পঞ্চম খণ্ড – নবম অধ্যায় – ঠাকুরের ভক্তসঙ্ঘ ও নরেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের বিশেষ ভক্তসকলের আগমন – ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে
ঠাকুর যোগদৃষ্টিসহায়ে যে সকল ভক্তের দক্ষিণেশ্বরে আসিবার কথা বহু পূর্বে জানিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া আমরা ইতিপূৰ্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি, তাহারা সকলেই ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দ অতীত হইবার পূর্বে তাঁহার নিকটে আগমন করিয়াছিল। কারণ, ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে পূর্ণ তাহার নিকটে আসিয়াছিল এবং তাহাকে কৃপা করিবার পরে তিনি বলিয়াছিলেন, “এখানে আসিবে বলিয়া যাহাদিগকে দেখিয়াছিলাম, পূর্ণের আগমনে সেই শ্রেণীর ভক্তসকলের আসা সম্পূর্ণ হইল; অতঃপর ঐ শ্রেণীর আর কেহ এখানে আসিবে না!”
ঐ সকল ভক্তের সহিত মিলনে ঠাকুরের আচরণ
পূর্বোক্ত শ্রেণীর ভক্তদিগের মধ্যে অনেকেই আবার ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যভাগ হইতে ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দের মধ্যভাগের ভিতরে ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হইয়াছিল। নরেন্দ্র তখন সাংসারিক অভাব অনটনের সহিত সংগ্রামে ব্যস্ত এবং রাখাল কিছুকালের জন্য শ্রীবৃন্দাবন দর্শনে গমন করিয়াছিলেন। ঐ সকল ভক্তদিগের মধ্যে কাহারও আসিবার কথা, ঠাকুর সমীপস্থ ব্যক্তিদিগের নিকটে “আজ (উত্তর দক্ষিণাদি কোন দিক দেখাইয়া) এই দিক হইতে এখানকার একজন আসিতেছে” এইরূপে পূর্বেই নির্দেশ করিতেন। কেহ বা উপস্থিত হইবামাত্র ‘তুমি এখানকার লোক’ বলিয়া পূর্ব-পরিচিতের ন্যায় সাদরে গ্রহণ করিতেন। কোন ভাগ্যবানের সহিত প্রথম সাক্ষাতের পরে তাহাকে পুনরায় দেখিবার, খাওয়াইবার ও তাহার সহিত একান্তে ধৰ্ম্মালাপ করিবার জন্য অধীর হইয়া উঠিতেন। কোন ব্যক্তির স্বভাব সংস্কারাদি লক্ষ্য করিয়া পূৰ্বাগত সমসংস্কারসম্পন্ন কোন ভক্তবিশেষের সহিত তাহাকে পরিচিত করাইয়া তাহার সহিত ধর্মালোচনায় যাহাতে সে অবসরকাল অতিবাহিত করিতে পারে, তদ্বিষয়ের সুযোগ করিয়া দিতেন। আবার কাহারও গৃহে অযাচিতভাবে উপস্থিত হইয়া সদালাপে অভিভাবকদিগের সন্তোষ উৎপাদনপূর্বক যাহাতে তাহারা তাহাকে মধ্যে মধ্যে তাহার নিকটে আসিতে নিষেধ না করেন তদ্বিষয়ে পথ পরিষ্কার করিয়া দিতেন।
অধিকারিভেদে ভক্তসকলকে দিব্যভাবাবিষ্ট ঠাকুরের স্পর্শ, মন্ত্রদান ইত্যাদি ও তাহার ফল
ঐসকল ভক্তের আগমনমাত্র অথবা আসিবার স্বল্পকাল পরে ঠাকুর তাহাদিগের প্রত্যেককে একান্তে আহ্বানপূর্বক ধ্যান করিতে বসাইয়া তাহাদিগের বক্ষ, জিহ্বা প্রভৃতি শরীরের কোন কোন স্থান দিব্যাবেশে স্পর্শ করিতেন। ঐ শক্তিপূর্ণ স্পর্শে তাহাদিগের মন বাহিরের বিষয়সমূহ হইতে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে সংহৃত অন্তর্মুখী হইয়া পড়িত এবং সঞ্চিত ধর্মসংস্কারসকল অন্তরে সহসা সজীব হইয়া উঠিয়া সত্যস্বরূপ ঈশ্বরের দর্শনলাভের জন্য তাহাদিগকে বিশেষভাবে নিযুক্ত করিত। ফলে, উহার প্রভাবে কাহারও দিব্য-জ্যোতিমাত্রের অথবা দেব-দেবীর জ্যোতির্ময় মূর্তিসমূহের দর্শন, কাহারও গভীর ধ্যান ও অভূতপূর্ব আনন্দ, কাহারও হৃদগ্রন্থিসকল সহসা উন্মোচিত হইয়া ঈশ্বরলাভের জন্য প্রবল ব্যাকুলতা, কাহারও ভাবাবেশ ও সবিকল্প সমাধি এবং বিরল কাহারও নির্বিকল্প সমাধির পূর্বাভাস আসিয়া উপস্থিত হইত। তাহার নিকটে আগমন করিয়া ঐরূপে জ্যোতির্ময় মূর্তি প্রভৃতির দর্শন কত লোকের যে উপস্থিত হইয়াছিল তাহার ইয়ত্তা হয় না। তারকের মনে ঐরূপে বিষম ব্যাকুলতা ও ক্রন্দনের উদয় হইয়া অন্তরের গ্রন্থিসকল একদিন সহসা উন্মোচিত হইয়াছিল এবং ছোট নরেন উহার প্রভাবে স্বল্পকালে নিরাকারের ধ্যানে সমাধিস্থ হইয়াছিল, একথা আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি। কিন্তু ঐরূপ স্পর্শে এককালে নির্বিকল্প অবস্থার আভাস প্রাপ্ত হওয়া একমাত্র নরেন্দ্রনাথের জীবনেই হইতে দেখা গিয়াছিল। ভক্তদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তিকে ঠাকুর ঐরূপে স্পর্শ করা ভিন্ন কখন কখন আনবী বা মন্ত্রদীক্ষাও প্রদান করিতেন। ঐ দীক্ষা প্রদানকালে তিনি সাধারণ গুরুগণের ন্যায় শিষ্যের কোষ্ঠি-বিচারাদি নানাবিধ গণনা ও পূজাদিতে প্রবৃত্ত হইতেন না। কিন্তু যোগদৃষ্টি সহায়ে তাহার জন্মজন্মাগত মানসিক সংস্কারসমূহ অবলোকনপূর্বক ‘তোর এই মন্ত্র’ বলিয়া মন্ত্রনির্দেশ করিয়া দিতেন। নিরঞ্জন, তেজচন্দ্র, বৈকুণ্ঠ প্রভৃতি কয়েকজনকে তিনি ঐরূপে কৃপা করিয়াছিলেন, একথা আমরা তাহাদিগের নিকটে শ্রবণ করিয়াছি। শাক্ত বা বৈষ্ণব বংশে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছে বলিয়াই তিনি কাহাকেও সেই মন্ত্রে দীক্ষা প্রদান করিতেন না। কিন্তু অন্তঃসংস্কার নিরীক্ষণ পূৰ্ব্বক শক্ত্যুপাসক কোন কোন ব্যক্তিকে বিষ্ণুমন্ত্রে এবং বৈষ্ণব কাহাকেও বা শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত করিতেন। অতএব বুঝা যাইতেছে, যে ব্যক্তি যেরূপ অধিকারী তাহা লক্ষ্য করিয়াই তিনি তাহার উপযোগী ব্যবস্থা সৰ্ব্বদা প্রদান করিতেন।
ঠাকুরের দিব্যস্পর্শ যাহা প্রমাণ করে
ইচ্ছা ও স্পর্শমাত্ৰে মহাপুরুষগণ অন্তরের আধ্যাত্মিক শক্তি অপরে সংক্রমণপূর্বক তাহার মনের গতি উচ্চপথে পরিচালিত করিয়া দিতে সমর্থ, এই কথা শাস্ত্রগ্রন্থসকলে লিপিবদ্ধ আছে। অন্তরঙ্গ শিষ্যবর্গের ত কথাই নাই–বেশ্যা লম্পটাদি দুষ্কৃতকারীদিগের জীবনও ঐরূপে মহাপুরুষদিগের শক্তিপ্রভাবে পরিবর্তিত হইয়াছে। শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, ঈশা, শ্রীচৈতন্য প্রভৃতি যে-সকল মহাপুরুষগণ ঈশ্বরাবতার বলিয়া সংসারে অদ্যাবধি পূজিত হইতেছেন, তাহাদিগের প্রত্যেকের জীবনেই ঐ শক্তির স্বল্পবিস্তর প্রকাশ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু শাস্ত্রে ঐরূপ থাকিলে কি হইবে, ঐ শ্রেণীর পুরুষদিগের অলৌকিক কাৰ্য কলাপের সাক্ষাৎ পরিচয় বহুকাল পর্যন্ত হারাইয়া সংসার এখন ঐ বিষয়ে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হইয়া উঠিয়াছে। ঈশ্বরাবতারে বিশ্বাস করা ত দূরের কথা, ঈশ্বর-বিশ্বাসও এখন অনেক স্থলে কুসংস্কারপ্রসূত মানসিক দুর্বলতার পরিচায়ক বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে। মানব সাধারণের চিত্ত হইতে ঐ অবিশ্বাস দূর করিয়া তাহাদিগকে আধ্যাত্মিকভাবসম্পন্ন করিতে ঠাকুরের ন্যায় অলৌকিক পুরুষের সংসারে জন্ম পরিগ্রহ করা বর্তমান যুগে একান্ত আবশ্যক হইয়াছিল। পূর্বোক্ত শক্তির প্রকাশ তাহাতে অবলোকন করিয়া আমরা এখন পূৰ্ব্ব পূর্ব যুগের মহাপুরুষদিগের সম্বন্ধেও ঐ বিষয়ে বিশ্বাসবান হইতেছি। ঈশ্বরাবতার বলিয়া ঠাকুরকে বিশ্বাস না করিলেও তিনি যে শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, ঈশা ও চৈতন্যপ্রমুখ মহাপুরুষসকলের সমশ্রেণীভুক্ত লোকোত্তর পুরুষ, এবিষয়ে উহা দেখিয়া কাহারও অস্বীকার করিবার উপায় নাই।
ভক্তসকলের ঠাকুরকে নিজ নিজ ভাবের লোক বলিয়া ধারণা ও ঠাকুরের তাহাদিগের সহিত আচরণ
পূৰ্ব্বপরিদৃষ্ট ভক্তগণের মধ্যে বালক ও বৃদ্ধ, সংসারী ও অসংসারী, সাকার ও নিরাকারোপাসক, শাক্ত, বৈষ্ণব অথবা অন্য ধর্মসম্প্রদায়ভূক্ত প্রভৃতি নানাবিধ অবস্থা ও অশেষ প্রকার ভাবের লোক বিদ্যমান ছিল। ঐরূপ অশেষ প্রভেদ বিদ্যমান থাকিলেও এক বিষয়ে তাহারা সকলে সমভাবসম্পন্ন ছিল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত ও পথে আন্তরিক শ্রদ্ধাসম্পন্ন এবং নিষ্ঠাবান থাকিয়া ঈশ্বরলাভের নিমিত্ত অশেষ ত্যাগ সহিত আচরণ স্বীকারে সর্বদা প্রস্তুত ছিল। ঠাকুর তাহাদিগকে নিজ স্নেহপাশে আবদ্ধ করিয়া তাহাদিগের ভাব রক্ষাপূৰ্ব্বক সামান্য বা গুরুতর সকল বিষয়ে তাহাদিগের সহিত এমন ব্যবহার করিতেন যে, তাহারা প্রত্যেকেই অনুমান করিত তিনি সকল ধর্মমতে পারদর্শী হইলেও সে যে পথে অগ্রসর হইতেছে তাহাতেই অধিকতর প্রীতিসম্পন্ন। ঐরূপ ধারণবশতঃ তাহার উপর তাহাদিগের ভক্তি ও ভালবাসার অবধি থাকিত না। আবার তাহার সঙ্গগুণে এবং শিক্ষাদীক্ষাপ্রভাবে সঙ্কীর্ণতার গণ্ডি সমূহ একে একে অতিক্রমপূৰ্ব্বক উদারভাবসম্পন্ন হইবামাত্র তাহাতেও ঐ ভাবের পূর্ণতা দেখিতে পাইয়া তাহারা প্রত্যেকে বিস্মিত ও মুগ্ধ হইত। দৃষ্টান্তস্বরূপে এখানে সামান্য একটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি—
ভক্তগণের অন্তরে উদারতা বৃদ্ধির সহিত ঠাকুরকে বুঝিতে পারিবার দৃষ্টান্ত – বলরাম বসু
কলিকাতা বাগবাজারনিবাসী শ্ৰীযুক্ত বলরাম বস্তু বৈষ্ণববংশে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন এবং স্বয়ং পরম বৈষ্ণব ছিলেন। সংসারে থাকিলেও ইনি অসংসারী ছিলেন এবং যথেষ্ট ধন-সম্পত্তির অধিকারী হইলেও ইহার হৃদয়ে অভিমান কখনও স্থান পায় নাই। ঠাকুরের নিকটে আসিবার পূর্বে ইনি প্রাতে পূজা-পাঠে চারি-পাঁচ ঘণ্টাকাল অতিবাহিত করিতেন। অহিংসাধর্ম পালনে তিনি এতদূর যত্নবান ছিলেন যে, কীট পতঙ্গাদিকেও কখন কোন কারণে আঘাত করিতেন না। ঠাকুর ইহাকে দেখিয়াই পূর্বপরিচিতের ন্যায় সাদরে গ্রহণপূর্বক বলিয়া ছিলেন, “ইনি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের সাঙ্গোপাঙ্গের অন্যতম– এখানকার লোক; শ্ৰীঅদ্বৈত ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুপাদদিগের সহিত সঙ্কীর্তনে হরিপ্রেমের বন্যা আনিয়া কিরূপে মহাপ্রভু দেশের আবাল-বৃদ্ধ নরনারীকে মাতাইয়া তুলিয়াছিলেন, ভাবাবেশে তাহা দর্শন করিবার কালে ঐ অদ্ভুত সঙ্কীৰ্ত্তনদলের মধ্যে ইহাকে (বলরামকে) দেখিয়াছিলাম”।
ঠাকুরের দর্শনলাভে বলরামের উন্নতি ও আচরণ
ঠাকুরের পুণ্যদর্শনলাভে বলরামের মন নানারূপে পরিবর্তিত হইয়া আধ্যাত্মিক রাজ্যে দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়াছিল। বাহ্যপূজাদি বৈধী ভক্তির সীমা অতিক্রমপূর্বক স্বল্পকালেই তিনি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ও সদসদ্বিচারবান্ হইয়া সংসারে অবস্থান করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। স্ত্রী-পুত্ৰ-ধন-জনাদি সৰ্বস্ব তাহার শ্রীপাদপদ্মে নিবেদন পূৰ্ব্বক দাসের ন্যায় তাহার সংসারে থাকিয়া তাহার আজ্ঞা প্রতিপালন এবং ঠাকুরের পূত সঙ্গে যতদূর সম্ভব কাল অতিবাহিত করাই ক্রমে বলরামের জীবনোদ্দেশ্য হইয়া উঠিয়াছিল। ঠাকুরের কৃপায় স্বয়ং শান্তির অধিকারী হইয়াই বলরাম নিশ্চিত থাকিতে পারেন নাই। নিজ আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধব প্রভৃতি সকলেই যাহাতে ঠাকুরের নিকট আগমন করিয়া যথার্থ সুখের আস্বাদনে পরিতৃপ্ত হয়, তদ্বিষয়ে অবসর অন্বেষণপুৰ্ব্বক তিনি সর্বদা সুযোগ উপস্থিত করিয়া দিয়াছিলেন। ঐরূপে বলরামের আগ্রহে বহু ব্যক্তি ঠাকুরের শ্রীচরণাশ্রয়লাভে ধন্য হইয়াছিল।
বলরামের অহিংসা-ধর্ম সম্বন্ধীয় মতের পরিবর্তনে সংশয়
বাহ্যপূজার ন্যায় অহিংসাধর্মপালন সম্বন্ধীয় মতও বলরামের কিছুকাল পরে পরিবর্তিত হইয়াছিল। ইতিপূর্বে অন্য সময়ের কথা দূরে থাকুক, উপাসনাকালেও মশকাদি দ্বারা চিত্ত বিক্ষিপ্ত হইলে তিনি তাহাদিগকে আঘাত করিতে পারিতেন না; মনে হইত, উহাতে সমূহ ধৰ্ম্মহানি উপস্থিত হইবে। এখন ঐরূপ সময়ে সহসা একদিন তাহার মনে উদয় হইল,-সহস্রভাবে বিক্ষিপ্ত চিত্তকে শ্রীভগবানে সমাহিত করাই ধৰ্ম্ম, অহিংসা ধৰ্ম্ম। মশকাদি কীটপতঙ্গের জীবনরক্ষায় উহাকে সতত নিযুক্ত রাখা নহে; অতএব দুই-চারিটা মশক নাশ করিয়া কিছুক্ষণের জন্যও যদি তাহাতে চিত্ত স্থির করিতে পারা যায় তাহাতে অধৰ্ম্ম হওয়া দুরে থাকুক সমধিক লাভই আছে। তিনি বলিতেন, “অহিংসাধৰ্ম প্ৰতিপালনে মনের এত কালের আগ্রহ ঐরূপ ভাবনায় প্রতিহত হইলেও চিত্ত ঐবিষয়ে সম্পূর্ণরূপে সন্দেহ নির্মুক্ত হইল না। সুতরাং ঠাকুরকে ঐ বিষয় জিজ্ঞাসা করিতে দক্ষিণেশ্বরে চলিলাম। যাইবার কালে ভাবিতে লাগিলাম, অন্য সকলের ন্যায় তাহাকে কোন দিন মশকাদি মারিতে দেখিয়াছি কি? মনে হইল না; স্মৃতির আলোকে যতদুর দেখিতে পাইলাম তাহাতে আমাপেক্ষাও তাহাকে অহিংসাব্রতপরায়ণ বলিয়া বোধ হইল। মনে পড়িল, দুৰ্ব্বাদলশ্যামল ক্ষেত্রের উপর দিয়া অপরকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া নিজবক্ষে আঘাত অনুভবপুর্বক তিনি যন্ত্রণায় এক সময়ে অধীর হইয়াছিলেন—তৃণরাজিমধ্যগত জীবনীশক্তি ও চৈতন্য এত সুস্পষ্ট এবং পবিত্র ভাবে তাহার নয়নে প্রতিভাসিত হইয়াছিল! স্থির করিলাম তাহাকে জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন নাই, আমার মনই আমাকে প্রতারণা করিতে পূর্বোক্ত চিন্তার উদয় করিয়াছে। যাহা হউক তাঁহাকে দর্শন করিয়া আসি, মন পবিত্র হইবে”।
ঠাকুরের অদৃষ্টপূর্ব আচরণ লক্ষ্য করিয়া তাঁহার সন্দেহভঞ্জন
“দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছিয়া ঠাকুরের গৃহদ্বারে উপস্থিত হইলাম। কিন্তু তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইবার পূর্বে দূর হইতে তাঁহাকে যাহা করিতে দেখিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইলাম। দেখিলাম, তিনি নিজ উপাধান হইতে ছারপোকা বাছিয়া তাহাদিগকে বিনাশ করিতেছেন! নিকটে উপস্থিত করিয়া তাহার হইয়া প্রণাম করাতেই তিনি বলিলেন, ‘বালিশটাতে বড় ছারপোকা হইয়াছে, দিবারাত্রি দংশন করিয়া চিত্তবিক্ষেপ এবং নিদ্রার ব্যাঘাত করে, সেজন্য মারিয়া ফেলিতেছি’। জিজ্ঞাসা করিবার আর কিছুই রহিল না, ঠাকুরের কথায় এবং কাৰ্য্যে মন নিঃসংশয় হইল। কিন্তু স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, গত দুই-তিন বৎসরকাল ইহার নিকটে যখন তখন আসিয়াছি, দিনে আসিয়াছি রাত্রে ফিরিয়াছি, সন্ধ্যায় আসিয়া রাত্রি প্রায় দ্বিতীয় প্রহরে বিদায় গ্রহণ করিয়াছি। প্রতি সপ্তাহে তিন-চারি দিন ঐরূপে আসা যাওয়া করিয়াছি, কিন্তু একদিনও ইহাকে এইরূপ কর্মে প্রবৃত্ত দেখি নাই—ঐরূপ কেমন করিয়া হইল? তখন নিজ অন্তরেই ঐ বিষয়ের মীমাংসার উদয় হইয়া বুঝিলাম, ইতিপূর্বে ইহাকে ঐরূপ করিতে দেখিলে আমার ভাব নষ্ট হইয়া ইহার উপরে অশ্রদ্ধার উদয় হইত—পরম কারুণিক ঠাকুর সে জন্য এই প্রকারের অনুষ্ঠান আমার সমক্ষে পূর্বে কখনও করেন নাই”।
ঠাকুরের ভক্তসঙ্ঘ ও বালক ভক্তগণ
পূর্বপরিদৃষ্ট ভক্তগণ ভিন্ন অন্য অনেক নরনারী এইকালে ঠাকুরকে দর্শনপূর্বক শান্তি লাভের জন্য দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। ইহাদিগকেও তিনি সস্নেহে গ্রহণপূর্বক কাহাকেও উপদেশ দানে, আবার কাহাকেও বা দিব্যাবেশে স্পর্শ করিয়া কৃতার্থ করিয়াছিলেন। ঐরূপে যত দিন যাইতেছিল ততই তাঁহাকে আশ্রয় করিয়া এক বৃহৎ ভক্তসঙ্ঘ স্বতঃ গঠিত হইতেছিল। তন্মধ্যে বালক ও অবিবাহিত যুবকদিগের ধর্মজীবনগঠনে তিনি অধিকতর লক্ষ্য রাখিতেন। ঐ বিষয়ের কারণ নির্দেশপূর্বক তিনি বহুবার বলিয়াছেন, “ষোলআনা মন না দিলে ঈশ্বরের পূর্ণদর্শন কখনও লাভ হয় না। বালকদিগের সম্পূর্ণ মন তাহাদের নিকটে আছে-স্ত্রী পুত্র, ধন সম্পত্তি, মান যশ প্রভৃতি পার্থিব বিষয়সকলে ছড়াইয়া পড়ে নাই; এখন হইতে চেষ্টা করিলে ইহারা ষোলআনা মন ঈশ্বরে অর্পণপূর্বক তাহার দর্শনলাভে কৃতার্থ হইতে পারিবে—ঐজন্যই ইহাদিগকে ধর্ষপথে পরিচালিত করিতে আমার অধিক আগ্রহ”। সুযোগ দেখিলেই ঠাকুর ইহাদিগের প্রত্যেককে একান্তে লইয়া যাইয়া যোগধ্যানাদি ধর্মের উচ্চাঙ্গসকলের এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হইয়া অখণ্ড ব্রহ্মচর্য্য পালনে উপদেশ করিতেন। অধিকারী নির্বাচন করিয়া ইহাদিগকেও তিনি ভিন্ন ভিন্ন উপাস্য নির্দেশ করিয়া দিতেন এবং শান্তদাস্যাদি যে ভাবের সম্বন্ধ ইষ্টদেবতার সহিত পাতাইলে তাহারা প্রত্যেকে উন্নতিপথে সহজে অগ্রসর হইতে পারিবে তদ্বিষয়ে উপদেশ প্রদান করিতেন।
গৃহী ভক্তদিগকে ও নরনারী সাধারণকে ঠাকুর যেভাবে উপদেশ দিতেন
বালকদিগকে শিক্ষাপ্রদানে ঠাকুরের সমধিক আগ্রহের কথা শুনিয়া কেহ যেন না ভাবিয়া বসেন, সংসারী গৃহস্থ ভক্তদিগের প্রতি তাহার কৃপা ও করুণা স্বল্প ছিল। উচ্চাঙ্গের ধর্মতত্ত্বসকলের অভ্যাস ও অনুশীলনে তাহাদিগের অনেকের সময় ও সামর্থ্য নাই দেখিয়াই তিনি তাহাদিগকে ঐরূপ করিতে বলিতেন না। কিন্তু কাম-কাঞ্চন-ভোগবাসনা ধীরে ধীরে কমাইয়া ভক্তি মার্গ দিয়া যাহাতে তাহারা কালে ঈশ্বরলাভে ধন্য হইতে পারে, এইরূপে তাহাদিগকে নিত্য পরিচালিত করিতেন। ধনী ব্যক্তির গৃহে দাসদাসীদিগের ন্যায় মমতা বর্জনপূর্বক ঈশ্বরের সংসারে অবস্থান ও নিজ নিজ কর্তব্য পালন করিতে তিনি তাহাদিগকে সর্বাগ্রে উপদেশ করিতেন। “দুই-একটি সন্তান জন্মিবার পরে ঈশ্বরে চিত্ত অৰ্পণ করিয়া ভ্রাতা-ভগ্নীর ন্যায় স্ত্রী-পুরুষের সংসারে থাকা কর্তব্য”—ইত্যাদি বলিয়া যথাসাধ্য ব্রহ্মচর্য্য রক্ষা করিতে তাহাদিগকে উৎসাহিত করিতেন। তদ্ভিন্ন নিত্য সত্যপথে থাকিয়া সকলের সহিত সরল ব্যবহার করিতে, বিলাসিতা বর্জনপূর্বক ‘মোটা ভাত মোটা কাপড়’ মাত্র লাভে সন্তুষ্ট থাকিয়া শ্রীভগবানের দিকে সর্বদা দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিতে এবং প্রত্যহ দুই সন্ধ্যা ঈশ্বরের স্মরণ-মনন, পূজা, জপ ও সঙ্কীৰ্ত্তনাদি করিতে তাহাদিগকে নিযুক্ত করিতেন। গৃহস্থদিগের মধ্যে যাহারা ঐসকল করিতেও অসমর্থ বুঝিতেন, তাহাদিগকে সন্ধ্যাকালে একান্তে বসিয়া হাততালি দিয়া হরিনাম করিতে এবং আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদিগের সহিত মিলিত হইয়া নাম-সঙ্কীৰ্ত্তনের উপদেশ করিতেন। সাধারণ নরনারীগণকে একত্রে উপদেশকালে আমরা তাহাকে অনেক সময়ে ঐকথা এইরূপে বলিতে শুনিয়াছি, কলিতে কেবলমাত্র নারদীয়-ভক্তি–উচ্চরোলে নামকীৰ্ত্তন করিলেই জীব উদ্ধার হইবে; কলির জীব অন্নগতপ্রাণ, অল্পায়ু, স্বল্পশক্তি—সেইজন্যই ধৰ্মলাভের এত সহজ পথ তাহাদিগের নিমিত্ত নির্দিষ্ট হইয়াছে। আবার যোগধ্যানাদি কঠোর সাধনমার্গের কথাসকল শুনিয়া পাছে তাহারা ভগ্নোৎসাহ হয়, এজন্য কখন কখন বলিতেন, “যে সন্ন্যাসী হইয়াছে সে ত ভগবানকে ডাকিবেই। কারণ, ঐ জন্যই ত সে সংসারের সকল কর্তব্য ছাড়িয়া আসিয়াছে– তাহার ঐরূপ করায় বাহাদুরী বা অসাধারণত্ব কি আছে? কিন্তু যে সংসারে পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্রাদির প্রতি কর্তব্যের বিষম ভার ঘাড়ে করিয়া চলিতে চলিতে একবারও তাহাকে স্মরণ-মনন করে, ঈশ্বর তাহার প্রতি বিশেষ প্রসন্ন হন, ভাবেন, ‘এত বড় বোঝ স্কন্ধে থাকা সত্বে এই ব্যক্তি যে আমাকে এতটুকুও ডাকিতে পারিয়াছে, ইহা স্বল্প বাহাদুরী নহে, এই ব্যক্তি বীরভক্ত’”।
নরেন্দ্রকে ঠাকুরের সকল ভক্তাপেক্ষা উচ্চাসন প্রদান
নবাগত শ্রেণীভুক্ত নরনারীদের ত কথাই নাই, পূৰ্বপরিদৃষ্ট ভক্তগণের ভিতরেও ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে কত উচ্চাসন প্রদান করিতেন তাহা বলা যায় না। উহাদিগের মধ্যে কয়েকজনকে নির্দেশ করিয়া তিনি বলিতেন, ইহারা ঈশ্বরকোটী, অথবা শ্রীভগবানের কাৰ্যবিশেষ সাধন করিবার নিমিত্ত সংসারে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছে। ঐ কয়েক ব্যক্তির সহিত নরেন্দ্রের তুলনা করিয়া তিনি এক দিবস আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, “নরেন্দ্র যেন সহস্রদল কমল; এই কয়েক জনকে ঐ জাতীয় পুষ্প বলা যাইলেও, ইহাদিগের কেহ দশ, কেহ পনর, কেহ বা বড় জোর বিশদলবিশিষ্ট”। অন্য এক সময়ে বলিয়াছিলেন, “এত সব লোক এখানে আসিল, নরেন্দ্রের মত একজনও কিন্তু আর আসিল না।” দেখাও যাইত, ঠাকুরের অদ্ভুত জীবনের অলৌকিক কার্যাবলীর এবং প্রত্যেক কথার যথাযথ মর্ম গ্রহণ ও প্রকাশ করিতে তিনি যতদূর সমর্থ ছিলেন, অন্য কেহই তদ্রূপ ছিল না। এই কাল হইতেই নরেন্দ্রের নিকটে ঠাকুরের কথাসকল শুনিয়া আমরা সকলে সময়ে সময়ে স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতাম, তাই ত ঐ সকল কথা আমরাও ঠাকুরের নিকটে শুনিয়াছি, কিন্তু উহাদিগের ভিতরে যে এত গভীর অর্থ রহিয়াছে তাহা ত বুঝিতে পারি নাই! দৃষ্টান্তস্বরূপে ঐরূপ একটি কথার এখানে উল্লেখ করিতেছি—
ঠাকুরকে নরেন্দ্রের সর্বাপেক্ষা অধিক বুঝিতে পারিবার দৃষ্টান্ত – ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা‘
১৮৮৪ খৃষ্টাব্দের কোন সময়ে আমাদিগের জনৈক বন্ধু দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন ঠাকুর গৃহমধ্যে ভক্তগণপরিবৃত হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। শ্ৰীযুত নরেন্দ্রও সেখানে উপস্থিত। নানা সদালাপ এবং মাঝে মাঝে নির্দোষ রঙ্গরসের কথাবার্তাও চলিয়াছে। কথাপ্রসঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মের কথা উঠিল এবং ঐ মতের সারমর্ম সমবেত সকলকে সংক্ষেপে বুঝাইয়া তিনি বলিলেন, “তিনটি বিষয় পালন করিতে নিরন্তর যত্নবান্ থাকিতে ঐ মতে উপদেশ করে–নামে রুচি, জীবে দয়া, বৈষ্ণব-পূজন। যেই নাম সেই ঈশ্বর–নাম-নামী অভেদ জানিয়া সর্বদা অনুরাগের সহিত নাম করিবে; ভক্ত ও ভগবান, কৃষ্ণ ও বৈষ্ণব অভেদ জানিয়া সর্বদা সাধু-ভক্তদিগকে শ্রদ্ধা, পূজা ও বন্দনা করিবে; এবং কৃষ্ণেরই জগৎ-সংসার একথা হৃদয়ে ধারণা করিয়া সৰ্বজীবে দয়া” (প্রকাশ করিবে)। ‘সৰ্ব্ব জীবে দয়া’ পর্যন্ত বলিয়াই তিনি সহসা সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন! কতক্ষণ পরে অর্ধবাহ্যদশায় উপস্থিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, “জীবে দয়া–জীবে দয়া? দুর শালা! কীটানুকীট তুই জীবকে দয়া করবি? দয়া করবার তুই কে? না, না, জীবে দয়া নয়—শিবজ্ঞানে জীবের সেবা!”
ঠাকুরের ঐ কথায় নরেন্দ্রের অদ্ভুত আলোক দর্শন ও তাহা বুঝাইয়া বলা
ভাবাবিষ্ট ঠাকুরের ঐকথা সকলে শুনিয়া যাইল বটে, কিন্তু উহার গূঢ় মৰ্ম কেহই তখন বুঝিতে ও ধারণা করিতে পারিল না। একমাত্র নরেন্দ্রনাথই সেদিন ঠাকুরের ভাবভঙ্গের পরে বাহিরে আসিয়া বলিলেন, “কি অদ্ভুত আলোকই আজ ঠাকুরের কথায় দেখিতে পাইলাম! শুষ্ক, কঠোর ও নির্মম বলিয়া প্রসিদ্ধ বেদান্তজ্ঞানকে ভক্তির সহিত সম্মিলিত করিয়া কি সহজ, সরস ও মধুর আলোকই প্রদর্শন করিলেন! অদ্বৈতজ্ঞান লাভ করিতে হইলে সংসার ও লোকসঙ্গ সর্বতোভাবে বর্জন করিয়া বনে যাইতে হইবে এবং ভক্তি ভালবাসা প্রভৃতি কোমল ভাবসমূহকে হৃদয় হইতে সবলে উৎপাটিত করিয়া চিরকালের মত দূরে নিক্ষেপ করিতে হইবে—এই কথাই এতকাল শুনিয়া আসিয়াছি। ফলে ঐরূপে উহা লাভ করিতে যাইয়া জগৎ-সংসার ও তন্মধ্যগত প্রত্যেক ব্যক্তিকে ধর্মপথের অন্তরায় জানিয়া তাহাদিগের উপরে ঘৃণার উদয় হইয়া সাধকের বিপথে যাইবার বিশেষ সম্ভাবনা। কিন্তু ঠাকুর আজ ভাবাবেশে যাহা বলিলেন, তাহাতে বুঝা গেল-বনের বেদান্তকে ঘরে আনা যায়, সংসারের সকল কাজে উহাকে অবলম্বন করিতে পারা যায়। মানব যাহা করিতেছে, সে সকলই করুক তাহাতে ক্ষতি নাই, কেবল প্রাণের সহিত এই কথা সর্বাগ্রে বিশ্বাস ও ধারণা করিলেই হইল—ঈশ্বরই জীব ও জগৎরূপে তাহার সম্মুখে প্রকাশিত রহিয়াছেন। জীবনের প্রতি মুহূর্তে সে যাহাদিগের সম্পর্কে আসিতেছে, যাহাদিগকে ভালবাসিতেছে, যাহাদিগকে শ্রদ্ধা, সম্মান অথবা দয়া করিতেছে, তাহারা সকলেই তাঁহার অংশ– তিনি। সংসারের সকল ব্যক্তিকে যদি সে ঐরূপে শিবজ্ঞান করিতে পারে, তাহা হইলে আপনাকে বড় ভাবিয়া তাহাদিগের প্রতি রাগ, দ্বেষ, দম্ভ অথবা দয়া করিবার তাহার অবসর কোথায়? ঐরূপে শিবজ্ঞানে জীবের সেবা করিতে করিতে চিত্ত শুদ্ধ হইয়া সে স্বল্প কালের মধ্যে আপনাকেও চিদানন্দময় ঈশ্বরের অংশ, শুদ্ধবুদ্ধমুক্ত স্বভাব বলিয়া ধারণা করিতে পারিবে।
“ঠাকুরের ঐ কথায় ভক্তিপথেও বিশেষ আলোক দেখিতে পাওয়া যায়। সর্বভূতে ঈশ্বরকে যতদিন না দেখিতে পাওয়া যায়, ততদিন যথার্থ ভক্তি বা পরাভক্তি-লাভ সাধকের পক্ষে সুদূরপরাহত থাকে। শিব বা নারায়ণ জ্ঞানে জীবের সেবা করিলে ঈশ্বরকে সকলের ভিতর দর্শনপূর্বক যথার্থ ভক্তিলাভে ভক্তসাধক স্বল্পকালেই কৃতকৃতার্থ হইবে, একথা বলা বাহুল্য। কৰ্ম্ম বা রাজযোগ অবলম্বনে যে-সকল সাধক অগ্রসর হইতেছে তাহারাও ঐ কথায় বিশেষ আলোক পাইবে। কারণ, কর্ম না করিয়া দেহী যখন একদণ্ডও থাকিতে পারে না, তখন শিবজ্ঞানে জীবসেবা রূপ কৰ্ম্মানুষ্ঠানই যে কর্তব্য এবং উহা করিলেই তাহার লক্ষ্যে আশু পৌঁছাইবে, একথা বলিতে হইবে না। যাহা হউক ভগবান্ যদি কখন দিন দেন ত আজি যাহা শুনিলাম এই অদ্ভুত সত্য সংসারে সর্বত্র প্রচার করিব–পণ্ডিত মূর্খ, ধনী দরিদ্র, ব্রাহ্মণ চণ্ডাল, সকলকে শুনাইয়া মোহিত করিব।”
লোকোত্তর ঠাকুর ঐরূপে সমাধিরাজ্যে নিরন্তর প্রবিষ্ট হইয়া জ্ঞান, প্রেম, যোগ ও কর্ম সম্বন্ধে অদৃষ্টপূর্ব আলোক প্রতিনিয়ত আনয়নপূর্বক মানবের জীবনপথ সমুজ্জ্বল করিতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা তাহার কথা তখন ধারণা করিতে পারিতাম না। মনস্বী নরেন্দ্রনাথই কেবল ঐসকল দেববাণী যথাসাধ্য হৃদয়ঙ্গম করিয়া সময়ে সময়ে প্রকাশপূর্বক আমাদিগকে স্তম্ভিত করিতেন।