বাড়ির গেট থেকে মেরিয়াসের খবর নিয়ে যায় আর ব্যান্ডেজের জন্য কতকগুলি কাপড় দিয়ে যায়।

অবশেষে তিন মাস পর সেপ্টেম্বর মাসে একদিন ডাক্তার জানাল, মেরিয়াসের বিপদ সম্পূর্ণ কেটে গেছে। তবে তার ক্ষতস্থানগুলো সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলার জন্য আরও ছ মাস তাকে বিশ্রাম নিতে হবে, কোনও চলাফেরা করা যাবে না। এই বিশ্রামটা ভালোই হল মেরিয়াসের পক্ষে। কারণ তা হলে বিপ্লবী হিসেবে তার ধরপাকড়ের কোনও ভয় থাকবে না। ফ্রান্সে কোনও বিপ্লবের পর ছ মাস কেটে গেলে বিপ্লবীদের শাস্তিদানের কথা। সরকারের আর মনে থাকে না। তাছাড়া কোনও গণবিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সব লোককে শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। যদিও পুলিশের বড়কর্তা পিসকে সব ডাক্তারের ওপর আদেশ জারি করেছিলেন কোনও আহত বিপ্লবী তাঁদের কাছে চিকিৎসা করতে এলেই তারা যেন সরকারকে জানিয়ে দেন, তবু ডাক্তাররা সে কথা মানত না এবং সেদিক দিয়ে। মেরিয়াসের কোনও বিপদ ছিল না।

মেরিয়াসের যতদিন জ্ঞান হয়নি, তার অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক, ততদিন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের মনে শান্তি ছিল না। তিনিও অনেক কষ্ট করেন। সেবার লোকের কোনও অভাব না থাকলেও তিনি ইচ্ছা করে অনেকদিন রাত জাগতেন। রোগীর সব বিষয়ে তদারক করতেন। কিন্তু মেরিয়াসের অবস্থা বিপদ থেকে মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলেন তিনি। ডাক্তারের মুখ থেকে কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি। আনন্দের আবেগে বাস্ককে তিন লুই বকশিশ দিলেন। সে রাত্রিতে তিনি তাঁর ঘরে আপন মনে নাচগান করলেন। তার পর নতজানু হয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন। বাস্ক এটা দরজার ফাঁক দিয়ে স্বচক্ষে দেখেছিল। অথচ তিনি এর আগে কোনওদিন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেননি।

মেরিয়াসের অবস্থা যত ভালোর দিকে যেতে থাকে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদও তেমনি শিশুর মতো আনন্দোচ্ছল হয়ে ওঠেন। একদিন তিনি পাশের বাড়ির এক সুন্দরী মহিলাকে একটা ফুলের তোড়া পাঠিয়ে দেন। তাতে তার স্বামী রেগে যায়। এমনকি তিনি একদিন নিকোলেত্তেকে তার কোলে বসাবার চেষ্টা করেন। মেরিয়াসকে তিনি মঁসিয়ে লে ব্যারন বলে ডাকতে থাকেন এবং একদিন ‘প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক’ বলে ধ্বনি দিয়ে ওঠেন। তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং বার্ধক্যের মাঝেও যেন অকাল যৌবনের অভ্যাগম হয়। তিনি এমন ভাব দেখাতে থাকেন যাতে মনে হত মেরিয়াসই বাড়ির সর্বময় কর্তা।

এদিকে মেরিয়াসের মনে একমাত্র কসেত্তে’র চিন্তা ছাড়া আর কোনও চিন্তা ছিল না। কে তাকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে, তা সে জানে না। কারণ সে তখন সম্পূর্ণ অচৈতন্য ছিল। এখানকার লোকরা বলে দু জন অচেনা লোক তাকে একটা গাড়িতে করে এ বাড়িতে নিয়ে আসে। ব্যারিকেডে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর কী ঘটেছিল বা কারা ছিল সে বিষয়ে অস্পষ্ট একটা ছবি ভেসে ওঠে তার মনে। এপোনিনে, গাভ্রোশে, মেবুফ, থেনার্দিয়ের, আর তার বন্ধুদের কিছু কিছু কথা মনে পড়ে তার।

তার মাতামহ যতই তার জন্য উচ্ছ্বসিত বা উল্লসিত হোন না কেন, তার সে উচ্ছ্বাসে বা উল্লাসে মেরিয়াস কোনও সময় সাড়া দিত না। একটা হিমশীতল ঔদাসীন্যে আচ্ছন্ন। করে রাখত সে তার মনটাকে। সে তার মাতামহকে ‘দাদু’ বলেও ডাকত না, মঁসিয়ে বলে ডাকত। সে মনে মনে সংকল্প করে বসেছিল, কসেত্তেকে সে খুঁজে বার করবেই এবং তাকে পাবার জন্য দাবি জানাবে সে তার মাতামহের কাছে। কিন্তু তিনি আগের মতো এ বিষয়ে অনমনীয় কঠোর থাকলে সে তার ক্ষতগুলো থেকে সব ব্যান্ডেজ তুলে দেবে এবং তার খাওয়া বন্ধ করবে। মনটা তাই আগে থেকে সে শক্ত করে রাখে।

একদিন সকালে মেরিয়াসের ঘরে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ১৭৯৩ সালের ফরাসি বিপ্লবে যে কনভেনশন গঠিত হয় সেই কনভেনশন এবং দাঁতন, সেন্ট জাস্ট, রোবোসপিয়ার প্রমুখ বিপ্লবী নেতাদের নাম করেন গিলেনৰ্মাদ। তা শুনে মেরিয়াস বলে ওঠে, ১৭৯৩ সালের বিপ্লবী নেতারা সত্যিই বীরপুরুষ ছিলেন।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তখন আর কোনও কথা বলেননি। আপোসহীন রাজতন্ত্রী মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের এই অর্থপূর্ণ নীরবতার মাঝে এক অবদমিত ক্রোধের আভাস পেয়েছিল মেরিয়াস।

.

৩.

একদিন যখন ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ মেরিয়াসের ঘর পরিষ্কার করছিল তখন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ মেরিয়াসের উপর ঝুঁকে পড়ে বললেন, আমি যদি তুমি হতাম তা হলে মাছ খেয়ে মাংস খেতাম বেশি। কারণ মাংসই তাড়াতাড়ি সারিয়ে তোলে মানুষকে।

মেরিয়াসের দেহে তখন শক্তি ফিরে এসেছিল। সে বিছানার উপর উঠে বসত। সে তার মাতামহের দিকে তাকিয়ে আক্রমণের ভঙ্গিতে বলল, আপনাকে একটা কথা বলার আছে।

কী কথা?

আমি বিয়ে করতে চাই।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ হাসতে হাসতে বললেন, অবশ্যই, এটা এমন আর কী কথা!

‘অবশ্যই’ মানে কী আপনি বলতে চাইছেন?

মানেটা খুবই সহজ! তুমি তাকে পাবে।

এক মধুর বিস্ময়ের আবেগে কাঁপতে লাগল মেরিয়াস।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আবার বলতে লাগলেন, তুমি তাকে অবশ্যই পাবে। আমি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, সে তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। মেয়েটি সুন্দরী এবং ভদ্র। সে রোজ তোমার খবর নেয়। তুমি আহত হওয়ার পর থেকে সে তোমার জন্য কান্নাকাটি করে দিন কাটায়। সে সাত নম্বর র‍্যু দ্য লা হোমি আর্মেতে থাকে। তুমি ভেবেছিলে কথাটা তুলঁলে আমার সঙ্গে যুদ্ধ বাধবে এবং একটা পাগলা ষাড়ের শিং ধরে তাকে বশ করতে হবে। আমি এত বোকা নই। আমি সব ঠিক করে রেখেছি। মেয়েটি তোমাকে এত ভালোবাসে যে তোমার মৃত্যু ঘটলে সে-ও মারা যেত। তখন আমাদের মোট তিনজনের জন্য তিনটে কফিনের দরকার হত। আমি তাকে তোমার বিছানার পাশে আনিনি, কারণ সেটা ভালো দেখায় না। কিন্তু জেনে রেখ, কসেত্তে তোমার এবং আমি তাকে তোমার হাতে তুলে দেবই। তোমরা বিয়ে করে সুখী হও–এটাই আমি চাই।

এই কথা বলেই মেরিয়াসের মাথাটা বুকের উপর জড়িয়ে ধরলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। ওরা দু জনেই কাঁদতে লাগল।

মেরিয়াস ডাকল, দাদু!

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, তা হলে তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাস? তুই আমাকে অবশেষে দাদু বলে ডাকলি?

এর পরম সুখের আবেশে দু জনেই বিভোর হয়ে উঠল।

খুব আস্তে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে মেরিয়াস শান্ত কণ্ঠে বলল, দাদু, এখন আমি ভালোই আছি। আমি একবার তার সঙ্গে দেখা করতে যাব।

অবশ্যই যাবে। কালই যাবে।

আজ নয় কেন?

ঠিক আছে, আজই যাবে। তুমি তিনবার আমাকে দাদু বলেছ, তোমার আবেদন মঞ্জুর হয়ে গেছে। আঁদ্রে শেনিয়েরের কবিতার এখানেই শেষ, যে আঁদ্রে শেনিয়েরের মাথাটা ‘৯৩ সালের বীর বিপ্লবীরা কেটে ফেলে।

কথাটা বলে ফেলেই ভুল করেছেন ভেবে শুধরে নিয়ে বলতে লাগলেন, না না, তারা সত্যিই বীর ছিল। তবে আঁদ্রে শেনিয়েরকে কোনও কারণে মানতে পারেনি বলে তাকে ফাঁসি দেয়।

এই বলে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। মেরিয়াস তখন কসেত্তে’র কথাটা একমনে ভাবতে থাকায় তার দাদুর কথাটা ভালো করে শোনেনি বা

সে কথায় কিছু মনে করেনি।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ঘর থেকে বেরিয়েই বাস্ককে দেখতে পেয়ে তার জামার কলার ধরে বললেন, এই শয়তানটাই তাঁকে খুন করেছে?

বাস্ক ভয়ে ভয়ে বলল, কাকে খুন করেছে?

আঁদ্রে শেনিয়েরকে।

বাস্ক বলল, নিশ্চয় মঁসিয়ে।

.

৪.

কসেত্তে আর মেরিয়াস আবার মিলিত হল দু জনে। মেরিয়াসকে যেতে হল না। খবর দিয়ে কসেত্তেকে আনানো হল মেরিয়াসের কাছে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে। সঙ্গে জাঁ ভলজাঁ মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত নাম ধারণ করে এল।

কসেত্তে মেরিয়াসের ঘরে ঢুকতেই বাড়ির সব লোক, সব চাকরবাকর এসে ভিড় করল তার চারদিকে। কসেত্তে যেন, স্বর্গসুখ উপভোগ করতে লাগল। কসেত্তে’র চেহারাটাকে যেন এক আলোর জ্যোতি ঘিরে ছিল। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ কসেত্তেকে দেখেই বলে উঠলেন, চমৎকার। এতদিন পর মেরিয়াসকে দেখতে পেয়ে এক পরম সুখে যেন অভিভূত হয়ে পড়েছিল কসেত্তে। দু হাত দিয়ে মেরিয়াসকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু ঘরে অনেক লোক থাকায় তা পারছিল না।

কসেত্তে’র পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত নামে জাঁ ভলজাঁ। তার পরনে ছিল সুন্দর কালো পোশাক। তার বগলে ছিল সবুজ কাগজে মোড়া একটা বড় প্যাকেট।

নিকোলেত্তে নিচু গলায় বলল, ওই প্যাকেটে বই আছে?

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার উত্তরে বললেন, বিদ্বান লোকদের বগলে বই থাকে সব সময়।

এবার মাথাটা নত করে গলা উঁচু করে বলতে লাগলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ, মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত! আমি আমার কন্যার পুত্র ব্যারন মেরিয়াস পঁতমার্সির পক্ষ থেকে বিবাহের জন্য আপনার কন্যার পাণি প্রার্থনা করছি।

মানুষের নামের আদি অক্ষরটা মনোযোগ দিয়ে না শুনে বিকৃত করে উচ্চারণ করাটা মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের এক অভিজাতসুলভ অভ্যাস।

নীরবে মাথা নত করল মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, তা হলে তো সব ঠিক হয়ে গেল।

এরপর মেরিয়াস আর কসেত্তে’র কাঁধের উপর দুটো হাত রেখে বললেন, এবার তোমরা অবাধে ভালোবাসতে পার পরস্পরকে।

একথা আর দু বার বলার প্রয়োজন ছিল না। কসেত্তেই প্রথমে কথা শুরু করল। মেরিয়াসের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আর সেই বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কসেত্তে বলতে লাগল, তোমার সঙ্গে যে আবার দেখা হবে একথা ভাবতেই পারিনি। কেন তুমি যুদ্ধ করতে গিয়েছিলে? কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! চার মাস আমার কিভাবে যে কটেছে তুমি তার কী জানবে? আমার প্রায়ই মনে হত আমি যেন আর বেঁচে নেই। আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। তবু তুমি যুদ্ধে গিয়ে নিষ্ঠুরের মতো কাজ করেছ? যা হোক, এবারকার মতো ক্ষমা করলাম। ভবিষ্যতে আর যেন কখনও এ কাজ কর না। চার মাস ধরে শুধু চোখের জল ফেলেছি। তার পর যখন এখানে আসার জন্য আমাকে খবর দেওয়া হল তখন আমার মনে হল আনন্দের আবেগে আতিশয্যে আমি বোধ হয় মারা যাব। আমি ভালো করে সাজগোজ করিনি।… তুমি কোনও কথা বলছ না কেন? আমিই শুধু বকে চলেছি। আমরা লা হোমির বাড়িতেই আছি। তোমার দাদু তো ভালোই লোক না, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা কর না, এতে খারাপ হতে পারে। আজ আমার কী সুখ! এখন আমাদের বাড়িটাতে কিন্তু বাগান নেই।

মেরিয়াস শুধু প্রেমিক হিসেবে অতি সাধারণ একটা কথা বলল, হে আমার দেবদূত!

কথাটা বলে ঘরে অনেক লোক থাকায় চুপ করে গেল। তারা শুধু পরস্পরের হাত ধরল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ঘরে উপস্থিত লোকদের বললেন, তোমরা গোলমাল কর না, ওরা তা হলে কথা বলতে পারবে না।

এরপর কসেত্তে ও মেরিয়াসের উপর ঝুঁকে বললেন, সহজভাবে কথা বলে যাও তোমরা, ভয় কর না।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ সাতান্ন বছর বয়সে বিস্ময়ের সঙ্গে যেন এক সফল প্রেমের বিজয়গৌরব দেখছিল। তার সে দৃষ্টির মধ্যে কোনও ঈর্ষা বা আঘাতের চিহ্ন ছিল না।

তার বাবা একবার একসময় তাকে নিচু গলায় বললেন, এরকম ঘটবে আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম… পরের প্রেমের সুখ নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করতে হবে।

এবার মেরিয়াস ও কসেত্তে’র সঙ্গে ঠাট্টা করতে লাগলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। বললেন, মেরিয়াস, তুই একটা পাজি বদমাশ ছেলে, ছবির মতো সুন্দর মুখওয়ালা এই মেয়েটা একা তোর হবে! আমার বয়স যদি এর থেকে আর পনেরো বছরের কম হত তা হলে আমি এই মেয়েটার জন্য তোর সঙ্গে ডুয়েল লড়তাম! হে সুন্দরী তরুণী, আমিও তোমার প্রেমে পড়েছি। বিয়েটা খুব ভালো করেই দিতে হবে। আমাদের এ অঞ্চলেও একটা চার্চ আছে। কিন্তু তোমাদের বিয়েটা দেওয়া হবে সেন্ট পল চার্চে। জেসুটদের দ্বারা নির্মিত ওই চার্চ আরও অনেক ভালো। সেন্ট লুই গির্জার কারুকার্য আরও অনেক ভালো। সেখানে তোমরা যাবে বিয়ে হবার পর। হে তরুণী, এখন বিবাহিত হয়ে সুখী ও সন্তানবতী হও। নারীদের এটাই ধর্ম, আচ্ছা মেরিয়াস, তোমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না?

মেরিয়াস বলল, হ্যাঁ ছিল। তার নাম কুরফেরাক।

সে এখন কোথায়?

সে মারা গেছে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ এতক্ষণে কসেত্তেকে বসতে বললেন। এতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পর আবার বলতে লাগলেন, কসেত্তে এত সুন্দরী যে তাকে একাধারে তরুণী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা বলে মনে হচ্ছে। যাই হোক, এবার কাজের কথায় আসা যাক। আমার বিষয়সম্পত্তি যা কিছু আছে তার আয়-উপস্বত্ব সব বার্ষিক বৃত্তি হিসেবে ধার্য করা আছে। আমার মৃত্যুর পর কী করবে তোমরা?

এমন সময় মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে বলল, ম্যাদময়জেল ইউফ্রেসি ফশেলেভেন্তের ছয় লক্ষ ট্র্য আছে।

জাঁ ভলজাঁ এতক্ষণ চুপ করে সব কথা শুনে যাচ্ছিল আর প্রেমিকদের কথা ভাবছিল তন্ময় হয়ে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, ম্যাদময়জেল ইউফ্রেসি কে?

কসেত্তে বলল, আমি মঁসিয়ে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আশ্চর্য হয়ে বললেন, ছয় লক্ষ ফ্রাঁ!

ভলজাঁ বলল, ছয় লক্ষ থেকে কিছু কম।

এই বলে সে তার বগল থেকে কাগজে মোড়া প্যাকেটটা বার করে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদের কাছে জমা দিয়ে সেটা গুনতে বলল। সেই প্যাকেটটা ব্যাংকনোটে ভর্তি ছিল। এক হাজার ফ্রা’র নোটই বেশি, কিছু একশো ফ্র’র নোটও ছিল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তাঁর মেয়েকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন, তা হলে তো সব ব্যাপার চুকেই গেল। পাজি বদমাশ মেরিয়াস তার স্বপ্নের পুরীতে এক রাজকন্যাকে পেয়ে গেছে। একটা যুবক ছাত্র সে এমন একটি মেয়েকে পেয়ে গেল যার আছে ছয় লক্ষ ফ্রাঁ।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ বলল, পাঁচ লক্ষ চুরাশি হাজার মানেই ছয় লক্ষ।

এই সব টাকার হিসাবের দিকে মন না দিয়ে মেরিয়াস ও কসেত্তে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে।

.

৫.

পাঠকদের হয়তো মনে আছে শ্যাম্প ম্যাথিউকে নিয়ে যে ঘটনা ঘটে যায় তার পর ধরা পড়ার ভয়ে ভলজাঁ লাফায়েত্তে ব্যাংক থেকে তার ছয় লক্ষ তিরিশ হাজার ফ্রাঁ তুলে সেই সব ব্যাংকনোটগুলো মঁতফারমেল বনের মাঝে এক জায়গায় পুঁতে রেখে আসে। তার পর যখন যেখানেই থাকত সে দরকারমতো টাকা সেখান থেকে নিয়ে আসত। তার থেকে এতদিন খরচ চালাবার পর সে মাত্র পাঁচশো ফ্রাঁ তার কাছে রেখে বাকি টাকা সে কসেক্তের যৌতুকস্বরূপ মেরিয়াসের মাতামহের হাতে তুলে দিল।

এদিকে বিয়ের প্রস্তুতি চলতে থাকে। তখন ডিসেম্বর মাস চলছিল। ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করায় ডাক্তার পরামর্শ দেয় ফেব্রুয়ারি মাসে বিয়েটা হোক।

বিয়ের ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাওয়ায় প্রেমিকরা সুখে দিন কাটাতে লাগল সমস্ত দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত হয়ে। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদেরও সুখের পরিমাণ কম ছিল না। তিনি প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কসেত্তে’র কথা ভাবতেন।

তিনি একদিন বললেন, আমি এমন সুন্দরী, শান্ত ও আনন্দদায়িনী মেয়ে জীবনে কখনও দেখিনি। বৎস মেরিয়াস, তুমি একজন ব্যারন এবং ধনী। ওকালতি করে বৃথা সময় নষ্ট কর না।

মেরিয়াস একদিন কসেত্তেকে বলল, দাদুর কথা সব বুঝতে পারছ?

কসেত্তে বলল, না। আমি শুধু অনুভব করছি ঈশ্বরের সদয় দৃষ্টি আমাদের ওপর আছে।

এদিকে জাঁ ভলজাঁ নিজে একদিন মেয়র থাকায় কসেত্তে’র সামাজিক মর্যাদা ও জন্মপরিচয় সম্বন্ধে সব ব্যবস্থা করে ফেলল। সে দেখাল দুই ফশেলেভেন্ত ভ্রাতা পেতিত পিকপাসের কনভেন্টে একসময় মালীর কাজ করত। কসেত্তে হচ্ছে তার বড় ভাই-এর মেয়ে এবং বড় ভাই মারা যাওয়ার পর কসেত্তে’র অভিভাবক হয়ে ওঠে সে। কসেত্তের নাম ইউফ্রেসি ফশেলেভেন্ত। এই মর্মে সে কাগজপত্রও সব ঠিক করে ফেলল। কনভেন্টের কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সাক্ষী আছে।

যৌতুকের সব টাকা এক ট্রাস্টির মাধ্যমে কসেত্তে’র নামে রাখা হল। তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে টাকা সে পাবে। উত্তরাধিকারসূত্রে সে মোট পায় পাঁচ লক্ষ চুরানব্বই হাজার ফ্রাঁ, তার থেকে দশ হাজার ফ্রাঁ তার শিক্ষাবাবদ খরচ হয়।

কসেত্তে যদিও বুঝল, যে ফশেলেভেন্তকে সে এতদিন তার বাবা বলে জেনে এসেছে সে তার পিতা নয়, পিতৃব্য, তথাপি সে তাকে বাবা বলেই ডেকে যেতে লাগল। যদিও তার অতীতজীবন ও জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে এক রহস্য তাকে তখনও ঘিরে ছিল তথাপি সে রহস্য নিয়ে আর সে মাথা ঘামাল না, কারণ সে তার মেরিয়াসকে পেয়ে গেছে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদকে তার ভালোই লাগে। তিনি নিত্যনতুন ভালো ভালো পোশাক উপহার দেন।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে তখন রোজ উৎসবের হাওয়া বইছিল। তিনি আসন্ন বিয়ে উপলক্ষে উৎসব আর জাঁকজমকের কথা বলতেন বারবার, আর সেই সব কথা ভাবতেন।

তিনি একদিন মেরিয়াসকে বললেন, ভালোবাসা ব্যাপারটা খুবই ভালো। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু চাই। প্রেমের সুখের সঙ্গে চাই ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্য। এ ব্যাপারে কিছু অমিতব্যয়িতা, কিছু আতিশয্য থাকবেই। কিন্তু উনিশ শতকের লোক উৎসব বা আনন্দ করতে জানে না। তারা জানে না ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যহীন প্রেমের আনন্দ বা সুখ হচ্ছে মাখনহীন রুটির মতো। তা কোনও রকমে গলাধঃকরণ হয়, কিন্তু তা তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া হয় না, তা দিয়ে ভোজসভার অনুষ্ঠান হয় না। উৎসবের মধ্যে কিছু ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের প্রকাশ থাকবে। থাকবে আতিশয্য। কিন্তু আজকের লোকেরা সে আতিশয্যকে বুর্জোয়া ভাবধারা বলে তাকে এড়িয়ে চলে, কারণ তারা বেশি মিতব্যয়ী সাজতে চায়। কিন্তু তারা জানে না হেলেনের রূপসৌন্দর্যের সঙ্গে তার পোশাকের জাঁকজমক না থাকলে ট্রয়যুদ্ধ হত না। আজ হোমার বেঁচে থাকলে কসেত্তেকে নিয়ে তিনি ইলিয়াড মহাকাব্য লিখতেন এবং সে মহাকাব্যে আমি হতাম বৃদ্ধ বিজ্ঞ নেস্টার। আজ জাতির জীবন থেকে জাকজমক চলে গেছে। বিপ্লবের পর থেকে আজকের লোকেরা পাতলুন পরে। তারা মনে করে তাদের ভালো দেখায়, কিন্তু তাতে তাদের খারাপই দেখায়। তাদের নাচগানের মধ্যে কোনও অনাবিল আনন্দ নেই! নাচগানের মধ্যেও তারা নীতিশিক্ষা চায় কোনও না কোনও। চার্চে বিয়ের প্রথাগত অনুষ্ঠান গুরুগম্ভীর হোক, তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের পর উৎসব হবে জাঁকজমকপূর্ণ। কোনও কার্পণ্য সেখানে চলবে না। উৎসবের দিন গাছে গাছে বেহালা বাজবে, আকাশ থাকবে রুপালি আর নীল, পরীর মতো নগ্ন মেয়েরা নাচবে।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ তার স্বভাবসুলভ ঔদাসীন্যের সঙ্গে এই সব কিছু প্রত্যক্ষ করে যেত। বিপ্লব এবং ব্যারিকেডের যুদ্ধে যোগদান, মৃতের মতো মেরিয়াসের বাড়িতে ফিরে আসা, তার প্রেম, তার বিয়ের ব্যাপার এবং যৌতুকস্বরূপ ধনসম্পদ লাভ–এই সব ঘটনা অভিভূত করে তোলে তাকে। ফলে সে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়ে আরও বেশি করে ঈশ্বরচিন্তা আর উপাসনার মধ্যে ডুবে যায়। সে বেশি করে মালা জপ করতে থাকে।

মেয়ের এই ক্রমবর্ধমান ঔদাসীন্য দেখে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ একদিন বললেন, সর্দি হলে মানুষ যেমন কোনও গন্ধ অনুভব করতে পারে না, তোমারও তাই অবস্থা হয়েছে।

টাকার ব্যাপারে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদের একটা দায়িত্ব ছিল। তার বাবার বেশি টাকা নেই। কিন্তু তার মায়ের দিক থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সে ধনী। মেরিয়াস যদি বিনা যৌতুকে এক গরিব ঘরে মেয়েকে বিয়ে করত তা হলে তাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হত। কিন্তু মেরিয়াস এ বিয়েতে অনেক টাকা পাওয়ায় সে ভাবনা আর ভাবতে হবে না তাকে। সে টাকায় তাদের জীবন ভালোভাবেই কেটে যাবে।

ঠিক হল, বিয়ের পর মেরিয়াস কসেত্তেকে নিয়ে তার মাতামহের বাড়িতেই থাকবে। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, তাঁর শোবার ঘর হবে মেরিয়াসদের শোবার ঘর। আর তার লাইব্রেরি হবে ওকালতির অফিসঘর। চঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, তাঁর শোবার ঘরে নবদম্পতিরা শুলে তিনি নবযৌবন লাভ করতেন তাদের মতো। তার ঘরে তাদের মধুচিন্দ্রমা হবে, এটা কত বড় সুখের কথা তার পক্ষে।

কসেত্তে রোজ মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তকে সঙ্গে করে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে আসত। ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ একদিন বলল, মেয়ে পুরুষের কাছে রোজ আসবে এটা দেখতে খারাপ লাগে। কিন্তু মেরিয়াসের পক্ষে এখন বেশি চলাফেরা করা উচিত নয়, তার জন্য কসেত্তেকে আসতে হত। তাছাড়া মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ কসেত্তে’র উপস্থিতি এবং সাহচর্য পছন্দ করতেন এবং তাদের রোজ তাঁর বাড়িতে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন বলে না এসে পারত না তারা।

যেন এক গোপন চুক্তি অনুসারে মেরিয়াস আর মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা বলত না। মাঝে মাঝে মেরিয়াস রাজনীতি নিয়ে দু-একটা কথা বলত। দেখত তাঁর সঙ্গে মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তের মতের মিল হচ্ছে এবং সে অল্প দু-চার কথায় উত্তর দিচ্ছে। একদিন মেরিয়াস বলল, রাষ্ট্রের সকলের জন্য অবাধ শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। ফশেলেভেন্ত একথা মেনে নিল। মেরিয়াস দেখল ফশেলেভেন্তের ভালো ভাষাজ্ঞান ও চিন্তাশক্তি আছে এবং সে ভালো কথা বলতে বা আলোচনা করতে পারে।

কিন্তু এই লোককেই সে সেদিন ব্যারিকেডে দেখেছিল কি না, তা ঠিকমতো স্মরণ করতে পারে না মেরিয়াস। মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত তার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কেন্দ্র করে ব্যারিকেডে সেদিনকার সেই যুদ্ধের কথা মনে পড়ে। মঁসিয়ে মেবুফ, এপোনিনে ও গাভ্রোশের মৃত্যুর কথা একে একে মনে পড়ে তার। কিন্তু সে গুলির আঘাতে অচৈতন্য হয়ে পড়ার পর থেকে আর কোনও কথা মনে নেই তার। কিছু জানতেও পারেনি। এঁজোলরাস, কুরফেরাক, কমবেফারে, জাঁ প্রুভেয়ার প্রভৃতি তার বন্ধুরা কি সব মারা গেছে? যদি তারা বেঁচে থাকে তা হলে আজ তারা কোথায় গেল? আজ সে ধনী, তার আর আগেকার সেই দুরবস্থা নেই। সে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রেমিকার সঙ্গে পরিণীত হতে চলেছে। তবু তার বন্ধুদের কথা ভেবে দুঃখ হয়। আজ তার পাশে কসেত্তে না থাকলে, কসেক্তের প্রেমচেতনা তাকে আচ্ছন্ন করে না থাকলে সে দুঃখ ভুলতে পারত না সে কিছুতেই।

তার বিছানায় কসেত্তের পাশে যখন বসে থাকে ফশেলেভেন্ত, মেরিয়াস তখন তার পানে বরাবর তাকিয়েও বুঝতে পারত না, এই লোক আর সেদিন ব্যারিকেডে দেখা সেই লোক এক কি না। কথাটা একদিন তোলে মেরিয়াস। ফশেলেভেন্তকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা শাঁব্রেরি’র সেই ব্যারিকেডের কথাটা মনে আছে আপনার?

ফশেলেভেন্ত আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল, কোন শাঁব্রেরি? আমি তো তার কিছুই জানি না।

এরপর চুপ করে গেল মেরিয়াস। বুঝল, সেই মানুষ আর এই মানুষ এক নয়, দু জনের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য আছে। সে মানুষটি দেখতে অনেকটা এর মতো হলেও দু জনে এক নয়।

.

৬.

প্রেমাবেগে মত্ত হয়ে থাকলেও কয়েকটা চিন্তার পীড়ন থেকে মনটাকে মুক্ত করতে পারল না মেরিয়াস। মনে মনে সংকল্প করে বসল সে, বিয়ের আগে দুটি লোককে কৃতজ্ঞতাবোধ ও মানবতার খাতিরে খুঁজে বার করতেই হবে। তাদের একজন হল থেনার্দিয়ের, যে তার বাবা ব্যারন পঁতমার্সিকে বাঁচিয়েছিল। তার প্রতি সে তার যথাকর্তব্য পালন করতে পারেনি। আর একজন হল যে তাকে ব্যারিকেডের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অচৈতন্য অবস্থায় এ বাড়িতে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। তার প্রতিও তার একটা কর্তব্য আছে। তার প্রাণরক্ষার জন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতেও পারেনি সে। এই দুটি কর্তব্য পালন না করে নতুন জীবনে প্রবেশ করলে সে জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

থেনার্দিয়ের একটা আস্ত শয়তান, একটা পাকা দুবৃত্ত–এ কথা সত্যি হলেও সে যে তার বাবাকে ওয়াটারলুর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে এবং তার প্রাণ বাঁচায় এ বিষয়ে তার কোনও সন্দেহ নেই। সে তাই লোক পাঠিয়ে তার খোঁজ নেবার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু কেউ থেনার্দিয়েরের বর্তমান ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারল না। শুধু জানা গেল থেনার্দিয়ের জেল থেকে পালিয়ে এসেছে। তার স্ত্রী জেলের মধ্যেই মারা গেছে। তার বড় মেয়ে এপোনিনে মারা গেছে, তার বড় ছেলে গাভ্রাশে মারা গেছে। আজেলমা তার বাবার কাছে আছে। তার বাকি দুটি ছেলে নিরুদ্দেশ! কোথায় তারা আছে, তা কেউ জানে না।

থেনার্দিয়েরের স্ত্রী মারা গেছে, বুলাত্রিউল ছাড়া পেয়েছে, ক্লাকেসাস, কুঁজ প্রভৃতি দুবৃত্তেরা জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ায় গর্বোর মামলাটা খারিজ করে দেওয়া হয়। এছাড়া থেনার্দিয়ের সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায়নি।

আর যে লোকটি মেরিয়াসকে ব্যারিকেড থেকে বাড়িতে দিয়ে যায় তার সম্বন্ধেও খোঁজ নিয়ে বিশেষ কিছু জানতে পারেনি মেরিয়াস। যে ঘোড়ার গাড়িটি তাকে এখানে নিয়ে আসে তার খোঁজ পেয়েছিল অনেক চেষ্টার পর। কিন্তু চালক বলে, সেদিন সে একজন পুলিশ অফিসারের আদেশে অনেকক্ষণ ধরে সেন নদীর ধারে অপেক্ষা করেছিল। সন্ধ্যার দিকে শহরের বড় ঢাকা নর্দমাটা যেখানে নদীর কাছে এসে শেষ হয়েছে, সেই গেটের মুখে একজন লোক সহসা মৃতবৎ একটি আহত লোককে তুলে নিয়ে আসে। পুলিশ অফিসার তাকে দেখে গ্রেফতার করে এবং আমার গাড়িতে করে আহত লোকটিকে এই বাড়িতে দিয়ে যায়। তার পর আমাকে র‍্যু হোমি অঞ্চলে যেতে বলে। আমি তখন র‍্যু দে আর্কিডের গলির মুখে গাড়ি থামাই এবং তারা দু জন গলিপথে ঢুকে সেই পথ দিয়ে চলে যায়। এরপর আর আমি কিছু জানি না।

মেরিয়াস ভাবতে লাগল, কোনও পুলিশ নিশ্চয় তাকে ব্যারিকেড থেকে নদীর ধারে তুলে আনেনি। কোনও একজন লোক নিশ্চয় তাকে বয়ে এনেছে এবং সে নিশ্চয় ঢাকা নর্দমার ভেতর দিয়ে তাকে বয়ে আনে। এটা তার আত্মত্যাগের আশ্চর্য দৃষ্টান্ত। আজ সে তার সেই উদ্ধারকর্তা ও পরিত্রাতাকে খুঁজে বার করতে চায়, অথচ কোনও খোঁজ পাচ্ছে না। গাড়ির চালক বলে, পুলিশ তাকে সেদিন গ্রেপ্তার করে। সেই সূত্র ধরে স্থানীয় থানায় গিয়ে সে খোঁজ নেয়। কিন্তু পুলিশ বলে সেদিন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। হলে তার রেকর্ড থাকত। পুলিশ বলল, গাড়িচালক কথা বানিয়ে বলেছে।

ক্রমে রহস্যটা ঘোরালো হয়ে উঠল মেরিয়াসের মনে। তার উদ্ধারকর্তা সেই লোকটিকে হয়তো বিপ্লবী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু সে গেল কোথায়? তাকে যে গ্রেপ্তার করেছিল সেই পুলিশই-বা গেল কোথায়? তবে কি গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য আসামি পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বশীভূত করে পালিয়ে গেছে? কিন্তু মেরিয়াসের সঙ্গে দেখা করবে না কেন, যাকে বাঁচাবার জন্য এত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করেছে সে বেঁচে রইল কি না, তার খবর নিল না কেন? বাস্ক আর নিকোলেত্তে এ সব কিছুই দেখেনি। একমাত্র বাড়ির দারোয়ান বাতি হাতে মেরিয়াসের উদ্ধারকর্তা সেই লোকটিকে দেখেছিল। কিন্তু তার মুখ তখন এমন কাদা ও রক্তমাখা ছিল যে তাকে দেখলে এখন হয়তো চিনতেই পারবে না।

একদিন সন্ধেয় মেরিয়াস সেত্তে আর ভলজাঁ’র সামনে তার উদ্ধারকর্তা সম্বন্ধে এই রহস্যের কথাটা তোলে। কিন্তু ভলজাঁ’র ঔদাসীন্য দেখে মেরিয়াস রেগে গেল। রাগতভাবে সে বলতে লাগল, জানেন মঁসিয়ে, সে কী করেছে আমার জন্য? স্বর্গ থেকে সে যেন দেবদূতের মতো এসে পড়ে। সে তার নিজের জীবন বিপন্ন করে আমায় যুদ্ধের জায়গা থেকে তুলে নিয়ে ঢাকা নর্দমার মধ্যে ঢুকে মাটির তলায় সুড়ঙ্গপথ দিয়ে আড়াই মাইল পথ কাদা-জলের মধ্যে হেঁটে আমাকে বাইরে আনে। বাইরে আসার পরেই সে গ্রেপ্তার হয়। এত কিছু করেছিল সে শুধু একজন মুমূর্ষ লোককে বাঁচাবার জন্য। কোনও পুরস্কার সে পায়নি, বা চায়নি। আজ আমি যদি তাকে খুঁজে পাই তা হলে তার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত দিতে পারি। হায়, কসেত্তে’র ওই টাকা যদি আমার হত।

ভলজাঁ বাধা দিয়ে বলল, ওটা তোমারই টাকা।

মেরিয়াস বলল, আমি তাকে খুঁজে বার করার জন্য ওই সব টাকা খরচ করব।

জাঁ ভলজাঁ চুপ করে রইল। কোনও কথাই বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *