বাতাস নেই, শীতও নেই। ফাল্গুনের প্রারম্ভেই, আকাশটা এই দিন মেঘলা হয়ে রয়েছে। কথায় বলে, যদি বর্ষে ফাল্গুনে, চিনা কাওন দ্বিগুণে। পূর্বাঞ্চলে যদিও বা হয়, এ অঞ্চলে চিনা কিংবা কাওনের ধানচাষ দেখা যায় না।
মেঘের তেমন সমারোহ নেই। দুপুরে একবার কালবৈশাখীর মতো করে ঘনঘটা হয়েছিল, সেরকম বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু মেঘ আছে আকাশে।
হাটে তেঁতুলতলায় ভোটের মিটিং-এ মারামারি হয়ে গিয়েছে কয়েকদিন আগে। শ্রীধর দাস এবং গোলকবিহারী মিত্তিরের দলেই মারামারি হয়েছে। উভয় পক্ষেরই কয়েকজন সদরের হাসপাতালে আছে। সবাই মনে করেছিল, গোলোকবিহারীর শাকরেদ সনাতন ঘোষের নামেই পরোয়ানা বেরুবে। কারণ, সে-ই দাঙ্গা করেছে বেশি। কিন্তু সে বুক ফুলিয়েই চলছিল।
আর তিন দিন বাদেই ভোট। এখনও সভা-সমিতির সময় ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই সারা অঞ্চলটা যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। থমকে আছে।
আবগারি থেকে পুলিশের টহল এখনও তুলে নেওয়া হয়নি গ্রাম থেকে।
দুর্গা বারে বারে ঘরবার করছিল। তার কেবলইমনে হচ্ছে বেলা বুঝি যায়। মেঘের জন্যেই আরও এরকম মনে হচ্ছে। নন্দ ঘুমোচ্ছে দাওয়ায়। তাকে ডাকতে গিয়েও থমকে গেল দুর্গা।
এই ছটফটানির মধ্যেই বেদো এল। যাক! তা হলে সব ঠিক আছে। কিন্তু বেদোর মুখ অন্ধকার। বোধ হয় নেশার ঘোরেই। নেশার ঘোরে তো বেদোকে হাসকুটে উত্তেজিতই মনে হয়। এমন মাথা নত, অপরাধীর ভাব কেন? ধরা পড়েছে নাকি?
সে কাছে আসতেই দুর্গা বলল, কী হয়েছে? সব পৌঁছে দিয়েছ?
বেদো মুখ না তুলেই, ঘাড় নেড়ে জানাল, দিয়েছি।
তবে?
বেদো বলল, কবরেজ বাড়ির দিদিরা যাবে না।
-কেন?
–তা জানি নাকো। খালি বললে, দুগগাকে বলে দাওগে, আমরা যেতে পারব না।
–কেউ না? বড়দি না, মেজদিও না?
না।
দুর্গা ঠোঁট কামড়ে ধরে, স্থির দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপরে বলল, তোমাকে যে গোরুর গাড়ির কথা বলেছিলুম?
বেদো বলল, সে ব্যবস্থা পাকা আছে। খালধার থেকে উঠবার কথা তো? সেই অর্জুনের তলায়? সেখেনে গাড়ি গাড়োয়ান সব ঠিক থাকবে। মালপত্তর পৌঁছে দিইচি ঠিক জায়গায়। গাড়িসুদ্ধ ওখেনে আসবে।
দুর্গা দাওয়া থেকে নেমে বলল, একটুখানি বসো খুড়ো, আসছি। বলে সে, দুখানি বাড়ি পেরিয়ে যমুনা-মাসির বাড়ি এল। দরজা খোলাই ছিল। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল দুর্গা। যমুনা-মাসীর মেয়ে যোগো আর যোগোর বর পাশাপাশি বসে কথা বলছে। হাসাহাসি করছে।
দেখতে পেয়ে যোগো ডাকল, এসো দুগগাদি।
দুর্গা বলল, হাঁ আসব একবারটি। মাসি কোথা?
যোগো বলল, এই তো ছেল। কোথা গেল আবার। বসোনা।
যোগোর বর হীরালাল। গঙ্গার পুব পারের মানুষ। বারাসাতের গ্রামাঞ্চলে বাড়ি। চাষবাসের সঙ্গে একটি ছোট মুদিখানা আছে। লম্বা রোগা ভাল-মানুষ-মুখটিতে কেবল চোখ দুটি একটু চঞ্চল। পয়সা ভালবাসে, একটু বেশি ভালবাসে। আর বাবুর সাজবার ঝোঁক বড় বেশি। শ্বশুরবাড়ি যখন আসে, পাটনা থেকে সিলকেরের পাঞ্জাবিটি থাকে গায়ে, কোঁচাটি হাতে ধরা থাকা চাই। ঘাড়ের পাউডারটুকু মুছতে দেবে না কিছুতেই।
সে বলল, হাঁ, একটুখানি বইস দিদি। এই দেখো তোমার বোন কী বলছে। বলছে গোরুর গাড়িতে চাপবে, চোখ বুজে গিয়ে মাল খালাস করবে, চলে আসবে। কবরেজের মেইয়ের সঙ্গে যদি ফষ্টিলষ্টি করবে তো ঝাঁটা।
যোগো কপালে চোখ তুলে বলল, ওমা, ঝাঁটা বলেছি তোমাকে?
হীরালাল বলল, অই হল আর কী। চোখ পাকানো যা, ঝাঁটাও তাই, কী বল দিদি, অ্যাঁ? আমি বইললাম কিনা, তা কখনও হয়? ওঁয়ারা বাউন কবরেজের মেয়ে, ওঁয়ারা কেন ঢলাবেন? তা তুমি বইললে না, ওসব বাউন কবরেজ ঢের দেখা আছে, কিছুটি বিশ্বেস নেই। বলো নাই?
হীরালালের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে বোঝা গেল, সে চটাচ্ছে যোগোকে। যোগো ভেংচে বলল, বেশ করেছি বলেছি। তোমাকে বিশ্বেস কী?
অই দেখেন।
দুর্গা হাসল। ভিতরে দুশ্চিন্তা, বাইরে হাসিটা তাই শুকনো। কথা হয়েছিল, হীরালাল বর সেজে গোরুর গাড়িতে বউ নিয়ে যাবে। বউ হয়ে যাবে অচলা না হয় সুশীলা। হীরালাল আসলে যোগোকেই নিতে এসেছে। কিন্তু দুর্গা একটি লোক খুঁজছিল। একটি বর। নতুন বিয়ে হয়েছে, এমনি বর আর বউ। লজ্জাবতী বউ, ঘোমটা ঢাকা গোরুর গাড়িতে বউ, বাকসো, প্যাটারা, বিছানা বোঝাই করে যাবে। আসলে আসল জিনিসই যাবে। কিন্তু বউ ছিল, বর ছিল না। যমুনার কাছে সব শুনে, তিন টাকার মজুরিতে, হীরালাল অপরের মিছিমিছি বর হতে রাজি হয়েছে। কাজ নয়, কর্ম নয়, খালি গোরুর গাড়িতে যাওয়া সদরের গঙ্গার ঘাট অবধি। তারপরে আবার পরের পয়সায় রেলে করে ফিরে আসা। ফিরে এসে বউ নিয়ে চলে যাবে।
কিন্তু এখন বর আছে, বউ নেই। দুর্গা সেই কথাই বলল হীরালালকে, কবরেজ বাড়ির মেয়েরা কেউ যাবে না। কী হয়েছে ওদের জানি না। এখন গে একবার খবর নে আসব। তবে বউ এ্যাটটা থাকবেই, বুঝলে!
হীরালাল বলল, কে থাকবে?
দুর্গা বলল, যে-ই থাক, থাকবেই একজন। ঠিকঠাক, এখন আর পেছুনো যাবে না। ও জিনিস তো এখন গলার কাঁটা। যেখানে হোক পাচার করতে হবে। তুমি যেন ভুলে যেয়ো না। সঙ্গে বাতি দেখলেই চলে যেয়ো যমুনা-মাসির সঙ্গে, বুঝলে?
–আচ্ছা।
দুর্গা বলল, সেই কথাই বলতে এসেছিলুম, যমুনা-মাসিকে বলিস যোগো। কবরেজ বাড়ি গে যদি কোনও বিপদ-আপদের খবর পাই তালে জানাব। নইলে আমি আর আসব না। ওদের পাঠিয়ে দিস।
যোগো বলল, আচ্ছা।
হীরলাল তাড়াতাড়ি বলল, ও দুগগাদিদি, শোনো একটু-আধটু পাওডার-টাওডার মাখব তো?
দুর্গা হেসে ফেলল। বলল, যত তোমার খুশি।
দুর্গা বাড়ি চলে এল! বেদো তেমনি বসে তখনও। নন্দ জেগে বসেছে।
দুর্গা ঘরের মধ্যে ঢুকল। সেখান থেকেই বলল, সব শুনেছ তো নন্দদা?
-শুনলুম।
দুর্গা বলল, ছোট্ঠাকুরের আসতে তো অনেক রাত। আমি এটটু কবরেজবাড়ি যাচ্ছি। যদি দেখি, ওরা যাবে না, তবে আমি যাব।
নন্দ চমকে উঠে বলল, কোথা? সদরের গঙ্গার ঘাট অবধি?
দুর্গা বলল, হ্যাঁ। পাকা রাস্তায় পড়লে তাড়াতাড়ি যাবে। রাত দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে শহরে পৌঁছে যাব। এ তো আর ধানচালের গাড়ি নয় যে ঝিমিয়ে যাবে।
নন্দ বলল, কিন্তু ফিরবে কী করে?
দুর্গা বলল, রাতে গাড়ি পাই ভাল। না হয়, কাল ভোরে। রান্নাবান্না সব করে রেখেছি। তুমি খেয়ো। ছোটঠাকুরেরটা আলাদা রেখেছি, তুমি বেড়ে দিয়ো। সে যেন চিন্তা না করে, বুঝলে?
নন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বুঝব কী দিদি? ছোটঠাকুর যে আমাকে আস্ত রাখবে না?
দুর্গা বলল, রাখবে। সব ভেঙে বোলো? তারপরে সব সামলাবার দায় আমার।
বলে দুর্গা বেড়ায়-গোঁজা ছোট আয়নাটির সামনে দাঁড়িয়ে, গলায় হারগাছটি পরল। পরে দেখে, ঠোঁট টিপে হাসল। বউ যখন তাকেই সাজতে হবে, গলায় আজ হারটি থাক।
তারপরে দড়ির ওপর থেকে, লাল রঙের ভাঁজ করা ব্লাউজটি আরও ভাঁজ করে হাতে নিল। শাড়ি এবং প্রসাধন অচলাদের বাড়িতেই পাওয়া যাবে। গলার হারের ওপর আঁচলটি ঢেকে, বাইরে এল সে।
নন্দ বললে, চললে?
–হ্যাঁ।
বেদো বলে উঠল, কিন্তু এ্যাটটা কথা মেয়ে, দুজন কিষেনকে নে বিরাজ ঠাকুরকে দেখে এলুম, কবরেজ বাড়ির পেছনকার বাগানের জমি মাপছে ফিতে দে।
দুর্গার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। আবার একবার ভাবল। বলল, আচ্ছা, দেখি গে আগে ব্যাপার কী।
কবরেজ বাড়ির সামনে এসে দেখল দুর্গা, মিছে নয়, বিরাজ ভটচাজ কাটি পুতে জমি মাপছে। সে তাড়াতাড়ি বিরাজ ভটচাজের চোখ ফাঁকি দিয়ে, পোড়োজংলা উঠোনটা পেরিয়ে বারান্দায় উঠল। দরজা ভেজানো ছিল। ঘরে ঢুকে একেবারে ওপরে গিয়ে উঠল সিঁড়ি দিয়ে।
উঠে থমকে গেল। কবরেজমশায়ের ঘর খোলা। গিন্নি বাগানের দিকে জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন। অঘোর কবরেজ যেমন শুয়ে থাকেন, তেমনি আছেন। অন্যদিকে অচলা-সুশীলার ঘরে ঢুকল দুর্গা।
আশ্চর্য! যা কখনও দেখা যায়নি, আজ তাই। ওরা দুজন পরম আলস্যে শুয়ে আছে। অচলা শুয়ে আছে। সুশীলা চুপ করে তাকিয়ে আছে কড়িকাঠের দিকে। কিন্তু দুর্গাকে দেখে চমকে উঠল না সুশীলা। তেমন হেসেও উঠল না। খুবই শান্ত গলায় ডাকল, আয় দুর্গা।
দুর্গা দরজাটা ভেজিয়ে দিল। দিয়ে বলল, কী ব্যাপার তোমাদের মেজদি?
সুশীলা আস্তে আস্তে উঠে বলল, খুব ভাল। আমার আর আচির বে এই ফাল্গুনেই।
দুর্গা যেন এমন বিচিত্র কথা কোনওদিন শোনেনি। কিংবা মানে বোঝেনি। কেমন একটা অর্থহীন চোখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। আসলে অন্য কথা ভাবছিল সে। তার অবাক লাগছিল অচলা-সুশীলাকে দেখে। ভাবল, এরা কি সেই মেয়ে যারা মদের চোরাচালানের কাজ করে। কয়েকদিনের ব্যবধানে যেন চেনাই যায় না দুজনকে। এরা যেন আর কেউ। দুর্গার অবাক লাগল, ভেবে যে, এ বাড়িতেই কোনওকালে ও সব পাট ছিল কিনা। সব যেন উবে গিয়েছে, অচেনা একটা বাড়িতে ঢুকেছে বুঝি সে।
দুর্গা বলল, বে কবে?
সুশীলার মুখে যেন সেই পুরনো দুর্বিনীত হাসিটা একবার উঁকি দিল। কিন্তু সে মুখ খোলবার আগেই, চোখ-বোজা অবস্থায় অচলা প্রায় জড়ানো গলায় বলে উঠল, একুশে ফাল্গন, লগনসা রাত্তির নটায়। আসিস কিন্তু দুগগা।
সুশীলার হাসি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল না। একটু ঝংকার শোনা গেল মাত্র। দুর্গা-ই অবাক হলেও, হেসে পারল না অচলার কথায়।
সুশীলা বলল, সেই যে বলেছিলুম তোকে, মেয়ে দেখতে আসবে? তোর পয়সায় তো লোক দুটোকে খাওয়ানো হয়েছিল। চিরে ভটচাজেরই চেনা লোক। দুই বর এসেছিল মেয়ে দেখতে।
অচলা বলল, আর দেখেই পছন্দ হয়েছে। আমরাও খুব পছন্দ করেছি ওদের।
সুশীলা বলে উঠল, তবে বাংলা বলতে পারে না। ভেবেছিলুম হিন্দুস্থানি। কিন্তু লোক দুটো বলছে, ওদের জন্মকর্ম সব বেহারে! বাঙালির সঙ্গে কোনওদিন মিশতে পারেনি তাই কথা শেখেনি।
দুর্গাকে কিছু বলারই অবসর দিল না। অচলা আবার বলে উঠল, তবে প্রমাণপত্র আছে। ওরা চিরে ভটচাজের আত্মীয়। বয়স তেপান্ন আর পঞ্চান্ন, পিটোপিটি ভাই। বেহারে কোথায় নাকি গুড়ের ব্যবসা করে। এ্যাদ্দিন সময় পায়নি বে করার। এবার করবে। চিরে ভটচাজ ছিল, তাই আমাদের কপাল খুলেছে। এখানে নিয়ে এসেছে।
সুশীলা বলল, সত্যি আচি ওদের জন্যে এ্যাদ্দিন আমাদের বের ফুল ফোটেনি, অ্যাঁ?
অচলা বলল, হ্যাঁ। কই রে দুগগা বসবি তো।
দুর্গা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু আশ্চর্য! কোনওটাই যে ঠাট্টা নয়, সেটা সে বুঝল।
সুশীলা আবার শুয়ে পড়ে, হাই তুলে বলল, উঃ কী ঘুম পাচ্ছে।
যেন জীবনের সমস্ত ক্লান্তির শোধ একদিনেই করে নিতে চাইছে দুজনে। ঘুমিয়ে থাকা, বসে বসে থাকা কাকে বলে ওরা জানত না, সহসা ওরা ভীষণ ক্লান্ত অলস আয়েসি হয়ে উঠল। অনেক ছুটোছুটি, অনেক উৎকণ্ঠিত অনিশ্চিত জীবন যাপনের পর, নতুন বদলের মুখে ওরা চঞ্চল হয়ে ওঠেনি। গা এলিয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ছে।
দুর্গা বলল, কিন্তুন, চিরে ভটচাজ পেছনের বাগান মাপছে কেন? সুশীলা বলল, কিনবে ওটা চিরে ভটচাজ। নইলে বের খরচ কোথায় পাওয়া যাবে? কিছু না হোক, শাঁখা সিঁদুর কাপড় গামছা আর পুরোত-খরচ তো চাই।
অচলা বলল, শুধু তা কেন? দু চারজন লোকও খাবে। চিরে ভটচাজের টাকা, সে নিজের হাতেই খরচ করবে। তার চেনাশোনা আত্মীয়-স্বজনেরা নিমন্ত্রণ খাবে।
সুশীলা বলল, মা বলছিল, আমাদের চৌদ্দ পুরুষকে উদ্ধার করল চিরে ভটচাজ। মেয়েদের আইবুড়ো নাম ঘোচাল।
দুর্গা না জিজ্ঞেস করে পারল না, তোমাদের যে কে দাদা আছে কলকাতায়, তাকে খবর দেয়া হবে?
অচলা বলল, নেহি।
সুশীলা বলল, হামলোক দাদা বলে কাউকে নেহি জানতা।
আবার একটু হাসির চকিত-নিক্কণ শোনা গেল দুজনের। চুপিসাড়ে চলা কোনও মেয়ের হাতের চুড়ি অসাবধানে বেজে ওঠার মতো।
অচলা বলল, এখন থেকে আমরা হিন্দিতেই কথা বলব।
সুশীলা বলল, ওরা খুব খুশি হবে।
অর্থাৎ বরেরা।
অচলা এবার মাথা তুলে দুর্গার দিকে তাকাল। বলল, আয় না, বসবি আয় এখানে।
দুর্গা এগিয়ে গিয়ে অচলার পাশে বসল।
অচলা বলল, খুব রাগ করেছিস তো আমাদের ওপর?
দুর্গা মাথা নেড়ে বলল, না। কিন্তুন আমার ভাল লাগছে না বড়দি।
ওরা দুজনেই নিঃশব্দে হাসল। অচলা বলল, কেন রে? বে হবে, তোর আনন্দ হচ্ছে না?
দুর্গা চুপ করে রইল।
সুশীলা বলল, তোর মতো তো তা বলে আমরা হতে পারব না। সেটা ভাল না মন্দ কিছু বোঝা গেল না। অন্য সময় হলে দুর্গা রুষ্ট হয়ে হয়তো পালটা কিছু জিজ্ঞেস করত। এখন সে কিছু বলতে পারল না। বরং জিজ্ঞেস করল, তোমরা চলে গেলে কবরেজমশায় আর গিন্নির কী হবে? কে তাদের দেখবে-শুনবে। কী খাবে?
অচলা বলল, কী আবার করবে! শুকিয়ে শুকিয়ে মরবে।
সুশীলা বলল, বল, শুক্কে-শুক্কে পচে হেজে-হেজে ঘরের কোণে মরে পড়ে থাকবে। তারপর গাঁয়ের লোকেরা একদিন জানতে পেরে সবাই ছুটে আসবে দাহ করতে।
দুর্গা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল সুশীলার দিকে। সত্যি কথাও কি এমন করে মানুষ বলতে পারে?
কিন্তু অচলা-সুশীলা তো মিথ্যে কথা আজ একটিও বলেনি। সত্যি কথাগুলিই এমন ভয়ংকর শোনাচ্ছে। দুর্গার বলতে ইচ্ছে হল, কবরেজমশায় আর গিন্নিকে আমি দেখব। আমি খাওয়াব। কবে থেকে যে এমন একটি মায়া পড়ে গিয়েছে গিন্নির ওপরে, দুর্গাও জানত না। সেই প্রথম দিনটির কথা মনে পড়ে। দুর্গা, আমার এখানে চোলাই করিস, কিছু দিস। বড়মানুষ ভদ্রলোকের অমন মতি দেখে তো ঠোঁট বেঁকেনি দুর্গার। বরং মনটা খারাপই হয়ে গিয়েছিল। মানুষটিকেও কেন যেন ভাল লেগেছিল খুব।
অচলা দুর্গার হাত টেনে নিল। বলল, রাগ করছিস দুর্গা?
দুর্গা বলল, না। রাগ কেন করব?
অচলা বলল, সেই ভাল। যা রায়বাঘিনী তুই। তোর রাগ দেখলে আমার পিলে চমকে ওঠে।
মিথ্যে নয়। দুর্গাকে তারা তুই তোকারি করে। করবেই। মানে ও বয়সে, দুইয়েতেই দুর্গা ছোট। গাঁয়ের মেয়ে বলে ছিটে-ফোঁটা স্নেহও আছে। তবু দুর্গা রেগে উঠলে, কেমন যেন থিতিয়ে যেত ওরা।
অচলা বলল, তবে, আজকের জিনিসের কী করবি? বর জোগাড় হয়েছে?
দুর্গা বলল, হ্যাঁ।
সুশীলা বলল, ইস? ফসকে গেল। বরটা কেমন রে?
দুর্গা বলল, ভালই।
অচলা জিজ্ঞেস করল, কিন্তু বউয়ের কী হবে?
দুর্গা বলল, আমি যাব।
অচলা এইবার যেন একটু নড়ে উঠল। বলল, তুই যাবি? তুই ধরা পড়ে গেলে যে সব কানা হয়ে যাবে।
ধরা পড়ব কেন শুধু শুধু?
আবার সমাধিস্থ হয়ে গেল অচলা। বলল, অ। আচ্ছা।
দুর্গা বলল, লাল শাড়িটা যে পাঠিয়ে দিয়েছিলুম, কোথা সেটা?
–ওই দ্যাখ, তাকের ওপর রেখেছি।
বাইরে ক্রমেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দিনের আলো যত না কমেছে, মেঘের অন্ধকার তার চেয়ে বেশি। তবু বসন্তের প্রথম পাখিটা গ্রামে এসে পড়েছে। একটু স্তিমিত গলাতেই কোথায় ডাকছে কুহু! কুহু!
দুর্গা তাকের ওপর থেকে ক্ষয়ে প্রায় শেষ হয়ে আসা ছোট্ট এক টুকরো সবুজ রঙের সাবান নিয়ে নীচে নেমে গেল। বাড়ির ভিতরেই কুয়ো আছে। জল তুলে দুর্গা সাবান বুলিয়ে মুখ ধুল। মুছল আঁচল দিয়ে। ওপরে এসে মাথা আঁচড়াল। চুল বাঁধবার সময় নেই। শুধু ফিতে নিয়ে চুলের গোড়ায় বাঁধন দিয়ে, এলো খোঁপা করে নিল।
জিজ্ঞেস করল, তোমাদের যে এটা হিমানী কৌটা ছেল?
সুশীলা আঙুল বাড়িয়ে দেখাল, ওই যে।
দেখা গেল, ঘরের জল যাবার মুখের কাছে, ঝাঁট দেওয়া এক রাশ ধুলোবালির ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছে হিমানীর কৌটা।
দুর্গা বলল, এত হতচ্ছেদা কেন গো হিমানীর?
অচলা বলল, দেখলুম তখন পায়ের কাছে মেঝেয় পড়ে আছে দিলুম পা দিয়ে ঠেলে।
আবার একটা হাসির আড়ষ্ট অক্ষুট ঝংকার। কিন্তু দুর্গাকে তো সাজতেই হবে। কৌটা তুলে, কুলুঙ্গির ছোট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিমানী মাখল সে। কড়ে আঙুলে কাজল নিয়ে নিপুণ করে টানল চোখে। তারপর, গালার তৈরি সিঁদুর কৌটাটির দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত থমকে রইল। একটু একটু করে হাসি ফুটল ঠোঁটে। সারা মুখে ও চোখে ফুটল বিথরে বিথরে। চিরঞ্জীবের মুখখানি ভেসে উঠল চোখের সামনে। কৌটো টেনে নিয়ে আঙুলের ডগায় সিঁদুর লাগিয়ে, আগে দিল সিঁথিতে। তারপর কপালে। খুব সাবধানে। সবাই নাকি গোল করে ফোঁটা দিতে পারে না। ঠিক পূর্ণিমার সুগোল চাঁদের মতো ফোঁটা দিতে হবে। নইলে ক্ষয়াটে চাঁদের মতো দেখায়।
দিয়ে সারাটি মুখ একবার দেখল। হাসল আবার। পরমুহূর্তেই ভ্রূকুটি করেই, আবার উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল চোখ দুটি। এই বেশে চিরঞ্জীবের কাছে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল মন। লজ্জা পেল, হাসি পেল, তবু উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। আর মুহূর্তে স্থির করে ফেলল, কাজ শেষ করে, রাত্রের মধ্যেই আজ যেমন করে হোক ফিরে আসতে হবে। ছোটঠাকুরের সামনে দাঁড়াতে হবে এই বেশে। রাত্রেই, আজ রাত্রেই।
যেন সহসা তাড়া লেগে গেল তার। সুশীলা অচলার দিকে পিছন ফিরে, গায়ে আঁচল ছড়িয়ে, জামাটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। লাল জামাটা গায়ে দিল। শাড়িটা খুলে ফেলল। খুলতেই ঠন করে একটা জিনিস পড়ে গেল। সেই অস্ত্র, সেই গুপ্তি, খাপে ঢাকা। এক ফুট লম্বা, সুতীক্ষ্ণ সূচাগ্র! সায়া রয়েছে। নেড়েচেড়ে টেনেটুনে দেখল একবার সায়াটি। তারপর লাল শাড়িটি টেনে পরল কুঁচিয়ে। যেমন করে যোগো পরে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়। গাঁয়ের সব মেয়েরাই এমন কুঁচিয়ে পরে। পরে গুপ্তিটা গুজল কোমরে। চিরঞ্জীব বলেছে সব সময় কাছে রাখতে। মাথার ঘোমটা তুলে দিয়ে আর একবার দাঁড়াল গিয়ে আয়নার সামনে।
প্রথমে উঠে বসল সুশীলা। তারপর অচলা, যেন বিমূঢ় হয়ে পড়েছে।
সুশীলা বলল, তোর গলায় ওটা কী? হার?
-হ্যাঁ।
–কে দিয়েছে? চিরো?
চিরঞ্জীব বুঝি সুশীলার চেয়েও দু এক বছরের ছোট। ওরা চিরো-ই বলে। কিন্তু হ্যাঁ বলতে দুর্গার লজ্জা করল। সে বলল, দেখো না! সখ দেখে বাঁচি না।
অচলা বলল, এতদিন মনে হত, তুই জিতেছিস। আজ মনে হচ্ছে, চিরোটাই জিতেছে।
দুর্গা বলল, কেন?
অচলা বলল, তোকে দেখে বুঝলুম।
সুশীলা বলল, দাঁড়া তবে উঠি।
সে উঠে আলতার শিশি বার করল। দুর্গার পায়ের কাছে বসে বলল, আয়, পরিয়ে দিই।
দুর্গা লাফ দিয়ে সরে গেল। –আ ছি ছি মেজদি, তোমার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নাই! আমার পায়ে হাত দিতে আসছ? দাও, আমি নিজে পরে নিই।
সুশীলা বলল, কেন, বামুন বলে? তোর ইয়ে দেখে বাঁচিনে। চিরোর সঙ্গে সব
দুর্গা নিজের হাতে আলতা পরতে পরতে বলল, তা কী করব বলল। সবই কি ঠিক ঠিক হয় সোমসারে?
আলতা পরা হয়ে গেলে অচলা উঠে এল এবার। বলল, দাঁড়া দুগ্গা। আর একটু বাকি আছে।
অচলা আঙুলের ডগায় আলতা নিয়ে দুর্গার ঠোঁটে লাগিয়ে দিল। দিয়ে, ভেজা থাকতে থাকতেই আবার কাপড় দিয়ে ঘষে একটু হালকা করে দিল। বিম্বোষ্ঠা দুর্গা হাসতেই তার সাদা দাঁত ঝকমকিয়ে উঠল।
অচলা বলল, ধরা পড়লেও তোর ক্ষতি নেই। যে ধরবে, সে ব্যাটা তোকে দেখেই ধরাশায়ী হয়ে যাবে, দেখিস।
সুশীলা বলল, সত্যি।
দুই বোন দুর্গার দিকে যেন অবাক স্থবির চোখে তাকিয়ে রইল। লজ্জায় দুর্গার নাসারন্ধ্র স্ফীত হল। অচলা কাছে এগিয়ে এল। দুর্গার গলা জড়িয়ে ধরে চিবুক তুলে বলল, দেখি?
দুর্গা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, যাঃ।
সহসা অচলা লুব্ধ তৃষ্ণার্ত ঠোঁট নিয়ে লুটিয়ে পড়ল দুর্গার ঠোঁটের ওপর। গাঢ় সম্পূর্ণ চুম্বনে শ্বাসরুদ্ধ করে দিল।
সুশীলাও এসে জড়িয়ে ধরল দুর্গাকে।
কিন্তু দুর্গার মাথায় সহসা রক্ত চড়ে গেল। গাটা যেন গুলিয়ে উঠল। সে দুজনকেই প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আঃ, ছাড়ো ছাড়ো! এ কী বিদঘুটে ব্যাপার বাপু!
এই প্রথম ওরা দু বোনে জোর হাসল। অচলা বলল, রাগ করলি?
কোনও জবাব না দিয়ে জানালায় গিয়ে থু থু করে থুথু ফেলল দুর্গা। ফিরল না। সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। রাগে ও ঘৃণায় তার শরীরের মধ্যে যেন জ্বলছে। সে বাইরের দিকে তাকাল। অন্ধকার ঘনাচ্ছে। সময় হয়ে এল। পশ্চিমের আকাশে, মেঘচাপা একটা রক্তের আভাস দেখা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে চামচিকাটা ফড়ফড় করে এপাশ-ওপাশ করছে।
দুর্গা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই শাঁখ বেজে উঠল ঘরে ঘরে। দুর্গা ফিরল। সুশীলা অচলা শুয়ে পড়েছে আবার।
অচলা বলল, যাচ্ছিস?
এবার যাব।
দুর্গার মন আবার ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
সুশীলা উঠে বলল, চল, আমিও নীচে যাব। রান্না বসাব।
অচলা বলল, আমিও উঠি, শাঁখটা বাজাই।
সে উঠে একটা কুলুঙ্গি থেকে শাঁখ নিয়ে বাজাল। তীক্ষ্ণ সরু শব্দ শাঁখটার। যেন কানে তালা লেগে যায়। এঁটো শাঁখটাই রেখে দিয়ে, হ্যারিকেন ধরাল সে।
দুর্গা ভেজানো দরজাটা খুলল। সিঁড়িটা এর মধ্যেই ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। মশার গুনগুনানি। সিঁড়ির মাঝপথে কবিরাজ-গিন্নি। ঠাহর করে দেখে বললেন, কে?
আমি দুর্গা।
ঘরের হ্যারিকেনের আলোর একটি রেশ তার গায়ে পড়েছে। গিন্নি কাছে এসে বললেন, বাঃ, একেবারে লক্ষ্মীপ্রতিমাটি হয়েছিস।
বলে তাকিয়ে রইলেন। দুর্গা পায়ে-পায়ে নীচে এল। অচলাও এল। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে দুর্গা বাইরে পা বাড়িয়ে, সুশীলার উদ্দেশে বলল, চললুম মেজদি।
সুশীলা কী বলল, দুর্গা শুনতে পেল না।
গ্রামের তিন রাস্তার মোড়ের কাছে, মন্দিরের চত্বরে সব সময়েই লোক থাকে। আজ সেখানে একটু বেশি ভিড়। ভোটের ঘর (পোলিং বুথ) তৈরি হচ্ছে। সুতরাং সে রাস্তা এড়িয়ে, আরও পশ্চিমে গিয়ে, উত্তরে বাঁক নিল দুর্গা। গ্রামের ভিতরে পা বাড়াল। এমনি গাঁয়ের লোকে দেখতে পেলে ক্ষতি ছিল না। কিন্তু সাজাগোজা ঘোমটা-পরা একটি মেয়েকে এমন আনকা নির্জন অন্ধকারে চলতে দেখলে, অসহায় ভেবে কেউ হয়তো ভিন্ন মতলবে পিছন নেবে। দুর্গার অন্য কোনও ভয় নয়, তার কাজ ভেস্তে যাবে।
দুর্গার মাথায় শুধু এক চিন্তা। যত রাত হোক, ফিরে আসতে হবে কাজ সেরে। খাল-পারে অর্জুন গাছের গোড়ায় গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সব প্রস্তুত। হীরালালকে নিয়ে যমুনা এসে পড়েছে।
দুর্গা চুপি চুপি বলল যমুনাকে, আশেপাশে কেউ নেই তো?
যমুনা বলল, না। এখানে কাছেই বেদো আর নন্দ লুকে আছে কোথাও।
একটু যেন স্বস্তি পেল দুর্গা। গাড়ির চালক বিমলাপুরের লোক নন্দর চেনা। দুর্গা তাকে বলল, চট করে বাতি জ্বালো দিকিনি। জ্বেলে গাড়ির তলায় ঝুলিয়ে দাও।
গাড়োয়ান বলল, বাতি জ্বাললে যে গাড়ি চলবে দেখা যাবে।
দুর্গা ব্যস্ত গলায় বলল, তা তো যাবেই হে। বাতি না জ্বেলে গেলে, সন্দেহ করবে বেশি। রাস্তায় কত লোকের সঙ্গে দেখা হতে পারে।
গাড়োয়ান হ্যারিকেন জ্বালল। পলতে কমিয়ে ঝুলিয়ে দিল গাড়ির তলায়।
দুর্গা দেখল, হীরালাল তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যেন কথা সরছে না মুখে। দুর্গা বলল, তাককে আছ কি লো জামাই। আমি গাড়িতে উঠছি। তুমি সামনে পা ঝুলিয়ে বসো, গাড়োয়ানের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা বলো। আর যোগোকে যেমন ডাকো, আমাকে তেমনি ডেকো, আর কথা বোলো।
হীরালাল যথাসাধ্য সেজেছে। ঘাড়ে মুখে পাউডারও মেখেছে। পান চিবিয়েছে। কোঁচা পুরেছে পকেটে। প্রায় বিস্মিত বিভ্রান্ত গলায় বলল, যোগোকে যেমন বলি, তোমাকে সেই রকম বলতে হবে?
হ্যাঁ।
তটস্থভাবে বলল হীরালাল, পারব তো?
–পারতে হবে। আমি উঠলুম গাড়িতে।
গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করল, জিনিস?
গাড়োয়ান বলল, সব ঠিক আছে। ছইয়ের মধ্যে, বাকস প্যাঁটরা বিছানায় পোরা আছে সব।
দুর্গা ছইয়ের ভিতরে গিয়ে বসল। হীরালাল গাড়োয়ানের গা ঘেঁষে সামনে বসল। ছইয়ের ভিতর থেকে দুর্গা বলল চলে যাও যমুনা-মাসি।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
শুক্লপক্ষ যদিও পড়েছে, আকাশের আলোর রেশও নেই। মেঘ করে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। উঁচু পাহাড় থেকে খালের জল যদিও দেখা যায় না, তবু থেকে থেকে এক-একটি ঝিলিক দেখা যায়। হয়তো জলের স্রোত সেখানে বাঁকা।
দুর্গা হীরালালের আরও কাছে এগিয়ে এল। হীরালাল তাড়াতাড়ি আরও সরে, গাড়োয়ানের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছিল। দুর্গা তার জামা ধরে টান দিল। বলল, আঃ যাচ্ছ কোথা? বসো এখেনেই।
হীরালাল বলল, অ।
কিন্তু তার যেন ফিরে তাকাবার সাহস হচ্ছে না। দুর্গার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামনের দিকে। বন্দুকধারী পুলিশ কটা কোথায় আছে কে জানে? কিছু হোক বা না হোক, টর্চ ফেলে ফেলে অনেকক্ষণ ধরে দেখবে। গাড়ির চাকায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। মাঝখানে আলো থাকায়, দুদিকে চাকার অতিকায় ছায়া দুটি অন্ধকারে বার বার হারিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি বেশ জোরেই চলেছে।
দুর্গা বলল গাড়োয়ানকে, অমন চুপচাপ কেন। বলদ দুটোকে এটটুস্ হ্যাট হোট করো। অমন চুপ করে থেকো না।
গাড়োয়ান সাড়া শব্দ তুলল। দুর্গা হীরালালের পিঠে খোঁচা দিয়ে বলল, কথা বলো।
অ্যাঁ? কী বইলব?
-যা খুশি, ঘরের কথা বলো না আপন মনে।
–অ! তা আজ হল গে তোমার শনিবার, কাল আমাদের ওইখেনে হাট। দোকানটা খুলতে পারলে—
এ সব কথাই ভাবছিল বোধহয় হীরালাল। কাল তাকে যেমন করে হোক দোকান খুলতে হবে।
গ্রাম ছাড়িয়ে এল। খাল থেকে যে-নয়নজুলি গ্রামের ভিতরে গিয়েছে, তার ওপরের কালভার্টটা দেখা গেল। গাঁয়ের লোকে বলে সাঁকো। এই সাঁকোটার ওপরেই একদিন দুর্গা বসেছিল। ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভোলা আর কেষ্টকে ন্যাড়াকালীতলায়। সেই পরিত্যক্ত সাহেববাগানটা বাঁ-দিকে!
সাঁকোটা পার হল। আর চাবুকের মতো ঝলকে উঠল তীব্র টর্চের আলো। দুর্গা চকিতে মুখ লুকাল হীরালালের পিঠের পিছনে। প্রশ্ন এল, কাঁহা যাতা?
সেই বন্দুকধারী সেপাই কটা। ওরা কাছে এগিয়ে এল। টর্চের আলো হীরালাল আর গাড়োয়ানের মুখের ওপর ফেলল।
হীরালাল বলল, আজ্ঞে শহরে যাচ্ছি। গঙ্গার ওপারে, বারাকপুর থেনে বারাসাত যাব।
সেপাইয়ের আলো গাড়ির ভিতরে পড়ল। দুর্গা তখন ঘোমটা টেনেছে। যদিও সেপাইয়ের সামনে একেবারে মুখ ঢাকেনি। কারণ তারা সহসা দুর্গাকে চিনতে পারবে না।
একজন সেপাই ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করল, অন্দর মে কী আছে?
হীরালাল বলল, আজ্ঞে বউ আছে একজন। মানে কথা হল কী, আমার বউ।
কথা শেষ হবার আগেই, নীচে খালের ধার থেকে কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কী হল সেপাই জি। গাড়ি নিকি?
ধ্বক করে উঠল দুর্গার বুকের মধ্যে। ভোলা! ভোলার গলার স্বর।
সেপাই জবাব দিল, হ্যাঁ।
ভোলা বলল, ছেড়ো না যেন। আগে যাই দাঁড়াও। কেষ্টা।
কেষ্টর গলা শোনা গেল, হাঁ।
–আয়, গাড়িটা দেখি কোত্থেকে এল।
কেষ্টর গলা শোনা গেল, যে-গুড়ের সন্ধানে আছি, তা মিলবে না।
ভোলা বলল, তা জানি। দুগগা হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়।
দুর্গার যতই সাহস থাক, নিশ্বাস ঠেকে রইল তার গলার কাছে। এখন হীরালাল ভরসা। ছইয়ের পিছনের মুখঘাটের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল সে।
ভোলা-কেষ্ট দুজনেই এল। টর্চের আলো ফেলাই ছিল গাড়িটার ওপর।
ভোলা জিজ্ঞেস করল গাড়োয়ানকে, কে হে, চেনা মানুষ নিকি?
গাড়োয়ানটি নীরস গলায় বলল, দেখে লাও।
কেষ্ট বলল, দেখলেই তো চেনা যায় না। কোত্থেকে আসছ?
–বিমলাপুর।
ভোলা বলল, হুঁ! দেখি সেপাইজি, আলোটা এটটু ইদিকে মারো দিকিনি।
হীরালালকে দেখাল সে। আলো পড়ল হীরালালের ওপর। হীরালালের ঘাড়ে আর মুখে, পাউডারের ঘাম লেগে মেঘলা ভাঙা রোদের মতো হয়েছে।
ভোলা-কেষ্ট পাশাপাশি। রক্তাভ ভাবলেশহীন চোখ জোড়া ভিতরে। লাল শাড়ি, ঘোমটা ঢাকা মূর্তি তারা দেখতে পেল। দুজনে মুখ চাওয়াচায়ি করল।
ভোলা বলল, বউ নিকি?
হীরালাল বলল, হ্যাঁ।
কেষ্ট আপন মনে উচ্চারণ করল, বউ।
-যাওয়া হবে কোথা?
ভোলা জিজ্ঞেস করল।
বারাসাত।
–আর একটু আগে বেরনো উচিত ছিল যেন? সেই সদরে গে রাত করে গঙ্গা পার হতে হবে।
হীরালাল বলল, হ্যাঁ ; এটটু তো দেরিই হয়ে গেছে।
ভোলা আর কেষ্ট আর একবার চোখাচোখি করল। ভোলা বলল, আমাদের ইদিক পানে, একজন মেয়েমানষের খোঁজ চলছে। তাই বলছিলুম, বউয়ের ঘোমটাখান একবার খোলা যায় না? মুখখানা দেখব খালি।
সেপাই তিনজনেই মুখ টিপে হাসল। টর্চের আলোটা ভিতরে পড়ল ভাল করে।
দুর্গা শক্ত হয়ে উঠল। ঘামতে আরম্ভ করেছে সে। তদ্রুপ অবস্থা হীরালালের। সে প্রায় আমতা আমতা করে বলল, বউয়ের মুখ দেইখবেন কী মশাই। এ আবার কেমন কথা?
কেষ্ট বলল, আমরা আবগারির লোক। ক্ষেতি কিছু হবে না।
একজন সেপাই বলল, ঠিক হ্যায় বাবা জরুকে মু নহি দেখাও তো শমাম দেখা দো। হো যায়েগা, ব্যাস্। দারু উরু কুছ হ্যায় সাহ্ মে?
হীরালাল তাড়াতাড়ি বলল, এ তো বড় ভ্যালা বেপদ হল দেখছি। দারু পাব কমনে মশাই?
ভোলা জানে, আইন তার হাতে। সশস্ত্র সিপাহি আছে সঙ্গে। সে গাড়ির ওপরে পা দিল। বলল, দেখব সব জিনিসপত্তর।
ভোলার ছায়া পড়ে গাড়ির ভিতরটা অন্ধকার হল এক মুহূর্ত। দুর্গা চকিতে সরে গেল পিছনের মুখছাটের কাছে। মাত্র দুটি গিট। মুখছাট খুলেই, পিছন দিয়ে নেমে দৌড়নো ছাড়া গতি নেই। সকলেই গাড়ির সামনের দিকে আছে।
বিদ্যুৎ গতিতে গিঁট খুলল দুর্গা। যে মুহূর্তে মুখছাট খুলে গেল, সেই মুহূর্তেই ভোলা চেঁচিয়ে উঠল, পালাচ্ছে।
বলেই সে ছইয়ের উপর দিয়েই লাফিয়ে, বিশাল হিংস্র জানোয়ারের মতো দুর্গার ওপরে পড়ল। পড়েই একটা বীভৎস উল্লাসে আবার চিৎকার করে উঠল, দুগগা। দুগগা! পেয়েছি।
হীরালাল আর গাড়োয়ান দৌড়বার চেষ্টা করছিল। সেপাইরা তাদের ধরে ফেলল ছুটে। একটা হাঁকডাক চেঁচামেচি পড়ে গেল।
কিন্তু ভোলা যেন কী এক অভূতপূর্ব আনন্দে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তার বাহুর বেষ্টনীতে দুর্গা। একটা উদভ্রান্ত শুয়োরের মতো তার চোখ যেন দিশেহারা হয়ে গেল। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
কেষ্টাও চেঁচিয়ে উঠল, দুগগা! দুগগা!
দুর্গা হ্যাঁচকা দিয়ে গর্জে উঠল, গায়ে হাত দিস না, খবরদার।
কিন্তু ভোলার বাহুবেষ্টনী আরও কঠিন হল। সে ভুলে গেল, তার কর্তব্য। সে ভুলল, সে কে! সে শুধু দেখল, সেই দুর্গা। তার রক্তের মধ্যে উন্মত্ত মহাপ্রলয়ের ঢেউ উঠল। সে দুর্গাকে মুহূর্তে দুহাত তুলে অন্ধকার খালপাড়ের ঢালু জঙ্গলে দৌড় দিল। পিছনে পিছনে কেষ্টা। আজ। আজ সেই দিন! কাল থেকে আর আবগারির কাজ নয়! একটা অধ্যায়ের শেষ।
দুর্গা ভোলার চুলের মুঠি ধরে টেনে চিৎকার করে উঠল, ছাড় ছাড় বলছি! ভোলা আরও হিংস্র হল। দুর্গার হাত ধরতে গিয়ে, ফাঁস করে বুকের জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলল। আছড়ে ফেলল দুর্গাকে কালকাসুরে জঙ্গলে। নুয়ে পড়ে কাপড় ধরে টানল।
সেপাইয়ের চিৎকার ভেসে এল, এই ভোলা, এই কেষ্টা, কাঁহা রে?
দুর্গা একটা ভয়ংকর গর্জন করল। মনে হল মাটি ফাটল! আকাশ কুটি কুটি হল। সেই সঙ্গেই ভোলার অন্তিম চিৎকার শোনা গেল দুগগা!
কিন্তু দুর্গার হাত থামল না। মুহুর্মুহু তার হাত বিষাক্ত ফণার মতো বারে বারে ভোলার সর্বাঙ্গে ছোবলাতে লাগল। তার হাতে চিরঞ্জীবের দেওয়া সেই অস্ত্র। সাপিনীর মতো গর্জাতে লাগল সে, ঢ্যামনা, কুত্তা, গায়ে হাত দিবি?
কেষ্ট অন্ধকারের মধ্যেও ভোলার সেই ভয়ংকর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে কাঁপতে লাগল। পিছন ফিরে দৌড়ে চিৎকার করে উঠল, খুন! খুন করেছে ভোলাকে!
দুজন সেপাই বন্দুক নিয়ে ছুটে এল। হাতে তাদের টর্চলাইট। কিন্তু কেষ্ট দাঁড়াল না। সে ছুটতে ছুটতে একেবারে আবগারির অফিসে।
সেপাই দুজন থমকে দাঁড়াল। ভোলার সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত। কিন্তু রক্তাম্বরী দুর্গা পালায়নি। হাতের অস্ত্র ফেলেনি। শুধু বুকের জামা ছিঁড়ে যাওয়া অনাবৃত অংশে আঁচল টেনে দিল। সন্দেহান্বিত রক্ত চোখে তাকাল সেপাইয়ের দিকে। বলল, রুদ্ধশ্বাস হয়ে, দম নিয়ে নিয়ে বলল, ওকে মেরেছি। কোথা নে যাবে চলো।
সেপাই দুজনেই বন্দুক বাগিয়ে দুদিক থেকে ঘিরেছে দুর্গাকে। কিন্তু তারাও যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একজন খালি বলল, মারডালা। জান সে খতম কর দিয়া।
.
বলাই যখন সদলবলে এল, ওখানে দুর্গা তেমনি বসে আছে। খোলা চুল, গালে একটি ছোট কাটা দাগ। সেখান দিয়ে রক্ত পড়ছে। রক্তাম্বরী দুর্গাকে দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখে কাজল, ঠোঁটে রং, কপালে সিঁথিতে যেন অঙ্গারের মতো জ্বলজ্বলে সিঁদুর। এলো চুল। সঙ্গে নিয়ে আসা হ্যাজাকের আলো যেন দুর্গার গায়ে পড়েই দ্বিগুণ হল।
পায়ের কাছে পড়ে আছে ভোলা। চোখের পাতা আধখোলা। গলায় বুকে সুগভীর ক্ষতের মুখগুলিতে রক্ত ড্যালা পাকিয়ে গিয়েছে। খালি গা ছিল সে। উরতের ওপরে উঠে গিয়েছে কাপড়। হাঁ করে আছে সে। জিভটা যেন গুটিয়ে গিয়েছে মুখের মধ্যে। ছোপ ধরা দাঁতের ভিতরগুলি দেখা যাচ্ছে।
সেই দিকে চোখ রেখেই বলাই ডেকে বলল, বিনয়, সাইকেল এনেছ?
–না স্যার।
–অফিস থেকে সাইকেল নিয়ে যাও থানায়। ওসি না থাকলে, যে-ই হোক, কাউকে আসতে বলো। উইথ জিপ আসতে বলবে।
–আচ্ছা স্যার।
চলে গেল জমাদার বিনয়। ইতিমধ্যে গোরুর গাড়ির বাক্সবিছানা থেকে মদের ব্লাডারগুলি বার করা হয়েছে।
বলাই বলল, কাসেম, ব্লাডারগুলি যেভাবে ছিল, সেইভাবে রেখে দাওগে।
যাই বড়বাবু।
তারপর? কথা ফুরিয়ে যেতে লাগল বলাইয়ের। হ্যারিকেন হাতে লোকজন আসতে দেখা যাচ্ছে গ্রাম থেকে। ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে না যেন। কেউ কথা বলছে না। বলাই আর তাকাতে পারছে না দুর্গার দিকে।
শুধু নন্দকে কেউ দেখতে পেল না, এই ভিড়ের মধ্যে। দেখল না, ছায়ার মতো সরে গিয়ে, সে ছুটে যাচ্ছে নিল্লার দিকে।
বলাই একটু একটু করে চোখ তুলল দুর্গার দিকে। দুর্গা পুবদিকে মুখ করে বসেছিল। ওই দিকেই নিল্লা গ্রাম।
বলাই বলল, মদ নিয়ে যাচ্ছিলে দুর্গা?
তেমন যেন রূঢ় হল না বলাইয়ের গলা। দুর্গা বলল, হ্যাঁ।
–ভোলাকে তুমি
মেরেছি বড়বাবু।
দুর্গা বলে উঠল। বলল, ও তো চোরাচালানদারনিকে ধরে নাই বড়বাবু, আমাকে ধরেছেল। বে-ইজ্জত করবে বলে টেনে নে এসেছেল এখেনে। তাই মেরেছি।
বলাইয়ের মনে হল, তার গলা স্খলিত শোনাবে। সে সাবধান হয়ে বলল, খুন করবে বলেই মেরেছিলে?
–হ্যাঁ। নইলে ও আমাকে রেহাই দিত না। ধড়ে প্রাণ থাকতে না।
দুর্গা সকলের মুখের দিকে তাকায়। অনেক লোক এসেছে। চেনা অচেনা অনেক লোক এখনও আসছে। হাট বসার মতো। কিন্তু সেই মুখটি কোথায়? আসবে না? রাগ করবে? ঘেন্না করবে খুনি দুর্গাকে? মুখ দেখবে না আর? দুর্গা অবাধ্য হয়েছে, তাই? বারণ মানেনি বলে রাগ হবে, না?
কারা যেন ছুটে এল। দুর্গা ব্যাকুল চোখ তুলে তাকাল। না, সে নয়। কেউ কি তাকে একটু খবর দেবে না? যদি চালান করে দেয় আগেই? খুন করলে ফাঁসি হয়। আর কি তাকে দেখতে পাব না? একবারটি? একবারটি শুধু।..হীরালালের দোষ আমি কাটিয়ে দিয়ে যাব, গাড়োয়ানেরও। বড়দি মেজদির (সুশীলা অচলা) বিয়েটা দেখা হবে না। গুলি, নন্দদা, বেদো-খুড়ো, ডোমনি-খুড়ি, যমুনা-মাসি, যোগো, ওদের বোধহয় আর দেখতে পাব না, না? আমার বাবা, বাকাঁ বাগদি আমার বাবা। সে কি এ সব দেখতে পাচ্ছে? বাবা গো! অই দেখো, তুমি কাঁদছ। আমি কাঁদি না। তুমি জানতে, এ সোমসারে কাঁদলে কিছু হয় না। তুমি তো সব দেখছ বোধহয়? ও জানোয়ারটার মরণ লিখা ছিল নিশ্চয় আমার হাতে। সেইদিন, ভোরবেলা, হাটের ধারে আমার এই কথা মনে হয়েছিল। তাই হল।
কে? এল নাকি? না, সে নয়। বোধহয় আসবে না। খবর দিলেও না। আমি অবাধ্য হয়েছি। কথা শুনিনি। রাগ করে বলবে, যা খুশি হোক, যাব না। তবু রাগ করে এলেও তো একটু দেখা হত। সাত তাড়াতাড়ি ফিরে এসে তাকে এই বেশে দেখা দেব ভেবেছিলুম।
আশ্চর্য! আজ সিঁদুর পরলুম। আজই শেষ। আজই প্রথম। এমনও হয়। সোনার হারটাও তো পরেছি। একবার দেখে গেলে পারত। বেশ তো, কথা শুনিনি। আর তো কোনওদিন দুর্গা অবাধ্য হবে না। এই তো শেষ। আজ আর ছোট্ঠাকুর বলতে ইচ্ছে করছে না। চিরঞ্জীব নামও না। কোনও নাম নয়। একটা মুর্তি, একটা মূর্তি শুধু। কোনও নাম দিয়ে যাকে চেনা যায় না। শুধু মুখ চোখ দেখলেই হয়।
.
একটু বাতাস এল। মৃত ভোলার গায়ের লোমগুলি শিউরে উঠল। এতক্ষণ পরে, গলার ক্ষত দিয়ে আবার খানিকটা রক্ত উপছে এল।
আচ্ছা, গত মাসে তো আমার কিছু হয়নি। যমুনা-মাসিও বলেছিল, তোকে যেন কেমন কেমন দেখায় দুর্গা। তা হলে? যদি ফাঁসি হয়। আমার ফাঁসি হলে গর্ভের জীব কি বাঁচবে? তা কখনও বাঁচবে না। বাবা, তুমি তো সব জান। আর একটা কথা তাকে আমি বলব। যদি সে আসে। নইলে বলতে বলে দিয়ে যাব। বলব, এ সমাজে সোমসারে এত জ্বলছিলুম। রাগ করে শোধ নিচ্ছিলুম। সদরের মেয়ে পাড়ায় গে বসে নাই। তবু বলব, আমি বলব তোমাকে, আমার ইজ্জতে লাগছেল। তোমারও যেমন লাগছেল। কেন? এ পথে যদি এলুম, তবে ইজ্জতের খিদে কেন? তোমাকে কেন আমি মানী দেখতে চেয়েছিলুম? তোমার মানে মানিনী হতে চেয়েছিলুম। তা যখন সোমসার দেবে না, তখন, (পায়ে পড়ি রাগ কোরো না) ফিরে এসো। এ পথে আর নয়। কিন্তু বলা হল না। বলব বলব করে বলা হল না। তার আগেই শেষ হল। তবু একবারটি এসো। একবার বলে যাব।…
জিপ গাড়ির শব্দ শোনা গেল ওপরের রাস্তায়। ও-সি-র চিৎকার ভেসে এল, সান্যাল!
ইয়েস?
–ইজ ইট রিয়ালি মাডার।
ইয়েস!
ওসি হুড়মুড় করে নেমে এল। এসে দুর্গা আর মৃত ভোলাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। বলাইকে জিজ্ঞেস করল, ইজ শি?
বলাই বলল, হ্যাঁ।
–স্বীকার করেছে নাকি?
–হ্যাঁ! নিজেই বলছে।
কারণ?
–ওকে নাকি রেপ করবার চেষ্টা করছিল!
–আই সি? কোয়ায়েট ইয়ং গার্ল? হু ইজ শি। দ্যাট টাইগ্রেস আই থিঙ্ক?
বলাই বলল, হ্যাঁ।
গলা নামিয়ে বলল ও-সি, বাট হোয়াই ইউ আর লুকিং সো ডেজার্টেড?
বলাই বলল, ভাল লাগছে না। আচ্ছা, ওকে কি থানায় নিয়ে যাবেন?
–হ্যাঁ তাই তো উচিত। কেস তো বোধ হয় দুটো। ইল্লিসিট লিকার অ্যান্ড মার্ডার। সঙ্গে আরও লোক আছে নাকি?
–আছে। তবে তারা প্রায় আদার ব্যাপারি। বড় জোর কিছু ফাইন হতে পারে।
ওসি আর একবার দুর্গার দিকে তাকিয়ে বলল, এ তো ম্যারেড দেখছি।
বলাই বলল, তা প্রায় তাই বলা যায়। যদিও লিগাল ম্যারেজ কিছু হয়নি। আর সেই লোকটির কথা ভেবেই আমি আশ্চর্য হচ্ছি। সবাই এল। সে আসেনি।
ওসি বলল, নাউ দি হানি ইজ ইন বোটল। হোয়াই হি শুড কাম। সেই চিরঞ্জীব বলে ছেলেটা তো? আমি তো তাকে চিনি বিলক্ষণ। পলেটিকাল রেকর্ডে তো তার নাম আছে এখনও। কিন্তু তাকে তো ফাঁসাতে পারবে না।
বলাই বলল, একমাত্র মেয়েটাই পারে। কিন্তু সে আশা না করাই ভাল।
ওসি চিৎকার করে এস-আই দাশকে ডেকে বলল, কই দাশ, ডেসক্রিপশন লিখুন একটা তাড়াতাড়ি, তারপরে সব নিয়ে চলুন। যে মরেছে, সে তো একসাইজে-এর ইনফরমার?
–হ্যাঁ, কনট্রাক্টে কাজ করত।
–এক কাজ করলে হয়। জিপে তো ডেডবডিটা তোলা যাবে না। গোরুর গাড়িতেই তুলে নেওয়া যাক।
তাই সাব্যস্ত হল।
কিন্তু বলাই চারদিকে কোথাও অখিলবাবুকে দেখতে পেল না। সে রাস্তার উপরে উঠে এল। যেখানে হীরালাল আর গাড়োয়ানসহ গাড়িটা ঘিরে রয়েছে সেপাইরা। কিন্তু অখিলবাবু কোথায়? কাসেমকে জিজ্ঞেস করল সে, অখিলবাবু কোথায়?
একটা গাছতলার অন্ধকার থেকে প্রায় সুপ্তোত্থিত গলা ভেসে এল, এই যে স্যার। কিছু বলছেন?
হ্যারিকেনের আলোয় অখিলবাবুর মুখটা দেখে অবাক হল বলাই। কেমন যেন ঘুমভাঙা, স্বপ্নভাঙা দেখাচ্ছে তাকে। বলাই বলল, কী করছিলেন?
অখিলবাবু বললেন, বসেছিলাম। ভাবছিলাম ব্যাপারটা।
বলাই তবু অবাক হয়ে বলল, ও!
অখিলবাবুর গলাটা মোটা শোনাল। বললেন, হ্যাঁ ভাবছিলাম স্যার। মানে, অনেকদিন আছি এখানে, ছোটবেলা দেখেছি মেয়েটাকে তাই আর কী। আমাদের আর কী, বুড়ো হয়ে গেলাম, কিন্তু পাপ আমাদের ছাড়ল না।
বলতে বলতে অখিলবাবু হেসে ফেললেন। বললেন, আমিও একটা স্কেচ করে ফেলি, দরকার হবে তো। কাগজ নিয়েই এসেছি।
বলাই তাকিয়ে দেখল অখিলবাবুকে। কোন পাপের কথা বললেন অখিলবাবু, কে জানে।
.
রাত এগারোটা বাজে। বলাই থানা থেকে ফিরবে ভাবল। কাসেম ছাড়া নিজের অফিসের সবাইকে সে পাঠিয়ে দিয়েছে। থানার ওসি সংলগ্ন কোয়ার্টারে খেতে গিয়েছে। এলেই বলাই চলে যাবে। দুর্গা মেঝেয় বসে আছে পা গুটিয়ে। ভোলার মৃতদেহ একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে, বারান্দায় রেখেছে সেপাইয়ের হেফাজতে। কাল জেলা সদরের মর্গে যাবে। দুর্গাকেও কাল মহকুমা হাজতেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এখানকার হাজত-ঘরে বসে আছে হীরালাল আর গাড়োয়ান। দুর্গাকে জামিন নিশ্চয় দেওয়া হবে না। ওদের দুজনকে দিয়ে দেবে।
এস-আই দাশ আর ও-সি এতক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে স্টেটমেন্ট নিয়েছে দুর্গার। এবার ভাল করে গুছিয়ে লিখে নিচ্ছে দাশ।
বলাই দেখল, দুর্গার আঁচল খসে গিয়েছে। ভোলার থাবার আঘাতে যেটুকু অনাবৃত হয়েছিল, আর তা ঢাকতে ভুলে যাচ্ছে সে। বলাইয়ের সন্দেহ হল, ওই মৃত ভোলারই দাঁতের দাগ দুর্গার গালে। দুর্গার অপলক চোখ দুটি বাইরে। বলাই জানে, দুর্গার চোখ কার অপেক্ষায়। এত ঘৃণা বুঝি আর কোনওদিন হয়নি চিরঞ্জীবের প্রতি।
সে ডাকল, দুর্গা।
–অ্যাঁ?
দুর্গার যেন চমক ভাঙল।
বলাই বলল, চিরঞ্জীব এল না।
দুর্গা কোনও জবাব দিল না।
বলাই বলল, তুমি ওকে ছেড়ো না দুর্গা, তুমিও ওকে শিক্ষা দাও, ওকে ধরিয়ে দাও। কী পেলে তুমি ওর কাছে?
দুর্গা যেন শুনতেই পায়নি। সে একাগ্র হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। যেন ধ্যানে বসে আছে।
ও-সি এল ঘরে। বলাইকে বলল, আছেন এখনও?
বলাই বলল, হ্যাঁ। একটা কথা বলছিলাম। চিরঞ্জীব যদি আসে—
বলাইয়ের কথা শেষ হল না। ও-সি যেন কী বলে উঠতে যাচ্ছিল। সেপাইয়ের গলার রুক্ষ স্বর শোনা গেল, কেয়া মাংতা?
সঙ্গে সঙ্গে দুর্গা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। ও-সি গর্জে উঠল, বসো, বসো তুমি। কে?
চিরঞ্জীব দরজায় এসে দাঁড়াল। যেন চিরঞ্জীবের গলা নয়, আর কারুর চুপিচুপি গলার স্বর। যাব স্যার?
ওসি বলল, কাম ইন। চিরঞ্জীব ব্যানার্জি?
–হ্যাঁ।
চিরঞ্জীব ঢুকল দুর্গার দিকে তাকিয়ে। বলাই ইশারা করে, ও-সি-কে চুপ করে থাকতে বলল। দুর্গার চোখের পলক পড়ল না। কী যেন বলছে দুর্গা ফিসফিস করে। চিরঞ্জীব একবার তাকাল দারোগার দিকে। আবার ফিরল দুর্গার দিকে।
দুর্গার হাতটা ক্রমেই থানার পাথরের মেঝে খামচে খামচে অগ্রসর হতে লাগল। চিরঞ্জীবের পায়ের কাছে এসে থামল। কিন্তু কারুর চোখ থেকে কেউ চোখ সরাতে পারল না। দুর্গার অনুচ্চারিত কথা অস্ফুটধ্বনিতে এবার উচ্চারিত হল, মাপ করো, মাপ করো, আমাকে মাপ করো। রাগ কোরো না। ও আমাকে রেহাই দিত না, তাই মেরেছি। রাগ কোরো না। আমি এমন কাজ আর কখনও করব না।
কিন্তু চিরঞ্জীব কিছুই শুনতে পেল না। সে দুর্গার সিঁথি দেখছে, কপাল দেখছে, গলা দেখছে, বেশ দেখছে। চোখে চোখে তাকিয়ে দেখছে। কিছু শুনছে না। শুধু দুটি হাতে অক্ষম রক্তের দাপাদাপি। ওই প্রতিটি চেনা অঙ্গকে আঁকড়ে বুকে নিতে ইচ্ছে করছে। শুধু অর্থহীন প্রলাপের মতো একটি কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, এ কী করলি দুর্গা?
এবং তার মুখ দিয়ে সেই কথাটি বেরিয়ে এল, এ কী করলি দুর্গা।
দুর্গা চোখ নামাল না। মাথা ঝাঁঝিয়ে খালি বলল, জানি না, জানি না। ও আমাকে রেহাই দিত না, তাই। তাই। সেই অস্তরখানি যে আমার কাছে থাকত। ও যে জানোয়ার হয়ে গেছল।
কিন্তু চিরঞ্জীবের কানে কয়েকদিন আগে, দুর্গার সেই কথাগুলি বাজতে লাগল, মরব, মরব।
চিরঞ্জীব যেন টুঁটি-টেপা গলায় বলল, কোনও পথ রাখলিনে? একটু ফাঁক রাখলিনে দুর্গা?
দুর্গার হাত তখন চিরঞ্জীবের শ্যান্ডেলসুদ্ধ পা ছুঁয়েছে। অসহায় কান্নায় বলল, ত্যাখন যে কিছু মনে ছিল না। কিছুটি না। অসুরের মতন আমাকে কাঁধে ফেলে নে ছুটতে লাগল খালধারের জঙ্গলে। আমাকে বে-ইজ্জত করতে লাগল।
বলতে বলতে দুর্গার জলে ভেজা চোখে আবার আগুন ফুটল। অঙ্গারের মতো দপদপিয়ে উঠল সারা মুখ। স্ফীত হল নাসারন্ধ্র। বলল, ত্যাখন কি কিছু মনে থাকে ছোটঠাকুর? রক্ত দশশন করতে ইচ্ছে যায় না? আবার হলে আবার মারব আমি। যত বার হবে, তত বার। তুমি হলে কী করতে?
চিরঞ্জীব হাত বাড়িয়ে দিল দুর্গার মাথায়। উপুড় হয়ে বলল, জানি দুর্গা জানি
ওসি বলে উঠল, নো মোর। ডোন্ট টাচ হার। সরে আসুন আপনি।
ওসি হাতের ইশারা করল চিরঞ্জীবকে। চিরঞ্জীব দুর্গার দিকে চোখ রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বুকের বোতাম খোলা, উশকো-খুশকো চুল, কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি, কালি পড়া চোখের কোল, নত মাথা চিরঞ্জীবকে দুর্গার চেয়ে বেশি করুণ দেখাল। চোখে তার জল নেই। কিন্তু তার চেয়ে বেশি। এই রকম ভাবলেশহীন অসহায় মুখ তার কোনওদিন কেউ দেখেনি।
কথা বলতে গিয়ে ওই দৃঢ় দুর্বিনীত ঠোঁট কেঁপে যেতে দেখেনি কেউ।
চিরঞ্জীবের দৃষ্টি অনুসরণ করে দুর্গা আঁচলে বুক ঢাকল। তার রক্তের অশেষ তৃষ্ণা নিয়ে চিরঞ্জীবের বুকের দিকে তাকাল। তার শেষ শক্তি দিয়ে সে পা চেপে ধরল চিরঞ্জীবের। চিরঞ্জীব অন্যদিকে মুখ করে বলল, ছাড় দুর্গা।
ওসি বলল, বেল দেবার কোনও প্রশ্নই নেই। সেটা কোর্ট ডিসাইড করবে। কোর্ট অনুমতি দিলে দেখাও করতে পারবেন। এখানে নয়, সম্ভবত জেল-হাজতে। আর ওই দুটি কালকেই বেল পেয়ে যাবে হয়তো।
হীরালাল আর গাড়োয়ানকে দেখিয়ে বলল ও-সি। হাতের ঘড়ি দেখে বলল আবার চিরঞ্জীবকে, ইউ বেটার গো নাউ। দুর্গাকে আমি এবার অন্য ঘরে তালা বন্ধ করে দেব। দুর্গার হাত আস্তে আস্তে শিথিল হল চিরঞ্জীবের পা থেকে। চিরঞ্জীব সরে এল। কিন্তু চোখের দৃষ্টি ওদের পরস্পরকে বেঁধে রাখতে চাইল।
চিরঞ্জীবের মনে হল, কী যেন একটা ঠেলে আসছে তার বুক থেকে। তার শক্ত নিষ্ঠুর দুর্বিনীত বুক থেকে। আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলে, বুক থেকে ঠেলে আসা দারুণ কঠিন শক্ত জিনিসটি ফেটে বুঝি চৌচির হয়ে যাবে। সে জোর করে চোখ ফেরাল। মুখ ফেরাল। ফিরতে যাবে, দুর্গা সহসা ডেকে উঠল।
–ছোটঠাকুর, শোনো গো
চিরঞ্জীব ফিরল। যেন স্বাভাবিক গলায় বলল, শিকেয় তোমার জন্যে মাছ ঝাল দেওয়া তুলে রেখে এসেছি। আর নিরিমিষ তরকারি।
চিরঞ্জীব এবার অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, দুর্গা! দুর্গা!
সে কথা শুনতে পেল না দুর্গা। বলল, তোমার ভাতও শিকেয় তোলা। নন্দদাকে বলে এসেছি। আজ সে বেড়ে দেবে, খেয়ো কিন্তুন, বুঝলে?
চিরঞ্জীব তেমনি অপরিস্ফুট আর্তধ্বনি করে বলল, তুই সত্যি বাঘিনী রে? সত্যি?
দুর্গা তখনও বলে চলেছে, আর কুলুঙ্গিতে তোমার মাজা গেলাস রয়েছে। এতে করে জল দিতে বোলো। আর গুলিকে বোলো ছোট্ঠাকুর, আমাদের ভাত-তরকারিগুলোন যেন ও খায়। আর—
চিরঞ্জীব এবার রুদ্ধস্বরে মিনতি করল, চুপ কর দুর্গা, চুপ কর। বলব, সব বলব, সব করব, যা বললি।
ওসি আর কথা বলতে দিল না। চিরঞ্জীবের সামনে এসে দাঁড়াল! বেরিয়ে গেল চিরঞ্জীব। দুর্গা তাকিয়ে ছিল তৃষ্ণার্ত ব্যাকুল চোখে।
কাপড়ে-ঢাকা মৃতদেহটির দিকে একবার তাকিয়ে, ধীরে ধীরে রাস্তায় নেমে এল চিরঞ্জীব। বৃষ্টি আর আসেনি। কিন্তু মেঘ আছে, অন্ধকার করে আছে তেমনি। নির্জন অন্ধকার রাস্তা, আকাশ, গাছ, সব যেন আজ দুর্গার জীবনের মতো বাতাসহীন কালো আড়ষ্ট অর্থহীন।
কোন দিকে যাবে চিরঞ্জীব? এখন কি নিল্লায় যাবে আবার? সেখানে সবাই তার জন্য বসে আছে। আজ বাইরে মদ চালান যাবার কথা নয়। কানা নদীর ধারে যে পুরনো কালীমন্দির রয়েছে তার একটি সুড়ঙ্গঘর আছে। কিংবদন্তি আছে যে, ওর ভিতরে গেলে, কেউ কোনও দিন ফেরে না। যেতেও নেই নাকি। কোনও এক সময় নাকি নরবলি হত ওর ভিতরে। নরকঙ্কালে নাকি ঠাসা আছে সুড়ঙ্গঘরটা। তার ওপরে যখন বড় বড় অজগরেরা চলে বেড়ায়, তখন সেই হাড়ে মড়মড় শব্দ ওঠে। অনেকে অনেকদিন নাকি শুনতেও পেয়েছে। সেই কালীমন্দিরের পাতালঘর আবিষ্কৃত হয়েছে। শূন্য ঘর। শুধু একটি কালো পাথরের শিলিঙ আছে ঘরের মাঝখানে। সাপ হয়তো আছে, মানুষের সাড়া পেলেই পালাবে। আজ কথা ছিল, সেই পাতালঘরে মদ রেখে দেওয়া হবে। যা-কিছু সরঞ্জাম, সব চলে যাবে সেখানে।
কিন্তু নিল্লায় যেতে ইচ্ছে করল না চিরঞ্জীবের। গ্রামের পথেও যে সে চলছে না, সে খেয়াল নেই। ন্যাড়াকালীতলার দিকে চলছে সে। জেনে নয়, অজান্তে।
এমন সময় বলাই বেরিয়ে এল থানা থেকে। ওসি তাকে জিপগাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিল। সে যায়নি ইচ্ছে করেই। অন্ধকারে লক্ষ করে সে ডাকল, চিরঞ্জীববাবু!
চিরঞ্জীব ফিরল। দূর থেকেই জিজ্ঞেস করল, কী বলছেন?
–শুনুন।
চিরঞ্জীব ফিরে বলাইয়ের কাছে এল।
বলাই বলল, কোথায় যাচ্ছেন ওদিকে?
বলাইয়ের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সন্দেহ করল, চিরঞ্জীব হয়তো তার সেই একই কাজে ফিরে যাচ্ছে এখুনি। যদিও গলার স্বরটা অন্যরকম লাগল তার।
চিরঞ্জীব বলল, এমনি যাচ্ছিলুম। কোথাও ভেবে নয়।
বলাই বলল, বাড়ি যান। দুর্গা আপনার জন্য রান্না করে রেখে এসেছে। আপনার গিয়ে খাওয়া উচিত।
চিরঞ্জীব বলল, আশ্চর্য! আজ দুর্গা আমার জন্য শেষ রান্না করে রেখে এসেছিল।
বলাই বলল, শেষ নাও হতে পারে। সবই তো আপনার জন্যে। এর পরে যদি আর সুযোগ পান—
কথা শেষ হবার আগেই চিরঞ্জীব বলে উঠল, আচ্ছা আমাকে থানার এই উঠোনটায় বসে থাকতে দেবে?
লাভ কী? বাড়ি যান। চলুন, আমিও যাব।
চিরঞ্জীব চলতে লাগল বলাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে। চিরঞ্জীবের খালি পা। সে যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থাতেই ছুটে এসেছিল। গভীর অন্ধকার রাত্রির বুকে বাজতে লাগল বলাইয়ের জুতোর শব্দ।
এবার কী করবেন ভাবছেন চিরঞ্জীববাবু? বলাই জিজ্ঞেস করল। চিরঞ্জীব বলল, জানিনে।
বলাই বলল, আপনি নিশ্চয় জানেন, দুর্গার ভীষণ আত্মসম্মানবোধ ছিল। আপনাদের এ জীবন বোধ হয় সে আর ইদানীং সমর্থন করছিল না।
চিরঞ্জীব বলল, এখন যেন তাই মনে হচ্ছে।
–কিন্তু অনেক মূল্য দিয়ে।
বলাই বলল।
অনেক মূল্য। কত মূল্য? কী দিয়ে তা নির্ধারণ করা যায়? কী মূল্য ছিল দুর্গার? হয়তো সংসারের মানুষদের কাছে কানাকড়িটিও নয়। কিন্তু চিরঞ্জীবের জীবনে বা কত কড়ি? মূল্য শব্দটাই যেন অবাস্তব বোধ হতে লাগল।
আবগারি-অফিসের সামনে বলাই বিদায় নিল। বলল, আচ্ছা কাল কোর্টে দেখা হবে।
অন্ধকারে ধীরে ধীরে দুর্গার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল চিরঞ্জীব। সে বুঝতে পারল, বাতি না জ্বেলে অনেকে দাওয়ায় বসে আছে। নন্দ, গুলি, বেদো, যমুনা, যোগো, সবাই। থেকে থেকে, আচমকা এক-একটা কথা বলছে তারা।
কিন্তু চিরঞ্জীবের পা উঠল না। যেন শক্ত করে কেউ ধরে আছে। এ বাড়ি দুর্গা নেই। আর কোনওদিন আসবে কিনা কেউ জানে না। এ বাড়িতে আর কেমন করে ঢোকা যায়?
এ বাড়িতে ঢোকা যায় না। পিছন ফিরলে, এই যে গ্রাম, এই গ্রামে কি থাকা যায়? সকল পথে দুর্গার পায়ের শব্দ কি বাজবে না? এই গ্রামের রাতে, এই গ্রামে স্তব্ধ দুপুরে দুর্গার উচ্চ হাসি কি প্রতিধ্বনি করবে না?
এই গ্রামে থাকা যায় না, এই দেশে থাকা যায় না। কিন্তু হৃৎপিণ্ড বাদ দিয়ে কি বাঁচা যায়? ছিন্নবাধা দুর্বিনীত হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে কি নামটা বাজবে না? অহর্নিশ চলার সব অহঙ্কার কি ঘুচবে না? চলার বেগের ছন্দটা কি ফাঁকি মানবে? সে কি বেয়াদপ বিদ্রোহী ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়াবে না?
দুর্গা কি কখনও ছেড়ে যাবে? এই তো সবে শুরু। দুর্গার এই তো সবে শুরু। কারণ এই বাড়ি থাকবে, চিরঞ্জীব থাকবে। তাই আর এক দুর্গার শুরু হবে। এই বাড়ি দেখিয়ে লোকে বলবে। চিরঞ্জীবকে দেখিয়ে লোকে বলবে। চিরঞ্জীবের সকল পারের ঘাটে ঘাটে নিরন্তর খেলায় দুর্গা বসে থাকবে তার নিশিন্দা-পাতা আয়ত চোখ দুটি তুলে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে।
না, যেতে হবে ওই ঘরে। মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে মাজা গেলাসে জল পান করে অনিশ্চিত অন্ধকার বিহারের পথে যেতে হবে।
.
শ্ৰীধর দাসের পরাজয় হয়েছে নির্বাচনে।
চিরঞ্জীবের মনে হয়েছিল, এ পরাজয় যেন তার জীবনেরই চকিত আঘাতের সঙ্গে যুক্ত। অথচ কত নিশ্চিন্ত ছিল। সন্দেহের অতীত। এখন মনে হয় বোধ হয় তাই এই পরাজয়। এত নিশ্চিন্ত, এত নিশ্চিন্ততাই বুঝি ডেকে আনল সব পরাজয়। ভোটের সময় অনেক সভা হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরের মধ্যে তেমন সভা হয়নি। উন্নয়নমূলক যে সব কাজের মধ্যে সমিতির সকলের থাকার কথা ছিল সেগুলি সেই একই সরকারি দপ্তরের লোকেদের হাতেই থেকে গিয়েছিল। সেটা সরকারি অফিসের জোরে নয়, নিজেদেরই আলাদা করে রাখা হয়েছে। গ্রাম-পঞ্চায়েতের নির্বাচনের ওপর একটুও জোর দেওয়া হয়নি। যেন, বিধানসভার সদস্য নিজেদের লোক আছে বলে পঞ্চায়েতের ওপর অধিকারটা কেউ বড় করে দেখেনি। গত বছর মজুরির আন্দোলনের জন্য যে কৃষকেরা সকলেই প্রস্তুত ছিল কিংবা অন্যায় ভাবে ক্যানেল কর আদায়ের বিরুদ্ধে যে দৃঢ় মনোভাব ছিল, কোনওটাই যেন তেমন আমল পায়নি। অবিশ্বাস ও হতাশা বাড়ছিল।
নতুন কোনও তথ্য বা চিন্তা নয় এ সব। গোটা কৃষক-আন্দোলনকে যদি একটি পরিবারের বিষয় ভাবা যায়, তবে এগুলি প্রত্যহের খুঁটিনাটির মধ্যে পড়ে। কিন্তু কেন পড়েনি? কে জানে, কেন? চিরঞ্জীব তার কিছুই জানে না।
কিন্তু আশ্চর্য! চিরঞ্জীব এ সব কথা ভাবছে কেন? এ বিষয়গুলি তো তার চিন্তায় আসার কথা নয়। পাঁছ বছরের এ সব ভাবনা কোথায় লুকিয়েছিল তার? অবচেতনের কোন স্তরে?
আরও আশ্চর্য! আজ এগারো মাস পূর্ণ হল দুর্গার মামলার রায় শুনে ফিরছে এখন চিরঞ্জীব। আরও আগেই মামলা শেষ হত। জেল হাসপাতালে দুর্গার একটি অকাল মৃত সন্তান হয়েছিল। এখন ভাল আছে। যদিও দুর্গার চেহারাটা একেবারেই বদলে গিয়েছে। রোগা হয়েছে, তাই লম্বা হয়েছে। চোখ দুটি আরও বড় দেখায় আজকাল।
আজ মামলার রায় শুনে এল। জেলা সদর থেকে ফিরছে সে এখন। মহকুমা জংশন স্টেশন থেকে যে-গাড়ি বদলে আসতে হয়, সেই গাড়িতে উঠেই সে দেখল সপারিষদ গোলকবিহারী মিত্র। নব নির্বাচিত এম. এল. এ। তাই বোধহয় কথাগুলি মনে পড়ল। নইলে যে-গোলকের ওপর কোনও গ্রামের একটু আস্থা নেই, সে কেমন করে নির্বাচিত হল। ভুয়া ভোট আর কত দিতে পারে। প্রায় চার হাজার ভোট পেয়েছেন শ্রীধরদা।
যদিও এই ভোটের রাজনীতির ওপরে একটুও আস্থা নেই চিরঞ্জীবের। তার ধারণা, ওটা একটা খারাপ ব্যবসায়ের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। সাধারণ মানুষকেই যেন বিষাক্ত এবং হতাশ করা হচ্ছে। অবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের জমি থেকে সরানো গেল না। সর্বক্ষেত্রে প্রায় তাদেরই নেতৃত্ব। কৃষকের হাতে জমি দাও–এ শ্লোগান তারা কোনওদিন সার্থক হতে দেবে না। অ্যাসেম্বলি আর পার্লামেন্ট তো এক ভিন্ন জাতীয় কথাকারদের কারখানা। শৌখিন মলাটের সাহিত্যের মতো তো হাতে হাতেই ফেরে। কোথাও কোনও বীজ পড়ে না। অঙ্কুরিত হয় না কিছুই।
ভাগ্যিস, কথাগুলি মনে মনেই ভাবছে। লোকে জানলে, এই ভাববার অধিকারটুকুও তার ছিল না। উচ্চারণ তো দূরের কথা। চিরঞ্জীব খুনি মদ স্মাগলার দলের নেতা। সে জানে, ট্রেনের কামরায় শুধু গোলক মিত্তিরেরা-ই নয়। অনেকে তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। যারা তাকে চেনে। কত কী ভাবছে তারা। কত রূপকথা, কত উপন্যাস তার নামে রটেছে। এখনও সে এক ভয়ংকর। ইতিকথার নায়ক। সে কেন ও সব কৃষক-আন্দোলন, রাজনীতির কথা ভাববে।
গুলিটা সঙ্গেই রয়েছে। সে বলল, চাদরটা ভাল করে গায়ে দাও চিরোদা। তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না?
গায়ের চাদর খুলে পড়েছিল কোলের ওপর। ঠাণ্ডা আছে কিন্তু চিরঞ্জীবের শীত লাগছে না। বরং কেমন যেন গরমই লাগছে। জিভটা শুকিয়ে উঠছে। আজকাল তার জিভ শুকিয়ে যাওয়াটা ব্যাধির পর্যায়ে পৌঁছেছে। চোখে কতকগুলি লাল ছর পড়েছে। চুলগুলি বেয়ে পড়েছে ঘাড়ের পাশ দিয়ে। চোখের কোলে বাসা বেঁধেছে স্থায়ী অন্ধকার। তার মুখে যে এত কাটা ছেড়া দাগ আছে আগে যেন টের পাওয়া যেত না। এমনি সহসা বোঝা যায় না কতখানি গ্রীর ভেঙেছে তার। কিন্তু খুব অল্পদিনের মধ্যে চিরঞ্জীব যেন অনেক বয়স্ক হয়ে গিয়েছে। সিগারেট টানলেও, তার দমক সহ্য করতে পারে না। হাঁফ ধরার মতো কাশে। অল্প দামের সিগারেট সব সময় তার ঠোঁটে আছে। অথচ তিরিশেও পৌঁছয়নি সে।
চাদরটা তুলে নিল গায়ে। বাইরে মাঠ এখন রিক্ত। ধানকাটা সারা, খানে খানে রবিশস্য কিছু আছে। অড়হর, মুগ, কলাই।
মনে করতে না চাইলে কী হবে। সেই মুখখানি ভেসে উঠল আবার। কালো পাড় শাড়ি, সাদা, মোটা কাপড়ের একখানি ব্লাউজ পরা, একহারা দুর্গা। বিচারক যখন রায় দিলেন, দুর্গা তার দিকেই তাকিয়েছিল।
সরকারি উকিলের শেষ কথাগুলি ওর মনে পড়ছে। মানবতার দোহাই দিয়ে সে বিচারককে বলেছিল, যাকে আমরা এখন দেখছি, এই পারুলবালা দাসী–
পারুলবালা! কী আশ্চর্য নাম দুর্গার। কত সময় চিরঞ্জীবের ওই নামে ডাকতে ইচ্ছে করেছে। লজ্জায় পারত না। আবেগ যখন বাধা মানত না, তখনই বলতে পারত।
–এই পারুলবালা দাসী, ওরফে দুর্গা, একে এখন দেখে খুবই ভালমানুষ মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, পাপ দেহ-ব্যবসা থেকে শুরু করে (সরকারি উকিলের তাই বিশ্বাস), নিজের হাতে বে-আইনি মদ চোলাই, নানান অভিনব পন্থায় স্মাগলিং এবং সর্বোপরি খুন, এটাই হচ্ছে তার স্বাভাবিক প্রাত্যহিক জীবন। আবগারি তার নাম-ই দিয়েছিল বাঘিনী। আই মিন টাইগ্রেস। এমনিই ভয়ংকর নিষ্ঠুর হিংস্র এই মেয়েমানুষটি। পৃথিবীর আলো বাতাস এর জন্যে নয়। এর মৃত্যু হলেই দেশের মঙ্গল। দশের মঙ্গল। বিচারকের কাছে প্রার্থনা–
তখন চিরঞ্জীবের চোখে কি আগুন জ্বলছিল! দুর্গা তার বড় বড় চোখ দুটি তুলে, তাকে কী বলছিল আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে?
লোয়ার কোর্টেই বিচার শেষ হল। আপিলের অধিকার স্বীকার করা হয়নি। বিচারক অনুভব করেছেন, এই জাতীয় কোনও মেয়ে আপন ইজ্জত বাঁচাবার জন্য খুন করতে পারে না। যে-অবস্থায় সে খুন করেছিল একজন আবগারি-ইনফর্মারকে, সে অবস্থায় ইজ্জতের কোনও প্রশ্নই আসতে পারে। ধর্ষিতা হওয়ার আশঙ্কাও তার পক্ষে, তার জীবনের পক্ষে অভাবনীয়। ডেসপারেট মার্ডার বলতে যা বোঝায়, তাই হয়েছে। যদিও আইনের চোখে নারী পুরুষ সমান, তবু কোর্ট পারুলবালাকে করুণা দেখাচ্ছে। ফাঁসি না দিয়ে, তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল।
দুর্গা যেন ছটফটিয়ে উঠেছিল।
বিচারক যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার কিছু বলবার আছে?
দুর্গা বলেছিল, বাঁচিয়ে কেন রাখলেন হুজুর। ফাঁসি কেন দিলেন না গো?
-তোমাকে দয়া করা হল।
তখন সবাই দেখছিল, পারুলবালা দাসী শুধু ফিসফিস করে বলছে, এ কী হল ছোটঠাকুর! একী হল।
মিথ্যে বলবে না চিরঞ্জীব। তার মনে হয়েছিল, শেষ শঙ্খ বাজল না। প্রতীক্ষা রইল, তাই, এখন নিষ্ঠুর মনে হলেও বেঁচে থাকার তাগিদটা রয়ে গেল তার। কারণ, অদৃশ্য হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের মতো, দুর্গা বাজবে, বাজবে, বাজবে।
একটু কথা বলতে দিয়েছিল পুলিশ।
দুর্গা বলেছিল, একেবারে যেতে পারলুম না ছোট্ঠাকুর। বছরে অ্যাটটা দিন সময় পেলে জেলে এস।
চিরঞ্জীবের গলা কাঁপছিল। বলেছিল, বছরে একদিন কেন?
দুর্গা বলেছিল, ওইদিন এলেই হবে। উনিশে ভাদ্দোর, যেদিন হারটা পাটঠেছেলে—
–দুর্গা!
–হ্যাঁ ছোটঠাকুর। আর, এটটা কথা। কতবারই তো বললুম এ এগারো মাসের মধ্যে, এ পথ থেকে ফিরে যেয়ো। সবাই বলে, তুমি এখন থেমে আছ। আবার নিকি শুরু করবে। তা নয়। এবার ফিরে যাও, আর আর–
বল দুর্গা।
দুর্গা অম্লান গলায় মিনতি করেছিল, দেখো তো শরীলটা কী করেছ? এ্যাটটা বে করো—
চিরঞ্জীব একেবারে ভেঙে পড়েছিল। সে বলে উঠেছিল, ওরে, ওরে রাক্ষুসী, তুই একটা রাক্ষুসী দুর্গা!
দুর্গা তবু বলেছিল, সোমসার ছেলে-পিলে চাই না? আমি জেলে বসে তাদের দেখব, তুমি নে আসবে সঙ্গে করে—
সময় হয়ে গিয়েছিল। কথা শেষ হবার আগেই নিয়ে গিয়েছিল দুর্গাকে।
নামো চিরোদা।
গুলি ডাকল। তাদের গাঁয়ের স্টেশনে এসেছে। আজ বুঝি হাটের দিন। মানুষ আর গোরুর গাড়ির ভিড়। চারদিকে কোলাহল। খেজুর গুড়ের গন্ধই বেশি আসছে চারদিক থেকে। মাঘ মাস যাচ্ছে তো। তরি-তরকারিও প্রচুর। এই দুটি মাস, একটু প্রাচুর্য সবখানেই। তাই, এ সময়ে হাটে বেগুনবাঁশিও বাজে।
আবগারির নতুন জমাদার তাকিয়ে দেখল চিরঞ্জীবকে। বলাই, কাসেম, অখিলবাবু–তিন জনেই বদলি হয়ে গিয়েছিল একে একে।
একদিন বলাই বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল চিরঞ্জীবকে। অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল চিরঞ্জীবের। বলাই তার স্ত্রী মলিনাদেবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তার। আশ্চর্য! মলিনাদেবী কেঁদে ফেলেছিলেন। একটুও লজ্জা করেননি। বলেছিলেন খালি, দেখুন তো কী হল! আর কি তাকে ফিরে পাবেন? থাকতে বোঝেননি, আর আপনার কী রইল?
মলিনাদেবী সত্যি বলেছিলেন। কিন্তু সবটুকু নয়। কিছুই কি রইল না?
.
দুর্গার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল চিরঞ্জীব। নন্দ বসে আছে উঠোনে। বেদো আর তার ডোমনি। যমুনা-মাসি আর মেসো। হীরালাল খালাস পেয়ে গিয়েছে। সে অনেকদিন হল যোগোকে নিয়ে দেশে ফিরেছে। আর কোনওদিন নাকি শ্বশুরবাড়ি-মুখো হবে না।
গুলিই সবাইকে শেষ বিচারের কথা শোনাল।
কিন্তু চিরঞ্জীব কী করবে? বুকের জ্বালা বুকেই রইল। আগুন নিভল না। শোধ নেওয়া হল না। তবু তো আর চোলাই করতে যেতে পারছে না। শোধ নেওয়ার রূপটা যেন কেমন বদলে যাচ্ছে মনের মধ্যে। সে যে বলেছিল, সোনার লঙ্কা ছারখার করতে ইচ্ছে। কিন্তু সোনার লঙ্কা পুড়ল কই? আমি যে দুর্গাকেই আগে জ্বালালাম! রাক্ষসের সোনার লঙ্কার একটি ইটও তো খসাতে পারিনি। তাদেরই দরবারের বিচারে আমি এখানে এসেছি। নিজের গায়ে আগুন নিয়ে ফিরছি। সবাই আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাকে। মাথা তুলতে পারছিনে! আমি একলা আগুন লাগাব কেমন করে? আমার কী আছে? পাতালের অন্ধকারে সাপের বিষাক্ত নিশ্বাস ফেলছি। উত্থান চাই। আগুন নিয়ে উত্থান।
চোলাই দলের সবাই মুখ চেয়ে আছে আমার! কবে আবার আরম্ভ হবে। আর পারব না, দুর্গা বলেছে বলে শুধু নয়। তোকে হারালাম বলে নয় শুধু। তোকে হারিয়ে বুঝতে হল, আমার মায়ের, আমার দিদির মুক্তি আমার একার ক্ষমতায় নেই। আমার একলা অন্ধকার পাতালচক্রের আবর্তে নেই। সামগ্রিক উত্থানে। বুধাইদার সহজ কথা, সহজ যুক্তির কথাগুলিই সত্যি।
মলিনাদেবী বলেছিলেন, আর আপনার কী রইল?
কিছুই কি রইল না? এত বড় ভুলটা ভাঙল, এ তো অনেক বড় পাওনা। শোধ নেবার দিগন্ত ভরে যে এত কোটি-কোটি মানুষের হাত রয়েছে, তাকে যে নতুন করে দেখতে পেলাম, সেটা কি কিছু নয়।
সামাজিক মনের যে বিচারক, সে অবিশ্বাস করবে চিরঞ্জীবকে। একটি মেয়েকে হারালে বলে সত্য উদ্ধার করলে তুমি?
হ্যাঁ, তাই তো। বক্তৃতা শুনে, বই পড়ে যারা সত্য উদ্ধার করেছে, তাদের দলে যেতে পারল না চিরঞ্জীব। নিতান্ত আপন, আপন রক্ত, আপন আত্মা, শুধু আপন ভালবাসার একটি ভয়ংকর চকিত আঘাতে সত্য কি কখনও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না? শুধু যার হারাল, সে-ই বুঝল, কী হারিয়ে বুঝতে হল। হারাল বলে সংবিৎ ফিরল সকলের কাছে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু সেই সকলময় দৃগী হবে, এমন মহৎ ভালবাসা চিরঞ্জীবের কোথায়? দুর্গা যে একটি, মাত্র একটি। জীবতত্ত্বের আকর্ষণে যদি কোনওদিন ভিন্ন দেহে দেহে ফিরতে হয়, শুধু পারুলবালার জন্য প্রতীক্ষাটুকুই তো ব্যক্তির মনুষ্যত্বের জয় ঘোষণা করে।
চিরঞ্জীব উঠোনের সকলের মাঝখানে বসে পড়ল। বলল, নন্দদা, ডাকাতি তো অনেকদিন ছেড়েছ। আর বোধহয় করতে পারবে না?
নন্দ অবাক হয়ে বলল, কেন বলো তো?
–তোমাকে এ বাড়িতে থাকতে হবে। খেটে-খুটে পেটের দানা জোগাড় করে থাকো। দুর্গা না আসা পর্যন্ত এ বাড়ি রক্ষা করো।
নন্দর মতো অত বড় দেহধারী ডাকাতটা গালে হাত দিয়ে বসে রইল। তারপর মুখটা নামিয়ে, দুই হাঁটুর মাঝখানে গুঁজে রাখল।
চিরঞ্জীব বলল, আমি চলি। মার কাছে যাই একটু। ঘুরে আসব।
সবাই মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনও কথা বলতে পারল না।
চিরঞ্জীব ডাকল, আয় রে গুলি।
রাস্তায় চলতে চলতে গুলিকে বলল, কী রে সনাতন ঘোষ কিংবা ওকুরের দলে যাবি নাকি?
গুলি কোনও কথা বলল না। চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে উঠল। শুধু চিরঞ্জীব তার গলা জড়িয়ে ধরে চলতে চলতে বলল, আরে, এমনি বললুম। ঠাট্টা করে। কিন্তু করবি কী?
গুলি বলল, যা বলো।
–এক কাজ কর। বুধাইদার কাছে চলে যা। গিয়ে বল, মোটর চালানো শিখিয়ে দাও। বুধাইদা তো পাগল। বকা ধমক করতে পারে, ছাড়িসনে। শিখে নে, একটা কাজ জানা থাকবে তবু, কেমন?
গুলি ঘাড় নেড়ে বলল, আচ্ছা। আর তুমি?
–আমি?
অন্যমনস্ক হয়ে বলল চিরঞ্জীব, দেখি।
বাড়ি ঢুকেই গলা তুলে ডাকল চিরঞ্জীব। মা ও মা!
মা এলেন। মাথাটি ন্যাড়া করেছেন। চোখের কোলগুলি ঢুকে প্রায় কংকালের মতো দেখাচ্ছে। চিরঞ্জীব চৌকির উপর থেকে টান মেরে তার বিছানা তুলে ফেলল। বেশ খান কতক ছড়ানো নোট। পাঁচ টাকা দশ টাকার। চিরঞ্জীব হেসে বলল, এতে তোমার এখন হয়ে যাবে মা। কাশীতে বড় মাসিমার কাছে অনেকবার যেতে চেয়েছ। এবার চলে যাও।
মা অসহায় ভাবে তাকালেন। কেঁদে বললেন, তুই?
চিরঞ্জীব বলল, থাকব এখানেই। এ গাঁ ছেড়ে কোথাও যাব না। তুমি চলে যাও। এ টাকায় তোমার অনেকদিন চলে যাবে। দরকার পড়লে লিখে জানিও। পাঠিয়ে দেব।
মা আবার বললেন, কিন্তু তুই? চিরো, তুই সংসার করবিনে?
চিরঞ্জীব হেসে উঠল। বলল, করব বইকী মা। সংসার মানে তো বিয়ে? যখন করতে ইচ্ছে করবে, তখন জানাব তোমাকে।
মা বললেন, আমি অনেক পাপ করেছি। তা বলে মরবার সময় তোকে দেখতেও দিবিনে একটু? তাড়িয়ে দিবি আমাকে?
চিরঞ্জীব একটু চুপ করে থেকে বলল, সত্যি বলছি মা, তুমি এখানে থাকলে আমার চলবে না। তুমি এখন বলছ এরকম, পরে হয়তো তোমার ভাল লাগবে না। তোমাকে আমি বড় মাসিমার কাছেই পাঠাব। তোমার শরীর খারাপ করলে, আমাকে চিঠি দিয়ো, আমি যাব।
কেমন যেন দৃঢ় মনে হল চিরঞ্জীবকে। মা অসহায় ভাবে বললেন, যেমন তোর ইচ্ছে চিরো। তবে, ডাকলে কিন্তু যাস, সেটা যেন মিছে না হয়।
.
সবাই চলে গিয়েছে। মা গিয়েছে। গুলি চলে গিয়েছে। এরা চলে যাবার পর দুটি দিন শুধু গালে হাত দিয়ে বসে রইল চিরঞ্জীব। পরদিন ভোরবেলা সে বেরিয়ে পড়ল। এক নাগাড়ে হেঁটে, প্রায় নটার সময় উপস্থিত হল এক গ্রামে, তার চেনা গ্রাম অনেকদিনের। চেনা পথঘাট। অনেক লোককেও সে চেনে। কিন্তু তাকে কেউ চিনতে পারল না। তাই কেউ কথা বলল না। চিরঞ্জীবও বলতে পারল না।
চিরঞ্জীবের কপালের রেখাগুলি কেঁপে কেঁপে উঠছে সংশয়ে। কী একটা আশা-নিরাশার আলোছায়া তার মুখে খেলছে।
ধান মাড়াইয়ের কাজ করছে কয়েকজন চাষি বাড়ির বাইরে। উঠোন সেটা। ইটের পাঁচিল-ঘেরা মাটির বাড়ি। বাড়ির বাইরের দরজাটা খোলা।
চিরঞ্জীব একেবারে ভিতরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল। রান্নাঘরে রান্নার ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ। একটি বড় ঘরের দাওয়ায় এক বৃদ্ধ ভ্রূ কুঁচকে তাকে নিরীক্ষণ করছেন। ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মোটা মোটা বই-ভরতি র্যাক।
বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, কে ওখেনে? ওখেনে কে?
বলতে বলতেই, ঘরের ভেতর থেকে শ্রীধর এসে দাঁড়ালেন দাওয়ায়। পরনের কাপড় এলোমেলো। চুল উশকোখুশকো। খালি গা। হাতে খোলা কলম। কিছু লিখছিলেন বোধহয়।
কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। শ্রীধরের মুখ কঠিন হয়ে উঠল। তারপরে একটু বিস্ময়। নত মাথা, চিরঞ্জীবের আপাদমস্তক দেখে বললেন, কী চাই?
চিরঞ্জীব চোখ তুলে তাকাল। শ্রীধরের বুকটা কেমন দুলে উঠল। বললেন, কী বলতে চাস, ঘরে এসে বলে যা।
চিরঞ্জীব পায়ে পায়ে ঢুকল ঘরে। শ্রীধর তার টেবিলের সামনে, হাতলবিহীন চেয়ারটিতে বসলেন। তাকিয়ে দেখলেন সেই অতীতের কিশোর ছেলেটিকে। শ্রীধরের বুকের মধ্যে একটা কেমন অস্থিরতা পাক খেতে লাগল। চিরঞ্জীবের মুখে মাথায় পায়ে ধুলো। হেঁটে এসেছে এতদূর।
শ্রীধর বললেন, কোত্থেকে এলি?
চিরঞ্জীব বলল, বাড়ি থেকে।
বলে সে, শ্রীধরের চেয়ারের আর টেবিলের মাঝখানে মাটিতেই বসে পড়ল। শ্রীধর স্তব্ধ হয়ে রইলেন তবু। তারপরে হঠাৎ যেন মনে পড়ল, জিজ্ঞেস করলেন, সেই মেয়েটার কী হল?
চিরঞ্জীব মুখ নামিয়ে রেখেই বলল, যাবজ্জীবন জেল। শ্রীধরদা—
শ্রীধর তাকালেন। চিরঞ্জীব ঢোক গিলল। প্রায় ভেঙে যাওয়া গলায় বলল, ফিরে এলুম শ্রীধরদা। আবার শুরু করব, আবার–
শ্রীধর হাত বাড়িয়ে চিরঞ্জীবের ধূলিরুক্ষ মাথা ধরলেন। তাঁর গলার স্বরও যেন কেমন চেপে গেল। বললেন, জানি চিরো, আমি কত চেয়েছি, মনে-প্রাণে চেয়েছি।
চিরঞ্জীব কারুর সামনে কাঁদতে পারে না। পায়ে ধরে লুটিয়ে পড়তে পারে না। এখানে তার সে লজ্জা, সে সঙ্কোচ, সে বাধা নেই। সে শ্রীধরের পা ধরে বলল, ক্ষমা করুন শ্রীধরদা, আমাকে ক্ষমা করুন।
শ্রীধর মাটিতে নেমে পড়ে, চিরঞ্জীবকে দুহাতে ধরে প্রায় চুপিচুপি বললেন, রাসকেল! তুই একটা রাসকেল। ছাড় পা ছাড়!
দুজনেই যেন একই স্পন্দন দোলায় দুলতে লাগল। শ্রীধর আবার বললেন, তেমনি চাপা গলায়, ভোট গেল। অবাক হয়ে গেছলুম। মিথ্যে বলব না, হতাশায় ভুগছিলুম কিন্তু কেন? কী মিথ্যে, কত মিথ্যে ভোগা ভুগেছি। তুই ফিরে আসতে পারিস, আর আমি ভোটের পরাজয়ে ঘরের কোণে মুখ লুকোব? কেন? কেন?
চিরঞ্জীব বলে উঠল না না শ্রীধরদা কী বলছেন আপনি? আপনি–
শ্রীধরদা বললেন, থাম। সত্যি কথা বলতে হবে না? রং বেরং ছড়িয়ে থাকলে কী হবে! ওটা তো রকমারি আলোর দোষ। একটা জায়গায় তো সবাই এক।
চিরঞ্জীব বলল, আমি জানি সেটা কোথায়।
-কোথায় বল তো?
-ভালবাসায়।
শ্রীধর যেন একটু অবাক হলেন। বোধহয় তাঁর কথাটাই সহজ করে বলল চিরঞ্জীব! ঘাড় নাড়লেন বারে বারে। ঠিক ঠিক, তাই। ভালবাসা। কী যেন কঠিন! ভালবাসা, কী যে নিষ্ঠুর আর কী বিচিত্র তার সংবেদ!