পঞ্চম খণ্ড – পঞ্চম অধ্যায়: ঠাকুরের অহেতুক ভালবাসা ও নরেন্দ্রনাথ
নরেন্দ্রের পূর্ব-জীবনের অসাধারণ প্রত্যক্ষসমূহ – নিদ্রার পূর্বে জ্যোতিঃদর্শন
আমরা বলিয়াছি, অদ্ভুত পুণ্যসংস্কারসমূহ লইয়া শ্রীযুত নরেন্দ্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সেজন্য অপর-সাধারণ হইতে ভিন্ন ভাবের প্রত্যক্ষসকল তাঁহার জীবনে নানা বিষয়ে ইতঃপূর্বেই উপস্থিত হইয়াছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপে ঐরূপ কয়েকটির উল্লেখ করিলেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন। নরেন্দ্র বলিতেন – “আজীবন, নিদ্রা যাইব বলিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিলেই ভ্রূমধ্যভাগে এক অপূর্ব জ্যোতির্বিন্দু দেখিতে পাইতাম এবং এক মনে উহার নানারূপ পরিবর্তন লক্ষ্য করিতে থাকিতাম। উহা দেখিবার সুবিধা হইবে বলিয়া লোকে যেভাবে ভূমিতে মস্তক স্পর্শ করিয়া প্রণাম করে, আমি সেইভাবে শয্যায় শয়ন করিতাম। ঐ অপূর্ব বিন্দু নানা বর্ণে পরিবর্তিত ও বর্ধিত হইয়া ক্রমে বিম্বাকারে পরিণত হইত এবং পরিশেষে ফাটিয়া যাইয়া আপাদমস্তক শুভ্র-তরল জ্যোতিতে আবৃত করিয়া ফেলিত! – ঐরূপ হইবামাত্র চেতনালুপ্ত হইয়া নিদ্রাভিভূত হইতাম! আমি জানিতাম, ঐরূপেই সকলে নিদ্রা যায়। বহুকাল পর্যন্ত ঐরূপ ধারণা ছিল। বড় হইয়া যখন ধ্যানাভ্যাস করিতে আরম্ভ করিলাম তখন চক্ষু মুদ্রিত করিলেই ঐ জ্যোতির্বিন্দু প্রথমেই সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইত এবং উহাতেই চিত্ত একাগ্র করিতাম। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উপদেশে কয়েকজন বয়স্যের সহিত যখন নিত্য ধ্যানাভ্যাস করিতে লাগিলাম, তখন ধ্যান করিবার কালে কাহার কিরূপ দর্শন ও উপলব্ধি উপস্থিত হইল, পরস্পরে তদ্বিষয়ে আলোচনা করিতাম। ঐ সময়ে তাহাদিগের কথাতেই বুঝিয়াছিলাম, ঐরূপ জ্যোতিঃদর্শন তাহাদিগের কখনও হয় নাই এবং তাহাদিগের কেহই আমার ন্যায় পূর্বোক্তভাবে নিদ্রা যায় না!”
দেশ-কাল-পাত্রবিশেষ-দর্শনে পূর্বস্মৃতির উদয়
“আবার বাল্যকাল হইতে সময়ে সময়ে কোন বস্তু, ব্যক্তি বা স্থানবিশেষ দেখিবামাত্র মনে হইত উহাদিগের সহিত আমি বিশেষ পরিচিত, ইতিপূর্বে কোথায় উহাদিগকে দেখিয়াছি! স্মরণ করিতে চেষ্টা করিতাম, কিছুতেই মনে আসিত না – কিন্তু কোনমতে ধারণা হইত না যে, উহাদিগকে ইতিপূর্বে দেখি নাই! প্রায়ই মধ্যে মধ্যে ঐরূপ হইত! হয়তো, বয়স্যবর্গের সহিত মিলিত হইয়া কোন স্থানে নানা বিষয়ের আলোচনা চলিতেছে এমন সময় তাহাদিগের মধ্যে একজন একটা কথা বলিল, অমনি সহসা মনে হইল – তাই তো এই গৃহে, এইসকল ব্যক্তির সহিত, এই বিষয় লইয়া আলাপ যে ইতিপূর্বে করিয়াছি এবং তখনও যে এই ব্যক্তি এইরূপ কথা বলিয়াছিল! কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুতেই স্থির করিতে পারিতাম না – কোথায়, কবে ইহাদিগের সহিত ইতিপূর্বে এইরূপ আলাপ হইয়াছিল! পুনর্জন্মবাদের বিষয় যখন অবগত হইলাম তখন ভাবিয়াছিলাম, তবে বুঝি জন্মান্তরে ঐসকল দেশ ও পাত্রের সহিত পরিচিত হইয়াছিলাম, এবং তাহারই আংশিক স্মৃতি কখনও কখনও আমার অন্তরে ঐরূপে উপস্থিত হইয়া থাকে। পরে বুঝিয়াছি, ঐ বিষয়ের ঐরূপ মীমাংসা যুক্তিযুক্ত নহে। এখন1 মনে হয়, ইহজন্মে যে-সকল বিষয় ও ব্যক্তির সহিত আমাকে পরিচিত হইতে হইবে, জন্মিবার পূর্বে সেইসকলকে চিত্রপরম্পরায় আমি কোনরূপে দেখিতে পাইয়াছিলাম এবং উহারই স্মৃতি, জন্মিবার পরে, আমার অন্তরে আজীবন সময়ে সময়ে উদিত হইয়া থাকে।”
1. এই অদ্ভুত প্রত্যক্ষের কথা শ্রীযুত নরেন্দ্র তাঁহার সহিত পরিচিত হইবার কিছুকাল পরেই আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, এবং শেষ জীবনে তিনি উহার সম্বন্ধে এইরূপ কারণ নির্দেশ করিয়াছিলেন।
ঠাকুরের দৈবীশক্তি প্রত্যক্ষ করিয়া নরেন্দ্রের জল্পনা ও বিস্ময়
ঠাকুরের পবিত্র জীবন এবং সমাধিস্থ হইবার কথা নানা লোকের1 নিকট হইতে শ্রবণ করিয়া শ্রীযুত নরেন্দ্র তাঁহাকে দর্শন করিতে আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া তাঁহার কোনরূপ অবস্থান্তর বা অদ্ভুত প্রত্যক্ষ উপস্থিত হইবে, এ কথা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেন নাই। ঘটনা কিন্তু অন্যরূপ দাঁড়াইল। দক্ষিণেশ্বরে, ঠাকুরের শ্রীপদপ্রান্তে আগমন করিয়া উপর্যুপরি দুই দিন তাঁহার যেরূপ অলৌকিক প্রত্যক্ষ উপস্থিত হইল তাহার তুলনায় তাঁহার পূর্বপরিদৃষ্ট প্রত্যক্ষসকল নিতান্ত ম্লান ও অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল এবং তাহার ইয়ত্তা করিতে তাঁহার অসাধারণ বুদ্ধি পরাভব স্বীকার করিল। সুতরাং ঠাকুরের বিষয় অনুধাবন করিতে যাইয়া তিনি এখন বিষম সমস্যায় পতিত হইয়াছিলেন। কারণ, ঠাকুরের অচিন্ত্য দৈবীশক্তি-সহায়েই যে তাঁহার ঐরূপ অদৃষ্টপূর্ব প্রত্যক্ষ উপস্থিত হইয়াছিল এ বিষয়ে সংশয় করিবার তিনি বিন্দুমাত্র কারণও অনুসন্ধান করিয়া প্রাপ্ত হন নাই, এবং মনে মনে ঐ বিষয়ে যতই আলোচনা করিয়াছিলেন ততই বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইয়াছিলেন।
1. আমরা ইতঃপূর্বে বলিয়াছি দক্ষিণেশ্বরে আসিবার কালে শ্রীযুত নরেন্দ্র কলিকাতার জেনারেল এসেম্ব্লিস্ ইন্স্টিটিউশন নামক বিদ্যালয় হইতে এফ.এ. পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। উদারচেতা সুপণ্ডিত হেস্টি সাহেব তখন উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। সাহেবের বহুমুখী প্রতিভা, পবিত্র জীবন এবং ছাত্রদিগের সহিত সরল সপ্রেম আচরণের জন্য নরেন্দ্রনাথ ইঁহাকে বিশেষ ভক্তি-শ্রদ্ধা করিতেন। সাহিত্যের অধ্যাপক সহসা অসুস্থ হইয়া পড়ায় হেস্টি সাহেব একদিন এফ.এ. ক্লাসের ছাত্রবৃন্দকে সাহিত্য অধ্যয়ন করাইতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এবং ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের কবিতাবলীর আলোচনা-প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যানুভবে উক্ত কবির ভাবসমাধি হইবার কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন। ছাত্রগণ সমাধির কথা বুঝিতে না পারায় তিনি তাহাদিগকে উক্ত অবস্থার কথা যথাবিধি বুঝাইয়া পরিশেষে বলিয়াছিলেন, “চিত্তের পবিত্রতা ও বিষয়বিশেষে একাগ্রতা হইতে উক্ত অবস্থার উদয় হইয়া থাকে; ঐপ্রকার অবস্থার অধিকারী ব্যক্তি বিরল দেখিতে পাওয়া যায় – একমাত্র দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আজকাল ঐরূপ অবস্থা হইতে দেখিয়াছি – তাঁহার উক্ত অবস্থা একদিন দর্শন করিয়া আসিলে তোমরা এ বিষয় হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবে।” ঐরূপে হেস্টি সাহেবের নিকট হইতে শ্রীযুত নরেন্দ্র ঠাকুরের কথা প্রথম শ্রবণ করিবার পরে সুরেন্দ্রনাথের আলয়ে তাঁহার প্রথম দর্শনলাভ করিয়াছিলেন। আবার ব্রাহ্মসমাজে ইতঃপূর্বে গতিবিধি থাকায় তিনি ঠাকুরের কথা ঐ স্থানেও শ্রবণ করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়।
নরেন্দ্র কতদূর উচ্চ অধিকারী ছিলেন
বাস্তবিক ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হইয়া নরেন্দ্রনাথের সহসা যেরূপ অদ্ভুত প্রত্যক্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা ভাবিলে বিস্ময়ের অবধি থাকে না। শাস্ত্র বলেন, স্বল্পশক্তিসম্পন্ন সামান্য-অধিকারী মানবের জীবনে ঐরূপ প্রত্যক্ষ বহুকালের ত্যাগ ও তপস্যায় বিরল উপস্থিত হয় এবং কোনরূপে একবার উপস্থিত হইলে শ্রীগুরুর ভিতরে ঈশ্বরপ্রকাশ উপলব্ধি করিয়া মোহিত হইয়া সে এককালে তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করে। নরেন্দ্র যে ঐরূপ করেন নাই – ইহা স্বল্প বিস্ময়ের কথা নহে; এবং উহা হইতেই বুঝিতে পারা যায় তিনি আধ্যাত্মিক জগতে কতদূর উচ্চ অধিকারী ছিলেন। অতি উচ্চ আধার ছিলেন বলিয়াই ঐ ঘটনায় তিনি এককালে আত্মহারা হইয়া পড়েন নাই, এবং সংযত থাকিয়া ঠাকুরের অলৌকিক চরিত্র ও আচরণের পরীক্ষা ও কারণ নির্ণয়ে আপনাকে বহুকাল পর্যন্ত নিযুক্ত রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কিন্তু অভিভূত না হইলেও এবং এককালে বশ্যতা স্বীকার না করিলেও, তিনি এখন হইতে ঠাকুরের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, ইহাতে সন্দেহ নাই।
নরেন্দ্রের প্রতি ঠাকুর কতদূর আকৃষ্ট হইয়াছিলেন
প্রথম সাক্ষাতের দিবস হইতে ঠাকুরও অন্যপক্ষে নরেন্দ্রনাথের প্রতি একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করিয়াছিলেন। অপরোক্ষবিজ্ঞানসম্পন্ন মহানুভব গুরু সুযোগ্য শিষ্যকে দেখিবামাত্র আপনার সমুদয় জীবন-প্রত্যক্ষ তাহার অন্তরে ঢালিয়া দিবার আকুল আগ্রহে যেন এককালে অধীর হইয়া উঠিয়াছিলেন। সে গভীর আগ্রহের পরিমাণ হয় না, সে স্বার্থগন্ধশূন্য অহেতুক অধৈর্য, পূর্ণসংযত-আত্মারাম গুরুগণের হৃদয়ে কেবলমাত্র দৈব প্রেরণাতেই উপস্থিত হইয়া থাকে। ঐরূপ প্রেরণাবশেই জগদ্গুরু মহাপুরুষগণ উত্তম অধিকারী শিষ্যকে দেখিবামাত্র অভয় ব্রহ্মজ্ঞপদবীতে আরূঢ় করাইয়া তাহাকে আপ্তকাম ও পূর্ণ করিয়া থাকেন।1
1. শাস্ত্রে ইহা শাম্ভবী দীক্ষা বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। শাম্ভবী দীক্ষার বিস্তারিত বিবরণের জন্য ‘গুরুভাব, উত্তরার্ধ – ৪র্থ অধ্যায়’ দ্রষ্টব্য।
প্রথম দিবসে নরেন্দ্রকে ব্রহ্মজ্ঞ-পদবীতে আরূঢ় করাইবার ঠাকুরের চেষ্টা
নরেন্দ্রনাথ যেদিন দক্ষিণেশ্বরে একাকী আগমন করেন, ঠাকুর যে ঐদিন তাঁহাকে এককালে সমাধিস্থ করিয়া ব্রহ্মজ্ঞপদবীতে আরূঢ় করাইতে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, এ বিষয়ে সংশয়মাত্র নাই। কারণ, উহার তিন-চারি বৎসর পরে শ্রীযুত নরেন্দ্র যখন সম্পূর্ণরূপে ঠাকুরের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন এবং নির্বিকল্প সমাধিলাভের জন্য ঠাকুরের নিকট বারংবার প্রার্থনা করিতেছিলেন, তখন এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া ঠাকুর তাঁহাকে আমাদিগের সম্মুখে অনেক সময় বলিতেন, “কেন? তুই যে তখন বলিয়াছিলি তোর বাপ-মা আছে, তাদের সেবা করিতে হইবে?” আবার কখনও বা বলিতেন, “দেখ, একজন মরিয়া ভূত হইয়াছিল। অনেককাল একাকী থাকায় সঙ্গীর অভাব অনুভব করিয়া সে চারিদিকে অন্বেষণ করিতে আরম্ভ করিল। কেহ কোন স্থানে মরিয়াছে শুনিলেই সে সেখানে ছুটিয়া যাইত। ভাবিত, এইবার বুঝি তার একজন সঙ্গী জুটিবে। কিন্তু দেখিত, মৃত ব্যক্তি গঙ্গাবারি-স্পর্শে বা অন্য কোন উপায়ে উদ্ধার হইয়া গিয়াছে। সুতরাং ক্ষুণ্ণমনে ফিরিয়া আসিয়া সে পুনরায় পূর্বের ন্যায় একাকী কালযাপন করিত। ঐরূপে সে ভূতের সঙ্গীর অভাব আর কিছুতেই ঘুচে নাই। আমারও ঠিক ঐরূপ দশা হইয়াছে। তোকে দেখিয়া ভাবিয়াছিলাম এইবার বুঝি আমার একটি সঙ্গী জুটিল – কিন্তু তুইও বলিলি, তোর বাপ-মা আছে। কাজেই আমার আর সঙ্গী পাওয়া হইল না!” ঐরূপে ঐ দিবসের ঘটনার উল্লেখ করিয়া ঠাকুর অতঃপর নরেন্দ্রনাথের সহিত অনেক সময় রঙ্গ-পরিহাস করিতেন।
নরেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় দিবসের অদ্ভুত প্রত্যক্ষের মধ্যে প্রভেদ
সে যাহা হউক, সমাধিস্থ হইবার উপক্রমে নরেন্দ্রনাথের হৃদয়ে দারুণ ভয়ের সঞ্চার হইতে দেখিয়া ঠাকুর সেদিন যেরূপে নিরস্ত হইয়াছিলেন, তাহা আমরা ইতঃপূর্বে বলিয়াছি। ঘটনা ঐরূপ হওয়ায় নরেন্দ্রের সম্বন্ধে ইতঃপূর্বে তিনি যাহা দর্শন ও উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে ঠাকুরের সন্দিহান হওয়া বিচিত্র নহে। আমাদিগের অনুমান, সেইজন্যই তিনি নরেন্দ্র তৃতীয় দিবস দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিলে শক্তিবলে তাঁহাকে অভিভূত করিয়া তাঁহার জীবন সম্বন্ধে নানা রহস্যকথা তাঁহার নিকট হইতে জানিয়া লইয়াছিলেন এবং নিজ প্রত্যক্ষসকলের সহিত উহাদিগের ঐক্য দেখিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন। উক্ত অনুমান সত্য হইলে ইহাই বুঝিতে হয় যে, নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিয়া পূর্বোক্ত দুই দিবসে একই প্রকারের সমাধি-অবস্থা লাভ করেন নাই। ফলেও দেখিতে পাওয়া যায়, উক্ত দুই দিবসে তাঁহার দুই বিভিন্ন প্রকারের উপলব্ধি উপস্থিত হইয়াছিল।
নরেন্দ্রের সম্বন্ধে ঠাকুরের ভয়
নরেন্দ্রনাথকে পূর্বোক্তভাবে পরীক্ষা করিয়া ঠাকুর একভাবে নিশ্চিন্ত হইলেও, তাঁহার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন বলিতে পারা যায় না। কারণ, তিনি দেখিয়াছিলেন, যে-সকল গুণ বা শক্তিপ্রকাশের মধ্যে একটির বা দুইটির মাত্র অধিকারী হইয়া মানব সংসারে জনসাধারণের মধ্যে বিপুল প্রতিপত্তি লাভ করে, নরেন্দ্রনাথের অন্তরে ঐরূপ আঠারোটি শক্তিপ্রকাশ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান, এবং ঈশ্বর, জগৎ ও মানব-জীবনের উদ্দেশ্যসম্বন্ধে চরম-সত্য উপলব্ধি করিয়া শ্রীযুত নরেন্দ্র উহাদিগকে সম্যকরূপে আধ্যাত্মিক পথে নিযুক্ত করিতে না পারিলে ফল বিপরীত হইয়া দাঁড়াইবে। ঠাকুর বলিতেন, ঐরূপ হইলে নরেন্দ্র অন্য সকল নেতাদিগের ন্যায় এক নবীন মত ও দলের সৃষ্টিমাত্র করিয়া জগতে খ্যাতিলাভ করিয়া যাইবে; কিন্তু বর্তমান যুগ-প্রয়োজন পূর্ণ করিবার জন্য যে উদার আধ্যাত্মিক তত্ত্বের উপলব্ধি ও প্রচার আবশ্যক, তাহা প্রত্যক্ষ করা এবং উহার প্রতিষ্ঠাকল্পে সহায়তা করিয়া জগতের যথার্থ কল্যাণসাধন করা তাহার দ্বারা সম্ভবপর হইবে না। সুতরাং নরেন্দ্র যাহাতে স্বেচ্ছায় সম্পূর্ণভাবে তাঁহার অনুসরণ করিয়া তাঁহার সদৃশ আধ্যাত্মিক তত্ত্বসকলের সাক্ষাৎ উপলব্ধি করিতে পারেন, সেজন্য এখন হইতে ঠাকুরের প্রাণে অসীম আগ্রহ উপস্থিত হইয়াছিল। ঠাকুর সর্বদা বলিতেন – গেঁড়ে, ডোবা প্রভৃতি যে-সকল জলাধারে স্রোত নাই সেখানেই যেমন দল বা নানারূপ উদ্ভিজ্জ-দামের উৎপত্তি দেখিতে পাওয়া যায়, সেইরূপ আধ্যাত্মিক জগতে যেখানে আংশিক সত্যমাত্রকে মানব পূর্ণ সত্য বলিয়া ধারণা করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসে, সেখানেই দল বা গণ্ডিনিবদ্ধ সঙ্ঘসকলের উদয় হইয়া থাকে। অসাধারণ মেধা ও মানসিক-গুণসম্পন্ন নরেন্দ্রনাথ বিপথে গমন করিয়া পাছে ঐরূপ করিয়া বসেন, এই ভয়ে ঠাকুর কতরূপে তাঁহাকে পূর্ণসত্যের অধিকারী করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিয়া বিস্মিত হইতে হয়।
ঠাকুরের নরেন্দ্রের প্রতি অসাধারণ আকর্ষণের কারণ
অতএব দেখা যাইতেছে, নরেন্দ্রনাথের সহিত মিলিত হইবার প্রথম হইতেই ঠাকুর নানা কারণে তাঁহার প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করিয়াছিলেন এবং যতদিন না তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, নরেন্দ্রের আর পূর্বোক্তভাবে বিপথে গমন করিবার সম্ভাবনা নাই, ততদিন পর্যন্ত উক্ত আকর্ষণ তাঁহাতে সহজ স্বাভাবিক ভাব ধারণ করে নাই। ঐসকল কারণের অনুধাবনে স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম হয়, উহাদের কতকগুলি নরেন্দ্রনাথের সম্বন্ধে ঠাকুরের নিজ অদ্ভুত দর্শনসমূহ হইতে সম্ভূত হইয়াছিল এবং অবশিষ্টগুলি, পাছে নরেন্দ্র কালধর্মপ্রভাবে দারৈষণা, বিত্তৈষণা, লোকৈষণা প্রভৃতি কোনরূপ বন্ধনকে স্বেচ্ছায় স্বীকার করিয়া লইয়া তাঁহার মহৎ জীবনের চরমলক্ষ্যসাধনে আংশিকভাবে অসমর্থ হন, এই ভয় হইতে উত্থিত হইয়াছিল।
উক্ত আকর্ষণ উপস্থিত হওয়া যেন স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী
বহুকালব্যাপী ত্যাগ ও তপস্যার ফলে ক্ষুদ্র ‘অহং মম’-বুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হওয়ায় জগৎ-কারণের সহিত নিত্য অদ্বৈতভাবে অবস্থিত ঠাকুর ঈশ্বরের জনকল্যাণসাধনরূপ কর্মকে আপনার বলিয়া অনুক্ষণ উপলব্ধি করিতেছিলেন। উহারই প্রভাবে তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হইয়াছিল যে, বর্তমান যুগের ধর্মগ্লানি-নাশ-রূপ সুমহৎ কার্য তাঁহার শরীর-মনকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া সাধিত হয়, ইহাই বিরাটেচ্ছার অভিপ্রেত। আবার উহারই প্রভাবে তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, ক্ষুদ্র স্বার্থসুখসাধনের জন্য শ্রীযুত নরেন্দ্র জন্মপরিগ্রহ করেন নাই, কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি একান্ত অনুরাগে পূর্বোক্ত জনকল্যাণসাধনরূপ কর্মে তাঁহাকে সহায়তা করিতেই আগমন করিয়াছেন। সুতরাং স্বার্থশূন্য নিত্যমুক্ত নরেন্দ্রনাথকে তাঁহার পরমাত্মীয় বলিয়া বোধ হইবে এবং তাঁহার প্রতি তিনি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হইবেন, ইহাতে বিচিত্র কি? অতএব আপাতদৃষ্টিতে নরেন্দ্রনাথের প্রতি ঠাকুরের আকর্ষণ দেখিয়া বিস্ময়ের উদয় হইলেও, উহা যে স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী তাহা স্বল্পচিন্তার ফলেই বুঝিতে পারা যায়।
নরেন্দ্রের প্রতি ঠাকুরের ভালবাসা সাংসারিক ভাবের নহে
প্রথম দর্শনের দিন হইতেই ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে কতদূর নিকটাত্মীয় জ্ঞান করিয়াছিলেন এবং কিরূপ তন্ময়ভাবে ভালবাসিয়াছিলেন তাহার আভাস প্রদান করা একপ্রকার সাধ্যাতীত বলিয়া আমাদিগের মনে হইয়া থাকে। সংসারী মানব যে-সকল কারণে অপরকে আপনার জ্ঞান করিয়া হৃদয়ের ভালবাসা অর্পণ করিয়া থাকে, তাহার কিছুমাত্র এখানে বর্তমান ছিল না; কিন্তু নরেন্দ্রের বিরহে এবং মিলনে ঠাকুরের যেরূপ ব্যাকুলতা এবং উল্লাস দর্শন করিয়াছি তাহার বিন্দুমাত্রেরও দর্শন অন্যত্র কোথাও আমাদিগের ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে নাই। নিষ্কারণে একজন অপরকে যে এতদূর ভালবাসিতে পারে, ইহা আমাদিগের ইতঃপূর্বে জ্ঞান ছিল না! নরেন্দ্রের প্রতি ঠাকুরের অদ্ভুত প্রেম দর্শন করিয়াই বুঝিতে পারিয়াছি, কালে সংসারে এমন দিন আসিবে যখন মানব মানবের মধ্যে ঈশ্বরপ্রকাশ উপলব্ধি করিয়া সত্য সত্যই ঐরূপ নিষ্কারণে ভালবাসিয়া কৃতকৃতার্থ হইবে।
উক্ত ভালবাসা সম্বন্ধে স্বামী প্রেমানন্দের কথা
ঠাকুরের নিকটে নরেন্দ্রের আগমনের কিছুকাল পরে স্বামী প্রেমানন্দ দক্ষিণেশ্বরে প্রথম উপস্থিত হইয়াছিলেন। নরেন্দ্রনাথ ইতঃপূর্বে সপ্তাহ বা কিঞ্চিদধিক কাল দক্ষিণেশ্বরে আসিতে না পারায় ঠাকুর তাঁহার জন্য কিরূপ উৎকণ্ঠিতচিত্তে তখন অবস্থান করিতেছিলেন, তদ্দর্শনে তিনি মোহিত হইয়া ঐ বিষয়ে আমাদের নিকট অনেকবার কীর্তন করিয়াছেন। তিনি বলেন –
স্বামী প্রেমানন্দের প্রথম দিন দক্ষিণেশ্বরে আগমন ও ঠাকুরকে নরেন্দ্রের জন্য উৎকণ্ঠিত দর্শন
“স্বামী ব্রহ্মানন্দের সহিত হাটখোলার ঘাটে নৌকায় উঠিতে যাইয়া ঐদিন রামদয়ালবাবুকে তথায় দেখিতে পাইলাম। তিনিও দক্ষিণেশ্বরে যাইতেছেন জানিয়া আমরা একত্রেই এক নৌকায় উঠিলাম এবং প্রায় সন্ধ্যার সময় রানী রাসমণির কালীবাটীতে পৌঁছিলাম। ঠাকুরের ঘরে আসিয়া শুনিলাম, তিনি মন্দিরে ৺জগদম্বাকে দর্শন করিতে গিয়াছেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ আমাদিগকে ঐ স্থানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া তাঁহাকে আনয়ন করিবার জন্য মন্দিরাভিমুখে চলিয়া গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই তাঁহাকে অতি সন্তর্পণে ধারণ করিয়া ‘এখানটায় সিঁড়ি, উঠিতে হইবে – এখানটায় নামিতে হইবে’ ইত্যাদি বলিতে বলিতে লইয়া আসিতেছেন, দেখিতে পাইলাম। ইতঃপূর্বেই তাঁহার ভাববিভোর হইয়া বাহ্যসংজ্ঞা হারাইবার কথা শ্রবণ করিয়াছিলাম। এজন্য ঠাকুরকে এখন ঐরূপে মাতালের ন্যায় টলিতে টলিতে আসিতে দেখিয়া বুঝিলাম তিনি ভাবাবেশে রহিয়াছেন। ঐরূপে গৃহে প্রবেশ করিয়া তিনি ছোট তক্তপোশখানির উপর উপবেশন করিলেন এবং অল্পক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া পরিচয় জিজ্ঞাসাপূর্বক আমার মুখ ও হস্ত-পদাদির লক্ষণপরীক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন। কনুই হইতে অঙ্গুলি পর্যন্ত আমার হাতখানির ওজন পরীক্ষা করিবার জন্য কিছুক্ষণ নিজহস্তে ধারণ করিয়া বলিলেন, ‘বেশ’। ঐরূপে কি বুঝিলেন, তাহা তিনিই জানেন। উহার পরে রামদয়ালবাবুকে শ্রীযুত নরেন্দ্রের শারীরিক কল্যাণের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন এবং তিনি ভাল আছেন জানিয়া বলিলেন, ‘সে অনেকদিন এখানে আসে নাই, তাহাকে দেখিতে বড় ইচ্ছা হইয়াছে, একবার আসিতে বলিও।'”
ঠাকুরের সারারাত্র দারুণ উৎকণ্ঠা দর্শনে প্রেমানন্দের চিন্তা
“ধর্মবিষয়ক নানা কথাবার্তায় কয়েক ঘণ্টা বিশেষ আনন্দে কাটিল। ক্রমে দশটা বাজিবার পরে আমরা আহার করিলাম এবং ঠাকুরের ঘরের পূর্বদিকে – উঠানের উত্তরে যে বারান্দা আছে তথায় শয়ন করিলাম। ঠাকুর এবং স্বামী ব্রহ্মানন্দের জন্য ঘরের ভিতরেই শয্যা প্রস্তুত হইল। শয়ন করিবার পরে এক ঘণ্টাকাল অতীত হইতে-না-হইতে ঠাকুর পরিধেয় বস্ত্রখানি বালকের ন্যায় বগলে ধারণ করিয়া ঘরের বাহিরে আমাদিগের শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হইয়া রামদয়ালবাবুকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘ওগো, ঘুমুলে?’ আমরা উভয়ে শশব্যস্তে শয্যায় উঠিয়া বসিয়া বলিলাম, ‘আজ্ঞে না।’ উহা শুনিয়া ঠাকুর বলিলেন, ‘দেখ, নরেন্দ্রের জন্য প্রাণের ভিতরটা যেন গামছা-নিংড়াবার মতো জোরে মোচড় দিচ্ছে; তাকে একবার দেখা করে যেতে বলো; সে শুদ্ধ সত্ত্বগুণের আধার, সাক্ষাৎ নারায়ণ; তাকে মাঝে মাঝে না দেখলে থাকতে পারি না।’ রামদয়ালবাবু কিছুকাল পূর্ব হইতেই দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করিতেছিলেন, সেজন্য ঠাকুরের বালকের ন্যায় স্বভাবের কথা তাঁহার অবিদিত ছিল না। তিনি ঠাকুরের ঐরূপ বালকের ন্যায় আচরণ দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন, এবং রাত্রি পোহাইলেই নরেন্দ্রের সহিত দেখা করিয়া তাঁহাকে আসিতে বলিবেন ইত্যাদি নানা কথা কহিয়া ঠাকুরকে শান্ত করিতে লাগিলেন। কিন্তু সে রাত্রে ঠাকুরের সেই ভাবের কিছুমাত্র প্রশমন হইল না। আমাদিগের বিশ্রামের অভাব হইতেছে বুঝিয়া মধ্যে মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য নিজ শয্যায় যাইয়া শয়ন করিলেও, পরক্ষণেই ঐ কথা ভুলিয়া আমাদিগের নিকটে পুনরায় আগমনপূর্বক নরেন্দ্রের গুণের কথা এবং তাহাকে না দেখিয়া তাঁহার প্রাণে যে দারুণ যন্ত্রণা উপস্থিত হইয়াছে, তাহা সকরুণভাবে ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। তাঁহার ঐরূপ কাতরতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়া আমি ভাবিতে লাগিলাম, ইঁহার কি অদ্ভুত ভালবাসা এবং যাহার জন্য ইনি ঐরূপ করিতেছেন সে ব্যক্তি কি কঠোর! সেই রাত্রি ঐরূপে আমাদিগের অতিবাহিত হইয়াছিল। পরে রজনী প্রভাত হইলে মন্দিরে যাইয়া ৺জগদম্বাকে দর্শন করিয়া ঠাকুরের চরণে প্রণত হইয়া বিদায় গ্রহণপূর্বক আমরা কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছিলাম।”
নরেন্দ্রের প্রতি ঠাকুরের ভালবাসা সম্বন্ধে বৈকুণ্ঠনাথের কথা
১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের কোন সময়ে আমাদিগের জনৈক বন্ধু1 দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, নরেন্দ্রনাথ অনেক দিন আসেন নাই বলিয়া ঠাকুর বিশেষ উৎকণ্ঠিত হইয়া রহিয়াছেন। তিনি বলেন, “সেদিন ঠাকুরের মন যেন নরেন্দ্রময় হইয়া রহিয়াছে, মুখে নরেন্দ্রের গুণানুবাদ ভিন্ন অন্য কথা নাই! আমাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘দেখ, নরেন্দ্র শুদ্ধসত্ত্বগুণী; আমি দেখিয়াছি সে অখণ্ডের ঘরের চারিজনের একজন এবং সপ্তর্ষির একজন; তাহার কত গুণ তাহার ইয়ত্তা হয় না!’ – বলিতে বলিতে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে দেখিবার জন্য এককালে অস্থির হইয়া উঠিলেন এবং পুত্রবিরহে মাতা যেরূপ কাতরা হন সেইরূপে অজস্র অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন। পরে কিছুতেই আপনাকে সংযত করিতে পারিতেছেন না দেখিয়া এবং আমরা তাঁহার এরূপ ব্যবহারে কি ভাবিব মনে করিয়া ঘরের উত্তরদিকে বারান্দায় দ্রুতপদে চলিয়া যাইলেন, এবং ‘মাগো, আমি তাকে না দেখে আর থাকতে পারি না’, ইত্যাদি রুদ্ধস্বরে বলিতে বলিতে বিষম ক্রন্দন করিতেছেন, শুনিতে পাইলাম। কিছুক্ষণ পরে আপনাকে কতকটা সংযত করিয়া তিনি গৃহমধ্যে আমাদিগের নিকটে আসিয়া উপবেশন করিয়া কাতর-করুণস্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘এত কাঁদলাম, কিন্তু নরেন্দ্র তো এল না; তাকে একবার দেখবার জন্য প্রাণে বিষম যন্ত্রণা হচ্ছে, বুকের ভিতরটায় যেন মোচড় দিচ্ছে; কিন্তু আমার এই টানটা সে কিছু বুঝে না’ – এইরূপ বলিতে বলিতে আবার অস্থির হইয়া তিনি গৃহের বাহিরে চলিয়া যাইলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার গৃহে ফিরিয়া আসিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘বুড়ো মিনসে, তার জন্য এইরূপে অস্থির হয়েছি ও কাঁদচি দেখে লোকেই বা কি বলবে, বল দেখি? তোমরা আপনার লোক, তোমাদের কাছে লজ্জা হয় না, কিন্তু অপরে দেখে কি ভাববে, বল দেখি? কিন্তু কিছুতেই সামলাতে পাচ্ছি না!’ নরেন্দ্রের প্রতি ঠাকুরের ভালবাসা দেখিয়া আমরা অবাক হইয়া রহিলাম এবং ভাবিতে লাগিলাম নিশ্চয়ই নরেন্দ্র দেবতুল্য পুরুষ হইবেন, নতুবা তাঁহার প্রতি ঠাকুরের এত টান কেন? পরে ঠাকুরকে শান্ত করিবার জন্য বলিতে লাগিলাম, ‘তাই তো মহাশয়, তার ভারি অন্যায়, তাকে না দেখে আপনার এত কষ্ট হয় – এ কথা জেনেও সে আসে না!’ এই ঘটনার কিছুকাল পরে অন্য এক দিবসে ঠাকুর নরেন্দ্রের সহিত আমাকে পরিচিত করিয়া দিয়াছিলেন। নরেন্দ্রের বিরহে ঠাকুরকে যেমন অধীর দেখিয়াছি তাঁহার সহিত মিলনে আবার তাঁহাকে তেমনি উল্লসিত হইতে দেখিয়াছি। পূর্বোক্ত ঘটনার কিছুকাল পরে ঠাকুরের জন্মতিথিদিবসে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়াছিলাম। ভক্তগণ সেদিন তাঁহাকে নূতন বস্ত্র, সচন্দন-পুষ্প-মাল্যাদি পরাইয়া মনোহর সাজে সাজাইয়াছিল। তাঁহার ঘরের পূর্বে, বাগানের দিকের বারান্দায় কীর্তন হইতেছিল। ঠাকুর ভক্তগণপরিবৃত হইয়া উহা শুনিতে শুনিতে কখনও কিছুক্ষণের জন্য ভাবাবিষ্ট হইতেছিলেন, কখনও বা এক একটি মধুর আখর দিয়া কীর্তন জমাইয়া দিতেছিলেন; কিন্তু নরেন্দ্র না আসায় তাঁহার আনন্দের ব্যাঘাত হইতেছিল। মধ্যে মধ্যে চারিদিকে দেখিতেছিলেন এবং আমাদিগকে বলিতেছিলেন, ‘তাই তো নরেন্দ্র আসিল না!’ বেলা প্রায় দুই প্রহর, এমন সময়ে নরেন্দ্র আসিয়া সভামধ্যে তাঁহার পদপ্রান্তে প্রণত হইলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র ঠাকুর একেবারে লাফাইয়া উঠিয়া তাঁহার স্কন্ধে বসিয়া গভীর ভাবাবিষ্ট হইলেন। পরে সহজ অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া ঠাকুর নরেন্দ্রের সহিত কথায় ও তাঁহাকে আহারাদি করাইতে ব্যাপৃত হইলেন। সেদিন তাঁহার আর কীর্তন শুনা হইল না।”
1. শ্রীযুত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল।
ঠাকুরের বিশেষ ভালবাসার পাত্র হইয়াও নরেন্দ্রের অচল থাকা তাঁহার উচ্চাধিকারিত্বের পরিচয়
ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হইয়া শ্রীযুত নরেন্দ্র যে দেবদুর্লভ প্রেমের অধিকারী হইয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। উহাতে অবিচলিত থাকিয়া তিনি যে যথার্থ সত্যলাভের আশায় ঠাকুরকে পরীক্ষা করিয়া লইতে অগ্রসর হইয়াছিলেন ইহাতে বুঝিতে পারা যায়, সত্যানুরাগ তাঁহার ভিতরে কতদূর প্রবল ছিল। অন্যপক্ষে ঠাকুর যে নরেন্দ্রের ঐরূপ ভাবে ক্ষুণ্ণ না হইয়া শিষ্যের কল্যাণের নিমিত্ত পরীক্ষা প্রদানপূর্বক তাঁহাকে আধ্যাত্মিক সকল বিষয় উপলব্ধি করাইয়া দিতে পরম আহ্লাদে অগ্রসর হইয়াছিলেন, ইহাতে তাঁহার নিরভিমানিত্ব এবং মহানুভবত্বের কথা অনুধাবন করিয়া বিস্ময়ের অবধি থাকে না। ঐরূপে নরেন্দ্রের সহিত ঠাকুরের সম্বন্ধের কথা আমরা যতই আলোচনা করিব ততই একপক্ষে পরীক্ষা করিয়া লইবার এবং অন্যপক্ষে পরীক্ষা প্রদানপূর্বক উচ্চ আধ্যাত্মিক তত্ত্বসকল উপলব্ধি করাইয়া দিবার আগ্রহ দেখিয়া মুগ্ধ হইব, এবং বুঝিতে পারিব, যথার্থ গুরু উচ্চ অধিকারী ব্যক্তির ভাব রক্ষা করিয়া কিরূপে শিক্ষাদানে অগ্রসর হন ও পরিণামে কিরূপে তাহার হৃদয়ে চিরকালের নিমিত্ত শ্রদ্ধা ও পূজার স্থল অধিকার করিয়া বসেন।