আনন্দের সন্ধানে রাসেল
সংশয় থেকে যাত্রা করে সত্য জ্ঞানে পৌঁছানো যায় কিনা, এই ছিল ফরাসী দার্শনিক দেকার্তের সমস্যা। আর অবিশ্বাস থেকে শুরু করে আনন্দে পৌঁছবার পথ খুঁজেছেন সারাজীবন, এ যুগের মহান চিন্তাবিদ রাসেল।
রাসেলের এই দীর্ঘ অন্বেষণের মূলে শুধু দার্শনিক কৌতূহল নয়, বরং তাঁর জীবনের একটি অতি ঘনিষ্ঠ সমস্যা জড়িত ছিল। শৈশব থেকে তিনি ছিলেন অসুখী। যৌবনে বহুবার আত্মহত্যার চিন্তা তাঁর মনে উঁকি দিয়েছে। এমন কি তিনি যখন বিবাহিত, সন্তানের পিতা, এবং ব্যক্তিগত জীবনে বাহ্যত সুখী, তখনও তাঁর মনের গভীরে একটা বিপুল নৈর্ব্যক্তিক নৈরাশ্য অনড় বোঝার মতো চেপে বসে ছিল। তাঁর বয়স যখন প্রায় ষাট তখন তিনি লিখেছেন “I have derived from my children at least as much instinctive satisfaction as I anticipated…But while my personal life has been satisfying my impersonal outlook has become increasingly sombre. My activities continue from force of habit, and in the company of others I forget the despair which underlines my daily pursuits and pleasures. But when I am alone and idle, I cannot conceal for myself that my life had no purpose. … I find myself involved in a vast mist of solitude.” (June 11, 1931). ১৯৩১ সালে তাঁর অসুখের অন্যতম কারণ ছিল পৃথিবী সম্বন্ধে, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে, হতাশা। কিন্তু এর অতিরিক্ত, আরও গভীর, কিছু কি ছিল না।
প্রথম যৌবনের সংশয় ও বেদনা থেকে রাসেল আত্মরক্ষা করেছিলেন গণিত শাস্ত্রকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু ১৯১৪-১৮ সালের মহাযুদ্ধ আবারও তাঁর মনে একটা প্রচণ্ড তোলপাড় সৃষ্টি করল। সমাজ ও সভ্যতার সমস্যা তাঁকে অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলল।
বিপর্যয়ের শুরুতেই মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ভয়ানকভাবে পালটে গেল। তিনি লিখেছেন, “I had supposed that most people liked money better than anything else, but I discovered that they liked destruction even better” অর্থাৎ অধিকাংশ ইংরেজ যুক্তিবাদীর মতো রাসেলও পূর্বে বিশ্বাস করতেন যে, সাধারণ মানুষ সবচেয়ে ভালোবাসে টাকা অথবা সাংসারিক স্বাচ্ছন্দ্য; কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে তিনি। আবিষ্কার করলেন যে, টাকার চেয়েও মানুষকে বেশী টানে বিশুদ্ধ ধ্বংসের উন্মাদনা। কেন এমন হয়, কি করে মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, এটাই হয়ে উঠল। রাসেলের প্রধান চিন্তা।
গভীর চিন্তার পর রাসেল কয়েকটি সরল প্রত্যয়ে এসে পৌঁছলেন। তিনি লিখলেন “I becamc for the first time deeply convinced that Puritanism docs not make for human happiness. Through the spectacle of death I acquired a new love for what is living. I became convinced that most human beings are possessed by a profound unhappiness venting itself in destructive rages, and that only through a diffusion of instinctive joy can a good world be brought into being.” TOYOT এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, প্রবৃত্তিকে পীড়ন করে মানুষকে সমাজে বাঁচতে হয়। প্রবৃত্তির এই পীড়নের ফলে মানুষ অসুখী; আর এই অসুখই মানুষকে হন্যে করে তোলে, অপরকে পীড়নের ভিতর মানুষ সুখ খোঁজে। এই সময় তিনি rinciples of Social Reconstruction নামে একটি বই লেখেন। মানুষের মনের ঝোঁকগুলিকে এখানে সৃজনধর্মী (creative) ও সংরক্ষণধর্মী (possessive) এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মানুষ যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভালোবাসে, শিল্পে নিজেকে প্রকাশ করে, অথবা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে জ্ঞানের অন্বেষণ করে, তখন তার ভিতর সৃজনধর্মিতার প্রাধান্য। আবার মানুষ যখন স্বধন রক্ষায় চিন্তিত কিংবা নিজের অথবা অপরের নিগ্রহে নিযুক্ত, তখন তাঁর মন সংরক্ষণধর্মী। সেই সমাজই ভালো যেখানে মানুষের মন স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করবার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত নয়, যেখানে জ্ঞান মুক্ত, আর প্রেম মানুষে-মানুষে নির্ভয় বন্ধনের সেতু।
মানুষের প্রকৃতির উপর যখনই জোর করে কিছু চাপিয়ে দেবার চেষ্টা হয় তখনই দেখা দেয় তার বিকৃতির সম্ভাবনা। অতএব প্রবৃত্তির উপর জোরজবরদস্তি যতটা কম করা যায়। ততই ভালো। কথাটা আরও একটু তলিয়ে দেখা দরকার। রাসেল জন স্টুয়ার্ট মিলের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন। মিল কিন্তু জানতেন যে একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত হতে গেলে বন্য থেকে যাবার ভয় আছে। মিল বুঝেছিলেন যে, অনুশীলনের ভিতর দিয়েই চরিত্র গঠন হয়; অতএব তিনি লিখেছিলেন “Nearly every respectable attribute of humanity is result, not of instinct, but of victory over instinct.” এ সব কথা নিশ্চয়ই রাসেলের অজামা ছিল না। কিন্তু সত্যের এপিঠ ওপিঠ আছে। রাসেল সত্যের ওপিঠটা জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন বোধ করেছিলেন।
তিনি একথা বলা প্রয়োজন মনে করলেন যে, প্রচলিত সমাজ ও সংস্কার মানুষকে। আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে বেঁধেছে, যেটা মানুষের সুখ অথবা সমাজের ভবিষ্যৎ কোনো দিক থেকেই বাঞ্ছনীয় নয়। এইসব অশুভ বন্ধনের ভিতর কিছু হল বাহ্য, আবার কিছু গুহ্য। প্রথম শ্রেণীতে পড়ে যান্ত্রিকতার অত্যাচার, আর দ্বিতীয় শ্রেণীতে অতীন্দ্রিয় শংকা, রাসেল যাকে বলেছেন ‘metaphysical fears”। এইসব বাধানিষেধ থেকে রাসেল মানুষকে। মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
আধুনিক সমাজে যান্ত্রিকতার আধিপত্য। মানুষকে এখানে বাঁধা হয়েছে যন্ত্রের তালের সঙ্গে। রাসেল মনে প্রাণে বৈজ্ঞানিক। অথচ যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি এমন বাক্যও উচ্চারণ যা গান্ধীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আধুনিক যান্ত্রিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজের একটা চিরকালের ঝোঁক ক্ষমতার কোনো কেন্দ্রে সংহত হবার প্রবণতা। এই অতিকেন্দ্রিকতার বিপদ রাসেলকে ভাবিয়ে তুলেছিল। Power: A New Social Analysis নামক গ্রন্থে রাসেল বিষয়টি বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। এই বইটি সম্বন্ধে রাসেল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন “এই পুস্তকের বক্তব্য আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়; আমি আশা করেছিলাম যে, বইটি আরও বেশী লোকে পড়বে।” এই পুস্তকের মূল কথাটি রাসেলের OTAKOS 969 faros “I argued that power, rather than wealth, should be the basic concept of social theory, and that social justice should consist in qualization of power to the greatest practicable degree. ধনতান্ত্রিক সমাজে ধন অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে; সাম্যবাদী সমাজে রাজনীতিক ক্ষমতা, অর্থাৎ রাষ্ট্রের শক্তি, একটি দল অথবা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে সংহত হয়েছে। দুই-ই ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রকারভেদ। দুই-ই অসাম্যের কারণ। ক্ষমতার এই অতিকেন্দ্রিকতার ফলে। স্বাধীনতার সংকট ও নানারকম নিষ্ঠুরতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
রাজনীতিক মহলে বিভিন্ন দল বিভিন্ন সময়ে রাসেলের প্রতি প্রসন্ন অথবা ক্রুদ্ধ হয়েছে। এর কারণ বোঝা কঠিন নয়। রাসেলের যা মনে হয়েছে, জনপ্রিয়তার কথা। বিবেচনা না করেই তিনি তা অকপটে বলেছেন। তাঁর হো চি-মিনকে ভালো লেগেছে; লেনিনকে ভালো লাগেনি। রুশবিপ্লব সম্বন্ধে তাঁর সমালোচনা সুস্পষ্ট; আবার ভিয়েতনামের যুদ্ধের ব্যাপারে বিরোধিতাও অক্লান্ত। তাঁকে সাম্যবাদী বলা যেতে পারে; কিন্তু অত্যন্ত বিশেষ অর্থেই তিনি সাম্যবাদী ছিলেন। ঐ নামে যেসব ব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রচলিত আছে তার কোনোটিকেই তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে পারেননি। আবার মার্কিন সমাজের প্রতিও তিনি ছিলেন অতিশয় বিরক্ত। কিন্তু রাসেলের মূল চিন্তার পক্ষে এসব কথা গৌণ। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি নিজেই লিখেছেন “I have imagined myself in turn a liberal, a socialist, or a pacifist, but I have never been any of these things.” আসলে তাঁর মতের গায়ে কোনো রাজনীতিক তকমা চাপাবার চেষ্টা করাই। ভুল। তিনি কি ভেবেছিলেন সেটাই প্রধান কথা। মূলত রাসেল চেয়েছিলেন মানুষ যেন নির্ভয়ে জ্ঞানের অন্বেষণ করতে পারে আর আনন্দের ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
তাঁর মতে মানুষের মুক্তির পথে অন্যতম প্রধান বাধা হ’ল অন্ধ সংস্কারের ওপর। প্রতিষ্ঠিত ধর্মত। খৃষ্টধর্মে যে “আদি পাপ”-এর তত্ত্ব আছে, রাসেল তার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে আদি পাপের ধারণা মানুষের মনের প্রাচীন হিংস্রতাকে একটা সম্ভ্রান্ত কুসংস্কারের সাহায্যে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। এ যুগের কোনো কোনো। আন্দোলনে আবার ভগবানের বিধানের পরিবর্তে কল্পনা করা হয়েছে ইতিহাসের বিধান এবং তারই নামে নিষ্ঠুরতার এক নতুন অধ্যায় অনেকের কাছে শ্রদ্ধেয় হয়েছে।
শিক্ষানীতিতেও রাসেল একটা অহেতুক কঠোরতার প্রাধান্য লক্ষ করেছিলেন। তা ছাড়া নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাপবোধ প্রেমের আনন্দকে তিক্ত করে তুলেছে। এসব বিষয়ে রাসেলের ধারণা ছিল প্রচলিত ধারণা থেকে একেবারেই পৃথক।
শিক্ষা সম্বন্ধে আলোচনায় রাসেল লিখেছেন “It is reverence towards others that is lacking in those who advocate machine-made cast-iron systems” ব্যক্তিত্বের প্রতি যাঁদের শ্রদ্ধা নেই তাঁরাই ছাঁচে-ঢালা মানুষ তৈরী করতে চান। খানিকটা বাধ্যবাধকতা ও নিয়মকানুন ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হতে পারে না, একথা রাসেল জানতেন। কিন্তু একথাটার ওপর তিনি জোর দিতে চাননি। Principles of Social Reconstruction নামে বইটিতে পাই তাঁর অনবদ্য গদ্যের আরও একটি উদাহরণ “The man who has reverence will not think it his duty to “mould” the young. He feels in all that lives, and most of all in children, something sacred, indefinable, unlimited, something individual and strangely precious, the growing principle of life, an embodied fragment of the dumb striving of the world.” মানুষের, বিশেষত শিশুর, বিকাশোন্মুখ মনের প্রতি শ্রদ্ধাকে রাসেল শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন।
মার্কিন দেশে যৌনচিন্তার প্রচণ্ডতায় রাসেল বিরক্ত বোধ করেছিলেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও তজ্জনিত প্রবৃত্তির অবদমনকেই তিনি এর জন্য দায়ী মনে করেন। পাশ্চাত্ত্য জগতে এই গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং সেই প্রতিক্রিয়ার প্রথম যুগে আতিশয্য অবশ্যম্ভাবী, একথাও রাসেল বলে যান। তবু নৈতিক গোঁড়ামি থেকে যৌনচিন্তাকে মুক্ত করা প্রয়োজন বলে তাঁর মনে হয়। এ বিষয়ে রাসেলের মতামত এক সময়ে শুধু বিতর্কই নয়, প্রচণ্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। বিবাহিত জীবনের বাইরে পারস্পরিক সম্মতি সহ যৌন সম্পর্ক স্থাপন রাসেল সব সময় গুরুতর অপরাধ মনে। করতেন না। কিন্তু যৌনচিন্তা আমাদের মনকে অধিকার করে থাকবে এটাও তিনি কখনও চাননি, কারণ যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রাধান্য মনের একটা বন্ধনবিশেষ। Marriage and Morals পুস্তকে তিনি একদিকে যেমন লিখেছেন, “Joy of life depends upon a certain spontaneity in regard to sex.” অন্যদিকে তেমনই দুর্থহীন ভাষায় যোগ করেছেন “I wish to repeat, as emphatically as I can, that I regard an undue preoccupation with this as an evil. রাসেলের সিদ্ধান্ত স্থিল এই যে, শুধু নিষেধের চদ্বারা নয় বরং যৌন আকাঙ্ক্ষার পাশে লোকহিতচিন্তা ও জ্ঞানচর্চার মতো সদর্থক প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করেই জীবনে সাম্য আনা সম্ভব।
রাসেল শুধু প্রচলিত আচারবিচারের বিরোধী একজন সমাজ সংস্কারকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন দার্শনিক। সমাজের বহিরঙ্গে কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে, মানুষ সম্বন্ধে এমন অগভীর ধারণা রাসেলের নিশ্চয়ই ছিল না। তাঁর ব্যক্তিগত হতাশা ও বেদনার ভিত্তি ছিল অস্তিত্বের আরও গভীরে। সমাজকে ছেড়ে মানুষের চলে না; কিন্তু মানুষের একটা দিক আছে যেখানে সে নিঃসঙ্গ। মানুষ সামাজিক হয়েও সমাজসর্বস্ব নয়। অদ্ভুত রাসেল ছিলেন না।
জীবনে বহুবার রাসেল নিজেকে অনেক মানুষের ভিতর একাকার করে দেবার আগ্রহ বোধ করেছেন; কিন্তু তাঁর সংশয়ধর্মী বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বসচেতন মন তাঁকে ঐ মাতলামিতে ডুবতে দেয়নি। রাসেল লিখেছেন “Throughout my life I have longed to feel that oneness with large bodies of human beings that is experienced by the members of enthusiastic crowds…Always the sceptical intellect, when I frave most wished it silent, has whispered doubts to me, has cut me off from the facile enthusiasms of others, and has transported me into a desolate solitude.’’ যে-মধ্যযুগীয় মন সমবেতভাবে হাঁটু গেড়ে বসে মুক্তির তাৎক্ষণিক স্বাদ অনুভব করে, অথবা যূথবদ্ধ হয়ে বিধর্মীর বিরুদ্ধে ক্রোধে ফেটে পড়ে, তার সঙ্গে রাসেলের নাড়ির। সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল। ক্রুশের পরিবর্তে ঝাণ্ডাকেও তিনি গ্রহণ করতে পারেননি।
একক সাধক হিসাবেও ভগবানকে মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ কথাটাও তিনি কখনও যুক্তির ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন, আবার কখনও অত্যন্ত করুণ এবং বেদনার্ত স্বরে বলেছেন। যুক্তির দিক থেকে ভগবানের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ তিনি খুঁজে পাননি। ভগবানে বিশ্বাসের আশ্রয় হারাতে তাঁকে অসহনীয় যন্ত্রণাবোধ করতে হয়েছে; তবু যুক্তিকেই তিনি গ্রহণ করেছেন। প্রিয়াকে লিখিত একটি পত্রে তিনি বলেছেন “The centre of me is always and eternally a terrible paina searching for something beyond what the world contains, something transfigured and infinite the beatific vision God I do not find it, I do not think it is to be found.”
যে বিশ্বাস তাঁর তাপিত জীবনে শীতল করুণাধারার মতো বর্ষিত হতে পারত, তার আশ্রয় থেকে তিনি নিজেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত করেছেন। অথবা বলা ভালো যে, এ বিষয়ে তাঁর যুক্তিবাদী মনের কাছে কোনো গত্যন্তর ছিল না। তাঁর যুক্তি এ প্রশ্নে নিরপেক্ষতার ভূমিকা গ্রহণ করেনি, বরং ভগবানের অস্তিত্বের বিপক্ষেই স্পষ্টভাবে রায় দিয়েছে। ভগবানের অস্তিত্বের সঙ্গে রাসেল পৃথিবীতে অসংখ্য অন্যায়কে মেলাতে পারেননি; আর বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে তাঁর মনে হয়েছে। অতএব রাসেলকে এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয়েছে যে, মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বজগতের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই; জগৎ আছে, কিন্তু কোনো জগদীশ্বর নেই।
মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জগতের কোনো নিগূঢ় আত্মিক সম্পর্ক নেই জেনেও স্পিনোজা নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে এমন একটি বিশ্বজোড়া সমম্বয়ের সন্ধান পেয়েছিলেন যে তাতেই তাঁর বুদ্ধি ও আত্মা তৃপ্ত হয়েছিল। কিন্তু যে সমন্বয়দৃষ্টি স্পিনোজাকে শাস্তি দিয়েছিল তাও রাসেলের কাছে গ্রহণীয় হল না। তিনি লিখেছেন “What Spinoza calls “the intellectual love of God” has seemed to me the best thing to live by, but I have not had even the somewhat abstract God that Spinoza allowed himself to whom to attach my intellectual love.” এ বিষয়ে রাসেলের দ্বিধার কারণ তিনি স্পষ্টভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। পাশ্চাত্ত্য দর্শনের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর বৃহৎ গ্রন্থে তিনি G10 “Spinoza thinks that if you see your misfortunes as they are in reality, as part of the concatenation of causes stretching from the beginning of time to the end, you will see that they are only misfortunes to you, not to the universe, to which they are merely passing discords heightening an ultimate harmony. I cannot accept this; I think that particular events are what they are, and do not become different by absorption into a whole. Each act of cruelty is eternally a part of the universe; nothing that happens later…can confer perfection on the whole of which it is a part.” নিজের দুঃখকে যদি-বা উপেক্ষা করা যায়, অন্যের প্রতি অন্যায় কোনো বিশ্বদৃষ্টিতেই মেনে নেওয়া যায় না। এই মুহূর্তের একটি অমার্জনীয় অবিচার অনাগত ভবিষ্যতের কোনো সুবিচারের ফলে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারায় না। প্রতিটি অন্যায় নিষ্ঠুরতা ইতিহাসের বুকে কাঁটার মতো জেগে থাকে। বিশ্ব জগতে এমন কোনো সমম্বয় নেই যাতে হৃদয় মুগ্ধ হয়। স্পিনোজার বিরুদ্ধে রাসেলের সমালোচনার বঙ্গানুবাদ না-হলেও এটাই মর্মার্থ।
রাসেলের সমস্যা তা হ’লে এই। আনন্দ তাঁর জীবনের লক্ষ্য, তিনি মুগ্ধ হতেই ব্যাকুল। অথচ তিনি অবিশ্বাসী, তাঁর যুক্তি তাঁকে সংশয়বাদী করেছে। অবিশ্বাস থেকে শুরু করে কি আনন্দে পৌঁছানোর কোনো পথ আছে? জনতার ভিতর তিনি নিজেকে হারাতে পারলেন না; ভগবানে তিনি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারলেন না; বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও তিনি কোনো পরম সুন্দরের মহিমা খুঁজে পেলেন না। তবে তিনি কি নিয়ে বাঁচবেন?
রাসেলের জীবনদর্শন কি আত্মবিরোধী নয়? স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের ভিত্তিতে তিনি জীবনকে স্থাপন করতে চেয়েছেন। কিন্তু এই বিশাল বিশ্ব মানুষের মহত্তম আদর্শ এবং আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি নিষ্করুণ একথা জানবার পর কি জীবনকে কোনো সরল, সহজ আনন্দের সুরে বাঁধা যায়? সহজ আনন্দের দুটি স্তর আছে; এক, শিশুর মন, আর দ্বিতীয়, সাধকের দৃষ্টি। যে-বিশ্লেষণী বুদ্ধি জগতে অসঙ্গতি খুঁজে পায়, যে-ন্যায় অন্যায় চেতনা এই অসঙ্গতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তা তো আমাদের শিশুর স্বর্গ থেকে নির্বাসিত করে, আবার সাধকের জগতে প্রবেশাধিকার দেয় না। এই সংশয় বুদ্ধির প্রতি যদি আমাদের। বিশ্বস্ত থাকতে হয় তো তার মূল্য হিসাবে অশান্তিকে মেনে নেওয়াই কি সঙ্গত নয়? আর এই বুদ্ধিকে যদি আমরা উত্তীর্ণ হই, তারপরও কি কালহীন বিশ্বে কোনো বিকট অসামঞ্জস্য। রাসেলের অভ্যস্ত বেদনার্ত অট্টহাস্যের মতো অনন্ত শূন্যকে ব্যাপ্ত করে ধ্বনিত হতে থাকে? রাসেল যুক্তিবাদী, এই দুই বিকল্পের কোনো একটিকে বেছে নেওয়াই কি যুক্তির কথা নয়?
কিন্তু রাসেল একটি তৃতীয় পথ অনুসরণ করলেন। সেটি করুশার পথ।
পৃথিবীতে ন্যায় নেই; বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের প্রতি করুণা নেই; মানুষের মহত্তম সাধনায় সাফল্যের কোনো নির্ভরযোগ্য প্রতিশ্রুতি নেই। ব্রহ্মাণ্ডের এই নির্মমতার বিরুদ্ধে মানুষের দৃপ্ত বিদ্রোহের পতাকা হবে, মানুষের প্রতি মানুফের করুণা। A Free Man’s Worship শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে রাসেল লিখেছেন “United with his fellow men by the strongest of all ties, the tie of a common doom, the free man finds that a new vision is with him always, shedding over every daily task the light of love…One by one as they march, our comrades vanish from our sight, seized by the silent orders of omnipotent Death… Be it ours to feel that, where they suffered, where they failed, no deed of ours was the cause.” রাসেল জান, ন যে, মৃত্যু যতদিন আছে দুঃখ ততদিন অনিবার্য। জগতের নিয়মে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কাজেই অমরতা তিনিও দাবি করেননি। তিনি চেয়েছিলেন দুঃখে ক্লিষ্ট মানুষের দুঃখ লাঘব করতে।
‘ভগবান’ বুদ্ধ ভগবান সম্বন্ধে মৌন ছিলেন। রাসেলও করুণাকে তাঁর পথ এবং পাথেয় বলে গ্রহণ করলেন।
এ পথের শেষে কি তিনি আনন্দে পৌঁছেছিলেন? জানি না। শুধু জানি যে, জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি এমন কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, অপার্থিব আনন্দ ও করুশতম বেদনার সংমিশ্রণে যা অবিস্মরণীয়। চুরানব্বই বছরের বৃদ্ধ রাসেল তাঁর আত্মজীবনীর মুখবন্ধে লিখেছেন “Three passions, simple but overwhelmingly strong, have governed my life; the longing for love, the search for knowledge, and unbearable pity for the suffering of mankind… I have sought (love) because in the union of love I have seen, in a mystic miniature, the prefiguring vision of the heaven that saints and poets have imagined. This is what I sought, and this is what at last I have found…With equal passion I have sought knowledge…A little of this, but not much, I have achieved…Love and knowledge, so far as they were possible, led upward toward the heavens. But always pity brought me back to earth. Echoes of cries of pain reverberate in my heart… I long to alleviate the evil, but I cannot, and I too suffer.” 3 চমকে উঠতে হয়। রাসেল বলছেন যে, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি অবশেষে সেই অলৌকিককে লাভ করেছেন যে-অধরা শুধু কবি ও সাধকের কল্পনায় ধরা দেয়। প্রেম ও জ্ঞানের হাত ধরে তিনি স্বর্গের দিকে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে মানুষের আর্তনাদ তাঁকে সেই স্বর্গে স্থির থাকতে দেয়নি। বেদনায় বিদ্ধ হয়ে তিনি সংসারে ফিরে এসেছেন।
রাসেল যুক্তিবাদী রাসেল–আনন্দের স্বর্গে পৌঁছেছিলেন, একথা কি সত্য? অবিশ্বাস্য। কিন্তু রাসেল মিথ্যা বলেছেন, এও তো বিশ্বাস করা যায় না। সমাজ ও ইতিহাস (১৯৭০)