পঞ্চম খণ্ড – ষষ্ঠ অধ্যায় – প্রথম পাদ: ঠাকুর ও নরেন্দ্রনাথের অলৌকিক সম্বন্ধ
নরেন্দ্র ঠাকুরের পূতসঙ্গ কতকাল লাভ করিয়াছিলেন
দীর্ঘ পাঁচ বৎসর কাল শ্রীযুত নরেন্দ্র ঠাকুরের পূত সহবাসলাভে ধন্য হইয়াছিলেন। পাঠক হয়তো ইহাতে বুঝিবেন যে, আমরা বলিতেছি তিনি ঐ কয় বর্ষ নিরন্তর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের শ্রীপদপ্রান্তে অতিবাহিত করিয়াছিলেন। তাহা নহে। কলিকাতাবাসী অন্য সকল ভক্তগণের ন্যায় তিনিও ঐ কয় বৎসর বাটী হইতেই ঠাকুরের নিকটে গমনাগমন করিয়াছিলেন। তবে এ কথা নিশ্চয় যে, প্রথম হইতে ঠাকুরের অশেষ ভালবাসার অধিকারী হওয়ায় ঐ কয় বৎসর তিনি ঘন ঘন দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিয়াছিলেন। প্রতি সপ্তাহে এক বা দুই দিবস তথায় গমন এবং অবসর পাইলেই দুই-চারি দিন বা ততোধিক কাল তথায় অবস্থান করা নরেন্দ্রনাথের জীবনে ক্রমে একটা প্রধান কর্ম হইয়া উঠিয়াছিল। সময়ে সময়ে ঐ নিয়মের যে ব্যতিক্রম হয় নাই, তাহা নহে। কিন্তু ঠাকুর তাঁহার প্রতি প্রথম হইতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে ঐ নিয়ম বড় একটা ভঙ্গ করিতে দেন নাই। কোন কারণে নরেন্দ্রনাথ এক সপ্তাহ দক্ষিণেশ্বরে না আসিতে পারিলে ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য এককালে অধীর হইয়া উঠিতেন এবং উপর্যুপরি সংবাদ পাঠাইয়া তাঁহাকে নিজ সকাশে আনয়ন করিতেন, অথবা স্বয়ং কলিকাতায় আগমনপূর্বক তাঁহার সহিত কয়েক ঘণ্টা কাল অতিবাহিত করিয়া আসিতেন। আমাদের যতদূর জানা আছে, ঠাকুরের সহিত পরিচিত হইবার পরে প্রথম দুই বৎসর ঐরূপে নরেন্দ্রের দক্ষিণেশ্বরে নিয়মিতভাবে গমনাগমনের বড় একটা ব্যতিক্রম হয় নাই। কিন্তু বি.এ. পরীক্ষা দিবার পরে ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম ভাগে পিতার সহসা মৃত্যু হইয়া সংসারের সমস্ত ভার যখন তাঁহার স্কন্ধে নিপতিত হইল, তখন নানা কারণে কিছুদিনের জন্য তিনি পূর্বোক্ত নিয়ম ভঙ্গ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
নরেন্দ্রের সহিত ঠাকুরের উক্ত কালের আচরণের পাঁচটি বিভাগ
সে যাহা হউক, উক্ত পাঁচ বৎসর কাল ঠাকুর যেভাবে নরেন্দ্রনাথের সহিত মিলিত হইয়াছিলেন, তাহার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলে উহাতে পাঁচটি প্রধান বিভাগ নয়নগোচর হয় –
১ম – দেখা যায়, ঠাকুর তাঁহার অলৌকিক অন্তর্দৃষ্টি-সহায়ে প্রথম সাক্ষাৎ হইতেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন নরেন্দ্রনাথের ন্যায় উচ্চ অধিকারী আধ্যাত্মিক রাজ্যে বিরল, এবং বহুকালসঞ্চিত গ্লানি দূরপূর্বক সনাতনধর্মকে যুগপ্রয়োজনসাধনানুযায়ী করিয়া সংস্থাপনরূপ যে কার্যে শ্রীশ্রীজগদম্বা তাঁহাকে নিযুক্ত করিয়াছেন, তাহাতে বিশেষ সহায়তা করিবার জন্যই শ্রীযুত নরেন্দ্র জন্মপরিগ্রহ করিয়াছেন।
২য় – অসীম বিশ্বাস ও ভালবাসায় তিনি নরেন্দ্রনাথকে চিরকালের নিমিত্ত আবদ্ধ করিয়াছিলেন।
৩য় – নানাভাবে পরীক্ষা করিয়া তিনি বুঝিয়া লইয়াছিলেন যে, তাঁহার অন্তর্দৃষ্টি নরেন্দ্রনাথের মহত্ত্ব এবং জীবনোদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁহার নিকটে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে নাই।
৪র্থ – নানাভাবে শিক্ষা প্রদানপূর্বক তিনি নরেন্দ্রনাথকে উক্ত সুমহান জীবনোদ্দেশ্য-সাধনের উপযোগী যন্ত্রস্বরূপে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন।
৫ম – শিক্ষার পরিসমাপ্তি হইলে অপরোক্ষ-বিজ্ঞান-সম্পন্ন নরেন্দ্রনাথকে তিনি, কিরূপে ধর্মসংস্থাপনকার্যে অগ্রসর হইতে হইবে, তদ্বিষয়ে উপদেশ প্রদানপূর্বক পরিণামে উক্ত কার্যের এবং নিজ সঙ্ঘের ভার তাঁহার হস্তে নিশ্চিন্তমনে অর্পণ করিয়াছিলেন।
অদ্ভুত দর্শন হইতে ঠাকুরের নরেন্দ্রের উপর বিশ্বাস ও ভালবাসা
আমরা ইতঃপূর্বে বলিয়াছি, নরেন্দ্রনাথের দক্ষিণেশ্বর আগমনের স্বল্পকাল পূর্বে তদীয় মহত্ত্ব-পরিচায়ক কয়েকটি অদ্ভুত দর্শন ঠাকুরের অন্তর্দৃষ্টি-সম্মুখে প্রতিভাত হইয়াছিল। উহাদিগের প্রভাবেই তিনি নরেন্দ্রকে প্রথম হইতে অসীম বিশ্বাস ও ভালবাসার নয়নে নিরীক্ষণ করিয়াছিলেন। ঐ বিশ্বাস ও ভালবাসা তাঁহার হৃদয়ে আজীবন সমভাবে প্রবাহিত থাকিয়া নরেন্দ্রনাথকে তাঁহার প্রেমে আবদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছিল। অতএব বুঝা যাইতেছে, বিশ্বাস ও ভালবাসার ভিত্তিতে সর্বদা দণ্ডায়মান থাকিয়া ঠাকুর নরেন্দ্রকে শিক্ষাপ্রদান ও সময়ে সময়ে পরীক্ষা করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন।
নরেন্দ্রকে পরীক্ষা করিবার কারণ
প্রশ্ন হইতে পারে, যোগদৃষ্টি-সহায়ে নরেন্দ্রনাথের মহত্ত্ব এবং জীবনোদ্দেশ্য জানিতে পারিয়াও ঠাকুর তাঁহাকে পরীক্ষা করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন কেন? উত্তরে বলা যাইতে পারে, মায়ার অধিকারে প্রবিষ্ট হইয়া দেহধারণ করিলে মানবসাধারণের কা কথা – ঠাকুরের ন্যায় দেব-মানবদিগের দৃষ্টিও স্বল্পবিস্তর পরিচ্ছিন্ন হইয়া দৃষ্ট-বিষয়ে ভ্রম-সম্ভাবনা উপস্থিত করে। সেজন্যই কখনও কখনও ঐরূপ পরীক্ষার আবশ্যক হইয়া থাকে। ঠাকুর আমাদিগকে ঐ বিষয় বুঝাইতে যাইয়া বলিতেন, “খাদ না থাকিলে গড়ন হয় না”, অথবা বিশুদ্ধ স্বর্ণের সহিত অন্য ধাতু মিলিত না করিলে যেমন উহাতে অলঙ্কার গঠন করা চলে না, সেইরূপ জ্ঞানপ্রকাশক শুদ্ধ সত্ত্বগুণের সহিত রজঃ ও তমোগুণ কিঞ্চিন্মাত্র মিলিত না হইলে উহা হইতে অবতার-পুরুষদিগের ন্যায় দেহ-মনও উৎপন্ন হইতে পারে না। ঠাকুরের সাধনকালের আলোচনা করিতে যাইয়া আমরা ইতঃপূর্বে দেখিয়াছি, শ্রীশ্রীজগদম্বার কৃপায় অদ্ভুত জ্ঞানপ্রকাশ উপস্থিত হইয়া অলৌকিক দর্শনসমূহ তাঁহার জীবনে উপস্থিত হইলেও, তিনি কত সময়ে ঐসকল দর্শন সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া পুনরায় পরীক্ষা করিয়া তবে উহাদিগকে নিশ্চিন্তমনে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অতএব নরেন্দ্রনাথের সম্বন্ধেও তাঁহার যে-সকল অদ্ভুত দর্শন এখন উপস্থিত হইয়াছিল সে-সকলকেও তিনি যে পরীক্ষাপূর্বক গ্রহণ করিবেন ইহাতে বিচিত্র কি আছে?
ঠাকুর নরেন্দ্রকে যেভাবে দেখিতেন
নরেন্দ্রনাথের প্রতি ঠাকুরের আচরণের পাঁচটি বিভিন্ন বিভাগ পূর্বোক্তরূপে নির্দিষ্ট হইলেও, উহাদিগের মধ্যে বিশ্বাস ও ভালবাসা, পরীক্ষা এবং শিক্ষাপ্রদানরূপ তিনটি বিভাগের কার্য যে প্রায় যুগপৎ আরব্ধ হইয়াছিল, এ কথা স্বীকার করিতে হয়। উক্ত তিন বিভাগের মধ্যে প্রথম বিভাগের কার্যের, অথবা নরেন্দ্রনাথের প্রতি ঠাকুরের অসীম বিশ্বাস ও ভালবাসার পরিচয় আমরা ইতঃপূর্বে পাঠককে সংক্ষেপে দিয়াছি। ঐ বিষয়ের আরও অনেক কথা আমাদিগকে পরে বলিতে হইবে। কারণ, এখন হইতে ঠাকুরের জীবন নরেন্দ্রনাথের জীবনের সহিত যেরূপ বিশেষভাবে জড়িত হইয়াছিল, তাঁহার শ্রীচরণাশ্রিত অন্য কোন ভক্তের জীবনের সহিত উহা ইতঃপূর্বে আর কখনও ঐরূপে মিলিত হয় নাই। কথিত আছে, ভগবান ঈশা তাঁহার কোন শিষ্যপ্রবরের সহিত মিলিত হইবামাত্র বলিয়াছিলেন, “পর্বতসদৃশ অচল অটল শ্রদ্ধাসম্পন্ন এই পুরুষের জীবনকে ভিত্তিস্বরূপে অবলম্বন করিয়া আমি আমার আধ্যাত্মিক মন্দির গঠিত করিয়া তুলিব!” নরেন্দ্রনাথের সহিত মিলিত হইয়া ঠাকুরের মনেও ঐরূপ ভাব দৈবপ্রেরণায় প্রথম হইতেই উপস্থিত হইয়াছিল। ঠাকুর দেখিয়াছিলেন, নরেন্দ্র তাঁহার বালক, তাঁহার সখা, তাঁহার আদেশ পালন করিতেই সংসারে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এবং তাঁহার ও তাহার জীবন পূর্ব হইতে চিরকালের মতো প্রণয়িযুগলের ন্যায় অবিচ্ছিন্ন প্রেমবন্ধনে সম্বদ্ধ হইয়া রহিয়াছে! – তবে, ঐ প্রেম উচ্চ আধ্যাত্মিক প্রেম – যাহা প্রেমাস্পদকে সর্বপ্রকার স্বাধীনতা প্রদান করিয়াও যুগে যুগে আপনার করিয়া রাখে, যাহাতে আপনার জন্য কিছু না চাহিয়া পরস্পর পরস্পরকে যথাসর্বস্বদানেই কেবলমাত্র পরিতৃপ্তিলাভ করে। বাস্তবিক ঠাকুর ও নরেন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা অহেতুক প্রেমের যেরূপ অভিনয় দেখিয়াছি, সংসার ইতঃপূর্বে আর কখনও ঐরূপ দেখিয়াছে কিনা সন্দেহ। সেই অলৌকিক প্রেমাভিনয়ের কথা পাঠককে যথাযথভাবে বুঝাইবার আমাদিগের সামর্থ্য কোথায়? তথাপি সত্যানুরোধে উহার আভাসপ্রদানের চেষ্টামাত্র করিয়া আমরা নরেন্দ্রনাথের সহিত ঠাকুরের সর্বপ্রকার আচরণের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি।
নরেন্দ্রের সম্বন্ধে সাধারণের ভ্রমধারণা
ঠাকুরের একনিষ্ঠা, ত্যাগ এবং পবিত্রতা দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ যেমন তাঁহার প্রতি প্রথম দিন হইতে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, ঠাকুরও বোধ হয় তেমনি যুবক নরেন্দ্রের অসীম আত্মবিশ্বাস, তেজস্বিতা এবং সত্যপ্রিয়তা-দর্শনে মুগ্ধ হইয়া প্রথম দর্শন হইতে তাঁহাকে আপনার করিয়া লইয়াছিলেন। যোগদৃষ্টি-সহায়ে নরেন্দ্রনাথের মহত্ত্ব ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ঠাকুর যাহা দর্শন করিয়াছিলেন, তাহা গণনায় না আনিয়া যদি আমরা এই পুরুষপ্রবরের পরস্পরের প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণের কারণ-অন্বেষণে প্রবৃত্ত হই তাহা হইলে পূর্বোক্ত কথাই প্রতীয়মান হয়। অন্তর্দৃষ্টিশূন্য জনসাধারণ শ্রীযুত নরেন্দ্রের অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসকে দম্ভ বলিয়া, অসীম তেজস্বিতাকে ঔদ্ধত্য বলিয়া এবং কঠোর সত্যপ্রিয়তাকে মিথ্যাভান অথবা অপরিণত বুদ্ধির নিদর্শন বলিয়া ধারণা করিয়াছিল। লোকপ্রশংসালাভে তাঁহার একান্ত উদাসীনতা, স্পষ্টবাদিতা, সর্ববিষয়ে নিঃসঙ্কোচ স্বাধীন ব্যবহার এবং সর্বোপরি কোন কার্য কাহারও ভয়ে গোপন না করা হইতেই তাহারা যে ঐরূপ মীমাংসায় উপনীত হইয়াছিল, এ কথা নিঃসন্দেহ। আমাদের মনে আছে, শ্রীযুত নরেন্দ্রের সহিত পরিচিত হইবার পূর্বে তাঁহার জনৈক প্রতিবেশী তাঁহার কথা উল্লেখ করিয়া একদিন আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, “এই বাটীতে একটা ছেলে আছে, তাহার মতো ত্রিপণ্ড ছেলে কখনও দেখি নাই; বি.এ. পাশ করেছে বলে যেন ধরাকে সরা দেখে, বাপ-খুড়োর সামনেই তবলায় চাঁটি দিয়ে গান ধরলে, পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে দিয়েই চুরুট খেতে খেতে চলল – এইরূপ সকল বিষয়ে!”
ঠাকুরের নিকট হইতে গ্রন্থকারের নরেন্দ্রের প্রশংসা-শ্রবণ
উহার স্বল্পকাল পরে ঠাকুরের শ্রীপদপ্রান্তে উপস্থিত হইয়া একদিন – বোধ হয় সেদিন আমরা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিয়া তাঁহার পুণ্য-দর্শনলাভে ধন্য হইয়াছিলাম – আমরা নরেন্দ্রনাথের গুণানুবাদ এইরূপে শুনিতে পাইয়াছিলাম – রতন নামক যদুলাল মল্লিকের উদ্যানবাটীর প্রধান কর্মচারীর সহিত কথা কহিতে কহিতে আমাদিগকে দেখাইয়া ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “এরা সব ছেলে মন্দ নয়, দেড়টা পাস করিয়াছে (এফ.এ. পাস দিবার জন্য সেই বৎসর আমরা প্রস্তুত হইতেছিলাম), শিষ্ট, শান্ত; কিন্তু নরেন্দ্রের মতো একটি ছেলেও আর দেখিতে পাইলাম না! – যেমন গাইতে-বাজাতে, তেমনি লেখাপড়ায়, তেমনি বলতে-কইতে, আবার তেমনি ধর্মবিষয়ে! সে রাত-ভোর ধ্যান করে, ধ্যান করতে করতে সকাল হয়ে যায়, হুঁশ থাকে না! – আমার নরেন্দ্রের ভিতর এতটুকু মেকি নাই, বাজিয়ে দেখ – টং টং করছে। আর সব ছেলেদের দেখি, যেন চোক-কান টিপে কোন রকমে দু-তিনটে পাস করেছে, ব্যস, এই পর্যন্ত – ঐ করতেই যেন তাদের সমস্ত শক্তি বেরিয়ে গেছে। নরেন্দ্রের কিন্তু তা নয়, হেসে-খেলে সব কাজ করে, পাস করাটা যেন তার কাছে কিছুই নয়! সে ব্রাহ্মসমাজেও যায়, সেখানে ভজন গায়, কিন্তু অন্য সকল ব্রাহ্মের ন্যায় নয় – সে যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞানী। ধ্যান করতে বসে তার জ্যোতিঃদর্শন হয়। সাধে নরেন্দ্রকে এত ভালবাসি?” ঐরূপ শ্রবণে মুগ্ধ হইয়া নরেন্দ্রনাথের সহিত পরিচিত হইবার মানসে আমরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মহাশয়, নরেন্দ্র কোথায় থাকে?” তদুত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “নরেন্দ্র বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র, বাড়ি সিমলায়।” পরে কলিকাতায় ফিরিয়া অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছিলাম, আমরা ইতঃপূর্বে প্রতিবেশীর নিকট হইতে যাহার সম্বন্ধে পূর্বোক্ত নিন্দাবাদ শুনিয়াছিলাম সেই যুবকই ঠাকুরের বহুপ্রশংসিত নরেন্দ্রনাথ! বিস্মিত হইয়া আমরা সেদিন ভাবিয়াছিলাম, বাহিরের কতকগুলি কার্যমাত্র অবলম্বন করিয়া আমরা সময়ে সময়ে অপরের সম্বন্ধে কতদূর অন্যায় সিদ্ধান্ত করিয়া বসি!
প্রথম দর্শনদিবসে নরেন্দ্রের সম্বন্ধে গ্রন্থকারের ভ্রমধারণা
পূর্বোক্ত প্রসঙ্গে আর একটি কথা এখানে বলিলে মন্দ হইবে না। ঠাকুরের শ্রীমুখে নরেন্দ্রনাথের ঐরূপ গুণানুবাদ শুনিবার কয়েক মাস পূর্বে জনৈক বন্ধুর ভবনে শ্রীযুত নরেন্দ্রের দর্শনলাভ একদিন আমাদিগের ভাগ্যে উপস্থিত হইয়াছিল। সেদিন তাঁহাকে দর্শনমাত্রই করিয়াছিলাম, ভ্রমধারণাবশতঃ তাঁহার সহিত আলাপ করিতে অগ্রসর হই নাই। কিন্তু তাঁহার সেইদিনকার কথাগুলি এমন গভীরভাবে আমাদিগের স্মৃতিতে মুদ্রিত হইয়া গিয়াছে যে, এতকাল পরেও উহাদিগকে যেন কাল শুনিয়াছি এইরূপ মনে হইয়া থাকে। কথাগুলি বলিবার পূর্বে যে অবস্থায় আমরা উহাদিগকে শ্রবণ করিয়াছিলাম, তদ্বিষয়ে কিঞ্চিৎ আভাস পাঠককে দেওয়া কর্তব্য; নতুবা শ্রীযুত নরেন্দ্রের সম্বন্ধে সেদিন আমাদিগের কেন ভ্রমধারণা উপস্থিত হইয়াছিল, সে কথা বুঝিতে পারা যাইবে না।
জনৈক বন্ধুর ভবনে নরেন্দ্রকে প্রথম দেখা
যে বন্ধুর আলয়ে আমরা সেদিন শ্রীযুত নরেন্দ্রকে দেখিয়াছিলাম, তিনি তখন কলিকাতার সিমলাপল্লীস্থ গৌরমোহন মুখার্জী লেনে নরেন্দ্রের বাসভবনের সম্মুখেই একটি দ্বিতলবাটী ভাড়া করিয়াছিলেন। স্কুলে পড়িবার কালে আমরা চারি-পাঁচ বৎসর সহপাঠী ছিলাম। প্রবেশিকা পরীক্ষা দিবার দুই বৎসর পূর্বে তিনি বিলাত যাইবেন বলিয়া বোম্বাই পর্যন্ত গমন করিয়াছিলেন। কিন্তু নানা কারণে সমুদ্রপারে গমনে অসমর্থ হইয়া একখানি সংবাদপত্রের সম্পাদক হইয়াছিলেন এবং মধ্যে মধ্যে বাঙলায় প্রবন্ধ ও কবিতা লিখিয়া পুস্তকসকল প্রণয়ন করিতেছিলেন। কিছুকাল পূর্বে তিনি বিবাহ করিয়াছিলেন এবং ঐ ঘটনার পরে নানা লোকের মুখে শুনিতে পাইয়াছিলাম, তাঁহার স্বভাব উচ্ছৃঙ্খল হইয়াছে এবং নানা অসদুপায়ে অর্থোপার্জন করিতে তিনি কুণ্ঠিত হইতেছেন না। ঘটনা সত্য বা মিথ্যা নির্ধারণ করিবার জন্যই আমরা সেদিন সহসা তাঁহার ভবনে উপস্থিত হইয়াছিলাম।
ঐ কালে নরেন্দ্রের বাহ্যিক আচরণ
ভৃত্যের দ্বারা সংবাদ পাঠাইয়া আমরা বাহিরের ঘরে উপবিষ্ট আছি, এমন সময়ে একজন যুবক সহসা সেই ঘরে প্রবিষ্ট হইলেন এবং গৃহস্বামীর পরিচিতের ন্যায় নিঃসঙ্কোচে নিকটস্থ একটি তাকিয়ায় অর্ধশায়িত হইয়া একটি হিন্দী গীতের একাংশ গুনগুন করিয়া গাহিতে লাগিলেন। যতদূর মনে আছে, গীতটি শ্রীকৃষ্ণবিষয়ক, কারণ, ‘কানাই’ ও ‘বাঁশরী’ এই দুইটি শব্দ কর্ণে স্পষ্ট প্রবেশ করিয়াছিল। শৌখিন না হইলেও, যুবকের পরিষ্কার পরিচ্ছদ, কেশের পারিপাট্য এবং উন্মনা দৃষ্টির সহিত ‘কালার বাঁশরী’র গান ও আমাদিগের উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুর সহ ঘনিষ্ঠতার সংযোগ করিয়া লইয়া আমরা তাঁহাকে বিশেষ সুনয়নে দেখিতে পাইলাম না। গৃহমধ্যে আমরা যে বসিয়া রহিয়াছি তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করিয়া, তাঁহাকে ঐরূপ নিঃসঙ্কোচ ব্যবহার এবং পরে তামাকু সেবন করিতে দেখিয়া আমরা ধারণা করিয়া বসিলাম, আমাদিগের উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুর ইনি একজন বিশ্বস্ত অনুচর এবং এইরূপ লোকের সহিত মিলিত হইয়াই তাঁহার অধঃপতন হইয়াছে। সে যাহা হউক, গৃহমধ্যে আমাদের অস্তিত্ব দেখিয়াও তিনি ঐরূপ বিষম উদাসীনতা অবলম্বন করিয়া আপন ভাবে থাকায়, আমরাও তাঁহার সহিত পরিচয়ে অগ্রসর হইলাম না।
বন্ধুর সহিত নরেন্দ্রের সাহিত্য-সম্বন্ধীয় আলাপ
কিছুক্ষণ পরে আমাদিগের বাল্যবন্ধু বাহিরে আসিলেন এবং বহুকাল পরে পরস্পরে সাক্ষাৎলাভ করিলেও, আমাদিগের দুই-একটি কথামাত্র জিজ্ঞাসা করিয়াই পূর্বোক্ত যুবকের সহিত সানন্দে নানা বিষয়ের আলাপে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার ঐরূপ উদাসীনতা ভাল লাগিল না। তথাপি সহসা বিদায়গ্রহণ করাটা ভদ্রোচিত নহে ভাবিয়া, সাহিত্যসেবী বন্ধু যুবকের সহিত ইংরাজী ও বঙ্গ সাহিত্য সম্বন্ধে যে বাক্যালাপে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, আমরা তদ্বিষয়ে শ্রবণ করিতে লাগিলাম। উচ্চাঙ্গের সাহিত্য যথাযথ ভাবপ্রকাশক হইবে, এই বিষয়ে উভয়ে অনেকাংশে একমত হইয়া কথা আরম্ভ করিলেও, মনুষ্যজীবনের যে-কোন প্রকার ভাবপ্রকাশক রচনাকেই সাহিত্য বলা উচিত কিনা, তদ্বিষয়ে তাঁহাদের মতভেদ উপস্থিত হইয়াছিল। যতদূর মনে আছে, সকল প্রকার ভাবপ্রকাশক রচনাকেই সাহিত্যশ্রেণীভুক্ত করিবার পক্ষ আমাদিগের বন্ধু অবলম্বন করিয়াছিলেন, এবং যুবক ঐ পক্ষ খণ্ডনপূর্বক তাঁহাকে বুঝাইতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন যে, সু বা কু যে কোন প্রকার ভাব যথাযথ প্রকাশ করিলেও রচনাবিশেষ যদি সুরুচিসম্পন্ন এবং কোন প্রকার উচ্চাদর্শের প্রতিষ্ঠাপক না হয়, তাহা হইলে উহাকে কখনই উচ্চাঙ্গের সাহিত্যশ্রেণীমধ্যে পরিগণিত করা যাইতে পারে না। আপন পক্ষ সমর্থনের জন্য যুবক তখন ‘চসর’ (Chaucer) হইতে আরম্ভ করিয়া যত খ্যাতনামা ইংরাজী ও বাঙলা সাহিত্যিকের পুস্তকসকলের উল্লেখ করিয়া একে একে দেখাইতে লাগিলেন তাঁহারা সকলেই ঐরূপ করিয়া সাহিত্যজগতে অমরত্ব লাভ করিয়াছেন। উপসংহারে যুবক বলিয়াছিলেন, “সু এবং কু সকল প্রকার ভাব উপলব্ধি করিলেও, মানুষ তাহার অন্তরের আদর্শবিশেষকে প্রকাশ করিতেই সর্বদা সচেষ্ট রহিয়াছে। আদর্শবিশেষের উপলব্ধি ও প্রকাশ লইয়াই মানবদিগের ভিতর যত তারতম্য বর্তমান। দেখা যায়, সাধারণ মানব রূপরসাদি ভোগসকলকে নিত্য ও সত্য ভাবিয়া তল্লাভকেই সর্বদা জীবনোদ্দেশ্য করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আছে – They idealise what is apparently real. পশুদিগের সহিত তাহাদিগের স্বল্পই প্রভেদ। তাহাদিগের দ্বারা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সৃষ্টি কখনই হইতে পারে না। আর এক শ্রেণীর মানব আছে, যাহারা আপাতনিত্য ভোগসুখাদিলাভে সন্তুষ্ট থাকিতে না পারিয়া উচ্চ উচ্চতর আদর্শসকল অন্তরে অনুভব করিয়া বহিঃস্থ সকল বিষয় সেই ছাঁচে গড়িবার চেষ্টায় ব্যস্ত হইয়া রহিয়াছে – They want to realise the ideal. – ঐরূপ মানবই যথার্থ সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়া থাকে। উহাদিগের মধ্যে আবার যাহারা সর্বোচ্চ আদর্শ অবলম্বন করিয়া উহা জীবনে পরিণত করিতে ছুটে, তাহাদিগকে প্রায়ই সংসারের বাহিরে যাইয়া দাঁড়াইতে হয়। ঐরূপ আদর্শ জীবনে পূর্ণভাবে পরিণত করিতে দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসদেবকেই কেবলমাত্র দেখিয়াছি – সেজন্যই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করিয়া থাকি।”
উহার পরে ঠাকুরের নিকটে নরেন্দ্রের মহত্ত্বের পরিচয়লাভ
যুবকের ঐ প্রকার গভীর ভাবপূর্ণ বাক্য এবং পাণ্ডিত্যে সেদিন চমৎকৃত হইলেও, আমাদিগের বন্ধুর সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ দেখিয়া তাঁহার কথায় ও কাজে মিল নাই ভাবিয়া আমরা ক্ষুণ্ণ হইয়াছিলাম। অনন্তর বিদায় গ্রহণপূর্বক আমরা সে স্থান হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম। ঐ ঘটনার কয়েক মাস পরে আমরা ঠাকুরের নিকটে শ্রীযুত নরেন্দ্রের গুণানুবাদশ্রবণে মুগ্ধ হইয়া তাঁহার সহিত পরিচিত হইবার জন্য তাঁহার আলয়ে উপস্থিত হইয়াছিলাম এবং পূর্বপরিদৃষ্ট যুবককে ঠাকুরের বহুপ্রশংসিত নরেন্দ্রনাথ বলিয়া জানিতে পারিয়া বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইয়াছিলাম।
প্রথম দেখা হইতে ঠাকুরের নরেন্দ্রকে বুঝিতে পারা
গতানুগতিক স্বভাবসম্পন্ন সাধারণ মানব ঐরূপে নরেন্দ্রনাথের বাহ্য আচরণসমূহ দেখিয়া তাঁহাকে দাম্ভিক, উদ্ধত এবং অনাচারী প্রভৃতি বলিয়া অনেক সময় ধারণা করিয়া বসিলেও ঠাকুর কিন্তু তাঁহার সম্বন্ধে কখনও ঐরূপ ভ্রমে পতিত হয়েন নাই। প্রথম দর্শনকাল হইতেই তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, নরেন্দ্রের দম্ভ ও ঔদ্ধত্য তাঁহার অন্তর্নিহিত অসাধারণ মানসিক শক্তিসমূহের ফলস্বরূপ বিশাল আত্মবিশ্বাস হইতে সমুদিত হয়, তাঁহার নিরঙ্কুশ স্বাধীন আচরণ তাঁহার স্বাভাবিক আত্মসংযমের পরিচায়ক ভিন্ন অন্য কিছু নহে, তাঁহার লোকমান্যে উদাসীনতা তদীয় পূত স্বভাবের আত্মপ্রসাদ হইতেই সমুত্থিত হইয়া থাকে। তিনি বুঝিয়াছিলেন, কালে নরেন্দ্রের অসাধারণ স্বভাব সহস্রদল কমলের ন্যায় পূর্ণবিকশিত হইয়া নিজ অনুপম গৌরব ও মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হইবে। তখন তাপদগ্ধ সংসারের সংঘর্ষে আসিয়া তাঁহার ঐ দম্ভ ও ঔদ্ধত্য অসীম করুণাকারে পরিণত হইবে, তাঁহার অদৃষ্টপূর্ব আত্মবিশ্বাস হতাশ প্রাণে বিশ্বাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিবে, তাঁহার স্বাধীন আচরণ সংযমরূপ সীমায় সর্বদা অবস্থিত থাকিয়া যথার্থ স্বাধীনতালাভের উহাই একমাত্র পথ বলিয়া অপরকে নির্দেশ করিবে।
উচ্চ আধার বুঝিয়া নরেন্দ্রকে প্রকাশ্যে প্রশংসা
সেইজন্যই দেখিতে পাওয়া যায়, প্রথম পরিচয়ের দিন হইতেই ঠাকুর সকলের নিকটে শতমুখে নরেন্দ্রের প্রশংসা করিতেছেন! প্রকাশ্যভাবে সর্বদা প্রশংসালাভ করিলে দুর্বল মনে অহঙ্কার প্রবৃদ্ধ হইয়া তাহাকে বিনাশের পথে অগ্রসর করে, এ কথা বিশেষভাবে জানিয়াও যে তিনি নরেন্দ্রনাথের সম্বন্ধে ঐ নিয়মের ব্যতিক্রম করিয়াছিলেন, তাহার কারণ – তিনি নিশ্চয় বুঝিয়াছিলেন নরেন্দ্রের হৃদয়-মন ঐরূপ দুর্বলতা হইতে অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করিতেছে। ঐ বিষয়ক কয়েকটি দৃষ্টান্তের এখানে উল্লেখ করিলেই পাঠক ঐ কথা বুঝিতে পারিবেন –
নরেন্দ্রের অন্তর্নিহিত শক্তি সম্বন্ধে ঠাকুরের কথা
মহামনস্বী শ্রীযুত কেশবচন্দ্র সেন, শ্রীযুত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রভৃতি লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্রাহ্মনেতৃগণ ঠাকুরের সহিত সম্মিলিত হইয়া একদিন একত্র সমাসীন রহিয়াছেন। যুবক নরেন্দ্রও তথায় উপবিষ্ট আছেন। ঠাকুর ভাবমুখে অবস্থিত হইয়া প্রসন্নমনে কেশব ও বিজয়ের প্রতি দৃষ্টি করিতে লাগিলেন। পরে নরেন্দ্রনাথের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হইবামাত্র তাহার ভাবী জীবনের উজ্জ্বল চিত্র তাঁহার মানসপটে সহসা অঙ্কিত হইয়া উঠিল এবং উহার সহিত কেশবপ্রমুখ ব্যক্তিদিগের পরিণত জীবনের তুলনা করিয়া তিনি পরম স্নেহে নরেন্দ্রনাথকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। পরে সভাভঙ্গ হইলে বলিলেন, “দেখিলাম, কেশব যেরূপ একটা শক্তির বিশেষ উৎকর্ষে জগদ্বিখ্যাত হইয়াছে, নরেন্দ্রের ভিতর ঐরূপ আঠারটা শক্তি পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান! আবার দেখিলাম, কেশব ও বিজয়ের অন্তর দীপশিখার ন্যায় জ্ঞানালোকে উজ্জ্বল রহিয়াছে; পরে নরেন্দ্রের দিকে চাহিয়া দেখি, তাহার ভিতরের জ্ঞান-সূর্য উদিত হইয়া মায়া-মোহের লেশ পর্যন্ত তথা হইতে দূরীভূত করিয়াছে!” অন্তর্দৃষ্টিশূন্য দুর্বলচেতা মানব ঠাকুরের শ্রীমুখ হইতে ঐরূপ প্রশংসা লাভ করিলে, অহঙ্কারে স্ফীত হইয়া আত্মহারা হইয়া পড়িত। নরেন্দ্রের মনে কিন্তু উহাতে সম্পূর্ণ বিপরীত ফলের উদয় হইল। তাঁহার অলৌকিক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মন উহাতে আপনার ভিতরে ডুবিয়া যাইয়া, শ্রীযুত কেশব ও বিজয়ের অশেষ গুণরাজির সহিত নিজ তাৎকালিক মানসিক অবস্থার নিরপেক্ষ তুলনায় প্রবৃত্ত হইল, এবং আপনাকে ঐরূপ প্রশংসালাভের অযোগ্য দেখিয়া ঠাকুরের কথার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলিয়া উঠিল – “মহাশয়, করেন কি? লোকে আপনার ঐরূপ কথা শুনিয়া আপনাকে উন্মাদ বলিয়া নিশ্চয় করিবে। কোথায় জগদ্বিখ্যাত কেশব ও মহামনা বিজয় এবং কোথায় আমার ন্যায় একটা নগণ্য স্কুলের ছোঁড়া! – আপনি তাঁহাদিগের সহিত আমার তুলনা করিয়া আর কখনও ঐরূপ কথাসকল বলিবেন না।” ঠাকুর উহাতে তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া বলিয়াছিলেন, “কি করব রে, তুই কি ভাবিস আমি ঐরূপ বলিয়াছি, মা (শ্রীশ্রীজগদম্বা) আমাকে ঐরূপ দেখাইলেন, তাই বলিয়াছি; মা তো আমাকে সত্য ভিন্ন মিথ্যা কখনও দেখান নাই, তাই বলিয়াছি।”
নরেন্দ্রের ঐ কথার প্রতিবাদ
‘মা দেখাইয়াছেন ও বলাইয়াছেন’ বলিলেই ঠাকুর ঐরূপ স্থলে নরেন্দ্রের হস্তে সর্বদা নিষ্কৃতি পাইতেন, তাহা নহে। তাঁহার ঐরূপ দর্শনসকলের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ হইয়া স্পষ্টবাদী নির্ভীক নরেন্দ্র অনেক সময়ে বলিয়া বসিতেন, “মা দেখাইয়া থাকেন, অথবা আপনার মাথার খেয়ালে ঐসকল উপস্থিত হয়, তাহা কে বলিতে পারে? আমার ঐরূপ হইলে আমি নিশ্চয় বুঝিতাম, আমার মাথার খেয়ালে ঐরূপ দেখিতে পাইতেছি। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শন এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত করিয়াছে যে, চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয়সকল আমাদিগকে অনেক স্থলে প্রতারিত করে। তদুপরি বিষয়বিশেষ-দর্শনের বাসনা যদি আমাদিগের মনে সতত জাগরিত থাকে, তাহা হইলে তো কথাই নাই, উহারা (ইন্দ্রিয়গ্রাম) আমাদিগকে পদে পদে প্রতারিত করিয়া থাকে। আপনি আমাকে স্নেহ করেন এবং সকল বিষয়ে আমাকে বড় দেখিতে ইচ্ছা করেন – সেইজন্য হয়তো আপনার ঐরূপ দর্শনসকল আসিয়া উপস্থিত হয়।”
নরেন্দ্রের তর্কশক্তিতে মুগ্ধ হইয়া ঠাকুরের জগন্মাতাকে জিজ্ঞাসা
ঐরূপ বলিয়া শ্রীযুত নরেন্দ্র পাশ্চাত্য শারীর-বিজ্ঞানে স্বসংবেদ্য দর্শনসমূহ-সম্বন্ধে যেসকল অনুসন্ধান ও গবেষণা আছে এবং যেরূপে তাহাদিগকে ভ্রমসঙ্কুল বলিয়া প্রমাণিত করা হইয়াছে, সেইসকল বিষয় নানা দৃষ্টান্তসহায়ে ঠাকুরকে বুঝাইতে সময়ে সময়ে অগ্রসর হইতেন। ঠাকুরের মন যখন উচ্চ ভাবভূমিতে অবস্থান করিত, তখন নরেন্দ্রের ঐরূপ বাল-সুলভ চেষ্টাকে সত্যনিষ্ঠার পরিচায়কমাত্র ভাবিয়া তিনি তাহার উপর অধিকতর প্রসন্ন হইতেন। কিন্তু সাধারণ ভাবভূমিতে অবস্থানকালে নরেন্দ্রের তীক্ষ্ণ যুক্তিসকল ঠাকুরের বালকের ন্যায় স্বভাবসম্পন্ন সরল মনকে অভিভূত করিয়া কখনও কখনও বিষম ভাবাইয়া তুলিত। তখন মুগ্ধ হইয়া তিনি ভাবিতেন, ‘তাইতো, কায়মনোবাক্যে সত্যপরায়ণ নরেন্দ্র তো মিথ্যা বলিবার লোক নহে; তাহার ন্যায় দৃঢ় সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিসকলের মনে সত্য ভিন্ন মিথ্যা সঙ্কল্পের উদয় হয় না, এ কথা শাস্ত্রেও আছে; তবে কি আমার দর্শনসমূহে ভ্রমসম্ভাবনা আছে?’ আবার ভাবিতেন, ‘কিন্তু আমি তো ইতঃপূর্বে নানারূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি, মা (শ্রীশ্রীজগদম্বা) আমাকে সত্য ভিন্ন মিথ্যা কখনও দেখান নাই এবং তাঁহার শ্রীমুখ হইতে বারংবার আশ্বাসও পাইয়াছি, তবে সত্যপ্রাণ নরেন্দ্র আমার দর্শনসকল মাথার খেয়ালে উপস্থিত হয়, এ কথা বলে কেন? – কেন তাহার মন বলিবামাত্র ঐসকলকে সত্য বলিয়া উপলব্ধি করে না?’
ঐরূপ ভাবনায় পতিত হইয়া মীমাংসার জন্য ঠাকুর অবশেষে শ্রীশ্রীজগদম্বাকে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিতেন এবং “ওর (নরেন্দ্রের) কথা শুনিস কেন? কিছুদিন পরে ও (নরেন্দ্র) সব কথা সত্য বলে মানবে” – তাঁহার শ্রীমুখ হইতে এইরূপ আশ্বাস-বাণী শুনিয়া তবে নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপে এখানে একদিনের ঘটনার উল্লেখ করিলেই পাঠকের পূর্বোক্ত বিষয় হৃদয়ঙ্গম হইবে।
ঐ বিষয়ক দৃষ্টান্ত – সাধারণ সমাজে ঠাকুরের নরেন্দ্রকে দেখিতে আসা
তখন কুচবিহার-বিবাহে মতভেদ লইয়া ব্রাহ্মগণ দুই দলে বিভক্ত হইয়াছেন এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা কয়েক বৎসর হইল হইয়া গিয়াছে। নরেন্দ্রনাথ শ্রীযুত কেশবের নিকট সময়ে সময়ে গমনাগমন করিলেও সাধারণ সমাজেই নিয়মিতভাবে যোগদানপূর্বক রবিবাসরীয় উপাসনাকালে তথায় ভজনাদি করিতেছেন। কোন কারণবশতঃ নরেন্দ্র এই সময়ে দুই-এক সপ্তাহ দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে যাইতে পারেন নাই। ঠাকুর প্রতিদিন তাঁহার আগমন প্রতীক্ষাপূর্বক নিরাশ হইয়া স্থির করিলেন, স্বয়ং কলিকাতায় যাইয়া অদ্য নরেন্দ্রকে দেখিয়া আসিবেন। পরে মনে পড়িল, সেদিন রবিবার – নরেন্দ্র যদি কাহারও সহিত সাক্ষাৎ করিতে কোথাও গমন করে এবং কলিকাতায় যাইয়াও তাহার দেখা না পান? তখন স্থির করিলেন, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সান্ধ্যোপাসনাকালে সে ভজন গাহিতে নিশ্চিত উপস্থিত হইবে, সেখানে যাইলেই তাহাকে দেখিতে পাইব। আবার ভাবিলেন, সহসা সমাজে ঐরূপে উপস্থিত হইলে ব্রাহ্মভক্তগণের অসন্তোষের কারণ হইব না তো? পরক্ষণেই মনে হইল – কেন, কেশবের সমাজে ঐরূপ কয়েকবার উপস্থিত হইয়াও তো তাহাদিগের সন্তোষ ভিন্ন অসন্তোষ দেখি নাই এবং বিজয়, শিবনাথ প্রভৃতি সাধারণ সমাজের নেতৃগণ তো দক্ষিণেশ্বরে ঐরূপে ইতঃপূর্বে অনেক সময় আসিয়াছেন? ঠাকুরের সরল মন ঐরূপ সরলভাবে ঐ কথা মীমাংসা করিবার কালে একটি বিষয় স্মরণ করিতে বিস্মৃত হইল। তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়া শ্রীযুত কেশব ও বিজয়ের ধর্ম-সম্বন্ধীয় মতের পরিবর্তন লক্ষ্যপূর্বক শিবনাথ-প্রমুখ সাধারণ সমাজভুক্ত ব্রাহ্মগণের অনেকে যে তাঁহার নিকটে পূর্বের ন্যায় গমনাগমন ক্রমশঃ ছাড়িয়া দিতেছেন, এ কথা ঠাকুরের মনে ক্ষণকালের জন্যও উদিত হইল না। না হইবারই কথা – কারণ, ঈশ্বরের প্রতি তীব্র অনুরাগে মানব-মন উচ্চ ভাব-ভূমিকায় আরোহণপূর্বক তাঁহার পূর্ণ কৃপাসৌভাগ্যলাভে যত অগ্রসর হইবে, ততই তাহার ইতঃপূর্বের ধর্মমতসকল ক্রমশঃ পরিবর্তিত হইবে, এ বিষয়ে সত্যতা তিনি আজীবন প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। সত্যপ্রিয় ব্রাহ্মগণ সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই এতকাল সংগ্রাম করিয়া আসিতেছেন, অতএব আধ্যাত্মিক উপলব্ধিসকলের ইতি নির্দেশ করিতে তাঁহারা যে এখন ভিন্ন পথে অগ্রসর হইবেন, এ কথা তিনি বুঝিবেন কিরূপে?
তাঁহার তথায় আগমনের ফল
সন্ধ্যা সমাগতা। শত ব্রাহ্মভক্তের পূত হৃদয়োচ্ছ্বাস ‘সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম’ ইত্যাদি মন্ত্রসহায়ে ঊর্ধ্বে উত্থিত হইয়া শ্রীভগবানের শ্রীপাদপদ্মে মিলিত হইতে লাগিল। ক্রমে উপাসনা ও ধ্যান পরিসমাপ্ত করিয়া ঈশ্বরানুরাগ ও আধ্যাত্মিক ঐকান্তিকতা বৃদ্ধির জন্য আচার্য বেদী হইতে ব্রাহ্মসঙ্ঘকে সম্বোধনপূর্বক উপদেশ প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন। এমন সময়ে অর্ধবাহ্য-অবস্থাপন্ন ঠাকুর ব্রাহ্মমন্দিরে প্রবিষ্ট হইয়া বেদিকায় উপবিষ্ট আচার্যের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সমাগত ব্যক্তিগণের মধ্যে অনেকে তাঁহাকে ইতঃপূর্বে দেখিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার সহসা আগমনের বার্তা সঙ্ঘমধ্যে প্রচারিত হইতে বিলম্ব হইল না এবং ইতঃপূর্বে যাঁহারা তাঁহাকে কখনও দর্শন করেন নাই, তাঁহাদিগের কেহ বা দণ্ডায়মান হইয়া, কেহ বা বেঞ্চির উপরে উঠিয়া তাঁহাকে দেখিতে লাগিলেন। ঐরূপে সঙ্ঘমধ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইতে দেখিয়া আচার্য নিজ কার্যসাধনে বিরত হইলেন এবং ভজনমণ্ডলীমধ্যে উপবিষ্ট নরেন্দ্রনাথ, ঠাকুর যে জন্য সহসা তথায় উপস্থিত হইয়াছেন বুঝিতে পারিয়া তাঁহার পার্শ্বে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু বেদীস্থ আচার্য বা সমাজস্থ অন্য কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি আসিয়া ঠাকুরকে সাদরাহ্বান করা দূরে থাকুক, তাঁহাকে বিজয়কৃষ্ণ-প্রমুখ ব্রাহ্মগণের মধ্যে পূর্বোক্ত মতদ্বৈধ আনয়নের কারণরূপে নিশ্চয় করিয়া তাঁহার প্রতি সাধারণ শিষ্টাচার প্রদর্শনেও সেদিন উদাসীন হইয়া রহিলেন।
জনতানিবারণ জন্য গ্যাস-নির্বাণ করা
ঠাকুর এদিকে কোন দিকে লক্ষ্য না করিয়া বেদীর নিকট উপস্থিত হইলেন এবং সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন। তখন তাঁহার উক্ত অবস্থা দেখিবার জন্য উপস্থিত জনসাধারণের আগ্রহবৃদ্ধি হওয়ায় পূর্ব-বিশৃঙ্খলতার বৃদ্ধি ভিন্ন হ্রাস হইল না; এবং উহা নিবারণ করা অসম্ভব দেখিয়া জনতা ভাঙিয়া দিবার উদ্দেশ্যে সমাজ-গৃহের প্রায় সমস্ত গ্যাসালোক নির্বাপিত করা হইল। ফলে মন্দিরের বাহিরে আসিবার জন্য অন্ধকারে জনতামধ্যে বিষম গণ্ডগোল উপস্থিত হইল।
নরেন্দ্রের ঠাকুরকে কোনরূপে বাহিরে আনয়ন ও দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছাইয়া দেওয়া
সমাজস্থ কেহ ঠাকুরকে সাদরে গ্রহণ করিলেন না দেখিয়া শ্রীযুত নরেন্দ্র ইতঃপূর্বে মর্মাহত হইয়াছিলেন। অন্ধকারে কিরূপে তাঁহাকে মন্দিরের বাহিরে আনয়ন করিবেন, তদ্বিষয়ে তিনি এখন বিষম চিন্তিত হইলেন। অতঃপর ঠাকুরের সমাধিভঙ্গ হইবামাত্র মন্দিরের পশ্চাতের দ্বার দিয়া তিনি তাঁহাকে কোনরূপে বাহিরে আনয়নপূর্বক তাঁহার সহিত গাড়িতে উঠিয়া তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছাইয়া দিলেন। নরেন্দ্র বলিতেন, “আমার জন্য ঠাকুরকে সেদিন ঐরূপে লাঞ্ছিত হইতে দেখিয়া মনে কতদূর দুঃখ-কষ্ট উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা বলা অসম্ভব। ঐ কার্যের জন্য তাঁহাকে সেদিন কত না তিরস্কার করিয়াছিলাম। তিনি কিন্তু পূর্বোক্ত ঘটনায় ক্ষুণ্ণ হওয়া বা আমার কথায় কর্ণপাত করা, কিছুই করেন নাই।”
তাহাকে ভালবাসিবার জন্য নরেন্দ্রের ঠাকুরকে তিরস্কার ও তাঁহার জগন্মাতার বাণী শুনিয়া আশ্বস্ত হওয়া
“আমার প্রতি ভালবাসার জন্য তিনি ঐরূপে আপনার দিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য রাখেন না দেখিয়া তাঁহার উপর বিষম কঠোর বাক্য প্রয়োগ করিতেও কখনও কখনও কুণ্ঠিত হই নাই। বলিতাম – পুরাণে আছে, ভরত রাজা ‘হরিণ’ ভাবিতে ভাবিতে মৃত্যুর পরে হরিণ হইয়াছিল, এ কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে আপনার আমার বিষয়ে অত চিন্তা করার পরিণাম ভাবিয়া সতর্ক হওয়া উচিত! বালকের ন্যায় সরল ঠাকুর আমার ঐসকল কথা শুনিয়া বিষম চিন্তিত হইয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, ‘ঠিক বলেছিস; তাই তো রে, তাহলে কি হবে, আমি যে তোকে না দেখে থাকতে পারি না।’ দারুণ বিমর্ষ হইয়া ঠাকুর মাকে (শ্রীশ্রীজগদম্বাকে) ঐ কথা জানাইতে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে হাসিতে হাসিতে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘যা শালা, আমি তোর কথা শুনব না; মা বললেন – তুই ওকে (নরেন্দ্রকে) সাক্ষাৎ নারায়ণ বলে জানিস, তাই ভালবাসিস, যেদিন ওর (নরেন্দ্রের) ভিতর নারায়ণকে না দেখতে পাবি, সেদিন ওর মুখ দেখতেও পারবি না।’ ঐরূপে আমি ইতঃপূর্বে যত কথা বুঝাইয়াছিলাম, ঠাকুর সেইসকলকে এক কথায় সেইদিন উড়াইয়া দিয়াছিলেন।”
পঞ্চম খণ্ড – ষষ্ঠ অধ্যায় – দ্বিতীয় পাদ: ঠাকুর ও নরেন্দ্রনাথের অলৌকিক সম্বন্ধ
নরেন্দ্রের মহত্ত্ব সম্বন্ধে ঠাকুরের বাণী
নরেন্দ্রনাথের পবিত্র হৃদয়-মন উচ্চভাবসমূহকে আশ্রয় করিয়া সর্বদা কার্যে অগ্রসর হয়, ঠাকুরের তীক্ষ্ণদৃষ্টি এ কথা প্রথম দিন হইতে ধরিতে সক্ষম হইয়াছিল। নরেন্দ্রের সহিত ঠাকুরের দৈনন্দিন আচরণসকল সেজন্যই অন্য ভাবের হইতে নিত্য দেখা যাইত। ভগবদ্ভক্তির হানি হইবে বলিয়া আহার, বিহার, শয়ন, নিদ্রা, জপ, ধ্যানাদি সর্ববিধ বিষয়ে যে ঠাকুর নানা নিয়ম স্বয়ং পালনপূর্বক নিজ ভক্তসকলকে ঐরূপ করিতে সর্বদা উৎসাহিত করিতেন, তিনিই আবার নিঃসঙ্কোচে সকলের সমক্ষে এ কথা বারংবার স্পষ্ট বলিতেন, নরেন্দ্র ঐ নিয়মসকলের ব্যতিক্রম করিলেও তাহার কিছুমাত্র প্রত্যবায় হইবে না! ‘নরেন্দ্র নিত্যসিদ্ধ’ – ‘নরেন্দ্র ধ্যানসিদ্ধ’ – ‘নরেন্দ্রের ভিতরে জ্ঞানাগ্নি সর্বদা প্রজ্বলিত থাকিয়া সর্বপ্রকার আহার্যদোষকে ভস্মীভূত করিয়া দিতেছে, সেজন্য যেখানে-সেখানে যাহা-তাহা ভোজন করিলেও তাহার মন কলুষিত বা বিক্ষিপ্ত হইবে না’ – ‘জ্ঞানখড়্গ-সহায়ে সে মায়াময় সমস্ত বন্ধনকে নিত্য খণ্ডবিখণ্ড করিয়া ফেলিতেছে, মহামায়া সেজন্য তাহাকে কোন মতে নিজায়ত্তে আনিতে পারিতেছেন না’ – নরেন্দ্রের সম্বন্ধে ঐরূপ কত কথাই না আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখ হইতে নিত্য শুনিতে পাইয়া তখন বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইতাম।
মারোয়াড়ী ভক্তদিগের আনীত আহার্য নরেন্দ্রকে দান
মারোয়াড়ী ভক্তগণ ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়া মিছরি, পেস্তা, বাদাম, কিসমিস প্রভৃতি নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য তাঁহাকে উপহার প্রদান করিয়া যাইল। ঠাকুর ঐসকলের কিছুমাত্র স্বয়ং গ্রহণ করিলেন না, সমীপাগত কোন ভক্তকেও দিলেন না, বলিলেন, “উহারা (মারোয়াড়ীরা) নিষ্কামভাবে দান করিতে আদৌ জানে না, সাধুকে এক খিলি পান দিবার সময়েও ষোলটা কামনা তাহার সহিত জুড়িয়া দেয়, ঐরূপ সকাম দাতার অন্ন-ভোজনে ভক্তির হানি হয়!” সুতরাং প্রশ্ন উঠিল – তাহাদের প্রদত্ত দ্রব্যসকল কি করা যাইবে? ঠাকুর বলিলেন, “যা, নরেন্দ্রকে ঐসকল দিয়ে আয়, সে ঐসকল খাইলেও তাহার কোন হানি হইবে না!”
নিষিদ্ধ দ্রব্য ভোজনে নরেন্দ্রের ভক্তিহানি হইবে না
নরেন্দ্র হোটেলে খাইয়া আসিয়া ঠাকুরকে বলিল, “মহাশয়, আজ হোটেলে সাধারণে যাহাকে অখাদ্য বলে, খাইয়া আসিয়াছি।” ঠাকুর বুঝিলেন, নরেন্দ্র বাহাদুরী প্রকাশের জন্য ঐ কথা বলিতেছে না, কিন্তু সে ঐরূপ করিয়াছে বলিয়া তাহাকে স্পর্শ করিতে বা তাঁহার গৃহস্থিত ঘটি বাটি প্রভৃতি পাত্রসকল ব্যবহার করিতে দিতে যদি তাঁহার আপত্তি থাকে, তাহা হইলে পূর্ব হইতে সাবধান হইতে পারিবেন, এজন্য ঐরূপ বলিতেছে। ঐরূপ বুঝিয়া বলিলেন, “তোর তাহাতে দোষ লাগিবে না; শোর গোরু খাইয়া যদি কেহ ভগবানে মন রাখে, তাহা হইলে উহা হবিষ্যান্নের তুল্য, আর শাকপাতা খাইয়া যদি বিষয়-বাসনায় ডুবে থাকে, তাহা হইলে উহা শোর গোরু খাওয়া অপেক্ষা কোন অংশে বড় নহে। তুই অখাদ্য খাইয়াছিস তাহাতে আমার কিছুই মনে হইতেছে না, কিন্তু (অন্য সকলকে দেখাইয়া) ইহাদিগের কেহ যদি আসিয়া ঐ কথা বলিত, তাহা হইলে তাহাকে স্পর্শ পর্যন্ত করিতে পারিতাম না!”
ঠাকুরের ভালবাসায় নরেন্দ্রের উন্নতি ও আত্মবিক্রয়
ঐরূপে প্রথম দর্শনকাল হইতে শ্রীযুত নরেন্দ্র ঠাকুরের নিকটে যেরূপ ভালবাসা, প্রশংসা ও সর্ববিষয়ে স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিলেন, তাহা পাঠককে যথাযথ বুঝানো একপ্রকার সাধ্যাতীত বলিয়া বোধ হয়। মহানুভব শিষ্যের আন্তরিক শক্তির এতদূর সম্মান রাখিয়া তাহার সহিত সর্ববিষয়ে আচরণ করা জগদ্গুরুগণের জীবনেতিহাসে অন্যত্র কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। ঠাকুর অন্তরের সকল কথা নরেন্দ্রনাথকে না বলিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেন না, সকল বিষয়ে তাঁহার মতামত গ্রহণ করিতে অগ্রসর হইতেন, তাঁহার সহিত তর্ক করাইয়া সমীপাগত ব্যক্তিসকলের বুদ্ধি ও বিশ্বাসের বল পরীক্ষা করিয়া লইতেন, এবং সম্যকরূপে পরীক্ষা না করিয়া কোন বিষয় সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে তাঁহাকে কখনও অনুরোধ করিতেন না। বলা বাহুল্য, ঠাকুরের ঐরূপ আচরণ শ্রীযুত নরেন্দ্রের আত্মবিশ্বাস, পুরুষকার, সত্যপ্রিয়তা ও শ্রদ্ধাভক্তিকে স্বল্পকালের মধ্যেই শতধারে বাড়াইয়া তুলিয়াছিল এবং তাঁহার অসীম বিশ্বাস ও ভালবাসা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের ন্যায় চতুর্দিকে অবস্থানপূর্বক অসীম স্বাধীনতাপ্রিয় নরেন্দ্রকে তাঁহার অজ্ঞাতসারে সর্বত্র সকল প্রকার প্রলোভন ও হীন আচরণের হস্ত হইতে নিত্য রক্ষা করিয়াছিল। ঐরূপে প্রথম দর্শন-দিবসের পরে বৎসরকাল অতীত হইতে না হইতে শ্রীযুত নরেন্দ্র ঠাকুরের প্রেমে চিরকালের নিমিত্ত আত্মবিক্রয় করিয়াছিলেন। কিন্তু ঠাকুরের অহেতুক প্রেমপ্রবাহ তাঁহাকে ধীরে ধীরে ঐ পথে কতদূর অগ্রসর করিয়াছে, তাহা কি তখন তিনি সম্পূর্ণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন? – বোধ হয় নহে। বোধ হয়, ঠাকুরের অপার্থিব প্রেমলাভে অননুভূতপূর্ব বিশুদ্ধ আনন্দে তাঁহার হৃদয় নিরন্তর পূর্ণ ও পরিতৃপ্ত থাকিত বলিয়া উহা যে কতদূর দুর্লভ দেববাঞ্ছিত পদার্থ, তাহা স্বার্থপর কঠোর সংসারের সংঘর্ষে আসিয়া তুলনায় বিশেষরূপে বুঝিতে তখনও তাঁহার কিঞ্চিৎ অবশিষ্ট ছিল। পূর্বোক্ত কথাসকল পাঠকের হৃদয়ঙ্গম করাইতে কয়েকটি দৃষ্টান্তের অবতারণা করিলে মন্দ হইবে না:
শ্রীযুত ম – র সহিত নরেন্দ্রের তর্ক বাধাইয়া দেওয়া
ঠাকুরের নিকটে শ্রীযুত নরেন্দ্রের আগমনের কয়েক মাস পরে ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-প্রণেতা শ্রীযুত ‘ম’ দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া ঠাকুরের পুণ্যদর্শনলাভে ধন্য হইয়াছিলেন। বরাহনগরে অবস্থান করায় কিরূপে তখন তাঁহার কয়েকবার উপর্যুপরি ঠাকুরের নিকট আসিবার সুবিধা হইয়াছিল, ঠাকুরের দুই-চারিটি জ্ঞানগর্ভ শ্লেষপূর্ণ বাক্য তাঁহার জ্ঞানাভিমান বিদূরিত করিয়া কিরূপে তাঁহাকে চিরকালের মতো বিনীত শিক্ষার্থীর পদে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল, ঐসকল কথা তিনি তৎপ্রণীত গ্রন্থের স্থানবিশেষে স্বয়ং লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। নরেন্দ্রনাথ বলিতেন, “ঐ কালে এক দিবস দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে রাত্রিযাপন করিয়াছিলাম। পঞ্চবটীতলে কিছুক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া আছি, এমন সময়ে ঠাকুর সহসা তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং হস্তধারণপূর্বক হাসিতে হাসিতে বলিতে লাগিলেন, ‘আজ তোর বিদ্যা-বুদ্ধি বুঝা যাবে; তুই তো মোটে আড়াইটা পাস করিয়াছিস, আজ সাড়ে তিনটা পাস1 করা মাস্টার এসেছে; চল, তার সঙ্গে কথা কইবি।’ অগত্যা ঠাকুরের সহিত যাইতে হইল এবং ঠাকুরের ঘরে যাইয়া শ্রীযুত ম-র সহিত পরিচিত হইবার পরে নানা বিষয়ে আলাপে প্রবৃত্ত হইলাম। ঐরূপে আমাদিগকে কথা কহিতে লাগাইয়া দিয়া ঠাকুর চুপ করিয়া বসিয়া আমাদিগের আলাপ শুনিতে ও আমাদিগকে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। পরে শ্রীযুত ম – সেদিন বিদায় গ্রহণপূর্বক চলিয়া যাইলে বলিলেন, ‘পাস করিলে কি হয়, মাস্টারটার মাদীভাব2; কথা কহিতেই পারে না!’ ঠাকুর ঐরূপে আমাকে সকলের সহিত তর্কে লাগাইয়া দিয়া তখন রঙ্গ দেখিতেন।”
1. নরেন্দ্রনাথ তখন বি.এ. পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং শ্রীযুত ম বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া আইন (বি.এল.) পড়িতেছিলেন – সেই কথাই ঠাকুর ঐরূপে নির্দেশ করিয়াছিলেন।
2. ঠাকুর এ স্থলে অন্য শব্দ ব্যবহার করিয়াছিলেন।
ভক্ত শ্রীকেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীযুত কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ঠাকুরের গৃহস্থ ভক্তগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। বোধ হয়, নরেন্দ্রনাথের দক্ষিণেশ্বরে আসিবার কিছুকাল পূর্ব হইতে ইনি ঠাকুরের নিকট গমনাগমন করিতেন। কিন্তু কর্মস্থল পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে থাকায় পূজাদির অবকাশ ভিন্ন অন্য সময়ে ইনি ঠাকুরের নিকটে বড় একটা আসিতে পারিতেন না। কেদারনাথ ভক্ত সাধক ছিলেন এবং বৈষ্ণব-তন্ত্রোক্ত ভাব অবলম্বন করিয়া সাধন-পথে অগ্রসর হইতেছিলেন। ভজন-কীর্তনাদি শুনিলে তাঁহার দু-নয়নে অশ্রুধারা প্রবাহিত হইত। ঠাকুর সেজন্য সকলের নিকটে তাঁহার বিশেষ প্রশংসা করিতেন। কেদারনাথের ভগবৎপ্রেম দেখিয়া ঢাকার বহু লোকে তাঁহাকে শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন করিত। অনেকে আবার তাঁহার উপদেশমত ধর্মজীবন-গঠনে অগ্রসর হইত। শুনা যায়, ঠাকুরের নিকটে যখন বহু লোকের সমাগম হইতে থাকে, তখন ধর্ম-বিষয়ে আলোচনা করিতে করিতে পরিশ্রান্ত ও ভাবাবিষ্ট হইয়া তিনি এক সময়ে শ্রীশ্রীজগন্মাতাকে বলিয়াছিলেন, ‘মা, আমি আর এত বকতে পারি না; তুই কেদার, রাম, গিরিশ ও বিজয়কে1 একটু একটু শক্তি দে, যাতে লোকে তাদের কাছে গিয়ে কিছু শেখবার পরে এখানে (আমার নিকটে) আসে এবং দুই-এক কথাতেই চৈতন্যলাভ করে!’ – কিন্তু উহা অনেক পরের কথা।
1. শ্রীযুত কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, রামচন্দ্র দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী।
কেদারের তর্কশক্তি ও নরেন্দ্রের সহিত প্রথম পরিচয়
কিছুকালের নিমিত্ত অবসর গ্রহণ করিয়া শ্রীযুত কেদার ঐ কালে কলিকাতায় আগমনপূর্বক ঠাকুরের নিকটে মধ্যে মধ্যে আসিবার সুযোগলাভ করিয়াছিলেন। ঠাকুরও সাধক ভক্তকে নিকটে পাইয়া পরম উৎসাহে তাঁহার সহিত ধর্মালাপ করিতে এবং সমীপাগত অন্যান্য ভক্তগণকে তাঁহার সহিত পরিচিত করিয়া দিতেছিলেন। শ্রীযুত নরেন্দ্র এই সময় একদিন ঠাকুরের নিকটে আসিয়া কেদারনাথকে দেখিতে পাইলেন এবং ভজন গাহিবার কালে তাঁহার ভাবাবেগ লক্ষ্য করিয়াছিলেন। পরে কেদারের সহিতও ঠাকুর কিছুক্ষণের জন্য নরেন্দ্রনাথের তর্ক বাধাইয়া দিয়াছিলেন। কেদার আপনার ভাবে মন্দ তর্ক করিতেন না এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর বাক্যের অযৌক্তিকতা সময়ে সময়ে তীক্ষ্ণ শ্লেষবাক্যপ্রয়োগে নির্দেশ করিয়া দিতেন। বাদীকে এক দিন তিনি যে কথাগুলি বলিয়া নিরস্ত করিয়াছিলেন, তাহা ঠাকুরের বিশেষ মনোজ্ঞ হওয়ায় ঐরূপ প্রশ্ন কেহ পুনরায় তাঁহার নিকটে উত্থাপিত করিলে ঠাকুর প্রায়ই বলিতেন, কেদার ঐরূপ প্রশ্নের এইরূপ উত্তর দেয়। বাদী সেদিন প্রশ্ন উঠাইয়াছিল, ভগবান যদি সত্যসত্যই দয়াময় হয়েন, তবে তাঁহার সৃষ্টিতে এত দুঃখকষ্ট অন্যায় অত্যাচারাদি সৃজন করিয়াছেন কেন? যথেষ্ট অন্ন উৎপন্ন না হওয়ায় সময়ে সময়ে সহস্র সহস্র লোকের দুর্ভিক্ষে অনাহারে মৃত্যু হয় কেন? কেদার তাহাতে উত্তর দিয়াছিলেন, “দয়াময় হইয়াও ঈশ্বর তাঁহার সৃষ্টিতে দুঃখ কষ্ট, অপমৃত্যু ইত্যাদি রাখিবার কথা যেদিন স্থির করিয়াছিলেন, সেদিনকার মিটিং-এ (সভায়) আমাকে আহ্বান করেন নাই; সুতরাং কেমন করিয়া ঐ কথা বুঝিতে পারিব?” কিন্তু নরেন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ যুক্তিতে সকলের সম্মুখে কেদারকে অদ্য নিরস্ত হইতে হইয়াছিল।
ঠাকুরের জিজ্ঞাসায় কেদারের সম্বন্ধে নরেন্দ্রের নিজমত প্রকাশ
কেদার বিদায়গ্রহণ করিবার পরে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “কি রে, কেমন দেখলি? কেমন ভক্তি বল দেখি, ভগবানের নামে একেবারে কেঁদে ফেলে! হরি বলতে যার চোখে ধারা বয়, সে জীবন্মুক্ত; কেদারটি বেশ – নয়?” পবিত্র-হৃদয় তেজীয়ান নরেন্দ্রনাথ ধর্মলাভ অথবা অন্য যে-কোন কারণে হউক, যাহারা পুরুষ শরীর ধারণপূর্বক নারীসুলভ ভাব অবলম্বন করে, তাহাদিগকে অন্তরের সহিত ঘৃণা করিতেন। দৃঢ়সঙ্কল্প ও উদ্যমসহায় না হইয়া পুরুষ রোদন-মাত্রকে আশ্রয়পূর্বক ঈশ্বরের নিকটে উপস্থিত হইবে, এ কথা তাঁহার নিকটে পুরুষত্বের অবমাননা বলিয়া সর্বদা প্রতীত হইত। ঈশ্বরে একান্ত নির্ভর করিলেও পুরুষ চিরকাল পুরুষই থাকিবে এবং পুরুষের ন্যায় তাঁহাকে আত্মসমর্পণ করিবে, তাঁহার এইরূপ মত ছিল। সুতরাং ঠাকুরের পূর্বোক্ত কথা সম্পূর্ণহৃদয়ে অনুমোদন করিতে না পারিয়া তিনি বলিলেন, “তা মহাশয়, আমি কেমন করিয়া জানিব? আপনি (লোক-চরিত্র) বুঝেন, আপনি বলিতে পারেন। নতুবা কান্নাকাটি দেখিয়া ভালমন্দ কিছুই বুঝা যায় না। একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিলে চোখ দিয়া অমন কত জল পড়ে! আবার শ্রীমতীর বিরহসূচক কীর্তনাদি শুনিয়া যাহারা কাঁদে, তাহাদের অধিকাংশ নিজ নিজ স্ত্রীর সহিত বিরহের কথা স্মরণ বা আপনাতে ঐ অবস্থার আরোপ করিয়া কাঁদে, তাহাতে সন্দেহ নাই! ঐরূপ অবস্থার সহিত সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার ন্যায় ব্যক্তিগণের মাথুর কীর্তন শুনিলেও অন্যের ন্যায় সহজেই কাঁদিবার প্রবৃত্তি কখনই আসিবে না।” ঐরূপে শ্রীযুত নরেন্দ্র যাহা সত্য বলিয়া বুঝিতেন, জিজ্ঞাসিত হইলে তাহা ঠাকুরের নিকটে সর্বদা নির্ভয় অন্তরে প্রকাশ করিতেন। ঠাকুরও উহাতে সর্বদা প্রসন্ন ভিন্ন কখনও রুষ্ট হইতেন না। কারণ, অন্তর্দর্শী ঠাকুর নিশ্চয় বুঝিয়াছিলেন, সত্যপ্রাণ নরেন্দ্রের ভাবের ঘরে কিছুমাত্র চুরি নাই।
সাকারোপাসনার জন্য নরেন্দ্রের তিরস্কার, রাখালের ভয় ও ঠাকুরের কথায় উভয়ের মধ্যে পুনরায় প্রীতিস্থাপন
ঠাকুরের দর্শনলাভের স্বল্পকাল পূর্বে নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করিয়াছিলেন। নিরাকার অদ্বিতীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসবান হইয়া কেবলমাত্র তাঁহারই উপাসনা ও ধ্যানধারণা করিবেন, এই মর্মে ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গীকারপত্রে এই সময়ে তিনি সহি করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম হইয়া উক্ত সমাজ-প্রচলিত সামাজিক আচারব্যবহারাদি অবলম্বন করিবার সঙ্কল্প তাঁহার মনে কখনও উদিত হয় নাই। শ্রীযুত রাখাল এই কালের পূর্ব হইতেই নরেন্দ্রনাথের সহিত পরিচিত ছিলেন এবং অনেক সময় তাঁহার সহিত অতিবাহিত করিতেন। শিশুর ন্যায় কোমল-প্রকৃতিসম্পন্ন নির্ভরশীল রাখালচন্দ্র যে নরেন্দ্রনাথের সপ্রেম ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া তাঁহার প্রবল ইচ্ছাশক্তির দ্বারা সর্ববিষয়ে নিয়ন্ত্রিত হইবেন, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। সুতরাং নরেন্দ্রনাথের পরামর্শে তিনিও ঐ সময়ে ব্রাহ্মসমাজের পূর্বোক্তপ্রকার অঙ্গীকারপত্রে সহি করিয়াছিলেন। ঐ ঘটনার স্বল্পকাল পরেই রাখালচন্দ্র ঠাকুরের পুণ্যদর্শনলাভে কৃতার্থ হয়েন এবং তাঁহার উপদেশে সাকারোপাসনার সুপ্ত প্রীতি রাখালের অন্তরে পুনরায় জাগরিত হইয়া উঠে। উহার কয়েক মাস পরে নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকটে আসিতে আরম্ভ করেন এবং রাখালচন্দ্রকে তথায় দেখিয়া পরম প্রীত হয়েন। কিছুদিন পরে নরেন্দ্রনাথ দেখিতে পাইলেন, রাখালচন্দ্র ঠাকুরের সহিত মন্দিরে যাইয়া দেববিগ্রহসকলকে প্রণাম করিতেছেন। সত্যপরায়ণ নরেন্দ্র উহাতে ক্ষুণ্ণ হইয়া রাখালচন্দ্রকে পূর্বকথা স্মরণ করাইয়া তীব্র অনুযোগ করিতে লাগিলেন। বলিলেন, “ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গীকারপত্রে সহি করিয়া পুনরায় মন্দিরে যাইয়া প্রণাম করায় তোমাকে মিথ্যাচারে দূষিত হইতে হইয়াছে।” কোমল-প্রকৃতি রাখাল বন্ধুর ঐরূপ কথায় নীরব রহিলেন এবং তদবধি কিছু কাল তাঁহার সহিত দেখা করিতে ভীত ও সঙ্কুচিত হইতে লাগিলেন। পরিশেষে ঠাকুর রাখালচন্দ্রের ঐরূপ হইবার কারণ জানিতে পারিয়া নরেন্দ্রনাথকে মিষ্টবাক্যে নানাভাবে বুঝাইয়া বলিলেন, “দেখ, রাখালকে আর কিছু বলিসনি, সে তোকে দেখলেই ভয়ে জড়সড় হয়; তার এখন সাকারে বিশ্বাস হয়েছে, তা কি করবে, বল; সকলে কি প্রথম হইতে নিরাকার ধারণা করিতে পারে?” শ্রীযুত নরেন্দ্রও তদবধি রাখালের প্রতি দোষারোপ করিতে ক্ষান্ত হইলেন।
অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী করিতে ঠাকুরের চেষ্টা ও নরেন্দ্রের প্রতিবাদ
নরেন্দ্রনাথকে উত্তম অধিকারী জানিয়া প্রথম দিন হইতে ঠাকুর তাঁহাকে অদ্বৈততত্ত্বে বিশ্বাসবান করিতে প্রযত্ন করিতেন। দক্ষিণেশ্বর আসিলেই তিনি তাঁহাকে অষ্টাবক্রসংহিতাদি গ্রন্থসকল পাঠ করিতে দিতেন। নিরাকার সগুণ ব্রহ্মের দ্বৈতভাবে উপাসনায় নিযুক্ত নরেন্দ্রনাথের চক্ষে ঐসকল গ্রন্থ তখন নাস্তিক্য-দোষদুষ্ট বলিয়া মনে হইত। ঠাকুরের অনুরোধে একটু-আধটু পাঠ করিবার পরেই তিনি স্পষ্ট বলিয়া বসিতেন, “ইহাতে আর নাস্তিকতাতে প্রভেদ কি? সৃষ্ট জীব আপনাকে স্রষ্টা বলিয়া ভাবিবে? ইহা অপেক্ষা অধিক পাপ আর কি হইতে পারে? আমি ঈশ্বর, তুমি ঈশ্বর, জন্ম-মরণশীল যাবতীয় পদার্থ সকলই ঈশ্বর – ইহা অপেক্ষা অযুক্তিকর কথা অন্য কি হইবে? গ্রন্থকর্তা ঋষিমুনিদের নিশ্চয় মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছিল, নতুবা এমন সকল কথা লিখিবেন কিরূপে?” ঠাকুর স্পষ্টবাদী নরেন্দ্রনাথের ঐরূপ কথা শুনিয়া হাসিতেন এবং সহসা তাঁহার ঐরূপ ভাবে আঘাত না করিয়া বলিতেন, “তা তুই ঐ কথা এখন নাই বা নিলি, তা বলে মুনিঋষিদের নিন্দা ও ঈশ্বরীয় স্বরূপের ইতি করিস কেন? তুই সত্যস্বরূপ ভগবানকে ডাকিয়া যা, তারপর তিনি তোর নিকটে যে ভাবে প্রকাশিত হইবেন, তাহাই বিশ্বাস করিবি।” কিন্তু ঠাকুরের ঐ কথা নরেন্দ্র বড় একটা শুনিতেন না। কারণ, যুক্তি দ্বারা যাহার প্রতিষ্ঠা হয় না, তাহাই তাঁহার নিকট তখন মিথ্যা বলিয়া মনে হইত এবং সর্বপ্রকার মিথ্যার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়া তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। সুতরাং ঠাকুর ভিন্ন অন্য অনেকের নিকটেও কথাপ্রসঙ্গে অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে নানারূপ যুক্তি প্রদর্শন করিতে এবং সময়ে সময়ে শ্লেষবাক্য প্রয়োগ করিতেও তিনি কুণ্ঠিত হইতেন না।
প্রতাপচন্দ্র হাজরা
প্রতাপচন্দ্র হাজরা নামক এক ব্যক্তি তখন দক্ষিণেশ্বর-উদ্যানে অবস্থান করিতেন। প্রতাপের সাংসারিক অবস্থা পূর্বের ন্যায় সচ্ছল ছিল না। সেজন্য ধর্মলাভে প্রযত্ন করিলেও অর্থকামনা তাঁহার অন্তরে অনেক সময় আধিপত্য লাভ করিত। সুতরাং তাঁহার ধর্মাচরণের মূলে প্রায়ই সকাম ভাব থাকিত। কিন্তু বাহিরে ঐ কথা কাহাকেও জানিতে দেওয়া দূরে থাকুক, তিনি সর্বদা নিষ্কামভাবে উপাসনার উচ্চ উচ্চ কথাসকল লোকের নিকটে বলিয়া প্রশংসালাভে উদ্যত হইতেন। শুদ্ধ তাহাই নহে, ধর্ম-কর্ম করিবার কালে প্রতি পদে নিজ লাভ-লোকসান খতাইয়া দেখা তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ছিল এবং বোধ হয়, জপ-তপাদির দ্বারা কোনপ্রকার সিদ্ধাই লাভ করিয়া নিজ অর্থকামনা পূরণ করিবেন, এ কথাও মধ্যে মধ্যে তাঁহার মনে উঁকি-ঝুঁকি মারিত। ঠাকুর প্রথম দিন হইতেই তাঁহার অন্তরের ঐ প্রকার ভাব বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং উহা ত্যাগ করিয়া যথার্থ নিষ্কামভাবে ঈশ্বরকে ডাকিতে তাঁহাকে উপদেশ দিয়াছিলেন। দুর্বলচেতা হাজরা ঠাকুরের ঐ কথা কেবল যে লইতে পারেন নাই তাহা নহে, কিন্তু ভ্রমধারণা, অহঙ্কার এবং স্বার্থসিদ্ধির প্রেরণায় ঠাকুরের দর্শনকামনায় আগত ব্যক্তিসকলের নিকটে অবসর পাইলেই প্রচার করিতেন যে, তিনিও স্বয়ং একটা কম সাধু নহেন। ঐরূপ করিলেও বোধ হয় তাঁহার অন্তরে সৎ হইবার যথার্থ ইচ্ছা একটু-আধটু ছিল। কারণ, ঠাকুর তাঁহার ঐ প্রকার কার্যকলাপের কথা নিত্য জানিতে পারিলেও এবং উহার জন্য কখনও কখনও তীব্র তিরস্কার করিলেও তাঁহাকে তথা হইতে এককালে তাড়াইয়া দেন নাই। তবে তিনি আমাদিগের মধ্যে কাহাকেও কাহাকেও তাঁহার সহিত অধিক মিশামিশি করিতে সতর্ক করিয়া দিতেন; বলিতেন, “হাজরা শালার ভারী পাটোয়ারী বুদ্ধি, ওর কথা শুনিসনি।”
হাজরা মহাশয়ের বুদ্ধিমত্তায় নরেন্দ্রের প্রসন্নতা
অন্যান্য দোষ-গুণের সহিত হাজরা মহাশয়ের অন্তরে সহসা কোন বিষয় বিশ্বাস করিব না, এ ভাবটিও ছিল। তাঁহার ন্যায় স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তিগণের তুলনায় তাঁহার বুদ্ধিও মন্দ ছিল না। সেজন্য নরেন্দ্রনাথের ন্যায় ইংরাজীশিক্ষিত ব্যক্তিগণ যখন পাশ্চাত্য সন্দেহবাদী দার্শনিকগণের মতামত আলোচনা করিতেন, তখন তিনি উহার কিছু কিছু বুঝিতে পারিতেন। বুদ্ধিমান নরেন্দ্র ঐজন্য তাঁহার উপর প্রসন্ন ছিলেন এবং দক্ষিণেশ্বরে আসিলেই অবকাশমত দুই-এক ঘণ্টাকাল হাজরা মহাশয়ের সহিত আলাপ করিয়া কাটাইতেন। নরেন্দ্রনাথের প্রখর বুদ্ধির সম্মুখে হাজরার মস্তক সর্বদা অবনত হইত। তিনি বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রীযুত নরেন্দ্রের কথাগুলি শুনিতেন এবং মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে তামাক সাজিয়া খাওয়াইতেন। হাজরার প্রতি নরেন্দ্রের ঐরূপ সদয় ভাব দেখিয়া আমরা অনেকে রহস্য করিয়া বলিতাম, “হাজরা মহাশয় হচ্চেন নরেন্দ্রের ‘ফেরেণ্ড’ (friend)।”
নরেন্দ্রের দক্ষিণেশ্বরে আগমনে ঠাকুরের আচরণ
নরেন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে আসিলে ঠাকুর অনেক সময় তাঁহাকে দেখিবামাত্র ভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িতেন! পরে অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরমানন্দে তাঁহার সহিত ধর্মালাপে নিযুক্ত থাকিতেন। ঐ সময়ে তিনি যেন নানা কথায় ও চেষ্টায় উচ্চ আধ্যাত্মিক প্রত্যক্ষসমূহ তাঁহার অন্তরে প্রবিষ্ট করাইয়া দিতে প্রযত্ন করিতেন। কখনও বা ঐরূপ সময়ে তাঁহার গান (ভজন) শুনিবার ইচ্ছা হইত এবং নরেন্দ্রের সুমধুর কণ্ঠ শুনিবামাত্র পুনরায় সমাধিস্থ হইয়া পড়িতেন। নরেন্দ্রনাথের গান কিন্তু ঐজন্য থামিত না, তন্ময় হইয়া তিনি কয়েক ঘণ্টা কাল একের পর এক অন্য গীত গাহিয়া যাইতেন। ঠাকুর আবার অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া হয়তো নরেন্দ্রনাথকে কোন একটি বিশেষ সঙ্গীত গাহিতে অনুরোধ করিতেন। কিন্তু সর্বশেষে নরেন্দ্রের মুখ হইতে ‘যো কুছ্ হ্যায় সো তুহি হ্যায়’ সঙ্গীতটি না শুনিলে তাঁহার পূর্ণ পরিতৃপ্তি হইত না। পরে অদ্বৈতবাদের নানা রহস্য, যথা – জীব ও ঈশ্বরের প্রভেদ, জীব ও ব্রহ্মের স্বরূপ ইত্যাদি কথায় কতক্ষণ অতিবাহিত হইত। এইরূপে নরেন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে দক্ষিণেশ্বরে আনন্দের তুফান ছুটিত।
অদ্বৈততত্ত্ব সম্বন্ধে নরেন্দ্রের হাজরার নিকটে জল্পনা ও ঠাকুরের তাহাকে ভাবাবেশে স্পর্শ
ঠাকুর ঐরূপে নরেন্দ্রনাথকে এক দিবস অদ্বৈতবিজ্ঞানের জীবব্রহ্মের ঐক্যসূচক অনেক কথা বলিয়াছিলেন। নরেন্দ্র ঐসকল কথা মনোনিবেশপূর্বক শ্রবণ করিয়াও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন না এবং ঠাকুরের কথা সমাপ্ত হইলে হাজরা মহাশয়ের নিকটে উপবিষ্ট হইয়া তামাকু সেবন করিতে করিতে পুনরায় ঐসকল কথার আলোচনাপূর্বক বলিতে লাগিলেন, “উহা কি কখনও হইতে পারে? ঘটিটা ঈশ্বর, বাটিটা ঈশ্বর, যাহা কিছু দেখিতেছি এবং আমরা সকলেই ঈশ্বর?” হাজরা মহাশয়ও নরেন্দ্রনাথের সহিত যোগদান করিয়া ঐরূপ ব্যঙ্গ করায় উভয়ের মধ্যে হাস্যের রোল উঠিল। ঠাকুর তখনও অর্ধবাহ্যদশায় ছিলেন। নরেন্দ্রকে হাসিতে শুনিয়া তিনি বালকের ন্যায় পরিধানের কাপড়খানি বগলে লইয়া বাহিরে আসিলেন এবং ‘তোরা কি বলছিস রে’ বলিয়া হাসিতে হাসিতে নিকটে আসিয়া নরেন্দ্রকে স্পর্শ করিয়া সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন।
উহার ফলে নরেন্দ্রের অদ্ভুত দর্শন
নরেন্দ্রনাথ বলিতেন, “ঠাকুরের ঐদিনকার অদ্ভুত স্পর্শে মুহূর্তমধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হইল। স্তম্ভিত হইয়া সত্য সত্যই দেখিতে লাগিলাম, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কিছুই আর নাই! ঐরূপ দেখিয়াও কিন্তু নীরব রহিলাম, ভাবিলাম – দেখি কতক্ষণ পর্যন্ত ঐ ভাব থাকে। কিন্তু সেই ঘোর সেদিন কিছুমাত্র কমিল না। বাটীতে ফিরিলাম, সেখানেও তাহাই – যাহা কিছু দেখিতে লাগিলাম, সে সকলই তিনি, এইরূপ বোধ হইতে লাগিল। খাইতে বসিলাম, দেখি অন্ন, থাল, যিনি পরিবেশন করিতেছেন, সে-সকলই এবং আমি নিজেও তিনি ভিন্ন অন্য কেহ নহে! দুই-এক গ্রাস খাইয়াই স্থির হইয়া বসিয়া রহিলাম। ‘বসে আছিস কেন রে, খা না’ – মায়ের ঐরূপ কথায় হুঁশ হওয়ায় আবার খাইতে আরম্ভ করিলাম। ঐরূপ খাইতে, শুইতে, কলেজ যাইতে, সকল সময়েই ঐরূপ দেখিতে লাগিলাম এবং সর্বদা কেমন একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হইয়া রহিলাম। রাস্তায় চলিয়াছি, গাড়ি আসিতেছে দেখিতেছি, কিন্তু অন্য সময়ের ন্যায় উহা ঘাড়ে আসিয়া পড়িবার ভয়ে সরিবার প্রবৃত্তি হইত না! – মনে হইত, উহাও যাহা আমিও তাহাই! হস্ত-পদ এই সময়ে সর্বদা অসাড় হইয়া থাকিত এবং আহার করিয়া কিছুমাত্র তৃপ্তি হইত না। মনে হইত যেন অপর কেহ খাইতেছে। খাইতে খাইতে সময়ে সময়ে শুইয়া পড়িতাম এবং কিছুক্ষণ পরে উঠিয়া আবার খাইতে থাকিতাম। এক একদিন ঐরূপে অনেক অধিক খাইয়া ফেলিতাম। কিন্তু তাহার জন্য কোনরূপ অসুখও হইত না! – মা ভয় পাইয়া বলিতেন, ‘তোর দেখছি ভিতরে ভিতরে একটা বিষম অসুখ হয়েছে’ – কখনও কখনও বলিতেন, ‘ও আর বাঁচবে না’। যখন পূর্বোক্ত আচ্ছন্ন ভাবটা একটু কমিয়া যাইত, তখন জগৎটাকে স্বপ্ন বলিয়া মনে হইত! হেদুয়া পুষ্করিণীর ধারে বেড়াইতে যাইয়া উহার চতুষ্পার্শ্বে লৌহরেলে মাথা ঠুকিয়া দেখিতাম, যাহা দেখিতেছি তাহা স্বপ্নের রেল, অথবা সত্যকার! হস্ত-পদের অসাড়তার জন্য মনে হইত, পক্ষাঘাত হইবে না তো? ঐরূপে কিছুকাল পর্যন্ত ঐ বিষম ভাবের ঘোর ও আচ্ছন্নতার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাই নাই। যখন প্রকৃতিস্থ হইলাম, তখন ভাবিলাম উহাই অদ্বৈতবিজ্ঞানের আভাস! তবে তো শাস্ত্রে ঐ বিষয়ে যাহা লেখা আছে, তাহা মিথ্যা নহে! তদবধি অদ্বৈততত্ত্বের উপরে আর কখনও সন্দিহান হইতে পারি নাই।”
নরেন্দ্রের সহিত গ্রন্থকারের একদিবস আলাপের ফল
অন্য একটি আশ্চর্য ঘটনাও আমরা নরেন্দ্রনাথের নিকটে সময়ান্তরে শুনিতে পাইয়াছিলাম। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের শীতকালে, যখন তাঁহার সহিত আমরা বিশেষভাবে পরিচিত হইয়াছি, তখন তিনি আমাদিগের নিকটে ঐ ঘটনার উল্লেখ করিয়াছিলেন। কিন্তু আমাদিগের অনুমান ঘটনাটি এই কালে হইয়াছিল। সেজন্য এইখানেই ঐ বিষয়ে পাঠককে বলিতেছি। আমাদিগের স্মরণ আছে, বেলা দুই প্রহরের কিছু পূর্বে সেদিন আমরা সিমলার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রীটস্থ নরেন্দ্রনাথের ভবনে উপস্থিত হইয়াছিলাম এবং রাত্রি প্রায় এগারটা পর্যন্ত তাঁহার সহিত অতিবাহিত করিয়াছিলাম। শ্রীযুক্ত রামকৃষ্ণানন্দ স্বামীজীও সেদিন আমাদিগের সঙ্গে ছিলেন। প্রথম দর্শন-দিন হইতে আমরা নরেন্দ্রের প্রতি যে দিব্য আকর্ষণে আকৃষ্ট হইয়াছিলাম, বিধাতার নিয়োগে উহা সেদিন সহস্রগুণে ঘনীভূত হইয়া উঠিয়াছিল। ইতঃপূর্বে আমরা ঠাকুরকে একজন ঈশ্বরজানিত ব্যক্তি বা সিদ্ধপুরুষ মাত্র বলিয়া ধারণা করিয়াছিলাম। কিন্তু ঠাকুরের সম্বন্ধে নরেন্দ্রনাথের অদ্যকার প্রাণস্পর্শী কথাসমূহ আমাদের অন্তরে নূতন আলোক আনয়ন করিয়াছিল। আমরা বুঝিয়াছিলাম, মহামহিম শ্রীচৈতন্য ও ঈশা প্রভৃতি জগদ্গুরু মহাপুরুষগণের জীবনেতিহাসে লিপিবদ্ধ যে-সকল অলৌকিক ঘটনার কথা পাঠ করিয়া আমরা এতকাল অবিশ্বাস করিয়া আসিতেছি, তদ্রূপ ঘটনাসকল ঠাকুরের জীবনে নিত্যই ঘটিতেছে – ইচ্ছা বা স্পর্শমাত্রেই তিনি শরণাগত ব্যক্তির সংস্কারবন্ধন মোচনপূর্বক তাহাকে ভক্তি দিতেছেন, সমাধিস্থ করিয়া দিব্যানন্দের অধিকারী করিতেছেন, অথবা তাহার জীবনগতি আধ্যাত্মিক পথে এরূপভাবে প্রবর্তিত করিতেছেন যে, অচিরে ঈশ্বরদর্শন উপস্থিত হইয়া চিরকালের মতো সে কৃতার্থ হইতেছে! আমাদের মনে আছে, ঠাকুরের কৃপালাভ করিয়া নিজ জীবনে যে দিব্যানুভবসমূহ উপস্থিত হইয়াছে, সে-সকলের কথা বলিতে বলিতে নরেন্দ্রনাথ সেদিন আমাদিগকে সন্ধ্যাকালে হেদুয়া পুষ্করিণীর ধারে বেড়াইতে লইয়া গিয়াছিলেন এবং কিছুকালের জন্য আপনাতে আপনি মগ্ন থাকিয়া অন্তরের অদ্ভুত আনন্দাবেশ পরিশেষে কিন্নরকণ্ঠে প্রকাশ করিয়াছিলেন –
“প্রেমধন বিলায় গোরা রায়!
চাঁদ নিতাই ডাকে আয় আয়!
(তোরা কে নিবি রে আয়!)
প্রেম কলসে কলসে ঢালে তবু না ফুরায়!
প্রেমে শান্তিপুর ডুবু ডুবু
নদে ভেসে যায়!
(গৌর-প্রেমের হিল্লোলেতে)
নদে ভেসে যায়!”
নরেন্দ্রের অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ
গীত সাঙ্গ হইলে নরেন্দ্রনাথ যেন আপনাকে আপনি সম্বোধনপূর্বক ধীরে ধীরে বলিয়াছিলেন, “সত্য সত্যই বিলাইতেছেন! প্রেম বল, ভক্তি বল, জ্ঞান বল, মুক্তি বল, গোরা রায় যাহাকে যাহা ইচ্ছা তাহাকে তাহাই বিলাইতেছেন! কি অদ্ভুত শক্তি! (কিছুক্ষণ স্থির হইয়া থাকিবার পরে বলিতেছেন) রাত্রে ঘরে খিল দিয়া বিছানায় শুইয়া আছি, সহসা আকর্ষণ করিয়া দক্ষিণেশ্বরে হাজির করাইলেন – শরীরের ভিতরে যেটা আছে সেইটাকে; পরে কত কথা কত উপদেশের পর পুনরায় ফিরিতে দিলেন! সব করিতে পারেন – দক্ষিণেশ্বরের গোরা রায় সব করিতে পারেন!”
গ্রন্থকারের বাসস্থানে আসিয়া নরেন্দ্রের অপূর্ব উপলব্ধি
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া তামসী রাত্রিতে পরিণত হইয়াছে। পরস্পর পরস্পরকে দেখিতে পাইতেছি না, প্রয়োজনও হইতেছে না। – কারণ, নরেন্দ্রের জ্বলন্ত ভাবরাশি মরমে প্রবিষ্ট হইয়া অন্তরে এমন এক দিব্য মাদকতা আনিয়া দিয়াছে – যাহাতে শরীর টলিতেছে এবং এতকালের বাস্তব জগৎ যেন দূরে স্বপ্নরাজ্যে অপসৃত হইয়াছে, আর অহৈতুকী কৃপার প্রেরণায় অনাদি অনন্ত ঈশ্বরের সান্তবৎ হইয়া উদয় হওয়া এবং জীবের সংস্কার-বন্ধন বিনষ্ট করিয়া ধর্মচক্রপ্রবর্তন-করারূপ সত্য – যাহা জগতের অধিকাংশের মতে অবাস্তব কল্পনাসম্ভূত – তাহা তখন জীবন্ত সত্য হইয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়াছে! – সময় কোথা দিয়া কিরূপে পলাইল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না, কিন্তু সহসা শুনিতে পাইলাম রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় গ্রহণ করিবার সঙ্কল্প করিতেছি, এমন সময়ে নরেন্দ্র বলিলেন, “চল, তোমাদিগকে কিছুদূর অগ্রসর করিয়া দিয়া আসি।” যাইতে যাইতে আবার পূর্বের ন্যায় কথাসকলের আলোচনা আরম্ভ হওয়ায় আমরা এতদূর তন্ময় হইয়া যাইলাম যে, চাঁপাতলার নিকটে বাটীতে পৌঁছিবার পরে মনে হইল, শ্রীযুত নরেন্দ্রকে এতদূর আসিতে দেওয়া ভাল হয় নাই। সুতরাং বাটীতে আহ্বান করিয়া কিছু জলযোগ করাইবার পরে বেড়াইতে বেড়াইতে তাঁহাদের বাটী পর্যন্ত তাঁহাকে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিলাম। সেদিনকার আর একটি কথাও বিলক্ষণ স্মরণ আছে। আমাদের বাটীতে প্রবেশ করিয়াই শ্রীযুত নরেন্দ্র সহসা স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন, “এ বাড়ি যে আমি ইতঃপূর্বে দেখিয়াছি! ইহার কোথা দিয়া কোথা যাইতে হয়, কোথায় কোন্ ঘর আছে, সে সকলি যে আমার পরিচিত – আশ্চর্য!” নরেন্দ্রনাথের জীবনে সময়ে সময়ে ঐরূপ অনুভব আসিবার কথা এবং উহার কারণ সম্বন্ধে তিনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা আমরা পাঠককে অন্যত্র বলিয়াছি। সেজন্য এখানে আর তাহার পুনরুল্লেখ করিলাম না।