পঞ্চম খণ্ড – দ্বাদশ অধ্যায় – তৃতীয় পাদ: ঠাকুরের শ্যামপুকুরে অবস্থান
ঠাকুরের নিজ সূক্ষ্ণশরীরে ক্ষত দর্শন—অপরের পাপভার গ্রহণ- কারণ ঐরূপ হওয়া ও উহার ফল
শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে ঠাকুরের এক দিবস এক অদ্ভুত দর্শন উপস্থিত হইয়াছিল। তিনি দেখিয়াছিলেন, তাহার সূক্ষ্ণশরীর স্থূলদেহের অভ্যন্তর হইতে নির্গত হইয়া গৃহমধ্যে ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে এবং তাহার গলার সংযোগস্থলে পৃষ্ঠদেশে কতকগুলি ক্ষত হইয়াছে। বিস্মিত হইয়া তিনি ঐরূপ ক্ষত হইবার কারণ কি ভাবিতেছেন, এমন সময়ে শ্রীশ্রীজগদম্বা তাহাকে বুঝাইয়া দিলেন, নানারূপ দুষ্কর্ম করিয়া আসিয়া লোকে তাঁহাকে স্পর্শপূর্বক পবিত্র হইয়াছে, তাহাদের পাপভার ঐরূপে তাহাতে সংক্রমিত হওয়ায় তাহার শরীরে ক্ষতরোগ হইয়াছে। জীবের কল্যাণসাধনে তিনি লক্ষ লক্ষ বার জন্ম পরিগ্রহ পূর্বক দুঃখভোগ করিতে কাতর নহেন, একথা আমরা দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে সময়ে সময়ে বলিতে শুনিয়াছিলাম, সুতরাং পূর্বোক্ত দর্শনে কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া আনন্দের সহিত তিনি যে এখন ঐ বিষয়ে আমাদিগকে বলিবেন, ইহা বিচিত্র বোধ হইল না এবং উহাতে তাঁহার অপার করুণার কথা স্মরণ ও আলোচনা করিয়া আমরা মুগ্ধ হইলাম। কিন্তু ঠাকুরের শরীর পূর্বের ন্যায় সুস্থ না হওয়া পৰ্যন্ত যাহাতে কোন নূতন লোক আসিয়া তাহার চরণ স্পর্শপূর্বক প্রণাম না করে, তদ্বিষয়ে ভক্তদিগের—বিশেষতঃ যুবক-ভক্তদিগের ঠাকুরের শ্যামপুকুরে অবস্থান মধ্যে উহাতে বিশেষ প্রয়াস উপস্থিত হইল এবং ভক্তগণের মধ্যে কেহ কেহ আবার পূর্বজীবনের উচ্ছলতার কথা স্বরণপূর্বক এখন হইতে ঠাকুরের পবিত্র দেহ আর স্পর্শ করিবেন না, এইরূপ সংকল্প করিয়া বসিলেন। আবার নরেন্দ্র প্রমুখ বিরল কোন কোন ব্যক্তি উক্ত দর্শনের কথা শুনিয়া অন্যকৃত কর্মের জন্য অন্যের স্বেচ্ছায় ফলভোগ করারূপ যে মতবাদ খৃষ্টান, বৈষ্ণব প্রভৃতি কোন কোন ধর্মের মূলভিত্তিস্বরূপ হইয়া রহিয়াছে, উহাতে তাহারই সত্যতার ইঙ্গিত প্রাপ্ত হইয়া, ঐ বিষয়ের চিন্তা ও গবেষণায় নিযুক্ত হইলেন।
ভক্তগণের নবাগত ব্যক্তিসকলের সম্বন্ধে নিয়মবন্ধন
ঠাকুরের নিকটে নূতন লোকের গমনাগমন নিবারণের চেষ্টা দেখিয়া গিরিশচন্দ্র বলিয়াছিলেন, “চেষ্টা করিতেছ কর, কিন্তু উহা সম্ভবপর নহে-কারণ, উনি (ঠাকুর) যে ঐজন্যই দেহধারণ করিয়াছেন।” ফলে দেখা গেল, সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকসকলকে নিষেধ করিতে পারিলেও ভক্তগণের পরিচিত নবাগত ব্যক্তিসকলকে নিবারণ করা সম্ভবপর হইল না। সুতরাং নিয়ম হইল, ভক্তগণের মধ্যে কাহারও সহিত বিশেষ পরিচয় না থাকিলে নবাগত কাহাকেও ঠাকুরের নিকটে যাইতে দেওয়া হইবে না এবং ঐরূপ ব্যক্তি সকলকে পূৰ্ব্ব হইতে বলিয়া দেওয়া হইবে, যাহাতে ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করিয়া প্রণাম না করেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত কাহার কাহারও ব্যাকুলতা দেখিয়া মধ্যে মধ্যে উক্ত নিয়মেরও ব্যতিক্রম হইতে লাগিল।
কালীপদের সাহায্যে অভিনেত্রীর ঠাকুরকে দর্শন
ঐরূপ নিয়ম লইয়া একদিন এক রঙ্গ উপস্থিত হইয়াছিল। গিরিশচন্দ্র পরিচালিত নাট্যশালায় ধর্মমূলক নাটক বিশেষের অভিনয় দর্শন করিতে ঠাকুর একদিবস দক্ষিণেশ্বরে থাকিবার কালে গমন করিয়াছিলেন এবং নাটকের প্রধান ভূমিকা যে অভিনেত্রী গ্রহণ করিয়াছিল, তাহার অভিনয় দক্ষতার প্রশংসা করিয়াছিলেন। অভিনয়ান্তে ঐদিন উক্ত অভিনেত্রী ভাবাবিষ্ট ঠাকুরের পাদ-বন্দনা করিবার সৌভাগ্যের অধিকারিণী হইয়াছিল। তদবধি সে তাহাকে সাক্ষাৎ দেবতা বলিয়া মনে মনে বিশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি করিত এবং আর এক দিবস তাহার পুণ্যদর্শন লাভ করিবার সুযোগ খুঁজিতেছিল। ঠাকুরের নিদারুণ পীড়ার কথা শুনিয়া সে এখন তাহাকে একবার দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিল এবং শ্ৰীযুত কালীপদ ঘোষের সহিত পরিচিত থাকায় বিশেষ অনুনয়-বিনয়পূর্বক ঐ বিষয়ের জন্য তাহার শরণাপন্ন হইল। কালীপদ সকল বিষয়ে গিরিশচন্দ্রের অনুগামী ছিলেন এবং ঠাকুরকে যুগাবতার বলিয়া ধারণা করায় দুষ্কৃতকারী অনুতপ্ত হইয়া তাহার চরণস্পর্শ করিলে তাঁহার রোগবৃদ্ধি হইবে—এ কথায় আস্থাবান ছিলেন না। সুতরাং ঠাকুরের নিকটে উক্ত অভিনেত্রীকে আনয়ন করিতে তাহার মনে কোনরূপ দ্বিধা বা ভয় আসিল না। গোপনে পরামর্শ স্থির করিয়া একদিবস সন্ধ্যার প্রাক্কালে তিনি তাহাকে পুরুষের ন্যায় ‘হ্যাট কোটে’ সজ্জিত করিয়া শ্যামপুকুরের বাসায় উপস্থিত হইলেন এবং নিজ বন্ধু বলিয়া আমাদিগের নিকটে পরিচয় প্রদানপূর্বক ঠাকুরের সমীপে লইয়া যাইয়া তাহার যথার্থ পরিচয় প্রদান করিলেন। ঠাকুরের ঘরে তখন আমরা কেহই ছিলাম না, সুতরাং ঐরূপ করিবার পথে তাহাকে কোন বাধাই পাইতে হইল না। আমাদিগের চক্ষে ধূলি দিবার জন্যই অভিনেত্রী ঐরূপ বেশে আসিয়াছে জানিয়া রঙ্গপ্রিয় ঠাকুর হাসিতে লাগিলেন এবং তাহার সাহস ও দক্ষতার প্রশংসাপূর্বক তাহার ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলেন। অনন্তর ঈশ্বরে বিশ্বাসবতী ও তাঁহার শরণাপন্ন হইয়া থাকিবার জন্য তাহাকে দুই-চারিটি তত্ত্ব-কথা বলিয়া অল্পক্ষণ পরে বিদায় দিলেন। সেও অশ্রুবিসর্জন করিতে করিতে তাহার শ্রীচরণে মস্তক স্পর্শপূর্বক কালীপদের সহিত চলিয়া যাইল। ঠাকুরের নিকট হইতে আমরা পরে একথা জানিতে পারিলাম এবং আমরা প্রতারিত হওয়ায় তিনি হাস্য-পরিহাস ও আনন্দ করিতেছেন দেখিয়া কালীপদের উপরে বিশেষ ক্রোধ করিতে পারিলাম না।
ভক্তগণের মধ্যে ভাবুকতা বৃদ্ধির কারণ
ঠাকুরের সঙ্গগুণে এবং তাহার সেবা করিবার ফলে ভক্তগণের হৃদয়ে ভক্তি-বিশ্বাস দিন দিন বৰ্ধিত হইতে থাকিলেও, এক বিষয়ে তাহাদিগের মনের গতির বিপদসঙ্কুল বিপরীত পথে যাইবার সম্ভাবনা এখন উপস্থিত হইয়াছিল। কঠোর ত্যাগ এবং কষ্টসাধ্য সংযমের আদর্শ অপেক্ষা সাময়িক ভাবের উচ্ছাসই তাহাদিগের নিকটে এক্ষণে অধিকতর প্রিয় হইতেছিল। ত্যাগ ও সংযমকে ভিত্তিস্বরূপ অবলম্বনপূর্বক উদিত না হইলে ঐ প্রকার ভাবোচ্ছাসসকল ধর্ম মূলক হইলেও যে মানবকে কাম-ক্রোধাদি রিপুর সহিত সংগ্রামে জয়ী হইবার সামর্থ্য দিতে পারে না, একথা তাহারা বুঝিতে পারিতেছিল না। ঐরূপ হইবার অনেকগুলি কারণ একে একে উপস্থিত হইয়াছিল। প্রথমে সহজ বা সুখসাধ্য পথ ও বিষয়কে অবলম্বন করিতে যাওয়াই মানবের সাধারণ প্রকৃতি। ধর্মানুষ্ঠান করিতে যাইয়াও সে ঐ সংসার ও ঈশ্বরভোগ ও ত্যাগ উভয় দিক রক্ষা করিয়া চলিতে চাহে। ভাগ্যবান কোন কোন ব্যক্তিই তদুভয়কে আলোক ও অন্ধকারের ন্যায় বিপরীত ধর্মবিশিষ্ট বলিয়া ধারণা করে এবং ঈশ্বরার্থে সর্বত্যাগরূপ আদর্শকে কাটিয়া-ছটিয়া অনেকটা মাইয়া না আনিলে যে ঐ উভয়ের সামঞ্জস্য হওয়া অসম্ভব, একথা বুঝিয়া ঐরূপ ভ্রমে পতিত হয় না। ঐরূপে উভয় দিক রক্ষা করিয়া যাহারা চলিতে চাহে, তাহারা শীঘ্রই ত্যাগাদর্শের দিকে এতটা পৰ্যন্ত অগ্রসর হওয়াই কৰ্তব্য ভাবিয়া সীমা নির্দেশপূর্বক চিরকালের নিমিত্ত সংসারে নোঙর ফেলিয়া বসে। ঠাকুর ঐজন্য কেহ তাহার নিকট উপস্থিত হইবামাত্র তাহাকে নানারূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতেন, সে ঐরূপে নোঙর ফেলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়াছে কি না এবং ঐরূপ করিয়াছে বুঝিলে ঈশ্বরার্থে সর্বস্বত্যাগ রূপ আদর্শের সে যতটা লইতে পারিবে ততটা মাত্র প্রথমে তাহার নিকটে প্রকাশ করিতেন। ঐজন্যই দেখা যাইত, অধিকারিভেদে তাঁহার উপদেশ বিভিন্ন প্রকারের হইতেছে অথবা তাহার গৃহী ও যুবক-ভক্তদিগকে তিনি সাধন সম্বন্ধে ভিন্ন প্রকারের শিক্ষা দিতেছেন। এজন্যই আবার সর্বসাধারণকে উপদেশ দিবার কালে তিনি বলিতেন, ‘কলিতে কেবলমাত্র হরির নামসঙ্কীৰ্ত্তন ও নারদীয়-ভক্তি।” সাধারণের মধ্যে তখন ধর্ম ও শাস্ত্র-চর্চা এতটা লুপ্ত হইয়াছিল যে, ‘নারদীয়-ভক্তি’ কথার অর্থও শতের মধ্যে একজন বুঝিত কিনা সন্দেহ। উহাতেও যে ঈশ্বর-প্রেমে সর্বস্ব ত্যাগের কথা উপদিষ্ট হইয়াছে, একথা লোকের হৃদয়ঙ্গম হইত না। সুতরাং ঠাকুরের অনভিজ্ঞ ভক্তগণ যে দুর্বল প্রকৃতির বশবর্তী হইয়া সময়ে সময়ে সংসার ও ধর্ম উভয় বজায় রাখিবার ভ্রমে পতিত হইবেন এবং সুখসাধ্য ভাবুকতার বৃদ্ধিটাকেই ধর্মলাভের চুড়ান্ত বলিয়া ধরিয়া লইবেন, একথা বিচিত্র নহে।
আবার ঠাকুরের কঠোর সংযম ও তপস্যাদি আমরা তাহার নিকটে যাইবার পুর্বে অনুষ্ঠিত হওয়ায়, তাঁহার অলৌকিক ভাবুকতা কোন্ সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে, তাহা দেখিতে না পাওয়া ভক্তগণের ঐরূপ ভ্রমে পতিত হইবার অন্যতম কারণ বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু ঐ বিষয়ে চূড়ান্ত কারণ উপস্থিত হইল, যখন গিরিশচন্দ্র ঠাকুরের আশ্রয় লাভ এবং তাহাকে যুগাবতার বলিয়া স্থির ধারণাপূর্বক প্রাণের উল্লাসে সাধারণের সম্মুখে ঐ কথা হাঁকিয়া ডাকিয়া বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। ঠাকুরের সম্বন্ধে ঐরূপ ধারণা ইতিপূর্বে অনেকের প্রাণে উপস্থিত হইলেও তাহারা সকলে তাহার নিষেধ মানিয়া ঐ বিষয় প্রাণের মধ্যে লুক্কায়িত রাখিয়াছিল—কারণ ঠাকুর চিরকাল একথা বলিয়া আসিতেছিলেন, তাঁহার দেহরক্ষার অনতিকাল পূর্বেই বহুলোকে তাঁহাকে ঈশ্বরবতায় বলিয়া জানিতে পারিবে। গিরিশচন্দ্রের মনের গঠন অন্যরূপ ছিল, তিনি দুষ্কর্ম বা সুকর্ম যাহা কিছু করিয়াছেন আজীবন কখনও লুকাইয়া করিতে পারেন নাই, সুতরাং ঐ বিষয়েও ঠাকুরের নিষেধ মানিয়া চলিতে পারিলেন না। তাহার প্রখর বুদ্ধি, উচ্চাবচ ঘটনা বলপূর্ণ বিচিত্র জীবন এবং প্রাণের অসীম উৎসাহ ও বিশ্বাসই যে তাঁহাকে ঠাকুরের দিব্যশক্তির অনন্ত প্রভাবের কথা বুঝাইয়া তাহার হতে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করিতে সহায়তা করিয়াছে, একথা ভুলিয়া যাইয়া তিনি স্বয়ং যাহা করিয়াছেন তাহাই করিবার জন্য সকলকে মুক্তকণ্ঠে আহ্বান করিতে লাগিলেন। ফলে আন্তরিকতার পরিবর্তে লোকে মুখে বকা দিয়াছি, আত্মসমর্পণ করিয়াছি ইত্যাদি বলিয়া সাধন, ভজন, ত্যাগ ও তপস্যাদির প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষাপূর্বক ধৰ্মলাভ ব্যাপারটাকে সুখসাধ্য করিয়া লইল। ঠাকুরের প্রতি গিরিশচন্দ্রের অসীম ভালবাসা ঐ বিষয় প্রচারের পথে অন্তরায় হইতে পারি, কিন্তু তাহার বুদ্ধি তাহাকে বুঝাইয়া দিল যুগযুগান্তের গ্লানি দূরপূর্বক অভিনব ধর্মচক্র প্রবর্তনের জন্য যাহার দেহধারণ এবং ত্রিতাপে তাপিত জীবকুলকে আশ্রয় দিবার জন্যই যিনি জন্মজরাদি দুঃখ-কষ্ট স্বেচ্ছায় বহন করিতেছেন, অভীষ্ট কাৰ্য্য সম্পূর্ণ হইবার পূর্বে তাহার দেহাবসান কখন সম্ভবপর নহে। সুতরাং ঠাকুরের আশ্রয় লাভপূর্বক লোকে তাহার ন্যায় শান্তি ও দিবব্যাঙ্গাসের অধিকারী হইবে বলিয়া তিনি যে তাহাদিগকে আহ্বান করিতেছেন তাহাতে দূষণীয় কিছুই নাই।
উহার বৃদ্ধি বিষয়ে গিরিশের অনুসরণে রামচন্দ্রের চেষ্টা
গিরিশচন্দ্রের প্রখর বুদ্ধি ও যুক্তিতর্কের সম্মুখে রামচন্দ্র প্রমুখ অনেক প্রবীণ গৃহী ভক্তের বুদ্ধি তখন ভাসিয়া গিয়াছিল। আমরা ইতিপূর্বে বলিয়াছি, রামচন্দ্র বৈষ্ণববংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, সুতরাং দিব্যশক্তির বিকাশ দেখিয়া তিনি যে ঠাকুরকে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীগৌরাঙ্গ বলিয়া বিশ্বাস করিবেন, ইহা বিচিত্র বিষয়ে নহে। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের প্রচারের পূর্বে তিনি উহা অনেকটা রাখিয়া-ঢাকিয়া লোকসমক্ষে প্রকাশ করিতেন। এখন গিরিশচন্দ্রের সহায়তা পাইয়া তাহার উৎসাহ ঐ বিষয়ে সম্যক্ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল। তিনি এখন ঠাকুরকে অবতার বলিয়া নির্দেশ করিয়াই ক্ষান্ত রহিলেন না, কিন্তু তাহার ভক্তগণ গৌরাঙ্গ ও শ্রীকৃষ্ণাবতারে কে কোন সাঙ্গোপাঙ্গরূপে আবির্ভূত হইয়াছিল, সময়ে সময়ে তদ্বিষয়ের জল্পনাও করিতে লাগিলেন এবং বলা বাহুল্য, সাময়িক ভাবুকতার উচ্ছাসে যাহাদিগের এখন শারীরিক বিকৃতি এবং কখন কখন বাহ্যসংজ্ঞার লোপ হইতেছিল, তাহারা তৎকৃত সিদ্ধান্তে উচ্চস্থান লাভ করিতে থাকিল।
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর ঐ বিষয়ে সহায়তা
ঠাকুরের যুগাবতারত্বে বিশ্বাস স্থাপনপূর্বক ভক্তগণের অনেকে যখন ঐরূপে ভাবুকতার উচ্ছাসে অঙ্গ ঢালিতেছিল, তখন শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর ঢাকা হইতে আগমন এবং ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়া সকলের সমক্ষে মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করা যে, তিনি ঢাকায় গৃহমধ্যে বসিয়া ধ্যান করিবার কালে ঠাকুর তথায় সশরীরে আবির্ভূত হইয়াছিলেন এবং তিনি (বিজয়) তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বহস্তে স্পর্শ করিয়া দেখিয়াছিলেন(১)—অগ্নিতে ইন্ধন সংযোগের ন্যায় ফলদ হইয়াছিল। ঐরূপে নানা প্রকারে ভাবুকতার বৃদ্ধিতে ভক্তগণের মধ্যে পাঁচ-সাত জনের তখন ভজন-সঙ্গীতাদি শুনিবামাত্র বাহ্যসংজ্ঞার আংশিক লোপ ও শারীরিক বিকৃতি উপস্থিত হইতেছিল এবং অনেকেই সহজ-বুদ্ধি ও জ্ঞান-বিচারের প্রশস্ত পথ পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক ঠাকুরের দৈবশক্তি প্রভাবে কখন কি অঘটন ঘটিয়া বসিবে, এইরূপ একটা ভাব লইয়া সৰ্ব্বদা উদ্গ্রীব হইয়া থাকিতে অভ্যস্ত হইতেছিল।
(১) ‘লীলাপ্রসঙ্গ—গুরুভাব’, উত্তরার্ধ, ৫ম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
নরেন্দ্রের ঐ বিষয় খর্ব করিয়া ভক্তদিগের মধ্যে ত্যাগ-সংযমাদি বৃদ্ধির চেষ্টা—ঠাকুর ঐ চেষ্টা করেন নাই কেন
ঐরূপে ভাবুকতার বৃদ্ধিই যখন ধর্মের চূড়ান্ত বলিয়া ভক্তগণের মধ্যে পরিগণিত হইতেছিল, তখন ত্যাগ, সংযম ও নিষ্ঠাদির তুলনায় উহা যে অতি অকিঞ্চিৎকর বস্তু এবং উহার নির্বাধ প্রশ্রয়ে ভবিষ্যতে বিষম বিপদের সম্ভাবনা আছে–একথা ঠাকুর যাহাকে ভক্তগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উচ্চাসন সর্বদা প্রদান করিতেন, সেই সূক্ষ্মদর্শী নরেন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়াইতে পারে নাই। তিনি ঐ বিষয় বুঝাইয়া উহার হস্ত হইতে তাহাদিগকে রক্ষা করিতে বিশেষ প্রয়াস পাইয়াছিলেন। প্রশ্ন হইতে পারে, ভক্তগণের ঐরূপে বিপথে যাইবার সম্ভাবনা দেখিয়াও ঠাকুর নিশ্চেষ্ট ছিলেন কেন? উত্তরে বলা যায় তিনি নিশ্চেষ্ট ছিলেন না, কিন্তু যে ভাবুকতায় কোনরূপ কৃত্রিমতা নাই, তাহাকে ঈশ্বয়লাভের অন্যতম পথ জানিয়া ঐসকল ভক্তগণের মধ্যে কোন্ কোন্ ব্যক্তি ঐপথের যথার্থ অধিকারী তাহা লক্ষ্য করিয়া তাহাদিগকে ঐ পথে চালিত করিবার সময় ও সুযোগ অন্বেষণ করিতেছিলেন—কারণ, তাঁহাকে আমরা বারংবার বলিতে শুনিয়াছি, ‘ইচ্ছা করিলেই সহসা কোন বিষয় সংসিদ্ধ হয় না, কালে হইয়া থাকে’, অথবা ঐ বিষয়ের সিদ্ধি উপযুক্ত কালের আগমন প্রতীক্ষা করে। হইতেও পারে, ভক্তগণের ঐ ভ্রম দূর করিতে নরেন্দ্রনাথকে বদ্ধপরিকর দেখিয়া ঠাকুর উহার ফলাফল লক্ষ্য করিতেছিলেন, অথবা নরেন্দ্রনাথকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া ঐ বিষয় সংসিদ্ধ করাই তাঁহার অভীপ্সিত ছিল।
জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আনে না বলিয়া ভাবুকতার মূল্য নাই
দৃঢ়বদ্ধ শরীর এবং স্থিরপ্রতিজ্ঞ মন-বিশিষ্ট যুবক ভক্তমণ্ডলীই তাহার কথা সহজে ধরিতে-বুঝিতে পারিবে ভাবিয়া নরেন্দ্রনাথ নানা যুক্তিতর্ক সহায়ে তাহাদিগকে সর্বদা বলিতে লাগিলেন, “যে ভাবোচ্ছ্বাস মানব জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন উপস্থিত না করে, যাহার প্রভাব মানবকে এইক্ষণে ঈশ্বরলাভের জন্য ব্যাকুল করিয়া তুলিয়া পরক্ষণে কামকাঞ্চনের অনুসরণ হইতে নিবৃত্ত করিতে পারে না, তাহার গভীরতা নাই, সুতরাং তাহার মূল্যও অতি অল্প। উহার প্রভাবে কাহারও শারীরিক বিকৃতি যথা অশ্রু পুলকানি, অথবা কিছুক্ষণের জন্য বাহ্যসংজ্ঞার আংশিক লোগ হইলেও তাঁহার নিশ্চয় ধারণা, উহা স্নায়বিক দৌর্বল্যপ্রসূত; মানসিক শক্তিবলে উহাকে দমন করিতে না পারিলে পুষ্টিকর খাদ্য এবং চিকিৎসকের সহায়তা গ্রহণ করা মানবের অবশ্য কর্তব্য।”
অশ্রুপুলকাদি শারীরিক বিকৃতির মধ্যে অনেক সময় কৃত্রিমতা থাকে
নরেন্দ্র বলিতেন, “ঐরূপ অঙ্গবিকার এবং বাহ্যসংজ্ঞা লোপের ভিতর অনেকটা কৃত্রিমতা আছে। সংযমের বাঁধ যত উচ্চ এবং দৃঢ় হইবে মানসিক ভাব তত গভীর হইতে থাকিবে, এবং বিরল কোন কোন ব্যক্তির জীবনেই আধ্যাত্মিক ভাবরাশি প্রবলতায় উত্তাল তরঙ্গের আকার ধারণ করিয়া ঐরূপ সংযমের বাধকেও অতিক্রম পূৰ্বক অঙ্গবিকার এবং বাহ্যসংজ্ঞার বিলোপরূপে প্রকাশিত হয়। নির্বোধ মানব ঐকথা বুঝিতে না পারিয়া বিপরীত ভাবিয়া বলে। সে মনে করে, ঐরূপ অঙ্গবিকৃতি ও সংবিলুপ্তির ফলেই বুঝি ভাবের গভীরতা সম্পাদিত হয় এবং তজ্জন্য ঐ সকল যাহাতে তাহার শীঘ্র শীঘ্র উপস্থিত হয়, তদ্বিষয়ে ইচ্ছাপূর্বক চেষ্টা করিতে থাকে। ঐরূপে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চেষ্টা ক্রমে অভ্যাসে পরিণত হয় এবং তাহার স্নায়ুসকল দিন দিন দুর্বল হইয়া ঈষন্মাত্র ভাবের উদয়েও তাহাতে ঐ বিকৃতিসকল উপস্থিত করে। ফলে উহার অবাধ প্রশ্রয়ে মানব চরমে চিররুগ্ন অথবা বাতুল হইয়া যায়। ধর্মসাধনে অগ্রসর হইয়া শতকরা আশী জন জুয়াচোর এবং পনর জন আন্দাজ উন্মাদ হইয়া যায়। অবশিষ্ট পাঁচজন মাত্র পূর্ণ সত্যের সাক্ষাৎকারে ধন্য হইয়া থাকে। অতএব সাবধান।”
কোন কোন ভক্তের আচরণ দেখিয়া নরেন্দ্রের কথা বিশ্বাস
নরেন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত কথাসকল সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া আমরা প্রথম প্রথম বিশ্বাস করিতে পারিতাম না। কিন্তু অনতিকাল পরে ঘটনাচক্রে যখন জানিতে পারা গেল নির্জনে বসিয়া ভাবোদ্দীপক পদাবলী গাহিতে গাহিতে অনুরূপ অঙ্গবিকৃতিসকল আনয়নের জন্য জনৈক ভক্ত চেষ্টা করিয়া থাকে—ভাবাবেশে বাহ্যসংজ্ঞার আংশিক বিলোপ হইলে অপর জনৈক ভক্ত যেরূপ মধুর নৃত্য করে, সেইরূপ নৃত্য সে পূর্বে অভ্যাস করিয়াছিল—এবং পূর্বোক্ত ব্যক্তির নৃত্য দেখিবার স্বল্পকাল পরে অপর এক ব্যক্তিও ভাবাবিষ্ট হইয়া তদনুরূপ নৃত্য করিতে আরম্ভ করিল, তখন তাহার (নরেন্দ্রনাথের) কথার সত্যতা আমাদিগের অনেকটা হৃদয়ঙ্গম হইল। আবার, জনৈক ভক্তের পূর্বাপেক্ষা ঘন ঘন ভাবাবেশ হইতে দেখিয়া যেদিন তিনি তাহাকে বিরলে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া ভাবসংযম অভ্যাস ও অপেক্ষাকৃত পুষ্টিকর খাদ্য ভোজন করিতে অনুরোধ করিলেন এবং এক পক্ষকাল ঐরূপ করিবার ফলে সে যখন অনেকটা সুস্থ ও সংযত হইতে পারিল, তখন নরেন্দ্রনাথের কথায় অনেকে বিশ্বাস স্থাপন পূর্বক তাহাদিগের ন্যায় ভাবাবেশে অঙ্গবিকৃতি ও বাহ্যসংজ্ঞাবিলুপ্তি হয় নাই বলিয়া আপনাদিগকে অভাগ্যবান্ বলিয়া আর ধারণা করিতে পারিল না।
ভাবুকতা লইয়া নরেন্দ্রের ব্যঙ্গ পরিহাস—দানা ও সখী
যুক্তিতর্ক অবলম্বনে ঐবিষয় প্রচার করিয়াই নরেন্দ্র ক্ষান্ত হন নাই, কিন্তু কাহারও ভাবুকতায় কিছুমাত্র কৃত্রিমতার সন্ধান পাইলে ঐ বিষয় লইয়া সকলের সমক্ষে ব্যঙ্গ পরিহাসে তাহাকে সময়ে সময়ে বিশেষ অপ্রতিভ করিতেন। আবার, পুরুষের স্ত্রীজনোচিত ভাবানুকরণ, যথা—বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে প্রচলিত সখীভাবাদি সাধনাভ্যাস কখন কখন কিরূপ হাস্যাস্পদ আকার ধারণ করে, তদ্বিষয়ে প্রসঙ্গ তুলিয়া তিনি ভক্তদিগের মধ্যে পরিহাস কখন কখন হাস্যের রোল তুলিতেন এবং আমাদিগের মধ্যে যাহাদিগের ঐরূপ ভাবপ্রবণতা ছিল, তাহাদিগকে সখী-শ্রেণীভুক্ত বলিয়া নির্দেশ করিয়া পরিহাস করিতেন। ফলকথা, ধর্মসাধনে অগ্রসর হইয়াছে বলিয়া পুরুষ নিজ পুরুষকার, তত্ত্বানুসন্ধানপ্রবৃত্তি, ওজস্বিতাদি বিসর্জন দিয়া সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আপনাকে আবদ্ধ করিবে এবং স্ত্রীজনোচিত ভাবানুকরণ, বৈষ্ণবপদাবলী ও রোদনমাত্র অবলম্বন করিবে ইহা–পুরুষসিংহ নরেন্দ্রনাথ একেবারেই সহ্য করিতে পারিতেন না। তজ্জন্য ঠাকুরের পুরুষভাবাশ্রয়ী জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি বিশিষ্ট ভক্তদিগকে ‘শিবের ভুত অথবা দানা-শ্রেণীভুক্ত’ বলিয়া পরিহাসপূৰ্ব্বক নির্দেশ করিতেন এবং তদ্বিপরীত সকলকে পূর্বোক্তরূপে ‘সখী-শ্রেণীভুক্ত’ বলিতেন।
ভাবুকতার স্থলে যথার্থ বৈরাগ্য ও ঈশ্বরপ্রেম প্রতিষ্ঠা করিবার চেষ্টা
ঐরূপে যুক্তিতর্কে এবং ব্যঙ্গ পরিহাস সহায়ে ভাবুকতার গণ্ডী ভগ্ন করিয়াই নরেন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত হন নাই। কাহারও কোনরূপ ভাব ভঙ্গ করিয়া তাহার স্থলে অবলম্বনম্বরূপে অন্য ভাব যতক্ষণ না প্রতিষ্ঠিত করিতে পারা যায়, ততক্ষণ প্রচার-কাৰ্য্য সুসম্পন্ন ও ফলদ হয় না—একথা তিনি সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতেন এবং তজ্জন্য ঐ বিষয়ে এখন হইতে বিশেষ প্রয়াস ও ঈশ্বরপ্রেম পাইয়াছিলেন। অবসরকালে যুবক-ভক্তসকলকে দলবদ্ধ করিয়া তিনি সংসারের অনিত্যতা, বৈরাগ্য এবং ঈশ্বরভক্তিমূলক সঙ্গীতসকল তাহাদিগের সহিত মিলিত হইয়া গাহিয়া তাহাদিগের প্রাণে ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং ভক্তিভাব অনুক্ষণ প্রদীপ্ত রাখিতেন। ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়া অনেকে তখন তাহার মধুর সুরলহরী উৎক্ষিপ্ত ‘কেয়া দেলমান তামিল পেয়ারা আখের মাট্টিমে মিল যানা’, অথবা—’জীবন মধুময় তব নামগানে হয় হে, অমৃতসিন্ধু চিদানন্দঘন হে’, অথবা
মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ু-
শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্।।
ঠাকুরকে ভালবাসিলে তাঁহার সদৃশ জীবন হইবে
প্রভৃতি সঙ্গীত ও স্তবাদি শ্রবণে বৈরাগ্য ও ঈশ্বর-প্রেমের উত্তেজনায় অশ্রু বিসর্জন করিতে করিতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। ঠাকুরের জীবনের গভীর ঈশ্বরানুরাগপ্রসূত সাধন-কথাসকল বিবৃত করিয়া কখন বা তিনি তাহাদিগকে তাঁহার তাহার মহিমাজ্ঞাপনে মুগ্ধ ও স্তম্ভিত করিতেন এবং ‘ঈশানুসরণ’ গ্রন্থ হইতে বচন উদ্ধৃত করিয়া বলিতেন, ‘প্রভুকে যে যথার্থ ভালবাসিবে তাহার জীবন সর্বতোভাবে শ্রীপ্রভুর জীবনের অনুযায়ী হইয়া গঠিত হইয়া উঠিবে,অতএব ঠাকুরকে আমরা ঠিক ঠিক ভালবাসি কি-না তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ উহা হইতেই পাওয়া যাইবে’। আবার ‘অদ্বৈত-খান আঁচলে বেঁধে যাহা ইচ্ছা তাহা কর’–ঠাকুরের ঐকথা তাহাদিগকে স্মরণ করাইয়া বুঝাইয়া দিতেন, তাঁহার সকলপ্রকার ভাবুকতা ঐ জ্ঞানকে ভিত্তিস্বরূপে অবলম্বন করিয়া উত্থিত হইয়া থাকে—অতএব ঐ জ্ঞান যাহাতে সর্বাগ্রে লাভ করিতে পারা যায় তজ্জন্য তাহাদিগকে সচেষ্ট হইতে হইবে।
ভক্তগণকে নতুন তত্ত্বসকল পরীক্ষাপূর্বক গ্রহণ করাইবার চেষ্টা
নূতন তত্ত্বসকলের পরীক্ষাপূর্বক গ্রহণে তিনি তাহাদিগকে অনেক সময়ে প্রোৎসাহিত করিতেন। আমাদের স্মরণ আছে, ধ্যান বা চিত্তৈকাগ্রতা সহায়ে আপনার ও অপরের শারীরিক ব্যাধি দূর করা যাইতে পারে, ঐকথা শুনিয়া তিনি একদিন আমাদিগকে একত্র মিলিত করিয়া ঠাকুরের শারীরিক ব্যাধি দুর করিবার মানসে দ্বার রুদ্ধ করিয়া গৃহমধ্যে ঐরূপ অনুষ্ঠানে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ঐরূপ আবার, অযুক্তিকর বিষয়সকল হইতে ভক্তগণ যাহাতে দূরে অবস্থান করে, তদ্বিষয়েও তিনি সর্বদা প্রয়াস পাইতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ নিম্নলিখিত ঘটনাটির উল্লেখ করা যাইতে পারে—
মহিম চক্রবর্তীর লোকমান্যলাভের লালসা
মতিঝিলের দক্ষিণাংশ যথায় কাশীপুরের রাস্তার সহিত সংযুক্ত হইয়াছে, তাহারই সম্মুখে রাস্তার অপর পাশে মহিমাচরণ চক্রবর্তীর বাটী ছিল। নানা সদগুণভূষিত হইলেও চক্রবর্তী মহাশয় লোকমান্যের জন্য নিরন্তর লালায়িত ছিলেন। বোধ হয় মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করিলে যদি লোকমান্য পাওয়া যাইত তাহা হইলে তাহা করিতেও তিনি কুণ্ঠিত হইতেন না। কিসে লোকে তাঁহাকে ধনী, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, ধাৰ্মিক, দানশীল ইত্যাদি যাবতীয় সদগুণশালী বলিবে, এই ভাবনা তাহার জীবনের প্রত্যেক কাৰ্য নিয়মিত করিয়া সময়ে সময়ে তাঁহাকে লোকের নিকটে হাস্যাস্পদ করিয়াও তুলিত। চক্রবর্তী মহাশয় কোন সময়ে এক অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলিয়া তাহার নাম রাখিয়াছিলেন, ‘প্রাচ্য-আর্য্য-শিক্ষা কাণ্ড-পরিষৎ’, তাহার একমাত্র পুত্রের নাম রাখিয়াছিলেন, ‘মৃগাঙ্ক মৌলী পূততুণ্ডী, বাটীতে একটি হরিণ ছিল তাহার নামকরণ করিয়াছিলেন, ‘কপিঞ্জল’। কারণ তাহার ন্যায় পণ্ডিত ব্যক্তির ছোটখাট সরল নাম রাখা কি শোভা পায়? তাহার ইংরাজী, সংস্কৃত নানা গ্রন্থ সংগ্রহ ছিল। আলাপ হইবার পরে একদিন নরেন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার বাটীতে যাইয়া আমরা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ‘চক্রবর্তী মহাশয়, আপনি এত গ্রন্থ সব পড়িয়াছেন?’ উত্তরে তিনি সবিনয়ে উহা স্বীকার করিয়াছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই নরেন্দ্র উহার মধ্যস্থিত কতকগুলি গ্রন্থ বাহির করিয়া উহাদিগের পাতা কাটা নাই দেখিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বলিয়াছিলেন, ‘কি জান ভায়া, লোকে আমার পড়া পুস্তকগুলি লইয়া যাইয়া আর ফিরাইয়া দেয় নাই, তাহার স্থলে এই পুস্তকগুলি পুনরায় কিনিয়া রাখিয়াছি, এখন আর কাহাকেও পুস্তক লইয়া যাইতে দিই না। নরেন্দ্রনাথ কিন্তু স্বল্প দিনেই আবিষ্কার করিয়াছিলেন, চক্রবর্তী মহাশয়ের সংগৃহীত যাবতীয় পুস্তকেরই পাতা কাটা নাই! সুতরাং ঐ সকল গ্রন্থ যে তিনি কেবলমাত্র লোকমান্যলাভ ও গৃহশোভা বন্ধনের জন্য রাখিয়াছেন, তদ্বিষয়ে নরেন্দ্রের একরূপ দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল।
জ্ঞানী মহিমের ব্যাঘ্রাজিন
আমাদের সহিত আলাপ হইবার কালে ধর্মসাধনার কথাপ্রসঙ্গে চক্রবর্তী মহাশয় আপনাকে জ্ঞানমার্গের সাধক বলিয়া পরিচয় দিয়া ছিলেন। কলিকাতাবাসী ভক্তসকলের ঠাকুরের নিকট যাইবার বহু বৎসর পূর্ব হইতে মহিমাচরণ দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতেন এবং কোন কোন পৰ্বদিবসে পঞ্চবটীতলে ব্যাঘ্রচর্ম বিছাইয়া গেরুয়াবস্ত্র পরিধান, রুদ্রাক্ষ ধারণ ও একতারা গ্রহণপূর্বক আড়ম্বর করিয়া সাধনায় বসিতেন। গৃহে ফিরিবার কালে ব্যাঘ্রাজিনখানি ঠাকুরের ঘরের এক কোণে দেয়ালের গায়ে ঝুলাইয়া রাখিয়া যাইতেন। ঠাকুর তাহাকে ‘এক আঁচড়ে’ই চিনিয়া লইয়াছিলেন। কারণ ঐ ব্যাম্ৰাজিন খানি কাহার, একথা আমাদিগের একজন এক দিবস প্রশ্ন করিলে বলিয়াছিলেন, “ওখানি মহিম চক্রবর্তী রাখিয়া গিয়াছে। কেন জান? লোকে উহা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিবে ওখানি কার এবং আমি তাহার নাম করিলে ধারণা করিবে মহিম চক্রবর্তী একটা মস্ত সাধক।”
মহিমের গুরু
দীক্ষাসম্বন্ধে কথা উঠিলে মহিম বাবু কখন বলিতেন, “আমার গুরুদেবের নাম আগমাচাৰ্য্য ডমরুবল্লভ।” আবার কখন বলিতেন, “ঠাকুরের ন্যায় তিনিও পরমহংস পরিব্রাজক শ্রীযুক্ত তোতাপুরীর নিকট দীক্ষাগ্রহণ করিয়াছেন! পশ্চিমে তীৰ্থপৰ্যটনকালে এক স্থানে তাহার দর্শন পাইয়াছিলাম এবং দীক্ষিত হইয়াছিলাম, ঠাকুরকে তিনি ভক্তি অবলম্বন করিয়া থাকিতে বলিয়াছেন এবং আমাকে জানমার্গের সাধক হইয়া সংসারে থাকিতে উপদেশ করিয়াছেন।” বলা বাহুল্য ঐকথা কতদূর সত্য তাহা তিনি স্বয়ং এবং সর্বান্তৰ্যামী পুরুষই জানিতেন।
মহিম বাবুর ধর্ম-সাধনা
সাধনার মধ্যে দেখা যাইত মহিম বাবু যখন তখন এবং যেখানে সেখানে একতারার সুরের সহিত গলা মিলাইয়া প্রণবোচ্চারণ, মধ্যে মধ্যে এক-আধটি উত্তরগীতাদি পুস্তকের শ্লোক পাঠ ও হুঁকারধ্বনি করিতেন। তিনি বলিতেন, উহাই সনাতন জ্ঞানমার্গের সাধনা, উহা করিলে অন্য কোনও সাধনা করিবার প্রয়োজন নাই। উহাতেই কুলকুণ্ডলিনী জাগরিত হইয়া উঠিবে এবং ঈশ্বরদর্শন হইবে। মহিম বাবুর বাটীতে শ্ৰীশ্ৰীঅন্নপূর্ণামূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং বোধ হয় প্রতি বৎসর জগদ্ধাত্রীপূজাও হইত—উহা হইতে অনুমিত হয় তিনি শাক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। শেষজীবনে ইনি শাক্ত সাধনপ্রণালীই অবলম্বন করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। কারণ তখন ইহাকে একখানি ছোট বগি-গাড়ীতে করিয়া ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিবার কালে মধ্যে মধ্যে চীৎকার করিয়া বলিতে ওনা যাইত, ‘তারা তত্ত্বমসি, ত্বমসি তৎ’। চক্রবর্তী মহাশয়ের অল্প-অল্প জমিদারী ছিল, তাহার আয় হইতেই তাহার সংসার নির্বাহ হইত।
শ্যামপুকুরে মহিমাচরণ
ঠাকুরের শ্যামপুকুরে অবস্থান করিবার কালে মহিম বাবু দুই তিন বার তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। তখন ঠাকুরের কহিত কুশল-প্রশ্নাদি করিবার পরে তিনি সাধারণের নিমিত্ত যে ঘর নির্দিষ্ট ছিল, তাহাতে আসিয়া বসিতেন এবং একতারা-সংযোগে মন্ত্রসাধনে এবং উহারই ভিতর মধ্যে মধ্যে অপরের সহিত ধৰ্ম্মালাপে নিযুক্ত হইতেন। তাঁহার গৈরিকপরিহিত সুন্দর কান্তি, বিশাল বপু এবং বাক্যচ্ছটায় মুগ্ধ হইয়া অনেকে তখন তাহাকে আধ্যাত্মিক নানা প্রশ্ন করিতে থাকিত। ঠাকুরও কখন কখন তাঁহাকে বলিতেন, “তুমি পণ্ডিত, (উপস্থিত সকলকে দেখাইয়া) ইহাদিগকে কিছু উপদেশ দাও গে।” কারণ কতকগুলি শিষ্য সংগ্রহপূর্বক ধর্মোপদেষ্টা বলিয়া নিজ নাম জাহির করাটা যে তাহার প্রাণের ইচ্ছা, একথা তাহার জানিতে বাকি ছিল না।
মহিম ও নরেন্দ্রের তর্ক
শ্যামপুকুরে আসিয়া মহিম বাবু একদিন ঐরূপে নানা কথা কহিতে লাগিলেন এবং অন্য সকল প্রকার সাধনোপায়কে হীন করিয়া তাহার অবলম্বিত সাধনপথই শ্রেষ্ঠ এবং সহজ, ইহা প্রতিপন্ন করিতে লাগিলেন। ঠাকুরের যুবকভক্ত সকলে তাহার ঐ কথাসকল বিনা প্রতিবাদে শুনিতেছে দেখিয়া নরেন্দ্রনাথের আর সহ্য হইল না। তিনি বিপরীত তর্ক উত্থাপিত করিয়া মহিম বাবুর কথা অযুক্তিকর দেখাইতে লাগিলেন এবং বলিলেন, ‘আপনার ন্যায় একতারা বাজাইয়া মন্ত্রোচ্চারণ করিলেই যে ঈশ্বর-দর্শন উপস্থিত হইবে তাহার প্রমাণ কি?’ উত্তরে মহিম বাবু বলিলেন, ‘নাদই ব্ৰহ্ম, ঐ স্বরসংযুক্ত মন্ত্রোচ্চারণের প্রভাবে ঈশ্বরকে দেখা দিতেই হইবে, অন্য আর কিছু করিবার আবশ্যক নাই’। নরেন্দ্র বলিলেন, “ঈশ্বর আপনার সহিত ঐরূপ লেখা-পড়া করিয়াছেন না কি? অথবা ঈশ্বর মন্ত্রৌষধিবশ সর্পের ন্যায়-সুর চড়াইয়া হুম-হাম করিলেই অবশ হইয়া সুড়সুড়, করিয়া সম্মুখে নামিয়া আসিবেন!” বলা বাহুল্য, নরেন্দ্রনাথের তর্কের জন্য মহিম বাবুর প্রচার কাৰ্যটা সেদিন বিশেষ জমিল না এবং তিনি ঐ দিবস শীঘ্র শীঘ্র বিদায় গ্রহণ করিলেন।
নরেন্দ্রের যথার্থ সাধকসকলকে সমান জ্ঞান করিতে শিক্ষা দেওয়া
ভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত যথার্থ সাধকসকলে যাহাতে ঠাকুরের ভক্ত দিগের নিকটে বিশেষ সম্মান পায়, তদ্বিষয়েও নরেন্দ্রনাথের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি বলিতেন, সাধারণে যেরূপে অপর সকলের নিন্দা এবং কেবলমাত্র নিজ সম্প্রদায়ের সাধকসকলকেই শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, ঐরূপ করিলে ঠাকুরের ‘যত মত তত পথ’-রূপ মতবাদের উপরে– সুতরাং ঠাকুরের উপরেই অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়। শ্যামপুকুরে থাকিবার কালে ঐরূপ একটি ঘটনার কথা আমাদিগের স্মরণ হইতেছে—
খৃষ্টান ধর্মযাজক প্রভুদয়াল মিশ্র
প্রভুদয়াল মিশ্র নামক জনৈক খৃষ্টান ধর্মযাজক ঠাকুরকে দর্শন করিবার জন্য একদিন উপস্থিত হইলেন। গেরুয়া পরিহিত দেখিয়া আমরা তাহাকে প্রথমে খৃষ্টান বলিয়া বুঝিতে পারি নাই। পরে কথাপ্রসঙ্গে তিনি যখন তাহার স্বরূপ পরিচয় প্রদান করিলেন, তখন তাহাকে প্রশ্ন করা হইল, তিনি খৃষ্টান হইয়া গৈরিক বস্ত্র ব্যবহার করেন কেন? তাহাতে তিনি উত্তর করিয়াছিলেন, “ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, ভাগ্যক্রমে ঈশামসির উপর বিশ্বাস স্থাপনপূর্বক তাঁহাকে নিজ ইষ্টদেবতারূপে গ্রহণ করিয়াছি বলিয়াই কি আমাকে আমার পিতৃপিতামহাগত চালচলনাদি ছাড়িয়া দিতে হইবে? আমি যোগশাস্ত্রে বিশ্বাস এবং ঈশাকে ইষ্টদেবতারূপে অবলম্বন করিয়া নিত্য যোগাভ্যাস করিয়া থাকি। জাতিভেদে আমার বিশ্বাস না থাকিলেও যাহার-তাহার হস্তে ভোজনে যোগাভ্যাসের হানি হয়, এ কথায় আমি বিশ্বাস করি এবং নিত্য স্বপাকে হবিষ্যান্ন খাইয়া থাকি। উহার ফলে খৃষ্টান হইলেও যোগাভ্যাসের ফল—যথা, জ্যোতিদর্শনাদি আমার একে একে উপস্থিত হইতেছে। ভারতের ঈশ্বরপ্রেমিক যোগীরা সনাতন কাল হইতে গৈরিক পরিধান করিয়া আসিয়াছেন, সুতরাং উহাপেক্ষা আমার নিকটে অন্য কোন প্রকার বসন কি প্রিয়তর হইতে পারে? প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিয়া নরেন্দ্রনাথ তাহার প্রাণের কথাসকল ঐরূপে একে একে বাহির করিয়া লইয়াছিলেন এবং সাধু ও যোগী জনিয়া তাহাকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমাদিগকেও ঐরূপ করিতে শিক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন। আমাদিগের অনেকেও উহাতে তাহার পাদস্পর্শপূর্বক প্রণাম ও তাঁহার সহিত একত্রে ঠাকুরের প্রসাদী মিষ্টান্নদি ভোজন করিয়াছিল। ঠাকুরকে ইনি সাক্ষাৎ ঈশা বলিয়া নিজ মত প্রকাশ করিয়াছিলেন।
ঠাকুরের ব্যাধির বৃদ্ধি ও ভক্তগণের তাঁহাকে কাশীপুর লইয়া যাওয়া
ঐরূপে নরেন্দ্রনাথ যখন ঠাকুরের ভক্তগণকে সুপথে পরিচালিত করিতে নিযুক্ত ছিলেন, তখন ঠাকুরের শারীরিক ঠাকুরের ব্যাধি দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছিল। ডাক্তার সরকার পূর্বে যে-সকল ঔষধপ্রয়োগে স্বল্পাধিক ফল পাইয়া ছিলেন, ঐ সকল ঔষধে এখন আর কোন উপকার হইতেছে না দেখিয়া চিন্তিত হইয়া পড়িলেন এবং কলিকাতার দূষিত বায়ুর জন্য ঐরূপ হইতেছে স্থির করিয়া শহরের বাহিরে কোন বাগানবাটীতে ঠাকুরকে রাখিবার জন্য পরামর্শ প্রদান করিলেন। তখন অগ্রহায়ণের অর্ধেক অতীত হইয়াছে। পৌষ মাসে ঠাকুর বাটী পরিবর্তন করিতে চাহিবেন না জানিয়া ভক্তগণ এখন উঠিয়া পড়িয়া ঐরূপ বাগানবাটীর অনুসন্ধানে লাগিয়া যাইলেন এবং অনতিকালের মধ্যেই কাশীপুরস্থ মতিঝিলের উত্তরাংশ যেখানে বরাহনগর-বাজারে যাইবার বড় রাস্তার সহিত সংযুক্ত হইয়াছে, তাহারই সম্মুখে রাস্তার অপর (পূর্ব) পার্শ্বে অবস্থিত রাণী কাত্যায়নীর জামাতা গোপালচন্দ্র ঘোষের উদ্যানবাটী ৮০ টাকা মাসিক ভাড়ায় ঠাকুরের বাসের জন্য ভাড়া করিয়া লইলেন। ঠাকুরের পরমভক্ত কলিকাতার শিমুলিয়া পল্লীনিবাসী সুরেন্দ্রনাথ মিত্র মহাশয় উক্ত বাটীভাড়ার সমস্ত ব্যয়বহনে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন।
বাটী স্থির হইলে শুভদিন দেখিয়া শ্যামপুকুর হইতে দ্রব্যাদি লইয়া যাইয়া উক্ত বাটীতে থাকিবার বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। পরিশেষে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির এক দিবস পূৰ্বে অপরাহে ভক্তগণ শ্যামপুকুরের বাসা হইতে ঠাকুরকে কাশীপুরের উদ্যানবাটীতে আনয়ন করিলেন এবং ফলপুষ্পসমন্বিত বৃক্ষরাজিশোভিত ঐস্থানের মুক্তবায়ু, নির্জনতা প্রভৃতি দর্শনে ঠাকুরকে আনন্দিত দেখিয়া পরম চিত্তপ্রসাদ লাভ করিলেন।