৫.০৭ সুলতান – আহমদ নদিম কাস্‌মি

সুলতান – আহমদ নদিম কাস্‌মি

দাদার বাঁ হাতের পাঞ্জার নিচে সুলতানের মাথা, আর ডানহাতে লাঠি। এই লাঠি পাকা ফুটপাতের উপর ঠুকে ঠুকে সে এলোপাতাড়ি শব্দ সৃষ্টি করছিল।

সুলতান যেই একটু থামল, দাদা অমনি বলতে লাগল, ‘বাবুজি, অন্ধ মিস্কিনকে দুটো পয়সা খয়রাত-‘

‘না, না, দাদা, বাবু নয়।’ সুলতান বলল, ‘ভেল্কির খেল হচ্ছে।’

‘হেঁহ, ভেল্কির খেল হচ্ছে। তোর– ‘ জিবের ডগায় একটা খারাপ কথা এসে গিয়েছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময় ফুসফুস থেকে জোর একটা কাশির ধাক্কা ঠেলা দিয়ে উঠল। সুলতানের মাথা থেকে সরিয়ে নিয়ে হাতটাকে বুকে রেখে দীর্ঘ কাশির দমকে ডুবে গেল দাদা।

দাদার শ্বাসনালী পরিষ্কার হতে হতে যে সময়টুকু চলে গেল, সেই সময়ের মধ্যে ভেলকির পুরো একটা খেল দেখে নিতে পারল সুলতান। ঝুড়ির মধ্যে ময়লা ন্যাকড়া রাখা ছিল- ভেল্কিঅলা সেই ন্যাকড়াকে যখন দুই-দুটো মোটা মোটা পায়রা বানিয়ে ফেলল, তখন উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী হাততালি দিয়ে উঠল। আত্মহারা, তন্ময় সুলতানও যোগ দিল সেই হাততালিতে।

দাদা আবার বাঁ হাতটা মাথার উপর রাখতে গিয়ে মাথা খুঁজে পেল না। ‘কোথা গেলি রে তুই?’

সুলতান দৌড়ে এসে হাতের নিচে মাথা রাখল। তারপর, আবার চলতে লাগল দাদাকে নিয়ে।

চলতে চলতে একসময় দাদার লাঠিতে বিদ্যুতের খুঁটি বেজে উঠল। সুলতান বলল, ‘শুনেছ, দাদা, থামটা কেমন বেজে উঠল?’

‘হুঁ।’ দাদা থামল। খুঁটির উপর দাদা আর একটা বাড়ি মারল লাঠির। কিন্তু বাড়িটা

বেজায়গায় লেগে ফসকে গেল।

সুলতান বলল, ‘আমাকে দাও।’ সুলতান দাদার হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে জোরে জোরে বিদ্যুতের খুঁটির উপর বাড়ি মেরে বাজনা বাজাতে লাগল।

‘দেখেছিস, কেমন বাজনা!’ দাদা ছেলেমানুষি জুড়ে দিল সুলতানের সঙ্গে। ‘যখন আমি তোর মতো ছোট ছিলাম, থামে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন থামের ভেতর থেকে মেম সাহেব ইংরেজিতে কথা বলত। ইউ গুড, ইউ ব্যাড

‘থামের ভেতরে মেম সাহেব কথা বলত?’ সুলতান অবাক হয়ে গেল। ‘তখন না-হয় মেম বলত, আর এখন কে বলে, দাদা?’ তারপর, হঠাৎ সুর পালটে ফিসফিস করে বলল, ‘দাদা, দুজন বাবু আসছে।’

দাদা তাড়াতাড়ি আওড়াতে শুরু করে দিল, ‘ও বাবু, অন্ধ মিস্কিনকে দুটো পয়সা খয়রাত দিয়ে যাও। আল্লা তোমার চাকরিতে তরক্কি দেবেন, বাবা। সকাল থেকে রুটি খাওয়া হয়নি, বাবা। আল্লা তোমাকে ছেলে দেবেন, পোতা দেবেন; তুমি সুখে থাকবে, বাবা। গরিব মিস্‌কিনকে–‘

এক বাবু অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন, ‘বুড়োটা দেখছি পরিবার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে হে।’ তারপর হাসতে হাসতে চলে গেলেন তাঁরা দুজন।

‘চলে গেল।’ সুলতান আস্তে করে বলল কথাটা। কিছুক্ষণ থেমে সে জোরে একটা গাল দিয়ে দিল বাবু দুজনকে।

দাদা সুলতানের মাথায় চাপ দিল বাঁ হাতের। ‘আবার মুখ খারাপ করলি তুই? কাল তোকে কী বলেছিলাম রে, শুয়োর। কেউ যদি শুনে ফেলে, কল্লাটা তোর ছিঁড়ে উল্টোদিকে বসিয়ে দেবে, বুঝেছিস?’

সুলতান চুপচাপ চলতে লাগল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আমার মাথায় তোমার বুড়ো আঙুলটা যেখানে আছে না, ঠিক ওইখানকায় একটু চুলকে দাও তো, দাদা।’

দাদা কানের ওপাশ থেকে শুরু করে ওপাশ পর্যন্ত সারা মাথায় জোরে জোরে চুলকে দিল। ‘সুলতান, কী ব্যাপার, আজকে যে তুই থামতেই চাস না। বাবু-টাবু কেউ কি যাচ্ছে না রে?

‘না, দাদা।’

‘বাবুরা সব আজ গেল কোথায়, বলতে পারিস?’

‘মরেছে বোধহয়।’ তারপর, হঠাৎ থেমে পড়ে জিগ্যেস করল, ‘আজকে কী দাদা?’

‘তা আমি কেমন করে বলব রে! তুই মনে করে রাখতে পারিস না? আমার কাছে তো দিন-রাত সব সমান, তা জানিস না নাকি?’ কিছুক্ষণ চিন্তা করে দাদা আবার বলল, ‘পরশু তুই আমায় নীলা মসজিদ নিয়ে গিয়েছিলি না? পরশু জুম্মার দিন ছিল না? তাহলে তো আজকে রোববার রে। রোববারটা দেখছি এক্কেবারে সর্বনেশে দিন রে, সুলতান। বাবুরা আজকে বিবি-বাচ্চাদের নিয়ে বাড়িতে বসে খেলা করছে, বুঝেছিস?’

সুলতান দাঁড়িয়ে থাকল। একটু পরে টিনের বাটিতে টুন করে একটা শব্দ হল।

‘কী পড়ল রে সুলতান? কত?’

‘এক পয়সা, দাদা। টেডি এক পয়সা।’

সুলতানের মাথায় পাঞ্জাটা দাদা ঘোরাল। সুলতানকে নিজের দিকে করে নিয়ে বলল, ‘যা, ওইটা নিয়ে কিছু কিনে খাগে যা। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকছি।’

‘এক পয়সা দিয়ে কিছুই পাওয়া যায় না, দাদা। কিচ্ছু না। আরো তিন-চারটে হলে হয়তো আখের গোল্লা পাওয়া যেতে পারে।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাদা আরো কয়েকটা পয়সা বের করল। ‘এই নে। কিছু কিনে খেয়ে আয়। সকাল থেকে তো কিছুই খাসনি। বাচ্চাদের ক্ষিদে আবার বুড়োদের চাইতে বেশি! যা।’

সুলতান পয়সা নিয়ে দৌড় মারল।

দাদা আবার বলল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরিস কিন্তু। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি রে সুলতান?’ সুলতান আবার ফিরে এল। ‘আর একটু বাঁ দিকে সরে দাঁড়াও দাদা।’ সুলতান হাত ধরে সরিয়ে দিল দাদাকে। ‘এই থামটার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাক

সুলতান চলে গেল। আর, দাদা থামের সঙ্গে কান লাগিয়ে কী যেন শোনার চেষ্টা করতে লাগল। শুনে শুনে মুচকে মুচকে হাসল সে। এইভাবে কেটে গেল অনেকক্ষণ। সুলতান আসছে না কেন? দাদা হাঁক ছাড়ল, ‘সুলতান ও সুলতান! ও হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা, মরলি নাকি?’ কোনো জবাব এল না। তারপর, এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে রাস্তার লোকদের সম্বোধন করল, ‘ও ভাই, ও বাবু, আমার পোতাটা এইদিক দিয়ে গেল কিছু কিনতে। সুলতান নাম। টাঙার নিচে, মটরের নিচে গিয়ে পড়ল না তো হতচ্ছাড়াটা। ও সুলতান, সুলতান!

‘আসছি, দাদা।’ দূর থেকে সুলতানের গলা শোনা গেল।

কিন্তু ঠিক তেমনি সময়ে আবার কাশি উঠল দাদার। কাশির দমক কমলে মুখ ফিরিয়ে যেন সে থামটাকেই জিগ্যেস করল, ‘কোথায় গিয়েছিলি রে মরতে?’

সুলতান নিজে নিজেই দাদার বাঁ-হাতটা নিয়ে তার মাথায় চাপাল। ‘ভেল্কির খেল হচ্ছিল, দাদা?। পেটের ভেতর থেকে গুলি বের করছিল টেনে টেনে। আমার পেট থেকেও একটা বের করল।’

পাঁচ আঙুলের ডগা দিয়ে দাদা সুলতানের মাথাটাকে এমনভাবে টিপে ধরল, যেন সে তাকে উপরে তুলে ফেলবে। ‘চল, ঘরে ফিরে চল। ওখানে গিয়ে তোকে আমি ভালো করে ভেল্কির খেল দেখাব। হারামজাদা, আমি যে দুচোখের কানা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পা দুটো যে পাথর হয়ে গেল, তা তোর একটুও মনে থাকল না রে, অ্যাঁ?’

সুলতান কিছুই বলল না, হাঁটতে থাকল।

কিছুক্ষণ পর শান্ত গলায় দাদা বলল, ‘কী খেলি রে, ছোঁড়া?’

‘আখের গোল্লা।’

‘আখের গোল্লা! আখ আবার একটা খাবার জিনিস হল রে, অ্যাঁ! ও তো একদম পানি। ছোলাভাজা কিনে খেতে পারলি না– সারাদিন পেটে থাকত।

সুলতান কিছু বলল না, চুপচাপ হাঁটতে থাকল।

দাদা আবার বলল, ‘বাটিটা হাতে ঝুলিয়ে রেখেছিস নাকি রে, সুলতান?’

‘না, দাদা।’

‘খবরদার, ঝুলিয়ে রাখবি না। উঁচু করে ধরে থাকবি, ঝুলিয়ে রাখলে লোকে ভাববে, ভিখিরি নয়, সওদা করতে যাচ্ছে।’

এ-কথায় স্মৃতি কপচানোর ইচ্ছা হল সুলতানের। মনে আছে-না দাদা, একবার বাটিতে করে তেল আনতে যাচ্ছিলাম দোকানে। বাটিটা তোলা ছিল বলে এক বাবু বাটিতে একটা দুয়ানি ফেলে দিল, না দাদা?’

‘তা দুয়ানিটা কী করলি?’

‘কেন, তোমাকে দিয়ে দিলাম, মনে নাই বুঝি?’

‘হ্যাঁ, পয়সা পেলেই দিয়ে দিবি আমাকে, বুঝেছিস? পয়সা বাজে খরচ করা খুব খারাপ।’

‘দাদা!’

‘কী, বল?’

‘আমার মাথাটা একটু চুলকে দাও তো– ঠিক তোমার বুড়ো আঙুলটার কাছে।’

দাদা থেমে গিয়ে জোরে জোরে সুলতানের মাথা চুলকে দিল। তারপর বলল, ‘ঘরে ফিরে জেবুকে বলব, তোর মাথার উকুন বেছে দেবে। তুইও ওর কোনো কাজ করে দিস, কেমন?’

‘আচ্ছা’।

কিন্তু ঘরে ফিরলে আর উকুন বাছার কথা জেবুকে বলতে মনে থাকে না দাদার। এটা রোজকার ব্যাপার। ঘরে ফিরলে রোজই খাঁটিয়ার উপর বসে দাদা প্রথমে একটু হাঁপ ছাড়বে। লাঠিটাকে খাঁটিয়ার কোণায় পায়ার সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখবে।

আর, সুলতানের মাথা থেকে দাদার হাতটা যখন সেদিনের মতো নেমে আসবে, সুলতানের তখন মনে হবে, যেন তার মাথাটা একেবারেই হাল্কা হয়ে গেছে। চুপি চুপি পা টিপে টিপে সে বাইরে বেরিয়ে পড়বে। জেবু খালা যেন দেখতে না-পায়, সেদিকেও তার খেয়াল থাকা চাই। একবার বেরুতে পারলেই হাল্‌কা মাথা নিয়ে চোঁ চোঁ দৌড়। এক দৌড়েই বাংলো দিয়ে ঘেরা মাঠটায় গিয়ে পৌঁছাবে সে। সেখানে বড়লোকের বাচ্চারা ক্রিকেট খেলে, আর গরিবের বাচ্চারা দূরে চলে-যাওয়া বল কুড়িয়ে এনে দেয়। তারপর, বড়লোকের বাচ্চারা যখন খেলাশেষে মাঠ খালি করে দিয়ে চলে যায়, তখন বেয়ারা, চাপরাসি, খানসামা আর মেথরের বাচ্চারা কাঁচের গুলি খেলতে আরম্ভ করে দেয় সেই মাঠে

সুলতানও একবার চেষ্টা করেছিল এই খেলায় যোগ দিতে। কিন্তু মেথরের বাচ্চা প্রকাশ করে দিয়েছিল, ওটা তো ভিখিরির বাচ্চা। কাজেই সুলতান আর খেলবার সুযোগ পায়নি। কিন্তু কাঁচের গুলি অনেক দূরে চলে গেলে দৌড়ে গিয়ে সে কুড়িয়ে আনে সেটা, আর যার জিনিস তাকে ফেরত দেওয়ার আগে গুলিটাকে সে আঙুলের ডগায় ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখে নেয়।

একদিন সে অনেক কান্নাকাটি করে দাদার কাছ থেকে কয়েকটা পয়সা নিয়ে কাঁচের গুলি কিনেছিল কয়েকটা। কিন্তু সেই গুলি নিয়ে যখন সে বড় সাধ করে মাঠে গেল খেলতে, তখন বেয়ারা, চাপারাসি, খানসামা আর মেথরের বাচ্চারা সুলতানের ওপর চিলের মতো ঝাঁপটা মারল, আর ভিখিরির বাচ্চারা সব গুলি কেড়ে নিয়ে গেল। সুলতান অনেক কাঁদল, কিন্তু গুলি সে ফেরত পেল না আর।

সুলতান তবু ফাঁক ফেলেই ওই মাঠে যায়। মাঠে যাওয়া একটা নেশার মতো। মাঠটা যেন তাকে চুম্বকের মতো টানে।

আর, মাঠে এলে ফিরতে ইচ্ছে করে না সুলতানের। দাদার হাতের পাঞ্জাটাকে সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। সেই হাতে রস নেই, কষ নেই। শক্ত। শুকনো কাঠের মতো। সেই কাঠে কী ধার। সুলতানের মগজের ভেতরে যেন সেটা কেটে বসে যেতে চায়। সুলতান জানে, সকাল হলেই তাকে উঠতে হবে। উঠে মাথার উপর চাপিয়ে নিতে হবে হাতের পাঁচটা আঙুল। আঙুল নয়, যেন লোহার পাঁচটা শলা।

ঘুমিয়ে থাকলেও দাদার হাত মাথার উপর টের পায় সুলতান। হাতটা যেন একটা পিঞ্জর, আর সুলতানের উকুনে-ভরা-মাথাটা একটা পাখি। পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই তার।

রাস্তা দিয়ে দাদাকে নিয়ে যখন চলে, তখন মনে হয়, কয়েদ খাটতে যাচ্ছে সে, সেপাই হাত-কড়া দিয়ে চোরকে বেঁধে নিয়ে গেলে চোরের না-গিয়ে যেমন কোনো উপায় থাকে না, সুলতানেরও না-গিয়ে তেমনি কোনো উপায় নেই।

দাদা আখ খেতে নিষেধ করে, কিন্তু আখের দিকেই তার টান বেশি। আখঅলার ঠেলাগাড়ি থেকে দু-একটা গোল্লা গড়িয়ে নালায় পড়লে সে ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে এনে মজা করে খায়। দাদাকে নিয়ে পথ চলতে চলতে পায়ের কাছে বাবুদের-ফেলে দেওয়া কলার খোসা চোখে পড়লে কুড়িয়ে নেয়। সেই খোসাতে ইঁদুরের মতো দাঁত বসিয়ে মজ্জা বের করে আনে। বাদামের খোসা পেলে তুলে নিয়ে দেখে, আস্ত, না, ছাড়ানো।

রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে নানাভাবে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা কম করে না সুলতান। কিন্তু সুলতানের মাথায় রাখা আঙুলের ডগা দিয়েই দাদা অনেক আগে টের পেয়ে যায় সুলতানের ফন্দি। কখনো বকে, গাল দেয়। কখনো বোঝায়। বলে, ‘আমি মরলেই তোর ছুটি, তখন তুই যা-খুশি করে বেড়াবি। লোকের হাতে কত মার খাবি। তখন তুই নিজে নিজেই বুঝতে শিখবি, কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ। কিন্তু যদ্দিন না-মরছি, তোকে ছাড়া আমি ভিখ করব কেমন করে, বল। দিন পোয়ালে চারটি গণ্ডা পয়সা জেবুর হাতে তুলে না-দিলে রুটি খাবি কী দিয়ে?’

অনেকদিন আগের কথা, মেথরপট্টির পেছনে বেগু টাঙাঅলার গাড়ির নিচে দাদা-পোতায় জড়াজড়ি করে রাত কাটাত। একদিন সাহেবপাড়া থেকে ভিক্ষা করে ফিরছিল। বেগুর মা জেবু এসে সামনে দাঁড়াল। ‘ফকির বাবা, আল্লার কাছে একটু দোআ করে দাও, আমার বেগুর যেন অসুখ সেরে যায়। এক টাকা মানত করেছি ফকির বাবা, আমি তোমাকে দেব।’

দাদা ওইখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে দোয়া করল।

আবার ক’দিন পর দাদা সুলতানকে নিয়ে ভিক্ষা করে ফিরছিল। জেবু সামনে এসে দাঁড়াল। দাদার হাতে একটা টাকা দিয়ে বলল, ‘ফকির বাবা, তোমরা বাইরে পড়ে থাক আমার ছেলে বলছিল, ওতে আমাদের পাপ হয়। তোমরা আজ থেকে আমার এই কুঁড়েঘরেই থাকবে।’

সেদিন থেকে ওরা জেবুদের কুঁড়েঘরে এক কোণায় জায়গা পেয়ে গেল। ওরা দিনমান ভিক্ষা করে যা পায়, জেবুর হাতে তুলে দেয়। বিনিময়ে জেবু ওদের রুটি খেতে দেয় দু’বেলা!

সুলতান যে কেবল দাদাকে দেখতে পারে না, তাই নয়– জেবু খালাও দু’চাখের বিষ দাদাকে ঘরে তুলে খেলার মাঠে রওনা দেওয়ার সময় ধরা পড়লে পড়তে হয় এক জেবু খালারই হাতে। আর, ধরা পড়লে অমনি জেবু খালা বলবে, ‘দেখেছ, বাবু এখন খেলতে চললেন। বুড়ো, অন্ধ, দাদাটাকে একলা ফেলে রেখে খেলতে যাওয়া– এ কেমনধারা আক্কেল বল দেখিনি?’

তাই শুনে দাদাও হয়তো অমনি বলে বসবে, ‘ওরে সুলতান, যাসনে ভাই। তার চাইতে চল, চৌরঙ্গিতে একটা চক্কর দিয়ে আসি। দুটো পয়সা বেশি পেলে কালকে তোর ছুটি।’

কিন্তু সুলতান জানে, ছুটি সে কোনোদিনই পাবে না। দুটো পয়সা বেশি পাওয়াও হয় না, ছুটিও মেলে না।

তবে ক’দিন থেকে দাদার হাঁপানিটা বেড়েছে। এই হাঁপানি যেদিন মাঝরাত্রে শুরু হয়, সেদিন বেলা উঠলেও শেষ হয় না। কাশতে কাশতে দম আটকে আসে। সেদিন আর ভিক্ষা করতে বের হয় না তারা।

কিন্তু সুলতানের তবু ছুটি নেই। সারাদিন বসে বসে সে দাদার পিঠ আর বুকে মালিশ করে, পাছা আর মাজা টিপে দেয়। তাতে অল্প খানিক আরাম হয় দাদার। সুলতানের হাত থেমে গেলে দাদা কাশির দাপট আটকে রেখে বহু কষ্টে টেনে টেনে বলে, ‘কি সুলতান, মরলি নাকি?’

সুলতান সঙ্গে সঙ্গে আবার টিপতে শুরু করে দিয়ে মনে মনে বলে, তুই মর, দাদা। কী মজাই-না হয় তুই মরলে— খোদার কসম। আল্লা আল্লা করে তুই মর, এখনই মর। তাহলে আমি সাহেবপাড়ায় গিয়ে সারাদিন মাথায় বাতাস লাগিয়ে কাটাতে পারি।

তারপর, দাদা একদিন সত্যি সত্যি মরে গেল। সেদিন হাঁপানির টান খুব বেড়েছিল। সারারাত দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে টেনে টেনে কাশল। দাদার পিঠে মালিশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুলতান। আর দাদা কাশতে কাশতে দম আটকে মরে গেল।

সকালবেলায় সুলতান যখন উঠল তখন জেবু কাঁদছিল। জেবু বলল, ‘তোর দাদা মরেছে রে।’

‘সত্যি?’ সুলতানের যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। দাদারাও যে মরতে পারে, তা তো কোনোদিন সে শোনেনি। এখন সে শুনল। নিজের চোখে দেখল। দেখে যখন বিশ্বাস হল, দাদা মরেছে, তখন তার মনের বাগানে ফুলঝুরির ফুলকি ছুটল।

বেগু টাঙাঅলা পাড়া-প্রতিবেশীদের ডেকে এনে জড়ো করল। দাদাকে নাইয়ে-ধুইয়ে কবর দিতে নিয়ে গেল তারা।

সারাদিন জেবু খালা কাঁদল আর সুলতানকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলাল। বেগু টাঙাঅলা দাদাকে মাটি দিয়ে যখন ফিরল, সুলতানের হাতে তুলে দিল সে একমুঠো আখের গোল্লা। তাই সে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিবোল আর চুষল। মনে মনে বলল, খোদার কসম, দাদা মরলে কত লাভ।

রাত্রেও জেবু খালা সুলতানকে দাদার খাঁটিয়ায় শুতে দিল না। বাচ্চা ছেলে, রাত্রে ঘুম ভেঙে অন্ধকারে একলা ভয় পেতে পারে। সে নিজের কাছে বুকের সঙ্গে সুলতানকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াল।

সকাল হলে জেবু খালা জব্বর নাশতা খাওয়াল সুলতানকে। দইয়ের সঙ্গে গুড় মেশানো; তার সঙ্গে পুরো একটা বাসি রুটি। খেয়েদেয়ে সুলতান মনের ফুর্তিতে বাইরের দিকে পা বাড়াল।

জেবু খালা জিগ্যেস করল, ‘কোথায় চললি, বাপ?’

এই প্রশ্ন অদ্ভুত ঠেকল সুলতানের কানে। যেখানে খুশি যাচ্ছে সে। দাদা তো মরেই গেছে। তবে আবার কোথায় যাচ্ছে, তা জেনে কার কী লাভ?

নীরব দেখে খালা বলল, ‘ছি বাবা, ভিখিরির বাচ্চার খেললে চলে!’ তারপর সে সুলতানের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এল। সেই হাতে তুলে দিল টিনের বাটি। ‘বাটিটাকে ঝুলিয়ে রাখিসনে যেন— উঁচু করে তুলে ধরবি। ঝুলিয়ে রাখলে লোকে ভাববে, ভিখিরি নয়, সওদা করতে যাচ্ছে।’

সুলতান নীরবে তুলে নিল বাটিটা। বাইরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর, আবার ঘরে ফিরে এল এমনভাবে, যেন কোনো জিনিস নিতে ভুলে গিয়েছে। কিন্তু না। জেবু খালার সামনাসামনি হতেই খালাকে সে জড়িয়ে ধরল। খালার পেটের নিচে মুখ গুঁজে দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল সুলতান, আর ছটফট করতে থাকল তাকে জড়িয়ে ধরে।

খালা বলল, ‘ভিখিরির বাচ্চা ভিখ না মাংলে খাবি কী? আজকে যদি তুই আট-দশ আনা আনতে পারিস, আমি তোকে খুশবু চালের ক্ষীর খাওয়াব দেখিস। আল্লার নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়, বাছা– দেরি করিসনে।’

কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল সুলতান। কাঁদতে কাঁদতে গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়ে বড় রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁদতে কাঁদতে টিনের বাটি মেলে সামনে। ‘বাবুজি, অন্ধ মিস্কিনকে দুটো পয়সা খয়রাত দিয়ে যাও। বাবুজি–‘ দাদার ভাষা তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। মুখস্থ বুলিই তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল আপনা-আপনি।

‘কী বললি? অন্ধ? তুই অন্ধ?’ পথচারী বাবুর কঠোর প্রশ্ন।

সুলতান এই ভুল সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল। কেবল মাথা নাড়িয়ে জানাল, সে অন্ধ নয়। আর, ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।

‘মিথ্যে বলছিস, আবার উল্টো কাঁদছিস?’

এ যেন প্রশ্ন নয়– শাসন। এ শাসন বুঝি অনেক বেশি কড়া দাদার শাসনের চাইতে। সুলতান শাসনের কাছে মাথা নত করে দিল। কিছুই সে বলতে পারল না মুখ ফুটে।

‘চাকরি করবি? বাসার কাজ?’

সুলতান কেবল কেঁদেই যাচ্ছে। এসব প্রশ্নের অর্থ জানা নেই তার।

উত্তর না-পেয়ে বাবু চলে গেলেন।

অমনি যেন সম্বিত ফিরে পেল সুলতান। ‘হেই বাবু, দুটো পয়সা দিয়ে যাও। আল্লার রাহে খয়রাত করে যাও, বাবু।’

বাবু আবার ফিরে একবার তাকালেন। তারপর আবার হনহন করে চলে যেতে লাগলেন নিজের কাজে। সুলতান ভাবল, না-জানি আবার কী ভুল কথা বলে ফেলল সে।

‘হেই বাবু, হেই বাবুজি– ‘ সুলতান দৌড়াতে লাগল মরিয়া হয়ে তাঁর পিছু পিছু।

বাবু থামলেন। ‘কি, চাকরি করবি নাকি, বল!’ আরো কিছু লোক জুটে গেল সেখানে।

‘বাবুজি… ‘হাঁপাতে হাঁপাতে সুলতান তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়ল। ‘বাবুজি, ভিখ চাই না, চাকরি চাই না।’ টিনের বাটিটা সে পটকে দিল রাস্তায়।

‘তাহলে আমাকে ডাকলি কেন?’

অপ্রতিরোধ্য, অজস্র বারিধারা সুলতানের দু’চোখের গহ্বরে ভিড় জমাল। তার ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল থরথর করে। অনকে কষ্টে কেটে কেটে বলল, ‘বাবুজি, খোদায় আপনার ভালো করবে। আমার মাথায় হাত রেখে খানিকদূর আপনি আমার সঙ্গে চলতে পারবেন?’

‘শোনো কথা।’ চারপাশের ভিড় জমানো লোকদের পানে বোকার মতো চেয়ে

থাকলেন ভদ্রলোক।

অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *