বিনয় কুমার সরকার : দ্বন্দ্ব ও “শক্তিযোগ”
কোনো আন্দোলনের প্রভাবে ক’জন স্মরণীয় মানুষ সৃষ্টি হয়েছে সেটা যদি তার ঐতিহাসিক মূল্য বিচারে বিবেচ্য হয় তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯০৫ সালের আন্দোলনের মতো উল্লেখযোগ্য ঘটনা বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাঙালির মনে ঐ সালটিতে যে মন্থন সৃষ্টি হয়েছিল তার ভিতর থেকে উঠে এসেছিলেন অরবিন্দ ও মানবেন্দ্রনাথের মতো অসাধারণ মানুষ। বিনয় সরকারও ঐ সালটিকে ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে একটি পরম মুহূর্ত বলে মেনে নিয়েছিলেন। এই অর্থে তাঁকে ১৯০৫-এর যুগসন্তান বলা চলে।
মানবেন্দ্রনাথ রায় ও বিনয়কুমার সরকার উভয়ের জন্ম ১৮৮৭ সালে। অর্থাৎ দু’জনেরই জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে অতিসম্প্রতি। মানবেন্দ্রনাথ বিষয়ে অন্যত্র লিখেছি। এখানে প্রসঙ্গ বিনয়কুমার।
বিনয় সরকারের বিদ্যার পরিধি ছিল অসামান্য। তাঁর তুল্য পণ্ডিতব্যক্তি সহসা চোখে। পড়ে না। এদেশে যাঁরা পাঠ্যপুস্তক ও নোটবই লিখে হাত পাকিয়েছেন অথবা ধার করা মতবাদের ব্যাখ্যা ও ভাষা রচনায় অভ্যস্ত হয়েছেন, বিনয় সরকারের চিন্তার প্রচণ্ড উচ্ছলতা তাঁদের কাছে অনেক সময় অস্বস্তির কারণ হয়েছে। তাঁর ভাষা আমাদের সাধু লেখকদের। আ কায়দা মেনে চলত না, তাঁর চিন্তাও গতানুগতিকতার বাধ্য নয়। অতএব এদেশীয় সমাজে বিনয় সরকার বিদ্বান হয়েও সর্বত্র পৃজিত ছিলেন না।
বিদেশের পণ্ডিত সমাজে কিন্তু তিনি আশ্চর্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এর কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি। The Sociology of Races, Cultures and Human Progress নামে তাঁর গ্রন্থটি আলোচনা করতে গিয়ে জমান সমালোচক লিখেছেন ‘Professor Sarkar reminds us in many ways of our Oswald Spengler on account of starilingly manysided erudition and flexibility with which his scholarship traverses in a powerful manner all the regions and epochs of human culture.’ সময়ে জমানিতে স্পেঙ্গলারের খ্যাতি ছিল অসামান্য। এই দুই পণ্ডিতের তুলনার ভিতর দিয়ে বিনয় সরকারের প্রতি জমান সমালোচকের বিপুল শ্রদ্ধাই যে প্রকাশ পেয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
আবার The Positive Background of Hindu Sociology নামে পুস্তকটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ফরাসী সমালোচক বলেছেন “Dr. Benoy Kumar Sarkar, well-known in all the countries of Europe as one of the best representatives of modern Indian thought in the fields of sociology and education, is veritably an encyclopaedic spirit.’ এখানেও মনে রাখতে হবে যে, ফরাসী চিন্তা ও পাণ্ডিত্যের ইতিহাসে encyclopedia শব্দটি একটি বিশেষ অনরণন সৃষ্টি করে। বস্তুত ইউরোপ ও আমেরিকায় বিনয় সরকার পণ্ডিত হিসেবে যে খ্যাতি লাভ করেছিলেন এ দেশে তার তুলনা সহজে পাওয়া যাবে না। একাধিক ইউরোপীয় ভাষায় তিনি স্বচ্ছন্দে বক্তৃতা করতে পারতেন। আর তাঁর চিন্তার ক্ষেত্রটি অনায়াসে প্রসারিত ছিল বিশ্বময়।
এ আমার সৌভাগ্য যে আমি একদা সরকার মহাশয়ের ছাত্র ছিলাম এবং তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যখন আমি পড়াতে শুরু করি তখনও সাময়িকভাবে তিনিই বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি বিদেশে যাত্রা করেন। সেখানেই অল্পকালের ভিতর ১৯৪৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এইভাবে জীবনের শেষ পর্যায়ে কয়েক বছর তাঁকে কাছে থেকে দেখবার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনার আগে ব্যক্তি মানুষটির একটু পরিচয় দিয়ে নেব।
ছাত্র হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার কথাই প্রথমে বলব। অধ্যাপক সরকার আমাদের এমন একটি বস্তু শেখাতে চেষ্টা করে গেছেন এদেশে যার একান্ত অভাব। তাঁর পড়ানোর ধরনটাই ছিল অন্যরকম। তিনি অল্প কথা নিপুণভাবে গুছিয়ে বলতে পারতেন না, অথবা সে চেষ্টাই করতেন না। ক্লাসে যা তিনি বলতেন তা যথাযথ টুকে নিলে ভালো ‘নোট’ তৈরি হত না। আমাদের মনকে প্রবলভাবে নাড়া দেওয়াটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। চিন্তার ক্ষেত্রেও যে সাহস বলে একটা বস্তু আছে, সাহসী হওয়া যে প্রয়োজন, একথাটা এমনভাবে অন্য কোনো অধ্যাপকের কাছে পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। তাঁর মতামতের সমালোচনা করতেই তিনি আমাদের উৎসাহিত করতেন, সেই সমালোচনা দুর্বল হলে তিনি তা পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন আমরা যেন খুব জোরের সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে নির্ভয়ে বলি।
১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াতে শুরু করি। তখন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে বিনয় সরকারের আচরণ উল্লেখযোগ্য! একটি উদাহরণ দিচ্ছি। একদিন দেখি অধ্যাপক। সরকার আমার ক্লাসে শেষ বেঞ্চিতে বসে আছেন। পুরো ঘণ্টাটাই তিনি ক্লাসে ছিলেন। আমার পড়ানো নিয়ে পরে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও অধ্যাপক সরকার। তরুণদের সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতেন যেটা সব দেশেই দুর্লভ, বিশেষত এদেশে।
অধ্যাপক সরকারের ভাবনাচিন্তা নিয়ে এবার সংক্ষেপে দুএক কথা বলা যেতে পারে। Weltanschauung শব্দটি তিনি খুব ব্যবহার করতেন। তাঁর বিশ্বদৃষ্টি একাধিক গ্রন্থে বহু পৃষ্ঠা জুড়ে বিবৃত হয়েছে। The Sociology of Races, Culturs and Human Progress গ্রন্থটির কথা আগেই বলেছি। বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির ভিতর দ্বন্দ্ব এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন ‘Eur-America had been challenging Asia for about a century. It was not possible for Asia to accept that challenge for a long time. It is only so late as 1905 in the event at Port Arthur that Eur-America has learned how at last Asia intends to retaliate. Naturally the challenge is twofold: political and cultural. … The reply from Asia is accordingly being offered in two fields of revolt: military and scientific.’ শিয়ার পুনরভ্যুত্থানকেই বিনয় সরকার তাঁর বিশ্বদর্শনে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন মূলত শক্তির উপাসক। তাঁর মতে মানুষের প্রবলতম প্রবৃত্তি হল আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে মানুষ পুরনো ঐতিহ্য ভাঙে, নতুন সংস্কৃতি স্থাপন করে। ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে এক জাতির ভাষা ও ভাবনা অন্য জাতির ভাষা ও ভাবনার ভিতর প্রবেশ করে, সংস্কৃতির ঘটে রূপান্তর। এই প্রক্রিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী চলেছে। এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে যেমন ভারতে তেমনি সারা বিশ্বে। বিশুদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতীয় সংস্কৃতির কল্পনা অবান্তর। একদিকে দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার সংগ্রাম, অন্য দিকে পারস্পরিক দান-প্রতিদান, দুই-ই সত্য।
বিনয় সরকার দেশবাসীর সামনে এই কথাটা জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছেন, আমাদের শক্তিশালী হতে হবে আর শক্তিশালী হবার জন্যই অন্যের কাছ থেকে যা-কিছু প্রয়োজন গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীকে বুঝতে হবে, জাগতিক পরিস্থিতিকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিতর পার্থক্য টেনে যাঁরা বলেন যে, ভারতবাসী আত্মায় বিশ্বাসী আর পশ্চিমের মানুষ জড়বাদী অথবা ভোগবাদে বিশ্বাসী, বিনয় সরকার তাঁদের সেই ধারণা ভ্রান্ত বলে অগ্রাহ্য করেছেন। এইখানেই ভারতীয় ঐতিহ্যের বহু প্রবক্তার সঙ্গে তাঁর প্রভেদ। তিনি বলতেন, সব দেশের মানুষই দেহ ও আত্মা দুয়েতেই বিশ্বাসী। ঐহিক চিন্তা প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির একটা প্রধান অংশ ছিল, একথা তিনি বারবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। এদেশের প্রাচীন ইতিহাসে বৃহত্তর ভারত প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা ও সামরিক অভিযানের ভিতর প্রাণশক্তির উল্লেখযোগ্য প্রকাশকে তিনি অভিনন্দন জানাতে ইতস্তত করেননি। অত্যন্ত জাগতিক অর্থেই “চরৈবেতি” কথাটি তাঁর প্রিয় ছিল।
বিনয় সরকারের দর্শনে রাজসিকতার প্রাধান্য লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন “Two master passions have made man here there and everywhere both in the East and the West. These are, first, love, and second war, or first, war and second love.” এই জীবনদর্শন অসম্পূর্ণ মনে হতে পারে, এর অপব্যাখ্যা নিশ্চয়ই সম্ভব। তবু এই তামসিকতার দেশে একজন রাজসিক পণ্ডিতের প্রয়োজন ছিল।
(খ)
বিনয় কুমার সরকারের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর ভাবনাচিন্তা নিয়ে নতুন করে কিছুটা আলোচনা ও বিতণ্ডা শুরু হয়েছে। নিজের মতামত তিনি খুব জোরের সঙ্গে বলতে ভালোবাসতেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জীবৎকালে কিছু তর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই পুরনো সমালোচনা আজ আবারও মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে।
বিনয় সরকারের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ, তিনি নাকি মতামতের ক্ষেত্রে ফাঁসিস্তপন্থী ছিলেন। অভিযোগটি অন্যায়। যারা ফাঁসিস্ত তারা পর মত সম্বন্ধে অসহিষ্ণু হয়। ভিন্ন মত সম্বন্ধে যারা অসহিষ্ণু নয় তাদের ফাঁসিস্ত বলে চিন্তিত করবার অর্থ হয় না। বিনয় সরকার নিজের মতামত জোরের সঙ্গে বলতেন, কিন্তু ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন বিপরীত মতটাও প্রবলভাবে বলতে। তিনি ছিলেন চিন্তার ক্ষেত্রে বহুত্ববাদী। এর পর তাঁকে। ফাঁসিস্ত বলা যায় কী করে? অধ্যাপক সরকার ছাত্রদের ভিতর মতবাদের ঐক্য চাইতেন না, যুক্তিতর্কের ভিতর নিয়ে নিজ নিজ মত বলবার সাহসটাই ছিল তাঁর কাছে মূল্যবান। দ্বন্দ্বেরর ভিতর দিয়ে প্রগতি ঘটে; সকলক্ষেত্রেই, মতবাদের ক্ষেত্রেও, এইরকম তিনি বিশ্বাস করতেন। যাঁরা শিক্ষার ক্ষেত্রে আজ কর্তব্যে নিযুক্ত তাঁরা এই গুণটি অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকারের কাছ থেকে শিখে নিতে পারলে ভালো হয়।
ঐ অভিযোগ তবে বিনয় সরকারের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছিল কেন? শেষ পর্যন্ত অভিযোটা দাঁড়ায় না, তবু তার কিছু কারণ অবশ্য ছিল। বিনয় সরকার ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের সন্তান। দেশবিদেশে তিনি অনেক ঘুরেছেন, সারা বিশ্বের জ্ঞানে ছিল তাঁর আগ্রহ। কিন্তু জাতীয়তাবাদ তিনি ত্যাগ করেননি। এইখানে সমবয়স্ক মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর তফাত। বিনয় কুমার ছিলেন এক বিশ্বমুখী জাতীয়তাবাদী। “স্বদেশসেবকের পক্ষে চাই বিশ্বদক্ষতা”, এই ছিল তাঁর বক্তব্য। সেই সঙ্গে আরো একটা কথা মনে রাখতে হবে। তাঁর চিন্তাভাবনায় শক্তিযোগের একটা বড় স্থান ছিল। সে যুগে যারা ফাঁসিস্ত বলে পরিচিত হয়েছিল তাদের ভিতরও পাওয়া যায় জাতীয়তাবাদ ও কোনো একটা-অর্থে শক্তি অথবা সংঘবদ্ধ ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ। শুধু ইয়োরোপে নয়, তৎকালীন এশিয়াতেও ঐ যোগাযোগটা চোখে পড়ে, বিশেষভাবে উঠতি শক্তি জাপানের মধ্যে। বিনয় সরকার জাপানকে বাহবা দিয়েছেন। এইরকম কিছু কারণে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বিপজ্জনক মনে
আসলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী কোনো প্রচলিত মতবাদের সঙ্গেই পুরোপুরি মেলে না। ফাঁসিস্তপন্থীরা ছিল জাতীয় শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাসী, নিজ জাতির শ্রেষ্ঠতা নিয়ে অহংকৃত। এ ব্যাপারে বিনয় সরকারের ঝোঁকটা লক্ষ করবার যোগ্য। স্বদেশে তিনি ছিলেন সবচেয়ে হীনজাতি বা পারিয়ার বন্ধু ও গুণগ্রাহী। যারা অশিক্ষিত, সমাজের নীচুতলায় যাদের বাস, তাদের ভিতরও যে মনুষ্যত্বের অভাব নেই, তারাও যে নীতির দিক থেকে মানুষের মর্যাদার অধিকারী, এই কথাটা তিনি বারবার নানাভাবে বলেছেন। আর ভারতীয় সংস্কৃতির জন্য তিনি চেয়েছেন বিশ্বের দরবারে সাম্যের অধিকার–শ্রেষ্ঠত্ব নয়, সাম্য।
ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে পণ্ডিতদের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে বিনয় সরকারের বেশ বড় রকমের অমিল ছিল। সে সময়ে এইরকম একটা ধারণা ক্রমে জোরালো হয়ে উঠেছিল যে, ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে দেখা যায় অধ্যাত্মবাদী ও সংসারবিমুখ দৃষ্টিভঙ্গীর প্রাধান্য, আর পাশ্চাত্য সমাজ ও সংস্কৃতি ভোগবাদী, সংসারনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ। ম্যাক্স মুলার থেকে অ্যানি বেসান্ট ও ভগিনী নিবেদিতা পর্যন্ত অনেকেই প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে বৈপরীত্যের এই তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, এ দেশীয় অনেক পণ্ডিতেরও এতে বিশ্বাস ছিল। বিনয় কুমার তরুণ বয়সে যদি-বা এই তত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তবু সেই আকর্ষণ টেকেনি। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নিয়ে ১৯১১ সালের পর গবেষণার ফলে স্বদেশের অন্য এক ভাবমূর্তি তাঁর সামনে আকার গ্রহণ করে। “ভারতবর্ষ ততখানি বস্তুনিষ্ঠ, ততখানি যুদ্ধপ্রিয়, ততখানি শক্তিয়োগী, ততখানি সাম্রাজ্যবাদী–যতখানি ইওরোপ। আবার ইওরোপ ততখানি নীতিনিষ্ঠ ও অধ্যাত্মবাদী–যতখানি ভারতবর্ষ। “ খুব জোরের সঙ্গে এই কথাটা বলে তিনি প্রচলিত ধারণাকে ধাক্কা দিয়েছিলেন।
এখানেও আবার বিনয় সরকারের মতবাদের কিছুটা ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন যে, বিনয় কুমার প্রথমে ছিলেন ভাববাদী, পরে বস্তুবাদী হয়ে ওঠেন। ঐভাবে দেখলে কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি সুবিচার করা হয় না।
তরুণ বয়সে বিনয় সরকারের ওপর বিবেকানন্দের প্রভাব পড়েছিল। সেই প্রভাব একেবারে ক্ষয় হয়ে যায়নি কখনো। জাতীয়তাবাদ ত্যাগ না করে একরকমের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্বদৃষ্টির সঙ্গে তিনি বিবেকানন্দকে মেলাতে চেয়েছিলেন, অধ্যাপক সরকারের চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য এইখানে। বিবেকানন্দের চিন্তা ও চারিত্রের ভিতর যে-জিনিসটা বিনয় কুমার মূলবস্তু বলে গ্রহণ করেছিলেন সেটা এই অবসরে একার দেখে নেওয়া যাক। “The key to Vivekananda’s entire life… is to be found in his sakti-yoga, energism, the vigour and strength of freedom.” এই যে “শক্তিয়োগ”, অধীনতা ত্যাগ করে স্বাধীন হবার চেষ্টা, বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, এটাকে বিনয় সরকার চিনে নিয়েছিলেন মানবপ্রকৃতির এক মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে। শুধু প্রাচ্যের মানুষ বা পাশ্চাত্যের মানুষ নয়, সব মানুষেরই এই বৈশিষ্ট্য। এই শক্তির সাধনা জীবনের কোনো একটা প্রকোষ্ঠে সীমাবদ্ধ নয়, সর্বত্র সেটা ছড়িয়ে পড়তে চায়। আর শক্তির সাধনাই হল বিনয় সরকারী দৃষ্টিতে মানুষের অধ্যাত্মসাধনা। মানুষ যখন সংসারে নিযুক্ত, অর্থ যেখানে তার কাম্য, তখনও যদি সে ভয়ের জড়ত্ব ত্যাগ করে, বীরের মতো সংগ্রাম করে, তবে সেটা তার আধ্যাত্মিকতারই প্রকাশ।
বিনয় সরকার তাই বলছেন, “মানুষকে জীবনের ক্ষেত্রে বাড়াইয়া তুলিতে যে পারে সেই বড় লোক, মহাপুরুষ, পরমহংস।” আবার বলছেন, “আমার বিবেচনায় মানুষের সবকিছুই আধ্যাত্মিক।…ধনবিজ্ঞান আমার মেজাজে আধ্যাত্মিক বিদ্যা।” মানুষ যে-পরিমাণে জড়জগতের অধীন সে পরিমাণেই মানবিক পরিস্থিতির জড়বাদী ব্যাখ্যা যথার্থ প্রযোজ্য; কিন্তু যে পরিমাণে সে সচেতনভাবে জড়জগতের ওপর নিজের শক্তি ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী সেই পরিমাণে মানুষ উদ্যোগী বলেই আধ্যাত্মিকও বটে! বিনয় সরকারের মতবাদ আমরা গ্রহণ করি বা না করি, সেটাকে এক কথায় ভাববাদী, বা জড়বাদী। কখনই বলা যাবে না।
বিনয় কুমার বুঝেছিলেন যে, প্রাচ্যের মানুষকে আধ্যাত্মিক কিন্তু সংসারবিমুখ বলার ভিতর একটা বিপদ আছে। এতে করে সংসারের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের আধিপত্যই স্বাভাবিক, এমন কি ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নিতে হয়। বিনয় সরকার দেখাতে চেয়েছিলেন যে, প্রাচ্যের তৎকালীন অধীন অবস্থা একটা সামাজিক ঘটনা, এর কারণ খুঁজতে হবে পরিবর্তনশীল বিশ্বপরিস্থিতির ভিতর, প্রাচ্যের কোনো চিরস্থায়ী সংসারবিমুখতার ভিতর নয়। তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ভারতের সেই ভাবমূর্তি যেটা সংসারের দ্বন্দ্বে দেশকে দেবে এগিয়ে যাবার শক্তি ও প্রেরণা।
অন্যান্য বহু মতবাদের মতোই বিনয় কুমার সরকারের ধ্যানধারণা গঠিত হয়েছে কিছু সাময়িক লক্ষ্যের প্রভাবে, প্রয়োজনের চাপে। যে-দেশে মানুষ সংসারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। পিছিয়ে পড়েছে সেখানে চাই সংসারমুখী আধ্যাত্মিকতা। এটাই জড়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, অতএব স্বাস্থ্যের লক্ষণ। সমগ্র বিশ্বের সংকটটা আজ কিন্তু পৌঁছে গেছে অন্য এক স্তরে। ভোগবাদ আর যুদ্ধনিষ্ঠা দিয়ে তাকে ঠেকানো যাবে না। আধ্যাত্মিকতারও অন্য। স্তর আছে। এসব কিছু বিনয় সরকারের চিন্তায় অস্বীকৃত নয়। কিন্তু তিনি হতে চেয়েছিলেন বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যনিষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী। ভবিষ্যতের কোনো কল্পচিত্র তাঁর ধ্যানধারণায় বিশিষ্ট স্থান লাভ করেনি। মার্ক্স কিংবা অরবিন্দের সঙ্গে এইখানে তাঁর উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। শক্তিয়োগী তবু বহুত্ববাদী, স্বদেশনিষ্ঠ কিন্তু বিশ্বসচেতন, বস্তুনিষ্ঠ এবং আধ্যাত্মিক,এইসব দ্বন্দ্ব নিয়ে বিনয় কুমার সরকারের চিন্তাধারা।
দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ (১৯৮৯)