পঞ্চম অধ্যায় : মুহাম্মদের পর : পরবর্তী প্রজন্ম
হিজরি ১১ সালে (আনুমানিক ৮ জুন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) যে উজ্জ্বল তারকা আরব-জগতে ২৩ বছর ধরে জ্বলজ্বল করছিল তা অবশেষে অস্তমিত হয়ে গেল। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আনসারদের মাঝে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয় নবির মরদেহ ঠাণ্ডা হবার আগেই বানু সায়েদা সভাকক্ষে আনসাররা জমায়েত হলেন। তাঁরা আওয়াজ তুললেন, “আমাদের জন্য একজন আমির, তোমাদের জন্য আরেক আমির। এর ফলে যা হবার তাই হল। মক্কা থেকে আসা মুহাজির এবং মদিনার স্থানীয় বাসিন্দা যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে বিরোধ চরমে পৌছায়। ইসলামের ইতিহাস পাঠ করলে এটা পরিষ্কার জানা যায় যে, নবির মৃত্যুর পর মুসলমানদের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক ক্ষমতার লড়াই দানা বাঁধে। এই ক্ষমতার সংগ্রামে ‘ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে হাতিয়ার হিসেবে।
নবুওতি লাভের পর মুহামদ মক্কায় অবস্থান করেন তের বছর। এরপর তিনি চলে যান মদিনায়। এই তের বছর মুহাম্মদ মূলত আধ্যাত্মিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ-সময় কোরানের যে আয়াতগুলি নাজিল হয় তার সবই ছিল ধর্মোপদেশ, পথনির্দেশ এবং উত্তম কাজ করার আবেদন, যাতে করে মক্কাবাসীরা অসৎ কর্ম থেকে বিরত থাকে। মদিনায় হিজরতের পর এ-ধরনের নৈতিকতাভিত্তিক এবং আধ্যাতিকধর্মী আয়াত নাজিল হওয়া কমে যায়। এর বদলে মদিনার আয়াতগুলোতে প্রধানত গুরুত্ব পায় আদেশ-নিষেধ এবং আইন। আল্লাহ এই আয়াতগুলি তখনকার মদিনার মুসলমানদেরকে তাদের শক্রর বিরুদ্ধে সুসংহত ও শক্তিশালী করার জন্য প্রেরণ করেন। ফলে মাদানি আয়াতের মাধ্যমে মুহাম্মদ এক নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপনে সচেষ্ট হন। মদিনার অনুকূল পরিস্থিতির জন্য নবি মুসলমানদের এক নতুন সমাজ সৃষ্টিতে সফল হন।
কোরান এবং মুহাম্মদের জীবনযাপন থেকে এটা পরিষ্কার যে, মক্কা ও মদিনার পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু তা যাই হোক সব কিছুর পিছনে মুহাম্মদের একটি উদ্দেশ্য ছিল, আর তা হল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। অবশেষে মদিনায় এক ইসলামি রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি তাঁর আজন্ম লালিত লক্ষ অর্জন করেন। নবি কৌশলী হয়েছেন, শক্তি প্রয়োগ করেছেন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, রক্তপাত হয়েছে। এই যাবতীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করেছেন। এ- হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু নবির মৃত্যুর পরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দীপনা অনেকাংশে ধাক্কা খায়। নেতৃত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তখন হয়ে ওঠে প্রধান উদ্দেশ্য। তথাপি সবকিছুর মূলে রয়েছে ইসলাম, এবং ইসলাম ছাড়া যে কোনো কিছুই টিকে থাকবে না তাও সবাই বুঝলেন। তাই নবি- পরবর্তী সবাই ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকতে সচেষ্ট হলেন। সে জন্য পরবর্তী প্রায় ১২ বছর ইসলামের বিধান এবং নবির রীতিনীতি খুব কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হত। এই সময়টা ছিল দুই খলিফার ; যথাক্রমে হজরত আবু বকর (হিজরি ১১ বা ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে হিজরি ১৩ বা ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং হজরত ওমর (হিজরি ১৩ বা খ্রিস্টাব্দ ৬৩৪ থেকে হিজরি ২৩ বা ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) । কিন্তু নবির মৃত্যুর পর যত দিন যেতে লাগল তত ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হতে লাগল এবং ইসলামের লক্ষ থেকে সবাই দূরে সরে যেতে থাকলেন। ইসলাম ব্যবহৃত হতে থাকল নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা দখলের জন্য।
নবি মুহাম্মদ যখন মারা যান তখন মদিনার আনসারদের খাজরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন সাদ বিন ওবায়দা। তিনি সমগ্র মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব নিতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু ওমর ছিলেন অতিশয় দক্ষ ও কুশলী। তিনি অবিলম্বে আবু বকরকে নেতা ঘোষণা করে সাদ বিন ওবায়দার স্বপ্নকে অস্কুরেই বিনষ্ট করে তাঁকে বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দিলেন। আবু বকর নেতা হওয়ার পরও কখনো ভুলে গেলেন না ওমরের ঋণ। তিনি নেতৃত্ব নেবার পরপরই ঘোষণা দিলেন, নেতৃত্ব হচ্ছে নবির উত্তরাধিকারী হওয়া – যার নাম হচ্ছে খেলাফত। আবু বকর সুপারিশ করলেন যে তাঁর পরে খলিফা হবেন ওমর। ওমর খলিফা হবার পর মনে মনে ঠিক করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা হবেন আব্দুর রহমান বিন আউফ। তথাপি ওমর যখন ছুরিকাহত হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তখন তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করার জন্য ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদ গঠন করেন। সেই পরিষদ হজরত উসমানকে খলিফা নির্বাচিত করেন। হিজরি ৩৫ (৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) সালে উসমান আততায়ীদের হাতে খুন হবার পর তাঁর খেলাফতের অবসান ঘটে। সুষ্ঠুভাবে রাজত্ব চালাবার জন্য খলিফা উসমান হজরত আলির কাছে আনুগত্য কামনা করেন। কিন্তু উসমানকে তাঁর পাঁচ বছরের খেলাফতের পুরোটাই কাটাতে হয়েছে গৃহযুদ্ধ সামলাতে। যেমন জামালের যুদ্ধ, সিফিফনের যুদ্ধ এবং নাহরাবানের যুদ্ধ। এ-সময় কুরাইশ বংশের মুয়াবিয়া বিন সুফিয়ান এবং কুরাইশ বংশের বানু শাহম গোত্রের আমর ইবনে আল-আস খলিফা উসমানের শক্র হয়ে পড়েন। তাই উসমানকে রাজত্ব চালানোর পাশাপাশি এই দুই গৃহশক্রকেও মোকাবেলা করতে হয়। শক্ৰদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-চলাকালীন অবস্থায় হিজরি ৪০ সালে (৬৬১ খ্রিস্টাব্দ) জন্য প্রচণ্ড উন্মাদনা শুরু হয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় তৎপরবর্তী অনেক ঘটনার মাঝে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুয়াবিয়ার উমাইয়া খেলাফতের পত্তন এবং তাঁর উত্তরাধিকারগণ, হিজরি ৬১ (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) সালে মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াজিদের হাতে আলির পুত্র হোসেনের মৃত্যু, হিজরি ৬১ (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) সালে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের সাথে যুদ্ধে কাবাকে অপবিত্র করা, হাশেমি গোত্রের প্রবল প্রচারণার মুখে উমাইয়া খেলাফতের পতন এবং আব্বাসিয়াদের খেলাফত দখল, পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিদ্বন্দী ফাতেমি বংশের ক্ষমতা দখল, এবং পূর্বাঞ্চলে বিপ্লবী ইসমাইলি আন্দোলন। ইসমাইলি আন্দোলন তুঙ্গে উঠে যখন হিজরি ৬৫৬ (১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ) সালে মঙ্গলীয় বাহিনী হালাকু খানের নেতৃত্বে বাগদাদ দখল করে আব্বাসিয়া খেলাফতের পতন ঘটায়।
প্রশ্ন ওঠে নবি মুহাম্মদ আধ্যাতিক ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণার ভিত্তিতে যে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন তাঁর মৃত্যুর পর সেই রাষ্ট্র কেমন করে চালানো হল? নবির কি উচিত ছিল না তাঁর উত্তরাধিকার মনোনীত করে যাওয়া, যাতে করে নতুন মুসলিম সমাজ জানতো তাদের প্রধান দায়িত্বসমূহ কী কী হবে? আরও কিছু প্রশ্ন আছে এর সাথে, যেমন নবির সহচরদের কী উচিত ছিল না যেভাবেই হোক নবির উত্তরাধিকারী কে হবে সে- ব্যাপারে একটা সমঝোতায় আসা? যেহেতু নবুওতি হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত, তাই ভবিষ্যতে মুসলমানদের আধ্যাতিক নেতৃত্ব কী ক্ষমতা দখলে জড়িয়ে পড়বে? নবি যদি নিজেই তাঁর উত্তরাধিকারী ঠিক করে যেতেন তবে কাকে তিনি মনোনীত করতেন? আলি ছিলেন নবির চাচাতো ভাই, একই সাথে তাঁর মেয়ে ফাতেমার স্বামী, এবং হাশেমি গোত্রের প্রথম পুরুষ যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এছাড়াও আলি ছিলেন একজন অসীম সাহসী যোদ্ধা ও সুদক্ষ সমরনায়ক। একাধিকবার বিপদে আলি নবির জীবন রক্ষা করেছেন। নবির কি উচিত ছিল না আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করে যাওয়া? আবু বকর ছিলেন উচ্চপদাধিষ্ঠিত। লুকিয়ে মদিনা যাবার পথে মুহাম্মদ একদা গুহায় আশ্রয় নেন। আবু বকরও সেই রাতে মুহাম্মদের সাথে গুহায় থেকেছেন। ইসলামের প্রথম যুগে আবু বকর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ইসলামের জন্য বয়ে আনেন প্রচুর সমান। এছাড়াও আবু বকর তাঁর সুন্দরী কন্যা আয়েশাকে বিয়ে দিয়েছেন নবির সাথে। মুহাম্মদর কি উচিত ছিল না আবু বকরকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাওয়া? ওমর ছিলেন এক সুদৃঢ়, একনিষ্ঠ, ও সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। ইসলামের রক্ষাকর্তা হিসেবে ওমর ছিলেন আপোষহীন। রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন দক্ষ। নবি কি কখনও চিন্তা করেছিলেন যে ওমরই হবেন তাঁর যোগ্যতম উত্তরাধিকারী? মুহামদ মদিনাতে নবুওতি পালন করলেন দশ বছর। এই সুদীর্ঘ দশ বছরে তিনি কেন উত্তরাধিকারী সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলেন না? যে নবি এত দূরদর্শী এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণসম্পন্ন ছিলেন, যিনি শূন্য থেকে নিজের একক প্রচেষ্টায় মদিনাতে মুসলিম- সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন আমরা কী চিন্তা করতে পারি সেই নবি উত্তরাধিকারী মনোনয়নের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলা করে যাবেন? মৃত্যুর আগে নবি ইসলামকে আরব জাতীয়তাবাদ বলে নির্ধারিত করেছিলেন এবং বলে ছিলেন যে আরবে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম থাকবে না। সেই নবিই কেমন করে তাঁর সদ্যভূমিষ্ঠ ইসলামি রাষ্ট্রের বলাবাহুল্য, এই ধরনের অনেক প্রশ্নই আমাদের মনে জাগে। কিন্তু প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর কোনোদিনও পাওয়া যাবে না। ফলে এ-বিষয়ে আমরা যা যা জানতে পাই তা শুধুমাত্র অনুমান ছাড়া আর কিছু নয়। নবি পরবর্তী ইসলামের যে দ্বন্দু দেখা দিয়েছিল তার প্রধান কারণ হচ্ছে এই উত্তরাধিকারের বিষয়টি।
আমরা হয়তো নিশ্চিতভাবে বলতে পারি নবি তাঁর উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেননি। কথিত আছে হিজরি ১০ সালে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) নবি বিদায় হজের পর যখন মদিনায় ফিরছিলেন তখন গাদির আল খুম নামের এক জলাধারের (কেউ কেউ বলেন কৃপ) কাছে যাত্রাবিরতি দেন এবং আলির হাত ধরে বললেন, “আমি যাদের বন্ধ (অভিভাবক) আলিও তাদের বন্ধু ( অভিভাবক) । উল্লেখ্য মাওলা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে নিকটে আসা, এর আরও দুটি অর্থ রয়েছে, অভিভাবক বন্ধু এবং আশ্রিত ব্যক্তি। শিয়ারা মনে করেন যে ওই বাক্য দ্বারা নবি আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিয়োজিত করে গিয়েছেন। [ কোনো কোনো মুসলিম পণ্ডিতের তফসিরে (যেমন তফসির
হিসেবে আলিকে মনোনীত করে ছিলেন। কিন্তু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় তিনি এ-ঘোষণাটি স্থগিত রেখেছিলেন, যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়। (*Ră : Saiyid Safdar Hosain, The Early History of Islam, Low Price Publications, Delhi, (First Published 1933), 2006, page 235) । শিয়াদের মধ্যে কেউ কেউ হজরত আলিকে নবির উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনয়নের ব্যাপারে সুরা ইনশিরাহ এর ১- ৮ নম্বর আয়াতের দিকে নির্দেশ করেন। যদিও এই সুরায় আলিকে সরাসরি মুহাম্মদের পরবর্তী নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, শুধুমাত্র নবিকে ভারমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।অনুবাদক] সুন্নিরা অবশ্য তা অস্বীকার করেন। সুন্নিরা বলেন, নবি যদি এই বাক্য বলে থাকেন তবে তা বলেছিলেন ইসলামের প্রতি আলির একনিষ্ঠতা আর সেবার প্রতি প্রশংসা করে। আলি যে ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন তা সকল মুসলিমই স্বীকার করেন। এখানে এটাও বলা যেতে পারে যে, আলিকে উদ্দেশ্য করে ওই বাক্যকে যদি নবির উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সিদ্ধান্ত বলে ধরা হয় তবে নবি অসুস্থ থাকাকালীন সময় যখন আবু বকরকে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দেন, সেই উদাহরণটাও বলতে হয় নবির সিদ্ধান্ত ছিল যে আবু বকর হবেন তাঁর উত্তরাধিকারী। খেলাফত বিষয়ে সুন্নিদের বক্তব্যকে আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও শিয়াদের সাথে এ-বিষয়ে অনেক বিরোধ রয়েছে। সুন্নিরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে কোরানের এই আয়াতের উদ্ধৃতি দেন: , , , আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম মনোনীত করলাম। তবে যদি কেউ ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়, কিন্তু ইচ্ছা করে পাপের দিকে না ঝোঁকে (তার জন্য) আল্লাহ তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। ( সুরা মায়িদা : আয়াত ৩) ।
সুন্নিরা বলেন যে এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ মুহামদের নবুওতির দায়িত্ব সম্পন্ন করেন এবং মুসলমানদের জন্য কোরানের নির্দেশাবলী বাধ্যতামূলক করে দেন। এই মত অনুযায়ী কোরান হচ্ছে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ। তাই মুসলমানদের জন্য মুহামদ নির্বাচিত কোনো ঐশ্বরিক ও অভ্রান্ত উত্তরাধিকারীর দরকার নাই, যা শিয়ারা বিশ্বাস করেন। সুন্নিরা আরও বলেন, যে কোনো ব্যক্তি যদি কোরানের আদেশ মানেন এবং নবির আদর্শে চলেন তবে তিনি মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারেন। তাই নবির সহচরদের অধিকার আছে যাকে তাঁরা যোগ্য মনে করবেন তাকেই মুসলমানদের নেতা হিসাবে নিয়োগ করবেন। এই নেতাই মুসলিমদের কোরান এবং সুন্নাহর (নবির আচার-ব্যবহার এবং তাঁর উদাহরণ) পথে চালাবেন। সুন্নিদের এই মতবাদ কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হলেও বলতে হবে যে এটা বিগতকালীন ব্যাপারেও প্রযুক্ত – এর উদাহরণ। চার খলিফার আমলে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার ভিত্তিতে সুন্নিদের এই মতবাদ প্রসার পায়। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে বুঝা যাবে যে এ- বক্তব্য সঠিক নয়।
নবির মৃত্যুর সাথে সাথে বানু সায়েদার হলঘরে যে কলহের সূত্রপাত হয়, তা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে সবার মনে তখন প্রাধান্য পাচ্ছিল নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা। তখন দরকার ছিল একজন উত্তরাধিকারীর যে মুসলমানদের কোরান এবং সুন্নাহর রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু দুই পক্ষই একজন সুদক্ষ উত্তরাধিকারী নিয়োগে ব্যর্থ হয়। এই কোলাহলপূর্ণ সমাবেশে মদিনার স্থানীয় মুসলমানরা (আনসার) এবং মক্কা থেকে আগত শরণার্থীরা (মুহাজির) এই দুই পক্ষই নেতৃত্বের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দাবি করল। আনসারদের দাবি ছিল তাঁরা নবিকে সাহায্য করেছিলেন, আর মক্কার মুহাজিররা দাবি করলেন নবির সাথে তাদের আত্মীয়তার।
এই সভায় উত্তরাধিকারী নির্বাচনের জন্য নবির নিজস্ব গোত্র, হাশেমি গোত্রের কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না। নবির ভ্রাতুষ্পপুত্র আলি এবং নবির চাচা আল আব্বাস ছিলেন নবির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এই দুইজন সেই বৈঠকে যোগদান করেননি। মুহাম্মদ তাঁর দশজন সহচরকে (ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম দশজন পুরুষ) বেহেশতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। বানু সায়েদার বৈঠকে সেই দশজনের মধ্যে আরও দুইজন অনুপস্থিত থাকলেন। তাঁরা হলে তালহা বিন উবায়দুল্লাহ এবং জুবায়ের বিন আওয়াম। তাঁরা ফাতেমা- আলির ঘরে নবির মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত ছিলেন। এ- সময় আলিকে জানানো হয় বৈঠকে মুহাজিররা জিতেছেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, মুহাজিররা নবির আত্মীয়। ওদের উৎস একই গাছ, আর সেই গাছ হচ্ছেন নবি । এ-কথা শুনে আলি বললেন, ‘ওরা গাছের যুক্তি দিয়েছে কিন্তু গাছের ফলের কথা ভুলে গেছে। এই সংবাদ শুনে জুবায়েরও ক্ষেপে উঠলেন। রাগতস্বরে বললেন, ‘এরা যতক্ষণ পর্যন্ত না আলির প্রতি তাঁদের আনুগত্য দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমার তরবারি কোষবদ্ধ হবে না।
কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান (মুয়াবিয়ার পিতা) বললেন, “ওহে আবদে মনাফের বংশধরেরা (হাশেমি এবং উমাইয়া গোত্রের সাধারণ উৎস) আজ যে মরুঝড় উঠেছে তা মিষ্টি ভাষায় শান্ত করা যাবে না। তাঁরা আবু বকরের মত নীচুগোত্রের লোককে তোমাদের নেতা নিযুক্ত করেছে। তাঁরা এতোই নীচুজাতের ব্যক্তিকে চায়, তবে আলি অথবা আল- আব্বাসকে সুযোগ দিল না কেন? মুহাম্মদের একসময়কার তীব্র বিরোধী (যিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলাম কবুল করেন) আবু সুফিয়ান আলির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আপনি আপনার হাত দিন, আমি আপনার কাছে আমার আনুগত্য জানাব। আপনি চাইলে আমি মদিনা ভরে দিব অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য দ্বারা। আবু সুফিয়ানের এই প্রস্তাব আলি প্রত্যাখ্যান করলেন।
নবি এবং ইসলামের প্রতি আলির ছিল অকৃত্রিম ও গভীর অনুরক্তি। এ- জন্য আলির নৈতিকতার মান অন্যান্য আরবের চেয়ে অনেক উপরে। এটা পরিষ্কার যে একমাত্র আলি ব্যতীত বাকি সব বিশিষ্ট কুরাইশ ব্যক্তির লোভ ছিল ক্ষমতা দখলের। এ-বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করার জন্য তাবারির ইতিহাস থেকে এবং ইবনে হিশামের নবির জীবনী থেকে কিছু উদ্ধৃতি পুনরায় উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি ঘটনা ছিল এ-রকম: নবির অসুস্থতার শেষ দিনে আলি নবির গৃহ থেকে চলে যান। জনসাধারণ আলিকে ঘিরে ধরেন। তাঁরা নবির স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানতে চান। আলি উত্তর দিলেন, আল্লাহকে ধন্যবাদ, তিনি সুস্থ হচ্ছেন। তখন আলিকে একপাশে নিয়ে আব্বাস বললেন, আমার মনে হয় তিনি মৃত্যুর পথে। তাঁর মুখে আমি যা দেখেছি সেই দৃশ্য আমি আগেও দেখেছি আব্দুল মোতালেবের ছেলেদের মৃত্যুকালে। আপনি নবির কাছে যান এবং জেনে নিন তাঁর পরে কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। কর্তৃত্ব যদি আমাদের হাতেই রাখতে হয় তা আমাদের জানা দরকার। আর কর্তৃত্ব যদি অন্যের হাতে বর্তায় তাহলে তাঁর উচিত হবে কাউকে সুপারিশ করা। আলি উত্তরে বললেন, আমি কখনোই এ-ধরনের প্রশ্ন করব না। তিনি যদি এই ব্যাপারটা আড়ালে রাখেন, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ আমাদের দিকে তাকাবে না।
এটা অনস্বীকার্য যে প্রথম দুই খলিফার রাজত্ব ভালই চলেছিল। দুজনের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া যদিও প্রশ্নের উর্ধ্বে নয় এবং তাঁদের ক্ষমতায় আরোহণের বিষয়ে নবির সহচরদের সর্বসম্মত সমর্থন ছিল না, তথাপি সরকার চালানোর নীতিতে তাঁরা কোরান ও নবির সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হননি। হজরত আবু বকর এবং হজরত ওমর সৎ ছিলেন। আলি ছিলেন নবির স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি। তথাপি আবু বকর খলিফা হলে আলি ছয় মাস পরে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেন। কিন্তু ওমর খলিফার আসনে বসলে তাঁর প্রতি আনুগত্য জানাতে তিনি কোনো দ্বিধা করলেন না। তৃতীয় খলিফা উসমানের সততা প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। উসমান খেলাফতকালে অনেক ক্ষেত্রেই কোরানলঙ্ঘন করেছেন ফলে সমগ্র মুসলিম সমাজে অসন্তোষ ধূমায়িত হয় এবং অচিরেই তা বিদ্রোহের রূপ নেয়।
খলিফা নির্বাচন পরিষদের সমতিক্রমেই উসমান খলিফার পদ দখল করেন, এবং তাঁর প্রতি সাধারণ জনতার সমর্থনও ছিল। তাই উসমানের খেলাফতে কিছুটা গণতন্ত্রের আভাষ পাওয়া যায়। ওমর ছয় সদস্যের এক পরিষদ গঠন করে নির্দেশ দেন তাদের মধ্যে থেকে একজনকে খলিফা মনোনীত করতে, যে তাঁর উত্তরাধিকারী হবেন। এই ছয় সদস্য ছিলেন : আলি, উসমান, তালহা, জুবায়ের, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং আব্দুর রহমান বিন আউফ। আব্দুর রহমান প্রস্তাব দিলেন যে আলি অথবা উসমান খলিফা হবেন। আলি অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাই আব্দুর রহমান বিন আউফ উসমানের প্রতি তাঁর আনুগত্য জানালেন। তাঁর দেখাদেখি পরিষদের অন্যান্য সদস্যরাও উসমানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এর তিন দিন পূর্বে জনতার মতামত জানবার জন্য আব্দুর রহমান বিন আউফ এক জনমত যাচাই করেন।
উসমান জনগণের ইচ্ছায় খলিফার আসনে বসলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল তাঁর শাসন- দক্ষতার মান নবির আদর্শ থেকে অনেক দূরে। উসমানের বিরুদ্ধে কমপক্ষে পঞ্চাশটি অন্যায়ের অভিযোগ উঠে। এর জন্য মূলত দায়ী ছিলেন তাঁর নিজস্ব গোত্রের আত্মীয়স্বজনরা। ব্যক্তিগতভাবে উসমান ছিলেন বিনয়ী ও সাদাসিধে। কিন্তু উসমানের বড় দুর্বলতা ছিল, তিনি তাঁর নিকট আত্মীয়দের কাকুতিমিনতি বা অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারতেন না। খলিফা হিসেবে ওমরের চরিত্রের যে দৃঢ়তা ছিল তার সাথে উসমানের কোনো তুলনা হয় না। ওমর তাঁর সিদ্ধান্তে এতই দৃঢ় থাকতেন যে নবির কোনো সহচর পর্যন্ত ওমরকে তাঁর সিদ্ধান্ত হতে বিচ্যুত করতে পারতেন না।
খলিফা নির্বাচনে আলিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তিনি খলিফা মনোনয়ন পেলে মদিনার আমজনতা এবং নবির প্রায় সমস্ত সাহাবিরা শুভেচ্ছার সাথে তা গ্রহণ করেন। কিন্তু আলির শাসনকাল ছিল খুব স্বল্প। এই স্বল্পকালে তাঁকে তিনটি গৃহযুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। আলিকে বেশ কিছু নাশকতামূলক ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার সমূখীনও হতে হয়। এছাড়াও নবির দুই প্রবীণ সহচর যথা তালহা এবং জুবায়ের আলির প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেন। আলি যখন এই দুজনকে যথাক্রমে কুফা এবং বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত করতে আপত্তি জানান তখনই তাঁরা আলির বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করেন।
এ- ধরনের প্রায় ভজন খানেক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। খলিফা নিয়োগে সুন্নি- মতামত নীতিগতভাবে মেনে নিলেও ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এটা সর্বাংশে সত্য নয় এবং এই পদ্ধতি মুসলমানদের কোনো উপকারে আসেনি। ক্ষমতা এবং সম্পদের উপর লোভের ফলে কোরান ও সুন্নাহকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।
একটা প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, নবি মুহাম্মদ কি তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ব্যাপারে অন্য কারো চেয়ে বেশি সক্ষম ছিলেন না? নবি মুহাম্মদ এ-বিষয়ে যে অদ্বিতীয়ভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন তা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। কারণ মুহাম্মদ নবুওতির গুণে গুণান্বিত ছাড়াও নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে তাঁর সমসাময়িকদের চেয়ে শীর্ষে ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ। মানবচরিত্র এবং তাঁর সহচরদের মানসিকতা সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। তিনি যখন ক্ষমতার তুঙ্গে, তখন তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাহস কারো ছিল না। এতো অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নবি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয়ে নীরব রইলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তিনি নীরব ছিলেন? তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়োগের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে তিনি কি চিন্তা-ভাবনায় আনেননি? অথবা তিনি কি জানতেন যে তিনি আরও অনেক দিন বাঁচবেন তাই উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সময় আসেনি?
নবির অসুস্থতার সময় বয়স ছিল ৬৩ বছর। এটা তেমন বৃদ্ধ- বয়স নয়। তাঁর অসুস্থতা ছিল অল্পদিনের। এই অসুস্থতাকালীন ঘটনাবলী থেকে মনে হয়, নবি তাঁর অসুস্থতাকে মারাত্মক ভাবেননি। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ভেবেছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাই হয়তো নবি তাঁর অসুস্থতার প্রথম দিনে স্ত্রীগণকে জানালেন, তিনি আয়েশার গৃহে সেবা-শুশ্রুষা পেতে চান। সেই সময় আয়েশা শিরঃপীড়ায় ভুগছিলেন। তাই রসিকতা করে নবি আয়েশাকে বললেন, ‘তুমি কি আমার আগেই মারা যেতে চাও যাতে করে আমাকে তোমার লাশ ধুতে হয় এবং দাফন করতে হয়?’ আয়েশাও রসিকতা করে জবাব দিলেন, তাহলে তো আপনি নির্বিঘ্নে আমার গৃহেই আপনার অন্যান্য স্ত্রীর সাহচর্য পেতে পারবেন। এ- থেকে বুঝা যায়, নবি ভেবেছিলেন তাঁর অসুখ তেমন মারাত্মক নয়।
এই অনুমানের সমর্থনে আরও কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। রোগাক্রান্ত হবার শুরুর দিকে নবি সিরিয়ার খ্রিস্টান- আরবদের আক্রমণ করার জন্য এক সেনাবাহিনী গঠনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই আক্রমণকারী বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নবির মুক্তক্রীতদাস ও পালকপুত্র জায়েদ বিন হারিসের পুত্র বিশবছর বয়স্ক ওসামাকে মনোনীত করেন। এই সিদ্ধান্তে মুসলিম সৈন্যদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ মুহাজির ও আনসারদের মাঝে বেশ কয়েকজন ঝানু সেনানায়ক ছিলেন যারা ওসামার পদটি পাবার জন্যে আগ্রহী ছিলেন। তবে অসন্তোষের খবর পেয়ে নবি ক্রুদ্ধ হোন। মসজিদের বেদিতে দাঁড়িয়ে নবি ঘোষণা দেন, এই ধরনের অসন্তোষ অবাধ্যতারই নামান্তর। তিনি আরও বলেন, ওসামার নিয়োগ সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। নবির এই ঘোষণা প্রকাশের পর অসন্তোষ- প্রকাশকারীরা চুপ হয়ে যান। এ-ঘটনা হতেও প্রতীয়মান হয় মুহাম্মদ ভেবেছিলেন তাঁর অসুস্থতা সাময়িক এবং আশা করছিলেন দ্রুত সেরে উঠবেন।
এই ঘটনার পক্ষে আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়, যা উত্তরাধিকারী নির্ণয়ের চাইতে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তখনও নবি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে কোরান সংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজে হাত দেননি। কোরান হচ্ছে মুহাম্মদের নবুওতির হুকুমনামা এবং মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। মুহাম্মদের মৃত্যুকালে কোরান এককভাবে সংগৃহীত ছিল না। সে- সময় কোরান মুহাম্মদের বিভিন্ন সহচর ও ওহি লেখকদের মাঝে বিক্ষিপ্ত ছিল। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ইসলাম-বিশারদ এবং কোরান বর্ণনাকারীদের মধ্যে প্রচুর তফাৎ দেখা দেয়। এ-সমস্যা সৃষ্টি হত না, যদি মুহামদ তাঁর জীবদ্দশায় কোরান সংকলনের কাজটি সম্পন্ন করে যেতেন। বর্তমানে কোরানের আক্ষরিক ব্যাখ্যা নিয়ে যে সমস্যা আছে, তাও থাকত না। কোরানের যে- সব আয়াত রহিত হয়েছে কিংবা যে- সব আয়াত অন্য আয়াতকে রহিত করেছে সেগুলোকেও সহজে সনাক্ত করা যেত। সর্বোপরি কোরানকে সাজানো যেত সুরা এবং আয়াতের নাজিল হওয়ার কালক্রম অনুযায়ী। প্রচলিত আছে যে, হজরত আলি কালক্রম অনুযায়ী কোরানের একটি সংকলন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এটি সংরক্ষণ করা হয়নি।
মুহাম্মদের দুইজন ওহি লেখকের অন্যতম ছিলেন জায়েদ বিন সাবিত। কথিত আছে জায়েদ একবার বলেছিলেন : আবু বকর আমাকে ভেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘অনেকদিন যাবত ওমর আমাকে চাপাচাপি করছেন কোরান সংগ্রহ এবং সংকলিত করার জন্য। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে নারাজ। কারণ কোরান সংকলন যদি এতোই প্রয়োজনীয় ছিল তবে নবি নিজেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতেন। কিন্তু ইয়ামামার যুদ্ধে নবির অনেক সহচর মারা গেলেন। এদের অনেকেই কোরানের বিভিন্ন আয়াত মুখস্ত করে রেখেছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর সাথে তাঁরা কোরানও নিয়ে গেলেন কবরে। তাই আমি এখন কোরান সংকলনের ব্যাপারে ওমরের সাথে একমত।”
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ওমর কোরান সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং এ- জন্য খলিফা আবু বকরকে প্ররোচিত করেন। এরপরও কোরান সংকলন করতে অনেক দিন পার হয়। উসমান কোরান সংকলনের জন্য একটি কমিটি করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই কমিটি যে কোরান সংকলন করেন তা কালক্ৰমানুযায়ী হয়নি। এমন কী এই কমিটি হজরত আলি এবং বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের কাছে যে কোরান ছিল তা ধর্তব্যেও আনলেন না।
উসমানের কমিটির প্রণীত কোরানের সূরাগুলির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী সাজালেন। বেশি দৈর্ঘ্যের সুরাগুলি আগে (সুরা ফাতিহা বাদে) এবং স্বল্প দৈর্ঘ্যের সুরাগুলি শেষে। এ-ধরনের বিন্যাস একেবারে অপ্রয়োজনীয়। কারণ যুক্তি অনুযায়ী মক্কি সুরাগুলি আসা ছিল কোরানের প্রথম দিকে এবং মাদানি সুরাগুলি থাকা উচিত ছিল শেষের দিকে। কিন্তু উসমানের কোরান- সংকলন কমিটি মক্কি সুরার মাঝে মাদানি সুরা আর মাদানি সুরার মাঝে মক্কি সুরা মিলিয়ে কোরানের বিন্যাস করলেন। যাহোক, নবির মৃত্যু হয়েছিল অকস্মাৎ, ফলে তিনি কোরান সংকলন ও সম্পাদনার সময় পাননি।
অনেকের ধারণা, অসুস্থতার শেষের দিন নবি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর অসুখ মারাত্মক। সে দিন ২৮শে সফর হিজরি ১১ অথবা ১৩ই রবিউল আওয়াল, ইংরেজি ৮ই জুন ৬২৩ সন। এ-দিন জ্বরের তীব্রতা বেড়ে গেলে নবি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হল, তাঁর আর বেশি সময় নেই। তাই আশেপাশের সকলকে কাছে আসতে বললেন এবং এক দোয়াত কালি এবং এক খণ্ড কাগজ দেয়ার কথা বললেন : ‘আমি তোমাদের জন্যে কিছু লিখতে চাই (অথবা কাউকে দ্বারা লিখাতে চাই) । এটা করা হলে ভবিষ্যতে তোমরা বিপথে যাবে না। দুর্ভাগ্যবশত নবির শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। যারা নবির নিকটে ছিলেন তাঁরা প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর তাঁরা নিজেদের মধ্যেই বচসা শুরু করে দিলেন। উপস্থিত একজন বললেন, তিনি কি ক্রোধান্বিত হয়ে এ- সব বলছেন? তাঁকে কি ভূতে ধরেছে? তাহলে ওঝা নিয়ে আসি। এ- শুনে জয়নাব বিনতে জাহশ এবং কয়েকজন সাহাবি বলে উঠলেন, নবি যা চাইছেন তোমাদের উচিত তা অবিলম্বে নিয়ে আসা। ওমর বললেন :
নিবির জ্বর অত্যধিক। আমাদের জন্যে রয়েছেন আল্লাহ এবং কোরান, এগুলোই আমাদের জন্য যথেষ্ট। অন্যকিছুর দরকার নেই। এভাবে যারা চেয়েছিল নবির লিখিত পথনির্দেশ যাতে তাঁরা ভবিষ্যতে ভুল পথে না যায় এবং যারা চাননি যে তিনি কিছু লিখুন, তারা দুই পক্ষে বিভিক্ত হয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দেন। নবি এই বচসা দেখে খুব মর্ম- পীড়িত হলেন। এক সময় তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে দুই পক্ষকেই তাঁর সামনে বাকযুদ্ধ বন্ধ করতে বললেন। কারোই ধারণা ছিল না যে নবি কী লিখতে চাচ্ছিলেন। আর তাছাড়া তিনি অসুস্থ, তাই কারো বোধগম্য ছিল না, কাকে দিয়ে লেখাবেন তাঁর নির্দেশগুলো। তিনি কি তাঁর উত্তরাধিকারীর নাম লিখতে চেয়েছিলেন? এমন কিছু লিখতে চাচ্ছিলেন যা কোরানে ছিল না? অথবা কোরানের কোনো কিছু কি তিনি বাতিল করতে চাচ্ছিলেন? অথবা আরব জাতির প্রগতির জন্য কি কোনো নীতিমালা দিতে চেয়েছিলেন? এই সবই যদি হয় তবে তিনি মৌখিকভাবে তা বললেন না কেন? নবির এই নীরবতা চিরকালের জন্যে এক রহস্য হয়ে থাকবে।
উপরের ঘটনাতে একটি বিতর্কিত বিষয় আছে। ওমর ছিলেন একজন নির্ভীক, দৃঢ় ও অটল মানুষ। ইসলাম ও ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার উপর ওমর ছিলেন সম্পূর্ণ নিবেদিত। এহেন ওমর কেন মুহাম্মদের শেষ লিখিত নির্দেশের বিরোধী হলেন আর বললেন কোরানই হবে যথেষ্ট? ওমর কি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন যে, নবি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন? ওমর তো বাস্তববাদী, দূরদর্শীসম্পন্ন হিসেবে পরিচিত। সে- জন্যেই কি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুহাম্মদ মৃত্যুর পূর্বে আলিকেই তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে পারেন? এমন যদি হয়, তবে ওমর ভালভাবেই জানতেন যে আপামর মুসলিম সমাজ নবির ইচ্ছাকেই সম্মান দেখাবে। এবং এর ফলে ওমরের হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না। খলিফা মনোনয়ন নিয়ে শিয়াদের মধ্যে এ- ধারণাটাই বিদ্যমান। যৌক্তিকভাবে বিচার করলে শিয়াদের এই ধারণা অমূলক নয়। কেননা ওমর কেন নবিকে তাঁর শেষ ইচ্ছে লিখতে দিলেন না তার সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য কারণ আজ পর্যন্ত কেউ উপস্থাপন করতে পারেননি।
ইসলামের ইতিহাসে ওমর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনি ছিলেন নবির প্রিয়, সম্মানিত এবং প্রভাবশালী সাহাবি। রাজনৈতিক বিষয়াবলীতে ওমর ছিলেন শক্তিশালী স্তম্ভ। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছাড়াও তিনি মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণে ছিলেন দক্ষ। তাঁর দূরদর্শিতাও ছিল অপরিসীম। ফলে ধারণা করা যায়, ওমর পূর্বেই অনেক হিসাব নিকাশ করেছিলেন। তিনি জানতেন নবিকে যদি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করার সুযোগ দেওয়া হয় তবে তা নিঃসন্দেহে হবেন আলি অথবা আবু বকর। এদের মধ্যে আলি ছিলেন হাশেমি গোত্রের সবচেয়ে সমানিত ব্যক্তি। আবার তিনি নবির ভাই, নবির জামাতা, এক নির্ভীক যোদ্ধা এবং ঘনিষ্ঠ ওহি- লেখক। এছাড়া আলির ছিল নিজস্ব মৌলিক চিন্তাধারা। ফলে আলি সহজে অন্য কারো চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হতেন না। আবু বকর ছিলেন ওমরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মদিনার দশ বছর আবু বকর ও ওমর একে-অপরের সান্নিধ্যের মধ্যে ছিলেন। নবির অন্যান্য সহচরদের চেয়ে আবু বকরের সাথেই ওমর বেশি মেলামেশা করতেন। যে কোনো ব্যাপারে তাঁদের দুজনের থাকত মতের মিল। আলি ও আবু বকর, এই দুজনের মাঝে ওমর অবশ্যই আবু বকরকে বেছে নিবেন মুহাম্মদের উত্তরাধিকারী হিসেবে। আবু বকর ছিলেন ধীর ও শান্ত মেজাজের। আবু বকরের গোত্র প্রভাবশালী ছিল না। তাই ওমর জানতেন, আবু বকর মুহাম্মদের স্থলাভিষিক্ত হলে মূলত তিনিই হবেন আবু বকরের দক্ষিণ হস্ত। আর নবির উত্তরাধিকারী যদি আলি হন তবে আলি পাবেন নবির সহচরদের সম্মান এবং সমগ্র হাশেমি গোত্রের সমর্থন। এই অবস্থায় আলি ওমরকে পাশ কেটে চলবেন, বিষয়টি ওমর ভাল করেই বুঝেছিলেন। ওমর আবু বকরের বয়সের বিষয়েও সজাগ ছিলেন। মুহাম্মদ যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন আবু বকরের বয়স ছিল ষাটের উর্ধ্বে। প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে আবু বকর ছিলেন সম্মানিত। আর আলির বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ। তাই ওমর জানতেন আবু বকর নেতা হলে শীঘ্র ওমরের হাতে ক্ষমতা চলে আসবে কিন্তু আলি নেতা হলে সেটা হবে না। সংক্ষেপে বলা যায় আবু বকর নবির উত্তরাধিকারী হলে ওমরের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়তা হবে। এ-দিক দিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায় ওমর কেন নবির শেষ নির্দেশের বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। ওমর হয়তো ভেবেছিলেন মুহাম্মদ বোধহয় শেষ ইচ্ছাপত্র লিখে যেতে পারেন; এবং নবির মৃত্যুর পরে শাসনক্ষমতা শুধুমাত্র হাশেমি গোত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে যার ফলে অন্যান্যদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ রূদ্ধ হয়ে যাবে।
হতে পারে নবির লেখার উদ্দেশ্য উত্তরাধিকারী মনোনীত করা ছিল না। তিনি ভিন্ন কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে ওমর কোনোক্রমেই ঝুঁকি নিতে চাননি। তিনি এই ব্যাপারে আর বৃথা তর্কে যেতে চাননি। ওমর ভেবেছিলেন নবি শেষমেশ উইল করতে পারেন। তাই তিনি নিজের মনের কথা গোপন রেখে বলেছিলেন নবি প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বলছেন, তাই তাঁর পক্ষে কোরানে কিছু যোগ করার মতো অবস্থা নেই। ওমর আরও বললেন নবির কাছে যত ওহি এসেছে তা সবই এসেছিল যখন তিনি সুস্থ ও ভাল স্বাস্থ্যে ছিলেন। কোরানে যা থাকার সব কিছুই নবি পেয়ে গেছেন সে অবস্থায়, কাজেই নতুন আর কিছু লেখার প্রয়োজন নাই।
জানালেন না কেন? শিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী, নবির উদ্দেশ্য ছিল আলিকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করা। তাই যদি হয় তবে যখন বাহাস শুরু হল এবং যখন ওমর কাগজ-কলম আনতে নিষেধ দিলেন তখন নবি মৌখিকভাবে অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাঁর শেষ ইচ্ছেটা জানিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু নবি তা করেননি। এ- সময় নবির কক্ষে অনেক ব্যক্তিই উপস্থিত ছিলেন। ফলে তিনি যা বলতেন তা মুখে মুখে সমগ্র মুসলিম- সমাজে ছড়িয়ে পড়ত। তাহলে কি নবির অন্য কোনো কারণ ছিল যার জন্য তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেননি? আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এই রহস্যের গভীরতা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা সত্য নয়।
একটা বিষয় আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, মুহাম্মদ সারাটা জীবন যা করে এসেছেন তার সব কিছুর পেছনে সর্বদা কোনো না কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছে। তেইশ বছর ধরে তাঁর মনে এক দুর্বার আকাঙ্ক্ষার শিকড় গেড়ে ছিল। এই শিকড় তাঁর মনে- প্রাণে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে এই দুর্বার শক্তি তাঁর ব্যক্তিত্বের অঙ্গ হয়ে পড়ে। নবির এই অদম্য উদ্দেশ্য ছিল এক ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যার ভিত্তি হতে হবে আরব জাতীয়তাবাদ। নবির ছিল সহজাত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মানুষের চরিত্র বুঝার অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর সব সহচরের গুণ ও মেজাজের বৈশিষ্ট্য তিনি খুব ভাল করে জানতেন। নবি খুব ভালভাবে লক্ষ করেছিলেন ওমরের চরিত্রের একাগ্রতা, দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা এবং নৈতিকতা। ওমর এবং আবু বকরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও নবি ভাল করে জানতেন। ইসলামে দীক্ষা নেবার পর থেকে ওমর হয়ে যান নবির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর। নানা সময়েই ওমর নবিকে প্ররোচিত করেছিলেন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য, যা পরিশেষে ইসলামের কল্যাণ বয়ে আনে। আবু বকর ছিলেন মুহাম্মদের বিশ্বস্ত অনুগামী। কিন্তু ওমর সেরকম ছিলেন না। ওমর ছিলেন নিজস্ব ধ্যান- ধারণার ব্যক্তি। অনেক ক্ষেত্রে ওমর তাঁর অভিপ্রায় নবির কাছে উপস্থাপিত করতেন এবং নবি প্রায়ই ওমরের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় পূরণ করতেন। মিশরীয় বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জালালউদ্দিন আল সুয়তির (১৪৪৫-১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) লেখা “আল-ইতকান ফি উলুম আল- কোরান বইয়ের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘কোরানের সেইসব প্রত্যাদেশ যা সাহাবিদের অভিপ্রায়ে সংযোজিত। কোরানের আয়াতের কয়েকটি এসেছে ওমরের পরামর্শ থেকে। মোজাহেদ বিন জাবর বলেছেন : কোনো বিষয়ে ওমর তাঁর মতামত জানালেন। কিছু পরে তা ওহি হয়ে কোরানে স্থান পেয়ে যেত। এমনকি ওমর নিজেই বলেছেন কোরানের তিনটি আয়াত তাঁর ব্যক্তিগত পরামর্শে কোরানে স্থান পেয়েছে। এই আয়াতগুলি হচ্ছে মুসলিম নারীদের পর্দার ব্যাপারে (সুরা আহজাব ; আয়াত ৫৯) , বদরের যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে (সুরা আনফাল ; আয়াত ৬৭) , এবং ইব্রাহিমের তৈরি ঘর (কাবা) স্থান সম্পর্কে (সুরা বাকারা ; আয়াত ১২৫) । এ-বিষয়গুলিতে সুন্নাহ-সংকলনকারী, মুহাম্মদের জীবনীকারক, এবং কোরানের তফসিরকারকদের অনেক কিছু বলার আছে। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী ওমর ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিজ্ঞ ছিলেন। এজন্য নবি ওমরকে বিশ্বাস করতেন। এ- ধরনের ব্যক্তি নবির ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে পাঁচজনের বেশি ছিলেন না।
মুহাম্মদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে বুঝা যায়, উদ্দেশ্য ছাড়া তিনি কোনোভাবে কিছু লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন না। এমনও হতে পারে নবি মৌখিকভাবে কারো নাম উল্লেখ করলে তা হয়তো ওমর, আবু বকর এবং তাঁদের সহযোগীরা বিরোধিতা করে বসতেন। ফলে নবির জীবদ্দশাতেই ইসলামের অনেক ক্ষতি হয়ে যেত। নবি তাঁর জীবদ্দশায় যে অপরিসীম সমানের অধিকারী হয়েছিলেন তাতে তিনি ইচ্ছামাফিক যেকোনো সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিছুদিন পূর্বে নবি ওসামা বিন জায়েদকে সেনাপতি নিয়োগ দেয়ায় অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হন। কিন্তু তিনি তীব্র তিরস্কারের সাথে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু মুহাম্মদের মৃত্যুর পর এ-বিষয় অন্যদিকে মোড় নেয়। তাঁর অবর্তমানে কার ক্ষমতা ছিল যে গোত্রে- গোত্রে শক্ৰতার অবসান ঘটাতে পারেন? কে নেতৃত্ব ও ধনদৌলতের প্রতি লোভ লালসার সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম ছিলেন? এক ইসলামি সমাজ গড়া ছিল নবির মুখ্য উদ্দেশ্য। নবি যে এত কষ্ট করে নতুন ইসলামি সমাজের ভিত্তি করলেন সেটার কি হবে? আরবরা কি আবার তাদের পরস্পর দীর্ঘকালব্যাপী হানাহানি ও খুনোখুনিতে মেতে উঠবে? নবির মনে হয়তো এ-ধরনের অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই তিনি শুধুমাত্র তাঁর ঘরে যারা ছিলেন তাদেরকে চলে যেতে বলে চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন। এছাড়া আরও অন্যান্য কারণও হয়তো থাকতে পারে, যার জন্য নবি তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী মনোনীত করেননি।
আলির যে অনেক গুণ ছিল তা তাঁর শক্রমিত্র উভয়েই একমত। আলি জীবনে কখনো মূর্তিপূজা করেননি। এগার বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম প্রচারের প্রথমদিকে ওহুদের যুদ্ধে আলি মুহামদকে মারাত্মক বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। পরিখার যুদ্ধে আমর বিন আবদ ওয়াদকে আলি ধরাশায়ী করেন এবং খায়বার যুদ্ধে নাতাত দুর্গে আক্রমণ করেন। হিজরতের আগে রাতে (নবি ও আবু বকর সে- রাত একসাথে গুহায় কাটান) নিহত হবার আশংকা থাকা পরও নবির বিছানায় আলি শুয়ে ছিলেন। নবির সহচরদের মধ্যে আলিই সবচেয়ে বেশি শক্ৰ হত্যা করেছেন। নবির উদাহরণ পালনে অসীম সাহসিকতা, অকপটতা, বাকপটুতা ও নির্ভুলতায় আলি সবার প্রশংসা অর্জন করেছেন। মুহাম্মদের নিজস্ব গোত্র হাশেমিদের কাছে আলি ছিলেন সম্মানিত ব্যক্তি। আলির এতো গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন মুহাম্মদের সহচরদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। এমন- কী তিনি ছিলেন মুহাম্মদের চাচাতো ভাই ও জামাতা (নবি তনয়া ফাতেমার স্বামী) । মুহাম্মদ হয়তো ভেবেছিলেন আলিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলে আত্মীয়পোষণের অভিযোগ আসতে পারে। ফলে আন্তঃগোত্রীয় ঈর্ষার জন্ম হতে পারে যা মুসলিম সমাজের জন্য ক্ষতিকর হবে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে আলির অনন্য-সব গুণাবলী হয়তো নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় তাঁর অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। অপরিসীম উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিদের শাসন করতে দরকার স্থৈর্য, আত্মসংবরণ, এবং মধ্যপন্থী মানসিকতা। নিচুপদের লোকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি মনোযোগ দেয়াও একান্ত কর্তব্য। নবি মুহাম্মদের মাঝে এই গুণাবলী যথেষ্ট ছিল। মক্কা বিজয়ের পর সামান্য কয়েকজন ছাড়া নবি তাঁর বিপক্ষের, সে যতই একগুঁয়ে অথবা জেদি হোক, কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেননি। হাওয়াজেন গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অর্জিত গনিমতের সকল মাল নবি কুরাইশ নেতাদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। কিন্তু এ- ব্যাপারে আলি ছিলেন অনমনীয়। যে দাবিগুলি তিনি অন্যায্য মনে করতেন তিনি সেগুলিকে কোনোদিন বিবেচনায় আনতেন না। হিজরি ১০ (৬৩১- ২ খ্রিস্টাব্দ) সালে আলি ইয়েমেনে এক সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তাঁর সৈন্যরা দাবি করেন যুদ্ধে পাওয়া গনিমতের মাল তাদেরকে সাথে সাথে ওই স্থানেই বিতরণ করে দিতে হবে। কিন্তু আলি তাদের এই দাবি অগ্রাহ্য করে সকল মাল নবির কাছে জমা করলেন। পরে নবি ওই যুদ্ধে লব্ধ মাল সকলের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতরণ করে দিলেন। সৈন্যরা আলির বিরুদ্ধে নালিশ করলে নবি আলিকে সকল অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দিলেন। উসমানের খলিফা হবার সময় উবায়দুল্লাহ বিন ওমর হত্যা করেন হরমুজানকে (এক ইরানি সেনাপতি, তাঁকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে মদিনাতে আনা হয় এবং পরে একজন উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়) । উবায়দুল্লাহ সন্দেহ করেছিলেন যে তাঁর পিতা সাবেক খলিফা ওমরের হত্যাকাণ্ডের সাথে হরমুজান জড়িত”। হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হলে উসমান আলির সাথে পরামর্শ করেন। আলি সাথে সাথে উত্তর দিলেন, ইসলামি আইন অনুযায়ী উবায়দুল্লাহকে এই হত্যার বদলা দিতে হবে। অর্থাৎ উবায়দুল্লাহর সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড। উসমান আলির পরামর্শ মানেননি। উবায়দুল্লাহ ছিলেন খলিফা ওমরের দ্বিতীয় পুত্র। উসমান ওমরের এই দ্বিতীয় পুত্রের জীবনরক্ষা করলেন। উবায়দুল্লাহকে দিতে হল হত্যার খেসারত-অর্থাৎ রক্তের মূল্য। এরপর উসমান উবায়দুল্লাহকে ইরাকে পাঠিয়ে দিলেন।
নবি খুব ভাল করেই আলির সদগুণের সাথে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও নবি জানতেন যে আলি কোনো কিছুকে সঠিক মনে করলে সেই ব্যাপারে আপোষহীন থাকতেন। স্বাভাবিকভাবে আলির এই আদর্শবান চরিত্র প্রশংসনীয়। কিন্তু এটা সত্যি অনেক ব্যক্তি ধর্মের লেবাস পরলেও ধনদৌলতের লোভ সামলাতে পারেননি। তাই বাস্তবতা যাচাইয়ে আলির এই আপোষহীন মানসিকতা যথাযোগ্য নয়। আলি যদি নেতৃত্ব নেন তবে এ- সকল লোভী ব্যক্তিরা বিপদ পড়বেন। তাতে সমগ্র মুসলিম সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে এবং ইসলামের লক্ষ অর্জন করা যাবে না। নবি এ-বিষয়টিতেও সজাগ ছিলেন। আলির রাজত্বকাল ছিল স্বল্পসময়, হিজরি ৩৫, ১৮ জিলহজ থেকে হিজরি ৪০, ১৭ রমজান ( ১৭ জুন ৬৫৬- ২৪ জানুয়ারি ৬৬১) পর্যন্ত। এই সময় যারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাঁরা প্রমাদ গোনেন। যারা পাপের পথে চলেছিলেন, আলি তাদের সাথে কোনো সমঝোতায় আসতে অস্বীকার করলেন। এমন কী খুব অল্প সময়ের জন্যেও আলি তাদেরকে ছাড় দিতে চাইলেন না। আলির এই অনমনীয় মনোভাবের জন্য সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়ার সাথে বিরোধ দেখা দেয়। তালহা এবং জুবায়ের ছিলেন নবির সহচরদের মধ্যে অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ দুই সাহাবি। নবির এই দুই সাহাবিও আলির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিলেন।
সব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে, নবি তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়োগ করার আগেই মারা যান। নবির এই সিদ্ধান্ত তাঁর প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতারই প্রমাণ করে। অনেক চিন্তাভাবনা করে নবি হয়ত শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ক্ষমতার লড়াইয়ে মুসলিম সমাজকে বিভক্ত করা সঠিক হবে না। এই ক্ষমতার লড়াই প্রকৃতির নিয়ম মাফিক চলুক-নবি তাই চাইলেন। এই নিয়মে যে সবচাইতে বলবান সেই টিকে থাকবে, যাতে করে ইসলামও বেঁচে থাকবে।
এ- ঘটনার সাথে আধুনিককালের একটি ঘটনার মিল পাওয়া যায়। রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিন অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় উপস্থিত হতে পারলেন না। তাই তাঁর বিছানা থেকে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিকে একটা চিঠি পাঠান। সেই চিঠিকে বলা হয় লেনিনের জবানবন্দি। চিঠিতে লেনিন সোভিয়েত বলশেভিক দলের দুই প্রখ্যাত সদস্যের প্রশংসা করলেন। এ-দুই ব্যক্তি ছিলেন স্টালিন এবং ট্রটস্কি। লেনিন লিখলেন এই দুই ব্যক্তি নতুন সরকারের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু লেনিন এও আশঙ্কা করলেন যে ভবিষ্যতে দুজনের মাঝে বিরোধ ঘটতে পারে। লেনিন পত্রে এই দুজনের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার দিকগুলোও তুলে ধরলেন। কিন্তু উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ব্যাপারে চুপ থাকলেন। মনে হয় লেনিনও চাইলেন যে প্রকৃতির নিয়মমাফিক যে যোগ্যতম ব্যক্তি সে-ই বিজয়ী হবে।
ইসলামের পূর্বে আরবরা তাদের নিজ নিজ গোত্র, বংশ অথবা বংশবৃত্তান্ত নিয়ে বড়াই করতেন। তাদের এই দাম্ভিকতার মূলে তাদের কোনো নৈতিক উৎকর্ষতা বা আচরণের সাধারণ মাধুর্য ছিল না। বরং তাদের গর্ব প্রকাশ পেত হত্যাকাণ্ডে শৌর্য দেখানো, লুটতরাজ এবং অন্য গোত্রের নারী অপহরণের মধ্যে। ইসলাম আরবদের এই অসভ্যতার মূলে আঘাত হানে এবং কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধাৰ্মিকতাকেই প্রাধান্য দেয়। কিন্তু ইসলামের এই নতুন মানদণ্ড বেশিদিন থাকল না। সত্যি বলতে হিজরি ২৩ (৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে খলিফা ওমরের মৃত্যুর পর ইসলামের নৈতিকতার মানদণ্ডে ফাটল ধরে। উসমানের সময় ধাৰ্মিকতার স্থলে আত্মীয়পোষণ প্রাধান্য পেল। আবুজর গিফারির” এবং আমার বিন ইয়াসিরদের মতো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা পেছনে পড়ে রইলেন। এ- স্থানে উসমানের গোত্রের লোকেরা, যেমন মুয়াবিয়া বিন সুফিয়ান এবং হাকাম বিন আবুল আসারা পেলেন শাসনকর্তার পদ।
ইসলামের সবচেয়ে উজ্জ্বল নীতি ছিল মহত্ত্ব এবং ধাৰ্মিকতা। উমাইয়া খেলাফতের সময় (হিজরি ৪১- ১৩২ বা ৬৬১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামের এই নীতিগুলিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়। এর স্থলে প্রাধান্য পায় গোত্র ও জাতিগত দাম্ভিকতা। এই দম্ভ আরও ব্যাপকতা লাভ করে ক্রমে। ফলে শুরু হয় আরব জাতীয়তাবাদের দাবি মেটানোর পালা। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় বিজিত জাতি পদানত করে এবং তাদের সম্পদ হরণ করে।
আরবের উষর মরুভূমির বেদুইনরা আক্রমণ শুরু করেন সভ্যজগতের বিশাল এলাকা। মরুভূমির বেদুইনরা দখল করে নিলো সভ্যজগতের শাসন ক্ষমতা এবং হরণ করে এইসব বিজিত দেশগুলির বিশাল ধনসম্পদ। ক্ষমতা- মদমত্ততার দেশগুলিকে নিকৃষ্ট জাতি হিসাবে গণ্য করতে লাগল। আরবরা বিজিত দেশগুলোর জনতাকে অপরিসীম ঘৃণার চোখে দেখল। কখনো তাদেরকে আরবদের সমকক্ষ মনে করত না। এমনকি বিজিত দেশের যারা ইসলাম গ্রহণ করে আরবরা তাদেরকে পর্যন্ত ইসলামের যে সার্বজনীন সৌভ্রাতৃত্বের নীতি আছে তা থেকে বঞ্চিত করল।
কথিত আছে, এক ইরানি মুসলমান হয়ে আরব গোত্র বানু সুলায়ম গোত্রের আশ্রিত হন। সেই ইরানি বানু সুলায়ম গোত্রের এক মহিলাকেও বিবাহ করেন। এ- সংবাদ শোনার পর ওই গোত্রের একজন, মুহামদ বিন বশির মদিনাতে গিয়ে শাসনকর্তা ইব্রাহিম বিন হিশাম বিন আল মুগিরার কাছে ইরানির বিরুদ্ধে নালিশ করেন। মদিনার শাসক এক প্রতিনিধি পাঠালেন। সেই প্রতিনিধি ইরানিকে দুইশত বেত্ৰাঘাত করে মস্তক, মুখ ও ভ্রমুণ্ডণ করে দিল। তারপর ইরানিকে জোরপূর্বক তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া হল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুহামদ বিন বশির এক গীতিকবিতা রচনা করেন। গীতিকবিতাটি কিতাব আল- আগানি’ ( Kerab ০LAghani গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। সেই গীতিকাব্যের কয়েকটি লাইন এখানে অনুবাদ করে দেয়া হল :
আপনি কোনো বিদেশির কাছ হতে শাসন ক্ষমতা পাননি।
এই জন্য ওই আশ্ৰিত অনারব পেল দুইশত বেত্ৰাঘাত
এবং তার মাথা মুণ্ডন করা হল।
এই হচ্ছে তার দৃষ্ট্রক্তমূলক শক্তি।
তাদের জন্যে রয়েছে খসরুর কন্যার?
এর পরেও কি ওই আশ্রিত বেশি পেতে চায়?
এই আশ্ৰিতের জন্য কি আছে?
ক্রীতদাসের সাথে ক্রীতদাসীর বিবাহ হয়।
আব্দুল্লাহ বিন কুতায়বা লিখিত ‘আইন আকবর’ গ্রন্থ থেকে আরও একটা তথ্য জানা যায় : এক আরব কাজির কাছে গিয়ে বলেন : “আমার পিতা মারা গেছেন। তাঁর উইলে লেখা আছে তাঁর সম্পত্তি আমার ভ্রাতা, আমার মাতা, আমি এবং এক হাজুন, আমাকে জানান কে কী পরিমাণ সম্পত্তি পাবেন? ( হাজুন একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে ইতর। তৎকালীন সময়ে কোনো অনারব মহিলার গর্ভের সন্তান বোঝাতে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হত) । কাজি উত্তর দিলেন : এখানে কোনো সমস্যা নাই। প্রত্যেকে পাবে এক তৃতীয়াংশ। আরব ব্যক্তি বললঃ আপনি আমাদের সমস্যা বুঝেননি। আমরা দুই ভাই এবং একজন হাজুন। কাজি উত্তর দিলেন: সম্পত্তিতে প্রত্যেকের সমান অধিকার আছে। আরব ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন: এক হাজুন কেমন করে আমাদের সমান হয়?’ কাজি বললেন:
‘এ আল্লাহর আদেশ। ’
ইসলামের অতীত শতাব্দী থেকে এ- ধরনের শতশত উদাহরণ পাওয়া যায়। এই উদাহরণগুলি প্রমাণ করে ক্ষমতা দখল ও অন্য জাতির উপর প্রাধান্য বিস্তারের প্রয়োজনে ইসলামকে ব্যবহার করা হয়েছে। কোরানে যেসব ক্ষমাশীল এবং দয়াপূর্ণ আয়াত আছে সেগুলি কোনোদিন মেনে চলার ব্যবস্থা করা হয়নি। পৌত্তলিক আরবে যেভাবে আরবেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ দেখাতেন সেই মানসিকতারই নিশ্চয়তা পাওয়া গেল এ-যুগেও। তথাপি অনারব মুসলিমরা ইসলামের মহান শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত থাকেন। তাঁরা সারণ করেন কোরানের এই আয়াতটি তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি সাবধানি। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সুরা হুজুরাত আয়াত ১৩) । আরবদের দাম্ভিক আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইরানে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন। জাতীয়তাবাদী- ঘরানার এ গণআন্দোলনকে বলা হয় ‘শোবিয়া আন্দোলন। এ ধরনের আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন থাকত না, যদি নবি মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ যে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং যে ইসলামের পথ ধরে আবু বকর, ওমর এবং আলি চলেছিলেন, সেই ইসলামের ধারা অব্যাহত থাকত।