রামমোহন রায়
১
যদি ভারতের উনিশ শতকী নবজাগরণের জন্মবৃত্তান্ত এবং তার পরিণত আশা একই বৃন্তে প্রত্যক্ষ করতে চাই তবে আমাদের চোখ ফেরাতে হয় রামমোহনের দিকে।
রামমোহনের জন্মের মাত্র কিছুকাল আগে বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন স্থাপিত হয়েছে। ১৮১৪-১৫ সালে তিনি যখন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করতে আসেন ততদিনে সারা ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য সুনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। এই ঐতিহাসিক পটভূমিকাতেই তাঁর জীবন ও চিন্তাধারার পর্যালোচনা আবশ্যক।
ইংরেজের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটে। রামমোহন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুগণ, যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর অথবা প্রসন্নকুমার ঠাকুর, এই নতুন মধ্যবিত্তের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। Bengal Herald নামে যে পত্রিকা তাঁরা প্রকাশিত করেন তার পাতায় এর প্রমাণ আছে। ১৮২৯ সালের ১৩ জুন তারিখের একটি সম্পাদকীয়তে এই ইতিহাসসচেতন মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে অষ্টম হেনরী এবং ক্রমওয়েলের মধ্যবর্তীকালে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমশ বৃদ্ধিলাভ করে এবং নতুন যুগের সৃষ্টিতে নেতৃত্বদান করে, সে সম্বন্ধে ঐ সম্পাদকীয়তে পরিচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। সামাজিক মুক্তির সম্প্রসারণে মধ্যবিত্তের ভূমিকা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে। স্পেন অথবা পোল্যান্ডে যে অনুরূপ কোনো শ্রেণী ঐ সময়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি এবং সেই কারণে ঐসব দেশে সামাজিক মুক্তিরও তেমন সম্প্রসারণ সম্ভব হয়নি, এইসব কথার ইঙ্গিত আমরা পাই ঐ সম্পাদকীয়তে। ১৮২৯ সালের চিন্তা হিসেবে এই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ আশ্চর্য রকমের স্বচ্ছ ও প্রাগ্রসর।
রামমোহন স্বভাবতই এই নতুন মধ্যবিত্তের বিকাশ ও বৃদ্ধি চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এটাই আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন যে, এই নতুন শ্রেণীর মানুষ এমন ভাবেই তার সামাজিক ভূমিকা পালন করবে যাতে এই শ্রেণীর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সারা সমাজেরই এবং বিশেষত দরিদ্র চাষীরও অবস্থার উন্নতি হয়। এই প্রসঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা এসে যায়। সরকার ও জমিদারদের ভিতর এই বন্দোবস্তের ফলে নতুন মধ্যবিত্তের সুবিধা হয়। নতুন জমিদারেরা কিন্তু প্রজাদের উপর খাজনার বোঝা বাড়িয়ে চললেন। অর্থাৎ সরকার জমিদারের কাছে কতটা দাবী করতে পারবেন সেটা স্থির হয়ে গেল, কিন্তু জমিদার প্রজার কাছ থেকে কতটা আদায় করতে পারবেন তার কোনো সীমা নির্ধারিত হল না। এতে রামমোহনের আপত্তি ছিল। তিনি সরকার ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে এই সুপারিশ করেন যে, জমিদার এবং দরিদ্র কৃষক বা রায়তের ভিতরও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুরূপ। একটা ব্যবস্থাই প্রবর্তন করা প্রয়োজন যাতে খাজনার বোঝা এইভাবে বাড়ানো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ক্রমাগত খাজনা বাড়িয়ে নয়, উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি করেই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্পদবৃদ্ধির প্রয়াস করতে হবে।
রামমোহন ছিলেন বেন্থাম, জেমস মিলের সমসাময়িক মানুষ। এঁদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল। মতামতের আংশিক মিলও লক্ষ করা যায়। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রশ্নে তৎকালীন ব্রিটিশ লিবারেলদের মতামত যতটা অনমনীয় ছিল রামমোহনের তেমন ছিল না বলেই মনে হয়। ১৮৩০ সালে রুমামোহন পশ্চিমযাত্রা করেন এবং ১৮৩৩ সালে তাঁর মৃত্যু অবধি পাশ্চাত্য দেশেই, প্রধানত ইংল্যান্ডে থাকেন। সে সময়ে ঐ দেশে সমাজতান্ত্রিক নেতা রবার্ট ওয়েনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ এবং চিন্তার বিনিময় হয়। ওয়েন খ্রীষ্টধর্ম বিরোধী ছিলেন, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তো ছিলেন বটেই। বেন্থাম, জেমস মিল, রামমোহন এই সকলের সঙ্গেই ওয়েনের মতপার্থক্য দেখা যায়। কিন্তু এখানে যেটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল এই, জেমস মিলের মতো লিবারেলদের সঙ্গে ওয়েনের বিরোধ ছিল সমাজতন্ত্র নিয়ে অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রশ্ন নিয়ে, ধর্ম নিয়ে নয়। আর রামমোহন আপত্তি তুলেছিলেন ওয়েনের ধর্মবিরোধিতার বিরুদ্ধে, সমাজতন্ত্র বিষয়ে মতামত নিয়ে নয়। বরং তাঁর চিঠিপত্র থেকে এরকমই মনে হয় যে, রবার্ট ওয়েনের সমাজতান্ত্রিক কাজকর্মে তিনি সদিচ্ছা ও মানবিকতার সন্ধান পেয়েছিলেন। রবার্ট ওয়েনকে ১৮৩২ সালের ২রা জানুয়ারি তারিখে লিখিত তাঁর পত্রে তিনি জানান তাঁর “best wishes for the success of your system if founded upon the precepts of christianity” এবং পরের বছরে ওয়েনের পুত্রকে লিখিত বিখ্যাত পত্রে ব্যক্ত করেন তাঁর OtoYEART” to see you and your father crowned with success in your benevolent undertakings.”
অর্থাৎ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি এবং সেই সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে তাঁর অবস্থান সচেতনভাবে স্বীকার করে নিয়েও রামমোহন এমন নীতির সন্ধান ও সমর্থন করেছিলেন। যাতে মধ্যবিত্তের ক্রিয়াকর্মে ও উদ্যোগে সমস্ত সমাজ তৎসময়ে উপকৃত হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মেনে নিয়েও তিনি সেই অধিকারকে বৃহত্তর ধর্ম ও আদর্শের অধীন রাখতে চেয়েছেন। সংক্ষেপে, বাস্তব পরিস্থিতিকে স্বীকার করেও তাঁর প্রয়াস ছিল সেই পরিস্থিতিতে আবদ্ধ হয়ে না পড়া। বরং সেই পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে যাওয়ার মতো আদর্শ সম্ভব মতো সম্মুখে রেখে চলতে চেয়েছিলেন তিনি।
.
২
রামমোহনের নামের সঙ্গে তাঁর ধর্মচিন্তা অচ্ছেদ্য। এই বিষয়টি এবার আলোচনা করা যেতে পারে।
যে ভারতবর্ষে তাঁর জন্ম সে দেশের সঙ্গে ইংল্যান্ডের একটা বড় পার্থক্য এই যে, ভারত বহু ধর্মের দেশ, ইংল্যান্ডে এক ধর্ম প্রধান। ধর্মকে অবলম্বন করে কিছু গুরুতর সমস্যা রামমোহন স্বদেশে লক্ষ করেছিলেন। এক হল, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের ভিতর সদ্ভাবের অভাব! ঔরঙ্গজেব ও শিবাজীর সময় থেকেই রাজনীতির সূত্রে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে। শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গেও মুসলমানদের সংঘাত দেখা দেয়। বিরোধ ছিল সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরেও। হিন্দুধর্মের ভিতর সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভেদ এবং জাতিভেদজনিত অসাম্য রামমোহনকে চিন্তিত করে। তাছাড়া হিন্দুধর্ম ছিল কুসংস্কারে এবং সতীদাহের মতো অমানবিক আচারে জর্জরিত। এরই ভিতর এলো খ্রীষ্টধর্মের চ্যালেঞ্জ এবং যুক্তিবাদী দর্শনের আহ্বান। এই যুক্তিবাদ রামমোহনের কাছে এসে পৌঁছয় প্রথমে ইসলামীয় সূত্রে, মুতাজিলা ঐতিহ্য থেকে, পরে পাশ্চাত্য দর্শনের মাধ্যমে।
এই সবের ভিতর রামমোহনকে নিজস্ব পথ বেছে নিতে হল। এ ব্যাপারে তাঁর চিন্তা সাবধানে বুঝবার চেষ্টা করতে হবে, কারণ সেই চিন্তা স্থির হয়ে থাকেনি। তাঁর ত্রিশ বছর বয়সের চিন্তা আর চল্লিশোত্তর ভাবনা ঠিক এক নয়।
রামমোহনের প্রথম জীবনের ধর্মচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় ‘তৃহফাং-উল-মুওআহিদিন’ নামে পুস্তকটিতে। এখানে দেখি যে তিনি বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলিকে যুক্তিবাদের সাহায্যে বিচার করতে চাইছেন। বলছেন যে, প্রতি ধর্মে কিছু সার বস্তু থাকে এবং সেই সঙ্গে থাকে আরো কিছু যা অসার এমন কি অনিষ্টকর। বিভিন্ন ধর্মের ভিতর ভিন্নতা দেখা দেয় বাহ্য আচার এবং ভ্রান্ত কুসংস্কার নিয়ে; বিভিন্ন ধর্মের মিল তাদের সত্যবস্তুতে। যেখানে মিল সেখানেই তাদের সর্বমানবীয় এবং যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তি। সেটাই শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণীয়।
ধর্মবিচার এবং ধর্মসমন্বয় সম্বন্ধে একটা মূল প্রশ্ন এখানে এসে যায়। দুটি ভিন্ন মনোভাব নিয়ে এই বিচারে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। আমরা নিজেদের কোনো বিশেষ ধর্মের অন্তর্গত না ভেবে সব ধর্মকেই বাইরে থেকে বিচার করতে পারি। ধর্মবিচারের একটা দ্বিতীয় পথও আছে। নিজেকে ঐতিহ্যসূত্রে লব্ধ কোনো বিশেষ ধর্মের অন্তর্গত বলে মেনে নিয়ে আমরা সেই ধর্মের ভিতর এমন কী আছে যা শ্রেষ্ঠ এবং শ্রদ্ধেয় তার অন্বেষণ করতে পারি, অন্যান্য ধর্মকে আমরা সেই দৃষ্টিতে বিচার করে দেখতে পারি এবং ভিন্ন ধর্মের ভিতর যা কিছু শ্রেষ্ঠ তারই সাহায্যে নিজ ধর্মের শোধন ও উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট হতে পারি।
রামমোহনের প্রথম জীবনে অর্থাৎ ‘তুহফা শীর্ষক পুস্তকে যে দৃষ্টিভঙ্গী সেটা প্রায় সম্পূর্ণত যুক্তিবাদী এবং সেখানে তিনি সব ধর্মকে বাইরে থেকে দেখে বিচারপ্রয়াসী। কিন্তু কলকাতায় বসবাস শুরু করবার পর তাঁর বিভিন্ন রচনায় যে দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ পায় সেটা এই বাহ্যবিচারের উপর নির্ভরশীল নয়। তাতে অন্য একপ্রকার অন্তদৃষ্টির প্রাধান্য। বেদ-উপনিষদকে অবলম্বন করে তিনি এবার হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠভাগ আবিষ্কার করতে চাইছেন, তারই সঙ্গে মিলিয়ে খ্রীষ্টধর্মের বিচার করছেন এবং স্বধর্মের সংস্কারের জন্য সচেষ্ট হচ্ছেন।
এই ব্যাপারটা তৎকালীন প্রগতিবাদীদের দৃষ্টি এড়ায়নি। ডিরোজিও গোষ্ঠীভুক্ত কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দুধর্মের প্রতি বিরক্ত হয়ে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি রামমোহনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বলেছিলেন, “Rammohan’s memory we cannot but venerate”। কিন্তু সেই সঙ্গে যোগ করেছিলেন, “It is impossible for us not to regret that he so hastily considered the rejection of Hinduism to be incompatible with his patrotism” (Calcutta Review, Vol III, 1845) TACTION নিজে সমস্যাটি বুঝেছিলেন অন্যভাবে। হিন্দুধর্মকে ত্যাগ করে তাঁর ঐতিহাসিক দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারবেন না; অন্তদৃষ্টি নিয়ে স্বজাতির অভ্যন্তর থেকেই তাঁকে করতে হবে সত্যশোধনের প্রয়াস।
এই প্রসঙ্গে আরো দুটি কথা যোগ না করলে রামমোহনের দৃষ্টিভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য বোঝা যাবে না।
একজাতীয় দেশপ্রেম আছে যাতে আত্মসমালোচনার বড়ই অভাব। এই সংকীর্ণ দেশপ্রেম নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির কোনো ত্রুটিই স্বীকার করতে রাজী নয়। হিন্দুধর্মের কোনো দিকে কোনো ন্যূনতা আছে, আমাদের সংস্কৃতি কোনো অংশে দুর্বল, এমন কথা শুনলেই এই দেশপ্রেমিকরা প্রতিবাদ করা কর্তব্য মনে করেন রামমোহনের ভিতর এজাতীয় সংকীর্ণতা ছিল না। হিন্দুধর্ম ও খ্রীষ্টধর্মের তুলনামূলক বিচারে তিনি অহেতুক পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত ছিলেন। এরই ফলে ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন ধর্ম থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে স্বধর্ম ও নিজ দেশের সংস্কৃতির রূপান্তরে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছে
রামমোহনের বিচারে আত্মজ্ঞান সম্বন্ধে চিন্তার ক্ষেত্রে বেদই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু সমাজের প্রতি কর্তব্যপালনের জন্য যে নীতিশিক্ষা প্রয়োজন সেই শিক্ষা খ্রীষ্টধর্মে আরো সংহত আকারে পাওয়া যায়। চন্দ্রশেখর দেবের স্মৃতিচারণে এই রকম একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। রামমোহন সেখানে বলেছেন, “If religion consists of the blessings of sell-knowledge and of improved notions of God and his attributes and (il) a system of morality holds a subordinate place, I certainly prefer the Vedas. But the moral precepts of Jesus are something most extraordinary. The Vedas contain the same lessons of morality but in a scattered form. ( cata fari, অগ্রহায়ণ ১৭৯৪ শক, পৃঃ ১৪০) রামমোহন লক্ষ করেছিলেন যে পুণ্যকর্ম বলতে হিন্দু প্রথমেই বোঝে যাগযজ্ঞ, পূজোআচা, আচার-অনুষ্ঠান সমাজসেবা অথবা প্রতিবেশীর হিতসাধক কাজ তেমন নয়। তিনি লিখেছিলেন, “Christians understand by works action of moral merit, whereas Hindus use the term in their theology only to denote religious riles and ceremonies” (The English Works of Raja Rammohan Roy, od Kalidas Nag and Debajoti Burman, Part II, p. 100) খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে তুলনায় হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে এইরকম সমালোচনামূলক মন্তব্য করতে আমাদের অনেকেরই দেশপ্রেমে বাধে। রামমোহন কিন্তু হিন্দুধর্মের প্রতি প্রীতি রক্ষা করেই এসব কথা বলতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মব্যাখ্যা মাত্র নন, ধর্মসংস্কারক; তাঁর। সমালোচনা সংস্কারেরই সহায়ক। হিন্দুসমাজে সমষ্টিগত উপাসনার প্রচলন তিনি প্রয়োজন মনে করেছিলেন, একক উপাসনার পরিপূরকরূপে। শুধু নিজের চিত্তকে মুক্ত ও জ্ঞানোজ্জ্বল করাই তাঁর লক্ষ্য ছিল না, চারদিকের অজ্ঞান অন্ধকারকে দূর করতে তিনি তাঁর শক্তি নিযুক্ত করেছিলেন। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে তিনি হিন্দুসম্প্রদায়কে চালিত করতে চেয়েছিলেন বৃহত্তর সমাজসেবার দিকে; একই প্রচেষ্টা আরো পরে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায় বিবেকানন্দের শিক্ষার ভিতর।
রামমোহন যদিও হিন্দুধর্মের ও সমাজের ভিতর থেকেই কাজ করতে চেয়েছেন তবু প্রথম জীবনের বৃহত্তর সমন্বয়ের আদর্শ তিনি শেষ অবধি ত্যাগ করেননি। হিন্দু ও মুসলমানের ভিতর বিরোধ তিনি অতিক্রম করেছিলেন উল্লেখযোগ্যভাবে। হিন্দুসমাজের ভিতরে কাজ করেও সমস্ত সাম্প্রদায়িক সীমা অতিক্রম করতেই তিনি আগ্রহী ছিলেন। তিনি জানতেন যে, প্রতিটি ব্যক্তির মানবপরিচয় মূল্যবান। মানুষের সংস্কৃতিকে আরো। ভালোভাবে জানা, মানবজাতির হিতসাধন করা, এটাই ছিল তাঁর বৃহত্তর লক্ষ্য। আঠারো ও উনিশ শতকে যে মানবতাবাদী এবং মানবিক সংস্কৃতিতে আগ্রহী চিন্তার আন্দোলন পাশ্চাত্য দেশের কিছু মনীষীর ভিতর দেখা দেয় তারই সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রামমোহন। তৎকালেই তিনি সেই হিসেবে স্বীকৃতিও লাভ করেছিলেন। রামমোহনের জীবনের শেষভাগে তাঁর সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে একজন ফরাসী ভারতবিদ্যাবিদ সেই মানবধর্মী চিন্তার আন্দোলন সম্বন্ধে আলোকপাত করেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলিয়ে রামমোহন সম্বন্ধে তাঁর অভিমত উল্লেখযোগ্য। লেখক বলছেন, “ঠিক যেমন তিনি (রামমোহন) স্বয়ং বিপুল আগ্রহ সহকারে মানবসভ্যতা সম্পর্কে বৃহত্তর, মহত্তর ও দৃঢ়তর অন্তদৃষ্টি লাভের জন্য ইউরোপীয় সভ্যতা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় ব্রতী হয়েছেন, আমরা ইউরোপীয়রাও একইভাবে মানবজাতি সম্পর্কে বৃহত্তর ও উচ্চতর ধারণা অর্জন করার জন্যই এসিয়ার সভ্যতা ও জ্ঞানবিজ্ঞানসমূহের অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয়েছি; কারণ মনুষ্যত্বের কোনো বিভাগ নেই।” (দিলীপকুমার বিশ্বাস, রামমোহন সমীক্ষা, সারস্বত লাইব্রেরী, কলকাতা ১৯৮৩, পৃঃ ৫২৪-২৫)*। এর উপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
.
৩
সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহন স্বকালে ও স্বদেশে অগ্রগণ্য হলেও সেখানে তিনি একা ছিলেন না। কিন্তু যুগসচেতন বিশ্বমানবতার বোদ্ধারূপে তৎকালীন ভারতে তাঁর সঙ্গে তুলনীয় অন্য কাউকে দেখি না। দেশপ্রেম আরো অনেকের মধ্যে ছিল, কিন্তু দেশপ্রেম ও আন্তজাতিকতার ভিতর অবিরোধ স্থাপনে তিনি অদ্বিতীয়। যুক্তিবাদী অথবা ধার্মিক হিসেবে উল্লেখযোগ্য নামের অভাব নেই। কিন্তু এ দুয়ের ভিতর সমন্বয়সাধনের প্রচেষ্টার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রামমোহন।
তাঁর আজীবন সাধনার মূল্য বৈশিষ্ট্য সম্ভবত এখানেই। যে যুগে, যে শ্রেণীতে ও যে দেশে তাঁর জন্ম সেই যুগ, শ্রেণী ও দেশের প্রতি তাঁর মমতা ছিল। কিন্তু এই সবে তিনি আবদ্ধ থাকেননি, সব কিছুকে গ্রহণ করেও তিনি অতিক্রম করে গেছেন। এখানেই একটি মৌল প্রশ্ন দেখা দেয়। সীমাকে মমতার সঙ্গে গ্রহণ করেও তাকে অতিক্রম করবার এই শক্তি কোথা থেকে আসে? আমরা সকলেই ব্যক্তি হিসেবে ক্রমপ্রসরমাণ নানা বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত। যতক্ষণ ছোট বৃত্তের সঙ্গে বৃহত্তর বৃত্তের স্বার্থের সংঘাত নেই, ততক্ষণ সমস্যা দেখা দেয় না। কিন্তু সংঘাত প্রায়শই ঘটে, আর তখনই আমরা পরীক্ষার সম্মুখীন হই। আমাদের ব্যক্তিগত অথবা সাম্প্রদায়িক স্বার্থের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের স্বার্থের যদি বিরোধ দেখা দেয় তবে আমরা কোনটিকে ত্যাগ করব, কোনটিকে রক্ষা করব, এবং কেন? আমাদের ভিতর যাঁরা আত্মশক্তিতে বড়, যাঁরা শ্রদ্ধেয়, তাঁরা কোন শক্তির বলে স্থির করেন যে, ব্যক্তিগত, শ্রেণীগত অথবা নিতান্ত স্থানীয় স্বার্থকেই সেখানে ত্যাগ করতে হবে, বৃহত্তর বৃত্তের কাছে আত্মোৎসর্গ করেই ক্ষুদ্রতর বৃত্তের সার্থকতা?
এ প্রশ্নের একটি উত্তর এই যে, যুক্তিই এই দ্বন্দ্বের ভিতর মানুষের পথপ্রদর্শক। রামমোহনের উত্তর এত সরল ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ধর্ম ও যুক্তির পরস্পরনির্ভর একটা সংযোজন, যেজন্য রবার্ট ওয়েনের ধর্মত্যাগী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে তিনি সম্পূর্ণ সমর্থন করতে পারেননি। মূল প্রশ্নটির প্রতি আর একবার দৃষ্টিপাত করা যাক। ব্যক্তির বৈষয়িক স্বার্থের সঙ্গে বৃহত্তর মানবসমাজের স্বার্থের যদি দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তবে কোন যুক্তিতে ব্যক্তি তাঁর বৈষয়িক স্বার্থ ত্যাগ করতে চাইবে? বলা হয়ে থাকে যে, সমাজের স্বার্থের হানি হলে তাতে ব্যক্তির বৈষয়িক স্বার্থ অবশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যক্তিসমষ্টির। কাছে এ যুক্তি আদরণীয়, কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের কাছে এটা গ্রহণীয় হবে কেন? সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেও নিজের বৈষয়িক স্বার্থ গুছিয়ে নিয়েছেন এমন লোকের তো অভাব। নেই। বলা যেতে পারে যে, উচ্চতর আদর্শের জন্য নিজের ছোট স্বার্থ ত্যাগ করে মানুষ একটা গভীরতর তৃপ্তি লাভ করে। এই তৃপ্তি অথবা উচ্চতর আদর্শের উপলব্ধি কিন্তু বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধি থেকে ভিন্ন বস্তু। রামমোহনের দৃষ্টিতে এর যোগ আধ্যাত্মিক উপলব্ধির সঙ্গে। যুগ যুগ ধরে পরীক্ষিত আধ্যাত্মিক উপলব্ধির সংগ্রহ ঘটে শাস্ত্রে। এই অর্থে শাস্ত্র শ্রদ্ধেয়। তবু রামমোহন ধর্মের সঙ্গে আবার যুক্তিকেও অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন। কেন?
যুক্তি যথেষ্ট নয়; আবার যুক্তি মূল্যবান। দুটি কথা একই সঙ্গে বলা আবশ্যক। এক সর্বব্যাপী সন্দেহ অথবা সংশয়বাদের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে যুক্তি, এইরকম রামমোহনের মনে হয়েছিল। কাজেই যুক্তি যথেষ্ট নয়। আবার যা কিছু ধর্ম অথবা আধ্যাত্মিকতা অথবা শাস্ত্রীয় বচনের বেশে আসে তাই আধ্যাত্মিক নয়, তার কিছু শুধুই বঞ্চনা। কাজেই যুক্তির সাবধানী দৃষ্টির প্রয়োজন আছে। যুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা না। করলে বিপদ আছে। যুক্তি এবং আধ্যাত্মিকতা হাত ধরাধরি করে চলবে, যা কিছু সংকীর্ণতা তা থেকে আমাদের পথ দেখিয়ে নেবে বৃহত্তরের দিকে, উচ্চতর আদর্শের দিকে।
রামমোহনের সামাজিক ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এখানে আবারও উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। যে দেশে তাঁর জন্ম তার গ্রামের সঙ্গে তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। আবার বাণিজ্য ও প্রশাসনের কেন্দ্র কলকাতা নগরীর সঙ্গেও তাঁর ঘটেছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তিনি লক্ষ করেছিলেন কলকাতায় যুক্তিবাদের অভ্যুত্থান। যুক্তিবাদের সদর্থক দিকের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন। তবু তিনি এটাও দেখেছিলেন যে, গ্রামের মানুষ যদিও হতদরিদ্র ও নিরক্ষর তবু তারা তেমন নীতিভ্রষ্ট নয় যেমন নগরের মানুষ। নগরবাসীদের সম্বন্ধে রামমোহন লিখেছেন যে, এদের অধিকাংশ হল “far inferior, in point of character, to the peasants” (574), B. N. Ganguli, Gandhi’s Social Philosophy, chapter 9, Vikash, Delhi, 1973) ধর্ম কত সহজে কুসংস্কারের দিকে ঝোঁকে এটা যেমন তাঁর জানা ছিল তেমনি যুক্তিবাদ কত সহজে মানুষকে আদর্শভ্রষ্ট স্বার্থসর্বস্বতার দিকে নিয়ে যায় সেটাও তিনি অভিজ্ঞতার ভিতরই পেয়েছিলেন। ধর্ম ও যুক্তির যে-সমন্বয়ের চিন্তা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল, তার পিছনে ছিল এই বাস্তব অভিজ্ঞতা।
তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের শেষ সমাধান অবশ্য খণ্ড খণ্ড সামাজিক অভিজ্ঞতার দ্বারা হয় না। কাজেই তর্ক চলে। যাঁরা ভগবানে অথবা ধর্মে বিশ্বাসী নন তাঁদের ভিতরও কি আমরা কখনও কখনও মহৎ আদর্শনিষ্ঠার উদাহরণ দেখি না? এর উত্তরে যে কথা বলা চলে তা এই। আত্মার আলোতে অনেকে স্বভাবত বেষ্টিত থাকেন, যেমন থাকে শিশুরা। সচেতন না হয়েও সেই আলোতে পথ দেখা সম্ভব। আধ্যাত্মিক সচেতনতার তবে প্রয়োজন কী? আলো যদি অচঞ্চল হয় তবে সচেতনতার প্রয়োজনও ঘটে না, যেমন বায়ু যদি সদা নির্মল থাকে তবে সে বিষয়ে আমাদের মনোযোগী হওয়া অনাবশ্যক। যাঁরা স্বভাবত উচ্চতম আদর্শে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের কাছে ধর্মপ্রচার করা নিষ্প্রয়োজন। অন্যদের কাছে এর প্রয়োজন। আছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। আরো একটা কথা আছে। নীতিবোধ এবং সৌন্দর্যবোধ যেমন এক বস্তু নয় তেমনি নীতিবোধ এবং আধ্যাত্মিক আনন্দের আস্বাদও অভিন্ন নয়। যে নীতিবোধ আধ্যাত্মিক আনন্দের সঙ্গে যুক্ত নয় তাতে সমাজের প্রয়োজন হয়ত মেটে না, কিন্তু মানুষের মুক্তি তাতে সম্পূর্ণ হয় না।
রামমোহনের উপলব্ধির জগতে আধ্যাত্মিকতার যে একটা বিশেষ স্থান ছিল সে কথা সুস্পষ্ট। এই উপলব্ধির আলোতে তিনি যথাসাধ্য তাঁর পরিণত ধ্যানধারণা রচনা। করেছিলেন। রামমোহন সম্বন্ধে তাঁর সহকর্মী উইলিয়ম অ্যাডাম বলেছিলেন, “Love of freedom was perhaps the strongest passion of his soul (রামমোহন সমীক্ষা, পৃঃ ৩৬৫)। যে মুক্তি তিনি নিজের জন্য চেয়েছিলেন সব মানুষের জন্যই আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন সেই গভীরতর সম্পূর্ণতর মুক্তি, আত্মার জ্যোতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি জানিয়ে, যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে নয় বরং তাকে সাবধানে সঙ্গে নিয়ে। এমন জাগ্রত সমাজচেতনার সঙ্গে এমন আধ্যাত্মিক মুমুক্ষার সংযোগ বিরল ঘটনা। এই বিরল সংযোগই কিন্তু ভারতীয় নবজাগরণের কেন্দ্রস্থিত আদর্শ। যদিও নবজাগরণের ধারা। বারবার বিচিত্র পথে এই কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে সরে গেছে তবু যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির আকর্ষণে সেই ধারা কিছু নতুন ভাষা ও উচ্চারণ নিয়ে, সময়ের পলিমাটি বহন করে, আবারও মূল আদর্শের দিকেই ফিরে আসতে চেয়েছে।
গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৬)।