বোবা চোখ – মির্জা আদিব
সেদিন সারা শহর শেখ খয়রুদ্দিন মরহুমের জন্মবার্ষিকী পালন করছিল।
এই দিনটি উদ্যাপনের জন্য গত ক’সপ্তাহ ধরে খুব তোড়জোড় প্রস্তুতি চলছে। যেমন : বিভিন্ন খবরের কাগজের বিশেষ সংখ্যা ছাপা হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় মরহুমের চিত্রাবলি মুদ্রিত হচ্ছে। এবং রবিবার সন্ধ্যায় পৌরসভার মেয়রের সভাপতিত্বে টাউন-হলে এক বিরাট সাধারণ সভাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওই সভায় শহরের ক’জন প্রখ্যাত অনন্য পুরুষ মরহুমের বরেণ্য জীবনের ঘটনাবলির ওপর আলোকপাত করছেন। এই সূত্রে আমাকেও অন্যতম বক্তা নির্বাচিত করা হয়েছে। মরহুমের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জানাশুনো ছিল। তাছাড়া, সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধাদি অধ্যয়ন করার পর আমার হাতে এত বেশি উপকরণ জমা হয়ে গিয়েছে যে, ওঁর সম্পর্কে একটা কেন, কম-সে-কম দশটা লম্বা-চওড়া বক্তৃতা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু আমি চাইছিলাম, যাই লিখি-না কেন, মরহুমের জীবনের একটি বিশেষ দিককে নিয়েই শুধু লিখব। আর, তার জন্য আমি যে বিষয় নির্বাচন করেছি, তা হচ্ছে : শেখ খয়রুদ্দিন মরহুমের কাছে জনগণের ঋণ। আমার চোখের সামনে উপকরণ ছড়িয়ে পড়ে ছিল– আমার কলম দ্রুতগতিতে সেগুলোকে গুছিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে–
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, শেখ সাহেব মরহুম শহরের বিখ্যাত ধনবানদের একজন ছিলেন। পৈতৃক ওয়ারিশান সূত্রে তিনি প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেছিলেন। তাছাড়া নিজের ব্যক্তিগত চেষ্টায়ও তিনি তাঁর দৌলতের অনেক বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের দেখা দরকার, সেটি হচ্ছে এই যে, তাঁর মরহুম ধন-দৌলত কোথায় কীভাবে খরচ করেছেন এবং মরহুমের হাতে তাঁর পুঁজির আর কত অবশিষ্ট ছিল। শেখ সাহেব ছিলেন নিরাশ্রয়ের আশ্রয় আর পিতৃহীন-মাতৃহীনের ভরসা। সারাজীবন তিনি আল্লার সৃষ্ট জীবের সেবা করে গেছেন। তিনি তাঁর আয়ের একটা বিশেষ অংশ জনকল্যাণের জন্য আলাদা করে রাখতেন। কবিবর জওক্ বলেছেন :
বরণীয় নাম : তিনি কল্যাণের হইলেন হেতু।
কূপ হইল, মসজিদ হইল, হইল পুষ্করিণী, সেতু।।
‘মরহুম এই কবিতার জীবন্ত প্রতীক। আজ কে না জানে ‘খয়রুদ্দিন হাসপাতালে’র নাম। এই হাসপাতালে প্রতিদিন বহু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে, আর বেশির ভাগ রোগীকেই ওষুধ দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। মরহুম শুধু হাসপাতাল করেই ক্ষান্ত হননি, একেবারে আপন পকেট থেকে মোটা অঙ্ক ব্যয় করে একটি এতিমখানাও বানিয়ে দিয়েছেন। আজও সেই এতিমখানায় সমাজের কত নিরাশ্রয়, নিঃসম্বল শিশু প্রতিপালিত হচ্ছে। সহায়-সম্বলহীন মানুষের সহায় হওয়াই ছিল তাঁর কাজ।’
‘বাবুজী, একটা চিঠি লিখে দেবেন গো?’
আমার কলম হঠাৎ থেমে গেল। মাথা তুলে সামনে তাকালাম। মেহেরুন গোয়ালিনী ময়লা হাতে একটি খালি খাম নিয়ে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে।
‘দেবেন চিঠি লিখে? ফুরসত আছে?’
আমি জানি, যদি আমার যাবতীয় ভাবনাগুলোকে আমি এখন গুছিয়ে না-নিই, তাহলে পরে আমার বক্তৃতার গাঁথুনি আর ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাবে; এবং লেখার যে সহজ কায়দাটিকে আমি এখন আয়ত্ত করেছি, তা আর থাকবে না। কিন্তু কী করি, রাজি না হতেও মন চাইছে না। মেহেরুন গত দশ বছর ধরে পানি না-মিশিয়ে আমাদের দুধের রোজ দিয়ে আসছে। এরজন্য তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। রাজি। না-হলে এই কৃতজ্ঞতার বরখেলাপ হয়। সুতরাং মাথা নেড়ে ইশারায় তাকে ভেতরে আসতে বলি। মেহেরুন ভেতরে এসে মেঝের উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল।
‘বাবুজিকে বড্ড কষ্ট দিলাম গো! লিখতে হবে আমার বোনকে, বুঝলে গো? সে থাকে পিণ্ডিতে। গ্রাম–’
‘কী লিখতে হবে আগে বাপু তাই বল। ঠিকানা পরে লিখতে হয়। একটু দাঁড়াও। কাগজ নিই আগে। হ্যাঁ, এবার বল।
লিখে দেন, বিষুদ্বার সাঁঝের বেলা পাহাতুন-মা মারা গেছে– ব্যস্, এই কথা।’
বলতে বলতে তার গলার আওয়াজ কেমন ম্লান হয়ে গেল।
‘ফাতেমাকে পাহাতুন-মা বড় ভালোবাসত। সেই যে সেবার– ফাতেমা তখন আইবুড়ো– ওর পা একটু পুড়ে গিয়েছিল, পাহাতুন সারাদিন ঘুরে ঘুরে, আল্লা জানে কোথা থেকে না-কোথা থেকে মলম নিয়ে এল। এদিকে আবার সারা শহরে সেদিন জব্বর
হরতাল।’
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘পাহাতুন-মা– মানে সেই ধোপানি তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ– ওই যে গলির শেষে থাকত। আপনার কাপড়ও হয়তো ধুতো। গোটা মহল্লার কাপড় ওই তো ধুতো।’
‘ও, তাই বল। এইজন্য পরশু ওর ঘরের সামনে লোকজন বসেছিল? তাহলে পাহাতুন মারা গেছে?
মেহেরুন প্রশংসার গলায় বলল, ‘আহা, কী যে বুকের পাটা ছিল গো ওই মেয়ের। কাজ করে কেলান্তি নাই। কে বলে মেয়েলোক? সে ছিল মেশিন গো মেশিন।
‘আর জাঁহাবাজ ঝগুড়ে মেয়ে বলেও তার খুব নামডাক ছিল, তাই না? সব সময় ঝগড়া-কাজিয়া করত। পাড়ার লোক তার থেকে দশ হাত দূরে থাকত।’
আমি পাহাতুনের যে বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিলাম, তা সর্বজনবিদিত। ওটা একটা নিত্যনৈমিত্তিক আলোচনার বিষয় ছিল।
‘ঝগড়া তো সে করতই গো নিচ্চয়, আর চেঁচাচেল্লিও করত। তা, সে ঝগড়া করত আপন সোয়ামির সঙ্গে। আল্লা জানে, তার জন্যে লোকে কেন অত বদনাম করত। আমি হক্ কথাটা বলব গো তোমাকে, সে কেমন মেয়েলোক ছিল? বড্ড ভালো। হায় মা, দেখ, তোমার সময় নষ্ট হচ্ছে!’
আমি বক্তৃতার কাগজটার উপর নজর ফেললাম : ‘অসহায় সম্বলহীন লোকদের আশ্রয় দেওয়া মরহুমের কাজ ছিল।’ পরের বাক্যটা ঠিক করার জন্য বাঁ হাতের চেটোর উপর কপাল রেখে চোখ বন্ধ করে আমি ভাবতে লাগলাম।–
‘পৃথিবীতে এমন লোক খুব কমই আছেন, যাঁরা ভাঙা হৃদয় জোড়া দেন, নিপীড়িতকে ঠাঁই দেন এবং অনাথকে আশ্রয় দেন। শেখ সাহেবের খ্যাতির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে তিনি অনাথ-পতিতের সত্যিকার বন্ধু ছিলেন।’ আমার মাথায় গোটা গোটা বাক্য যথাযথ শব্দ-পরম্পরায় এগিয়ে আসছে। কলমের খোঁজে আমি এদিক-ওদিক তাকাই। মেহেরুন মিটিমিটি চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে, কী যেন ভাবে। কী সে বলতে চায়? তার নীরব চোখ দুটিতে কেমন এক আবেদনের ভাষা। তাতে এক বিশেষ ইচ্ছার ঝলক। মন চাইল, তার গুটিকয় কথা শুনেই নিই। দু-দশ মিনিট যাবে তাতে। না-হয় তারপরই শেখ সাহেবের জীবনের আরো দু’চারটি ঘটনার কথা লিখে আমার ভাষণ শেষ করব। বললাম, ‘তাহলে ঝগড়াটে ছিল না তোমার পাহাতুন-মা?’
‘হ্যাঁ ছিল, নিশ্চয় ছিল– আমি বলছি, ছিল। আল্লা ভালো করুক। হ্যাঁ, আমার পুরুষের কথাই ধর-না। বিয়ের পর আমি যখন তার সংসারে এলাম, সে বলল, ‘দেখ মেহেরুন-বউ, ওই পাহাতুন থেকে কিন্তু একদম দূরে দূরে থেক। তোমাকে নিয়ে যদি কোনোদিন পড়ে, তো তোমার মাথার একটি চুলও আর বাকি রাখবে না, হ্যাঁ।’
‘আমি বললাম, ‘আমিও কিছু কম নই কারো থেকে, হুঁ। আমার সঙ্গে যদি লড়তে আসে, আমিও খোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেব।
‘ওই কথা তো আমি বললাম বড়-মুখ করে, কিন্তু সত্যি বলতে কী, পাহাতুনের কাছে যেতে আমার খুব ডর লাগত। আমাকে বাপু ক-বার ডেকেও ছিল, কিন্তু আমি যে দূরে দূরে, সেই দূরে দূরেই রইলাম। তারপর এই ধরেন গো সেদিনের কথা– আমার পুরুষের মরা তখন একমাসও হয়নি, পাহাতুনের তার সোয়ামি মওলা বখ্শের সঙ্গে এমন কাজিয়া হল– সে আর তোমাকে কী বলব গো বাবুজি! পাহাতুন তো আসমানটাকে একেবারে মাথায় করল। সেদিন আমি একদম পাকাপাকি ঠিক করে ফেললাম, ওরা মুখোমুখি আর হওয়া নয়। জানো বাবুজী, কী নিয়ে সেই কাজিয়া? শোনো তাইলে। পাহাতুন কোথায় শুনেছে, মওলা বখ্শের কোন খেমটাউলির সঙ্গে পিরিত হয়েছে। তার ঘরে যাওয়া-আসা আছে। তাই শুনে তো পাহাতুনের সারা শরীলে-গতরে আগুন ধরে গেল। খেমটাউলিকে সে তো ভালো-মন্দ যা শোনাল, তোবা তোবা, সে আর মুখে আনার লয় গো। কিন্তু অর্ধেক রাত পর্যন্ত সে আর মহল্লার কাউকে ঘুমোতে দেয়নি।– হেই মা, দেখ দেখ, আমি তোমার সময় নষ্ট করে দিলাম কত। দেখ আমার আক্কেল, আমি পাহাতুনের কিস্সা কেমন শুরু করলাম বসে বসে।’ বলতে বলতে মেহেরুন একেবারে অস্থির হয়ে উঠল। আমি তাকে ভরসা দিয়ে বললাম, ‘না না, তুমি বল পাহাতুনের কাজিয়ার কথা।’
‘দু’দিন পর আবার কাজিয়া। মওলা বখ্শ বলল, সে খেমটাউলির ঘরে যাবেই যাবে। ব্যস্, পাহাতুন তো একেবারে যেন কতকাল না-খেয়ে থাকা একটা বাঘিনী হয়ে গেল। সেদিন তার চাচাও এসে রাগের মাথায় মওলা বখশের একটা হাত দিল ভেঙে। তারপর, বুঝি দু’তিন দিন পরের কথা, আমি আমার এক খদ্দেরকে দুধ দিচ্ছি, দেখি পাহাতুন ছোট একটা গেলাস হাতে কখন এসে কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে।’
‘পাহাতুন বলল, ‘বউ, আমাকে একটু দুধ দাও’।
‘আমি ওকে দুধ দিলাম। ভেবেছিলাম, দুধ নিয়ে চলে যাবে; কিন্তু একেবারে ধরনা দিয়ে বসে গেল, তারপর কথা শোনাতে লেগে গেল। পেখম তো বলতে লাগল, মওলা বশের খুব অসুখ, খুব কষ্ট। বেচারা সারারাত তড়পেছে। আর পাহাতুনও দু’রাত দুই চোখের পাতা এক করেনি। তারপর সে নিজের সংসারের হাল শোনাতে লাগল। বাবুজি, ওইদিন আমি বুঝতে পারলাম, পাহাতুনের মন আসলে ভালো। বাবুজি, তুমি তাকে কেমন করে মন্দ বলবে গো। তার সোয়ামি একটা খেমটাউলির সঙ্গে পিরিত চালাচ্ছে। কিন্তু তবু শরীলে জখম নিয়ে সে যখন বাড়ি ফেরে, সে সারারাত জেগে জেগে তার খেজমত করেছে। আর নুলো শাশুড়িটার তো সে সেইদিন থেকে খেজমত করছে, যেদিন তার বিয়ে হয়েছে। তাই দেখে কিন্তু আমার যা সন্দ ছিল, তা চলে গেল। আমি তার বাড়ি যাওয়া-আসা করতে লাগলাম। অসুখে পড়ে মওলা বখ্শ বলেছিল, সে আর খেমটাউলির ঘরে যাবে না। কিন্তু যেই সেরে উঠল, অমনি পাহাতুনের সোনার ক’গাছা চুড়ি চুরি করে পালাল। আর সেই চুড়ি দিল গিয়ে খেমটাউলিকে।
‘পাহাতুনের আপন লোকরা বলেছিল মওলা বখ্শকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু তাতে সে রাজি হয়নি। বাপের বাড়ি চলে গেল। তারপর একমাস পর আবার এল। আল্লা জানে, এমন একটা বদ্ সোয়ামির ওপর তার কিসের অত টান। যদি আমি হতাম, তাইলে, জানো বাবুজি, কী করতাম? ওই লোকের ছায়া মাড়াতাম না– এই একদম সত্যি কথা কয়ে দিলাম, হ্যাঁ। আচ্ছা, তারপর একদিনের কথা। আমি আমার ঘরে বসে রুটি খাচ্ছি। কোথা থেকে একটা মেয়েলোক এসে দাঁড়াল। কয়লার মতো পায়ের রং। জবাফুলের মতো লাল চোখ। আবার গলায় মতির মালা। আমি বললাম, হায় আল্লা, এ আবার কে কোত্থেকে এল! সেই মেয়েলোক মাজা দোলাতে দোলাতে এল। তারপর আমার কাছে মোড়া টেনে নিয়ে বসে পড়ল।
‘আমি বললাম, ‘বহিন, তুমি কোথাকার লোক। তোমার কী চাই?’
‘তাতে সে বলল, ‘আমার নাম দরিয়া। আমি মিসবি শাহ্-তে থাকি। মওলা বখ্শকে একটু ডেকে দাও না।
‘আমি বললাম, ‘হায় মা, তুই তাইলে সেই খেমটাউলি, হ্যাঁ গা? না বাবা, আমি এর মধ্যে নাই। পাহাতুন যদি শোনে তুই এখানে রয়েছিস, তাইলে, আল্লা জানে কী হাল করে সে ছাড়বে তোর, হুঁ। বড় কঠিন মেয়েছেলে সে। গোটা মহল্লা তাকে ডরায়।’
‘তাই শুনে সে বলল, ‘বহিন, আমি এখন কোথায় যাই, কও। আমার ঘরের লোকে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলে, আমি কলঙ্কিনী হয়েছি। মওলা বখ্শকে একটু ডাক, তারে শুধাই, সেই পাজি আমারে কলঙ্কিনী বানিয়ে কার কাছে ফেলে পালিয়ে এসেছে?’
‘আমি বললাম, ‘আমি কী করে জানব বাছা তুমি কোথায় যাবে। কিন্তু আমি এসবের মধ্যে নাই। পাহাতুনকে তো তুমি দেখনি। যদি তোমাকে সে এখানে দেখে ফেলেছে, তো তোমার হাড্ডি সে একদম গুঁড়ো করে দেবে। এই বলে দিলাম, হ্যাঁ। আল্লার কসম, সে বড় কঠিন মেয়েলোক। চুপচাপ পালাও এখান থেকে। তাতে তোমারই ভালো।’
‘সে বলল, ‘তার সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। কদিন থেকে সে আর ওদিকে পা রাখছে না। আল্লা তাকে কেন আমার কাছে পাঠিয়েছিল। কেন সে আমার ঘরে উঠেছিল! বেশ বহিন, তুমি যদি মওলা বখ্শকে ডেকে না-দাও তো আমিই যাচ্ছি তার বাড়ি।’
‘বাবুজি, সে তো পাহাতুনের বাড়ি যাবেই, শুনবে না। কিন্তু আমি যখন তাকে খুব করে ডর দেখালাম, তখন সে বলতে লাগল, ‘আচ্ছা, বেশ, তাইলে আর কী করি– বেশ, পিণ্ডিতে আমার মামু আছে, তার কাছেই যাই।’
‘সে চলে গেল। গলিটা তখন অন্ধকার হয়েছিল। কোন দিকে গেল, দেখতে পেলাম না। ভাবলাম, এমন ডর ডরিয়েছে, আর পেছন ফিরেও চাইবে না।’
‘কিন্তু ও-মা, সক্কাল বেলা পাহাতুনের বাড়ি গিয়ে যা দেখলাম, তাতে তো নিজের চোখকেই পেত্যয় হয় না। পাহাতুন কাপড় ইস্তিরি করছে, আর সে– আর কে– সেই খেমটাউলি, পাহাতুনের সতীন, মোড়ায় বসে দই দিয়ে বাসি রুটি খাচ্ছে। দেখে তো আমি থ। পাহাতুন বলল, ‘মেহেরুন, জানো, এ কে?’
‘আমি বললাম, ‘না।’ কী করি, মিছে কথাইটা বললাম।
‘সে বলল, ‘সেই নষ্ট ছুঁড়ি– দরিয়া নাচনেউলি।’
‘আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এখানে?’
‘সে বলল, ‘হ্যাঁ বউ, ছুঁড়ি কয়, ঘরের লোকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কয়, আমার আর কেউ নাই– আমি কলঙ্কিনী হয়েছি। আমি কইলাম, আচ্ছা, ঘরের লোকে তোকে তাড়িয়ে দিয়েছে–তা আয়, থাক আমাদের সঙ্গে– শুকনো রুটি আমাদের যা জুটবে, তুইও চাট্টি খাস।’
‘দরিয়া পাহাতুনদের কাছে থাকতে লাগল। পাহাতুনের আত্মীয়-কুটমরা যখন জানতে পারল দরিয়া খেমটাউলি তার বাড়ি এসে থাকছে, তখন যা কাণ্ড হল, তাতে মনে হল, একদল নেকড়েবাঘ বুঝি কেউ ছেড়ে দিয়েছে। সবাই একমুখে বলল, ‘ওকে এক্ষুনি দূর কর!’ কিন্তু পাহাতুন বলল, ‘আমি ওকে ঠাঁই দিয়েছি, আর ওকে তাড়াতে পারি না। বেচারি এখন পথে পথে কোথায় ঘুরে মরবে?’
‘বাবুজি, কী বলব! পাহাতুনের আত্মীয়-কুটুমরা খুব রাগ করল, খুব মেজাজ চড়াল। তার চাচা তো এদ্দূর বলল, ‘এই বেবুশ্যে মাগি যদি এখানে থাকে, আমি কক্ষণো আর তোমার বাড়িমুখো হব না।’ পাহাতুন সব শুনল, কিন্তু আল্লার বান্দা ওই মেয়ে, দরিয়াকে বাড়ি থেকে যেতে বলল না।
‘পাহাতুন আগের মতোই সংসারের সব কাজ করত। দরিয়া কিছু করতে পারে না বললেই হয়। তার পেশা ছিল গান-বাজনা করা। সে কি আর ভাটির কাজ করতে পারে, না ইস্তিরি করতে পারে!
‘যাই হোক, দিন যেমন যায়, তেমনি যেতে লাগল। পাহাতুনের চেনা-জানা সবাই তাকে একঘরে করল। তার বাপ-চাচাও আসা-যাওয়া বন্ধ করল। তাই দেখে দরিয়া বলতে লাগল, ‘বহিন, অনেক হয়েছে, আর না– আমি যাই।’ সে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। পাহাতুন তার চুলের গোছা ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে এল। তারপর আর দরিয়া কখনো যাওয়ার কথা মুখে আনেনি।
‘পাঁচ-ছ মাস পর দরিয়ার একটি মেয়ে হল। কমজোর এতটুকু মেয়ে একটা। আমি তো তাকে দেখেই বুঝেছিলাম, বাঁচবে না। কিন্তু কথায় বলে না, রাখে আল্লা মারে কে। মেয়েটা সামলে উঠল, কিন্তু মায়ের হাল গেল খারাপ হয়ে। পাহাতুন তার জন্যে অনেক খরচা করল, লেডি-ডাক্তার আনল, কিন্তু সে বাঁচল না। তখন আয়েশার বয়েস দু-আড়াই মাস।
‘মা গেল মরে, এখন মেয়েকে মানুষ করে কে? দরিয়া মরার সময় মেয়েটিকে পাহাতুনের হাতে সঁপে দিয়ে গিয়েছিল। ব্যস্, আর কোনো কথা নাই। পাহাতুন তাকে বুকে তুলে নিল, তারপর মানুষ করতে লাগল। আল্লা জানে, মেয়েটাকে পাহাতুন কেন অত ভালোবেসে ফেলেছিল। তাকে সে একদণ্ড কোল থেকে নামাত না।’
মেহেরুনের আবার খেয়াল হল, সে আমার অনেক সময় নষ্ট করে দিয়েছে। সুতরাং, উবু হয়ে বসে খালি খামটাকে দেখতে লাগল। খাম সে সঙ্গে এনেছিল এবং সেটা আমার চারপাইয়ের উপর কাগজের স্তূপের সঙ্গে এখন পড়ে ছিল।
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘মেয়েটা বেঁচে ছিল?’
মেহেরুন আবার পা ছড়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলতে শুরু করল, ‘হ্যাঁ, বেঁচে বইকি। কিন্তু পাহাতুনের জন্যে সে এক আপদ হয়ে দাঁড়াল। তুমি বলবে, কেমন করে? তবে শোনো বাবুজি। খেমটাউলি যদ্দিন বেঁচে ছিল, লোকে পাহাতুনকে বলত, ‘ও ভ্রষ্ট মেয়ে, ওকে শিগগির তাড়িয়ে দাও।’ সে যখন মরে গেল তো তারা বলতে লাগল, ‘কে বলতে পারে, এ মেয়ে মওলা বখ্শের কিনা। ওকে ওর নানীর কাছে পাঠিয়ে দাও।’শুনছ বাবুজি? মোটকথা ওই মেয়েটাকে নিয়ে সবার সন্দেহ ছিল, তাই একদিন আত্মীয়-কুটুম-পড়শি যত লোক পাহাতুনের বাড়ি জমা হয়ে বলতে লাগল, ‘দেখ পাহাতুন আমরা সবাই আজ পর্যন্ত তোমার মুখ দেখেছি। এখন ভালো যদি চাও, মেয়েটাকে তার নানির কাছে পাঠিয়ে দাও। না-হলে কিন্তু আমরা আর তোমার খাতির করব না।’ সেইকথার ওপর পাহাতুন কী বলল জান বাবুজি? সে ছাতি ফুলিয়ে শুনিয়ে দিল, ‘এইটুকু অবলা মেয়েটা আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না।’
‘তারা বলল, ‘যদি-না ছাড় তো আমরা তোমাকে একঘরে করব।’
‘পাহাতুন তেমনি মুখের ওপর জবাব করল, ‘যা খুশি কর। আমি যখন ওকে বুকে তুলে নিয়েছি, তখন আমার মরণই শুধু ওকে আলাদা করতে পারে।’
মেহেরুনের গলায় তখন উত্তেজনা। এমনভাবে সে বর্ণনা দিচ্ছিল, যেন মনে হচ্ছিল, মঞ্চে সে পাহাতুনের চরিত্রে অভিনয় করছে।
‘তাহলে পাড়া-পড়শি তাকে একঘরে করল?’
‘হ্যাঁ, বাবুজি। আর শেষ পর্যন্ত মওলা বখ্শও তার বিবির খেলাপ হয়ে গেল। পাহাতুনের দুই ছেলে তো আগেই খেমটাউলিকে দেখতে না-পেরে মামা-বাড়ি চলে গিয়েছিল। তারা সেখানেই কাজ-কাম করছিল। আমি যখন দেখলাম পাহাতুন তার জেদের জন্যে বড় লোকান করছে নিজের, তখন একদিন তাকে বললাম, ‘পাহাতুন, তুমি মেয়েটাকে পাঠিয়েই দাও। ওটাকে কাছে রেখে কী ফায়দা বল। সব লোক তোমার শত্রুর হয়ে গেল।’
‘তাই শুনে সে বলল, ‘না রে বউ, তা হয় না। আমি ওর মাকে কড়ার করেছি ওকে বুকে করে রাখব। তাইলে বল্, তাকে কী করে পাঠাই? লোকে শত্তুর হচ্ছে তো হোক– হাজার বার হোক। কাউকে যখন ঠাঁই দিয়েছি, তখন আর লোকের কথায় ডরানো চলে?’
আমি বললাম, ‘তোমার নিজের ছেলেরাও তো তোমার শত্তুর হয়েছে।
‘পাহাতুনের চোখে পানি ভরে এল। সে বলল, ‘লোকে বলে, ছেলে মা-বাপের ডান হাত। কিন্তু আমার ছেলেরা! যাকগে, আল্লা তাদের ভালো করবেন। তারা যা-খুশি তাই করুক। তাদের আমি ডরাই না। আল্লা, যদি বুকে বল দেয় আমার কোনো কাম আটকাবে না।’
‘আর পাহাতুন তার নিজের কাজ-কাম করে যেতে লাগল। আয়েশা বাড়তে লাগল। পাহাতুন দিন-রাত খেটে তার বিয়ের যৌতুক জমা করতে লাগল– তাতে সে তার সব পুঁজি ঢেলে দিল। আয়েশার বিয়ে হয়ে গেলে পাহাতুন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তার ফরজ সে পুরা করেছে। কিন্তু বাবুজি, আসলে আল্লার ইচ্ছা অন্যরকম। আয়েশার বিয়ে হয়েছিল গুজরাতে। আয়েশার শ্বশুরকে গিয়ে সেখানে কেউ বলে বলে দেয়, আয়েশা খেমটাউলির বেটি। ব্যস্, আর যায় কোথা! শ্বশুরবাড়ির লোকে তাকে মেরেধরে পাহাতুনের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। তারপর তালাকের কাগজও পাঠিয়ে দিল। আয়েশা এদিকে তালাক নিয়ে বাড়ি ঢুকল, আর ওদিকে মওলা বখ্শ রক্ত তুলতে লাগল। পাহাতুনের বিপদের ওপর বিপদ। আর কেউ হলে, তো পাগলই হয়ে যেত। কিন্তু পাহাতুন দমবার লোক নয়। একা নুলো শাশুড়ির খেমত করতে লাগল, সোয়ামির অসুখের খরচ চালাতে লাগল, আবার মানুষের কাপড়ও সমান ধুয়ে চলল।
‘পাহাতুনের এক সম্পর্কের ভাইপো ছিল– নাম তার তাজু। মস্ত একটা বাউণ্ডুলে। পাহাতুন তাকে নিজের কাছে এনে রাখল। সেই ছেলে তাকে কাজে-কামে সাহায্য করত। তারপর যখন পাহাতুন দেখল, তাজু ভালো হয়ে গেছে, তার সঙ্গে আয়েশার নিকাহ পড়িয়ে দিল। আল্লা আল্লা করে তার ঘাড় থেকে ওই বোঝা নামল। বাবুজি, তারপর হল কী, মওলা বখ্শ দুই বছর রোগে ভুগে মারা গেল। ক’দিন পর পাহাতুনের নুলো শাশুড়িও চলে গেল। বুড়ি পাহাতুনের বিয়ের পর পুরো এক কুড়ি দশ আর দু’বছর বেঁচে ছিল। এক কুড়ি দশ আর দুই, এই এত বছর পাহাতুন তার খেজ্জ্মত করেছে।
‘একদিন রাত্রে পাহাতুন কাপড় ইস্তিরি করছিল। আল্লা জানে, কী করে ইস্তিরি থেকে আগুন বেরিয়ে তার কাপড়ে পড়ে। তাতে বেচারির হাঁটু পুড়ে যায়। সকাল পর্যন্ত সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। সকালবেলা আয়েশা তাকে ওই অবস্থায় দেখে নিজের মাথায় বাড়ি মারতে লাগল। আমরা ছুটে গিয়ে সবাই তাকে চারপাইয়ে তুলে শুইয়ে দিলাম ডাক্তার ডাকলাম। তার জ্ঞান ফিরে এল। কিন্তু আগের সেই পাহাতুন আর রইল না। বেচারি চারপাই থেকে নামতেই পারত না। মঙ্গলবারের রাতের কথা। পাহাতুন নিচে শুয়ে, আর ছাদের উপরে আয়েশা, তাজু, আর তাদের ছেলে। মাঝরাতে ছেলেটা কাঁদতে লাগল। আল্লা জানে, কেন সে অত কাঁদছিল। আয়েশার হল গিয়ে জোয়ান মানুষের ঘুম। সে বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল। পাহাতুন আর থাকতে পারল না। পেখম ডাকাডাকি করল। তাতেও ছেলের কাঁদা থামল না দেখে সে উপরে গেল। আল্লা জানে, কী করে সে উপরে উঠল আর কী করেই-বা ছেলেকে কোলে নিল। আর আয়েশার ঘুম ভাঙাল। আয়েশা খুব রাগ করল। বলল, ‘মা, তোর মরার সাধ হয়েছে!’
‘সেই কথা তার সত্য হল। পাহাতুনের ঠাণ্ডা লেগে গেল। তারপর বৃহস্পতিবারের সন্ধেবেলা সে মরে গেল। সারাজীবন মানুষের খেমত করে আর উপকার করে শেষে মরেই গেল।’
মেহেরুনের গলা বুজে আসে। তার চোখে দুঃখের ছায়া। ওড়নার খুঁটে নাক মুছতে মুছতে সে অন্যদিকে মুখ ফেরাল।
আমি ভাবতে থাকি : পাহাতুন– মা মরে গেছে। এ হল সেই পাতাতুন-মা, যে বত্রিশ বছর নুলো শাশুড়ির সেবা করেছে। নিজের সতিনকে এমন সময় ঠাঁই দিয়েছে, যখন তার নিজের লোকে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাকে পাথারে ভাসিয়েছে। সেই সতিনের মেয়ে যখন মায়ের বুকের দুধ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়েছে, তখন তাকে নিজের বুকে তুলে নিয়েছে। দুবছর ধরে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার ব্যয় বহন করেছে। এ হল সেই পাহাতুন-মা, সে পঞ্চাশ বছর এই পাড়ায় ছিল, কিন্তু তার সম্পর্কে আমি শুধু এইটুকুই জানতাম যে, সে একজন ধোপানি আর খুব ঝগড়াটে মেয়েলোক।
মেহেরুন ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবুজি, তাইলে লিখে দাও চিঠি।’ আমি কাগজ নিয়ে লেখার জন্য প্রস্তুত হলাম। মেহেরুন চোখ বন্ধ করে ডান হাতের আঙুল দিয়ে চোখ দুটো টিপে ধরল। তার চোখের নিচের উঁচু গালের হাড় সিক্ত হয়ে উঠল। মেহেরুন তর্জনী ঘষে ভেজা গাল শুকিয়ে নিল। তারপর গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘চিঠি লেখা হল বাবুজি?’
‘হ্যাঁ, হল।’
চিঠি শেষ করে আমি ওর হাতে দিয়ে দিলাম। সে উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আবার জিগ্যেস করল, ‘শহরে আজ এত ঝাণ্ডা কেন ঝোলানো হয়েছে, বাবুজি?’
‘ও, তুমি জান না? শেখ খয়রুদ্দিন মরহুমের আজ জন্মদিন যে।’
‘সত্যি? শেখ খয়রুদ্দিন? আমি তেনাকে দেখেছি। তিনি খুব জবর লোক ছিলেন। পাহাতুন তেনার কাপড় ধুত।’
মেহেরুন চলে গেল। আমি বক্তৃতা শেষ করার জন্য আবার কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লাম। কিন্তু আমি তখন চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমার চোখের সামনে পাহাতুনের বুড়ো মুখটা ভাসতে লাগল। মনে হল যেন তার ওই মুখের উপর শত শতাব্দীর স্বার্থহীন সেবার ধুলো জমা হয়ে আছে। সেই ধুলোর আস্তরণের ভেতর থেকে তার বোবা চোখ আমাকে কী-যেন প্রশ্ন করছে। আর, আমার মগজের ভেতর মেহেরুনের কথাগুলো ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে : ‘খায়রুদ্দিন খুব জবর লোক ছিলেন! পাহাতুন তেনার কাপড় ধুতো।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির