মুরগির চাষ – মুশতাক আহমদ ইউসুফি
বললাম, ‘যাই বলুন-না কেন, বাড়িতে মুরগি পালার পক্ষপাতী আমি নই। আমার মতে, মুরগির স্থান কেবল পেটে আর প্লেটে
তিনি বললেন, ‘পেট আর প্লেটের শোভা বর্ধনের জন্যেই তো মুরগি পালা দরকার, ভায়া। তাই তো বলতে এসেছি, কয়েকটা মোরগ-মুরগি পাঠিয়ে দিই তোমার বাড়িতে।’ এই বলে তিনি মুরগি পোষার ফজিলত বয়ান করতে লাগলেন।
আমি অনেক বোঝালাম যে, ক্রমে ক্রমে মুরগির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে আর উৎপাত বাড়বে। আমি হলাম গিয়ে নিরিবিলি প্রকৃতির লোক। এসব ঝঞ্ঝাট সইবে না আমার ধাতে।
তিনি তখন আরম্ভ করলেন, ‘মুরগি সবসময়ই দরকার। ঘরে দু-চারটে মুরগি থাকলে পয়সা বাঁচে। অসময়ে মেহমান এলে বাজারে দৌড়াতে হয় না। তাছাড়া মুরগির ফজিলত শুধু মুরগির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ডিমের কথাই ধর। আমি বলব, ডিম হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। যতক্ষণ তাজা রয়েছে, নিজে খাও, বাচ্চাদের খাওয়াও। তারপরও যদি শেষ না হয়, পচতে দাও। পচলেও ডিমের দাম কম নয়। হোটেলে কিংবা মিটিং ভাঙার জন্যে সাপ্লাই দাও। তাছাড়া, তোমার গিন্নির রান্নায় যেমন হাত– মাশেআল্লা, তিনি তোমাকে ডিম খাওয়াতে গিয়ে কত কিসিমের মারফতি আর কেরামতি যে দেখাবেন, তা তুমি গুনেই শেষ করতে পারবে না। অলেট, পোচ, হাফ-ফ্রাই, খাগ্নি, বানি, কানি, হালুয়া, মোগলাই পরাটা, ডিম-টোস্ট…’
বাধা না দিলে হয়তো এই তালিকা সারাদিনেও ফুরোেত না। বললাম, ‘আপনার কথা না-হয় মেনেই নিলাম যে, ডিমের মতো খাদ্য সারা দুনিয়াতে নেই। কিন্তু মুরগি আমরা যদি একবার খেতে ধরি, তাহলে দরমাকে-দরমা সাবাড় হতে লাগবে তো মাত্র কয়েকদিন। ডিম আসবে কোত্থেকে!’
‘বলো কী ভায়া!’ অবাক হয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করলেন তিনি। ‘মুরগির বংশ কি কখনো ধ্বংস হতে পারে! এই যে সারা দেশে এত রানীক্ষেতের মহামারী। হাজার হাজার লাখ লাখ মুরগি মরে গেল। কিন্তু বাজারে মুরগির কোনোদিন কম্তি দেখেছ? আর, তুমি বলছ কিনা, খেয়েই সাবাড় করবে! দেখ ভায়া, মুরগির বেলায় যোগের অঙ্ক অন্যরকম। দুই-এ দুই-এ চার হয় না– হয় চল্লিশ। বিশ্বাস-না হয়, নিজেই হিসাব করে দেখে লও। ধর, দশটা মুরগি দিয়ে শুরু করলে। ধর, দশটার মধ্যে নয়টাই বাঁজা– একটাতে ডিম দেয়। ভালো জাতের একটা মুরগি বছরে ডিম দেয় দুশো থেকে আড়াইশো। কিন্তু তুমি যেহেতু কনজারভেটিভ লোক, সেহেতু ধরে নিলাম, তোমার মুরগিও কনজারভেটিভ হারে ডিম দিচ্ছে বছরে দেড়শো।’
মাঝপথে বাধা দিয়ে বললাম, ‘আমার কনজারভেটিভ হওয়ার সঙ্গে মুরগির ডিম কম বা বেশি দেওয়ার সম্পর্কটা ঠিক বুঝলাম না।
‘ভায়া, তুমি দেখছি সব কথাতেই ভড়কে যাচ্ছে। বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কম করে ধরলেও মুরগির বংশ কখনো ধ্বংস হয় না। তা বছরে যদি দেড়শো ডিম হয়, তাহলে পরের বছর সেই ডিম থেকে যে মুরগি বেরুবে, তারা পাড়বে বাইশ হাজার পাঁচশো ডিম তৃতীয় বছরে, এইরকম হিসাব করলে দেখতে পাবে, তেত্রিশ লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার মুরগিশাবক তোমার বাড়িটাকে গুলজার করে রেখেছে। এ তো একদম সোজা হিসাব।’
‘তা যেন বুঝলাম। কিন্তু এত মুরগি-শাবককে যদি ঠিকমতো খেতে দিতে হয়, তাহলে আমার নিজের শাবকরাই যে না-খেতে পেয়ে মরবে।’
বললেন, ‘কথায় বলে, রুজির মালিক আল্লাতালা। কিন্তু সেটা হচ্ছে মানুষের বেলায়। মুরগি আর মোল্লার বেলায় রুজির চিন্তা খোদ আল্লাতালাকেও করতে হয় না। এঁরা দুজন যার যার খাদ্য নিজেরাই খুঁজে নেন। তুমি একবার পেলেই দেখ না, ভায়া। দেখবে ঘাস্-বিচালি, পোকা-মাকড়, তরকারির খোসা, রুটির কণা, এঁটো-কাঁটা, কাঁকর, পাথর– এইসব খেয়েই ওরা বেঁচে থাকবে।’
জানতে চাইলাম, ‘মুরগি পালা যদি এতই সহজ আর লাভজনক হয়, তাহলে আপনি নিজের মুরগি আমাকে দিতে চাচ্ছেন কেন?
‘তা এতক্ষণ এতকথা বলিয়ে না নিয়ে প্রথমেই এই প্রশ্নটা করলে না কেন ভায়া? তুমি তো জানোই, আমার বাড়িটা কত ছোট। সেই বাড়ির অর্ধেকে থাকি আমরা, আর অর্ধেক জুড়ে থাকে আমার মুরগিরা। এখন মুশকিল দেখা দিয়েছে একটা। কালকে আমার শ্বশুরবাড়ির কিছু আত্মীয়-কুটুম আসছেন ছুটি কাটাতে।
সুতরাং, পরের দিন তাঁর বাড়িতে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-কুটুমের আর আমার বাড়িতে মুরগির আড্ডা বসল।
মানুষ ভালোবাসার কাঙাল। এইজন্য মানুষ কেবল মানুষকে নয়– জীব-জন্তু, পশু-পক্ষীকেও ভালোবাসে। এই ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ আমরা জীব-জন্তু, পশু-পক্ষী পুষি। ছোট্ট একটি টিয়াপাখি থেকে শুরু করে বিরাট একটা হাতি পর্যন্ত সবাইকেই বশ মানানো যায়, তাদের দিয়ে হুকুম তামিল করানো যায়। মাঝখানে রয়েছে ঘোড়া আর কুকুর– তাদের প্রভুভক্তির কথা সর্বজনবিদিত। ঘোড়া মনিবকে দেখলে হেষা রব তুলে পিঠ পেতে দেয় চড়ার জন্যে। কুকুর যখন পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে লেজ নাড়ে, তখন মালিকের মনে যে অনাবিল আনন্দের উদ্রেক হয়, সে আনন্দ ভাষায় ধরে রাখা শক্ত। সাপ যে সাপ, সে-ও সাপুড়ের নির্দেশে ফণা নামিয়ে নেয়। কিন্তু মুরগির বেলায় আজ পর্যন্ত এমন কখনো দেখা যায়নি যে, কোনো মুরগি মোরগ ছাড়া অন্য কাউকে চেনে। মোরগের বেলায়ও সেইকথা সত্য।
মোরগ-মুরগিকে যতই আপনি আদর করুন, হাতে ধরে ধরে খাওয়ান-না কেন, কিছুতেই পোষ মানাতে পারবেন না, তাদের দিয়ে লেজ নাড়াতে পারবেন না। অবশ্য আমার বলার উদ্দেশ্য আদৌ এ নয় যে, পেলেছি বলেই আমার মোরগ সেই ভেল্কির বানরের মতো তোপ দেগে আমাকে সালাম ঠুকে যাক কিংবা আমার মুরগি ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাছে এসে আমার হাতের উপর একটা ডিম পেড়ে দিয়ে পাছা দোলাতে দোলাতে চলে যাক। কিন্তু কথা নেই, বার্তা নেই, চক্চকে কোনো জিনিস দেখলেই কট্ট্-কটাশ্ রব তুলে গোটা বাড়ি মাথায় তোলার তো কোনো মানে হয় না। স্বীকার করছি, কেবল ছুরি দেখলে তাদের সে-রকম করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কিন্তু যা চক্চক্ করে, তাই যে ছুরি নয়— সে-কথা তারা কবে শিখবে?
আমার ছেলে-মেয়েরা তবু পোষ মানাবার চেষ্টার ত্রুটি করল না। টুনটুনি, ঝুনঝুরি, ফুলঝুরি, চুনচুনি, ফুলপরী– এইসব আদরের মিষ্টি-মিষ্টি নাম রাখল মুরগিদের। আর, মোরগের নাম রাখা হল পুরনো যত বিখ্যাত নেতা আর আমাদের নিজেদের পূর্বপুরুষদের নামে। এতে কবরের তলা থেকে তাঁরা প্রতিবাদ করে উঠলেন কিনা, জানা গেল না; তবে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মির্জা আবদুল ওদুদ বেগ বললেন, ‘মোরগদের নিয়ে এ কিন্তু বাড়াবাড়ি।
মুরগি তবু একটা থেকে আর একটা চেনা যায়। কিন্তু মোরগের বেলায় একটা থেকে আর একটাকে স্বতন্ত্র করে দেখা আজ পর্যন্ত আমার দ্বারা হয়ে উঠল না। সব মোরগকেই আমার এক বলে মনে হয়। তাদের চলা-ফেরা, আদব-কায়দা, মুখের বুলি– সবই এক! আমার পঞ্চেন্দ্রিয়ের ক্ষমতার অভাব অবশ্য সেজন্য দায়ী হতে পারে।
সাধারণভাবে শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এবং বিশেষভাবে উর্দু কবিদের মধ্যে একটা সর্বব্যাপী ধারণা রয়েছে যে, প্রত্যূষে মোরগ আর মোল্লার আজানের উৎপত্তিগত ও ব্যুৎপত্তিগত কারণ একই। আঠারো মাস এই কারণ নিয়ে আমি গবেষণা চালিয়েছি। তাতে দেখা গেছে, আমার ঘুম যখন সবচাইতে গভীর, ঠিক তেমনি সময়ে আমাদের মোরগ আজান দেয়। আমার অভ্যাস এবং আমাদের মোরগের স্বভাব–এ দুটোর কোনোটারই পরিবর্তন হয়নি আজ পর্যন্ত। যাই হোক, রবিবারে অনেক বেলা অবধি ঘুমিয়ে থাকার যে সপ্তাহান্তিক আনন্দ, মুরগি পালার পর থেকে সে আনন্দ আমার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে গেছে। বিশেষত আমাদের মোরগের সকালবেলাকার আজান এতই সময়নিষ্ঠ আর গগন-বিদারী যে, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও কেউ সহসা কোনোদিনও আর অ্যালার্ম ঘড়ি কেনার প্রয়োজন বোধ করবেন না।
সত্যি, কোনো কোনো মোরগের আজান এতই হেঁড়ে-ধরনের যে, তা শুনে কবর থেকে কাফন ছিঁড়ে মরা মানুষের আবার বেঁচে ওঠার কথা। আমার কথা অতিশয়োক্তি বলে মনে করবেন না। দেহের আয়তনের তুলনায় এই ধ্বনির আনুপাতিক হার কত হতে পারে আপনিও তা একবার অঙ্ক কষে দেখতে পারেন। আমার মতে, ঘোড়ার হেষা রবের তুলনায় মোরগের আজানধ্বনি একশো গুণ বেশি শক্তিশালী। আল্লাতালা যদি আনুপাতিক হারে ঘোড়ার গলায় এই শক্তি দিতেন, তাহলে প্রাচীনকালের যুদ্ধে প্রয়োজন দেখা দিত না তোপধ্বনি করে শত্রু-পক্ষকে ঘায়েল করার। ঘোড়াকে দিয়েই সে কাজ অনায়াসে সমাধা করা যেত।
একদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি তখন কাজ থেকে ফিরছিলাম। বাড়ির পৈঠায় পা দিতে দিতে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকে দেখি, আমার সাদা ধপধপে বিছানার উপর তিনটে মোরগ-মুরগি ঠোঁট দিয়ে দেহের পরিচর্যা করছে। সাদা চাদরের সর্বত্র ময়লা মাখা পায়ের ছাপ। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গিন্নিকে বললাম, ‘তুমি থাকতে এই কাণ্ডটা হল, আর তুমি কিছু বললে না?’
গিন্নি নাক ঝাপ্টা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমাকে কি মুরগির পাহারাদার ঠাওরেছ?’
‘ও, তাহলে দোষটা আমারই, তাই না?’
গিন্নি এবারে একটু শান্ত হলেন। বললেন, ‘আমি রান্নাঘরে ছিলাম, দেখিনি। বাড়িতে মুরগি থাকলে ওরকম এক-আধটু হয়ই। এত চিৎকার করার কী আছে? তুমি আজকাল মুরগি দেখলেই অ্যালার্জিক হয়ে ওঠ।’
এইকথা শুনে আমার আর মুখ থেকে রা সরল না। মুরগির প্রতিও যে মানুষের মনে অ্যালার্জি বাসা বাঁধতে পারে, সেই অদ্ভুত আবিষ্কার নিয়ে মনের মধ্যে আন্দোলন চলছে, এমন সময় আরো একটা নতুন জিনিস আবিষ্কৃত হল। আমার সাদা ধপধপে বিছানায় শুধু যে মুরগির পায়ের ছাপ পড়েছিল, তাই নয়– তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আরো একটা জিনিস তারা ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাপার হচ্ছে, মুরগিকে আপনি ডালের কণা না-খাইয়ে যদি সোনা-দানা, মণি-মুক্তোর কণাও খাওয়ান, তবু সে সুযোগ পেলেই পোকা-মাকড়, আরশুলা, মাকড়সা, কেঁচো, পিঁপড়ে, ময়লা, নোংরা, আবর্জনা খাবেই। এইভাবে মুরগি যাই খাক-না কেন, তা হজম হওয়ার পর যে জিনিস সে নির্গত করবে, সর্বক্ষেত্রে তা বড়ই অসহ্য। সেইরকম অসহনীয় বস্তু সেদিন আমার বিছানায় যত্রতত্র, যথেচ্ছভাবে খালাস করা হয়েছে।
আমার মনের কোণায় তখন এই চিন্তা সুড়সুড়ি কাটতে লাগল যে, মুরগির থাকবার জন্য চমৎকার করে দরমা বানিয়ে দিয়েছি, পলই কিনে এনেছি– তা সত্ত্বেও মানুষের শয়নাগারে বা শয্যায় কেন মুরগি আসবে? এই নিয়ে পুরো দেড় বছর গবেষণা চালিয়ে আবিষ্কার করা গেল যে, মুরগি কখনো দরমায় বা পলই-এ থাকে না। এই দুই জায়গায় ছাড়া সর্বত্র আমি মুরগি দেখেছি কিংবা দেখেছি মুরগির ছেড়ে যাওয়া অভ্রান্ত নিদর্শন। এমনকি, ডিম পাড়ার সময়েও তারা দরমায় যায় না। হয় বাথরুমে, না হয় আলনায় চেপে ডিম পেড়ে দেয়। গ্রীষ্মকালে তুলে রাখা লেপ কাঁথার স্তূপ থেকে কুড়ুক-পড়া মুরগি বের হতে আর দরমার ভেতর থেকে দাড়ি-কাটার পেয়ালা বের হতে আমি প্রত্যেক দিন দেখেছি। তাছাড়া, একদিন টেলিফোন বেজে উঠল, আমি রিসিভার তুললাম, কিন্তু ‘হ্যালো’ বলতে পারার আগেই পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে একটা মোরগ বিকট গলায় আজান দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তারের অন্য প্রান্ত থেকে শব্দ ভেসে এল, ‘সরি, রং নাম্বার।’ এই কথা বলেই, যিনি অনুগ্রহ করে আমাকে স্মরণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি রিসিভার রেখে দিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার আর কথা বলা হল না।
একদিন কাজের থেকে ফিরে দেখি, ইলাহি কাণ্ড। গোটা পাড়ার ছেলেপুলে একত্র হয়েছে। আর, তাদের মাথার উপর অসংখ্য চিল-কাক উড়ে বেড়াচ্ছে। কী ব্যাপার! না, আমাদের ল্যাংড়া মোরগটা ইন্তেকাল করেছে। আমার নতুন ক্যারম বোর্ডের উপর লাশ শুইয়ে রাখা হয়েছে। শব-শোভাযাত্রার পুরোভাগে রয়েছে বড় বড় ছেলে, আর পেছনে ছোটরা। চারজন-চারজন করে কাঁধ বলাবলি করে লাশ নিয়ে যাচ্ছে দাফন করতে। একেবারে পেছনে রয়েছে যারা, তাদের মধ্যে দু-একজন ভালো করে হাঁটতেও শেখেনি। তারা কান্না জুড়ে দিয়েছে এই বলে যে, বড়রা তাদের লাশ বইবার সুযোগ দিচ্ছে না।
এর কয়েকদিন পরে চোখ দুটোকে অবাক করে দিল অন্য এক ঘটনা। আমার ছেলেরা পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে শিন্নি বিলোচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, শাহ্-রুখ নামের মোরগটা আজ প্রথম আজান দিয়েছে। এইরকম বাজে কাজে পয়সা নষ্ট করার জন্য আমি যখন খেদ প্রকাশ করছিলাম, তখন এই বলে আমার খেদ দূর করা হল যে, শিন্নি বিলোনোর জন্যে কোনো কাঁচা পয়সা খরচ করা হয়নি– দশ বছর ধরে বেকার পড়ে-থাকা আমার সার্টিফিকেট আর, আমার প্রথম উপন্যাসের মরচে ধরে-যাওয়া পাণ্ডুলিপি মোটা দামে সের-দরে বিক্রি করে সেই পয়সা দিয়ে এই উৎসব উদযাপন করা হচ্ছে।
আমার গোটা বাড়িটা এখন একটা প্রথম শ্রেণির পোলট্রি ফার্ম। তবে পার্থক্য এটুকুই যে, পোলট্রি ফার্মে কেবল হাঁস-মুরগির চাষ হয়, আর আমার ফার্মে সেই সঙ্গে মানুষের চাষও অব্যাহত রয়েছে।
এই পোল্ট্রি ফার্মের তদারকি করতে গিয়ে সঞ্চিত আমার অভিজ্ঞতার ফসল অফুরন্ত। একদিনে এক বৈঠকে বসে তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে, যাঁরা দুনিয়াদারির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মায়া ত্যাগ করে পারলৌকিক ও পারমার্থিক চিন্তায় নিমগ্ন হওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁদের জন্য আমার আপাতত কেবল এই পরামর্শটুকু দেওয়ার রয়েছে যে, তাঁরা মুরগি পালুন। তাহলে তাঁদের জীবনে এমন সব আধিভৌতিক কাণ্ড ঘটবে আর এমন সব বিচিত্র বিদ্ঘুটে সমস্যা, কোলাহল, কলহ ব্যাঙের ছাতার মতো আপনাআপনি গজিয়ে উঠবে যে, তাঁরা সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হবেন এবং লালায়িত হয়ে উঠবেন পূর্বের সাদা-সিধে, হাসি-কান্নার, সুখ-দুঃখের জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য।
নতুন এক জ্বালাময়ী সমস্যার সৃষ্টি হল মোরগে-মোরগে লড়াইয়ের ব্যাপার নিয়ে। প্রথম প্রথম মোরগের সংখ্যা যখন কম ছিল, তখন ছেলেরা মোরগ-লড়াই দেখার জন্য নানাভাবে কসরত করেছে। দুই মোরগের গলায় ঘণ্টি বেঁধে দিয়ে ধরে ধরে সামনাসামনি ঠোকাঠুকি করিয়েছে, কিন্তু অনিচ্ছুক মোরগদের দিয়ে লড়াই বাধানো যায়নি। আর এখন, এই লড়াই অহরহ হচ্ছে। একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। কিন্তু এই রক্তারক্তি কাণ্ড যদি কেবল নিজের বাড়ির মোরগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে ও কথা ছিল। তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ার অন্যান্য মোরগের মধ্যেও। আমার মোরগরা সারাদিন যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থেকে সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোর ব্যবস্থা সম্পন্ন করে অন্য মোরগঅলাদের।
মোরগের লড়াই কেবল মোরগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না। দু-একটা মোরগ মানুষের উপরও আক্রমণ চালাতে লাগল। এই অভিযোগ প্রথম প্রথম আমার বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু অবিরাম পথচারীদের নালিশ শুনতে শুনতে কান যখন আমার ঝালাপালা, তখন নিজেই একদিন এক মোরগের আমি শিকার হলাম। মির্জা আবদুল ওদুদ বেগ এই ঘটনা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না। বললেন, ‘কই, আমার উপরে তো কোনো মোরগ কোনোদিন ঝাপ্টা মারেনি!’ শুনে আমি মানুষ-সমান এক আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। দেশে কিছুতেই মনে হল না, আমাকে দেখে কোনো শান্তিপ্রিয় জীবের চোখ রক্তবর্ণ হওয়া উচিত।
যাই হোক, আমার মোরগদের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ যখন একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গেল, জীবন হয়ে পড়ল অতিষ্ঠ, তখন এক মুরগি-বিশারদের কাছে গিয়ে পরামর্শ চাইলাম। তিনি আমাকে শুধু পরামর্শ নয়– অনেক জ্ঞানও দিলেন। বললেন, ‘মোরগ-মুরগির জাতটা প্রাকৃতিকভাবে শান্তিপ্রিয়। চিল বা বাজপাখির জাত আর মোরগ-মুরগির জাত এক প্রজাতিভুক্ত নয়। প্রথমটা সুবিধাবাদী, স্বার্থপর, হিংসাপরায়ণ; কিন্তু দ্বিতীয়টা শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী, সেবাপরায়ণ। ‘
এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেক্চার শুনতে হয়তো আমার বিশেষ খারাপ লাগছিল না। কিন্তু আমার নিজের মোরগের স্বভাবের ব্যাপার নিয়ে আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। কাজেই তাঁকে বাধা দিতে হল এবং আমার আগমনের কারণটা তাঁকে মনে পড়িয়ে দিতে হল।
বললেন, ‘দেখুন, আপনার মোরগ ঝগড়াটে মাত্র একটা কারণেই হয়ে থাকতে পারে। এই মোরগকে এঁটো মাংস খাওয়ানো হয়েছে।
সূত্র পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ালাম বাড়ির দিকে। গিন্নির কাছে তা ব্যক্ত করলাম। শুনে তিনি একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, ‘বুড়ো বয়েসে তোমার ভিমরতি ধরেছে। একটা ভালো ডাক্তারের কাছে না-গিয়ে গিয়েছিলে কোন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে। বলি, আমরা কি এতই অপবিত্র হয়ে গেছি যে, আমাদের এঁটো খেলে মুরগির অসুখ করবে!
মুরগি পালবার আগে খুব কম লোকেই আমাকে চিনত। কারণ, বাইরে কাজে যাই, আর কাজ ফুরোলে বাসায় ফিরে লেখা-পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সুতরাং স্বল্প-সংখ্যক যে কয়জন আমাকে চিনতেন, তাঁরা কোণাই-চণ্ডি হিসেবেই চিনতেন। কিন্তু মুরগি পুষবার পর থেকে আমার পরিচয় সর্বব্যাপী হয়ে গেল। এখন কোনো নতুন লোক আমার খোঁজে এলে পাড়ার বাচ্চারাও সহজে আমাকে চিনিয়ে দিতে পারে। বলে, ‘ও, মুরগি-সাহেবকে চান? ওই যে ওইখানে লাল বাড়িটার পাশে মুরগি সাহেব থাকেন।
শুধু তাই নয়– আমাদের পাড়ার কেউ যখন কোনো নিজের লোককে ঠিকানা বোঝাবার চেষ্টা করেন, তখন তা ব্যক্ত করেন এই ভাষায়, ‘ওখানে গিয়ে যে-কাউকে জিগ্যেস করবেন, মুরগি সাহেবের বাড়ি কোনটা। তারপর পশ্চিমের দুটো বাড়ি ছেড়ে ডাইনে ঘুরলেই আমাকে পাবেন। মুরগি সাহেব নামটা মনে রাখবেন কিন্তু।’
যাই হোক, ঝগড়া-প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসা যাক। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, পাড়ার তাবৎ লোক আমার কাছেই আসে আমার মোরগ-মুরগির বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে। অথচ, এ পাড়ায় কম হোক, বেশি হোক– মুরগি তো সবাই পোষে। মামুন সাহেব সেদিন বাড়ি-চড়াও হয়ে আমাকে খুব খানিক ভালো-মন্দ শুনিয়ে গেলেন। আমার মুরগিতে নাকি তাঁর পালং শাকের ক্ষেত একেবারে ছাগলের মতো করে মুড়িয়ে দিয়ে এসেছে।
হারুন সাহেবের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। কিন্তু তাঁর কুকুর দবির সাহেবের একটা মুরগিকে চিবিয়ে রেখে এসেছে, সেজন্যও দবির সাহেব আমারই উপর চড়াও হলেন। হারুন সাহেব বাড়ি নেই, কিন্তু তাঁর বন্ধু আমি রয়েছি, কাজেই তাঁর কুকুরটাকে আমি কেন সামলে রাখিনি।
এত নির্যাতন সহ্য করার পর শেষে আল্লা-আল্লা করে আমারও একদিন দিন এল। ‘খলিল মঞ্জিলে’র খলিল সাহেব খাসি-প্রমাণ একটা লাইট-সাসেক্স মোরগ কিনে এসেছেন। কদিন ধরে তিনি এই মোরগ সবাইকে দেখিয়ে বেড়ালেন আর বলে বেড়ালেন যে, এর ঔরসে যে ডিম হবে, তা তিনি লাহোর পাঠাবেন একজিবিশনে। খলিল সাহেবের দাপট কিছুটা থিতিয়ে এলে আসল দাপট শুরু হল খোদ মোরগটার। গর্দান উঁচিয়ে সে পাড়াময় জৌলুস বিলিয়ে বেড়ায়। তার আজানের হাঁক শুনলে মুরগির বাচ্চারা ভয়ে সেঁধিয়ে যায় মায়ের ডানার তলায়। তারপর, এই মোরগের অত্যাচারে পাড়ার অন্য সব মোরগের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
খলিল সাহেবের মোরগ একদিন আমার একটা হুয়াইট লেগ্হর্নের চোখ উপড়ে ফেলল। যখন জানতে পারলাম, তখন অসময়। সারারাত মনে মনে রিহার্সাল চালালাম ঝগড়া করার। এমনকি, দুজনের মুখ থেকে যেসব সংলাপ নির্গত হবে, তা-ও প্রায় আমার মুখস্থ হয়ে গেল। তারপর, দাঁত কটমট করে সকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
খলিল সাহেবের বৈঠকখানায় গিয়ে যখন উঠলাম, তখন তিনি হাতের চেটোর উপর একটা ডিম দাঁড় করিয়ে রেখে সমবেত দর্শকমণ্ডলীর কাছে সেই ডিমের মহিমা ব্যাখ্যা করছিলেন। ডিমের প্রশংসায় তিনি এত বেশি পঞ্চমুখ যে, শুনলে মনে হবে, সে ডিম তাঁর কোনো মুরগির নয়– যেন সেটা তিনি নিজেই পেড়েছেন।
এই দৃশ্য দেখে আমার প্রস্তুতি যেন খানিকটা দুর্বল হয়ে গেল। তবু আমি নির্ভাবনায় রিহার্সাল-করা প্রথম সংলাপটা ছেড়ে দিলাম, ‘আমি মুরগি সাহেব, আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
উত্তর এল, ‘কোনো অসুবিধে নেই।’
‘কালকে আপনার মোরগ আমার মোরগের চোখ খেয়ে ফেলেছে।’
‘ধন্যবাদ। এক চোখ, না দু’চোখ?’
‘এক চোখ।’
‘ডান চোখ, না বাঁ চোখ?’
আমার মুখস্থ-করা সংলাপ কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও ডান চোখ, না বাঁ চোখ, তা মনে করতে পারলাম না। শেষে বললাম, ‘ডান হোক, বাঁ হোক– তাকে কী এসে যায়!’
‘বলেন কী, মুরগি-সাহেব! আপনার কাছে ডান আর বাঁয়ে কোনো পার্থক্য নেই!’
‘কিন্তু আপনার মোরগে যা করেছে, সেটা অন্যায়।’
‘নিশ্চয় অন্যায়। কিন্তু আপনার পর্দানশীন মোরগের বাইরে বেরুনোটা আরো বেশি অন্যায়।’!
‘আপনার মোরগটা বোধহয় রাজহংস?’
‘দেখুন, আপনি আমাকে যা-খুশি বলুন; কিন্তু আমার মোরগকে কিছু বলবেন না। আমার মোরগ রাজহংসই যদি না-হবে তাহলে অমন রাজার মতো শান-শওকত নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কেন, বলুন দেখি! আর, আপনার মোরগই-বা কেন আসবে আমার মোরগের কাছে!’
‘মানুষ তো আর নয় যে, ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখবে নিজেকে।’
‘আপনি যদি আপনার সুলোচনকে বেঁধে রাখতে না-পারেন, তাহলে আমিই-বা কেমন করে তার ঠোঁটে ঠুলি লাগিয়ে রাখি, বলুন!’
সুতরাং যে-রাগ নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই রাগ নিয়েই ফিরে আসতে হল আমাকে। কোনো লাভ হল না। লাভের মধ্যে আমার আরো খানিক মূল্যবান সময় নষ্ট হল।
মহামারি আকারে কত রানীক্ষেত এল, কত মুরগি কুকুরে খেয়ে ফেলল, কত লোপাট করল প্রতিবেশীরা, কিন্তু মুরগির যে বীজ একদিন আমার সেই সদাশয় আত্মীয় বপন করে দিয়ে গিয়েছিলেন, তার গাছ, ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা, পত্র, পল্লব, পুষ্প যেন অমর। এ বংশ কিছুতেই ধ্বংস করা গেল না।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির