মানবেন্দ্রনাথ রায় জাতীয়তাবাদ থেকে মার্ক্সবাদ
বিশ শতকে জাতীয়তাবাদ থেকে মার্ক্সবাদের পথে যাত্রীর অভাব হয়নি। তবু মানবেন্দ্রনাথের পরিক্রমা এরই মধ্যে বিশেষ স্মরণীয়, ঘটনার বৈচিত্র্যে ও চিন্তার ঘাতপ্রতিঘাতে। এ যুগের একটি প্রধান ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েও তিনি এক ব্যতিক্রমী। পুরুষ। যে পথে অনেকেই কিছুদূর গিয়ে চলবার শক্তি হারিয়ে থেমে গেছেন, তিনি সেখানে শেষ অবধি এগিয়েই চলেছেন, চরৈবেতি চরৈবেতি। সেই স্মরণীয় যাত্রা আলোকিত হয়েছে তাঁর অজস্র লেখায়!
মানবেন্দ্রনাথের লেখার পরিমাণ এত বেশি এবং সেই সব লেখা পৃথিবীর দূর দূরান্তে নানা দেশে ও বিভিন্ন ভাষায় এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে তার সম্পাদনার কাজ অতি দুরূহ। সৌভাগ্যের কথা, এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের মতো একজন পণ্ডিত চিন্তাশীল ও সম্পাদনার কাজে অভিজ্ঞ বিবেকী ব্যক্তি। ইন্ডিয়ান রেনেসাঁস ইনস্টিটিউটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। মানবেন্দ্রনাথের সমগ্র রচনা নয়, বরং সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য।
এতেও অন্তত ছ’ সাতটি বেশ বড় আকারের ভল্যুম দরকার। প্রথম ভল্মমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মানবেন্দ্রনাথের বৈচিত্র্যময় জীবনের পাঁচটি বছর, ১৯১৭ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত। ১৯১৭ সালে তিনি ত্রিশ বছরে পা দিয়েছেন। অর্থাৎ ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের ভিতর তাঁর কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনার পরিচয় পাই সম্পাদিত এই গ্রন্থটিতে। এই সময়টা রায়ের জীবনে বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর চিন্তা ও কর্মের প্রবাহ একটা বড় রকমের চাঞ্চল্যকর বাঁক নিয়েছে এই বছরগুলিতে। মানবেন্দ্রনাথের জীবনে এক সন্ধিক্ষণ এটা বড় পরিবর্তন তাঁর জীবনে একাধিকবারই এসেছে, তাঁর চিন্তাধারা একটি প্রশস্ত নদীর। মতো পথ তৈরি করে এগিয়ে গেছে। তবু ঐ প্রথম বাঁকটির একটা বিশেষ ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে, যেমন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে তেমনি আমাদের যুগের ইতিহাসে।
১৯১৭ সালে মানবেন্দ্রনাথ যখন মেক্সিকোতে পদার্পণ করেন তখনও তিনি মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হননি। বরং তাঁকে বলা যেতে পারে বিপ্লবী স্বদেশপ্রেমিক। জার্মানি থেকে অস্ত্রসংগ্রহ করে ইংরেজশাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করাই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯১৫ সালে তিনি ভারত থেকে বেরিয়েছিলেন। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে। জার্মান প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার পর তাঁর মনে হয় অস্ত্রসংগ্রহের ব্যবস্থা পাকা করতে হলে তাঁকে জার্মানি পর্যন্ত যেতে হবে। তখন প্রথম মহাযুদ্ধ চলছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখনও যুদ্ধে যোগ দেয়নি। ১৯১৬ সালে মানবেন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন জার্মানি যাবার সুযোগের সন্ধানে। সেই সুযোগ আসবার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করল জার্মানির বিরুদ্ধে। মানবেন্দ্রনাথের পক্ষে তখন সে দেশে বাস করা নিরাপদ রইল না, তিনি পালিয়ে পাশের দেশ মেক্সিকোতে আশ্রয় নিলেন। সেখানে পৌঁছবার পরও অসংগ্রহের পরিকল্পনা তিনি সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যাগ করেননি, মেক্সিকোতে কিছু জামান চরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও হয়েছিল। কিছুদিনের ভিতরেই কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন যে, জার্মানি থেকে অস্ত্রসংগ্রহ করে ভারতে বিপ্লব ঘটাবার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হবার। পথ বন্ধ।
মেক্সিকোতে তিনি ছিলেন আড়াই বছর, ১৯১৭ সালের জুন থেকে আরম্ভ করে ১৯১৯ সালের শেষ অবধি। প্রথম দিকে তাঁর প্রধান কাজ হল, সমাজতান্ত্রিক অর্থাৎ সোস্যালিস্ট। দল সংগঠন আর সেইসঙ্গে ভারতের সপক্ষে জনমতগঠন করা। এই সময়ে স্প্যানিশ। ভাষায় লিখিত তাঁর একটি বইয়ের নাম, La India, su Pasado, Su Presente Su Porvenir (India: Her Past, Present and Future). প্রকাশকাল ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর মাস। মানবেন্দ্রনাথের রচনা সংকলনের প্রথম ভন্যুমে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তখন পর্যন্ত রায় যদিও সমাজতন্ত্রী তবু মার্ক্সবাদ গ্রহণ করেননি। ১৯১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মেক্সিকোতে এসে উপস্থিত হলেন মাইকেল বোরোদিন, ইনি ছিলেন লেনিনপন্থী এবং নবপ্রতিষ্ঠিত কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিস্টার্নের প্রতিনিধি। অতি দ্রুত রায়ের সঙ্গে বোরোদিনের ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। আর এই সময় থেকেই শুরু হয় মানবেন্দ্রনাথের ভাবনাচিন্তা ও কর্মকাণ্ডের এক নতুন পযায়। কমিন্টার্নের সূত্র ধরেই কিছুদিনের ভিতর আমন্ত্রণ এলো লেনিনের কাছ থেকে।
১৯২০ সালে রায় ইয়োরোপে গিয়ে পৌঁছলেন। কয়েক মাস জার্মানিতে কাটিয়ে প্রবেশ করেন মস্কোতে। সেখানে অংশ গ্রহণ করেন কমিন্টার্নের দ্বিতীয় আন্তজাতিক কংগ্রেসে। জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্ন নিয়ে বিচার-বিবেচনায় লেনিনের প্রস্তাবের পাশে পাশে মানবেন্দ্রনাথের প্রস্তাবও আলোচিত হয়, দৃটি প্রস্তাবই কিছু সংশোধনসহ কংগ্রেসে গৃহীত হয়। এর পর নতুন আন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানে মানবেন্দ্রনাথ অল্প সময়ের ভিতরই নেতৃত্বের উচ্চ আসনে পৌঁছে যান।
তাঁর এই সময়কার বেশ কয়েকটি লেখা রচনা সংকলনের প্রথম ভমে স্থান পেয়েছে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত India in Transition নামে পুস্তকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এইসব লেখায় যে মানবেন্দ্রনাথকে আমরা পাই তিনি মার্ক্সবাদী। তাঁর ১৯১৮ সালের রচনার সঙ্গে ১৯২০ কিংবা ১৯২২ সালের দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভেদ অনেকখানি। একই গ্রন্থে এইসব রচনা পাশাপাশি স্থান পেয়েছে বলেই প্রভেদটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আলোচ্য সংকলন গ্রন্থটি এইদিক থেকেও আকর্ষণীয়।
এই বিষয়টি আরো একটু আলোচনা করে নিলে ভালো হয়। ১৯১৮ অবধি যে মানবেন্দ্রনাথ ছিলেন বিপ্লবী স্বদেশপ্রেমিক আর ১৯২০ সালে যিনি সকলের সামনে আবির্ভূত হলেন মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক হিসেবে, এ দুয়ের ভিতর মিল কতটা আর অমিল প্রধানত কোথায়?
মানবেন্দ্রনাথের পিতৃদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ। নরেনের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলনের ভিতর দিয়ে। তাঁর জীবনে ১৯০৫ একটি অবিস্মরণীয় বছর। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে কিশোর নরেনের ইতিমধ্যে যোগ ঘটে গেছে সে যুগের অন্যান্য স্বদেশভক্তদের মতো তাঁরও চেতনা ও আদর্শ গঠিত হয়েছিল বঙ্কিম বিবেকানন্দ ও অরবিন্দের প্রভাবে।
উনিশ শতকের শেষভাগে এঁদের মুখে সাম্যের আদর্শের কথা বার বার শোনা গেছে। আচণ্ডাল সমস্ত ভারতবাসীকে সমদৃষ্টিতে দেখতে শিখিয়েছিলেন বিবেকানন্দ তাঁর আবেগময়ী ভাষায়। তারও আগে স্বচ্ছ সুন্দর রচনায় সাম্যের কথা লিখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। “এই সংসারে একটি শব্দ সর্বদা শুনিতে পাই–”অমুক বড় লোক–অমুক ছোট লোক’। “ এই দিয়ে যে প্রবন্ধটি শুরু তার শেষে বলা হয়েছে, “সকলের উন্নতির পথ মুক্ত চাহি।” আর এই “সাম্য” প্রবন্ধের মাঝখানে বঙ্কিমচন্দ্র কৃষকের অবস্থা নিয়ে লিখেছেন, “যাঁহারা সংবাদপত্র লিখিয়া, বক্তৃতা করিয়া বঙ্গসমাজের উদ্ধার চেষ্টা করিয়া বেড়ান, তাঁহারা সকলে কৃষকের অবস্থা সবিশেষ অবগত নহেন। সাম্যতত্ত্ব বুঝাইতে গিয়া সে বৈষম্য না দেখাইলে কথা অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়।”
কাজেই মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হবার আগেই মানবেন্দ্রনাথ এক প্রকারের সাম্যতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর অবস্থান ছিল নরমপন্থীদের বিপরীত প্রান্তে। জাতীয় আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে দরিদ্র জনসাধারণের মোগ কম এই ধারণার। জন্যও তাঁকে মার্ক্সবাদের দ্বারস্থ হতে হয়নি।
উনিশ শতকের শেষদিকে অরবিন্দ তীক্ষ্ণ ভাষায় ঐসব কথা বলে গেছেন। ১৮৯৩-৯৪ সালে ‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত অরবিন্দের কিছু প্রবন্ধ এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অরবিন্দ তখন লিখেছেন, “The Congress represents not the mass of the population but a single limited class…I should not hasitate to call it our rew middle class. আরো বিস্ময়কর, প্রোলেতারিয়েতের ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভূমিকার কথাও অরবিন্দ সেই সময়েই উল্লেখ করেছেন। এইসব চিন্তার তরঙ্গ তরুণ নরেন্দ্রনাথের চেতনায় ধাক্কা দেয়নি এমন বিশ্বাস করা যায় না।
এক রকমের শোষণতত্ত্বও নরেন্দ্রনাথের অজানা ছিল না। বিশেষত বিদেশী শাসকশ্রেণী কীভাবে ভারতকে শোষণ করেছে, এ বিষয়ে উনিশ শতকে দাদাভাই নওরোজী থেকে রমেশচন্দ্র দত্ত পর্যন্ত প্রখ্যাত লেখকদের চিন্তাধারার প্রভাব ছিল সে সময়ে সুবিস্তৃত। মার্ক্সবাদ গ্রহণ করবার আগেই মানবেন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শোষণ বিষয়ে অনেকটা পড়াশুনো ও চিন্তা করেছিলেন। ভারত সম্বন্ধে তাঁর লেখাতে সেই প্রমাণ আছে।
তাঁর জাতীয়তাবাদী ___ বিশ্বচেতনা _____ মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনকে ১৯১৭ সালে তিনি যে খোলা চিঠি পাঠান তাতে সেই বিশ্বসচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতের স্বাধীনতার জন্য জার্মান সাহায্য গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি। যখন দেশ-বিদেশে যাত্রা শুরু করলেন তখন তাঁর মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও গ্রহিষ্ণু চেতনাসম্পন্ন মানুষের মন বিশ্বমুখী হয়ে পড়বে এটা অপ্রত্যাশিত নয়।
অতএব সাম্যের আদর্শই হোক, শোষণের তত্ত্বই হোক কিংবা বিশ্বসচেতনতাই হোক, এই সবের জন্য মানবেন্দ্রনাথের মন আগে থেকেই তৈরি ছিল। তবু যে বোরোদিন তথা মার্ক্সবাদের সঙ্গে পরিচয় এবং কমিন্টার্নের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তাঁর চিন্তার জগতে। একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে পরাস্ত জার্মানি থেকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের জন্য অস্ত্রসংগ্রহের সম্ভাবনা অন্তত অনেকদিনের জন্য লুপ্ত হল। ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি আশার স্তম্ভ যেন ভেঙে পড়ল। ঠিক সেই সময়ে কমিন্টার্নের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে মানবেন্দ্রনাথ লাভ করলেন এক নতুন বিশ্বদৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে এক নতুন আশার আলো। ভারতের মুক্তিসংগ্রাম সহায়তা পাবে কমিন্টার্ন তথা বিপ্লবী সোভিয়েত রাষ্ট্রের কাছ থেকে। জার্মানি হয়তো ভারতের মুক্তিসংগ্রামকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। কমিন্টার্ন গুরুত্ব দেবে তো? না কি কমিন্টার্নের দৃষ্টি কেড়ে নেবে ইয়োরোপ? আর এশিয়া তথা ভারত অবহেলিত থেকে যাবে? ১৯২০ সালে কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসে মানবেন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত শক্তি নিযুক্ত করলেন এ কথাটা বোঝাতে যে, এশিয়া তথা ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামকে অবহেলা করা ভুল হবে। এশিয়ার বিপ্লব জয়যুক্ত না হলে ইয়োরোপেও হবে না।
একই সঙ্গে শ্রেণীসংগ্রাম সম্বন্ধে মানবেন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী আরো ধারালো হয়ে উঠল। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য সম্বন্ধে সচেতনতা তো আগে থেকেই ছিল। সাদা আমলার জায়গায় কালো আমলা এলে তাতে দরিদ্রের কোনো লাভ নেই, এই বোধটা নতুন নয়। কিন্তু মার্ক্সবাদের প্রভাবে শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব মানবেন্দ্রনাথ মেনে নিলেন। রাজনীতি ও সংগ্রামনীতির বিশ্লেষণে এটা একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
কিন্তু শুধু রাজনীতি নয়, মার্ক্সবাদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ল মানবেন্দ্রনাথের সংস্কৃতিবিষয়ক চিন্তায়। যেমন ধরা যাক, ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও সভ্যতার কথা। বিপ্লবী স্বদেশপ্রেমিকদের চোখে প্রাচীন ভারতের চিত্রটি গৌরবোজ্জ্বল। মার্ক্সবাসী তত্ত্ব মানবেন্দ্রনাথকে এবার প্রতিষ্ঠিত করল প্রাচীন ঐতিহ্যের কঠোর সমালোচকের ভূমিকায়। অনেক পুষ্পিত বাক্য ও শাস্ত্ৰসিদ্ধ অনুশাসনের পিছনে আছে শ্ৰেণীস্বার্থের শঠতা, এই রকম একটা বোধ এবার তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রাধান্য লাভ করল। জাতীয়তাবাদ থেকে মার্ক্সবাদে যাত্রার পথে এটাই হয়তো মানবেন্দ্রনাথের চিন্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
১৯১৮ সালে যখন তিনি ভারতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পূর্বে উল্লিখিত বইটি লিখেছেন তখনও এ দেশের অতীত সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান। তাই ভারতের সভ্যতা সম্বন্ধে তিনি সেখানে সংশয়হীন ভাষায় বলতে 697637630 “The superior philosophical, religious and ethical character of this ancient civilization is generally accepted by the world.” ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বত্ব স্বীকৃত, এই সরল বিশ্বাস প্রকাশ করতে তিনি সংকোচবোধ করেন না। বইয়ের ভূমিকায় তিনি বলেছেন যে, তাঁর দেশের প্রতি মেক্সিকোতে তিনি অনেক সহানুভূতি লক্ষ করেছেন, কিন্তু ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, “giorious history, বিষয়ে অজ্ঞতা থেকে গেছে। এ দেশের প্রাচীন সামাজিক ব্যবস্থায় মানবেন্দ্রনাথ লক্ষ করেন সাম্য ও সহযোগিতার প্রশংসনীয় প্রয়াস। অন্যান্য অনেক ভারতপ্রেমিকের মতোই দারিদ্র্য ও অসাম্য সম্বন্ধে সচেতন থেকেও স্বদেশের একটা ভাবমূর্তিকে প্রণাম জানাতে। সেইসময় পর্যন্ত তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। পরবর্তী কালের রচনায় এই দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ১৯২২ সালে প্রকাশিত India in Transition নামে বইটিতে তিনি লেখেন। “Advocates of Hindu orthodoxy consciously or unconsciously desire to keep the people in the darkness of ignorance and submission.” spate (9766 অথবা অজান্তে হোক, হিন্দু ঐতিহ্যবাদীদের উদ্দেশ্য হল সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে আর অধীনতার বন্ধনের ভিতরে ফেলে রাখা।
মানবেন্দ্রনাথ যেমন জাতীয়তাবাদকে একদিন অতিক্রম করে গিয়েছিলেন তেমনি মার্ক্সবাদেও চিরকাল আবদ্ধ থাকেননি। এই নিষ্ক্রমণের পর্যায়গুলি আমাদের যুগের পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ, কাজেই সংক্ষেপে স্মরণ করা যেতে পারে। লেনিনের মৃত্যুর কয়েক বছর পর কমিন্টার্ন তথা মস্কোর অধীনতা মেনে নেওয়া রায়ের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। মার্ক্সবাদের। কিছু মৌল তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তও তিনি ক্রমে পরিত্যাগ করেন। এর ভিতর আছে শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব। শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য ও সংহতির নামে এক রকমের অসহিষ্ণুতা প্রশ্রয় পায়, মানুষের বুদ্ধিকে সেটা শৃঙ্খলিত করে। তাঁর এই প্রত্যয় দৃঢ় হল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে, যখন সোভিয়েত নেতারা যুদ্ধজয়ের পরেও স্বদেশে সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক স্বাধীনতার খোলা হাওয়া প্রবেশ করতে দিলেন না।
মানবেন্দ্রনাথ এর পর নিজের মার্ক্সবাদী পরিচয় পর্যন্ত মুছে দিলেন। কিন্তু তাই বলে পুরোনো চিন্তায় কখনো ফিরে যাননি। জাতীয়তাবাদ থেকে মার্ক্সবাদের পথ ধরে তিনি অবশেষে উত্তীর্ণ হলেন নব মানবতাবাদে। এ দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য বিশেষত ব্রাহ্মণ্যধর্ম। সম্বন্ধে তাঁর সমালোচনা তিনি শেষজীবন পর্যন্ত রক্ষা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এ দেশে বুদ্ধির মুক্তি ও সামাজিক মুক্তির জন্য এই সমালোচনা আবশ্যক। তবে প্রাচীন ঐতিহ্যে সবই অশ্রদ্ধেয় নয়, কিছু মূল্যবান মানবিক উপাদান আছে সেখানেও, একথা তিনি বলতে ভোলেননি
দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ (১৯৮৯)