2 of 2

৫.১০ মানবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারা প্রসঙ্গে

মানবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারা প্রসঙ্গে

যেমন পশ্চিমে তেমনি ভারতেও উনিশ শতকের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তা বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এদেশে কোনোটির উদ্ভব বেদ উপনিষৎ অথবা অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থে, পাশ্চাত্য উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কোনোটি যুক্ত, কোনোটি বা জড়বাদী। এই বৈচিত্র্য অস্বাভাবিক নয়।

দর্শনের উচ্চশিখর থেকে নানা পথে প্রবাহিত হয়ে এইসব ধারা যখন আমাদের কালে সমাজচিন্তার সমতলভূমিতে প্রবেশ করেছে তখন বৈসাদৃশ্যের পাশে পাশে এদের ভিতর কিছু উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্যও উন্মোচিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চিন্তা ও অভিজ্ঞতা স্মরণীয়। রাজনীতিতে একদিন তাঁর স্থান ছিল গান্ধীর বিপরীত মেরুতে। সেই ব্যবধান কখনো সম্পূর্ণ দূর হয়নি। তবু সমাজ ও রাজনীতির কিছু মৌল সমস্যা নিয়ে তাঁর শেষ জীবনের সিদ্ধান্ত গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনীয়।

মানবেন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার প্রধান প্রধান কথাগুলি সাজিয়ে গুছিয়ে বলা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। রায়ের চিন্তাধারার কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করাই উদ্দেশ্য।

মার্ক্সের চিন্তাকে যেমন বলা হয় মার্ক্সবাদ অথবা দ্বান্দ্বিক জড়বাদ, মানবেন্দ্রর বিশিষ্ট চিন্তাকে তেমনি বলা যায় মানববাদ অথবা মানবতাবাদ। তবে মানববাদে পৌঁছবার আগে জীবনের এক মধ্যবর্তী পর্যায়ে তিনি ছিলেন মার্ক্সবাদী।

সেই পর্যায়ের একটি ইংরাজী বইয়ের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত, বাংলায় বইটির নাম দেওয়া যেতে পারে যুগান্তরের পথে ভারত’। বইটি যখন প্রকাশিত হয় মানবেন্দ্রনাথের বয়স তখন পঁয়ত্রিশ। মাত্র কয়েক বছর আগে তিনি মার্ক্সবাদ গ্রহণ করেছেন। বইটি লেখা হয়েছিল দ্রুত, বিশেষ রাজনীতিক কারণে। তবু ঐ অনতিদীর্ঘ পুস্তকটিতে যে পাণ্ডিত্য এবং সেই সঙ্গে তথ্য ও যুক্তিকে সাজাবার যে ক্ষমতা দেখা গেছে তাকে নিঃসন্দেহে অসাধারণ বলা যেতে পারে।

বইটির সঙ্গে যাঁরা তেমন পরিচিত নন তাঁদের সুবিধার্থে কয়েকটি প্রধান কথা সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক।

মোগল যুগ থেকে ব্রিটিশ যুগ অবধি ভারত-ইতিহাসের ধারার একটা ব্যাখ্যা বইটিতে পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতের সমাজের ভিত্তিতে ছিল প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক প্রথায় চালিত, কিছু গ্রামসমাজ। এই সব গ্রামসমাজ থেকে স্বাভাবিক নিয়মে দেশীয় সামন্ততন্ত্রের বিবর্তন সম্ভব ছিল, সেটা কিছু পরিমাণে ঘটেছিল। কিন্তু মোগল আধিপত্যের ফলে দেশীয় সামন্ততন্ত্রের ওপর চেপে বসে এক বিদেশী সামন্ততন্ত্র। তার উদ্ভব হয়নি নিচের গ্রামসমাজ থেকে, তাকে বসানো হয়েছে ওপরের রাজধানী থেকে। ঐ বিদেশী ও দেশীয় সামন্ততন্ত্রের সংঘর্ষ আমরা দেখি সে যুগের কিছু উল্লেখযোগ্য যুদ্ধে, ভারতময় সকলের স্মৃতিতেই যেগুলি আছে। মোগল ও রাজপুতের সংঘাত তারই অন্যতম উদাহরণ।

যাই হোক, ভারতের এই সামন্ততন্ত্রের ধ্বংস ঘটল পশ্চিমী বণিকতন্ত্রের আক্রমণে! ভারতের বর্তমান যুগের শুরু এইভাবে। এর বৈশিষ্ট্য ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে উল্লেখ্য। মার্ক্স আমাদের শিখিয়েছেন যে, বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে সংঘর্ষে সামন্ততান্ত্রিক অভিজাত শ্রেণীর পতন ঘটে। ভারতে তাই হল বটে, কিন্তু এদেশের সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটেনি এদেশেীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর সঙ্গে সংঘাতের ফলে।

ভারতে সে সময়ে কোনো দেশীয় বণিকশ্রেণী ছিল না এমন নয়। ছিল, আর তারাই হয় তো একদিন এদেশ থেকে সামন্ততন্ত্রকে হটাতো। কিন্তু তার আর সময় হল না, তার আগেই ব্যাপারটা অন্যভাবে ঘটে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেতৃত্বে। সেই কোম্পানি বাহাদুরই আবার এদেশের মধ্যবিত্তকে ঠেলে দিল দীর্ঘকালের জন্য, তার স্বাভাবিক পরিণতির পথ থেকে অনেক দূরে, অন্য এক জমিদারী বন্দোবস্তের দিকে। ইউরোপের ইতিহাসে বুর্জোয়ার যে বৈপ্লবিক ভূমিকা দেখা দিয়েছিল ভারতে সেটা ঘটতে পারেনি। এদেশে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটল এইভাবে যার প্রধান নির্ভর জমি এবং সরকারী চাকরী।

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে কিন্তু এদেশেও শিল্পের উন্নতি শুরু হল। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত সেটা চলছিল ধীরে, যুদ্ধের ধাক্কায় তার গতি হল দ্রুত। যুদ্ধের সময় বিদেশী শাসকশ্রেণীর দেশ থেকে সাগর পেরিয়ে শিল্পজাত দ্রব্য ভারতের বাজারে এনে ফেলা সহজ ছিল না। কাজেই এদেশের শিল্প তখন একটা অভাবিত সুবিধা পেয়ে গেল। ভারতের নিজস্ব বুর্জোয়াশ্রেণীর বিবর্তনের এটা অতএব একটা নতুন অধ্যায়।

রায়ের ঐ বইটি প্রকাশিত হয় জেনিভা থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তির অল্প কিছুকাল পরে, ১৯২২ সালে। ভারতের রাজনীতিতে তখন তোলপাড় চলছে। ঐ রাজনীতিক সন্ধিক্ষণে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া ছিল মানবেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য বইটা লেখা হয়েছিল ঐ কারণে।

কিছুদিন আগেই কংগ্রেসের ভিতর নরমপন্থী আর চরমপন্থীদের বিবাদ ঘটে গেছে। রায় অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলেন তাঁর নিজস্ব মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। নিজস্ব বলছি এই জন্য যে, মার্ক্সবাদীরা সবাই আবার একমত ছিলেন না। লেলিনের সঙ্গেই মানবেন্দ্রনাথের মতের পুরো মিল ছিল না।

যাই হোক, মানবেন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে পরিস্থিতিটা দাঁড়াল এইরকম। নরমপন্থীদের বিশ্বাস করা যায় না। ওদের কোন বৈপ্লবিক ভূমিকা নেই। ওদের সঙ্গে বিদেশী সরকারের যে বিবাদ সেটা তো ধনিকতন্ত্রের সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের বিবাদ নয়, সেটা প্রধানত এক

ধনিকশ্রেণীর সঙ্গ আর এক ধনিকশ্রেণীর স্বার্থের সংঘাত। ভারতীয় বুর্জোয়া ব্রিটিশ বুর্জোয়াকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইবে ঠিকই, কিন্তু বিদেশী ধনিকশ্রেণীর চেয়েও তার বড় শত্রু স্বদেশের শ্রমিকশ্রেণী। কাজেই বিপদ দেখলেই ভারতীয় বুর্জোয়া বিদেশী বুর্জোয়ার সঙ্গে আপস করবে। নরমপন্থীদের হাতে স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতৃত্ব ছেড়ে দিলে আন্দোলন মাঝপথেই আটকে যাবার বিপদ আছে।

আর চরমপন্থী? তাদের কি বিশ্বাস করা যায়? সেখানেও রায় এক বিপদ দেখলেন। চরমপন্থীরা লড়তে চায় বটে। কিন্তু লড়াইয়ের অস্ত্র হিসেবে ওরা গ্রহণ করেছে এক প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা। ওদের মুখে শুধু প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের স্তবগান। ওরা বিদেশীকে খতম করতে প্রস্তুত, কিন্তু দেশের ভিতর যত কুসংস্কার তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা নেই চরমপন্থীদের ধ্যানধারণায়। সম্প্রতি আবার আন্দোলনের নেতৃত্ব গিয়ে পড়েছে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর হাতে। তিনি তো পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবল বিরোধী, যন্ত্রসভ্যতারই বিরোধী। তদুপরি তিনি আবার অহিংসায় বিশ্বাসী। এই সব মত নিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামে জেতা অসম্ভব, আবার জিতলে নতুন উন্নতর সমাজ গড়ে তোলা আরো অসম্ভব।

এই সংকটের ভিতর তা হলে পথ কী? এ অবস্থায় চাই শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব নেতৃত্ব এবং নিজস্ব মতবাদ শ্রমিকশ্রেণী বলতে রায় এখানে ভাবছেন কৃষক, শ্রমিক এবং নিম্নমধ্যবিত্তের কথা। বুর্জোয়াশ্রেণীকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেবার সময় এখনও আসেনি। তাদেরই পাশে পাশে গড়ে তুলতে হবে এই শ্রমিকশ্রেণীর নতুন নেতৃত্ব ও নিজস্ব আন্দোলন। এই আন্দোলনের চাপে যদি বুর্জোয়াশ্রেণী সঠিক পথে থেকে যায় তো। ভালো। নয় তো অবস্থা বুঝে শ্রমিকশ্রেণীকেই এগিয়ে যেতে হবে জাতীয় স্বাধীনতা চাই, আরো চাই শ্রমিকের স্বাধীনতা। শ্রমিকশ্রেণীর দাবী হবে, সকলের ভোটের অধিকার, শিল্পে শ্রমিকসমিতির নিয়ন্ত্রণ, জমিদারী ব্যবস্থার বিলোপ। স্বরাজ বলতে এসবই বোঝায়, শুধু অল্প কিছু মানুষের সুবিধা বোঝায় না। এই দাবী এবং মতবাদ নিয়ে, ভাবালু চরমপন্থীদের ভ্রান্তি ত্যাগ করে, গান্ধীবাদকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, শ্রমিক-কৃষক নিম্নমধ্যবিত্তদের নিজস্ব নেতৃত্ব গড়ে তুলবার সময় এসে গেছে। সংকট। কাটাবার অন্য পথ নেই। বুর্জোয়াদের একক নেতৃত্ব সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারবে না।

প্রথম মহাযুদ্ধের পরে নানা কারণে ভারতে একটা উত্তেজনাপূর্ণ সময় দেখা দিয়েছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড তারই ইঙ্গিত বহন করছিল। এ অবস্থায় কী করা যায়, এ প্রশ্ন স্বভাবতই দেশপ্রেমিকদের মনে প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মানবেন্দ্রনাথ দেশের অবস্থার যে বিশ্লেষণ করেছিলেন তার কিছুটা পরিচয় দেওয়া গেল। মার্ক্সবাদীরা সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে রাজনীতির প্রোগ্রাম ও রণকৌশল গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ ঐ মুহূর্তে রাজনীতির পথপ্রদর্শন করতে গিয়ে ভারতীয় ইতিহাস, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সব কিছুর ওপর। আলোকপাত করে যেভাবে তাঁর যুক্তি বিস্তার করেছিলেন তাতে তাঁর মননশীলতার একটা বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতের তৎকালীন পরিস্থিতির বিশ্লেষণ হিসেবে তুলনীয় অন্য লেখা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।

.

মানবেন্দ্রনাথের বিশ্লেষণে কয়েকটি ত্রুটি থেকে গিয়েছিল। সে বিষয়ে এবার কিছুটা আলোচনা করা দরকার। তথ্যঘটিত ছোট ছোট ভুলের কথা আমি বলছি না, তাতে মূল সিদ্ধান্তের তেমন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু আমরা যখন বড় আকারে যুক্তি বিস্তার করি তখনও এমন কিছু কথা কখনও কখনও বিবেচনার বাইরে পড়ে যায় যার গুরুত্ব আছে। সেই সব কথা তারপর বিবেচনার ভিতর আনতে গেলে ভাবনাচিন্তারকাঠামোটাই অল্পবেশী বদলে ফেলতে হয়। মানবেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও ঐরকম ঘটেছিল। ফলে তাঁর চিন্তা। কখনও একই জায়গায় আটকে থাকেনি।

মানবেন্দ্রনাথকে যেমন প্রথম মহাযুদ্ধের ঠিক পরবর্তী সময়ে ভারতের বিপ্লবের পথ নিয়ে চিন্তা করতে হয়েছিল মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, লেনিনকেও তেমনি চিন্তা করতে হয়েছিল আরো কয়েক ব র আগে রুশদেশে। সেখানে তখন চলছে স্বৈরতন্ত্রী জারের শাসন। তিনিও এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, তাঁর নিজ দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করে তুলবার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় না বুর্জোয়াশ্রেণীর হাতে, সাম্যবাদী। বিপ্লবের কথা তো ভিন্ন। লেনিনের আশংকা ছিল যে, রুশ বুর্জোয়াশ্রেণী আপস করে বসবে মাঝপথেসামন্ততান্ত্রিক শাসকশ্রেণীর সঙ্গে। অতএব সাম্যবাদী বিপ্লবের জন্য তো বটেই এমন কি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করে তুলবার প্রয়োজনেও শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব আবশ্যক। এর পরবর্তী ইতিহাস সবাই জানেন। ১৯১৭ সালের। শেষে রুশদেশে পুরনো শাসকশ্রেণী পরাস্ত হল, অক্টোবর বিপ্লবের ভিতর দিয়ে নতুন যুগের সূচনা হল।

রুশদেশও ছিল শিল্পের দিক থেকে এক পিছিয়ে পড়া দেশ। সেখানে ছিল ভারতের মতো এক দরিদ্র নিপীড়িত কৃষকশ্রেণী। কিন্তু ১৯১৭ সালের রুশদেশের সঙ্গে যুদ্ধপরবর্তী ভারতের এক জায়গায় ছিল একটা বড় অমিল। রুশ সরকার যুদ্ধে ভেঙ্গে পড়ছিল সেদিন। আর ব্রিটিশ সরকার ১৯১৮ সালে মহাযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এলো বিজয়ী হয়ে। ঐ অবস্থায় কোনো হিংসাত্মক বিপ্লবে ব্রিটিশ সরকারকে পরাস্ত করা ভারতে সেদিন ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। এ দিক থেকে ভারত এবং রুশদেশের অবস্থা তুলনীয় ছিল না।

ভারতে গান্ধীবাদ যে সেদিন গৃহীত হয়েছিল তার অন্যতম কারণ এইটাই। গান্ধীর কাছে অহিংসা একটা নীতির প্রশ্ন ছিল বটে। কিন্তু রণকৌশলের দিকটাও তাঁর মনে ছিল না এমন নয়। ১৯০৯ সালে লন্ডনে বসে হিংসার পথে বিশ্বাসী কিছু বিপ্লবীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ ঘরোয়া আলোচনা হয়। যুদ্ধের সাজে সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তিকে সাধারণ অবস্থায় ভিতর থেকে হিংসাত্মক উপায়ে পরাস্ত করা কত কঠিন সেটা সেদিন তিনি তাঁর যুক্তির ভিতর রেখেছিলেন। হিন্দ স্বরাজ’ গ্রন্থেরই এক জায়গায় তার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ভারতে গান্ধীর অহিংসার পথ যাঁরা মেনে নিয়েছিলেন তাঁরা যে সবাই অহিংসাকে শুদ্ধ নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এমন নয়। অনেকেই ব্যাপারটাকে মনে মনে রণকৌশলের দিক থেকেও ভেবে নিয়েছিলেন। এবিষয়ে মানবেন্দ্রনাথের চিন্তা সেদিন যথেষ্ট সতর্ক হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পরে হয়েছিল।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে সোবিয়েত লাল ফৌজের অগ্রগতি যতদূর, ইউরোপে সাম্যবাদী বিপ্লবের অগ্রগতি ঘটল মোটের ওপর ততদূরই। চীনদেশ এবং এশিয়ার আরো কিছু দেশে জাপানী সৈন্যের পশ্চাদপসরণের পর তাদের পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র বিপ্লবীদের কাজে লাগল। সাম্যবাদ কতটা এগোলো আর কোথায় গিয়ে থেমে গেল এইসব নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে রায়ের কাছে কতগুলি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে উঠলো, যেমন হল আরো অনেকের কাছে। ফ্রান্স অথবা ইতালিতে যে সাম্যবাদীরা ক্ষমতায় আসতে পারল না আর পূর্ব জার্মানি অথবা চেকোস্লোভাকিয়ায় পারল, তার কারণ এই নয় যে প্রথমোক্ত দেশগুলিতে কম্যুনিস্ট দল অথবা আন্দোলন তুলনায় দুর্বল ছিল। আসলে হিংসাত্মক বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে না শুধু দলের নিজস্ব সংগঠনশক্তির ওপর নির্ভর করে আন্তজাতিক অবস্থা এবং ঐরকম আরো কিছু বিশেষ পরিস্থিতির ওপর। হিংসাত্মক আন্দোলনের সাফল্যের পূর্বশর্তগুলি ভারতে সেদিন উপস্থিত ছিল না। ‘যুগান্তরের পথে ভারত’ বইটিতে এই বিষয়ে চিন্তার কোনো ছাপ নেই। রুশ বিপ্লবের সাফল্য সম্ভবত রায়ের মনে তখনও মোহ বিস্তার করে ছিল।

এবার দ্বিতীয় কথায় আসা যাক। ঐ বইটিতে রায় সামাজিক ও রাজনীতিক চিন্তার বিবর্তন বুঝতে এবং বোঝাতে চেয়েছেন বাস্তব অবস্থা বিশেষত সমাজের আর্থিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে। যেমন ধরা যাক, জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। এটার যোগ আছে বুর্জোয়াশ্রেণীর উদ্ভব এবং বৃদ্ধির সঙ্গে। দেশের ভিতর বাণিজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নটা একটা আর্থিক ভিত্তি খুঁজে পায়। আবার সামন্ততান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রয়োজন হয় জনগণের সমর্থন। এইভাবে গড়ে ওঠে রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ভিত্তি করে নতুন জাতীয়তাবাদ। ভারতে মধ্যবিত্তশ্রেণীই আধুনিক জাতীয়তাবাদের জনক। জাতীয় ঐক্যের আদর্শ প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় ঐতিহ্যে খুঁজতে গেলে ভুল করা হবে, বিষয়টা দেখতে হবে ঐতিহাসিক বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। এই কথাটা মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর বিশের দশকের লেখায় বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন। তাঁর ঐ বিশ্লেষণে আমাদের সামনে কিছু নতুন চিন্তা খুলে যায়, একথা। মেনে নেওয়া ভালো।

কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায়। আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ একটা বাস্তব ভিত্তি পেয়েছে ঠিকই, আর এই শিল্পবাণিজ্যকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে বুর্জোয়াশ্রেণী। অতএব এটাই হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একমাত্র স্বীকার্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা, একথা বললে বোধ করি সমাজবিজ্ঞানের ওপর একটু বেশি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকায় এক যুক্তরাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্র আজও গড়ে ওঠেনি, একটা কুণ্ঠিত চেষ্টা চলছে পশ্চিম ইউরোপে এইমাত্র। বহুদেশে খণ্ডিত ইউরোপে তবু শিল্পবাণিজ্যের বহু উন্নতি সম্ভব হয়েছে। সারাভারত এক হলে বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষে ভালো কথাই; বহুধা বিভক্ত হলেও শিল্পবাণিজ্য আটকে থাকত এমন নয়। ভারতীয় ঐক্যের সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্ক স্বীকার্য, কিন্তু এর ব্যাখ্যাকারী ক্ষমতা বড় বেশি বাড়িয়ে দেখা ঠিক নয়।

প্রাচীন ভারতে আসমুদ্রহিমাচলের একটা ধর্মীয় এবং কাব্যময় কল্পনা ছিল। এর পিছনে আর্থিক কিংবা বাস্তব ভিত্তি সুদৃঢ় ছিল না। রায় বলছেন, ভৌগোলিক আধার। থাকলেই জাতীয় ঐক্য লব্ধ হবে এমন নয়। ইতিহাসের বাস্তববাদী ব্যাখ্যায় ভূগোলের বেশি কিছু চাই! কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য একটা কথাও মনে রাখা ভালো। জাতীয় ঐক্যের ধারণায় রূঢ় বাস্তবের বেশি কিছু থাকে, অর্ধেক বাস্তব আর অর্ধেক কল্পনা। সেটাই ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠে। সেই ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময়ে এসে মানুষের চেতনার দরজায় টোকা দেয়। সেটাও একরকমের বাস্তব। আর্থিক পরিস্থিতি দিয়ে গড়া নয় সেই বাস্তব, তবু আর্থিক পরিস্থিতির ওপরও তার প্রভাব এসে পড়ে।

কথাটা মানবেন্দ্রনাথ অন্য একভাবে পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। যদিও তিনি শেষ অবধি জড়বাদী দর্শনে বিশ্বাসী তবু তিনি মেনে নিয়েছিলেন যে, মানুষের চিন্তাভাবনার। নিজস্ব একটা ইতিহাস আছে, অন্তর্নিহিত বেগ আছে। চিন্তা ও বাস্তবের মধ্যে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া চলে। চিন্তার ইতিহাস এবং মানুষের ইতিহাসে তার ভূমিকা বুঝতে হলে যেমন বাস্তব পরিস্থিতির দিকে চোখ রাখতে হয় তেমনি চিন্তার ভিতরকার নিজস্ব। গতিপ্রকৃতিকেও ধারণার মধ্যে আনতে হয়। আমাদের আজকের ভাষা ও কল্পনার কিছু আজকের মানুষের এবং পরিস্থিতির সৃষ্টি বটে, কিন্তু অনেকটাই অতীত থেকে পাওয়া।

প্রশ্নটা আমাদের বামপন্থী রাজনীতিতে ফিরে এসেছিল অন্য একভাবে। ১৯৩৬ সালে কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দলের সভায় নেহরু এক বার্তা পাঠালেন। তাতে তিনি বললেন, “তোমরা তো জানোই সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে আমার আগ্রহ প্রবল। এখন প্রশ্ন কোন ভাষায় আমরা সমাজতন্ত্রের কথা এদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব? কোন ভাষায় বললে অতীতের স্মৃতি আর বর্তমানের পরিস্থিতি সব জড়িয়ে কথাটা এদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গিয়ে ধ্বনি তুলতে পারবে?” সহজেই অনুমান করা যায় কোন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি এই কথাগুলি সেদিন বলছিলেন।

মানবেন্দ্রনাথও নিজের মতো করে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। ভারতীয় প্রাচীন চিন্তার ভিতর খুঁজতে হবে নতুন চিন্তার বীজ! নতুন চিন্তাধারা যদি প্রাচীন চিন্তার কোনো ধারার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে তবে তার শক্তিবৃদ্ধি হয় না, মানুষের চেতনায় তার মূল প্রসারিত হয় না। সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এইরকম ঘটে। ঐতিহ্য থেকে রস আহরণ করে তবেই নতুন চিন্তা জনমানসে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে পারে। এ সব তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তবে তিনি সতর্ক ছিলেন। নিজের বক্তব্য সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা রাখা। চাই ভাষা খুঁজতে গিয়ে বক্তব্য হারিয়ে ফেললে চলবে না।

কিন্তু মানবেন্দ্রনাথের বক্তব্যেরও ক্রমশ পরিবর্তন ঘটেছিল। বিশের দশকেও মার্ক্সবাদী হিসেবে তিনি অবশ্যই জানতেন যে, জাতীয়তাবাদই যথেষ্ট নয়, যেমন জানতেন রবীন্দ্রনাথও মার্ক্সবাদী না হয়েও। কিন্তু তিরিশের দশকে জার্মানিতে নাৎসীশক্তির অভ্যুত্থানের পর জাতীয়তাবাদের বিপদ সম্বন্ধে তিনি আরো তীব্রভাবে সচেতন হলেন। প্রথম যৌবনে দেশ থেকে বাইরের পথে যখন তিনি পা বাড়িয়েছিলেন তখন তিনি নিজে ছিলেন জাতীয়তাবাদী। এবার তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ হল জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে। মানুষকে সতর্ক করা। স্বভাবতই ভারতে এসব কথা জনপ্রিয় হবার মতো নয়। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ চিন্তার ক্ষেত্রে নির্ভীক ছিলেন, যেমন জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে। অনেকে বলবেন যে, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তজাতিকতার কোনো বিরোধ নেই। জাতীয়তাবাদ মোপানমাত্র আন্তর্জাতিকতার পথে। এ নিয়ে তর্ক ছেড়ে দিয়ে বাস্তুৰ ঘটনা দেখা যাক। জাতীয়তাবাদের নামে এমন কাজ বারবার করা হয়েছে যেটা বিশ্বের বৃহত্তর স্বার্থের বিরোধী; যেমন জাপান আক্রমণ করেছে চীনকে। এটা বাস্তব ঘটনা, তত্ত্ব দিয়ে এই ঘটনা মুছে দেওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাথ ঐ অবস্থায় জাতীয়তাবাদের নিন্দা করেছেন, জাতীয়তাবাদকে বলেছেন ভৌগোলিক অপদেবতা। মানবেন্দ্রনাথও প্রবলভাবে জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেছেন।

কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেনি। তিনি বললেন যে, একটা সামষ্টিক শক্তিকে দেবতা বানিয়ে তার কাছে ব্যক্তিকে বলি দেওয়াটাই অপরাধ। এ কথা যদি জাতীয় সংহতি সম্বন্ধে সত্য হয় তবে শ্রেণীসংহতি সম্বন্ধেও সত্য। সেই শ্রেণী যদি শ্রমিকশ্রেণী হয় তবু একই কথা মানতে হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য। জাতীয়তাবাদের উর্ধ্বে উঠলেই চলবে না; শ্রেণীবাদকেও অতিক্রম করতে হবে। আবারও আপত্তি উঠবে। কেউ কেউ বলবেন যে, শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে মানুষের সবোত্তম স্বার্থের বিরোধ অসম্ভব। তবু ঘটনা হল এই যে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থের নামে এমন কাজ করা হয়েছে, এমন নীতি গৃহীত হয়েছে, যেমন স্তালিনী আমলে এমন কি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই, যেটা মানুষের আদর্শের বিপরীত। কোনো নীতি সম্বন্ধেই শেষ প্রশ্ন এই নয় যে, সেটা কোনো বিশেষ জাতি অথবা শ্রেণী অথবা সম্প্রদায়ের স্বার্থে প্রয়োজন কি না শেষ প্রশ্ন এই যে সেটা মানুষের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মানুষের ধর্মের কথা। মানবেন্দ্রনাথ বললেন নবমানবতাবাদের কথা। এখানেই মার্ক্সবাদ থেকে তাঁর নিষ্ক্রমণ। তাঁর ভাষা ও বক্তব্য দুয়েরই বিবর্তনে একটা নবপর্যায় উন্মোচিত হল এইভাবে। এইখানে শুরু নতুন কিছু জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধান।

প্রশ্ন উঠবে, মনুষ্যত্বের আদর্শ বলতে আমরা কী বুঝি? মানবপন্থীরা বলবেন, ব্যক্তিমানুষের ভিতর যে অজস্র সম্ভাবনা আছে তার পরিপূর্ণ বিকাশই হল মানবতাবাদীর লক্ষ্য। প্রতিটি মানুষ ভালো খেয়ে পরে সুস্থ দেহে থাকবে, ইন্দ্রিয়ের ভিতর দিয়ে যে আনন্দআস্বাদন করা যায় তা লাভ করবে, বুদ্ধি এবং চিন্তার ক্ষেত্রে বিশ্বমানবের যে ঐশ্বর্যময় ঐতিহ্য তাতে তার অধিকার যথাসম্ভব বিস্তৃত হবে, শিল্পসাহিত্যের ভিতর দিয়ে যে। নান্দনিক অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত হয় তা থেকেও বঞ্চিত থাকবে না। এইভাবে ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার ভিতর দিয়েই সমাজের পূর্ণতা। প্রশ্ন তবু থেকে যায়। মানুষের বিভিন্ন সম্ভাবনার ভিতরও বৈপরীত্য থাকে। সব সম্ভাবনার একই সঙ্গে পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এই সব বৈপরীত্যের মধ্যে পথ খুঁজে নেওয়া যাবে কোন সূত্র ধরে? এ প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি রেখে অন্য একটা জরুরী জিজ্ঞাসায় যাওয়া যাক।

রাজনীতির একটা বড় সমস্যা মানবেন্দ্রনাথকে শেষ জীবনে ক্রমশই পীড়িত করছিল। হয় তো অনেক আগেই এর শুরু, কিন্তু তাঁর চিন্তার অভিব্যক্তির শেষ পর্যায়ে এটা বড় হয়ে উঠল। সমস্যাটা রাজনীতিতে দুর্নীতি নিয়ে। তিনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন একটা আদর্শ নিয়ে, আরো কিছু মানুষের মতো তিনিও আদর্শের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির পথ ধরে আদর্শের দিকে অগ্রসর হওয়া কতটা সম্ভব? যদি

সেটা সম্ভব না হয় তবে তো প্রচলিত রাজনীতিও একটা ব্যবসা মাত্র, বিবেকবান মানুষের। তাতে রুচি থাকবার কথা নয়। অতএব রাজনীতিকে দুর্নীতি থেকে মুক্ত করাটাই একটা বড় প্রশ্ন। কী করে সেটা সম্ভব? মানবেন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্লেষণী বুদ্ধি দিয়ে সমস্যাটা বুঝবার চেষ্টা করলেন। আজকের রাজনীতি হল মূলত বিভিন্ন দলের ভিতর ক্ষমতার জন্য লড়াই। আর এরই ফলে রাজনীতি হয়ে উঠেছে দুর্নীতি। অথচ দলীয় গণতন্ত্রকে রাজনীতির একমাত্র এবং অনিবার্য রূপ মনে করবার কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্রের কিছু আদর্শ শ্রদ্ধেয়, কিন্তু দলীয় রাজনীতির অথবা গণতন্ত্রের পক্ষে অপরিহার্য নয়। একদলীয় নয় কিন্তু নির্দলীয় গণতন্ত্রের আদর্শ মানবেন্দ্রনাথের শেষ জীবনের চিন্তার একটি প্রধান অঙ্গ।

এই সব চিন্তাভাবনার ভিতর দিয়ে গান্ধী এবং মানবেন্দ্রনাথের ধারা জীবনের শেষ প্রান্তে যেন কিছু সামঞ্জস্যের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। কিছুটা, কিন্তু সর্বাংশে নয়।

আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা, বাণিজ্য ও শিল্পকে আশ্রয় করে যে সভ্যতা গান্ধীর সামনে অনাবৃত হয়েছিল, নিজের আদর্শ ও জীবনবোধের সঙ্গে গান্ধী তার অসামঞ্জস্য লক্ষ। করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে, এই নতুন সমাজে ক্ষমতা ছড়িয়ে নেই লোকালয়ে। লোকালয়ে, কেন্দ্রীভূত হয়েছে বিশেষত নগরে। আধুনিক প্রযুক্তি এই কেন্দ্রীকরণকেই সুদৃঢ় করেছে। তিনি আরো দেখেছিলেন যে, নাগরিক সভ্যতায় মানুষের ভোগতৃষ্ণার সীমা নেই, তার মন অধিকার করে আছে অর্থ ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, যেন এরই অন্তহীন সঞ্চয়ের ভিতর দিয়ে লাভ হবে অন্তহীন চরিতার্থতা। তাঁর মনে হয়েছিল যে, ক্ষমতার কাড়াকাড়ি এবং ভোগের তৃষ্ণা যতদিন প্রবল থাকবে ততদিন সমাজ থেকে হিংসা ও দুর্নীতি সরানো যাবে না। তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, সামাজিক বিন্যাসে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের অবসান চাই, আর মানুষের বিশেষত বিত্তবান মানুষের ভোগবাদী মনোভাবকেও সচেতনভাবে সংযত করা আবশ্যক।

মার্ক্সবাদী মানবেন্দ্রনাথ জানতেন যে, ভোগবাদবিরোধী দর্শনকে সমাজের উঁচুশ্রেণীর মানুষ ব্যবহার করেছে নিচুশ্রেণীকে সংযত রাখবার জন্য। ভোগবাদবিরোধী দর্শনের প্রতি তাই তাঁর একটা বিরোধিতা ছিল সেই বিরোধিতা তিনি কখনও সম্পূর্ণ ত্যাগ করেননি। ঈশ্বরে নয়, তিনি বিশ্বাস ন্যস্ত করেছিলেন যুক্তিতে, যে যুক্তি সুখের ভিতরই সদর্থ খুঁজে পায়। গরীবের জন্য যে রুটিই প্রথম প্রয়োজন একথা গন্ধীও জানতেন এবং অত্যন্ত স্মরণীয় ভাষায় বলে গেছেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভোগের আকাঙ্ক্ষাকে সংযত করে মানুষ তার ভিতরের শক্তিকে অন্য এক রূপ দিতে পারে, যার প্রকাশ সেবা এবং প্রেমে। এরই আলোতে আমরা অবশেষে চিত্তের বিভিন্ন প্রবৃত্তির ভিতর সামঞ্জস্যের সূত্র খুঁজে পাই। এই সব কথা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের জীবনদর্শনে গুরুত্ব পায়নি। বস্তুত এসব কথায় তিনি বিপদের আশংকাই দেখেছেন। এই শিকড় থেকেই বেড়ে ওঠে সেই ধর্ম যাকে অবলম্বন করে দীর্ঘকাল ধরে পুরোহিতশ্রেণী বিভ্রান্ত করেছে সাধারণ মানুষকে। মানবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারায় এই কথাটাই থেকে গেছে। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন, সেই সঙ্গে চাই বিবেকহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সংগঠিত জনমত, এই প্রতীতিতে গান্ধী ও মানবেন্দ্রনাথ পরম্পর কাছাকাছি এসেছিলেন। গান্ধীর দৃষ্টিতে নীতির ভিত্তিভূমি, অহিংসা তথা সত্য; রায়ের দৃষ্টিতে, যুক্তি অতএব সত্য।

.

নবমানববাদী আন্দোলনে পথপ্রদর্শক হবেন কারা?

সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে আসবার পথে স্বাভাবিক নেতৃত্ব ছিল বুর্জোয়াশ্রেণীর হাতে। মার্ক্স এই শিক্ষা দিলেন যে, ধনতন্ত্র থেকে সাম্যবাদের পথে আন্দোলনের স্বাভাবিক নেতৃত্ব শ্রমিকশ্রেণীর। পৃথিবীর কোনো দেশে আজ ধনতন্ত্র, কোনো দেশে সমাজতন্ত্র। কিন্তু আধুনিক সব সমাজে দেখি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের সেই ঝোঁক, গান্ধী ও মানবেন্দ্রনাথ দুজনের চোখেই যেটা মনে হয়েছে বিপজ্জনক, অতএব বিরোধের যোগ্য। কিন্তু এই বিরোধিতায় কে নেতৃত্ব দেবে? সমাজের অভ্যন্তর থেকে এমন কোনো বিশেষ শ্রেণীর কি উদ্ভব হয়েছে যার কাছ থেকে নেতৃত্ব আশা করা যায় ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণের প্রতিরোধী আন্দোলনে? এমন কোনো বিশেষ শ্রেণী কি আছে যার কাছ থেকে নেতৃত্ব প্রত্যাশিত দুর্নীতি ও হিংসার বিরুদ্ধে সংগ্রামে?

এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য জন্ম হয়নি কোনো বিশেষ শ্রেণীর। এই মূল্যবোধের সংগ্রাম নয় পুরনো কোনো অর্থে সুনির্দিষ্ট শ্রেণীসংগ্রাম। এ মূল্যবোধ যারই কাছে শ্রদ্ধেয় তিনিই এই সম্ভাবিত আন্দোলনের অংশীদার। মানবেন্দ্রনাথ যে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং চাষী মজুরের কথা বলেছিলেন তারা হয় তো যোগ দেবে এ সংগ্রামে, যেমন দিয়েছে পোল্যান্ডের শ্রমিকশ্রেণী সে দেশের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। কিন্তু তবু এই নতুন আন্দোলনের কোনো সংজ্ঞাপিত রূপ নেই, পতাকা নেই, শ্রেণীগত সীমানা নেই। কোথাও এতে আন্দোলিত হচ্ছে যুবসম্প্রদায়, কোথাও নতুন যুগের নারী। কোথাও সরকারি ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে অসীম সাহসে কাজ করে যাচ্ছে কিছু নবচিন্তক। এ সংগ্রাম সর্বমানবের। মানবেন্দ্রনাথের নবমানবতাবাদের সঙ্গে এর সুর মেলে। যেমন মেলে গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে। এঁদের কারো চিন্তাই অন্যের সঙ্গে অভিন্ন নয়। কিন্তু এ এক অন্য আন্দোলন, যেখানে চিন্তার বৈচিত্র্য অপরাধ নয়।

মানবেন্দ্রনাথের ধ্যানধারণার সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক তার সজীবতা, তার বিচিত্র বিবর্তন। চিন্তা নয়, চিন্তাধারা; তাতে পরিবর্তন আছে আর সেই সঙ্গে ধারাবাহিকতা, মুক্ত চিন্তার যেটা স্বাভাবিক ধর্ম। বিশের দশকের সেই বৈজ্ঞানিক মার্ক্সবাদ কত সরল ছিল। যুক্তিবাদের একটা স্তর আছে যেখানে মনে হয়,ভাবালুতা ত্যাগ করে বাস্তব পরিস্থিতির আলোতে সমস্যার পরিচ্ছন্ন সমাধান খুঁজে নেওয়াটাই কর্তব্য। অথচ অনন্য কোনো বাস্তব পরিস্থিতি নেই, কোনো বাস্তব পরিস্থিতিতেই লুকিয়ে নেই সমস্যার কোনো অনন্য। সমাধান আছে শুধু স্তর ও সম্ভাবনার সমাহার। মানুষের চেতনার পটভূমিতে কত দৃশ্য এবং অদৃশ্য লিপি লিখে রেখে গেছে অতীত। তারই সঙ্গে মিলিয়ে ব্যক্তিচৈতন্য এবং বাস্তব পরিস্থিতিকে আমরা চিনি, যুক্তি এবং বিবেকের ভাষা গড়ে ওঠে, মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার নতুন পাঠ তৈরি হয়।

বিচিত্র সেই পাঠ; বিবিধ তার ব্যাখ্যা। শিক্ষা ও সংশোধন চলবে। কোন মূল্যবোধের দিকে আমরা চালিত হচ্ছি, সেটাই প্রধান কথা। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *