৫.৩ অন্ধকার রাত্রে বটতলায়

হাঁসুলী বাঁকের উপকথার মানুষেরা–অন্ধকার রাত্রে বটতলায় আশ্রয়গ্রহণকারী মানুষের দল। এ রাত্রি আদ্যিকালে আরম্ভ হয়েছে, শেষ কবে হবে জানে না। তবে শেষ যেদিন হবে, সেদিন হাঁসুলী বাঁকেরও শেষ হবে। কাহার-জীবন যতদিন, এ রাত্রি ততদিন, হাঁসুলী বাঁকও ততদিন। তারপর হয়ত দহে পরিণত হবে কোপাইয়ের কোপে, নয়ত কিছু হবে, কি হবে কে জানে! রাত্রে আকাশে তারা খসে, বাদল নামে, কাহারেরা ফল ভোগ করে, এর শেষ কি হয়? বনওয়ারী ভুল করেছিল, বছর শেষ হওয়ায় ভেবেছিল বিপদ কেটে গেল। তাই কি হয়? বিপদ কাটে না। দুদণ্ড জ্যোৎস্না দেখে যে ভাবে, বাদল আর হবে না, আকাশে তারা আর খসবে না, কিছুই জানে না। বনওয়ারী জানে, জেনেও ভুল করেছিল। কাহারপাড়ার আরও অনেকে ভুল করেছিল। এই ঘটনাটিতে ভুল সকলের ভাঙল। তাতে একটি সুফল হল কিন্তু।

পাঁচ জন ছাড়া করালীর দল সকলেই ছাড়ল। শেষাশেষি বহুজনই গোপনে গোপনে করালীর দিকে ঝুঁকেছিল। বনওয়ারী সকলকে বারবার সাবধান করেও মানাতে পারে নাই; এবার সব। থমকে গেল। ফিরল।

রতন প্ৰহাদ সকলেই ঘাড় নাড়লে। পাগল গান গাইলে—পুরনো গান–

মন চাহে যাও হে তুমি—আমি যাইব না–
কেলি-কদমতলায়, বৃন্দে গো!
মানিক পেলে তুমিই লিয়ো—আমি চাইব না
কালোমানিক কালায়, বৃন্দে গো!

ঠিক কথা। পাগল নইলে এ সকল কথা শোনায় কে, আর বাবাঠাকুরের শাসন ভিন্ন ভালর পথ ধরায় কিসে? পানার ছেলের এই সর্পাঘাতবাবাঠাকুরের বাহন যে সাপটি, সেই বংশের সাপের দণ্ডাঘাতের দণ্ডে কাহারপাড়া থমকে গেল। করালীর হাসি, বেপরোয়া কথা, সাজসজ্জা সবেরই রঙের উপর ভয়ের কালো রঙ মাখিয়ে দিলে। মাথার উপরের উড়োজাহাজের লাল নীল আলো বাবাঠাকুরের এক যুঁয়ে নিবে যাবে একদিন—এই সত্য উপলব্ধি করে সেই পুরনো কালের উদাস দৃষ্টি তাদের চোখে আবার ফিরে এল। ফলও হল। ঘোষ-বাড়িতে বনওয়ারীর মুখ থাকল।

ঘোষ মহাশয়ের বাড়িতে সকলেই গেল শ্রদ্ধার সঙ্গে। কৌলিক কাহারধর্ম সে কি ছাড়া যায়! শুধু করালীরা কজনে গেল না।

সে বললে—যা যাঃ! তোরা পতিত। কাহারপাড়াকে পতিত করলাম আমি। আরও বলে দিলে—ঘোষকর্তা যদি কারুরও কেরাচিনি বন্ধ করে, চিনি বন্ধ করে, তবে আমিও দেখব। সদরে দরখাস্ত দেব আমি। ম্যানকে নিয়ে চলে যাব ম্যাজিস্টর সাহেবের কাছে।

‘ম্যান’ মানে রাঙামুখে যুদ্ধের সাহেব, যে করালীর সঙ্গে মধ্যে মধ্যে কাহারপাড়ায় আসে।

বনওয়ারী শুনে হাসে। পতঙ্গের পাখা উঠলে সে মাতঙ্গ হয় না বাবা! মাতঙ্গ দূরের কথা পক্ষীও হয় না। বাবাঠাকুরের গাছতলাটি বাধানো হচ্ছে—বনওয়ারীই বাধিয়ে দিচ্ছে, সেইখানে বসে তদারক করতে করতে করালীর মাতঙ্গপনা দুবেলা সে দেখে। হেলেদুলে যায়, মধ্যে মধ্যে ‘ম্যান সাহেবটাকে সঙ্গে নিয়ে চারিপাশে ঘুরে বেড়ায়। লোকটা গলায় ঝুলানো একটা বাক্স নিয়ে কিলি কিলি করে ছবি তোলে—‘ফটোক্‌’ অর্থাৎ ফোটো।

সেদিন বনওয়ারী মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিল।

গোটা জ্যৈষ্ঠ কাঠফাটা রৌদ্র গেল। বৈশাখের সঙ্গে সঙ্গে পবনদেব ক্ষান্ত হয়েছেন। যোগাড়যন্ত্র করে বাবাঠাকুরের গাছটিকে খাড়া করে থানটি বাধাবার কাজ শেষ হয়েও হচ্ছে না। বিলাতি মাটির জন্যে চৌদ্দভুবন দেখলে বনওয়ারী। বিলাতি মাটি ‘কন্টোল হয়েছে। ‘রবশ্যাষে’ অর্থাৎ অবশেষে তিন গুণ দাম দিয়ে দু বস্তা মাটি সে পেয়েছে। আষাঢ় এসেছে। আকাশ যেন কেমন করছে। চারিদিকটা মধ্যে মধ্যে থমথমিয়ে উঠছে, আবার ক্ষান্ত হচ্ছে। এইবার নামবারই কথা।

“চৈতে মথর মথর বৈশাখে ঝড় পাথর
জষ্ঠিতে মাটি ফাটে, তবে জেনো বর্ষা বটে।”

হবার সব লক্ষণ মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আর দুটি দিন, বাবাঠাকুর, আর দুটি দিন-দুদিন হলেই ঠাঁইটি বাঁধানোর কাজ শেষ হবে। বিলাতি মাটি দেওয়া হচ্ছে আজ। কাল হলেই শুকিয়ে যাবে। বিলাতি মাটির ওই আশ্চর্য গুণ!

করালী এসে দাঁড়াল।

—কি?

–একটা কথা বলতে এলাম।

—তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা না।

—তোমার নাই, আমার আছে। গোটা পাড়ার আছে।

গোটা পাড়ার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ কি?

—তোমার যা সম্বন্ধ, আমারও তাই।

–না।

—‘না’ বললে আমি শুনব কেনে?

–ভাল। কি বলছ বল?

–বলচি, পাড়ার লোকের ঘরে ধান নাই, মনিবে ধান বন্ধ করেছে। তুমি হয় ব্যবস্থা কর, নইলে বল-ওরা কারখানাতে চলুক।

বনওয়ারী হুঙ্কার দিয়ে উঠল। করালী হাসলে, বললেই সব ভয় আমাকে দেখিও না। যা বলবার বললাম। যা করবার কোরো।

পটগট করে চলে গেল করালী। বনওয়ারী আক্রোশভরে চেয়ে রইল তার দিকে। কাল যুদ্ধ! যুদ্ধের গতিকে দু মাসের মধ্যে ধান পাঁচ টাকা থেকে দশ-বারতে উঠেছে। সদ্‌গোপেরা হুড়হুড় করে ধান বেচে টাকা করছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে জল না হওয়ার ছুতো ধরে ধান। বন্ধ করেছে। পাড়ার লোকের অভাব হয়েছে সত্যি। কিন্তু সে কষ্ট স্বীকার করতে হবে।

হঠাৎ চোখ বেঁধে গেল। গুড়-গুড় করে ডেকে উঠল মেঘ। বনওয়ারী আশ্বস্ত হল। বুকটা ফুলে উঠল। মেঘের এ ডাক বর্ষার মেঘের ডাক। বৈশাখে পবনদেবের মেঘ ডাকে কড়-কড়কড় শব্দে।

বর্ষার মেঘ ইন্দ্ররাজার মেঘ। এ মেঘ ডাকে গুড়-গুড়ু-গুড়ু-গুড় শব্দে। পশ্চিম থেকে দেয় মৃদু মৃদু বাতাস। ঝরঝর ঝরঝর ধারায় মেঘ যেন ভেঙে নেমে আসে মা-পৃথিবীর বুকে।

***

ঊনপঞ্চাশে আবার নামল আষাঢ় কাড়ান। জয় বাবাঠাকুর! কাহারেরা ঝাপ দিয়ে পড়ল হাঁসুলী বাঁকের মাঠে। হাল গরু নিয়ে ছুটল। পাগল পালাল গ্রাম ছেড়ে। কি করবে সে এখন আর গ্রামে থেকে? কাহারেরা পড়েছে চাষ নিয়ে, সে গায়ে একলা কাকে নিয়ে দিন কাটাবে? গোটা কাহারপাড়া মাঠে—গরু-মানুষ-মেয়ে-পুরুষ সব।

যে জমিতে হাল চলেছে, তার চারিপাশে ঝকবন্দি বক নেমেছে, লম্বা পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ লম্বা গলা বাড়িয়ে লম্বা ঠোঁটে জমির ঘোলা জলে ঠোকর মেরে ব্যাঙ পোকা কেঁচো কঁকড়া ধরে খাচ্ছে। লাঙলের ফালে জমির মাটির তলার পোকামাকড় ভেসে উঠছে। মাথার উপর উড়ছে ফিঙে কাকের দল। তারাও ছোঁ মারছে। কাকে আর ফিঙেতে চিরকেলে ঝগড়া; খাবার লোভে তাও ভুলেছে ওরা। বনওয়ারী বলে—উদর এমনি বটে! উদরের দায় বড় দায়!

কাহারদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জমির আলের গর্তের ভিতর কাঁকড়া ধরে বেড়াচ্ছে। কাহার-মেয়েরা ঘরের পাট-কাম সেরে, গাই-গরুর দুধ দুইয়ে চন্ননপুরে যারা দুধের যোগান দিতে যায় তাদের দিয়ে, মরদদের জন্যে জলখাবার নিয়ে মাঠে আসবে। সঙ্গে আছে ঝুড়ি কাস্তে, পুরুষদের জলখাবার খাইয়ে আলে আলে ঘাস কাটবে। বোঝা বোঝা ঘাস। কতক খাওয়াবে। নিজেদের গরুকে, কতক পাঠাবে চন্ননপুরে বিক্রির জন্যে।

চন্ননপুরে যাবার আলপথটি ঘাসে প্রায় ভরে গিয়েছে। এই পথটার দিকে তাকিয়ে সবচেয়ে খুশি হয় বনওয়ারী। ওপথে করালীর দল ছাড়া কাহাপাড়ার লোকেরা বড় কেউ হাটে না।

দুধ ঘাস ঘুটে যোগান দিতে যাওয়া ছাড়া ওপথে নিত্য কেউ হাটে না। তাও সে চন্ননপুরের কলের কারখানার এলাকায় নয়। ভদ্রলোকের বাবু মহাশয়দের পাড়াতে যায় তারা। মেয়েরাই যায়। পুরুষদের মধ্যে যার যেদিন মাঠের কাজ কম থাকে সে যায় বিকেলবেলা আবগারির পচুই মদের দোকানে। বড় একটা জালায় আনে রশি মদ, ধেনো পচাইয়ের সবচেয়ে তেজস্কর অংশটা। সেটা তারা জল মিশিয়ে পরিমাণে বাড়িয়ে যার যেমন পয়সার সামর্থ্য সে তেমনি ভাগ নিয়ে যায়। করালী চন্ননপুর যাওয়া-আসার একটা নতুন আলপথ তৈরি করেছে। পথটা একেবারে মাঠের বুক চিরে সোজা চলে গিয়েছে।

করালীর পিছনে পিছনে মাথলা, নটবর, তাদের পিছনে পিছনে আরও কজন ওই পথে যাওয়া-আসা করে। পিতিপুরুষের আমলের জাঙল-ঘেঁষা পথকে বায়ে রেখে নতুন পথ ফেলেছে। তারা। সেপথ কিন্তু আজও ঠিক হয়ে ওঠে নাই। মাথলা নটবর গোপাল ছাড়া আর সকলে সায়েস্তা হয়ে গিয়েছে, তারা আবার মাঠের কাজে লেগেছে। কাজ জুটিয়ে দিয়েছে বনওয়ারীই। কাজের ভাবনা কি? নতুন মাঠ হচ্ছে সায়েবডাঙায়। বাবুদের অঢেল পয়সা, জমি কাটিয়ে ফেলেছে অনেক, তাতে ঢেলেছে মরা পুকুরের পাক মাটি। চাষ চালিয়েছে জোর। কিন্তু বাবুরা তো নিজে হাতে চাষ করে না, চাষ করে কাহারেরা, আর করে কাহারদের মতই হাতেনাতে চাষ করতে যাদের নীচুকুলে জন্ম তারাই। এ হল ভগবানের বিধান, বাবাঠাকুরের হুকুম। খাট, খাও। বুক পেড়ে দু হাতে খাট, সোনার লক্ষ্মীতে ভরে উঠুক হাঁসুলীর মাঠ; বাবু মহাশয়ের সদ্‌গোপ মহাশয়দের ভাগ্য আর তোমাদের হাতযশ। মনিবের খামারে ধান তুলে দাও, মনিবান শাখ বাজিয়ে জলধারা দিয়ে লক্ষ্মী ঘরে তুলুক। তুমি আঁচলে খামার ঝেড়ে তুলে নিয়ে এস মা-লক্ষ্মীর পায়ের ধুলো। তাই তোমার ঢের, তার চেয়ে আর বেশি কি চাও? যেমন বিয়ে তেমনি বাজনা’। কাহারকুলে জন্ম যখন হয়েছে, তখন এ জনমের এই বিধান। চুরি কর, ডাকাতি কর, এর চেয়ে বেশি কিছুতেই হবে না। চুরি-ডাকাতি করেও তো দেখেছে কাহারেরা। এই তো পরম—সেদিন পর্যন্ত ডাকাতি করেছে। কি হয়েছে? তাতেও এই চুরি-ডাকাতি করে মাল তুলে দাও সামালদার মহাশয়ের ঘরে, চুরির লক্ষ্মী তার ঘরে তুলে দিয়ে নিয়ে এস শুধু সেই লক্ষ্মীর পায়ের ধুলো। আর নিয়ে এস অধর্মের বোঝ। তার চেয়ে বহু ভাগ্যে চাষের পথ খুলে দিয়েছেন কর্তাঠাকুর, সেই পথে হাট, ধর্মকে মাথায় রাখ। সকাল-সন্ধে দেবতাকে প্রণাম করে বল-এ জন্মে এই হল, আসছে জন্মে যেন উঁচুকুলে জনম দিয়ো দয়াময় হরি হে!

গোপালীবালা এসে দাঁড়াল মাঠের আলের উপর। জলখাবার নিয়ে এসেছে। বনওয়ারী ঘোষেদের ভাগের জমির একটা কোণ ‘চৌরস’ অর্থাৎ সমান করছে, হাস-হাস শব্দে কোদাল চালাচ্ছে। সদূগোপ মহাশয়দের গরুগুলি এই পথে নদীর ধারে চরতে যায়। জমিখানার একটি কোণকে খানিকটা যেন দুমড়ে দিয়ে গোপথটা চলে গিয়েছে। চারটি কোণ সমান একখানি ‘দেখনসারি’ অর্থাৎ দেখতে সুন্দর জমিতে পরিণত করবার জন্য বনওয়ারী প্রতি বৎসরই খানিকটা কেটে জমির মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে থাকে অন্যের অগোচরে। জাঙলের সদূগোপ মোয়দের গোচরে এলে তুমুল কাণ্ড করবে তারা। ঘোষ মশায়দের কানে উঠলেও তারা বলবেন কতবার তোমাকে বারণ করেছি বনওয়ারী। কি দরকার আমার খানিকটা জমি বাড়িয়ে নিয়ে? মেজ ঘোষ বললে— আশ্চর্য! জমিটা যদি তোমার হত তো বুঝতাম। এতে তোমার লাভ কি বল তো? বনওয়ারী এ সবের জবাব দিতে পারে না, মাথা চুলকোয়, কিন্তু চাষের সময় এলে খানিকটা বাড়িয়ে না নিয়েও তার মন পরিতুষ্ট হয় না।

গোপালীবালা বসল। বনওয়ারীর এখন কোনো দিকে তাকাবার অবসর নাই। এই সময়টায় এদিকে কেউ নাই; কাহারেরাও না। এই উপযুক্ত সময়। কাহারেরা তার অনুগত বটে, কিন্তু এ বিষয়ে বিশ্বাস নাই। নিজেরা কিছু বলবে না, কিন্তু ফুসফুস করে সদ্‌গোপ মনিবের কানে তুলে দেবে। দশ-পনের হাত লম্বা আলটার কোথাও আধ হাত, কোথাও তিন পোয়া জমি কেটে কুপিয়ে হেঁটে জমিটার চষাখোড়া মাটির সঙ্গে মিলিয়ে বনওয়ারী উঠে মাথা ঝাড়লে। কঁকড়া চুল থেকে জল ঝরে পড়ল—ঝরে পড়ল কালো বনওয়ারীর চুল থেকে মুক্তবরন টোপা টোপা জলের ফেঁটা। কোমরটা টাটিয়ে উঠেছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। বেঁকে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চাইলে বনওয়ারী। জলখাবারের বেলা হয়েছে। আকাশে ঘন ঘোর মেঘ আজ। বেলা বুঝবার উপায় নাই। কাল রাত্রি থেকে জোর বর্ষা নেমেছে। বাঁশবাঁদির বাঁশবন বট পাকুড় শিরীষ গাছের মাথায় ছাইরঙের মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, এক যাচ্ছে, এক আসছে—কেউ ফুলছে, কেউ কাঁপিছে—ক্রমশ আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, কেউ বা ছুটে চলে যাচ্ছে শনশন করে কোন দেশ থেকে কোন দেশে, কে জানে! কাহারপাড়ার চালে চালে বড় বড় গাছের গায়ে গায়ে বাঁশবনের ঘনপল্লবে কাহারবাড়ির উনোনের ধোঁয়া হালকা কুণ্ডলী পাকিয়ে জমে রয়েছে, যেন পেঁজা শিমুলতুলোর রাশি জড়িয়ে দিয়েছে কেউ। মেঘে মেঘে এমন ঘোরালো হয়ে আছে চারিদিকে যে বেলা ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। কেবল পেটে ক্ষিদে লেগেছে আর গরুবাছুরের ডাক শুনে মনে হচ্ছে যে, হাঁ, জলখাবারের বেলা হয়েছে। কিন্তু গোপালীবালাকে দেখে খুব খুশি হল না বনওয়ারী। সুবাসী এল না কেন? সে এলে যে তাকে দুদণ্ড দেখতে পেত, দুটো হাসি-খুশির কথা হত; পেট ভরার সঙ্গে মন-মেজাজ ভরে উঠত। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে বনওয়ারী। সে কথা বলাইবা যায় কি করে গোপালীবালাকে? তবে গোপালীবালা লোকটি বড় ভাল। সেই যে কুড়িটি টাকা নিয়ে বলেছিল, কোনো আপত্তি অশান্তি করবে না—সে কথা সে রেখেছে, কোনো আপত্তি অশান্তি করে না। ঘর দুয়ার গরু বাছুর হাঁস মুরগি নিয়ে আছে, ঘুটে দিচ্ছে, গোবর কুড়িয়ে আনছে, ধান ভেনে চাল করছে। সুবাসী শুধু ঘর নিকোয়, বাসন মাজে, ভাত রাঁধে, আর নিজের তরিবৎ সাজসজ্জ নিয়েই আছে। চুল বাঁধছে, খুলছে, আবার বাঁধছে। রাত্রিবেলা দেখতে পায় না বনওয়ারী, ভোরবেলা যখন ওঠে তখন নজরে পড়ে—সুবাসীর হাতে আলতার রঙের দাগ লেগে আছে, বনওয়ারীর নিজের অঙ্গেও তার দাগ লেগে থাকে প্রত্যহ। লজ্জার কথা। পাড়ার ছেলে-ছোকরা মেয়েরা মুখ টিপে হাসে, রতন প্ৰহাদ গুপী দেখতে পেলে আর বাকি রাখে না। ঘোষ-বাড়ির বউঠাকুরুন সেদিন দেখে যে ঠাট্টাটা তাকে করেছেন, তাতে বড়ই লজ্জা পেয়েছে। বনওয়ারী; তবু তো পাগল নাই। সে যে সেই কাড়ান লাগতেই গেরাম ছেড়ে কোথায় পালিয়েছে, আর ফেরে নাই। সে থাকলে গান বাঁধত।

বনওয়ারী মাঠের ঘোলা জলেই হাত মুখ ধুয়ে আলের উপর বসল। গোপালী তার সামনে খুলে দিলে মস্ত একটা খোরায় রাশিকৃত মুড়ি, খানিকটা গুড়, দুটো লঙ্কা, দুটো পেঁয়াজ। একটা বড় ঘটি থেকে ঢেলে দিলে জল। ভিজিয়ে মোটা মোটা গ্ৰাসে খেতে লাগল বনওয়ারী।

-হ-হ-হ। অই-অই! বারণ করলে শোনে না। চলল দেখ, পরের ড়ুয়ের পানে চলল। দেখ! মেরে তোমার পস্তা উড়িয়ে দেব, পম্বা নড়িয়ে দোব।

বনওয়ারী শাসন করছিল গরু দুটোকে। সে দুটো জোয়ালে জোতা অবস্থাতেই অন্য বীজধানের জমির দিকে যাবার উদ্যোগ করছিল।

গোপালীবালা উঠল, গরু দুটোর জোয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বনওয়ারী কিছুটা মুড়ি ফেলে রেখেই উঠল। এই নিয়ম। ওই কটি খাবে পরিবার। গোপালীবালা বনওয়ারীর দিকে পিছন ফিরে বসে খেতে লাগল। বনওয়ারী বললে—মুনিব-বাড়ি হয়ে যেয়ো। কদিন যাই নাই আমি। পাট-কাম থাকে তো করে দিয়ে যাবা।

গোপালী ঘাড় নেড়ে জানালে, তাই হবে।

গোপালী কেমন হয়ে গিয়েছে, সে কথা কয় না তেমন ভাল করে। বনওয়ারী আবার। বললে—একটা কথা বলছিলাম। যে টাকাটা দিয়েছি তাতে ধান কিনে আখ কেনে! যুদ্ধর বাজারে ধানের দর হু-হু করে বাড়বে বলছে সবাই। তোমার ধান তুমিই ‘আখবা’ আমি তাতে হাত দোব না। লাভ যা হবে তুমিই নেবে।

গোপালী আবার ঘাড় নেড়ে জানালে, তাই হবে।

বনওয়ারী রসিকতা করে আবার বললে—তবে যদি অভাব অনটন পড়ে, লোব তোমার কাছে চেয়ে। তুমিই তো ঘরের গিনি, তুমিই ততা নক্ষ্মী আমার, তোমার দৌলতেই তো সব। আমি তো ভিখিরি, খাটি, খাই।

গোপালী এবার কথা বললে তা লিয়ো।

বনওয়ারী বললে—ছটকীকে ঘরে এনেছি আটপৌরের মেয়ে বলে, বুয়েচ?

গোপালী ঘাড় ঘুরিয়ে এবার মুখ মুচকে হেসে বললে—আর কালোশশীর বুঝি, কালোশশীর মতন দেখতে শুনতে বলে।

বনওয়ারী অবাক হয়ে গেল! গোপালী এ কথা জানল কি করে?

অনেকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে সে বললেইসব কি যা-তা বলছ তুমি?

—যা—তা লয়, ঠিক বলছি আমি। আমি শুনেছি।

—শুনেছ? কে কে বললে?

গোপালী বনওয়ারীর দিকে চেয়ে ভয় পেলে খানিকটা, সে বললেই-উ-সি (এ-ও-সে) পঁচজনায় বলে। আর কালোশশী আমাকে দেখে হাসত যে মুখ টিপে টিপে। আর মেয়েলোক ঠিক বুঝতে পারে, বুয়েচ!

কালোশশী হাসত, নিশ্চয় হাসত এবং গোপালী যত বোকা হোক সে হাসির মানে নিশ্চয়। বুঝত। সে সম্বন্ধে কোনো কথা বলে ফল নাই। পাঁচজনটা কে?

হঠাৎ কানে এসে পৌছু একটা কান্নার শব্দ। মড়াকান্না। কে কাঁদছে? নয়ানের মা? চাষের সময় কাহারদের জোয়ান ছেলেরা চাষে খাটে, এ সময় জোয়ান ছেলের কথা মনে পড়ার কথা বটে। নিত্যই মনে পড়বে। কিন্তু কিন্তু কান্নাটা তো তেমন পুরনো কান্না নয়। তেমন সুর করে গানের মত বিনিয়ে বিনিয়ে তো কাঁদছে না! ওরে আমার সোনা মানিক বাবাধন রে, কোথা গেলি রে? তোর জলভরা উঁই পড়ে বাবা, তু কোথা গেলি রে?—সেসব কথার তো কিছুই শোনা যাচ্ছে না? এ যে আছাড়িপিছাড়ি কান্না, যেন এখনই কারও কিছু হয়েছে। ওরে বাবা রে! ওরে মা রে! ও বাবা রে! ও ধন রে! বলে যেন বুক চাপড়ে কাঁদছে।

গোপালীবালা কান পেতে শুনে বললে—হেই মা!

—কার কি হল বল দি-নি?

–মাথলাদের বাড়িতে গো।

–মাথলাদের বাড়িতে?

–হ্যাঁ, মাথলার বউয়ের গলা।

—কি হল?

–তা তো জানি না।

—তুমি যাও দি-নি। একটা খবর দিয়ে।

মাথলার বাড়িতে কি হল? মাথলার বাড়িতে তিনটি মানুষ বউ, বেটা, নিজে। মাথলা চন্ননপুরে। বউ কাঁদছে। তবে কি ছেলেটা? কি সৰ্বনাশ! রোগ নাই, বালাই নাই, কি হল হঠাৎ? কিছু হওয়ার মানে বাবাঠাকুরের রোষ। তবে কি করালীর উপর বাবার রোষ পড়ল এইবার? মাথলা করালীর সঙ্গে চন্ননপুরের কারখানায় গিয়েছে-কলির পাপপুরীতে। তবে কি–?

সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে যেন কে চেঁকি কুটতে আরম্ভ করে দিল। হে বাবা! হে বাবাঠাকুর।

ছুটতে ছুটতে এল একটি ছেলে! পেল্লাদের ছোটা। মাথলার ছেলেকে কিসে কামড়েছে। মাঠে কাকড়া ধরতে গিয়েছিল আলের গর্তের মধ্যে হাত পুরে। কিসে কামড়ে দিয়েছে। ছেলেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।

বনওয়ারী ছুটল।

পাড়ার মাতব্বর গুণী লোক সে। সাপের কামড়ের ওষুধও দু-চারটে জানে সে। জানতে হয়। আর জানত পাগল। সে বড় ওস্তাদ।

বর্ষার সময় কাহারপাড়ায় হাঁসুলী বাকে—দু-চারটে এমন হয়। নিয়তি। ‘সাপের লেখা বাঘের দেখা। কপালের লিখনে না থাকলে সর্পাঘাত হয় না আর বাঘ লিখন মানে না—দেখা হলেই খায়। তাই হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় বাঘ সম্বন্ধে যত সাবধান হয়, সাপ সম্বন্ধে সাবধান তত নয়। সাবধান হয় বৈকি, কিন্তু ওটাকে তারা লিখন বলেই মানে। চিরকালই তো বর্ষার সময় কঁকড়া ধরে কাহারেরা, মধ্যে মাঝে এমন হয় একটা আধটা। কিন্তু সবাই তো মরে না। তা হলে হয় ‘নিয়ৎ’ অর্থাৎ নিয়তি, নয় দেবরোষ কি ব্ৰহ্মরোষ। রোজই তো সবাই আঁচল-ভর্তি কঁকড়া নিয়ে ঘরে ফিরছে। লঙ্কা নুন দিয়ে চমৎকার হয় কাকড়ার ঝাল। শুধু ওই দিয়েই ভাত চলে যায়। হঠাৎ বনওয়ারী দাঁড়াল। একটা ওষুধ নজরে পড়েছে তার। ছেলেটাকে এগিয়ে যেতে। বলে সে শিকড় তুলতে বসল।

সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার ডাকলে ছেলেটাকে। আর একটা জরুরি কথা মনে পড়েছে। –যা তো রে ঘোষ মাশায়দের বাড়ি—আমার মনিব-বাড়ি। বড় ঘোষ মাশায়কে বলবি, মুরুক্মি পাঠালে সেই মিহিজামের ওষুধ-সপ্যাঘাতের ওষুধ, ‘নিউনাইন-বোডের’ ওষুধ যদি থাকে তো দ্যান।

ইউনিয়ন-বোর্ডের মেম্বর বড় ঘোষ মহাশয়ের হাতে বোর্ডের মিহিজামের সাপের ওষুধ দিয়েছে। এই কঠিন মাটির দেশে সাপের উপদ্রব বড় বেশি, তার মধ্যেও প্রকোপ বেশি হাঁসুলী বাকে। বাঁশবাঁদির ছায়ার মধ্যে শীতলতার আরামে এখানে আদিম কালের আবহাওয়া ভোরের ঘুমের মত এখনও বেঁচে রয়েছে। তার মধ্যে থাকতে ভালবাসে সাপ, বিছে, পোকা-মাকড়। মাছি মশাও এখানে ওই বাঁশপাতা-পচা পানির মধ্যে ভনভন করে। মানুষের দেহে সঞ্চারিত করে দেয় নানা বিষ। কাহারপাড়ায় মানুষের দেহে যখন ছিল ভীমের মত বল, তখন সেসব বিষ তারা হজম করত। এখন শ্রাবণ মাস না আসতেই কঁপন-লাগানো ‘মালোয়ারীতে পড়ে। তখন ‘কুনিয়ানের’ বড়িও পাওয়া যায় ‘নিউনাইন-বোডের’ মেম্বর ঘোষ মশায়ের কাছ থেকে। বনওয়ারী সুপারিশ করে দেয়। কিন্তু এ বছর নাকি দুটোর একটাও আর দেবে না ‘নিউনাইনবোড’। যুদ্ধ লেগেছে। আক্ৰাগণ্ডার জন্য বোর্ডের খরচ চলাই দায় হয়েছে সাপের ওষুধ, কুনিয়ানের বড়ি দেবে কোথা থেকে। তবুও বনওয়ারী ছেলেটাকে পাঠালে—যদি পুরনো শিশিতে ‘খানিক-আধেক’ পড়ে থাকে।

বনওয়ারী উঠে দাঁড়িয়ে কাছায় হাত দিলে। কাছাটা ঠিকই আছে। খুলে গেলে শিকড়ের ওষুধে কাজ হত না। এ সব হল ওস্তাদি তুক। আহাহা! একটা তুক করতে ভুল হয়ে গেল! যে ঘোড়াটা খবর নিয়ে এসেছিল, ওকে মেরে তাড়িয়ে দিতে হত। যে খবর দিতে আসে, সে যদি ছুটে পালায়, তবে রোগীর বিষও ঘরে নামতে আরম্ভ করে। এঃ, বড়ই ভুল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কি সাপ? বাবাঠাকুরের রোষ হলে নিশ্চয় সেই বাহনের দাঁতের দংশন। হবেই যে! পানার ছেলেটাকে দিয়ে আরম্ভ হয়েছে এবার। না, মঙ্গল নাই। মঙ্গল নাই। মঙ্গল নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *