৫.১ রত্না হলো রাজিয়া

ভারত অভিযান (মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান) (পঞ্চম খণ্ড) / এনায়েতুল্লাহ আলতামাস / অনুবাদ – শহীদুল ইসলাম
সুলতান মাহমুদ গজনবীর ঐতিহাসিক সিরিজ উপন্যাস।

উৎসর্গ

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানার বিডিআর সদর দফতরে চক্রান্তমূলক হত্যাকাণ্ডে নিহত সেনা অফিসারদের রূহের মাগফিরাত এবং প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত সকল সদস্যের ঐক্য, সংহতি ও সাফল্য কামনায় যারা হবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়–
শির দেগা নাহি দেগা আমামা
এর মূর্ত প্রতীক।

–অনুবাদক

.

প্রকাশকের কথা

আলহামদুলিল্লাহ! এদারায়ে কুরআন’ কর্তৃক প্রকাশিত সুলতান মাহমূদ এর ভারত অভিযান সিরিজের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড পাঠক মহলে সাড়া জাগিয়েছে। এজন্য আমরা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি এবং পাঠক মহলকে জানাচ্ছি মোবারকবাদ। নিয়মিত বিরতি দিয়ে এর প্রতিটি খণ্ড প্রকাশের ঐকান্তিক ইচ্ছা আমাদের ছিল । কিন্তু নানাবিধ কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পঞ্চম খণ্ড প্রকাশের বিলম্বের কারণে অনেক আগ্রহী পাঠক-পাঠিকা ও সুহৃদ আমাদের তাকিদ দিয়েছেন, কেউ কেউ তো রীতিমতো অসন্তোষ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বস্তুত সম্মানিত পাঠকদের এই তাগাদা, ক্ষোভ একজন প্রকাশক হিসেবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। কারণ সিরিজের গোটা উপাখ্যানটি পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়বোধ আমার আছে। সেই সাথে একটি প্রিয় সিরিজের অপঠিত অংশের জন্যে একজন উৎসাহী পাঠকের মধ্যে কতোটা তাড়না থাকে এই অনুভূতিটুকুও আমাকে তাড়িয়েছে। মোদ্দাকথা হলো, বিলম্ব বিলম্বই। কোনর জবাবদিহিতাই বই সামনে পেশ করা ছাড়া পাঠকের আহত মনকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। অতএব শত যৌক্তিক কারণ থাকার পরও সবার কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে পঞ্চম খণ্ডটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে সুখানুভব করছি।

নানাবিধ সীমাবদ্ধতার পরও আমরা এ খণ্ডটি আগেরগুলোর চেয়ে আরো সুন্দর করার চেষ্টা করেছি। তবুও মুদ্রণ প্রমাদ ভুল-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। বিজ্ঞমহলের কাছে যে কোন ত্রুটি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করার বিনীত অনুরোধ রইল।

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডের মতো পঞ্চম খণ্ডটিও পাঠক-পাঠিকা মহলে আদৃত হলে আমাদের সার্বিক প্রয়াস সার্থক হবে।

–প্রকাশক

.

লেখকের কথা

“মাহমুদ গজনবীর ভারত অভিযান” সিরিজের এটি পঞ্চম খণ্ড। উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান মাহমূদ গজনবী সতের বার ভারত অভিযান পরিচালনাকারী মহানায়ক হিসেবে খ্যাত। সুলতান মাহমূদকে আরো খ্যাতি দিয়েছে পৌত্তলিক ভারতের অন্যত: দু’ ঐতিহাসিক মন্দির সোমনাথ ও থানেশ্বরীতে আক্রমণকারী হিসেবে। ঐসব মন্দিরের মূর্তিগুলোকে টুকরো টুকরো করে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন মাহমুদ। কিন্তু উপমহাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এবং ইতিহাসে মাহমুদের কীর্তির চেয়ে দুষ্কৃতির চিত্রই বেশী লিখিত হয়েছে। হিন্দু ও ইংরেজদের রচিত এসব ইতিহাসে এই মহানায়কের চরিত্র যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তার সুখ্যাতি চাপা পড়ে গেছে। মুসলিম বিদ্বেষের ভাবাদর্শে রচিত ইতিহাস এবং পরবর্তীতে সেইসব অপইতিহাসের ভিত্তিতে প্রণীত মুসলিম লেখকরাও মাহমূদের জীবনকর্ম যেভাবে উল্লেখ করেছেন তা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের বোঝার উপায় নেই, তিনি যে প্রকৃতই একজন নিবেদিতপ্রাণ ইসলামের সৈনিক ছিলেন, ইসলামের বিধি-বিধান তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। জাতিশত্রুদের প্রতিহত করে খাঁটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও দৃঢ় করণের জন্যেই নিবেদিত ছিল তার সকল প্রয়াস। অপলেখকদের রচিত ইতিহাস পড়লে মনে হয়, সুলতান মাহমূদ ছিলেন লুটেরা, আগ্রাসী ও হিংস্র। বারবার তিনি ভারতের মন্দিরগুলোতে আক্রমণ করে সোনা-দানা, মণি-মুক্তা লুট করে গজনী নিয়ে যেতেন। ভারতের মানুষের উন্নতি কিংবা ভারত কেন্দ্রিক মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা তার কখনো ছিলো না। যদি তৎকালীন ভারতের নির্যাতিত মুসলমানদের সাহায্য করা এবং পৌত্তলিকতা দূর করে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়ার একান্তই ইচ্ছা তাঁর থাকতো, তবে তিনি কেন মোগলদের মতো ভারতে বসতি গেড়ে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেন না? ইত্যাকার বহু কলঙ্ক এঁটে তার চরিত্রকে কলুষিত করা হয়েছে।

মাহমূদ কেন বার বার ভারতে অভিযান চালাতেন। মন্দিরগুলো কেন তার টার্গেট ছিল? সফল বিজয়ের পড়ও কেন তাকে বার বার ফিরে যেতে হতো গজনী? ইত্যাদি বহু প্রশ্নের জবাব; ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ সৈনিক সুলতান মাহমূদকে তুলে ধরার জন্যে আমার এই প্রয়াস। নির্ভরযোগ্য দলিলাদি ও বিশুদ্ধ ইতিহাস ঘেটে আমি এই বইয়ে মাহমূদের প্রকৃত জীবন চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রকৃত পক্ষে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর মতোই মাহমূদকেও স্বজাতির গাদ্দার এবং বিধর্মী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়াই করতে হয়েছে। যততা বার তিনি ভারত অভিযান চালিয়েছেন, অভিযান শেষ হতে না হতেই খবর আসতো, সুযোগ সন্ধানী সাম্রাজ্যলোভী প্রতিবেশী মুসলিম শাসকরা গজনী আক্রমণ করছে। কেন্দ্রের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাধ্য হয়েই মাহমূদকে গজনী ফিরে যেতে হতো। একপেশে ইতিহাসে লেখা হয়েছে, সুলতান মাহমুদ সতের বার ভারত অভিযান চালিয়েছিলেন, কিন্তু একথা বলা হয়নি, হিন্দু রাজা-মহারাজারা মাহমূদকে উৎখাত করার জন্যে কতো শত বার গজনীর দিকে আগ্রাসন চালিয়ে ছিল।

সুলতান মাহমূদের বারবার ভারত অভিযান ছিল মূলত শত্রুদের দমিয়ে রাখার এক কৌশল। তিনি যদি এদের দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হতেন, তবে হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকতাবাদ সাগর পাড়ি দিয়ে আরব পর্যন্ত বিস্তৃত হতো।

মাহমূদের পিতা সুবক্তগীন তাকে অসীয়ত করে গিয়েছিলেন, “বেটা! ভারতের রাজাদের কখনও স্বস্তিতে থাকতে দিবে না। এরা গজনী সালাতানাতকে উৎখাত করে পৌত্তলিকতার সয়লাবে কাবাকেও ভাসাতে চায় । মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময়ের মত ভারতীয় মুসলমানদেরকে হিন্দুরা জোর জবরদস্তি হিন্দু বানাচ্ছে। এদের ঈমান রক্ষার্থে তোমাকে পৌত্তলিকতার দুর্গ গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ভারতের অগণিত নির্যাতিত বনি আদমকে আযাদ করতে হবে, তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে।”

আলবিরুনী, ফিরিশতা, গারদিজী, উতবী, বাইহাকীর মতো বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদগণ লিখেছেন, সুলতান মাহমূদ তৎকালীন সবচেয়ে বড় বুযুর্গ ও ওলী শাইখ আবুল হাসান কিরখানীর মুরীদ ছিলেন। তিনি বিজয়ী এলাকায় তার হেদায়েত মতো পুরোপুরি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তিনি নিজে কিরখানীর দরবারে যেতেন। কখনও তিনি তার পীরকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠাননি। উপরন্তু তিনি ছদ্মবেশে পীর সাহেবের দরবারে গিয়ে ইসলাহ ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তিনি আত্মপরিচয় গোপন করে কখনও নিজেকে সুলতানের দূত হিসেবে পরিচয় দিতেন। একবার তো আবুল হাসান কিরখানী মজলিসে বলেই ফেললেন, “আমার একথা ভাবতে ভালো লাগে যে, গজনীর সুলতানের দূত সুলতান নিজেই হয়ে থাকেন। এটা প্রকৃতই মুসলমলে লামত।”

মাহমূদ কুরআন, হাদীস ও দীনি ইলম প্রচারে খুবই যত্নবান ছিলেন। তাঁর দরবারে আলেমদের যথাযথ মর্যাদা ছিল। সব সময় তার বাহিনীতে শত্রু পক্ষের চেয়ে সৈন্যবল কম হতো কিন্তু তিনি সব সময়ই বিজয়ী হতেন। বহুবার এমন হয়েছে যে, তার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। তখন তিনি ঘোড়া থেকে নেমে ময়দানে দু’রাকাত নামায আদায় করে মোনাজাত করতেন এবং চিৎকার করে বলতেন, “আমি বিজয়ের আশ্বাস পেয়েছি, বিজয় আমাদেরই হবে।” বাস্তবেও তাই হয়েছে।

অনেকেই সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী আর সুলতান মাহমুদকে একই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বীর সেনানী মনে করেন। অবশ্য তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য একই ছিল। তাদের মাঝে শুধু ক্ষেত্র ও প্রতিপক্ষের পার্থক্য ছিল। আইয়ুবীর প্রতিপক্ষ ছিল ইহুদী ও খৃস্টশক্তি আর মাহমূদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল হিন্দু পৌত্তলিক রাজন্যবর্গ। ইহুদী ও খৃস্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর সেনাদের ঘায়েল করতে প্রশিক্ষিত সুন্দরী রমণী ব্যবহার করে নারী গোয়েন্দা দিয়ে আর এর বিপরীতে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে এরা ব্যবহার করতো শয়তানী যাদু। তবে ইহুদী-খৃস্টানদের চেয়ে হিন্দুদের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল দুর্বল কিন্তু সুলতানের গোয়েন্দারা ছিল তৎপর ও চৌকস।

তবে একথা বলতেই হবে, সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর গোয়েন্দারা যেমন দৃঢ়চিত্ত ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল ছিল, মাহমূদের গোয়েন্দারা ছিল নৈতিক দিক দিয়ে ততোটাই দুর্বল। এদের অনেকেই হিন্দু নারী ও যাদুর ফাঁদে আটতে যেতো। অথবা হিন্দুস্তানের মুসলিম নামের কুলাঙ্গররা এদের ধরিয়ে দিতো। তারপরও সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর চেয়ে সুলতান মাহমূদের গোয়েন্দা কার্যক্রম ছিল বেশি ফলদায়ক।

ইতিহাসকে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, বিশেষ করে তরুণদের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে পরিবেশনের জন্যে গল্পের মতো করে রচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থ। বাস্তবে এর সবটুকুই সত্যিকার ইতিহাসের নির্যাস। আশা করি আমাদের নতুন প্রজন্ম ও তরুণরা এই সিরিজ পড়ে শত্রু-মিত্রের পার্থক্য, এদের আচরণ ও স্বভাব জেনে এবং আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হয়ে পূর্বসূরীদের পথে চলার দিশা পাবে।

–এনায়েতুল্লাহ
লাহোর।

.

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

৫.১ রত্না হলো রাজিয়া

কনৌজ এখন গযনীর দখলে। গযনী বাহিনীর সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকী কন্নৌজের গভর্নর। কনৌজের মহারাজা রাজ্যপাল গযনী বাহিনী কনৌজ অবরোধের আগেই কনৌজ ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে গিয়েছিলেন। কনৌজে মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর রাজা রাজ্যপাল ছদ্মবেশে কনৌজ এসে মুসলিম শাসক সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকীর কাছে পরাজয় স্বীকার করলেন এবং তার লোকদের পুনর্বাসনের জন্যে আব্দুল কাঁদেরের কাছে রাড়ী নামক স্থানে বসতি স্থাপনের অনুমতি চাইলেন। সেই সাথে আবেদন করলেন, তাকে সেখানে নগর স্থাপনের অনুমতি দেয়া হোক এবং রাড়ীকে রাজধানী করে পুনরায় তার সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করার সুযোগ দেয়া হোক।

গভর্নর আব্দুল কাদের সেলজুকী রাজা রাজ্যপালের আবেদনে সাড়া দিলেন। তিনি বললেন–

আপনাকে আমি রাড়ীতে রাজধানী গড়ে তোলার অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু পরাজয় স্বীকার করার পর মুসলিম শাসনাধীন থাকতে হলে আপনাকে যে সব শর্ত মেনে নিতে হবে সেগুলো সুলতান মাহমূদ ঠিক করবেন এবং তিনিই নির্ধারণ করবেন আপনাকে কি পরিমাণ যুদ্ধ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং বাৎসরিক খাজনার পরিমাণ কি হবে? তাছাড়া আপনি কি কি সুবিধা ভোগ করতে পারবেন, আপনার কোন কোন বিষয় আমাদের কর্তৃত্বে থাকবে তাও সুলতানই নির্ধারণ করবেন।

যে কোন শর্ত মেনে নিয়ে মুসলিম শাসনাধীনে থেকে রাজা রাজ্যপাল তার লোক লস্কর নিয়ে কনৌজের পরিবর্তে রাড়ীকে রাজধানী করে রাজত্ব পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নিলেন। যাতে তার অস্তিত্বও টিকে থাকে এবং তার অনুগত সৈনিক ও প্রজারা নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারে।

রাজ্যপাল স্বেচ্ছায় কনৌজ এসে গযনী সুলতানের অধীনে রাড়ীকে রাজধানী করে নিজের লোকদের পুনর্বাসন করতে চান। এ খবর দিয়ে সেই দিনই গযনী সুলতানের কাছে দূত পাঠালেন কনৌজের শাসক আব্দুল কাদের সেলজুকী।

খবর পেয়ে দূতের কাছে আদিঅন্ত সবকিছু জেনে সুলতান মাহমুদ রাজ্যপালের জন্যে পালনীয় শর্তাদি ঠিক করে দিলেন। সুলতান যে সব শর্ত দিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল–

রাজ্যপাল কখনো গযনীবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবেন না। গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে কাউকে প্ররোচনা দেয়া বা সামরিক সহযোগিতা করতে পারবেন না।

নতুন রাজধানীতে রাজা রাজ্যপালের যে সব সৈনিক থাকবে তারা শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজ করবে; কিন্তু তারা থাকবে গযনীর নিয়ন্ত্রণে। স্বায়ত্তশাসনের মতো রাজ্যপাল সুবিধাদি ভোগ করবেন, প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা ট্যাক্স ইত্যাদি উসূল করবেন। কিন্তু তার সবকিছু থাকবে গযনী সরকারের কাছে জাবাদেহিমূলক। রাজ্যপালের উপর যদি কোন বহিঃশত্রু আক্রমণ করে তবে গযনী বাহিনী তাকে সাহায্য করবে। মোটকথা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে রাজ্যপালের উপর। তবে সার্বিক নিরাপত্তা ও সামরিক কর্তৃত্ব থাকবে গযনী বাহিনীর হাতে! বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ ও রাড়ীর নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে গযনী বাহিনীর কাছে।

গযনী সুলতানের দেয়া সব শর্তই রাজা রাজ্যপাল মেনে নিলেন এবং তিনি সুলতানকে নির্ধারিত অংকের ক্ষতিপূরণ ও বার্ষিক খাজনা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

স্বেচ্ছায় গযনীর গভর্ণর আব্দুল কাঁদেরের কাছে আত্মসমর্পণের পর রাজ্যপাল নিজেই বলেছিলেন, গযনী বাহিনী কনৌজ অবরোধ করার আগেই তিনি তার রাজ্যের সকল রাজকীয় সম্পদ অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। অতএব সুলতান মাহমূদকে ধার্য করা ক্ষতিপূরণ দিতে তার কোন আপত্তি নেই এবং তাতে তার কোন বেগও পোহাতে হবে না।

সুলতানের নির্দেশ মতো গভর্ণর আব্দুল কাদের রাজ্যপালের কাছ থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও বার্ষিক খাজনা উসূল করে নিলেন। সুলতান মাহমূদ গভর্ণর আব্দুল কাদের সেলজুকীকে নির্দেশ দিলেন, রাজা রাজ্যপালের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তার সম্পর্কে সবধরনের সংবাদ সব সময় গযনী পাঠাতে থাকবে।

সুলতানের এই নির্দেশ থেকে বুঝা যায়, রাজা রাজ্যপাল সম্পর্কে সুলতানের মধ্যে একটা কৌতূহল ছিল। অথবা রাজা রাজ্যপালের মনোভাবের উপর তিনি নির্ভর করতে পারছিলেন না। কারণ, রাজ্যপাল সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ায় সেখানকার অন্যান্য হিন্দু রাজাদের মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। সুলতান মাহমুদ প্রকারান্তরে চাচ্ছিলেন রাজা-রাজ্যপালকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে। যাতে করে সে পুনর্বার শক্তি সঞ্চয় করে গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ না পায়।

মহারাজা রাজ্যপাল বশ্যতা স্বীকার করে যুদ্ধ ক্ষতিপূরণ ও সুলতানকে বাৎসরিক খাজনা পরিশোধ করে গযনী সরকারের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ছিলেন বটে, কিন্তু এতে সারা হিন্দুস্তান রাজ্যপালের শত্রুতে পরিণত হলো। তকালীন হিন্দুস্তানের পার্শবর্তী মহাশক্তি তিন শক্তিধর হিন্দুরাজা রাজ্যপালের এতোটাই শত্রুতে পরিণত হলো যে, তারা রাজ্যপালকে হত্যা করার চেষ্টায় মেতে উঠলো।

রাজ্যপালের শত্রুদের মধ্যে কালাঞ্জরের রাজা গোবিন্দ ছিল অন্যতম। দ্বিতীয় ছিল গোয়ালিয়রের রাজা অৰ্জুন, তৃতীয় লাহোরের মহারাজা তরলোচনপাল । লাহোরের মহারাজা ভীমপাল তখন বৃদ্ধ ও অসুস্থ। ফলে তার ছোট ভাই তরলোচনপালকে লাহোরের রাজা ঘোষণা করা হয়। তরলোচনপাল রাজত্বের আসনে বসে কালাঞ্জর ও গোয়ালিয়রের রাজাদের সাথে হাত মিলিয়ে নতুন উদ্যমে গযনীর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করল।

অবশ্য রাজা তরলোচনের বড় ভাই ভীমপাল সুলতান মাহমূদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে সুলতানের অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিল এবং গযনীর সুলতানকে বাৎসরিক খাজনা পরিশোধ করে গযনীর বিরুদ্ধে কোন ধরণের সামরিক তৎপরতায় যোগ দিবে না বলে চুক্তিতে সই করেছিল। ফলে রাজা তরলোচন পালের পক্ষে প্রকাশ্যে গযনী সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব ছিলো না। কিন্তু গোপনে সে রাজা গোবিন্দ ও অর্জুনের সাথে মৈত্রী গড়ে তোলে এবং তিন রাজ্যের সেনাবাহিনী গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

তরলোচনপাল তার সৈন্যদের প্রকাশ্যে না এনে কনৌজ থেকে দূরে একটি ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে রেখেছিল। সে অন্য রাজাদের বলেছিল তার সেনারা প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। প্রয়োজনের সময় সে তার সেনাদের প্রকাশ্যে নিয়ে আসবে। প্রকৃতপক্ষে তরলোচনপালের সামরিক প্রস্তুতি এবং লাহোর থেকে তার সেনাদের এনে কনৌজের কাছের কোন জঙ্গলে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারটি ছিল অন্যান্য হিন্দু রাজাদের জন্য একটা গোলক ধাঁধা। তারা তরলোচনপালকে ঠিক বিশ্বাসও করতে পারছিল না, আবার তার বাহিনীকে এ দিকে নিয়ে আসার ব্যাপারটিকে অস্বীকারও করতে পারছিল না।

অবশ্য এই তিন রাজা মনে প্রাণে চেষ্টা করছিল, রাজা রাজ্যপালকে তাদের পক্ষে আনতে এবং গযনীর বশ্যতা প্রত্যাখ্যান করে তাদের কাতারে শামিল করতে। কিন্তু রাজ্যপাল ইচ্ছা করেই এসব রাজাদের সাথে সবধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের দেয়া কোন সংবাদ যেমন গ্রহণ করতেন না, তিনিও তাদের সাথে কোন ধরনের যোগাযোগের চেষ্টা করতেন না। এর কারণ ছিল, গযনী সরকার তার তৎপরতা পর্যবেক্ষণের জন্য রাজ্যপালের নতুন রাজধানী রাড়ীতে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ করে রেখেছিল এবং সামরিক বাহিনীর কয়েকজন কমাণ্ডার পর্যায়ের ব্যক্তি সব সময় বাড়ীতে অবস্থান করে রাজ্যপালের সার্বিক কাজ কর্ম ও তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করতো।

রাড়ীতে গযনী বাহিনীর যে ক’জন সেনা কমান্ডারকে নিয়োগ করা হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিল কমান্ডার যুলকারনাইন। কমান্ডার যুলকারনাইন ছিল হিন্দুস্তানের যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী অভিজ্ঞতার অধিকারী। সে হিন্দুস্তানের প্রায় সবগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তাছাড়া দীর্ঘ দিন সে লাহোর ও মুলতানে অবস্থান করেছিল। ফলে অনায়াসে যুলকারনাইন স্থানীয় ভাষায় কথাবার্তা বলতে পারতো। স্থানীয় ভাষা জানার কারণে হিন্দুদের মনোভাব সে ভালো বুঝতে পারতো। এজন্য যুলকারনাইনকে রাড়ীতে মহারাজা রাজ্যপালের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

যুলকারনাইন ছিল দীর্ঘদেহী সুদর্শন যুবক। একটা স্মিতহাসি সব সময় তার মুখে দেখা যেতো। সে যে কোন মানুষের সাথে খুব সহজেই মিশতে পারতো, ফলে হিন্দুদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যুলকারনাইন।

ঘটনাক্রমে এই যুলকারনাইন এক হিন্দু তরুণীকে বিয়ে করেছিল। এই তরুণীর নাম ছিল রত্মা। অবশ্য যুলকারনাইনের সাথে বিয়ের আগেই রত্না তার নাম বদল করে রাজিয়া রেখেছিল। এই রত্মাকে যুলকারনাইন পেয়েছিল মথুরায়। এক ভয়ানক পরিস্থিতিতে রত্মা যুলকারনাইনের সান্নিধ্যে আসে।

সুলতান মাহমূদ যখন মথুরা আক্রমণ করেছিলেন তখন ছিল পূজার মৌসুম। পূজা দেয়ার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার হিন্দু ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে মথুরায় এসে জমায়েত হয়েছিল। পুরো মথুরা শহর আগতদের তাঁবুতে ভরে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ এক রাতের তুফান ও ঘূর্ণিঝড় গোটা শহর লন্ডভণ্ড করে ফেলে। তাঁবু উড়িয়ে নেয়। শত শত মানুষ গাছ কিংবা বিধ্বস্ত ঘর বাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। প্রচণ্ড ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় মথুরা নগরী।

ঠিক সেই ঝড়ের দু’দিন পর গযনীবাহিনী মথুরা আক্রমণ করেছিল। হিন্দু বাহিনীর সাথে শহরের বাইরে গয়নী বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। মথুরার আকাশে তখন শকুনের উড়াউড়ি আর বাতাসে মৃত লাশের গন্ধ। সর্বত্র ভগ্নস্তূপ। মথুরার সৈন্যরা গযনী বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

এক রাতে পাহারার জন্যে যুলকারনাইন দুই সঙ্গীকে নিয়ে শহরের বাইরে টহল দিচ্ছিল। ভয়াবহ পরিস্থিতি সবখানে। যত্রতত্র গাছপালা ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মৃত মানুষের দেহ। হাজার হাজার তাঁবুর জঞ্জাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সর্বত্র। শহরের ভেতরে ও বাইরে বহু লোক দুই বাহিনীর সংঘর্ষের সময় পদপিষ্ট হয়ে মারা পড়ে।

ঘোর সন্ধ্যার অন্ধকারে টহলরত অবস্থায় হঠাৎ যুলকারনাইনের কানে ভেসে এলো কারো পালানোর শব্দ। যুলকারনাইন ভেসে আসা শব্দের দিকে ঘোড়া হাকাল। ঘোড়ার খুঁড়ে শব্দ শুনে পলায়নপর লোকটি থেমে গেল এবং চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করল। যুলকারনাইন ঘোড়া থেকে নেমে দেখল, ভেঙ্গে পড়া

একটি গাছের আড়ালে একটি তরুণী মেয়ে নিজেকে লুকাতে চেষ্টা করছে। যুলকারনাইন হাত বাড়িয়ে যেই মেয়েটিকে ধরতে গেল, মেয়েটি গলা চড়িয়ে কান্না শুরু করল। দেখেই বুঝা যাচ্ছিল মেয়েটি ভয় ও আতংকে কাঁদছে।

যুলকারনাইন মেয়েটির আরো কাছে গিয়ে তাকে যখন টেনে দাঁড় করাল, তখন বুঝতে পারল, মেয়েটি যুবতী, সম্ভবত কুমারী।

আমাকে মেরে ফেলো- আতংকগ্রস্ত কণ্ঠে বললো মেয়েটি। আমার গায়ে হাত দিয়ো না, আমাকে মেরে ফেলো। আমাকে তুমি তুলে নিয়ো না- নিবেদনের সুরে বললো মেয়েটি।

এখানে আমরা কোন মেয়েকে হত্যা করতে আসিনি- বললো যুলকারনাইন। আমরা নারী ও মেয়েদের মর্যাদা দিতে এসেছি। তাদের জীবন বাঁচাতে এসেছি। আমরা অসহায় জীবন ও ইজ্জতের হেফাযত করতে এসেছি। বলো মেয়ে? তুমি কোথায় যেতে চাও, আমরা তোমাকে সেখানেই পৌঁছে দেবো।

আমি কোথাও যেতে চাই না, আমি মরতে চাই। আমাকে হত্যা করে আমার মা বাবার কাছে পৌঁছে দাও- কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো তরুণী।

তোমার মা বাবা কি মারা গেছে?

হ্যাঁ, তারা উভয়েই মারা গেছে। আমি যে স্থান থেকে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি, সেখানে তাদের মরদেহ পড়ে আছে। আমার একটি যুবক ভাই ছিল সেও মারা গেছে।

এই মেয়েটি বহু দূর থেকে তার মা বাবা ও ভাইয়ের সাথে মথুরা এসেছিল পূজা দিতে। ঝড়ের দিন তাদের তাঁবু বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়, তার যুবক ভাইটি গাছ চাপা পড়ে মারা যায়। আর দু’দিন পর যুদ্ধ শুরু হলে তার বাবা ও মা ভীত সন্ত্রস্ত ছুটন্ত মানুষের ভিড়ে ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যায়। যুদ্ধ শুরু হলে মেয়েটিকে তার মা বাবা এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল। ফলে সে বেঁচে যায়।

গয়নী সৈন্যদের এদিকে আসতে দেখে সে আতংকে কেঁপে উঠে, চরম আতঙ্কে দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যায়। তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে সে ভাঙ্গা গাছের আড়ালে বসে পড়ে। যুলকারনাইন এসে তাকে ধরে দাঁড় করায়। এই অবস্থায় মেয়েটিকে রেখে যাওয়া সমীচীন মনে করেনি যুলকারনাইন। সে মেয়েটিকে আশ্বস্ত করতে চায়। কিন্তু মেয়েটি তার পায়ে পড়ে মিনতি করতে থাকে–

আমি কুমারী। পরপুরুষের হাতে নিগৃহীত হওয়ার চেয়ে আমার মরে যাওয়া ভালো। দয়া করে তুমি আমাকে মেরে ফেলো।

যুলকারনাইন কিছুতেই তরুণীকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে পারছিল না, বাধ্য হয়েই যুলকারনাইন তাকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। তাও অসম্ভব হওয়ায় এক পর্যায়ে সে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল । যুলকারনাইন তাকে বার বার অভয় দিতে দিতে বলছিল

এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে যাওয়াটা হবে আমাদের জন্যে অন্যায়। বিশ্বাস করো, আমাদের হাতে তোমার কোন ধরনের নির্যাতিত হওয়ার আশংকা নেই। নারীর মর্যাদা রক্ষাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। তোমার গায়ে কেউ হাত দেবে না। তোমার আতংকিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তুমি নির্ভয়ে আমার সাথে এসো।

মেয়েটিকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে যুলকারনাইন তার উর্ধতন সেনা কমান্ডারের কাছে এলো। সময়টা ছিল খুবই জটিল। এ সময় কোন অসহায় মেয়েকে সেবা দেয়ার অবকাশ ছিল না। কমান্ডার যুলকারনাইনকে বললেন, একে তোমার কাছে রাখতে চাইলে রাখতে পারো, নয়তো কোন হিন্দুর কাছে রেখে আসতে পারো। তবে সতর্ক থাকবে এ যেনো তোমার কর্তব্য পালনে কোন ধরনের ত্রুটির কারণ না হয়।

অবশ্য সে দিন এই অসহায় হিন্দু তরুণী যুলকারনাইনের কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে কোন ক্রটি সৃষ্টি করতে পারেনি। তার কর্তব্য কর্মে কোন বাধা হয়নি, তবে তার জীবনের বাঁধনে আটকা পড়ে এই তরুণী! হয়ে পড়ে জীবন সঙ্গিনী।

সেই রাতের বাকী সময়টা তরুণী যুলকারনাইনের তাঁবুতেই কাটায়। যেহেতু যুলকারনাইন ছিল কমান্ডার। এজন্য তার জন্য ছিল স্বতন্ত্র তাঁবু। সেই তাঁবুতে পড়ে মেয়েটি কাঁদতে থাকল এবং তাকে মেরে ফেলার জন্যে অনুরোধ করতে লাগল। যুলকারনাইন তাকে নানাভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু তরুণী কিছুতেই আশ্বস্তবোধ করছিল না। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে মেয়েটির চোখ বন্ধ হয়ে এলো। ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুম থেকে জেগে সে যখন যুলকারনাইনের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখতে পেল না তখন নিজের মধ্যেও কোন অস্বাভাবিকতা অনুভব করল না। তার মনে হলো মা বাবার সান্নিধ্যে যেভাবে ঘুমাতো সেভাবেই ঘুমিয়েছে সে।

এমন অবস্থা দেখে তরুণী যুলকারনাইনকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার? আমাকে কি তোমার মনে ধরেনি?

তোমাকে যদি ভালো না লাগতো, তাহলে আমার সাথে না রেখে তোমাকে অন্য কোন স্থানে রেখে আসতাম। বললো যুলকারনাইন। তুমি বলছিলে না, তুমি কুমারী। আমি বলছিলাম- হ্যাঁ, তুমি খুবই সুন্দরী। আমি তোমাকে একজন পবিত্র মেয়েই মনে করেছি এবং পবিত্র রাখারই মনস্থির করেছি। এখন মন থেকে সব ভয় ঝেড়ে ফেলে বলো- কোথায় যেতে চাও?

তরুণী কোন কথা না বলে দীর্ঘ সময় যুলকারনাইনের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার দু’পা জড়িয়ে ধরে পায়ে মাথা ঠেকালো। যুলকারনাইন দ্রুত তার পা সরিয়ে নিয়ে বললো- আমাদের ধর্মে কোন মানুষকে অপর মানুষের সেজদা করার অনুমতি নেই। তুমি আমার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে আমাকে গোনাহগার বানিও না। বলো, কোথায় যেতে চাও তুমি?

তরুণী একটি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, মেয়ে হয়ে জন্মালে মা বাবার ঘর ছেড়ে একদিন না একদিন কারো না কারো ঘরে যেতেই হয়। আমার মা বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন তুমিই বলো, আমি কি করবো? কোথায় যাবো?

আমার সাথে থাকতে চাইলে তোমাকে তোমার ধর্মত্যাগ করতে হবে, বললো যুলকারনাইন। কিন্তু তোমর ধর্ম-ত্যাগ করলে অল্প দিনের মধ্যেই তুমি অনুভব করতে পারবে, ধর্মত্যাগ করে তুমি ভালই করেছে।

যুলকারনাইনের মুখে ধর্মত্যাগের কথা শুনে তরুণী চিন্তায় পড়ে গেল। যুলকারনাইন তরুণীকে বুঝতে দিতে চাচ্ছিল না, সে তরুণীর প্রেমে পড়ে গেছে। তরুণী ছিল খুব সুন্দরী, চলন বলনে মার্জিত। তরুণীর মুখের ভাষা ও কণ্ঠস্বর যে কারো হৃদয় রাজ্যে তোলপাড় সৃষ্টি করার মতো আকর্ষণীয়। যুলকারনাইন অনুভব করছিল, এই তরুণীকে তার বিয়ে করে ফেলা উচিত। নয়তো এই মেয়ে তার কর্তব্য কাজে বাধা হয়ে উঠতে পারে। এমনিতেও যুলকারনাইনের মনে প্রচণ্ড একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুতেই এই তরুণীকে হারাতে চাচ্ছিল না কিন্তু হিন্দু একটি মেয়েকে সাথে রাখা এবং তাকে বিয়ে করাও সম্ভব ছিল না।

আমি তোমর উপর কোন শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছি না। তোমাকে অসহায় পেয়ে আমি তোমার মনের বিপরীতে কোন কিছু করতে বাধ্য করছি না। যদি চলে যেতে চাও, তবে বলো, কোথায় যেতে চাও?

আমাকে হরিকৃষ্ণের পায়ে বসিয়ে দাও, বাকী জীবন মন্দিরে দেবীর পূজা করে কাটিয়ে দেবো।

তরুণীর মুখে একথা শুনে যুলকারনাইনের রক্তে আগুন ধরে গেল। সে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো- নিজেকে কেন ধোঁকা দিচ্ছে। এসব মন্দিরে কি হয় তা সবাই জানে। এসব রহস্য আর গোপন নেই যে, দেব-দেবীর নামে জীবন উৎসর্গকারিণী কুমারীদেরকে সব সময় মন্দিরের পুরোহিতরা রক্ষিতার মতো ব্যবহার করে। এই মন্দিরে গিয়ে তোমাকেও তো পুরোহিতদের রক্ষিতা হয়েই কাটাতে হবে। তোমাদের পাথরের গড়া দেবদেবী আসলে একটা ধোকা। কেন নিজে এই নোংরা জীবন বেছে নিতে চাচ্ছো। তোমার বয়স কম, জীবন জগত সম্পর্কে তোমার ধারণাও কম। এজন্যই তোমার প্রতি আমি এতটা দরদ দেখাচ্ছি। নয়তো তুমি তো আমার কাছে একজন বিধর্মী মেয়ে ছাড়া কিছুই নও। তোমার মতো একজন তরুণীই তো আর গোটা হিন্দুস্তান নয়। আমি এতো দূর থেকে শুধু তোমার মতো একটি তরুণীকে পাওয়ার জন্যে আসিনি। আমি এসেছি তোমাদের এই পূজনীয় মূর্তি ধ্বংস করতে। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখো, তোমাদের দেবদেবীদেরকে আমরা টুকরো টুকরো করে ফেলে রেখেছি। মানুষ এগুলোকে পায়ে পিষে আসা যাওয়া করছে।

যুলকারনাইনের কথা শুনে তরুণী গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। কারণ সে ধর্মীয় আবেগ তাড়িত হয়েই তো মা বাবার সাথে ভারতের এক কোণ থেকে মথুরায় পূজা দিতে এসেছিল। তখন তার মনে হিন্দুত্ববাদের আবেগ ছিল প্রবল। তাই ধর্ম ত্যাগের কথা শুনে সে চিন্তায় পড়ে গেলো ।

যুলকারনাইন বললো, তুমি যেখানে যেতে চাও, সেখানেই তোমাকে পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু কোন মন্দিরে তোমাকে থাকতে দেয়া হবে না।

ঝড়ের তাণ্ডব, যুদ্ধের বিভীষিকা, মা বাবা ভাইয়ের মৃত্যু আর অগণিত মৃতের লাশ দেখে তরুণী এতোটাই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে, যুলকারনাইনের তাঁবু থেকে বাইরে যাওয়ার সাহস সে পাচ্ছিল না। তা ছাড়া বিগত একরাতের নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কারণে যুলকারনাইনের প্রতি যে আস্থা জন্মেছে সেই আস্থা ও আশ্রয় সে হারাতে চাচ্ছিল না। মনের অজান্তেই তরুণীর কাছে যুলকারনাইনই হয়ে পড়ে ছিল আস্থা ভরসা ও নির্ভরতার মূর্তপ্রতীক।

এভাবে কেটে গেল তিন চার দিন। এ কয় দিনের মধ্যে তরুণী আর যুলকারনাইনের তাঁবু থেকে বের হলো না। কিন্তু নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কেও সে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না। এ দিকে যুলকারনাইনকে মথুরা ত্যাগ করে আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। যুলকারনাইন যখন তরুণীকে একথা জানাল তখন তরুণী কোন কিছু চিন্তা না করেই বললো- তুমি যেখানে যাও, আমাকেও সেখানে নিয়ে চলো।

বিগত তিন চার দিনে তরুণী অনুভব করলো এবং প্রত্যক্ষ করলো, সুন্দর সুঠামদেহের অধিকারী আকর্ষণীয় এই যুবক বাস্তবে একটা পাথর হৃদয়ের মানুষ নয়তো ফেরেশতা। এ তিন চার দিনে একটি বারও তার দিকে হাত বাড়াবে দূরে থাক একটু স্পর্শও করেনি। তাই রওয়ানা হওয়ার আগে সে যুলকারনাইনকে বললো, আমার ব্যাপারে যা করতে হয় তুমি সেই ব্যবস্থা করো, আমি কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যাবো না। প্রয়োজনে আমি ধর্ম ত্যাগ করতেও রাজি।

তরুণীর কণ্ঠে ধর্মত্যাগের আগ্রহ শুনে যুলকারনাইনের মনে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। সে দিনই এক ফাঁকে তরুণীকে সেনাবাহিনীর ইমামের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ইমাম তাকে কলেমা পড়িয়ে ইসলামে দীক্ষা দিলেন এবং তার নতুন নাম দিলেন রাজিয়া।

তরুণীর নাম ছিল রত্মা। এবার সে রত্না থেকে রাজিয়া। রত্মার ইসলাম গ্রহণের ফলে সেনাপতি নিজেই উদ্যোগী হয়ে যুলকারনাইনের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনীর সাথে থাকা আরো কয়েকজনের স্ত্রীরা এসে নতুন বধুকে বরণ করে নিল। রাজিয়াকে তাদের কাছে অর্পণ করে যুলকারনাইন তার কর্তব্য পালনে সেনাদলের সাথে অভিযানে চলে গেল।

অভিযান থেকে ফিরে এলে যুলকারনাইনকে রাজিয়া সম্পর্কে জানানো হলো, নওমুসলিম রাজিয়া তাকে ফেরেশতার মতোই পবিত্র মানুষ বলে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু ইসলামের হুকুম আহকাম বিশেষ করে নামায পড়তে গিয়ে এই তরুণী কেমন জানি হাঁপিয়ে ওঠে এবং তার কাছে নামায কঠিন মনে হয়। অথবা এমনও হতে পারে এই তরুণী অন্তর দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেনি। তার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। নিজের জীবন বাঁচানোর তাকিদেই হয়তো সে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে।

মথুরা জয়ের পর এক বছর চলে গেছে। যুলকারনাইন এখন রাড়ীতে মহারাজা রাজ্যপালের উপদেষ্টা হিসেবে অবস্থান করছে। রাজ্যপাল বাহ্যত নামে রাজা থাকলেও তার সেই দাপট ও কর্তৃত্ব ছিল না। সে এখন আর একজন লড়াকু রাজা নয়, প্রকৃতই একজন পুতুল রাজা মাত্র। অঢেল বিত্তবৈভবের কারণে সে রাজার হাতেই চলতো বটে। কিন্তু আগের জাঁকজমক আর ছিল না।

অবশ্য নর্তকীর নাচ বাদকদের বাজনা ছাড়া মহারাজার দিন কাটতো না। ফলে রাজ্য হারা রাজা হলেও এসব আয়োজনের কোন ঘাটতি ছিল না রাজ্যপালের। রাড়ীতে রাজ্যপাল অল্প দিনের মধ্যেই একটি রাজ প্রাসাদ গড়ে তুলেন এবং রাজমহলের এসব গান বাজনায় গযনীর কমান্ডার ও উপদেষ্টাদেরও দাওয়াত দেন। কিন্তু গযনী সরকারের কোন কর্মকর্তা রাজার গান বাজনাও নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ করেন না।

রাড়ীতে পূর্ব থেকেই একটি মন্দির ছিল। সেটিতে আগে জৌলুস না থাকলেও রাজধানী ঘোষণার পর মন্দিরটি জৌলুসপূর্ণ হয়ে ওঠে। দলে দলে পূজারীরা মন্দিরে পূজা দিতে ভীড় করে। হিন্দুস্তানের বিভিন্ন জায়গা থেকে মন্দিরে এসে আস্তানা গেড়ে বসে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞ পুরোহিত।

সুলতান মাহমূদের নির্দেশে তার কর্মকর্তারা রাজ্যপাল ও হিন্দুদের পূজা অর্চনায় কোন প্রকার বিধি নিষেধ আরোপ করেনি। সুলতান নির্দেশ দিয়ে ছিলেন, হিন্দুদের কাছে যেন ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয় এবং তাদের সামনে ইসলামের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হয়।

গযনীর নিয়োজিত কর্মকর্তা ও সেনারা দাওয়াতী কাজ যথারীতি চালু করেছিল। ফলে দু’চারজন করে হিন্দু প্রতিদিনই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছিল।

এ দিকে যুলকারনাইন তার স্ত্রী রাজিয়াকে বলেছিল, সে যেনো হিন্দু মহিলাদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করে। সে যেনো হিন্দু মহিলাদের বলে ইসলাম কতটা সুন্দর। ইসলামের রীতি নীতি কতো মানবিক এবং মুসলমানদের আচার আচরণ ও চরিত্র কতত পবিত্র। সে যেনো হিন্দু মহিলাদের জানায়, ইসলামের অনুশাসন এমনই সুন্দর যে, তা মানুষকে পবিত্র করে তোলে।

রাজিয়া ইসলামের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলীর গুণগ্রাহী ছিল। সে মুসলমান পুরুষদের উন্নত নৈতিকতা নিজের জীবনে অনুভব করেছিল। ফলে হিন্দু কোন মহিলা এলে সে তার জীবনের কাহিনীই বর্ণনা করতো।

এদিকে গফনীতে সুলতান মাহমূদ প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। তিনি তার প্রতিবেশী গযনী বিরোধী মুসলমান শক্তিগুলোকে রণাঙ্গনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। অবশ্য শত ব্যস্ততার মধ্যেও তার একটি কান সব সময় হিন্দুদের দিকে উৎকর্ণ হয়ে থাকতো। কারণ হিন্দুস্তানের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে তিনি মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুসলিম যোদ্ধাকে রেখে এসেছিলেন। যাদের চতুর্দিকে অবস্থান করছিল বিপুল শক্তির অধিকারী হিন্দু রাজা মহারাজারা। যারা এক ফুঙ্কারে গযনীর এই সৈন্যদেরকে উড়িয়ে দেয়ার জন্য রাত দিন চেষ্টা-সাধনা করছিল। মেতে উঠে ছিল গযনী বিরোধী নানা আয়োজনে। মথুরা ছিল হিন্দুদের হৃৎপিণ্ডের মতো। এই হৃৎপিণ্ডে ইসলামের খঞ্জর বিদ্ধ হয়েছিল। ফলে বুকের মধ্যে বিদ্ধ খঞ্জর নিয়ে হিন্দু রাজা মহারাজাদের নীরব নির্বিকার বসে থাকার উপায় ছিল না।

সুলতান মাহমূদ কয়েকটি কঠিন অভিযান পরিচালনার পর অনুভব করতে পেরেছিলেন, হিন্দুজাতি মুশরিক ও বহু দেবদেবীর পূজারী হলেও এরা ভীতু নয়, লড়াকু। সুলতান প্রত্যক্ষ করে ছিলেন হিন্দুরা অকাতরে তাদের জাতি ও ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্যে জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তাদের প্রধান দুর্বলতা সেনাপতিদের অদূরদর্শিতা। তারা কৌশলের চেয়ে জনবল এবং আবেগের উপর বেশী নির্ভর করে। রণাঙ্গনে মাথার চেয়ে শক্তিকে বেশী ব্যবহার করে। নির্ভিক চিত্তে হামলে পড়া এবং প্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করাকেই তারা মনে করে লড়াই।

পক্ষান্তরে সুলতান মাহমূদ লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সব সময়ই শক্তির চেয়ে কৌশলকে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি দারুণ কার্যকর কৌশলে শক্তির ব্যবহার করতেন। ফলে তিনগুণ চারগুণ প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করেও তিনি অনায়াসে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারতেন। ইতিহাসবিদগণ এ কারণেই পৃথিবীর ক্ষণজন্মা সমরবিদদের অন্যতম স্থানটি সুলতান মাহমুদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছেন। সুলতান মাহমূদ তাই বিশ্ব ইতিহাসে একজন দূরদর্শী সমরনায়ক হিসেবে বিবেচিত।

সুলতান মাহমুদের যুদ্ধ কৌশল সব সময় প্রতিপক্ষকে ফাঁদে আটকে ফেলতো। তখন শত্রুপক্ষের সামনে দুটি পথই খোলা থাকতো। লড়াই করে জীবন দিতে হতো, নয়তো হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পনের পথ বেছে নিতে হতো।

ধর্মীয় ভাবাবেগের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুরা কম ধর্ম অনুরাগী ছিলো না। বলা চলে হিন্দুদের মধ্যে ধর্মের আবেগ ছিল মুসলমানদের চেয়ে বেশী। মুসলমানরা অদৃশ্য আল্লাহর ফরমান বিশ্বাস করে লড়াই করতো। আর হিন্দুরা তাদের দৃশ্যমান দেবদেবীদের সম্মান রক্ষার জন্যে জীবন উৎসর্গ করতো।

হিন্দু ধর্ম যে ভ্রান্ত এমন ধারণা তারা কখনোই মনে স্থান দিতো না। তারা বংশপরস্পরায় মূর্তিপূজাকেই একমাত্র সঠিক ধর্ম বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো। সেই সাথে শৈশব থেকে মনের মধ্যে গেঁথে নিতো রূপকথার মতো দেবদেবীদের নানা কাহিনী। বাস্তবতা ও যুক্তির বিচারে এগুলো প্রত্যাখ্যানযোগ্য হলেও হিন্দু মণী ঋষি ও পুরোহিতেরা যুগ যুগ ধরে সাধারণ হিন্দুদেরকে এসব উপখ্যানই ধর্মের আবরণে পেশ করে আসছিল। পরম শ্রদ্ধায় হিন্দুরা পুরোহিতদের সৃষ্ট এসব কাহিনীকেই ধর্ম পালনের অংশ ভেবে আসছিল।

হিন্দুরা কখনেই বুঝতে চাইতো না, তারা সত্য ধর্মের বিপরীতে মিথ্যার পক্ষ হয়ে লড়ছে। তাদেরকে কেউ বলতো না, সত্য মিথ্যার লড়াইয়ে সত্যের পক্ষেই থাকে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ।

সুলতান মাহমূদের অস্বাভাবিক সামরিক দূরদর্শিতা প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর দেয়া বিশেষ এক দান ছিল। আল্লাহ তাআলা সুলতান মাহমূদকে এমন সামরিক দূরদর্শিতা, সাহস ও দৃঢ়তা দিয়েছিলেন যার সামনে কঠিন পাহাড় ধসে যেতো। সুলতান মাহমূদ বলতেন, সাপ শেষ পর্যন্ত মানুষের হাতেই মারা পড়ে কিন্তু মানুষকে সতর্ক থাকতে হয়, তার অসতর্কতায় সাপ না আবার তাকে দংশন করে বসে। তিনি হিন্দুদেরকে সাপ বিচ্ছুর সাথে তুলনা করতেন। কারণ, বিচ্ছুর মতোই হিন্দুরা সব সময় কিভাবে মুসলমানদের দংশন করবে এ চিন্তায় বিভোর থাকতো।

আমি হিন্দুদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি না- সামরিক উপদেষ্টাদের, বলছিলেন সুলতান মাহমূদ। কারণ হিন্দুদের সমূলে উপড়ে ফেলা আমার পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি। আমি হিন্দুদের আত্মসমর্পণের উপর নির্ভর করতে পারি না। সাপ-যদি গর্তেও চলে যায় কিংবা সাপকে যদি বাক্সেও ভরে ফেলা হয় তবে তার স্বভাব বদলে যায় না, তার বিষ নিঃশেষ হয়ে যায় না। সুযোগ পেলেই সে ছোবল মারতে পারে।

তিনি প্রায়ই বলতেন, আমাকে আল্লাহ হয়তো এতো বেশী বয়স দেবেন না, যাতে আমি মুহাম্মদ বিন কাসিমের আযাদকৃত যমীনকে পুনর্বার ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসবো। এটাও জানা নেই, আমার পরবর্তী গযনী শাসকরা এ দিকে মনোযোগ দেবে কি না। পরবর্তী শাসকরা যদি হিন্দুদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে তা হবে মুসলমানদের সাথে দুশমনী। যতো দিন পৃথিবীতে হিন্দু থাকবে তারা ইসলামকে ছোবল মারবেই এবং হিন্দুস্তানের যমীন মুসলমানদের রক্তে রি ত হতেই থাকবে। হিন্দুস্তানের মজলুম মুসলমানদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসবে না। যাদের এগিয়ে আসার কথা তাদেরকে হিন্দু শাসকরা মৈত্রী ও বন্ধুত্বের জালে আটকে রাখবে।

সুলতান মাহমূদ বলতেন, হিন্দু শাসকরা বহুগামী, স্ত্রীর মতো, যে প্রকাশ্যে স্বামীর পা ধুইয়ে দেয় এবং দৃশ্যত সে স্বামীর অর্ধাহীনী হিসেবে নিজেকে জাহের করে, কিন্তু স্বামীর আড়াল হলেই সে আরো কয়েক জনের সাথে প্রেম করে। প্রকৃত পক্ষে সে স্বামী বেচারার জন্যে প্রেমের ফাঁদ এবং জীবন্ত প্রতারণা হয়ে সবসময় স্বামীর সাথে প্রতারণা করে। এমন স্ত্রী যে কোন সময় তার প্রেমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য স্বামীকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না।

সুলতাম মাহমূদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও মুর্শিদ শায়খ আবুল হাসান কিরখানী তাকে বলেছিলেন, মানবেতিহাসে দু’টি জাতি একই মাটি থেকে একই সচে বানানো হয়েছে। এই দু’টি জাতি হলো ইহুদী ও হিন্দু। মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ এদের স্বভাবজাত এবং এদের ধর্মের অংশ। যে যুগে মুসলমানরা এই দুই জাতি সম্পর্কে অসতর্ক হবে কিংবা এই দুই জাতিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, সেই যুগ হবে মুসলমানদের পতনের যুগ।

মুসলিম মিল্লাত তখন তাদের আত্মমর্যাদাবোধকে হারিয়ে ফেলবে, তাদের মান মর্যাদা ধ্বংস হয়ে যাবে। শতধা বিচ্ছিন্ন মুসলিম শাসক গোষ্ঠী মুসলিম জনতাকে প্রজা ভাবতে শুরু করবে। তখনকার শাসক শ্রেণী নাগরিকদের মুখ বন্ধ করে দেবে। ইহুদী ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলমানরা কিছুই বলার সুযোগ পাবে না। কারণ তখনকার শাসক গোষ্ঠী ইহুদী ও হিন্দুদের মনোরঞ্জন করে ক্ষমতায় থাকতে চেষ্টা করবে। সেই যুগ হবে ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার যুগ। তখন আল্লাহর যমীন মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হতে থাকবে।

সুলতান মাহমূদ খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে তার শায়খের কথা শুনতেন। এ সব কথা শোনার সময় তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো। তাকে দেখে মনে হতো তিনি সেই সময়ের কথা ভেবে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। দুঃখ যন্ত্রণায় তার অন্তর কেঁপে উঠতো। একদিন আবুল হাসান কিরখানী বললেন, এমন একদিন আসবে, যখন তোমার এই রাজ্যে বিধর্মী শক্তি তাদের ইচ্ছামতো শাসন কাজ চালাবে। তোমার রাজ্যে মুনাফিকদের দৌরাত্ম চলবে। গযনী, কান্দাহার, গারদিজ তখন বিধর্মীদের পদপিষ্ট হবে। যাদের কোন দীন ধর্ম থাকবে না, তাদেরকেই একদল মুসলিম দীনের প্রহরী ভাবতে শুরু করবে।

সম্মানিত মুর্শিদ! কম্পিত কণ্ঠে একথা শুনে বললেন সুলতান, সে সময়ের অনাগত সেই জাতির দুর্ভাগ্য আজ আমি কি ভাবে রোধ করতে পারবো? আমাকে এজন্য কি ভূমিকা পালন করতে হবে?

আরে সুলতান! তুমি তো তখন হবে কবরের অধিবাসী। তোমার কবর তাদের কিছুই করতে পারবে না। তোমার আমার কবরের চার পাশেই ভবিষ্যতে রক্তের হুলি খেলার আয়োজন হবে। তখন আর আমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। অতএব যা করার এখনই করতে হবে। অবশ্য তুমি তোমার কর্তব্য যথার্থই পালন করছে।

এই প্রেক্ষিতে আজ আমি তোমাকে কি কাজ করা ঠিক হবে না সে ব্যাপারটি বলতে চাচ্ছি। তুমি বার বার মোহময় মায়াবী হিন্দুস্তানে যাচ্ছো। হিন্দুস্তানে রয়েছে সোনা-দানা ও সহায়-সম্পদের চমক এবং হিন্দুস্তানের মেয়েরাও মারাত্মক চমক। এরা কোন প্রকার পর্দা করে না। শুধু মেয়ে নয়, হিন্দুস্তানের প্রাকৃতিক পরিবেশও মোহময়। তুমি, তোমার সেনাপতি ও কমান্ডাররা যদি এসব মোহ-মায়া থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতে পারো, তাহলে তোমাদের পক্ষে সেই দুর্গ তৈরী করা সম্ভব হবে, যে দুর্গ প্রাচীরে মাথা ঠুকে মরবে হিন্দুরা।

সম্মানিত মুর্শিদ! অনেক সময় আমার সৈনিকরা হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে ফেলে। অবশ্য যেসব মেয়ে বিয়ের আগেই স্বেচ্ছায় ইসলামে দীক্ষা নেয় তাদেরকেই গযনীর সেনারা বিয়ে করে। আমি কি এই ধারা চালু থাকতে দেবো, না বন্ধ করে দেবো?

শোন মাহমূদ! এই প্রেক্ষিত্রে তোমাকে একটি গল্প বলি- বললেন শায়খ কিরখানী! আমি যখন যুবক, তখন আমার আব্বার একজন বন্ধু প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে আসতেন। আব্বার এই বন্ধুটি ছিলেন খুবই দূরদর্শী সৎ ও ব্যবসায়ী। একবার তিনি কোন স্থান থেকে একটি চিতার বাচ্চা নিয়ে এলেন। আমি সেই চিতার বাচ্চাটি দেখেছি। লোকটি চিতার বাচ্চাটিকে খুবই আদর করতেন। মনে হতো তিনি একটি বিড়ালের বাচ্চাকে আদর করছেন। আব্বার সেই বন্ধু চিতার বাচ্চাকে তার কোলে বসিয়ে দুধ পান করাতেন এবং নিজের বিছানায় শোয়াতেন।

চিতার বাচ্চাটি যখন বড় হলো, তখন আব্বার ব্যবসায়ী বন্ধু সেটিকে পাখি ও হরিণের গোশত খাওয়াতেন। ব্যবসায়ী যে দিকে যেতেন, চিতার বাচ্চাও সেদিকেই যেতো। মুনীবের সাথে চিতার বাচ্চার খুবই ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল।

একদিন সেই ব্যবসায়ী আমার আব্বার সাথে দেখা করতে এলেন। তার একটি হাত কুনুই থেকে বাজু পর্যন্ত কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, হাতের গোশত চিতার বাচ্চা ছিঁড়ে খেয়েছে। একথা শুনে আমার আব্বা বললেন, আরে চিতার বাচ্চা না তোমাকে খুবই আপন ভাবতো, তুমি তাকে আদর করতে ব্যবসায়ী বললো, আদর করেই সে কামড় দিয়েছে। আদর করে কামড়ে দিলেও দাঁত আমার হাতে বিধিয়ে ফেলে। ফলে খুব কষ্টে তার দাঁত ছাড়াতে হয়েছে। এতে তার শরীরের অর্ধেক রক্ত ঝরে গেছে।

লোকটি চলে যাওয়ার পর আব্বা আমার উদ্দেশে বললেন, কিছু বুঝলে হাসান?

হিংস্রদের আদরেও হিংস্রতা থাকে। চিতার বাচ্চা তার স্বভাবের কারণে মানুষের বন্ধু হতে অক্ষম, স্বভাবগত কারণে সে মানুষকে শত্রু ভাবতে বাধ্য। মাহমূদ! হিন্দু আর ইহুদীরা হলো সেই চিতার বাচ্চার মতোই হিংস্র। এদের ভালোবাসার মধ্যেও হিংস্রতা রয়েছে। স্বভাবগতভাবেই এরা মুসলমানদেরকে শত্রু ভাবতে বাধ্য। এ থেকে তুমিই সিদ্ধান্ত নাও, মুসলমানরা হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করবে কি না। পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন এই দুই জাতির নারী পুরুষ একে অন্যের শরীরের মধ্যে কোনরূপ বিরূপতা বা শত্রুতা অনুভব করবে না ঠিক, যতটুকু স্বাদ অনুভব করার কথা ততটুকুই করবে বৈ কি? কিন্তু তাতে রক্তের শত্রুতা ও বৈরীতার বিলুপ্তি ঘটবে না। এবং ব্যাপকভাবে আত্মিক মিলনও কখনো ঘটবে না। দৈহিক সম্পর্ক আদর্শিক বিরোধ নিঃশেষ করে না। সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। জিনিস। যা কেবল সঠিক সময়েই বুঝা যাবে।

সুলতান মাহমূদ হিন্দু মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে কোন প্রকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি বটে, কিন্তু তিনি সেনাবাহিনীর ইমামদের বলেছিলেন, তারা যেন হিন্দু মেয়েদের ব্যাপারে সেনাদের সতর্ক রাখে। এই সতর্কতা অবলম্বনের পরও পরিস্থিতির কবলে পড়ে অনেক সৈনিকই হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছিল। এমনই এক পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়ে কমান্ডার যুলকারনাইনও রত্মা নামের মেয়েটিকে বিয়ে করেছিল। যে রত্মা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে রাজিয়া নাম ধারণ করেছিল এবং যুলকারনাইনকে তার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছিল।

রাজিয়া ছিল একেবারে নিঃস্ব ও নিরূপায়। বাবা মা ভাইকে হারিয়ে আশ্রয় পাওয়ার মতো তার কেউ ছিল না। তার সামনে একমাত্র পথ ছিল মন্দিরে আশ্রয় নেয়া। কিন্তু মেয়েটিকে মন্দিরের অন্ধকার জীবনে ঠেলে দিতে চাচ্ছিল না যুলকারনাইন। কারণ রত্মার রূপ সৌন্দর্য ও তার অসহায়ত্বের দিকটি যুলকারনাইনকে অনেকটা বাধ্য করে তুলেছিল মেয়েটির দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে এবং অন্ধকার জীবন থেকে মেয়েটিকে আলোর পথে নিয়ে আসতে। মেয়েটির অসহায়ত্ব এবং যুলকারনাইনের প্রতি আত্মনিবেদন সেনাবাহিনীর ইমাম ও সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকীকেও মেয়েটির প্রতি দয়াপরবশ করে তুলেছিল। ফলে তারা কেউ যুলকারনাইনের সাথে রাজিয়া ওরফে রত্নার বিয়েতে বাধা দেননি।

সময়ের ব্যবধানে রাজিয়ার বিয়ের সংবাদ সুলতান মাহমুদের কানেও পৌঁছাল কিন্তু যুলকারনাইনের কর্তব্য নিষ্ঠা এবং রাজিয়ার অসহায়ত্ব ও যুলকারনাইরে কাছে তার স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের কথা শুনে এ ব্যাপারে সুলতানও কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি।

একটা নিয়ম মতো রুটিন মাফিক হিন্দুস্তান থেকে বিভিন্ন সংবাদ নিয়ে গযনীতে দূত পাঠানো হতো। হিন্দুস্তানের বিভিন্ন জায়গায় গযনী সুলতানের যেসব গোয়েন্দা অবস্থান করছিল তাদের সরবরাহকৃত খবরও সমন্বয় করে গযনী সুলতানের কাছে পাঠানো হতো।

গোয়েন্দাদের পাঠানো তথ্যমতে লাহোরের মহারাজা তরলোচনপাল তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে রাজধানী থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। সে গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী কোথাও অবস্থান না করে আরো উত্তরের দিকে কোন পাহাড়ী এলাকায় আত্মগোপন করেছিল। কেন সে রাজধানী থেকে সৈন্য সামন্ত নিয়ে আত্মগোপন করেছিল, তার উদ্দেশ্য ও অবস্থান সম্পর্কে গোয়েন্দারা সঠিক কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি।

রাজা তরলোচনপালের ইচ্ছা যাই থাকুক, তার কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছা পূরণের আয়োজন চলছিল কালাঞ্জরে। কালাঞ্জরের রাজা গোবিন্দের রাজ মহলে গোয়ালিয়রের রাজা অৰ্জুন এবং লাহোরের রাজা তরলোচনপাল মিলিত হলো। তাদের সাথে গোবিন্দ নামের এক অভিজাত হিন্দু এবং কালাঞ্জরের প্রধান পুরোহিতও উপস্থিত ছিল। তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল, মহারাজা রাজ্যপাল তাদেরকে ধোকা দিয়েছে এবং মৈত্রী চুক্তির আড়ালে সে সুলতান মাহমূদের বশ্যতা স্বীকার করে তার গোলামী করছে। তারা আলোচনা করছিল কিভাবে রাজ্যপালকে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া যায়।

নানামুখী আলোচনা পর্যালোচনা যখন তুঙ্গে ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের কক্ষের বাইরে চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ শোনা গেল। চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ শুনে সবাই উপরের দিকে তাকালেন। তারা ভাবলেন উপর তলায় হয়তো কোন নর্তকী কিংবা মহিলা নাচের ঘুঙুর পরে উঁকি দিয়েছে। কিন্তু চতুর্দিকে দৃষ্টি ঘুরে কক্ষের মধ্যে ঝুলন্ত রেশমী কাপড়ের পর্দায় তাদের দৃষ্টি আটকে গেল। ওই পাতলা পর্দার আড়ালে সাধারণত রাণী বা রাজকুমারীদের কেউ এসে বসতো। সবাই লক্ষ করলো অতি পাতলা পর্দার আড়ালে সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক নারী দাঁড়িয়ে। বিবস্ত্র নারীর অস্তিত্ব দেখে সবার দৃষ্টি অবনমিত হয়ে গেল।

এই নাও, গল্পে গল্পে আর মদের গ্লাসে আসর না মাতিয়ে তোমরা এই চুড়িগুলো পরে নাও! পর্দার ওপাশ থেকে তীর্যক শ্লেষাত্মক বাক্য উচ্চারিত হলো।

কী ব্যাপার? দৃষ্টি নীচের দিকে ফিরিয়ে নিয়েছে কেন? আমার দিকে তাকাও। আমি তোমাদের সম্ভ্রম, আমি ভারত মাতা, আমি ইন্দ্রাদেবী। দেখে নাও আমাকে, আমি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তোমরা আমাকে এমন বিবস্ত্র করেছে। তোমরা নির্লজ্জ। এখন সব লজ্জার ভান করে দৃষ্টি নীচের দিকে নামিয়ে নিয়েছে কেন?

এই ইন্দ্রাদেবী ছিল মহারাজা গোবিন্দের স্ত্রী, বড় রাণী। রানীর এই অবস্থা দেখে মহারাজা গোবিন্দ রাগে ক্ষোভে অপমানে জ্বলে উঠলো। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে গর্জন করে বললো- ভালো চাও তো এখান থেকে চলে যাও শকুন্তলা! শোনে রাখো, শিবাজী এবং হরেকৃষ্ণের অমর্যাদার প্রতিশোধ নিয়েই আমি তোমার কাছে আসবো। যে পর্যন্ত ভারত মাতার বুকে গযনীর একটি সৈন্যও অবশিষ্ট থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমি তোমার চেহারাও দেখবো না, তোমাকে স্পর্শও করবো না। ইন্দ্রাদেবীকে রাজা শকুন্তলা নামে ডাকতো।

রাখো তোমার এই শপথ! তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠে বললো রাণী শকুন্তলা। রাজপুতদের রক্ত আর তোমাদের দেহে প্রবাহিত নেই। শরাবের নেশা রাজপুত রক্তকে পানি করে ফেলেছে। তোমরা যদি সত্যিকার আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হতে, তাহলে সলাপরামর্শের নামে রাজমহলে বসে শরাবের নেশা করতে পারতে না। তোমরা কেন সেই ময়দানে যাচ্ছে না, যেখানে ভারত মাতার হাজারো সন্তান জীবন দিয়েছে? তোমরা সেই সব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের নীচে পড়ে কেন মৃত্যুবরণ করলে না মুসলমানরা যেসব মন্দির ধ্বংস করেছে?

রাণী! এখনো তুমি এখান থেকে যাচ্ছো না? আমাকে কি কোন ব্যবস্থা নিতে হবে? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো রাজা গোবিন্দ।

রাজার একথা শুনে কালাঞ্জরের প্রধান পুরোহিত দাঁড়িয়ে গেল। সেই যুগে হিন্দু রাজা মহারাজারা রাজ্য শাসন করতো আর রাজাদের শাসন করতো পুরোহিতেরা। কোন কোন এলাকায় সরাসরি পুরোহিতদের শাসন চলতো। গোটা হিন্দুস্তান জুড়ে ছিল পুরোহিতদের দাপট। রাজা মহারাজাদের যতো দাপটই থাক না কেন কোন না কোন ভাবে তারা পুরোহিতদের দ্বারা প্রভাবিত হতো। পুরোহিতদের অদৃশ্য শাসন চলতো সবখানে।

কালাঞ্জরের এই বৈঠকে পুরোহিত যখন রানী শকুন্তলাকে পর্দার ওপাশে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখতে পেল তখন সে রাগে ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো এবং রাজাদের উদ্দেশ্যে বললো- আপনারা বলছেন, রানী এখান থেকে যাচ্ছে না কেন? আমি বলি রাণী এই অবস্থাতেই আমাদের সামনে আসছে না কেন? যাতে আমরা ভালো ভাবে বুঝতে পারি, বিবস্ত্র অর্ধার্মিক আত্মমর্যাদাহীন একটি জাতি কেমন হতে পারে?

সুলতান মাহমূদ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য দখল করে নিয়েছে দু’বছর হয়ে গেলো। এই দু’বছর, তোমরা আসর বসিয়ে গল্প মারা ছাড়া আর কি করেছো? তাই তোমাদের অস্ত্র সন্ত্র তরবারী এই দেশের নারী ও পুরোহিতদের হাতে দিয়ে তোমরা চুড়ি পড়ে রাজপ্রাসাদে থাকো। নারী আর পুরোহিতরা গিয়ে লড়াই করুক। এখনো তোমাদের নর্তকী আর শরাব নিয়ে রাজমহলে আনন্দ ফুর্তিতে ভাটা পড়েনি। দেবতাদের নামে তোমরা বার বার কসম করেছো, এসব প্রতীজ্ঞা আর কসমও তোমরা রক্ষা করো নি।

এক পর্যায়ে রাণীকে ইঙ্গিত করে পুরোহিত বললো? চলে যাও রাণী! আমি মহারাজাদের কপালে ঘামের ফোঁটা দেখতে পাচ্ছি। আশা করি, লজ্জার এই ঘাম তাদের রক্তকে গরম করবে।

রাণী চলে গেল বটে, কিন্তু দরবার মহলে নেমে এলো নীরবতা। এই নীরবতার মধ্যেই জন্ম নিলো গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে মারাত্মক এক তুফান। অবস্থা এমন হলো যে, উপস্থিত তিন মহারাজার কেউ কারো প্রতি লজ্জা ও অপমানে তাকাতে পারছিল না।

কনৌজ দুর্গে গযনীর সৈন্য সংখ্যা এক হাজারও হবে না- বললো পুরোহিত। তোমরা হামলা করলে লড়াই ছাড়াই তাদেরকে পরাস্ত করতে পারো। তোমাদের বিপুল জনশক্তি দেখে ওরা লড়াই না করেই হাতিয়ার ফেলে দিতে বাধ্য হবে। কারণ, তাদের সাহায্য করার কেউ এখানে নেই। কে আসবে তাদের সাহায্য করতে?

তাদের এই এক হাজার সৈন্যকে হত্যা করলেও কিছু হবে না; গযনী থেকে মাহমূদ ঝড়ের বেগে চলে আসবে- বললো গোয়ালিয়রের রাজা অৰ্জুন। আর তখন মাহমূদ এসে এমন প্রতিশোধ নেবে যা হিন্দুস্তানের মানুষ কখনো ভুলতে পারবে না। লড়াই করা এবং লড়াই করানো আপনার সাধ্যের ব্যাপার নয় পণ্ডিত মহারাজ! বললো মহারাজা গোবিন্দ। এ ব্যাপারে আপনার চিন্তার চেয়ে আমাদের চিন্তা আরো গভীর। আমাদের সাময়িক কোন বিজয়ের ব্যবস্থা করলেই চলবে না, চিরদিনের জন্যে মাহমূদের শক্তিকে নিঃশেষ করে দিতে হবে।

আমাদেরকে ভাবতে হবে সবাই মিলে কিভাবে গয়নী দখল করা যায়। আমাদের এই প্লাবনের উৎস বন্ধ করতে হবে নয়তো কিছুদিন তা থেমে থাকার পর আবার এই প্লাবন আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

আপনাদের পক্ষে গযনী দখল করা সম্ভব নয় মহারাজ! বললো পুরোহিত। লাহোরের মহারাজা তরলোচনপাল এখানে আছেন, তারা দাদা মহারাজা জয়পাল গযনীর উপর কতোবার আক্রমণ করেছেন, কিন্তু তার পরিণতি কি হয়েছে আপনারা সবাই জানেন। এই প্রেক্ষিতে আমি তরলোচনপালকে জিজ্ঞেস করতে চাই, গযনী বাহিনী মথুরাকে এভাবে লন্ডভন্ড করে জনমানবহীন করে ফেলল, বুলন্দশহর মুনাজকে ধ্বংস করে দিল, এখন কনৌজকেও ধ্বংস করে দিয়েছে, লাহোরের মহারাজা এ ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? তিনি কোথায় জানি তার সৈন্যদেরকে লুকিয়ে রাখলেন আর অন্যদেরকে লড়াই করতে উস্কানি দিয়ে গেলেন।

এ ক্ষেত্রে আমি ভিন্ন কোন চাল দিতে চাচ্ছিলাম, সেটি করার সুযোগ আমার হয়নি- বললো মহারাজা তরলোচনপাল। আমি গয়নী বাহিনীর উপর পেছন থেকে আক্রমণ করতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কোন জায়গাতেই দীর্ঘ সময় মোকাবেলা করতে পারেনি আমাদের কোন সহযোগী বাহিনী। মাহমূদ বলতে গেলে প্রতিদিনই আমাদের একেকটি দুর্গ জয় করে নিয়েছে। কনৌজে তো কোন মোকাবেলাই হয়নি। রাজা রাজ্যপাল আগেই রাজধানী ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমিতো শত্রুবাহিনীর পিঠ দেখারই সুযোগ পাইনি।

তরলোচনপাল! বললো মহারাজা গোবিন্দ। আপনার এই চাল আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। আপনি যদি আপনার সৈন্যদের গযনী বাহিনীর আগমন পথে নিয়ে আসতেন, তাহলে আর এরা এতো সহজে অগ্রসর হতে পারতো না। তখন পরিস্থিতি ভিন্নতর হতো।

মহারাজা তরলোচনপালের চাল আমি বুঝতে পেরেছি- বললো পুরোহিত। তিনি তার বাহিনীকে লাহোর থেকে এজন্য বাইরে নিয়ে গিছেন, যাতে তার যোদ্ধারা লাহোরের বাইরে থাকে, আর তিনি অন্যদেরকে যুদ্ধে নামাতে পারেন।

পুরোহিতের কথা শুনে তরলোচনপাল ক্ষোভে অপমানে চিৎকার করে বললো- এসব কথা বলে আমাকে অপমান করা হচ্ছে; এমন অপমান বরদাশত করা হবে না ।

তরলোচনপালের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে পুরোহিত বললো, ঠিক আছে মহারাজ! আমি শুধু বিষয়টির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার জন্যে কথাটি বলেছিলাম। আপনাকে অপমান করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। এতে যদি লাহোরের মহারাজা অপমানবোধ করে থাকেন তবে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

কিন্তু লাহোরের সেনাবাহিনীকে আপনি খুব শীঘ্রই সম্মুখ সমরে নিয়ে আসবেন এবং শত্রুর মুখোমুখি সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ঘোষণা করবেন, আপনি গযনীর বশ্যতা স্বীকার করেন না এবং গযনীর সাথে আপনার পূর্ব পুরুষের কৃত মৈত্রীচুক্তি আপনি প্রত্যাখ্যান করবেন।

প্রথমে তিন মহারাজার এই সম্মিলন ছিল একটি ঘরোয়া বৈঠকের মতো। বৈঠকী মেজাজেই কথাবার্তা হচ্ছিল। কিন্তু রাণী শকুন্তলার বিবস্ত্র হয়ে মহারাজাদের উত্তেজিত ও অপমানিত করার পর মহারাজাদের এই বৈঠক হট্টগোলের রূপ ধারণ করে। আর পুরোহিতের উস্কানির পর সবাই এক সাথে উত্তেজিত কথা বলার কারণে রীতিমতো হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। বৈঠকের শুরু থেকেই সেখানে উপস্থিত গোবিন্দ নামের এক বুদ্ধিজীবী সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো–

আপনারা শান্ত হোন। আপনাদের মতো মহারাজাদের পক্ষে সুলতান মাহমূদকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। আপনারা মাহমূদের কিছুই করতে পারলেন না।

সবাই শুনুন! আমি যা জানি আপনারা কেউ তা জানেন না। আপনারাই তো আমার বিদ্যা বুদ্ধির প্রশংসা করেন। আপনারা জেনে অবাক হবেন, কল্লৌজের বর্তমান গভর্নর আব্দুল কাদের সেলজুকীর সাথে আমার যে পরিমাণ হৃদ্যতা আছে এমন হৃদ্যতা তার সেনাবাহিনীর কারো সঙ্গেও তার নেই। সে আমাকে তার বিশ্বস্ত গোয়েন্দা মনে করে, অথচ তার বুকের ভেতর থেকে কথা বের করে আজ আমি আপনাদের সামনে রাখছি। আমিই বর্তমানে কনৌজে আপনাদের চোখ আপনাদের কান। আমি যে কথাগুলো বলছি, আপনারা পারস্পরিক মতভেদ ভুলে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।

গোবিন্দের মুখে একথা শুনে সবাই কথাবলা বন্ধ করে তার দিকে মনোযোগী হলো। আসলেই উপস্থিত মহারাজাদের সবাই গোবিন্দের যোগ্যতার প্রশংসা করতো। তার দূরদর্শিতা বিশেষ করে একজন হিন্দু হয়েও গযনীর গভর্ণরের কাছে নিজেকে বিশ্বস্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার ব্যাপারটি ছিল সেই সময়কার ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

গোবিন্দ এই তিন মহারাজার কাছে সঠিক সময়ে সঠিক সংবাদটি পৌঁছে দিতো, ফলে সবাই তাকে আপনজন এবং নিজের পক্ষের গোয়েন্দা বলেই বিশ্বাস করতো।

অপর দিকে গোবিন্দ গযনীর গভর্ণর আব্দুল কাদের সেলজুকীরও আস্থা ভাজন ছিল। সেলজুকী তাকে অতি বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করতো। সেলজুকীর দরবারে গোবিন্দের অবাধ যাতায়াত ছিল। অথচ গোবিন্দ ছিল একজন গোড়া হিন্দু। আব্দুল কাদির সেলজুকীকে গোবিন্দ বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল, আমি মুসলমান হয়ে গেলে হিন্দুরা আমার সাথে মনের কথা দূরে থাক কাছে ধারেও বসতে দেবে না।

বাস্তবে গোবিন্দ ছিল ডাবল এজেন্ট। সে উভয় দিকের খবরাখবর উভয় দলের কাছেই সরবরাহ করতো। অবশ্য খবর সরবরাহের ব্যাপারে সে নিজে আগে যাচাই বাছাই করতো, কতটুকু তথ্য কোন দলকে দেয়া যাবে, কি পরিমাণ বললে উভয় দলের কাছে খবরটি বিশ্বাসযোগ্য হবে। এই বিষয়টি নির্বাচন করার ব্যাপারটি ছিল খুবই কূটিলতা ও চতুরতার ব্যাপার। এ কাজে গোবিন্দ শতভাগ উত্তীর্ণ হতে পেরেছিল। প্রকৃতপক্ষে গোবিন্দ হিন্দু-মুসলমান কারো পক্ষেই কাজ করছিল না, সে অর্থের লোভে দ্বিমুখী চরিত্র ধারণ করে দু’হাতে কাড়ি কাড়ি পয়সা কামাতে ব্যস্ত ছিল। হিন্দু মুসলিম কেউ গোবিন্দের এই দ্বিমুখী চেহারা আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই নির্বিঘ্নে গোবিন্দ তার চাতুর্যপূর্ণ কৌশল কাজে লাগিয়ে হিন্দু মুসলিম উভয় শাসকদের আস্থাভাজন রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলো।

এবার সে মহারাজাদের বৈঠকে তাদেরকে বলল, আপনাদেরকে প্রথমেই এই পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে যে, কনৌজে মাত্র এক হাজার গয়নী সৈন্য রয়েছে বিধায় সেখানে আক্রমণ করা উচিত। আমি বলছি, আপনাদেরকে এই পরিকল্পপনা সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। আপনাদের মনে রাখতে হবে, রাজ্যপালের বর্তমান রাজধানী রাড়ীকে গযনীর সেনারা ক্যাম্প বানিয়ে ফেলেছে। বাড়ীতে এখন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে।

কনৌজ থেকে যেসব হিন্দু পরিবার পালিয়ে গিয়েছিল, তারা এখন রাড়ীতে এসে বসতি স্থাপন করেছে। রাজ্যপালের যে সব সৈন্য রাড়ীতে রয়েছে তাদেরকে মনীর সেনা কমান্ডাররা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। গযনীর সেনাদের আচার ব্যবহার এতোটাই সন্তোষজনক যে, এ পর্যন্ত শ’খানেক হিন্দু সৈনিক ইসলাম গ্রহণ করেছে। হিন্দুদের অনেক কুমারী মেয়েও ইসলাম গ্রহণ করেছে।

রাজা রাজ্যপালের পুত্র লক্ষণপালও রাড়ীতেই অবস্থান করছে। লক্ষণপাল খুবই পেরেশান। সে মনে মনে মুসলমানদের প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ। কিন্তু তার বাবা মুসলমানদের অধীনতা মেনে নেয়ার কারণে তার পক্ষে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। সে আমাকে একথাও বলেছে, সুযোগ পেলে সে তার বাবাকে হত্যা করে হলেও মুসলিম অধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু সে ভয় পায় গযনী বাহিনীর প্রতিশোধকে। কারণ রাজা গযনী বাহিনীর মিত্র। কোন অবস্থাতেই রাজা গযনী শাসকদের বিরুদ্ধে যেতে চায় না। রাজার কথা হলো, সম্মুখ সমরে কোন হিন্দুর পক্ষেই গযনী বাহিনীকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। চক্রান্ত করেও গয়নী বাহিনীকে পরাস্ত করা অসম্ভব। তাদের অধীনতা মেনে নিয়ে আমি যে কোন সময়ের তুলনায় ভালো আছি। অকারণে তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন বিপর্যয় ডেকে আনা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

আমি বর্তমানে ভেতরের অবস্থা যতটুকু জানি; তাতে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, রাজ্যপালকে অতি গোপনে হত্যা করতে পারলে হয়তো রাড়ীতে গযনী বিরোধী একটা পরিবেশ তৈরী করা যাবে। তবে এই হত্যা কাণ্ড এমন সংগোপনে ঘটাতে হবে যাতে গযনী বাহিনীর কোন সন্দেহ করার অবকাশ না থাকে যে, এই কাণ্ড চক্রান্তমূলকভাবে কোন হিন্দুর দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।

গোবিন্দের একথা শুনে মহারাজা গোবিন্দ তার উরুতে থাপ্পর মেরে বললেন, এতক্ষণে তুমি আসল কথাটি বলেছে, আমি একথাটিই ভাবছিলাম। রাজ্যপালকে যদি হত্যা করা যায় কিংবা সে মারা যায় তাহলে আমরা তার ছেলে লক্ষণপালকে আমাদের সাথে মেলাতে পারবো। সে গযনী বাহিনীর অধীনে থেকেও আমাদের পক্ষে গযনীর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে। আমরা যখন সম্মিলিত বাহিনী গঠন করবো, তখন সে তার সৈন্যদের নিয়ে রাড়ীতে অবস্থানরত গযনীর গুটিকয়েক কমাণ্ডারকে বন্ধি করে ঘোষণা দিয়ে দেবে, আমি এখন থেকে গযনীর সাথে কৃত মৈত্রী চুক্তি অস্বীকার করলাম। এরপর যদি সুলতান মাহমুদ সেনাভিযান চালায়, আমরা তখন দুর্গ-বন্দি না হয়ে উন্মুক্ত ময়দানে তার সঙ্গে মোকাবেলা করবো।

এ ব্যাপারে আলোচনা পর্যালোচনার পর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো, লক্ষণপালকে হিন্দুদের পক্ষে কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য রাজা রাজ্যপালকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু কোন রাজা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারলো না, কে রাজ্যপালকে হত্যা করবে এবং কিভাবে করবে?

গোবিন্দ জানালো, রাজ্যপাল কার্যত মুসলমানদের হাতে বন্দি। তার নিরাপত্তা বাহিনীতে সব সময় তিন চারজন গযনী সেনা অবস্থান করে। কাজেই রাজ্যপালকে প্রকাশ্যে হত্যা করে ফিরে আসা সহজ ব্যাপার নয়।

একজন বললো, রাজ্যপালের কোন নর্তকীকে হাত করে তার মাধ্যমে খাবারে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করতে হবে। আরেকজন এটা প্রত্যাখ্যান করে বললো, এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। কোন পেশাদার নর্তকী একাজ করতে মোটেও রাজি হবে না।

এ ব্যাপারে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে- বললো পুরোহিত। আমাকে কালাঞ্জর রাজ্যের দূত হিসেবে মহারাজা রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হোক। আমার সাথে আরো কিছু লোক দেবেন। আমি রাড়ীর বাইরে তাঁবু ফেলে রাজ্যপালকে খবর দিবো যে, কালাঞ্জরের পক্ষ থেকে মহারাজার কাছে দূত এসেছে। দূত তার তাঁবুতেই মহারাজার সাথে মিলিত হতে চান। আমার তাঁবুতে যদি রাজ্যপাল আসে, তাহলে আমি কোন পানীয় বা খাবারে মিশিয়ে তাকে এমন বিষ খাইয়ে দেবো, যা খুব ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে, কেউ কিছুই টের পাবে না।

কয়েক দিন পরই রাজা দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে যাবে। দশ/পনেরো দিনের মধ্যে পেটের পীড়ায় ভুগে সে মারা যাবে। কোন ডাক্তার বদ্যি কাজে আসবে না। বিষ প্রয়োগের বিষয়টি কেউ মাথায়ও আনবে না।

তবে বিষ প্রয়োগের আগে আমি তাকে সম্মত করাতে চেষ্টা করবো, দৃশ্যত তিনি যেন গযনী বাহিনীর মিত্র হয়েই থাকেন এবং সময় সুযোগ মতো বিদ্রোহ করেন। আমি তার মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করবো, আসলে সে আমাদের ধোকা দেবে না, গযনী সরকারকে ধোঁকা দেবে। পরিস্থিতি বুঝে আমি সিদ্ধান্ত নেবো, তার বেঁচে থাকা দরকার না মৃত্যু দরকার।

আপনার এই পরিকল্পনায় কোন কাজ হবে না। কারণ, গযনীর কমান্ডাররা তাকে রাড়ীর সীমানার বাইরে যেতে দেবে না- বললো গোবিন্দ। আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, আমি গভর্ণর আব্দুল কাঁদেরের ব্যক্তিগত বন্ধু ও অতি আস্থাভাজন লোক। আমাকেও রাজার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয় না।

অবশ্য আমার কাছে একটা ফর্মুলা আছে। মহারাজা রাজ্যপাল খুবই নারী পাগল। তার সবসময় নতুন নুতন সুন্দরী মেয়ে না হলে চলে না। আপনি যদি দুতিনটি সুন্দরী মেয়েকে সাথে নিয়ে যেতে পারেন। আর কোনভাবে রাজার কানে খবরটি পৌঁছে দিতে পারেন যে, রাজার জন্য অতি সুন্দরী মেয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। তাহলে সে গযনীর শাসকদের অনুরোধ করে, বলে কয়ে আপনার কাছে চলে আসতে পারে।

তোমরা এ ব্যাপারে যে পদ্ধতিই অবলম্বন করোনা কেন, যে কেউ হোক কাজটি যে করে দিতে পারবে এবং প্রমাণ করতে পারবে যে, সে রাজ্যপালকে হত্যা করেছে, আমি তাকে জায়গীর ও সোনাদানা দিয়ে ভরে দেবো। তাকে এমন সুন্দরী মেয়ে জীবনের জন্যে দিয়ে দেবো, যা কোন দিন সে কল্পনাও করতে পারবে না- বললো গোয়ালিয়রের রাজা অর্জুন।

রাজা অর্জুন গোবিন্দের দিকে তাকিয়ে বললেন, গোবিন্দ! তুমি ইচ্ছা করলে এ কাজটি করতে পারো। যেহেতু তুমি ওখানে সবার কাছে বিশ্বস্ত, তাই রাজাকে খুন করার কোন না কোন একটি পন্থা তুমি বের করে নিতে পারবে।

পণ্ডিত মশাইও যেতে পারেন। সবাইকে জানিয়েই বলছি, দু’জনের মধ্যে যেই সফল হবে, সেই হবে আমার রাজ্যের সবচেয়ে বড় জায়গীরের মালিক। ভারতের সবচেয়ে সুন্দরী রক্ষিতা থাকবে তার ঘরে। রাজ্যপালের মৃত্যুর পর আমরা আবার সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেবো, আমাদেরকে কি করতে হবে। আপাদত এই কাজটিই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা হোক।

গোবিন্দের এই ফর্মুলা সবার পছন্দ হলো এবং সবাই এক বাক্যে গোবিন্দকেই রাজ্যপালকে খুন করার দায়িত্ব দিল । সেই সাথে রাজা অর্জুনের মতো অন্যেরাও একাজে সফল হলে তাকে মোটা অংকের পুরস্কার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিল।

তিন মহারাজার এই চক্রান্তমূলক বৈঠকের কয়েক দিন পর দ্বিমুখী গোবিন্দ কন্নৌজে গভর্নর আব্দুল কাদের সেলজুকীর সামনে বসা ছিল। গোবিন্দ গভর্ণর সেলজুকীকে বলছিল, তিন রাজার বৈঠকে কি কি সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সাথে বললো, মহারাজা রাজ্যপালের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করা দরকার।

লাহোরের মহারাজা তরলোচনপালের সৈন্যরা কোথায় অবস্থান করছে? গোবিন্দের কাছে জানতে চাইলেন গভর্ণর সেলজুকী। যতটুকু মনে হয় এখান থেকে খুব দূরে নয়, তবে ঠিক কোথায় তারা অবস্থান করছে তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, বললো গোবিন্দ। এমনও হতে পারে তরলোচনপালের সৈন্যরা এখান থেকে লাহোর ফিরে গেছে। অবশ্য এখন তরলোচনপালই সব চেয়ে বেশি ভয়ংকর লোক।

এরপরও আমি আপনাকে বলতে চাই, সব রাজা মহারাজা এখন রাজ্যপালের প্রাণের শত্রু। তারা সবাই রাজ্যপালকে হত্যার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে। যে কোন দিন রাজ্যপাল কোন আততায়ীর হাতে নিহত হতে পারেন। কারণ, আপনাদের কোন লোকই তার সব নিরাপত্তারক্ষী, দরবারী আমলা এবং রাজমহলের বাসিন্দাদের চেনে না। কিন্তু আমি সবাইকে চিনি। কাজেই আমাকে রাজমহলের ধারে কাছে কোথাও থাকতে দিন; যাতে আমি ওখানকার পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে পারি।

মনে রাখতে হবে, রাজ্যপালের ছেলে লক্ষণপালও তার বাবার ঘোরতর শত্রু। তাকেও রাজার কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে এবং লক্ষণের উপর কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে।

গোবিন্দ ছিল স্বার্থপর । শিক্ষিত চতুর। অর্থলোভী গোবিন্দের কাছে জাতি ধর্মের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থটাই ছিল বড়। এ জন্য তার কাছে জাতিধর্ম সবই ছিল সমান। শাসক হিন্দু না মুসলমান এটা তার কাছে মুখ্য ব্যাপার ছিল না। সে ছলচাতুরী করে যে কোন শাসককেই পক্ষে নিয়ে আসতে পারতো। কনৌজ গযনী বাহিনী দখল করে নেয়ার পর কোন হিন্দুর পক্ষে ওখানকার গভর্ণরের কাছাকাছি যাওয়ার সাহস হয়নি। কিন্তু নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষ ও শাসকদের জন্যে হিতাকাংখী সেজে মুসলিম গভর্নর আব্দুল কাদের সেলজুকীর কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গোবিন্দের কোনই বেগ পেতে হয়নি।

তিন রাজ্যের মহারাজাদের বৈঠকে গোয়ালিয়রের মহারাজা যখন গোবিন্দের প্রশংসা করে বললেন, গোবিন্দ! তোমার পক্ষেই কেবল বাড়ীতে গিয়ে রাজা রাজ্যপালকে খুন করানো সম্ভব। তুমিই পারবে সাফল্যের সাথে এ কাজ করতে। যদি তা করতে পারো, তবে আমার রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় জায়গীরের অধিকারী হবে তুমি। বাকী জীবন রাজার হালতে কাটিয়ে দেবে। সেই সাথে দেশের সেরা সুন্দরী মেয়েটিকে তোমার রক্ষিতা বানিয়ে দেয়া হবে।

বিশাল এই ভূসম্পত্তির প্রতিশ্রুতি ছিল গোবিন্দের জন্য লোভনীয়। ছোট ৰাটো একটি এলাকার অধিকারী হওয়া কম কথা নয়। মোটামুটি রাজা না হলেও পরগনার শাসক। লোকেরা এমন জায়গীরদারকেও রাজার মতোই সম্মান করে। কর দেয়, খাজনা দেয়। জায়গীরদারের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী থাকে। যখন যাকে ইচ্ছা তাকে ভোগ করতে পারে।

গোবিন্দ একজন অর্থ পিশাচ ও চতুর লোক। এই অঞ্চলের সব রাজ্য শাসকই তার ভক্ত। সবাই গোবিন্দের বুদ্ধি ও মেধার প্রশংসা করে। কিন্তু তাই বলে কেউ তো আর তাকে রাজার মতো কুর্ণিশ করে না। অথচ এসব রাজা মহারাজা কেউ তার মতো এতো প্রখর মেধার অধিকারী নয়। গোবিন্দের মতো লোকেরই রাজা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভারতের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ধারা অনুযায়ি এটা অসম্ভব। সাধারণ মানুষ মনে করে রাজ্য শাসন সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ভগবানের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে কোন বংশের লোকেরা রাজ্য শাসন করবে।

জায়গীর পাওয়ার লোভ সামলাতে পারলো না গোবিন্দ। সে সুযোগ খুঁজতে লাগলো কি ভাবে রাজ্যপালকে খুন করবে। গভর্ণর সেলজুকীর কাছ থেকে সে অনুমতি আদায় করে নিল। গোবিন্দ রাজার সাথে সাক্ষাত করতে না পারলেও রাজমহলের আশেপাশের এলাকায় বিনা বাধায় ঘোরাফেরা করতে পারবে।

এদিকে গভর্নর আব্দুল কাদের সেলজুকীর জন্যে গোবিন্দের দেয়া তথ্যগুলো ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি গোবিন্দকে বহু মূল্যের পুরস্কার দিয়ে বললেন, তুমি রাড়ী চলে যাও এবং রাজমহলের আশেপাশে থেকে সন্দেহজনক লোকদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখো। সেই সাথে কমান্ডার যুলকারনাইনের কাছে গভর্নর সেলজুকী বার্তা পাঠালেন, কোন ভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধি যদি রাজার সাথে সাক্ষাত করতে আসে তবে তাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেবে না।

এর কয়েকদিন পর কালাঞ্জরের পুরোহিত কালাঞ্জরের রাজা গোবিন্দের প্রতিনিধি হয়ে রাজ্যপালের সাথে সাক্ষাতের জন্যে রাড়ীতে পৌঁছাল। রাড়ীর শহরতলীতে তাঁবু ফেলে কালাঞ্জর রাজার প্রতিনিধি রাজ্যপালের কাছে খবর পাঠালো, মহারাজা গোবিন্দের প্রতিনিধি আপনার সাথে রাজমহলের বাইরে তাঁবুতেই সাক্ষাত প্রত্যাশা করে।

কমান্ডার যুলকারনাইন সংবাদবাহী পুরোহিতকে রাজার কাছে পৌঁছতেই দিল না। পুরোহিত যখন হতাশ হয়ে ফিরে যেতে প্রস্তুত হলো, তখন গোবিন্দ তার কাছে পৌঁছাল। গোবিন্দ পুরোহিতকে জানাল, বাস্তবে রাজা রাজ্যপাল এখন মুসলমানদের হাতে বন্দি। বর্তমানে তার উপর বিধি নিষেধের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। হতাশ হয়ে পুরোহিত গোবিন্দকে অনুরোধ করলো, আমি তো ব্যর্থ হলাম। আপনি রাজ্যপালকে হত্যার সমুদয় ব্যবস্থা করুন।

গোবিন্দ মহারাজাদের থেকেও সুবিধা নিতো। গোবিন্দ তার প্রতি রাজাদের আস্থার মাত্রা আরো বাড়ানোর জন্য পুরোহিতকে বললো, আপনি রাজ্যপালের ছেলে লক্ষণপালকে আপনার সাথে নিয়ে যান। নয়তো রাজা নিহত হলে গযনী বাহিনী লক্ষণপালকে কয়েদ করতে পারে। গোবিন্দ পুরোহিকে জানালো, লক্ষণ একটি যুবক ছেলে। যৌবনের উষ্ণতায় সম্প্রতি সে এমন কিছু কাজ করেছে যে, গযনী বাহিনী তার প্রতি সন্দেহ পোষণ করছে। গযনীর শাসকরা ভাবছে, তারা লক্ষণের চলাফেরার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করবে, অথবা লক্ষণকে নজরবন্দি করে রাখবে।

পুরোহিতকে একথা বলে গোবিন্দ সোজা লক্ষণ পালের কাছে চলে গেল। লক্ষণকেও সে একই কথা শোনাল যা পুরোহিতকে বলেছিল। একথা শুনে গোপনে লক্ষণপাল পুরোহিতের সাথে চলে গেল এবং যাবার সময় গোবিন্দকে বলে গেল, সে যেন তার বাবাকে হত্যার ব্যবস্থা করে। লক্ষণ নিজেও গোবিন্দকে লোভনীয় পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিল। লক্ষণের মুখে পুরস্কারের ঘোষণা শুনে গোবিন্দ রাজ্যপালকে হত্যার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠলো।

গোবিন্দ গভর্ণর আব্দুল কাদের সেলজুকীকে যে তথ্য দিয়েছিল এসব তথ্য লিখে তিনি দ্রুত একজন সংবাদবাহককে গযনী সুলতানের কাছে প্রেরণ করলেন। সেলজুকী পয়গামে লিখলেন, এখানকার মহারাজাদের উপর আস্থা রাখা যায় না। কাজেই এখানকার কোন উদ্ভূত পরিস্থিতি কিংবা হামলা বা অবরোধ ঠেকাতে একটি অশ্বরোহী ইউনিটকে জলদি পাঠিয়ে দিন। বড় কোন আঘাত হলে যাতে আপনাদের আসা পর্যন্ত শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখা যায়।

একের পর এক ফন্দি এঁটে গোবিন্দ মহারাজা রাজ্যপালের রাজমহলে যাতায়াতের অনুমতি পেয়ে গিয়েছিল। এবার সে রাজ্যপালকে কিভাবে হত্যা করা যায় এ ফন্দি আঁটতে লাগল। হিন্দু হওয়ার সুবাদে হিন্দুদের সাথে সে মেলামেশা বাড়িয়ে দিল। স্থানীয় গোঁড়া হিন্দুদের সাথে সম্পর্ক মজবুত করার জন্যে গোবিন্দ মন্দিরে যাতায়াত বাড়িয়ে দিল। মন্দিরের পুরোহিতদের সাথেও সে গড়ে তুললো গভীর সম্পর্ক। মন্দিরের গোপণ প্রকোষ্ঠে বসে সে পুরোহিতদের সাথে রাজা রাজ্যপাল ও সুলতান মাহমূদ সম্পর্কেও খোলামেলা আলাপ আলোচনা করতো । মন্দিরে গিয়ে গোবিন্দ নিজেকে একজন নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিন্দু হিসেবে জাহির করতো।

একদিন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত গোবিন্দকে জানাল, এ হিন্দু মেয়ে মুসলমান হয়ে কমান্ডার যুলকারনাইনকে বিয়ে করেছে। হিন্দু মেয়েরা আমাকে জানিয়েছে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুলকারনাইনের স্ত্রী মুসলমান হয়েছে বটে, কিন্তু তার হৃদয়ে হিন্দুত্ববাদ বহাল রয়েছে। স্বামীকে সে এতোই শ্রদ্ধা করে যে, স্বামীর ধর্মকেই সে নিজের ধর্ম মনে করে। কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে সরে গিয়ে আশপাশের চতুর্দিকে তাকালে তার কাছে হিন্দুত্ববাদই আকর্ষণীয় মনে হয়। সে হিন্দু মহিলাদের জানিয়েছে, তার স্বামী তাকে বলেছে, সে যেন হিন্দু মেয়েদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করে। এই সুবাদে সে হিন্দু মেয়েদের সাথে মেলামেশা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ইসলামের কোন কথাই সে মুখ থেকে বের করে না।

অসহায় এই মেয়েটিকে এই ডাকাতের হাত থেকে মুক্ত করা দরকার। মেয়েটি শৈশব থেকেই ধর্মনিষ্ঠ পরিবারে বেড়ে উঠেছে। ধার্মিক পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে হিন্দুত্ববাদ তার রক্তের শিরায় শিরায় মিশে আছে। কিন্তু কমান্ডার যুলকারনাইন মেয়েটির প্রতি এমন সহানুভূতি দেখিয়েছে যে, মেয়েটি যুলকারনাইনের উপকার ভুলতে পারছে না।

একথা শোনে গোবিন্দের মাথায় দারুণ বুদ্ধি এলো। সে বুঝে নিল এই মেয়েটিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। গোবিন্দ ছিল ধূর্ত। চাতুর্যপূর্ণ বুদ্ধিমত্তায় তার কোন জুড়ি ছিল না। সে ভাবনায় পড়ে গেল, এই মেয়েটিকে কি রাজ্যপালের হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা যায়?

চিন্তা ভাবনা করে সে একটা পথ আবিষ্কার করে ফেলল। পণ্ডিতকে গোবিন্দ বললো, আপনি আমাকে সেই সব হিন্দু মেয়েদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন যেসব মেয়েদের সাথে এই মেয়েটি মেলামেশা করে।

পণ্ডিত গোবিন্দকে জানালো, মেয়েটি হিন্দু মেয়েদের সাথে শুধু গল্পগুজবই করে না, সে তাদের সাথে স্নান করতে নদীতেও যায়। তার স্বামী এসবকে কিছু মনে করে না। স্বামী মেয়েটিকে খুবই বিশ্বাস করে এবং তার উপর গভীর আস্থা রাখে।

এই আলোচনার কয়েক দিন পর এক দিন দুপুরে রাজিয়া আরো কয়েকজন হিন্দু মেয়ের সাথে নদীতে গোসল করতে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে ছিল বড় বড় অশ্বথ বৃক্ষ ও ঝোঁপ ঝাড়।

একটি বড় অশ্বথ গাছের নীচে একজন সন্যাসীরূপী বয়স্ক লোক মাথা নীচের দিকে করে বসেছিল। লোকটির ছিল লম্বা দাড়ি এবং মাথার চুল কাধ পর্যন্ত দীর্ঘ। চেহারা ছবি অনেকটা মুসলমানদের মতো। কিন্তু তার পোষাক পরিচ্ছদ হিন্দু সন্ন্যাসী ঋষিদের মতো। রাজিয়া ও তার সঙ্গীনী মেয়েরা যখন লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন মাথা সোজা করে আঙুল উঁচিয়ে মেয়েদের থামতে ইঙ্গিত করল । মেয়েরা তার ইঙ্গিতে দাঁড়ালো। সাধুরূপী লোকটি তাদেরকে পাশে বসিয়ে রাজিয়ার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রাজিয়ার দৃষ্টিও লোকটির চেহারার মধ্যে নিবদ্ধ ছিল। সন্ন্যাসী রাজিয়ার চোখে চোখ রেখে তার দুটি হাত রাজিয়ার মাথায় রাখল এবং ধীরে ধীরে তার কপালে হাত বুলাতে লাগল। সঙ্গিনী মেয়েরা দেখল, রাজিয়া পলকহীন দৃষ্টিতে সন্ন্যাসীকে দেখছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে মেয়েটি যেন সম্বিত হারিয়ে ফেলেছে, সে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে সন্ন্যাসীর চেহারার দিকে।

তোমার আত্মা পথ হারিয়ে দিগ্বিদিক ঘুরছে- দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্ষীণ আওয়াজে কানে কানে বলার মতো করে রাজিয়ার উদ্দেশ্যে বললো সন্ন্যাসী। সে আরো বললো, তোমার অন্তর এক জায়গায়, আর দেহ আরেক জায়গায়। অন্তর পবিত্র, কিন্তু দেহ অপবিত্র। এক চোখে আলো অপর চোখে ঘোরতর অন্ধকার। পর জনমের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। পর জনমে শিয়ালের রূপ ধারণ করবে। মানুষ ধূর্ত শিয়াল বলে ঘৃণা করবে।

হঠাৎ সন্ন্যাসী মাথা ঝাকুনী দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠার মতো করে বললো- যাও! চলে যাও। ছিঃ! জগতে এমন পাপিষ্ঠ অন্তরও থাকে?

নওমুসলিম অনভিজ্ঞ রাজিয়ার অন্তরে সন্ন্যাসীরূপী এই লোকের সংশয়পূর্ণ কথায় মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হলো। রাজিয়ারূপী রত্মার অন্তরে শুরু হলো দ্বান্দ্বিক তোলপাড়।

সন্ন্যাসী স্বগতোক্তির মতো করে বলতে লাগল- এক চোখে ঘোরতর অন্ধকার। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা, তুমিও কিছুই দেখবে না। তুমি তা বরদাশত করতেও পারবে না। যাও, চলে যাও। মসজিদ ও মন্দিরের মাঝামাঝি ঘোরতর অন্ধকার। তুমি এই অন্ধকারে হাতড়ে মরবে। নিজের পরিণতির কথা জিজ্ঞেস করো না। যদি জিজ্ঞেস করো, তাহলে মরে যাবে। যদি মরতে না পারো তাহলে পাগল হয়ে যাবে।

সন্ন্যাসীর কথা, তার দৃষ্টি ও ভবিষ্যতবাণী বলার মধ্যে এমন যাদুময়তা ছিল যে, অনভিজ্ঞ রাজিয়া তাৎক্ষণিক বদলে গেলো। কারণ, রক্তমাংসে রাজিয়া ছিল হিন্দু। তাছাড়া বিগত বছরখানেক ধরে রাড়িতে এসে সে হিন্দু মেয়েদের সাথে মেলামেশা করতে থাকে। যার ফলে হিন্দু কৃষ্টি কালচার মনের অজান্তেই তার অন্তরে পুনর্বার বাসা বাধে।

জাতিগতভাবে হিন্দুরা প্রকৃতি পূজারী এবং মানুষের পুনর্জনমে বিশ্বাসী। হিন্দুরা মনে করে মানুষ একবার মরে গিয়ে কৃতকর্মের ভিত্তিতে পুনর্বার পৃথিবীতে পুনর্জন্ম লাভ করে। ধর্মকর্ম পালন করলে মরে গিয়ে মানুষ আবার বিভিন্ন হিংস্র জন্তু জানোয়ারের রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আসে।

সন্ন্যাসীর এই যাদুকরী বাক্য ও ভবিষ্যতবাণী শুনে রাজিয়া এতোটাই তন্ময় হয়ে পড়ল যে, সে সন্ন্যাসীর সামনে থেকে উঠতেই চাচ্ছিল না। সন্ন্যাসীর কথায় সে বুঝতে পারল, ইসলাম গ্রহণ করে সে মারাত্মক অপরাধ করেছে, যে অপরাধের কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই। এই অপরাধের জন্যে পুনর্জন্মে রাজিয়া শিয়ালের রূপধারণ করে দুনিয়াতে আসবে এবং ইতর জানোয়ারের জীবন যাপন করবে।

সঙ্গী মেয়েরা সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করতে লাগলো। তারা সন্ন্যাসীর উদ্দেশে বললো- বাবাজী! এই মেয়ে বুঝে শুনে ধর্ম ত্যাগ করেনি। আপনি তার প্রতি একটু সদয় হোন। কিন্তু সন্ন্যাসী আর কোন কথা বলল না। অনেক্ষণ পর যদিও মুখ খুলল, কিন্তু বজন গাইতে লাগল। অনেক অনুরোধের পর বললো

এই মেয়েটিকে আর নদীতে নিয়ে যেয়ো না- গম্ভীর কণ্ঠে বললো সন্ন্যাসী। মথুরার জলহস্তি ওকে আস্ত গিলে ফেলার জন্যে এসে গেছে। শুধু শুধু আমি মেয়েটিকে দেখিনি। বাতাসে একটি গন্ধ ভেসে এসেছে, যা দুনিয়ার কোন মানুষ টের পায় না। এই গন্ধ হলো সেই সব পাপিষ্ঠ আত্মার গন্ধ, যে সব আত্মারা পাপের মধ্যে ডুবে থাকে এবং ভেতরে ভেতরে নরকের আগুনে জ্বলতে থাকে।

তোমরা আমার কাছাকাছি এলে এই মেয়েটির দেহ থেকে আমার নাকে এমন গন্ধ লেগেছিল। এজন্য আমার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। আমি মেয়েটির প্রতি তাকিয়ে থাকি। আহা! মরার পর যার আত্মা পাপিষ্ঠ হবে, জীবন্ত অবস্থায়ই তা নরকে জ্বলতে শুরু করেছে!

হঠাৎ রাজিয়া রূপী রত্না বলতে লাগল- হ্যাঁ, ঋষি বাবা! আমি সত্যিকার অর্থেই পাপি। আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করেছি। এক লোক আমার অন্তরকে জয় করে নিয়েছিল। ভালোবাসার টানে আমি ধর্মান্তরিত হয়ে তাকে বিয়ে করি। কিন্তু আমার ধর্মকে আমি ভুলতে পারিনি। আমি আসলে কিছুই জানি না সাধু বাবা! আমি একটা মূর্খ। আমাকে এই নরক থেকে বাঁচার পথ দেখান।

কিন্তু যে পাপ তুমি করে ফেলেছো, এর শাস্তি থেকে তুমি কিভাবে মুক্তি পাবে?

কিভাবে এই পাপ থেকে বাঁচতে পারবো, সে কথা আপনি বলে দিন ঋষি বাবা! আপনি অবশ্যই সেই পথের খবর রাখেন। আত্মাকে পাপের শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্যে আমি জীবন্ত চিতায় শুতেও রাজি আছি। পরজনমের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্যে আমি নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও রাজি।

কি বলবো, বলতেও ভয় করে! তোমার যদি সাহস থাকে তবে শোন। পানি থেকে সব সময় দূরে থাকবে। তোমাকে একটি জীবনের বলিদান করতে হবে!

দু’চোখ বন্ধ করে খুব ক্ষীণ আওয়াজে কথা বলছিল সন্ন্যাসী। হ্যাঁ, তোমার পাপ মোচনের জন্যে তোমাকে অনেক বড় মানুষের বলিদান করতে হবে। তোমাকে বড় মানুষ খুন করতে হবে। হ্যাঁ, বলা মুশকিল মহারাজাকে বলিদান…।

হ্যাঁ, যেকোন পাপীকে হত্যা করে পাপের স্খলন ঘটাতে হবে। মহারাজাও পাপী, যে মহারাজা তার বাপদাদার ভগবানদেরকে মুসলমানের হাতে ধ্বংস করিয়ে এখন তাদের বন্দী জীবন নিয়ে পরম তৃপ্তিতে আছে।

হ্যাঁ, সে পাপী, বড় পাপীষ্ঠ, মহাপাপী রাজা।

শোন মেয়ে! যদি তোমার পাপের স্থলন চাও, তাহলে এই পাপি রাজাকে খুন করে ফেলো। প্রথমে মহারাজার রক্তের টিপ নিজের কপালে লাগাও, পরে এই টিপের উপরে তোমার পাপিষ্ট স্বামীর রক্তের টিপ লাগাও। এর পর সোজা মন্দিরে চলে যাবে। সেখানে গেলে আলো দেখতে পাবে। এই আলো হবে তোমার মুক্তির ইঙ্গিত।

হত্যা? স্বগতোক্তি করলো রাজিয়া। কেঁপে উঠলো তার সর্বাঙ্গ। না, না! আমি তা পারবো না!

হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। রাজপুতের মেয়ে একটা পাপিষ্টকে হত্যা করতে ভয় পায় বললো সন্ন্যাসী। ঠিক আছে, যদি ভয় পাও তবে নদীতে চলে যাও। নদীতে নেমে জলহস্তির পেটে চলে যাও, আর পরজনমে শিয়াল হয়ে ফিলে এসো।

আজ যাকে ছেড়ে দিচ্ছো, সেই মহারাজার পালিত কুকুরেরা তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। এই মহারাজার তীরের আঘাতে তুমি আহত হবে। তীরবিদ্ধ অবস্থায় জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মরবে। তোমার জখমে ঘা হবে। ঘায়ে পোকা হবে। আর পোকার কামড়ে তুমি চিৎকার করে জঙ্গলে দৌড়াবে। যাও! তাই হবে, তাই হবে।

রাজিয়ার সঙ্গীনী এক মেয়ে সন্ন্যাসীর উদ্দেশ্যে বললো- সাধু মহারাজ! দেবতাদের অভিশাপ ঠেকানো যায় না। আপনি রাজাকে খুন করার কোন সহজ পন্থা তাকে বলে দিন। যাতে একাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়। তার প্রতি দয়া করুন। মহারাজ! ভগবানের কৃপা থেকে তাকে দূরে ঠেলে দেবেন না। রাজিয়া ও সঙ্গীনী মেয়েদের উপর্যপরী অনুরোধে সন্ন্যাসী মহারাজা রাজ্যপালকে হত্যার যে পদ্ধতি বললো, তা ছিল এমন–

মহারাজা রাজ্যপাল নারী লোভী। রাজিয়া খুবই সুন্দরী যুবতী। ইসলাম ধর্ম প্রচারের নামে সে রাজপ্রাসাদে যাবে এবং সুযোগ মতো মহারাজার খাস কামরায় ঢুকে পড়বে। যেহেতু রাজিয়া কমান্ডার যুলকারনাইনের স্ত্রী এজন্য তাকে দেখে মুগ্ধ হলেও মহারাজা তার প্রতি হাত বাড়াবে না। কিন্তু রাজিয়াকেই উদ্যোগী হয়ে নিজের রূপ সৌন্দর্য দিয়ে মহারাজাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে হবে, যাতে মহারাজা বুঝে যে, রাজিয়া নিজেই স্বেচ্ছায় মহারাজাকে সঙ্গ দিয়ে ধন্য হতে চাচ্ছে। তাহলে একান্তে মিলনের জন্য রাজাই এগিয়ে আসবে।

রাজিয়া তার শাড়ীর আঁচলে একটি ধারালো খঞ্জর লুকিয়ে রাখবে। সুযোগ মতো সেই খঞ্জর দিয়ে রাজাকে হত্যা করে ঘরে এসে স্বামীকে হত্যা করবে। উভয়ের হত্যাকাণ্ড সমাপ্ত হলে সোজা মন্দিরে চলে আসবে। মন্দিরে এলে পুরোহিত তাকে দূরে কোথাও নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।

ঋষি মহারাজ! আমি কি এতোটা সাহসী হতে পারবো? কীভাবে খুন করবো আমি? আমার তো হাত কাঁপবে! বললো রাজিয়া।

সন্ন্যাসী তার পাশে রাখা একটি বাক্স হাতড়িয়ে একটি কৌটা বের করল এবং তা থেকে কিছুটা তুলার মতো বের করে একটি কাপড়ের টুকরোতে বাঁধতে বাঁধতে বললো- তুমি যখন রাজাকে হত্যার উদ্দেশ্য ঘর থেকে বের হবে তখন এক গ্লাস পানিতে এই তুলাটি ভিজিয়ে পান করে নেবে। দেখবে তোমার মধ্যে সাহস এসে যাবে। কোনরূপ ভয়-ভীতি থাকবে না।

সেই দিন রাতের বেলায় গোবিন্দ রাড়ির প্রধান মন্দিরে বসা ছিল। তার সামনে দু’জন হিন্দু মহিলা তাকে বলছিল- রাজিয়া দিনের বেলায় তাদের সাথে নদীতে যাওয়ার পরিবর্তে ঘরে ফিরে এসেছিল।

সে আমাকে কোনরূপ সন্দেহ তো করেনি? জিজ্ঞেস করল গোবিন্দ।

আরে আমরা তো আপনাকে আগে থেকেই জানতাম, তার পরও আমাদেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, সেই সন্ন্যাসীরূপী লোকটি আপনিই বললো এক মহিলা।

আপনার এই সন্ন্যাসীরূপ ধারণ ছিল অকৃত্রিম। আপনার কাজে আপনি শতভাগ উত্তীর্ণ হয়েছেন। এরপর আমরাও রাজিয়াকে কয়েকটি কাহিনী শুনিয়ে এ কাজে সম্মত করিয়ে ফেলেছি- বললো অপর মহিলা।

রাজিয়াকে এই হত্যাকাণ্ডে রাজি করানোর জন্যে এতো জল ঘোলা করার প্রয়োজন ছিল না। কারণ ধর্মান্তরিত হওয়ার অনুশোচনায় সে এমনিতেই দগ্ধ হচ্ছিল। সে খুঁজে ফিরছিল স্বধর্মে ফিরে গিয়ে পাপ স্খলনের একটা উছিলা। সন্ন্যাসীরূপী গোবিন্দের কথার মধ্যে সে পাপ স্খলনের উছিলা দেখতে পাচ্ছিল।

রাজিয়ার স্বামী যুলকারনাইন তাকে হিন্দু মেয়েদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু অপরিপক্ক রাজিয়া যখন হিন্দু মেয়েদের সাথে মিশতে শুরু করল, তখন হিন্দু মেয়েরা তার মধ্যে বাপদাদার ধর্মকেই পুনরুজ্জীবিত করল। রাজিয়া তার পৈতৃক ধর্মমতকেই পুনরায় আবিষ্কার করল এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হলো। ইসলাম ধর্ম প্রচার দুরের কথা, ইসলামের কোন কথাই সে কোন দিন হিন্দু মহিলাদের কাছে উচ্চারণ করতে পারেনি।

পরদিন নানা কাজের চাপে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত যুলকারনাইন রাতে ঘরে ফিরে ক্লান্তির কারণে শুয়ে পড়লো। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। রাজিয়ার প্রতি ঘুনাক্ষরেও কোন দিন যুলকারনাইনের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। ফলে তার আস্থা পরীক্ষার কোন প্রয়োজনও সে কোন দিন বোধ করেনি।

কিন্তু দিনের বেলায় সন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী রাজিয়াকে অস্থির করে তুলে ছিল । যুলকারনাইন ঘুমিয়ে পড়তেই রাজিয়ার মধ্যে জেগে উঠলো রত্মার বৈশিষ্ট্য। সে পাপ স্খলনের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলো।

সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে সন্ন্যাসীর দেয়া তুলা পানিতে ভিজিয়ে পান করল রাজিয়া।

এতক্ষণ তার মধে, যে ভয়, আতংক ও জড়তা ছিল তুলা ভেজানো পানি পান করার পর তার মন থেকে সব ভয় শংকা ও জড়তা দূর হয়ে গেল। এরপর রাজিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে চাঁদের আলোয় পায়চারী করছিল সে। তখন নিজের মধ্যে একটা পাশবিক শক্তি উন্মাদনা টের পেলো সে। রাজিয়া অনুভব করছিল, যেন সে গযনী আক্রমণ করে সুলতান মাহমুদকে খুন করে ফেলবে।

এই ঘটনার এক দিন আগে রাজিয়া তার স্বামী যুলকারনাইনের সাথে বলেছিল, আগামী কাল থেকে সে রাজমহলে যেতে চায়, যাতে সেখানকার মহিলাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে পারে। রাজিয়ার কথা শুনে কমান্ডার যুলকারনাইন এই ভেবে খুবই খুশী হয়েছিল যে, তার প্রিয় স্ত্রী তার কথামতো হিন্দু মেয়েদের মধ্যে নিজ দায়িত্বে ইসলাম প্রচার করছে।

পরদিন যথারীতি রাজিয়া রাজমহলে গেল। রাজমহলের সবাই জানতো রাজিয়া কমাণ্ডার যুলকারনাইনের স্ত্রী। রাজিয়া মেয়েদের এঘর সে ঘর ঘুরতে ঘুরতে সুযোগ বুঝে মহারাজা রাজ্যপালের কক্ষে চলে গেল। রাজা তাকে দেখে খুব খুশী হলেন। খুশীর কারণ এই নয় যে, রাজিয়া তার উপদেষ্টা কমান্ডার যুলকারনাইনের স্ত্রী। খুশীর মূল কারণ রাজিয়া যুবতী এবং অস্বাভাবিক সুন্দরী। রাজা রাজিয়াকে পরম আগ্রহে ও সম্মানে তার পাশে বসাল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উভয়ে একে অন্যের সাথে এমন অন্তরঙ্গ ভাবে কথাবার্তা বলতে লাগল যেন অনেক দিন থেকে তারা পরস্পরের পরিচিত। রাজিয়ার মধ্যে অপরিচিতের দূরত্ব দূর হয়ে যাওয়ার বড় কারণ হলো সে ছিল মূলত হিন্দু। আর মনে প্রাণে সে হিন্দুই থেকে গিয়েছিল। ফলে একজন জাত হিন্দুর সাথে তার হৃদ্যতা তৈরী হতে বেশী সময় লাগেনি। তাছাড়া রাজিয়া ছিল

একটি বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের প্রতি মনোযোগী। যত দ্রুত সম্ভব সে রাজার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করল। রাজাকে আপন করে নেয়ার জন্যে সে নারীত্বের যতটুকু কারিশমা তার মধ্যে ছিল সবটুকুই সে প্রয়োগ করল। কথায় কথায় নিজের রূপ-লাবণ্য রাজার সামনে তুলে ধরার জন্য নিজে থেকেই সে রাজার কাছাকাছি বসল এবং বার বার বিভিন্ন ছুতোয় শাড়ির আঁচল খুলে শরীর ঢাকার ভান করে নিজের দেহকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছিল।

রাজা ছিল নারী লোভী। নবাগত রাজিয়ার গায়ে পড়া অঙ্গভঙ্গি তার মধ্যে প্রচণ্ড কামনা সৃষ্টি করল এবং সে রাজিয়াকে একান্তে পাওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে পড়লো। যেহেতু রাজিয়া নিজেই বিশেষ এক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে রাজাকে একান্তে পাওয়ার পাঁয়তারা করছিল, ফলে তাদের শরীরী কথাবার্তায় পৌঁছাতে বেশী সময়ের দরকার হলো না। রাজিয়াকে একান্তে পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল বুড়ো রাজ্যপাল।

রাজিয়াও কালবিলম্ব না করে রাজার একান্ত সান্নিধ্য পাওয়ার বাসনা ব্যক্ত করে বললো- মহারাজ! অনুমতি দিলে আজ রাতেই আমি আপনার কাছে একান্তে মিলিত হতে আগ্রহী। তবে আমি চাই আমার এই আসা সবার অগোচরে থাকুক এবং কারো দৃষ্টিতে না পড়ুক।

রাজাও তাতে সায় দিলেন। তিনি এও বললেন, আমাদের একান্ত গোপন অভিসারের কথা তোমার স্বামী কমান্ডার যুলকারনাইন জানতে পারলে আমাদের উভয়কেই খুন করে ফেলবে। তিনি রাজিয়াকে রাতের বেলায় আসার জন্যে একটি গোপন পথ দেখিয়ে দিলেন এবং একটি গোপন কক্ষ দেখিয়ে বললেন, আমি রাতের বেলায় এই কক্ষে একাকি থাকবো।

সেই রাতেই রাজিয়া সুরক্ষিত পথে রাজ্যপালের গোপন কক্ষে এসে হাজির হলো। রাজ্যপাল রাজিয়াকে দেখে উফুল্ল হয়ে বললো- তুমি তো শরাব পান করবে না, কারণ হঠাৎ পান করলে এর রেশ অনেক্ষণ থাকবে। তোমাকে যেহেতু তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে হবে এজন্য শরাব পান না করাই ভালো হবে।

রাজিয়া তাকে বললো, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আপনি নিজে নিজেই শুরাহীতে ঢেলে পান করুন। আমি শরাবের গন্ধও সহ্য করতে পারি না। আমার মাথা চক্কর দেবে।

রাজ্যপাল ছিলেন দাঁড়ানো অবস্থায়। দাঁড়ানো থেকে নীচের দিকে ঝুঁকে তিনি শাহীতে মদ ঢালতে লাগলেন। এদিকে রাজিয়া তখনো তুলা ভেজানো পানীয়ের উত্তেজনায় উত্তেজিত। রাজাকে মদের গ্লাসের প্রতি মগ্ন থাকতে দেখে সে শাড়ীর ভাঁজ থেকে খঞ্জরটি বের করে দু’হাত উপরে তোলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রাজ্যপালের পিঠে খঞ্জর ঢুকিয়ে দিল।

খঞ্জরের আঘাতে রাজ্যপাল যেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো অমনি রাজিয়া খঞ্জর টেনে বের করে সোজা রাজার বুকে আমূল খঞ্জরটি বিদ্ধ করল। রাজার মুখে আর কোন ধরনের শব্দ উচ্চারিত হলো না। ধপাস করে রাজ্যপাল মরা বকরির মতো মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

বুকে বিদ্ধ খঞ্জরটি টেনে বের করে রাজার দিকে তাকাল রাজিয়া। খঞ্জর বিদ্ধ রাজার দেহটি কয়েক বার খেচুনী দিয়ে অসাড় ও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ল।

রাজিয়ার অনুভবই হচ্ছিল না, সে কতো বড় একজন ব্যক্তিকে অবলীলায় খুন করে ফেলেছে। রাজ্যপাল তখন শুধু একজন হিন্দু রাজা নন, তিনি গযনী সুলতানের বিশ্বস্ত বন্ধু। সুলতান মাহমুদের সাথে চুক্তি করার ফলে মূলতঃ রাজ্যপাল মুসলমানদের সহযোগী হয়েছে। তাই রাজ্যপালকে হত্যা করার পরিণতি কি ভয়াবহ হতে পারে এর বিন্দু বিসর্গও কোন চিন্তা ভাবনা রাজিয়ার মনে ছিল না। বরং রাজিয়া রাজ্যপালের নিথর দেহ দেখে পরম স্বস্তি বোধ করলো।

হত্যা করার পর খুব ধীর স্থির ভাবে যে শুরাহীতে রাজ্যপাল শরাব পান করতে শরাব ঢেলে ছিল, রাজিয়া আস্তে করে শরাবের গ্লাসটি তার ঠোঁটে ছোঁয়াল এবং এক নিঃশ্বাসে সবটুকু শরাব গলাধঃকরণ করলো । অতঃপর খুব শান্তভাবেই রাজার কক্ষটির দরজায় ছিটকিনি এঁটে দিয়ে কক্ষ ছেড়ে পথে নামলো এবং লোক চক্ষুর অন্তরালেই নিজের ঘরে পৌঁছে গেল ।

রাজিয়ার ঘরে কোন পরিবর্তন ছিল না। যথারীতি নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছিল যুলকারনাইন। রাজিয়ার হাতে রক্ত মাখা খঞ্জর। এবার তার স্বামী যুলকারনাইনকে হত্যার পালা।

গভীর ঘুমে যুলকারনাইন। খোলা জানালা দিয়ে চতুর্দশী চাঁদের আলো এসে যুলকারনাইনের ঘুমন্ত চেহারা ও খোলা বুকের উপর পড়ছে। সোজা চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছে যুলকারনাইন। নিঃশ্চিন্তে। এখন বুকের উপর একবার খঞ্জর বিদ্ধ করলেই নির্ঘাত মৃত্যু।

প্রচণ্ড উত্তেজনায় ধীরে ধীরে স্বামীর দিকে এগিয়ে গেল রাজিয়া। রক্তমাখা খঞ্জর তার হাতে। কাছে গিয়ে দু’হাত উপরে তুলে গভীরভাবে ওর ঘুম পরখ করতে লাগল রাজিয়া। নিয়মিত নিঃশ্বাস ফেলায় উঠানামা করছে বুক। এক পলক যুলকারনাইনের চেহারার দিকে তাকাল রাজিয়া।

হঠাৎ যুলকারনাইনের ঠোঁটে দেখা দিল মুচকি হাসি। হয়তো ঘুমের মধ্যে কোন স্বপ্ন দেখে হাসছে সে। অসম্ভব মায়াবী চেহারা। মনকাড়া ওর হাসি। রাজিয়ার দেখা এই জগতের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্পাপ যুবক। হিন্দু মুসলিম সকলের কাছে প্রিয় যুলকারনাইন। উঁচু নীচু ধনী গরীব সবার কাছে পরম শ্রদ্বেয় কমান্ডার যুলকারনাইন। এই দূরদেশের চরম শত্রুদের কাছেও যুলকারনাইন একটি পরিচিত মুখ আদরনীয় নাম।

যুলকারনাইনের স্বপ্নময় মিষ্টি হাসি রাজিয়ার মধ্যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল। নেশার ঘোর কেটে গেল তার। আসলে শরাব পানের কারণে সন্ন্যাসীর দেয়া ঔষধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকতা ফিরে এসে ছিলো রাজিয়ার মধ্যে। একটু আগে যে রাজিয়া অবলীলায় মহারাজা রাজ্যপালকে খুন করে এলো, স্বামীকে খুন করতে উদ্যত সেই খুনী রাজিয়ার দেহ হঠাৎ কেঁপে উঠলো- উত্তোলিত হাত থেকে রক্তমাখা খঞ্জরটি পড়ে গেল যুলকারনাইনের পেটের উপরে । আর রাজিয়া হাউমাউ করে কেঁদে লুটিয়ে পড়ল যুলকারনাইনের বুকের উপরে।

ধড়ফড় করে জেগে উঠলো যুলকারনাইন। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বাতি জ্বালালো। তার বিছানায় রক্তমাখা খঞ্জর দেখে অবাক হয়ে গেল। রাজিয়া তখন দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। যুলকারনাইন আকস্মিক এই অবস্থার কোন কূলকিনারা বুঝে উঠতে না পেরে রাজিয়াকে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করলো, এসব কি? এই রক্তমাখা খঞ্জর কোত্থেকে এসেছে? তুমি এভাবে কাঁদছো কেন?

রাজিয়া কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো-”না, আমি তোমাকে হত্যা করতে পারবো না। আমি আমার কলিজায় খঞ্জর চালাতে পারবো না। একথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো রাজিয়া।

তখনো যুলকারনাইন ঘটনার মাথামুণ্ডু কিছুই পরিষ্কার বুঝতে পারল না। তবে এতটুকু আন্দাজ করতে পারলো, নিশ্চয় কোন চক্রান্তের শিকার হয়েছে রাজিয়া। যা সে সহজে বলতে পারছে না। একজন কমান্ডার হিসেবে সে যে হিন্দুদের টার্গেট সে সম্পর্কে সতর্ক ছিল যুলকারনাইন। তাই ঠাণ্ডা মাথায় সে রাজিয়াকে জিজ্ঞেস করলো–

কি হয়েছে রাজিয়া? আমাকে সব খুলে বললো, তোমার কোন ভয় নেই। তুমি কোন অপরাধ করে থাকলেও আমি কিছুই বলবো না। পরিষ্কার করে আমাকে সব বলো।

যুলকারনাইনের আশ্বাস ও উপর্যপরী অনুরোধে রাজিয়া বললো- আমি কতক্ষণ আগে নিজ হাতে মহারাজা রাজ্যপালকে খুন করে এসেছি। কথা ছিল এরপর তোমাকে হত্যা করবো।

কি বলছো এসব? তোমার মাথা ঠিক আছে? তোমার মতো একটি মেয়ে মহারাজাকে খুন করতে পারে? আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আসল কথা আড়াল না করে আমার কাছে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলল।

রাজিয়া জানালো, আমি দু’জন হিন্দু মেয়ের সাথে নদীতে গোসল করতে যাচ্ছিলাম, পথিমধ্যে সন্ন্যাসীরূপী এক বয়স্ক সাধুকে দেখতে পাই। তারপর রাজিয়া জানালো, সন্ন্যাসী তাকে দেখে কি ভবিষ্যদ্বাণী করলো এবং ইসলাম গ্রহণের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হলে তাকে কি করতে হবে। রাজিয়া এও জানালো, হিন্দু মেয়েরা তাকে কি ভাবে রাজ্যপালকে হত্যার জন্যে উদ্বুদ্ধ করলো এবং হত্যাকাণ্ডে যাওয়ার আগে সন্ন্যাসীর দেয়া তুলা ভেজানো পানি পানের কথাও যুলকারনাইনকে জানালো।

রাজিয়া বললো- আমাকে ক্ষমা করে দাও যুলকারনাইন, এই খঞ্জর দিয়ে আমাকে তুমি খুন করে ফেলো। আমি তোমার প্রেমে পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলাম বটে। কিন্তু তোমার ধর্মকে আমি মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারিনি। ধর্ম নয়, আমার হৃদয়ে শুধু তোমার প্রতিই ভালোবাসা ছিল। আমি তোমার শেখানো ইবাদত বন্দেগীর কোনটাই নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারিনি। তুমি আমাকে হিন্দু মেয়েদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলে কিন্তু আমি হিন্দু মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে ইসলাম প্রচারের বিপরীতে হিন্দুত্বকেই আরো বেশি আত্মস্থ করেছি। রাজিয়া বললো, সেই শৈশবকাল থেকেই আমাকে বুঝানো হয়েছে, মুসলমানরা পাপী, অপবিত্র, ঘৃণার পাত্র। আমিও মুসলমানদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়েই বড় হয়েছি। কিন্তু তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তোমাকে আমি ঘৃণা করতে পারিনি। তবে অন্য মুসলমানদের প্রতি আমার কোনই শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়নি।

হঠাৎ দ্রুত পায়ে উঠে রক্তাক্ত খঞ্জরটি যুলকারনাইনের প্রতি বাড়িয়ে দিয়ে রাজিয়া বললো- এই খঞ্জর দিয়ে তুমি আমাকে খুন করে ফেলো। আমি আর বাঁচতে চাই না। আমি যে পাপ করেছি মৃত্যুই এর উপযুক্ত শাস্তি।

যুলকারনাইন রাজিয়ার হাত থেকে খঞ্জর ছিনিয়ে নিয়ে বললো, তোমাকে মরলে চলবে না, বেঁচে থাকতে হবে। অচিরেই তোমার হৃদয়ও বলবে, মুসলমানরা সত্যিকারে অপবিত্র নয়, পবিত্র। ইসলাম কোন মিথ্যা ধর্ম নয় বরং হিন্দুত্ববাদই মিথ্যা। অনেক কথা বলে অনেক কষ্টে যুলকারনাইন রাজিয়াকে শান্ত করলো।

রাত পোহালে যুলকারনাইন রাজ্যপাল নিহত হওয়ার খবর দিয়ে কনৌজের গভর্ণর আব্দুল কাদের সেলজুকীর কাছে দ্রুত পাঠালো এবং রাজিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী দুই হিন্দু মহিলাকে গ্রেফতার করে আনলো। মহিলা দু’জনকে হুমকি ধমকি ও ভয়-ভীতি দেখানোর পর তারা গোবিন্দের কারসাজির কথা প্রকাশ করে দিল। তাৎক্ষণিক গোবিন্দকে পাকড়াও করা হলো।

কিন্তু চক্রান্তের ব্যাপারে গোবিন্দকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে এর সাথে সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করলো এবং বললো– এই দুই মহিলার সাথে কখনো আমার কোন কথা হয়নি। গোবিন্দকে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেও যখন যুলকারনাইন তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি বের করতে পারলো না, তখন সে দুটি ঘোড়া আনতে বললো। সহকর্মীরা দু’টি ঘোড়া নিয়ে এলে যুলকারনাইন গোবিন্দের দু’পায়ের গোড়ালীতে রশি বেধে দু’টি ঘোড়ার সাথে বেধে দিল এবং দু’জন অশ্বারোহীকে বললো, দুটি ঘোড়াকে দু’দিকে তাড়া দাও। ঘোড়া দুটি দু’দিকে চলা শুরু করলেই গোবিন্দের দু’পা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। সাথে সাথে সে চিৎকার দিয়ে বললো, আমিই রাজাকে হত্যা করেছি। এরপর ঘোড়াকে থামিয়ে গোবিন্দকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কেন এ কাজ করেছো?

গোবিন্দ জানালো, কালাঞ্জর ও গোয়ালিয়রের মহারাজা তাকে বড় অংকের পুরস্কার দানের লোভ দেখায়। সে আরো জানায়, কালাঞ্জর ও গোয়ালিয়রের দুই রাজা মিলে কি পরিকল্পনা করেছে। গোবিন্দ এও জানায়, সে এতো দিন দু’মুখী গোয়েন্দাগিরি করে উভয় পক্ষের কাছ থেকেই সুবিধা লাভ করেছে।

খবর পেয়েই সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকী ঝড়ের বেগে রাড়ীতে পৌঁছলেন। তিনি এসে ঘটনার আদি অন্ত সব শুনে গোবিন্দকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি পালিয়ে যেতে চেষ্টা করো। ছাড়া পেয়ে গোবিন্দ পালানোর জন্য দৌড়াতে লাগল। আবদুল কাদের সেলজুকী তার এক সহকর্মীর কাছ থেকে। একটি তীর ও ধনুক নিয়ে দ্রুত তীরটি গোবিন্দকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে তীরটি গিয়ে গোবিন্দের পিঠে বিদ্ধ হলো এবং গোবিন্দ আর্ত চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সেনাপতি সেলজুকী সৈন্যদের বললেন, ওর মরদেহটিকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে শহরের বাইরে ফেলে এসো।

একজন পরাজিত বশ্যতা স্বীকার করে নেয়া রাজার খুন হয়ে যাওয়াটা সুলতান মাহমূদের জন্যে এমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না যে, দ্রুত তাকে এ ব্যাপারে অবহিত করতে হবে। আসলে পরাজিত রাজা রাজ্যপালের মৃত্যুর চেয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের হিন্দু রাজাদের চক্রান্তের বিষয়টি ছিল গযনী সুলতান ও গযনী বাহিনীর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মহারাজা রাজ্যপালের খুনের ব্যাপারটি এবং গোবিন্দের দ্বিমুখী গোয়েন্দাগিরি ও কালাঞ্জর এবং গোয়ালিয়রের হিন্দু রাজাদের চক্রান্তের খবর দিয়ে একজন দ্রুতগামী দূতকে তখনই সেনাপতি সেলজুকী গযনীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করিয়ে দিলেন।

সুলতান মাহমূদ দূতের মুখে এই সংবাদ শুনে সাথে সাথেই সৈন্যদেরকে হিন্দুস্তানে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন।

তিন দিন পর এক ঐতিহাসি লড়াইয়ের জন্যে গযনী বাহিনী হিন্দুস্তানের দিকে রওয়ানা হলো। আর এদিকে গোয়ালিয়র, কালাঞ্জর ও লাহোরের হিন্দু সৈন্যরা চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল। হিন্দু রাজারা জানতো, রাজ্যপালের খুনের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেলে এবং তিন রাজার মিলিত যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর প্রকাশ হয়ে গেলে সুলতান মাহমূদ ঝড়ের বেগে হিন্দুস্তানের দিকে রওয়ানা হবেন। আর এটিই হবে তাদের সাথে গযনী বাহিনীর চূড়ান্ত লড়াই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *