বিভ্রান্ত-বৈভব – ইব্রাহিম জলিস
অনেকক্ষণ হল সূর্য অস্ত গেছে। অন্ধকার গম্ভীর হতে গভীরতর হচ্ছে। কিন্তু এ যে শুধু অন্ধকার; রাত কোথায়? করাচি থেকে হাজার মাইল দূরে হংকং-এর রাস্তায় মজিদ খান রাতই খুঁজছে। পুরুষের জীবনে সূর্যাস্তের পর যদি কোনো নারী না থাকে, বা নারীর জীবনে পুরুষ না থাকে তবে সূর্যোদয় পর্যন্ত শুধু অন্ধকারই প্রতীয়মান হয়। তাই তো অন্ধকারে নারী-পুরুষের প্রথম মিলনকে ‘প্রথম রাত’ বলে অভিহিত করা হয়।
প্রথম রাত। ইতোপূর্বে জীবনটা গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।
নারী হলে অন্ধকার রাত, নারী ছাড়া রাত শুধুই অন্ধকার।
যৌবন-সীমায় পা দেবার পর থেকে আজ পর্যন্ত মজিদ খানের জীবনে এই প্ৰথম সূর্যাস্তের পর রাতের বদলে নিকষ কালো অন্ধকার প্রতীয়মান হয়। কারণ, তার মনোরম রাত– কুলসুম করাচিতে অথচ সে এখানে।
মজিদ খান যতদিন করাচি ছিল ততদিন তার জীবনে কুলসুম ছাড়া আর একটি রাতও উদয় হয়নি। আর তাই মেয়েদের সাথে ব্যবহারে মজিদ খান বেশ ধৈর্য, পারদর্শিতা আর সংযমের পরিচয় দিত, যাতে করে এক কুলসুম ছাড়া শহরের যে-কোনো মহিলা নিৰ্ভয়ে তার সাথে মেলামেশা করতে পারত। কিন্তু একান্ত নীরবে-নিভৃতে মজিদ খানের অন্তরাত্মা বারবার তাকে একটিমাত্র প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলছে– সত্যি কি মেয়েদের ব্যাপারে খুব বেশি নির্লিপ্ত ছিল? আদমের নির্লিপ্ততার পেছনেও একটা বড় কারণ তখন হাওয়া ছাড়া অন্য কোনো নারীই পৃথিবীতে ছিল না। কিন্তু যেই পৃথিবীতে একাধিক নারীর আবির্ভাব ঘটেছে, অমনি মানুষের ভেতরকার বহুদিনের সুপ্ত পাশবিক প্রবৃত্তি আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই তো পৃথিবীতে নারীর জন্যেই প্রথম রক্তের বন্যা প্রবাহিত হয়েছিল।
তাহলে আর নির্লিপ্ততা কী? নির্লিপ্ত মনোভাব বা আভিজাত্যের নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা শুধুমাত্র দৈনন্দিন জীবনের পরিচিতির বন্ধন যা মানুষকে অক্টোপাশের মতো বেঁধে রাখে। যেহেতু পরিচিতির বন্ধন সাধারণ দৃষ্টিসীমার ঊর্ধ্বে সেহেতু মানুষকে ‘কয়েদি’ আখ্যা না-দিয়ে অভিজাত আর নির্লিপ্ত বলা হয়। অতএব মানুষের মধ্যে যদি পরিচিতির বন্ধন না-থাকে তো তারা একে অপরের জন্য পশু ছাড়া আর কিছু নয়।
এ জন্য পৃথিবীতে যত পাপ সংঘটিত হয় তা সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে হয়। কারণ, রাতের অন্ধকারে মানুষ সকল প্রকার পরিচিতির বন্ধন থেকে মুক্ত থাকে। সে সাহসী হয়ে ওঠে। যেমন– এখন আমায় কে দেখছে? বা এখন আমায় কে চিনবে?
মজিদ খানও এমন একজন যুবক হিসেবে পরিচিত যে, আভিজাত্যের ছোঁয়ায় নির্লিপ্ত। কারণ তার দৃষ্টিসীমা ছিল পরিচিতির নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ যা ছিন্ন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেদিন সে বুঝল তার আভিজাত্য আর নির্লিপ্ততা বেশ ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে, সেদিন তাকে বাধ্য হয়ে কুলসুমের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে হল। তার এ মনোভাবের দরুন পরে তাকে সাধারণ যুবকদের মনোবৃত্তি সংশোধনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত আন্দোলনের সভাপতিও মনোনীত করা হয়েছিল। সভাপতি মনোনয়নের পর সাধারণ আলোচনা-সভার বিবরণী সংবাদপত্রে ছবি-সমেত ছাপা হয়। এতে করে সে শুধু শহরেই নয় এবং দেশের প্রতিটি মানুষের পরিচিত হয়ে ওঠে। শেষে মানুষের সাধারণ পরিচিতির বন্ধন এত নিবিড় হয়ে ওঠে যে তার পক্ষে রাতের অন্ধকারেও এ-বন্ধনকে উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তার আজো মনে আছে– গভীর রাত্রে সে একদা তার এক বন্ধুর সাথে বাড়ি ফিরছিল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে আবছাভাবে একটা গলির ভেতরে তার চোখ পড়ে। দেখে একটা নারী দাঁড়িয়ে আছে। তার বন্ধুটি ওই নারীটির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছানোর সাথে সাথেই তার অন্তরাত্মা ধুক ধুক শুরু করে দেয়। শীতের ঠাণ্ডা রাতেও তার দেহ হতে দর দর করে ঘাম ছোটে। একটা দারুণ উত্তেজনায় তার পা দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে। তার ভেতর যেন একটা ভয়াবহ দানব নড়েচড়ে ওঠে– যা বছর বছর ধরে সুপ্ত ছিল। সেই বুঝি তাকে উস্কিয়ে দিচ্ছে– ‘ভয় করছ কেন? এমন ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কে তোমায় চিনবে? কেই-বা তোমায় দেখছে?’
এ মনোভাবই তার পা দুটিকে ওই নারীটির দিকে ঠেলে দিল। ঠিক সে সময় দূর থেকে একখানা গাড়ি অন্য একটা গলি থেকে এদিকে মোড় নেয়। হঠাৎ একটা উজ্জ্বল আলোকে সমস্ত গলি ঝিকমিক করে ওঠে। আলো অত্যন্ত তীব্রগতিতে তার নিকটবর্তী হচ্ছে দেখে সে ভীত কুকুরের ন্যায় লেজ গুটিয়ে অন্য একটা গলিতে ঢুকে পড়ে। ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে। তিনি আলো দেখিয়ে তাকে পাপ থেকে মুক্ত করেছেন। কিন্তু সে-কৃতজ্ঞতার প্রকাশও অনেকটা লজ্জিত বিড়ালের থাম আঁচড়ানোর রূপ পরিগ্রহ করে।
এই একটিমাত্র ঘটনা। অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতোই। আসলে মজিদ খানের জীবনে রাতের অন্ধকারে কুলসুম ছাড়া আর কিছুই করাচিতে তথা সমগ্র পাকিস্তানে ছিল না।
নারী যদি থাকে তো শুধু কুলসুম; রাত যদি থাকে তো তা-ও কুলসুম। কিন্তু আজ কুলসুম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে হংকংয়ের গভীর পাহাড়ের ভেতর যখন সূর্য অস্ত গেল হঠাৎ কুইন্স রোডের উপর একটি হিংস্র অন্ধকার মজিদ খানের সমগ্র সত্তাকে ঘিরে ফেলল।
করাচি বিমানবন্দর থেকে যে-মুহূর্তেই সে হাওয়ায় ভর দিয়ে উঠেছে সেই মুহূর্তেই তার সকল প্রকার পিরীতির বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। অতএব সে এখন কুইন্স রোডের উপর সম্পূর্ণ মুক্ত। এখানে তাকে বলবার বা জানবার কেউ নেই। অতএব সে যা-খুশি তাই করতে পারে। কোনো বন্দি যেদিন বছর-বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে সেদিন তার মনে প্রথম আকাঙ্ক্ষা জাগে কখন সূর্য অস্ত যাবে। বেশ কিছুক্ষণ আগে সূর্য অস্ত গেছে; কিন্তু রাতের তো নাম-নিশানাও নেই। মজিদ খান এই অজ্ঞাত অন্ধকারে ক্ষুধিত পশুর ন্যায় হাত-পা ছুড়ছে যেন। এমনিতে বিদেশির কাছে অন্ধকার বড় পীড়াদায়ক হয়; তা-ও আবার শীতের অন্ধকার। গভীর আর বিস্তৃত, অতএব ভীষণ। তার ওপরে বিদেশ-বিভুঁই, যেখানে মানুষ সকল প্রকার বাধ্যবাধকতা হতে মুক্ত।
তবুও মজিদ খান পাপকে ভয় করে। কারণ?
রাত পাপের জননী। অন্ধকারের গর্ভ হতে পাপের জন্ম হয়। আর সে অন্ধকারই মজিদ খানকে ঘিরে ফেলেছে।
খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হংকংয়ের রাস্তায় মজিদ খান কোনো অবলম্বন খোঁজে। সে ভাবে– কোনো রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সি ড্রাইভার বা কোনো রাতের দালালের যদি খোঁজ পাওয়া যায়, বা, স্ট্রিটল্যাম্পের নিচে একটি রাত যদি পাওয়া যায় যাতে ভর দিয়ে এই শীতল আর অজ্ঞাত অন্ধকারের হাত হতে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে।
আলোর নিচে রাত।
মজিদ খান তার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর মুখে শুনেছিল– সূর্যাস্তের পর হংকংয়ের স্ট্রিট-ল্যাম্পের নিচে অসংখ্য রাত জমায়েত হয়।
রাত্রির শহর হংকং। কারণ পূর্বের হংকং পশ্চিমের কলঙ্কের শেষ নিদর্শন স্বরূপ বিরাজ করছে– প্রাচ্যে ইংরেজের শেষ কলোনি। প্রশান্ত মহাসাগরে ইংরেজের শেষ যুদ্ধঘাঁটি। যার সঙ্গিন আর তোপ প্রথমে জাপানের দিকে উঁচানো ছিল, এখন চীনের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। হংকং চীনের প্রথম বার। এখানে ইংরেজ এবং আমেরিকা পরস্পরের সাহায্যে চীনা কম্যুনিজমকে ঠেকিয়ে রেখেছে। পূর্বে ইংরেজদের সূর্য শুধুমাত্র হংকংয়ের পাহাড়ে উদিত হত। আর অন্যান্য প্রাচ্য দেশে ইংরেজদের সূর্য অনেক আগে গঙ্গায়, ইরাবতিতে আর মেকংয়ে অস্ত গেছে। তাই লাখ লাখ, কোটি কোটি সৈন্য প্ৰশান্ত মহাসাগরের এই পর্বতসঙ্কুল দ্বীপে মাথা খুঁড়ে মরছে– যাতে-না এখানে ইংরেজের শেষ সূর্য প্যারল সাগরে অস্তাচলগামী হয়।
লাখ লাখ, কোটি কোটি সৈন্য নিজ নিজ স্ত্রী, বাগদত্তা বা প্রেয়সীর কাছ থেকে বহুদূরে অথচ মৃত্যুর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, এরই মাঝখানে পরম কমনীয় নারী।
নারী! পৃথিবীর সবচাইতে বড় লালসা। এই লালসার জালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সৈন্য আর বিভিন্ন দেশের নারী পরস্পরের সাথে একাত্ম হয়ে গেঁথে রয়েছে যেন।
বক্ষে নারী থাকলে পুরুষ মৃত্যুকেও ভয় করে না, তাই তো হংকংয়ে হাজার হাজার সৈন্যের বুকে বসে হাজার হাজার নারী তাদের সাহস আর শক্তি দিচ্ছে। সৈন্য দ্বারা যুদ্ধ জয় করা যায়, আর যুদ্ধ দ্বারা পৃথিবীতে বিচ্ছেদ ছড়িয়ে পড়ে। তবুও সূর্যাস্তের সাথে সাথেই নারী উদিত হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধই হংকংকে রাত্রির শহরে রূপান্তরিত করেছে।
কুইন্স রোডের উপর দিয়ে বিভিন্ন দেশীয় রাত চলাফেরা করে। কিন্তু মজিদ খান ঠাহর করতে পারে না কোন রাত সুন্দরী। চীনা রাত, জাপানি রাত, মালয়ী রাত, ফিলিপাইনি রাত, শ্যামি রাত, বার্মি রাত, ইংরেজ রাত, অ্যামেরিকান রাত!
কুইন্স রোডের উপর যেসব পুরুষ ঘোরাফেরা করছে মজিদ খানের কাছে সবাইকে অচেনা বলে মনে হয়; কিন্তু কোনো নারীই অচেনা নয়। সে কোনো নারীকেই জানে না, তথাপি ওরা যেন কেউ অচেনা নয়। বিদেশে যত দূরেরই হোক-না কেন পুরুষ প্রথমে নারীকেই চিনে ফেলে। আদম থেকে শুরু করে এই মজিদ খান পর্যন্ত সবারই এক অবস্থা। পৃথিবীতে কোনো পুরুষ কোনো নারীর অচেনা নয়। শুধু তার নাম, জাতিত্ব আর সম্প্রদায় অচেনা হতে পারে।
অতএব ল্যাম্পপোস্টের সাথে মূর্তির মতো দণ্ডায়মান ক্ষীণদেহী একটি নারীও তাকে দেখে চিনে ফেলল, আর মুখ টিপে হেসে কাছে ডাকল। মেয়েটির চেহারা ছোট্ট আর গোলগাল। মজিদ খান নিজের অজ্ঞাতেই যেন অনেকটা মেয়েটির ডাকে আকৃষ্ট হয়ে যন্ত্রচালিতের মতো তার দিকে পা বাড়ায়। কাছে গিয়ে পৌঁছুলে মেয়েটি অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে বলে– টুয়েনটি ডলার্স।
মজিদ খান ইংরেজিতে জবাব দিল– ডলার যা চাও পাবে সে চিন্তা করো না,– কিন্তু—-।
মেয়েটি তাকে মাঝপথে থামিয়ে বলল– নো ইংলিশ, জাপানিজ।
মজিদ খান জাপানি ভাষা জানে না। আর মেয়েটি ইংরেজি ভাষা জানে না। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই আছে, কিন্তু দোকানের ঠিকানা নেই।
সম্ভবত মেয়েটি জাপানি ভাষায় বোঝাতে চাইছে আমি তোমার হোটেলে যাব না। আর মজিদ খান চাইছে তার সাথে মেয়েটিকে হোটেলে যেতে হবে– অথবা সে হোটেলে যেতেই রাজি আছে; মজিদ খান ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী মেয়েটি বলতে চায়। মজিদ খান আক্ষেপ করে– মানুষ পরস্পরের নিকটে থাকলেও নিষ্ঠুর ভাষা তাদের কত দূরে সরিয়ে রাখে।
মেয়েটি বলল– নো টক– টুয়েন্টি ডলার্স– টু আওয়ারস।
মজিদ খান বলল— এগ্রিড।
ঠিক সে-সময় একখানা ট্যাক্সি এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। ড্রাইভার অদ্ভুত ভঙ্গিতে মজিদ খানের ওপর দৃষ্টি রেখে তাদের কাছে আসে আর বো করতে থাকে। মজিদ খান শুধু একটি শব্দ বুঝতে পারে- অ্যামেরিকান।
মজিদ খান ট্যাক্সির দিকে চায়। একটি অ্যামেরিকান অতিরিক্ত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পেছনের সিটে বসে আছে। মেয়েটি ট্যাক্সির দিকে চায়; আর অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে বলে- অ্যা, আমেরিকান? মেয়েটি মজিদ খানের দিকে আর ফিরেও তাকায় না। পাকাপাকি কথারও তোয়াক্কা না করে সে ট্যাক্সির দিকে ছুটে যায়। দরজা খুলে মাতাল অ্যামেরিকানটির পাশে বসে পড়েই তার মাথার চুল ধরে তাকে প্রকৃতিস্থ করতে চেষ্টা করে। মজিদ খান রেগে-মেগে ট্যাক্সির দিকে ছোটে কিন্তু ইতোমধ্যেই ট্যাক্সি একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
মজিদ খান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে আজ প্রথমবারের মতো অনুভব করে অ্যামেরিকার তুলনায় পাকিস্তান কত দুর্বল রাষ্ট্র। তার মনের তীব্র অনুভূতি বাঙ্ময় হয়ে বারবার তার সত্তাকে ধিক্কার দেয়– যদি মেয়েটি ইংরেজি জানত তাহলে তাকে বুঝিয়ে দিতে পারত যে, সে জাপানের ইজ্জত তথা এশিয়ার ইজ্জত অ্যামেরিকার কাছে বিক্রি করছে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর থেকে এ মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উত্থিত হয়। এ কেমনতরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আসলে তো এটা ঈর্ষা! তা না-হলে সে তো ভাবতে পারত যে, অ্যামেরিকানটি তো তারই মতো বিদেশি। সে এশিয়ার অধিবাসী হয়েও এশিয়ার ইজ্জত ক্রয় করতে চাইছে না? সে নিজেও কি জাপানের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে তয়ের হয়ে যায়নি?
কিন্তু — সত্যি কি ওই মেয়েটি জাপান বা এশিয়ার ইজ্জতে সওয়াল? যে-নারী নিজের সতীত্বকে অর্থের বিনিময়ে বিলিয়ে দিতে পারে, তার আবার সম্প্রদায় আর জাতিত্ব! যে-নারী নিজের পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে, সে তার জাতীয়তাবোধ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। একটি শুধুমাত্র দৈহিক কারবার। আর দৈহিক ব্যাপারে পৃথিবীর সব জাতই সমান
জাপানের ইজ্জত! জাপানের ইজ্জত তো এখন টোকিও, নাগাসাকি, হিরোসিমার গৃহে গৃহে নিজ নিজ স্বামীর গভীর আলিঙ্গনে সংরক্ষিত আছে। অতএব এ কী করে এশিয়ার আব্রুর সওয়াল হতে পারে! মজিদ খান হঠাৎ অ্যামেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু অসতী নারীর যেমন কোনোপ্রকার জাতীয়তাবোধ আর সাম্প্রদায়িক চেতনা থাকে না তেমনি সূর্যাস্তের পর বিদেশে পুরুষের কোনো আতা-পাতা থাকে না।
সূর্যাস্তের পর বিদেশি পুরুষ অ্যামেরিকান, ইংরেজ বা জার্মান-পাকিস্তানি কিছুই থাকে না। সবাই শুধুই পুরুষ। নেহায়েতই দেহলিপ্সু দানব। কিন্তু এটা কেমনতরো কথা যে, বৃহৎ জাতি আর ক্ষুদ্র জাতির প্রশ্ন শুধু ইউনাইটেড নেশন্সেই নয়, বেশ্যালয়েও এসে পড়বে? মজিদ খান হতাশাভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে পা বাড়ায়। একখানা উড়োজাহাজ কোম্পানির বড় বোর্ডের বিজ্ঞাপনের নিচে একটি ধবধবে সাদা রঙের মেয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। মজিদ খান তার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু মেয়েটি অন্যদিকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মজিদ খান অত্যন্ত সাহস ভরে তার পাশে এসে দাঁড়ায় আর ইংরেজিতে বলে– রাত ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তৈরি হয়নি।
মেয়েটি ভ্রুকুঞ্চিত করে জবাব দেয়– ইউ আর ব্ল্যাক, অ্যান্ড আই ডোন্ট লাইক ব্ল্যাক পিপল। একথা বলেই মেয়েটি হন হন করে প্রস্থান করে।
মজিদ খান বড় দুঃখের সাথে ভাবে পাপের ভেতরও রাজনীতি ঢুকছে। ভারি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা জীবনের!
রাত প্রায় অর্ধেক হয়ে এল। মজিদ খানের মনে হয় হোটেলে গিয়ে গভীর অন্ধকারকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়াই বরং আফজল হবে।
কিন্তু হংকং হোটেলের নিকট অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসে। মনে হয় যেন কেউ নিঃশব্দে শিস দিচ্ছে। মজিদ খান ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। একখানা বদ্ধ দোকানের শোকেসের আড়ালে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। চেহারা-সুরতে চীনা বলেই মনে হয়। মজিদ খান তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার আর রাতের প্রয়োজন নেই, সে শুধু অন্ধকারই এখন চায়। তাই মজিদ ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তার সামনে দাঁড়ায় আর নিষ্কৃতি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই বলে– আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ।
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করে– হোয়াই? মজিদ খান বলল– কারণ আমি যা বলতে চাইব তা তুমি বুঝবে না।
মেয়েটি অত্যন্ত দ্রুত ইংরেজিতে বলে– আমি ইংরেজি খুব ভালো জানি। গত যুদ্ধের আগে আমার প্রেমিক ছিল একজন ইংরেজ। সে আমায় লন্ডন নিয়ে গেছিল। আমি তো সেক্সপিয়রের নাটকও পড়তে পারি।
সেক্সপিয়রের ইংরেজি! হায়রে! ইংরেজি কোথা হতে কোথা গিয়ে পৌঁছেছে। বাকিংহাম প্যালেস আর হোয়াইট হাউস হতে শুরু করে পৃথিবীর প্রত্যেকটি গণিকালয় পর্যন্ত শুধু ইংরেজি ভাষাই লেনদেনের একমাত্র মাধ্যম। ইংরেজি ভাষা প্রতিটি মুহূর্তেই আশীর্বাদস্বরূপ। যদিও ইংরাজ-সূর্য শুধুমাত্র টেস্ নদীতে অস্ত যায় তথাপিও ইংরেজি ভাষা পৃথিবীর সর্বত্রই সচল। ইংরাজি না-হলে বিদেশে মানুষ বোবার শামিল।
চীনা মেয়েটি সত্যি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইংরেজি বলতে পারে। সে একজন ইংরেজের হাতে বিধ্বস্ত, অথচ আজ ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে সে প্রতিরাতে অসংখ্য প্রেমিক খুঁজে বার করছে। মেয়েটি শুধু দশ ডলার দাবি করল। মজিদ খান তার দিকে বিশ ডলার বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েটিকে সে ব্যবহার করতে চায় না। বলল– আমি এশিয়াকে বেশ্যা হিসেবে দেখতে চাই না।
মেয়েটি অত্যন্ত আত্মম্ভরিতার সাথে জবাব দেয়– কিন্তু আমি এশিয়াকে ভিখিরি হিসেবে দেখতে চাই না।
মজিদ খান সামনের দিকে পা বাড়ায়। মেয়েটি সম্ভবত ইউরোপ বা অ্যামেরিকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
মজিদ খান কাওলন হোটেলে উঠেছে। এই হোটেল চীনের মূল ভূমিতে অবস্থিত। মূল চীন আর হংকংয়ের মাঝে প্রবাহিত নদী পার হবার শেষ লঞ্চ একটায় ছেড়ে যায়। আর তখন প্রায় দুটো বেজে যাচ্ছে।
একটা তীব্র হতাশা মজিদ খানকে ঘিরে বসে। এবার কী হবে? এত রাত, বিদেশ-বিভুঁই, যাবে কোনদিকে, থাকবেই-বা কোথায়?
একটা ট্যাক্সি ড্রাইভার তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ড্রাইভার চীনা কি জাপানি ঠিক বুঝতে পারে না মজিদ খান। তবে তাদেরই মতো ক্ষুদ্রাকৃতি, চক্ষু দুটি কটা, এবড়ো-থেবড়ো চেহারা, সে-ও চমৎকার ইংরেজি বলতে পারে।
ইংরেজি শিখবার এবং জানবার জন্য যেমন উপাদেয় তেমনি বিভিন্ন কাজের ধান্দার জন্যও মূল্যবান।
মজিদ খান কোনো কথা বলার আগেই ড্রাইভারটি বলে ওঠে– বাকি রাত শেষ করতে চাও, এই তো?
মজিদ খান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। ড্রাইভার ট্যাক্সির দরজা খুলে দেয়।
ট্যাক্সি উল্কার মতো ছুটে চলে। ট্যাক্সির গতির সাথে ড্রাইভারের মুখেও খই ফুটতে থাকে। সে অত্যন্ত উৎসাহের সাথে হংকংয়ের নারীদের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে থাকে। পরিশেষে তাকে প্রশ্ন করে বসে, কোন দেশীয় নারী তার পছন্দসই?
মজিদ খান অত্যন্ত সংক্ষেপে তার মনোভাব ব্যক্ত করে। ট্যাক্সি ড্রাইভার পাকা সমঝদারের মতো আধুনিক যুগের এইসব কাণ্ডকীর্তনে আক্ষেপ করতে থাকে আর নিজ মনে বিড়বিড় করে বলে– ফ্রি ওয়ার্লড, ফ্রি ওয়ার্লড– ডেমোক্র্যাসি– ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট– বিগ ফোর– ইউ এন ও– স্মল নেশন্স্– মেগাটন বম!
কীসব যে বকে যাচ্ছে হয়তো-বা তা সে নিজেও জানে না। মজিদ খানের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় চিৎকার দিয়ে তাকে এসব বকাঝকা বন্ধ করতে বলে। কোথায় ‘ফ্রি ওয়ার্লড’! পাপের সমুদ্রে ডুবতে ডুবতেও মানুষ ভুলতে পারেনি রঙ, আভিজাত্য, জাতীয়তাবোধ আর বড়-ছোট’র মধ্যে পার্থক্য। পাপের বন্ধনের সাথে এসব চিন্তাধারাও মানুষকে দিন দিন বিচ্ছিন্ন আর বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে। এসময় তুমি কি ‘ফ্রি ওয়ার্লড’ ‘ফ্রি ওয়ার্লড’ বলে চিৎকার দিচ্ছ?
কিন্তু মজিদ খানকে একটা তীব্র হতাশা ঘিরে ফেলে। সে কিছু বলে না, শুধু গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করে– আর কদ্দুর নিয়ে যাবে আমায়?
ট্যাক্সি ড্রাইভার অত্যন্ত অভিজ্ঞ দোকানির মতো বলে– তুমি বোধহয় খুব অস্বস্তি বোধ করছ। যাও, সে জায়গাটাও এসে পড়েছে। তোমায় এমন জায়গায় নিয়ে এসেছি যে, বুঝে উঠতে পারবে না তুমি ভারতে না আর কোথাও আছ। হি হি হি। আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম তুমি ভারতে যেতে চাও– হি হি হি।
সে মজিদ খানকে ভারতীয় মনে করেছে। মজিদ খানও তাকে বোঝাতে চায় না যে, সে ভারতীয় নয়। একটা ছোট্ট গলির ভেতরে গিয়ে ট্যাক্সি থেমে যায়। সম্মুখে সমুদ্রের জলকল্লোল স্থানটিতে মুখরিত করে তুলেছে।
একখানা তিনতলা দালান। দালানের দ্বিতলের একখানা ফ্ল্যাট হতে উজ্জ্বল আলো জানালা দিয়ে ঠিকরে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসছে। বাকি অট্টালিকা গভীর রাতের অন্ধকারে প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল– আমার পিছু পিছু এস।
মজিদ খান তার পিছু পিছু সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উজ্জ্বল ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছয়। উজ্জ্বল আলোতে মনে হয় ভেতরে হয়তো-বা কোনো নারী জেগে আছে।
ড্রাইভার দরজায় মৃদু করাঘাত করে। অল্পক্ষণ পর দরজা খুলে যায়। একটি বর্মি বা মালয়ি বৃদ্ধা দরজা থেকে তাদের অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে যায়।
ছোট্ট একখানা কক্ষ। এটাকে বরং ড্রয়িংরুমই বলা সমীচীন! ভেতরে ছোট এক সেট সোফা। কোণের দিকে একটা রেডিও সেটের উপর মহাত্মা গৌতম বুদ্ধের কালো কাষ্ঠনির্মিত প্রতিমূর্তি। দেওয়ালে খান কতেক অর্ধ-উলঙ্গ ছবি ছাড়াও গান্ধীজির একখানা বড় ছবি টাঙানো। ড্রাইভার মজিদ খানকে সোফার উপর বসিয়ে পাশের কক্ষে ঢোকে। খানিক পর মুখ টিপে হেসে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে– অলরাইট, আমি এবার আসি। মজিদ খান পকেট থেকে বিশ ডলার বের করে তার হাতে দিয়ে জিগ্যেস করে– এনাফ?
ড্রাইভার দাঁত বের করে হেসে ওঠে আর বলে– ওহ্ টুমাচ, টুমাচ, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ অ্যান্ড গুডনাইট। সে তিন বার মস্তকভঙ্গি করে বেরিয়ে যায়।
বৃদ্ধাটিও ভেতর চলে যায়। মজিদ খান গভীর মনোনিবেশ সহকারে গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি দেখে। কপিলাবস্তু থেকে কলম্বো, রেঙ্গুন, ব্যাঙ্কক আর হংকং পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে প্রতিটি স্থানে গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বুদ্ধের জীবন-দর্শন আজ কোথাও নেই। শুধু পাথরের বা কাঠের মূর্তি।
খানিক পরে তার মনে হয় যেন কক্ষে প্যারিসের সন্ধ্যা ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা বাতাসে ভর দিয়ে। সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। সোফার পাশে একটি যুবতী রমণী দাঁড়িয়ে। তার নিটোল, সুশ্রী আর সুঠাম দেহে যেন যৌবনের হিল্লোল প্রবাহিত হচ্ছে। পরনে সেলোয়ার আর কামিজ। কিন্তু তার গলায় বা মাথায় কোনো কাপড় নেই। অবশ্য ওটার তার দরকারই-বা কী! মেয়েদের মাথায় উত্তরীয় তখনি দরকার হয় যখন তার জীবনে একটিমাত্র পুরুষের আবির্ভাব ঘটে।
যুবতীটি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। মনে হয় যেন সে এই প্রথম কোনো ভারতীয়কে দেখল বা অনেকদিন পর নিজের রঙের সাথে সুসামঞ্জস্য নিজের মাটির মানুষ দেখল। একটা তীব্র উত্তেজনার ছাপ তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। কিন্তু সে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে রীতিমতো ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলল– ড্রাইভারকে আমি ত্রিশ ডলারের কথা বলেছি।
মজিদ খান একথার কোনো জবাব দেয় না। পকেট থেকে ত্রিশ ডলার বের করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। স্ত্রীলোকটি মুচকি হেসে ত্রিশ ডলারের নোট তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গ্রহণ করে বলে– কিছু পান করবে?
মজিদ খান উত্তর দিল– না, পানের অভ্যেস নেই।
মেয়েলোকটি প্রশ্ন করে– হিন্দু না মুসলমান?
একথা মজিদ খানের অন্তরে তীব্র এক ধাক্কা মারে– গণিকালয়েও সাম্প্রদায়িক বিষ ঢুকে গেছে! সে বলল– হিন্দুও না মুসলমানও না। মানুষ যখন পাপের পথে পা বাড়ায় তখন ধর্ম তাকে চরম ঘৃণাভরে পদদলিত করে পালিয়ে যায়।
একথায় রমণীটির মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে লজ্জিত হয়ে পড়ে আর বিস্মিতভাবে মজিদ খানকে নিরিখ করতে থাকে। মেয়েলোকটি সম্পর্কে একটু বিভ্রান্তি বোধ করে মজিদ খান। সে জিজ্ঞেস করে– তুমি কে?
মজিদ খানের অনুমানই সত্য। রমণীটি তাকে ভারতীয় হিন্দু মনে করছে। সে বলল– মুসলমান, আমার নাম কুলসুম।
কুলসুমের নাম শুনে মজিদ খানের চমকে ওঠার কথা কিন্তু সে অত্যন্ত অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বুদ্ধের প্রতিকৃতি আর গান্ধীর ছবির দিকে চেয়ে বলল– খুব দূরদর্শী দোকানি তো তুমি। তুমি এটাও জান যে, শত্রুর মেয়ে দেখলে পাপীর রসনা ক্ষুধার্ত শকুনির মতো লক্ লক্ করে ওঠে। কিন্তু আমিও যাগু গ্রাহক। কোনো দোকানদার আজো আমায় ঠকাতে পারেনি, অতএব তুমিও নিজেকে মুসলমান-কুলসুম যাই বল-না কেন আমায় ধোঁকা দিতে পারবে না।
মেয়েলোকটি একথায় থতমত খেয়ে যায়। মিথ্যাবাদীর মিথ্যা কথা ধরে ফেলার ফলে মানুষের যে-করুণ অবস্থা দাঁড়ায় তারও তাই হয়। সে অত্যন্ত অপ্রসন্ন স্বরে অস্ফুটে উচ্চারণ করল– ভারি অদ্ভুত মানুষ তো! পরিশেষে নিজের অবগতির জন্য সে মজিদ খানের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে– তুমি কে?
মজিদ খান বলল– আমি মিথ্যা বলি না– আমি মুসলমান।
একথাটা যেন স্ত্রীলোকটির সমগ্র সত্তায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সে তড়াক করে উঠে পড়ে আর বলে– আমি মুসলমানকে ঘৃণা করি। তুমি এখনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। আহত নাগিনীর ন্যায় একটি অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠে সে।
মজিদ খান প্রত্যুত্তরে শান্ত স্বরে বলল– তুমি বললে অবশ্যই চলে যাব। তুমি জান আমি মিথ্যা কথা বলি না। অতএব তুমি আমার ওপর আস্থা রাখতে পার যে, আমি তোমার ‘দেহের’ জন্য এখানে আসিনি, শুধু বিছানার জন্য এসেছি। আচ্ছা তাহলে উঠি 1
মজিদ খান সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে। স্ত্রীলোকটি মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে– দেহের জন্য নয়, বিছানার জন্য এসেছি!
মজিদ খান তার পাশে গিয়ে বলে– তোমার কাছে হয়তো-বা একথা নতুন ঠেকতে পারে কিন্তু পুরুষ আর নারীর মাঝখানে যদি গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি থাকতে পারে তো বিছানা আর দেহের মধ্যে কিছু ফারাক থাকে বইকি!
মেয়েটি একথা বুঝতে পারে না। মজিদ খান দরজার দিকে পা বাড়ায়। মেয়েটি বিস্মিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে চেয়ে থাকে। কে জানে কেন! হয়তো-বা আজ সে প্রথমবারের মতোই বুঝতে পারছে তার দেহ আর যাই হোক-না কেন কোনো বিছানা নয়। তার মন ভেতরে ভেতরে একটা অব্যক্ত বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে চাইছে। তার চক্ষু দুটি হঠাৎ কেন জানি সজল হয়ে ওঠে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে মজিদ খানের অপসৃয়মাণ মূর্তির দিকে চেয়ে থাকে।
মজিদ খান প্রায় দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ রমণীটি করুণ স্বরে ডাকল– শোন।
মজিদ খান থমকে দাঁড়ায়। শুধু মুখ ফিরিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে, কিছু বলে না।
মেয়েলোকটি ধীরে ধীরে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। ছলছল নেত্রে তার দিকে চেয়ে আর্দ্রকণ্ঠে বললে– এখন তুমি কোথায় যাবে?
মজিদ খান বলল– জানি না কোথায় যাব। সম্পূর্ণ অপরিচিত বিদেশি আমি। তিন-চার দিন হংকংয়ে থেকে করাচি চলে যাব ভেবেছি।
মেয়েলোকটি হঠাৎ চিৎকার করে বলল– কী বললে! করাচি? সে নিজের অজ্ঞাতে শক্ত করে মজিদ খানের কাঁধে হাত রেখে একটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওঠে– করাচি, করাচি– করাচি।
সে অত্যন্ত জোরে শব্দ করে বলে ওঠে– তুমি করাচি থেকে এসেছ একথা প্রথমে বললে না কেন? আমি সত্যি লজ্জিত, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। এস ভেতরে এস, এস এস। স্ত্রীলোকটি আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে ভেতরে এনে সোফার গায়ে নিক্ষেপ করে। এবার সে একেবারে শান্ত দুটি চোখ জানালার বাইরে দূর নীলিমায় তুলে ধরে। তার দৃষ্টি দূরে বহুদূরে হয়তো-বা করাচি পর্যন্ত অবলোকন করছে। সে নিজ মনে বলে চলে– গঙ্গারাম বিল্ডিং– বন্দর রোড– স্বামী নারায়ণের মন্দির– ডেঙ্গু হল– লক্ষ্মী বিল্ডিং– গোবর্ধন দাস মার্কেট।
মজিদ খান মুখে দুষ্টুমিভরা হাসি টেনে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে বলল– লক্ষ্মী বিল্ডিং আর গোবর্ধন মার্কেটের মধ্যবর্তী নিউ মেমন মসজিদের কথা বাদ দিলে কেন?
মজিদ খানের একথায় রমণীটি চমকে ওঠে। সে করাচি থেকে আবার হংকং ফিরে আসে। ফিক্ করে হেসে বলে সে– আচ্ছা ওখানে আসানমল ওঝা রোড, গঙ্গারাম বিল্ডিং আজো আছে?
মজিদ খান বলল– সব আজো আছে, শুধু তুমি নেই।
এবার স্ত্রীলোকটি একটু লজ্জিত হয়। হঠাৎ তড়াক করে উঠে সে তীব্রবেগে কক্ষান্তরে প্রবেশ করে। খানিক পরে সে ফিরে আসে। তার মাথায় তখন একখণ্ড উত্তরীয় শোভা পাচ্ছে আর হাতে একমুঠো চামেলি ফুল।
মজিদ খানের সামনে এসে তার পায়ের কাছে বসে পড়ে সে, আর সবকয়টি ফুল তার পায়ে ছড়িয়ে দেয়।
মজিদ খান তাড়াতাড়ি নিজের পা গুটিয়ে নিতে নিতে বলে– তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি মুসলমান।
কিন্তু রমণীটি শক্ত করে মজিদ খানের পা জড়িয়ে ধরে বলে– তুমি মুসলমান নও, তুমি করাচি। করাচি– যেখানে গঙ্গারাম বিল্ডিং অবস্থিত; গঙ্গারাম বিল্ডিং যেখানে ত্রিশ বছর আগে কমলাজ্ঞান চন্দনি জন্মগ্রহণ করেছিল, যে কমলাজ্ঞান চন্দনি হংকং এসে আত্মহত্যা করেছে। একথা বলে সে তার মাথা মজিদ খানের হাঁটুর উপরে ঝুলিয়ে রাখে।
মজিদ খান অত্যন্ত আদরের সাথে দু’হাত দিয়ে কমলাজ্ঞান চন্দনির মুখ উপরের দিকে তুলে ধরে। তার দু’চোখ বন্ধ। কিন্তু মজিদ খানের মনে হয়– করাচির বিস্তৃত বক্ষে এসে কমলাজ্ঞান চন্দনি পুনর্জন্ম লাভ করেছে।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী