৫.৩ রাজবংশী সমাজের জাতিপরিচয় ও উপজাতি পরিচয়

১৭১. রাজবংশী সমাজের জাতিপরিচয় ও উপজাতি পরিচয়

রাজবংশী সমাজের ঐতিহাসিক কাল জুড়ে নিজেদের উপজাতি পরিচয়কে জাতি পরিচয়ে এমনভাবে মিশিয়ে দেবার চেষ্টা সত্ত্বেও সেই উপজাতির স্মারক থেকে গেছে তাদের চাপা নাক, ছোট চোখ, একটু ফর্শা রং ও চিবুকের উঁচু হাড়ে। যে বৃহৎ হিন্দু সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে রাজবংশী সমাজের এমন শত-শত বছরব্যাপী চেষ্টা সেই বর্ণ হিন্দু সমাজ তার দরজা কোনো সময়েই রাজবংশী সমাজের জন্যে খুলে দেয় নি। নরনারীর যে-সম্পর্কের ভেতর দিয়ে রক্তের মেলামেশায় উপজাতি পরিচয় খসে যেতে পারত শরীর থেকে, সে-সম্পর্ক কোনো সময়ই তৈরি হয় নি বর্ণ হিন্দু সমাজের লোকজনের সঙ্গে রাজবংশী সমাজের লোকজনের। যে-দুই রাজপরিবার রাজবংশী সমাজের প্রধান পরিবার তারা নানাভাবে নিজেদের বর্ণ হিন্দু করে ফেলতে পেরেছে, বর্ণ হিন্দু সমাজও তাদের নিজেদের ভেতর নিয়ে নিয়েছে। অত বড় বড় রাজপরিবারে বা জমিদার পরিবারে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে কারই বা আপত্তি হবে? তখন ত তাদের রাজা হিশেবেই দেখা হয়, রাজবংশী হিশেবে দেখা হয় না। কালাপাহাড় যে কামাক্ষা মন্দির ধ্বংস করে দেন (১৫৬৩), কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ সেই কামাক্ষ্যা মন্দির পুননির্মাণ করেন ও সেখানে দুর্গাপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে নিজের হিন্দু হওয়ার পথ তৈরি করেন। এই উপলক্ষে ১৫০ জন মানুষকে বলি দিয়ে তাম্রপত্রে মন্দিরের দেবীদের সামনে দেয়া হয়। রাজবংশী বা কোচ থেকে হিন্দু হওয়ার এমন রক্তপিচ্ছিল পথ সকলের পক্ষে বা সাধারণের পক্ষে সুলভ ছিল না। রাজারা কখনো রক্ত ঢেলেছেন, কখনো রক্তের প্রতীক সিঁদুর ঢেলেছেন। লক্ষ্মীনারায়ণ বলে কোচবিহারের কে রাজা আকবরের সেনাপতি মানসিং-এর সঙ্গে তার এক মেয়ের বিয়ে দেন (১৫৮৫)। আর-এক রাজা প্রাণনারায়ণ (১৬২৫-১৬৬৫) তার বোন রূপমতীর বিয়ে দেন নেপালের রাজা প্রতাপমল্লর সঙ্গে। ১৮৭৮-এ কোচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে বিয়ে হল ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্রের কন্যা সুনীতি দেবীর। নৃপেন্দ্রনাথের বড় ছেলে জিতেন্দ্র নারায়ণের বিয়ে হল বরোদার ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে। তার মেয়ে গায়ত্রী দেবীর বিয়ে হল জয়পুরের মহারাজার সঙ্গে। আর-এক বোনের বিয়ে হল আগরতলার রাজার সঙ্গে। ভারতীয় রাজার স্বীকৃতির মূল্য হিশেবে কোচবিহারের রাজা স্বেচ্ছায় ত্যাগ করলেন নিজের রাজবংশী পরিচয়।

বৈকুণ্ঠপুরের রাজপরিবারের ইতিহাসও প্রায় একই রকম। কিন্তু তারা ত দেশীয় রাজ্য হিশেবে স্বীকৃত নয়, তাই, অন্যান্য দেশীয় রাজারা তাদের পরিবারের সঙ্গে বিয়েশাদি দেন নি। কিন্তু টাকা দিয়ে বর্ণ হিন্দু। ঘর থেকে জামাই ও মেয়ে তারাও জোগাড় করেছেন।

রাজবংশী পরিচয়ের সুবাদে যে রাজ্য ও প্রায় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, রাজবংশী পরিচয় অবলুপ্তির মধ্যে দিয়ে সেগুলি নিজেদের হিন্দু সমাজের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ঠিক বিপরীত পদ্ধতিতে বর্ণ হিন্দু সমাজ এই রাজবংশীদের দূরে ঠেলে রেখেছে। ফলে তারা গত প্রায় পাঁচশ বছর এক অদ্ভুত বিপরীত জীবন যাপন করে আসছে। তাদের সমস্ত অবয়বে কোচ জন্মচিহ্ন, তাদের পোশাক-আসাকে কোচ উপজাতির অভ্যাস, তাদের অলঙ্করণে কোচসংস্কার, তাদের তৈজসপত্রে কোচঐতিহ্য, তাদের পরিবারের লোকজনের ভেতরকার সম্পর্ক কোচঐতিহ্য সম্মত, তাদের বাড়িঘর কোচরীতি অনুযায়ী তৈরি হয়, অথচ তারা কিছুতেই নিজেদের কোচ বলে স্বীকার করে না, কোচপরিচয় তাদের পক্ষে প্রায় নিকৃষ্ট অপমান।

বিশাই বা বিশ্বসিংহকে (১৪৯৬-১৫৫৩) যদি ঐতিহাসিক কালে কোচদের সংগঠিত আত্মপ্রকাশের প্রথম চরিত্র বলে ধরে নেই তা হলে পাঁচশ বছর ধরেই রাজবংশী মানুষ নিজের এই দুটি জীবন মেনে নিয়েছে। সে নিজেকে মনেপ্রাণে হিন্দু মনে করে। তার পরম দেবতা জল্পেশ্বর শিব। কিন্তু বর্ণ হিন্দুরা তাকে হিন্দু মনে করে না, তাই বর্ণ হিন্দু সংস্কৃতিও সে আয়ত্ত করে নিতে পারে নি।

এখন ভারতের অর্থনীতির রাজনীতির নিয়মে এই রাজবংশী তার কোচপরিচয় পুনরুদ্ধার করতে, চাইছে। যে-হিন্দুত্ব ছিল তার আদর্শ, সেই হিন্দুত্ব থেকে সে বেরিয়ে আসতে চাইছে। শরীরে ও সংস্কৃতিতে যে-কোচ সে থেকেই গেছে, সেই কোচই সে হয়ে উঠতে চায়। আর, এই কোচপরিচয়ের সুবাদেই ভারতের রাজনীতি-অর্থনীতিতে ভারতীয় হিশেবে সে তার বিশেষ সুবিধে আদায় করে নিতে চায়। হিন্দু হওয়ার পাঁচশ বছর পর সে অহিন্দু হতে চাইছে। কিন্তু এই অহিন্দু হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার কোচঐতিহ্যের গৌরববোধ থেকে ও চৈতন্য থেকে জন্মাচ্ছে না, জন্মাচ্ছে তার টাকাপয়সার নগদ হিশেব থেকে। যে-কোচ পাঁচশ বছর ধরে রাজবংশী থেকেছে সে কি আর ইচ্ছে করলেই আজ কোচ হতে পারে?

হতে পারার একটা উপায় অবিশ্যি তার ছিল। হিন্দু সমাজের প্রত্যাখ্যানের ফলেই সে তার কোচ জীবনযাপনের যে-অভ্যাস অব্যাহত রাখতে পেরেছে সেই অভ্যাসটাকে প্রায় আক্রমণের ভঙ্গিতে হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু তা হলে ত তাকে অস্বীকার করতে হয় এই রাজবংশী নামটিই। কোনো রাজপরিবারের সঙ্গে উপজাতি পরিচয়ের ঐক্যসূত্রে সে তার কোচপরিচয় ফিরে পাবে না। সেই রাজপরিবারের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অস্বীকার করলেই তার উপজাতিপরিচয় সে ফিরে পেতে পারে। কিন্তু ১৮৯০ থেকে শুরু করে ১৯৩০-৩৫ পর্যন্ত যে নিজেকে শুধু রাজবংশী নয়, ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিতে চেয়েছে, সেই পরিচয়ই তার সামাজিক আন্দোলনের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে, সে কী করে এখন নিজেকে রাজবংশী না বলে কোচ বলবে? কোচ ত নয়ই, রাজবংশীও নয়–হিন্দু ক্ষত্রিয়–এই পরিচয় এখন উল্টে যাবে কী করে–হিন্দু ত নয়ই, রাজবংশীও নয়–কোচ?

উল্টে যেতে পারত যদি সত্যি আত্মপরিচয়ের এক প্রখর বেদনায় ও অভিমানে এই সমাজ নিজের ওপর বদলা নিতে চাইত, নিজের পঁচশ বছরের হিন্দু হওয়ার ইতিহাসের বদলা নিতে চাইত, নিজেকে আঘাতে-আঘাতে পর্যদস্ত করতে চাইত। তা হলে এক উদ্ভট প্রতিক্রিয়ায় সে নিজের সংস্কৃত নাম ত্যাগ করত, সে এমন-কি রায় বা বর্মন উপাধিও ছেড়ে দিত, সে বিয়ে-শাদি-শ্রাদ্ধে পুরুত বামুনকে আসতে দিত না, উদ্ধার করে আনত নিজের পিচশ বছরের পুরনো কোনো রীতি, এমন-কি জল্পেশ্বর শিবকেও অস্বীকার করত, এমনকি কোচবিহারের মদনমোহনকেও অস্বীকার করত, কামাক্ষ্যা মন্দিরের বিগ্রহকেও অস্বীকার করত–বদলে গড়ে তুলত নিজের নতুন তীর্থ, তা হলে সেই অভিযান এই বিরাট রাজবংশী সমাজকে ইতিহাসের এক অবাস্তব পুনরাবৃত্তির প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে ফেলত ঠিকই কিন্তু সেই পুনরাবৃত্তি হয়ত নতুন একটা আরম্ভও ঘটাতে পারত। এই উত্তরখণ্ড আন্দোলন ত তা নয়ই, বরং তার উল্টো।

কংগ্রেসের আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বলে কংগ্রেসের যে-জনভিত্তি গ্রাম-গ্রামান্তরে আছে, সেই জনভিত্তির ওপর তৈরি হচ্ছে এই ধরনের আঞ্চলিকতাবাদী আন্দোলন। কিন্তু এটা হয়ত পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ পরিস্থিতি। পশ্চিমবঙ্গ বাদ দিয়ে সারা ভারতেও ভারতীয়তার বিপরীত যে রাজনৈতিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এর সঙ্গে হয়ত তারও সম্পর্ক আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের সেই নির্দিষ্টতা বাদ দিলেও, আসলে ভারতের অর্থনীতিতে মুনাফা ভাগাভাগি এত স্পষ্ট চেহারা নিয়েছে যে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জোতদারও তার ভাগ চায়।

এমন একটা সম্মিলন যেমন হওয়ার কথা তেমনিই হতে লাগল। ছদিন ধরে এই সম্মিলন সকালের দিকে প্রতিদিনই ঘন্টা দু-তিন করে হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রতিদিন একই বক্তৃতা হয়েছে। এমনকি প্রতিদিন বক্তৃতা করার লোক পাওয়া যায় নি। পুরো সম্মিলনটা একদিনেই শেষ হতে পারত-যদি একটু সাজানো যেত। কিন্তু সেরকম সাজানোর লোকও নেই, সেরকম সাজানোর কোনো উদ্দেশ্যও ছিল না। মাঝখানে, একদিন দেবনাথ রায় পি-এইচ-ডি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগের, কয়েকজন অধ্যাপককে এনে উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতির ওপর একটা আলোচনা সভার ব্যবস্থা করে। তাতে বরং এমন কিছু শোনা গিয়েছিল, যা সম্মিলনের অন্যান্য বক্তৃতায় আসে নি। ।

সম্মিলন সকালে শুরু হতে-হতে প্রায় দশটা হয়ে যেত, তারপর বারটা-সাড়ে বারটার মধ্যেই শেষ। দু-একদিন এমনও হয়েছে যে দশটাতেও আরম্ভ করা যায় নি। কিন্তু একটি অধিবেশন সম্পূর্ণ বাদ দেয়া ঠিক নয় বলে যে-কেউ একটা বক্তৃতা করে অধিবেশন শেষ করে দিয়েছে। 

শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে সম্মিলনে অনেকগুলি প্রস্তাব নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে এইগুলি আছে। এক : উত্তরবঙ্গের রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকাকে স্বতন্ত্র অধিকার দিতে হবে, প্রয়োজনে এর জন্যে রাজ্য সীমা পুননির্ণায়ক কমিটিকে নিয়োগ করতে হবে। দুই : উত্তরবঙ্গে সমস্ত সরকারি কাজকর্মে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিক্যাল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে রাজবংশী ছাত্রদের জন্যে শতকরা অন্তত ৫০ ভাগ আসন নির্দিষ্ট রাখতে হবে ও তাদের ভর্তির জন্যে প্রবেশিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। তিন : তিস্তা ব্যারেজের জন্য অধিগৃহীত জমির সমপরিমাণ জমি খাশ জমি থেকে কৃষকদের দিতে হবে এবং আর-কোনো জমি অধিগ্রহণ করা চলবে না। চার : কৃষিপণ্যের সর্বোচ্চ দাম ও লেভির বাধ্যতা উত্তরবঙ্গের প্রযোজ্য হবে না, কারণ উত্তরবঙ্গে কৃষির জন্যে কোনো সেচ ব্যবস্থা নেই ও এখানকার ফলন কম।

কিন্তু এগুলি ত নীতিমূলক প্রস্তাব। কার্যকরী প্রস্তাব নেয়া হয়েছে দুটো।

প্রথম প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছে-যে-ভাবে তিস্তা ব্যারেজ তৈরি হচ্ছে তাতে এই সম্মিলন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারে না। সরকার যদৃচ্ছভাবে জমি অধিগ্রহণ করেছেন। অধিগ্রহণের সময় এমন-কি জমির দাঁড়ানো ফসল পর্যন্ত বিবেচনা করা হয় নি। অথচ যদি তিস্তা ব্যারেজ কোথা দিয়ে যাবে তার একটা মানচিত্র আগে প্রচার করা হত তা হলে কৃষকরা আগেই সতর্ক হতে পারতেন ও অধিগ্রহণের আশঙ্কা আছে এমন জমিতে ফসল বুনতেন না। তদুপরি তিস্তা ব্যারেজের কাজে স্থানীয় লোকজনদের নেয়া হয় নি। তা ছাড়াও তিস্তা ব্যারেজের ফলে কোথায় কী ভাবে জল যাবে তার কোনো হিশেব জনসাধারণকে দেয়া হয় নি। ফলে, এরকম আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে তিস্তা ব্যারেজের ফলে উত্তরবঙ্গের কৃষিপণ্যের ধারা ব্যাহত হবে। অথচ এই আশঙ্কা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার তাড়াতাড়ি তিস্তা ব্যারেজ চালু করতে চাইছেন। অতি শীঘ্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিস্তা ব্যারেজের প্রথম পর্যায়ের উদ্বোধন করবেন বলে যে-ঘোষণা করা হয়েছে তাতে সম্মিলন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারছে না। তিস্তা ব্যারেজের কাজ কতটা এগিয়েছে সে-বিষয়ে জনসাধারণকে কিছু না-জানিয়েই সরাসরি উদ্বোধন করে দেয়া অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক। পরন্তু, তিস্তা ব্যারেজের কাজ এখনো উদ্বোধনের পর্যায়ে আসেই নি। এমতাবস্থায় সম্মিলন উত্তরবঙ্গবাসীকে সতর্ক করে দিচ্ছে–এই উদ্বোধনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠুন। তাই সম্মিলন আহ্বান করছে–মুখ্যমন্ত্রী তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধন করতে এলে আপনারা নির্দিষ্ট দিনে সারা, উত্তরবঙ্গ থেকে মিছিল নিয়ে এসে এই উদ্বোধনের প্রতিবাদ করুন, মুখ্যমন্ত্রী যাতে এই উদ্বোধন না। করতে পারেন।

দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আরো দূরপ্রসারী। তাতে বলা হল–উত্তরবঙ্গের উন্নতির প্রতি কোনো রাজ্য সরকারই কোনোদিন মনোযোগ দেন নি। অথচ উত্তরবঙ্গ থেকে চা, তামাক ও কাঠের শুল্কবাবদ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কোটি-কোটি টাকা পেয়ে থাকেন। উত্তরবঙ্গের প্রতি এই উপেক্ষার প্রতিবাদে সম্মিলন আহ্বান করছে যে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গবাসী যোগ দেবেন না। সম্মিলনের পক্ষ থেকে উত্তরবঙ্গবাসীকে আহ্বান করা হচ্ছে, তার যেন বিধানসভায় ভোট বয়কট করেন। উত্তরবঙ্গের কেউ প্রার্থী হবেন না। উত্তরবঙ্গের কেউ ভোেট দেবেন না। সম্মিলনের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে উত্তরখণ্ড হিংসায় বিশ্বাস করে না, তাই কোনো হিংসাশ্রয়ী উপায়ে ভোট বন্ধ করার আহ্বান দেয়া হচ্ছে না। সম্মিলন শুধু শান্তিপূর্ণ উপায়ে আগামী বিধানসভা নির্বাচন বয়কট করার আহ্বান দিচ্ছে।

.

১৭২. সাংস্কৃতিক ফাংশনের বিবরণ–যাত্রা

শনিবার ছিল কলকাতার নবরঞ্জন অপেরার কুলটার কুল আর রবিবার ঐ একই অপেরার প্রমোদতরণী। সোমবার ছিল গানের আসর। তাতে চিত্রা সিং শেষ পর্যন্ত জোড়ায় আসেন নি, একাই এসেছেন। কিন্তু অনুপ জালোটা এসেছিলেন, মান্না দে ছিলেন, তা ছাড়া অন্যান্য আর্টিস্টরা ত ছিলেনই। মঙ্গলবার কলকাতার গ্রুপ থিয়েটার নামে একটা দল ব্রেখটের ককেসিয়ান চক সার্কল করে। বুধবারের অনুষ্ঠানটা সন্ধ্যায় শুরু হয় নি, শুরু হয়েছে রাত আটটায় আর শেষ হয়েছে সকাল চারটেয়–সারা রাত ধরে ভিডিওতে চারটি ফিল্ম দেখানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার একটিই অনুষ্ঠান ও সেটিই সম্মিলনের শেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-শ্রীদেবীর নাচ।

এর ভেতর যাত্রার অনুষ্ঠানটা দুদিনই খুব জমে গিয়েছিল। তবে একটা পৌরাণিক হলে আরো ভাল হত। দুটোই খানিকটা ঐতিহাসিক আর খানিকটা সামাজিক। নবাবি আমলে একটি মেয়ে কুলত্যাগিনী হয়ে কী করে অত্যাচারী নবাবের প্রতিরোধ সংগঠন করেছিল তার কাহিনী–কুলটার কুল। মেয়েটি। হিন্দু, হিন্দু জমিদারের গায়ে থাকে। সে একটি যুবকের সঙ্গে এক রাত্রিতে বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। সে জন্যেই সে কুলটা। কিন্তু পরে ধীরে-ধীরে জানা যায় ঐ হিন্দু জমিদার ঐ হিন্দু মেয়েটিকে মুসলমান মনসবদারের কাছে ভেট দিতে চায় এই খবর পেয়ে মনসবদারের এক যুবক সৈন্যাধ্যক্ষ পালিয়ে এসে মেয়েটিকে বাড়ি থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে রক্ষা করে। কিন্তু ইতিমধ্যে সেই জমিদার, মনসবদারের ঐ ছেলেটিকে তনখাইয়া ঘোষণা করে, তার খোঁজে সমস্ত জায়গায় সৈন্য পাঠায় ও গ্রামে-গ্রামে সেই সৈন্যরা অত্যাচার শুরু করে। বিশেষত মেয়েদের ওপর। এক-একদল মেয়েকে ধরে আনা হয়–জমিদারকে দেখানোর জন্যে যে তার ভেতর সেই মেয়েটি আছে কি না। আর, আত্মগোপন করে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে-বেড়াতে সেই ছেলেটি ও মেয়েটি হঠাৎ একটা সময় থেকে নবাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের সংগঠক হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ঐ মুসলমান সেনানী ও হিন্দু নারীর নেতৃত্বে স্বতঃসংগঠিত গ্রামবাসীদের বাহিনী গেরিলা যুদ্ধে সেই মুসলমান মনসবদার ও হিন্দু জমিদারের ভাড়াটে সৈন্যদের পর্যদস্ত করে ফেলে।

খানিকটা দেবী চৌধুরানীর আদল আসে, জোয়ান অব আর্কও একটু আছে। যারা ঐতিহাসিক নাটক ভালবাসে তাদের কাছে মনসবদার, জমিদার আর ঐ গ্রামের মেয়েটি কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচিত হয়ে যায়। আর, তারপরই হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের ওপর মাঝেমধ্যেই কথাবার্তা আসতে থাকে। গেরিলা যুদ্ধের ব্যাপারে নকশালদের খতম অভিযান-এর কথা মনে পড়ে আবার পাঞ্জাবের সন্ত্রাসবাদীদের কথাও মনে আসে। এই সব মিলিয়ে যাত্রাটি প্রায় সব রকম দর্শকের কাছে অনায়াসে পৌঁছে যায়। এমন-কি আধুনিক ছেলেপিলে, যারা ইতিহাসের ততটা ধার ধারে না, তারাও অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের সংগঠিত বিদ্রোহের কাহিনীতে নিজেদের বিষয় পেয়ে যায়। একদিকে মনসবদার ও জমিদারের অত্যাচার দেখানোর সুযোগ নরনারীর কিছু ঘনিষ্ঠ দৃশ্যও ছিল, সেখানে হিন্দি গজল গানই গাওয়া হয়েছে, সঙ্গে মেয়েটি নেচেছেও। এই মোনা গুপ্তা মেয়েটি ফিল্মে ক্যাবারে নাচের জন্যে খুব নাম করেছে। মনসবদারের এক মদ্য পানের দৃশ্যে মোনা গুপ্তার ক্যাবারে নাচ ছিল। এই নাচটা যে আছে তা অনেকেই জানত। আসলে, এই নাচটার জন্যেই কুলটার কুল যাত্রা হিশেবে হিট করেছে। ক্যাবারের বেশ কিছুটা জুড়ে বেলিডান্স। শেষের দিকে এক সময় মেয়েটা প্রায় আর্চ করে স্টেজের মাঝখানে ঘোরে, তার পেটের ওপর, তলপেটের ওপর আর বুকের ওপর আলো পড়ে, অন্য সব আলো নিবে যায়, মেয়েটিকে ঐ আর্চ করেই স্টেজজুড়ে ঘুরতে হয়, যাতে সব দিকের দর্শকরা দেখতে পায়, দর্শকদের ভেতর থেকে হাততালি, চিৎকার, শিস ওঠে। যখন যেদিক থেকে তার পেট আর বুক দেখা যায়, তখন সেদিক থেকেই হাততালি, চিৎকার আর শিস ধ্বনিত হয়। কিন্তু এ-স্টেজ ত যাত্রার মত চারদিক খোলা নয়, থিয়েটারের মত একদিক খোলা। মোনা গুপ্তার শরীর ঘোরানোর ফলে সব দর্শকই তার বুক ও পেটের নতুন নতুন দৃশ্য পায়। ফলে, তারাও হাততালি, চিৎকার আর শিস দেয়। এই দৃশ্য একটু যেন বেশি সময় ধরেই হয়। তারপরই বাইরে বোমার আওয়াজ, চকিত অন্ধকারে মোনা গুপ্তা উঠে দাঁড়ায়, হাত বাড়িয়ে নেয়া একটা কাল কাপড়ে সে নিজেকে সম্পূর্ণ আবৃত করে নিতে-নিতেই আলো সম্পূর্ণ জ্বলে ওঠে ও সেই নায়ক-নায়িকার গেরিলাবাহিনী স্টেজে ঢুকে পড়ে। তখন বোঝা যায়, ঐ নর্তকীও ছিল ছদ্মবেশী গেরিলা। সেখানে মনসবদারের পরাজয় ও হত্যাতেই যাত্রার সমাপ্তি–তার আগে কিছু · ছোটাছুটি ও সংক্ষিপ্ত তলোয়ার খেলা আছে।

প্রমোদতরণী-ও এরকমই কিছুটা ঐতিহাসিক ও কিছুটা সামাজিক। কুলটার কুল-এ যে রকম, প্রমোদতরণীতেও সেরকম, নায়ক-নায়িকার সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট হয় না–অর্থাৎ ভাইবোন, স্বামীস্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা–এ রকম নির্দিষ্ট পরিচয়ের চাইতেও তাদের একসঙ্গে থাকা ও বাঁচাটাই প্রধান ব্যাপার। প্রমোদতরণীর বেশ অনেকটা জুড়ে প্রথমেই মোনা গুপ্তাসহ অন্যান্য মেয়েদের নাচ আছে। মোনা গুপ্তা এখানে মাইক হাতে নিয়ে পাশ্চাত্য ফিল্মের কায়দায় ঘুরে-ঘুরে গানও গায়। নীলকর সাহেবের বাংলোতে বড়দিনের উৎসব ছিল এরকম দীর্ঘ ও সমবেত নাচের উপলক্ষ। সেখানেও নীলদর্পণ-এর তোরাপের মত চরিত্র আছে, সংখ্যায় কিছু বেশি। ক্ষেত্রমণির ধর্ষণ দৃশ্য আছে বার দুয়েক–একবার সাহেব করে, একবার নায়েবগোছের বাঙালি একজন। কিন্তু ঐরকম কিছু অংশ ছাড়া নীলদর্পণ আর মনে পড়ে না। সেখানেও দেখা গেল অনেকেই ঐ আরম্ভের সমবেত নারীনৃত্য ও ভেতরের ধর্ষণের দৃশ্যের কথা জানে। তাই সেই নৃত্যের পরই প্যান্ডেল থেকে অনেকে বেরিয়ে যায়, আবর ধর্ষণের আগে ঢোকে। নাচের সময় আলো খুব চড়া, রঙিন ও ঘুরন্ত–ফলে সেই ঘূর্ণনের একটা মাদকতা আসে। সেই মাদকতা দর্শকদের মধ্যে ছড়ায় বটে কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে কাহিনীর ইঙ্গিত বুঝে নিতে হয় বলে এতটা ছড়ায় না যে দর্শকরা নিজেদের আসন ছেড়ে উঠে নাচতে থাকবে! সেটা বরং ঘটে ধর্ষণ দৃশ্য দুটিতে। দুটি দৃশ্যই একটু বিস্তারিত ভাবে দেখানো হয়। সেখানেও আলো খুব পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহৃত হয়। ধর্ষণদৃশ্য দুইবার কেন, তার একটা জবাব কাহিনী থেকে পাওয়া যায়–পালাকার দেশীয় তাঁবেদার শ্রেণীর, চরিত্রও দেখিয়েছেন। সেটা অবিশ্যি অন্যভাবেও দেখানো যেত। কিন্তু দর্শকদের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, প্রথম বারের ধর্ষণটা কিছু প্রত্যাশিত ও কিছু দুর্ঘটনা। সেখানে অত্যাচারের আবহ সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় না। কিন্তু একই মেয়ের দ্বিতীয় ধর্ষণের দৃশ্য দর্শকদের নাটকীয় ও অপ্রত্যাশিত ঠেকে। শরীরজীবিনী কোনো মেয়ের শরীরের ওপর কোনো যৌন আঘাত এলে যেমন দর্শকের শারীরিক পবিত্রতাবোধ আহত হয় না, তেমনি, একবার ধর্ষিতা মেয়েকে দ্বিতীয়বার ধর্ষিতা হতে দেখলে দর্শকদের সামাজিক নিরাপত্তাবোধ হয়ত ব্যাহত হয় না। বরং, এই দ্বিতীয় ধর্ষণটাকে যাত্রার দৃশ্য হিশেবে অনেক নিরপেক্ষভাবে ভোগ করা যায়। সেই ব্যাপারে আলোকসম্পাতের সাহায্যও পাওয়া যায়। প্রথমবার ঘটনা ঘটে সাহেবের কুঠিতে। সেখানে ততক্ষণ বেশ প্রকাশ্য আলো থাকে যতক্ষণ সাহেব সেটা চায়, আর সাহেব বেশ অনেকক্ষণ ধরে। সেখানে অজ্ঞাত কোনো উৎস থেকে সাহেবি বাজনাও বাজে ধর্ষণের আয়োজন জুড়ে। আর দ্বিতীয়বার ধর্ষণ ঘটে মেয়েটির নিজের ঘরে, অন্ধকারে। সেখানে দর্শকরা নটনটীর শ্বস, দীর্ঘশ্বাস, কাতরতার আওয়াজ বেশ ভালভাবে শুনতে পায়।

প্রত্যেকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই দেখা গেল যে দর্শকদের বড় একটা অংশ প্রায় সবটাই আগে থেকে জানে। সেই অংশটা সংখ্যার দিক থেকে বড় কিনা তা বলা যাবে না। বরং অনুমান হয়, তা নয়। কারণ প্যান্ডেলভর্তি অত মানুষের মধ্যে কত মেয়ে এসেছে কাছাকাছি গ্রাম থেকে, অনেক দর্শক এসেছে দূর থেকে বাসে করে। তাছাড়া সে রকম পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। তারা এ সব যাত্রা, থিয়েটার ফিল্ম আগে দেখে নি। তারা এ-সব গান বরং কিছুটা রেডিওতে আগে শুনেছে। কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে, এ-সব দেখা বা জানা দর্শকের সংখ্যা বেশি না হলেও, ঐ দর্শকরাই অত বড় প্যান্ডেলের ভেতরে প্রধান। তারা নানা জায়গায় বসে থাকে বটে, কিন্তু ঢোকে আর বেরয় প্রায় একসঙ্গেই। তাদের বয়সের সীমাটাও বেশ বড়–বিশ-বাইশ থেকে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত। এদিককার আলোর ভোল্টেজ কম। সেই ক আলোয় খুব পরিষ্কার বোঝাও যায় না এরা সবাই স্থানীয় ছেলে কি না। তার ওপর এ অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি হয়েছে পাহাড়ে, আসামের কাছাকাছি এলাকায়, বিহারের এলাকায়, বালুরঘাট রায়গঞ্জ শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি এই সব শহরেও। সুতরাং হিমঝরা রাত্রির আধো-আলোর এই অনুষ্ঠানে স্থানীয় রাজবংশী যুবকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল চা বাগানের মজুরদের মদেশিয়া মুখ, গোখা মুখ, বিহারী বা আসামী মুখ। পলিথিনের জ্যাকেট, টুপি আর একই ধরনের জুতোয় শহরের যুবকদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল ট্রাক বা বাসের ড্রাইভার-ক্লিনাররা বা ট্রাকভর্তি করে দূর থেকে আসা নানা পেশার নানা মানুষ। এই ভিড়টাই কিন্তু দর্শকদের প্রধান অংশ–তারাই যেন ঠিক করছিল কোথায় কতটা শিস বাজবে, কতটা আওয়াজ উঠবে, কোথায় একজনের একটা মন্তব্য শোনা যাবে, কোথায় হাততালি অর চিৎকার একসঙ্গে চলবে।

.

১৭৩. সাংস্কৃতিক ফাংশনের বিবরণ—গা

 দর্শকদের এই অংশের অনুষ্ঠানগুলো সম্পর্কে পূর্বজ্ঞানই এই সাংস্কৃতিক অধিবেশনগুলির প্রধান দিক। শিশুরা যেমন শোনা গল্পটাই একাধিকবার শুনতে চায় ও গল্প শুনতে-শুনতে তার মনের পরিচিত প্রতিক্রিয়াটাই আস্বাদ করতে করতে এগয়, এই দর্শকরাও সে রকম অনুষ্ঠানটির পরিচিত অংশগুলিই বারবার শুনতে চায়, দেখতে চায়। এমন হতে পারে যে এই দর্শকদের মধ্যেও বড় একটা অংশ ফিল্ম দেখে, টিভি দেখে, বা নানা জায়গায় এই সব অনুষ্ঠান দেখে-দেখে পাকা দর্শক হয়ে গেছে।

দর্শকদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে এই পূর্বজ্ঞানই সবচেয়ে বেশি বোঝা গেল গানের আসরে। কারণ, এমন-কি মেয়েদের মধ্যেও অনেকে এই সব গায়কের গলার সঙ্গে ও তাদের নির্দিষ্ট গানের সঙ্গে পরিচিত। মেয়েদর্শকদের ভিড়ও অবিশ্যি পুরুষদর্শকদের মতই বিচিত্র। সংখ্যায় অনুপাতে সেখানে রাজবংশী ও মদেশিয়া মেয়েদেরই ভিড় বেশি। কিন্তু এই গানের অনুষ্ঠানে শহরের মেয়েরাও অনেকে এসেছে–জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, ধূপগুড়ি, আলিপুর দুয়ার থেকেও। গায়কের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না–চিত্রা সিং, অনুপ জালোটা, মান্না দে। তা ছাড়া আরো তিনজন, তত খ্যাতনামা নয় এমন, গায়ক। তাদের দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু হয়, ভিড় তখনো জমাট নয়। অনেকেই বাইরের মাঠে, এমন কি রাস্তাতেও, জটলা পাকায়, চা-সিগারেট খায়। একটা ছোট্ট তাড়ির দোকান বসেছে মাঠের ভেতর সেই ইমিটেশন গহনার দোকানের পেছনে। অনেকেই একটু এলোমেলো হাঁটতে-হাঁটতে অন্ধকারের দিকে গিয়ে সেই তাড়ির দোকানে এক পাক ঘুরে আসছে। বাইরের দলগুলি অত গা ঢাকাও দেয় না। তারা বেশ হৈ-হৈ করতে-করতে সেদিকে যায়, ফিরে আসে।

মান্না দে-কে দিয়েই অনুষ্ঠান আসলে শুরু হল। একটা ভজন দিয়ে শুরু করলেন। তারপর, একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলেন। এই দুটো গানের পর একটু বিরতি নিলেন, কিছুক্ষণ হার্মনিয়াম বাজালেন, তবলা, গিটার এগুলো একটু বাধাৰ্বাধি হল, তারপর একটু গুনগুন করলেন–সেটাও মাইকে শোনা গেল, তারপর একেবারে হঠাৎ একটা কলি গেয়ে উঠে থেমে গেলেন, দর্শকরা হাততালি দিয়ে উঠল। হাততালি শেষ হলে তিনি গানটা গাইবার মত করে গাইতে আরম্ভ করেন মাইক থেকে মুখটা একটু সরিয়ে। সে-গানটা খুব তালের গান নয়, কিন্তু টানা সুরের চলন আছে। উঁচু পর্দায় টানা সুরের সেই চলনে একটা উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল। ছড়াচ্ছিল কিন্তু পুরো ছড়াতে না-ছড়াতেই গানটা, যেন খানিকটা আচমকা শেষ করে দিয়ে বানলা লোকসঙ্গীতের সুরে একটা আধুনিক গানের প্রথম স্তবকটি গেয়ে দেন। প্রথম চরণটি শুরু হতেই দর্শকদের ভেতর ই-স এরকম একটা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই আওয়াজের ভেতর আকস্মিকের উত্তেজনার চাইতে হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার বিস্ময় ছিল। সেই প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর দর্শকরা গানটা যেন আস্বাদ করে। আর, এই গানটাতেই মান্না দে যেন বুঝে যান, দর্শকদের একটু অন্য রকম ভাল লাগছে। গানটা তিনি ফিরে-ফিরে গান আর সেই ফিরে-ফিরে গাওয়ায় প্রক্রিয়ায় দ্রুত হওয়া সত্ত্বেও গানটা থেকে নাটক ঝরে যেতে থাকে।

মান্না দের পরে এলেচ চিত্রা সিং। কিন্তু দলবলসহ মান্না দের প্রস্থান, তারপর পর্দা নেমে আসা, দর্শকদের অনেকেরই বাইরে বেরিয়ে আসা, এই সব মিলে একটা বিরতির মতনই হয়। বেশ কিছুটা পরে, চিত্রা সিং মঞ্চে বসলে পর্দা ওঠে। তারপর যন্ত্রপাতি বাধাবাধি শুরু হয়। তখন বোঝা যায় দর্শকরা বেশ স্থির হয়ে বসেছে, তখন, চিত্রা সিং মাইকেই একটু গুনগুন করে নেন। বেশ নরম গলার সেই গুনগুনানিতে সাড়া প্যান্ডেল ভরে যায়। তারপর গুনগুনানি থামে, বাজনাগুলো হঠাৎ জোরে একসঙ্গে বেজে উঠে একটা সুর বাজিয়ে ফেলে আধ মিনিটটাক। সেটা থেমে গেলে মাইকে ঘোষণা শোনা যায়, শ্রোতাদের কাছে শ্ৰীমতী চিত্রা সিং-এর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুরোধ তারা যেন এই অনুষ্ঠান ক্যাসেট বা টেপ না করেন। যদি এরকম করা হয় তাহলে তিনি তখনই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেবেন। এই ঘোষণাটা দুবার করা হয়। চিত্রা সিং হার্মনিয়ামটা একটু জোরে বাজিয়ে নিয়ে দু হাত তুলে নমস্কার করেন। তারপর তার প্রথম গানটি ধরেন।

শুরু করতেই মেয়েদের ভেতর থেকে আবছা একটা গুনগুনানি ওঠে, সমবেত গুনগুনানি। উঠেই থেমে যায়। কিন্তু তাতে বোঝা যায়, গায়িকার সঙ্গে-সঙ্গে অনেকেই মনে-মনে সুর ভাজছে। চিত্রা সিং-এর অনুষ্ঠানেরই মাঝামাঝি এই মনে-মনে সুর ভঁজাটা প্রকাশ্য হয়ে পড়ল। মনে হয়, গায়িকা কিছুটা উৎসাহই দিলেন দর্শকদের এই সক্রিয়তায়। একটু মৃদু হাসলেন। তারপর সে-গানটা শেষ হতেই একটা দ্রুত লয়ের ভজন গেয়ে উঠে, দর্শকদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন, আপনারাও গান, তারপর একটা লাইন গেয়ে যেন অপেক্ষা করেন দর্শকদের প্রতিধ্বনির জন্যে। আর প্রতিধ্বনি ওঠেও। একটু ধীরে বটে কিন্তু বেশ উল্লসিত প্রতিধ্বনি। আরো দু-তিন রণ এরকম গাইবার পর চিত্রা সিং হঠাৎ হার্মনিয়াম ছেড়ে উঠে দাঁড়ান-ভজনের ছন্দে-ছন্দে দু হাত দু দিকে প্রসারিত করে নিজে ত যেন প্রায় ভজনতাড়িত হয়ে ওঠেনই, সঙ্গে সঙ্গে দু-হাতের ইঙ্গিতে দর্শকদের গাইতে বলেন, উইং থেকে ছুটে এসে একজন তার হাতে একটা মাইক ধরিয়ে দেয়, তিনি বা হাতে মাইকটা নিগে, ডান হাতে বাতাসে হাততালি দেন, মাথাটা তালে-তালে দোলান, তাঁর নিমীলিত চোখে ভজনের ঘোর বোঝা যায়, তার চুলের দোলনেও সেই একটু চাপা নেশা। দর্শকরা প্রথমে তার মাথার দোলনের সঙ্গে তাল রেখে মৃদু হাততালি দিতে থাকে, কিন্তু গানের দ্রুততার সঙ্গতিতে সে-হাততালি উচ্চকিতও হয়, দ্রুতও হয়, অনেকটা কীর্তনের আসরের মত, চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি অনেক সময় চুপ করে শুধু মাথা দুলিয়ে যান আর দর্শকরা হাততালি দিয়ে গাইতে থাকে। সেটাও আরো একটা পর্যায়ে উঠে সেই চুড়াতেই শেষ হয়। চিত্রা সিং দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আনত হন। ধীরে ধীরে পর্দা নেমে আসে। সমস্ত আসরটা যেন একটু আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

সেই আচ্ছন্নতা কাটতে একটু সময় লাগে কিন্তু দর্শকরা বড় একটা বাইরে যান না, মোটামুটি যে যার আসনে বসেই থাকেন! পর্দাও তাড়াতাড়িই ওঠে। স্টেজের আলো ও চিত্রা সিং-এর পোশাক একটু বদলেছে! এবার তার গলাতে অন্য সুর খেলা করে–একটু আদরকাড়া সুর, বালগোপালকে নিয়ে। কিন্তু সে বালগোপালও দর্শকদের চেনা। এটাও যেন তাদের জানা যে এই দ্বিতীয় বৈঠকে তাদের গলা মেলানো বারণ, গানগুলোও গলা মেলানোর নয় অবিশ্যি।

অনুপ জালোটার বেলায় দর্শকদের এই পূর্বজ্ঞানই প্রকাশিত হয় অন্য ভঙ্গিতে। চিত্রা সিং-এর পর তার আসর বাসার আগেও একটা বিরতি-মত হয়। পর্দা ওঠার পর তিনিও কিছুটা সময় নেন দর্শকদের সঙ্গে তার উপস্থিতির একটা সংযোগ তৈরি করতে। বারবার হার্মনিয়াম বাজান আর দর্শকদের দিকে তাকান, যেন চেনা লোক খুঁজছেন এমন ভঙ্গিতে। কিন্তু ওটা একটা ভঙ্গিই মাত্র। মঞ্চের সব আলো তারই ওপর। সেই আলোর পর্দা ভেদ করে তার পক্ষে দশর্কদের কাউকে দেখা সম্ভবই নয়! কিন্তু দর্শকরা ত তার এই ভঙ্গি দেখছিল ও সেই ভঙ্গিতে সাড়াও দিচ্ছিল গানের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ। তৈরি করে। অনুপ জালোটা ঐ রকম আঁতিপাতি খুঁজতে-খুঁজতেই খুব চাপা স্বরে একটা উর্দু গজল ধরেন, যেন গাঢ় স্বরে কেউ নিভৃতে নিজের সঙ্গে কথা বলছে। ময়নাগুড়ির মত একটা জায়গায় প্রধানত রাজবংশী শ্রোতাদের সামনে উর্দু শায়েরের মেজাজে অনুপ জালোটার সেই গান কেমন মোহ তৈরি করে। যতই কেন না আসাম-বিহারের দর্শক আসুক, যতই কেন না শিলিগুড়ি-বালুরঘাটের দর্শক আসুক–এদের মধ্যে বড় জোর কেউ-কেউ হিন্দিভাষী। কিন্তু উর্দুর সূক্ষ্ম রসিকতায় আপ্লুত হয়ে যায় উর্দু ভাষা থেকে এত দূরবর্তী এই দর্শক আর গায়ককে বাহবাও জানায় উর্দুরীতিতেই। অনুপ জালোটা যে এই উর্দু গজলেই আটকে থাকেন তা নয়। কিন্তু প্রথম দুটি গজল ঐ ধরনের গেয়ে যেন ভুলিয়েই দেন একটু আগে চিত্রা সিং এখানে আর-এক রকম গানে কী রকম মোহ তৈরি করেছিলেন শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে। অনুপ জালোটা এরকম দুটি গান গাওয়ার পর মৃদু হেসে হিন্দিতে বলেন, আমি আপনাদের সেবার জন্যে এখানে এসেছি। আপনাদের হুকুম মত গাইব। কিন্তু সবাই মিলে হুকুম করলে ত শুনতে পাব না। আমার একটা গান শেষ হলে আমিই জানতে চাইব। তখন আপনাদের যার গুলা আমার কানে পৌঁছবে, তার ফরমায়েশ মত আমি গাইব। অনুপ জালোটা তার এক-একটা গানে দর্শকদের স্তব্ধ করে দিয়ে, রুমালে মুখে মুছে, হেসে বলেন, ফরমাইয়ে। সমবেত চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই তিনি একটা গান ধরে বসেন। হয়ত গানটি তার আগেই ঠিক করা ছিল কিন্তু দর্শকদের ঐ ফরমায়েশের অধিকারের ফলেই অত বড় প্যান্ডেলভর্তি হাজার-হাজার দর্শকের সঙ্গে গায়কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। যতক্ষণ গান হয়, ততক্ষণ দর্শক গায়কের এই সম্পর্কেরই নানা দিক উন্মোচিত হতে থাকে। কখনো তিনি হেসে দর্শকদের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেন। কখনো মাথা ঝাঁকিয়ে একটা লাইন ফিরে-ফিরে গাইতেই থাকেন এক নিশ্চয়তায় যে, যে-দর্শকদের তিনি দেখতে পাচ্ছেন না তারা কী ভাবে তাকে ও তার গানকে নিচ্ছে।

.

১৭৪. সাংস্কৃতিক ফাংশনের বিবরণ–ভিডিও

এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে ত উত্তরখণ্ড সম্মিলন উপলক্ষেই–যদিও যারা অনুষ্ঠান করছে তারা উত্তরখণ্ডী নাও হতে পারে। কিন্তু উত্তরখণ্ডের সঙ্গে তাদের কোনো এক ধরনের সহানুভূতি যদি না থাকত তবে ত তারা নিজেরাই আলাদা ভাবে টাকা খাঁটিয়ে এরকম অনুষ্ঠান করতে পারত। সে-সহানুভূতি হয়ত রাজনৈতিক নয়, বা শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়। সে-সহানুভূতি হয়ত তৈরি হয়েছে। এই উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ব্যবসাপাতি বা কাজকর্মেরই সূত্রে। এমন-কি, হয়ত ব্যক্তিগত চেনাজানারই সূত্রে। কিন্তু যে-সূত্রেই হোক, সহানুভূতিটা ত সত্য। আবার উল্টো দিকে উত্তরখণ্ডের এত বড় একটা সম্মিলন যারা সংগঠিত করেছে তারা ত জানে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এই সম্মিলনেরই একটা অংশ। একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করলে উত্তরখণ্ড সম্মিলনের কথা সারা উত্তরবঙ্গে অন্তত সবাই ভালভাবে জানতে পারবে–প্রচারের এমন সহজ উপায় হিশেবেও তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটিকে দেখে থাকতে পারেন।

কিন্তু প্রথম ধাক্কায় মনে হয় উত্তরখণ্ড সম্মিলন আর এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেন পরস্পরের বিপরীত কাজ করছে। সম্মিলনে উত্তরখণ্ড বলতে বোঝায় রাজবংশীদের স্বাতন্ত্র্য, অতীত গৌরব, বর্তমান বঞ্চনা, বিক্ষোভ, ভবিষ্যতের কর্মসূচি। আর সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে চলতে থাকে প্রধানত হিন্দি-উর্দু গান বা অন্তত বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিশেবে ঐতিহাসিক নাটকের ধারায় যাত্রা, বা, এমনকি ব্রেখটের নাটকের বাংলা অনুবাদ, তা ছাড়া ভিডিও ফিল্ম। এর প্রত্যেকটাই ত দর্শকদের ভারতের বৃহত্তর সত্তা, এমনকি বিশ্বের সত্তার কথাও মনে করিয়ে দেয়, অন্তত সেরকমই মনে করিয়ে দেয়ার কথা। তা যদি হয়, তা হলে সকালে সম্মিলনে যে-স্বাতন্ত্র্যের দাবি তোলা হচ্ছে, সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে ত সেই স্বাতন্ত্রের দাবিই নাকচ হয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যই আরো বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তা হলে, এই সম্মিলনের সঙ্গে এমন অনুষ্ঠান যুক্ত হল কেন?

কথাটাকে আরো একটু বাড়িয়েও ভাবা যায়। অনুষ্ঠানগুলিতে দর্শকদের পূর্বজ্ঞানের ব্যাপারটি এতই প্রতিষ্ঠিত যেন মনে হয় এই অনুষ্ঠানগুলি না হলেও দর্শকরা এ গুলিতেই সব সময় আবিষ্ট থাকে। তাই যদি হবে, তা হলে এই উত্তরখণ্ডের ত কোনো ভিং গাড়বার মত মাটিই নেই।

নাকি কোথাও কোনো সংযোগ অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে? কোথাও কোনো সংযোগ আরো দৃঢ় হচ্ছে–অদৃশ্য? পরিচিত ঐতিহাসিক কাহিনীর ভেতর বম্বে ফিরে দেখা ক্যাবারে আর বেলিডামে, জায়গা হয়ে যায় যে-প্রক্রিয়ায়, খবরের কাগজে গণধর্ষণের রিপোর্ট পড়তে অভ্যস্ত দর্শকের সামনে একই মেয়ে দুবার দুভাবে ধর্ষিত হয় যে কারণে, চিত্রা সিং-এর ভজন গানের উন্মাদনা আর অনুপ জালোটার দরবারি গানের কারুকাজ দর্শকের ভাল লেগে যায় গান শোনাবার যে-বৈষয়িক কৌশলে, এমনকি ভিডিওর মত আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার এই পশ্চাত্তম অঞ্চলে ঘটে যায় যে-স্বাচ্ছন্দ্যে–সেই প্রক্রিয়া, কারণ, কৌশল ও স্বাচ্ছন্দ্যের ভেতরই নিহিত থাকে বিচ্ছিন্নতার এক প্রবল টান। নদীতে যেমন অনেক সময় ওপরের স্রোত যত বেগে ছেটে, তার নীচে এক স্রোত তত বেগেই তার বিপরীতে ছোটে, সমাজবদ্ধ মানুষের বেলাতেও হয়ত তেমনি। এই সব যাত্রা-গানবাজনা যত বেশি সমস্ত মানুষকে এক করে ফেলে, ততই বেশি মানুষ নিজের ভেতর গুটিয়ে যেতে চায়। শামুকের মত নয়, কারণ, শামুকের গুটিয়ে যাওয়ার মধ্যে আত্মরক্ষাই মাত্র থাকে, কোনো প্রতি-আক্রমণের হিংস্রতা থাকে না।

সারা রাত্রি ধরে ভি-সি-আর-এ চারটি ফিল্ম দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল বুধবার। পরদিন শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান। আগের দিনটা এতে একটু হালকা থাকে। কারণ, ভিডিও-ফিল্ম দেখতে দূরের– দর্শকরা নিশ্চয়ই আসবে না, গ্রামের দর্শকরাও আসবে না–স্থানীয় দর্শকরাই সারা রাত ধরে যতটুকু পারে দেখবে। একটা দিন বাদ দিলেই ভাল হত, কিন্তু বাদ দেওয়াটা নেহাৎ খারাপ দেখায় বলেই ভিডিও ফিল্মের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। একটা ইংরেজি–ড্রাকুলা। দুটো হিন্দি–শোলে আর শাহেনশা। একটা বাংলা–প্রতিকার। এখন জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে হাট অনেক বেড়েছে। বড়বড় কয়েকটি হাটে ভিডিও-পালারও হয়েছে। প্রথমে কথা ছিল, কলকাতায় কোনো ভিডিও-পার্লারের মালিকের সঙ্গে ব্যবস্থা করা হবে। সবই যখন বাইরে থেকে আসছে, ভিডিওটাকে আর লোক্যাল রেখে কী হবে? কিন্তু হলদিবাড়ি হাটের ভিডিও-পার্লারের মালিক-ভদ্রলোক এখানে এসে ধরাধরি করেন। ভদ্রলোকের বাবা হলদিবাড়ির বিখ্যাত জোতদার ছিলেন। ছেলেরা জমিজায়গা বিক্রি করে দিয়ে প্রায় সবাই বাইরে চলে গেছে। এক ছেলে ত বিদেশেই থাকে। এক এই ভদ্রলোকই এখানে থেকে গেছেন। পৈতৃক বাড়ির অংশ আছে। নানা রকম ব্যবসা নানা সময় করেছেন–কিছুদিন হল এই ভিডিও-পার্লার খুলেছেন ওদের পরিবার বীরেনবাবুর পুরনো মক্কেল–এখন যদিও মামলা-মোকদ্দমার কোনো ব্যাপার নেই। ভদ্রলোক এসে বীরেনবাবুকে ধরেন। বীরেনবাবু তাঁকে, নকুলবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। উনি কথা দেন, এদের লিস্ট অনুযায়ী কলকাতা থেকে নতুন প্রিন্ট নিয়ে আসবেন। উদ্যোক্তারাও চাইছিলেন না ভিডিও-ফিল্ম ব্যাপারটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে। শেষে, এই ভদ্রলোকের প্রস্তাবেই রাজি হন।

কিন্তু কী কী ফিল্ম আনা হবে–এটা ঠিক করতে অনেক সময় যায়। একটা গোপন প্রস্তাব নিয়ে কিছু নাড়াচাড়া হয় যে শেষের দিকে একটা ব্লু ফিল্ম দেখানো হোক। অত রাতে তেমন কেউ থাকবেও না, যদি থাকেও ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু, শেষে, গোপন ভাবেই ঠিক হয়ে যায় যে ব্লু ফিল্ম আনা হবে না কারণ পুলিশ ঝামেলা করতে পারে। তার চাইতে এ্যাডাল্ট-হরর অনেক নিরাপদ। খানিকটা ব্লু থাকে কিন্তু টানা হয়, মাঝে-মাঝে হঠাৎ। তা ছাড়া হররটাই প্রধান। কিছু এ্যাডাল্ট-হরর ছবি নিয়ে কথাও হয়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় ড্রাকুলাই ভাল। ঐ ভিডিওর ভদ্রলোকই খবর দেন, এটা নতুন ড্রাকুলা, সম্পূর্ণ নতুন ভাবে শুধু ভি-সি-আরের জন্যেই তৈরি। শশালের ব্যাপারে মতৈক্য হয় সবচেয়ে দ্রুত। ভদ্রলোকই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যদি শাহেনশার একটা প্রিন্ট পান, আনবেন কি না। অমিতাভ বচ্চনের শাহেনশার পোস্টার বারবার দেয়া সত্ত্বেও, মুক্তির তারিখ বারবার স্থির হওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই মুক্তি করতে দেয়া হচ্ছে না। বাংলা ছবির বেলায় কোনো পছন্দ ছিল না–এমন একটা ছবি হলেই বেটা সবার ভাল লাগে, মেয়েরা এলে ত ঐ প্রথম ফিল্মটা দেখেই চলে যাবে।

শেষ পর্যন্ত এই চারটি ফিল্মই এসে যায়। ঐ ভদ্রলোকই ঠিক করে দিলেন, প্রথমে বাংলা ফিল্মটাই হোক, তারপর শোলে। তারপর ড্রাকুলা। শেষে শাহেনশা। কিন্তু পরে এটা বদলাতে হল। শোলে লম্বা ছবি, অনেকের দেখা। সেটা বরং শেষে থাকুক। শাহেনশা একেবারে নতুন ছবি–সেটাই বরং আগে দেখানো হোক। শেষে তাই ঠিক হল। কিন্তু সে-ঠিক হওয়ার পথেও নানা বাধা। কারণ, বেশ জাগ্রন্থ অবস্থায় শোলের ঐ পরিচিতি সংলাপগুলি শোনার ইচ্ছে অনেকেরই ছিল। শেষ রাতের ঠাণ্ডায় ঘুমের মধ্যে শোলে জমবে না। তখন যেন রাত কাটানোর জন্যেই ঝিমুতে-ঝিমুতে দেখা।

শোলে আগে দেখার পেছনে আর-একটা মতলব ছিল। তাড়ির দোকানটা তখন পর্যন্ত চালু থাকবে। মদ খেতে-খেতে শোলে দেখা–এ রকম সুযোগ ভাবা যায় না। কিন্তু শাহেনশার পক্ষেই মত বেশি হল। যারা শোলের পক্ষে ছিল, তারাও রাজি হয়ে যায়। যাই হোক অমিতাভ বচ্চনের স্না-দেখা ছবি! কত আর খারাপ হবে?

বাংলা ফিল্মটা সাড়ে দশটার মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। মাঝখানে কোনো ইন্টারভ্যাল দেয়া হয়নি। বাংলা ফিল্মটা মেয়েরাই বেশি দেখল। কিন্তু সে-ফিল্ম শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই প্যান্ডেল প্রায় ভরে যায়। এত লোক হবে এটা আশা করা যায় নি। টেলিভিশন সেটটা একটু উঁচু টুলের ওপর বসানো হয়েছে–টিনের বেড়ার ওপরের স্কু আটার জন্যে সে-টুলটা বানানো হয়েছিল। কিন্তু স্টেজের ওপর না রেখে, টুলটা রাখা হয়েছে প্যান্ডেলের মাঝামাঝি–পুব দিকের বেড়া ঘেষে। দর্শকরা বসেছে টিভিটা ঘিরে। সামনের দিকে যারা, তারা বেশি পাশে যেতে পারে নি, কিন্তু পেছনে যারা তারা পাশেও অনেকটা ছড়িয়েছে।

 ঐটুকু স্ক্রিনের আলো থেকে প্যান্ডেলের ভেতরে মুহূর্তে-মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তরের নানা দৃশ্য, পাহাড় থেকে সমদ্র মধ্য যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিস্তারিত হয়ে যায়। আর সেই প্রায় তিন ঘন্টা ব্যাপী বাস্তবের ওপরেই নেমে আসে মধ্যযুগের এক পাশ্চাত্য প্রাসাদ–তাতে মৃত্যুর পর নির্বিকল্প এক মুখোশের মত মুখ নিয়ে এক দীর্ঘদেহী মানুষ, তার বয়স বোঝা যায় না, তার চোখের দৃষ্টিতে পলকের ছায়া পড়ে না। ময়নাগুড়ির ঐ প্যান্ডেলের মাথায় শেষ রাতের শিশির পড়ে টুপ টুপ, অঝোরে, আর, প্যান্ডেলের ভেতরে দর্শকদের নিদ্রালু চোখের সামনে একটার পর একটা হত্যা ঘটে যায়। প্রত্যেকটা হত্যাকাণ্ড দেখানো হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে। যাকে খুন করা হচ্ছে তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ নানা ক্লোজ-আপে দর্শকের সামনে ঘোরাফেরা করে। হত্যার পর হত্যার পর হত্যা, রক্তের পর রক্তের পর রক্তে মানবশরীর যখন অবান্তর হয়ে যায়, তখন সেই যান্ত্রিক অবান্তরতায় মেয়েদের শরীর মোমের শরীরের মত পর্দা জুড়ে শুধু ঘোরে। যেন, কোনো উচ্চারণ নেই, কোনো ভাষা নেই, বোমায় বিধ্বস্ত কোনো নগরের মত নারীশরীর আছে; শুধু শরীর। সেই সম্পূর্ণ অচেনা কাহিনীর শেষে গব্বর সিং-এর চিরপরিচিত কণ্ঠস্বরে ড্রাকুলাও উত্তরখণ্ড সম্মিলনের আত্মীয় হয়ে ওঠে।

.

১৭৫. শ্রীদেবীর নাচের জন্য ট্রাফিক কন্ট্রোল

 বৃহস্পতিবার সকাল দশটা নাগাদ মনে হল ময়নাগুড়ি শহরটা পুলিশ দখল করে নিয়েছে। তিস্তা ব্রিজ থেকে যে রাস্তা ময়নাগুড়িতে ঢুকেছে, আর ময়নাগুড়ি থেকে যে রাস্তা দুটো মালবাজারের দিকে ও আসামের দিকে চলে গেছে–সেই তিনটি রাস্তাতেই পুলিশভর্তি গাড়ি চলে গেল। মালবাজারের রাস্তায় একটি, আসামের রাস্তায় তিনটি, আর ব্রিজের রাস্তায় দুটি। তা ছাড়া একটা জিপ গাড়ি নিয়ে ডি-এস-পি সাহেব চৌপত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আসামের রাস্তায় চলে গেলেন ময়নাগুড়ি থানার ওসি আর জলপাইগুড়ির দিকে থাকলেন জলপাইগুড়ির ও-সি। বেলা দশটা থেকে বারটা এই সব ছোটাছুটিতেই কাটল। বেলা বারটার পর থেকেই বোঝা গেল পুলিশ সমস্ত ট্রাফিকের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। আসামের রাস্তায় মাইল,তিন আগে থেকে, জলপাইগুড়ির রাস্তায় তিস্তা ব্রিজ পর্যন্ত, কোনো গাড়িকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না কিন্তু কোনো গাড়ি আটকাচ্ছেও না। মিনি বাস বা লাইনের বাসগুলোকে স্পিড়ও কমাতে দিচ্ছে না–প্যাসেঞ্জার নামানো-ওঠানোর জন্যে অনুষ্ঠানের জায়গায়, চৌপত্তিতে, চৌপত্তির পরে এক জায়গায় মাত্র এক মিনিটের জন্যে দাঁড়াতে দিচ্ছে। মালবাজারের দিকে গাড়িগুলোকে টাউনের ভেতর ঢুকতেই দিচ্ছে না–ভারতী সিনেমার কাছ থেকে বের করে দিচ্ছে। ফলে, ময়নাগুড়ির চৌপত্তির অন্য দিনের তুলনায় গাড়ির ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে যদিও মানুষের ভিড় অনেক বেড়ে গেছে। অনেকটা হরতালের দিনের মত লাগছে।

বেলা একটা-দেড়টা থেকে বাইরের ট্রাক বাস আসতে শুরু করে। পুলিশ কোনো ট্রাক বাসকেই শহরের ভেতরে ঢুকতে দেয় না। অনুষ্ঠানের জায়গা থেকে মাইলখানেক দূরে আসামের রাস্তায় একটা বড় মাঠে সেই ট্রাক-বাসগুলোকে ঢোকানো হচ্ছে। সারি দিয়ে দাঁড়ানো ট্রাকবাসগুলোকে একটা টোকেনও দেয়া হচ্ছে–গাড়ির নম্বর ও ড্রাইভারের নাম লিখে রাখা হচ্ছে। প্রথম দিকের কয়েকটা বাসট্রাকের পারমিট আছে কিনা দেখা হয়েছিল। তা নিয়ে একটু গোলমাল দেখা দিতেই ডি-এস-পি সাহেব এসে ময়নাগুড়ির ওসিকে বলে দেন, পারমিট দেখতে হবে না। ডি-এস-পি সাহেব চলে যাওয়ার পর দুই হেড কনস্টেবল মাঠের ভেতরে সারি দিয়ে দাঁড়ানো গাড়িগুলোতে গোপনে পারমিট দেখতে চায়। পারমিটের বদলে তারা দশটা টাকা দেয়। পাঁচটাকাই দিতে চেয়েছিল কিন্তু কনস্টেবলরা তাদের বোঝায় কত ভাগ করতে হবে। তখন থেকে দশ টাকাই ঠিক হয়ে যায়। কয়েকটা ট্রাক-বাস আসতে-আসতেই এই সব হাঙ্গামা মিটে যায়। নতুন গাড়ি মাঠে ঢুকেই জেনে যায়–কনস্টেবলকে দশ টাকা দিতে হবে। ঐ দুই কনস্টেবলকে আর-কেউ ডাকাডাকি করে না, তারা ওখানে একটা বাসের ছায়ায় পাতা শতরঞ্জির ওপর বসে থাকে।

 তিস্তা ব্রিজ দিয়ে প্রথম গাড়ি আসতে শুরু করে আর-একটু পর, বেলা তিনটে নাগাদ। ওদিকে কাছাকাছির মধ্যে খালি মাঠ না থাকায় গাড়িগুলোকে একটু বেশি দূরে, প্রায় মাইল দেড়েক দূরে এক মাঠের ভেতর ঢোকানো হয়। সে মাঠটাও নিচু। ফলে রাস্তা থেকে মাঠের ভেতর নামতে গাড়িগুলোকে একটু সামলাতে হয়। মাঠটা বড় হলেও একটু দূরেই জংলা গাছপালা শুরু হয়ে গেছে। সেদিকে কোনো ট্রাক বা বাসই যেতে রাজি হয় না।

তিস্তা ব্রিজের দিক থেকে প্রাইভেট গাড়ি ও ট্যাক্সি অনেক বেশি আসতে থাকে। তারা ঐ মাঠে নামতে অস্বীকার করে আর ঐ মাঠে নেমে অতটা হেঁটে যেতেও তাদের আপত্তি। সেখানেও বেলা চারটে নাগাদ বেশ একটা গোলমাল পেকে ওঠে। ডি-এস-পি সাহেবকেও আসতে হয়। যারা ডি-এস-পি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন তারা অনেকেই দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ির ব্যবসায়ী বা চাকুরে। কলেজের শিক্ষকরাও দুটো ট্যাক্সিতে এসেছে। ব্যাপারটা পাকিয়ে ওঠার আগেই ডি-এস-পি বলে দেন, দেখুন, ট্রাক, বাস বা মিনিবাসকে এখানে নামতে হবেই, প্রাইভেট গাড়ি ও ট্যাক্সির জন্যে সামনে একটা পয়েন্ট আমরা করে দিচ্ছি ঐ পয়েন্টে গিয়ে প্যাসেঞ্জারদের নামিয়ে আবার এখানে চলে। আসতে হবে। এতে আপনারা রাজি থাকলে, বলুন, নইলে, সবাইকেই এখানে নামতে হবে।

সমর্থন ও আপত্তির একটা গুঞ্জনের মধ্যে হঠাৎ একজন জিজ্ঞাসা করে, তার মানে ফেরার সময়। আবার এখানে এসে উঠতে হবে? এতটা হেঁটে এসে?

ডি-এস-পি ধমকে ওঠেন, বাস-ট্রাকের প্যাসেঞ্জারদের যে এখান থেকেই হাঁটতে হচ্ছে সেটা দেখছেন না। আপনারা সময় নষ্ট করবেন না, যা করার এখনি করুন। এর মধ্যে আবার একটা কণ্ঠস্বর শোনা যায়, অত রাতে এতটা রাস্তা হেঁটে আসার সময় ছেনতাই-টেনতাইয়ের দায়িত্ব কে নেবে।

ডি-এস-পি সাহেব বলেন, রাস্তায় কাল সকাল পর্যন্ত পুলিশ থাকবে। বলে রাস্তার ওপর দাঁড়ানো একটা মারুতিকে সোজা চলে যেতে বলেন। মারুতির ড্রাইভার অত কিছু না বুঝে সোজা চলে যায়। তার পেছনে দাঁড়ানো গাড়িগুলোও না জেনে তার পেছন-পেছন যায়। জলপাইগুড়ির ও-সিকে সেই আগের পয়েন্টে পাঠিয়ে দিয়ে ডি-এস-পি তার গাড়িতে ওঠেন।

জলপাইগুড়ির ও-সি তার জিপগাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে নামে–তারপর ডি-এস-পির এগিয়ে আসা জিপের দিকে হাটে। ডি-এস-পি গাড়ি থামাতেই ও-সি বলে, স্যার, আগে যে ব্যবস্থা ছিল সেটাই রাখুন স্যার, না-হলে এইটুকু রাস্তায় সেই মানুষ আর গাড়িতে গোলমাল বেধে যাবে।

ডি-এস-পি গাড়ি থেকে নামেন! তারপর ওসিকে নিয়ে আবার আগের জায়গায় আসতে থাকেন হেঁটে। প্রাইভেট গাড়ির ধুলোয় রাস্তা অন্ধকার হয়ে আসে। ডি-এস-পি চাপা গলায় বলেন, ঠিকই বলেছেন, গাড়িকাড়ি মিলিয়ে একটা স্ট্যামপিড হয়ে যাবে।

সেই পার্কিঙের মাঠটাতে এসে ডি-এস-পি হাত দেখিয়ে বাকি প্রাইভেটগাড়িগুলোকে আটকে দিয়ে মাঠে ঢুকতে বলেন। সেই সব নতুন গাড়ির লোকরা জানেও না যে ইতিমধ্যে এখানে কী হয়েছে। ফলে তারা মাঠে ঢুকে যায়। আর যে-সব প্রাইভেট গাড়ির লোকজন ওখানে নামতে আপত্তি করেছিল, তারাও অনেকে মাঠে নেমে গেছে। কারণ, গাড়ির ভেতর কারো কারো ফ্লাস্কে চা আছে, কারো কারো মদের বোতলও আছে। গাড়ি তাদের খানিকটা দূর এগিয়ে আবার যদি ফিরেই আসে তা হলে লাভটা কী? তার চাইতে বরং এখানে এই মাঠের মধ্যেই গাড়িটা রেখে হেঁটে-হেঁটে যাওয়া ভাল–এ রকম ভেবে তারাও মাঠের ভেতরই ঢুকে যায়। এ নিয়ে আর-কোনো গোলমাল হয় না। যে-গাড়িগুলোকে প্রথমে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, সেগুলো ফিরে এলেডি-এস-পি, ওসিকে বলেন, আপনি এখানেই থাকুন।

ততক্ষণে যে-তিনটি দিক থেকে ট্রাক বাস গাড়ি আসছিল সেই তিনটি দিকই সংগঠিত হয়ে গেছে। আকাশ থেকে যদি তাকানো যেত, তা হলে দেখা যেত তিস্তাব্রিজ থেকে, আসাম রোড থেকে, ডুয়ার্সের রাস্তা থেকে আর এ-ছাড়াও মাঠ দিয়ে, মেঠো পথ দিয়ে, যেন এইটুকু জায়গার সব দিক থেকে পায়ে হটা মানুষ একটা কেন্দ্রের দিকে চলছে। এই এত সব পথ দিয়ে এত হাজার-হাজার মানুষ আস্তে-আস্তে হেঁটে-হেঁটেই সেই কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছে খুব বড় মেলায় তীর্থ যাত্রীরা যেমন হাঁটে। তাতে ধুলো উড়ছে। আকাশ আর মাটির মাঝখানে ধুলোর একটা পর্দাও তৈরি হচ্ছে। সেই পর্দার আড়ালে মানুষজনকে একটু অস্পষ্টও-দেখাচ্ছে। কিন্তু অত মানুষের একসঙ্গে এক গতিতে একটি কেন্দ্রের দিকে হাটার সঙ্গে সেই ধুলোওড়াটুকু মানিয়েও গেছে। এত আর ট্রাক বা বাসের ধুলোর ঝড় নয়, মানুষের পায়ে-পায়ে ওড়া ধুলো। একই কেন্দ্রের দিকে এত মানুষ যায় বলে ধুলোরও যেন একটা প্রবাহ পথ তৈরি হয়।

.

১৭৬. শ্রীদেবীর নাচ : প্রত্যাশা ও প্রতীক্ষা

ময়নাগুড়ির কাছেই জল্পেশে প্রতি বছরই শিবরাত্রিতে মেলা বসে। জল্পেশের কাছাকাছি ময়নাগুড়িই সবচেয়ে বড় শহর আর জল্পেশের মেলাও চলে প্রায় মাসখানেক। ফলে নানা জায়গায় তীর্থযাত্রীরা। ময়নাগুড়ির ওপর দিয়ে যায়, ময়নাগুড়ির মাঠেঘাটে, বারান্দায়, গাছের তলায় অস্থায়ী ডেরা বাধে। শিবরাত্রির দিন ময়নাগুড়ির ওপর দিয়ে আগে পায়ে হাঁটা তীর্থযাত্রীরা যেত, এখন বাস-মিনিবাসের ভিড় লেগে যায়। এসব দেখার অভিজ্ঞতা ময়নাগুড়ির লোকজনের আছে।

কিন্তু শ্রীদেবীর নাচের অনুষ্ঠানটির দিন বেলা চারটে থেকে ময়নাগুড়ি ও তার আশেপাশের যে-চেহারা হল তা সেই বাৎসরিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে কণামাত্র মেলে না। মনে হল, ময়নাগুড়িতে ও তার আশেপাশে কয়েকটা জল্পেশ মেলা একসঙ্গে বসেছে।

আসাম ও বিহারের দিক থেকে যারা ট্রাক-বাসে এসেছে তাদের ট্রাকে ও বাসেই খাবারদাবার পোশাক-আশাক বিছানাপত্র। ডিলাক্স বাসের যে-যাত্রীরা কোনো কোম্পানির দায়িত্বে এসেছে তাদের ত বাসটায় ঘরবাড়ি। ফলে, মাঠের ভেতর গাড়িগুলোকে ঢুকিয়ে দেয়ার পর গাড়ির যাত্রীরা নিজেদের পরিবারের লোকজন বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে দুটো-একটা শতরঞ্জিতে আলাদা-আলাদা হয়ে ছড়িয়ে যায়। কোথাও টিনের মুখ খুলে ডালপুর, আচার, ডালমুট, চানাচুর, প্যারা বেরচ্ছে। শালপাতার ঠোঙাও সঙ্গে আছে, আর আছে জেলিক্যানে জল। কোথাও পাম্প দেয়া কেরোসিন স্টোভের সা-সঁ আওয়াজের ওপর কড়াই চাপানো হয়েছে–লুচি ভাজা হচ্ছে। এমন-কি মাত্র এই স্বল্প অবকাশেও কোথাও-কোথাও তাসের আসর বসে গেছে। মেয়েরা আছে কিন্তু সংখ্যায় তত বেশি নয়–এরকম সব অনুষ্ঠানে। মেয়েদের সংখ্যাই যেমন বেশি থাকে, তেমন নয়। তবে লুচি ভাজা, টিনের বাক্স থেকে খাবার বের করে দেয়া এ-সবের জন্যে ত মেয়েদেরও দরকার হয়। কোনো-কোনো ডিলাক্স বাসে মেয়েদের সংখ্যা বেশ বেশি। সেখানে বড়-বড় কলসীর সাইজের ফ্লাস্কে চাও আছে, ঠাণ্ডা জলও আছে।

ট্রাক, বাস, গাড়ি পার্কিঙের জায়গায় খাবারের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গে মিশে আছে একটু-আধটু মদের গন্ধও। কিন্তু খাবারের গন্ধ এত জটিল যে মদের গন্ধটাও তার সঙ্গে মিশে গেছে–আলাদা করা যাচ্ছে না। অথচ আওয়াজগুলোকে আলাদা করা যাচ্ছে। মেলার মত খুব হৈ-হৈ নেই–মানুষজন নিজেদের ভেতরই কথা বলছে। সে-আওয়াজ আরকতটা দূরেই বা যেতে পারে। দোকানপাটের চিৎকার নেই, গাড়িঘোড়ার আওয়াজ নেই। মানুষজনের গলার স্বরের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে ক্যাসেটে শ্রীদেবীর সব বিখ্যাত গান। ক্যাসেট প্লেয়ারগুলো কাঁধে বা হাতে ঝুলিয়ে লোজন চলাফেরা করছে বলে এক একটা গানের সঙ্গে অন্য গান চকিতে মিশে আবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কোনো-কোনো ক্যাসেটে অন্য গানও বাজছে। কেউ-কেউ খালি গলায় এই সব গানের সঙ্গে গলায় মেলাচ্ছে। কিন্তু তবুও কোনো হট্টগোল তৈরি হচ্ছে না। এমনকি ক্যাসেটও কেউ যেন খুব জোরে বাজাচ্ছে না। কিংবা, হয়ত জোরে বাজানো সত্ত্বেও এতটা বড় জায়গা ও এত মানুষজনের ফলে আওয়াজগুলো চাপা পড়ে থাকছে। এত মানুষজন, এত গাড়িঘোড়ার সঙ্গে আজকাল মাইকের আওয়াজটা এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে, যে, শুধু মাইকটা না-থাকার ফলেই মনে হচ্ছে সব কেমন চুপচাপ।

এই হাজার-হাজার মানুষ অপেক্ষাকৃত শান্ত অনুত্তেজিত হয়ে ঘোরাফেরা করছে, ধীরস্বরে ক্যাসেট বাজিয়ে যাচ্ছে, খাওয়াদাওয়া-তাসখেলার মধ্যেও একটু আনমনা হয়ে আছে, চায়ে বা মদে গলা একটু ভেজালেও তাতে কখনোই মজে যাচ্ছে না, তার কারণ, এই হাজার-হাজার মানুষ একটা স্থায়ী ও অনাটকীয় প্রত্যাশার আবহের ভেতরে ঘোরাফেরা করছে। যদি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কোনো কিছু নিয়ে গড়ে উঠত, তা হলে সেই প্রত্যাশাটাকে এতটা ধীর ও নিশ্চিত লয়ে তাতিয়ে তোলা যেত না–একটা অনিশ্চয়তার উদ্বেগে সে-প্রত্যাশা ফেটে পড়ত। কারণ, শ্রীদেবী এই ভিড়ের প্রায় কারো কাছেই অপরিচিত নয়। শ্রীদেবীর ফিল্ম দেখে, নাচ দেখে এই ভিড় আজকের অনুষ্ঠানে কী দেখতে পারে তা নিশ্চিতভাবেই জানে। এমন-কি, এই ভিড় তার সেই দেখা ও চেনা শ্রীদেবীকেই রক্তমাংসে দেখতে চায়। এমন-কি, যেন শ্রীদেবী যদি এই রাস্তা দিয়ে খোলা গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে চলে যায়, তাতেও এই ভিড়ের অনেকটা তৃপ্তি ঘটবে এটুকু জেনে যে শ্রীদেবীর একটি রক্তমাংসের শরীর আছে। শ্রীদেবী তার রক্তমাংসের শরীর নিয়েই এই সব মানুষের কাছে পরিচিত। সেই রক্তমাংসের শরীর থেকে যে-যৌনতা সিনেমাহলের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ে এই ভিড় সেই যৌনতার টানেই এসেছে। এই ভিড়ের যেন এরকম একটা কাণ্ডজ্ঞানও আছে যে, ছবি থেকে বিচ্ছুরিত যৌনতার একটা মানবিক উৎস আছে এটুকু জানাই যথেষ্ট। কিন্তু সেই কাণ্ডজ্ঞানেরও সীমা একটা খুব শিথিল আছে। এই ভিড়ের ভেতর এমন একটা অসম্ভবের প্রস্তুতিও যেন থাকে যে সিনেমার পর্দা ছাড়াও মঞ্চের বাস্তবতায় রক্তমাংসের শ্রীদেবীকে দেখা ত তার ঐ সিনেমা হলের অভিজ্ঞতারই সম্প্রসারণে, তেমনি, হতেও ত পারে শ্রীদেবীর রক্তমাংসের শরীরকে ছুঁয়ে ফেলা যাবে বা, প্রায় ছুঁয়ে ফেলা যাবে। সিনেমার পর্দায় শ্রীদেবীর বাহুমূলের ভাঁজ বা পিঠের তিনকোনা হাড়ের ওপরকার পেশীর কম্পন পর্যন্ত যার চেনা, সে সেই শরীরটাকে অতটা স্পর্শাতীত নাও ভাবতে পারে–যদি সুযোগ পাওয়া যায়। তাই এই ভিড়ের শান্ত বা অনুত্তেজ প্রত্যাশার ভেতরে একটা হিংস্রতার ইচ্ছাও যে মিশে থাকে না তা নয়। এতটা শান্ত ও অনুত্তেজিত না থাকলে সেই হিংস্রটাও অনুমান করা যেত না।

অথবা, সে-হিংস্রতাটাকে সব সময়ই সত্য বলে ধরে নেয়া হয়।

তাই, পুলিশের পরামর্শ অনুযায়ীই শ্রীদেবী শিলিগুড়ির হোটেল থেকে তার তিন গাড়ি নিয়ে জলপাইগুড়ি হয়ে তিস্তা ব্রিজ দিয়ে ময়নাগুড়িতে এলেন না। কারণ, এই রাস্তা দিয়েই দর্শকরা আসছে। যে-কোনো জায়গায় গাড়ি আটকে যেতে পারে, মানুষজন শ্রীদেবীকে চিনে ফেলতে পারে। শ্রীদেবী ময়নাগুড়িতে এলেন শেবক ব্রিজ হয়ে, ওদলাবাড়ি পার হয়ে, চালসার মোড় দিয়ে, লাটাগুড়ির ওপর দিয়ে। কারণ এই রাস্তাতেই দর্শকদের গাড়ি সবচেয়ে কম, যা আসছে তাও চা বাগানেরই। রাস্তাটাও একটু চওড়া, অনেকটা পাহাড়, ফরেস্ট ও চা বাগান। ফলে হঠাৎ চিনে ফেললেও লোকজন জমে যাওয়ার ভয় ততটা নেই।

শ্রীদেবীর তিনটি গাড়ির প্রথমটিতে তার দেহরক্ষীরা, দ্বিতীয়টিতে তিনি নিজে এবং হয়ত আর-কেউ। সে-গাড়ির কাল কাঁচ তুলে দেয়া। তৃতীয়টিতে তার অন্যান্য সহকারীরা, যারা যন্ত্রপাতি বাজাবে, যারা মেক-আপ দেবে। এই তিন গাড়ি থেকে একটু দূরত্ব রেখে পুলিশের একটা জিপও ছিল।

ময়নাগুড়ির কাছাকাছি এসে পুলিশের গাড়ি আর-দূরে থাকে না–প্রথম গাড়িটার আগে-আগেই চলে। ময়নাগুড়ির রাস্তায় তখন হাজার-হাজার লোক চলছে। পুলিশের গাড়িটা সাইরেন বাজিয়ে দেয়। সেই উচ্চকিত সাইরেনের আওয়াজের সঙ্গে মিলে চার-চারটি গাড়ির হেডলাইট এই রাস্তাভর্তি মানুষজনের গায়ের ওপর হামলে পড়ে। আর, এত মানুষজন এত বেগে রাস্তার দু পাশে ছিটকে যায় যে পাড়িগুলোকে কোথাও বেগ কমাতেই হয় না। চার-চারটি গাড়ি সেই একই বেগে অনুষ্ঠানের জায়গায় এসে নতুন তৈরি ক্যালভার্ট দিয়ে প্যান্ডেলের বা পাশে একেবারে গ্রিনরুমের গেটের সামনে গিয়ে পৌঁছয়। পুলিশের গাড়িটা সরে যায়, তার পেছনে প্রথম গাড়িটাও সরে যায়। দ্বিতীয় কাতোলা গাড়িটা এগিয়ে আসে। তৃতীয় গাড়ির দরজা খুলে কয়েকজন নামে, নেমে দাঁড়িয়েই থাকে। কেউ বুঝতেই পারে না দ্বিতীয় গাড়িটার দরজা খুলে শ্রীদেবী কখন কোল্যাপসিবল গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছেন। গাড়িগুলো থেকে তখন নানা যন্ত্রপাতি নামাচ্ছে নানা লোক।

.

১৭৭. শ্রীদেবীর আগমনের প্রতিক্রিয়া

শ্রীদেবী যে এসেছেন এটা বোঝার আগেই শ্রীদেবী গ্রিনরুমের ভেতরে কয়েকটা কোল্যাপসিবল গেটের আড়ালে চলে যান। শুধু সবচেয়ে বাইরের কোল্যাপসিবল গেটটায় শ্রীদেবীর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের সঙ্গে উত্তরখণ্ড সম্মিলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একজন দাঁড়িয়ে থাকেন–ভেতরে ও বাইরে আর-সর্বত্রই শ্রীদেবীরই লোকজন। গ্রিনরুমের বা স্টেজের প্রধান দরজা প্যান্ডেলের যে-পুব দিকে সেদিক দিয়ে প্যান্ডেলের ভেতরে ঢোকার কোনো পথ নেই। বাইরের বড় রাস্তার নীচের নালার ওপরে যে-কালভার্টটা দুদিনের মধ্যে বানাতে হয়েছে সেটা দিয়ে শুধু এই পুব দিকটাতেই আসা যায়। এখন এই পুব দিক দিয়ে গিয়ে স্টেজ-গ্রিনরুমের পেছন দিয়ে ঘুরে আবার প্যান্ডেলের পশ্চিমে যাওয়া যায় বটে কিন্তু সেটা অনেক ঘুরপথ। একটা গাড়ি রাস্তার দিকে মুখ করে গ্রিনরুমের প্রধান কোল্যাপসিবল গেটের সঙ্গে লাগানো। আর একটা যে-ছোট গেট আছে গ্রিনরুম থেকে বেরবার, ঠিক এর বিপরীত দিকে, সেখানেই বাকি দুটো গাড়ি পার্ক করা। কয়েকটি পুলিশ ও একজন অফিসার গোছের ভদ্রলোক এই পুরো এলাকাটাতে ঘোরাফেরা করছে।

গাড়ি তিনটি ও পুলিশের গাড়িটি এই ক্যালভার্ট দিয়ে ঢুকে যাবার ও লোকজন নেমে যাবার পর সারা রাস্তায় একসঙ্গে আওয়াজ ওঠে–এসে গেছে, এসে গেছে, শ্রীদেবী এসে গেছে। শ্রীদেবী ঐ ভিড়ের মধ্য দিয়েই এসেছেন, পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজিয়েছে, লোকজন তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে জায়গাও দিয়েছে–কিন্তু তখন তারা বুঝতে পারে নি যে শ্রীদেবীই আসছেন। কারণ, এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দর্শক হিশেবে আসার পর থেকে লোকজনকে আজ যে-অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে সে-অভিজ্ঞতা তাদের আগে কখনো হয় নি। ফলে, ময়নাগুড়িতে পৌঁছুনোর পর শ্রীদেবী ব্যাপারটি আর তাদের কাছে প্রধান ছিল না, তাদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে এই ব্যবস্থাটিই। কোথায় বাস বা ট্রাক দাঁড়াবে, কোথায় নামতে হবে, কখন হাঁটতে হবে, কোথা দিয়ে হাঁটতে হবে, কোথা দিয়ে ঢুকতে হবে ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাটা এমনই প্রাধান্য পেতে থাকে যে লোকজন যেন ভুলেই যায় তারা এখানে একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে এসেছে–মাত্র গান শুনতে আর নাচ দেখতে। এ যেন হয়ে দাঁড়ায় সারা দেশের খুব বড় কোনো নেতার মিটিঙ শুনতে আসার মত ব্যাপার। বাড়ি থেকে বেরনো আর বাড়িতে ফেরা পর্যন্ত সমস্তটাই ঐ মিটিঙের উদ্যোক্তাদের ব্যাপার–তার সঙ্গে মিছিলের বা মিটিঙের লোকের কোনো সম্পর্ক নেই। যে রাস্তায় আজ যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ সে রাস্তায় যখন তিন-তিনটি গাড়ি ও পেছনে-পেছনে একটা পুলিশের গাড়ি একই গতিতে ছুটে আসে আর লোকজনকে মুহূর্তে সরে গিয়ে জায়গা করে দিতে হয়, তখন সে-গাড়িতে আর-কে থাকতে পারে, একমাত্র সেই ব্যক্তি ছাড়া যার জন্যে এই রাস্তায় বাকি যানবাহন আজ নিষিদ্ধ, যার জন্যে এই রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ? এই সোজা হিশেবটি আর মানুষের মাথায় ঢোকে না।

কিন্তু একবার যখন রটে যায় যে শ্রীদেবী এসে গেছেন, তখন রাস্তায় একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। রাস্তায় এমনিতে কোনো লাইন ছিল না–সকলেই যে-যার মত হেঁটে যাচ্ছে। প্রায় সব রাস্তাই কার্যত ওয়ান ওয়ে হয়ে গেছে বলে লোকজনের কোনো ধাক্কাধাক্কিও নেই। আসামের রাস্তার লোকজন আসছে পুব থেকে পশ্চিমে। তিস্তাব্রিজের রাস্তার লোকজন আসছে পশ্চিম থেকে পুবে। আর ডুয়ার্সের রাস্তায় লোকজন আসছে উত্তর থেকে দক্ষিণে।

কিন্তু সবাইকেই ত ব্লক অফিসের ক্যালভার্টটা দিয়ে সম্মিলনের মাঠে ঢুকতে হচ্ছে। সম্মিলনের তিনটি গেট থেকে লাইন রাস্তায় বহু দূর পর্যন্ত গেছে। রাস্তার লোকজনকেও লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। ফলে রাস্তায় যারা হেঁটে একমুখো আসছে তারাও আসলে পাঁচ-ছ জনের সারির একটা লাইনেই থাকে। শ্রীদেবী এসে গেছে রটে যাওয়ার পর রাস্তার ওপরের এই লাইনগুলোতে ঠেলাঠেলি পড়ে যায় যেন, এখানে ঠেলাঠেলি করলে তাড়াতাড়ি প্যান্ডেলের ভেতরে ঢুকে যাওয়া যাবে।

এত মানুষ যেখানে সেখানে সামান্য ঠেলাঠেলিতেই একটা হুল্লোড় বেধে যায়। কিন্তু প্যান্ডেলের কাছে ও রাস্তায় পুলিশ অফিসাররা খুব দৌড়োদৌড়ি করছিলেন। এক জায়গায় একটু ধাক্কাধাক্কি শুরু হতেই তারা তিনজন ব্যাটনগুলো ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে লোকজনকে ঠেকিয়ে দেন, তারপর ঠেলে একটু সরিয়েও দেন। ডি-এস-পি সাহেবও সেখানে পৌঁছে যান। তিনি জিজ্ঞাসা করেন–পুলিশের মাইকটা কোথায়?

সে ত পেট্রল পাম্পে স্যার, ঐ দিকে।

ডি-এস-পি নিজেই দৌড়ে চলে যান। এ-দিকের ধাক্কাধাক্কিটা অবিশ্যি থেমে যায়–লোকজন আবার চলতে শুরু করে। একটু পরে মাইকে শোনা যায়–পুলিশের পক্ষ থেকে বলছি। আপনারা হুড়োহুড়ি করবেন না। লাইন ভাঙবেন না। লাইন রাখুন। আপনারা প্রত্যেকে নিজেদের জায়গায় বসার আগে অনুষ্ঠান শুরু হবে না। আপনারা ঠেলাঠেলি করলে আপনাদেরই ঢুকতে দেরি হবে। এরপর গলাটা একটু ওঠে, প্রায় চিৎকার করে বলা হয়, গেটে যারা টিকিট চেক করছেন তারা তাড়াতাড়ি কাজ করুন, দেরি করবেন না, রাস্তায় ভিড় জমে যাচ্ছে, গেটে যারা টিকিট চেক করছেন তারা তাড়াতাড়ি কাজ করুন, দেরি করবেন না, রাস্তায় ভিড় জমে যাচ্ছে।

পুলিশের নাম শুনেই লোকজন ঠেলাঠেলিটা বন্ধ করেছিল। টিকিট তাড়াতাড়ি দেখে দেয়ার নির্দেশে লোজন যেন আশ্বস্ত হয় যে পুলিশ তাদের তাড়াতাড়ি প্যান্ডেলের ভেতরে ঢোকাতেই ব্যস্ত।

ডি-এস-পি সাহেব পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে আবার সেই জটলার কাছে আসেন–ব্লক অফিসের ক্যালভার্টের ওপরে যেখানে তিন দিক থেকে আসা লোকজন মিলছে। সেখানে ইতিমধ্যে আরো দু-জন সেকেন্ড অফিসার এসে গেছেন। তারা তিনদিকের লোকজনকে একটা লাইনে ফেলে ছাড়ছেন আর মাঝে-মাঝে এক-একদিকের লোক আটকাচ্ছেন। ডি-এস-পিকে দেখে একজন বলে ওঠেন, স্যার, স্যার, এখনো এত লোক বাইরে, যদি তাড়াতাড়ি না ছাড়ে তা হলে ত এখানে আটকে যাবে।

ডি-এস-পি বলেন, দাঁড়াও, আমি গেছে দেখছি, দাঁড়াও, আমি এসে বলছি। ডি-এস-পি ঐ লাইনের পাশ দিয়ে, ভেতর দিয়ে, মাঠের মধ্যে পৌঁছে যান। তিনি সবচেয়ে শেষের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে গেলে গেটের ছেলেটি তাকে না দেখে আটকায় আর গেটের কনস্টেবলটি ছেলেটির হাত তুলে দেয়। ছেলেটি দেখেই সরি স্যার জিভ কাটে। তাড়াতাড়ি করুন, তাড়াতাড়ি করুন, বলে ডি-এস-পি ভেতরে ঢোকেন জায়গার অবস্থা দেখতে। তাকে দেখে নকুল রায়, বটুক বর্মন ছুটে আসে।

 শুনুন, আপনারা আমাদের যা একাউন্ট দিয়েছেন তার বাইরে কোনো টিকিট বাজারে ছাড়েন নি ত? ডি-এস-পি জিজ্ঞাসা করেন।

না, স্যার। একথা জিগেস করছেন কেন স্যার? নকুল বলে।

না, না, অন্য কারণে না। বাইরে লোক ত দেখেছেন, এ্যাকমোডেশন হয়ে যাবে ত?

হ্যাঁ, স্যার এখনো ত অর্ধেক প্যান্ডেল খালি স্যার। আমরা ত স্যার আপনাদের স্কোয়ার ফুটের হিশেব দিয়েছি স্যার, প্ল্যান জমা দিয়েছি স্যার।

আরে মশাই, সে-সব আপনাদের কে জিগেস করছে। বাইরে লোকজন একটু ইমপেশেস্ট হয়ে পড়তে পারে, কত দূর-দূর থেকে এসেছে, তাই বলছিলাম আপনারা জায়গার তুলনায় যদি আমাদের গোপন করে বেশি টিকিট ছেড়ে থাকেন তবে কিন্তু কেলেংকারি হবে। আপনাদের ত সিট নাম্বার নেই? ডি-এস-পি বলেন।

না স্যার, আপনাকে সত্যি বলছি স্যার আপনাদের যা বলেছি সেই টিকিট ছেড়েছি স্যার। এ রিস্ক স্যার কে নেবে? নকুল প্রায় ডি-এস-পির হাত ধরে। ডি-এস-পি বলেন, তা হলে টিকিট পাঞ্চ করছেন কেন? প্রত্যেককে টিকিট হাতে তুলে দেখিয়ে ঢুকে যেতে বলুন–তা হলে দেখবেন বাইরের প্রেসারটা কমে যাবে।

নকুল বটুকের দিকে তাকায়। বটুক বলে, স্যার, ভেতরে ঢুকে যদি টিকিট বাইরে পাঠিয়ে দেয়?

আরে, কেউ ঢুকতেই পারছে না মশাই আর টিকিট বাইরে পাঠিয়ে দেবে? আমরা এ্যানাউন্স করে দিচ্ছি কাউকে বাইরে বেরতে দেয়া হবে না। আপনারাও এ্যানাউন্স করে দিন।

আপনারাই যা করার করেন স্যার। আমাদের ত স্যার স্টেজে উঠতেই দেবে না। নকুল বলে।

কে দেবে না?

স্টেজ ত এখন স্যার শ্রীদেবীর কন্ট্রোলে, কাউকে ঢুকতে দেবে না স্যার, বটুক বোঝায়। ডি-এস-পি হেসে বলেন, আপনাদের এখান থেকে শ্রীদেবীর কী দেখা যাবে আর?

থার্ড ক্লাশ থেকে স্যার এর বেশি দেখা যায় না, নকুল হে-হে করে হাসে। ডি-এস-পি বলেন, তা হলে গেটকে বলে দিন শুধু টিকিটটা তাকিয়ে দেখে ছাড়তে, আমরা বাইরে মাইকে বলে দিচ্ছি।

নকুল, বটুক আর ডি-এস-পি বাইরে বেরিয়ে যান। ডি-এস-পি আবার লোকজনের ভেতর দিয়ে-দিয়ে পথ করে নিয়ে রাস্তায় উঠে যান। তারপরই মাইকে শোনা যায়, পুলিশের পক্ষ থেকে বলছি। যারা গেটে টিকিট পাঞ্চ করছেন তারা টিকিট পাঞ্চ করবেন না। দর্শকদের হাতে টিকিট দেখে ছেড়ে দিন। এই ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে একটা আওয়াজ ওঠে। সেটা থেমে গেলে মাইকে আবার শোনা যায়, দর্শকদের কাছে অনুরোধ। আপনারা আপনাদের হাতে টিকিটটা উঁচু করে ধরে নির্দিষ্ট গেট দিয়ে প্রবেশ করুন যাতে যারা টিকিট দেখছেন, তারা দেখতে পান। এই ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে আবার একটা সমবেত আওয়াজ ওঠে–সমর্থনের। মাইকে শোনা যায়, লাইন ভাঙবেন না, হুড়োহুড়ি করবেন না, নিজের টিকিট নিজের হাতে উঁচু করে ধরে নির্দিষ্ট গেট দিয়ে প্যান্ডেলে ঢুকুন। প্যান্ডেলে ঢোকার পর কাউকে বেরতে দেয়া হবে না। মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, প্যান্ডেলে ঢোকার পর কাউকে বেরতে দেয়া হবে না।

এই ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই লাইনটি বেশ তাড়াতাড়ি এগতে থাকে। ঘোষণার পর লোকজনের মধ্যে দু-ধরনের ব্যস্ততা দেখা যায়। বড়বড় দলে যারা এসেছে বা শুধু বাড়ির লোকজন নিয়েও যারা এসেছে, তারা সব টিকিট একজনের কাছে জমা রেখেছিল। এই ঘোষণা শুনে যার-যার টিকিট তার-তার হাতে দেয়া শুরু হয়ে যায়। এত হাজার-হাজার লোকের হাতে টিকিট বিলি একটা ঘটনা ত বটেই। আর, প্যান্ডেলে ঢুকলে আর বেরতে দেয়া হবে না শুনে হঠাৎ-হঠাৎ লাইন ভেঙে পেচ্ছাব করতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়া বা বসে পড়া শুরু হয়। এত হাজার-হাজার মানুষের মধ্যে এ-হিড়িক পড়লে সেটাও একটা ঘটনা বটে।

.

১৭৮. শ্রীদেবী : চেনা ও অচেনা

 শ্রীদেবীর নাচের অনুষ্ঠানটা শুরু হয়ে যায় কিন্তু খুব সহজ ভাবে। শুরুর ধরন দেখে মনেই হয় না যে এই অনুষ্ঠানের জন্যে গত মাস দুই ধরে এত প্রচার, বাংলা-বিহার-আসাম জুড়ে দর্শকদের আসার নানা আয়োজন, প্রায় মাসখানেক ধরেই রাজনৈতিক স্তরে ও প্রশাসনের স্তরে মিটিঙ, কলকাতা থেকে মন্ত্রীদের আসা আর এখন এই প্রায় লক্ষ দর্শকের উপস্থিতি। অনুষ্ঠানের শুরু দেখেই হতাশ হওয়ার জন্যে ত এত দর্শক আসে নি, তাই দর্শকরা হতাশ হয় না নিশ্চয়ই। শুরু থেকেই এই সমস্ত দর্শক শ্রীদেবীকে তাদের মধ্যে পেয়ে যাবে–এমন একটা আবহ হয়ত আলাদা-আলাদা ভাবে কোনো-কোনো দর্শকগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল। কিন্তু এই প্যান্ডেলের ভেতর বসার পর দেখা যায় দর্শকদের একটা বেশ বড় অংশই রাজবংশী ও চা বাগানের মদেশিয়া। এদের মধ্যে শ্রীদেবী সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট প্রত্যাশা ছিল না, ফলে শুরু দেখে তারা হতাশ হয় নি। সেই কারণে, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই প্যান্ডেলটা চুপ করে যায়। সেই নীরবতার মধ্যে কিছু সম্ভ্রমও ছিল।

বোধ হয়, এ-ধরনের অনুষ্ঠান নানা জায়গায় নানা ধরনের সমাবেশে করতে করতে অনুষ্ঠানের প্রধান শিল্পী, যিনি পয়লা নম্বরের ফিল্মস্টার ও হিন্দি ফিল্মে যাকে যৌন বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, একটা পদ্ধতি-প্রক্রিয়া তৈরি করে ফেলতে পেরেছেন। তাই তার প্রথম চেষ্টা হয়, তাকে ঘিরে দর্শকদের মধ্যে যদি কোনো জ্বরের মত তাপ তৈরি হয়ে থাকে, সেটাকে নষ্ট করা।

স্টেজটার পর্দা খুলে যাওয়ার পর ধীরে-ধীরে খুব কম আলো দর্শকদের বাঁ দিক থেকে স্টেজের পেছনে দর্শকদের ডান দিকে পড়ে। পুরো স্টেজটা কিছুক্ষণ খালি পড়ে থাকে শুধু এই গবাক্ষ পথে আসা আলোটুকু নিয়ে। সেই সময়টুকু জুড়ে দর্শকরা ধীরে-ধীরে চুপ করতে থাকে ও যে যার দেখার রাস্তা ঠিক করে নেয়। ঠিক যখন মনে হতে শুরু করেছে যে স্টেজে দেখার কিছু নেই তখনই একটি ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা যায়। তারপর একটি মেয়ের প্রবেশ অনুসরণ করতে করতে বোঝা যায় স্টেজে এতক্ষণে আবছা একটা আলোও ফুটে উঠেছে যে-আলোতে মেয়েটি দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। মেয়েটিকে দেখেই প্যান্ডেলে শ্বাসপতনের আওয়াজ হয়। কিন্তু এই দর্শকদের ভেতর ত এমন কয়েক হাজার আছে। যারা শ্রীদেবীর দৈর্ঘ্য জানে, শ্রীদেবীর হাটার ছন্দ চেনে। তাদের প্রতিক্রিয়াতে বাকি সবাই মুহূর্তে বুঝে যায়, এ মেয়েটি শ্রীদেবী নয়। কিন্তু সেই জানাটুকুসহই সবাই দেখে মেয়েটি সেইখানে হাঁটু গেড়ে বসে যেখানে এতক্ষণ আলো ফেলে রাখা হয়েছিল। সে একটা দেশলাই কাঠি জ্বালে, তাতে একটি প্রদীপ জ্বলে ওঠে, স্টেজের আলো একটু বেড়ে যায় আর দেখা যায় মেয়েটি নটরাজের ছোট মূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে। প্রণাম সেরে মেয়েটি প্রায় পূর্ণ আলোকিত মঞ্চ ছেড়ে চলে যায়, ঘুঙুরের আওয়াজ তুলতে-তুলতেই। আর, সে-আওয়াজ মিলিয়ে যেতে দেয়া হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আর-একটা ঘুঙুরের আওয়াজ স্পষ্ট হতে থাকে–কেউ হেঁটে আসছে। দর্শকদের বা দিক থেকে স্টেজের একেবারে সামনে দিয়ে ঢুকে শ্রীদেবী দর্শকদের দিকে একবারও না তাকিয়ে কোনাকুনি স্টেজটা হেঁটে পার হয়ে গেলেন স্টেজের পেছনে দর্শকদের ডান হাতি কোণে, যেখানে প্রথমে আলো পড়ে ছিল অনেকক্ষণ, পরে, প্রদীপ জ্বালানো হয়েছিল। সেখানে শ্রীদেবী হাটু গেড়ে বসে কোমর থেকে মাথা মাটির ওপর হেলিয়ে নটরাজকে প্রণাম করেন। তাঁর প্রণামের ভঙ্গি জুড়ে, স্টেজের আলো কমে আসে কিনা বোঝা যায় না, কিন্তু তার লম্বা পিঠটুকু জুড়ে একটা অতিরিক্ত আলো মাথা দিয়ে গলে হাতটুকু দিয়ে মাটিতে মিশে যায়। লম্বা বেণীটা তার গলা থেকে ডাইনে দর্শকদের দিকেই পড়ে থাকে।

ফিল্মে-ফিল্মে যারা শ্রীদেবীকে চেনে, তারা তার এই হাঁটার ভঙ্গি, তার ডান হাতটা হাঁটার সময় কনুইয়ের কাছে একটু ভাজ ফেলে যে শরীরের বাইরে থাকে, তার শরীরের উর্ধাঙ্গ যে হাঁটার তালে-তালে একটু-একটু দোলে, তিনি প্রণাম করার সময় যে এরকম বেণী লুটিয়েই প্রণাম করেন–এ-সবই চেনে। ফলে শ্রীদেবী ঢোকামাত্র তারা শ্বাস বন্ধ করে প্রায় মিলিয়ে নেয় ফিল্মের প্রাণহীন শরীরের চলাফেরা এই প্রাণময় শরীরে সবটুকুই উপস্থিত।

প্রণাম সেরে উঠে শ্রীদেবী স্টেজের মাঝখানে এসে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে ঘাড়ের একটা ভঙ্গিতে লম্বা বেণীকে পিঠে ফেলেন–এ ভঙ্গিটাও কতবার চেনা। তখন স্টেজের সব আলো জ্বলে উঠেছে, একটুও ছায়া নেই। শ্রীদেবী দুই হাতে নমস্কার করে একটু হাসেন। সেই হাসিটা সহই তিনি দর্শকদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে তাকানবায়ে, ডাইনে, বায়ে, ডাইনে ও নমস্কার করেন। শ্রীদেবীর দিঘল চেহারার ওপর ছোট মুখটাতে ছোট ঠোঁটে হাসিটা খুব খোলামেলা নয়। কিন্তু এই যে-হাসিতে মুখটা ছড়িয়ে যায় না, সেই হাসিটাতেই তিনি তার দর্শকদের এত পরিচিত। সেই পরিচয়ের কথা মনে পড়িয়ে দিতেই শ্রীদেবী তার খুব পরিচিত আর-একটা ভঙ্গিতে মাথাটাকে একটু হেলান, কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলেন, যেন ঐ ভঙ্গি দিয়ে দর্শকদের জানাতে চাইছেন, আরে, আমিই, আমিই। দর্শকরা হাততালি দিয়ে ওঠেন, হাততালি যেন থামতে চায় না। শ্রীদেবী দুই হাত ওপরে তুলে থামাতে বললে হাততালি আরো বেড়ে যায়। তখন তিনি দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ছোট্ট একটা কাধঝাঁকুনি দেন—-মিস্টার ইন্ডিয়াতে এরকম কাঁধঝাঁকুনি তিনি প্রায়ই দিয়েছেন। দর্শকদের হাততালি বেড়ে ত যায়ই, তার সঙ্গে হাসি মেশে, বেশ উচ্চকিত হাসি। যেন তারা এতক্ষণে পেয়ে গেছে, ছবিতে-ছবিতে তাদের এত পরিচিত নায়িকাটিকে পেয়ে গেছে। আর এটাই যেন শ্রীদেবীর প্রাথমিক দায় ছিল–দর্শকদের চেনা ফিল্মের শ্রীদেবীর সঙ্গে নিজেকে মেলানো। তারপরই তিনি স্টেজ থেকে চলে যান। হাততালিও ধীরে ধীরে কমে আসে। সম্পূর্ণ থেমে যাবার আগেই মাইকে একটু গম্ভীর গলায় ঘোষণা করা হয় যে শ্রীদেবী প্রথমে আপনাদের সামনে ভরতনাট্যম পেশ করবেন। এই ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গেই মাইকে সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি শুরু হয় আর শ্রীদেবী মাথায় মুকুট পরে পোশাক সামান্য বদলে মঞ্চে ঢোকেন।

শ্রীদেবী প্রথম প্রবেশ, নটরাজ প্রণাম ও নমস্কারের নানা ভঙ্গির মধ্যে দিয়ে দর্শকদের স্মৃতি জাগিয়ে দিয়েছিলেন, এবার ভরতনাট্যমের নানা ভঙ্গি দিয়ে স্মৃতির সেই পরিচয় নষ্ট করতে লাগলেন। কোনো-কোনো ফিল্মে শ্রীদেবী ভরতনাট্যম নেচেছেন হয়ত, কিন্তু দর্শকদের সঙ্গে তিনি তার ভরতনাট্যম দিয়ে বাধা নন, যেমন ছিলেন একসময় বৈজয়ন্তীমালা, বা তার পরে এমনকি হেমামালিনীও। ফলে ভরতনাট্যমের নান্দীমুখ থেকেই যতই তিনি অভিনয়ের প্রবলতার মধ্যে ঢুকছিলেন ও মাইকের তবলা-মৃদঙ্গবাদ্য ও বোলের সঙ্গে-সঙ্গে নিজের ক্ষমতার জোর দেখাচ্ছিলেন, ততই এই দর্শকদের মধ্যে তার সম্পর্কে সম্ভ্রম তৈরি হচ্ছিল। প্রথম পরিচয়ে নিজেকে দর্শকদের কাছে তাদের পরিচিত নায়িকা হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করে প্রথম কর্মসূচিতেই তিনি নিজেকে আলাদা করে নেন। সিনেমায় তাকে একই নাচের রকমফেরে বারবার দেখে-দেখে, তার শরীরের নানা প্যাঁচঘোচ বারবার দেখে-দেখে যে-দর্শক তার যৌনতাকেই প্রধানত বা একমাত্র চিনে নিয়েছে, সেই দর্শক এই ভরতনাট্যম দেখে হতাশ হবে। ভরতনাট্যমটা বেশ খানিকক্ষণ ধরেই হয়। কিন্তু কোনো সময়ই একঘেয়ে হয় না–শ্রীদেবী এতই পরাক্রমে আলোময় স্টেজটাকে দখল করে রাখেন। সেই পরাক্রম দেখানোর সময় তিনি যেন প্রতিশোধের মত করে দর্শকের মধ্যে তার সম্পর্কে যা কিছু স্মৃতি আছে সব কিছুকে মুছে দেন-যে-শ্রীদেবীকে তোমরা দেখো আমি সে শ্রীদেবী নই।

কিন্তু শ্রীদেবী নাচতে নাচতে স্টেজের বাইরে চলে যান না। নাচটা তিনি স্টেজের ওপরই থামান। থামান, স্টেজের পেছন দিকে। তারপর, সেখান থেকে হাঁফাতে-হাফাতে হাঁটতে-হাঁটতে আসেন স্টেজের একেবারে সামনে। একটু দাঁড়িয়ে থাকেন। সবাই দেখে, যেমন অনেক ফিল্মেই দেখেছে, বড় চেনা শ্রীদেবীকে–ঘামছেন, বুক ওঠানামা করছে, ঠোঁটটা একটু ফাঁক, কপালে চূর্ণ চুল। ভরতনাট্যমের বাধা ভেঙে ফেলে দর্শকদের শ্রীদেবীসংক্রান্ত স্মৃতি হুহু করে ফিরিয়ে এনে নমস্কার করে শ্রীদেবী স্টেজ থেকে চলে যান।

.

১৭৯. শ্রীদেবী কতটা দেখান 

এত-এত টাকার টিকিট কিনে এত কাছ ও দূর থেকে যারা শ্রীদেবীর নাচ বা শ্রীদেবীকেই দেখতে এসেছে, আর এত টাকা খাঁটিয়ে যারা শ্রীদেবীকে দেখানোর অনুষ্ঠান করছে তারা ত আর মাত্র কিছু সময়ের এই কার্যসূচিতে আসল শ্রীদেবী তাদের চেনা শ্রীদেবী থেকে কত আলাদা তা দেখতে বা দেখাতে চায় না–তারা ছবির শ্রীদেবীকে রক্তমাংসের হিশেবে মিলিয়ে নিতে চায়। সেই মিলিয়ে নেয়া কতটা সম্ভব তা জানা নেই, জানা নেই বলে ইচ্ছেটাই প্রবল। শ্রীদেবীরও নিশ্চয় এ হিশেবটা খুব ভাল জানা। তিনি যদি নিজেকে ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে না পারেন তা হলে ছবির বাইরে এই লাখ-লাখ টাকার অনুষ্ঠানের অর্ডার তিনি পাবেন কেন? কিন্তু ছবির পর্দায় যা দেখানো যায় তা ত আর স্টেজে সকলের চোখের সামনে দেখানো যায় না। তারও কখন কোন নাচটি নাচবেন, তার হিশেব আছে। সেই হিশেব হল দর্শককে একটু চিনিয়ে দেয়া, আর একটু অচেনা রাখা। মাত্র এইটুকু সময়ের একটা অনুষ্ঠানে দর্শক তার নিজের মত করে বুঝে নেবে–ক্যামেরার লেন্স দিয়ে শ্রীদেবীর যতটা দেখা যায়, ফিরে-ফিরে দেখা যায়, নিজের দুটো চোখ দিয়ে ততটা দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু দর্শককে ত সেই লোভের জায়গা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে যাতে তারা বোঝে ফিল্মের শ্রীদেবী আরো কত লোভনীয়। তাতে শ্রীদেবীর ফিল্মগুলো হিট। হবে, সুপার হিট হবে, সুপার-সুপার হিট হবে। ফিল্মের পর্দা থেকে মঞ্চে দেখার লোভ জাগানো, আর মঞ্চ থেকে ফিল্মের পর্দায় দেখার লোভ জাগানো–এর ভেতরেই শ্রীদেবীর নিজেকে দেখানোর হিশেব-নিকেশ কাজ করে।

ভরতনাট্যমের পর একটু বিরতি যায়, পর্দা অবিশ্যি পড়ে না। তারপরেই স্টেজের নিজস্ব মাইক্রোফোনে গান বেজে ওঠে, হাওয়া খাওয়া ই। বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই হাততালি, চিৎকার, দু-চারটে সিটি–মিস্টার ইন্ডিয়ার গান। দর্শকদের চোখের সামনে মিস্টার ইন্ডিয়া শ্রীদেবীর সেই দৃশ্যটি ভেসে ওঠে যাতে মনে হচ্ছিল শ্রীদেবী কাল একটা ব্রার ওপর দিয়ে গোলাপি একটা ওড়না ফেলে পর্দা জুড়ে ওড়াচ্ছিলেন। ছবির গানটিতে শ্রীদেবীর কথার পর বাচ্চারা কোরাসে উই উই উই উই উই আওয়াজ করে ওঠে। মাইক্রোফোনের গানটিতে সেই জায়গাটি আসতেই, তখনো শ্রীদেবী মঞ্চে ঢোকেন নি, দর্শকরা কোরাসে গেয়ে ওঠে, উই উই উই উই উই। আর, সঙ্গে সঙ্গে স্টেজের একেবারে সামনে দিয়ে শ্রীদেবী গোলাপি ওড়না উড়িয়ে নেচে যান-হাওয়া খাওয়া ই। আবার হাততালি, চিৎকার ও সিটি। সেটা শেষ হতে না-হতে শ্রীদেবীর স্টেজে দু-চক্কর ঘোরা হয়ে যায়। দর্শকরা একটু ঠাণ্ডা হয়ে যেন তাড়াতাড়ি দেখে নিতে চায় ফিল্মের মতই মঞ্চেও শ্রীদেবীর কাল ব্রাটা দেখা যাচ্ছে কিনা। কিন্তু নানা জায়গায় বসে নানা দর্শক একই ব্রা একই রকম ভাবে দেখবে কী করে? অথচ যে যার জায়গায় বসে ঐ ব্রাটুকুই খুঁজতে চায়–তার ওড়নার আড়াল থেকে কাল কাপড়ের সীমানায় তার গলাটুকু যে দেখা যায়। কিন্তু এ-নাচটি ত ছোটাছুটির নাচ। শ্রীদেবীর সারা স্টেজ জুড়েই ছুটছেন। ফিল্মে যেমন মনে হয়েছিল সেই হলঘর, বাগান সব কিছুর ওপর দিয়েই শ্রীদেবী উড়ে বেড়াচ্ছেন–হাওয়া খাওয়া-ই, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চারাও সমবেত স্বরে উই-উই-উই করে উঠছে, এখানে তেমনি শ্রীদেবী পুরো মঞ্চটা জুড়ে ছুটছেন, উড়ছেন। মঞ্চের ওপরের অংশটাতে তার গোলাপি ওড়না উড়তে থাকে, উড়তে-উড়তে আবার তার কাছে চলে আসে। ফিল্মে শ্রীদেবীর ছোটাছুটিটাকে এত স্পর্শগ্রাহ্য মনে হয় নি, যদিও তার কাল ব্রাটি অনেক বেশি দৃশ্য ছিল। দর্শকরা সমবেত স্বরে বাচ্চাদের উই উই উই করে ওঠে আর শ্রীদেবী দর্শকদের দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে বাহবা দিয়েই পরের লাইনকটি নাচেন।

ঐ দ্রুততাতেই নাচটা শেষ করে দিয়ে শ্রীদেবী মঞ্চ থেকে চলে যাওয়া মাত্রই আবার হাততালি, চিৎকার, সিটি। দর্শকরা গরম হয়ে উঠছে। চিৎকার থামে না। নানা জায়গা থেকে আওয়াজ ওঠে, সোলভা সঁওন, নগিনা, মিস্টার ইন্ডিয়া। সে সব চিৎকার থামতে না-থামতেই স্টেজের মাইক্রোফোনে একটা গানের মুখ যন্ত্রে বেজে ওঠে। একটু হতচকিত বিশৃঙ্খলা হাততালি পড়তে-পড়তেই গানের মুখটার সঙ্গে-সঙ্গে ঘাঘরা পরা শ্রীদেবী মঞ্চে লাফিয়ে ঢুকে একটা চক্কর মেরে দেন–ঘাঘরা ফুলে ওঠে, শ্রীদেবীর গায়ের চুমকি বসানো জামা ঝলসায় আর ঘোমটা হিশেবে চুলের সঙ্গে ঝোলানো ওড়না বাতাসে ওড়ে। আউলাদ আউলাদ–চিৎকার করে দর্শকরা জানিয়ে দেন যে তারা চিনতে পেরেছেন। শ্রীদেবী একটা ছোট্ট লাফে দর্শকদের দিকে মুখ করে দাঁড়ান, বা পাটা এগিয়ে দেন, ঘাঘরাটা ঘের খায়, আর শ্রীদেবী বা হাতের তালুর ওপর ডান হাতের তালু রেখেই আবার একটা পাল্টা পাক খান। আউলাদ ফিল্মের প্রথম দিকে রাস্তায় নেচে-নেচে সওদাবেচার দৃশ্য আছে। মঞ্চে রাস্তা নেই, সওদা নেই কিন্তু শ্রীদেবীর পোশাকটা এবার অবিকল ফিল্মের মতই। চুমকি বসানো জামায় আলো ঠিকরে পড়ছে। শ্রীদেবী যখন স্টেজের উইঙ থেকে উইঙে যাচ্ছেন দর্শকদের দিকে নিজের শরীরের পার্শ্বরেখাঁটিকে ধরে রেখে আর মুখটা কখনো শরীরের রেখার সঙ্গে মিলিয়ে, কখনো মুখটাকে শরীর থেকে সমকোণে দর্শকদের দিকে ঘুরিয়ে, তখন, বুকের ওপর থেকে চুমকি চমকায়, সেই চমকে সেই বুকের দোলন বোঝা যায়। দর্শকরা প্রবল হাততালিতে ফেটে পড়ে। দর্শকদের হাততালি দেওয়ার ক্ষমতা শেষ করে দিতেই যেন শ্রীদেবী আবার বিপরীত উইঙ থেকে ঘুরে আসতে শুরু করেন। দর্শকরা যেন তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী দেখে নিতে পারে, যতটা ইচ্ছে ততটা! সেই হাঁটাটুকু শেষ হয়ে গেলেই শ্রীদেবী একলাফে পেছন থেকে এগিয়ে আসেন, তার পর দুটো পাক খেয়ে স্টেজের একেবারে সামনে এসে দর্শকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েন। তখন সেই ফেরিওয়ালির গানের দ্রুত লয়ের সঙ্গে তাল রেখে শ্রীদেবীর বুকদুটো দর্শকদের সামনে ওঠে, নামে। দর্শকরা যেন এতটা আশাই করে নি। তারা ভুলে যায়–ফিল্মটাতে এতটাই ছিল কিনা, এ যেন ফিল্ম থেকেও বেশি। শ্রীদেবী তার নমনীয় দীর্ঘ শরীরকে আনত করে গানের তালে-তালে তালি দিতে-দিতেই উইঙ দিয়ে বেরিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের বেশির ভাগই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিতে দিতে প্রায় যেন নেচেই ওঠে। কেউ-কেউ চিৎকার করে শ্রীদেবীর গানটাই হাততালি দিয়ে দিয়ে গেয়ে ওঠে, কেউ-কেউ আবার সেই হাততালির সঙ্গে মিলিয়ে নেচে ওঠে। সেখানে নাচের সঙ্গে-সঙ্গে আবার হাততালি পড়তে থাকে। মনে হয়, অনুষ্ঠান যেন ভেঙেই গেল। কিন্তু এই সবই হতে থাকে প্যান্ডেলের ভেতরে, প্যান্ডেল থেকে কেউ বাইরে যায় না। রাজবংশী মেয়েদের ভেতর কেউ-কেউ খানিকটা বিহ্বল হয়ে দর্শকদের এই হাততালি, গান আর নাচ দেখতে থাকে। তাদের চোখেমুখে, ভয় যদি নাও হয়, একটু অনিশ্চয়তা দেখা যায় যেন। মঞ্চে আলোেগান, নাচ–এটা তারা বুঝতে পারে। কিন্তু দর্শকদের নাচ-গান বুঝতে পারে না। বরং চা বাগানের মদেশিয়া মেয়েরা দর্শকদের নাচ দেখে খিলখিল হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে; তাদের মধ্যে কেউ-কেউ হাততালিও দিয়ে ফেলে।

এই অবকাশে পুলিশের লোকজন আর উদ্যোক্তারা মিলে প্যান্ডেলের একেবারে পেছনের টিনের বেড়াটা দ্রুত খুলতে শুরু করে। তাতে আওয়াজও হতে থাকে–টিন থেকে পেরেক খোলার আওয়াজ। দর্শকদের নাচগান তাতে থেমে যায়। দর্শকরা নিজের জায়গা থেকে নড়তেও চায় না অথচ এরকম অদ্ভুত আওয়াজের ব্যাপারটা জানতেও চায়। সামনের দুদিকে কোনাকুনি চেয়ারে জেলার সব অফিসারদের আর হর্তাকর্তা লোকদের বসে থাকতে দেখে দর্শকরা কিছুটা আশ্বস্তও হয়। এর মধ্যেই সবাই জেনে যায়–পেছনের বেড়াটা পুলিশ সাহেবের নির্দেশে খুলে দেয়া হচ্ছে! সেজন্যেই স্টেজও খালি।

টিকিট কেনা দর্শক ছাড়াও নতুন দর্শনার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে বাড়তে এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে তাদের দেখার ব্যবস্থা করাটা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ডি-এস-পি সাহেব উদ্যোক্তাদের বলেন–টিকিট বিক্রি করা চলবে না, কারণ প্যান্ডেলে একটুও জায়গা নেই। তখন ঠিক হয় অনুষ্ঠান মাঝামাঝি হয়ে গেলে পেছনের বেড়াটা খুলে দেয়া হবে। শ্রীদেবীর লোকজনকেও তাই জানানো হয়।

.

১৮১. সমবেত রমণনৃত্য

অঘোষিত ঐটুকু বিরতির পর শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান আবার শুরু হয়। আর চলতেও থাকে সেই খানিকটা ঠাণ্ডা খানিকটা গরম–এই ছন্দে। দুটো-একটা নাচগানের পর শ্রীদেবী তার সুপারহিট ফিল্ম নগিনার একটা গানের সঙ্গে স্টেজে কিছুটা হাঁটেন–ভুল যায়ে তুম এক কহানী। ফিল্মে এই জায়গাটিতে ভাঙা শিবমন্দিরের প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে, অলিন্দ দিয়ে, মাঠ দিয়ে শ্রীদেবী কখনো পুঁতে রঙের, কখনো গোলাপি রঙের পোশাকে আপাদমস্তক নিজেকে ঢেকে, শুধু মুখটুকু বের করে রেখে গেয়ে-গেয়ে যান ঈষৎ বিলম্বিত লয়ে, ভুল যায়ে তুম এক কহানী। এ যেন জন্মান্তরের কাহিনী মনে পড়িয়ে দেয়া। ফিল্মে এই দৃশ্যে শ্রীদেবীর পাশে-পাশে ঋষিকাপুর ছুটে-ছুটে যান। আর শ্রীদেবী কখনো আধো ঘোমটা খুলে, কখনো বা না-খুলে, তাকে জন্মান্তরের কাহিনী শুনিয়ে যান। এখানে মঞ্চে শ্রীদেবী একা–শিবমন্দিরের অলিন্দ নেই, প্রাসাদ নেই, ঋষিকাপুরও নেই। কিন্তু শ্রীদেবী এমন ভাবে টেন আর হাঁটাটাই এমন নাচ হয়ে ওঠে, আধো ঘোমটা খোলেন বা খোলেন না যে দর্শকদের মনে হতে শুরু করে যে তারাই ঋষিকাপুর। এ গানটিতে সেই উল্লাস নেই, বরং যেন বিষণ্ণতা আছে।

এরকম আরো দুটো-একটা নাচগানের পর স্টেজের আলো কমে আসে। ফলে প্যান্ডেলটাতেও আবছায়া ছড়িয়ে পড়ে। দর্শকদের অনেকের জানাই আছে যে শ্রীদেবী, মোট কত ঘণ্টার অনুষ্ঠান করবেন, সব মিলিয়ে রাত নটা থেকে সাড়ে এগারটা, তার মানে আর বড় জোর দুটো-তিনটে নাচগান হবে। দর্শকরা এর মধ্যে হিশেব-নিকেশও একটা করে ফেলেছে যে অনুষ্ঠানটিতে যা তারা চেয়েছিল, তা পেয়েছে কি না। এখন যেন সেই প্রত্যাশাটা চরমের দিকে যাচ্ছে–আলো কমে আসায় ও সেই আধা-আলোর স্টেজ খালি ও নীরব থাকায় প্রত্যাশাটা এমনই পর্যায়ে ওঠে যে দর্শকরা কোনো কথা পর্যন্ত বলে না। হঠাৎ খুব চাপা স্বরে মাইকে অত্যন্ত দ্রুত লয়ে একটা বাজনা বেজে ওঠে। একটু পরে তার সঙ্গে আরো চাপা গলায়, যেন ফিসফিসিয়ে গাওয়া হচ্ছে–থাকা থাকা ট্রি-ই-ম, থাকা থাকা দ্রি-ই-ম। মাইকে কানে কানে কথা বলার মত করে এই আওয়াজটা ছড়িয়ে পড়ে। চাপা আলো, চাপা স্বর আর ঐ ছন্দিত দ্রুত লয়ে দর্শকদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যেন-থাকা থাকা ট্রি-ই-ম, থাকা থাকা দি-ই-ম। কেউ-কেউ হিসিয়ে ওঠে–হিম্মৎ ঔর মেহনৎ। শ্রীদেবী সেই আধো আলোর সঙ্গে মিশে মঞ্চে একটা বিড়ালীর মত উঁচু লাফে ঢোকেন। তার গলা থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত টাইট একটা পোশাক রংটা ঐ ধোয়াটে আলোয় বোঝা যায় না। বিড়ালীর মত দুটো-একটা লাফ মেরেই শ্রীদেবী হাঁটুতে আর কোমরে বিপরীত মোচড় দিয়ে নিজেকে গানের তালে-তালে কাঁপাতে থাকেন।

আলো বাড়ে না, গানের আওয়াজটাও বাড়ে না। শ্রীদেবী মঞ্চের এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় যান এক-একটা লাফ দিয়ে। তারপর আবার সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কোমরে মোচড় দিয়ে নিজের সারা শরীরকে কাঁপাতে থাকেন। স্টেজের একটু পেছন দিকেই এখনো তিনি লাফালাফি করেন। দর্শকরা খুব একটা স্পষ্ট দেখতেও পায় না। কিন্তু তার জন্যে কোনো আওয়াজ দিয়ে ওঠে না। যেন দর্শকরা জানেই–এটা তত স্পষ্ট দেখা যাবে না। জানে বলেই দর্শকদের ভেতর যতখানি দেখা সম্ভব ততখানি দেখে নেয়ার জন্যে একটা টানটান উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়। আলো একটু হয়ত বাড়ে কিংবা হয়ত দর্শকরাই একটু বেশি দেখতে পায়–তখন দেখা যায় শ্রীদেবী স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, কোমরে সেই একই মোচড়, কিন্তু শরীরের সেই কম্পনের ফলে কখনো তার স্তন দুটি শরীর থেকে আলাদা হয়ে কাঁপছে–কিছুটা ছায়ায় স্তনের রেখা এত খোদাই হয়ে ওঠে যেন সে-স্তনের কোনো আবরণ নেই। আবার, কখনো থাকা-থাকা দ্রিইম-এর তালে-তালে শ্রীদেবীর নিতম্ব ছায়াতে খোদাই হয় ওঠে। সেই নিতম্বের কম্পনে মনে হয় ঐ শরীরে কোনো আবরণ নেই। অত বড় প্যান্ডেলে ঐ প্রায় লক্ষ লোকের মধ্যে নীরবে একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, যেন, এইটির প্রত্যাশাতেই তারা এতক্ষণ ছিল। আলো একটু বাড়ে অথবা দর্শকরাই আরো একটু বেশি দেখতে পায়। শ্রীদেবী হাত দুটো মাথার ওপরে সোজা তুলে ফেলেন, তার শরীরের সব রেখা দর্শকদের চোখের সামনে খোদিত হয়ে যায়। তারপর দর্শকদের মুখোমুখি সেই শরীরটা যেন এক অনন্ত রমণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই নিজেকে মোচড়ায়। শ্রীদেবীর কোমর থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সেই রমণে আবর্তিত হতে থাকে, আবর্তিত হতে থাকে। এর যেন আর শেষ নেই। মাইকের সেই চাপা স্বর শীৎকারের মত শোনায়–থাকা থাকা ট্রি-ই-ম, থাকা থাকা দি-ই-ম।

প্যান্ডেলের ঐ প্রায় লক্ষ মানুষ তখন পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে সমবেত এক বিচ্ছিন্ন নিষিদ্ধ সম্ভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সকলে কেমন অধৈর্য হয়ে ওঠে–এই সম্ভোগের জন্যে আর-বেশি সময় হাতে নেই যেন। মাইকের চাপা শীৎকারে আর দ্রুত শ্বাসপতনের আওয়াজে এই দৃশ্যের নিষিদ্ধ ব্যক্তিগত যেন আরো সার্বজনীন হয়ে ওঠে। একটি বাচ্চা হঠাৎ চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে–সে এই চাপা আলো, চাপা স্বর, মঞ্চের আধা স্পষ্ট দৃশ্য আর তার চারপাশের চাপা উদ্বেগে ভয় পেয়ে গেছে। বাচ্চাটি একবারই মাত্র চিৎকার করে উঠতে পারে। তার মা তীব্র চাপা স্বরে হিসিয়ে ওঠে, চুপ যা চুপ যা কেনে। মায়ের হাতচাপা তার কান্না থেকে একটা নিশ্বাসের আকুলতা শুধু ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাতেই দর্শকদের অনড়তা ভেঙে যায়। কয়েকজন ছায়াচ্ছন্ন যুবক দূরে শ্রীদেবীর নাচের সঙ্গে মিলিয়ে প্যান্ডেলে রমণনৃত্যে মেতে ওঠে। থাকা থাকা ট্রি-ইম, থাকা থাকা ট্রি-ইম। আরো একদল যুবক আর-এক কোণে নাচ শুরু করে। তাতে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটে না। হিম্মৎ ওঁর মেহন্নত ফিল্মে এই দৃশ্যে শ্রীদেবী নেচেছিলেন জিতেন্দ্রর সঙ্গে। এখন মঞ্চে তিনি একা নাচছেন। এই প্যান্ডেলের নানা কোণে অনেকে তাদের আসন ছেড়ে উঠে ঐ চাপা শীৎকারের তালে-তালে মঞ্চের শ্রীদেবীকে সঙ্গ দিতে চায়।

মাইকে রমণের কাল্পনিক ধ্বনিপুঞ্জ দ্রুত ছন্দে তখন আরো চাপা স্বরে বেরিয়ে আসছে—থাকা থাকা দ্রি-ইম, থাকা থাকা ট্রি-ইম। চাপা নিশ্বাস, দ্রুত নিশ্বাস, পশুধ্বনি। শ্রীদেবী মঞ্চের আরো সামনে চলে এসেছেন। এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তিনি কোমর থেকে তার শরীরের ওপরের অংশটাকে আর্চের মত বঁকিয়ে দিয়েছেন–তাতে তার স্তন দুটির বাক তীব্র হয়ে ওঠে, আর কোমর থেকে নীচের অংশটি এগিয়ে দিয়েছেন–তাতে তার উরু দুটি শক্ত ও প্রখর দেখায়! সেই অবস্থাতেও তার শরীরে ঐ শীৎকারের প্রবল আন্দোলন। সে-আন্দোলনের মধ্যে কোনো বৈচিত্র্য নেই, কিন্তু সে-আন্দোলন যেন কখনোই থামবে না।

 একটা দল প্যান্ডেলের একেবারে পেছন থেকে বেড়াটা খুলে দেয়ায় এখন ত রাস্তা পর্যন্ত প্যান্ডেল-বাঘারুকে মাঝখানে নিয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে আসে। গয়ানাথ আর আসিন্দির সপরিবার অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে–কাজকর্মের জন্যে বাঘারুকে সঙ্গে আনা। বাঘারু অনুষ্ঠানের ভেতরে ঢোকে নি–সে রাস্তার ওপরেই ছিল কিন্তু যেন তাকে অনুষ্ঠানের ভেতরে টেনে আনার জন্যেই পেছনের বেড়াটা খুলে দিয়ে রাস্তাটাকেও প্যান্ডেলের ভেতর নিয়ে আসা। কিছু যুবক রাস্তার ওপর ও রাস্তার ঢালে বসেবসে গোপনে দ্রুত মদ খেতে-খেতে অনুষ্ঠান দেখছিল। এইবার তারা তাদের, জ্যাকেট ও জিনসসহ রাস্তার ওপর রাস্তার ঢালে জেগে ওঠে–থাকা থাকা ট্রি-ইম। তারা কোনো আওয়াজ করে না কিন্তু নিজেদের শরীরের দ্রুততম আবর্তনে নেচে ওঠে রাস্তায় ও রাস্তার ঢালে। বাঘারু সেই দলের মধ্যে পড়ে যায় কিংবা সেই দলটাই বাঘারুকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। অত দ্রুত অতটা মদ খাওয়ায় তাদের পা টলছিল বা রাস্তা ও রাস্তার ঢালে ঐ নাচ নাচছিল বলে তারা গড়িয়ে নীচে নেমে যায় দ্রুত-বাঘারুকে নিয়েই। নীচে যাওয়া মানেই প্যান্ডেলের ভেতরে ঢুকে পড়া। তখন ত প্যান্ডেলের ভেতরেও নানা জায়গায় নানা দল নাচছে, নীরবে নাচছে, মাইকের চাপা থেকে চাপা শীৎকারের সঙ্গে নাচছে। এই দলটি বাইরে থেকে নাচতেনাচতে সেই সব নাচের সঙ্গে মিশে যায়। মিশে যায় আর এগিয়ে যায় মঞ্চের দিকে। তাদের মাঝখানে আপাদমস্তক প্রায়নগ্ন বাঘারু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *