নিখোঁজ – খোদেজা মস্তুর
সে যদি একলা হত, তবু কথা ছিল। পাথরের দেওয়ালে মাথা ঠুকে আবর্জনার মতো তুচ্ছ এই জীবনটাকে শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু আরো তিনটি প্রাণী রফিকের জীবনের কণ্ঠহার। কণ্ঠহারে ওরা তিনজন তিনটি মোতির মতো– একটিকেও সে এই মালা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
বিয়ের পর তাদের সেই প্রখর যৌবনের দিনে তারা ছিল সন্তানের কাঙাল। আল্লার কাছে কত কাকুতিমিনতি করেছে, কত মোনাজাত করেছে সন্তানের জন্য, কিন্তু তা পূর্ণ হয়নি। তারপর, যৌবন যেন ক্ষণস্থায়ী, তা যখন ফুরিয়ে যাচ্ছে, তখনো তারা নিঃসন্তান। আল্লাকে স্মরণ করার কথাও তখন ভুলে গিয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা এই অসহায়তা দেখে বুঝিয়েছে, ‘রফিক মিয়া, দোয়ার জোরে পাথরও গলে যায়– আর তোমার এই সামান্য আরজি আল্লা শুনবেন না, তা কি কখনো হতে পারে। নিরাশ হয়ো না, খাঁটি মন নিয়ে আল্লাকে ডাক। ডাকার মতো করে ডাক, তাহলেই পাবে।’ কিন্তু রফিকের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পাড়ার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের খেলতে দেখলে কখনো কোলে তুলে নিতে ইচ্ছা করে, আবার কখনো বিষাক্ত হয়ে ওঠে মন। নিজের একটা সন্তান লাভের ইচ্ছার অপূর্ণতা গোটা বিশ্ব-সংসারের প্রতি তার মনকে করে তোলে বিরূপ। এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন রফিকের বউ দাঁতের ডগায় ওড়নার আঁচল চেপে ধরে
লজ্জারাঙা হয়ে বলল, ‘তোমার দোয়া আল্লা কবুল করেছেন।
একটা পেয়েই তাদের আনন্দের সীমা ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় বছরেই আরো একটা যখন এল, তখনো তারা আল্লার উদ্দেশে মাটিতে মাথা রেখে তাঁর হাজার শুকুর আদায় করল। রফিক নিজেই যেন একটা ছোট শিশু তেমনি শিশুর মতো করেই সে আনন্দ যতই খারাপ হোক– গরিবের আনন্দ প্রকাশ করে বেড়াতে লাগল সর্বত্র। অবস্থা বাঁধনহারা। এ কথাও তার স্মরণ থাকে না যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ করার শক্তিও ফুরিয়ে এসেছে : অল্পতেই হাত-পা ক্লান্ত হয়ে আসে। এই ক্ষুদ্র দুটি প্রাণকে বড় করে তুলতে এক যুগ সময়ের দরকার। আর, এক যুগ সময় কাটানোর জন্য দরকার অনেক টাকা-পয়সার।
যখন সুদিন ছিল আর গায়ে ছিল জোয়ানির তাকত, তখন মজুর খেটে অনেক পয়সা সে আয় করেছে। তখনকার সঞ্চয় এই বেকারত্বের দিনেও ওরা খরচ করে আসছে। সঞ্চয় এমন কিছু নয়– ভালোভাবে খেলে-পরলে এক বছরের বেশি যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু রফিকের বউ শুকনো রুটি খেয়ে এমনভাবে খরচ চালিয়েছে যে, এতদিন পর্যন্ত তা টেনে আনা গেল। কত কষ্ট স্বীকার করেছে, কিন্তু স্বামীকে একটা কথা বলেনি। কারণ, সে নিজের চোখে দেখছে, কাজের খোঁজে সারাদিন লোকটা কেমন পই পই করে ঘোরে। হাঁটুর ব্যথায় যার চৌ-প্রহর বিছানায় পড়ে থাকার কথা, সে আরাম কাকে বলে জানে না।
কিন্তু আর তো চুপ থাকা যায় না। পানি যখন গলা পর্যন্ত উঠেছিল, তখনো রফিকের বউ কিছুই বলেনি; এখন মাথাটাই ডুবতে বসেছে, কেমন করে চুপ থাকে। খাবার সময় হলে সবাই তো তার কাছেই আসবে। কাজেই তাকে বলতে হল, ‘আজকের দিনটাও কোনোরকমে কাটল, কাল সকালে কিন্তু চুলো জ্বলবে না।’
শুনে রফিকের চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল। মনে হল, শ্মশান থেকে উঠে আসা একসারি কঙ্কাল তার চোখের সামনে নৃত্য জুড়ে দিয়েছে।
সাত-সকালে উঠে সে বাইরে বেরুল। পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে উনুন জ্বলছে। তারই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশপানে ছুটছে। এই ধোঁয়া আজ তার রান্নাঘরের চাল থেকে বের হবে না ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ছেলেদের আজ সে কেমন করে খেতে দেবে, চতুর্দিকে একবার করে সে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। এ-পাড়ার সব কুঁড়েঘর তার চেনা। কিন্তু কেমন করে গিয়ে সে বলবে, আজ আমাদের ঘরে উনুন জ্বলেনি। আজ পর্যন্ত কখনো সে হাত পাতেনি কারও কাছে। কোনো দোকানে গিয়ে আটা ডাল ধার চাইবে, সেরকম মনোবলও তো তার নেই।
দোকানের কথা ভাবতেই সামনের মোড়ের মওলা মুদির দোকানের কথা তার স্মরণ হল। তার সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা অনেক দিনের। নিজে লেখাপড়া জানে না, কিন্তু খবরের কাগজে চুরি-ডাকাতি, লোমহর্ষক রাহাজানি, নারী হরণ, বাজার-দর ইত্যাদি খবর শুনতে মওলা মুদির খুব ভালো লাগে। রফিক নিজেও বিশেষ লেখাপড়া জানে না; কিন্তু কোনোরকমে উর্দুটা পড়ে নিতে পারে। প্রত্যেকদিন সকাল বেলায় গিয়ে মওলাকে সে খবরের কাগজ পড়ে শুনিয়ে দিয়ে আসে। এই সুবাদেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। আর, খবর শোনার নেশা মওলার এত যে, হাড়-কিপটে হলেও খবরের কাগজটা সে রোজ নিজের পয়সা দিয়েই কেনে।
কিন্তু মওলা মুদির দোকান আজ এখনো বন্ধ। হয়তো এখনো সময় হয়নি– রফিক এসে গেছে অনেক সকালে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস, কোনোরকমে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে চাইতে পারলে ধারে জিনিস সে দেবে। খবরের কাগজ পড়ে দেওয়া ছাড়াও সে আরো কত কাজ করে দেয় মওলার। কাজেই সে আশায় বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকল দোকান খোলার অপেক্ষায়।
মওলা মুদি এল খবরের কাগজ বগল-দাবা করে প্রায় দশটা বাজিয়ে। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে রফিক গিয়ে বসল তার নির্দিষ্ট ভাঙা চেয়ারটায়। পড়তে শুরু করে দিল। কিন্তু আজ আর পড়ায় মন নিবিষ্ট করতে পারছে না। জানা শব্দও আজ তাকে বানান করতে হচ্ছে। এইভাবে কোনোরকমে দায় সেরে সে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকল। তার ধারণা, এইরকম গুমটি মেরে বসে থাকলে মওলা কারণ জানতে চাইবে। কিন্তু মওলা মুদি নিজের কাজে ব্যস্ত। ধুলো ঝাড়ার কাজ শেষ করে এখন সে হিসাবের খাতা দেখতে বসে গেল। অনন্যোপায় হয়ে রফিক কথাটা পাড়ল।
শুনে মওলা মুদি খুব ইতস্তত করতে লাগল। তারপর তার কাছে যখন কড়ার করল যে, যেমন করে হোক, আজ সন্ধ্যার মধ্যে দাম দিয়ে দেবে, তখন মওলা তাকে দু’সের আটা আর এক পোয়া ছোলার ডাল ওজন করে দিল।
সওদা নিয়ে রফিক যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তত হচ্ছে, মওলা মুদি তখন তাকে আরো একবার বুঝিয়ে দিল যে, ওর এই ছোট দোকান ধারে জিনিস দিলে একেবারেই অচল হয়ে পড়বে; এমনকি দু-চার দিনের জন্যেও সে ধার আটকে রাখতে পারে না।
এ কথা শুনে ওর লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু করার কিছুই নেই। ছেলেদের মুখে রুটি গুঁজে দিতে হবে। গলায় মালার একটা মোতিও সে ছিঁড়তে পারে না। বাড়ি গিয়ে বউ-এর হাতে পোঁটলা দিয়ে চুপচাপ আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ল সে।
তিন-চার ঘণ্টা ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়ানোর পর সে অনুভব করল, প্রত্যেকদিন ছেলেদের মুখে রুটি তুলে দেওয়া সহজ নয়। গরিব লোকের জন্য শৌখিন মিষ্টির দোকান কাছে থাকলেও যেমন নাগালের বাইরে, তার জন্যে তেমনি কাজ করে রোজগার করাটা দুঃসাধ্য।
রফিক তবু শব্জি-বাজারে কাজ করে। আধ মাইল দূরে একটা দোকানে চার ঝুড়ি মাল পৌঁছে দিয়ে পেল বারো আনা। শেষ ঝুড়িটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মনে হতে লাগল, মাথাটা তার সেই বলদের শিঙের মতো, যার উপর এই দুনিয়াটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। শোনা যায়, এক শিং ক্লান্ত হলে সে অন্য শিঙের উপর দুনিয়ার বোঝা পালটে নেয়, আর তখনই দুনিয়ার কোথাও না-কোথাও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। কিন্তু রফিকের শিং, অর্থাৎ মাথা তো মাত্র একটাই– বদল করার কোনো জো নেই।
বারো আনার বারো আনাই মওলা মুদিকে দিয়ে সে খালি হাতে বাড়ি ফিরল। বুকটা তখন বড্ড খচখচ করতে লাগল একটা কথা ভেবে। এত খাটল, তবু ছেলেদের জন্য এক আনার লেবুনচুসও আনতে পারল না। আঙিনায় রাখা ছেঁড়া খাঁটিয়ার উপর শুয়ে পড়ল সটান হয়ে। ছেলেরা এই প্রথম বাবাকে সারাদিন দেখতে পায়নি। তাই দুজনেই হইচই শুরু করে দিল। কেউ বুকের উপর, আর কেউ পায়ের উপর লাফাতে লাগল। তারপর, মুখে ঘোড়ার খুরের কৃত্রিম শব্দ তুলে বলল, ‘আমরা ঘোড়ায় চাপব।’
ঘোড়া সাজবার সাধ্য এখন তার নেই। তবু একজন একজন করে ছেলেদের পিঠে চাপিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ সে ঘুরল। এত তাড়াতাড়ি নেমে পড়তে হল বলে অসন্তুষ্ট হল ছেলেরা। রফিক বলল, ‘ঘোড়া এখন বুড়ো হয়েছে। বুড়ো ঘোড়া চলতে পারে না, আরাম করে।
ছেলেরা চলে গেল রাগ করে। আর রফিক আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকল। আকাশে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে পাখির দল এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে চলে যাচ্ছে।
বউ হয়তো সবই বুঝল, কিন্তু কিছুই বলল না। বলার তার কিছুই নেই। চুপচাপ চলে গেল খাবারের আয়োজন করতে।
এদিকে হাঁটুর ব্যথায় রফিক ঝাঁকিয়ে উঠল। পা দুটোকে গুটিয়ে নিল বুকের কাছে। মুখ বিকৃত করে সে পড়ে থাকল চোখ বুঁজে। মোট বইবার কাজ করতে গিয়ে হয়তো, এ ব্যথা এত বেড়েছে।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে ঘুমন্ত ছেলে দুটোর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আপন মনে বলতে লাগল, ‘কাল আমি তোদের জন্যে লেবুনচুস নিয়ে আসব, দুধ-মালাই নিয়ে আসব।’ কী ভেবে আবার নিজের মনেই বলল, ‘না, না, দুধ-মালাই আনতে পারব না– অনেক দাম, তবে লেবুনচুস নিশ্চয়ই আনব।’
হাঁটুর ব্যথায় বড় কষ্ট পাচ্ছে, ঘুম আসছে না। বউ অনেকক্ষণ ধরে পা টিপে দিল। তারপর, আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল– গভীর ঘুম।
সকালে উঠে মওলা মুদির কাছে থেকে আবার আটা-ডাল ধারে আনল। আজকে আর ধার দিতে সে আপত্তি করল না। হয়তো বুঝেছে, এ বাকি রাখার লোক নয়। হলও তাই। শবজিবাজারে দোকানে দোকানে মাল পৌঁছে দিয়ে এক টাকা আয় করল। বারো আনা দিল মুদিকে। এক আনার লেবুনচুস কিনল। আজকে বেশি ঝুড়ি বয়েছে। তাই হাঁটুর ব্যথাও কালকের চাইতে বেশি। কিন্তু ছেলেদের লেবুনচুস খাওয়া দেখে আর ওড়নার খুঁটে বউকে তিন আনা পয়সা বাঁধতে দেখে হাঁটুর ব্যথা ভুলে গেল রফিক। সেই আনন্দের টানে টানে সে ছেলেদের সঙ্গে ঘোড়া-ঘোড়াও খেলল। কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না। এত তাড়াতাড়ি নামতে হল বলে ছেলেরা রাগ করল। রফিক বলল, ‘ঘোড়া এখন বুড়ো হয়েছে। বুড়ো ঘোড়া চলতে পারে না, আরাম করে।’
এইরকম চলতে লাগল প্রত্যেকদিন। সকাল বেলায় মওলা মুদির দোকানে গিয়ে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, লুটতরাজ, দাঙ্গা, নারী হরণের খবর শুনিয়ে আসে। বিনিময়ে ধারে কিনে আনতে পারে আটা-ডাল। তারপর, চলে যায় শবজি-বাজারে মজুর খাটতে। এখন সে তার নিজের শক্তির পরিমাপ গ্রহণ না-করেই ছয়টা পর্যন্ত ঝুড়ি বয়ে নিয়ে যায় দুপুরের প্রখর রোদ অমান্য করে। তারপর বেলা গড়িয়ে বাড়ি ফিরতে পারে।
এইভাবে পনেরো-কুড়ি দিনের বেশি চলা গেল না। লু হাওয়ার গরমে শরীর ঝলসে গেল। সেই সঙ্গে হাঁটুর ব্যথা তীব্রতা লাভ করল আর ছড়িয়ে পড়ল অন্যান্য জোড়ে। ছেঁড়া খাঁটিয়ায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করতে লাগল। ব্যথার দোসর হয়ে এল জ্বর। জ্বরের বিকারে সে বকতে লাগল, ঝগড়া করতে লাগল মোট বইবার দরাদরি নিয়ে মালিকের সঙ্গে।
রফিকের বউ কখনো এর-ওর বাড়ি যাওয়া ছাড়া অন্য কোথাও যায়নি। এখন তাকে লম্বা একটা ময়লা বোরকা পরে বাইরে বেরুতে হল। মওলা মুদির দোকানে না-গেলে হাঁড়ি চড়বে না। অবশিষ্ট সময় সে কেবল অঝোর ধারে কাঁদে আর আল্লার কাছে প্রার্থনা করে। ছেলেরা ম্লান মুখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ঘোড়ায় চাপা তাদের হয় না। খেতে পায় না লেবুনচুস। পনেরো দিন পরে রফিকের জ্বর বাড়ল।
অসুস্থতার কালে মওলা মুদি প্রত্যেকদিন আটা, ডাল, সাগু দিয়েছে ধারে। প্রত্যেকদিন দু আনা, তিন আনা করে এতদিন যা বাঁচিয়েছিল, তাই দিয়ে ওষুধ আর ডাক্তারের খরচ কুলিয়েছে। মরলে গরিব লোকের কাফনের টাকাটা হয়তো চাঁদা করে তোলা যায়, কিন্তু না-মরা পর্যন্ত চিকিৎসার খরচটা গাঁট থেকে না-খসালে চলে না। কিন্তু ঋণের বোঝা এত বেড়েছে যে, তা সারাজীবন মজুর খাটলেও শোধ হওয়ার নয়। ভাবতেও তার সারা শরীর শিউরে ওঠে। রোগমুক্তির পর থেকে সবসময় তার চিন্তা, কেমন করে এই ঋণ শোধ করবে। ব্যথা কিছু কমলেও দুর্বলতার জন্য উঠবার সাধ্য নেই। তবু তার আশা, আরো আট-দশ দিন গেলে হয়তো আবার শবজি-বাজারের দিকে পা বাড়াবার যোগ্য হয়ে উঠবে সে।
জোয়ান বয়স হলে আরোগ্যলাভের পর শক্তি ফিরে পেতে সময় লাগে না বেশি। কিন্তু ওর বয়স প্রৌঢ়ত্বে এসে ঠেকেছে। তার ওপর কর্জের শুকনো রুটি খেয়ে অচিরে সে বুঝে ফেলল, দেহটা একেবারেই অকেজো হয়ে গেছে। মাত্র কিছুক্ষণের জন্য মওলা মুদির দোকানে খবরের কাগজ পড়তে গেলেও পা টলমল করে, মাথা ঘোরে, হাঁটুর ব্যথা বেড়ে যায়। বাড়ি ফিরে একাকী মুখ লুকিয়ে পড়ে থাকে। ছেলেদের দিকে তাকালে আপনি আপনি দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অঝোর ধারে।
কাজে যেতে না-পারলেও রোজ সকালে মওলার দোকানে ডিউটি দিতে যাওয়া অপরিহার্য। আটা আর ডাল ধার করতে যেতে হয়; তাছাড়া ধার যে সে শোধ করবে, এই মিথ্যা আশ্বাসটাও দিতে যেতে হয়। নিজে না-গিয়ে বড় ছেলেটাকে পাঠালে অসন্তুষ্ট হয় মওলা মুদি। রফিক তার কাছে এখন কৃপণ বেনের ঘিয়ের মতো, যে ঘি খাওয়া যায় না, কেবল আলমারির তাকে সাজিয়ে রাখা যায় সবসময় চোখের তৃপ্তি বাড়ানোর জন্য।
ওদিকে টাকা পাওয়ার জন্য মওলার কোনো তাড়া নেই। সে মনে মনে অন্য এক পাঁয়তারা কষে রেখেছে। কিন্তু রফিক মনে করছে, মওলার মতো বিপদের দিনের বন্ধু আর হয় না। একদিন সেজন্য সে তার ভদ্রতার প্রশংসাও করল। তখন মওলা তাকে বোঝাল, ধার শোধ করার ব্যাপার নিয়ে তাকে আদৌ চিন্তা করতে হবে না। যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে রফিক তার কুঁড়েঘরের ওই সামান্য মাটিটুকু মওলাকে দিয়ে দিতে পারবে। বন্ধুত্ব মানেই হচ্ছে বিপদে একজন আর একজনের কাজে আসা।
বন্ধুত্বের এই ব্যাখ্যা শোনার পর থেকে রফিক আরো ঝিমিয়ে পড়ে। তার মনে শান্তি দেওয়ার মতো এখন কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট থাকল না। বউ তার রাস্তায় নেমেছে। ছেলেরা আওয়ারা কুকুরের মতো এর-ওর বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করে। আর, এই মাথা গুঁজবার ঠাঁইটুকুও ক’দিন পরে আর তার থাকবে না।
সেদিন সে মওলা মুদিকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে গিয়ে। লিখেছে, হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির সন্ধান দিতে পারলে পাঁচশো টাকা পুরস্কার। তন্ময় হয়ে ভাবতে লাগল রফিক এই ছেলেটিকে খুঁজে পাওয়া কি তার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতেই মনের মধ্যে অজস্র চিন্তার বেড়াজালে সে নিখোঁজ করে ফেলল নিজেকে। পাঁচশো টাকা। যখন তার সুদিন ছিল, তখন সে এই কুঁড়েঘরটা তুলেছিল। এ তার নিজের ভিটেমাটি। পাঁচশো টাকা পেলে সুদিনের এই স্মৃতিটাকে রক্ষা করতে পারবে সে। তাছাড়া নিজে কিছু ভালো জিনিস খেয়ে গায়ে তাকত আনবে, যেন সে আবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারে। ছি ছি, কী লজ্জার কথা। সে নিজের ছেলেদের কথা আগে ভাবেনি। ওদের জন্য লেবুনচুসের আস্ত একটা টিন কিনে ফেলবে। আর, বউটা খেটে খেটে একেবারে অস্থিচর্মসার– ওর জন্যও অনেক কিছু করতে হবে বইকি। তাছাড়া, পাঁচশো টাকার একটা বাচ্চাতেই তো আর ‘নিখোঁজ’ বিজ্ঞপ্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আরো কতজনের কত আদরের ছেলে বা মেয়ে নিখোঁজ হবে। তারা যদি হাজার টাকা বা পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বসে, তাহলে তাতেই-বা আর বিস্মিত হওয়ার কী থাকতে পারে। যার অনেক দৌলত, তার কাছে টাকা আগে, না সন্তান আগে? বাড়ি ফিরে খুব রহস্যপূর্ণ ভঙ্গিতে বউকে পুরস্কারের কথা জানাল। আর বলল, আল্লার কাছে, যেন কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে।
কিন্তু ঘরের কোণায় বসে থাকলে নিখোঁজ শিশুকে পাওয়া যাবে না। সুতরাং, সে রাস্তায় নামল। রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে গলিতে, পার্কে-ময়দানে নিখোঁজ শিশুকে খুঁজে বেড়ালো হন্যে হয়ে। দুর্বলতা হেতু মাথা ঘুরলে কিংবা হাঁটুর ব্যথা চাড়া দিয়ে উঠলে এক জায়গায় থপ্ করে বসে পড়ল। বসে বসেই খুঁজতে লাগল নিখোঁজ শিশুকে। বাচ্চা দেখলেই সে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। কিছু যেন মিল পাওয়া যাচ্ছে! না, এ দেখার ভুল। কোনো ছেলেকে একা একা কাঁদতে দেখলে সে ছুটে যায়। কিন্তু ধরতে পারার আগেই ছেলেটা পালিয়ে যায় কিংবা ঢুকে পড়ে নিজের বাড়িতে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে অগোচরে। তবু মনে মনে ভাবে, আশাই এখন সম্বল, হাল ছাড়া উচিত নয়।
ঘুরতে ঘুরতে সে একটা বড় রাস্তায় নামল। অন্য কারও ছেলে নয়– যেন সে নিজেরই কোনো হারানো মানিককে খুঁজছে। সেই মানিক খুঁজতে খুঁজতে শেষে বড় একটা প্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে ভিড় দেখে থামল। সম্ভবত বিয়ে-বাড়ি। সামনের প্রশস্ত উদ্যানে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। তার নিচে খানা-পিনার আয়োজন। বহু চেয়ার-টেবিল, লোকজন। ব্যান্ড বাজছে। ছেলে-মেয়েরা রং-বেরঙের পোশাক পরে ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি করছে। প্রাসাদের ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব দেখতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে। রফিক ভাবছে, তার ছেলের যখন বিয়ে হবে, তখন ব্যান্ড-পার্টি না আনতে পারুক, সানাই নিশ্চয় বাজবে, মেহমানদের পোলাও-জর্দা খাওয়াবে, আর কনের জন্য খুব দামি না হোক, ভালো পছন্দসই কাপড়-চোপড়, অলঙ্কার কিনে আনবে।… এমনি আরো কত কী চিন্তার মগ্নতা ছিন্ন করে সামনে এসে দাঁড়াল ভৌতিক স্বপ্নের মতো মওলা মুদির প্রলুব্ধ চোখ দুটো। আর, অমনি হাঁটুর ব্যথাটা সে টের পেল। আর, চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল দু’গাল বেয়ে।
তখনো তার চোখের পানি শুকোয়নি। এমন সময় দুটি শিশু ছুটতে ছুটতে ফটকের বাইরে এসে পড়ল। একটা ছেলে তাড়াচ্ছিল একটা মেয়েকে। একেবারে রফিকের সামনে এসে পড়লে ছেলেটা মেয়েটিকে ধরে ফেলল, তারপর বেশ কয়েকটা কিল-চড় মারল। রফিক গিয়ে বাধা দিতে পারার আগেই আরো কয়েকটা কিল-ঘুষি মেরে দিয়ে সে পালিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। ছোট মেয়েটি কাঁদতে লাগল গলা ফাটিয়ে। রফিক তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। আস্তে আস্তে কান্না থামাল মেয়েটি।
‘নাম কী, মা তোমার?’ আদর করতে করতে প্রশ্ন করল রফিক।
‘তা-তা-তাতি।’ কান্নার রেশ তখনো থামেনি, তার ওপর এত বেশি তোতলাচ্ছে যে, কী সে বলল, তা ভালোমতো বোঝাই গেল না।
রফিক তাকে আরো বেশি আদর করতে লাগল, আর আদর করতে করতেই হঠাৎ তার মাথায় একটা বদ-খেয়াল চেপে গেল। মেয়েটিকে সে চুরি করবে। কিন্তু না, চুরি করা মহা-পাপ। সে কখনো কোনোরকম পাপের পথে পা রাখেনি। কিন্তু মওলা মুদির চোখ দুটোকে কেমন করে তার ভিটেমাটির ওপর থেকে সরাবে সে এইসব ভাবছে আর এদিকে-ওদিক তাকাচ্ছে চোরের মতো– কেউ-না আবার দেখে ফেলে এই অবস্থায়। রাস্তা দিয়ে যত লোক যাচ্ছে, তারা সবাই যেন ওকে সন্দেহের চোখে দেখছে। তারা যদি টের পায় ওর উদ্দেশ্য, তাহলে যে কী অবস্থা হবে তা সে ভাবতেও পারে না। তারপর একসময়, রাস্তায় যখন আর কেউ নেই, তখন মেয়েটিকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে প্রথমে একটা গলিতে ঢুকল; তারপর নানা ঘোরাল পথ, গলি-পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সটান উঠল গিয়ে নিজের বাড়িতে। মেয়েটি কখন কাঁধের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, তা সে টেরও পায়নি।
বউ ছুটতে ছুটতে কাছে এল। ‘কী ব্যাপার? এ মেয়েকে কুড়িয়ে পেলে? হারিয়ে গিয়েছিল? বড়লোকের মেয়ে মনে হচ্ছে!’
‘হ্যাঁ, হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি। খুব বড়লোকের মেয়ে।’ রফিক বউকে মিথ্যা বলল। তারপর হাঁক ছাড়ল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? পরিষ্কার ওয়াড়অলা বালিশ আনো। আস্তে করে শুইয়ে দাও, যেন কোথাও চোট না লাগে। এয়ারকন্ডিশনে মানুষ– তুমি ওর মাথার কাছে হাত-পাখাটা নিয়ে বসে থেক।’
রফিকের বউ বালিশ এনে মেয়েকে শোয়াল। তারপর, হাত-পাখার বাতাস দিতে লাগল। রফিকের ছেলে দুটো এমন জমকালো পোশাক-পরা মেয়ে দেখে অবাক হয়ে গেছে। তাই দেখে রফিক বলল, ‘আমি তোদের এর চাইতে ভালো জামা বানিয়ে দেব, দেখিস। আর নতুন জুতোও পাবি। তাই পরে হেঁটে বেড়াবি মমশ্ করে।’ ছেলেদের কাছে টেনে নিয়ে খুব খানিক আদর করল, তারপর বউকে বলল, ‘তুমি মা-মণির কাছ থেকে সরে যেও না কিন্তু। একলা আবার ভয় পেয়ে যেতে পারে। আমি ততক্ষণে ওর খাবার ব্যবস্থা দেখি। শুকনো বাসি রুটি তো আর ওর খাওয়ার অভ্যেস নেই।’ এই বলে সে বাইরে চলে গেল তাড়াতাড়ি।
মওলা মুদির কাছে পাঁচ টাকা ধার চাইল। ওর কুঁড়েঘরের দিকে প্রলুব্ধ দৃষ্টি হেনে সে ঠোঁটের কোণায় মিহি করে হাসল। ভাড়াটে বাসায় বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে আরো কতদিন কষ্ট করতে হবে, সে তার হিসাব নিল মনে মনে। তারপর যোগ-বিয়োগের ফলাফল সন্তোষজনক মনে হওয়ায় পাঁচ টাকা ধার দিতে সে আর দেরি করল না। ওই কুঁড়েঘর ভেঙে ওখানে একটা ছোটখাটো বাড়ি তুলবে যেদিন, সেদিন তার বেশি দূরে নয়।
মেয়েকে ক্ষীর খাওয়ানোর মানসে কিনে নিয়ে গেল দুধ, পাটালিগুড় আর খুশবু মিহি চাল। দুপুর গড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ওর বউকে আবার নতুন করে চুলো ধরাতে হল। এদিকে ক্ষীর রান্না হচ্ছে, ওদিকে রফিক দৌড়াতে দৌড়াতে আবার বাজারে গেল। মেয়ের জন্য কিছু মিষ্টান্ন আনা হয়নি। বাড়ি ফিরে দেখে মেয়ে জেগে গেছে। জেগেই কাঁদতে শুরু করে দিল সে। মিষ্টি দিয়ে ভুলিয়ে ভুলিয়ে রফিক তার কান্না থামাল। কিন্তু মিষ্টি ফুরোলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অপরিচিত পরিবেশ দেখে আবার কাঁদতে আরম্ভ করল। তখন কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল রফিক, আর অদ্ভুত অদ্ভুত সব শব্দ করে তার কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।
ছেলেদের বলল, ‘তোরা দুজন হাততালি দে।’ তাদের হাততালি শুনে মেয়ে থামল। কিন্তু হাততালি থামতে আবার চিৎকার জুড়ে দিল। ততক্ষণে ক্ষীর তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রফিক নিজের হাতে ধরে ধরে মেয়েকে ক্ষীর খাওয়াতে আরম্ভ করল। কিন্তু দূরে নিজের ছেলেদের চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বউয়ের ওপর বিগড়ে গেল ভীষণ। ‘তুমি আমার ছেলেদের ক্ষীর দাওনি কেন?’
নিজের ছেলেদের কাছেও পরিবেশন করা হল ক্ষীর। ক্ষীর খেয়ে মেয়ে অনেকক্ষণ চুপ থাকল বটে, কিন্তু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল এখানকার অপরিচিত পরিবেশকে। রফিক বউকে বলল আশ্বস্ত হয়ে, ‘ক্ষিদে পেয়েছিল, সেই জন্যে কাঁদছিল। দেখ, এখন কেমন চুপ করেছে।’
‘হ্যাঁ, তা যেন হল। কিন্তু মা-মণির ক্ষীর পছন্দ হয়েছে কিনা কে জানে!’ বউ বলল। রফিক জানতে চাইল, ‘কী মা-মণি, ক্ষীর তোমার ভালো লেগেছে তো?’
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল মেয়েটি।
‘তোমার আব্বার নাম কী?’
সংক্ষিপ্ত উত্তর এল, ‘আব্বা।’ ওরা দুজন হেসে ফেলল তাই শুনে
‘তোমার আব্বা কী করেন?
‘লুটি খান।’
‘রুটি খান? আর কিছু করেন না?’
‘বলফের পানি খান। লেডিও শোনেন
ওরা দুজন এই শুনে খুব হাসল। রফিক বউকে বলল, ‘বড়লোকের কাণ্ডই আলাদা। উঠতে খান, বসতে খান, শুতে শুতেও খান।’ আনন্দে রফিক আত্মহারা। আজকে সে হাঁটুর ব্যথার কথাও সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। আনন্দের জোয়ার এসেছে তার মনে। সে কোনো কিছুই গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছে না। কেবল একটা চিন্তাই তার মাথায় বারবার ঘুর-পাক খাচ্ছে। আর, তা হচ্ছে : দৌলত সে এখনো পেয়ে যদি না-ও গিয়ে থাকে, পেতে বিশেষ আর বিলম্ব নেই।
‘ঘোড়া-ঘোড়া খেলবে, মা-মণি?’
রফিকের এই প্রস্তাব সে সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিল। আর, অমনি রফিক লুঙ্গি গুটিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ল। তারপর সারা আঙিনায় এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে সে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতে লাগল মেয়েকে পিঠে চাপিয়ে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে মেয়ে খুব আনন্দ পেল, আর হাসল খিলখিল করে। তারপর, ক্লান্ত হয়ে যখন সে মেয়েকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিল, তখন তার হাঁটু দিয়ে রক্ত ঝরছিল।
বউ সেই রক্ত দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলে রফিক বলল, ‘ও কিছু নয়– আমার একটুও কষ্ট হয়নি।’ তারপর, লুঙ্গি দিয়ে রক্ত মুছে ফেলল।
এইভাবে দিনটা কেটে গেল। কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি আবার কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। আবার তাকে মিষ্টি কিনে এনে খাওয়ানো হল, ওর জন্য বিশেষভাবে জর্দা রান্না করে তা-ও খাওয়ানো হল, বউ অনেকক্ষণ পর্যন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে টহল দিয়ে বেড়াল, কিন্তু কিছুতেই তার কান্না থামানা গেল না। অবশেষে সে নিজে নিজেই ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত হয়ে ঘুমুনোর সঙ্গে সঙ্গেই সারাটা ঘর জুড়িয়ে গেল। শোয়ার সময় না-হওয়া সত্ত্বেও নিজের ছেলেদেরও ঘুমিয়ে পড়তে বলল সে। তাদের কলরবে মেয়ে যদি জেগে যায়, তাহলে ভারি বিপদ হবে। রফিকের বউ মাথার কাছে বসে বসে পাখা করতে লাগল। না-জানি, নিজের বাড়িতে সে কত আরামে ঘুমায়। আর, রফিক মনে মনে অস্থির হয়ে মেয়ের চারপাশে ছটফট করে বেড়াতে লাগল। কিছুতেই সে নিশ্চিন্ত হয়ে দু’দণ্ড বসতে পারছে না। কেবলই ভাবছে যে, পুরস্কার যদি অন্তত এক হাজার টাকাও পাওয়া যায়, তাহলেও ওদের অনেক দুঃখ ঘুচবে। এইকথা সে ভাবছে আর কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। রফিক ফিফিস্ করে বউয়ের কাছে জানতে চাইল, ‘এক হাজার টাকা পেলে তোমার কতদিন চলবে?’
‘তা চাটনি দিয়ে রুটি খেয়ে চালাতে পারলে তো পাঁচ-ছ’বছর যাবেই।’ বউ দিন-মাস-বছরের হিসাব-নিকাশ করেই উত্তরটা দিল। ‘তোমার ছেলেরাও বড় হয়েছে, ততদিনে ওরা কাজ করে তোমাকে খাওয়ানোর যোগ্য হয়ে উঠবে। তোমাকে আর তখন কাজ করতে হবে না।’
‘তা যা বলেছ বউ।’ সে বউয়ের আরো কাছে সরে এল। ‘বর্ষা আসছে; মাথার উপর চাল ফুটো, তা দেখেছ? এ বছর মেরামত না করলে সবসুদ্ধ ভেঙে পড়বে। আর, যদি পুরস্কার বেশি পাওয়া যায়, তাহলে গোটা ঘরটাই নতুন করে তোলা যাবে, কী বল?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়– ঘর আগে, না পেট আগে। এই ঘরে আমাদের ছেলে-বউরা আসবে একদিন।
‘তাহলে আমি এখনই মিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আসি, যেন কাল সকাল থেকে মেরামতের কাজ শুরু করে দেয়। মওলা মুদি দেখলে একেবারে মরমে জ্বলবে।’
‘এখন নয়, কাল সকালে বললেই চলবে’খন।’
‘না, না, এখনই বলে আসি– কাল সকালে তাকে আবার পাওয়া যাবে না।’ রফিক চলে গেল।
মিস্ত্রিকে খবর দিয়ে বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আসে না। আইচাই করে রাতটা কেটে গেল। সকালবেলায় উঠে দৌড়াল মওলা মুদির দোকানে। দোকান তখনো খোলেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল দোকান খোলার।
মওলা মুদি যখন এল, তখন তার হাত থেকে খবরের কাগজটা প্রায় কেড়ে নিল রফিক। তাড়াতাড়ি পাতা উল্টে খুঁজতে লাগল ‘নিখোঁজ’-বিজ্ঞাপন। শেষে এক জায়গায় পেয়ে গেল মেয়ে হারানোর খবর। কী আশ্চর্য! হুবহু মিলে যাচ্ছে বর্ণনার সঙ্গে। একেবারে এই মেয়েটিই। না হয়েই যায় না। তার ওপর পুরো ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে, কোথায় পৌঁছে দিতে হবে। তারপর, শেষে লিখেছে, ‘সন্ধানকারীকে এনাম দিয়ে খুশি করা হবে।’ রফিকের বুকটা ধড়ফড় করে উঠল এনামের কথা পড়ে।
খবরের কাগজ ফেরত দিয়ে রফিক মওলা মুদির কাছে পুরো পনেরো টাকা চেয়ে বসল। মওলা প্রথমে একটু ভ্রু কুঁচকাল, তারপর দিয়ে দিল টাকাটা। টাকা নিয়ে সে দৌড়াল ঘরের দিকে। বউকে শোনাল বিজ্ঞাপনের কথা।
‘কত টাকা দেবে লিখেছে?’ তার বউও অধৈর্য হয়ে উঠেছে
‘লিখেছে, সন্ধানকারীকে এনাম দিয়ে খুশি করা হবে।’ এই বলে রফিক শূন্যের পানে দু’হাত বিস্তৃত করে দিল। ‘হেই আল্লাহ্, তুমি তাদের খুশি রেখ।’
রফিকের বউ তাড়াতাড়ি মেয়ের জন্য পরোটা-ডিমের নাশ্তা তৈরি করল। তাকে গোসল করিয়ে চুল আঁচড়ে দিল। খাওয়াল। তারপর, কপালে-মুখে চুমু দিয়ে বিদায় করে দিল।
রফিক মেয়েকে কোলে করে বাইরে নিয়ে এল। টাঙা ভাড়া করে তাতে বসল। কোথায় যেতে হবে বলে দিল। আর বলে দিল, রাস্তায় খেলনার দোকান দেখলে যেন গাড়ি থামায়। খেলনার দোকান থেকে খেলনা কিনে ফেলল পুরো দশ টাকার। খেলনা পেয়ে মেয়ে একেবারে আনন্দে আত্মহারা। কেউ যাতে নিয়ে না নেয়, সেজন্য ফ্রকের আঁচলে সে লুকিয়ে রাখল খেলনাগুলো।
বিরাট এক কুঠির সামনে টাঙা এসে থামল। দেখে রফিকের চক্ষু চড়কগাছ। কুঠি নয়– যেন বিরাট এক পানির জাহাজ। জাহাজের মতোই চেহারা-সুরত। আনন্দে তার পা কাঁপতে লাগল। মেয়ে কোলে করেই সে টাঙা থেকে নামল। মেয়ে এতক্ষণে পরিচিত পরিবেশ পেয়ে রফিকের কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করতে লাগল। তারপর, কুঠির সদর-দরজা দিয়ে ঢুকতে না-ঢুকতেই মেয়ে একেবারে ছিটকে কোল থেকে নেমে দৌড় দিল ভিতরের দিকে। রফিক তাকে ধরবার অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মেয়ে ততক্ষণে অন্দরে চলে গিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেছে। রফিকের বড় দুঃখ হল। সে চেয়েছিল আঁচল-ভরা খেলনা নিয়ে মেয়েকে কোলে করে সাহেব-বাহাদুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, কিন্তু তা আর হল না। কাজেই সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল খালি হাতে।
সাদা পোশাক সজ্জিত এক ব্যক্তি এসে তার সামনে দাঁড়াল। ‘তুমিই তামিনাকে এনেছ?’
‘হ্যাঁ হুজুর, আমিই এনেছি।’ রফিক মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল।
‘সাহেব তোমাকে ভেতরে ডাকছেন– আমি সাহেবের আরদালি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা ভাই, ভুল হয়েছে মাফ চাই। আমাকে ভেতরে নিয়ে চল।’
রফিক এখন সাহেব-বাহাদুরের সামনে সশরীরে দাঁড়িয়ে। আহা, কী জৌলুস! এমন ঘর, আর এমন সব আসবাব-পত্র, সাজ-সজ্জা সে কেবল রাজপুত্র আর রাজ-কন্যাদের গল্পতেই শুনেছে। সাহেব-বাহাদুর একবার তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন। রফিক বুঝল, এই ময়লা কাপড় পরে আসা তার উচিত হয়নি। বউটার আক্কেল বলতে যদি কিছু থাকে। এত পারল আর এক আনার সাবান কিনে তার কাপড়টা একটু ধুয়ে দিতে পারল না।
‘মেয়েকে তুমি এনেছ?’ সাহেব-বাহাদুরের তির্যক প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ হুজুর, আমি এনেছি। আমি ওকে রাস্তায় পেয়েছি– কাঁদছিল। আর…’
‘আমরা খুব খুশি হয়েছি। তুমি খুব ভালো লোক। বেগম সাহেবের সঙ্গে মেয়ে গিয়েছিল বিয়ে-বাড়িতে। সেখানে থেকেই হারিয়ে যায়। তারপর…’
‘হুজুর, আমি… আমি…’ রফিকের মুখ থেকে আর কথা সরে না। আবেগে, উচ্ছ্বাসে সে ভেঙে পড়ে।
‘হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে মেয়ের বাপ অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। সে আমাদের হেড-বাবুর্চি। আমাদের খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি খুব উপকার করেছ আমাদের। এই নাও, পাঁচ টাকা বখশিশ্ দিলাম তোমাকে।’
পাঁচ টাকার নোট রফিকের হাতে গুঁজে দিয়ে তিনি অন্দরে চলে গেলেন।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির