মা
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৫ –পরিস্থিতি। পরিচ্ছেদ ২
মাতৃত্বে নারী পূর্ণ করে তার শারীরবৃত্তিক নিয়তি; এটা তার প্রাকৃতিক ‘পেশা,’ কেননা তার সমগ্র জৈবসংগঠন প্রজাতির স্থায়িভুবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তবে আমরা। দেখেছি মানবসমাজ কখনোই পুরোপুরি প্রকৃতির কাছে সমর্পিত হয় নি। এবং প্রায় এক শতাব্দী ধরে বিশেষ করে প্রজননের কাজটি আর শুধুই জৈব আকস্মিকতার ওপর নির্ভরশীল নয়; এটা মানুষের স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণের অধীনে এসে গেছে। কিছু কিছু দেশ সরকারিভাবে গ্রহণ করেছে জন্মনিরোধের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি; ক্যাথলিক প্রভাবের অধীন জাতিগুলোর মধ্যে এর চর্চা হয় গুপ্তভাবে। পুরুষটি হয়তো করে বাহ্যিক বীর্যপাত বা নারীটি সঙ্গমের পর তার দেহ থেকে বের করে দেয় শুক্রাণু। এ-ধরনের নিরোধ প্রেমিকপ্রেমিকা বা বিবাহিত দম্পতির মধ্যে মাঝেমাঝেই সৃষ্টি করে বিরোধ ও ক্ষোভ; পুরুষটি অপছন্দ করে সুখের মুহূর্তে সতর্ক থাকতে; নারীটি ঘৃণা করে ডুশ। করার অপ্রীতিকর কাজটি; পুরুষটি ক্ষুব্ধ থাকে নারীটির অতিশয় উর্বর দেহের ওপর; নারীটি ভয় পায় জীবনের বীজানুগুলোকে, যেগুলোকে পুরুষটি ঝুঁকির সাথে ঢুকিয়ে। দিয়েছে তার ভেতরে। আর এসব সাবধানতা সত্ত্বেও যখন নারীটি দেখে যে সে ‘ধরা পড়ে গেছে’, তখন উভয়েই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। যে-সব দেশে গর্ভনিরোধের পদ্ধতি আদিম, সেখানে এটা ইটে প্রায়ই। তখন আশ্রয় নিতে হয় বিশেষভাবে বেপরোয়া এক প্রতিকারের : অর্থাৎ, গর্ভপাতের। যে-সব দেশে গর্ভনিরোধ অনুমোদিত, সেখানেও গর্ভপাত কম অবৈধ নয়, তবে সেখানে এটা খুবই কম দরকার পড়ে। কিন্তু ফ্রান্সে বহু নারী বাধ্য হয় এ-অস্ত্রোপচারের আশ্রয় নিতে এবং এটা তাদের অধিকাংশের প্রেণয়ের জীবনে হানা দিতে থাকে প্রেতের মতো।
খুব কম বিষয়ই আছে, যার সম্পর্কে বুর্জোয়া সমাজ দেখিয়ে থাকে এর থেকে বেশি ভণ্ডামো; গর্ভপাতকে গণ্য করা হয় একটি ঘৃণ্য অপরাধ বলে, যার উল্লেখ করাকেও অশোভন মনে করা হয়। একজন লেখক যখন বর্ণনা করেন কোন নারীর সন্তান প্রসবের সময়ের আনন্দ ও যন্ত্রণা, সেটা চমৎকার; কিন্তু তিনি যদি বর্ণনা করেন একটি গর্ভপাতের ঘটনার, তখন তাঁকে অভিযুক্ত করা হয় ময়লায় গড়াগড়ি দেয়ার এবং মানবজাতিকে এক শোচনীয় আলোতে উপস্থাপনের জন্যে। এখন, ফ্রান্সে প্রতি বছর যতোগুলো শিশু জন্মে গর্ভপাতও ঘটে ততোগুলোই। এটা এমন একটি ব্যাপক প্রপঞ্চ যে প্রকৃতপক্ষে এটাকে গণ্য করতে হবে নারীর পরিস্থিতির মধ্যে নিহিত ঝুঁকিগুলোর একটি বলে। তবুও আইন নাছোড়বান্দার মতো অটল একে একটি লঘু অপরাধ বলে গণ্য করার জন্যে এবং তাই এ-সুকুমার অস্ত্রোপচারটি গোপনে সম্পন্নকরার দরকার হয়। গর্ভপাত বৈধকরণের বিরুদ্ধে যে-সব যুক্তি উপস্থাপন করা হয়, সেগুলোর থেকে বাজেকথা আর কিছুই হতে পারে না। মত পোষণ করা হয় যে এটি একটি ভয়ঙ্কর অস্ত্রোপচার। তবে মাগনাস হার্সফিল্ডের সাথে সৎ চিকিৎসকেরা স্বীকার করেন যে ‘হাসপাতালে একজন দক্ষ বিশেষজ্ঞ দিয়ে, যথোচিত সাবধানতার সাথে, গর্ভপাত ঘটালে, তাতে দণ্ডবিধি যে-ভয়ানক বিপদের দাবি করে, সে-ভয় থাকে না’। এর বিপরীতে, বর্তমান অবস্থায় এটা আসলে যেভাবে করা হয়, তা নারীর জন্যে এক ভীষণ ঝুঁকি। গর্ভপাতকারীদের দক্ষতার অভাবে এবং যে-খারাপ অবস্থার মধ্যে তারা অস্ত্রোপচার করে, তার ফলে ঘটে বহু দুর্ঘটনা, যার কোনো কোনোটি মারাত্মক।
আরোপিত মাতৃত্ব পৃথিবীতে নিয়ে আসে হতভাগ্য শিশুদের, মা-বাবারা যাদের ভরণপোষণ করতে পারবে না এবং যারা হবে সর্বসাধারণের তত্ত্বাবধানের শিকার বা ‘শহিদ শিশু’। এটা উল্লেখ করা দরকার যে আমাদের সমাজ, যা খুবই উৎসাহী ভ্রূণের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে, জন্মের পর শিশুর প্রতি আর কোনো আগ্রহ পোষণ করে; ‘জনসহায়তা’ নামের অকীর্তিকর সংস্থাটিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ না নিয়ে সমাজ মামলা দায়ের করে গর্ভপাতকারীদের বিরুদ্ধে; শিশুদের যারা শিশুপীড়নকারীদের। কাছে রক্ষণের জন্যে দায়ী, মুক্তি দেয় তাদের সমাজ চোখ বুজে থাকে শিশু-আশ্রম ও ব্যক্তিপরিচালিত শিশু-অবাসের পশুতুল্য নির্দয়দের ভয়ঙ্কর নির্মমতার প্রতি। এবং যদি স্বীকার না করা হয় যে ভ্রূণটির মালিক সে-নারী যে ভ্রূণটি ধারণ করে, তাহলে অন্য দিকে স্বীকার করতে হয় যে শিশু এমন বস্তু, যার মালিক তারা পিতামাতা এবং তারা নির্ভরশীল তাদের কৃপার ওপর। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সম্প্রতি আমরা দেখেছি যে একজন শল্যচিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন, কেননা গর্ভপাত করানোর অপরাধে তিনি দণ্ডিত হয়েছিলেন, আর একটি পিতা, যে তার ছেলেকে পিটিয়ে পিটি ফেলেছিলো, তাকে দণ্ডিত করা হয়েছে তিন মাস কারাদণ্ডে, তবে তার কারাদণ্ড স্থগিত রাখা হয়েছে। সম্প্রতি এক পিতা যত্ন না নিয়ে গলাফোলা রোগে মরতে দিয়েছে তারা পুত্রকে; এক মা তার কন্যার জন্যে ডাক্তার ডাকতে রাজি হয় নি, কেননা সে বিধাতার ইচ্ছের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে : সমাধিক্ষেত্রে শিশুরা তার দিকে পাথর ছুঁড়েছে; তবে যখন কয়েকজন সাংবাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তখন একদল গণ্যমান্য ব্যক্তি প্রতিবাদ করেন যে পিতামাতারা তাদের শিশুদের মালিক, তাই বাইরে থেকে কোনো হস্তক্ষেপ সহ্য করা যায় না। প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে এ-মনোভাবের ফলে এক মিলিয়ন ফরাশি শিশু শারীরিক ও নৈতিক বিপদের সম্মুখীন। উত্তর আফ্রিকার আরব রমণীরা গর্ভপাতের আশ্রয় নিতে পারে না, এবং তাদের জন্ম দেয়া দশজন শিশুর মধ্যে সাত-আটজনই মারা যায়; তবু কেউই বিচলিত বোধ করে, কেননা গর্ভধারণের এ-শোচনীয় ও উদ্ভট আধিক্য নষ্ট করে তাদের মাতৃসুলভ অনুভূতি। যদি এসব হয় নৈতিকতার অনুকূল, তাহলে এ-নৈতিকতা সম্পর্কে কী ভাবতে হবে। এর সঙ্গে আরো বলা দরকার যে-সব লোক জণের জীবনের প্রতি পোষণ করে অতিশয় বিবেকপরায়ণ শ্রদ্ধা, তারাই আবার যুদ্ধে বয়স্কদের মৃত্যুদণ্ডিত করার জন্যে হয় অতিশয় ব্যগ্র।
গর্ভপাতের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত বাস্তবিক বিচারবিবেচনাগুলো গুরুত্বহীন; নৈতিক বিচারবিবেচনার দিক দিয়ে ওগুলো পরিশেষে হয়ে ওঠে ক্যাথলিকদের পুরোনোযুক্তির সমার্থক : অজাত শিশুটির আছে একটি আত্মা, যেটি স্বর্গে প্রবেশাধিকার পাবে না যদি অদীক্ষা ছাড়াই ব্যাহত হয় তার জীবন। এটা বিস্ময়কর যে গির্জা অনেক সময় বয়স্কদের হত্যা করা অনুমোদন করে, যেমন করে যুদ্ধে অথবা আইনানুগ মৃত্যুদণ্ডের বেলা; কিন্তু এটা ক্ৰণাবস্থার মানুষের জন্যে সংরক্ষণ করে এক আপোসহীন মানবহিতৈষণা। এখানে অভাব ঘটে অক্ষুদীক্ষার মাধ্যমে পরিত্রাণের; তবে ধর্মযুদ্ধের সময় বিধর্মীরা ছিলো সমভাবে অক্ষুদীক্ষাহীন, তবু পূর্ণোদ্যমে উৎসাহিত করা হয়েছিলো তাদের নিধনকাণ্ডকে। সন্দেহ নেই আজ যে-অপরাধীকে গিলোটিনে বধ করা হয় এবং যে-সৈনিক মৃত্যুবরণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে, ধর্মবিচারসভা কর্তৃক দণ্ডিতদের সবাই ধর্মে তাদের থেকে বেশি দীক্ষাপ্রাপ্ত ছিলো না। এসব ক্ষেত্রে গির্জা ব্যাপারটি ছেড়ে দেয় বিধাতার করুণার ওপর; এটা স্বীকার করে যে মানুষ বিধাতার হাতের নিতান্তই একটি হাতিয়ার এবং কোনো আত্মার পাপমোচনের ব্যাপারটি মীমাংসিত হয় ওই আত্মাটি ও বিধাতার মধ্যেই। সুতরাং ভ্রূণের আত্মাটিকে স্বর্গে গ্রহণ করতে কেননা নিষিদ্ধ করা হবে বিধাতাকে? যদি কোনো গির্জীয় অধিবেশন এটা অনুমোদন করে, তাহলে বিধাতা আর অস্বীকার করবে না যেমন সে অস্বীকার করে নি গৌরবান্বিত পর্বগুলোতে যখন বিধর্মীদের বলি দেয়া হতো ধার্মিকভাবে।
ঘটনা হচ্ছে যে এখানে প্রতিবন্ধকটি হচ্ছে একটি প্রাচীন, একগুঁয়ে প্রথা, যাতে নৈতিকতার কোনোই বালাই নেই। আমাদের অবশ্যই বোঝাপড়া করতে হবে সেই পুরুষধর্মী ধর্ষকামিতার সঙ্গে, যে সম্পর্কে আমি ইতিমধ্যেই কথা বলেছি। একটা চমকপ্রদ উদাহরণ হচ্ছে ডঃ রয়ের একটি বই, ১৯৪৩-এ যা উৎসর্গ করা হয় পেতাঁকে। পিতৃসুলভ উৎকন্ঠায় লেখক দৃঢ়ভাবে কথা বলেছেন গর্ভপাতের বিপদ। সম্পর্কে, তবে পেট কেটে প্রসবকেই তার মনে হয়েছে সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত বলে। গর্ভপাতকে দুষ্টাচরণ বলে গণ্য না করে তিনি অপরাধ বলে গণ্য করার পক্ষপাতী; এমনকি তিনি একে একটি চিকিৎসাব্যবস্থা হিশেবেও নিষিদ্ধ দেখতে চান। অর্থাৎ গর্ভধারণ যখন মায়ের জীবন বা স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি। তিনি ঘোষণা করেন যে একটি জীবন ও আরেকটি জীবনের মধ্যে বাছবিছার করা অনৈতিক, এবং এ-যুক্তির বলে তিনি মাকে বলি দেয়ার পরামর্শ দেন। দৃঢ়ভাবে তিনি ঘোষণা করেন যে মা ভ্রূণের মালিক নয়, এটি এক স্বাধীন সত্তা। ‘সচ্চিন্তাশীল’ এ-চিকিৎসকগণ যখন মাতৃত্বের গুণকীর্তনে মুখর হন, তখন অবশ্য তারা বলেন যে ভ্রূণ মায়ের দেহের একটি অংশ অর্থাৎ এটি মায়ের মূল্যে বেড়ে ওঠা কোনো পরজীবী নয়। নারীবাদবিরোধিতা এখনো কতো জীবন্ত, তা দেখা যায় যা-কিছু নারীর মুক্তির অনুকূল, সে-সব প্রত্যাখ্যানের জন্যে কিছু লোকের ব্যগ্রতায়।
উপরন্তু, আইন–যা বহু নারীকে দণ্ডিত করে মৃত্যু, বন্ধ্যাত্ব, চিররুগ্নতায়–জন্মের সংখ্যাবৃদ্ধির নিশ্চয়তাবিধানে একেবারে অক্ষম। বৈধগর্ভপাতের শক্ত ও মিত্ররা যেএকটি ব্যাপারে একমত, তা হচ্ছে পীড়নমূলক আইনের চরম ব্যর্থতা। প্রামান্য বিশেষজ্ঞদের মতে ফ্রান্সে সম্প্রতি বছর গড়ে প্রায় দশ লক্ষ গর্ভপাত ঘটে। এর মধ্যে দু-তৃতীয়াংশই ঘটে বিবাহিত নারীদের। এসব গোপন ও প্রায়ই ভুল অস্ত্রোপচারের ফলে ঘটে অজ্ঞাত, কিন্তু বিপুল সংখ্যক মৃত্যু ও অনিষ্ট।
গর্ভপাতকে অনেক সময় উল্লেখ করা হয় একটি ‘শ্রেণী-অপরাধ’ বলে, এবং এতে বেশ সত্যতা আছে। জন্মনিরোধের জ্ঞান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত, এবং শ্রমিক ও চাষীদের বাড়িতে যেহেতু চলন্ত জলের ব্যবস্থা নেই, তাই স্নানাগার থাকায় তাদের থেকে মধ্যবিত্তদের পক্ষে এটা প্রয়োগ করা সহজ; অন্যদের থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীরা বেশি সতর্ক; এবং সচ্ছল লোকদের মধ্যে শিশু বিশেষ ভারি দায়িত্ব নয়। প্রায়সই গর্ভপাতের অতিশয় জরুরি কারণগুলোর মধ্যে আছে দারিদ্র্য, ঘিঞ্জি বসতি, এবং কাজ করার জন্যে নারীর বাইরে যাওয়ার আবশ্যকতা। প্রায়ই দেখা যায় যে দুটি সন্তানের পর দম্পতিরা সন্তানের জন্ম সীমিত করতে চায়; তাই দেখা যায় যে গর্ভপাত করা বিরক্তিপূর্ণ নারীটিই আবার একটি চমৎকার মাতা, যে বাহুতে দোলাচ্ছে দুটি স্বর্ণকেশী দেবদূত : একই ও অভিন্ন ব্যক্তিটি।
তবে, অন্য দিকে, কোনো একলা তরুণীর বিপজ্জনক পরিস্থিতির থেকে খুব কম পরিস্থিতিই অধিক শোচনীয়; টাকার অভাবে তার ‘ভুল’ সংশোধনের জন্যে সে বাধ্য হয় এক অপরাধমূলক কাজ করতে, তার গোষ্ঠি যাকে মনে করে ক্ষমার অযোগ্য। ঠিক এটাই প্রতি বছর ঘটে ফ্রান্সের ৩০০,০০০ কর্মচারী, সেক্রেটারি, শ্রমিক, ও চাষী নারীর ক্ষেত্রে; অবৈধ মাতৃত্ব আজো এতো বিভীষিকাময় দোষ যে অনেকে অবিবাহিত মা হওয়ার থেকে আত্মহত্যা বা শিশুহত্যাকেই বরণ করে নেয় : এর অর্থ হচ্ছে। কোনো দণ্ডই তাদের নিবৃত্ত করতে পারতো না অজাত শিশুটির থেকে ‘নিষ্কৃতি পাওয়া’ থেকে। সাধারণভাবে প্রচলিত গল্পটি প্রলোভনের গল্প, যাতে একটি কম-বেশি অজ্ঞ মেয়ে প্রলুব্ধ হয় তার দায়িত্বহীন প্রেমিকের দ্বারা, একদিন যা ঘটার ঘটে অবধারিতভাবে, সে এটা গোপন করে রাখে পরিবারের, বন্ধুদের, ও নিয়োগদাতার থেকে, এবং গর্ভপাতই হয় ভীতিকর, তবে মুক্তির একমাত্র কল্পনাসাধ্য উপায়।
প্রায়ই প্রলুব্ধকারী কামুকটি নিজেই নারীটিকে বোঝায় যে তাকে শিশুটির থেকে মুক্তি পেতেই হবে। অথবা এও হয় যে মেয়েটি যখন দেখে সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে, তার আগেই পুরুষটি তাকে ছেড়ে চলে গেছে, বা মেয়েটি সহৃদয়ভাবে চায় তার কলঙ্ক পুরুষটির কাছে গোপন করতে, বা সে বুঝতে পারে যে পুরুষটি তাকে সাহায্য করতে অসমর্থ। অনেক সময় মেয়েটি অনুশোচনার সাথেই শিশুটিকে ধারণ করতে অস্বীকার করে; কোনো-না-কোনো কারণে এমন হতে পারে যে এটিকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত সে সঙ্গেসঙ্গেই গ্রহণ করে না, বা এ-কারণে যে সে একটা ‘ভালো ঠিকানা’ জানে না, বা এমন হতে পারে যে তার হাতে টাকা নেই এবং অকেজো ঔষধপত্র ব্যবহার করে সে সময় নষ্ট করে ফেলেছে–যখন সে পৌছে গেছে তার গর্ভের তৃতীয়, চতুর্থ, বা পঞ্চম মাসে, তখন এটা থেকে সে মুক্তির উদ্যোগ নেয়; আর তখন গর্ভপাত হয়ে ওঠে আগের মাসগুলোর থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক, যন্ত্রণাকর ও আপোশমূলক। নারীটি এটা জানে; সে উদ্বেগ ও হতাশার মধ্যে উদ্যোগ নেয় নিজেকে মুক্ত করার। গ্রামাঞ্চলে এষণীর প্রয়োগ আদৌ জানা যায় না; যে-পল্লীনারীর একটা স্থলন ঘটেছে, সে হয়তো গোলাবাড়ির মই থেকে পড়ে মরে, বা সে লাফিয়ে পড়ে নিচের তলায়, এবং অনেক সময় নিরর্থক আহত হয়; এবং এও ঘটতে পারে যে ঝোপের নিচে বা একটা খাদে পাওয়া যায় গলা টিপে মারা একটা ছোটো লাশ।
নগরে নারীরা পরস্পরকে সাহায্য করে উদ্ধার করে। তবে একটা হাতুড়ে গর্ভপাতকারী পাওয়া সব সময় সহজ নয়, আরো কঠিন দরকারি টাকাপয়সা যোগাড়করা। তাই গর্ভিণী নারী সাহায্য চায় কোনো বান্ধবীর, বা নিজেই করে নিজের অস্ত্রোপচার। এ-অপেশাদার অস্ত্রোপচারকেরা প্রায়ই হয়ে থাকে অদক্ষ; তারা প্রায়ই ফুটো করে ফেলে এষণী বা শেলাইয়ের সূচ দিয়ে। এক ডাক্তার এক অজ্ঞ রাঁধুনি সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন যে প্রক্ষেপণি দিয়ে সে তার জরায়ুতে ভিনেগার ঢুকোতে গিয়েঢুকিয়ে ফেলে মূত্রাশয়ে, যা ছিলো প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক। স্থলভাবে শুরু ও অতি অযত্নে সম্পন্ন করার ফলে গর্ভপাত সব সময়ই হয়ে থাকে স্বাভাবিক প্রসবের থেকে অনেক বেশি বেদনাদায়ক, এতে এমন স্নায়ুবিকার ঘটতে পারে যে দেখা দিতে পারে মূৰ্ছারোগ, ঘটতে পারে মারাত্মক আভ্যন্তর ব্যাধি, এবং মারাত্মক রক্তক্ষরণ।
কলেৎ তাঁর গ্রিবিশ-এ নৃত্যশালার এক নর্তকীর অসহ্য যন্ত্রণার বিবরণ দিয়েছেন, যা সে ভোগ করে অজ্ঞ মায়ের হাতে; তার মা বলে যে এর ঠিক প্রতিষেধক হচ্ছে সাবানের ঘনীভূত দ্রবণ পান করা এবং সিকি ঘণ্টা ধরে দৌড়ানো। শিশুটির কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে এমন চিকিৎসায় অনেক সময় মারা যায় মা-টি। আমি এক সাঁটলিপিকারের কথা শুনেছি, যে খাদ্য ও জল ছাড়া নিজের রক্তে স্নাত হয়ে চার ঘণ্টা আটকে থাকে তার ঘরে, কেননা কারো সহিওয়ার সাহস তার হয় নি।
পুরুষেরা গর্ভপাতকে লঘুভাবে নিয়ে থাকে তারা মনে করে যে ক্ষতিকর প্রকৃতি নারীর ওপর আরোপ করেছে অজস্র বিপদ, এটা তার একটি, কিন্তু তারা এর মূল্যবোধ পুরোপুরি বুঝতে সমর্থ হয় না। যে-নারী গর্ভপাতের আশ্রয় নেয়, সে প্রত্যাখ্যান করে নারীর মূল্যবোধ, তার মূল্যবোধ, এবং একই সময়ে সে আমূলভাবে বিরোধিতা করে পুরুষের প্রতিষ্ঠিত নীতিবোধের। বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে তার নৈতিকতার সমগ্র মহাবিশ্ব। বাল্যকাল থেকে নারীকে বারবার বলা হয় যে তাকে তৈরি করা হয়েছে সন্তান বিয়োনোর জন্যে, এবং তার কাছে সব সময় গাওয়া হয় মাতৃত্বের মহিমার গান। তার পরিস্থিতির অসুবিধাগুলো ঋতুস্রাব, অসুখ, এবং আরো বহু কিছু–এবং গৃহস্থালির নীরস একঘেয়ে খাটুনির বিরক্তিকর ক্লান্তির যাথার্থ প্রতিপন্ন হয় তার এই চমকপ্রদ বিশেষাধিকার দিয়ে যে সে বিশ্বে নিয়ে আসে সন্তানদের। আর এখানে পুরুষ নিজের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে নারী হিশেবে নারীকে ছেড়ে দিতে বলে তার বিজয়কে, যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় পুরুষের ভবিষ্যৎ, তার পেশার মঙ্গলের জন্যে!
শিশু আর অমূল্য সম্পদ নয়, জন্মদান আর পবিত্র কর্ম নয়; কোষের এ-দ্রুতবিস্তার হয়ে ওঠে আপতিক ও পীড়াদায়ক; এটা নারীর আরেকটি খুঁত। এর তুলনায়মাসিক বিরক্তিটাকে মনে হয় আশীর্বাদ : এখন উদ্বেগে চোখ রাখা হয় লাল ধারার ফিরে। আসার ওপর, যে-ধারাকে বিভীষিকাকর মনে হয়েছে তরুণী মেয়ের এবং যার জন্যে মাতৃত্বের প্রতিশ্রুত আনন্দ দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। এমনকি যখন সে গর্ভপাতে সম্মতিও দেয়, এমনকি তা কামনাও করে, তখনও নারী এটাকে মনে করে তার নারীত্ব বিসর্জন : সে তার লিঙ্গে দেখতে বাধ্য হয় একটা অভিশাপ, এক ধরনের বৈকল্য, এবং একটা বিপদ। এ-অস্বীকৃতিকে একটা চরমে নিয়ে গিয়ে গর্ভপাতের আঘাতজনিত স্নায়ুরোগের ফলে কিছু নারী হয়ে ওঠে সমকামী।
নারীর ‘অনৈতিকতা’য়, নারীবিদ্বেষীদের যা একটি প্রিয় বিষয়, বিস্ময়ের কিছু নেই; কী করে তারা একটা আন্তর অবিশ্বাস পোষণ না করে পারে সে-সব অহঙ্কত নীতির প্রতি, পুরুষেরা যেগুলো প্রকাশ্যে ঘোষণা করে আর সংগোপনে অমান্য করে? পুরুষ যখন উচ্চপ্রশংসা করে নারীর বা যখন উচ্চপ্রশংসা করে পুরুষের, তখন পুরুষ যা বলে, তা অবিশ্বাস করতে শেখে নারীরা : যে-একটি জিনিশ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত, তা হচ্ছে এই খাজ কাটা ও ক্ষরণশীল জরায়ু, টকটকে লাল জীবনের এসব ছিন্নাংশ, এ-শিশু যে সেখানে নেই। নারী তার প্রথম গর্ভপাতের সময় শুরু করে ‘জানতে’। অনেক নারীর কাছে বিশ্ব আর কখনোই আগের মতো থাকবে না। এবং তবু, সুলভ জন্মনিরোধের অভাবে, গর্ভপাতই ফ্রান্সে আজ সে-নারীদের একমাত্র আশ্রয়, যারা পৃথিবীতে আনতে চায় না সে-শিশুদের, যারা দণ্ডিত হবে দুর্দশা ও মৃত্যুতে।
জন্মনিরোধ ও বৈধ গর্ভপাত নারীকে স্বাধীনভাবে গ্রহণ করতে দেয় তার গর্ভধারণের দায়িত্ব। বর্তমান অবস্থায়, নারীর গর্ভধারণ আংশিক স্বেচ্ছাকৃত, আংশিক আকস্মিক। কৃত্রিমভাবে গর্ভধারণ যেহেতু এখনো সাধারণ ব্যাপার হয়ে ওঠে নি, তাই এমন হতে পারে যে কোনো নারী গর্ভধারণ করতে চায়, কিন্তু তার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। কেননা পুরুষের সাথে তার সংস্পর্শ নেই, বা তার স্বামী বন্ধ্যা, বা সে নিজেই গর্ভধারণে অক্ষম। আবার, অন্য দিকে, কোনো কোনো নারী তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বাধ্য হয়সন্তানপ্রজননে। নারীর প্রকৃত মনোভাব অনুসারে গর্ভধারণ ও মাতৃত্বের ব্যাপারগুলোর অভিজ্ঞতা হতে পারে খুবই বিচিত্র, তা হতে পারে বিদ্রোহের, বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেয়ার, সন্তুষ্টির বা উদ্দীপনার। অবশ্যই বুঝতে হবে যে তরুণী মায়ের প্রকাশ্যে অঙ্গীকার করা সিদ্ধান্ত ও ভাবাবেগ সব সময় তার গভীরতর বাসনার সাথে খাপ খায় না। তরুণী অবিবাহিত মা তার ওপর হঠাৎ চাপানো বস্তুগত ভারে বিহ্বল হয়ে উঠতে পারে এবং হতে পারে বাহ্যিকভাবে হতাশাগ্রস্ত, এবং তবুও সে তার সন্তানের মধ্যে দেখতে পারে তার গোপন স্বপ্নের বাস্তবায়ন। অন্য দিকে, কোনো বিবাহিত তরুণী, যে আনন্দে ও গর্বে স্বাগত জানায় তার গর্ভধারণকে, সে হয়তো। অন্তর্গতভাবে একে ভয়পেতে পারে ও অপছন্দ করতে পারে, কারণ তার ওপর ভর করে থাকতে পারে আবিষ্টতা, অলীক কল্পনা, ও বাল্যস্মৃতি, যা সে খোলাখুলি স্বীকার করতে চায় না। এ-ব্যাপারে নারীরা যে গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়, এটা তার অন্যতম কারণ। তাদের নীরবতা আংশিকভাবে উদ্ভূত হয় একটি অভিজ্ঞতা, যা একান্তভাবেই তাদের অধিকারে, সেটিকে রহস্যাবৃত করে রাখার আনন্দ থেকে; তবে এ-সময়ে তারা অনুভব করে যে-সব আভ্যন্তর বিরোধ ও সংঘর্ষ, সেগুলো দিয়ে তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।
নিজে মা হয়ে নারী এক অর্থে গ্রহণ করে তার নিজের মায়ের স্থান : এটা বোঝায় তার সম্পূর্ণ মুক্তি। যদি সে আন্তরিকভাবেই কামনা করে, তাহলে তার গর্ভধারণের ফলে সে হবে আনন্দিত এবং সাহস পাবে একলা নিজে এ-ভার বহনের; কিন্তু সে যদি এখনো স্বেচ্ছায় মায়ের অধীনে থাকে, তাহলে সে নিজেকে আবার তুলে দেয় মায়ের হাতে; নবজাত সন্তানকে তার নিজের সন্তান বলে মনে না হয়ে ওটিকে তার মনে হবে একটি ভাই বা বোনের মতো। যদি সে একই সাথে মুক্তি পেতে চায়এবং নিজেকে মুক্ত করার সাহস না করে, তাহলে সে আশঙ্কা করতে থাকে যে শিশুটি তাকে বাঁচানোর বদলে আবার তার ওপর চাপিয়ে দেবে দাসত্বের জোয়াল, এবং এ-উদ্বেগের ফলে ঘটতে পারে গর্ভপাত।
তবে সর্বোপরি গর্ভধারণ এমন একটি নাটক, অভিনীত হয় নারীটির নিজের ভেতরেই। সে এটাকে একই সঙ্গে একটি সমৃদ্ধি ও একটি ক্ষত হিশেবে অনুভব করে;ভ্রূণটি তার দেহের একটি অংশ, এবং এটি একটি পরজীবী, যেটি বেঁচে থাকে তার দেহ খেয়ে; এটি তার অধিকারে এবং এটি দিয়ে সে অধিকৃত; এটি ভবিষ্যতের প্রতীক এবং এটি বহন করে সে নিজেকে বিশ্বের মতো বিশাল বলে অনুভব করে; কিন্তু এপ্রাচুর্যই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয় তাকে, তার মনে হয় সে আর কিছু নয়। একটি নতুন জীবন প্রকাশ করতে যাচ্ছে নিজেকে এবং প্রতিপাদন করতে যাচ্ছে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, এজন্যে সে গর্ববোধ করে; তবে সে অনুভব করে যেনো সে দুলছে ও তাড়িত হচ্ছে, সে হয়ে উঠেছে দুর্বোধ্য শক্তিরাশির খেলার পুতুল। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে গর্ভবতী নারী তার দেহের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারে ঠিক সে-মুহূর্তে যখন সেটি লাভ করছে সীমাতিক্ৰমণতা; তার দেহের প্রতি তার দেহের জন্মে বিবমিষা ও তার দেহটি আর নিজের জন্যে অস্তিত্বশীল নয়, তাই দেহটি হয়ে ওঠে আগের থেকে অনেক বড়ো। প্রকৃতির প্রলোভনে পড়ে গর্ভবতী নারী হয়ে ওঠে উদ্ভিদ ও পশু, কোলয়েডের গুদামঘর, ডিমস্ফোটনযন্ত্র, ডিম; যে-শিশুরা গর্ববোধ করে তাদের তরুণ, সরলসোজা শরীর নিয়ে, তা ভয় পায় তাকে দেখে, এবং তরুণেরা তাকে দেখে ঘৃণায় ফিক করে হেসে ওঠে, কেননা সে এমন একটি মানুষ, একটি সচেতন ও স্বাধীন ব্যক্তি, যে হয়েউঠেছে জীবনের অক্রিয় হাতিয়ার।
প্রসবের জন্যে সময় লাগতে পারে চব্বিশ ঘণ্টা থেকে দুই বা তিন ঘণ্টা, তাই এসম্পর্কে কোনো সাধারণীকরণ করা যায় না। অনেক নারীর কাছে প্রসবের কাজটি হচ্ছে শহিদ লাভ। এর বিপরীতে, অনেক নারী এ-যন্ত্রণাকে বেশ সহজে বহনযোগ্য বলেই মনে করে। কেউ কেউ এতে বোধ করে ইন্দ্রিয়সুখ। কিছু কিছু নারী বলে যে। প্রসবের ব্যাপারটি তাদের দেয় এক ধরনের সৃষ্টিশীল শক্তির বোধ; তারা সত্যিই সম্পন্ন করেছে একটি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত ও উৎপাদনশীল কাজ। অন্য চরম প্রান্তে অনেকে নিজেদের বোধ করে অক্রিয় দুর্ভোগগ্রস্ত ও উৎপীড়িত যন্ত্র।
নবজাত শিশুর সাথে মায়ের প্রথম সম্পর্কগুলো একই রকমে বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাদের শরীরের ভেতরে এখন যে-শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কিছু নারী কষ্ট বোধ করে: তাদের মনে হয় চুরি হয়ে গেছে তাদের সম্পদ। সেসিল সভাজ তাঁর কবিতায় প্রকাশ করেছেন এ-অনুভূতি : ‘আমি সে-মৌচাক, যেখান থেকে চলে গেছে মৌমাছির ঝাঁক’; এবং আবার : ‘তার জন্ম হয়েছে, আমি হারিয়েছি আমার তরুণ প্রিয়তমকে, এখন জন্ম হয়েছে তার, আমি একলা’।
বারবার দাবি করা হয়েছে যে শিশুর মধ্যে শিশ্নের সমতুল্য একটি বস্তু পেয়ে নারী সুখী হয়ে ওঠে, তবে এটি কিছুতেই একটি যথাযথ বিবৃতি নয়। ঘটনা হচ্ছেএকটি পুরুষ ছেলেবেলায় তার শিশ্নের মধ্যে যেমন একটি বিস্ময়কর খেলনা পেতো, বয়স্ক পুরুষ তা আর পায় না; প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কাছে এর মূল্য হচ্ছে এটি তাকে তার কাম্য বস্তুরাশি অধিকার করতে দেয়। একইভাবে, প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষকে ঈর্ষা করে পুরুষের অধিকৃত শিকারগুলোর জন্যে, যে-হাতিয়ারটি দিয়ে পুরুষ এ-কাজ করে, নারী সে-হাতিয়ারটিকে ঈর্ষা করে না। শিশু ধারণ করে সমগ্র প্রকৃতির রূপ। কলেৎ অদ্রির নায়িকা আমাদের বলেছে যে সে তার শিশুর মধ্যে পেয়েছে ‘আমার আঙুলগুলোর ছোঁয়ার জন্যে একটি ত্বক, সব বেড়ালছানা, সব পুষ্প যে-প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, এ ত্বক তা পূরণ করেছে’। নারীটি যখন ছিলো ছোটো মেয়ে, তখন সে যা চেয়েছিলো তার মায়ের মাংসে, এবং পরে সর্বত্র সব কিছুতে, শিশুর মাংসের আছে সে-কোমলতা, সে-উষ্ণ স্থিতিস্থাপকতা। শিশুটি হচ্ছে উদ্ভিদ ও পশু, তার চোখে আছে বৃষ্টি ও নদী, সমুদ্র ও আকাশের নীল; তার আঙুলগুলো প্রবাল, তার চুল হচ্ছে রেশমের বিকাশ; এটি একটি জীবন্ত পুতুল, পাখি, বেড়ালছানা; ‘আমার ফুল, আমার মুক্তো, আমার ছানা, আমার মেষ’। মা গুঞ্জন করতে থাকে অনেকটা প্রেমিকের শব্দপুঞ্জ, প্রেমিকের মতো লোলুপভাবে ব্যবহার করতে থাকে অধিকারমূলক কারকের; সে প্রয়োগ করে অধিকার করার একই অঙ্গভঙ্গি : স্পর্শাদর, চুম্বন; সে তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে, সে শিশুকে গরম রাখে নিজের কোলে ও বিছানায়। অনেক সময় এ-সম্পর্কস্পষ্টভাবেই কামের ধরনের। স্টেকেল থেকে ইতিমধ্যে উদ্ধৃত স্বীকারোক্তিতে মা বলছে সে লজ্জা পায়, কেননা তার লালনপালনের মধ্যে আছে একটা কামের আভাস এবং তার শিশুর স্পর্শ তাকে সুখে শিউরে দেয়; সে যখন সে দু-বছরের ছিলো, তখন শিশুটি, প্রায় অপ্রতিরোধ্যভাবে, তাকে আদর করতো প্রেমিকের মতো এবং শিশুর শিশ্ন নাড়াচাড়ার প্রলোভন কাটানোর জন্যে আড়াই করতে হয়েছে তাকে।
আমাদের সংস্কৃতিতে যে মহাবিপদ শিশুর ওপর হুমকিস্বরূপ, তা হচ্ছে যে-মায়ের ওপর সমস্ত ভার দেয়া হয় সম্পূর্ণরূপে অসহায় শিশুটির, সে-মা প্রায় সর্বদাই হয়েথাকে একটি অতৃপ্ত নারী। কামে সে শীতল বা অপরিতৃপ্ত; সামাজিকভাবে সে নিজেকে মনে করে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট; বিশ্বের বা ভবিষ্যতের ওপর স্বাধীনভাবে তার কোনো অধিকার নেই। এসব হতাশার সে ক্ষতিপূরণ করতে চায় তার সন্তানের মধ্য দিয়ে। যদি বুঝতে পারি যে নারীর বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পরিপূর্ণ সিদ্ধিলাভ কতোটা কঠিন, সংগোপনে সে লালন করে কতো অজস্র কামনা, বিদ্রোহী অনুভূতি, ন্যায়সঙ্গত দাবি, তখন এটা ভেবে ভয় পেতে হয় যে তারই ওপর ভার দেয়া হয়েছে অসহায় শিশুদের লালনপালনের। সেই যখন সে তার পুতুলগুলোকে একবার অত্যন্ত আদরযত্ন করতো, আবার করতো পীড়ন, তখন তার আচরণ ছিলো প্রতীকী; তবে তার সন্তানের জন্যে প্রতীক হয়ে ওঠে নির্মম বাস্তব। যে-মা তার সন্তানকে শাস্তি দেয়, সে শুধু একলা শিশুটিকে মারে না; এক অর্থে সে শিশুটিকে মারেই না : সে প্রতিশোধ নেয় একটি পুরুষের ওপর, পৃথিবীর ওপর, বা নিজের ওপর। এ-ধরনের মা প্রায়ই থাকে গভীর অনুশোচনাপূর্ণ এবং শিশুটি এতে ক্ষোভ বোধ নাও করতে পারে, তবে সে অনুভব করে মারপিটগুলো।
অধিকাংশ নারী যুগপৎ দাবি করে ও ঘৃণা করে তাদের নারীত্বের অবস্থাকে; একটা ক্ষুব্ধ অবস্থার মধ্য দিয়ে তারা এটা যাপন করে চলে। তাদের নিজেদের লিঙ্গের প্রতি ঘৃণাবশত তারা তাদের কন্যাদের দিতে পারে পুরুষের শিক্ষা, তবে তারা খুব কম সময়ই হয়ে থাকে যথেষ্ট পরিমাণে উদার। একটি নারী জন্ম দিয়েছে বলে নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে মা তার কন্যাকে স্বাগত জানায় এ-দ্ব্যর্থবোধক অভিশাপ দিয়ে : ‘তুমি হবে একটা নারী’। সে যাকে মনে করে তার ডবল, তাকে একটি উৎকৃষ্টতর প্রাণীতে পরিণত করে সে ক্ষতিপূরণ করতে চায় তার নিজের নিকৃষ্টতার; এবং যেদুর্ভোগগুলো সে নিজে ভোগ করেছে, সেগুলোও চাপিয়ে দিতে চায় তার ওপর। অনেক সময় সে সন্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে চায় অবিকল তার নিজের নিয়তি : ‘যা বেশ ভালো ছিলো আমার জন্যে, তা তোমার জন্যেও বেশ ভালো; আমি এভাবেই লালিত পালিত হয়েছিলাম, তুমি ভাগী হবে আমার ভাগ্যের’। এর বিপরীতে, অনেক সময় সে তার মতো না হওয়ার জন্যে কঠোর নির্দেশ দেয় সন্তানকে; সে চায় কিছুটা কাজে লাগুক তার অভিজ্ঞতা, এটা দ্বিতীয়বারের জন্যে সুযোগ পাওয়ার একটি উপায়। বেশ্যা তার মেয়েকে পাঠায় কোনো কনভেন্টে, মূখ নারীটি তাকে করে শিক্ষিত। যখন মেয়েটি বড়ো হয়, তখন দেখা দেয় আসল বিরোধ; আমরা যেমন দেখেছি, মেয়েটি তার মায়ের থেকে মুক্তি লাভ করে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তার স্বাধীনতা। এটাকে একটা ঘৃণ্য অকৃতজ্ঞতার লক্ষণ বলে মনে হয় তার মায়ের কাছে; সে। জেদের সঙ্গে চেষ্টা করে মেয়েটির মুক্তিলাভের ইচ্ছেকে বানচাল করে দিতে; তার ডবল একটি অপর হয়েউঠবে, এটা সে সহ্য করতে পারে না। নিজেকে পরম শ্রেষ্ঠ রূপে অনুভব করার আনন্দ–নারীর বেলা যা বোধ করে পুরুষেরা–কোনো নারী উপভোগ করতে পারে শুধু নিজের সন্তানদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তার মেয়েদের ক্ষেত্রে যদি তাকে ছেড়ে দিতে হয় তার বিশেষাধিকার, তার কর্তৃত্ব, তাহলে সে খুবই ভেঙে পড়ে। মা স্নেহশীলই হোক বা হোক বৈরী, তার সন্তানদের স্বাধীনতা চুরমার করে দেয় তার আশা। সে হয় দ্বিগুণ ঈর্ষান্বিত; বিশ্বের ওপর, যে তার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে তার কাছে থেকে, এবং তার মেয়ের ওপর, যে বিশ্বের একটি অংশ জয় করে সেটিকে অপহরণ করে নিচ্ছে তার কাছে থেকে।
সন্তানদের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক রূপ লাভ করে তার জীবনের সমগ্রতার মধ্যে; এটা নির্ভর করে তার স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের ওপর, তার অতীত, তার পেশা, তার নিজের ওপর; সন্তানকে একটি সর্বজনীন সর্বরোগের মহৌষধরূপে গণ্য করা যেমন ভুল তেমনি ক্ষতিকর তেমনি একটা বাজে ব্যাপার। হেলেন ডয়েটশের গবেষণাগ্রন্থ, যেটি থেকে প্রায়ই উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, সেটির সিদ্ধান্ত এটাই, যাতে তিনি তার মনোচিকিৎসার অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করেছেন মাতৃত্বের প্রপঞ্চটি। নারী এর মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে আত্মচরিতার্থতা লাভ করে, একথায় আস্থা রেখে তিনি অতিশয় গুরুত্ব আরোপ করেছেন এ-ভূমিকাটির ওপর। তবে একটি শর্ত দিয়েছেন যে এটা স্বাধীনভাবে গৃহীত হতে হবে এবং আন্তরিকভাবে বাঞ্ছিত হতে হবে; তরুণী নারীটিকে থাকতে হবে এমন এক মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক, ও বস্তুগত পরিস্থিতিতে, যা তাকে সামর্থ্য দেবে এ-উদ্যোগ গ্রহণের; অন্যথায় এর পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। বিশেষ করে, বিষাদগ্রস্ত উন্মাদরোগের বা মনোবৈকল্যের প্রতিষেধকরূপে সন্তান ধারণের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে অপরাধ; এর অর্থ মা ও শিশু উভয়েরই সুখহীনতা। শুধু সে-নারী, যে ভারসাম্যপূর্ণ, স্বাস্থ্যবতী, এবং নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, সে-ই পারে একজন ‘ভালো’ মা হতে।
দ্বিতীয় ভ্রান্ত পূর্বধারণাটি, যেটি প্রত্যক্ষভাবে দ্যোতিত প্রথমটি দিয়ে, সেটি হচ্ছে যে সন্তান নিশ্চিতভাবেই সুখ পাবে তার মায়ের বুকে। ‘অস্বাভাবিক মা’ বলে কোনোজিনিশ নেই, একথা সত্য, কেননা মাতৃস্নেহের মধ্যে ‘স্বাভাবিক’ বলে কিছু নেই; তবে, ঠিক এ-কারণেই, খারাপ মা আছে অনেক। মনোবিশ্লেষণ যে-সব সত্য ঘোষণা করেছে, সেগুলোর মধ্যে প্রধান একটি হচ্ছে শিশুদের জন্যে সে-সব পিতামাতারা বিপদজনক, যারা নিজেরা ‘স্বাভাবিক’। প্রাপ্তবয়স্কদের গূঢ়ৈষা, আবিষ্টতা, ও মনোবৈকল্যের মূল নিহিত তাদের বাল্যকালের পারিবারিক জীবনের মধ্যে; যেপিতামাতারা নিজেরাই জড়িত বিরোধে, যাদের মধ্যে ঘটে কলহ ও বেদনাদায়ক দৃশ্যের অবতারণা, তারা শিশুর খুবই খারাপ সঙ্গী। বাল্যকালের পারিবারিক জীবনে গভীরভাবে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ফলে তারা সন্তানদের সাথে সম্পর্ক পাতায় গূঢ়ৈষা ও হতাশাবোধের মধ্য দিয়ে; এবং অন্তহীনভাবে দীর্ঘতর হতে থাকে দুর্দশার এ-শেকল। বিশেষ করে, মায়ের ধর্ষ-মকামিতা কন্যার মধ্যে সৃষ্টি করে এমন অপরাধবোধ, যা ধর্ষ-মর্ষকামী আচরণরূপে প্রকাশ পায় তার সন্তানদের সঙ্গে আচরণে, এবং চলতে থাকে অন্তহীনরূপে।
আমরা দেখেছি নারীর নিকৃষ্টতার উদ্ভব ঘটেছে প্রথমত জীবন পুনরাবৃত্তির কাজে সীমিত থাকার ফলে, আর সেখানে পুরুষ তার দৃষ্টিতে, উদ্ভাবন করেছে শুধুই নিত্যনৈমিত্তিকভাবে অস্তিত্বশীল হয়ে থাকার থেকে আরো অপরিহার্য কারণ; নারীকে শুধু মাতৃত্ব লাভের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে এ-অবস্থাকে চিরস্থায়ী করা। সে আজ সে-সব কাজে অংশগ্রহণের দাবি করছে, যে-সব কাজের মধ্য দিয়ে মানবজাতি ধারাবাহিকভাবে সীমাতিক্রমণতার মাধ্যমে, নতুন লক্ষ্য ও সাফল্য অর্জনের দিকে অগ্রগতির মাধ্যমে, চেষ্টা করে নিজের যাথার্থ প্রতিপাদনের; যদি জীবনের কোনো অর্থ থাকে, তাহলে সে জীবন প্রসব করার সম্মতি দিতে পারে না; সে এ-সময়ের আর্থনীতিক, রাজনীতিক, ও সামাজিক জীবনে ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা না করে মা হতে পারে না। কামানের ইন্ধন, ক্রীতদাস, বা শিকার উৎপাদন করা, ও অন্যদিকে স্বাধীন মানুষ সৃষ্টি করা এককথা নয়। একটি সুবিন্যস্ত সমাজে, যেখানে শিশুদের ভার প্রধানত নেবে সারা সমাজ, যেখানে যত্ন নেয়া হবে মায়ের এবং তাকে সাহায্য করা হবে, সেখানে নারীর জন্যে মাতৃত্ব ও জীবিকা সঙ্গতিহীন হবে না। এর বিপরীতে, যে নারী কাজ করে যে কৃষক, রসায়নবিদ, বা লেখক–সে তার গর্ভধারণকে গ্রহণ করেসহজভাবেই, কেননা সে তার নিজের দেহে মগ্ন নয়; যে-নারী যাপন করে সমৃদ্ধতম ব্যক্তিগত জীবন, সে-ই তার সন্তানদের দিতে পারে সবচেয়ে বেশি এবং তাদের কাছে দাবি করে সবচেয়ে কম; উদ্যোগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে অর্জন করে সত্যিকার মানবিক মূল্যবোধ, সে-ই সন্তানদের সবচেয়ে ভালোভাবে লালনপালনে সমর্থ।
মাতৃত্বের মধ্য দিয়েই নারী প্রকৃতপক্ষে সমান হয়ে ওঠে পুরুষের, এ-ধারণা পোষণ একটা প্রতারণা। মনোবিশ্লেষকেরা এটা দেখানোর জন্যে খুবই কষ্ট স্বীকার করেছেন যে সন্তান নারীকে সরবরাহ করে শিশ্নের সমতুল্য একটা বস্তু; পুরুষের এ গুণটি ঈর্ষণীয় হতে পারে, তবে এমন ছুতোতে কেউ বিশ্বাস করে না যে এরকম একটি বস্তুর নিতান্ত মালিক হওয়াই প্রতিপন্ন করতে পারে তার অস্তিত্বের যাথার্থ্য, বা এ-ই হতে পারে অস্তিত্বের পরম লক্ষ্য। মায়ের পবিত্র অধিকার সম্পর্কে কথাবার্তারও কোনোকমতি নেই; তবে মা হিশেবে নারীরা ভোট দেয়ার অধিকার পায় নি, এবং অবিবাহিত মা এখনো নিন্দিত; মা গৌরব লাভ করে শুধু বিয়ের মধ্যেই–অর্থাৎ, শুধু তখন, যখন সে অধীন হয় একটি স্বামীর। পিতা যতো দিন থাকবে পরিবারের আর্থনীতিক কর্তা, ততো দিন সন্তানেরা মায়ের থেকে বাবার ওপরই থাকবে বেশি নির্ভরশীল, যদিও মা-ই বেশি ব্যস্ত থাকে সন্তানদের নিয়ে। এটাই তার কারণ, যেমন দেখেছি আমরা, কেননা বাবার সাথে মায়ের সম্পর্ক দিয়ে প্রগাঢ়ভাবে প্রভাবিত হয় সন্তানদের সাথে মায়ের সম্পর্ক।
তারপর আবার, ‘ভালো’ গৃহিণী থাকে জীবনের কর্মকাণ্ডের বিরোধী পক্ষে, যেমন আমরা দেখেছি : শিশু হচ্ছে মোমে-মাজা মেঝের শত্রু। ঘরবাড়ি সুসজ্জিত রাখার জন্যে মায়ের ভালোবাসা রূপ নিতে পারে ক্রুদ্ধ রাগারাগিতে। এটা বিস্ময়কর নয় যেনারী লড়াই করে এসব বিরোধিতার মধ্যে, প্রায়সই যে তার দিন কাটায় স্নায়ুবিকারগ্রস্তও বদমেজাজি অবস্থায়; সে সব সময়ই হারে একভাবে বা অন্যভাবে, এবং তার প্রাপ্তিগুলো অনিশ্চিত, সেগুলো নিশ্চিতভাবে সাফল্য বলে পরিগণিত হয় না। সে কখনোই শুধু তার কাজের মধ্যে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে না; এটা তাকে ব্যস্ত। রাখে, কিন্তু তার অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রতিপাদন করে না, কেননা তার যাথার্থ্য প্রতিপাদন তার হাতে নির্ভর করে না, করে স্বাধীন ব্যক্তিদের হাতে। গৃহে বন্দী থেকে, নারী নিজে তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না; ব্যক্তি হিশেবে দৃঢ়ভাবে আত্মঘঘাষণার জন্যে যে-সম্বল থাকাদরকার, তার তা নেই; এবং এর পরিণামে স্বীকৃতি দেয়া হয় না তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে। আরবদের ও ভারতীয়দের মধ্যে এবং বহু পল্লীজনগোষ্ঠির মধ্যে নারী হচ্ছে একটি গৃহপালিত মাদি পশু, সে যে-কাজটুকু করে তার জন্যে প্রশংসা পায় এবং সে অনুপস্থিত হয়ে গেলে কোনো আক্ষেপ ছাড়া তার স্থানে আরেকটি নেয়া হয়। আধুনিক সভ্যতায় তার স্বামীর চোখে সে কম-বেশি গণ্য হয় ব্যক্তি হিশেবে; তবে সে যদি তার অহংকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান না করে, যুদ্ধ ও শান্তির নাতাশার মতো সে। যদি নিজেকে তার পরিবারের প্রতি সংরক্ত ও নির্মম আনুগত্যে গ্রাস না করে, তাহলে তাকে পর্যবসিত করা হয় এক শুদ্ধ সাধারণ্যে। সে হচ্ছে একান্তভাবে গৃহিণী, স্ত্রী, মাতা, অনন্য ও স্বাতন্ত্র্যহীন; এই চরম আত্ম-নীচতার মধ্যে নাতাশা বোধ করে পরমানন্দ। কিন্তু আধুনিক পাশ্চাত্য নারী, এর বিপরীতে, বোধ করে যে লোকজন তার স্বাতন্ত্র্য বুঝবে এ-স্ত্রী, এ-মাতা, এ-নারীরূপে। এ-সন্তুষ্টিই সে চাইবে সামাজিক জীবনে।