৫.১৩ পরিশিষ্ট

কাশীপুরের উদ্যান-বাটী

কলিকাতার উত্তরাংশে যে প্রশস্ত রাস্তাটি প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত বরাহনগরকে বাগবাজার পল্লীর সহিত সংযুক্ত রাখিয়াছে তাহার উপরেই কাশীপুরের উদ্যান-বাটী বিদ্যমান।

বাগবাজার পুলের উত্তর হইতে আরম্ভ করিয়া উক্ত উদ্যানের কিছুদূর দক্ষিণে অবস্থিত কাশীপুরের চৌরাস্তা পর্যন্ত ঐ রাস্তার প্রায় উভয় পার্শ্বেই দরিদ্র মুটেমজুর-শ্রেণীর লোকসমূহের থাকিবার কুটীর এবং তাহাদিগেরই দৈনন্দিন জীবননির্বাহের উপযোগী দ্রব্যসভারপূর্ণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিপণিসকল দেখিতে পাওয়া যায়, উহার মধ্যে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকখানি ইষ্টকালয়-যথা, কয়েকটি পাটের গাঁট বাঁধিবার কুঠি, দাস কোম্পানির লৌহের কারখানা, রেলির কুঠি, দুই-একখানি উদ্যান বা বাসভবন ও কাশীপুরের চৌরাস্তার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত পুলিসের ও অগ্নিভয়নিবার ইঞ্জিনাদি রক্ষার কুঠি এবং উহারই পশ্চিমে অনতিদূরে সর্বমঙ্গলা দেবীর সুপ্রসিদ্ধ মন্দির—যেন মানবদিগের মধ্যে বিষম অবস্থাভেদের সাক্ষ্যপ্রদান করিবার জন্যই দণ্ডায়মান। শিয়ালদহ রেলওয়ের উন্নতি ও বিস্তৃতি হওয়ায় অধুনা আবার উক্ত রাস্তার ধারে অনেকগুলি টিনের ছাদসংযুক্ত গুদাম ইত্যাদি নির্মিত হইয়া কয়েক বৎসর পূর্বে উহার যাহা কিছু সৌন্দর্য ছিল তাহারও অধিকাংশের বিলোপসাধন করিয়াছে। ঐরূপে ঐ প্রাচীন রাস্তাটি নয়নপ্রীতিকর হইলেও ঐতিহাসিকের চক্ষে উহার কিছু মূল্য আছে। কারণ শুনা যায়, এই পথ দিয়া অগ্রসর হইয়াই নবাব সিরাজ গোবিন্দপুরের বৃটিশ দুর্গ অধিকার করিয়াছিলেন এবং বাগবাজার হইতে কিঞ্চিদধিক অৰ্ধ মাইল উত্তরে উহারই একাংশে মসীমুখ নবাব মীর্জাফরের এক প্রাসাদ এককালে অবস্থিত ছিল। ঐরূপে বাগবাজার হইতে কাশীপুরের চৌমাথা পর্যন্ত পথটি মনোদর্শন না হইলেও উহার পর হইতে বরাহনগরের বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত উহার অংশটি দেখিতে মন্দ ছিল না। উক্ত চৌমাথা হইতে উত্তরে স্বল্পদূর অগ্রসর হইলেই মতিঝিলের দক্ষিণাংশ এবং উহার বিপরীতে রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে আমাদিগের পরিচিত মহিমাচরণ চক্রবর্তীর সুন্দর বাসভবন তৎকালে দেখা যাইত। রেল কোম্পানি অধুনা উক্ত বাটীর চতুঃপার্শ্বস্থ উদ্যানের অধিকাংশ ক্রয় করিয়া উহার ভিতর দিয়া রেলের এক শাখা গঙ্গাতীর পর্যন্ত বিস্তৃত করিয়া উহাকে এককালে শ্রীহীন করিয়াছে। ঐস্থান হইতে আরও কিছু দূর উত্তরে অগ্রসর হইলে বামে মতিঝিলের উত্তরাংশ এবং তদ্বিপরীতে রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে কাশীপুর উদ্যানের উচ্চ প্রাচীর ও লৌহময় ফটক নয়নগোচর হয়। মতিঝিলের পশ্চিমাংশের পশ্চিমে অবস্থিত রাস্তার ধারে কয়েকখানি সুন্দর উদ্যানবাটী গঙ্গাতীরে অবস্থিত ছিল, তন্মধ্যে মতিলাল শীলের উদ্যানই—যাহা এখন কলিকাতা ইলেকট্রিক কোম্পানির হস্তগত হইয়া ইতিপূর্বের বিরাম ও সৌন্দর্যের ভাব হারাইয়া কর্ম ও ব্যবসায়ের ব্যস্ততা ও উচ্চ ধ্বনিতে সর্বদা মুখরিত রহিয়াছে—প্রশস্ত ও বিশেষ মনোজ্ঞ ছিল। মতি শীলের উদ্যানের উত্তরে তখন বসাকদিগের একখানি ভগ্ন বাসভবন গঙ্গাতীরে অবস্থিত ছিল। রাস্তা হইতে উক্ত জীর্ণ ভবনে যাইবার যে পথ ছিল তাহার উভয় পার্শ্বে বৃহৎ ঝাউগাছের শ্রেণী বিদ্যমান থাকায় তখন এক অপূৰ্ব্ব শোভা ও দিব্যধ্বনি সর্বদা নয়ন ও শ্রবণের সুখ সম্পাদন করিত। কাশীপুরের উদ্যান-বাটীতে ঠাকুরের নিকটে থাকিবার কালে আমরা উক্ত শীলমহাশয়দিগের উদ্যানে অনেক সময়ে গঙ্গাস্নানার্থ গমন করিতাম এবং ঠাকুর ভালবাসিতেন বলিয়া ঘাটের ধারে অবস্থিত বৃহৎ গুলচি পুষ্পের গাছ হইতে কুসুম চয়ন করিয়া আনিয়া তাঁহাকে উপহার প্রদান করিতাম। অনেক সময় আবার অপূর্ব ঝাউবৃক্ষরাজিশোভিত পথ দিয়া অগ্রসর হইয়া বসাকদিগের জনমানবশূন্য উদ্যানভবনে উপস্থিত হইয়া গঙ্গাতীরে উপবেশন করিয়া থাকিতাম। ঐ উদ্যানের কিঞ্চিৎ উত্তরে প্রাণনাথ চৌধুরীর প্রশস্ত স্নানের ঘাট এবং তদুত্তরে সুপ্রসিদ্ধ লালাবাবুর পত্নী রাণী কাত্যায়নীর বিচিত্র গোপাল-মন্দির। ঐ স্থানেও আমরা কখন কখন স্নান এবং গোপালজীর দর্শন জন্য গমন করিতাম। রাণী কাত্যায়নীর জামাতা গোপালচন্দ্র ঘোষ কাশীপুর উদ্যানবাটীর সত্ত্বাধিকারী ছিলেন। ভক্তগণ তাহারই নিকট হইতে উহা ঠাকুরের বাসের জন্য মাসিক ৮০ টাকা হার নিরূপণ করিয়া প্রথমে ছয় মাসের এবং পরে আরও তিন মাসের অঙ্গীকার পত্র প্রদানে ভাড়া লইয়াছিল। ঠাকুরের পরমভক্ত শিমলাপল্লী নিবাসী সুরেন্দ্রনাথ মিত্রই উক্ত অঙ্গীকারপত্রে সহি করিয়া ঐ ব্যয়ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন।

বৃহৎ না হইলেও কাশীপুরের উদ্যান-বাটি বেশ রমণীয়। পরিমাণে উহা চৌদ্দ বিঘা আন্দাজ হইবে। উত্তর-দক্ষিণে অপেক্ষা ঐ চতুষ্কোণ ভূমির প্রসার পূর্ব-পশ্চিমে কিছু অধিক ছিল এবং উহার চতুর্দিক উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত ছিল। উদ্যানের উত্তর সীমার প্রায় মধ্যভাগে প্রাচীরসংলগ্ন পাশাপাশি তিন চারিখানি ছোট ছোট কুঠরি রন্ধন ও ভাঁড়ারের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। ঐ ঘরগুলির সম্মুখে উদ্যানপথের অপর পার্শ্বে একখানি দ্বিতল বাসবাটী; উহার নীচে চারখানি এবং উপরে দুইখানি ঘর ছিল। নিম্নের ঘরগুলির ভিতর মধ্যভাগের ঘরখানিই প্রশস্ত হলের ন্যায় ছিল। উহার উত্তরে পাশাপাশি দুইখানি ছোট ঘর, তন্মধ্যে পশ্চিমের ঘরখানি হইতে কাষ্ঠনির্মিত সোপানপরম্পরায় দ্বিতলে উঠা যাইত এবং পূর্বের ঘরখানি শ্ৰীশ্ৰীমাতাঠাকুরাণীর জন্য নির্দিষ্ট ছিল। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত পূর্বোক্ত প্রশস্ত হলঘর ও তাহার দক্ষিণের ঘরখানি—যাহার পূর্বদিকে একটি ক্ষুদ্র বারাণ্ডা ছিল—সেবক ও ভক্তগণের শয়ন উপবেশনাদির নিমিত্ত ব্যবহৃত হইত। নিম্নের হলঘরখানির উপরে দ্বিতলে সমপরিসর একখানি ঘর, উহাতেই ঠাকুর থাকিতেন। উহার দক্ষিণে প্রাচীরবেষ্টিত স্বল্পপরিসর ছাদ, উহাতে ঠাকুর কখন কখন পাদচারণ ও উপবেশন করিতেন এবং উত্তরে সিঁড়ির ঘরের উপরের ছাদ এবং শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর নিমিত্ত নির্দিষ্ট ঘরখানির উপরে অবস্থিত সমপরিসর একখানি ক্ষুদ্র ঘর, উহা ঠাকুরের স্নানাদির এবং দুই-একজন সেবকের রাত্রিবাসের জন্য ব্যবহৃত হইত।

বসতবাটীর পূর্বে ও পশ্চিমে কয়েকটি সোপান বাহিয়া নিম্নের হলঘরে প্রবেশ করা যাইত এবং উহার চতুর্দিকে ইষ্টকনিৰ্মিত সুন্দর উদ্যানপথ প্রায় গোলাকারে প্রসারিত ছিল। উদ্যানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে উহার পশ্চিম দিকের প্রাচীরসংলগ্ন দ্বারবানের নিমিত্ত নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র ঘর এবং তদুত্তরে লৌহময় ফটক। ঐ ফটক হইতে আরম্ভ হইয়া গাড়ি যাইবার প্রশস্ত উদ্যানপথ পূৰ্বোত্তরে অর্থ চন্দ্রাকারে অগ্রসর হইয়া বসতবাটীর চতুর্দিকের গোলাকার পথে সহিত সংযুক্ত হইয়াছিল। বসতবাটীর পশ্চিমে একটি ক্ষুদ্র ভোবা ছিল। হলঘরে প্রবেশ করিবার পশ্চিমের সোপানশ্রেণীর বিপরীতে উদ্যানপথের অপর পারে উক্ত ডোবাতে নামিবার সোপানাবলী বিদ্যমান ছিল। উদ্যানের উত্তর-পূর্ব কোণে উক্ত ডোবা অপেক্ষা একটি চারি-পাঁচগুণ বড় ক্ষুদ্র পুষ্করিণী ও তাহার উত্তর-পশ্চিম কোণে দুই-তিনখানি একতলা ঘর ছিল। তদ্ভিন্ন উদ্যানের উত্তর পশ্চিম কোণে পূর্বোক্ত ক্ষুদ্র ডোবার পশ্চিমে আস্তাবল ঘর এবং উদ্যানের দক্ষিণ সীমার প্রাচীরের মধ্যভাগের সম্মুখেই মালীদিগের নিমিত্ত নির্দিষ্ট দুইখানি পাশাপাশি অবস্থিত জীর্ণ ইষ্টকনিৰ্ম্মিত ঘর ছিল। উদ্যানের অন্য সৰ্ব্বত্র আম্র, পনস, লিচু প্রভৃতি ফলবৃক্ষসমূহ ও উদ্যানপথসকলের উভয় পার্শ্ব পুষ্পবৃক্ষরাজিতে শোভিত ছিল এবং ডোবা ও পুষ্করিণীর পার্শ্বের ভূমির অনেক স্থল নিত্য আবশ্যকীয় শাকসবজী উৎপাদনের নিমিত্ত ব্যবহৃত হইত। আবার, বৃহৎ বৃক্ষসকলের অন্তরালে মধ্যে মধ্যে শ্যামলতৃণাচ্ছাদিত ভূমিখণ্ড বিদ্যমান থাকিয়া উদ্যানের রমণীয়ত্ব অধিকতর বর্ধিত করিয়াছিল।

এই উদ্যানেই ঠাকুর অগ্রহায়ণের শেষে আগমনপূর্বক সন ১২৯১ সালের শীত ও বসন্তকাল এবং সন ১৯৯২ সালের গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতু অতিবাহিত করিয়াছিলেন। ঐ আট মাস কাল ব্যাধি যেমন প্রতিনিয়ত প্রবৃদ্ধ হইয়া তাহার দীর্ঘ বলিষ্ঠ শরীরকে জীর্ণ ভগ্ন করিয়া শুষ্ক কঙ্কালে পরিণত করিয়াছিল, তাহার সংযমসিদ্ধ মনও তেমনি উহার প্রকোপ ও যন্ত্রণা এককালে অগ্রাহ্য করিয়া তিনি ব্যক্তিগত এবং মণ্ডলীগতভাবে ভক্তসংঘের মধ্যে যে কাৰ্য ইতিপূর্বে আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহার পরিসমাপ্তির জন্য নিরন্তর নিযুক্ত থাকিয়া প্রয়োজনমত তাহাদিগকে শিক্ষাদীক্ষাদি-প্রদানে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। শুদ্ধ তাহাই নহে, ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালে নিজ সম্বন্ধে যে সকল ভবিষ্যৎ কথা ভক্তগণকে অনেক সময়ে বলিয়াছিলেন, যথা “যাইবার (সংসার পরিত্যাগ করিবার) আগে হাটে হাঁড়ি ভাজিয়া দিব (অর্থাৎ নিজ দেব-মানবত্ব সকলের সমক্ষে প্রকাশিত করিব); “যখন অধিক লোকে (তাহার দিব্য মহিমার বিষয় ) জানিতে পারিবে, কানাকানি করিবে তখন (নিজশরীর দেখাইয়া) এই খোলটা আর থাকিবে না, মা’র (জগন্মাতার) ইচ্ছায় ভাঙ্গিয়া যাইবে”; “(ভক্তগণের মধ্যে) কাহার অন্তরঙ্গ ও কাহারা বহিরঙ্গ তাহা এই সময়ে (তাহার শারীরিক অসুস্থতার সময়ে ) নিরূপিত হইবে” ইত্যাদি—এই সকল কথার সাফল্য আমরা এখানে প্রতি নিয়ত প্রত্যক্ষ করিয়াছিলাম। নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ ভক্তগণসম্বন্ধী তাঁহার ভবিষ্যৎবাণীসকলের সফলতাও আমরা এই স্থানে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। যথা-“মা তোকে (নরেন্দ্রকে) তার কাজ করিবার জন্য সংসারে টানিয়া আনিয়াছেন,” “আমার পশ্চাতে তোকে ফিরিতেই হইবে, তুই যাইবি কোথায়, “এরা সব (বালক ভক্তগণ) যেন হোমা পাখীর শাবকের ন্যায়; হোমা পাখী আকাশে বহু উচ্চে উঠিয়া অণ্ড প্রসব করে, সুতরাং প্রসবের পরে উহার অওসকল প্রবলবেগে পৃথিবীর দিকে নামিতে থাকে-ভয় হয় মাটিতে পড়িয়া চুর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাইবে; কিন্তু তাহা হয় না, ভূমি স্পর্শ করিবার পূর্বেই অণ্ড বিদীর্ণ করিয়া শাবক নির্গত হয় এবং পক্ষ প্রসারিত করিয়া পুনরায় উর্দ্ধে আকাশে উড়িয়া যায়; ইহারাও সেইরূপ সংসারে আবদ্ধ হইবার পূর্বেই সংসার ছাড়িয়া ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হইবে।” তদ্ভিন্ন নরেন্দ্রনাথের জীবনগঠন পূর্বক তাঁহার উপরে নিজ ভক্তমণ্ডলীর, বিশেষত বালক-ভক্তসকলের ভারাপণ করা ও তাহাদিগকে কিরূপে পরিচালনা করিতে হইবে তদ্বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া ঠাকুর এই স্থানেই করিয়াছিলেন। সুতরাং কাশীপুরের উদ্যানে সংসাধিত ঠাকুরের কাৰ্যসকলের যে বিশেষ গুরুত্ব ছিল তাহা বলিতে হইবে না।

ঠাকুরের জীবনের ঐ সকল গুরুগম্ভীর কাৰ্য্য যেখানে সংসাধিত হইয়াছিল, সেই স্থানটি যাহাতে তাহার পুণ্য-স্মৃতি বক্ষে ধায়ণপূর্বক চিরকাল মানবকে ঐ সকল কথা স্মরণ করাইয়া বিমল আনন্দের অধিকারী করে তদ্বিষয়ে সকলের মনেই প্রবল ইচ্ছা স্বতঃজাগ্রত হইয়া উঠে। কিন্তু হায়, ঐ বিষয়ে বিশেষ বিঘ্ন অধুনা উদিত হইয়াছে। আমরা শুনিয়াছি, উক্ত উদ্যান-বাটী রেল কোম্পানি হস্তগত করিতে অগ্রসর হইয়াছে। সুতরাং ঠাকুরের এই অপূর্ব লীলাস্থল যে শীগ্রই রূপান্তরিত হইয়া পাটের গুদাম বা অন্য কোনরূপ শ্রীহীন পদার্থে পরিণত হইবে তাহা বলিতে হইবে না।(১) কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা যদি ঐরূপ হয় তাহা হইলে দুর্বল মানব আমরা আর কি করিতে পারি? অতএব ‘যদ্বিধের্মনসি স্থিতম’ বলিয়া ঐ কথার এখানে উপসংহার করি।

————–
(১) আনন্দের বিষয় এই যে, বেলুড় শ্রীরামকৃষ্ণ মঠে কর্তৃপক্ষ এই উদ্যাননাটী ক্রয় করিয়া নিজেদের অধিকারে আনিয়াছেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের স্মৃতি এইখানে যথোচিত রক্ষিত হইবে।–প্রঃ 

কাশীপুরে সেবাব্রত

আমরা ইতিপূর্বে বলিয়াছি, পৌষ মাসে যাত্রা নিষিদ্ধ বলিয়া ঠাকুর অগ্রহায়ণ মাস সম্পূর্ণ হইবার দুই দিন পূর্বে শ্যামপুকুর হইতে কাশীপুর উদ্যানে চলিয়া আসিয়াছিলেন। কলিকাতায় জনকোলাহল পূর্ণ রাস্তার পার্শ্বে অবস্থিত শ্যামপুকুরের বাটী অপেক্ষা উদ্যানের বসতবাটীখানি অনেক অধিক প্রশস্ত ও নির্জন ছিল এবং উহার মধ্য হইতে যে দিকেই দেখ না কেন, বৃক্ষরাজির হরিৎপত্র, কুসুমের উজ্জ্বল বর্ণ এবং তৃণ ও শষ্পসকলের শ্যামলতা নয়নগোচর হইত। দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীর অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনায় উদ্যানের ঐ শোভা অকিঞ্চিৎকর হইলেও নিরন্তর চারি মাস কাল কলিকাতা বাসের পরে ঠাকুরের নিকটে উহা রমণীয় বলিয়া বোধ হইয়াছিল। উদ্যানের মুক্ত বায়ুতে প্রবিষ্ট হইবামাত্র তিনি প্রফুল্ল হইয়া উহার চারিদিক লক্ষ্য করিতে করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন। আবার, দ্বিতলে তাঁহার বাসের জন্য নির্দিষ্ট প্রশস্ত ঘরখানিতে প্রবেশ করিয়াই প্রথমে তিনি উহার দক্ষিণে অবস্থিত ছাদে উপস্থিত হইয়া ঐস্থান হইতেও কিছুক্ষণ উদ্যানের শোভা নিরীক্ষণ করিয়াছিলেন। শ্যামপুকুরের বাটীতে যেরূপ রুদ্ধ, সঙ্কুচিতভাবে থাকিতে হইয়াছিল এখানে সেইভাবে থাকিতে হইবে না অথচ ঠাকুরের সেবা পূর্বের ন্যায়ই করিতে পারিবেন এই কথা ভাবিয়া শ্ৰীশ্রীমাতাঠাকুরাণীও যে আনন্দিত হইয়াছিলেন, ইহা বুঝিতে পারা যায়। অতএব তাঁহাদিগের উভয়ের আনন্দে সেবকগণের মন প্রফুল্ল হইয়াছিল একথাও বলা বাহুল্য।

উদ্যানবাটীতে বাস করিতে উপস্থিত হইয়া যে-সকল ক্ষুদ্র বৃহৎ অসুবিধা প্রথম প্রথম নয়নগোচর হইতে লাগিল সেই সকল দুর করিতে কয়েকদিন কাটিয়া গেল। ঐ সকলের আলোচনায় নরেন্দ্র নাথ সহজেই বুঝিতে পারিলেন, ঠাকুরের সেবার দায়িত্ব যাহারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়াছেন, তাহাদিগকেও চিকিৎসকগণের আবাস হইতে দূরে অবস্থিত এই উদ্যানবাটীতে থাকিতে হইলে লোকবল এবং অর্থবল উভয়েরই পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। প্রথম হইতে ঐ দুই বিষয়ে লক্ষ্য রাখিয়া কাৰ্যে অগ্রসর না হইলে সেবার ত্রুটি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। বলরাম, সুরেন্দ্র, রাম, গিরিশ, মহেন্দ্র প্রভৃতি যাহারা অর্থবলের কথা এ পর্যন্ত চিন্তা করিয়া আসিয়াছেন তাহারা ঐ বিষয় ভাবিয়া চিন্তিয়া কোন এক উপায় নিশ্চয় স্থির করিবেন। কিন্তু লোকবলসংগ্রহে তাহাকেই ইতিপূর্বে চেষ্টা করিতে হইয়াছে এবং এখনও হইবে। ঐজন্য কাশীপুর উদ্যানে এখন হইতে তাহাকে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করিতে হইবে। তিনি ঐরূপে পথ না দেখাইলে অভিভাবকদিগের অসন্তোষ এবং চাকরি ও পাঠহানির আশঙ্কায় যুবক-ভক্তদিগের অনেকে ঐরূপ করিতে পারিবে না। কারণ, ঠাকুরের শ্যামপুকুরে থাকিবার কালে তাহারা যেরূপে নিজ নিজ বাটীতে আহারাদি করিয়া আসিয়া তাহার সেবায় নিযুক্ত হইতেছিল এখান হইতে সেইরূপ করা কখনই সম্ভবপর নহে।

আইন (বি.এল.) পরীক্ষা দিবার নিমিত্ত নরেন্দ্র ঐ বৎসর প্রস্তুত হইতেছিলেন। উক্ত পরীক্ষার ও জ্ঞাতিদিগের শত্রুতাচরণে বাস্তুভিটার বিভাগ লইয়া হাইকোর্টে যে অভিযোগ উপস্থিত হইয়া ছিল তদুভয়ের নিমিত্ত তাহার কলিকাতায় থাকা এখন একান্ত প্রয়োজনীয় হইলেও তিনি গুরুর সেবার নিমিত্ত ঐ অভিপ্রায় মন হইতে এককালে পরিত্যাগপূর্বক আইন-সংক্রান্ত গ্রন্থগুলি কাশীপুর উদ্যানে আনয়ন ও অবসরকালে যতদূর সম্ভব অধ্যয়ন করিবেন, এইরূপ সংকল্প স্থির করিলেন। ঐরূপে সর্বাগ্রে ঠাকুরের সেবা করিবার সংকল্পের সহিত সুবিধামত ঐ বৎসর আইন-পরীক্ষা দিবার সংকল্পও নরেন্দ্রনাথের মনে এখন পর্যন্ত দৃঢ় রহিল। কারণ, অন্য কোন উপায় দেখিতে না পাইয়া তিনি ইতিপূর্বে স্থির করিয়া ছিলেন আইন-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া কয়েকটা বৎসরের পরিশ্রমে মাতা ও ভ্রাতাগণের জন্য মোটামুটি গ্রাসাচ্ছাদনের একটা সংস্থান করিয়া দিয়াই সংসার হইতে অবসর গ্রহণপূর্বক ঈশ্বরসাধনায় ডুবিয়া যাইবেন। কিন্তু হায়, ঐরূপ শুভ সংকল্প ত আমরা অনেকেই করিয়া থাকি—সংসারের পশ্চাদাকর্ষণে এতদুর মাত্র গাত্র ঢালিয়াই বিক্ৰম প্ৰকাশপূৰ্ব্বক সম্মুখে শ্রেয়ঃমার্গে অগ্রসর হইব এইরূপ ভাবিয়া কাৰ্যারম্ভ আমরা অনেকেই করি, কিন্তু আবর্তে না পড়িয়া পরিণামে কয়জন ঐরূপ করিতে সমর্থ হই? উত্তমাধিকারিগণের অগ্রণী হইয়া ঠাকুরের অশেষ কৃপালাভে সমর্থ হইলেও নরেন্দ্রনাথের ঐ সংকল্প সংসার-সংঘর্ষে বিধ্বস্ত ও বিপৰ্য্যন্ত হইয়া কালে অন্য আকার ধারণ করিবে না ত?–হে পাঠক, ধৈৰ্য্য ধর, ঠাকুরের অমোঘ ইচ্ছাশক্তি নরেন্দ্রনাথকে কোথা দিয়া কি ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছা’ইয়াছিল তাহা আমরা শীঘ্রই দেখিতে পাইব।

ঠাকুরের সেবার জন্য ভক্তগণ যাহা করিতেছিলেন সেই সকল কথাই আমরা এ পর্যন্ত বলিয়া আসিয়াছি। সুতরাং প্রশ্ন হইতে পারে, দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালে যাহাকে আমরা বেদ-বেদান্তের পারের তত্ত্বসকলের সাক্ষাৎ উপলব্ধির সহিত একযোগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৈনন্দিন বিষয়সকলে এবং প্রত্যেক ভক্তের সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থার প্রতিতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিতে দেখিয়াছি, সেই ঠাকুর কি এইকালে নিজ সম্বন্ধে কোন চিন্তা না করিয়া সকল বিষয়ে সর্বদা ভক্তগণের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতেন? উত্তরে বলিতে হয়, তিনি চিরকাল যাহার মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতেন সেই জগন্মাতার উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ ও একান্ত নির্ভর করিয়া এখনও ছিলেন এবং ভক্তগণের প্রত্যেকের নিকট হইতে যে প্রকারের যতটুকু সেবা গ্রহণ করিয়া ছিলেন তাহা লওয়া শ্রীশ্রীজগদম্বার অভিপ্রেত ও তাহাদিগের কল্যাণের নিমিত্ত একথা পূর্ব হইতে জানিয়াই লইতেছিলেন। তাহার জীবনের আখ্যায়িকা বলিতে আমরা যতই অগ্রসর হইব ততই ঐ বিষয়ের পরিচয় পাইব।

আবার ভক্তগণকৃত যে-সকল বন্দোবস্ত হার মনঃপূত হইত না সেই সকল তিনি তাহাদিগের জ্ঞাতসারে এবং যেখানে বুঝিতেন তাহারা মনে কষ্ট পাইবে সেখানে অজ্ঞাতসারে পরিবর্তন করিয়া লইতেন। চিকিৎসাৰ্থ কলিকাতায় আসিবার কালে ঐজন্য বলরামকে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন, “দেখ, দশজনে চাঁদা করিয়া আমার দৈনন্দিন ভোঙ্গনের বন্দোবস্ত করিবে এটা আমার নিতান্ত রুচিবিরুদ্ধ, কারণ কখন ঐরূপ করি নাই। যদি বল, তবে দক্ষিণের কালীবাটীতে ঐরূপ করিতেছি কিরূপে, কর্তৃপক্ষেরা ত এখন নানা সরিকে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে এবং সকলে মিলিয়া দেবসেবা চালাইতেছে?-তাহাতে বলি এখানেও আমায় চাঁদায় খাইতে হইতেছে না; কারণ রাসমণির সময় হইতেই বন্দোবস্ত করা হইয়াছে, পূজা করিবার কালে ৭ টাকা করিয়া মাসে মাসে যে মাহিনা পাইতাম তাহা এবং যতদিন এখানে থাকিব ততদিন দেবতার প্ৰসাদ আমাকে দেওয়া হইবে। সেজন্য এখানে আমি একরূপ পেন্সনে(১) খাইতেছি বলা যাইতে পারে। অতএব চিকিৎসার জন্য যতদিন দক্ষিণেশ্বরের বাহিরে থাকিব ততদিন আমার খাবারের খরচটা তুমিই দিও।” ঐরূপে কাশীপুরের উদ্যানবাটী যখন তাহার নিমিত্ত ভাড়া লওয়া হইল তখন উহার মাসিক ভাড়া অনেক টাকা (৮০) জানিতে পারিয়া তাহার ‘ছাপোষা’ ভক্তগণ উহা কেমন করিয়া বহন করিবে এই কথা ভাবিতে লাগিলেন; পরিশেষে ডষ্ট কোম্পানির মুৎসুদ্দি পরম ভক্ত সুরেন্দ্রনাথকে নিকটে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ সুরেন্দর, এরা সব কেরানী-মেরানী ছাপোষা লোক, এরা অত টাকা চাদায় তুলিতে কেমন করিয়া পারিবে, অতএব ভাড়ার টাকাটা সব তুমিই দিও।” সুরেন্দ্রনাথও করজোড়ে ‘যাহা আজ্ঞা’ বলিয়া ঐরূপ করিতে সানন্দে স্বীকৃত হইলেন। ঐরূপে পরে আবার একদিন তিনি দুর্বলতার জন্য গৃহের বাহিরে শৌচাদি করিতে যাওয়া শীঘ্ৰ অসম্ভব হইবে আমাদিগকে বলিতেছিলেন। যুবক ভক্ত লাটু(২) ঐদিন তাহার ঐ কথায় ব্যথিত হইয়া সহসা করজোড়ে সরলগম্ভীর ভাবে “যে আজ্ঞা মশায়, আমি ত আপকার মেস্তর (মেথর) হাজির আছি” বলিয়া তাহাকে ও আমাদিগকে দুঃখের ভিতরেও হাসাইয়াছিল। যাহা হউক, ঐরূপে অনেক বিষয়ে ঠাকুর নিজ বন্দোবস্ত যথাযোগ্যভাবে নিজেই করিয়া লইয়া ভক্তগণের সুবিধা করিয়া দিতেন।

ক্রমে সকল বিষয়ের সুবন্দোবস্ত হইতে লাগিল এবং যুবক ভক্তেরা সকলেই এখানে একে একে উপস্থিত হইল। ঠাকুরের সেবাকাল ভিন্ন অন্য সময়ে নরেন্দ্র তাহাদিগকে ধ্যান, ভজন, পাঠ, সদালাপ, শাস্ত্রচর্চা ইত্যাদিতে এমনভাবে নিযুক্ত রাখিতে লাগিলেন যে, পরম আনন্দে কোথা দিয়া দিনের পর দিন যাইতে লাগিল তাহা তাহাদিগের বোধগম্য হইতে লাগিল না। একদিকে ঠাকুরের শুদ্ধ নিঃস্বার্থ ভালবাসার প্রবল আকর্ষণ, অন্যদিকে নরেন্দ্র নাথের অপূৰ্ব সখ্যভাব ও উন্নত সঙ্গ এক মিলিত হইয়া তাহাদিগকে ললিত-কর্কশ এমন এক মধুর বন্ধনে আবদ্ধ করিল যে এক পরিবার-মধ্যগত ব্যক্তিসকল অপেক্ষাও তাহারা পরস্পরকে আপনার বলিয়া সত্যসত্য জ্ঞান করিতে লাগিল। সুতরাং নিতান্ত আবশ্যকে কেহ কোনদিন বাটীতে ফিরিলেও ঐ দিন সন্ধ্যায় অথবা পরদিন প্রাতে তাহার এখানে আসা এককালে অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠিল। ঐরূপে শেষ পর্যন্ত এখানে থাকিয়া যাহারা সংসারত্যাগে মেধাতের উদ্যাপন করিয়াছিল সংখ্যায় তাহারা দ্বাদশ(৩) জনের অধিক না হইলেও প্রত্যেকে গুরুগতপ্রাণ ও অসামান্য কর্মকুশল ছিল।

কাশীপুরে আসিবার কয়েক দিন মধ্যেই ঠাকুর একদিন উপর হইতে নীচে নামিয়া বাটীর চতুঃপার্শ্ব উদ্যানপথে অল্পক্ষণ পাদচারণ করিয়াছিলেন। নিত্য ঐরূপ করিতে পারিলে শীঘ্র সুস্থ ও সবল হইবেন ভাবিয়া ভক্তগণ উহাতে আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিল। কিন্তু বাহিরের শীতল বায়ুস্পর্শে ঠাণ্ডা লাগিয়া বা অন্য কারণে পরদিন অধিকতর দুর্বল বোধ করায় কিছুদিন পর্যন্ত আর ঐরূপ করিতে পারেন নাই। শৈত্যের ভাবটা দুই-তিন দিনেই কাটিয়া যাইল, কিন্তু দুর্বলতা-বোধ দূর না হওয়ায় ডাক্তারেরা তাহাকে কচি পাঁঠার মাংসের সুরুয়া খাইতে পরামর্শ প্রদান করিলেন। উহা ব্যবহারে কয়েক দিনেই পূর্বোক্ত দুর্বলতা অনেকটা হ্রাস হইয়া তিনি পূৰ্ব্বাপেক্ষা সুস্থ বোধ করিয়াছিলেন। ঐরূপে এখানে আসিয়া কিঞ্চিদধিক একপক্ষকাল পর্যন্ত তাহার স্বাস্থ্যের উন্নতি হইয়াছিল বলিয়াই বোধ হয়। ডাক্তার মহেন্দ্রলালও এই সময়ে একদিন তাহাকে দেখিতে আসিয়া ঐ বিষয় লক্ষ্য করিয়া হর্ষ প্রকাশ করিয়াছিলেন।

ঠাকুরের স্বাস্থ্যের সংবাদ চিকিৎসককে প্রদান করিতে এবং পথ্যের জন্য মাংস আনিতে যুবক সেবকদিগকে নিত্য কলিকাতা যাইতে হইত। একজনের উপরে উক্ত দুই কাৰ্য্যের ভার প্রথমে অর্পণ করা হইয়াছিল। তাহাতে প্রায়ই বিশেষ অসুবিধা হইত দেখিয়া এখন হইতে নিয়ম করা হইয়াছিল, নিত্য প্রয়োজনীয় ঐ দুই কার্যের জন্য দুইজনকে কলিকাতায় যাইতে হইবে। কলিকাতায় অন্য কোন প্রয়োজন থাকিলে ঐ দুইজন ভিন্ন অপর একব্যক্তি যাইবে। তদ্ভিন্ন বাটা ঘর পরিষ্কার রাখা, বরাহনগর হইতে নিত্য বাজার করিয়া আনা, দিবাভাগে ও রাত্রে ঠাকুরের নিকটে থাকিয়া তাহার আবশ্যকীয় সকল বিষয় করিয়া দেওয়া প্রভৃতি সকল কাৰ্য পালাক্রমে যুবক-ভক্তেরা সম্পাদন করিতে লাগিল এবং নরেন্দ্রনাথ তাহাদিগের প্রত্যেকের কার্যের তত্ত্বাবধান এবং সহসা উপস্থিত বিষয়সকলের বন্দোবস্ত করিতে নিযুক্ত রহিলেন।

ঠাকুরের পথ্য প্রস্তুত করিবার ভার কিন্তু পূর্বের ন্যায় শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর হস্তেই রহিল। সাধারণ পথ্য ভিন্ন বিশেষ কোনরূপ খাদ্য ঠাকুরের জন্য ব্যবস্থা করিলে চিকিৎসকের নিকট হইতে উহা প্রস্তুত করিবার প্রণালী বিশেষরূপে জ্ঞাত হইয়া গোপালদাদা প্রমুখ দুই-এক জন, যাহাদের সহিত তিনি নিঃসঙ্কোচে বাক্যালাপ করিতেন তাহারা যাইয়া তাহাকে উক্ত প্রণালীতে পাক করিতে বুঝাইয়া দিত। পথ্য প্রস্তুত করা ভিন্ন মাতা ঠাকুরাণী মধ্যাহ্নের কিছু পূর্বে এবং সন্ধ্যার কিছু পরে ঠাকুর যাহা আহার করিতেন তাহা স্বয়ং লইয়া যাইয়া তাহাকে ভোজন করাইয়া আসিতেন। রন্ধনাদি সকল কার্যে তাঁহাকে সহায়তা করিতে এবং তাহার সঙ্গিনীর অভাব দূর করিবার জন্য ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী শ্ৰীমতী লক্ষ্মীদেবীকে এই সময়ে আনাইয়া মাতাঠাকুরাণীর নিকটে রাখা হইয়াছিল। তদ্ভিন্ন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে যাহারা সর্বদা যাতায়াত করিতেন সেই সকল স্ত্রীভক্তগণের কেহ কেহ মধ্যে মধ্যে এখানে আসিয়া শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর সহিত কয়েক ঘণ্টা হইতে কখন কখন দুই-এক দিবস পৰ্যন্ত থাকিয়া যাইতে লাগিলেন। ঐরূপে কিঞ্চিদধিক সপ্তাহকালের মধ্যেই সকল বিষয় সুশৃঙ্খলে সম্পাদিত হইতে লাগিল।

গৃহী ভক্তেরাও ঐকালে নিশ্চিন্ত রহেন নাই। কিন্তু রামচন্দ্র অথবা গিরিশচন্দ্রের বাটীতে সুবিধামত সম্মিলিত হইয়া ঠাকুরের সেবায় কে কোন বিষয়ে কতটা অবসরকাল কাটাইতে এবং অর্থ সাহায্য প্রদান করিতে পারিবেন তাহা স্থির করিয়া তদনুসারে কাৰ্য্য করিতে লাগিলেন। সকল মাসে সকলের সমভাবে সাহায্য প্রদান করা সুবিধাজনক না হইতে পারে ভাবিয়া তাঁহারা প্রতি মাসেই দুই একবার ঐরূপে একত্রে মিলিত হইয়া সকল বিষয় পূর্ব হইতে স্থির করিবার সঙ্কল্পও এই সময়ে করিয়াছিলেন।

যুবক-ভক্তদিগের অনেকেই সকল কার্যের শৃঙ্খলা না হওয়া পৰ্যন্ত নিজ নিজ বাটীতে স্বল্পকালের জন্যও গমন করে নাই। নিতান্ত আবশ্যকে যাহাদিগকে যাইতে হইয়াছিল তাহারা কয়েক ঘণ্টা বাদেই ফিরিয়াছিল এবং বাটীতে সংবাদটাও কোনরূপে দিয়াছিল যে, ঠাকুর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাহারা পূর্বের ন্যায় নিয়মিতভাবে বাটীতে আসিতে ও থাকিতে পারিবে না। কাহারও অভিভাবক যে ঐ কথা জানিয়া প্রসঙ্গচিত্তে ঐ বিষয়ে অনুমতি প্রদান করেন নাই, ইহা বলিতে হইবে না। কিন্তু কি করিবেন, ছেলেদের মাথা বিগড়াইয়াছে, ধীরে ধীরে তাহাদিগকে না ফিরাইলে হিত করিতে বিপরীত হইবার সম্ভাবনা—এইরূপ ভাবিয়া তাহাদিগের ঐ আচরণ কিছুদিন কোনরূপে সহ্য করিতে এবং তাহাদিগকে ফিরাইবার উপায় উদ্ভাবনে নিযুক্ত রহিলেন। ঐরূপে গৃহী এবং ব্রহ্মচারী ঠাকুরের উভয় প্রকারের ভক্ত সকলেই যখন একযোগে দৃঢ়নিষ্ঠায় সেবাব্রতে যোগদান করিল এবং সুবন্দোবস্ত হইয়া সকল কাৰ্য্য যখন সুশৃঙ্খলার সহিত যন্ত্রপরিচালিতের ন্যায় নিত্য সম্পাদিত হইতে লাগিল, তখন নরেন্দ্রনাথ অনেকটা নিশ্চিন্ত হইয়া নিজের বিষয় চিন্তা করিবার অবসর পাইলেন এবং শীঘ্রই দুই-এক দিনের জন্য নিজবাটীতে যাইবার সংকল্প করিলেন। রাত্রিকালে আমাদিগের সকলকে ঐ কথা জানাইয়া তিনি শয়ন করিলেন, কিন্তু নিদ্রা হইল না। কিছুক্ষণ পরেই উঠিয়া পড়িলেন এবং গোপাল প্রমুখ আমা দিগের দুই একজনকে জাগ্ৰত দেখিয়া বলিলেন, “চল, বাহিরে উদ্যানপথে পাদচারণ ও তামাকু সেবন করি”। বেড়াইতে বেড়াইতে বলিতে লাগিলেন, “ঠাকুরের যে ভীষণ ব্যাধি, তিনি দেহরক্ষায় সংকল্প করিয়াছেন কিনা কে বলিতে পারে? সময় থাকিতে তাহার সেবা ও ধ্যান-ভজন করিয়া যে যতটা পারি আধ্যাত্মিক উন্নতি করিয়া নে, নতুবা তিনি সরিয়া যাইলে পশ্চাত্তাপের অবধি থাকিবে না। এটা করিবার পরে ভগবানকে ডাকিব, ওটা করা হইয়া যাইলে সাধন-ভজনে লাগিব, এইরূপেই ত দিনগুলা যাইতেছে এবং বাসনাজালে জড়াইয়া পড়িতেছি। ঐ বাসনাতেই সর্বনাশ, মৃত্যু– বাসনা ত্যাগ কর, ত্যাগ কর।”

পৌষের শীতের রাত্রি নীরবতায় ঝিম্ ঝিম্ করিতেছে। উপরে অনন্ত নীলিমা শত সহস্র নক্ষত্রকে ধরার দিকে স্থিরদৃষ্ট নিবদ্ধ করিয়া রহিয়াছে। নীচে সুর্যের প্রখর কিরণসম্পাতে উদ্যানের বৃক্ষতলসফল শুষ্ক এবং সম্প্রতি সুস্থ হওয়ায় উপবেশনযোগ্য হইয়া রহিয়াছে। নরেন্দ্রের বৈরাগ্যপ্রবণ, ধ্যানপরায়ণ মন যেন বাহিরের ঐ নীরবতা অন্তরে উপলব্ধি করিয়া আপনাতে আপনি ডুবিয়া যাইতে লাগিল। আর পদচারণ না করিয়া তিনি এক বৃক্ষতলে উপবিষ্ট হইলেন এবং কিছুক্ষণ পরে তৃণপল্লব ও ভগ্ন বৃক্ষ শাখাসমূহের একটি শুষ্ক স্তূপ নিকটেই রহিয়াছে দেখিয়া বলিলেন, “দে উহাতে অগ্নি লাগাইয়া, সাধুরা এই সময়ে বৃক্ষতলে ধুনি জ্বালাইয়া থাকে, আর আমরাও ঐরূপে ধুনি জ্বালাইয়া অন্তরের নিভৃত বাসনাসকল দগ্ধ করি।” অগ্নি প্রজ্বলিত হইল এবং চতুর্দিকে অবস্থিত পূর্বোক্ত শুষ্ক ইন্ধনস্তূপসমূহ টানিয়া আনিয়া আমরা উহাতে আহুতি প্রদানপূর্বক অন্তরের বাসনাসমূহ হোম করিতেছি এই চিন্তায় নিযুক্ত থাকিয়া অপূর্ব উল্লাস অনুভব করিতে লাগিলাম। মনে হইতে লাগিল যেন সত্যসত্যই পার্থিব বাসনাসমূহ ভস্মীভূত হইয়া মন প্রসন্ন নির্মল হইতেছে ও শ্রীভগবানের নিকটবর্তী হইতেছি! ভাবিলাম তাই ত কেন পূর্বে এইরূপ করি নাই, ইহাতে এত আনন্দ! এখন হইতে সুবিধা পাইলেই এইরূপে ধুনি জালাইব। ঐরূপে দুই-তিন ঘণ্টা কাল কাটিবার পরে, যখন আর ইন্ধন পাওয়া গেল না তখন অগ্নিকে শান্ত করিয়া আমরা গৃহে ফিরিয়া পুনরায় শয়ন করিলাম। রাত্রি তখন ৪টা বাজিয়া গিয়াছে। যাহারা আমাদিগের ঐ কাৰ্যে যোগদান করিতে পারে নাই প্রভাতে উঠিয়া তাহারা যখন ঐ কথা শুনিল তখন তাহাদিগকে ডাকা হয় নাই বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিল। নরেন্দ্রনাথ তাহাতে তাহাদিগকে সান্ত্বনা প্রদান করিবার জন্য বলিলেন “আমরা ত পূর্ব হইতে অভিপ্রায় করিয়া ঐ কাৰ্য্য করি নাই এবং অত আনন্দ পাইব তাহাও জানিতাম না, এখন হইতে অবসর পাইলেই সকলে মিলিয়া ধুনি জ্বালাইব, ভাবনা কি।”

পূর্বকথামত প্ৰাতেই নরেন্দ্রনাথ কলিকাতায় চলিয়া যাইলেন এবং একদিন পরেই কয়েকখানি আইনপুস্তক লইয়া পুনরায় কাশীপুরে ফিরিয়া আসিলেন।

————-
(১)  পেন্সনে না বলিয়া ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “পেন্সিলে খাইতেছি।”
(২) স্বামী অদ্ভুতানন্দ নামে অধুনা ভক্তসংঘে সুপরিচিত। ইনি ছাপরানিবাসী ছিলেন। বাঙ্গালা বুঝিতে সমর্থ হইলেও ঐ ভাষায় কথা কহিতে ইহার নানাপ্রকার বিশেষত্ব প্রকাশ পাইয়া বালকের কথার ন্যায় সুমিষ্ট শুনাইত।
(৩) পাঠকের কৌতূহল নিবারণের জন্য ঐ দ্বাদশ জনের নাম এখানে দেওয়া গেল। যথা—নরেন্দ্র, রাখাল, বাবুরাম নিরঞ্জন, যোগীন্দ্র, লাটু, তারক, গোপাল দাদা (যুবকভক্তদিগের মধ্যে ইনিই একমাত্র বৃদ্ধ ছিলেন), কালী, শশী, শরৎ এবং (ছটকো) গোপাল। সারদার পিতার নির্ব্যাতনে মধ্যে মধ্যে আসিয়া দুই-এক দিন মাত্ৰ থাকিতে সমর্থ হইত। হরিশের কয়েক দিন আসিবার পরে গৃহে ফিরিয়া মস্তিষ্কের বিকার জন্মে। হরি, তুলসী ও গঙ্গাধর বাটীতে থাকিয়া তপস্যা ও মধ্যে মধ্যে আসা-যাওয়া করিত; তদ্ভিন্ন অন্য দুইজন অল্পদিন পরে মহিমাচরণ চক্রবর্তীর সহিত মিলিত হইয়া তাহার বাটীতেই থাকিয়া গিয়াছিল। 

পরিশিষ্টঃ আত্মপ্রকাশে অভয়-প্রদান

কাশীপুরের উদ্যানে আসিবার কয়েক দিন পরে ঠাকুর যেরূপে একদিন নিজ কক্ষ হইতে বহির্গত হইয়া উদ্যানপথে অল্পক্ষণের জন্য পাদচারণ করিয়াছিলেন, তাহা আমরা পাঠককে ইতিপূর্বে বলিয়াছি। উহাতে দুর্বল বোধ করায় প্রায় এক পক্ষকাল তিনি আর ঐরূপ করিতে সাহস করেন নাই। ঐ কালের মধ্যে তাহার চিকিৎসার না হইলেও চিকিৎসকের পরিবর্তন হইয়াছিল। কলিকাতার বহুবাজার-পল্লীনিবাসী প্রসিদ্ধ ধনী অক্রুর দত্তের বংশে জাত রাজেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার আলোচনায় ও উহা সহরে প্রচলনে ইতিপূর্বে যথেষ্ট পরিশ্রম ও অর্থব্যয় স্বীকার করিয়াছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ইহার সহিত মিলিত হইয়াই হোমিও-মতের সাফল্য ও উপকারিতা হৃদয়ঙ্গমপূর্বক ঐ প্রণালী-অবলম্বনে চিকিৎসায় অগ্রসর হইয়াছিলেন। ঠাকুরের ব্যাধির কথা রাজেন্দ্র বাবু লোকমুখে শ্রবণ করিয়া এবং তাহাকে আরোগ্য করিতে পারিলে হোমিওপ্যাথির সুনাম অনেকের নিকটে সুপ্রতিষ্ঠিত হইবার সম্ভাবনা বুঝিয়া চিন্তা ও অধ্যয়নাদিসহায়ে ঐ ব্যাধির ঔষধও নির্বাচন করিয়া রাখিয়াছিলেন। গিরিশচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অতুলকৃষ্ণের সহিত ইনি পরিচিত ছিলেন। আমাদের যতদুর স্মরণ হয়, অতুলকৃষ্ণকে একদিন এই সময়ে কোন স্থানে দেখিতে পাইয়া তিনি সহসা ঠাকুরের শারীরিক অসুস্থতার কথা জিজ্ঞাসাপূর্বক তাহাকে চিকিৎসা করিবার মনোগত অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন এবং বলেন, “মহেন্দ্রকে বলিও আমি অনেক ভাবিয়া চিলি একটা ঔষধ নির্বাচন করিয়া রাখিয়াছি, সেইটা প্রয়োগ কৰিলে বিশেষ উপকার পাইবার আশা রাখি, তাহার মত থাকিলে সেইটা আমি একবার দিয়া দেখি।” অতুলকৃষ্ণ ভক্তগণকে এবং ডাক্তার মহেন্দ্রলালকে ঐ বিষয় জানাইলে উহাতে কাহারও আপত্তি না হওয়ায় কয়েকদিন পরেই রাজেন্দ্র বাবু ঠাকুরকে দেখিতে আসেন এবং ব্যাধির আদ্যোপান্ত বিবরণ শ্রবণপূর্বক লাইকোপোডিয়াম (২০০) প্রয়োগ করেন। ঠাকুর উহাতে এক পক্ষেরও অধিককাল বিশেষ উপকার অনুভব করিয়াছিলেন। ভক্তগণের উহাতে মনে হইয়াছিল, তিনি বোধ হয় এইবার অল্পদিনেই পূর্বের ন্যায় সুস্থ ও সবল হইয়া উঠিবেন।

ক্রমে পৌষমাসের অর্ধেক অতীত হইয়া ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারী উপস্থিত হইল। ঠাকুর ঐ দিন বিশেষ সুস্থ বোধ করায় কিছুক্ষণ উদ্যানে বেড়াইবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। অবকাশের দিন বলিয়া সেদিন গৃহস্থ ভক্তগণ মধ্যাহ্ন অতীত হইবার কিছু পরেই একে একে অথবা দলবদ্ধ হইয়া উদ্যানে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। ঐরূপে অপরাহ্ন ৩টার সময় ঠাকুর যখন উদ্যানে বেড়াইবার জন্য উপর হইতে নীচে নামিলেন তখন ত্রিশ জনেরও অধিক ব্যক্তি গৃহমধ্যে অথবা উদ্যানস্থ বৃক্ষসকলের তলে বসিয়া পরস্পরের সহিত বাক্যালাপে নিযুক্ত ছিল। তাঁহাকে দেখিয়াই সকলে সসম্ভ্রমে উত্থিত হইয়া প্রণাম করিল এবং তিনি নিম্নের হলঘরের পশ্চিমের দ্বার দিয়া উদ্যানপথে নামিয়া দক্ষিণমুখে ফটকের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলে পশ্চাতে কিঞ্চিৎ দূরে থাকিয়া তাঁহাকে অনুসরণ করিতে লাগিল। ঐরূপে বসতবাটী ও ফটকের মধ্যস্থলে উপস্থিত হইয়া ঠাকুর গিরিশ, রাম, অতুল প্রভৃতি কয়েকজনকে পশ্চিমের বৃক্ষতলে দেখিতে পাইলেন। তাহারাও তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া তথা হইতে প্রণাম করিয়া সানন্দে তাহার নিকটে উপস্থিত হইল। কেহ কোন কথা কহিবার পূর্বেই ঠাকুর সহসা গিরিশচন্দ্রকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “গিরিশ, তুমি যে সকলকে এত কথা (আমার অবতারত্ব সম্বন্ধে ) বলিয়া বেড়াও, তুমি (আমার সম্বন্ধে ) কি দেখিয়াছ ও বুঝিয়াছ?” গিরিশ উহাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হইয়া তাহার পদপ্রান্তে ভূমিতে জানু সংলগ্ন করিয়া উপবিষ্ট হইয়া উৰ্দ্ধমুখে করজোড়ে গগদ স্বরে বলিয়া উঠিল, “ব্যাস-বাল্মীকি যাহার ইয়ত্তা করিতে পারেন নাই, আমি তাহার সম্বন্ধে অধিক কি আর বলিতে পারি!” গিরিশের অন্তরের সরল বিশ্বাস প্রতি কথায় ব্যক্ত হওয়ায় ঠাকুর মুগ্ধ হইলেন এবং তাহাকে উপলক্ষ করিয়া সমবেত ভক্তগণকে বলিলেন, “তোমাদের কি আর বলিব, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হউক।” ভক্তগণের প্রতি প্রেম ও করুণায় আত্মহারা হইয়া তিনি ঐ কথাগুলি মাত্র বলিয়াই ভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িলেন। স্বার্থগন্ধহীন তাহার সেই গভীর আশীর্বাণী প্রত্যেকের অন্তরে প্রবল আঘাত প্রদানপূর্বক আনন্দস্পন্দনে উদ্বেল করিয়া তুলিল। তাহারা দেশ-কাল ভুলিল, ঠাকুরের ব্যাধি ভুলিল, ব্যাধি আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত তাহাকে স্পর্শ না করিবার তাহাদের ইতিপূর্বের প্রতিজ্ঞা ভুলিল এবং সাক্ষাৎ অনুভব করিতে লাগিল যেন তাহাদের দুঃখে ব্যথিত হইয়া কোন এক অপূর্ব দেবতা হৃদয়ে অনন্ত যাতনা ও করুণা পোষণপূর্বক বিন্দুমাত্র নিজ প্রয়োজন না থাকিলেও মাতার ন্যায় তাহাদিগের স্নেহাঞ্চলে আশ্রয় প্রদান করিতে ত্রিদিব হইতে সম্মুখে অবতীর্ণ হইয়া তাহাদিগকে সস্নেহে আহ্বান করিতেছেন! তাহাকে প্রণাম ও তাহার পদধূলি গ্রহণের জন্য তাহারা তখন ব্যাকুল হইয়া উঠিল এবং জয়রবে দিক মুখরিত করিয়া একে একে আসিয়া প্রণাম করিতে আরম্ভ করিল। ঐরূপে প্রণাম করিবার কালে ঠাকুরের করুণান্ধি আজি বেলাভূমি অতিক্রম করিয়া এক অদৃষ্টপূৰ্ব ব্যাপার উপস্থিত করিল। কোন কোন ভক্তের প্রতি করুণায় ও প্রসন্নতায় আত্মহারা হইয়া দিব্য শক্তিপূত স্পর্শে তাহাকে কৃতার্থ করিতে আমরা ইতিপূর্বে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে প্রায় নিত্যই দেখিয়াছিলাম, অদ্য অৰ্দ্ধবাহ্যদশায় তিনি সমবেত প্রত্যেক ভক্তকে ঐ ভাবে স্পর্শ করিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য, তাহার ঐরূপ আচরণে ভক্তগণের আনন্দের অবধি রহিল না। তাহারা বুঝিল আজি হইতে তিনি নিজ দেবত্বের কথা শুদ্ধ তাহাদিগের নিকট নহে কিন্তু সংসারে কাহারও নিকটে আর লুক্কায়িত রাখিবেন না এবং পাপী তাপী সকলে এখন হইতে সমভাবে তাহার অভয়পদে আশ্রয় লাভ করিবে-নিজ নিজ ক্রটি, অভাব ও অসামর্থ্য-বোধ হইতে তদ্বিষয়ে ও তাহাদিগের বিন্দুমাত্র সংশয় রহিল না। সুতরাং ঐ অপূৰ্ব ঘটনায় কেহবা বা নিষ্পত্তি করিতে অক্ষম হইয়া মন্ত্রমুগ্ধবৎ তাহাকে কেবলমাত্র নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, কেহবা গৃহমধ্যস্থ সকলকে ঠাকুরের কৃপালাভে ধন্য হইবার জন্য চীৎকার করিয়া আহ্বান করিতে লাগিল, আবার কেহ পুষ্পচয়নপূর্বক মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে ঠাকুরের অঙ্গে উহা নিক্ষেপ করিয়া তাহাকে পূজা করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ ঐরূপ হইবার পরে ঠাকুরের ভাব শান্ত হইতে দেখিয়া ভক্তগণও পূর্বের ন্যায় প্রকৃতিস্থ হইল এবং অদ্যকার উদ্যান-ভ্রমণ ঐরূপে পরিসমাপ্ত করিয়া তিনি বাটীর মধ্যে নিজ কক্ষে যাইয়া উপবিষ্ট হইলেন।

রামচন্দ্র প্রমুখ কোন কোন ভক্ত অদ্যকার এই ঘটনাটিকে ঠাকুরের ‘কল্পতরু’ হওয়া বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। কিন্তু আমা দিগের বোধ হয়, উহাকে ঠাকুরের অভয়-প্রকাশ অথবা আত্ম প্রকাশপূর্বক সকলকে অভয়-প্রদান বলিয়া অভিহিত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। প্রসিদ্ধি আছে, ভাল বা মন্দ যে যাহা প্রার্থনা করে কল্পতরু তাহাকে তাহাই প্রদান করে। কিন্তু ঠাকুর ত ঐরূপ করেন নাই, নিজ দেব-মানবত্বের এবং জনসাধারণকে নির্বিচারে অভয়াশ্রয়প্রদানের পরিচয়ই ঐ ঘটনায় সুব্যক্ত করিয়াছিলেন। সে যাহা হউক, যে-সকল ব্যক্তি অদ্য তাহার কৃপালাভে ধন্য হইয়াছিল তাহাদিগের ভিতর হারাণচন্দ্র দাসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ, হারাণ প্রণাম করিবামাত্র ভাবাবিষ্ট ঠাকুর তাহার মস্তকে নিজ পাদপদ্ম রক্ষা করিয়াছিলেন। ঐরূপে কৃপা করিতে আমরা তাহাকে অল্পই দেখিয়াছি।(১) ঠাকুরের ভ্রাতুস্পুত্ৰ শ্ৰীযুক্ত রামলাল চট্টোপাধ্যায় ঐদিন ঐস্থানে উপস্থিত ছিলেন এবং তাহার কৃপালাভে ধন্য হইয়াছিলেন। জিজ্ঞাসা করায় তিনি আমাদিগকে বলিয়া ছিলেন, “ইতিপূর্বে ইষ্ট-মূর্তির ধ্যান করিতে বসিয়া তাহার শ্রীঅঙ্গের কতকটা মাত্র মানস নয়নে দেখিতে পাইতাম, যখন পাদপদ্ম দেখিতেছি তখন মুখখানি দেখিতে পাইতাম না, আবার মুখ হইতে কটিদেশ পর্যন্তই হয়ত দেখিতে পাইতাম, ঐচরণ দেখিতে পাইতাম না, ঐরূপে যাহা দেখিতাম তাহাকে সজীব বলিয়াও মনে হইত না, অন্য ঠাকুর স্পর্শ করিবামাত্ৰ সৰ্বাঙ্গসম্পূর্ণ ইষ্টমূর্তি হৃদয়পদ্মে সহসা আবির্ভূত হইয়া এককালে নড়িয়া চড়িয়া ঝলমল করিয়া উঠিল।”

অদ্যকার ঘটনাস্থলে যাহারা উপস্থিত ছিলেন তাঁহাদিগের আট দশ জনের নামই মাত্র আমাদিগের স্মরণ হইতেছে, যথা-গিরিশ, অতুল, রাম, নবগোপাল, হরমোহন, বৈকুণ্ঠ, কিশোরী (রায়), হারাণ, রামলাল, অক্ষয়। ‘কথামৃত’-লেখক মহেন্দ্রনাথও বোধ হয় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ঠাকুরের সন্ন্যাসী ভক্ত গণের একজনও ঐদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না। নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ তাঁহাদিগের অনেকে ঠাকুরের সেবাদি ভিন্ন পূৰ্বরাত্রে অধিকক্ষণ সাধন-ভজনে নিযুক্ত থাকায় ক্লান্ত হইয়া গৃহমধ্যে নিদ্রা যাইতেছিলেন। লাটু ও শরৎ জাগ্রত থাকিলেও এবং ঠাকুরের কক্ষের দক্ষিণে অবস্থিত দ্বিতলের ছাদ হইতে ঐ ঘটনা দেখিতে পাইলেও স্বেচ্ছায় ঘটনাস্থলে গমন করে নাই। কারণ, ঠাকুর উদ্যানে পাদচারণ করিতে নীচে নামিবামাত্র তাহারা ঐ অবকাশে তাহার শয্যাদি রৌদ্রে দিয়া ঘরখানির সংস্কারে নিযুক্ত হইয়াছিল এবং কর্তব্য কাৰ্য্য অর্ধনিষ্পন্ন করিয়া ফেলিয়া যাইলে ঠাকুরের অসুবিধা হইতে পারে ভাবিয়া তাহাদিগের ঘটনাস্থলে যাইতে প্রবৃত্তি হয় নাই।

উপস্থিত ব্যক্তিগণের মধ্যে আরও অনেক জনকে আমরা অদ্যকার অনুভবের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তন্মধ্যে বৈকুন্ঠনাথ আমাদিগকে যাহা বলিয়াছিল তাহা লিপিবদ্ধ করিয়া আমরা এই বিষয়ের উপসংহার করিব। বৈকুণ্ঠনাথ আমাদিগের সমসাময়িক কালে ঠাকুরের পুণ্য-দর্শনলাভ করিয়াছিল। তদবধি ঠাকুর তাহাকে উপদেশাদি প্রদানপূর্বক যে ভাবে গড়িয়া তুলিতেছিলেন তদ্বিষয়ের কোন কোন কথা আমরা ‘লীলাপ্রসঙ্গের’ স্থলে স্থলে পাঠককে বলিয়াছি। মন্ত্রদীক্ষাদানে ঠাকুর বৈকুণ্ঠনাথের জীবন ধন্য করিয়াছিলেন। তদবধি সে সাধন-ভজনে নিযুক্ত থাকিয়া যাহাতে ইষ্টদেবতার দর্শনলাভ হয় তদ্বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে ছিল। ঠাকুরের কৃপা ভিন্ন ঐ বিষয়ে সফলকাম হওয়া অসম্ভব বুঝিয়া সে তাহার নিকটেও মধ্যে মধ্যে কাতর প্রার্থনা করিতেছিল। এমন সময়ে ঠাকুরের শারীরিক ব্যাধি হইয়া চিকিৎসাৰ্থ কলিকাতায় আগমন এবং পরে কাশীপুরে গমনরূপ ঘটনা উপস্থিত হইল। ঐ কালের মধ্যেও বৈকুণ্ঠনাথ অবসর পাইয়া দুই-তিন বার ঠাকুরকে নিজ মনোগত বাসনা নিবেদন করিয়াছিল। ঠাকুর তাহাতে প্রসন্নহাস্যে তাহাকে শান্ত করিয়া বলিয়াছিলেন, “রোস্ না, আমার অসুখটা ভাল হউক, তাহার পর তোর সব করিয়া দিব।”

অদ্যকার ঘটনাস্থলে বৈকুণ্ঠনাথ উপস্থিত ছিল। ঠাকুর ভক্ত দিগের মধ্যে দুই-তিন জনকে দিব্যশক্তিপূত স্পর্শে কৃতার্থ করিবামাত্র সে তাহার সম্মুখীন হইয়া তাহাকে ভক্তিভরে প্রণামপুরঃসর বলিল, “মহাশয়, আমায় কৃপা করুন।” ঠাকুর বলিলেন, “তোমার ত সব হইয়া গিয়াছে।” বৈকুণ্ঠ বলিল, “আপনি যখন বলিতেছেন হইয়াছে তখন নিশ্চয় হইয়া গিয়াছে, কিন্তু আমি যাহাতে উহা অল্পবিস্তর বুঝিতে পারি তাহা করিয়া দিন”। ঠাকুর তাহাতে “আচ্ছা” বলিয়া ক্ষণেকের জন্য সামান্য ভাবে আমার বক্ষস্থল স্পর্শ করিলেন মাত্র। উহার প্রভাবে কিন্তু আমার অন্তরে অপূর্ব ভাবান্তর উপস্থিত হইল। আকাশ, বাড়ী, গাছপালা, মানুষ ইত্যাদি যেদিকে যাহা কিছু দেখিতে লাগিলাম তাহারই ভিতরে ঠাকুরের প্রসন্ন হাস্যদীপ্ত মূর্তি দেখিতে লাগিলাম। প্রবল আনন্দে এককালে উল্লসিত হইয়া উঠিলাম এবং ঐ সময়ে তোমাদের ছাদে দেখিতে পাইয়া ‘কে কোথায় আছিস এই বেলা চলে আয়’ বলিয়া চীৎকার করিয়া ডাকিতে থাকিলাম। কয়েক দিন পর্যন্ত আমার ঐরূপ ভাব ও দর্শন জাগ্রতকালের সর্বক্ষণ উপস্থিত ছিল। সকল পদার্থের ভিতর ঠাকুরের পুণ্যদর্শনলাভে স্তম্ভিত ও মুগ্ধ হইতে লাগিলাম। অফিসে বা কৰ্ম্মান্তরে অন্যত্র যথায় যাইতে লাগিলাম তথায়ই ঐরূপ হইতে থাকিল। উহাতে উপস্থিত কৰ্ম্মে মনোনিবেশ করিতে না পারায় ক্ষতি হইতে লাগিল এবং কর্মের ক্ষতি হইতেছে দেখিয়া উক্ত দর্শনকে কিছুকালের জন্য বন্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াও ঐরূপ করিতে পারিলাম না। অর্জুন ভগবানের বিশ্বরূপ দেখিয়া ভয় পাইয়া কেন উহা প্ৰতিসংহারের জন্য তাহার নিকটে প্রার্থনা করিয়াছিলেন তাহার কিঞ্চিদাভাস হৃদয়ঙ্গম হইল। মুক্ত পুরুষেরা সৰ্ব্বদা একরস হইয়া থাকেন ইত্যাদি শাস্ত্রবাক্য স্মরণ হওয়ায় কতটা নিৰ্বাসনা হইলে মন উক্ত একরসাবস্থায় থাকিবার সামর্থ্য লাভ করে তাহার কিঞ্চিদাভাসও এই ঘটনায় বুঝিতে পারিলাম। কারণ, কয়েক দিন যাইতে না যাইতে ঐরূপে একই ভাবে একই দর্শন ও চিন্তাপ্রবাহ লইয়া থাকা কষ্টকর বোধ হইল। কখন কখন মনে হইতে লাগিল, পাগল হইব না কি? তখন ঠাকুরের নিকটে আবার সভায় প্রার্থনা করিতে লাগিলাম ‘প্রভু, আমি এই ভাবধারণে সক্ষম হইতেছি না, যাহাতে ইহার উপশম হয় তাহা করিয়া দাও’। হায়, মানবের দুর্বলতা ও বুদ্ধিহীনতা! এখন ভাবি কেন ঐরূপ প্রার্থনা করিয়াছিলাম-কেন তাহার উপর বিশ্বাস স্থির রাখিয়া ঐ ভাবে চরম পরিণতি দেখিবার জন্য ধৈৰ্য্যধারণ করিয়া থাকি নাই?-না হয় উন্মাদ হইতাম; অথবা দেহের পতন হইত। কিন্তু ঐরূপ প্রার্থনা করিবার পরেই উক্ত দর্শন ও ভাবের সহসা এক দিবস বিরাম হইয়া গেল! আমার দৃঢ় ধারণা, যাহা হইতে ঐ ভাব প্রাপ্ত হইয়াছিলাম তাহার দ্বারাই উহা শান্ত হইল। তবে ঐ দর্শনের একান্ত বিলয়ের কথা আমার মনে উদিত হয় নাই বলিয়াই বোধ হয় তিনি কৃপা করিয়া উহার এইটুকু অবশেষ মাত্র রাখিয়াছিলেন যে, দিবসের মধ্যে যখন-তখন কয়েকবার তাঁহার সেই দিব্যভাবোদ্দীপ্ত প্রসন্ন মূর্তির অহেতুক দর্শনলাভে আনন্দে স্তম্ভিত ও কৃতকৃতার্থ হইতাম।”

—————
(১) বেলিয়াঘাটানিবাসী হারাশচন্দ্ৰ কলিকাতার ফিনলে মিওর কোম্পানীর আফিসে কর্ম করিতেন। ঠাকুরের কৃপার স্মরণার্থ তিনি ইদানীং প্রতি বৎসর মহোৎসব করিতেন। স্বল্পদিন হইল দেহরক্ষাপুর্বক তিনি অভয়ধামে প্রয়াণ করিয়াছেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *