সামাজিক জীবন
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৫ –পরিস্থিতি। পরিচ্ছেদ ৩
পরিবার কোনো বদ্ধ মানবগোষ্ঠি নয় : অন্যান্য সামাজিক এককের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় এর বিচ্ছিন্নতা; গৃহ শুধু এমন কোনো ‘অভ্যন্তর’ নয়, যাতে রুদ্ধ হয়ে থাকে দম্পতিটি; এটি ওই দম্পতিটির জীবনযাত্রার মানের, তাদের আর্থিক মর্যাদার, তাদের রুচিরও প্রকাশ, এবং গৃহটি অন্যান্য এলাকজনের কাছে প্রদর্শন করার মতোও একটি জিনিশ। বিশেষ করে নারীর কাজ এ-সামাজিক জীবন পরিচালনা করা। পুরুষটি, উৎপাদনকারী ও নাগরিক হিশেবে, শ্রমবিভাজন ভিত্তি করে এক জৈব সংহতির অঙ্গীকারসূত্রে সমাজের সাথে যুক্ত; পরিবার, শ্রেণী, সামাজিক বৃত্ত, এবং সেটি যে-জাতির অন্তর্ভুক্ত, তা দিয়ে সংজ্ঞায়িত একটি একক হচ্ছে দম্পতিটি, এবং যান্ত্রিক সংহতির অঙ্গীকারসূত্রে এটি জড়িত অনুরূপ সামাজিক পরিস্থিতির সাথে; স্ত্রীটি শুদ্ধতমরূপে হয়ে উঠতে পারে এ সম্পর্কের মূর্তপ্রকাশ, কেননা স্বামীটির পেশাগত সংশ্লিষ্টতা অনেক সময়অসঙ্গতিপূর্ণ তার সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে, আর সেখানে স্ত্রীটির কোনো পেশাগত দায় নেই বলে, সে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারে তার সমান যোগ্যতাসম্পন্নদের সমাজের মধ্যে। উপরন্তু, তার আছে ‘একটু দেখা করতে গিয়ে’ এবং ‘বাড়িতে থেকে’ সে-সব সম্পর্ক রক্ষা করার অবকাশ, যেগুলোর কোনো বাস্তবিক উপকারিতা নেই এবং যেগুলো অবশ্য সে-সব সামাজিক শ্ৰেণীতেই গুরুত্বপূর্ণ, যার সদস্যরা সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে তাদের উচ্চস্থান রক্ষা করার জন্যে ব্যগ্র–অর্থাৎ বলা যায়, যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠতর মনে করে অন্যদের থেকে। নারীটি সুখ পায় তার ‘অভ্যন্তর’ দেখিয়ে, এমনকি তার নিজের আকার-অবয়ব দেখিয়ে, যা তার স্বামী ও সন্তানদের চোখে পড়ে না, কেননা তারা এর সাথে পরিচিত। তার সামাজিক দায়িত্ব হচ্ছে ‘দারুণ দেখানো’, এবং এর সাথে যুক্ত হয় তার নিজেকে প্রদর্শন করার আনন্দ।
এবং, প্রথমত, যেখানে সে নিজেই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেখানে অবশ্যই তাকে ‘দারুণ দেখাতে হবে’; বাড়িতে কাজকর্ম করার সময় সে পরে থাকে আটপৌরে কাপড়চোপড়; যখন সে বাইরে যায়, যখন বাড়িতে কাউকে আপ্যায়ন করে, তখন সে ‘সাজগোজ’ করে। আনুষ্ঠানিক পোশাকপরিচ্ছদের আছে দ্বিগুণ ভূমিকা : এর কাজ নারীটির সামাজিক মর্যাদা নির্দেশ করা (তার জীবনযাপনের মান, তার ধনসম্পদ, যেসামাজিক গোষ্ঠিগুলোর সে অন্তর্ভুক্ত, সে-সব), তবে একই সঙ্গে এটা হচ্ছে নারীর আত্মরতির মূর্তরূপ; এটা একটি উর্দি ও একটি আভরণ; যে-নারী কোনো কিছু করা থেকে বঞ্চিত, সে অনুভব করে সে যা, তা সে প্রকাশ করছে এর সাহায্যে। তার রূপের যত্ন নেয়া, সাজসজ্জা করা হচ্ছে এক ধরনের কাজ, যা তাকে সাহায্য করে নিজের দেহের মালিকানা গ্রহণ করতে, যেমন সে গৃহস্থালির কাজের মধ্য দিয়ে মালিকানা গ্রহণ করে তার গৃহের; তখন তার মনে হয় যেননা সে নিজে বেছে নিয়েছে ও পূনর্সষ্টি করেছে তার অহংকে। সামাজিক রীতিনীতি আরো বাড়িয়ে দেয় নারীর অবয়ব-আকৃতির সাথে নিজেকে অভিন্ন করে তোলার প্রবণতা। কোনো পুরুষের পোশাকের কাজ হচ্ছে, তার দেহের মতোই, তার সীমাতিক্ৰমণতা নির্দেশ করা, দৃষ্টি আকর্ষণ করা নয়; তার পোশাকের চমৎকারিত্ব ও সুন্দর চেহারা দিয়ে সে নিজেকে একটি বস্তু বলে প্রতিষ্ঠিত করে না; তা ছাড়াও, সে তার অবয়ব-আকৃতিকে সাধারণত নিজের অহংয়ের অভিব্যক্তি বলে গণ্য করে না।
এর উল্টো দিকে, সমাজও চায় যে নারী নিজেকে করে তুলবে কামসামগ্রি। যেফ্যাশনের সে দাসী হয়ে উঠেছে, তাকে একজন স্বাধীন ব্যক্তি হিশেবে প্রকাশ করা তার উদ্দেশ্য নয়, বরং তার উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরুষের কামনার কাছে তাকে একটি শিকাররূপে দান করা; তাই সমাজ তার কর্মোদ্যোগকে এগিয়ে দেয় না, বরং চেষ্টা করে সেগুলোকে ব্যাহত করার। স্কার্ট ট্রাউজারের থেকে কম সুবিধাজনক, উঁচুখুড়ের জুতো বাধা দেয় হাঁটতে; সবচেয়ে কম ব্যবহারিক যে গাউন ও জুতো, সবেচেয়ে পলকা যে-হ্যাট ও মুজো, সেগুলো হচ্ছে সবচেয়ে অভিজাত ধরনের; পোশাক দেহকে ছদ্মবেশ দিতে পারে, বিকৃত করতে পারে, বা তার বাকগুলোকে সুস্পষ্ট করে তুলতে পারে; তা যাইহোক, এটা দেহকে করে তোলে প্রদর্শনের সামগ্রী। এজন্যেই ছোটো বালিকা, যে নিবিষ্টভাবে দেখতে ভালোবাসে নিজেকে, তার কাছে সাজসজ্জা এক মোহনীয় খেলা; হাল্কা রঙের মসলিন ও চকচকে চামড়ার জুততা সৃষ্টি করে যেপ্রতিবন্ধকতা, তার বিরুদ্ধে পরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে তার শিশুসুলভ স্বাধীনতা; কাঁচা বয়সে বালিকা ছিন্নভিন্ন হইয়ে যায় নিজেকে প্রদর্শন করার ইচ্ছে ও অনিচ্ছের মধ্যে; কিন্তু একবার যখন সে মেনে নেয় কামসামগ্রি হিশেবে নিজের বৃত্তি, সে আনন্দ পেতে থাকে নিজেকে সাজিয়েগুজিয়ে।
সাজসজ্জার মাধ্যমে, আমি আগেই দেখিয়েছি, নারী নিজেকে করে তোলে। প্রকৃতির সহচর, এবং সে প্রকৃতির কাছে নিয়ে আসে ধূর্ততার আবশ্যকতা; পুরুষের কাছে সে হয়ে ওঠে পুষ্প ও রত্ন এবং নিজের কাছেও। পুরুষের ওপর জলের তরঙ্গিত প্রবাহ বিস্তার, পশমের উষ্ণ কোমলতা ছড়ানোর আগে, সে নিজে উপভোগ করে ওগুলো। তার টুকিটাকি গয়নাগাটি, তার গালিচাকম্বল, তার গদি, ও তার ফুলের তোড়ার সাথে তার সম্পর্ক অনেক কম অন্তরঙ্গ পালক, মুক্তো, বুটিদার রেশমি পোশাক, ও রেশমের সাথে তার সম্পর্কের থেকে, যা সে মিশিয়ে দেয় তার মাংসের সাথে; ওগুলোর বর্ণাঢ্যতা ও ওগুলোর কোমল বুনট ক্ষতিপূরণ করে কামের জগতের পরুষতার, যা তার ভাগ্য; যতো কম পরিতৃপ্ত হতে থাকে তার ইন্দ্রিয়ানুভূতি, সে ততোবেশি মূল্য দিতে থাকে ওগুলোকে। অনেক নারীসমকামী যে পুরুষের মতো পোশাক পরে, তা শুধু পুরুষদের অনুকরণ ও সমাজের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্যে নয়; তাদের কোনোই প্রয়োজন নেই মখমল ও সাটিনের সুখস্পর্শের, কেননা তারা নারীর শরীরেই লাভ করে একই ধরনের অক্রিয় গুণাবলি। বিষমকামী নারী, যে উৎসর্গিত। পুরুষের স্থল আলিঙ্গনের কাছে যদি সে এটা পছন্দও করে আর যদি সে এটা পছন্দ নাও করে–তার নিজের দেহ ছাড়া আর কোনো মাংসল শিকারকে আলিঙ্গন করার মতো তার কিছু নেই, তাই সে দেহকে একটি পুষ্পে রূপান্তরিত করার জন্যে সুগন্ধিত করে, এবং তার কণ্ঠহারের হীরের ঝলক মিলেমিশে যায় তার ত্বকের দ্যোতির সাথে; এগুলো অধিকার করার জন্যে বিশ্বের সমস্ত সম্পদের সাথে সে অভিন্ন করে তোলে নিজেকে। সে শুধু ওগুলোর কামনাতুর সুখ কামনা করে না, অনেক সময় চায়।ওগুলোর ভাবাবেগপূর্ণ ও আদর্শ মূল্যবোধগুলোও। এ-রত্নটি একটি স্মৃতিচিহ্ন, ওইটি একটি প্রতীক। অনেক নারী আছে, যারা নিজেদের করে তোলে সুগন্ধি ফুলের তোড়া, একটি পক্ষীশালা; আরো অনেকে আছে, যারা হচ্ছে যাদুঘর, আরো নারী আছে, যারা গূঢ়লিপিধর্মী। জর্জেৎ লেবলা তাঁর যৌবনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তার মেমওয়ারেতে লিখেছেন :
আমি সব সময় পরে থাকতাম ছবির মতো পোশাক। এক সপ্তাহ আমি থাকতাম ভান আইকের ছবির। মতে, রুবেলের কোনো রূপকের মতে, বা মেমলিংয়ের ভার্জিন-এর মতো। আজো আমি দেখতে পাই শীতকালের এক দিন আমি পার হচ্ছি ব্রাসেলসের একটি রাস্তা, পরে আছি আমেথি মখমল, যা কোনো চ্যাজিউবল থেকে ধার করে নেয়া রুপোর জরি দিয়ে বুনে পরিপাটি করা হয়েছে। আমার সোনালি চুল এঁটে আছে আমার হলদে পশমের শিরোবস্ত্রে, তবে সবচেয়ে অস্বাভাবিক জিনিশটি ছিলো আমার কপালের মাঝখানের হীরের বলয়টি। এসবের কী কারণ? আমি এটা উপভোগ করতাম পুরোপুরি এবং এতে আমার মনে হতো আমি অপ্রথাগতভাবে যাপন করছি জীবন। আমাকে যতোই উপহাস করা হতো আমার পোশাক পরিচ্ছদ হয়ে উঠতো ততোই কৌতুককর। আমি আমার অবয়বের সামান্যও বদলাতে লজ্জা পেতাম, কেননা তা করলে আমাকে নিয়ে পরিহাস করা হতো। এটা হতোএকটা শোচনীয় পরাজয়স্বীকার… বাড়িতে সব কিছু ছিল অন্য রকম। আমার আদর্শ কাঠামো ছিলো গোজোলি ও ফ্রা অ্যাক্সিলিকোর দেবদূতেরা, বার্নে-জোন্স ও ওয়ার্টসের মানবমূর্তি। আমি সব সময় পরতাম নীল ও সোনালি রঙের পোশাক; আমার ঝুলে পড়া বস্ত্র আমার চারদিকে স্তরেস্তরে গড়াগড়ি খেতো।
বিশ্বকে এমন ঐন্দ্রজালিকভাবে আত্মসাৎকরণের সবেচেয়ে ভালো উদাহরণ পাওয়া যায় উন্মাদদের চিকিত্সানিকেতনে। যে-নারী মূল্যবান বস্তু ও প্রতীকদের প্রতি তার ভালোবাসা দমন করতে পারে না, সে ভুলে যায়নিজের আসল আকৃতি-অবয়ব এবং চেষ্টা করে অসংযত পোশাকপরিচ্ছদে সাজতে। তাই ছোটো বালিকা মনে করে সাজগোজ হচ্ছে এমন এক ছদ্মবেশ, যা তাকে পরিণত করে পরী, রাণী, বা ফুলে; সে যখন ভারাক্রান্ত থাকে ফুলমাল্যে ও ফিতায়, তখন সে নিজেকে মনে করে সুন্দর, কেননা সে নিজেকে অভিন্ন মনে করে এ-চমকপ্রদ জাকালো বস্ত্রের সাথে। কোনো জিনিশের রঙে বিমুগ্ধ সরল তরুণী মেয়ে খেয়াল করে না যে তার গাত্রবর্ণের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে পাংশুটে আভা। এ-বিলাসবহুল রুচিহীনতা দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্ক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও, যারা তাদের নিজেদের আকৃতি সম্বন্ধে সচেতন থাকার বদলে বেশি মুগ্ধ থাকে বাহ্যজগত দিয়ে; এ-প্রাচীনপোশাকপরিচ্ছদ, এ-প্রাচীন রত্নে মোহিত হয়ে তারা চীন বা মধ্যযুগকে ডেকে এনে সুখ পায় এবং দ্রুত পক্ষপাতপূর্ণ দৃষ্টিতে এক পলকে আয়নায় দেখে নিজেদের। অনেক সময় অবাক হতে হয় বৃদ্ধা রমণীদের অদ্ভুত আঁকালোপ্রতীক অলঙ্কার পরা দেখে : উষ্ণীষ, ফিতা, রুচিহীন চকচকে বস্ত্র, এবং প্রাচীন কণ্ঠহার; এগুলো দুঃখজনকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করায় ওই নারীদের ভাঙাচোরা মুখমণ্ডলের প্রতি। কামপ্রলোভন জাগানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে এ-নারীদের অনেকে এমন এক স্থানে এসে পৌচেছে, যেখানে সাজগোজ করা এক নিরর্থক খেলা, যেমন নিরর্থক ছিলো তাদের কিশোরবেলায়। আভিজাত্যপূর্ণ কোনো নারী, অন্য দিকে, যদি দরকার হয় ইন্দ্রিয়গত বা নান্দনিক সুখ পেতে পারে তার প্রসাধনের মধ্যে, তবে সে একে অবশ্যই শোভন করে রাখবে তার রূপের সাথে; তার গাউনের রঙ সুন্দর করে তুলবে তার গাত্রবর্ণ, এর ছাঁটকাটের ধরন জোর দেবে বা সুন্দরতর করে তুলবে তার দেহসৌষ্ঠবকে। তার কাছে মূল্যবান হচ্ছে নিজেকে অলঙ্করণ, যে-বস্তুগুলো তাকে অলঙ্কৃত করে, সেগুলো নয়।
প্রসাধন শুধু অলঙ্করণ নয়; আমি আগেই বলেছি, এটা নারীটির সামাজিক পরিস্থিতিও নির্দেশ করে। শুধু বেশ্যাই, যে একান্তভাবে কাজ করে কামসামগ্রিরূপে, নিজেকে প্রদর্শন করে এ-রূপে এবং অন্য কিছু রূপে নয়; প্রাচীন কালের কুঙ্কুমরঞ্জিত চুল ও ফুল-বিছানো বস্ত্রের মতো, আজকের উঁচুখুড়ের জুতো, শরীরের সাথে সেঁটে থাকা সাটিন, ভারি প্রসাধন, ও উগ্র সুগন্ধিদ্রব্য বিজ্ঞাপিত করে তার পেশা। অন্য ধরনের কোনো নারী যদি ‘পথচারিণীর মতো পোশাক’ পরে তাহলে সমালোচনার সম্মুখিন হবে। যে-নারী দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে পুরুষের কামনা জাগায়, সে রুচিহীন; তবে যে এটা অস্বীকার করে সেও খুব প্রশংসনীয় নয়। লোকজন মনে করে সে পুরুষধর্মী হতে চায় এবং হয়তো সে নারীসমকামী, বা সে নিজেকে দর্শনীয় করে তুলতে চায় এবং নিঃসন্দেহে সে একটি বাতিকগ্রস্ত নারী। বস্তু হিশেবে তার ভূমিকা অস্বীকার করে সে অমান্য করছে সমাজকে; যে হয়তো একটি নৈরাজ্যবাদী। যদি সে নিতান্তই অগোচরে থাকতে চায়, তাহলে তাকে থাকতে হবে নারীসুলভ। প্রথাই ঠিক করে প্রদর্শনবাদ ও শালীনতাবোধের মধ্যে আপোষমীমাংসা; কোনো সময়ে দেখা যায় ‘শালীন নারী’কে ঢেকে রাখতে হয় তার বক্ষদেশ, অন্য কোনো সময়ে ঢেকে রাখতে হয় গোড়ালি; কখনোবা পাত্র আকর্ষণের জন্যে তরুণী বিস্তার করতে পারে তার রূপের জাল, আর তখন বিবাহিত নারী ছেড়ে দেয় তার সব সাজসজ্জা, যেমন ঘটে বহু। কৃষকসমাজে; কখনো তরুণীরা পরতে বাধ্য হয় রক্ষণশীল ছাঁটকাটের পাতলা, বর্ণিল ফ্রক, আর তখন বৃদ্ধ নারীরা পরে আঁটোসাঁটো গাউন, উজ্জ্বল রঙ, ও প্রলুব্ধকর ঢঙের পোশাক; যোলো বছরের মেয়ে যদি পরে কৃষ্ণবর্ণের পোশাক, তাহলে এটাকে মনে হয় অতিশয় জমকালো, কেননা এ-বয়সে এটা পরে না।
এ-নিয়মগুলো অবশ্যই অমান্য করা যাবে না; তবে সব ক্ষেত্রেই, এমনকি সবচেয়ে কঠোর নীতিপরায়ণ গোষ্ঠিতেও, গুরুত্ব দেয়া হয় নারীর যৌন বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর; উদাহরণস্বরূপ, যাজকের স্ত্রীও তার চুলে ঢেউ খেলায়, লাগায় হাল্কা প্রসাধন, এবং সতর্কভাবে মেনে চলে রীতিটি, সে তার দৈহিক আকর্ষণীয়তার জন্যে যে-যত্ন নেয়, তা দিয়ে সে নির্দেশ করে যে নারী হিশেবে সে তার ভূমিকা মেনে নিয়েছে। সামাজিক জীবনের সাথে কামের এ-সামঞ্জস্য বিধানের ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় সান্ধ্য গাউনে। এটা যে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান, যার প্রধান লক্ষণই বিলাসিতা ও দর্শনীয় অপচয়, তা বোঝানোর জন্যে এ-গাউনগুলোকে হতে হয় দামি ও পলকা; এগুলোকে হতে হয় যথাসম্ভব অসুবিধাজনকও; স্কার্টগুলো এতো লম্বা ও এতো বিস্তীর্ণ বা এতোটা লেংচাননা ধরনের হয় যে তাতে হাঁটাই অসম্ভব; নারীর রত্নাবলি, লাগানো পাড়, চুমকি, পালক, এবং নকল চুলের নিচে নারী রূপান্তরিত হয় মাংসের পুতুলে। এমনকি এ-মাংসও প্রদর্শিত বস্তু; ফোটা, বিকশিত পুষ্পের মতো নারীরা প্রদর্শন করে তাদের কাঁধ, পিঠ ও স্তন। কামোন্মত্ত উৎসবে ছাড়া এসবের প্রতি পুরুষদের বেশি আগ্রহ দেখানো বিধেয় নয়; তারা আকস্মিকভাবে একটু তাকাতে পারে বা নাচের সময় জড়িয়ে ধরতে পারে; তবে তাদের প্রত্যেকে অনুভব করতে পারে এসব সুকুমার সম্পদপূর্ণ বিশ্বের রাজা হওয়ার মোহনীয়তা।
প্রসাধনের এ-সামাজিক তাৎপর্য তার বেশভূষার মধ্য দিয়ে নারীকে প্রকাশ করতে দেয় সমাজের প্রতি তার মনোভাব। যদি সে প্রচলিত নিয়মের অনুগত হয়, তাহলে সে গ্রহণ করবে সতর্ক ও কেতাদুরস্ত ব্যক্তিত্ব। এখানে আছে বহু সম্ভবপর সূক্ষ্ম দ্যোতনা :সে নিজেকে তুলে ধরতে পারে ভঙ্গুর, শিশুসুলভ, রহস্যময়ী, অকপট, অনাড়ম্বর, উচ্ছল, অচঞ্চল, বেশ সাহসী, প্রশান্ত গম্ভীর রূপে। অথবা, এর বিপরীতে, যদি সে প্রথা অমান্য করে, তাহলে সে তার মৌলিকত্ব দিয়ে দর্শনীয় করে তুলবে সেটাকে। উল্লেখযোগ্য যে বহু উপন্যাসে ‘মুক্তনারী’ নিজের স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করে তার পোশাকের স্পর্ধার সাহায্যে, যা জোর দেয় কামসামগ্রি হিশেবে তার প্রকৃতির উপর, সুতরাং তার পরনির্ভরশীলতার ওপর। উদাহরণস্বরূপ, এডিথ হোয়ারটনের দি এইজ অফ ইনসন্সএ এক তরুণী বিবাহবিচ্ছেদপ্রাপ্ত নারী, যার আছে এক রোমাঞ্চপূর্ণ অতীত ও একটি দুঃসাহসী হৃদয়, সে প্রথমে দেখা দেয় বুকের দিকে বেশি করে কাটা একটি পোশাক পরে; সে যে কেলেঙ্কারির ঢেউ জাগিয়ে তোলে সেটা স্পষ্টভাবেই সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রতি তার ঘৃণার প্রকাশ। একই ধরনে, তরুণী মেয়ে আনন্দ। পায় একজন পরিণত বয়সের নারীর মতো সাজতে, বৃদ্ধ নারী সুখ পায় ছোট্ট মেয়ের মতো সাজতে, বারবনিতা সাজতে পছন্দ করে ভদ্র সমাজের নারীর মতো, আর পরেরজন পছন্দ করে ‘স্বৈরিণী’র মতো সাজতে।
প্রতিটি নারী যদি তার মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেশভূষাও করে, তবু থাকে একটা অভিসন্ধি : ছদ, শিল্পকলার মতোই, কল্পজগতের জিনিশ। শুধু কাঁচুলি, বক্ষবন্ধনি, কলপ, প্রসাধনই দেহ ও চেহারাকে ছদ্মবেশ দেয় না; নারীদের মধ্যে যে সবচেয়ে কম পরিশীলিত, সেও যখন ‘বেশভূষা করে’, সেও নিজেকে ধরা দেয় না পর্যবেক্ষণের কাছে; ছবি বা মূর্তির মতো, বা মঞ্চের কোনো অভিনেতার মতো সে হয়ে ওঠে এক প্রতিনিধি, যার মাধ্যমে নির্দেশ করা হয় অনুপস্থিত কাউকে–অর্থাৎ, সেচরিত্রটিকে, যার সে উপস্থাপক, কিন্তু নিজে ওই চরিত্রটি নয়। অলীক, অটল, উপন্যাসের নায়কের মতে, কোনো প্রতিকৃতি বা আবক্ষ প্রতিমার মতো বিশুদ্ধ কিছুর সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন বোধ করে সে সন্তোষ লাভ করে; সে প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজেকে এ-মূর্তিটির সাথে অভিন্ন করে তুলতে এবং এভাবে তার মনে হয় যেনো সে সুস্থিত করেছে নিজেকে, প্রতিপন্ন হয়েছে তার মহিমার যাথার্থ্য।
ঠিক এভাবেই, মারি বাশকির্তসেভের এক্রিৎ এতিম-এ আমরা দেখতে পাই তিনি পাতার পর পাতায় অক্লান্তভাবে বাড়িয়ে চলছেন তাঁর মূর্তি। তাঁর একটি পোশাকের কথা জানাতেও তিনি কৃপণতা করেন না; তাঁর মনে হয় যেননা তিনি রূপান্তরিত হয়ে গেছেন প্রতিটি নতুন বেশভূষায়, এবং নতুনভাবে জেগে ওঠে তার আত্মপুজো।
দিনের পর দিন তিনি পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন এ-ধ্রুবপদটি : ‘আমাকে মোহনীয় দেখাচ্ছিলো কৃষ্ণ পোশাকে… ধূসর পোশাকে আমাকে দেখাচ্ছিলো মোহনীয়… শুভ্র পোশাকে, আমি ছিলাম মোহনীয়’।
যেহেতু নারী একটি বস্তু, তাই বেশ বোঝা যায় যে তার সহজাত মূল্য প্রভাবিত হয় তার পোশাকের ধরন ও অলঙ্করণ দিয়ে। সে যে এতো গুরুত্ব দেয় তার রেশম বা নাইলনের মুজোর, দাস্তানার, হ্যাটের ওপর, এটা তার দিক থেকে সম্পূর্ণ নিরর্থক নয়, কেননা অবস্থান ঠিক রাখার জন্যে এটা এক অত্যাবশ্যক বাধ্যবাধকতা। আমেরিকায় কর্মজীবী মেয়ের অর্থকোষের এক বড়ো অংশ ব্যয় হয় রূপচর্চায় ও পোশাকপরিচ্ছদে। ফ্রান্সে এ-ব্যয় কিছুটা কম; তবে কোনো নারীকে যতো বেশি দারুণ দেখায়, সে ততত বেশি সম্মান পায়; চৌকশ দেখানো হচ্ছে একটি অস্ত্র, একটি পতাকা, একটি প্রতিরক্ষা, একটি প্রশংসাপত্র।
পোশাকের চমৎকারিত্বও একটা দাসত্ব; এর উপকারিতা পাওয়ার জন্যে অর্থ ব্যয় করতে হয়; এবং ব্যয়টা এতো বেশি যে, মাঝেমাঝেই, সুগন্ধিদ্রব্য, রেশমি মুজো, অন্তর্বাস, বা এরকম কিছু চুরি করার সময় মনোহারি দোকানের গোয়েন্দার হাতে ধরা পড়ে কোনো-না-কোনো সচ্ছল নারী। সুবেশবাসের জন্যে বহু নারী লিপ্ত হয় বেশ্যাবৃত্তিতে, বা গ্রহণ করে আর্থিক ‘সহায়তা’: প্রসাধনের জন্যেই তাদের দরকার হয় অতিরিক্ত অর্থের। সুবেশের জন্যে দরকার পড়ে সময় ও যত্নেরও; তবে এটা এমন কাজ, যা কখনো কখনো সদর্থক আনন্দও দিয়ে থাকে; এ-এলাকায়, যেমন পারিবারিক বাজার করার সময়, সম্ভাবনা আছে গুপ্তধন আবিষ্কারের, আছে মূলাহ্রাসের খোজাখুঁজি, আছে ঠকানোর কৌশল, ফন্দি, এবং উদ্ভাবনপটুত্ব। যদি সে চতুর হয়, তাহলে কোনো নারী দ্রুত বাড়াতে পারে নিজের বস্ত্রসম্ভার। মূলাহাসের দিনগুলোতে চলে রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা। একটি নতুন বস্ত্র একটা উদযাপন। প্রসাধন বা। কেশবিন্যাস হয়ে উঠতে পারে একটি শিল্পকর্ম সৃষ্টির বিকল্প। আজ খেলাধুলো, শরীরচর্চা, স্নান, অঙ্গসংবাহন, ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের মাধ্যমে নারী আগের থেকে অনেক বেশি পায় নিজের শরীর গঠনের আনন্দ; সে-ই ঠিক করে কী হবে তার ওজন, দেহের মাপ, ও তার চামড়ার বর্ণ। আধুনিক নান্দনিক ধারণাগুলো তাদের সুযোগ দেয় সৌন্দর্যের সাথে কর্মের মিলন ঘটানোর : তার অধিকার আছে নিজের পেশি নিজের ইচ্ছেমতোগঠনের, সে মেদ জমতে দেয় না; শরীরচর্চার মধ্যে কর্তা হিশেবে সে লাভ করে দৃঢ়ভাবে আত্ম-ঘঘাষণা এবং কিছু পরিমাণে নিজেকে মুক্ত করে সে নিজের অনিশ্চিত মাংস থেকে; কিন্তু এ-মুক্তি সহজেই পিছু হটে হয়ে ওঠে পরনির্ভরশীল। হলিউডের তারকা জয় ঘোষণা করে প্রকৃতির ওপর, কিন্তু প্রযোজকের হাতে সে আবার হয়ে ওঠে একটি অক্রিয় বস্তু।
এসব জয়, যেগুলোর জন্যে নারী ন্যায়সঙ্গতভাবেই উল্লাস বোধ করতে পারে, সেগুলো ছাড়াও নিজেকে আকর্ষণীয় রাখা বোেঝায়–গৃহ রক্ষণাবেক্ষণের মতোইস্থিতিকালের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ; কেননা তার শরীরও এমন একটি বস্তু, সময়ের সাথে সাথে যার অবনতি ঘটে। আঁ জু পেরদায় কলেৎ অদ্রি বর্ণনা করেছেন এ-লড়াই, যা ধুলোর সাথে গৃহিণীর যুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয় :
তা আর যৌবনের টানটান মাংস ছিলো না; তার বাহু ও উরুর পেশির গঠন দেখা যেতো শিথিল চামড়ায় ঢাকা মেদের একটা স্তরের নিচে। উদ্বিগ্ন হয়ে সে আবার বদলালো তার কর্মসূচি : সকালে আধঘন্টা ব্যায়াম, এবং রাতে, শুতে যাওয়ার আগে, পনেরো মিনিট অঙ্গসংবাহন। সে পড়ে দেখতে লাগলো চিকিৎসাবিদ্যার বই ও ফ্যাশন ম্যাগাজিন, কটিরেখার দিকে লক্ষ্য রাখার জন্যে। পান করার জন্যে সে ফলের জুস বানাতে লাগলো, মাঝেমাঝে জোলাপ নিতে লাগলো, এবং থালাবাসন ধোয়ার সময় সে রবারের দাস্তানা পরতে শুরু করলো। তার দুটো কাজ–তার দেহকে নবযৌবন দেয়া ও তার গৃহকে ঘষেমেজে ঝকঝকে রাখা–অবশেষে হয়ে উঠলো একটি কাজ, তাই শেষে সে গিয়ে পৌছোলো এক ধরনের কানাকেন্দ্রে… বিশ্বটি যেনো থেমে গেছে, ঝুলে আছে বয়স ও ক্ষয়ের বাইরে… তার স্টাইলের উন্নতির জন্যে সে সাঁতারের দিঘিতে কঠোর রীতিতে সাঁতার শিখতে লাগলো, এবং রূপচর্চার সাময়িকীগুলো তার মনোযোগ কেড়ে নিলো ওগুলোর পুনরাবৃত্ত রূপচর্চার প্রণালি দিয়ে।
এখানে আবার নিত্যনৈমিত্তিকতার ফলে সৌন্দর্যচর্চা আর জামাকাপড় রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে ওঠে একটা নীরস একঘেয়ে খাটুনি। সব সজীব বিকাশেরই মূল্য হ্রাস পাওয়ার বিভীষিকা কিছু কিছু কামশীতল বা হতাশাগ্রস্ত নারীর মধ্যে জীবন সম্বন্ধেই জাগিয়ে তোলে বিভীষিকা; অন্যরা যেমন সংরক্ষণ করে আসবাবপত্র বা বইয়মে রক্ষিত খাদ্য, তারা তেমনভাবে প্রচেষ্টা চালায় নিজেদের সংরক্ষণের। এ-নেতিবাচক একগুঁয়েমি তাদের করে তোলে নিজেদের অস্তিত্বের শত্রু এবং অন্যদের প্রতি বৈরী : সুখাদ্যে নষ্ট হয় দেহসৌষ্ঠব, মদে নষ্ট হয় গাত্রবর্ণ, বেশি হাসির ফলে চামড়ায় ভঁজ পড়ে, রোদে নষ্ট হয় ত্বক, ঘুমে হয়ে উঠতে হয় নিষ্প্রভ, কাজে জীর্ণ হয় দেহ, রমণের ফলে চোখের নিচে দাগ পড়ে, চুম্বনে লাল হয় গাল, স্পর্শাদরে নষ্ট হয় স্তনের গঠন, আলিঙ্গনে বিবর্ণ হয় মাংস, মাতৃত্ব বিকৃত করে চেহারা ও দেহ। আমরা জানি কতোটা রাগে তরুণী মা দূরে রাখে তার ববনাচের গাউনের প্রতি আকৃষ্ট শিশুকে : ‘তোমার চটচটে হাতে আমাকে ছুঁবে না, তুমি আমার পোশাকটা নষ্ট করবে!’ ছেনালও একই রকম রূঢ়ভাবে প্রত্যাখান করে স্বামী বা প্রেমিকের ব্যাকুল প্রণয়নিবেদন। সে নিজেকে রক্ষা করতে চায় পুরুষ থেকে, বিশ্ব থেকে, সময় থেকে, যেমন লোকজন ঢাকনা লাগিয়ে রক্ষা করে আসবাবপত্র।
তবে এসব সাবধানতাও পাকা চুল ও কাকের পার (অর্থাৎ চোখের কোণের কাছে চামড়ার কুঞ্চন) আবির্ভাব প্রতিরোধ করতে পারে না। যৌবনকাল থেকেই নারী জানে যে এ-নিয়তি অনিবার্য। এবং তার সমস্ত দূরদর্শিতা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা ঘটবেই : তার পোশাকের ওপর ছলকে পড়ে মদ, কোনো একটি সিগারেটের আগুনে পোড়ে পোশাকটি; এর ফলে হারিয়ে যায় সে-বিলাসিনী ও উৎসবপরায়ণ প্রাণীটি, যে গর্বিত হাসি নিয়ে আসতো নাচঘরে, কেননা তার মুখে এখন গৃহিণীর রাশভারী কঠোর ভঙ্গি; অচিরেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তার প্রসাধন বিশেষ একটি মুহূর্তকে অপরিমিত আলোতে ঝলকিত করার জন্যে কোনো আতশবাজির সমষ্টি ছিলো না, ছিলো না স্বল্পস্থায়ী উজ্জ্বলদীপ্তির ঝিলিক। এটা বরং এক সম্পদ, মূলধনীয় পণ্য, একটি বিনিয়োগ; এটা বুঝিয়েছে আত্মােৎসর্গ, এটার ক্ষতি এক সত্যিকার বিপর্যয়। দাগ, অর্শ, যেমন-তেমন তালি মেরে তৈরি পোশাক, বিশ্রী কেশবিন্যাস অনেক বড়ো প্রলয় পোড়া রোস্ট বা একটা ভাঙা পুষ্পধারের থেকে, কেননা ফ্যাশনপরায়ণ নারী বস্তুর। মধ্যে নিজেকে শুধু প্রক্ষেপই করে না, সে নিজেকে করে তুলতে চায় বস্তু, এবং এখন বিশ্বে সে নিজেকে সরাসরি আক্রান্তবোধ করছে। বস্ত্রপ্রস্তুতকারক ও টুপিবিক্রেতার সাথে তার সম্পর্ক, তার শারীরিক অস্থিরতা, কড়া চাহিদাগুলো–এসবই প্রকাশ করে তার গম্ভীর মনোভাব ও অনিরাপত্তাবোধ। একটা সুপ্রস্তুত গাউন তাকে করে তোলে তার স্বপ্নের সম্রান্ত মানুষ; কিন্তু একই প্রসাধন দুবার ব্যবহার করে, বা একটা বাজে প্রসাধন ব্যবহার করে, নিজেকে তার মনে হয় সমাজচ্যুত। মারি বাশকির্তসেভ আমাদের বলেছেন যে তার হাস্যরস, চালচলন, ও মুখের ভাব সবই নির্ভর করতো। তাঁর গাউনের ওপর; যখন তিনি মানানসই পোশাক পরা থাকতেন না, তখন নিজেকে তার মনে হতো বেঢপ, সাধারণ, এবং অবমানিত বোধ করতেন। খারাপ বেশে কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার থেকে অনেক নারী তাতে যাবেই না, যদিও সেখানে তাদের হয়তো পৃথকভাবে কেউ খেয়ালই করবে না।
কিছু নারী যদিও দাবি করে যে তারা ‘নিজেদের জন্যে বেশভূষা করে’, তবে আমরা দেখেছি এমনকি আত্মরতির মধ্যেও ইঙ্গিত থাকে যে অন্যরা তাদের দেখবে। পোশাকের প্রতি আসক্ত নারীরা, শুধু পাগল ছাড়া, কখনোইপুরোপুরি সুখ পায় না যদি অন্যরা তাদের দেখে; সাধারণত তারা সাক্ষী চায়। বিয়ের দশ বছর পরও তলস্তয়ের স্ত্রী চাইতেন যে তাঁর দিকে মুগ্ধচোখে তাকাক লোকজন এবং তাঁর স্বামী এটা দেখুন। তিনি ফিতে ও অলঙ্কার পছন্দ করতেন এবং চাইতেন চুলে ঢেউ খেলাতে; এবং যদি কেউ খেয়াল না করতো তাতে কী? কিন্তু তার ইচ্ছে করতো চিল্কার করে কাঁদতে।
সাক্ষীর এ-ভূমিকায় স্বামী ভালো নয়। এখানেও আবার তার আবশ্যকতাগুলো দ্ব্যর্থবোধক। তার স্ত্রীটি যদি অত্যন্ত রূপসী হয়, তাহলে সে ঈর্ষা বোধ করতে থাকে; তবে প্রতিটি স্বামীই কম-বেশি একেকটি রাজা কানদৌলেস; সে চায় তার স্ত্রী তার সুনাম বাড়াবে, এজন্য তার স্ত্রীকে হতে হবে রুচিশীল, সুন্দরী, বা অন্তত ‘চলনসই’; নইলে তারা যখন এঙ্গে কোথাও যায় তখন সে হয় বদমজাজি ও শ্লেষপরায়ণ। আমরা দেখেছি বিয়েতে যৌন ও সামাজিক মূল্যবোধগুলোর সুসামঞ্জস্য ঘটে না, এবং এখানে প্রতিফলিত হয় এ-শত্রুভাবাপন্নতা। যে-নারী বাড়িয়ে তোলে তার যৌনাবেদন, সে রুচিহীনতার পরিচয় দেয়, তার স্বামীর মতে; অন্য নারীতে যা তার কাছে মনে হতো প্রলুব্ধকর, নিজের স্ত্রীতে সেই প্রগলভতা সে অনুমোন করে না, এবং এই অননুমোদন নষ্ট করে দেয় যে-কোনো কামনা, যা সে বোধ করতে পারতো ভিন্ন অবস্থায়। তার স্ত্রী সংযতভাবে বেশভূষা করলে সে তা অনুমোদন করে, তবে করে নিরুৎসুকভাবে : তখন স্ত্রীকে তার আকর্ষণীয় লাগে না এবং অস্পষ্টভাবে নিন্দনীয় মনে হয়। এজন্যে সে কদাচিৎ স্ত্রীকে দেখে নিজের চোখে; সে স্ত্রীকে দেখে অন্যদের চোখ দিয়ে। ‘তার সম্বন্ধে লোকে কী বলবে?’ তার অনুমানগুলো ঠিক হওয়ার কথা নয়, কেননা সে তার স্বামিত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যদের দেয় কৃতিত্ব।
যখন নারী দেখে তার বেলা যে-বেশভূষা ও আচরণকে তার স্বামী সমালোচনা করে, কিন্তু মুগ্ধ হয় অন্য নারীর বেলা, এর থেকে আর কিছুই নারীকে অধিকতর রুষ্ট করে না। অধিকন্তু, বলা দরকার স্বামীটি এতো কাছে থাকে যে সে তার স্ত্রীকে দেখে; তার কাছে স্ত্রীর চেহারা সব সময় একই রকম; সে তার নতুন বেশভূষাও দেখে, কেশবিন্যাসের বদলও দেখতে পায় না। এমনকি প্রেমময় স্বামী বা ব্যাকুল প্রেমিকও প্রায়ই নির্বিকার থাকে নারীর বস্ত্রের প্রতি। যদি তারা তাকে নগ্নরূপে দেখতে ভালোবাসে, তাহলে এমনকি সবচেয়ে শোভন বস্ত্রটিও তাকে গোপন করার বেশি আর কিছু করে না; এবং সে চোখধাধানো থাকলেও তাদের কাছে যেমন প্রিয় থাকে, একই রকম প্রিয় থাকে খারাপ বস্ত্রে বা ক্লান্ত অবস্থায়। যদি তারা আর তাকে ভালো না। বাসে, তাহলে অতিশয় রূপবাড়ানো রও কোনো কাজে আসে না। বস্ত্র হতে পারে বিজয়ের অস্ত্র, তবে এটা প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র নয়; এর কলা মরীচিকা সৃষ্টির, এটা চোখের সামনে উপস্থিত করে একটা কাল্পনিক বস্তু; তবে যেমন ঘটে প্রাত্যহিক জীবনের ঘনিষ্ঠতার মধ্যে, তেমনি রক্তমাংসের আলিঙ্গনের মধ্যে চোখের সামনে থেকে বিলীন হয়ে যায় সব মরীচিকা; দাম্পত্য হৃদয়ানুভূতি, শারীরিক প্রেমের মতোই, বিরাজ করে বাস্তবতার স্তরেই। যে-পুরুষটিকে সে ভালোবাসেনারী তার জন্যে বেশভূষা করে না।
প্রায়ই বলা হয়ে থাকে নারীরা বেশভূষা করে অন্য নারীদের মনে ঈর্ষা জাগানোর জন্যে, এবং এ-ঈর্ষা প্রকৃতপক্ষে সাফল্যের একটা সুস্পষ্ট লক্ষণ : তবে এটাই একমাত্র লক্ষ্যবস্তু নয়। ঈর্ষান্বিত বা বিমুগ্ধ অনুমোদনের মাধ্যমে সে সে ধ্রুব ঘোষণাকরতে চায় তার সৌন্দর্যের, পোশাকের চমৎকারিত্বের, তার রুচির–তার নিজের; সে নিজের কাছে প্রদর্শন করে যে সে নিজে দিয়েছে নিজের অস্তিত্ব। এতে সে নিজেকে দান করে এক বেদনাদায়ক পরনির্ভরতার কাছে; স্বীকৃতি না পেলেও গৃহিণীর বিশ্বস্ত সেবা উপকারী; ছেনালের উদ্যোগগুলো হয় ব্যর্থ যদি তা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করে। সে চায় নিজের এক সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন, এবং ধ্রুবর জন্যে তার এ-দাবিই তার সন্ধানকে করে তোলে অত্যন্ত হয়রানিপূর্ণ; যদি নিন্দে করে শুধু একটি কণ্ঠ, তাহলে এ-হ্যাটটি হয়ে ওঠে বিশ্রী; একটা প্রশংসা তাকে সুখী করে কিন্তু একটা ব্যর্থতা তাকে ধ্বংস করে দেয়; এবং ধ্ৰুব যিহেতু প্রকাশ পায় অজস্র ব্যাপারপরম্পরায়, তাই সে কখনোই চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে না। এজন্যেই ফ্যাশনপরায়ণ নারী, ছেনাল, অতিশয় অরক্ষিত; এটাও ব্যাখ্যা করে কেনো কিছু কিছু সুন্দরী ও বহুলপ্রশংসিত নারী দুঃখের সাথে বিশ্বাস করে যে তারা সুন্দরীও নয় রুচিশীলও নয়, তারা যার অভাব বোধ করে, তা হচ্ছে একজন অজানা বিচারকের চূড়ান্ত অনুমোদন; কেননা তাদের লক্ষ্য একটা চিরস্থায়ী অস্তিত্ত্বাবস্থা (আঁ-সো) যা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
‘ভাবতেও কষ্ট লাগে,’ লিখেছেন মিশেলে, ‘নারী, সে-আপেক্ষিক সত্তা, যে বেঁচে থাকতে পারে শুধু একটি দম্পতির একটি সদস্য হিশেবে, সে প্রায়ই নিঃসঙ্গ থাকে পুরুষের থেকে অনেক বেশি। পুরুষ সবখানে সঙ্গী পায়, ধারাবাহিকভাবে পাতায় নতুন নতুন সম্পর্ক। পরিবার না থাকলে নারী কিছুই না। আর পরিবার হচ্ছে এক বিধ্বস্তকর বোঝ; তার সব ভার পড়ে নারীর ওপর’। এবং, সত্যিকারভাবেই, নারী তার সীমাবদ্ধ এলাকা ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে জানতেও পারে না একই লক্ষ্যে কর্মরত বন্ধুবান্ধবের সঙ্গলাভের আনন্দ; নারীর কাজ তার মনকে অধিকার করে রাখে না, তার প্রশিক্ষণ তার মনে স্বাধীনতার জন্যে আকাঙ্খও জাগায় না, স্বাধীনতাকে ব্যবহার। করার জন্যে কোনো অভিজ্ঞতাও দেয় না, এবং তবুও সে তার দিনগুলো কাটিয়ে দেয় একাকীত্বের মধ্যে। বিয়ে তাকে হয়তো বহু দূরে সরিয়ে নিয়েছে তার নিজের পরিবার ও যৌবনকালের বন্ধুদের থেকে, এবং নতুন পরিচিতদের ও বাড়িথেকে প্রাপ্ত চিঠিপত্র দিয়ে এ-উলতার ক্ষতিপূরণ করা কঠিন। এবং নববধু ও তার পরিবারের মধ্যে। প্রকৃত অন্তরঙ্গতা নাও থাকতে পারে, এমনকি তারা কাছাকাছি থাকলেও তার মাও তার প্রকৃত বন্ধু নয় তার বোনেরাও নয়। বাসস্থানের অভাবে আজকাল অনেক তরুণ দম্পতি তাদের শ্বশুরশাশুড়ির সাথেই থাকে; কিন্তু এবাধ্যতাবশত একত্রবাস কোনোমতেই সব সময় বধুটির জন্যে প্রকৃত সাহচর্যের উৎস হয়ে ওঠে না।
কোনো নারী অন্য নারীদের সাথে যে-বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখে ও নতুন বন্ধুত্ব তৈরি করে, তা খুবই মূল্যবান তার কাছে, কিন্তু সেগুলো পুরুষদের মধ্যে সম্পর্কের থেকে প্রকৃতিতে খুবই ভিন্ন। পুরুষেরা তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ আছে, এমন ভাবনাচিন্তা ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যোগাযোগ করে ব্যক্তি হিশেবে, আর তখন নারীরা বন্দী থাকে তাদের সাধারণ নারীধর্মী ভাগ্যের মধ্যে এবং পরস্পরের সাথে সাবদ্ধ থাকে এক ধরনের অন্তর্নিহিত দুষ্কর্মে সহযোগিতার মধ্যে। এবং তারা তাদের মধ্যে সবার আগে যা খোঁজে, তা হচ্ছে তাদের সবার জন্যে অভিন্ন যে-বিশ্ব, তার দৃঢ়ঘোষণা। তারা। মতামত ও সাধারণ চিন্তাভাবনা সম্বন্ধে আলোচনা করে না, কিন্তু পরস্পরকে বিশ্বাস করে তারা বিনিময় করে গোপন কথা ও কাঙ্খিত ফললাভের প্রণালি; তারা সংঘবদ্ধ হয় এক ধরনের একটি প্রতি-বিশ্ব সৃষ্টির জন্য, যার মূল্যবোধগুলো গুরুত্বে ছাড়িয়ে যাবে পুরুষের মূল্যবোধগুলোকে। দলবদ্ধভাবে তারা শক্তি পায় তাদের শেকল ছুঁড়ে ফেলার; পরস্পরের কাছে নিজেদের কামশীতলতা স্বীকার করে তারা অস্বীকার করে পুরুষের কামাধিপত্যকে, আর ব্যঙ্গ করে পুরুষের কামনাকে বা তাদের আনাড়িত্বকে; এবং শ্লেষের সাথে তারা সন্দেহ প্রকাশ করে তাদের স্বামীদের এবং সাধারণভাবে সমস্ত পুরুষের নৈতিক ও মননগত শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে।
তারা তুলনা করে তাদের অভিজ্ঞতার; গর্ভধারণ, প্রসব, তাদের নিজেদের ও তাদের সন্তানদের অসুখবিসুখ, এবং গৃহস্থালির সেবাযত্ন হয়ে ওঠে মানবোপাখ্যানের অপরিহার্য ঘটনাবলি। তাদের কাজ কোনো কৌশলদক্ষতা নয়; রান্নার প্রণালি ও এধরনের ব্যাপারগুলো একজনের কাছে থেকে আরেকজনে নিয়ে তারা একে ভূষিত করে মৌখিক ঐতিহ্যধারার এক গুপ্ত বিজ্ঞানের মর্যাদায়। কখনোবা তারা নৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। তারা কী নিয়ে কথা বলে নারীদের সাময়িকীগুলোর চিঠিপত্রের স্তম্ভগুলো তার ভালো উদাহরণ; শুধু পুরুষদের জন্যে আছে একটা ‘নিঃসঙ্গ হৃদয়’ স্তম্ভ, এটা ভাবাই যায় না; পুরুষেরা মিলিত হয় বিশ্বে, যা তাদেরই বিশ্ব, আর সেখানে নারীদের সংজ্ঞায়িত করতে হয়, পরিমাপ করতে হয়, ও পরীক্ষা করে দেখতে হয় তাদের বিশেষ এলাকা; তাদের চিঠিপত্রের বিষয় হচ্ছে রূপচর্চা সম্পর্কে পরামর্শ, রন্ধনপ্রণালি, সূচিকর্মের নির্দেশ; এবং তারা চায় উপদেশ; তাদের অনর্থক বকবকির ও নিজেকে প্রদর্শনের প্রবৃত্তির ভেতর দিয়ে কখনো কখনো প্রকাশ পায় প্রকৃত উদ্বেগ।
তবে অনেক স্ত্রী আছে, যারা অস্তিত্বধারণের অবলম্বন হিশেবে শুধু নৈতিক কর্তৃত্বেই সন্তুষ্ট নয়; তাদের জীবনে আছে প্রেমোন্মাদনার এক গভীর প্রয়োজন। তারা তাদের স্বামীদের যদি ঠকাতেও না চায় আবার ছাড়তেও না চায়, তখন তারা সে একই উপায় অবলম্বন করে, যা অবলম্বন করে রক্তমাংসের পুরুষের ভয়ে ভীত তরুণী : তারা কাল্পনিক সংরাগের কাছে সমর্পণ করে নিজেদের। স্টেকেল এরও দিয়েছেন নানা উদাহরণ। ভালো অবস্থানে আছে, এমন এক সম্রান্ত নারী প্রেমে পড়ে এক অপেরা গায়কের। সে তাকে ফুল ও চিঠি পাঠায়, তার ছবি কেনে, তার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু যখন সে সুযোগ পায় তার সাথে দেখা করার, তখন সে দেখা করতে যায় না; সে তাকে শারীরিকভাবে চায় না, সে চায় স্ত্রী হিশেবে বিশ্বস্ত থেকে শুধু তাকে ভালোবাসতে। আরেক নারী ভালোবাসতো এক বিখ্যাত অভিনেতাকে এবং তার ছবিতে ও পত্রিকায় প্রকাশিত তার সম্পর্কিত বিবরণে সে ভরে ফেলেছিলো তার ঘর। যখন অভিনেতাটি মারা যায়, নারীটি এক বছর ধরে শোক পালন করে।
রুডলফ ভ্যালিন্টিনোর মৃত্যুর সময় কতো অশ্রু ঝরেছে, তা আমাদের বেশ মনে আছে। বিবাহিত নারীরা ও বালিকারা পুজো করে সিনেমার নায়কদের। একলা আনন্দ লাভের বা দাম্পত্য সঙ্গমের উদ্ভট কল্পনার সময় মনে জাগিয়ে রাখা হয় তাদের ছবি। এবং তারা জাগিয়ে তুলতে পারে কোনো শৈশবস্মৃতি, তাতে তারা ভূমিকা পালন করতে পারে পিতামহের, ভাইয়ের, শিক্ষকের, বা এমন অন্য কারো।
এবং এঙ্গেলস্ বলেন :
একপতিপত্নীক বিয়ে স্থায়ী হয়ে যাওয়ার পর, দেখা দেয় দুটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সামাজিক চরিত্র : স্ত্রীর প্রেমিক ও ব্যভিচারী স্ত্রীর স্বামী… একপতিপত্নীক বিয়ে ও বেশ্যাবৃত্তির সাথে, ব্যভিচার হয়ে ওঠে একটি অবধারিত সামাজিক সংস্থা, নিষিদ্ধ, কঠোরভাবে দন্ডিত, কিন্তু দমন অসম্ভব।
যদি দাম্পত্য শৃঙ্গার স্ত্রীটির ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তি না ঘটিয়ে জাগিয়ে তোলে তার ঔৎসুক্য, তাহলে খুবই স্বাভাবিক যে সে তার পাঠ সমাপ্ত করবে অন্য কোনো শয্যায়। যদি তার স্বামী সফল হয় তার কাম জাগিয়ে তুলতে, তাহলে সে অন্য কারো সাথে। সম্ভোগ করতে চাইবে একই সুখ, কেননা স্বামীর জন্যে তার কোনো বিশেষ ধরনের প্রীতি নেই।
এমন হতে পারে যে তরুণী যেমন স্বপ্ন দেখে একটি ত্রাতার, যে এসে তাকে হরণ করে নেবে তার পরিবার থেকে, তেমনি স্ত্রীও প্রতীক্ষা করে সে-প্রেমিকের, যে তাকে উদ্ধার করবে বৈবাহিক জোয়াল থেকে। একটি প্রায়স-ব্যবহৃত বিষয় হচ্ছে যখন উপপত্নী বলতে শুরু করে বিয়ের কথা, তখন শীতল হয়ে ওঠে ও বিদায় নেয় ব্যাকুল প্রেমিক; নারীটি প্রায়ই আহত বোধ করে প্রেমিকের এ-সাবধান আচরণে, এবং তাদের সম্পর্ক বিকৃত হয়ে ওঠে বিক্ষোভে ও শত্রুতায়। যখন কোনো অবৈধ কামসম্পর্ক স্থিতি লাভ করে, তাহলে প্রায়ই পরিশেষে রূপ নেয় একটি পরিচিত, দাম্পত্য চরিত্রে; এতে আবার পাওয়া যাবে বিয়ের সমস্ত পাপগুলো : অবসাদ, ঈর্ষা, হিশেবনিকেশ, প্রতারণা প্রভৃতি। আর নারীটি আবার স্বপ্ন দেখতে থাকবে একটি পুরুষের, যে তাকে উদ্ধার করবে এ-নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম থেকে।
এছাড়াও পরিস্থিতি ও প্রথা অনুসারে ব্যভিচার ধারণ করে নানা বৈশিষ্ট্য। আমাদের সভ্যতায়, যেখানে টিকে আছে পিতৃতান্ত্রিক প্রথা, বৈবাহিক অবিশ্বস্ততা আজো স্বামীর থেকে স্ত্রীর জন্যে অনেক বেশি জঘন্য।
এ-কঠোরতার আদিকারণগুলো আমরা আলোচনা করেছি : স্ত্রীর ব্যভিচার পরিবারে নিয়ে আসতে পারে কোনো অজানা পুরুষের পুত্র, এবং প্রবঞ্চিত করতে পারে বৈধ উত্তরাধিকারীদের স্বামী হচ্ছে প্রভু, স্ত্রী তার সম্পত্তি। সামাজিক পরিবর্তন, জন্মনিয়ন্ত্রণ চর্চা হরণ করেছে এসব অভিপ্রায়ের বহু শক্তি। কিন্তু নারীকে পরনির্ভর অবস্থায় রাখার ধারাবাহিক বাসনা আজো স্থায়ী করে রেখেছে তাকে ঘিরে রাখা নিষেধগুলোকে। সে প্রায়ই আত্মস্থ করে ওগুলো; সে চোখ বুজে থাকে তার স্বামীর বৈবাহিক খেয়ালখুশির দিকে, যদিও তার ধর্ম, তার নৈতিকতা, তার ‘সতীত্ব’, তাকে নিষেধ করে নিজে ওই ধরনের আচরণ করতে। তার সহচররা চাপিয়ে দেয় যে-সব নিয়ন্ত্রণ–বিশেষ করে প্রাচীন ও নব বিশ্বের ছোটো ছোটো শহরগুলোতে সেগুলো তার স্বামীর জন্যে যতোটা তার থেকে অনেক বেশি কঠোর তার জন্যে; তার স্বামী অনেক বেশি বাইরে যায়, সে ভ্রমণে যায়, এবং আনুগত্য ক্ষুন্ন করলে তাকে অনেক বেশি প্রশ্রয় দেয়া হয়; নারীর ঝুঁকি থাকে বিবাহিত নারী হিশেবে তার সুনাম ও মর্যাদা হারানোর। যে-সব ছলে নারী এসব পাহারা ভণ্ডুল করতে সমর্থ হয়, তা প্রায়ই বর্ণনা করা হয়েছে; এবং আমি নিজেই জানি প্রাচীন কঠোর নীতিপরায়ণ একটি ছোটো পর্তুগিজ শহরের কথা, যেখানে তরুণী স্ত্রীরা শাশুড়ি বা ননদকে সঙ্গে না নিয়ে কখনো বাইরে যায় না; তবে ঘর ভাড়া পাওয়া যায় কেশবিন্যাসকারীর কাছে, যেখানে প্রেমিকপ্রেমিকারা স্বল্পকালের জন্যে মিলন উপভোগ করতে পারে। বড়ো নগরে স্ত্রীর কারারক্ষকদের সংখ্যা খুবই কম; তবে নতুন পরিচিতদের একটি ছোটো বৃত্তে অবৈধ সম্পর্কের সুযোগ বেশি নেই। ত্বরিত ও গোপন ব্যভিচার মানবিক ও মুক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করে না; বিয়ের মধ্যে সমস্ত মর্যাদা ধ্বংস করে সমাপ্তি ঘটে এর মিথ্যাচারের।
পার্থক্যটি ঘটে প্রথা ও আজকের সমাজের নির্দেশিত পুরুষ ও নারীর সামগ্রিক কামপরিস্থিতিবশত। নারীর প্রেমকে আজো গণ্য করা হয় পুরুষের প্রতি একটি সেবামূলক কাজ বলে, তাই এটা পুরুষটিকে প্রতিভাত করে নারীটির প্রভু বলে। আমরা দেখেছি, পুরুষ নিম্নস্তরের একটি নারীকে নিতে পারে সব সময়ই, কিন্তু কোনো নারী যদি তার থেকে নিম্ন সামাজিক স্তরের কোনো পুরুষের কাছে দান করে নিজেকে তাহলে তা একটা অধঃপতন, দু-ক্ষেত্রেই তার সম্মতি হচ্ছে আত্মবিলোপ, অধঃপতন। তাদের স্বামীদের অধিকারে আছে অন্য নারীরা, এটা স্ত্রীরা প্রায়ই স্বেচ্ছায় মেনে নেয়; এমনকি তারা অনেক সময় শ্লাঘাও বোধ করতে পারে : কিছু নারী অনেক সময় এতোদূর যায় যে তারা অনুকরণ করে মাদাম দ্য পপাদুরকে এবং কুটনির অভিনয়ও করে। অন্য দিকে, প্রেমিকের আলিঙ্গনে নারীটি রূপান্তরিত হয় একটি বস্তুতে, শিকারে; তার স্বামীর কাছে মনে হয় যেনো তার স্ত্রীর ওপর ভর করেছে একটি বাহ্যিক মানা, সে আর তার নয়, তার কাছে থেকে অপহরণ করে নেয়া হয়েছে স্ত্রীকে। যতো দিন নারী নিজেকে করে রাখবে দাসী এবং প্রতিফলিত করবে সে-পুরুষটিকে, যার কাছে সে ‘দান করেছে নিজেকে’, ততো দিন তাকে মেনে নিতে হবে যে তার ব্যভিচার তার স্বামীর ব্যভিচারগুলোর থেকে অনেক বেশি মারাত্মকভাবে বিপর্যয়কর।