গান্ধী ও সংসদীয় গণতন্ত্র
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হল। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলেন। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় পর্বের এখানে পরিসমাপ্তি। নতুন এক অধ্যায়ের আরম্ভে দাঁড়িয়ে আমাদের আজকের ভাবনাচিন্তা।
স্বাধীন ভারতের সংবিধানে প্রথম থেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এই শাসনতন্ত্রের নানা ত্রুটিবিচ্যুতির কথা সমালোচকরা বলেছেন। তবু এটাই আমাদের স্বীকৃত বিধান। বস্তুত সংসদীয় গণতন্ত্রের অবিচল প্রতিষ্ঠা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের অধুনা পরিসমাপ্ত অধ্যায়ের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ইরান অথবা মিশর পর্যন্ত প্রাচ্যের এই বিশাল ভূখণ্ডে অন্য কোথাও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তুলনীয় উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভারতকে এই সময়ে বহু ঝড়-ঝাঁপটা বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে, যুদ্ধবিগ্রহ হত্যাকাণ্ড যার সাক্ষ্য বহন করছে। কিন্তু এই সবের ভিতর দিয়েও, সামান্য ছেদ সত্ত্বেও, সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাকে আমরা ইতিহাসের একটি কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ পর্বে অক্ষুণ্ণ রেখেছি। প্রতিবেশী অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনায় এটা উল্লেখযোগ্য সন্দেহ নেই।
সংসদীয় ও বহুদলীয় গণতন্ত্র চিরকালীন কোনো ব্যবস্থা নয়, অজর অথবা অমর নয়। এর যেমন একদিন উদ্ভব হয়েছে, অনুমান করা যায় তেমনি কোনো একদিন অন্ত ঘটবে। অন্তত এর রূপ ও চরিত্রের পরিবর্তন অনিবার্য। তবু এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য স্বীকার্য যে-জন্য একে আমরা মূল্যবান মনে করি।
রাজনীতিতে সর্বক্ষণ ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে। গণতন্ত্র এই দ্বন্দ্বকে কিছু স্বীকৃত নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে। এই ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে তখন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের পথে ঠেলে দেয় সমাজকে। গণতন্ত্রে সম্ভব ক্ষমতা হিংস হস্তান্তর। এটাই প্রথম কথা। আরো একটা কথা আছে।
আধুনিক সমাজ কিংবা আধুনিক মানুষের চিন্তা ও জীবনচচা কোনো একটি শাস্ত্র দিয়ে সামগ্রিকভাবে শাসিত নয় নানা মানুষের এখানে নানা মত। একই ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজের জীবন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে নানা ভাবে। এরই ভিতর দিয়ে গঠিত হচ্ছে বিভিন্ন মানুষের জীবনের বৈচিত্র্য, চিন্তার স্বকীয়তা, গণতান্ত্রিক বিন্যাসের যেটা। বিশেষ ঐশ্বর্য। স্বভাবতই একের ক্রিয়াকলাপে অন্যের সঙ্গত অধিকার যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয় সেটা দেখা দরকার। এ কথাটা মেনে নিয়েও গণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মূল্য দেয়, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা করে যথাসম্ভব।
গণতন্ত্রের ভিতর যে সব গুণের সমাহার লক্ষ করা যায় তার তালিকায় এই সব কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ক্ষমতার হস্তান্তর, এই সবের জন্য শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি ও অধিকার রক্ষিত হয় বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। আমরা ভারতে অন্তত নীতিগতভাবে এই ব্যবস্থাকেই মেনে নিয়েছি। দেশের জন্য কাম্য অন্যান্য যে সব উদ্দেশ্য আছে, যেমন আর্থিক উন্নতি, সামাজিক সুবিচার এবং উচ্চনীচ অসাম্যহ্রাস, গণতান্ত্রিক সংবিধানের কাঠামোর ভিতর এইসবের জন্য মানুষের প্রচেষ্টা রূপলাভ করবে, এটাই আমাদের আশা।
গান্ধীর প্রধান পরিচয় অহিংসার অসামান্য ব্যাখ্যাতা ও প্রয়োগকর্তা রূপে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের মূল্য তিনি বহুবার বহুরূপে স্বীকার করছেন। এ বিষয়ে তাঁর মূল যুক্তিটি সরল। তিনি চেয়েছিলেন, মানুষ হবে বিবেকবান। কিন্তু বিবেক বস্তুটি ব্যক্তির অন্তরের ব্যাপার অতএব গান্ধী মূল্য দিয়েছেন ব্যক্তিকে। আমরা যখন কোনো কাজ করি বাধ্য হয়ে অথবা অন্য পাঁচজনের অনুকরণে শুধু, তখন সে কাজ ঠিক-ভুল যাই হোক না কেন, তার পিছনে কোনো সক্রিয় বিবেক নেই। যন্ত্র নির্ভুলভাবে কাজ করে যেতে পারে, কিন্তু যন্ত্রের বিবেক নেই। শুধু ব্যক্তি-মানুষই হতে পারে বিবেকবান। সমাজের অন্য দশজনের গৃহীত বিশ্বাস যদি আমি সত্য বলে অনুভব না করি তবে আমাকে একাই চলতে হবে। অপরের প্রশ্নহীন অনুসরণ নয়, আবার স্বেচ্ছাচারও নয়; নিজের হৃদয়কে শুদ্ধ রাখা এবং সেই শুদ্ধ হৃদয়ের প্রতি আনুগত্য রক্ষা করাই ব্যক্তির কর্তব্য, এই ছিল গান্ধীর বিশ্বাস। এই অর্থে তিনি ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র এবং সমাজপরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা, এই যদি হয় গণতন্ত্রের দুই মৌল প্রত্যয়, তবে গান্ধীর স্থান গণতন্ত্রের সপক্ষে এটাই ধরে নিতে হয়। এই অর্থে তিনি গণতন্ত্রের সমর্থনে মতপ্রকাশ করেছেন। অহিংসা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে নিয়ে যে গণতন্ত্র, গান্ধীবাদ তাকে পুষ্ট করেছে।
অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর কিছু স্পষ্ট এমন কি কঠোর মন্তব্য আছে, যাকে কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। হঠাৎ যখন আমরা ঐসব বাক্যের সম্মুখীন হই তখন আশ্চর্য লাগে, চিন্তার কারণ ঘটে। সেটাই আবশ্যক।
গান্ধীরচনার ভিতর একটি মূল গ্রন্থ ‘হিন্দ স্বরাজ’। এই গ্রন্থটিতে তিনি ব্রিটিশ পালামেন্ট সম্বন্ধে দু’টি মর্মান্তিক শব্দ উচ্চারণ করেছেন, বন্ধ্যা ও বারাঙ্গনা। এই শব্দ দুটি সহ ‘হিন্দ স্বরাজ’ প্রকাশিত হয়। এ ব্যাপারে তিনি পরে কখনো মতপরিবর্তন করা প্রয়োজন মনে করেননি, যদিও দ্বিতীয় শব্দটি তিনি প্রত্যাহার করতে রাজী হয়েছিলেন সৌজন্যের খাতিরে। যাই হোক, গান্ধী কী বলতে চেয়েছিলেন সেটাই বিবেচ্য। মনে রাখতে হবে যে গান্ধী যদিও ঐ বাক্যটি প্রয়োগ করেছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সম্বন্ধে তবু যুক্তির দিক থেকে আলোচ্য সবদেশেরই সংসদীয় ব্যবস্থা।
‘বন্ধ্যা’ শব্দটি নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। পালামেন্ট অথবা সংসদে ভালোমন্দ নানারকম আইন পাশ করা হয়। আমরা হয়তো বলি, সংসদ অথবা সংবিধান অস্পৃশ্যতা অথবা পণপ্রথা তুলে দিয়েছে। অথচ কথাটা বস্তুত সত্য নয়। পণপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত যদি যথেষ্ট প্রবল না হয়, তবে আইন প্রণয়ন করলেও সেটা কার্যকর হয় না। অস্পৃশ্যতা দূর করবার জন্য প্রয়োজন নতুন সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতি তৈরি না হলে আইন দিয়ে অস্পৃশ্যতা দূর করা যায় না। সমস্ত মৌল সামাজিক পরিবর্তন সম্বন্ধেই একথা খাটে। কোনো মৌল পরিবর্তনের জননী নয় সংসদ অথবা পালামেন্ট। যে-পরিবর্তনের জন্য জনমত প্রস্তুত ও সংগঠিত, সেই পরিবর্তনই জন্মলাভ করে; নয়তো আইনকানুন নিষ্ফল। আর দেশকে কোনো শুভকর্মের জন্য প্রস্তুত করবার কাজটাও সংসদের ভিতর বৃদ্ধিলাভ করে না। সেটা ঘটে দেশময় সার্থক প্রচেষ্টার ফলে, বড় কোন সামাজিক আন্দোলনের প্রভাবে। মননশীল মানুষ, সার্থক শিল্পী, দক্ষ সংগঠক, নিঃস্বার্থ কর্মী, এদের সকলেরই তাতে অবদান থাকে। এরাই প্রকৃতপক্ষে নতুনের জন্মদাতা। যেখানে এই বৃহত্তর শক্তি উপস্থিত সেখানেই কিছু ঘটে। শুধু সংসদের শক্তিতে বিশেষ কিছু সৃষ্টি হয় না। গান্ধীর দৃষ্টিতে বিবেকী ব্যক্তি এবং জাগ্রত লোকশক্তিই প্রকৃত স্রষ্টা।
এর পর আসছে ‘বারাঙ্গনা’ শব্দটি। ভোটে জয়লাভ করে যখন যে-দল আসে, সংসদ অথবা পার্লামেন্ট তখন তারই প্রভুত্ব মেনে নেয়। অথচ এই জয়লাভ সম্পূর্ণ নৈতিক উপায়ে ঘটে না। এর পিছনে থাকে টাকার খেলা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, আরো নানা দুর্নীতি। অবশ্য জনমত একান্তভাবে টাকার বাধ্য অথবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত, এমন কথা বলা ঠিক হবে না। শাসক দলও তো পরাজিত হয়, বিরোধী দল ভোটে জিতে ফিরে আসে ক্ষমতায়। জনগণের একটা বিচারশক্তি আছে, যাকে অবহেলা করা ভুল। কিন্তু গান্ধী যে। কথাটা ঐখানে জোরের সঙ্গে বলতে চেয়েছিলেন সেটাও সত্য, তাকে অস্বীকার করা যায় না! গান্ধী সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। শুধু সংসদ থাকলেই হল না, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয়। সব কিছুকেই অপবিত্র করে তোলে স্বার্থসর্ব ভ্ৰষ্টাচার। রাজনীতির একটা মূল ব্যাপার ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি। সংসদীয় গণতন্ত্র কিছু নিয়ম বেঁধে দেয় বটে, কিন্তু দুর্নীতি সহজে ঠেকানো যায় না। সক্রিয় সচেতন সংঘবদ্ধ জনমতের একটা ভূমিকা চাই, দুর্নীতির প্রতিরোধের জন্য শুধু সরকার অথবা সংসদের উপর নির্ভর করে থাকাটা অবাস্তব।
আধুনিক যুগের গোড়ায় মাকিয়াভেলি প্রমুখ চিন্তানায়কেরা বুঝিয়েছিলেন যে সুনীতির বাধ্যতা থেকে মুক্তি দিতে হবে রাজনীতিকে। এযুগে রাজনীতিকে গ্রাস করছে দুর্নীতি। হিংসা ও মিথ্যাচারের নগ্নরূপ আমরা দেখেছি, হিটলার ও স্তালিন থেকে শুরু করে ক্ষমতালিপু ডিকটেটরদের সর্বগ্রাসী রাজনীতিতে। সংসদীয় গণতন্ত্রে একটা ভদ্রতার মুখোশ থাকে। কিন্তু সেখানেও রাজনীতি মানেই তো কূটনীতি। তাতে কোনো নীতির বালাই নেই। মাকিয়াভেলির বিপরীত প্রান্তে দাঁড়ালেন গান্ধী। যে-রাজনীতি নীতিশূন্য, সমাজের পক্ষে তা মারাত্মক। জনগণের নামে যে রাজনীতি চলছে তাকে নীতির অধীনতা থেকে মুক্তি দিলে তাতে অবশেষে জনগণেরই অকল্যাণ।
সেই সঙ্গে আরো দুয়েকটি কথা গান্ধী অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। গান্ধী দেখেছিলেন, রাজধানী ক্ৰমে গ্রাস করে নিচ্ছে সমগ্র সমাজকে। ক্ষমতার লড়াই যে আজ সমাজের বুকের উপর অত্যাচারের মতো চেপে বসেছে তার একটা বড় কারণ হচ্ছে ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা। গ্রামসডার হাতে যথাসম্ভব ক্ষমতা ন্যস্ত করতে হবে। এই রকম গান্ধী চেয়েছিলেন। রাজ্য সরকার নয়, গ্রাম সমাজেই হবে ক্ষমতার ভিত্তি। এটা সহজ কথা নয়। কারণ গ্রামের ওপর বোঝা হয়ে চেপেছে শুধু সরকারি শাসনযন্ত্র নয়, সেই সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং দলীয় রাজনীতি। আমলা এবং ব্যবসায়ীর কর্তৃত্ব অথবা জবরদস্তির সঙ্গে গ্রামসমাজ পরিচিত অনেকদিন থেকেই। দলীয় রাজনীতির অত্যাচার বেড়ে উঠেছে সম্প্রতি। ত্রিমূর্তিতে ক্ষমতার প্রকাশ, কখন কোন মূর্তি প্রধান হবে সেটা নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর।
দলীয় রাজনীতির অবশ্য একটা আদর্শগত বক্তব্য থাকে। ক্ষমতার লড়াইটা চলে সেই আদর্শের নামে। রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর দলের কর্তৃত্ব চাই, আদর্শের রূপায়ণের জন্য এটাই বক্তব্য। ক্ষমতা দখল অথবা ক্ষমতা রক্ষাটাই কার্যত লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এটাই বাস্তব ঘটনা। ক্ষমতালাভের পথে যদি কোনো নীতি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তবে সেই নীতি বিসর্জন দেওয়া দলের কর্তব্য। দলের সভ্যের পক্ষে নীতির চেয়েও দল বড়। যাতেই দলের স্বার্থরক্ষা হয় সেটাই শ্রেয়। দলের শেষ লক্ষ্য নয় গ্রামস্থ ক্ষমতা, রাষ্ট্রিক ক্ষমতাই লক্ষ্য। বিভিন্ন দলের আসল লড়াইটা রাজধানীতে। সেই লড়াইয়ে জেতার জন্য গ্রামের উপর কর্তৃত্বটাও জরুরী। এমনি করে উঁচু মহলের রাজনীতির কলহ এসে ধাক্কা দেয় গ্রামের সমাজে। সুস্থ গ্রামীণ জীবনের পক্ষে সেটা একটা বড় বিঘ্ন।
পল্লীজীবন আজ জীর্ণ অজস্র দৈন্যে ও অশিক্ষায়। গ্রামীণ সমাজ ব্যাধিমুক্ত নয়। এর ভিতরে আছে বহু বিরোধ এবং অবিচার। তার সঙ্গে যখন দলীয় রাজনীতির মারফৎ আরো একটা বাইরের জটিলতা এসে যুক্ত হয় তখন অবস্থা আরো কঠিন হয়ে ওঠে। তবু তাঁর বাঞ্ছিত সমাজের ভিত্তি হিসেবে গান্ধী বেছে নিয়েছিলেন গ্রামকেই। গান্ধীর ধারণাটা আবারও সংক্ষেপে স্মরণ করা যেতে পারে। গ্রামীণ সমাজের অভ্যন্তরে একটা আত্মীয়সমাজের আদর্শ আছে। নানা অবিচার, কুসংস্কার এবং অশিক্ষায় যতই আচ্ছন্ন হোক না কেন, তবু এটাই গ্রামসমাজের নিজস্ব আদর্শ। গান্ধী একথাই বিশ্বাস করতেন, যেমন করতেন রবীন্দ্রনাথ। গ্রামসমাজের নব সংগঠনের জন্য যে প্রচেষ্টা, তার ভিতরও ঐ আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা করা প্রয়োজন। শহরের ক্ষমতার লড়াই যখন গ্রামে এসে পৌঁছায় তখন তার সঙ্গে আসে নাগরিকতার শ্রেষ্ঠভাগ নয়, বরং তার নিকৃষ্ট ভাগ। গ্রামের। সেবা করতে যাঁরা আসবেন তাঁরা কি হবেন এবিষয়ে সচেতন? নাগরিক স্বার্থের, দলীয় দ্বন্দ্বের ও কর্তৃত্বের প্রলোভনের আবর্জনা দূরে সরিয়ে রেখে তাঁদের আসতে হবে। তবেই তাঁরা গ্রামের সেবার যোগ্য হবেন।
গান্ধী তাই জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এই কথাটাই বলে গিয়েছিলেন এক জরুরী বাতায়। তাঁর প্রস্তাব, কংগ্রেস দল ভেঙে দাও। যাঁরা গ্রামের সেবা করতে চান তারা যেন সেই কংগ্রেসের নামে সেখানে না যান, রাজধানীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে যে কংগ্রেস দল। তাঁদের যেতে হবে গ্রামে, “লোক সেবক” এই পরিচয় নিয়ে। এইখানে গান্ধী আবারও সংসদীয় গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে গেলেন। তিনি সংসদ বর্জনের ডাক দিলেন না। তাঁর প্রিয় শিষ্যগণ সংসদীয় ক্ষমতায় আরূঢ়। তিনি তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেননি। সংসদীয়গণতন্ত্রেরও প্রয়োজন আছে। সীমাবদ্ধ তবু সেই প্রয়োজন। আরো। নীচে, আরো ধীরে স্থাপিত হবে এদেশের বৃহৎ সমাজের স্থায়ী এবং প্রশস্ত ভিত্তি। স্থাপিত হবে গ্রামে। সেই সংস্থাপনের কাজ হবে কোন পথে?
নগর থেকে আমলারা যাবে গ্রামে। যাবে সেই ব্যবসায়ীরা, অর্থই যাদের দেবতা এবং প্রভু। সেই সঙ্গে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করবে দলীয় রাজনীতির সেই ধ্বজাধারীরা যাদের হৃদয়ের ভূমি থেকে যেন উথত হয়েছে বিবেক, সেখানে দেবতার আসনে দলীয় স্বার্থ। এদের দ্বারা গ্রামের সংগঠন ‘সপূর্ণ হবার নয় সেই সংগঠনের মূল কথাটাই এরা কেউ জানে না।
গোষ্ঠী এবং শ্রেণীর স্বার্থের দ্বন্দ্বকে অবলম্বন করে গঠিত হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবহার ও বিধান। তারই ফলশ্রুতি দলীয় রাজনীতি। কিন্তু পরিবার যেমন রাজনীতি দিয়ে চালিত হয় না, আদর্শ গ্রামেরও ভিত্তিভূমি হতে পারে না দলীয়তা। অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চাই–সত্যাগ্রহের পথে। বহুদলীয় ব্যবস্থা নয়, একদলীয় রাজনীতিও নয়, গান্ধীর মতাদর্শের সঙ্গে মেলে নির্দলীয় লোকনীতি’। গ্রামসমাজের যেটা আদর্শরূপ জাতিভেদ ও শ্রেণীবিরোধ থেকে মুক্ত, আত্মীয়-ও-বান্ধব সমাজ তাকে সৃষ্টি করা যাবে না, বৃহত্তর মানবসমাজের ভিত্তিতে তাকে সংস্থাপন করা সম্ভব হবে না দলীয়তার পথে। সত্যাগ্রহীর শেষ অবলম্বন নয় কোনো বিশেষ দল। তাঁর অন্তিম আনুগত্য নিবদ্ধ নিজস্ব বিবেকে এবং মানুষের প্রতি বিশ্বাসে।
এইখানে গান্ধী সংসদীয় গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে গেলেন। রেখে গেলেন ভবিষ্যতের সমাজের অন্য এক চিত্র। ভবিষ্যতের মানুষকে ডাক দিয়ে গেলেন, অন্য এক পথে। এটাই গান্ধীমার্গ। আজকের রাজনীতিবিদ বলবেন অসম্ভব, এ অসম্ভব। গান্ধী বলবেন, এ ছাড়া সমাজের মুক্তি অসম্ভব।
গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৬)