প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৫.২ ময়লাবাহী নালার জাল বিস্তার

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১.

গোটা প্যারিস শহরের প্রতিটি রাস্তার তলা দিয়ে দশ শতাব্দী ধরে অসংখ্য ময়লাবাহী নালার জাল বিস্তার করা হয়। নেপোলিয়ন, অষ্টাদশ লুই, দশম চার্লস, লুই ফিলিপ, প্রজাতন্ত্রী সরকার সব মিলিয়ে মাটির তলায় যত নালা তৈরি করে তার দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় মোট তেইশ হাজার মিটার। ১৮২৬ থেকে ১৮৩১ সালের মধ্যে সিমেন্ট দিয়ে গাঁথা ড্রেন বা নালার সংখ্যা ও দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়। তখন সারা প্যারিস শহরের দু হাজার দুশো বড় রাস্তা ছিল, আর সেই সব রাস্তার তলায় ওই সংখ্যক জল ও ময়লানিকাশী ড্রেন ছিল।

ভলজাঁ’র মনে হল সে আছে লে হ্যালে অঞ্চলের রাস্তার তলায়। দু দিকে সিমেন্টের পাকা দেয়াল, হাত বাড়িয়ে ধরা যায়। রাস্তাটা সরু আর অন্ধকার, নিচে টালিপাতা মেঝেয় অল্প একটু জল আছে। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সে দেখল বাঁ ও ডান দিকে দুটো ওই ধরনের নালা চলে গেছে। এই নালাটা শেষ হয়েছে সেখানে। দুটোর একটা পথ তাকে বেছে নিতে হবে। সে ভাবল সে যদি জা’র দিকে যায় তা হলে মিনিট পনেরো’র মধ্যেই পঁত শেঞ্জ ও পত নুফে অঞ্চলে সেন নদীর ধারে গিয়ে পড়বে। স্পষ্ট দিবালোকে জনবহুল শহরের সকলের সামনে গিয়ে পড়বে সে এবং তার গ্রেপ্তার অনিবার্য। তার থেকে এই নিরাপদ অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়ানো ভালো। সে তাই ডান দিকে ঘুরল। মেরিয়াসের হাত দুটো তার সামনে আর তার পা দুটো তার পেছনে ঝুলছিল। তার গলাটা ভলজাঁ’র গালের সঙ্গে লেগে ছিল। তার মৃদু নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ভলজাঁ।

দু দিকের দেয়ালে হাত দিয়ে সে দেখল এখানে পথটা সরু। পায়ের তলার জলের স্রোতটা যাচ্ছে নিচের দিকে। এ পথ কোথায় তাকে নিয়ে যাবে, তা সে জানে না। ভয় হতে লাগল তার। ভাবল তারা হয়তো আর কোনওদিন পৃথিবীর আলোয় বার হতে পারবে না। রক্তক্ষরণ আর ক্ষুধায় মেরিয়াস হয়তো মারা যাবে আর সে-ও মারা যাবে। দুটো কঙ্কাল পড়ে থাকবে এই অন্ধকার নালার মধ্যে। সে বুঝল সে এখন সেন্ট ডেনিস অঞ্চলে নেই। সেন নদীর দিকে এগিয়ে চলেছে। পথটা যেখানে সরু সেখানেই সেটা শেষ হয়ে আর এক পথে গিয়ে মিশে যায়। অন্ধকারটা এখানে আরও ঘন মনে হল। হঠাৎ এক সময় পেছন ফিরে দেখল একটা লণ্ঠনের আলো দেখা যাচ্ছে দূরে আর তার পেছনে রয়েছে আট-দশটা লোক।

.

২.

সেদিন সকালে পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্যারিসের রাস্তার তলায় নর্দমাগুলোর ভেতরে বিপ্লবীদের খোঁজ করার আদেশ দেয়। এজন্য একদল করে সশস্ত্র পুলিশ লণ্ঠন হাতে মাটির তলায় অন্ধকার নালাগুলোতে নেমে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভলজাঁ দেখল লণ্ঠনটা তার দিকে আর এগিয়ে আসছে না।

আসলে ভলজাঁ যেখানে দুদিকে দুটো মোড়ে এসে কোন দিকে কোন পথে যাবে বলে ভাবতে থাকে সেখানে এসে পুলিশদলও ভাবতে থাকে। অবশেষে পুলিশরা ভলজাঁর মতো ডান দিকে না গিয়ে বাঁ দিকের পথ ধরে। কিন্তু পুলিশ যদি সেখানে দু দলে ভাগ হয়ে দু দিকে গিয়ে খোঁজ করত তা হলে ধরা পড়ে যেত উলজা।

সে কালে বিপ্লবের বা গৃহযুদ্ধের সময়ে পুলিশ তার কর্তব্যকর্ম ঠিক করে যেত। তারা অপরাধীদের পিছু পিছু ছুটত। অনুসন্ধানকার্য যথারীতি করত। ৬ জুন তারিখে সেন নদীর ধারে এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে। জায়গাটা হল পঁত দে ইনভার্নিদে অঞ্চলে।

ওই দিন তখন নদীর ধারে দু জন লোক পরস্পরের দিকে তাকাতে তাকাতে পথ হাঁটছিল। আগের লোকটি তার পেছনের লোকটিকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল। পেছনের লোকটি যেন তাকে ধরতে চায়। কিন্তু বাইরে এ বিষয়ে সে কোনও তৎপরতা দেখাচ্ছিল না। তারা দু জনেই সমান গতিতে হাঁটছিল বলে তাদের মাঝখানের দূরত্ব সমান ছিল। আগের লোকটিকে ক্লান্ত ও অবসন্ন দেখাচ্ছিল। তার চেহারাটা ছিল বেঁটে আর রোগা রোগা। অন্যদিকে অনুসরণকারী পেছনের লোকটি ছিল লম্বা আর বলিষ্ঠ চেহারার।

নদীর ধারটা ছিল জনশূন্য। অনুসৃত লেকাটি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। দারুণ ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল তার চোখে-মুখে। ছেঁড়া ময়লা একটা আলখাল্লা ছিল তার পরনে। তখন সেখানে কাছাকাছি কোনও পথচারী বা কোনও লোক ছিল না। নদীতে কাছাকাছি কোনও নৌকোও ছিল না। নদীর ওপার থেকে তাদের দেখা যাচ্ছিল। পাতলা আলখাল্লাপরা লোকটি শীতে কাঁপছিল। অনুসরণকারী লোকটির পরনে ছিল পুলিশের পোশাক।

পুলিশের পোশাকপরা লোকটি হঠাৎ একটা ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পেয়ে ডাকল। ড্রাইভার গাড়ি আনলে সে তাতে চেপে অনুসৃত লোকটি যে দিকে যাচ্ছিল সেই ঘাটের দিকে যেতে বলল। ঘাটের কাছে বাঁধের নিচে অনেক ভাঙা পাথর পড়েছিল। পুলিশের লোকটি ভাবল অনুসৃত লোকটি তার আড়ালে লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেখানে সে নেমে দেখল লোকটা নেই। সে বাঁধের উপর উঠে চারদিকে তাকিয়ে খোঁজ করতে লাগল। কিন্তু কোথাও দেখতে না পেয়ে সে আশ্চর্য হল। চারদিকে তাকাতে তাকাতে সে দেখল লোহার জাল দেওয়া একটা ঢাকনার তলায় একটা সুড়ঙ্গপথ রয়েছে নিচে। ঢাকনাটা তোলার অনেক চেষ্টা করেও সে তুলঁতে পারল না। গাড়িটা তার কাছেই অপেক্ষা করতে লাগল।

.

৩.

ভলজাঁ যে পথটা ধরে এগোচ্ছিল তার ছাদটা ছিল মাত্র পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উঁচু। মেরিয়াসকে কাঁধে নিয়ে এগোতে কষ্ট হচ্ছিল তার। শহরের নিষ্কাশিত ময়লা জলের দুর্গন্ধ নাকে লাগছিল তার। সে যখন এইভাবে প্রধান নালাটার কাছে এসে পড়ল তখন বেলা বোধহয় তিনটে হবে। সেখানে এসে দেখল নালাটা অনেকটা চওড়া আর ছাদটা উঁচু আগের থেকে। এখানে জলের গভীরতা আর স্রোতটাও বেশি।

সেখানে এসে দেখল দুদিকে দুটো নালা চলে গেছে। একটা নিচের দিকে নেমে গেছে আর একটা উপর দিকে উঠে গেছে। তাকে ঠিক করতে হবে কোন দিকে যাবে সে। সে ভাবল তাকে সেন নদীর মুখে যেতে হবে। তাই সে বাঁ দিকের পথটা ধরল। ডান দিকে গেলেও বাস্তিলের কাছে আর্সেনাল অঞ্চলে সেন নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছতে পারত। কিন্তু সে পথ এমনই গোলকধাঁধায় ভরা যে সে তা ঠিক করতে পারত না। তাই সে ঠিক পথই ধরেছিল।

কিছুদূর গিয়ে একটু আলো দেখতে পেল ভলজাঁ। মেরিয়াসের দেহটা কাঁধ থেকে এক জায়গায় নামাল একবার। দেখল মেরিয়াসের মুখটা মড়ার মতো দেখাচ্ছে। তার মুখের এক কোণে রক্ত লেগেছিল। তবে তার বুকে হাত দিয়ে দেখল তার দেহে তখনও প্রাণ আছে। হৃৎস্পন্দন ঠিক চলছে। সে তখন তার নিজের জামাটা ছিঁড়ে মেরিয়াসের ক্ষতস্থানগুলোয় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। তার পর সে এক অব্যক্ত ঘৃণার সঙ্গে তার অচেতন দেহটার দিকে তাকিয়ে রইল। মেরিয়াসের জামার পকেট খুঁজে দুটো জিনিস দেখতে পেল সে। একটা পাউরুটি আর একটুকরো লেখা কাগজ। তাতে লেখা ছিল, আমার নাম মেরিয়াস পঁতমার্সি। আমার মৃতদেহটাকে মারে অঞ্চলে ৬ র‍্যু দে ফিলে কালভেরিতে আমার মাতামহের কাছে নিয়ে যাবে।

ভলজাঁ রুটিটা খেয়ে নিয়ে ঠিকানাটা মুখস্থ করে কাগজটা মেরিয়াসের পকেটে রেখে দিল। তার পর সে মেরিয়াসের দেহটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে আবার হাঁটতে লাগল। রুটিটা খেয়ে গাঁয়ে একটু বল পেল সে।

ভলজাঁ বুঝতে পারল না সে শহরের কোন অঞ্চলে এসে পড়েছে। তবে মাঝে মাঝে রাস্তার উপর লোহার জালের ঢাকনা দেওয়া যে জলনিকাশি নর্দমার মুখ ছিল তার ফাঁক দিয়ে আশপাশের আলো দেখে বুঝল, সূর্য অস্ত যাচ্ছে। উপরে গাড়িঘোড়ার বিশেষ শব্দ হচ্ছে না। তাতে বুঝল এটা প্যারিস শহরের কেন্দ্রস্থল নয়, অপেক্ষাকৃত নির্জন কোনও শহরতলি। এখানে যানবাহনের চলাচল খুব কম। লোকের ভিড়ও অনেক কম। ঘরবাড়ির সংখ্যা কম। অন্ধকারে আবার এগোতে লাগল ভলজাঁ। কিন্তু তার পক্ষে হাঁটাটা কষ্টকর হয়ে উঠল ক্রমশ।

ভলজাঁ দেখল এখানে টালির মেঝে নেই। এখানে নর্দমাটা কাঁচা মাটির। জল বেশি নেই। কিন্তু পা দুটো বসে যাচ্ছিল। সে দেখল সে চোরাবালির রাজ্যে এসে পড়েছে। এখানে জলের স্রোত বেশি বলে নর্দমাটা পাকা করা হয়নি। তার ওপর গতকাল জোর বৃষ্টি হওয়ায় এখানে জলের পরিমাণ বেশি হয়ে উঠেছে। যতই যাবার চেষ্টা করতে লাগল ভলজাঁ ততই তার পা দুটো বসে যেতে লাগল। উপরে জল আর নিচে কাদা। দেখতে দেখতে তার প্রায় গোটা দেহটাই ডুবে গেল। শুধু মাথাটা আর হাত দিয়ে তুলে ধরা মেরিয়াসের দেহটা জলের উপরে জেগে রইল।

হঠাৎ সে তার পায়ের কাছে একটা পাথর অনুভব করল। সে কোনওরকমে এক পা এগিয়ে গিয়ে সেই পাথরের উপর উঠে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার মনে হল মরতে মরতে বেঁচে গেছে সে। সে যখন দেখল এ জায়গাটার নিচেটা পাথর দিয়ে গাঁথা তখন সে আবার নতুন উদ্যমে মেরিয়াসকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে লাগল। সে দেখল এখানে নালাটা ক্রমশ কম চওড়া হয়ে আসছে। মাথার ছাদটাও নিচু হয়ে আসছে।

এইভাবে বেশ কিছুটা এগিয়ে যাবার পর একটা মোড় ঘুরেই সে বাইরের জগতের আলো দেখতে পেল। গুহার অন্ধকারে হঠাৎ আসা কোনও চকিত অস্পষ্ট আলো নয়। দিনের স্পষ্ট আলো। সে ভাবল এইবার এতক্ষণে সে এই পূতিগন্ধময় নরককুণ্ড থেকে বেরোবার পথ পেয়ে গেছে। এখানে লোকজন নেই এবং এখানে সে অনায়াসে পালিয়ে যেতে পারবে।

কিন্তু সেই আলোর মুখে এসে থমকে দাঁড়াল ভলজাঁ। দেখল লোহার গ্রিল দেওয়া একটা বড় গেট তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। দুটো বড় তালা দেওয়া আছে। তাতে। ভলজাঁ ভালো করে তালা দুটো পরীক্ষা করে দেখল। সে তালা ভাঙা সম্ভব নয়। গেটের লোহার গ্রিলগুলোর উপর তার দেহের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে চাপ দিয়ে দেখল। সে গ্রিলও ভাঙা সম্ভব নয় তার পক্ষে। ভলজাঁ হতাশ হয়ে বসে পড়ল গ্রিলের গেটের উপরে পিঠ দিয়ে।

ভয়ঙ্কর লৌহকঠিন মাকড়সার জালের মধ্যে আটকে পড়েছে যেন তারা, যার থেকে। মুক্তিলাভের কোনও আশাই নেই। তখন শুধু একজনের কথাই তার মনে পড়ল। মেরিয়াসের নয়, সে হল কসেত্তে।

.

৪.

ভলজাঁ যখন এইভাবে ভাবতে ভাবতে হতাশার গভীর অন্ধকারে মুক্তির আলো খুঁজছিল। তখন হঠাৎ কে একজন তার কাঁধের উপর হাত দিল। বলল, ভয় নেই, আমরা একজন একজন করে বার হব।

ভলজাঁর মনে হল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। সে মুখ তুলে দেখল, একজন লোক নিঃশব্দে। কোথা থেকে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পাশে। লোকটার পরনে ছিল পাতলা ময়লা। একটা আলখাল্লা। তার জুতো দুটো হাতে ধরা ছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হলেও ভলজাঁ একনজর দেখেই চিনতে পারল লোকটা থেনার্দিয়ের।

কিন্তু ভলজাঁ’র মুখখানা এত ক্লান্ত, অবসন্ন ও রক্তাক্ত ছিল যে গ্রিলের ভেতর দিয়ে বাইরের আলো থাকা সত্ত্বেও তাকে চিনতে পারল না থেনার্দিয়ের।

অবশেষে থেনার্দিয়েরই প্রথমে কথা বলল। বলল, কেমন করে বেরোবে এখান থেকে?

ভলজাঁ কোনও কথা বলল না।

থেনার্দিয়ের বলল, তালা খোলার কোনও উপায় নেই। তবু আমাদের বেরোতে হবে এখান থেকে।

তা তো বটে।

আমরা একে একে যাব।

তার মানে?

তুমি একটা লোককে খুন করেছ। আমার কাছে চাবি আছে। আমি তোমাকে চিনি না, তবু আমি তোমাকে সাহায্য করব। তুমি আমার বন্ধু।

ভলজাঁ এবার বুঝতে পার থেনার্দিয়ের তাকে খুনি ভেবেই সাহায্য করতে চাইছে।

থেনার্দিয়ের বলে যেতে লাগল, শোন বন্ধু, তুমি হয়তো ওর পকেটে কী আছে তা না। দেখেই খুন করেছ ওকে। ওর কাছে যা আছে তার অর্ধেক ভাগ আমাকে দিলেই আমি তালা খুলে দেব।

এই বলে একটা বড় চাবি বার করল সে। বলল, দেখছ কত বড় চাবি?

ভলজাঁ’র মনে হল ঈশ্বর যেন তার মুক্তির জন্য থেনার্দিয়েরের ছদ্মবেশে এক দেবদূতকে পাঠিয়েছেন।

থেনার্দিয়ের তার পকেট থেকে একটা দড়ি বার করে বলল, এটাও আমি দেব তোমাকে।

ভলজাঁ বলল, কী জন্য? ওটাতে কী হবে?

তুমি বড় বোকা। এই লাশটাকে একটা পাথরের সঙ্গে বেঁধে নদীতে ফেলে দেবে। তা না হলে ভাসতে থাকবে।

অবশ্য নীরবে দড়িটা নিল ভলজাঁ।

পেনাদিংয়ের বলল, আমি তোমাকে চিনি না, তবু তুমি একটা কাজ করে ফেলেছ। এবং বিপদে পড়েছ। আমি তোমাকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করব। ভালো লোকদের সাহায্য করাই আমার কাজ। আচ্ছা, তুমি লাশটাকে ফেলে এলে না কেন?

ভলজাঁ চুপ করে রইল।

থেনার্দিয়ের বলল, বুঝেছি, ড্রেনের মধ্যে রাখলে ধরা পড়ার ভয় আছে। কালই মেথররা এই ড্রেন পরিষ্কার করতে আসবে। তার পর লাশ পেয়ে তারা পুলিশকে বলবে। এদিকে তো কেউ আসে না। পুলিশ আবার খুঁজে বেড়াবে। তার চেয়ে নদীতে লাশ ফেলে দিলে কোনও ঝামেলা থাকবে না। নদীতে লাশ ভাসলে কারও কিছু বলার থাকবে না।

কে খুন কেরছে? না, প্যারিস খুন করেছে। তখন তদন্তের কোনও কারণ থাকবে না।

ভলজাঁ যতই চুপ করে থাকছিল বাঁচাল থেনার্দিয়ের ততই বকতে লাগল। সে বলল, আমার কাছে চাবি আছে। কই, তোমার কাছে কী টাকা আছে দেখি। লোকটার কাছে কত ছিল?

থেনার্দিয়ের কথা বলছিল আর মাঝে মাঝে ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলছিল ইশারায়। তার কোনও কারণ বুঝতে পাল না। সে ভাবল থেনার্দিয়েরের সঙ্গে হয়তো আরও কিছু লোক লুকিয়ে আছে। তাদের কোনও ভাগ দিতে চায় না বলেই হয়তো কথাটা তাদের শোনাতে চায় না সে।

ভলজাঁ এবার তার পকেটটা খুঁজে দেখল। কিন্তু সে গতকাল বাড়ি থেকে বার হবার সময় টাকা-পয়সা বেশি নেয়নি। টাকার থলেটাও আনেনি। সে তার পকেটটা হাতড়ে মোট ছ ফ্র পাঁচ স্যু পেল। তার পর সেটা থেনার্দিয়েরর হাতে দিয়ে দিল।

থেনার্দিয়ের বলল, তুমি দেখছি শুধু শুধু খুন করেছ লোকটাকে।

ভলজাঁ যখন আনমনে ভাবছিল দাঁড়িয়ে থেনার্দিয়ের তখন তার ও মেরিয়াসের পকেটগুলো খুঁজে দেখল। সে আর কোনও টাকা-পয়সা পেল না। মেরিয়াসের পকেট থেকে একটা কাগজ পেয়ে সেটা সে ভলজাঁ’র অলক্ষে অগোচরে নিজের আলখাল্লার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। ভাবল এই কাগজটাতে হয়তো খুনি আর যাকে খুন করা হয়েছে তাদের ঠিকানা আছে।

থেনার্দিয়ের এবার বলল, থাক, তুমি যখন টাকা মিটিয়ে দিয়েছ তখন তোমাকে ছেড়ে দিতে হবে। ভলজাঁ মেরিয়াসের দেহটাকে কাঁধে তুলে নিতেই গেটের তালা খুলে দিল থেনার্দিয়ের। ভলজাঁ বেরিয়ে গেলে সে আবার সেই ড্রেনের অন্ধকারে ঢুকে পড়ল।

ভলজাঁ বাইরে এসেই নদীর ধারে মেরিয়াসকে কাঁধ থেকে নামাল। অবশেষে পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় এসে প্রাণটা বাঁচল তার। সেই ভয়াবহ অন্ধকার, দুর্গন্ধ, মৃত্যুভয় সব পেছনে পড়ে রইল। মুক্ত হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল সে। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। নীল আকাশে দু-একটা করে তারা ফুটে উঠছিল। ভলজাঁ কিছু জল নিয়ে মেরিয়াসের চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিল। তবু মেরিয়াসের চোখ খুলল না। তবে তার শ্বাসপ্রশ্বাস চলছিল এবং ঠোঁট দুটো কাঁপছিল।

ভলজাঁ আর একবার জল নিয়ে মেরিয়াসের চোখে-মুখে দিতে যেতেই কার পায়ের শব্দে চমকে উঠল সে। মনে হল এ শব্দ তার চেনা। মুখ ফিরিয়ে ভলজাঁ জেতার্তকে চিনতে পারল। জেভার্তের মাথায় টুপি আর গাঁয়ে লম্বা কোট ছিল। তার বগলে ছিল একটা লাঠি।

বিপ্লবীদের ঘাঁটি থেকে ছাড়া পেয়েই জেভার্ত পুলিশ অফিসে গিয়ে সব খবরাখবর দিয়ে আবার কাজে চলে যায়। পাঠকরা হয়তো বুঝতে পেরেছেন, এর আগে এই জেভাৰ্তই থেনার্দিয়েরের খোঁজ করছিল নদীর ধারে। জেভার্তের তাড়া খেয়ে থেনার্দিয়ের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ড্রেনের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

আমরা এটাও বেশ বুঝতে পারি যে তাড়াতাড়ি গেট খুলে ভলজাঁকে বার করে দেবার পেছনে থেনার্দিয়েরের একটা কৌশল ছিল। সে জানত জেভার্ত তখনও নদীর ধারে অপেক্ষা করছে তার জন্য। ভলজাঁ’র কাছে মৃতদেহটা দেখলেই জেভার্তের দৃষ্টি তার ওপর পড়বে। এই ভাবে তার ধৈর্যের পুরস্কার পাবে জেতার্ত আর সে নিজে ছয় ফ্র পেয়ে গেছে।

জেভার্ত ভলজাঁকে চিনতে পারেনি। সে তাই বলল, কে তুমি?

আমি।

কে তুমি?

জাঁ ভলজাঁ।

জেভার্ত এবার ভলজাঁ’র কাঁধের উপরটা হাত দিয়ে শিকারের মতো ধরল। এবার ভলজাঁকে চিনতে পারল।

ভলজাঁ বলল, ইন্সপেক্টার জেভাৰ্ত, আজ সকাল থেকে নিজেকে আমি আবার বন্দি হিসেবে ভাবছি। পালিয়ে যাবার ইচ্ছা থাকলে আমি আপনাকে আমার বাসার ঠিকানা দিতাম না। তবে একটা অনুমতি আমায় দিতে হবে।

জেভাৰ্ত অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে ভলজাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, কী করছ তুমি এখানে? এই লোকটাই-বা কে?

ভলজাঁ বলল, এরই জন্য অনুরোধ করছি আপনাকে। একে আমি প্রথমে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে চাই। তার পর আমাকে নিয়ে যা খুশি করতে পারেন।

জেভার্ত অরাজি হল না। সে তার পকেট থেকে রুমালটা বার করে জলে ভিজিয়ে মেরিয়াসের কপালের রক্ত মুছিয়ে দিল। তার পর যে গাড়িটা তার জন্য অপেক্ষা করছিল সেই গাড়িটাকে ডাকল। গাড়িটা এলে মেরিয়াসকে তার উপর চাপিয়ে ভলজাঁ ও জেভাৰ্ত তার উপর বসল। ভলজাঁ তাদের গন্তব্যস্থলে ঠিকানাটা বলে দিল। গাড়িতে কেউ কোনও কথা বলল না। জেভার্ত এক সময় বলল, এরই নাম মেরিয়াস। এ ব্যারিকেডে ছিল।

ভলজাঁ বলল, এ আহত হয়েছে। আমি ওর অচেতন দেহটাকে তুলে নিয়ে আসি।

জেভার্ত বলল, ও মারা গেছে।

ভলজাঁ বলল, না এখনও মরেনি।

কিন্তু মেরিয়াসকে মৃতের মতোই মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল গাড়িটার মধ্যে এক মৃতদেহের দু ধারে এক ছায়ামূর্তি আর এক প্রস্তরমূর্তি বসে রয়েছে।

.

৫.

ওরা যখন গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে পৌঁছল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। জেভাৰ্ত প্রথমে গাড়ি থেকে নেমে সদরজায় ঘা দিতে লাগল। গোটা বাড়িটা এরই মধ্যে ঘুমে অচেতন হয়ে গেছে। এই অভিজাত পল্লির সব বাড়িগুলো বিপ্লবের ভয়ে সব দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে সন্ধ্যা হতেই।

বাড়ির দারোয়ান দরজা খুলে দিতেই জেভার্ত জিজ্ঞাসা করল, এটা মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়ি

দারোয়ান বলল, কী চাই?

আমরা তাঁর আহত পুত্রকে ব্যারিকেড থেকে নিয়ে এসেছি।

তাঁর পুত্র? দারোয়ান আশ্চর্য হল।

ভলজাঁ মাথা নাড়ল নীরবে। ভলজাঁ’র কাদা ও রক্তমাখা পোশাক দেখে দারোয়ান ভয় পেয়ে গেল।

জেতার্ত বলল, যাও, তোমার মালিককে ডেকে আন। তাঁর ছেলে ব্যারিকেড়ে মরতে গিয়েছিল। ও মরে গেছে। আগামীকাল ওকে কবর দিতে হবে।

দারোয়ান প্রথমে বাড়ির ভৃত্য বাঙ্ককে ডাকল। বাস্ক নিকোলেত্তেকে ডাকল। নিকোলেত্তে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদকে ডাকল।

মেরিয়াসকে দোতলার একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ তার বাবার ঘুমের ব্যাঘাত না করে ডাক্তার ডাকতে পাঠাল।

জেভার্ত এবার ভলজাঁ’র কাঁধে একটা হাত রাখতেই ভলজাঁ তার মানে বুঝতে পারল। তারা দু জনে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল। দারোয়ান তাদের চলে যেতে দেখল।

আমাকে মিনিট খানেকের জন্য একবার আমার বাড়ি যাবার অনুমতি দিতে হবে।

জেভার্ত চুপ করে কী ভাবতে লাগল। তার পর হঠাৎ গাড়ির জানালা খুলে ড্রাইভারকে হুকুম দিল, ৭ র‍্যু দ্য লা হোমি আর্মেতে চল।

গাড়িতে কেউ কোনও কথা বলল না। বড় রাস্তা থেকে বেরিয়ে যাওয়া গলিপথটার মোড়ের মাথায় গাড়িটা থামাল ড্রাইভার। বলল, গাড়িটা ঢুকবে না সরু গলিটাতে।

জেভার্ত আর ভলজাঁ নেমে পড়ল।

ড্রাইভার জেতার্তকে বলল, মঁসিয়ে, আমার গাড়িটার ভালো সিটটাতে রক্ত লেগে আছে।

এই বলে সে তার পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে বলল, এ বিষয়ে কিছু একটা লিখে দিন।

জেভার্ত হাত দিয়ে তার নোটবইটা সরিয়ে দিয়ে বলল, এর জন্য কত লাগবে বল। আর তোমার ভাড়াই-বা কত হয়েছে বল।

ড্রাইভার বলল, সওয়া সাত ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। তার ওপর গাড়ির সিটটা নতুন। সব মিলিয়ে আশি ফ্রাঁ লাগবে।

কোনও কথা না বলে জেভার্ত চারটে নেপোলিয় বা স্বর্ণমুদ্রা বার করে দিয়ে দিল ড্রাইভারকে। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।

ভলজাঁ ভাবল, জেভার্ত তাকে প্রথমে থানায় নিয়ে যাবে। অথবা ফাঁড়িতে। দুটোই এখান থেকে বেশি দূরে নয়। ওরা দু জনে গলিপথ দিয়ে এগিয়ে চলল। পথটা একেবারে জনশূন্য। কিন্তু ভলজাঁ কী করতে চায়?

যে জীবন নতুন করে শুরু করেছিল সে জীবন শেষ করে দিতে চায় সে। সে প্রথমে কসেত্তেকে মেরিয়াসের খবরটা জানাবে। তাকে আরও কিছু কথা জানাবে। কিছু নির্দেশ হয়তো দেবে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত সব ব্যাপার শেষ হয়ে গেছে। সে জেভার্তের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। নিজের জীবনের সব কিছু শেষ করে দিয়েছে।

বাড়িটার সামনে গিয়ে জেভার্ত বলল, তুমি যাও, আমি এখানেই থাকব।

ভলজাঁ দারোয়ানকে ডাকতে সে উঠে দরজা খুলে দিল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলল সে।

ভলজাঁ তিনতলায় গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এরপর বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে নিচে বাড়ির সদরদরজার সামনেটা দেখল। রাস্তার আলোয় সবকিছু দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু দেখল কেউ কোথাও নেই। সে আশ্চর্য হল। জেভাৰ্ত চলে গেছে।

.

৬.

বাস্ক আর দারোয়ান দু জনে মিলে মেরিয়াসকে দোতলার ঘরে শুইয়ে দিয়েছিল। ডাক্তার এসে গেছে। ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল। সে একবার বলল, এমন হবে আমি জানতাম।

ডাক্তার এসে মেরিয়াসের নাড়ি পরীক্ষা করে দেখল, তার হৃৎস্পন্দন ঠিক আছে।

তার বুকে কোনও বড় আঘাত লাগেনি। তার ঠোঁটে যে রক্ত লেগেছিল তা তার নাসারন্ধ্র থেকে বেরিয়ে এসেছে। বালিশ ছাড়াই তাকে চিত করে শুইয়ে দেওয়া হল যাতে সে সহজে নিশ্বাস নিতে পারে। নিম্নাঙ্গে কোনও আঘাত লেগেছে কি না, তা দেখার জন্য তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দেওয়া হল। ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ পাশের ঘরে চলে গেল। দেখা গেল দু একটা গুলি তার মাথার খুলি আর পাজরগুলোর উপর আঁচড় কেটে চলে গেলেও তা গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে কোনও আঘাতই গুরুতর হয়নি। এ ছাড়া নিম্নাঙ্গে বা দেহের আর কোনও অংশে কোনও আঘাত লাগেনি। মুখে কোনও ক্ষত নেই। তার কাঁধে যে গুলি লাগে তা-ও ভেতরে ঢুকতে পারেনি। কাঁধটা কেটে যাওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই সে অচেতন হয়ে পড়ে। তার এই অচেতন ভাবটাই ভয়ের কথা। এই ধরনের অচৈতন্য অবস্থা থেকে অনেকেরই আর জ্ঞান ফেরে না।

বাস্ক আর নিকোলেত্তে চাদর ছিঁড়ে ব্যান্ডেজের কাপড় নিয়ে এল। মেরিয়াসের বিছানার পাশের টেবিলে একটা বাতি জ্বলছিল। টেবিলের উপর ডাক্তারের যন্ত্রপাতি সাজানো ছিল। ডাক্তার প্রথমে মেরিয়াসের চুল, মুখ ও দেহের ক্ষতগুলো ধুয়ে দিয়ে ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

ডাক্তার ভয় পেয়ে গিয়েছিল বলে কোনও কথা বলছিল না। রোগীর অবস্থা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারছিল না সে। এমন সময় ঘরের দরজা ঠেলে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ঘরে ঢুকলেন।

শহরের বিপ্লবীদের ঘাঁটিগুলোতে যুদ্ধ চলতে থাকার জন্য গতকাল সারাদিন ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত ছিলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। গতকাল তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। রাতে ঘুম হয়েছিল। কিন্তু উত্তেজনায় ঘুমটা গম্ভীর হয়নি। তার ঘুম কেউ না ভাঙালেও মেরিয়াসকে

যে ঘরে রাখা হয়েছিল সে ঘরটা তাঁর শোবার ঘরের পাশেই বলে লোকজনের কথাবার্তা ও ব্যস্ততার শব্দে তাঁর ঘুমটা ভেঙে যায় এবং তিনি বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।

ঘরের ভেতর না ঢুকে তিনি দরজায় একটা হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে ছিল শোবার গাউন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনও প্রেতমূর্তি একটা সমাধির দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি দেখলেন, ঘরের ভেতর বিছানার উপর একটা নগ্ন ও ক্ষতবিক্ষত দেহ শায়িত আছে। তার চোখ দুটো বন্ধ, মুখটা খোলা, ঠোঁট দুটো বিবর্ণ এবং দেহের কয়েকটা জায়গায় লাল ক্ষত রয়েছে।

বৃদ্ধ গিলেনৰ্মাদের আপাদমস্তক কাঁপতে লাগল। রাগে চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলতে লাগল। তাঁর সমস্ত মুখখানা শক্ত হয়ে উঠল। তাঁর হাত দুটো শিথিল হয়ে দেহের দু পাশে বুলতে থাকল। তিনি কোনওরকমে ঘরের ভেতর ঢুকে আশ্চর্য হয়ে বললেন, মেরিয়াস!

বাস্ক বলল, কিছুক্ষণ আগে ওকে আনা হয় মঁসিয়ে। ব্যারিকেডে ছিল…

গিলেনৰ্মাদ বললেন, ও মারা গেছে, দস্যু কোথাকার!

এবার দেহটাকে তিনি সোজা-শক্ত ও খাড়া করে বললেন, আপনি ডাক্তার? একটা কথা বলুন তো, ও কি সত্যিই মারা গেছে।

উদ্বিগ্ন ও অনিশ্চিত ডাক্তার কোনও কথা বলতে পারল না। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ পাগলের মতো জোর হাসিতে ফেটে পড়ে বলে উঠলেন, রক্তপিপাসু দুবৃত্তটা আমার ওপর ঘৃণাবশত ব্যারিকেডে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে এবং আমাকে শাস্তি দেবার জন্য আবার আমার কাছেই ফিরে এসছে। আমার জীবনের সকল দুঃখের কারণ আজ শেষ হয়ে গেল।

এবার তিনি জানালার ধারে গিয়ে জানালাটা খুলে দিয়ে যেন রাত্রির সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন, এখন ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলেছে। সে জানত আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তার ঘরটা প্রস্তুত হয়ে ছিল তারই জন্য। তার ছেলেবেলাকার ছবি ছিল আমার বিছানার পাশে। সে জানত, তার ফিরে আসার জন্য এক ব্যাকুল প্রত্যাশা নিয়ে আমি আগুনের পাশে বসে পাগলের মতো প্রতীক্ষা করছি। এবার তুমি যদি ফিরে এসে বলতে ‘এই তো আমি এসেছি তা হলে এ বাড়ির সমস্ত ভার তোমার হাতে তুলে নিয়ে আমি তোমার আদেশ সব বিষয়ে পালন করতাম। তোমার বৃদ্ধ মাতামহ তোমার আজ্ঞাবহ দাস হয়ে থাকত। কিন্তু তা না করে এখানে ফিরে না এসে তুমি ব্যারিকেড়ে গিয়ে মানসিক বিকৃতিবশত হত্যা করলে নিজেকে। ঠিক আছে, এখন শান্তিতে ঘুমোও, এই আমার শেষ কথা। তুমি বলেছিলে, ও রাজতন্ত্রী বলে ফিরে যাব না ওর কাছে।

ডাক্তার দেখল বৃদ্ধ গিলেনৰ্মাদও এক রোগীতে পরিণত হতে চলেছেন। সে তাই তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে তাঁর একটি হাত টেনে নিল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, ধন্যবাদ ডাক্তার। আমি শান্তই আছি। আমি ষোড়শ লুই-এর মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছি। তাছাড়া কত মৃত্যু দেখেছি। আসল কথা কী জানেন ডাক্তার, খবরের কাগজগুলোই সব আজেবাজে গরম গরম বক্তৃতা ছেপে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে ঝড় তুলে তরুণ যুবকগুলোর মাথা খায়। ও মেরিয়াস, তুমি আমার আগে মারা গেলে! ব্যারিকেড! ডাক্তার, আপনি হয়তো এই পাড়াতেই থাকেন। আমি আপনাকে চিনি। আপনি ভাববেন না আমি রেগে গিয়েছি। মৃত্যুর ওপর রাগ করা বৃথা। তবে কী জানেন? এই ছেলেটাকে আমি মানুষ করি। ও যখন তুলিয়েরের বাগানে খেলা করত, কোদাল দিয়ে মাটি কাটত তখন আমি নিজের হাতে মাটি দিয়ে খালগুলোকে বুজিয়ে দিতাম। সেই ছেলে একদিন বড় হয়ে বলল, “অষ্টাদশ লুই নিপাত যাক।’ এই বলে চলে গেল বাড়ি থেকে। এটা আমার দোষ নয়। দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ওর গায়ের রংটা ছিল গোলাপি আর চুলগুলো ভারি সুন্দর। ওর মা মারা যায়। ও ছিল লয়েরের এক দস্যুর ছেলে। কিন্তু বাপের অন্যায় কর্মের জন্য ছেলেরা তো দায়ী হতে পারে না। ওর চেহারাটা এত সুন্দর ছিল যে লোকে ওকে দেখার জন্য পথ দিয়ে যেতে যেতে ঘুরে তাকাত। ও যখন ছোট ছিল আমি লাঠিটা মারার ভঙ্গিতে তুলঁতাম। কিন্তু ও বুঝত, আমি ঠাট্টা করছি। ও যখন রোজ সকালে আমার ঘরে আসত তখন মনে হত এক ঝলক সূর্যের তাজা আলো এসে ঢুকল। লাফায়েত্তে না কি ওই সব বিপ্লবীরাই আমার সব শেষ করে দিল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ এবার মেরিয়াসের বিছানার কাছে এগিয়ে গেলেন। তাঁর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল। তিনি আবার কথা না বলে পারলেন না। নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, বিদ্রোহী, পাজি বদমাশ কোথাকার! আমাকেও মরতে হবে। সারা প্যারিস শহরে যেন ফুর্তি করার জন্য মেয়ে ছিল না। যুবক বয়সে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি না করে, নাচগান না করে উনি গেলেন প্রজাতন্ত্রীদের হয়ে ব্যারিকেডে যুদ্ধ করতে। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে উনি যুদ্ধ করে প্রাণ দিলেন। দুটো মৃতদেহ এই বাড়ি থেকে যাবে সমাধিভূমির দিকে। ঠিক আছে, খুব ভালো হয়েছে, আমি এটাই ভেবেছিলাম। আমি শেষ করব নিজেকে। আমার তো এক শো বছর বয়স হয়ে গেছে। অনেক আগেই মরা উচিত ছিল। কেন বৃথা চেষ্টা করছেন ডাক্তার ও মরে গেছে। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। আসল কথা, এই যুগটাই খারাপ। যতসব ভাবধারা, আদর্শ, তত্ত্বকথা, বিদ্বান, পণ্ডিত, ডাক্তার, লেখক, দার্শনিক, তুলিয়েরের কাকতাড়ানো বিপ্লব–এ যুগের সবটা বাজে। আর যেমন তুমি আমার কথা না ভেবে, আমার প্রতি কোনও দয়া না দেখিয়ে নিজেকে হত্যা করেছ, আমিও তেমনি তোমার মৃত্যুর জন্য কোনও দুঃখ করব না। বুঝলে খুনি?

এমন সময় মেরিয়াসের চোখ দুটো খুলে গেল। সে বিস্ময়ের আবেশে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের দিকে তাকাল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ চিৎকার করে উঠলেন, মেরিয়াস! আমার বাছা, আমার অন্তরের ধন, তুই বেঁচে আছিস তা হলে?

এই বলে মেঝের উপর মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *